মুজনাই সাহিত্য সংস্থা
রেজিস্ট্রেশন নম্বর- S0008775 OF 2019-2020
হসপিটাল রোড
কোচবিহার
৭৩৬১০১
ইমেল- mujnaisahityopotrika@gmail.com (মাসিক অনলাইন)
- mujnaiweekly@gmail.com (সাপ্তাহিক)
প্রকাশক- রীনা সাহা
সম্পাদনা, অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায়
প্রচ্ছদ- শৌভিক কার্যী
মুজনাই অনলাইন আশ্বিন সংখ্যা
সূচি
ডঃ ইন্দ্রাণী বন্দোপাধ্যায়, পার্থ বন্দোপাধ্যায়, চিত্রা পাল, শ্যামলেন্দ্র চক্রবর্তী, নির্মাল্য ঘোষ, পার্থ সারথি চক্রবর্তী, শ্রাবণী সেনগুপ্ত, স্বপন কুমার দত্ত, কবিতা বণিক, শ্রাবণী সেন, তমালী দাস, রীনা মজুমদার, জয়িতা সরকার, চম্পা বিশ্বাস, শিউলি রায়, মৌসুমী চৌধুরী, মিঠু অধিকারী, অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী, রীতা মোদক, পারিজাত প্রীত, রেবা সরকার, অপর্ণা বসু, প্রদীপ চৌধুরী, চন্দ্রানী চৌধুরী, অমিতাভ সরকার, অলকানন্দা দে, অদিতি মুখার্জি সেনগুপ্ত, বিজয় বর্মণ, মুনমুন সরকার, সুনন্দ মন্ডল, শতাব্দী সাহা, অভিমূন্য, মজনু মিয়া, সুদীপ দাস, বুলবুল দে, মহাজিস মণ্ডল, বিপ্লব গোস্বামী, দেবর্ষি সরকার, রূপক রায়, আকাশলীনা ঢোল, প্রিয়াংশু নন্দী, দেবাঞ্জনা রুদ্র, দেবোদয় গুহ রায়, অনুস্মিতা বিশ্বাস, অদ্রিজা বোস, তানভী দাম, অভ্রদীপ ঘোষ
মুজনাই অনলাইন আশ্বিন সংখ্যা ১৪২৮
।। পুজো প্রবন্ধ ।।
বঙ্গে দুর্গোৎসব : বাবু সংস্কৃতি ও বারোয়ারি পুজোর পরম্পরা
ডঃ ইন্দ্রাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
এক বিশেষ ধর্মীয় -সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে ষোড়শ শতকের মধ্য ভাগে বঙ্গে দুর্গোৎসব শুরু হয়েছিল। এই সময় কোন সম্প্রদায়ই তাঁদের নিজস্ব রক্ষণশীলতার পরিসর থেকে মুক্ত হতে পারে নি। বিদগ্ধ সমালোচকরা মুক্ত কণ্ঠে বলেছেন যে হিন্দুদের স্বকীয়তা রক্ষার দাবি কে কেন্দ্র করেই সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে বেশ কয়েক টি পারিবারিক দুর্গোৎসব প্রচলিত হয়েছিল। আর এসব পারিবারিক দুর্গোৎসবে ইংরেজ কর্মচারীদের সাদর আমন্ত্রণ ও তাদের উপস্থিতি এই পূজায় তাদের সক্রিয় সমর্থনের ই প্রমাণ দেয়। প্রথম
দুর্গোৎসবের প্রতিষ্ঠাতা মহারাজা কংস নারায়ণ রায়।
(১৫৮০ খ্রিস্টাব্দে)। তারপর আনুমানিক ১৬০৬ খ্রিস্টাব্দে নদিয়ার মহারাজা কৢষ্ণচন্দ্র রায়ের পূর্বপুরুষ ভবানন্দ মজুমদার দুর্গাপুজো করেছিলেন এরকম জনশ্রুতি থাকলেও এ বিষয়ে বিশেষ কোনো প্রামাণ্য পাওয়া যায় না। ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে প্রথম দুর্গাপুজো অনুষ্ঠিত হয়েছিল কলকাতার সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারে ।পুজোর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন লক্ষ্মীকান্ত মজুমদার। এই মতটি সর্বজনস্বীকৢত। এই পরিবার থেকে ই গোবিন্দ পুর, সুতানুটি ও কলিকাতা গ্রামের ইজারা নিয়ে বাংলায় বানিজ্য সনদ লাভ করেছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। এই সূত্র ধরেই বলা যায় সপ্তদশ শতকের শুরুতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হবার পর ও বিশেষত অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি একদিকে নতুন জমিদার তালুকদার শ্রেণী অপরদিকে ইংরেজের তাঁবেদার দালাল ও দেওয়ান দের নিয়ে গড়ে উঠল বাবু শ্রেণী, তাদের বিচিত্র বিলাস বহুল আচার আচরণের নাম হল বাবু সংস্কৃতি বা জেন্টু কালচার। বাবু নবাবের দেওয়া উপাধি হলে ও নব্য ধনী উশৃঙ্খল সম্প্রদায় নিজেরা নিজেদের কে বাবু নামে ঘোষণা করল। এই হঠাৎ ধনী হওয়া বাঙালি বাবুরা যারা চরম বিলাসিতার স্রোতে গা ভাসিয়ে ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম নদীয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় (১৭১০-১৭৮২) ও শোভাবাজারের তালুকদার রাজা নবকৃষ্ণ দেব। তবে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র গুণী মানুষ ছিলেন। তিনি পন্ডিত দের পৃষ্ঠ পোষকতা করতেন। রাজসভায় পন্ডিত দের খুব সম্মান ছিল। তিনি বাংলায় একাধিক পূজা পার্বণের প্রবর্তক। কথিত আছে যে তিনি খুব জাঁকজমক সহকারে দুর্গা পুজো করতেন ও অন্য ভূস্বামীদের এই পুজোর নির্দেশ দিয়েছিলেন।
এই পুজোয় কৃষ্ণনগরের রাজবাড়ির ধূমধাম ছিল সকলকে অবাক করার মতই। তাঁরা প্রচুর টাকা খরচ করতেন কিন্তু ভক্তি ভাবের থেকে আমোদ প্রমোদ বিনোদনের প্রাধান্য ছিল বেশি। আষাঢ় মাসে উল্টো রথের দিন কামানের গোলা ফাটিয়ে পুজোর সূচনা করা হত। দেবী দুর্গা পুরুষের পোশাক পরে অস্ত্র নিয়ে যোদ্ধা র বেশে অর্ধেক মানুষ অর্ধেক সিংহ রূপী বাহনের উপর দাঁড়িয়ে থাকতেন। ১০৮ মণ মাটি দিয়ে ঠাকুর তৈরি হত, সপ্তমী র দিন ১০৮ টি ঢাকের বাদ্য দিয়ে পুজো শুরু হত। পুজোর জন্য লাগত ১০৮ টি পদ্ম , ১০৮ টি পাঁঠাবলি হত আর ১০৮ গাড়ি নিয়ে বিসর্জন দেওয়া হত। তিনিই প্রথম পুজো উপলক্ষে বাঈজী নাচের আয়োজন করেছিলেন। আসলে সেই সময় দুর্গা পুজো পারিবারিক ঐতিহ্য ও ধনসম্পত্তির প্রাচুর্য দেখানোর মাধ্যমে পরিণত হয়েছিল।
