Sunday, January 31, 2021

মুজনাই সাপ্তাহিক  

     নদী সংখ্যা 


 ইছামতী-- একটি ভালোবাসার নাম

                 কুমকুম ঘোষ

   ইছামতী -- নদীর নামটির সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামটি। তাঁর যুগান্তকারী "পথের পাঁচালী"  কি " ইছামতী" উপন্যাসের মূল চরিত্র হিসেবে উঠে এসেছে এই নদীর প্রবাহ। দুটি উপন্যাসের নায়ক নায়িকা থেকে অতি সাধারণ চরিত্র সকলের জীবনের ছোট বড়ো সব মুহূর্ত গুলো সম্পৃক্ত হয়ে আছে এই নদীর সাথে।বলা ভালো নদী এখানে কথা বলে তাদের হয়ে। 
যেমন  নীলবিদ্রোহের পটভূমিতে লেখা  "ইছামতী" উপন্যাসের গৃহীসন্ন্যাসী  ভবানী বাঁড়ুজ্যে,তার সেবাপরায়ণা স্ত্রী তিলু এবং তাদের খোকা, এমনকি অত্যাচারী নীলকর সাহেব শিপ্টন ও রামকানাই কবিরাজ সবার জীবনে জুড়ে আছে ইছামতী নদী।
"পথের পাঁচালী" উপন্যাসের হরিহর রায়ের বংশ পরিচয় পর্বে  ইছামতী নদীর বুকে  ঘটে যায় এক ভয়ানক ঘটনা।হরিহরের পূর্ব পুরুষ বীরু রায়ের একমাত্র পুত্র নৌকা থেকে উধাও হয়ে যায় এই ইছামতী র এক নির্জন চর থেকে। মাঝিরা অনুমান করে তাকে কুমীরে ধরে নিয়ে গেছে।
অপু ও হরিহরের জীবনের অনেকটা অংশ জুড়ে বিরাজ করে এই  স্রোতস্বিনীর ধীর স্থির প্রবাহধারা।
ইছামতী নদীর সাথে আমার পরিচয় টাকী ভ্রমণের সাথে। অত্যন্ত বিখ্যাত ট্যুরিস্ট স্পট ও পিকনিকের আদর্শ জায়গা  উঃ চব্বিশ পরগণা র টাকী ,যার পাশ দিয়ে বয়ে চলে এই নদী । টাকীর উল্টোদিকে ই বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলা । ইছামতী র বুকের মাঝে দুই দেশের সীমানা চিহ্নিত কোনো  দৃশ্যমান কাঁটাতার নেই কিন্তু সীমারেখা আছে মাঝনদীতে। তাই এদিকের নৌকা কখনো ওদিকে যায়না।সব নৌকায় নিজের দেশের পতাকা লাগানো থাকে আর দুই তীরে সীমান্ত রক্ষী বাহিনী প্রহরায় থাকে চব্বিশ ঘন্টাই।  কিন্তু অবাক লাগে ভাবতে নদীর মাছেরা কি সেকথা জানে ? কিংবা পাখীরা? বর্ডারের সেই অদৃশ্য সীমারেখা মুছে যায় নদীর ছলাৎ ছলাৎ শব্দে ,এক ঝাঁক বাটা মাছের রূপালী আঁশে সকালের রোদ পড়ে ঝকঝক করে। সূর্যোদয়ের মুহূর্তে ইছামতী র জলে তখন সোনা রোদের গান ঝিলিক দিয়ে ওঠে।
   ভারত ও বাংলাদেশের পতাকা লাগানো জেলে নৌকা ঘুরছে ইছামতী র বুকে এ তো হামেশাই দেখা যায়। অনেক সময়েই দুই নৌকার মানুষেরা দূর থেকে  হাত নাড়িয়ে সৌজন্য বিনিময় করছেন,এই ঘটনা দেখেছি  নৌকায় করে   মাছরাঙা দ্বীপে যাওয়ার সময় বা নিছকই নৌকাভ্রমণের সময়।
 বিশেষ করে প্রতিবছর বিজয়া দশমীর দিনে এই নদী হয়ে ওঠে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের এক উজ্জ্বল উদাহরণ। হাজার হাজার মানুষ দুই পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকেন প্রতিমা বিসর্জন দেখার জন্য। ইছামতী র বুকে দুর্গা প্রতিমার বিসর্জন দুই দেশের প্রীতি ও ভালোবাসার অন্যতম হলমার্ক হয়ে থাকে।এই অনুষ্ঠান টিভিতে ডাইরেক্ট টেলিকাস্ট ও হয়।
এহেন নদীর প্রেমে পড়া যায় বারবার।তাই  ফিরে ফিরে এসেছি এর তীরে। বন্ধুদের সাথে পিকনিক করতে একদিনের জন্য, কিংবা ২০১১ সালের ১৭ ই জুন যেদিন ভোর রাত থেকে মুষলধারায় বৃষ্টি পড়ছিল সেদিন এক রোমাঞ্চকর লঙ্ ড্রাইভ করেছিলাম স্বামী- কন্যা সহ এই নদীকে দেখতে,রাত কাটাতে।   কখনও নদীর শোভা দেখতে রাত্রিবাস করেছি প্রিয় মানুষজনের সাথে, দিদি- জামাইবাবু র বিবাহবার্ষিকী পালন করেছি কিংবা প্রথমবারের সুন্দরবন ভ্রমণ করেছি টাকী পুরসভার সোনার তরী নৌকায়।

  সুন্দরী "ইছামতী"আদতে  তিনটি  ধারায় প্রবাহিত হয় যার দীর্ঘ তম অংশ ২০৮কিমি ।নদীটি নদীয়ার কাছে ভৈরব নদ থেকে উৎপন্ন হয়ে একবার অধুনা বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আবার ঢুকে পড়েছে উঃ চব্বিশ পরগণায়। কত সমৃদ্ধ জনপদ এর দুই তীরে। এদিকে নদীয়া, উঃ চব্বিশ পরগণা জেলা ওদিকে সাতক্ষীরা, যশোর , চুয়াডাঙ্গা । বর্তমানে নাব্যতাজনিত সমস্যায় জেরবার এই নদী।প্রতিবছর বর্ষাকালে বন্যা লেগেই থাকে।টাকীর পরেই হাসনাবাদের কাছে এই নদী দুটো ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। একভাগ কালিন্দী নদী হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশে গেছে ।  
সব সভ্যতাই তো নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে, তেমনি ভালোবাসারও জন্ম দেয়।
নদীমাতৃক বঙ্গে অনেক নদীর সাথে পরিচয় হয়েছে , বিশেষ করে আমি তো জন্মেছি ই গঙ্গাপাড়ের এক গ্রাম খড়দা'তে, ফলে নদীর সাথে আশৈশব জানাশোনা।।তবু গঙ্গা নয়  ইছামতী"ই আমার ভালোবাসার নদী:
ঠিক যেমনটি বলেছেন কবি ....

