Thursday, April 20, 2023

 

।পত্রিকা পরিচিতি 





লোকমানস


দেবাশিস ভট্টাচার্য সম্পাদিত `লোকমানস` নতুন সংস্করণ ৪র্থ সংখ্যা, মার্চ ২০২৩ পত্রিকাটি নিঃসন্দেহে সংগ্রহে রাখবার মতো। এই সংখ্যায় এগারোটি প্রবন্ধ সহ রয়েছে অনুবাদ গল্প, কবিতা, নিবন্ধ, অনুগল্প, ভ্রমণ, মুক্তগদ্য, নাটক, আঞ্চলিক ভাষার কবিতা, সাক্ষাৎকার, বই আলোচনা ইত্যাদি। দুশো-সাত পাতার পত্রিকাটির প্রচ্ছদ করেছেন  প্রশান্ত সরকার। বিশেষ উল্লেখযোগ্য হল কবি কমলেশ রাহাকে নিয়ে একটি ছোট্ট স্মরণ।

শ্রদ্ধেয় অর্ণব সেন, প্রমোদ নাথ, ডঃ দীপক কুমার রায় প্রমুখ প্রখ্যাত প্রাবন্ধিকদের পাশাপাশি তপোধীর ভট্টাচার্য, বিজয় দে,  রানা সরকার, বেনু সরকার, দেবজ্যোতি রায় প্রমুখের কবিতা পত্রিকার বড় সম্পদ। অবশ্য প্রবন্ধ ও কবিতার সূচিতে আরও অনেকেই আছেন যাঁরা যথেষ্ট পরিচিত। অপূর্বকুমার চক্রবর্তী, শুভময় সরকার, মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য প্রমুখেরা গল্প বিভাগকে সমৃদ্ধ করেছেন। গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্যের ভ্রমণ, শ্যামলী সেনগুপ্তর অনুবাদ কবিতা, দীপায়ন ভট্টাচার্যের নাটক নিঃসন্দেহে উপরি পাওনা। কোনও কোনও লেখক-কবির একাধিক সৃজনও রয়েছে। সম্পাদকের নিজের নেওয়া ডঃ অজয় মণ্ডলের সাক্ষাৎকারটি অভিনব। আছেন বহু কবি-লেখক। সকলের নাম আলাদা করে উল্লেখ করলাম না।  কবিতার ক্ষেত্রে নবীন প্রজন্মের কবিদের লেখা পেলেও, অন্যান্য বিভাগে তাঁদের প্রতিনিধিত্ব তুলনায় কম। 

`কমপ্লিট ম্যাগাজিন` বলতে যা বোঝায় `লোকমানস` সেটিই। সম্পাদকের আন্তরিক প্রচেষ্টা অবশ্যই প্রশংসনীয়। পত্রিকার মুদ্রণ ঝকঝকে। কাগজ যথেষ্ট ভাল। বাঁধাই চমৎকার। আগামীতে লোকমানসের হাত ধরে বহু লেখক উঠে আসবেন এই আশা রইল। 










 

দ্যুতি
 
আজিজুল হক সম্পাদিত `দ্যুতি' ইতিমধ্যেই পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। সাংস্কৃতিক চতুর্মাসিক এই পত্রিকার একাদশ বর্ষ প্রথম সংখ্যার বিষয়- ভাষা। শ্রদ্ধেয়  তপোধীর ভট্টাচার্য, সৌমেন নাগ, আনন্দগোপাল ঘোষ, রণজিৎ কুমার মিত্র, প্রমোদ নাথ প্রমুখ বিশিষ্ট প্রাবন্ধিকদের লেখা সহ মোট ২৪টি প্রবন্ধ এই সংখ্যাকে সমৃদ্ধ করেছে। ভাষা শহীদ পট্টি শ্রীরামালু থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথের ভারতবোধ ও মাতৃভাষা, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের গুরুত্ব, আলিপুরদুয়ার জেলার লোকভাষা, ভাষার আধিপত্য ও বর্তমান সংকট ইত্যাদি নানা বিষয়ের প্রবন্ধগুলি পাঠকদের মুগ্ধ করে। 