বড় বিস্ময় লাগে যখন আমরা জানতে পারি পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের জয়ে শোভাবাজারের তালুকদার নবকৃষ্ণ দেব বিজয়োৎসব পালন করেছিলেন। আর সেই উপলক্ষে বাড়িতে দুর্গা দালান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সে বছর খুব আলো বাদ্যি সহকারে পুজো হয়েছিল। শুধু তাই নয় লর্ড ক্লাইভ কিছু টাকা ঝুড়ি ভর্তি ফল আর একটি পাঁঠা ও উপহার দেন। এই রাজবাড়িতে কামানের গোলার শব্দে শুরু হত পুজো আর ১০০১ টি পশুবলি হত। সেখানে সাধারণ মানুষের থেকে প্রাধান্য পেত ইংরেজ রাজকর্মচারীরা। বিভিন্ন ধরনের নাচ ও বিনোদনের মধ্যে দিয়ে তাদেরকে তুষ্ট করা হত। প্রসিদ্ধ গবেষক বিনয় ঘোষ ও উইলিয়াম কেরি র রচনায় এই বাবু দের দুর্গা পুজোর জাঁকজমক ও ইংরেজ তোষণের অনেক কাহিনী লিপিবদ্ধ আছে।
এ প্রসঙ্গে আরো জানা যায় রাজা রামচন্দ্র রায়, ভূ কৈলাশের দেওয়ান গোকুল চন্দ্র ঘোষাল, দেওয়ান গঙ্গা গোবিন্দ সিংহ প্রভৃতির পারিবারিক দুর্গা পুজোয় এমন বাড়াবাড়ি রকমের আমোদ আহ্লাদ হত যে তাঁদের দুর্গোৎসব কে বলা হত 'গ্র্যান্ড ফিস্ট অফ দা জেন্টুস'।
ভূস্বামী গোবিন্দ রাম মিত্রের কুমোরটুলি র পুজোর খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। তাঁরা দেবী কে রূপোর সিংহাসনে বসাতেন । ভূরিভোজ ও মদ্যপানের ব্যবস্থা থাকত, নাচের আসর ও বসত।
জোড়াসাঁকোর কয়লা ও লোহার ব্যবসায়ী শিব কৃষ্ণ দাঁ প্রতিমা কে সোনা দিয়ে মুড়ে দিতেন। দেবীর অলংকারের মুক্ত পান্না প্যারিস থেকে আনা হত এরূপ জনশ্রুতি আছে। সাহেব মেমরা এই পুজোয় গান নাচে অংশগ্রহণ করত। মহারাজা সুখময় রায়ের বাড়িতে সাহেব দের খুশি করার জন্য ইংরেজি সুরে ভারতীয় সঙ্গীত গাওয়া হত। গড সেইভ দা কিং এই রকম গানর তখন বেশ চল ছিল এরকম শোনা যায়। এভাবে দুর্গোৎসব বাবুদের ধনসম্পদ দেখানো , পান ভোজন গান নাচ ও মহিলা দের অলংকার দেখানোর উপলক্ষ মাত্র হয়ে দাঁড়ালো। ভক্তি বা আরাধনার কোন স্থান রইল না। কালী প্রসন্ন সিংহের হুতোম প্যাঁচা র নকসায় বলা হয়েছে নবকৃষ্ণ দেবের ছেলের দুর্গা পুজো য় নবমীতে বিশেষ আয়োজন থাকতো বাঈ খেমটা , কবি গান ও কীর্তনের। মেডেল পাওয়া শহরের বড় বড় বাঈজিরা ও খেমটা ওয়ালীরা সে দিন দুর্গা পূজার আসর জমাত।
শোভাবাজার রাজবাড়ি তে বারো দিন ধরে পুজো হত পুজো দালানে সাধারণ মানুষের প্রবশাধিকার ছিল কিন্তু পুজোর তিন দিন সাহেব মেমরা নিমন্ত্রিত থাকতো আর কিছু মুষ্টিমেয় অতিথি। খাবারের সময় বাইরের জনসাধারণের প্রবেশ কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ ছিল।
তবে ইংরেজ কর্মচারীদের সঙ্গে বাবু দের অন্তরঙ্গতা ও দুর্গা পুজোর আমোদ আহ্লাদ মিশনারী রা ভালো ভাবে গ্রহণ করল না। ১৮১৩ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কে দেওয়া নতুন সনদ অনুসারে মিশনারী রা এদেশে বসবাস ও খ্রিস্টধর্ম প্রচারে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা পায়। তারা তিনটি বিষয়ের পুরোপুরি বিরোধিতা করে - ১.হিন্দু দের দুর্গা পুজোয় সরকারি কর্মকর্তা দের যোগদান ২. পুজোর শোভাযাত্রা য় সামরিক বাজনা বাজানো ৩. উৎসব উপলক্ষে দুর্গা ও জাহাজ থেকে কামান দাগা। মিশনারী দের আন্দোলনের ফলে ১৮৮০ সালে হিন্দু দের দুর্গা পুজো য় সাহেব মেম দের যোগদান বন্ধ হয়ে যায়।
ধনী পরিবারের পুজো য় সাধারণ মানুষের যোগদানের সুযোগ না থাকায় ও যথাযোগ্য সম্মানের অভাব থাকায় সর্বপ্রথম ১৭৯০ সালে বারোজন ব্রাহ্মণ বন্ধু নিজেদের মধ্যে চাঁদা তুলে কালনার কাছে গুপ্তিপাড়ায় শ্রী শ্রী বিন্ধ্যবাসিনী পুজো সমিতি গঠন করে পুজো করার সিদ্ধান্ত নেয়। এরপরে আশে পাশে অঞ্চলে ও শান্তিপুরে পুজো শুরু হয়।
পরবর্তী সময়ে কলকাতায় ভবানীপুর, রামতনু মিত্র লেন ও সিকদার বাগানে ও সর্বজনীন দুর্গোৎসব প্রচলিত হয়।
শান্তিপুর অঞ্চলে বারোয়ারি পুজোর পান্ডারা ক্রমশঃ ধনী পরিবারের পুজোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা শুরু করে ফলে এর আসল উদ্দেশ্য ই নষ্ট হতে থাকে। চাঁদা নিয়ে তারা জুলুমবাজি করতে থাকে এমন কি কখনো কখনো মহিলা দের গয়না ছিনতাই করে নেয়। একবার প্রতিমার আকার নিয়ে রেষারেষি র ফলে শান্তিপুরে একটি বারোয়ারি সমিতি ষাটলক্ষ টাকা ব্যয় করে বিরাট পুজো করে ও ষাট হাত উঁচু ঠাকুর তৈরি করে অবশেষে মূর্তি কেটে কেটে টুকরো করে বিসর্জন দিতে হয়। বিসর্জনের সময় এমন অবস্থা হত চুরোট তামাক ও চরসের ধোঁয়ায় কখনো ঠাকুরের মুখ পর্যন্ত দেখা যেত না।
এই বারোয়ারি পুজোর প্রভাবে যে সামাজিক গ্লানি ছড়িয়ে পড়েছিল তার বিরুদ্ধে সমাজে যথেষ্ট বিরোধিতা হয়েছিল। সোমপ্রকাশ পত্রিকা, সংবাদ ভাস্কর ও তত্ববোধিনী পত্রিকায় এর বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনা করা হয়েছিল। ১২৯৩ সালের ২৯ শে আষাঢ় সোমপ্রকাশ পত্রিকায় এরূপ মন্তব্য করা হয়েছিল -- আজকাল বারোয়ারি তে বিশুদ্ধ আমোদ লাভ করা যায় না। প্রায় ই মদ বেশ্যা ইত্যাদি লইয়া বারোয়ারি র পান্ডা দিগের আমোদ প্রমোদ হয়।