" যখন যেমন মনে করি তাই হতে পাই যদি,
আমি তবে এক্ষণি হই ইচ্ছামতী নদী।
রইবে আমার দখিন ধারে সূর্য- ওঠার পার,
বাঁয়ের ধারে সন্ধেবেলায় নামবে অন্ধকার,
আমি কইব মনের কথা দুই পারের ই সাথে--
আধেক কথা দিনের বেলায়, আধেক কথা রাতে।।" 

 মুজনাই সাপ্তাহিক 

     নদী সংখ্যা 











ইচ্ছেনদী 
যাজ্ঞসেনী


শৈশবের সেই নদীকে যে কোথায় দেখেছিলাম এখন আর মনে পড়ে না। সেদিন ভোরবেলায় লাল থালার মতো সূর্য একটু একটু করে উঁকি দিচ্ছে। একটু একটু করে খুব কৃপণের মতো বয়ে যাচ্ছে বাতাস। নদীর জলে তিরতির করে বয়ে যাচ্ছে সোনালি স্রোত। দূরে, অনেক অনেক দূরে নৌকো ভেসে ভেসে কোথায় যেন চলে যাচ্ছে। সেই নৌকোর মাঝিকে দেখা হয়নি কখনও। কখনও তাকে বলা হয়নি, ও মাঝি- এই যে এতো দূরপানে ভেসে যাও ভয় করেনা তোমার?  নদীর তো কোন ঠিকঠিকানা নেই। কখন শনশন ঝোড়ো হাওয়ায় উথালপাতাল হবে। কখন আবার স্রোত ছুটবে কনকনে শীতের মতো হিমেল মৃত্য হয়ে। কখনও আবার সে তোমার নৌকোখানা নিয়ে মোচার খোলার মতো খেলা করবে ইচ্ছেমতো।
বলা হয়নি।
জানা হয়নি সেই নদীর নামও। শুধু জানি, বুকের ভিতরে একটা নদী মাতৃগর্ভ থেকেই জন্মাতে থাকে। পল যায়, সময় যায়, দিন মাস বছর -- সবই দেখতে দেখতে চলে যায় কেমন। শৈশবের সেই নদীও বড় হতে থাকে ক্রমশ। তাতে কখন জোয়ার কখন ভাঁটা বলা খুব মুশকিল। আর নাব্যতা? 
সে নদীতে শেষ কবে  ডুবুরি নেমে  যে মুক্তোসন্ধান করেছিল!  অথচ, কত মুক্তোই না রাখা ছিল তুলে আনার জন্যে।
বুকের ভিতরের সেই  নদী প্রতীক্ষা করতে করতে করতে, একটা একটা করে ঢেউ গুনতে গুনতে গুনতে, একটা একটা নৌকোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে থাকতে, কবে যে কখন কেমন করে কত অবহেলায় মজে গেল,  আমি তার হিসেব  রাখিনি। মনে রাখিনি তার নামও। 
দেখা হলে বলতাম, নদী ও নদী -- তোমার নাম নিশ্চয়ই ইচ্ছেনদী।

ছবি- শৌভিক রায় 

মুজনাই সাপ্তাহিক 

    নদী সংখ্যা  
















নদী, কোথায় তোমার ঘর

নন্দিতা পাল

নদী দেখলেই চুপ করে কথা শুনতে ইচ্ছে করে আমার। এত কথা তার উচ্ছল শিশুর মত। আর কথা শুনতে শুনতে মন নীরবে কখন চলে যায় একের পর এক জীবনের পৃষ্ঠায়। নদী পুকুরের দেশে আমার ছোটোবেলা কেটেছে। যখন দাদুর বাড়ি যেতাম তোরসার হাত ধরে যেত রাস্তাটা। বাবা মায়ের চাকরি সুত্রে ছিলাম যে শহরে, যেখানে গল্প হত ভরা মান্সাইয়ের সাথে। তিস্তা নদী পেরিয়ে ছিল আমার স্কুল এক শহরে। সেই কুয়াশায় নদী হারিয়ে যেত সাদা একটা চাদরে, মাছ ধরার ডিঙ্গি গুলো দূরে চিকচিক জলে দাঁড় বাইত। বর্ষার চরগুলো হারিয়ে যেত এক্কেবারে, কোথেকে এত রাগ নদীর, গর্জনে কান পাতা দায়। একবার ভনঙ্কর সেই রূপ দেখলাম তোরসার, আটকে রাখতেই পারছে না নদী তার রাগ, ঘনঘন বাঁধের উপর চোটপাট। আর সেই বৃষ্টির রাতে দুদ্দাড় লোকের দৌড়াদৌড়ি, চিৎকারে কান রাখা দায়। আমাদের সবে ছাদ হয়েছে তখন, পাড়ার অনেক লোক আমাদের বাড়িতে, সবার হাতে দরকারি বা প্রিয় জিনিস। আমার তো মনে আছে, সবে মাধ্যমিক পাস করেছি, সেই একমাত্র সার্টিফিকেটটা নিয়ে ছাদে উঠে যাব ভাবছি। যাই হোক, সে প্রয়োজন হয়নি কারণ নদী বুঝতে পেরেছিল রাগ টা বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে, জল কমে এসেছিল সে রাতে, বৃষ্টিও।