ইমদাদুল হক মিলন, কৌশিক সরকার ও সঞ্জয় কুমার নাগের গল্প নিয়ে নতুন কিছু বলার নেই। তাঁরা নিজেদের সুনাম বজায় রেখেছেন। আমিনুর রহমান, অম্বরীশ ঘোষ, শঙ্খনাদ আচার্য, বিপুল আচার্য, প্রাণজি বসাক, উত্তম চৌধুরী, কৃষ্ণা ব্রজবাসী, গীতাঞ্জলি দাসের কবিতাগুলিও ভাল লাগে। দিনহাটার বর্ষীয়ান ক্রীড়াবিদ চন্দন সেনগুপ্তের আত্মকথন এই সংখ্যার বিশেষ পাওনা। 

সম্পাদকীয় কলমে  `এদেশের কোন জাতীয় ভাষা নেই অথচ একটি বিষয়ে ভাষাকে আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে` বলে যে আশঙ্কা করা হয়েছে তা অমূলক নয়। লিটল ম্যাগাজিনের সঙ্গে কমবেশি যুক্ত সকলে তো বটেই, এই ভয় কিন্তু আজ সচেতন সব মানুষকেই ঘিরে ধরেছে। সম্পাদক সঠিক বার্তা দিয়েছেন- `আমাদের মাতৃভাষার গৌরবকে যদি অম্লান রাখতে হয় তবে মাতৃভাষা বিষয়ক সচেতনতার প্রসার ঘটানো এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় দায়িত্ব।`  

কৃষ্ণজিৎ সেনগুপ্তর তাৎপর্যময় প্রচ্ছদে, সুন্দর মুদ্রণে `দ্যুতি` এই সংখ্যাতেও মননের ছাপ রেখেছে। 










খোলা চোখে 

নবপর্যায়ের দ্বিতীয় সংখ্যায় বিদ্যুৎ সরকার সম্পাদিত `খোলা চোখে' পত্রিকার থিম ছিল স্বাধীনতার ৭৫ বছর। সেই সূত্র ধরে বিকাশ চক্রবর্তী তুলে ধরেছেন `দেশভাগের উত্তরবঙ্গ ভাঙন জনিত সংকটের সাতকাহন`। ডঃ রাজর্ষি বিশ্বাস লিখেছে উত্তর স্বাধীনতা পর্বের জলপাইগুড়ি জেলার রাজনৈতিক আন্দোলনের চালচিত্র। শ্রদ্ধেয় আনন্দগোপাল ঘোষের পর্যবেক্ষণ হল স্বাধীনতার পর ৭৫ বছরে উত্তরবঙ্গে জেলা-মানচিত্রের পরিবর্তন। আছেন অভিজিৎ দাশ, হরিপদ রায়, পামেলা সরকারের মতো বিশিষ্ট প্রাবন্ধিকরা। বিদ্যুৎ সরকারের নিজের লেখাটিও মনোগ্রাহী।
 
সংস্কৃতি চর্চায় নাট্য ব্যক্তিত্ব দীপায়ন ভট্টাচার্যের `মালবাজারের নাট্যচর্চা` একটি দুরন্ত ডকুমেন্টেশন। অধ্যাপক জয়দীপ সরকারের সাময়িকী চিন্তার খোরাক যোগায়। দুর্নীতির ট্র্যাডিশন তাঁর কলমে বিদ্ধ হয়েছে। কালীকৃষ্ণ সূত্রধরের রায়সাহেব পঞ্চানন বর্মাকে নিয়ে লেখাটিও অনন্য আলোকপাত।              

Tuesday, April 18, 2023

 




। পাঠ প্রতিক্রিয়া।


শ্রাবণ মুখর সন্ধ্যা: মনোমিতা চক্রবর্তী 


করলা ভ্যালি চা বাগানে বসে শিক্ষিকা মনোমিতা চক্রবর্তী সাহিত্য চর্চা করে চলেছেন। সম্প্রতি তাঁর দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ `শ্রাবণ মুখর সন্ধ্যা` হাতে এসেছে। এর আগে লেখকের `জীবনের গল্প' গ্রন্থটি পড়বার সুযোগ হয়েছে। প্রথম গ্রন্থের তুলনায় দ্বিতীয় গ্রন্থে মনোমিতাকে অনেক বেশি অভিজ্ঞ মনে হয়েছে। যে কোনও গল্পকারের কাছে এই উত্তরণ জরুরি। যদিও দ্বিতীয় গ্রন্থে গল্পকার নিজেকে সেভাবে ভাঙতে পারেননি। তবে মাত্র দুটি গ্রন্থে কিছু গল্প পড়ে গল্পকারকে বিচার করা উচিত না। সেটি করছিও না। বরং অপেক্ষা করছি পরবর্তী জন্য। 