তবে তাতে ও পুজোয় পান্ডাদের উশৃঙ্খল আচরণ কিছু মাত্র কমে নি।
তার সঙ্গে ই সমানভাবে চলেছে ধনী মদ্যপ বাবু শ্রেণীর দুর্গা পুজো উপলক্ষে নাচ গান ভোজন ও সুরাপান আর পাশবিক পশুবলি। এ সময় কলকাতা শহরে কোন কোন দুর্গা পুজো র খরচ ছিল পঞ্চাশ লক্ষ টাকা আর পাঁঠাবলি হত হাজারের বেশি।
দুর্গা পুজো উপলক্ষ করে নাচ গান সুরা পানে ধনী বাবু সম্প্রদায় ক্রমে ধনসম্পত্তি হারিয়ে নিঃস্ব হতে লাগল। কোনরকমে পারিবারিক সম্মান টুকু বজায় রেখে পুজো করতে লাগল। আর পারিবারিক পুজোর নবতম সংস্করণ লাভ করল সার্বজনীন বা বারোয়ারি পুজো।
এর পরবর্তী ঊনিশ শতকে মূর্তি পূজা বিরোধী ব্রাহ্ম ধর্মের আন্দোলন সমাজে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করলেও তা ফলপ্রসূ হয় নি। সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় শারদীয়া দুর্গা মাতার মধ্যে দেশমাতৃকাকে দেখতে পেলেন। দেশের জনগনের মধ্যে দেশপ্রেম ও জাতীয়তা বোধ জাগিয়ে তোলার জন্য গান গাইলেন
ত্বং হি দুর্গা দশপ্রহরণ ধারনী
--- - -
ধরণীং ভরণীং মাতরম্।
বন্দে মাতরম গানটি গৃহীত হল জাতীয় সঙ্গীত রূপে।
কবিগুরু র সাহিত্যে দুর্গা যেন ঘরের আদরিণী মেয়ে বছরে একবার বাপের বাড়ি আসে। শুধু তাই নয় পৌত্তলিকতা বিরোধী কবি দেবীর মৃন্ময়ী মূর্তি পূজোর মধ্যে বাঙালির প্রাণের আবেগ ও মাধুর্যের ব্যঞ্জনা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। ১৯০২ সালে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর আঁকলেন চতুর্ভূজা ভারতমাতা র চিত্র। দেবীর হাতে ধানের গুচ্ছ ও কমণ্ডলু। ছবিটি র নাম দিলেন বঙ্গমাতা।
সমাজে দুর্গা সম্পর্কিত ধ্যান ধারণা বাবু সংস্কৃতি র সময় থেকে সমানে পরিবর্তিত হয়েছে। বাবু সংস্কৃতি র জন্য সমাজে অবক্ষয়ের কালো ছায়া দেখা দিলেও তা স্থায়ী হয় নি। এই উৎসব ক্রমশঃ জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকলের আনন্দ ও মিলনের উৎসবে পরিণত হয়েছে।
বারোয়ারি পুজোর জাঁকজমক ও সংখ্যা ধীরে ধীরে বেড়েছে। বিশ্বায়নের যুগে অনেক বারোয়ারি পুজো তে ভক্তি কে গ্রাস করতে চাইছে থিমের ধারণা,বাজি ,আলোর রোশনাই ,প্রতিযোগিতা ,পুরস্কার ও মিডিয়ার তীব্র আলো। বনেদী বাড়ি গুলি সাবেকী ঐতিহ্য আঁকড়ে ধরে রাখার চেষ্টা করে চলেছে। মঠ ও মিশনের ভক্তি ও নিয়ম নিষ্ঠা আন্তরিকতার বিষয়টির ও এই প্রসঙ্গে যথেষ্ট গুরুত্ব আছে। বাস্তবিক ই অন্তরের ভক্তি ও শ্রদ্ধার বিনম্র নিবেদনের কোন বিকল্প নেই, হতে পারে না। বারোয়ারি বা বনেদী যাই হোক দুর্গোৎসবের জন্য সকলেই অপেক্ষা করে থাকে।শিউলির আলপনায়, কাশফুলের চামর দোলায় , রৌদ্র ও মেঘের লুকোচুরি খেলায় বেজে ওঠে মাতৃ আবাহনী মন্ত্র। অসুর বিনাশিনী দেবী ভক্তের আহ্বানে তুষ্ট হয়ে সানন্দে বরাভয় প্রদান করেন --
সর্বদৃশা মম স্থানং সর্বেকালব্রতাত্মকা
উৎসবাঃ সর্বকালেষু যতোঽহং সর্বরূপিনী।
করম পূজা
শ্রাবণী সেনগুপ্ত
অরণ্যচারী শিকারী জীবন থেকে কৃষিজীবি হিসাবে আত্মপ্রকাশ থেকেই করমের উৎপত্তি বলে মনে করা হয়। সাঁওতাল লোককথা ও সৃষ্টিতত্ত্বে করম হলো আদিমতম বৃক্ষ।পুরাণ ও লোককাহিনীতে করম উৎসবের উৎপত্তির কথা রয়েছে।শস্য এবং সন্তান কামনায় গ্রীসদেশে
Garden of Adonis নামে যে অনুষঠান পালিত হয় তার সঙ্গে ঝাড়খণ্ডের করম উৎসবের এক আশ্চর্য সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়।
করম পালনকারী জনগোষ্ঠীর মধ্যে কৃষিজীবি কুড়মি জাতি অন্যতম হলেও
ভূমিজ,খেড়িয়া,কামার,কুমার,বাগাল,রাজোযাড়,ঘাটুয়াল,হাড়ি,বাউরী,ডোম,সাঁওতাল,মুন্ডা,ওরাওঁ,হো সকলেই করম পালন করে।মূল আদি বাসিন্দা ছাড়া অন্যেরা এখনো করম উৎসবে সামিল হতে পারেন নি।
পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া,ঝাড়খন্ড,মেদিনীপুরে
এবং এককথায় পুরো ঝাড়খণ্ডী এলাকায় করম উৎসব অত্যন্ত নিষঠার সঙ্গে পালিত হয়।ড.বঙ্কিমচন্দ্র মাহাত,ড.আশুতোষ ভট্টাচার্য,ড.বিনয় মাহাত,ড.সুধীর করণ,স্যার জেমস ফ্রেজার,ডলটন সাহেব,রাধাগোবিন্দমাহাত, শরৎচন্দ্র রায়, সুভাষ গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ বিদগ্ধ্জনেরা করম সম্বন্ধে গবেষণা করেছেন এবং একে কৃষিউৎসব বলে চিণ্হিত করেছেন।