এরপর গঙ্গা পেরিয়ে কলকাতা, বাড়ি ছেড়ে দূরে পড়াশুনো। সে আমলে কামরূপ এক্সপ্রেস ছাড়া তেমন ভালো কোন ট্রেন ছিল না। ট্রেনের চাকা যখন গড়াতে শুরু করত, চোখের সাথে মন ঝাপসা হয়ে আসত বাড়িতে খুশিতে দিন কাটানোর স্মৃতিতে। ট্রেনের ভারী চাকার আওয়াজে কান্না যেন গলার কাছে দলা হয়ে থাকত। এরপর, সকালে যখন গঙ্গা নদীর ওপর দিয়ে যেতাম, ভোরের আলোয় নদীর হাসিমুখ দেখে পেতাম নতুন উদ্যম, ঝাপসা কাটিয়ে নতুন বন্ধুদের মুখ গুলো মনে পড়তে দিন শুরু হত। এরপর দিন যত গড়িয়েছে, দূর শহর, বিদেশ পাড়ি, যাই হোক না কেন – প্লেনের জানালা দিয়ে যখন দেখেছি গঙ্গার মুখ, মন আনন্দে ভরে উঠেছে ঘরে ফেরার। গঙ্গার বিভিন্ন ঘাটে যাই বারবার, এক এক জায়গায় তার অন্য রকম রূপ। ভরা বৃষ্টিতে টইটম্বুর নদী, কুলের কাছে জলের অবিরাম কথা। গরমের দিনে স্রোত তেমনি গভীর, তবু দেখেছি কিছু লোকেদের ছপাং দেওয়া জলে। গঙ্গা শুধু নদী নয়, যখন ঘাটে চুপ করে বসি শুনতে পাই অনেক গল্প, বছরের পর বছর আগের অনেক ইতিহাস যার সাক্ষী ছিল সে। গঙ্গার বুকে সূর্যোদয় দেখেছি বাতাস এসে ফিসফিস করে ঘুম ভাঙ্গায় নদীর, সূর্য তো চোখ খুলে নদীকেই প্রথম দেখে তার মোলায়েম চোখে। আর বিকেলের পড়ন্ত আলো কিছুতেই যেন নদীর আঁচল ছাড়তে চায় না। মাঝিরা ভরা নদীতে গান ধরে উদাস করা বাউল। আমার মন ও অনেকবার জিগ্যেস করেছে, নদী, তোমার ঘর কোথায়। হেসে ছলকে গঙ্গা নির্বিকার বয়ে চলেছে দুর্বার গতিতে। আজ মনে হয় মা গঙ্গার ঘর আমার মনে, আমার ভাবনায়। আমি গঙ্গাকে নিজের মনে বয়ে নিয়ে চলি, যা বারেবারে ফিরিয়ে আনে আমায় নিজের জায়গার ঠিকানায়।

ছবি- লেখক 

মুজনাই সাপ্তাহিক 

    নদী সংখ্যা  













(করতোয়া নদী মোহনার সম্মুখে) 



আমার প্রিয় নদী

গৌতম চক্রবর্তী

নদীমাতৃক সভ্যতার মাতৃস্বরূপিণী ত্রিস্রোতা

মুজনাইয়ের এবারের বিষয়ভিত্তিক লেখা ‘আমার প্রিয় নদী’ লিখতে বসে দেখলাম মুজনাই সম্পাদক বড়ই সমস্যায় ফেলে দিয়েছেন বিষয় বৈচিত্র্যে। শুরু করার সময় কুলকিনারা খূঁজে পাচ্ছিলাম না যে আমার প্রিয় নদী কোনটি নয়। আমার বাড়ির পাশের করলা, যাওয়া আসার পথের তিস্তা, তোর্ষা, জলঢাকা, মুজনাই, বালাসন, মহানন্দা, সুটুঙ্গা এমনকি ডুডুয়া, গিলান্ডি, মাল, লিস, ঘিস, কালজানি, চেল, অজস্র ঝোরা, খোলা সবই যে আমার প্রিয়। কারণ ডুয়ার্সের প্রতিটি জনপদ গড়ে উঠেছে এই নদীগুলি এবং ঝোরাগুলিকে কেন্দ্র করেই যে। তাই “আমার প্রিয় নদীকুল” শিরোনামেই বিষয়বস্তূর অবতারণা করতে গিয়ে আচমকা মনে এল সেই সুপ্রাচীন ত্রিস্রোতা তথা করতোয়ার কথা যাকে কেন্দ্র করে এই ভূখন্ড, এই বরেন্দ্রভূমি, কোচ, কামতাপুর রাজ্যের উত্থান-পতন। কালের অমোঘ নিয়মে এই নদী আজ গল্পগাথায় পরিণত। কিন্তু নদীমাতৃক সভ্যতার মাতৃস্বরূপিণী ত্রিস্রোতা এখনো আমার প্রিয় নদী। ডক্টর চারুচন্দ্র সান্যাল, ডক্টর অরুণ ভূষণ মজুমদারের লেখা নিবন্ধ, রেণেলের ম্যাপ, সমসাময়িক পত্রিকা, জলপাইগুড়ি বিষয়ক বিভিন্ন বই থেকে সংগৃহীত তথ্যাবলী নিয়ে কলম ধরলাম। ইতিহাস, কল্পনা, বাস্তবতার সংমিশ্রণে লেখাটি সম্পৃক্ত হলেও ভূমিকম্পের ফলে মাটির নিচে অবলুপ্ত হয়ে যাওয়া করতোয়া এবং ত্রিস্রোতার পুণ্য সলিলের ওপর বর্তমানে দাঁড়িয়ে আছে জলপাইগুড়ি সহ এক একটা জনপদ। এটাই বাস্তবতা। আসলে বিশ্বাসে মিলায়ে বস্তূ, তর্কে বহুদূর।

ত্রিস্রোতা নামের উৎপত্তি 

উত্তরবঙ্গের প্রাচীন এবং প্রধান নদী ত্রিস্রোতাত্রিস্রোতার উৎপত্তি এবং মাহাত্ম্যের মত তার অবস্থান এবং গতিপথও বর্ণিত হয়েছে বিবিধ শাস্ত্র, পুরাণ, তন্ত্র এবং গ্রন্থে। ত্রিস্রোতা নামটির মধ্যেই নিহিত রয়েছে ত্রিধারার রহস্যতিস্তার মূল গতিপথের বিবরণ ডক্টর চারুচন্দ্র সান্যাল এর লেখা তিস্তা করতোয়ার রূপরেখা নিবন্ধে রয়েছে এবং তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বারোটি নদী মানচিত্রের বিবরণচারুচন্দ্র সান্যাল তিস্তার এই মূল গতিপথের আরো পরিষ্কার চিত্র তুলে ধরেছেনরেনেলের মানচিত্র এই গতিপথকে স্বীকৃতি দিয়েছেভুটানের উত্তরে হিমালয়ের কোলে সিকিমের পাহাড় থেকে উৎপত্তি হয়ে প্রাচীন তিস্তা সমতলের দিকে নেমে আসার সময় লেপচা এবং পাহাড়ি জনজাতির গ্রামবাসীরা তিস্তাকে তাদের পছন্দমতো নাম দিয়েছিল যেমন স্যা ছু, রং নিউং, রঙ্গ, দিসতা, তিস্তা। মূল নদী তিস্তা জলপাইগুড়ির উত্তরে পৌঁছে সোজা দক্ষিণে চলতে শুরু করেছিলসমতলে তিস্তা তিনটে স্রোতধারায় প্রবাহিত হয়েছিল বলেই তার নাম হয়েছে ত্রিস্রোতাতিস্তা সমতলে নেমে প্রবাহিত হতো তিনটি স্রোতধারায় যেগুলির নাম ছিল পাঙ্গা, যমুনা এবং করতোয়াজলপাইগুড়ি শিলিগুড়ির পথে নদীগুলির অবস্থান, গতিপথ ও বর্তমান উৎসস্থল এবং সেইসঙ্গে হলদিবাড়ির পশ্চিমদিকের নদীগুলির অবস্থান বিস্তারিত আলোচনায় পর্যালোচনা করলে দেখা যায় ত্রিস্রোতার গতিপথের নির্দিষ্ট ক্ষেত্রটি দাঁড়ায় শিলিগুড়ির অদূরে অধুনা জলপাইগুড়ি জেলার উত্তর প্রান্তে সেবক রেলপুলের দক্ষিণে ত্রিস্রোতার প্রায় পুরো অবস্থানটি ছিল অবিভক্ত জলপাইগুড়ি জেলার পশ্চিমপ্রান্ত জুড়ে আর তিস্তা করতোয়া রূপরেখা নিবন্ধে চারুচন্দ্র সান্যাল লিখেছেন ভারতের প্রসিদ্ধ একান্ন পীঠের ভ্রামরী পিঠ তিস্তা করতোয়ার তীরে














