Tuesday, July 2, 2024


 

সম্পাদকের কথা 

আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই বোধহয় একটি বালক বা বালিকা থাকে, যার সন্ধানেই কেটে যায় আমাদের সারা জীবন। মাঝবয়সে এসে সেই অন্বেষণ আকুল করে সবাইকে। তাই বারবার ফিরে যাই আমরা সেই শেকড়ে যেখান থেকে শুরু করেছিলাম আজীবন এই পথ চলা। মুজনাই এবার সেই শেকড় অর্থাৎ নিজের বিদ্যালয়কে মনে করেছে নানা ভাবে। বিদ্যালয় জীবন আসলে সেই জীবন যখন নিঃস্বার্থ দিন কেটে যায় এক অবিকল্প ভাল লাগায়। যত সময় যায় সেই বিদ্যালয় জীবন ততটাই আঁকড়ে ধরে আমাদের যাপনকে। ব্যক্তি স্বার্থহীন সেই জীবন আজ এই ভাঙাচোরা সময়ে বড্ড বেশি কাম্য। শিক্ষা আজ ভূলুন্ঠিত, মর্যাদা তার বিপন্ন। এই সময়ে নিজেদের ফেলে আসা সময় হয়ে উঠতে পারে শীতল প্রলেপ, দিতে পারে টালমাটাল পরিস্থিতিকে যুঝবার শক্তি।    



মুজনাই অনলাইন আষাড়   সংখ্যা ১৪৩১

 রেজিস্ট্রেশন নম্বর- S0008775 OF 2019-2020

হসপিটাল রোড 

কোচবিহার 

৭৩৬১০১

ইমেল- mujnaisahityopotrika@gmail.com (মাসিক অনলাইন)

ক্রোড়পত্রে ব্যবহৃত সংগৃহিত  ছবি- যামিনী রায়   

প্রকাশক- রীনা সাহা    

সম্পাদনা, প্রচ্ছদ, অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায় 

মুজনাই আষাড় সংখ্যা ১৪৩১ 


এই সংখ্যায় আছেন যাঁরা 


বেলা দে,  গৌতমেন্দু নন্দী, মাধবী তালুকদার  

বিকাশ দাস ( বিল্টু )পার্থ বন্দোপাধ্যায়,   বিপ্লব তালুকদার, 

সুদীপা ঘোষ, অনিতা নাগ, জয়তী ব্যানার্জি, 

কবিতা বণিক, শুভেন্দু নন্দী,  মনোরঞ্জন ঘোষাল 

 বটু কৃষ্ণ হালদার, ঋতুপর্ণা ভট্টাচার্য, তন্ময় কবিরাজ,

মজনু মিয়া, মিষ্টু সরকার, শ্রাবণী সেনগুপ্ত, 

রীনা মজুমদার, লীনা রায়,  সম্মিলিতা  দত্ত,

 সুদীপ দাস, রবিনা সরকার, রীতা মোদক,

মহঃ সানোয়ার, সুমন্ত সরকার, তিথি পাল



 

স্মৃতির বিদ্যালয়
বিকাশ দাস ( বিল্টু )

দুপুরের স্নিগ্ধ রোদকে চুম্বন করে আমি একা হাঁটছি শহর কলকাতার পথে। এই শহরের গলিগুলি বড্ড অদ্ভুত। গোলক ধাঁধার মতো। ক'দিন ধরে বিষণ্ণতা ভীষণভাবে ছুঁয়ে ছিল আমায়, এখনও আছে। কিছুই ভালো লাগছে না। কাজ আর কাজ। ব্যস্ততার ঘন্টি যেন লেপ্টে আছে বুকে। এর মাঝে হঠাৎ থমকে গেলাম বেহালার পাশে, একটি স্কুল দেখে। ভুলে গেলাম ব্যস্ততা। ভুলে গেলাম এন.ডি. এ, ই ন্ডি য়া। দিদি-মোদি। দেখলাম একদল স্নিগ্ধ শিশু রাস্তা পার হচ্ছে দল বেঁধে। কাঁধে ব্যাগ। ইউনিফর্ম। জানিনা মন কেন এত অবুঝ। সবুজ হয়ে উঠলো বুক। আমি ডুব দিলাম স্মৃতির ঘরে।

এখন আমি স্মৃতির বারান্দায়। পায়চারি করছি।ক্যানভাস জুড়ে মিঠে রোদ্দুরের আলো। আমি সেই আলোতে বসে ছোট্ট খোকা পড়ছি ' জীবনবিতান ' । অ-আ এর দেশ এক অদ্ভুত ভাল লাগার আবেশ। দিদি পড়াচ্ছেন। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো পড়ে যাচ্ছি লি-ডাবলি। সারা বাড়ি ভরে উঠছে কবুতরে। ওদের ভাষা ভীষণ প্রত্যয়ী। যেন আমার বুকের ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালির স্বর। 

মা ও ঘরে রান্না বসিয়েছেন। আজ সিদ্ধ ভাত হচ্ছে। বাবা গোয়াল থেকে গরু বের করে এখন জাবর কাটছে ঘাসের।  থেকে ভেসে আসা গলায়, কি নরম তীব্র স্বর। 'পড় রে বাবা, পড়.....' 
এরপরেই শোনা সোনা যেত অন্য একটি আকুতি। ' ভাত হইয়া গেছে। খাইয়া ল। স্কুল জাবি।'

আমার স্কুল জীবন শুরু গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। শিশুশিক্ষা কেন্দ্রে। এখান থেকেই আমি জানতে পারি, জলের অপর নাম জীবন। সাতের ঘরের নামতা। এক- এ চন্দ্র, দুই- এ পক্ষ। মনে না পড়ার মতো অনেক কিছুই আছে, তবে মনে রাখার মতোও অনেক। এক চিমটি ঘরে আমাদের চলতো পঠন-পাঠন। নলি বাঁশের বেড়ায় লটকানো ব্ল্যাকবোর্ডে দিদিমনি লিখতেন 'এ ', ' ঐ '.....

আমরাও মন্ত্রমুগ্ধের মতো সমস্বরে বলতে থাকতাম। কচুর পাতা ছিল আমাদের বর্ষার ছাতা। বাড়িতে অভাব আর অভাব। এক প্যান্ট- এ কেটে যেত সারা বছর। বাবা কুলিয়ে উঠতে পারতেন না। এ নিয়ে আমাদের কোনো অভিযোগ ছিল না। মনে পড়ে ' কলার পাতায় দোলায় চামর শিশির ধোয়ায় পা...'






তবে এই সমস্ত সব স্মৃতিকে ছাপিয়ে গেছে আমার হাইস্কুল জীবন। তখন হাফে প্যান্ট থেকে ফুল প্যান্ট- এ উত্তীর্ণ হওয়ার বয়স আমাদের। বাড়ি থেকে স্কুল যথেষ্ট দূরে আমাদের। মনে আছে এডমিশন টেস্ট দিতে দাদা নিয়ে গেছিল আমায়। সেদিনই পরীক্ষা গোয়েছিল।  ৫০ -এ ২৮ পেয়ে ১৩ নাম্বারে স্থান পেয়েছিলাম। এরপর যথেষ্ট বকুনি খেতে হয়েছিল আমায়।

আমার সেই প্রাণের বিদ্যালয়টির নাম 'শিবপুর হাই স্কুল'। আমার মরমিয়া স্বরের সাথে ঢেউ তোলে আমায়। আমিও পুলকিত হই গভীর ভাবে। শুনেছি বহু পুরানো এই স্কুল। তথ্য নথি থেকে জানা যায় বৃটিশ কাউন্সিল এর একটি ইংলিশ মাধ্যমের স্কুল। স্বর্গীয় কপিল উদ্দিন মিঞার প্রামাণ্য দলিল সে কথাই বলে। এই বিষয়ে বিস্তারিত একদিন বলব। 








নলি বাঁশের বেড়া তখন উঠে গেছে। স্কুলটির মাঝে আড়াআড়ি ভাবে ছিল এক সাইজের বিল্ডিং। যে আমগাছ দুটো রয়েছে তার পশ্চিম দিক বরাবর। এই এক নাগাড়ে ঘরগুলি ক্রমান্বয়ে ছিল বিভিন্ন শ্রেনীকক্ষ। সময়ের সাথে নিজেকে সাবলীল করে তুলেছি ততদিনে। হাসান স্যার বাংলা পড়াতেন। আর এক স্যার প্রিয় নজরুল। ওনার সান্নিধ্য তখনও পাইনি সেভাবে। কিন্তু স্কুলের আকাশে বাতাসে আজও তার নাম ভাসে।

গুটিগুটি পায়ে বড় হতে থাকলাম আমরা। নরম ঘাসের বাগিচায় হাঁটতে চলা শুরু। স্যারদের আন্তরিকতায় জীবনকে পাওয়ার এ এক অন্য অধ্যায়। 

আর এক জনকে ভীষন করে মনে পড়ে। তিনি ছিলেন বলেই, আজ আমি নিজেকে নিজের মতো চিনতে পেরেছি। শুধুই অর্থই কি মানুষ হতে সাহায্য করে। উত্তর যদি বলা হয়। বলব না। একটি সরকারি চাকরি কখনও একটি বড় মানুষের উর্ধ্বে হতে পারে না। কতটা বড় মানুষ হতে পেরেছি, এর বাইরে যার কাছ থেকে মানুষ হওয়ার মন্ত্র শিখেছি। তিনি হেডস্যার। রুপম সাহা। রাশভারী, গুরুগম্ভীর মানুষটির সাথে আজও আমার বিচ্ছেদ- এর গল্পটি লেখা হয়ে আছে। কোনদিন যদি আত্মজীবনী লেখার মতো সময় আসে। লিখব। 



 
সময়ের নাও তরতর করে বয়ে চলে। মানসাই ধরলার পূবালী সঙ্গীত গায়ে মেখে আমরা গায়ক হয়ে উঠেছি। জীবন যুদ্ধের গায়করা এমনই। এখন কে কোথায় বাজনা বাজাচ্ছে, জীবনকে সাজাচ্ছে খবর নেওয়া হয়না। যাইহোক, ষষ্ঠ শ্রেণীতে দ্বিতীয় হওয়ার পর, নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। শুরু হয় কঠিন অধ্যাবসায়। তখনও কোন গৃহশিক্ষক ছিল না। স্যারদের পড়ানোতেই হয়ে যেত সব। আজও ফিকে হায়নি কোনো তারা। স্মৃতির মণিকোঠায় জ্বলজ্বল করে জ্বলছে নীরদ স্যার, ললিত স্যারদের ক্লাস। মৌসুমী ম্যাম যখন পড়াতেন, যেন কোনো মা আমাদের খাইয়ে দিচ্ছেন সুগন্ধি চালের ভাত। কবিতা কি? জানতে পারি মন্টু বাবুর পড়ায়। সুব্রত স্যার, রতন স্যার, ভাস্কর স্যার লায়েক স্যার, বরেন স্যার, দেবাশিস স্যার। তখনকার সময়ের তরুণ তুর্কি। আজ অনেকেই অন্য স্কুলে আছেন। যোগাযোগ আছে কয়েকজনের সাথে। বন্ধুবৎসল। আপন করে নেওয়ার প্রবণতা ছিল ওনাদের। কাজেই উত্তরণ ঠেকাতে পারেনি স্কুলের। আমিও এরপর প্রতিটি পরীক্ষায় প্রথম হতে থাকি। একটি গ্রামীণ স্কুল অল্প সময়ে এভাবেই সেজে উঠলো তরতর করে। বিভিন্ন অনুষ্ঠান, কর্মসূচির মধ্যে দিয়েও উজ্বল হতে থাকলো তার গতি। প্রতি বছর রেজাল্ট হতে থাকল। স্টার পেতে থাকলো। সেই সময় স্টার ছিল, সত্যিই স্টার। 







এখন স্কুল প্রাঙ্গণ ছেয়ে আছে কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়ায়। জারুল এর শোভায় মুগ্ধকর উঠোন। সবটাই প্রিয় হেড স্যারের সৌজন্য। 

আজ ক'মাস হলো স্যার অবসর নিয়েছেন। দেখা হয়নি আর। আমিও পারি জমিয়েছি শহর কলকাতায়। আজ কেন জানি কচিকাঁচাদের দেখে মন কেমন করে উঠলো বুক। অজান্তে চোখে জল এলো। ভালো থাকুক আমার স্মৃতির বিদ্যালয়...