গরাম দেবতার পুজোর পরেই ঝাড়খণ্ড অঞ্চলে ধান রোপণের কাজ শুরু হয়ে যায়।ধান এই এলাকার একমাত্র ফসল না হলেও প্রধান ফসল।সাধারণতঃ শ্রাবণ মাসের শেষ বা ভাদ্র মাসের মাঝামাঝির মধ্যে ধান রোঁয়ার কাজ শেষ হয়ে যায়। আর ঠিক এই সময়েই উপযুক্ত রোদ,বৃষ্টির স্পর্শে চারাগাছগুলি সজীব ও সতেজ হয়ে ওঠে।এই সময়েই ভাদ্রমাসের শুক্লপক্ষে পর্যাপ্ত ফসলের আশায় কুমারী মেয়েরা 'জাওয়া' নামে একটি বর্নাঢ্য অনুষঠানের মাধ্যমে শস্যোৎসব পালন করে থাকেন। শুক্লপক্ষের প্রথম দিনে কুমারী মেয়েরা একটা ডালার মধ্যে বালি দিয়ে ঝাড়খণ্ডে যে সব শস্য জন্মায় সেইসব শস্যবীজ কাঁচা হলুদে রাঙিয়ে ঐ থালাটির মধ্যে চারা দেয়।তারপর একাদশী তিথি পর্য্যন্ত রোজ সন্ধ্যায় তারা ঐ ডালাটিকে মাঝখানে রেখে নাচ গান সহকারে নবাঙ্কুর চারাগাছগুলির বন্দনা করে ।হাত ধরাধরি করে ঘড়ির কাঁটার বিপরীতে কোমর দুলিয়ে পা ফেলে ফেলে ঘুরে ঘুরে যৌথ নৃত্য করে ও গান গায়।তারপর একাদশী তিথিতে আসে তাদের করম ঠাকুরের ব্রত উদযাপনের দিন।একাদশীর দিন গ্রামের কুমারী মেয়েরা করম ঠাকুরের পূজার ফুল তুলতে বনে যায়।সারাদিন তারা নির্জলা উপবাসে থাকে।দিনের শেষে সূর্য অস্ত গেলে পূজোর জন্য সংগৃহীত ফুল নিয়ে তারা ঘরে ফেরে।ঐ সমস্ত ফুল তুলসীতলায় রেখে তারা গ্রামের পুকুরে স্নান করতে যায়।স্নান শেষে পুকুরের ধারের ক্ষেত থেকে তারা মুঠো ভরে নিয়ে আসে নতুন ধানের সবুজ পাতা করম ঠাকুরের কাছে অঞ্জলি দিতে।ঘরে ফিরে সারাদিনের সংগৃহীত ফুল ও ফল থালায় সাজিয়ে,জ্বলন্ত প্রদীপ নিয়ে গাঁয়ের আখড়ায় বা যে বাড়িতে পূজোর জন্য করম গাছ পোঁতা
হয়েছে সেখানে সেই করম গাছের তলায় সবাই উপস্থিত হয়।ব্রত উদযাপনকারিণীদের প্রত্যেকের থালায় থাকে একটি করে সবৃন্ত,সুপুষ্টূ
কাঁকুড়।করম ঠাকুরের ব্রত উদযাপনকারিণীদের পার্বতী নামে অভিহিত করা হয়।এই কাঁকুড়টিতে পুরোহিত সিঁদুর মাখিয়ে দেন।কাঁকুড় পুত্রের প্রতীক এবং এই কাঁকুড়ের মতো সুপুষ্ট পুত্র প্রার্থনা করম পূজার ব্রত উদযাপনের অন্যতম উদ্দেশ্য।পুরোহিত ব্রতকথার মাধ্যমে পার্বতীদের করম ঠাকুরের ব্রত উদযাপনের গুণাগুণ শুনিয়ে থাকেন।এই ব্রতকথা শোনানো শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই সেদিনের মতোন পূজোর অনুষঠান শেষ হয়।এরপর করম গাছটিকে ঘিরে সারারাত চলে নাচ গান।ধামসা মাদল বাদ্যযন্ত্র সহযোগে চলে পাতা নাচ বা দাঁড় নাচ।পরের দিন সকালে দেওয়ালে তুলসী মঞ্চের অনুরূপ গোবর জলে করম ঠাকুর এঁকে গুঁড়ির ছোপ দেয়।স্নান করার সময় নদি-পুকুরঘাটে ঝিঙে পাতে তেল হলুদ দাঁতন দেয়।ধান ক্ষেত থেকে মূলসমেত ধান ঝাড় তুলে এনে সিঁদুর দিয়ে করম ঠাকুরের কাছে রাখে,তারপর আলত পাতে বাসি ভাত দিয়ে পারন করে।
জাওয়া ডালি ভাঙার সময় পার্বতী রা বছরের শেষ জাওয়া নাচ নেচে নেয় এবং করম ঠাকুরকে বিদায় জানায়-
জাহু জাহু করম গুঁসাই
জাহু ছও মাস গ ,জাহু ছও মাস।
পড়ত ভাদর মাস আনব ঘুরাই।
জাওয়া ভেঙে জাওয়ার অঙ্কুর শস্যক্ষেত্রে দেওয়া হয়,কেউবা ছাতা পরবে ছাতা ডাঙ্গে দেবার জন্য রাখে।
সাঁওতালেরা ডাল করম কে বলে কারাম।ঘরের চালে বাস্তুভিটায় করম গাছ জন্মালে শস্য ক্ষেত্রে পোঁতা ডালিতে ডালপালা গজালে,ধানের গাছে তসর বাঁধলে করম পূজা করতে হয়।নিজস্ব নাচ গান থাকলেও পূজা অনুষঠানে পুরুষেরাই অংশগ্রহণ করে।মেয়েদের ওখানে কোনো স্থান নেই।
করম ও জাওয়া গানগুলিতে সমাজের প্রতিচ্ছবি প্রতিফলিত হয়েছে।আবার গীত হিসাবে আবাহন বিসর্জন তো আছেই।তাছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক,ঐতিহাসক,অর্থনৈতিক বিদ্রোহ,বিক্ষোভ,জীবনবোধের অবস্থা,ঘটনা,ভ্রাতৃপ্রেম ,নারী সমাজ,ব্যঙ্গবিদ্রূপ,সন্তান,দেবর,ননদ,বাপের বাড়ি,শ্বশুর বাড়ির সঙ্গে সম্বন্ধ প্রভৃতি রূপ চিন্হিত হয়েছে।
জাওয়া করমের মূল ভাষা কুড়মালি।অধুনা বাংলা,হিন্দি ও উড়িয়া ভাষারও গানে অনুপ্রবেশ ঘটেছে।পুরুলিয়ার শীতলপুর ডুংরি ও ময়ূরভঞ্জের ভাঙাপাহাড়ে করম মেলা বিখ্যাত।এই উৎসব লোকজীবনের ঝাড়খণ্ডী নৃত্য ও সঙ্গীতের উৎস এবং লক্জিবনের দর্পণ।
"এক দিনকার ইলদ বাঁটা তিন দিনকার বাসি
লো।
মা বাপ কে বলে দিব বড় সুখে আছি লো।।"
করম অনুষঠানে কোথাও কোথাও একটির বদলে দু'টি করম গাছ বা ডাল পোঁতা হয়।এই দুইটির একটি পুরুষ এবং অপরটি প্রকৃতি বা সূর্য এবং পৃথিবী।এদের উভয়ের মিলনে ধরিত্রী শস্যপূর্ণ হয়ে উঠবে এই আশাতেই করম শাখার প্রতীকের মাধ্যমে এদের বিবাহ অনুষঠান সম্পন্ন করা হয়।করম পূজার আচার অনুষঠানগুলির প্রতি লক্ষ্য করলেই বোঝা যায় যে এগুলি একাধারে যেমন হরপার্বতীর মিলন অনুষঠান,তেমনই সূর্য ও পৃথিবীর মিলন অনুষ্ঠান।
অভ্রদীপ ঘোষ
।। পুজো ভ্রমণ।।
রানি রুদাবাঈ
চিত্রা পাল
পুবের শহরে থাকি, চলে গেলাম দেশের একেবারে পশ্চিম সীমানায়, চলার পথে বদল হতে লাগলো ভূপ্রকৃতি, পরিবেশ, মানুষ তার সঙ্গে মানুষের জীবনযাপন। এই বদল খুব ভাল ভাবে লক্ষ্য করলাম পশ্চিমের শহরে এসে। আমার এবারের যাত্রা শুরু গুজরাট প্রদেশের আমেদাবাদ শহর থেকে।কিছুদিন আগেও আমেদাবাদ গুজরাট রাজ্যের রাজধানী ছিলো,এখন তা গান্ধীনগরে স্থানান্তরিত। আমেদাবাদ শহর থেকে ১৮ কি।মি দূরে আদালজ নামে এক গ্রামে আছে এক গভীর কুয়ো বা স্টেপ ওয়েল, পরদিন সকালে সেই কুয়ো দর্শনের জন্য চলে এলাম আদালজ।