পাঙ্গার গতিপথ

যেখানে তিস্তা সমতলে নামে সেখানে পাঙ্গা, যমুনা এবং করতোয়া সহ তিনটি স্রোতধারা সৃষ্টি হয়প্রাচীন তিস্তার সমতলের গতিপথ তিনটি স্রোতধারায় প্রবাহিত হয়েছিল বলেই এর নাম ত্রিস্রোতাউল্লিখিত নদী মানচিত্রগুলিতে করতোয়া এবং যমুনার পূর্ব দিকে পাঙ্গা নদীর অবস্থান শিলিগুড়ির কাছে সেবক এর পর এই তিন স্রোতধারার উৎপত্তি হয়ে তারা আলাদা আলাদাভাবে প্রবাহিত হতো জলপাইগুড়ি এবং হলদিবাড়ি শহরের পশ্চিম দিক দিয়ে এবং পুনরায় একধারায় মিলিত হতো অবিভক্ত জলপাইগুড়ি জেলার দক্ষিণে দেবীগঞ্জে যেটা অধুনা বাংলাদেশেকিন্তু পরবর্তীকালে পাঙ্গার গতি পরিবর্তনের ফলে কার্যত একটি ধারায় পরিণত হয় অধুনা বাংলাদেশের শালডাঙ্গাতে

করতোয়ার গতিপথ

আমরা জানি প্রাচীন কামরূপের পশ্চিম সীমানা ছিল করতোয়া নদী। তিস্তার বিপুল জলরাশি থেকে তিনটি স্রোতধারা নির্গত হয়েছিলকরতোয়া ছিল তাদের মধ্যে একটিত্রিস্রোতার পশ্চিম ধারা করতোয়ার গতিপথ বর্ণনাতে ডক্টর চারুচন্দ্র সান্যাল তাঁর নিবন্ধে লিখেছেন জলপাইগুড়ি জেলার উত্তর-পশ্চিম দিয়ে করতোয়া গিয়েছিল প্রায় ৪৫ মাইল আমবাড়ি ফালাকাটা এবং ভজনপুর এর ওপর দিয়ে। এখনও ফাটাপুকুরের কাছে রয়েছে করতোয়া বলে একটি নদী। তারপর কোচবিহার রাজ্যের ঘোড়ামারা নদী এর সাথে মিলিত হয় করতোয়া তার গতিপথে প্রাচীন কোচবিহারের অন্তর্গত শালডাঙ্গাতে ঘোড়ামারা এবং দেবীগঞ্জে তিস্তার পরিত্যক্ত বুড়ি তিস্তার ধারাকে বুকে তুলে দক্ষিণে আত্রাই নাম ধারণ করে গঙ্গার সঙ্গে মিলিত হয়১৭৮৭ সালে উত্তরবঙ্গে ভয়ানক ভূমিকম্পে ভূপ্রকৃতির ব্যাপক ওলটপালট হওয়ার আগে পর্যন্ত সমতলে তিস্তার এই গতিপথ অব্যাহত ছিল











যমুনার গতিপথ

ত্রিস্রোতার মধ্য ধারা হলো যমুনা ডক্টর চারুচন্দ্র সান্যালের তিস্তা করতোয়ার রূপরেখা নিবন্ধে হান্টার সাহেবের বর্ণিত অংশে পাওয়া যায় তিস্তার একটি শাখার নাম ছিল যমুনা যমুনা নদী বাহাদুর তালুক, নগর বেরুবাড়ি, গড়ালবাড়ি ইত্যাদি এলাকার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার পর ভূজারীপাড়াতে দক্ষিণ বেরুবাড়ীতে প্রবেশ করেছে এবং সাতকুড়ার পশ্চিম দিক দিয়ে প্রবাহিত হয়ে দক্ষিণ বেরুবাড়ির দক্ষিণ সীমান্ত কীর্তনীয়া পাড়ায় নাউতারি নবাবগঞ্জে গিয়ে তার নামটিও হারিয়ে ফেলেছেদক্ষিণ বেরুবাড়ীর দক্ষিণ সীমান্ত কীর্তনীয়া পাড়া-নাউতারি নবাবগঞ্জে পাঙ্গা ও যমুনা পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হয়ে ঘোড়ামারা নাম ধারণ করে এখান থেকে এই মিলিত ধারা ঘোড়ামারা নামে প্রবাহিত হয়েছে দক্ষিণে