 

বিদ্যালয়ের স্মৃতি 

পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় 

পৃথিবীর পাঠশালায় আজও আমি ছাত্র।  প্রতিনিয়তই নতুন নতুন বিষয়  কিছু না কিছু শিখে চলেছি। শাস্ত্রে বর্ণিত আছে যিনি জন্ম দিয়ে থাকেন তিনি যেমন পিতা, যিনি শিক্ষা দিয়ে শিক্ষিত করে তোলেন, তিনিও পিতার সমান। আমার এই গুরুপ্রণামে, সেই সকল শিক্ষকদের আভূমি প্রণাম জানাই। 

 একজন সম্পূর্ণ ছাত্র হয়ে ওঠার পিছনে যাঁদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে, তাদের তালিকাটা নেহাৎই কোন অংশে কম নয়।  পিছনে ফিরে তাকিয়ে অতীতের দরজায় কড়া নাড়লে সর্বপ্রথম যে স্মৃতি মনকে নাড়া দেয় তা হল ছাত্রজীবন।আমরা স্কুলের পিছনের পাড়ায় থাকতাম, তাই পিছন দিক থেকে স্কুলে প্রবেশ করতাম। কিন্তু যারা বেড়গুম বাজারে বাস স্ট্যান্ড হয়ে স্কুলে আসতো বা মাস্টার মশাই, দিদিমণি যাঁরা হাবড়া,অশোকনগর কিম্বা গোবরডাঙা, মছলন্দপুর হয়ে আসতেন তারা প্রবেশপথে দেখতেন প্রকান্ড খেলার মাঠ। আর তার উল্টো দিকে পর পর দুটো স্কুল বিল্ডিং। ডান হাতে প্রাথমিক বিদ্যালয় আর বাঁহাতে উচ্চ বিদ্যালয়।  প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গা ঘেঁষে  তিনটে টিচার্স কোয়ার্টার। যার  দুটো পরিত্যক্ত অবস্থায় এবং একটাতে থাকতেন সাবিত্রী দিদিমণি ও তাঁর স্বামী সত্যেন বাবু।  বাইরে থেকে আসতেন বাণী দিদিমণি ও মঞ্জু দিদিমণি। এনারা ছিলেন প্রাথমিক শিক্ষিকা। যেবার ক্লাস ফোর পাস করে ফাইভে অর্থাৎ পাশের বিল্ডিংয়ে হাই স্কুলে উঠলাম সেবার পেয়েছিলাম গোপাল মাস্টারমশাইকে। তিনি পড়াবার পাশাপাশি আমাদের গান ও শেখাতেন। বাণী দি এবং মঞ্জু দিদিমণি যতটা স্নেহ ময়ী এবং মাতৃসুলভ ছিলেন, সাবিত্রী দিদিমণি ছিলেন তার উল্টো।  সদাই তাঁর কথায় বার্তায় ছিল ঝাঁঝ। তাঁর কাঁচা কঞ্চির ভয় এবং তার কঞ্চির মৃদু আঘাত কারো পিঠে পড়েনি এমন ঘটনা বিরল। আমার একজন সহপাঠি তাঁর হাত থেকে কঞ্চি কেঁড়ে নিয়ে স্কুল ত্যাগ করেছিল।  পরে তার সাথে আর কখনো স্কুলে দেখা হয় নি। সে তাঁর বাড়ির গরুর জন্য ঘাস কাটতো। ধান ক্ষেতে ছিপ ফেলে মাছ ধরতো। পড়াশোনা না করবার আক্ষেপ কখনোই তাঁর মুখে শুনি নি। সে মাঝে মাঝে সাবিত্রী দিদিমণির কোয়ার্টারের পাশ দিয়ে ঘুরে বেড়াতো। কেন সাবিত্রী  দিদিমণি সবাইকে মারতেন, বকতেন বা এত রাগী ছিলেন, এবিষয়ে আমার প্রতিবেশী এবং স্কুল ছুট সহপাঠী  তার অনুভব ব্যাক্ত করেছিল।  তার সেই অনুভব কখনো অন্য পরিসরে লিখতে চেষ্টা করব। 

তারুন্যে এবং কৈশোরে সব বন্ধুরা যখন আড্ডা মারতাম তখন কোনো কোনো বন্ধু অকপটে একথা স্বীকার করেছে যে প্রায় সবাই বাণী দি র পড়ানো বিষয়গুলো ভালো বুঝতে পারতো। তাঁর পড়াবার ধরনই ছিল আলাদা। বেড়গুম  প্রাথমিক বিদ্যালয়ের  সেই সব সোনালী অতীত  আলো আঁধারীর কোলাজ আমাকে সম্পূর্ণ মানুষ করে গড়ে তুলেছে। সেই অখ্যাত গন্ডগ্রামের মানুষ হয়ে আমার বিশ্বাস সেই সব শ্রেণী কক্ষের মধ্যে যে দিদিমণি,  মাষ্টারমশাইদের স্নেহ ভালোবাসা না পেলে হয়তো জীবনের চলার পথ এতটা মসৃন হতো না।

হাইস্কুলে এসে যে সকল শিক্ষক শিক্ষিকার সান্নিধ্যে এসেছিলাম তাঁরা ছিলেন প্রধান শিক্ষক শঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়,  সহ শিক্ষকরা ছিলেন কার্তিক মন্ডল (যিনি আমাদের শরীর শিক্ষা, পিটি,প্যারেড ও করাতেন), অমিত বসু, অলোকানন্দ হালদার, গৌর মোহন রায়, কণিকা ঘোষ ও দিবা ভট্টাচার্য। 
দিবা ভট্টাচার্য সম্পর্কে আমার পিসি ছিলেন।  আমাদের সংস্কৃত পড়াতেন। তার পড়ানোর ধরন একেবারেই আলাদা ছিল। খুব ভালো করে বোঝাতেন। সবাই দিদিমণি বললেও আমি দিবাপিসিই বলতাম। তার স্নেহ কখনোই মুখে প্রকাশ করতেন না।সেটা ভিতরে ভিতরে ফল্গুধারার মতো প্রবাহিত হতো সেটা প্রতি মুহূর্তে অনুভব করতাম। কখনো জ্বর হলে বা শরীর খারাপ হলে ইংরেজি দিদিমণি কনিকা ঘোষ কে সাথে নিয়ে ফল, হরলিক্স নিয়ে বাড়িতে চলে আসতেন। তিনি পরীক্ষায় আমাকে মেপে নম্বর দিতেন। কিন্তু মাধ্যমিক পরীক্ষায় আমি সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিলাম।

দিবা ভট্টাচার্য অত্যন্ত সুন্দরী ছিলেন। চশমার আড়ালে তার উজ্জ্বল বুদ্ধিদিপ্ত চোখ আমাদের সংস্কৃত শিক্ষার প্রতি উৎসাহ যোগাতো।আমার পিসি বলে নয়, তিনি ছিলেন অত্যন্ত স্নেহময়ী। একজন আদর্শ শিক্ষিকার যাবতীয় গুণাবলী  সব তার মধ্যে বিরাজমান ছিল। অত্যন্ত ভদ্র এবং রুচিসম্মত ছিল তাঁর ব্যাবহার।  পড়ানোর পাশাপাশি তিনি ছাত্রীদের শেখাতেন আধুনিকতা। সেই যাপন শিক্ষা আজ ক'জন শিক্ষিকা দিয়ে থাকেন সে বিষয়ে আমার মনে প্রশ্ন আজও রয়ে গেছে।

খুবই সাধারণ ভাবে বিদ্যালয়ে আসতেন অমিত বসু। সব বিষয়েই ছিল তার অগাধ জ্ঞান।  গোবরডাঙা যমুনা নদীর ব্রীজের আগেই থাকতেন। কোনো কোনো দিন  সাইকেল নিয়েই স্কুলে চলে আসতেন।  প্রথম প্রথম কথা বলতে ভয় হতো।  তিনি নিজের জীবনের কথা কখনো কখনো বলতেন।  আর সবাই যখন বাসে করে স্কুলে আসতেন, তিনি কেন সাইকেল নিয়ে আসছেন জানতে চেয়েছিলাম।  তিনি বলতেন প্রদীপ জ্বালবার আগে সলতে পাকানো বড়ো জরুরি। সাইকেল নিয়ে আসবার পথে তিনি সলতে পাকাতেন।  রীতিমতো হোম ওয়ার্ক করে আসতেন এবং গোটা রাস্তাটা তিনি ভাবতেন ক্লাসে কোন কোন বিষয় কিভাবে পড়াবেন।
অংকের মাষ্টারমশাই ছিলেন গৌর রায়। অত্যন্ত কড়া ভাষায় কথা বলতেন। তিনি গ্রামেই থাকতেন। তাঁকে আমরা কেউই খুশি করতে পারি নি।কোন সহপাঠী কখনো চল্লিশ নম্বরের বেশি পায়নি,  যেখানে আমরা ইংরেজি, জীবন বিজ্ঞান, ভুগোল ইত্যাদি বিষয়ে নব্বই এর ঘরে নম্বর পেতাম।

যার কথা না বললে স্মৃতিচারণ অসম্পূর্ণ থাকবে তিনি কণিকা ঘোষ। সব থেকে উল্লেখযোগ্য ছিল তার ভাষার সৌন্দর্য্য। তিনি বকা দিলেও সেটা ছিল সুন্দর। উঁচু ক্লাসে উঠে সে আমাদের বন্ধুসুলভ আচরণ করতেন। তার পড়ানোর পদ্ধতি অনুসরণ করলে শিক্ষা ব্যবস্থায় আমুল পরিবর্তন আসতে পারে। কলেজ জীবনে অধ্যাপক নিত্যানন্দ স্যার পড়াতেন মুদালিয়া কমিশণ। অমায়িক ছিল তার ব্যবহার। তার কথা কখনোই ভুলতে পারব না। কণিকা দি মুদালিয়া কমিশনে উল্লিখিত পদ্ধতি অনুসরণ করতেন, সেকথা বড়ো হয়ে বুঝতে পেরেছি।

কর্মসুত্রে দিল্লিতে এবং উত্তর বঙ্গে থাকলেও বছরে দু'একবার গ্রামের বাড়ি, শ্বশুর বাড়ি ও কোলকাতা বাংলা একাডেমিতে কবিতা পাঠ করতে যাই। প্রতিবারই স্কুলের সামনে দাঁড়াই, স্কুলের ছবি তুলি আর আমার মেজদা অমিত বন্দ্যোপাধ্যায় ( যিনিও বেড়গুম উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তনী) তাঁর সাথে স্কুলের খবরাখবর নিই।মেজদা অনেক মাষ্টারমশাই বা দিদিমণিদের সাথে যোগাযোগ  রাখতে সক্ষম হয়েছে।  বিশেষ  করে কনিকা ঘোষ, যিনি বিদ্যালয়ের সব থেকে জনপ্রিয় শিক্ষিকা ছিলেন তাঁর বিষয়ে খোঁজ খবর রাখেন। মাষ্টারমশাইদের মধ্যে দু'এক জন চলে গেছেন না ফেরার দেশে। বাকি শিক্ষকরা সবাই নতুন, তাঁদের সবাই স্যার। সেই স্যারেদের ভিড়ে আমাদের প্রিয় মাষ্টারমশাইরা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। 

বিদ্যালয়ে তিনজন অশিক্ষক কর্মচারী ছিলেন। তারা হলেন, অজিত ঘোষ, গৌরাঙ্গ রায় এবং অন্নপূর্ণা দি । তাদের  সবাই আমাদের খুবই ভালোবাসতেন। অজিত ঘোষ নিয়মিত মদ্যপান করতো।  তার চোখ সব সময় লাল থাকত। তার কারনেই এই মদ শব্দটা কি এবং কতটা ক্ষতিকর তা শিখেছিলাম।

মাত্র হাতেগোনা নয় দশ জন শিক্ষক, শিক্ষিকা ছিলেন। আমরা ছাত্ররা সংখ্যায় ছিলাম সব শ্রেণী মিলিয়ে প্রায় চার 'শ। স্কুল ছিল জমজমাট, তখন মিড ডে মিল চালু ছিল না।  এখন মিড ডে মিল প্রবর্তিত হয়েছে। কিন্তু অনেক স্কুলেরই গড় ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যা পঞ্চাশ জন।  

ঘটনাচক্রে এবং  সৌভাগ্যক্রমে একবার আমার বিদ্যালয়ে  ডেপুটেশন ভ্যাকান্সি তে শিক্ষকতা করবার সুযোগ এসেছিল। ঠিক তখনই আমার দিল্লি যাওয়ার ডাক আসে। বাড়িতে সকলের অমতেই সেই ডাকে সাড়া দিয়ে নতুন দিল্লির তালকাটোরা স্টেডিয়ামে প্রায় দুমাসের প্রশিক্ষণ শিবিরে অংশ গ্রহণ করি। জীবন অন্যখাতে প্রবাহিত হয়। তা না হলে হয়তো এই জীবনস্মৃতি অন্য ভাবে লেখা হতো।

বিদ্যালয়ের প্রাক্তনীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল প্রদীপ সরকার, স্বপন রায়, কল্পনা হালদার, চঞ্চল ঘোষ, প্রদীপ ঘোষ,পরিতোষ হাজরা,নাসিম বানু, নারায়ণ বিশ্বাস,শান্তি চ্যাটার্জি, গৌরী সরকার,  জয়দেব বিশ্বাস, সান্ত্বনা ঘোষ তারা সবাই স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত।  প্রদীপ সরকার  স্বপন রায় ও জয়দেব বিশ্বাস আজ না ফেরার দেশে। 

আজও কোনো নির্জন দুপুরে একাকী পিছনে ফিরে তাকালে বেড়গুম উচ্চ বিদ্যালয়ের বড়ো খেলার মাঠটা বড়ো টানে। মাঠের পাশে একটা জলাভূমিতে ফুটে থাকত শালুক ফুল। স্কুলের পিছনের প্রকান্ড বাবলাগাছ হাওয়ায় দুলছে  আর ঠিক তার পাশেই একটা কুল ভর্তি কুলগাছ, শুনতে পাই কেউ যেন ভারি মিষ্টি করে বলছে, 

"Shall I repeat,  or start again.,..? "


 