রুদাবাঈ স্টেপওয়েল বা কুয়ো যাকে গুজরাঠিভাষায় বলে ভাব।আগেকারদিনে এই ভাব বা জলাশয় রাজামহারাজারা দেশের জনগনের হিতার্থে উৎসর্গ করতেন। আমাদের দেশেও এমন বেশ কিছু প্রতিষ্ঠিত পুকুর সরোবর আছে, যা সেইসময়ে সেখানকার অর্থবান মানুষজন সাধারণের ব্যবহারের জন্য উৎ্সর্গ করে দিয়েছিলেন। গুজরাট শুষ্ক অঞ্চল, একেবারে মরুভূমির গায়ে লাগা।গ্রীষ্মে সুতীব্র দাবদাহ ও জলকষ্টহয়।তা থেকে বাঁচাতে প্রজা হিতার্থে রাণী রুদাবাঈ ১৪৯৮সালে তাঁর স্বামী রাণা ভীর সিংহের স্মৃতিতে এটি নির্মাণ করান। ভারতীয় স্থাপত্যের এটি একটি অসাধারণ নিদর্শন।বালি পাথরে নির্মিত পাঁচতলা গভীর এই জলাশয় এক অসামান্য ঐতিহাসিক নিদর্শন ও। রাণী রুদাবাঈ এর নিজের মর্যাদা রক্ষার্থে এই ভাবএ জীবনদানের মর্মন্তুদ কাহিনী পর্যটকদের অশ্রুসজল করে তোলে।আজও তাঁর কথা লোকের মুখে মুখে ফেরে।
পঞ্চদশ শতকে এই দন্ডাই দেশে রাজত্ব করতেন বাঘেলা বংশের হিন্দুরাজা ভীরসিংহ।তাঁর রাজ্য ছোট ছিল। কিন্তু তাঁর রাজ্যে ছিলো প্রবল জলাভাব। সব সময় বৃষ্টির জলের ওপর নির্ভর করতে হতো। গ্রীষ্মকালে জলকষ্টতো ছিলোই, আবার যে বছর বৃষ্টি কম হতো, তখন সারা বছরই জলের অভাব দেখা দিতো।জলের জন্য মানুষের কষ্টের আর সীমা ছিলো না। রাজা ভীর সিংহ রাজ্যের মানুষের জলকষ্ট দূর করার জন্যএকটা গভীর কুয়ো জলাশয় নির্মাণ করার কাজে ব্রতী হন। এই কুয়ো নির্মাণ শেষ হবার আগেই প্রতিবেশী রাজ্যের মুসলিম শাসক মহম্মদ বেগদা তাঁর রাজ্য আক্রমণ করেন। রাজা ভীর সিংহ তাঁর সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হন। আর তাঁর রাজ্য মহম্মদ বেগদার করায়ত্ত হয়।রাণা ভীর সিংহের পত্নী রাণী রুপবা বা রুদাবাঈ পরলোকগত স্বামীর সঙ্গে মিলিত হবার বাসনায় সতী হবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। সবাই জানে সতী হবার অর্থ অগ্নি কুন্ডে প্রাণ বিসর্জন দেওয়া।
রাণী রুদাবাঈ ছিলেন অপরুপা সুন্দরী। রুপমুগ্ধ মহম্মদ বেগদা তাঁকে বিবাহের প্রস্তাব দেন ও রাণী সে প্রস্তাবে সম্মতি দেন। কিন্তু শর্ত একটাই যে তাঁর স্বামীর আরব্ধ কাজ,এই জলাশয় নির্মাণ আগে সম্পূর্ণ করতে হবে। মহম্মদ বেগদা দ্রুত, খুব কম সময়ে এই কুয়ো বা জলাশয় নির্মাণ সম্পূর্ণ করেন।এবার মহম্মদ বেগদা রাণীর প্রতিশ্রুতির কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন।তখন রাণী তাঁর সহচরীদের নিয়ে কুয়ো প্রদক্ষিণ করে কুয়োর জলে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণত্যাগ করে নিজের মর্যাদা রক্ষা করেন।
এই কুয়োর কাছে দুশো বছর আগেকার এক সমাধি লিপিতে এই কথা উৎ্কীর্ণ আছে, কুয়ো নির্মাতা ছয় জন স্থপতির সমাধি এটি।শোনা যায়, মহম্মদ বেগদা কুয়ো নির্মাণকারীদের ডেকে জিজ্ঞেস করেছিলো যে এই রকম আরো একটা কুয়ো নির্মাণ করতে পারবে কিনা। ছয় জন নির্মাণকারী বলেছিলো হ্যাঁ, তারা পারবে। বেগদা এই কুয়োর স্থাপত্যে এতো মুগ্ধহয়েছিলেন যে তিনি চাইছিলেননা আরো একটা এরকম কুয়ো কেউ তৈরি করুক। তিনি তৎক্ষণাৎ্ ওই ছয়জনকে মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেন।
প্রজাহিতার্থে এই কুয়ো বা জলাশয় নির্মাণ এক ঐতিহাসিক ঘটনা তো বটেই, তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা অশ্রু সজল কাহিনীও কম গুরুত্বের নয়। কয়েক শতক আগেও এই প্রত্যন্ত অঞ্চলের রাণী জনসাধারণের সুবিধার জন্য, মঙ্গলের জন্য নিজের প্রাণদান করতেও দ্বিধা করেননি, তা ভেবে আজকের যুগে দাঁড়িয়েও আমাদের মাথা নত হয়েছিলো।
মন চলো যাই
শ্যামলেন্দ্র চক্রবর্তী
এই একটু আগে স্টেশনে ট্রেন ঢুকলো । বেশি কিছু নেই সঙ্গে বাক্সো প্যাটরা । শুধু একখানি ব্যাগ । গতকাল বিকেলে উঠেছিলাম বরাক ভ্যালি এক্সপ্রেসে দুমুঠো আতপের ভাত খেয়ে । কিসের এক্সপ্রেস ! গরুর গাড়িও জোরে ছোটে । মিটারগেজ লাইন । কামরাভরা দেহাতি মানুষ লটবহর নিয়ে । নামছে , উঠছে । যেদিকে তাকাই , শুধু ধানের খেত , একটু পর পর জঙ্গল । লামডিং কখন যে পেরিয়ে গেছি বুঝতেই পারিনি । তখন রাত । বসে বসেই ঘুমিয়ে নিচ্ছিলাম কুকুরশাবকের মতো । ভোরের আলো একটু একটু করে ফুটলো , আর ভেসে উঠতে লাগলো অসাধারণ সব চিত্রপট। পাহাড় । তার গায়ে লেপ্টে থাকা সবুজ । নল বাশের বাগান রেল লাইন ছাড়িয়ে ট্রেন ছুতে চায় যেন । হাফলঙ্গে অনেকক্ষণ দাড়িয়ে , ধেখলাম পেছনে আরেকটি ইঞ্জিন লাগানো হয়েছে । একটূ পরেই ট্রেন খাড়া উঠতে লাগলো , ঝুকে পড়লাম পেছনে । আবার নেমে গেলো , এবার সামনে ঝুকলাম । এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে এক লোহার সেতু , ট্রেন ধিকি ধিকি চলছে । নিচে বিস্ময় , ছোট্ট উপত্যকা ভূমি ।পিপড়ের আকারের মানুষ কি যেন করছে সেখানে । রেখার মতো নদী , সবুজের গালিচার মধ্য দিয়ে সূতোর মত গেছে ।বিকেলে বদরপুর । এখান থেকে ধর্মনগর নাকি খুব কাছেই । আমরা চার বন্ধু , অভিযানে নয় , চাকরির পরীক্ষা দিতে বেরিয়ে পড়েছি । শিলচর স্টেশনের গায়ে এক বন্ধুর স্বল্পপরিচিত পরিবার । হোটেলে থাকবার সামর্থ্য নেই , তাই চেনা বাড়ি খুজে নিই আগে । দরজায় টোকা দিলাম । মাসিমা সদৃশ মহিলা আগল খুলে বললেন , খিতা খরলা , এথো দেরি !