ত্রিস্রোতা বা বুড়ি তিস্তা

চারুচন্দ্র সান্যালের মতে, তিস্তা তখনও পূর্ব বাহিনী হয়নি২৬.৩৫ মিটার উত্তর অক্ষরেখা থেকে বাঁক নিয়ে দক্ষিণে প্রবাহিত হত মেখলিগঞ্জ এর পশ্চিম সীমা ছুঁয়ে আজকের হলদিবাড়িকে পূর্ব দিকে রেখে রংপুর অতিক্রম করে দিনাজপুরে প্রবেশ করত তিস্তাফার্মিন্জারের ১৭৭০-১৭৭৯ সনের বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট রেকর্ডের অংশ উদ্ধৃত করে বলতে পারি ত্রিস্রোতা ১৬৮৯ সালের আগেই দিনাজপুরে আত্রাই নদীর সাথে মিলে গঙ্গায় পতিত হত১৭৭৯ সালে ফকিরগঞ্জ অর্থাৎ জলপাইগুড়ি শহরের কয়েক মাইল দক্ষিণে মাদারগঞ্জ এর কাছে তিস্তার একটা শাখা কাশিয়াবাড়ী হয়ে পশ্চিম দিকে এবং তারপরে দক্ষিণে বেঁকে দেবীগঞ্জের কাছে করতোয়ায় মিশেছিলএই নদীর বিস্তারের বিষয়ে ডঃ চারুচন্দ্র সান্যাল লিখেছেন তিস্তা মন্ডলঘাট এবং হলদিবাড়ির ভেতর দিয়ে কাশিয়াবাড়িতে বুড়ি তিস্তা নামে চিলাহাটির ভেতর দিয়ে দক্ষিণে দেবীগঞ্জের কাছে করতোয়াতে মিশে গিয়েছিলকয়েক বছর বাদে বুড়ি তিস্তা অন্য পথে যাওয়ার ফলে এই ধারাটিও শুকিয়ে গেল উল্লিখিত নদী মানচিত্রগুলিতে এই বুড়ি তিস্তার বিবরণও তুলে ধরা হয়েছেবুড়ি তিস্তার গতি পরিবর্তনের ফলে পাঙ্গা তথা মূল নদী তিস্তা খয়েরবাড়ি এবং বোনাপাড়াতে কিছুটা পূর্ববাহিনী হয়ে তারপরে দক্ষিণে দক্ষিণ বেরুবাড়ির মানিকগঞ্জের পশ্চিম দিক দিয়ে প্রবাহিত হয়ে অধুনা বাংলাদেশে নাউতারি নবাবগঞ্জে পাঙ্গা নামটি হারিয়ে ফেলেজলপাইগুড়ি থেকে হলদিবাড়ির পথে নারায়ণপুরের পর পশ্চিমবাহিনী একাধিক জলধারা বিশেষ করে কাশিয়াবাড়ির কাছে পশ্চিমবাহিনী মৃত ধারাটি ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হয়ে আছে











পলি এবং বালি ঘাটলে উঠে আসে ইতিহাস

প্রাচীনকালে তিস্তা নদীর তীরে গড়ে উঠেছিল বহু দেশের রাজধানী, শিক্ষা সংস্কৃতির কেন্দ্র, বাণিজ্য কেন্দ্র এবং ধর্মীয় পীঠস্থান কালের প্রভাবে সেসবের অনেক কিছুই আজ অবলুপ্ত অনেক কিছুই তলিয়ে গেছে তিস্তার পলি এবং বালিতে কালের বিবর্তনে কখনো কখনো অযাচিতভাবে বেরিয়ে আসে সেসবের কিছু চিহ্ন বা প্রাচীন ইতিহাসের কিছু নিদর্শন তখন সেই সব নিয়ে শুরু হয় নানান জল্পনা কল্পনা তিস্তার গভীর পলি এবং বালি থেকে তুলে আনা হয় প্রাচীন ইতিহাসের নানা উপাদানপ্রাচীনকালে বহু দেশের সীমানা নির্ধারক নদী ছিল এই তিস্তাখেয়ালী তিস্তার গতি পরিবর্তনে একদিকে বিলীন হয়েছে কত গ্রাম, কত প্রাকৃতিক সম্পদ কত মানুষ হয়েছে ভূমি ছাড়া, বাস্তুহারাবিধ্বংসী তিস্তাতে প্রলয়ংকরী বন্যায় কত মানুষ এবং প্রাণী ভেসে গেছেউত্তরবঙ্গের প্রাচীন নদী তিস্তাকে নিয়ে মানুষের কল্পনার অন্ত নেই তিস্তা খেয়ালী, রাক্ষসী, তিস্তা বিধ্বংসী তিস্তা পাড়ের মানুষ, তিস্তাপারের ভাষা, তিস্তা পাড়ের গান, তিস্তাপারের প্রবাদ, তিস্তাপারের সংস্কৃতি নিয়ে কত কিছুই গড়ে উঠেছে তিস্তাকে কেন্দ্র করে কত নাটক-সিনেমা এবং বিভিন্ন ধরনের গল্পকথা তৈরি হয়েছে তিস্তাপাড়ের মানুষের জীবনকাহিনী নিয়ে উত্তরবঙ্গের মানুষের কাছে তিস্তা এক দেবী তিস্তা বুড়ির গান এবং নাচ আজও উত্তরবঙ্গের গ্রামীণ জীবনের এক অমূল্য সম্পদ

 

 

 ছবি- লেখক 

 

 

 

 

 

 

 

 মুজনাই সাপ্তাহিক 

     নদী সংখ্যা 


সুন্দরী করলা

পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় 


টেমসের  মত  নদী আছে এ শহরে 
দুই তীরে নদীটির শোভা ঝরে পড়ে

ইছামতী নদীর তীরে জন্ম এবং শৈশব কেটেছে। রায়ব্রীজ এবং বোটের পুল ( কাঠের নৌকো জোড়া দেওয়া ব্রীজ)  এর স্মৃতিমাখা শৈশব অামার। কেননা মামার বাড়ি ছিল বনগাঁয়। দাদু দিদা কে খুব একটা মনে না পড়লেও ইছামতীর স্মৃতি রয়েই গিয়েছে। 
গোবরডাঙা হিন্দু মহাবিদ্যালয়ে লেখাপড়ার সুবাদে যমুনা নদীর তীরে জমিদার বাড়ি এবং গোটা এলাকা জুড়ে গোষ্ঠ বিহারি র মেলা সার সার নৈকা। বৈঠা হাতে মাঝি, হাঁঁটুর ওপরে ধুতি পরে জেলে জাল ফেলছে।  নদীর পারে চা এবং মুড়ি বাদাম সহ গান, কবিতার আড্ডার কথা স্মৃতির গোটা ক্যানভাস জুড়ে আজও বিদ্যমান। 

১৯৯৭ সালে কর্মসুত্রে জলপাইগুড়ি এসে পরিচয় সুন্দরী করলার সাথে।  তার তীর বরাবর যেখানে যাই, যতদুর  যাই, মুগ্ধতায় মন ভরে যায়। ঠাঁই মেলে করলার পাড়ে, কি সহজ, কি সরল এই মানুষজন। রুটি, রুজির টানে শত দুঃখে, বুকফাটা কষ্টে, একবার তার কাছে আসলেই লাঘব হয়ে যায় সব বেদনা।  আমার একান্ত স্বজন তখন আমার দিদি।  তার চোখেই এ শহর দেখা। নদী এবং নারী  যে সমগোত্রীয় তার প্রথম পাঠ মেলে এই সুন্দরী করলার পাড়ে।