অন্যরকম

শ্রাবনী সেনগুপ্ত 


আমার পুঁথিগত বিদ্যার সঙ্গে পরিচয় হয় পাড়ার ইস্কুলে।সেখানে দুইবছর পড়ার পর বাড়ি থেকে গোটা তিনেক স্টপেজ দূরের একটি খৃষ্টান মিশনারী স্কুলে প্রথম এবং দ্বিতীয় শ্রেণী ।তারপর একদিন ভর্তির পরীক্ষা দিতে গেলাম একটি অন্যধারার  বিদ্যালয়ে বাবার হাত ধরে এবং ভর্তি হয়েও গেলাম তৃতীয় শ্রেণীতে। মনে পড়ে,প্রথম দিনই অবাক হয়েছিলাম যখন দেখেছিলাম যে,মাঠে প্রেয়ারের পর দিদিমনিরা একেকটি লাইনকে একেকটি ফুলের নাম ধরে ডাকছেন ,আর সেই লাইনটি এগিয়ে যাচ্ছে স্কুলবাড়ির দিকে।আমি আর আমার এক বান্ধবী একসঙ্গে ভর্তি হয়েছিলাম,এবং দুইজনেই প্রেয়ার লাইনে স্যুটকেস রেখে চলে যাচ্ছিলাম,আর আমাদের দুইজনের বাবা ই দূর থেকে হাত দিয়ে ইশারা করে স্যুটকেস নিতে বলছিলেন।আজ,এতো বছর পরেও যেন সব ষ্পষ্ট চোখের সামনে দেখতে পাই।আমার সেই বান্ধবী,আজ বেশ কয়েক বছর হল পাড়ি দিয়েছে অন্য জগতে।
          যত দিন যেতে লাগল ততই বুঝতে পারছিলাম,এই বিদ্যালয়ের শিক্ষা দেবার পদ্ধতি একদম আলাদা।বিশিষ্ট ঐতিহাসিক চিন্ময় সেহেলেনবিশ এর স্ত্রী শিক্ষয়িত্রী উমা সেহেলনবিশ,অক্সফোর্ড এর ট্রাইপোস লক্ষীদি,সত্যজিৎ রায়,উৎপল দত্ত  এঁদের প্রচেষ্টায় এক অন্য ঘরানার বিদ্যালয় পাঠভবন ।
এখানে আমরা পড়াশোনার পাশাপাশি অনায়াসে পাঠ পেতাম মূল্যবোধের।মনে পড়ে,তখন পড়তাম তৃতীয় শ্রেণীতে,ক্লাস চলাকালীন দিদিমনি(আমরা মিস্ বলতাম) বললেন নীচে যেতে, বটুকদা (জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র)
এসেছেন,আগে ওঁর সান্নিধ্য পাওয়া,তারপর আবার ক্লাসে ফেরা।এখন বুঝি,কি অসামান্য ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্য পেয়েছিলাম,উনি আমাদের শেখাতেন ' আমাদের পাঠভবন ' গানটি।গানটি এইরকম - "আমাদের পাঠভবন 
                 আমাদের পাঠভবন
                 শিক্ষা ও দীক্ষায়
                 জ্ঞানে বিজ্ঞানে হেথা
                  নব পাঠ করেছি গ্রহণ"।
একবার তখন চতুর্থ শ্রেণী ,তখন আমাদের ক্লাসরুম থেকে এক একজনের ডাক পড়ল গান শেখানোর ঘরে,যেখানে থাকত একটি পিয়ানো।
সেই পিয়ানো বাজিয়ে গান শেখানো হত আমাদের । সেই ঘরে গিয়ে দেখলাম,অনেকগুলি টুকরো টুকরো ছিট কাপড়কে একসাথে সেলাই করে অনেক বড় একটা চাদর বানানো হচ্ছে,যে যখন সময় পাচ্ছে,বা পাচ্ছেন,গিয়ে সেলাই করে জুড়ে দিচ্ছেন একেকটা টুকরো।এই ছাত্র ছাত্রী এবং দিদিমনিদের  হাতে তৈরী করা বড় চাদরটি
 দেওয়া হবে মাদার টেরিজার আশ্রমে ।আমাদের বিদ্যালয়ে কি সুন্দর গান,গল্পের মধ্যে দিয়ে সহজ করে শিক্ষা দেওয়া হত।আরেকবারের আরেকটি ঘটনা মনে খুব দাগ কেটে গিয়েছিল - আমার তখন তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণী,আমার এক বন্ধু,আরেকজনের মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিল,তখন লক্ষী মিস্ ক্লাসে এসে বলেছিলেন যে,বল কে মাথা ফাটিয়েছ,অন্যায় করলে স্বীকার করতে শেখ,তখন যেই বন্ধু মাথা ফাটিয়েছিল,সে উঠে দাঁড়িয়ে দোষ স্বীকার করেছিল,তখন লক্ষী মিস্ বলেছিলেন যে,তোমার এই সৎ সাহসের জন্য তোমায় ক্ষমা করে দিলাম,আর কখনো এমন অন্যায় করো না।আমার ওই শিশু বয়সে খুব অবাক লেগেছিল,এখনো অবাক হই,এভাবেও শিক্ষা দেওয়া যায়।
                  প্রাইমারী থেকে যখন সেকেন্ডারি বিদ্যালয়ে উন্নীত হলাম,সেইদিন রেজাল্ট এর সঙ্গে আমাদের পেন্সিল,ইরেজার দেওয়া হয়েছিল।প্রাইমারীতে গান শিখতাম পিয়ানো বাজিয়ে,সেকেন্ডারি তে সংস্পর্শে এলাম সুপূর্ণা মিসের,ঠাকুর পরিবারের ।এইরকম সংগীতশিল্পীর কাছে গান শেখা, ভাবাই যায়না। কত কত রবীন্দ্রনাথের গান যে গলায় তুলিয়ে দিয়েছিলেন,আর ছিলেন সুকেশদা।অজয়দা,আলো মিসের বাংলা ক্লাস কোনোদিন ভোলার নয়।আলো মিস্ আমাদের নিয়ে গিয়েছিলেন 'সাউন্ড অফ মিউজিক ' দেখাতে,ওই যে ভালবাসা ,মুগ্ধতা চারিয়ে গেল মনের গভীরে,আজও তা অটুট।' সাউন্ড অফ মিউজিক ' এর উৎসস্থল খুব টানে আমায়, স্বপ্নের মতন। বুদ্ধদেব গুহর 'খেলা যখন '
পড়ে আমরা গিয়েছিলাম আলো মিসকে অনেক সাহস সঞ্চয় করে জিজ্ঞেস করতে যে,ওই বইতে উল্লিখিত আলো দত্ত কি উনিই?ইন্দিরা গান্ধীকে যেদিন হত্যা করা হয় সেদিন উনি পাবলিক বাসে স্কুল ফেরত অসুবিধায় পরা দুটি ছেলে মেয়েকে নিজের বাড়ি নিয়ে গিয়ে পরে ওদেরকে নিজেদের বাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।অজয়দার খুব ব্যক্তিত্ব ছিল,ধুতি পাঞ্জাবি পরে আসতেন।ওঁকে অবশ্য খুব বেশিদিন পাইনি, পরে অন্য কোথাও চলে গিয়েছিলেন।মনে পড়ে মৈত্রেয়ী দি আসতেন 
স্কুটার চালিয়ে,গায়ে থাকত সাদা অ্যাপ্রন,পড়াতেন জীবন বিজ্ঞান।উচ্চ মাধ্যমিকে অঙ্ক পড়াতেন পিনাকিদা,যাঁর জ্ঞান,যোগ্যতা কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসরের থেকে কম নয়,উনি পারমিউটেশন কম্বিনেশন পড়ানোর শুরু করেছিলেন ব্ল্যাক বোর্ডে কয়েকটি আপেল একে - রবীন্দ্রনাথ খুব আপেল খেতে ভালবাসতেন বলতে বলতে।এইরকম ছিল আমাদের পড়াশোনা।
                    যখন নবম শ্রেণী,শান্তিনিকেতন নিয়ে গিয়েছিল আমাদের ইস্কুল থেকে।আমাদের সঙ্গে গিয়েছিলেন সুমিত্রা নারায়ণ(শ্যাম বেনেগালের বোন),ওঁর মেয়ে বনিদি তখন শান্তিনিকেতনের হোস্টেল এ থাকত।মনে আছে,উনি মেয়ের জন্য কতরকমের শুকনো খাবার করে নিয়ে গিয়েছিলেন ।আমরা,মেয়েরা গিয়েছিলাম হোস্টেলে,আর মেয়েদের হোস্টেল 
বলে ছেলেরা প্রবেশাধিকার পায়নি,তাই ওরা বাইরে বেশি করে চপ খেয়ে নিয়েছিল, আর তার টাকা দিয়েছিলেন দিদিমনিরা।খুব ভাল লেগেছিল,সেই শান্তিনিকেতন প্রথম যাওয়া,তারপর সে হয়ে উঠল সব থেকে আপন।আমাদের এক বন্ধুর দাদুর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের চিঠির আদানপ্রদান ছিল,তাই ও সেই চিঠির ঘরে(উদয়ন এ)ঢুকতে পেরেছিল।আমরা স্কুল থেকে গিয়েছিলাম গুরুসদয় দত্তর ব্রতচারী মিউজিয়াম এ।আজ অবশ্য তার কাছাকাছি আমার বাস,যদিও মিউজিয়াম বন্ধ হয়ে গেছে।
                  পাঠভবনের আরেকটি বিশেষত্ব হল গরমের আর পূজোর ছুটির আগে সাহিত্য সভা।মনে পড়ে আমরা একাদশ শ্রেণীতে পড়ার সময় করেছিলাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ' ঘাটের কথা '
আরো ছোটবেলায় দাদার ধুতি পাঞ্জাবি পরে অমল ও দইওয়ালার দইওয়ালা হয়েছিলাম ।তাছাড়া কবিতা,নাটক,গান, পাঠ সবই হত।আমাদের বিদ্যালয়ে মাতৃ ভাষায় দক্ষতা অর্জনের উপর খুব গুরুত্ব দেওয়া হত ,মাতৃ ভাষায় দখল থাকলে অন্য ভাষাও আয়ত্বে আসবে,এইটি বিশ্বাস করা হত ।কথাটি ভীষণভাবে সত্যি, তা নিজের জীবন দিয়ে উপলব্ধি করেছি।টেক্সট বই পড়ে,নিজের ভাষায় লেখার উপর জোর দেওয়া হত ।ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত সব বিষয় পড়ানো হত ইংরেজিতে,তারপর  বিদ্যালয় থেকেই ঠিক করে দেওয়া হত কে বাংলা মাধ্যমে পড়বে,কে ইংরেজি মাধ্যমে।এখন অবশ্য পাঠভবনে  আর বাংলা মাধ্যম নেই। তবে কিছু বই ইংরেজিতে পড়ানো হত,যেমন ইতিহাসে রোমিলা থাপার।আমরা পেন ব্যবহার করেছি ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে,তার আগে পেন্সিল।প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই আঁকার উপরেও জোর দেওয়া হত ,কোনো লেখা লিখলে,তার সঙ্গে আঁকা আবশ্যিক।গরমের ছুটিতে বাড়ির কাজ ছিল-সেই ছুটিতে কি কি করেছি,বা কোথায় বেড়াতে গেছি সব লেখা ও আঁকায় খাতা ভরানো। ডায়েরি লেখা ছিল আবশ্যিক।মা বলতেন,কোনোদিন কোনো কবিতা বাড়িতে মুখস্ত করাতে আরেকটি বিশেষ উপকারী বিষয় ছিল হাতের লেখা,এবং শ্রুতিলিখন,যা অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত আমাদের করতে হয়েছিল।তার জন্য স্টার পাওয়া যেত।শিক্ষক শিক্ষিকারা বলতেন,উচ্চারণ শুনে বানান লিখতে, যে জন্য আজও কোনো অচেনা শব্দের(ইংরেজি,বা বাংলা)সঠিক বানান লিখতে পারি উচ্চারণ শুনে।লাইব্রেরি ক্লাসের কথা খুব মনে পড়ে। লাইব্রেরিয়ান বন্দনা মিস্ বলতেন যে , বইয়ের ধুলো ঝাড়ো, হয় তবেতো বই এর সঙ্গে বন্ধুতা হবে। ভৌতবিজ্ঞানের স্বনামধন্য শিক্ষক তীর্থঙ্কর দা,দীপঙ্কর দা ,রসায়নের সমীরদা,অংকের শঙ্কর দা ,ঈশিতা দি,শকুন্তলা দি সবার কথা খুব মনে পরে।মনে পড়ে ভামতিদির ফেয়ারওয়েলের দিন
শ্রমনা গুহঠাকুরতার গানের কথা।
          সত্যজিত রায়ের অনেক সিনেমাতে আমাদের বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের দেখা গেছে।যেমন সোনার কেল্লার কুশল,ফটিকচাঁদ এর রাজীব(আমার ক্লাস মেট),তোপসে অর্থাৎ সিদ্ধার্থ,ঘরে বাইরের শুটিং চলাকালীন আমাদের বন্ধুরা সব স্কুলবাসে করে ইন্দ্রপুরী স্টুডিওতে নামত। সত্যজিৎ রায়ের জন্মদিনের দিন তাঁর বয়সের সমপরিমাণ মোমবাতি পাঠানো হত ।শ্রদ্ধেয় অনুপ ঘোষালের বাবা ছিলেন আমাদের বিদ্যালয়ের করণিক । আমাদের স্কুলবাসের নটবরদা, অচিন্ত্য দা,বাবলুদা এঁদের দায়িত্ববোধের কথা না বললেই নয়।একবার হয়েছিল কি,স্কুল বাসের জন্য অপেক্ষা করছি, বাস আর আসেনা,হঠাৎ আমি দেখতে পেলাম নটবর দা একটা ট্যাক্সি নিয়ে এসে আমায় একটু দূর থেকে আমায় ইশারায় ডাকছেন।আমিতো ছুটে ট্যাক্সিতে উঠে গেছি।এদিকে মা খুব ভয় পেয়ে গেছেন, নটবরদার সারা মুখে ছিল বসন্তের দাগ,মা তো ওঁকে কোনোদিন দেখেননি,তাই ভেবেছিলেন যে,মেয়ে হারিয়ে গেছে।সে এক কাণ্ড হয়েছিল বটে।
                 এইভাবেই গতানুগতিকতার বাইরে গিয়ে এক অন্যরকম আবহে শিক্ষাপ্রাপ্ত হয়েছি।
মার খাওয়াতো দূরস্থান, বকাও সেভাবে খেয়েছি বলে মনে পরেনা, ভুলগুলি শুধরে দেওয়া হত খুব স্নেহমিশ্রিত শাসনের মধ্যে দিয়ে।চক্ষুদান মহান দান তা আমাদের শেখানো হয়েছিল,এবং বাড়ির সবাইকে বোঝাতে বলা হয়েছিল।পেন্সিল কল দিয়ে কেটে সেইটি স্কুলের মেঝেতে না ফেলে নির্দিষ্ট ডাস্টবিনে ফেলা,আশেপাশে নোংরা না করা,এইসব শিক্ষাও স্কুল থেকেই।আর একটি বিষয়ের উপর খুব জোর দেওয়া হত ,সেটি হল,সবসময় বইয়ের সঙ্গে খাতা,পেন,পেন্সিল বের করা।শিক্ষক শিক্ষিকারা যখন পড়াতেন তখন যাতে মনোযোগ বিক্ষিপ্ত না হয়, তারজন্য তাঁদের কিছু কিছু বলা নোট করে নেওয়া,এই রানিং নোটস নেওয়া আমায় পরবর্তীতে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে খুব সাহায্য করেছে।আমাদের শিক্ষক শিক্ষিকারা বলতেন সোজা হয়ে বসে পুরো মনোযোগ দিতে,মাইন্ড বডি কোঅর্ডিনেশনের উপর খুব জোর দিতেন।আরো বলতেন সামনে একটি ঘড়ি নিয়ে পড়তে বসতে,নিজে ধীরে ধীরে পড়ার জায়গায় একটানা বসে পড়ার সময় বাড়াতে।খুব উপকার হয়েছিল,প্রথমে হয়ত দশ মিনিট বসলেই মনে হত একটু উঠি,কিন্তু ধীরে ধীরে তা অনেকক্ষণ ধৈর্য্য ধরে বসে থাকতে সাহায্য করেছিল। কত যে বড় মানুষদের সংস্পর্শে এসেছিলাম,এখন বুঝি, যাঁরা অন্য অনেক লোভনীয় জায়গা ছেড়ে অল্প বা প্রায় বিনা পারিশ্রমিকে উমাদিদের ডাকে শুধু শিক্ষাদানের উদ্যেশ্যে এই বিদ্যালয়ে যোগদান করেছিলেন। আমি নিজের কর্মজগতে ছাত্রছাত্রীদের এইভাবে শেখানোর চেষ্টা করি।