অনেক কথাই মাসিমার বুঝতে পারি না । বাধ্য ছেলের মতো শুনি , কী বলছেন বোঝার চেষ্টা করি , বুঝতে পারলে উত্তর দিই আর বাদবাকিতে আন্দাজে মাথা দোলাই ।
ডিমের ঝোল , আলু ভাজা , ভাত ; জম্পেশ খাওয়া হল , প্রায় চব্বিশ ঘন্টা বাদে। আহা , অমৃত । যেমন স্বাদ রান্নার , তেমনি মাসিমার আদর যত্নের । এক ঘরের মেঝেতে ঢালা বিছানা হল । আসল গন্তব্য কিন্তু শিলচর নয় । আমরা আরো দূরে যাবো , যেখানে যাওয়ার কথা অনেকেই ভাবতে পারে না। অন্ধকার থাকতেই উঠে পড়েছি । প্রাত্যকৃত্য সেরে বেরিয়ে পড়লাম । মাসিমা অনেক করে চায়ের কথা বললেন বটে , কিন্ত তাঁর আর যন্ত্রণা বাড়াতে মন চাইছিল না । আমরা যাবো আইজল , মিজোরামের রাজধানী । আন্তঃরাজ্য পাস নিতে হবে । চারটেয় গিয়ে মিজো পরিবহনের কাউন্টারে লাইনে দাঁড়ালাম । একজন দাঁড়াই , তিনজন বসে জিরাই । পরীক্ষার প্রবেশ পত্র দেখিয়ে ছাড় পাওয়া গেল । ঘন্টা দুয়েক বাদে পাস হাতে বাসের টিকিটও কাটা হল । বাস ছেড়ে দিলো ঠিক আটটায় । আমরা চার মূর্তি পাশাপাশি দুই আসন পেয়ে গেছি বলে কয়ে । বাস তো ছাড়লো , কিন্তু পেটের কোনো ব্যবস্থাই করা গেল না । চায়ের দোকানে ঝাপ তখনো ওঠে নি , সময়ও নেই দূরে দেখবো , পকেটের অংকটিও মাথায় রাখতে হচ্ছে । দেখা যাক , চল তো , পথে কিছু খেয়ে নেওয়া যাবে । শিলচরের পরিবেশ আর আমাদের এদিককার অনেকটাই এক রকমের । সমতল ভূমি , সুন্দর শহর । গোছানো কিন্ত ফাঁকা । মসৃন পাকা রাস্তা ধরে বাস ছুটলো , ঘন্টাখানেক । সব যাত্রী শান্ত হয়ে বসে । তারপর পাকদন্ডী শুরু , সাপের মত পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে উপরে উঠছে । সঙ্গে উঠে আসছে পাটের নাড়িভুড়ি । মিজো সীমান্তে পাস চেকিংয়ের পর আবার চললাম । অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য চারদিকে । মুগ্ধ হয়ে দেখছি । যোয়ান যোয়ান মিজো ছেলেগুলো দামাল হতে শুরু করলো । প্রত্যেকের কাছেই ছোড়াছিল , সেগুলো ওরা বার করে হাতে ধার করলো , যেন এক্ষুনি মুরগি জবাই করবে । বাসের মধ্যে মোটেই আমরা চার বাঙ্গালী , বাকি সব ওরাই , সব বয়সের , মহিলা বা পুরুষ । অল্প বয়সীরা দল বেঁধে দুর্বোধ্য কোরাস গাইতে শুরু করেছে , খোলা চাকু হাতে , মিজো মেশানো ইংরেজি ভাষায় । আমরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করি , পেটের খিদের চেয়ে প্রাণের ভয় বেশি হল । দুপুর নাগাদ পাহাড়ের গায়ে এক মাঠ মতন জায়গায় বাস থামলো । দুতিনটি খাবারের দোকান , আশেপাশে খোলা স্থানে দোকান বিছিয়ে আছে মহিলারা , দোকান মানে একরকমের সাদা বিড়ি । এখানে মেয়েরাই ব্যবসা চালায় । অনেক কষ্টে বোঝাতে পেরে একটি করে ডিম ভাজা ও পাউরুটি খেলাম ।
বুঝতে পারছিলাম হিমালয়ের একেবারে দক্ষিণ প্রান্তে পৌঁছে গেছি । যে দিকে চোখ যায় , শুধুই পাহাড় আর পাহাড় ; পাহাড় বলা ভুল হল , পর্বত বলাই সমীচীন। তবে ন্যাড়া নয় , বরং ঘন আর হালকা সবুজে ছয়লাপ । একটাই রং দূরে সমান্তরাল - সবুজ, উপরে কেবল নীল । আর কিছু তুলো উড়ে বেড়াচ্ছে বাতাসে । হোটেলের মালিক পরিস্কার বাংলায় বললেন , সূর্যাস্তের পর ঘর থেকে বেরবে না কেউ , কেউ ডাকলেও । গায়ে কাঁটা দিল যেন , এমন বিপজ্জনক সতর্কবানীতে এবং আইজলের এক মিজো হোটেলের মালিকের মুখে স্বচ্ছন্দ বাংলা শুনে । বললাম , আপনি বাঙ্গালী দাদা ? দেখে তো বুঝতে পারিনি ?
শিলিগুড়ির লোক আমি । পিওর বাঙ্গাল । মালিক বললেন । এতদূরে অজানা পরিবেশে ব্যবসা করছেন! কিভাবে যোগাযোগ হল এখানে ?
আমাদের ছিল জিজ্ঞাসা ।
তিনি এখানে অনেকদিন , প্রায় কুড়ি বছর আগে এসেছেন , এখানেই মিজো বিয়ে করে থিতু ।
ব্যক্তিগত বিষয়ে আর উৎসাহ দেখানো ঠিক নয় । দোতলার এক ঘরে ঠাঁই হল ।
কাচের শার্সিতে যেন মায়ামাখা ছবি কোন এক দুরন্ত শিল্পী ছবি এঁকে গেছেন ।
চিলাপাতার জঙ্গলে
কবিতা বণিক
নিরিবিলি কোন জঙ্গলে রাত্রি বাস করার একটা সুযোগ পেয়ে চলে গেলাম চিলাপাতা ফরেস্ট এর উদ্দেশ্যে। কোচবিহারের রাজ সেনাপতি চিলা রায়ের নাম অনুসারে এই জঙ্গলের নাম চিলাপাতা ফরেস্ট। বিকেলবেলা বেরোনোর ফলে পৌঁছতে রাত্রি হয়ে গেল। দিনহাটা পার হয়ে ধীরে ধীরে অন্ধকার গ্রামের রাস্তা ধরে এগোচ্ছি।
কোথাও মোটামুটি ভাল রাস্তা আবার কোথাও মাঠ পেরিয়ে বনের মধ্য দিয়ে গা ছমছমে রাস্তা। গাড়ির হেডলাইটের আলোয় যেটুকু দেখা যাচ্ছে। গিয়ে উঠলাম একটা রিসোর্টে " চিলাপাতা জঙ্গল ক্যাম্প।" বেশ সুন্দর পরিবেশ। কিছুক্ষণ আগে বৃষ্টি হয়ে গেছে। গাছেরা দু-একটা বৃষ্টির ফোটা দিয়ে আমাদের স্বাগত জানালো। আমরাও আপ্লুত হলাম। মনে মনে বললাম সারা পৃথিবী জুড়ে তোমাদের সুরক্ষার দায়িত্ব যে আমাদেরই। চারিদিকে মৃদু আলো আছে কিন্তু সবই ফুটল্যাম্প এর কাজ করছে। যাতে বন্য পশু, পাখিদের কোন কষ্ট না হয়। রিসোর্ট এর ভিতরে অনেক রকমের গাছ আছে। বৃষ্টিভেজা বাগানের সরু বাঁধানো পথ ধরে নানান গাছগাছালির মধ্য দিয়ে ঝিঁ ঝিঁ পোকার কনসার্ট শুনতে শুনতে পৌঁছলাম আমাদের নির্দিষ্ট কটেজে। বেশ অনেকগুলো কটেজ আছে। প্রথমেই মনে হোলো ভোরে উঠতে হবে। ভোরের আলোয় প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য কে মনের মনিকোঠায় বন্দি করে নিয়ে যাব।