মহালয়ার ভোরে পিতৃতর্পণের সময় মনে হয়, প্রথম রবি কিরণের ছটায় এই সংস্কৃত শ্লোক এর মানে বোঝার মত ক্ষমতা একমাত্র  সর্বসহা, সর্বজয়া, পতিতপাবনী, পূন্যদায়ীনি করলার পক্ষেই সম্ভব। 
করলা ভ্যালির বুকের ওপর অধিষ্ঠাত্রী দেবী তখনই খুশি হন, যখন বকের ডানায় আঁধার নেমে আসে আর কলার খোলে ধুপ, দ্বীপ,  ফল, মিষ্টি ভাসিয়ে দেওয়া হয়।
ছট পুজোর ভোরে করলা ফিসফিসিয়ে কথা বলে কিং সাহেবের ঘাটে। সুন্দরী ষোড়শীর সে কি সাজের বাহার। এই কিং সাহেবের ঘাটেই সুন্দরী করলা, তিস্তাবুড়ী র কাছে মনের কথা কইত।  তিস্তা সই কে  বলত যে এই শহরের মানুষ, শ্মশানের আধপোড়া  কাঠ, কয়লা, আধপোড়া লাশ, পচা গলা সারমেয়, গবাদি পশু,দিনবাজারের গ্লানি মাখা দীনতায় ভরা ভ্রুণ, সারা শহরের প্লাস্টিকের ক্যারিব্যাগ, ফুল,বেলপাতা মা দুর্গা র কাঠামো দিয়ে তার দেহকে বিষাক্ত করেই ক্ষান্ত হয় নি। ২০১১ সালে তাকে  বিষ পান করিয়েছে। সেবার ৪৩ রকম প্রজাতির মাছ তার বুকে ছটফটিয়ে মরেছে। এন্ডোসাফলান,মিথাইল প্যারাথিয়ন,ডাইল্ড্রিন, ডিডিটি কেন তাকে পান করানো হ'ল এই প্রশ্নের কোন সদুত্তর, তিস্তা সই দিতে পারে নি।
তিস্তা সই দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে একটা কথাই বলেছে যত দিন মানুষ  গোপন কথাটি জানতে পারবে না,  যে, " এই শহরের মানুষ দিবারাত্র করলার জল পান করে ততদিন এই অত্যাচার চলতেই থাকবে।"
আজও তিস্তাবুড়ী র মেলায়, মেছেনী নাচের তালে করলা নেচে ওঠে রবীন্দ্র ভবনের দরজার কাছে এসে চুপটি করে গান শোনে, "ওগো নদী আপন বেগে পাগল পারা ',  " ও নদী রে একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে ", আবার কখনো নিজেই গুন গুন করে গেয়ে ওঠে, "  আমি ও নদীর মত হারিয়ে যাব, আসব না ফিরে আর, আসব না ফিরে কোন দিন। 

ছবি- সংগৃহিত 

 মুজনাই সাপ্তাহিক 

    নদী সংখ্যা 





















সই-নদী
মৌসুমী চৌধুরী            

           আমাদের একটি নিজস্ব নদী ছিল ছোটবেলায়। আমাদের সই-নদী। পুঁথিপত্রে তার কি নাম ছিল তখন জানি নি। আমরা তাকে "সাঞ্জাই" বলে ডাকতাম। দেহে তার জড়ান ছিল টলটলে কাঁচরঙা শাড়ি আর তার শাড়ির দুই পাড়ে সবুজের গভীর ইশারা!
        শীতকালে সে নদী যেন বড় শান্ত ঘোমটা পরা পল্লীবধুটি। স্বচ্ছ জলের তলায় তখন দেখা যেত রূপোরঙা বালি আর সবুজ শ্যাওলা। দেখা যেত তাতে খেলে বেড়াচ্ছে ছোট ছোট মাছেদের ঝাঁক। পাড়ার সুশীল জেঠু বঁড়শি আর মাছ ধরবার চাঁই দিয়ে মাছ ধরতেন। খুব মজা লাগত দেখতে। জেলেরাও ছোট ছোট ডিঙি করে জাল ফেলে মাছ ধরত। বোরোলি, সরপুঁটি সহ কত রকমারি মাছ! দেখে ভারী অবাক লাগত! শীতকালে সেই নদীর পাড়ে জমে উঠত আমাদের খিঁচুড়ি আর হাঁসের ডিম-কষা দিয়ে পিকনিক। 
      গরমকালে আমরা বন্ধুরা প্রায়শই  দল বেঁধে নদীর বুকের মধ্য দিয়ে হেঁটে এপাড় থেকে ওপাড়ে যেতাম। ঠিক সেই সময় প্রতিবারই  আমার মনে পড়ত কবিতাটি  ___  "আমাদের ছোটো নদী চলে বাঁকে বাঁকে / বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে..." দল বেঁধে সেই নদীতে হুটোপুটি করে স্নান করা, ডুব সাঁতার আর উল্টো সাঁতার কাটা প্রভৃতি  ছিল আমাদের প্রিয় খেলা। ডুব সাঁতার দিয়ে বন্ধুদের পা টেনে ধরে ভয় দেখানোতে ভোলা ছিল ওস্তাদ! 
        বর্ষায় আমাদের সেই সাঞ্জাই নদী আমূল বদলে যেত। হয়ে উঠত আমাদের একেবারে অচেনা! নদী তখন একেবারে কানায় কানায় ভরে উঠত! তার কালো জলে তখন অশান্ত ঘূর্ণি! সেইসময় আমাদের ছোটদের নদীতে যাওয়া মানা থাকত। একবার ভরা শ্রাবণের এক বৃষ্টি ঝমঝমে দিনে নদীতে স্নান করতে গিয়ে জলে ডুবে মারা গিয়েছিল সুশীল জেঠুর মেয়ে শিখাদি। তারপর থেকে জেঠু আর নদীর ওই ঘাটটিতে কখনও মাছ ধরেন নি। বর্ষায় দুকূল ছাপিয়ে নদীর জল কখনও কখনও ঢুকে পড়ত আমাদের পলাশবাড়ী গ্রামটিতে। অনেক মানুষকে তখন আশ্রয় নিতে হত স্থানীয় পঞ্চায়েত অফিসে বা লাগোয়া ফ্লাড-সেন্টারে অথবা প্রতিবেশিদের দোতলা বাড়িতে। তখন সই-নদীর সঙ্গে আড়ি-পর্ব চলত আমাদের!
       বর্ষার গোমড়ামুখো আকাশ থেকে কালো মেঘেদের আপদ বিদেয় হলে জেগে উঠত ফিকে নীল উদাত্ত আকাশ। তাতে ইতিউতি  ফুটে উঠত পেঁজাতুলো মেঘেদের জাড়িজুড়ি। সাদা সাদা মেঘেদের গায়ে কখনও সিংহের হা-মুখ, কখনও বা মা দুর্গার মুখের আদল! নদীর টলটলে বুকে তাদের ছায়া পড়ত। আর ঠিক তখনই কাশফুলের মুকুট মাথায় হেসে উঠত আমাদের সেই সই-নদী! নদীর বুক থেকে এঁটেল মাটি তুলে নিয়ে কুমোরকাকুর বাড়িতে দুগ্গা ঠাকুরের খড়ের কাঠামোতে মাটির প্রলেপ পড়ত। আনন্দে ডগমগ আমরা দিন গুনতাম মায়ের আগমনের।
          গ্রামের লোকেরা প্রায়ই নিজেদের মাটির ঘরের দাওয়া নিকোনোর জন্য নদীর বুক থেকে মাটি খুঁড়ে খুৃঁড়ে তুলে নিতেন। ফলে আমাদের গ্রামের মহাকাল মন্দিরের কাছাকাছি নদীর একটি ঘাটে গভীর সুড়ঙ্গ মতো সৃষ্টি হয়েছিল। সেই সুড়ঙ্গে ঢুকে মাটি কেটে আনতে গিয়ে মাটির চাঙড় চাপা পড়ে মারা গিয়েছিল আমার বন্ধু রিনা। সেদিন আমাদের নদী-সইও যেন অপরাধী মুখে ধারণ করেছিল আমাদের হাহাকার আর চোখের জল! 
        এভাবে নদীকে ঘিরেই ছিল আমাদের আলিপুরদুয়ার জেলার সেই পলাশবাড়ী গ্রামটির সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নাময় যাপন। তারপর নদীর মতোই আমার জীবনও এঁকে বেঁকে বয়ে গেছে নানা খাতে। নানা সময়ে আমার সখ্যতা হয়েছে নানা নদীর সঙ্গে। কিন্তু মনের কোণে প্রিয় হয়ে থেকে গেছে আমার ছোটবেলার সেই সই-নদী "সাঞ্জাই"।