 

আমার বিদ্যালয় : ফিরে দেখা

ঋতুপর্ণা ভট্টাচার্য 


১৯৯১ সাল। উত্তরবঙ্গের কোচবিহার শহরের সবচেয়ে নামী সরকারি মেয়েদের স্কুল সুনীতি একাডেমীতে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় সুযোগ পেয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হলাম আমি। নব্বই দশকের সেই সময়ে মেয়েদের জন্য এই উচ্চবিদ্যালয়টিতে সুযোগ পাওয়া ছিল দারুণ গর্বের ব্যাপার। আজকের লটারি পদ্ধতির বদলে দস্তুরমতো এন্ট্রান্স টেস্ট হত তখন এবং তা নিয়ে উন্মাদনাও ছিল সাংঘাতিক। আমরা যারা বাংলা মাধ্যমের ছাত্রছাত্রী তারা প্রধানত নার্সারি স্কুল হিসেবে পড়াশোনা করতাম সারদা শিশুতীর্থে। সারদা শিশুতীর্থে চতুর্থ শ্রেণি অবধি পড়ার ব্যবস্থা থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অভিভাবকরা দ্বিতীয় শ্রেণির পরেই তাঁদের মেয়েদের সুনীতি একাডেমীর প্রবেশিকা পরীক্ষায় বসাতেন, নয়তো, পুনরায় পঞ্চম শ্রেণির প্রবেশিকা দিয়ে ওই স্কুলে ঢোকার ছাড়পত্র পাওয়া যেত। কিন্তু পঞ্চম শ্রেণির প্রবেশিকার আসন সংখ্যা নেহাতই নগণ্য হওয়ায় তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তির চাপ ছিল পাহারপ্রমাণ। দ্বিতীয় শ্রেণির শুরুতেই স্কুল ও বাড়ি দু’তরফেই সেই পরীক্ষার প্রস্তুতি আরম্ভ হত আদাজল খেয়ে এবং একেবারে ফল বেড়োনোর পর তার সমাপ্তি। সৌভাগ্যক্রমে, সারদা শিশুতীর্থ থেকে দ্বিতীয় শ্রেণি সম্পূর্ণ করে তৃতীয় শ্রেণিতে একবারেই সুনীতি একাডেমীতে সুযোগ পেয়েছিলাম আমি এবং তারপর দশ দশটি বছর কেটে গেছিল যেন চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই। প্রায় দুই যুগ পরে এখন ফিরে দেখলে ঠিক যেন একটা অলীক স্বপ্নের মতো মনে ওই সময়টাকে, কী এক আশ্চর্য জাদুবলে আমার আজকের আমিটার জমি কত অনায়াসে নিঃশব্দে তিল তিল করে তৈরি করে চলেছিল যে।

আমাদের স্কুলে প্রথাগত পড়াশোনার পাশাপাশি একজন ছাত্রীর সর্বাত্মক মানসিক এবং চারিত্রিক উন্নতির দিকেও সমান নজর রাখা হত। কঠোর নিয়মানুবর্তিতা আর শৃঙ্খলার বাঁধন যদিও ছিল যথেষ্ট, কিন্তু তার প্রয়োগটা এতই স্বাভাবিক ছিল যে সে বিষয়ক কোনও চাপই অনুভূত হত না। সমস্ত সময়টাই কাটত নিয়ম মেনে, অথচ আনন্দ করে। ফলে নিয়মিত স্কুলে যেতে ভাল লাগত, পড়াশোনাটা হত স্বচ্ছন্দে। সহপাঠীরা সবাই ছিল বন্ধু, পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে অস্বাস্থ্যকর কোনও প্রতিযোগিতা ছিল না, তাই বিদ্যালয়ের একটি মুহুর্তও বোঝা বলে মনে হত না। আমাদের সময়ে শ্রেণির পরীক্ষা হত বছরে দু’বার, ষাণ্মাষিক এবং বার্ষিক। তবে নীচু ক্লাসে কখনও কখনও ষাণ্মাষিক পরীক্ষার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময় অন্তর ক্লাস টেস্ট নিয়ে তার নম্বর যোগ করেও ফল বেড়িয়েছে। তাছাড়া ক্লাসেও নিয়মিত পড়া করে আসতেই হত। ফলে পড়াশোনার অভ্যাসটা শুরু থেকেই হয়ে পড়েছিল নিয়মিত। স্কুলেই এত ভাল পড়ানো হত যে বাইরে আর কোথাও পড়ার দরকার পড়ত না। আমি নিজেই অষ্টম শ্রেণির আগে বাইরে কারুর কাছে পড়িনি, তাও শুধু অঙ্ক বিষয়টাই পড়েছি। আমাদের স্কুলে হাউস সিস্টেম ছিল, মানে স্কুলের সব ছাত্রীকেই ছটির মধ্যে যেকোনও একটি হাউস বা গ্রুপের সদস্য হতে হত। এটা তৃতীয় শ্রেণির ক্লাস শুরুর দিন শ্রেণি শিক্ষিকাই জানিয়ে দিতেন। রাসমণি, গার্গী, নিবেদিতা, লক্ষীবাই, দুর্গাবতী ও মীরাবাই এই ছয়জন মহিয়সী ভারতীয় নারীর নামে হাউসগুলি নামাঙ্কিত ছিল এবং মাথার চুলে বাঁধার ফিতের রঙ দিয়ে এই হাউস চেনা যেত। আমার হাউস ছিল রাসমণি এবং এই হাউসের ফিতের রঙ ছিল সাদা। তৃতীয় শ্রেণির ক্লাস শুরুর দিন আমাদের ক্লাস টিচার নমিতা দিদিমণি সকলের হাউস ঠিক করে দিয়েছিলেন এবং উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে স্কুল ছাড়ার আগে পর্যন্ত আমি এই রাসমণি হাউসেরই সদস্য ছিলাম। 





সুনীতি একাডেমী ১৮৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। কোচবিহার শহরের রূপকার মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ এই বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন এবং তাঁর সহধর্মিণী মহারানি সুনীতিদেবী ছিলেন এই বিদ্যালয়ের মূল চালিকাশক্তি, প্রেরণা ও হৃৎপিণ্ড। বিদ্যালয়ের যাবতীয় খুঁটিনাটি বিষয়ে তাঁর সক্রিয় প্রভাব, নিয়ন্ত্রণ ও যোগদান ছিল নিরন্তর। কোচবিহার রাজপরিবার চরিত্রগত দিক দিয়ে অত্যন্ত আধুনিক, যেকোনরকম সামাজিক গোঁড়ামিবর্জিত এবং খোলামেলা উদারমনোভাবাপন্ন ছিল এবং তার সাথে যুক্ত হয়েছিল তৎকালীন কুসংস্কারাচ্ছন্ন গোঁড়া হিন্দুসমাজের শাসন ছিঁড়ে বেড়িয়ে এসে গড়ে তোলা ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠাতা কেশবচন্দ্র সেনের কন্যা সুনীতিদেবীর বিবাহসূত্রে এই পরিবারে সংযুক্তি। তাই স্বাভাবিকভাবেই এই বিদ্যালয়ে শুধুমাত্র প্রথাগত ডিগ্রিসর্বস্ব একমুখী পড়াশোনা নয়, সার্বিকভাবে ছাত্রীদের চারিত্রিক ও মানসিক গুণগত মানের উন্নতিও প্রথম থেকেই ভীষণভাবে কাম্য ছিল। আমাদের সময়েও বিষয়গত ও ব্যবহারিক পড়াশোনার সাথে সাথে হাউস সিস্টেমের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক নানা গুণের বিকাশসাধনে বিশেষ যত্ন নেওয়ার প্রথা প্রচলিত ছিল। প্রতি শনিবার নিয়ম করে শেষ পিরিয়ডে এই হাউসের আসর বসত ও দিদিমণিদের উপস্থিতিতে হাউসের প্রায় সকলেই নাচ গান আবৃত্তি নাটক বিতর্ক ইত্যাদি কোনও না কোনও বিষয়ে সোৎসাহে যোগদান করত। এছাড়া প্রতি বছর নিয়ম করে স্কুলের বিশাল হলঘরে জমজমাট বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান তো হতই। অন্যান্য অনুষ্ঠানের মধ্যে সরস্বতী পুজো আর স্পোর্টস ছিল অন্যতম। সারা বছর ধরে এই দুটো দিনের অধীর প্রতীক্ষা থাকত আমাদের। এর বাইরে নেতাজীর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষেও খুব বড় করে বেশ ক’দিন ধরে স্কুলে অনুষ্ঠান হয়েছিল মনে পড়ে। শহরের অন্যান্য বহু বিদ্যালয়ের সক্রিয় স্বতঃস্ফূর্ত যোগদানে আলো ঝলমলে ওই সোনার দিনগুলো এখনও কী ভীষণ জীবন্ত হয়ে জেগে আছে মনের মণিকোঠায়।

একটি বিদ্যালয়কে দীর্ঘদিন ধরে সফলভাবে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার পেছনে তার মূল যে চালিকাশক্তি, তা হল তার সুযোগ্য অনন্য সাধারণ শিক্ষিকাবৃন্দ। আমি স্কুলে ঢোকার কয়েক বছর পর থেকেই প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে পেয়েছি ভূপালী দিদিমণিকে। ভূপালী দিদিমণি ইংরাজীর শিক্ষিকা ছিলেন, যদিও স্কুলের প্রশাসনিক ব্যস্ততার চাপে বিশেষ ক্লাস নিতে পারতেন না। ফলে ইংরাজীর ক্লাস সাধারণত নিতেন কনকদি। আমাদের সময় ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে ইংরাজী পড়ার নিয়ম ছিল, ফলে এই বিদেশি ভাষাটা আমাদের শিখতে হয়েছিল খুব দ্রুত। কনকদি এক্ষেত্রে শুধু একজন দারুণ শিক্ষিকাই নন, বিষয়ান্তরে না গিয়েও আশ্চর্য সাবলীলভাবে এমন কিছু অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সোশ্যাল এটিকেট বা সামাজিক আদবকায়দার শিক্ষা দিতেন, যেটা ক্লাস বা বোর্ডের পরীক্ষায় নয়, কিন্তু পরবর্তী জীবনে কাজের ক্ষেত্রে সফট স্কিল আয়ত্ত করতে প্রভূত সাহায্য করেছিল। এর বাইরে শিক্ষিকাদের মধ্যে আর যে একজনের কথা না বললেই নয়, তিনি হলেন আমাদের বাংলার শিক্ষিকা সুমনা দিদিমণি। সুমনাদি সম্ভবত আমাদের চার পাঁচ বছর পড়িয়েছিলেন, কিন্তু সেই সময়ের মধ্যেই বিষয় হিসেবে বাংলার প্রতি এক আশ্চর্য গভীর অনুরাগ সৃষ্টি করিয়ে দিতে পেরেছিলেন যা ব্যক্তিগতভাবে সত্যিই আমার এক চিরকালীন অমূল্য প্রাপ্তি। 