মোরগের ডাকে বাইরে বের হলাম। অনেক মোরগ-মুরগি ছুটে ছুটে খেলছিল। কত পাখির ডাক শুনতে পাচ্ছি কিন্তু দেখতে পাচ্ছিনা। কত রকম গাছ আম ,বকুল ,কাঞ্চন ,অর্জুন, খয়ের, বয়রা ,সেগুন, শাল আরও নাম-না-জানা কত গাছ। রিসর্টের পিছনদিকে সীমানার বাইরে সবুজ ধান ক্ষেত অনেকটা দূর পর্যন্ত। চলে এলাম সামনের দিকে। ডাইনিং স্পেসের পাশেই একটা দীঘি আছে। ডাইনিং হল টা টিনের চাল কাঠের খুঁটির ওপর বাঁশের অর্ধেক বেড়ার ঘর। খাবার টেবিলে বসে চারিদিক খোলা থাকায় চার-পাশটা বেশ ভাল দেখা যায়। কটেজ গুলোর আশে পাশে গাছ গাছালির ফাঁকে ফাঁকে বসার জায়গা করা আছে। মাঝে মাঝে কোথাও দোলনা দিয়ে ও বসার জায়গা দিয়ে সুন্দর সাজানো হয়েছে। রাতেও খুব বৃষ্টি হয়েছে, এখন বেশ পরিষ্কার আকাশটা। সামনের গেটটা খুব সুন্দর করে সাজানো। " চিলাপাতা জঙ্গল ক্যাম্প "লেখা আছে। জঙ্গলে ক্যাম্পে থাকার অভিজ্ঞতা দিচ্ছে এই ক্যাম্প। গেটের সামনে দিয়ে পিচের রাস্তার ওপারে সবুজ ধানক্ষেত অনেক দূর পর্যন্ত। ধানক্ষেতের পেছনদিকটা চিলাপাতার জঙ্গলে ঘেরা।
দশটা নাগাদ বের হলাম। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে গাড়ি চলছে। মাঝে মাঝে চোখে পড়ল গাছবাড়ি। আমার কাছে খুব আকর্ষণীয় মনে হল। বড় বড় গাছের ওপর একজন বা দুইজন মানুষ বেশ বসতে বা শুতে পারে এতটাই বড়। মইয়ের মত সিঁড়ি দেওয়া ওপরে ওঠার জন্য। ছোট ছোট নদী, জলের ধারা, বর্ষায় এমন রূপ নিয়েছে চারিদিক থেকে সবাই বয়ে চলেছে অফুরন্ত আনন্দ নিয়ে। কোথাও এমন জলের ধারা পরছে মনে হল যেন চিত্রকূট পৌঁছে গেলাম। বর্ষায় নদীগুলো যেন রূপসী যুবতী। জলের ধারার চলার ছন্দ, পাথরে পাথরে জলের কলতান এই সুর তো কত সাধনা করে তোলেন রবিশংকর , ভীম সেন যোশী। অপূর্ব সুরের মূর্ছনা জলের। কতনা ধারায় কতনা ছন্দে নেচে নেচে গেয়ে চলেছে। বর্ষায় জল-জঙ্গলের যে মেলবন্ধন সেই অপরূপা শ্যামলীকে যখন সূর্যের কিরণে দেখি তার মোহময়ী নোলক ও কুণ্ডলের এর দ্যুতি যেন ঠিকরে বেরোচ্ছে। রাস্তা থেকে মাঝে মাঝেই চোখে পড়ছে চুপচাপ মাছ ধরার কাজ। খাইবে সুখে খিচুড়ি আর মাছ ভাজা। আবার বৃষ্টির ফোঁটাগুলো দল বেঁধে গাছের পাতায়, রাস্তায় নেমে ছোটাছুটি শুরু করে দিল। আমরা বৃষ্টির খেলা দেখতে দেখতে এগিয়ে গেলাম।
।। শারদীয়া গদ্য।।
মা আসছেন
শ্রাবণী সেন
ক্যালেন্ডারের পাতাগুলো হাওয়ায় উড়ছে খুব।
কি মাস এটা? আশ্বিন? আশ্বিন মাস!
তুলোর মত হাল্কা হাল্কা মেঘ উড়ে উড়ে উড়ে উড়ে বলে গেল "ঘরবার সব গুছিয়ে রাখ গো সব গুছিয়ে রাখ! মা আসছেন, মা আসছেন।"
মা আসছেন ঘরের মেয়ের রূপধরে। তাই আগে ভাগে আগমনী গান গেয়ে কাশফুল এল, শিউলি ফুল এল, স্থলপদ্ম সেও এল বৈকি।
শেষ বর্ষণের আকাশজলে মুখ মেজে প্রকৃতি তাই একেবারে প্রস্তুত।
মা আসছেন, জগজ্জননী মা দুর্গা আসছেন।
দশহাতে দশ প্রহরণধারিণী মা অসুরনাশিনী আসছেন।
এসো মা এসো...
শারদীয়...
তমালী দাস
শারদ প্রাতে সোনালী রোদ্দুর, কাশফুল, পূজোর গন্ধ, উৎসবের আমেজ...সব আসে।এর সঙ্গে অবধারিত ভাবে প্রচুর স্মৃতি আসে।জীবনের মধ্যভাগে দাঁড়িয়ে যদি পূজোর অনুভূতি খুঁজতে যাই..সত্যি বলতে,তেমন আনন্দের মুখ মনে পড়ে না।শৈশব,কৈশোর.. সব বয়সেই পূজো আসত আর এক অদ্ভুত বিষাদ নামতো মনোভূমি তে।আমার বোধহয় শরৎ তেমন প্রিয় ছিল না।ছিল...যতদিন অবধি ভোরবেলা শিউলি ফুল কুড়ানো ছিল,তার হলদে বোঁটার রঙ হাতে লেগে যাওয়া ছিল...ততদিন।তারপর ভালোলাগা এল হেমন্তের চরাচর জুড়ে। পুজো নয়,পুজো পরবর্তী নিসর্গ বড় প্রিয় হয়ে উঠল।কোজাগরী চাঁদ ছোটো হতে হতে মিশে যেত দীপাবলির আলোয়..তারপর সবকিছুর বিসর্জনান্তে,ফসল কাটার পর পড়ে থাকা মাঠের বুকে লেগে থাকত পাতলা সরের মত কুয়াশা।দূর রাস্তা থেকে উদাসী চোখ অনিমেষ চেয়ে থাকত ঐদিকে। সন্ধ্যের হালকা ভেজা ভেজা ভাব,বাতাসে হিমেল আমেজ..এসবই প্রিয় হল।পূজো প্যান্ডেলে জমজমাট আড্ডা,হৈচৈ,পারিবারিক উদযাপন,অজস্র উৎসবমুখর ভিড় থেকে সরে থাকা বয়ঃসন্ধি কিভাবে পেরিয়ে গেল জীবনের চৌকাঠ... আজ পূজোর স্মৃতির ভিড়ে সেগুলো অতীত। পূজো নয়,পূজো পরবর্তী হেমন্তবেলা বড় প্রিয় হয়ে উঠল।
শারদ কথা
জয়িতা সরকার
নীল আকাশ,সাদা মেঘ, আর বাতাসে মন কেমনের গন্ধ মানেই প্রকৃতি জুড়ে শরতের সুর। শহর জুড়ে উৎসব আমেজ। আকাশটা আজ একটু বেশিই নীলচে। মেঘের আনাগোনাও আছে। কিন্তু ছেলেবেলা নেই। নতুন জামার গন্ধ তো আর তেমন করে মন ভোলায় না, কিংবা পঞ্চমীতে স্কুল গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে পুজোর প্ল্যানিং গুলো আজ কেমন ' পুজোতে আসছিস নাকি' এই প্রশ্নেই ইতি টানে।
শরৎ এলেই ঘরে ফেরার ডাক আসে। তিস্তা পাড়ে কাশফুল গুলো মাথা নাড়িয়ে আগমনী তালে ছন্দ মেলায়। কুমোরটুলির ব্যস্ততায় পুজো আসে মন জুড়ে। কমলা-সাদা শিউলি ভরা উঠোন জুড়ে শারদ সকালের মিঠে রোদে পুজোর সুর বাজে প্রকৃতিতে। মাঠের কাঁচা পাকা ধানগুলোও যেন অপেক্ষা করে ঘরের মেয়ের পথ চেয়ে।
শরৎ মানেই একমুঠো মুক্তো বাতাস, ছুটির আমেজ, দূর থেকে কাছে ফেরার তাড়া। হই-হুল্লোড়, ছেলেবেলা,স্মৃতিগলি বেয়ে এই মন্ডপ , ওই মন্ডপে শৈশব খুঁজে পাওয়া। অথবা কিশোরী বেলার প্রথম ভালোলাগার অপেক্ষা। আমার শহর জুড়ে পুজোর ভালবাসার এমন কত গল্প ছড়িয়ে আছে।
ওই যে প্রথম শাড়ি পড়ে আশ্রম যাওয়ার তাড়া। অষ্টমীর সকালে হাজারো চোখ এড়িয়ে প্রথম চোখাচোখি, সেসব মিলিয়ে শরতের স্বরলিপি জুড়ে শুধুই ভালবাসা। এই আশ্বিনে শরত জোড়া মন কেমনের রাত-দিন। ছেলেবেলার স্মৃতি সিন্দুকের ধূলো ঝেড়ে কাটিয়ে দেওয়া এক শরত।