মুজনাই সাপ্তাহিক 

     নদী সংখ্যা  
















আমার প্রিয় নদী
অদিতি মুখার্জী (সেনগুপ্ত) 
 
প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর আমাদের দেশ, অন্যতম একটি অংশ এ দেশের নদ-নদী। নদীবিহীন সবুজ ভারতবর্ষ কল্পনাতীত। ভারতবর্ষকে অপরূপ সৌন্দর্যে  সৌন্দর্য-মন্ডিত করার পিছনে নদ-নদীর ভূমিকাই প্রধান। ভারতবর্ষের প্রকৃতিকে বৈচিত্র্য, প্রাচুর্য এবং সাথে সাথে সমৃদ্ধি এনে দিয়েছে এই নদীগূলি। 

ভারতবর্ষের উল্লেখনীয় নদীর মধ্যে গঙ্গা, যমুনা, কৃষ্ণা, কাবেরী, নর্মদা, গোদাবরী, মহানদী ইত্যাদির  প্রাধান্য বেশি। তবে প্রিয় নদীর কথা বলতে গেলে, আমার প্রিয় নদীটি ওড়িষা রাজ্যে প্রবাহিত ব্রাহ্মণী নদী।

ব্রাহ্মণী, পূর্ব ভারতের ওড়িষা রাজ্যের একটি প্রধান মরসুমি নদী। এই নদীটি শঙ্ক ও দক্ষিণ কোয়েল নদীর সঙ্গমে গঠিত হয়েছে এবং সুন্দরগড়,দেওদর,আঙ্গূল,ধেঙ্কানল,কটক,জাজাপুর ও কেন্দাপাড়ার মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়। নদীটি বৈতরনী নদীর সঙ্গে মিলিত হয়ে ধামরার কাছে বঙ্গোপসাগরে পতিত হওয়ার আগে একটি বৃহত্তর বদ্বীপ গঠন করে। 


























বাবার কর্মস্থল ওড়িষার সুন্দরগড় জেলার অন্তর্গত রাউরকেল্লায় ছিল, সেই সুত্রেই আমার শৈশব ও কৈশোর রাউরকেল্লাতেই কেটেছে। আর প্রায় প্রত্যেক শীতেই ব্রাহ্মণী  নদীর ধারে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর পিকনিক স্পটগুলোতে বনভোজনে যেতাম। সারাটা দিন খুব আনন্দে কেটে যেতো। কিছু উল্লেখনীয় পিকনিক স্পটগুলো হল- ঝিরপানী, ব্লুস্টোন, লেগুন পার্ক, ভালুলতা, কুয়ারমুন্ডা,  দার্জিং ইত্যাদি। নদীর ওপর পিতমবল বাঁধ আর মন্দিরা বাঁধ দুটি খুবই আকর্ষণীয় এবং তাই পর্যটক বহুল স্থান।

ব্রাহ্মণী নদীর তীরে অবস্থিত আরো একটি রমনীয় স্থান যা পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় ,তা হল বেদব্যাস মন্দির। এই মন্দিরটির নামকরণ মহাকাব্য মহাভারতের রচয়িতা বেদব্যাস মুণির নামেই হয়েছে। 

যখনই কোন প্রবাহমান নদীকুলে যাই, স্নিগ্ধ, স্বচ্ছ, কুল-কূল শব্দে প্রবাহিত ব্রাহ্মণী নদীরকথথা মনে পড়ে যায়। অনেক গভীর ভাবে এই নদীটি যেন আমার জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এটির প্রবাহমান ধারার সাথে আমি নিজের গতিশীল জীবনের সাদৃশ্য খুঁজে পাই। সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার এক অমর গাঁথা বুকে নিয়েই যেন এই নদীটি নিরন্তর ছুটে চলেছে উৎস থেকে মোহনা অবধি।