আমি উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে বিদ্যালয় ছেড়েছি ২০০০ সালে। আজ ২০২৪। সেই দশ বছরের স্কুলশিক্ষা তারপরের চব্বিশ বছরের বাস্তব জীবনে ঠিক কতটা প্রভাব ফেলেছে তার চুলচেরা বিচার করতে বসলে আজ কেবলমাত্র একটিই কথা মনে হয়, যেমন ভিত্তি, তেমনই ইমারত। বিদ্যালয় থেকে পাওয়া সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ যে শিক্ষাটি অনেকটা পথ পেরিয়ে এসে আজ আমাকে এই আজকের আমি হয়ে উঠতে সাহায্য করেছে বলে আমি মনে করি, তা হল নিজের জীবনে স্বেচ্ছায় যেকোনও চয়েস বেছে নেওয়ার দুঃসাহসী আত্মবিশ্বাস। চিরকালই আমার পছন্দের বিষয় ছিল বাংলা ইংরাজী এবং অঙ্ক, অর্থাৎ ভাষা ও বিজ্ঞান এই দুই ধারারই মূল বিষয়গুলি। প্রথমে অঙ্ক নিয়ে পড়ে ও পেশাগতভাবে সেই ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন কাজ করলেও একদিন সাহিত্যের জগতে পুরোপুরিভাবে আসার ইচ্ছেটা ছিলই। বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত হঠকারী মনে হলেও নিজের ওপর অসীম বিশ্বাসে ভর করেই শেষমেষ আজ এ জগতে প্রবেশ করেছি আমি, এবং, স্বীকার করতে একবিন্দুও দ্বিধা নেই যে এই সাহসের বীজটুকু কিন্তু লুকিয়ে আছে আমার সেই বালিকাবেলার শিকড়েই, যার অন্তর্নিহিত অসীম শক্তিই নির্ভয় হয়ে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণে আজ আমাকে সাহস জুগিয়েছে। আর, এখানেই বোধ হয় আমার জীবনে আমার বিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় সার্থকতা।


 

স্মৃতির বিদ্যালয়
অনিতা নাগ

আজ যা’কে আগলে নিয়ে বাঁচা,  দিন ফুরোলেই তা স্মৃতি হয়ে যায়। যা ভালোলাগার, ভালোবাসার তাকে আগলে রাখি আপন অন্তরে। জীর্ণ মলিন যা কিছু, তা হারিয়ে যায় কালের নিয়মে।
ছোটবেলায় পাড়ার এক প্রাইমারী স্কুলে বাবা নিয়ে গিয়ে ভর্তি করে দিয়েছিলেন।  উপেন্দ্র বিদ্যাবিথী। একটা একতলা বাড়ীর কয়েকটা ঘরে ক্লাস হতো। পাশেই ছিলো আমার পিসিমার বাড়ী। দাদু রোজ টিফিনের সময় জানলা দিয়ে মুখ বাড়াতেন। দাদুকে দেখেই আমার পেট ব্যথা শুরু হতো। দাদু রোজ আদরের নাতনিকে ছুটি করিয়ে নিয়ে আসতেন। বাড়ীতে রোজ মা'র কাছে বকা খেতাম। মা দাদুকে বোঝানোর চেষ্টা করতেন সবটাই আমার দুষ্টুমি। দাদুকে সে'কথা বিশ্বাস করানো যায় নি। এমনই ভাষা ভাষা কিছু স্মৃতি সেই স্কুলকে ঘিরে। সেই স্কুলের একটা ছবিও নেই আমার কাছে। গুগলেও সেই স্কুলের কোনো চিহ্নও নেই। মনের মাঝে রয়ে গেছে আধা অন্ধকার ক্লাসরুম, বড়দিদিমণি,  দোলা দিদিমণি,টিফিনের ঘন্টা। বার্ষিক অনুষ্ঠানে প্রাইজ নেওয়া! ওই টুকুই। তারপর যাত্রা শুরু নতুন স্কুলে, নতুন আলোয়। সেই আলোয় আজও পথচলা। সেই আলো এতো গভীর যে পথ হারানোর ভয় নেই।  
আমার স্বল্প শিক্ষিতা মা তার স্বপ্ন দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছিলেন এই যাত্রাপথ। মনে আছে সে বছর শহরের তিনটে নামকরা স্কুলে ভর্তির পরীক্ষা দিয়েছিলাম। এই স্কুলের পরীক্ষা ছিলো সবার শেষে। স্কুলে ঢুকেই চমক। বিশাল মাঠ। খেলার জন্য দোলনা, শ্লিপ, আরো কতো কিছু। কতো বড় স্কুল বাড়ী। বড় বড় ঘর।  বড় বড়  জানলা। কতো আলো! কি সুন্দর বসার ডেস্ক।  তাতে ব্যাগ রাখার জায়গা। কি লিখেছিলাম মনে নেই।  তাড়াতাড়ি খাতা জমা দিয়ে মাঠে গিয়ে অনেকক্ষণ খেলা করেছিলাম,  সেটা মনে আছে। আমার বাবা, মা, আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু আশ্চর্য ভাবে তিনটে স্কুলেই ভর্তির পরীক্ষায় পাশ করে গিয়েছিলাম। আমার তো পছন্দ শেষের স্কুলটি।  পাড়ায় খোঁজ নিয়ে জানা গেলো অনেকে এই স্কুলে ভর্তি হচ্ছে। একসাথে আসা যাওয়ার সুবিধা।  সেই প্রথম মেয়ে প্রাইভেট বাসে করে স্কুলে যাবে। সঙ্গী থাকলে নিশ্চিন্ত।  ভর্তি হলাম সেই স্কুলে। যা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি। বাগবাজার বহুমুখী বালিকা বিদ্যালয়। ক্লাস ফোর। সকালে স্কুল। বাড়ীর সামনে থেকে ৩০এ বাসে করে আসা যাওয়া। কালিচরণ ঘোষ রোড থেকে বাগবাজার। দূরত্ব নেহাত কম নয়। সেই প্রথম পাড়ার গন্ডীর বাইরে বেরুনো। মফ কালারের র্স্কাট, সাদা টপ। সাদা মোজা,  কালো জুতো। দুটো কলা বিনুনি। একেবারে টিপটপ। 
নতুন বই হাতে এলে যেমনটা হয়, প্রথমে মলাট দেখে মুগ্ধ।  বারবার নতুন বইয়ের গন্ধ নেওয়া। তারপর একটা করে পাতা উল্টে, উল্টে চমকের পর চমক। এ’ও অনেকটা সেইরকম। বিরাট গেট পেরিয়ে স্কুলে ঢোকা। সামনে অতন্দ্র প্রহরী মহেন্দ্রদা, স্কুলের দ্বাররক্ষক । গেটের পরেই টানা বারান্দা। একপাশে অফিসরুম, বড়দির ঘর, তারপর ক্লাসরুম। ডানদিকে বড় হলঘর। বারান্দার গেট পেরিয়ে মাঠ। মাঠে প্রার্থণা হতো। প্রার্থনায় একেক দিন একেকটা গান হতো। তারপর লাইন করে ক্লাসে যাওয়া। মাঠে কতোরকম খেলার ব্যবস্থা। সিঁড়ি দিয়ে উপরে গিয়ে বারান্দার একদিকে ক্লাসরুম, ল্যাবোরেটরী,কমনরুম। অন্যদিকে টিচার্স রুম, লাইব্রেরি। এতো কিছু স্কুলে থাকে! সেই বিস্ময়ের আবেশ আজো ও রয়ে গেছে মনে। বড় বড় ক্লাসরুম। কতো আলো! সেই  আলো তখন থেকেই ঘিরে আছে আমাকে। অন্ধকারকে বড় ভয় আমার। যেখানে যতো অন্ধকার, সব আলোয় ভরিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। 
সকালের বড়দি ছিলেন পূর্ণিমা দি। আর ছিলেন সীমা মিস, গীতা মিস। দুই বোন। আমাদের সাথে একই বাসে যেতেন দু'জনে।  আর কারুর কথা তেমন করে মনে পড়ে না।  ফাইভ থেকে দুপুরে স্কুল। যখন ক্লাস সিক্স তখন আমরা নতুন বাড়ীতে চলে যাই। একা স্কুল যাওয়া শুরু হয়। দুপুরের বিভাগে গিয়ে পেলাম আমাদের বড়দিকে,   শ্রীমতি অণিমা মুখোপাধ্যায়।  কি যে মানুষ ছিলেন!  ছাত্রীদের জন্য, স্কুলের জন্য নিবেদিত প্রাণ। কোমল, কঠোরের এমন মিশ্রন বড় একটা দেখা যায় না। সৌম্য মূর্তি।  ছোট করে কাটা চুল, সাদা শাড়ী, সাদা ব্লাউজ। এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। দিদির দুই মেয়ে আমাদের স্কুলেই পড়তো। দু'জনেই সিনিয়র। বড়দির মেয়ে বলে কোনো বাড়তি  সুবিধা নিতে দেখিনি। রোজ নিয়ম করে বড়দি সব ক্লাস ঘুরে দেখতেন। উঁচু ক্লাসে বড়দি ইংরাজী পড়াতেন।  সে অভিজ্ঞতা চিরদিনের।  স্কুল মানে কি শুধুই পড়াশোনা?  না, একেবারেই তা নয়। পড়ার সাথে সাথে কতো কিছু যে পেয়েছি,  কতো কিছু যে শিখেছি তার হিসেব নেই।  এই পাওয়া গুলো তখন বোঝার বুদ্ধি ছিলো না। প্রথম শিখেছি সকলকে সম্মান করতে, সকলকে ভালোবাসতে। আজ বুঝি সেটা জীবনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষা।  পড়াশোনার সাথে শিখেছি নাচ, গান, ব্রতচারী, সেলাই আরো কতো কিছু। শিখেছি চরকা কাটতে। শিখেছি ধূপ তৈরী করতে, মোমবাতি তৈরী করতে। অনেক কিছু শিখেছি দেখে দেখে। শিবানীদি কি ভালো আল্পনা দিতেন। প্রতিবছর সরস্বতী পূজোর আগের দিন দিদি গেটের সামনে আল্পনা দিতেন। কোনো অনুষ্ঠান এলেই  ঝর্ণাদি নাচ শেখাতেন। দিদির বিষয় ছিলো ভূগোল। কিন্তু কি ভালো নাচতেন। গাইড  করতাম। ক্যাম্পে যেতাম হৈ হৈ করে। দুষ্টুমিও কম করিনি। আমাদের একটা গ্রুপ ছিলো। সবকিছুতে সবার আগে যাওয়া চাই।  সে প্রজাতন্ত্র দিবসের প্যারেড হোক বা সরস্বতী পূজোর নেমন্তন্ন করতে যাওয়া। বন্ধুদের টিফিন চুরি করে খেয়েছি! বৃষ্টিতে জুতো মোজা ভিজিয়ে রেনি ডে’র আবদার করেছি। বৃষ্টিতে ক্লাসে জানলা দিয়ে জল আসায় কমন রুমে ক্লাস করার আবদার করেছি। এমন কতো কিছু। 





জীবনের অপরাহ্নে এসে নিজের যে একটা স্কুলবেলা আছে তাই তো ভুলতে বসেছিলাম।  নানান সম্পর্কের জালে কোথায় হারিয়ে গেছে জীবনের স্বর্ণালী দিনগুলো। সম্পর্কের নানান রসায়ন মেলাতে মেলাতে নিজেকে খুঁজে দেখার সময় কোথায়! এখন তো তাল মিলিয়ে ছুটে চলা। তবু সেই শিকড় আজো আঁকড়ে বেঁধে রেখেছে। পথ হারাতে দেয় না। আঁধার আসে, বিপদ আসে, হতাশা আসে। জীবন যে বড় জটিল। আজও সব প্রতিকূলতাকে কাটিয়ে উঠার মনের শক্তিটুকু সেই ছোট্টবেলায় পাওয়া। সময়ের সাথে সাথে  হারিয়ে গেছে অনেক কিছু। সেই হারিয়ে যাওয়া স্মৃতির ভীড়ে আলো হয়ে রয়েছে আমার বিদ্যালয়। জীবনের সেই প্রিয় দিনগুলো আজ স্মৃতির অলিন্দে বন্দী। কখনো কোনো দমকা বাতাসে সেই অলিন্দ খুলে যায়। দেখতে পাই দু বিনুনি বাঁধা সেই মেয়েটাকে। হেসে খলখল, গেয়ে কলকল। সবাই মিলে টিফিন খাওয়া। লাইব্রেরিতে গিয়ে ক্লাস সিক্সেই গোগ্রাসে শরৎচন্দ্র পড়া। মনে আছে লাইব্রেরীর শিপ্রাদি কেমন করে সবরকম বই পড়ার অভ্যেস করিয়েছিলেন। এমন অনেক স্মৃতি। ক্লাস ফোর থেকে হায়ার সেকেন্ডারি, জীবনের অনেকটা সময় এই বিদ্যালয়ে কেটেছে। আজো বাগবাজার স্ট্রীট দিয়ে যাওয়ার সময় স্কুল বাড়ীর দিকে অপলক তাকিয়ে থাকি। সেই লম্বা কড়িডোর। সেই আলো ঘেরা ক্লাসরুমের সারি! তবে বদলে গেছে অনেককিছু।  আগের সেই কৌলিন্য আজ অনেকটাই ম্লান। 
যখন মেঘ জমে মনে, দিশাহারা লাগে তখন কানে ভেসে আসে রবিঠাকুরের সুর।  চোখ বন্ধ করলে দেখতে পাই  মাঠের একদিকে সব দিদিরা, অন্যদিকে হাত জোড় করে সকলে গেয়ে চলেছি
 “অমনি করে আমার এ হৃদয় তোমার নামে হোক-না নামময়
আঁধারে মোর তোমার আলোর জয় গভীর হয়ে থাক্ জীবনের কাজে”।।
 