`শ্রাবণ মুখর সন্ধ্যা` গ্রন্থটিতে ঊনচল্লিশটি গল্প মলাটবন্দি হয়েছে। কিছু গল্প অণুগল্পের পর্যায়ভুক্ত। বাকিগুলিও কলেবরে খুব বড় নয়। 

মনোমিতার গল্পের যে দিকটি সবচেয়ে ভাল লাগে তা হল, তাঁর গল্পে আরোপিত কোনও কৃত্রিমতা নেই। তিনি যা দেখেছেন, যা বুঝেছেন সেটিই তুলে ধরেছেন। ফলে তাঁর গল্পগুলির চরিত্রদের খুব চেনা লাগে। আনন্দবাবু, মলয়বাবু, ফুলমতি, নুপুর, দীপ প্রমুখরা প্রত্যেকেই যেন আমাদের আশেপাশে রয়েছেন। তাদের কথা বলার ভঙ্গি, যাপন, ভাবনা ইত্যাদি সবকিছুর সঙ্গে একাত্ম বোধ করেন পাঠকেরা।  কিছু কিছু গল্পে আবার তারা যেন নিজেকে খুঁজেও পান। আবার কিছু গল্পে মনোমিতা সম্ভবত তাঁর নিজের কোনও অভিজ্ঞতাও গল্পের বুননে পাঠকের সামনে রাখেন। আসলে এমনটাই হওয়ার কথা। কেননা অভিজ্ঞতা ও কল্পনার মিশেলেই সৃষ্টি হয় গল্প।  

উপস্থাপনার ক্ষেত্রে মনোমিতা সহজ সরলভাবে গল্পগুলিকে আখ্যায়িত করেছেন। চমক সৃষ্টির আলগা প্রয়াস তাঁর নেই। যেটুকু আছে, গল্পের প্রয়োজনেই সেটুকু এসেছে। যেমন `শিক্ষা' গল্পটিতে অমিত ও রিনি বাবা-মা`কে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসার পর জানতে পারে তাদের বাড়ি ছাড়তে হবে, কেননা বাড়িটা আগে থেকেই অনাথ আশ্রমে দান করা। `ধ্বংস' গল্পটিতে মীরা দেবীর নিজের বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভাইপো অজিতের স্ত্রী রিমির গর্ভপাতে খানিকটা চমক থাকলেও, ছবিটি যেন অত্যন্ত চেনা। `ভালোবাসা আসলে অনুভূতি` গল্পের শ্রেয়া শেষ পর্যন্ত নিজের মৃত্যুতে যেন ভালবাসার খেলায় জিতে যায় অন্যভাবে। এভাবেই একের পর এক গল্পে নানা প্লট ও ঘটনা পরম্পরা পাঠককে গল্পগুলি পড়তে বাধ্য করে। পাঠ শেষে একটি হালকা রেশ রয়ে যায়। 

ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়েছে শব্দচয়নের ক্ষেত্রে মনোমিতাকে আরও যত্নশীল হতে হবে। `কান্না মিশ্রিত গলা', `সম্পর্কযুক্ত`, `চির নিদ্রার পথযাত্রী` `চুম্বন দিয়ে শক্ত করে ধরে` ইত্যাদি শব্দবন্ধের ব্যবহার গল্পের গতিকে রুদ্ধ করেছে। আবার, প্রেমকে বোঝানোর জন্য জনপ্রিয় `কেয়া হুয়া তারা বাদা...` জাতীয় প্রয়োগ কিন্তু শেষ অবধি ভাল লাগে না। 

মনে রাখতে হবে, নিজস্ব ভাষা ও স্টাইল সৃষ্টি না করা অবধি কিন্তু সাহিত্যের কোন শাখাতেই স্থায়ী আসন পাওয়া যায় না। প্রশ্ন আসতে পারে নিজস্ব ভাষা ও স্টাইল সৃষ্টি হবে কীভাবে? সব কিছুই তো বলে ফেলা হয়েছে। শব্দও তো নতুন কিছু সৃষ্টি হচ্ছে না। তাহলে পূর্বের সৃষ্টির সঙ্গে পার্থক্যটা ঘটবে কীভাবে? উত্তর হল, প্রয়োগে। যেখানে পূর্ববর্তীদের লেখা থেমেছে, সেখান থেকে এগিয়ে নিতে হবে নিজের সৃষ্টিকে।  