ছবি ধার -  ইন্টারনেট

মুজনাই সাপ্তাহিক 

   নদী  সংখ্যা 






















আমার  সুটুঙ্গা
রীতা মোদক

 নদী  তো নদীই হয় ।কখনো স্বচ্ছ জলের নিচে চিকচিকে বালির উপর ছোট ছোট মাছেদের খেলা, কখনো ঘোলা জলে কুন্ডলী পাকানো  স্রোতস্বিনী । তবু একটি নদী আমাকে খুব টানে। বুঝি জন্ম জন্মান্তরের সম্পর্ক তার সাথে।  মাথাভাঙ্গা শহরের মাঝ বরাবর আপন বেগে  বয়ে চলছে সুটুঙ্গা ।বাড়ি থেকে স্কুলে যাওয়ার পথে প্রতিদিন দেখা হতো তার সাথে। শহরে ঢুকার পথে আগে এই নদীর উপর  ছিল কাঠের ব্রীজ।    প্রতিটি কাঠের মাথায় ধরে ধরে ব্রীজ পাড়  হতাম । ব্রীজের নিচে ঘাটে বাঁধা থাকতো ছোট ছোট নৌকো।জেলেরা জাল দিয়ে মাছ ধরতো । পানকৌড়ির টুপটুপ জলে ডুব দেওয়া দেখলে মুখ থেকে বেরিয়ে আসতো -- "পানকৌড়ি তোর বর মরছে " ।  সুটুঙ্গার  একটা বড় আকর্ষণ---  দশমীর ঘাট। এখানে বহু বছর ধরে পালিত হয়ে আসছে ভাসানী উৎসব । দূর্গা পূজার শেষে দশমীর  বিকেলে  গ্রাম শহরের সব দূর্গা নৌকায় তোলা হয় ।অনেকেই নৌকাবিহারে অংশ গ্রহন করে।তখন ভরা নদীর দুই পাড়ে উপছে পরা ভিড়। সন্ধ্যায় বিসর্জন শেষে  সকলে বাড়ি ফেরে। 





    























দিনটা সম্ভবত ২০০৭ । প্রবল বর্ষণে জলের স্রোতে কাঠের ব্রিজটা ভেঙ্গে যায় । তখন নদীতে নামে বড় বড় দুটি নৌকো।সাইকেল মানুষ সব নৌকাতেই পারাপার হয়।এর পর ধীরে ধীরে তৈরী হয় পাকা ব্রীজ।ব্রীজের পাশে বয়স্কদের সময় কাটানোর জন্য ছোট্ট পার্ক ।
সুটুঙ্গা আবার আলোক সজ্জায় সেজে ওঠে ছট পুজোর রাতে। নদীর এক পাড়ে মহা শ্মশানের নিরবতা ,আরেক পাড়ে সূর্যের আরাধনায় মগ্ন মানুষের  উপছে পরা ভিড়।এটাই সুটুঙ্গার  সৌন্দর্য।

     শীতে ওএই নদী পুরো শুকায় না। সকালের প্রথম সূর্য স্পর্শে সুটুঙ্গার  জল সোনালী হয়ে উঠে।  আবার ভরা বর্ষায় ছোট্ট নদীটা ভয়ঙ্করী হয়ে উঠে।  তীরে গজিয়ে উঠা ফুটপাতি জীবন ভেসে যায় স্রোতের টানে। শহরের বর্জ্য আবর্জনা ধুয়ে নিয়ে আবার পবিত্র হয় আমার সুটুঙ্গা।

ছবি- লেখক 

মুজনাই সাপ্তাহিক 

    নদী সংখ্যা  















নদী
সুতপা রায়

চারিদিকে ভৈরব ভৈরবী
              গাজনে মগন। 
কিছু নেই, নেই কোনো পিছু টান 
ভেসে যেতে যেতে উদাস মনে
ফের যদি ফিরে আসি অজয় তীরে
পারবে কী খুঁজে নিতে নুড়ি পাথরে?  
পেছন ফিরে দেখনি কখনও কী ফেলে এসেছ।
প্রকৃতির সুর তাল নিয়ে
আসবে জোয়ার অজয়ের বানে
তারই স্রোতে জীবনের মানে।
নিশুতি রাতের তীরের কান্না, আত্মোগ্লানী
বাড়িয়ে দেয় বিশ্বাস
বলে জিতবে তুমি
হব আমরা নিশ্চই জয়ী।
তুমি আপন বেগে চল
যায় না তোমায় ধরা
আমি যেন এপার ওপার
দুই কূল বিষ্ময়ী  তারা।

ছবি- শৌভিক রায় 

মুজনাই সাপ্তাহিক 

   নদী সংখ্যা  













তিস্তা বুড়ি
বিজয় বর্মন

বিষন্নতার ওপারে তোমার সোনা মুখ,
ওগো নদী সাক্ষাৎ জননী,তুমিই জানো,
আমার সভ্যতার আদি কথা।

সাত পুরুষের অনন্ত ঘুমে 
তিস্তা পারের ইতিহাস,
কাঙাল মনের ঘরে,তোমার নিরবতা,
নদীর জন্ম দেয়,
তোমাতেই রচিত গানের কথায়,
ভাওয়াইয়া হৃদয় ভাঙে।

পুজার মঞ্চে অধিষ্ঠিতা,
ভাসাই জলে ঢোনা,
আত্মার শ্রদ্ধাঞ্জলি, কৃষ্টি পরম্পরা।

তুমি আমার তিস্তা বুড়ি,
তোমার গর্ভে জমা যত হাসি কান্না,
সুখে দুঃখে তুমি জীবন রেখা।
             
                                   
ছবি ঋণ- বিশ্বজিৎ সরকার

 মুজনাই সাপ্তাহিক

     নদী সংখ্যা  

ভালো থেকো প্রিয় নদী

শ্রাবনী সেনগুপ্ত


প্রিয় নদীটি সুবর্ণরেখা ,

বুকে তার স্বপ্নের ছবি আঁকা

আপন খেয়ালে বয়ে চলে,

মনে মনে কত কথা বলে

বুকে পাথরের বাঁকে বাঁকে কত স্বপ্ন বোনা ,

বৃষ্টির জলে জন্ম যে তারমেঘের কাছে শোনা

সূর্যাস্তের রং তার তীরের বালুচরে পড়ে

চিকচিক করে যেন গলানো সোনা

পাড়ে তার পাহাড়ের সারি

অপূর্ব শোভাদেখতে ভালো লাগে ভারি

"গৌরীকুঞ্জ" 'পথের কবি' সাধের বাড়ি,

তোমার কূলেতে লেখা যশোগাথা তারই

চলার পথেতে পড়ে কত জনপদ,

ঘাটশিলা,গালুডি,হুড্রু জলপ্রপাত

পৌষসংক্রান্তিতে আদরের টুসুকে ভাসিয়ে

ঘরে ফেরে সকলে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে

ভালো থেকো প্রিয় নদী

আবার দেখা হয় যদি,

কথা হবে তোমার সাথে

সাঁঝের বেলায় কিংবা প্রভাতে


ছবি- সংগৃহিত