আঁধারকে জয় করার মন্ত্রকে আগলে রাখি বড় সাবধানে।  হঠাৎ দু'চোখে অকাল বর্ষণ নামে। মনে মনে প্রণাম জানাই আমার বিদ্যালয়ের সক্কলকে।


 

স্মৃতির ঘরে বিদ্যালয় 

    রীনা মজুমদার 

স্কুল বেলা জীবনের শ্রেষ্ঠ বেলা। জীবনের শুরু, পড়াশোনার আঁতুড়ঘর প্রাথমিক স্কুল।  বাড়ির কাছেই ফালাকাটা যাদবপল্লী প্রাইমারী স্কুল। 
 বাবা ভর্তি করে দিল ওয়ানে, শুরুর দিনটি সবার কাছেই বিশেষ দিন। বাবা বলেছিল একটা আসন নিয়ে যেতে হবে স্কুলে, ক্লাস টু থেকে ক্লাসরুম। মা একটা বস্তা কেটে সুন্দর চারকোনা আসন বানিয়ে ,সঙ্গে স্লেট পেন্সিল আর দুটো বই নিয়ে,  দুরু দুরু বুকে আর দু'এক জন পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে হেঁটে চলে গেলাম। বিদ্যালয়ের উঠোন জুড়ে বিশাল এক কদম গাছের তলায় ওয়ানের ক্লাস। পাখি উড়ে বসছে, তাকিয়ে আছি, দেখছি, খেলছি বেশ মজাতেই প্রথম দিনটি কেটে গেল। বর্ষায় টপ টপ করে কদম ফুল পড়ত, সেই মজাতে খেলতাম ফুল দিয়ে।
 এখন বুঝি, রোজ তো তাই হয় না!
একদিন একজন মাস্টার মশাই মাথাটা টেনে "অ আ গুলো না লিখলে শেখা হবে!" ভয়ে সেই বোধহয় জীবনের প্রথম শুরু, পড়তে হবে লিখতে হবে।
পরে জেনেছিলাম, তিনিই আমাদের হেড মাস্টার মশাই শ্রী রাধাপদ মাস্টার মশাই। মনে আছে খুব ভালো বাসতেন। 
একটা ঘটনা খুব মনে পড়ে, তখন ক্লাস ফোর, ফাইনাল পরীক্ষা। বাংলা পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফিরেছি। ছোড়দা বলল, একদিন পর তো অংক! অংক করতে ভালই লাগত। বললাম হ্যাঁ, 'নে এই প্রশ্নটা রাতে সবগুলো করবি, দ্যাখ পারিস কিনা! কোনো টা না পারলে বলিস বলে দেব।'
একদিন পর অংক পরীক্ষায় বসে দেখি ছোড়দা যে প্রশ্ন পেপার দিয়েছিল! হুবহু একই।
আসলে আমাদের পাড়ার মানে (সারদা নন্দ পল্লী প্রাইমারি স্কুলেও পরীক্ষা চলছিল। একমাত্র অংক প্রশ্ন পত্রটিই নাকি একই জায়গা থেকে কেনা ছিল। যেদিন বাংলা পরীক্ষা ছিল সেদিন পাড়ার স্কুলে অংক ছিল। ছোড়দা স্কুল থেকে ফেরার সময়, বাচ্চাদের পরীক্ষা হয়ে গেছে দেখে একজনের থেকে চেয়ে নিয়ে আমাকে দিয়ে ছিল জাস্ট প্র্যাকটিস করাতে। ছোড়দাও অবাক! বলেছিল "হাসতে হাসতে পুরো ফুল নম্বর পাবি তো!"
হ্যাঁ পেয়েছিলাম অংকে একশো তে একশো। মনে পড়ে এমন সব সুখস্মৃতি, মজার সব ঘটনা।

এগিয়ে চলাই জীবন। শুরু হবে এবার আরেক স্কুল। ভর্তি করে দেবে বাবা গার্লস হাই স্কুলে।মাঝের কটা দিন মাসি- পিসির বাড়িতে যাব না তাই কখনো হয়! আমাদের সময় তো ফাইনাল পরীক্ষার পর এই আনন্দটাই ছিল সবচেয়ে বড় পাওয়া! 
গিয়েছিলাম পিসির বাড়িতে, দুদিন পরই চলে আসতে হয়েছিল কারণ সেবার থেকেই প্রথম শুরু হল এডমিশন টেস্ট নিয়ে ভর্তি। আবার পরীক্ষা! মন খারাপ হয়ে গেল, বসলাম নতুন স্কুলে পরীক্ষা দিতে। সবার প্রথমে আমার নাম উঠেছে। খুব ভালো লেগেছিল, বাবাও খুব খুশি, মনে পড়ে সে সব সময়ের দিনগুলো। 
একটা করে বছর পেরিয়ে ক্লাসরুম পাল্টে যাওয়া। নতুন নতুন বন্ধু হতে শুরু করল। মনের কথা বলা, টিফিনে ছুটোছুটি আর খেলা সে এক অনন্য সুন্দর মুহূর্ত নিয়ে ধাপে ধাপে এগিয়ে চলার স্কুল বেলা শ্রেষ্ঠ বেলা।
খুব ভালো লাগত, মনে পড়ে মৈত্রী দিদিমণির কথা। অংক ক্লাস নিতেন, অংক পারতাম বলে আমাকে খুব ভালো বাসতেন। আর মনে পড়ে আরতি দিদিমণির কথা.. একবার নাটক হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'ছুটি' মাখনের ভূমিকায় আমি। তখন থেকে আজও আমাকে মাখন বলেই ডাকেন। আমি তখন হয়তো সিক্সে, এক অদ্ভুত কান্ড হয়ে ছিল নাটকের সময়। স্টেজের সামনে যেমন পেছন দিকেও তেমন ভীড় হয়েছিল। নাটক শুরু হয়ে গেছে, মাখনের পার্ট শুরু হবে কিন্তু আমি পোশাক পরে ক্লাসরুম থেকে আরতি দিদিমণির হাত ধরে বেরিয়ে এসে আর তো ভীড়ে স্টেজে ঢুকতে পারছি না! তখন আরতি দিদিমণি আমাকে কোলে নিয়ে উঁচু করে সবার মাথার উপর দিয়ে স্টেজে ঢুকিয়ে দিয়ে ছিলেন। 
এমন সব স্মৃতি বিজড়িত দিনগুলো কেটেছে বিদ্যালয়ে, কোনদিন চেষ্টা করেও মোছা যাবে না। ছিলেন যেমন ভয়ের তেমনই স্নেহময়ী বড়দিদি মণি শ্রীমতী শ্রদ্ধেয়া মায়া বোস।  
পরবর্তীতে ফালাকাটা বয়েজ হাই স্কুলে দুবছর একাদশ দ্বাদশ শ্রেণী। সেখানে পেয়েছি শ্রদ্ধেয় শ্রী নীরদ বরণ রায় হেড স্যারকে। তাঁরা যেন বিদ্যালয় ও ছাত্র- ছাত্রীদের মধ্যে এক ভালোবাসা ও আদর্শের বন্ধন গড়ে তুলতেন। যা আমাদের চলার পথে ঠিক - বেঠিকের হাতে খড়ি দিয়েছেন, যেমন বাড়িতে মা- বাবা।
আর বিদ্যালয় থেকে বন্ধুদের ভালোবাসা ও একে অপরকে নিয়ে পথ চলার মধ্যেও অনেক কিছু শিখেছি। স্কুলে প্রাণ ছিল আনন্দ ছিল।
জীবনের শুরু থেকে বিদ্যালয় আমার কাছে শ্রেষ্ঠ সময়। আজও মনে হয়... প্রাইমারী স্কুলে কদম গাছ আর গার্লস স্কুলে কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে সবাই লাইন করে দাঁড়িয়ে " জন গণ মন অধিনায়ক জয় হে..." 



       স্মৃতির বিদ্যালয়

        বিপ্লব তালুকদার

 

বিদ্যালয়ের স্মৃতিকথা লিখতে বসে জীবনের এই মধ্যগগনে অনেক কিছুই আবছা হয়ে আসে স্বাভাবিকভাবেই, তবু তারমধ্যেই মনের মণিকোঠায় যা কিছু মনিমানিক্য আছে বিদ্যানিকেতনের এবং জীবনের সম্ভবত সবচেয়ে সুখী সময়ের —তারই কিছুটা তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

 

বাবার চাকরিসূত্রে বদলির জন্য আমাদেরও বাবার সঙ্গে জলপাইগুড়ি জেলার বিভিন্ন স্থানে সংসার পাততে হয়, বদল হয় যাপনেরও। কোচবিহারে জন্ম, তারপর ধূপগুড়ি থেকে শুরু করে ফালাকাটা হয়ে শেষমেশ বাপ-ঠাকুর্দার ভিটে ময়নাগুড়িতে এসে থিতু হওয়া কৈশোর ও যৌবনের দোড়গোড়ায়। সেই সূত্রে বিদ্যালয় জীবনের শুরুটা হয়েছিল ধূপগুড়ির বৈরাতিগুড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, এবং সেই সময়পর্ব ছিল অতি স্বল্প। ফলতঃ তার কিছুই আজ আর মনে নেই। যেটুকু মনে আছে,তা খুব একটা গুছিয়ে লেখাও সম্ভব না। আবছা হয়ে সেটুকু বরং ঐ জীবনখাতার প্রথম পাতাগুলোতেই রয়ে যাক।

বদলির নিয়মে আমাদের পরের গন্তব্য ফালাকাটা শহর— তখনও শহরের তকমা সেভাবে তার গায়ে বসেনি। নতুন শহরে এসে প্রথমে ভর্তি হয়েছিলাম পোস্ট-অফিস পাড়ার এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, সেই স্কুল ছিল আমাদের ভাড়াবাড়ির কাছেই। তাই বাবা নিশ্চিন্ত থাকতে সেখানেই ভর্তি করে দেন। সেখানে কিছুদিন থাকার পর ভর্তি হই ফালাকাটা নিম্ন বুনিয়াদি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এইখান থেকে স্কুলজীবন বলতে যে ঘুরনচরকির মতো রঙিন জীবনের একটা গুরুতর অংশ বোঝানো যায়, তার দুরন্ত সূচনাই বলা চলে। আর এখানেই পড়াশোনার পাশাপাশি সখ্যতা তৈরি হয়  আমার বয়সী ছেলেগুলোর সঙ্গে, যাদের আজকের দিনেও ‘বন্ধু’ বলতে আত্মবিশ্বাস স্পষ্ট থাকে গলায়। ওই বিদ্যালয় এবং সেখানে জীবন জুড়ে এতো স্মৃতি ছড়িয়ে আছে ইতিউতি, যে তার সবটা লেখা গেলে বুঝি বা একটা বই হয়েই যায়! প্রসঙ্গত, মাস্টারমশাইদের আমরা ‘দাদা’ বলে সম্বোধন করতাম। সেখানেই পেয়েছিলাম প্রধান শিক্ষক হিসেবে বড়দাকে ( অপরেশ ভৌমিক), পেয়েছি সেজদাকে, পেয়েছি রাঙ্গাদাকে—যিনি রেগে গেলে কপালে চক দিয়ে তিলক কেটে দিতেন। দিদিমণি হিসেবে পেয়েছিলাম শেফালী দিদিমনি ,প্রীতি দিদিমনিকে। প্রত্যেকেই ব্যক্তিত্বে পূর্ণ আর স্নেহশীল,স্নেহশীলা শিক্ষক -শিক্ষিকা হিসেবে আমাদের অভিভাবক -অভিভাবিকাসম। আমাদের জীবন পথের প্রথম কাঁচা মাটির পথ যেন পার করে দিয়েছিলেন স্নেহ -শাসনের মেলবন্ধনে।

 সেখানে প্রাইমারি স্কুল, হাই স্কুল এবং বালিকা বিদ্যালয়— তিনটি স্কুলই ছিলো একদম পাশাপাশি। ঐ যে বলছিলাম, সেসময় দেখা হয়েছিল যাদের সঙ্গে, যাদের এত বছর পরেও বন্ধু বলে বিশ্বাস করি। সেই নামগুলোর মধ্যে রয়েছে শৌভিক, ঋত্বিক,প্রণব, পুটন, বাপির মতো বন্ধুরা। লিখতে বসে মনে পড়ল, একবার কীসের জন্য যেন ইনজেকশন দিতে স্কুলে ডাক্তারবাবুরা এসেছিলেন, সেকথা শুনে আমার তো প্রাণপাখি ওখানেই পারলে খাঁচা ছেড়ে ফুরুৎ! ভয়ে তখন স্কুলেই বইপত্তর ফেলে এক ছুটে সোজা বাড়ি! সেই এক কান্ড! এখানে আরেকটা মজার কথা বলি, আমার মেয়ে যখন স্কুলে পড়ছে , তাদের স্কুলেও কোনো টীকা থুড়ি ইঞ্জেকশন দিতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। সূঁচের ভয়ে কন্যেটি আমার পালানোর পথ না পেয়ে টিফিনের ঘরেই কোন এক অব্যবহৃত ড্রামের ভেতর ঢুকে লুকিয়ে বসেছিল এই খবরে। বাবার যোগ্য উত্তরসূরী বটে— ভেবেছিলাম এই কান্ড শুনে! যাইহোক, অন্য গল্পে যাই। আমাদের সময় মিড-ডে মিল ছিলো না। হঠাৎ হঠাৎ সয়াবিনের খিচুড়ি রান্না হতো, যা ছিল কিনা অমৃতসম। ছিলো না বসবার বেঞ্চ, মাটিতে আসন পেতে বসতাম দল বেঁধে। কিন্তু এইসব তখন অপ্রাপ্তি মনে হয়নি কখনো, বরং স্কুল না যেতে পারলে মন একেবারে অস্থির হয়ে উঠত!