তবে এই দুর্বলতা (একান্তই আমার মতে) মনোমিতা আগামীতে অবশ্যই কাটিয়ে উঠবেন। এটা আশা করি। মনোমিতার বয়স অল্প। লেখার জন্য বহু সময় পড়ে আছে। তবে দ্বিতীয় গ্রন্থ হিসেবে মনোমিতার যাত্রার রেখাচিত্র অবশ্যই উর্দ্ধগামী। 

বইটির প্রকাশক শব্দ সাঁকো। সুমন হাজরার প্রচ্ছদ ভাল লেগেছে। কিছু কিছু লাইনের শুরুতে দাড়ি (।) থাকাটা ভয়ঙ্কর দৃষ্টিকটু। কোথাও কোথাও স্পেসের অভাবে সৌন্দর্য মার খেয়েছে। `মলয় বাবুর ছাত্ররা` গল্পটি সহ বেশ কিছু গল্পে ইনভার্টেড কমার উল্টো ছাপা প্রমাণ করে যে প্রুফ ঠিকমতো দেখা হয়নি। এই বিষয়েও সচেতন হওয়া দরকার।

আলোচক: শৌভিক রায়       

  

Monday, April 17, 2023


পাঠ প্রতিক্রিয়া

Poems of Dreams Language of Sunset- Santosh Sinha/ Translated by Biplab Sarkar 

Evincepub Publishing 

Price- Rs. 185/-

 

প্রথিতযশা অধ্যাপক প্রয়াত শ্রদ্ধেয় অশ্রুকুমার শিকদার বা কবি-আলোচক প্রখ্যাত গোপাল লাহিড়ীর মতো মানুষ যে কাব্যগ্রন্থের ভূমিকায় ভূয়সী প্রশংসা করেন, সেই কবিতার বই নিয়ে কিছু বলা বাতুলতা। তার ওপর উপরি পাওনার মতো রয়েছে আমেরিকার Transcendent Zero Press ও    Harbinger Asylun-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক Dustin Pickering-এর মূল্যবান কথা। তবু কিছু বলতে হচ্ছে একটাই কারণে। কেননা কাব্যগ্রন্থটি একটি অনুবাদ কর্ম। অনুবাদ করেছেন তরুণ কবি বিপ্লব সরকার। মূল কবিতাগুলি বর্ষীয়ান কবি শ্রদ্ধেয় সন্তোষ সিনহার। কিন্তু কবি সন্তোষ সিনহার কবিতাকেই কেন বিপ্লব বেছে নিলেন? 


প্রশ্নটির উত্তর বিপ্লবের ভাষায়- uniqueness of the way of expression in a subconscious state of mind. বিপ্লব এটাও বলেছেন যে, কবি সন্তোষ সিনহার কবিতা অনুবাদ করতে গিয়ে কখনও কখনও তাঁর মনে পড়েছে বিখ্যাত কবি John Donne-এর The Good Morrow বা The Anniversarie শীর্ষক বিখ্যাত কবিতাগুলির কথা। কেননা কবি সন্তোষ সিনহার কবিতা  `so pervasive and centralised`   John Donne-এর কবিতার সঙ্গে যাঁদের সামান্য পরিচয় রয়েছে, তাঁরা বুঝতে পারবেন এই তুলনা করতে গেলে ঠিক কতটা সাহস লাগে। বিপ্লব সেটা করেছেন। এই বিষয়ে নিজের কাছে তিনি সৎ ও স্বচ্ছ। এখন কবি সন্তোষ সিনহার কবিতা (অবশ্যই সব নয়, কিছু কিছু)  ও বিপ্লবের অনুবাদ সেই পর্যায়ভুক্ত কিনা তার বিচার করবে মহাকাল। আপাতত এটুকু বলা যায়, অনুবাদগুলি পড়লে কবি সন্তোষ সিনহার কবিতা সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে। বাংলা ভাষার বাইরে যে অগুনতি পাঠক রয়েছেন তাঁরা বুঝতে পারবেন, বাংলা কবিতা এই মুহূর্তে ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। কেননা বর্তমান সময়ে যে কতিপয় কবি  বাংলা কবিতার সত্যিকার (in the true sense of the term...আমার নিজের অনুবাদ ঠিক হল কিনা সেই বিষয়ে অনুবাদকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি) প্রতিনিধিত্ব করছেন, তাঁদের মধ্যে অবশ্যই কবি সন্তোষ সিনহা অন্যতম। তাই অনুবাদের কাজটি করে বিপ্লব সত্যিই বৈপ্লবিক একটি কাজ করলেন। অনুবাদের কাজ সেভাবে আর কোথায়? 