আসলে এবার নিজ শহরে শরত দেখার সুযোগ নেই। তিস্তা পাড়ে কাশ ফুলের হাতছানিতে সাড়া দেওয়ার উপায় নেই। সাদা বালিতে ছুটে বেড়ানোর তৃপ্তি নেই। দূর থেকে ভেসে আসা ঢাকের শব্দও নেই। সাদা মেঘের ভেলায় দূরদেশ থেকে আসা চখাচখির সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়ার সুযোগ নেই।
শরত জুড়ে যে পুজোর গন্ধ মাখা অনুভূতি, কিশোরীবেলা থেকে প্রথম প্রেমিকা হয়ে সংসার জীবনেও সেসবের ছুঁয়ে যাওয়া। সময়ের নিয়মে মুহুর্ত বদলায়, তবে প্রকৃতি আসে নিজ রূপে নিজ সাজে। ধান ক্ষেতের রোদ ছায়ায় লুকোচুরি খেলা ছেলেবেলাকে হৃদয় সিন্দুকে যত্নে রেখে দূর থেকে ছুঁয়ে যাওয়া শরত হয়ত এভাবেই স্মৃতিযাপনের গল্প লেখে।
পূজার গন্ধ
চম্পা বিশ্বাস
"ও আয়রে ছুটে আয় পূজোর গন্ধ এসেছে,
ড্যাং কুড়কুড় ড্যাং কুড়কুড় বাদ্যি বেজেছে।"
শরত ঋতুর আগমনের সাথে সাথে সত্যি সত্যিই যেন আকাশে বাতাসে একটা পূজার গন্ধ অনুভূত হয়। প্রকৃতি তার রূপের পসরা সাজিয়ে হাজির হয় আমাদের আনন্দ দানের আশায়। নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা, সকালে শিউলি ফুল কুড়ানো, তিস্তা, করলার পাড়ে ফুটে থাকা কাশফুলের সমাহার পূজার বার্তা বহন করে।
বাঙালীর বড়ো উৎসব দুর্গাপূজা। সারা বছর অপেক্ষা করার পর শরতের আগমনে তাই চারপাশে ছড়িয়ে পরে দেবীদূর্গার আগমন বার্তা। পূজার গন্ধে চারিদিক তখন ম-ম করছে। চারপাশের পূজা মন্ডপে মন্ডপে শুরু হয় বাঁশ বাঁধার কাজ, দোকানে
দোকানে ক্রেতা বিক্রেতার ভিড়, সাধ্যমতো প্রতিটি বাড়ির নবরূপে সাজ পূজার মাত্রা আরোও বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়।
ঋতুরানী শরতের প্রথম পূজা হল বিশ্বকর্মা পূজা। আর এই পূজার মধ্য দিয়েই উৎসবের মরসুমের সূত্রপাত। মহালয়ার পূণ্য প্রভাতে ধ্বনিত -"আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোক মঞ্জির।"--এই শব্দ গুলো বাতাসে পূজার গন্ধ ছড়িয়ে এক অনাবিল আনন্দঘন পরিবেশের সৃষ্টি করে।
বিস্ময় শিউলী রায়
"আয় রে ছুটে আয়
পূজোর গন্ধ এসেছে
ঢ্যাং কুড় কুড় ,ঢ্যাং কুড় কুড়
বাদ্যি বেজেছে ..."
ছোট থেকে এই গানটি শুনে বড় হয়েছি। পূজোর সময় এই গানটি শুনলে আজ ও সমান ভাবে এক অন্য অনুভূতি জাগায় বা বলা যেতে পারে ছোটো বেলার স্মৃতিতে ফিরিয়ে নিয়ে যায় ।
তবে এই কথাটা বোধহয় সত্যি বাঙালি মাত্রই পূজোর গন্ধ পায় । পাবে নাই বা কেন, প্রকৃতি ও যে সেজে ওঠে নতুন সাজে। আকাশের নীল রঙ আর পেঁজা তুলোর মত আকাশ জুড়ে ভেসে বেড়ানো সাদা মেঘ জানিয়ে দেয় শরৎ এসেছে, পূজো আসছে। কাশফুল আর বাতাসে শিউলির সুবাস জানান দেয় মায়ের আগমনের সুর। পূজো আসছে এই অপেক্ষাটাই বড় মধুর।
পূজো এলেই ছোটবেলার টুকরো টুকরো বহু কথা খুব মনে পড়ে । তবে একট বিষয় ছোটো বেলায় আমাকে বড় অবাক করত, সে হলো প্রতিমা তৈরি করার কাজ । আমার মামাবাড়িতে যাওয়ার পথে দূর্গা প্রতিমা তৈরি করা হতো । পূজোর প্রায় এক - দেড় মাস আগে থেকেই শুরু হতো প্রতিমা গড়ার কাজ । সারা বছর সেই স্থান থাকত বিবর্ণ , রিক্ত কিন্তু পূজো এলেই সেই স্থান যেন তার শ্রী ফিরে পেত । চারিদিক কেমন সাজসাজ রব শুরু হয়ে যেত। সারিসারি প্রতিমার কাঠামো রাখা থাকত । মাটি ,খড়, কাপড়, দড়ি, রঙের বালতি ,তুলি আর সেই সাথে ব্যাস্ততা স্থানটিকে কর্মমুখর করে তুলত ।
যখন মামাবাড়ি যেতাম তখনই এক ছুটে ওখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম প্রতিমা গড়ার কাজ । বাবা কে বলতাম - আমাকে প্রতিমা বানানো দেখাতে নিয়ে যাও। দাঁড়িয়ে থাকতাম মা দুর্গার পায়ের কাছে । কত্ত বড় বড় দুর্গা প্রতিমা । শিশু মন অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত শুধু । বড় ভালো লাগত দেখতে । কোনো কাঠামোতে তখন হয়তো মাটি লেপা হচ্ছে ,কোনটায় তখনও হয়নি । আবার কখনো গিয়ে দেখেছি মা দুর্গার গায়ে রঙ করছে, কাপড় পড়াচ্ছে । সকাল সন্ধ্যা কাজ চলত । ভেতরে হলুদ বাল্ব ঝোলান থাকত । আবার কখনো গিয়ে দেখেছি মাকে সাজানো হয়ে গিয়েছে । মা দুর্গা তার ছেলে মেয়ে নিয়ে মন্ডপে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে । একটা নয় একের অধিক মা দুর্গা অপেক্ষারত একই স্থানে । এক নজরে সব প্রতিমার মুখগুলো দেখে নিয়েই নিজের মনে ঠিক করে নিতাম কোন ঠাকুর টা সবচেয়ে সুন্দর হয়েছে আর মনে মনে ভাবতাম ওনারা কিভাবে পাড়ে এত সুন্দর করে প্রতিমা গড়তে । কোথায় আমরা তো পারি না ।
এই বিশ্ময় আর ভালো লাগাটা আজও রয়ে গিয়েছে । আজও বড় ভালোবাসি প্রতিমা গড়া দেখতে । সুযোগ পেলে অন্তত একবার হলেও দেখে আসি মায়ের মৃন্ময়ী রূপের সৃষ্টি দু চোখ ভরে । তবে সময়ের চাকায় আমার আর মায়ের সৃষ্টির স্থানের স্থান বদল হয়েছ বৈকি ।
আমার মনে হয় যেই স্থানে প্রতিমা গড়া হয় তার চাইতে পবিত্র স্থান কিছু হতে পারে না । মন্ডপের জাঁকজমক, আলোর ঝলকানিতে প্রতিমা দর্শন তো আমরা করেই থাকি । সেখানে আছে আড়ম্বরতা কিন্তু যেখানে একজন মানুষ কাঠের কাঠামো কে ধীরে ধীরে সাজিয়ে ,তিলে তিলে মায়ের রূপ দেয় তার চাইতে সুন্দর কিছু হতে পারে না । সেই স্থান জৌলুস হীন কিন্তু সেখানে রয়েছে একজন শিল্পীর আশা, তার সৃষ্টি যেন সকলের মন জয় করতে পারে । কাজের প্রতি কতটা ভালোবাসা থাকলে একটা কাঠের কাঠামো মায়ের রূপ নিতে পারে । না দেখলে ভাবা যায় না । যা আজও আমার কাছে বিস্ময়ের ।
।। পুজো ভাবনা।।
পুজোর সেকাল একাল
স্বপন কুমার দত্ত