সময় ফুরিয়ে এসে এরপর প্রাইমারি শেষ করে ভর্তি হলাম ফালাকাটা হাই স্কুলে। নবীন কিশোর, নবীন প্রাণের উচ্ছ্বাসে সবকিছুতেই তখন আনন্দে আত্মহারা। হাইস্কুলে পড়াকালীন মজার দিন ছিল বটে একেকখানি। স্কুলের পাশেই বসত মেলা-সার্কাস— আশির দশকের প্রাক্কালে বিনোদনের অন্যতম লোভনীয় বিষয়! স্কুলে গিয়ে চোখ,মন দুটোই পড়ে থাকত সেই সার্কাস বা মেলার মাঠে। অবশ্য খুব বেশিক্ষণ সেই অবস্থা থাকতনা মোটেই! মনোযোগের দাওয়াই ছিলো চন্ডি স্যারের পিটি ক্লাস কিম্বা পন্ডিত স্যারের সেই বেতের ভয়ে আর কিছু না হোক, যতটুকু সম্ভব হিন্দি লেখাটা লিখে রাখা। অফ ক্লাসে, দীপক সার্কাসের জোকাররা কেমন করে হাঁটেন সার্কাস চলাকালীন, তা নিয়ে ক্লাসে আবার সবার প্রতিযোগিতা হতো। আর ফার্স্ট হয়ে রথীন পেতো কাঠপেন্সিল পুরস্কার। ছবিগুলো ভাবলেও বিশ্বাস হয়না, জীবন এতটাই সহজ ছিল! স্কুলের বন্ধুদের সাথে টিফিন ভাগ করে খাওয়ার যে আনন্দটা যেন আজও চোখে ভাসে। আমাদের ছেলেবেলা ম্যাগি-চাউমিন-পাস্তার নয়। সেসবের নাম শুনেইছি কত পরে। বাড়ি থেকে স্টিলের বাক্সে পাঠাতো রুটি-লুচি, চিঁড়ের পোলাও, সুজি, ফলমূল এইসব। তবে হাইস্কুলে পড়বার সুযোগ আর সেখানে বেশিদিন হয়নি, কারণ বাবার আবার বদলি সূত্রে ময়নাগুড়ি চলে আসার খবর এলো। রয়ে গেল প্রাইমারি ও হাই স্কুলের সোনালী রূপালী জীবন, থেকে গেল দিদিমণি-মাস্টারমশাইদের শাসন-আদর, ফেলে এলাম বন্ধুদের, ফেলে এলাম স্কুলফেরত খেলাধুলো করে এসে ঘামে ভিজে বাড়ি ফিরে হ্যারিকেনের আলোয় পড়তে বসা ছোট্ট ছেলের মুখ,মা ভেজে আনত মুড়ি-বাদাম। ফেলে এলাম সার্কাসের মাঠ, উপহারের কাঠপেন্সিল। বুঝি জীবন তখন রবিঠাকুরের লেখার মতো, “হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোথাও, অন্য কোনোখানে…”

 

 এরপর চলে আসি ময়নাগুড়িতে।

অর্থাৎ আমাদের পৈতৃক বাড়ি যেখানে। একান্নবর্তী পরিবারের সঙ্গ পাওয়ার শুরু এইসময় থেকেই। জীবনের এক নতুন মোড়ে বাঁক নিলাম এখানেই।

ভর্তি হলাম ময়নাগুড়ি হাইস্কুলে, কালো প্যান্ট -সাদা শার্ট।‌‌ কিন্তু এই স্কুলে একটা বলার মতো ব্যাপার ছিল যে, বেশিরভাগ শিক্ষকমশাইরা ছিলেন আমার বড় কাকার সহপাঠী, বাবার বিশেষ পরিচিত এবং ছোটকাকুর শিক্ষক। কাজেই একটু বেচাল দেখলেই তা অভিযোগ আকারে বাড়ি পৌঁছে যেতে সময় লাগত না। মানে বাড়ি অব্দিও পৌঁছতে হতনা তেমন হলে, রাস্তাঘাটেই বাবা-কাকাদের সঙ্গে স্যারদের সাক্ষাতে সর্বনাশের ঘন্টা বেজেই যেত। আর যেহেতু তখন বয়সে একটু বড়,  কাজেই ল্যাজটাও বড়ো স্বাভাবিকভাবেই। বয়সের প্রশ্রয়ে খানিকটা বেপরোয়াও বটে! সুতরাং দুষ্টুমির অন্ত নেই, ফূর্তির প্রাণ যেন সবসময়ই খেলা,আড্ডা, বন্ধুদের নিয়েই ভরে আছে।

মনে পড়ে দপ্তরিকাকু যখন নোটিস খাতা নিয়ে ক্লাসে আসতেন, ধরেই নিতাম ঠিক ছুটির নোটিস! দীননাথ স্যারের সেই ‘প’ এর উচ্চারণ ‘ফ’ এবং সেই সূত্রে “ফুর্বো পাকিস্তান”এর (পূর্ব পাকিস্তান)গল্প আর শীতকালে ধুতির ওপর কালো কোট কোনোদিন ভোলার নয়। ছিলেন জয়ন্ত স্যার, যিনি আজীবন স্কুলের ড্রেসকোড মেনে চলতেন। এই ব্যক্তিত্বগুলো এতটাই প্রভাব ফেলেছিল মনে,যে এত বছরেও তা স্পষ্ট মনে পড়ে যায়।

      আজ এই মাঝবয়সে স্কুলের সেইসব কথা লিখতে বসে কেন জানি চোখের কোণ চিকচিক করে ওঠে। বন্ধুরা সবখানেই হৃদয়ের সমান কাছে। যোগাযোগের অভাবে অনেকেই ছিটকে গেছে। শিক্ষক -শিক্ষিকারা অনেকেই ইহলোক ত্যাগ করেছেন, অকালে চলে গেছে অনেক বন্ধুও। ব্যস্ততায় সোশ্যাল মিডিয়ার সূত্রের ওপরেই ভরসা রাখি। গেট-টুগেদার হয়, ফোনালাপ চলে, সংসার -সন্তানের ভবিষ্যৎ আলোচনা, বাজারে সব্জির দাম কম না বেশি, সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতি আলোচনা করতে করতে কার সুগার ধরা পড়েছে, কার ছেলে বিদেশে পড়তে যাচ্ছে, কার মেয়ের সামনেই বিয়ে, কার এত বছরে বয়সে নতুন প্রতিভা বিকাশের রাস্তা এগিয়ে যাচ্ছে — এই নিয়ে জীবন কেটে যায়। কিন্তু আলোচনার বিষয় বেশিরভাগ দিনে অন্তত একবার হলেও সেই স্কুলের কথা। ফালাকাটা হোক বা ময়নাগুড়ি — বিদ্যালয়ই তো সেই আশ্রয়, যেখানে জীবনের একেকটা ধাপ পেরিয়ে আজ মধ্য পঞ্চাশেও যার জন্য স্মৃতির বাক্স খুললে ছুটির পর ফাঁকা মাঠে উড়ে যাওয়া ধুলোর গন্ধ পাই, মনে পড়ে ব্ল্যাকবোর্ডে সাদা চকে লেখা বীজগণিতের সূত্র, কোন এক বন্ধু স্কুল ছুটির পর যাবে তার বান্ধবীর সঙ্গে দেখা করতে, কিন্তু সঙ্গে  সাইকেল বাহিনী নিয়ে পাহারা দিতে চলেছে বাকি বন্ধুরা। আমাদের সময় স্কুলের শেষ দিনে শার্টের পেছনে বন্ধুদের সই আর ফেয়ারওয়েল মেসেজ লেখার ধারণাটা ছিলনা। থাকলে বুঝি বড় ভালো হত। এখন স্মৃতি ধরে রাখা সহজ, আমাদের স্মৃতিগুলো ঐ বন্ধুদের সঙ্গে গল্পে, মনের ভেতরে আর রয়েছে স্কুলের ইট-কাঠ-পাথরগুলোতে। রিইউনিয়ন আমার প্রিয় উৎসবের একটি— আক্ষরিক অর্থেই। এ লেখার শুরুতেই বলেছিলাম, সম্ভবত জীবনের সবচেয়ে সুখী সময় স্কুলবেলা। তাই জটিল, ক্লান্ত জীবনে মাঝেমধ্যে সেই স্কুলের সোনালী বিকেলগুলো মনে করি, সাইকেলে ছুটে যাওয়া বাড়ির পথটুকু মনে করি, পরীক্ষার ভয়গুলো ‌মনে করি, মনে করি রোল নম্বর লেখা অ্যাটেনডেন্স খাতাটা। চারপাশের জীবনের ক্যাকোফোনিতে ক্লাসরুমে চিৎকার চেঁচামেচি করতে করতে হঠাৎ স্যার এসে পড়ায় যে পিনড্রপ সাইলেন্স মোড অন হয়ে যেত ক্লাসে সেই শান্তির আবহটাকে মনে করি। চোখ বুজে আসে, স্পষ্ট শুনতে পাই, “রোল নম্বর ৭… বিপ্লব, কাল স্কুলে আসিসনি ‌কেন?”

ভালো থাকুক স্কুল, এমন বেঁধে বেঁধে থাকি বন্ধুরা, মজবুত থাক স্মৃতির বিদ্যালয়ের দেওয়াল। এটুকুই চাওয়া!



 

ক্লাস ফাইভ থেকে ক্লাস সিক্স 

লীনা রায় 


১৯৮১ সালের জানুয়ারী মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ। শনিবার, বিকেল তিনটে। আমরা চার পাঁচজন সঙ্গে আমার সীমাদি চলেছি ফালাকাটা গার্লস হাই স্কুলে। সেদিন ক্লাস ফাইভের এডমিশন টেস্টের রেজাল্ট।স্কুলে ঢুকে দেখি আমাদের মত আরো অনেকেই আছে। ঠিক চারটের সময় বড়দি, মায়া বোস বাইরে এলেন। কিছু কথা বলেছিলেন। আজ সবটা যদিও মনে নেই। এরপর লিস্ট পড়তে শুরু করলেন। প্রথম নাম চৈতালি কর।যদিও আমাদের ক্লাসে এরপর প্রতিটি ক্লাসে সুমনা ছাড়া আর কেউ কোনদিন ফার্স্ট হতে পারে নি।যা হোক ,আমার নাম ও এলো।একসময় লিস্ট পড়া শেষ হল।লিস্টে আমার প্রিয় বন্ধুর নাম নেই। আনন্দ কেমন উবে গেল নিমেষে।

ক্লাস শুরু হল। নতুন স্কুল, নতুন পরিবেশ। ভাল লাগা, ভয় সব মিলেমিশে একাকার।এর মধ্যেই মোহনদা ক্লাসে অ্যানুয়াল স্পোর্টসের নোটিশ নিয়ে এলো। তিনটে ইভেন্টে নাম দেয়া যাবে। মনে আছে, আমরা ক্লাসের সবাই নাম দিয়েছিলাম।সেদিন সিলেকশন।ক্লাস ফাইভের ছাত্রীদের নিয়ে শুরু হল হিটস। এক একবারে জনা কুড়িকে দৌড়তে হচ্ছে। একমাত্র ফার্স্ট ফাইনালে খেলবে। দৌড় শুরু হল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বুঝে গেলাম খেলাধুলো আমার জন্য নয়। আর ওটাই প্রথম , আর অবশ্যই শেষবার।তবে স্কুল স্পোর্টসের নিয়মিত দর্শক ছিলাম। 

সে সময় বন্ধুদের সঙ্গে ঝগড়া হলে আড়ি হত। আর যাদের আড়ি হত তাদের ভাব করানোর দায়িত্ব থাকত অন্য বন্ধুদের ওপর। চৈতালি আর স্মৃতির ভাব করানোর জন্য কী পরিশ্রমটাই না করেছিলাম আমরা। একজনকে ধরে আনছি, আর একজন পালিয়ে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত ভাব হয়েছিল ওদের। আর স্কুল পেরিয়ে কলেজ জীবনেও ওরা বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল।