বিপ্লব যে কবিতাগুলি অনুবাদ করেছেন সেগুলির রচনাকাল ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৮। মোট ৬১টি কবিতা রয়েছে  Poems of Dreams Language of Sunset শীর্ষক কাব্যগ্রন্থে। কবিতাগুলি রচনার সময় কবি সন্তোষ সিনহার মানসিক স্থিতির একটি নিপুন বর্ণনা দিয়েছেন কবি-পত্নী শ্রীমতী বাসন্তী সিনহা। আসলে সকল কবির জীবনেই বোধহয় এমন একটি সময় আসে। একটি অদ্ভুত আবহে তাঁরা বন্দি করে ফেলেন নিজেকে। যাপন করেন ঘোরের মধ্যে। সেই অবস্থায় বোধহয় নিজেরাও বোঝেন না ঠিক কী বলছেন বা করছেন। আমাদের মতো সাধারণেরা সেই অবস্থাকে বুঝতে ঠিক পারি না, ব্যাখ্যাও করতে পারি না। হয়ত কবি পরবর্তীতে নিজেও সেটা পারবেন না। কিন্তু সেই অজানা ঘোর থেকেই তাঁরা লিখে ফেলেন এমন কিছু কথা যা নিমেষে আলাদা করে দেয় তাঁদের।  ১৪ জানুয়ারি ১৯৯৪ তারিখের ভোরে কবি সন্তোষ সিনহার সেই মানসিক পরিস্থিতি থেকে যা লিখেছিলেন অনুবাদক বিপ্লব তাকে বর্ণনা করেছেন-  There are some entrails around me/ The womb becomes pierced by an evil generation..../ What I see/ For that/ Don`t need much alphabet । এভাবেই এগিয়েছে বিপ্লবের অনুবাদ। 

অনুবাদের ক্ষেত্রটি কিন্তু সবসময় একটু কঠিন কাজ। বিশেষ করে কবিতার অনুবাদ। কেননা বিভিন্ন মানুষের কাছে কবিতার interpretation আলাদা আলাদা হতে পারে। তাই অনুবাদক যেভাবে অনুবাদ করলেন সেটিই যে মূল কবিতাটির আত্মা, সে বিষয়ে জোর দিয়ে কিছু বলা যায় না। অনুবাদটি অন্যরকম হতেই পারে বা পারত যদি অনুবাদকের কাছে তার interpretation আলাদা হত।  তবে সামগ্রিকভাবে একটি বক্তব্য থাকে সব কবিতার ক্ষেত্রেই। সেটিকে ধরে এগোনোই যায়। ব্যাপারটি অনেকটা যেন মূল দরজার ভেতর দিয়ে ঢুকে একটি ঘরের আনাচে কানাচে আরও দরজা বা জানালা আবিষ্কার করা। দ্বর্থহীন ভাবে বলব, বিপ্লব সেটি পেরেছেন। আর পেরেছেন বলে তাঁর অনুবাদে উঠে এসেছে The crazy wind blowings want to eat my lungs away/ Yet under these legendary trees of swayings/ I`m here with some bones only বা  Those who are there spreading feathers I`d like to tell them secretly....be careful, Cover yourself up shaking all the nobilities and celebrated sunshine off  জাতীয় লাইন। 