ফাইভ পেরিয়ে তখন সিক্সে। ফিফথ পিরিয়ডে তেষ্টা পেয়েছে। আমরা তখন জলের বোতল নিয়ে স্কুলে যেতাম না। তেষ্টা পেলে চাপা কল টিপে জল খেতাম। আমি আর বুবু জল খেতে যাচ্ছি। টিচার্স কমন রুমের সামনে একটা বকুল ফুলের গাছ ছিল। তাতে কমলা রঙের ছোট ছোট ফল ধরত। মেয়েরা ঢিল ছুড়ে সেই ফল পেড়ে খেত। সেই সময় একটি ঢিল আমার মাথায় পড়ে। হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরি। হঠাৎ দেখি সব্বাই পালিয়ে যাচ্ছে। আর গরম কিছু আমার চুলের ভেতর দিয়ে গড়িয়ে কানের পাশ দিয়ে পড়ছে। হাত দেখি। রক্তে মাখামাখি। একাই দিদিমণিদের কাছে যাই। মৈত্রেয়ী দিদিমনি আর রিতা দিদিমনি আমাকে হসপিটালে নিয়ে যান। ফিরে এসে দেখি যার ঢিলে আমার মাথা ফেটেছিল, সেই মাধবীদি কেঁদে কেঁদে অজ্ঞান হয়ে গেছে।

ছ'বছর – দীর্ঘ সময়। কত স্মৃতি। আজ পেছন ফিরে যখন দেখি সব মন ভাল করা স্মৃতির ভীড়। অবাক হয়ে ভাবি, খারাপ কিছু কি ছিল না? সত্যিই হয়ত ছিল না। আজও সেই স্কুলের বন্ধুরা একসঙ্গে আছি। কথা হয়। মেসেজের আদান প্রদানও নিয়মিত হয়। একবার সবাই দেখাও করেছি। সেই আনন্দ হয়ত লিখে বোঝানো সম্ভব নয়।এই অমূল্য বন্ধুত্ব– সৌজন্যে ফালাকাটা গার্লস হাই স্কুল।


 

স্মৃতির বিদ্যালয়
   সুদীপা ঘোষ 

যেদিন প্রথম তোমার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম, কিছুটা ভয় কিছুটা আশঙ্কার দোলাচলে মন ভরেছিল। গুটি গুটি পায়ে ভেতরে ঢুকে এদিক ওদিক চেনা মুখ খুঁজছিলাম। দুই তিনজন চেনা পরিচিত বান্ধবীকে পেয়েছিলাম। শুরুর দিকে তাদের সাথে সাথেই থাকার চেষ্টা করতাম। আস্তে আস্তে নিজের অজান্তেই কবে যে তোমাকে ভালবেসে ফেললাম বুঝতেই পারিনি। কতটা ভালবেসেছি, বুঝতে পারলাম  যেদিন শেষ বারের মত তোমার কাছ থেকে চলে এলাম। তুমি এখন শুধুই স্মৃতি ।অবশ্য শুধু স্মৃতি বললে ভুল হয় ,স্মৃতির মণিকোঠায় এক উজ্জ্বল জায়গা নিয়ে আছো।
                 হ্যাঁ, তুমি আমার "স্মৃতির বিদ্যালয়"। মালদার বহু পুরনো বিখ্যাত "বার্লো বালিকা বিদ্যালয় " - আমার বিদ্যালয়। এখন আমি তোমার থেকে অনেক দূরে থাকি। কিন্তু যখনই মালদায় যাই , একবার অন্তত তোমার সামনে গিয়ে দাঁড়াই। অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি ,ভেতরে ঢোকার সুযোগ পেলে এদিক ওদিক ঘুরে ফিরে দেখি ,তুমি কি সেই আগের মতই আছো! না, প্রত্যেকবারেই দেখি একটু একটু করে পরিবর্তন হচ্ছে। তোমার বদলে যাওয়া দেখে কখনো সামান্য মন খারাপ হয় । কিন্তু পরক্ষণেই ভাবি এ তো স্বাভাবিক। সময়ের সাথে সাথে বদলে যাওয়া ,একটু একটু করে উন্নতি করা - এটাই নিয়ম এবং সার্বিকভাবে ভালো। সবকিছুর মাঝখানে তুমি তো সেই তুমিই আছো। বিকেলে স্কুল ছুটির পরে যখন তোমার সামনে গিয়ে দাঁড়াই, মূল দরজা বন্ধ থাকলে বাইরে থেকেই কিছুক্ষণ তোমাকে দেখে ফিরে আসি। কখনো ভেতরে ঢোকার সুযোগ পেলে মাঝমাঠে দাঁড়িয়ে বারবার চারদিকে ঘুরে ঘুরে তাকাই। কোন্ ক্লাসে কোন্ ঘরটাতে বসতাম, এখনো মনে আছে আমার। প্রত্যেকবার নতুন নতুন ক্লাসে উত্তীর্ণ হয়ে প্রথম দিনটিতে সময়ের অনেক আগে যাওয়ার চেষ্টা করতাম, যাতে সবার সামনে বসতে পারি। আবার কাছের বন্ধুরা যাতে আমার আশেপাশেই বসতে পারে, তার জন্য জায়গাও রেখে দেওয়ার চেষ্টা করতাম। শিক্ষিকাদের আমরা বলতাম দিদিমণি। তাঁদের  কেউ কেউ সামনে দিয়ে হেঁটে গেলেই ভয়ে কুঁকড়ে যেতাম, আবার কারো সাথে মন খুলে অনেক কথা বলতাম। 
                  তোমার খোলা মাঠে বন্ধুদের সাথে হইচই করে খেলা, সুযোগ পেলেই উপরে নীচে সব ঘর বারান্দায় দৌড়াদৌড়ি করা, টিফিনের সময় গেটের ওপারে ছোট ছোট খাবারের দোকানের পসরা আর তাদের কাছ থেকে দরজার ফাঁক দিয়ে হাত বাড়িয়ে পয়সা দিয়ে খাবার নেওয়া - সবই এখনও স্মৃতির মণিকোঠায় জীবন্ত বন্দী। জানি সম্ভব নয়, তবুও  বারবার মনে হয়, যদি আবার ফিরে যেতে পারতাম সেই  স্কুলের দিনগুলিতে , যদি আবার ফিরে পেতাম সেই গোল্লাছুটের  ছেলেবেলা, তাহলে আমার আড়ি করা বান্ধবীদের সাথে আবার ভাব করে নিতাম, অনেক ভুলচুক শুধরে নিতাম।


 

আমার বিদ্যালয়
 মাধবী তালুকদার 

১৯৬৫ ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ। সেই সময় আমার বাবার কর্মস্থল কলাইকুন্ডা তে ছিলাম। বাবা ভারতীয় বিমান বাহিনীতে চাকরি করতেন। যুদ্ধের সাইরেন, যুদ্ধবিমানের ওঠানামা, কামান, ট্যাংক মাটিতে গর্ত খোঁড়া, বালির বস্তা, সবকিছুর পর যুদ্ধ শেষে, বাবা স্থির করলেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছেলেমেয়েকে আর চাকরিস্থলে রাখবেন না। আমাদের নবদ্বীপ শহরে এনে ভর্তি করালেন নবদ্দীপ হিন্দু স্কুলে। ১৯৬৬ সালে আমি ভর্তি হলাম প্রথম শ্রেণীতে আর আমার দাদা দ্বিতীয় শ্রেণীতে। আমরা তখন ভালো বাংলা জানতাম না। হিন্দি শুনে অভ্যস্ত ছিলাম। তাই ভর্তির পূর্বেই একজন শিক্ষকের কাছে নিয়ে যাওয়া হল। যিনি আমার মায়েরও শিক্ষক ছিলেন। সবাই তাকে বুড়ো মাস্টারমশাই বলতো। তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন। একটা ছোট বেড়ার ঘরে থাকতেন সপরিবারে। আমি চটের উপর বসে ওনার কাছে আদর্শ লিপি, নামতা, যোগ-বিয়োগ-গুন-ভাগ শিখেছিলাম। উনি পাঠ্য-পুস্তকের অনেকটা শেষ করিয়ে মা-বাবাকে বলেছিলেন প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলতে- আমাকে যেন দ্বিতীয় শ্রেণীতে ভর্তি নেওয়া হয়। বাড়িতে এই আলোচনা আমার কানে এলো। কিন্তু আমার দাদা বেঁকে বসলো। সে ছোট বোনের সঙ্গে একসাথে কিছুতেই পড়বে না। আমি প্রথম শ্রেণীতে থেকে গেলাম। এই বিদ্যালয়টি শহরের সবচেয়ে পুরনো বিদ্যালয়। বিদ্যালয়ের শিক্ষক মহাশয় সবাই খুব ভালবাসতেন। প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীতে উঠলাম। বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে একজন শিক্ষক আমাকে স্টেজে তুলে দিলেন। আমার প্রথম স্টেজে ওঠা। আমার পা কাঁপছিল। এই বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের কথা আমার এখনো মনে আছে, তিনি সিন্ধু বাবু। পুরো নাম আমরা জানতাম না। কাউকে কোনদিন বকতেন না। একবার আমাদের জিজ্ঞাসা করেছিলেন মরুভূমিতে জল নেই, গাছ নেই, এত কষ্ট তবু সেখানে মানুষ থাকে কেন? মাস্টার মশাই উত্তরে বলেছিলেন- যেহেতু সেটা তাদের জন্মভূমি বা মাতৃভূমি। কথাটা এখনো মনে পড়ে।তৃতীয় শ্রেণীতে একজন নতুন ছাত্র ভর্তি হল। শিক্ষকরা ছেলেটির উপর ভীষণ গুরুত্ব দিতে শুরু করলেন। তৃতীয় শ্রেণীতে আমি প্রথম হতে পারলাম না। বিদ্যালয়ের উপর এত অভিমান হল যে আমি চতুর্থ শ্রেণীতে অন্য বিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। নতুন বিদ্যালয় আমার পরীক্ষা নিয়েছিলেন প্রধান শিক্ষক সুনীল মাস্টার মশাই। অংক, বাংলা, ইংরেজি থেকে প্রশ্ন করেছিলেন। এই বিদ্যালয়টির অনেক অবদান আছে আমার জীবনে। সারা বছরে তিনবার পরীক্ষা হতো। এখানে প্রার্থনা সভা থেকে শিখেছিলাম গীতার শ্লোক-


यदा यदा हि धर्मस्य ग्लानिर्भवति भारत ।
अभ्युत्थानमधर्मस्य तदात्मानं सृजाम्यहम्‌ ॥
परित्राणाय साधूनां विनाशाय च दुष्कृताम्‌ ।
धर्मसंस्थापनार्थाय सम्भवामि युगे युगे ॥

ভবসাগর তারণ কারণ হে ...।
গানটি গাওয়া হত। আর সবশেষে জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে...।
এ বিদ্যালয়ের বার্ষিক অনুষ্ঠানে আমার প্রথম আবৃত্তি করা। মাস্টারমশাইরা শিখিয়ে দিয়েছিলেন। এখানে সব বিষয়ের ক্লাসের সাথে শনিবার দিন একটা বিশেষ ক্লাস হোতো। সেখানে প্রথম আমি তরু মাস্টারমশাইয়ের মুখে মহাভারতের- ভীমকে বিষের নাড়ু খাওয়ানোর গল্প শুনি। উনি এত সুন্দর করে গল্প শোনাতেন যে আমার মনে হতো আমি স্বয়ং গঙ্গার পাড়ে দাঁড়িয়ে ঘটনাগুলো দেখতে পাচ্ছি। এইভাবে রামায়ণ, মহাভারত দুটি মহাকাব্য জেনেছিলাম। হঠাৎ একদিন শুনলাম ধর্ম শাস্ত্র পরীক্ষা হবে। আমি প্রথমবার মৌখিক আদ্যপরীক্ষা দিতে গেলাম। কলকাতা থেকে একজন স্বামীজি এসেছেন পরীক্ষা নিতে। পরীক্ষা দিয়েছিলাম। কিছুদিন পর জানলাম আমাকে এবং আরো কয়েকজনকে পুরস্কার নিতে কলকাতায় যেতে হবে। এক শীতের ভোরে দুজন শিক্ষক আমাদের নিয়ে কলকাতায় বালিগঞ্জে এলেন। বিশাল স্টেজ। আমরা প্রাইজ নিয়ে আবার রাতে ট্রেনে বাড়ি ফিরে এলাম। এ আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর এক অভিজ্ঞতা। এইভাবে পাঁচবার আমি ধর্মশাস্ত্র পরীক্ষায় কৃতী ছাত্রী হিসেবে পুরস্কার পেয়েছি। বহু মূল্যবান পুস্তক এখনো আমার কাছে আছে। এই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুনীল ভট্টাচার্য মহাশয় আমাকে একদিন বললেন- 'তুমি মন দিয়ে লেখাপড়া করলে তোমার রেজাল্ট ভালো হবে, তোমার বিদ্যালয়ের গর্ব হবে, তোমার বাবা-মার গর্ব হবে।' কথাটি মনে গেঁথে গিয়েছিল। আজো আমি আমার ছাত্র-ছাত্রীদের এই কথাই বলি। এই পরীক্ষার সুবাদে আমি পূর্ণাত্মানন্দজী মহারাজের দেখা পাই। উনি আমার ডায়েরীতে লিখে দিয়েছিলেন-
বরদা যদি মে দেবী
দিব্য জ্ঞানম্ প্রদোচ্ছ মে।
আরো একটি লিখে দিয়েছিলেন। সংস্কৃত শ্লোকটি মনে নেই তবে অর্থটা এখনো মনে আছে। যাহা আমাকে অমৃত দানে অসমর্থ তাহালইয়া আমি কি করিব। এই বিদ্যালয়ে আমি প্রত্যেক পরীক্ষাতে প্রথম হয়েছিলাম। আর প্রথম হওয়ার জন্য জ্ঞান, শক্তি, সাহস, সবই আমার শিক্ষকদের অবদান। প্রিয় বিদ্যালয়, প্রিয় শিক্ষকদের আমার অন্তরের অনেক শ্রদ্ধা ও বিনম্র প্রণাম জানাই।