কবি সন্তোষ সিনহা বা অনুবাদক বিপ্লব সরকার ঠিক কী বলতে চেয়েছেন কবিতাগুলিতে? পাঠকদের interpretation আলাদা হবে ঠিকই, তবু বলা যায় এক অসামান্য দর্শন যেন কবিতাগুলির ছত্রে ছত্রে। একক ব্যক্তি মানসের এক অন্তর্লীন যাত্রায় সেই দর্শনে ফুটে ওঠে এক অদ্ভুত কান্না। ভবিষ্যতদ্রষ্টা কবি দেখেন এক নষ্ট জীবন যেখানে মিলেমিশে যায় সব জীবন বোধ। সামগ্রিকতার বিচারে যূথবদ্ধ মানবের একক স্খলন যে অবক্ষয়ের সূচনা করে সেখানে সত্যিই দরকার রুদ্র তাণ্ডব থেকে শুরু করে তথাগতর আত্মস্থ জীবনীশক্তিকে। জীবনবোধ যখন প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড়ায়, তখনই শুরু মানবমনের এই যাত্রা। ভেঙে চুরমার হয়ে যায় এতদিনের লালিত সংস্কার। যন্ত্রনাবিদ্ধ মানুষ শুধু চায় এমন কোনও  আশ্রয় যা তাকে শীতল করবে। উপশম হবে সব কষ্টের। নিজের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সে পাবে সব প্রশ্নের উত্তর। এই যাত্রা আসলে মনের। এই কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলিতে সেই একক যাত্রার এক দর্শন ধরা হয়েছে। বড় প্রবল তার অভিঘাত।    

শব্দ চয়নে ও কবিতার আত্মা স্পর্শে অনুবাদকের মুন্সিয়ানা নিঃসন্দেহে এই কাব্যগ্রন্থের বড় পাওনা। অনুবাদের কাজ হয়ত অনেকে করেন, কিন্তু সেটা কতটা অনুবাদ হয় সে বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে আমার। কিন্তু বিপ্লব তার নিরসন করেছেন। অন্তত এই কাব্যগ্রন্থের ক্ষেত্রে। মনে হয়, কবি সন্তোষ সিনহার মতো অনুবাদক বিব্লব সরকারেরও অনুবাদের সময় একটি ঘোর কাজ করছিল। যে subtelty, wit, imagery ইত্যাদি অনুবাদের কাজটিকে জীবন্ত করেছে তা অর্জন করা সহজ যায়। বিপ্লবের বয়স অল্প। আগামীতে অনুবাদকের ভূমিকায় তাঁকে আরও কাজ করতে দেখাব এরকম আশা করা যায়। কেননা Poems of Dreams সেই ইঙ্গিত দিচ্ছে। তবে কিছু কবিতা অনুবাদের ক্ষেত্রে বিপ্লব একটু তাড়াহুড়ো করেছেন বলে মনে হচ্ছে। উৎকর্ষতার দিক থেকে সেগুলি আরও যেন ভাল হতে পারত, যেমন ৩১ ও  ৪৭ নম্বর কবিতা দুটি। এরকম আরও কয়েকটি রয়েছে। শব্দচয়নেই ক্ষেত্রেও দুই একটি জায়গায় মনে হয়েছে আরও catchy word ব্যবহার করলে ভাল হত। মনে রাখতে হবে, অনুবাদ মানে কিন্তু একটি ভাষার সৃষ্টিকে অন্য ভাষায় প্রতিষ্ঠার লড়াই। 

সবশেষে, কবি সন্তোষ সিনহা ও অনুবাদক কবি বিপ্লব সরকারের জন্য শুভেচ্ছা ও শুভকামনা রইল। বিশ্বাস করি, পৃথিবীতে কিছু কাজ এমন থাকে যার মূল্য পরিমাপ করা যায় না। এই কাব্যগ্রন্থটিও সেই অমূল্য কাজের একটি হয়ে রইল।   

আলোচক- শৌভিক রায়  
 

Tuesday, April 4, 2023


 সম্পাদকের কথা

আবার একটা বছর আসতে চলেছে। কালের নিয়মই তাই। একজন যাবে, নতুন একজন আসবে। যাওয়া-আসার এই চক্রে পুরোনোকে ভুলে চলে না। কেননা বর্তমান দাঁড়িয়ে থাকে অতীতকে ভিত্তি করে। পূর্বের সবকিছুর যদি পুনরাবৃত্তি হয়, তবে সভ্যতা এগোয় না। তাই অতীত থেকেই আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়। অতীতকে পেছনে রেখে এগিয়ে যেতে হয় নতুনের পথে। আশা করি, আগামী নববর্ষে আমরা ফেলে আসা ভুলত্রুটি সরিয়ে নতুন করে বেঁচে উঠব। সাজিয়ে তুলব আমাদের পৃথিবী। পাশাপাশি আর একটি কথাও মনে রাখা প্রয়োজন। `ভাল` বিষয়টির কোনও শেষ নেই। তাই ব্যক্তিজীবনে `ভাল`-এর পেছনে দৌড়ে কোনও লাভ নেই। একটা পর্যায়ে এসে থামা উচিত। আর দৌড় চালু রাখা উচিত সামগ্রিক মানব জাতির কল্যাণে। এটিই প্রকৃত মানুষের কাজ। যাঁরা তেমন করেছেন, তাঁরাই মহামানব। বর্ষশেষে আমাদের প্রতিজ্ঞা হোক এটিই।    


 মুজনাই অনলাইন চৈত্র  সংখ্যা ১৪২৯ 

                                              রেজিস্ট্রেশন নম্বর- S0008775 OF 2019-2020

হসপিটাল রোড 

কোচবিহার 

৭৩৬১০১

ইমেল- mujnaisahityopotrika@gmail.com (মাসিক অনলাইন)

- mujnaiweekly@gmail.com (সাপ্তাহিক) 

প্রকাশক- রীনা সাহা  

সম্পাদনা, প্রচ্ছদ,  অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায় 

মুজনাই অনলাইন চৈত্র সংখ্যা ১৪২৯ 

       

এই সংখ্যায় আছেন যাঁরা 

বেলা দে, চিত্রা পাল, গৌতমেন্দু নন্দী, সপ্তাশ্ব ভৌমিক, পার্থ বন্দোপাধ্যায়, 

সুদীপ দাস, রীনা মজুমদার, প্রতিভা পাল, সুভাষিতা ঘোষ (দাস), 

সুনন্দ মন্ডল, স্বপন কুমার দত্ত, বটু কৃষ্ণ হালদার, মৌসুমী চৌধুরী, 

বিনয় বর্মন, সীমা সাহা, অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী,  টিনা ভট্টাচার্য, 

মনোমিতা চক্রবর্তী, জনা বন্দোপাধ্যায়, পূর্ণিমা বোস, টি এইচ মাহির, 

শতাব্দী সাহা, লীনা রায়, দেবদত্তা লাহিড়ী, সারণ ভাদুড়ী, 

অলকানন্দা দে, বিজয় বর্মন,  আশীষ কুমার বিশ্বাস, দেবযানী সেনগুপ্ত, 

এস সাহা (সঞ্জয়), রথীন পার্থ মণ্ডল,  ছবি ধর, বিপ্লব গোস্বামী, 

 বিনিময় দাস, মজনু মিয়া, রিসা দাস, সোমনাথ বণিক 

মুজনাই অনলাইন চৈত্র সংখ্যা ১৪২৯




ছবি- রিসা দাস 


ক্রোড়পত্র 

ভাঙন 
সপ্তাশ্ব ভৌমিক

পাড় ভাঙে  
নদী ভাঙে না

ঢেউ ভাঙে  
জল ভাঙে না 

শরীর ভাঙে
বয়স ভাঙে না 

ঘুম ভাঙতেই 
স্বপ্ন ভেঙে যায়।



আঘাত
সুদীপ দাস

কখনো আঘাত দিও না কারে,
অজান্তে, যদি দিয়ে দাও কভু!
নত হয়ে তার কাছে দাঁড়িয়ো তবু।
তব আঘাতে, তার জীবন বিষাদময়
অন্তরের রক্ত ক্ষরনে তার শত মৃত্যু হয়।
আঘাত আনে ধ্বংস কত , কত প্রাণ যায়!
আঘাতে কারো শিল্প সত্বা দহনে পুরে ছাই 
তোমার আঘাতে জরা ব্যাধিতে নিস্তার কারো নাই।
আঘাতের বশে কারো মুখ ম্লান, সাঙ্গ হল হাসি
নিজের জীবনে আঘাত পেয়ে কত জন সর্বনাশী।
এ আঘাতে বড়ই কষ্ট, নির্বাক হয়ে রয় প্রাণচ্ছল যত
প্রজাপতির মত উড়ত যে জন, সে আজ কত নিস্তব্ধ।
নিজের স্বার্থে কাওকে কখনো আঘাত দিওনা
নববর্ষে সবার জীবনে বয়ে চলুক এই চেতনা।




আলোকময় নতুন বছর
   রীনা মজুমদার

একটি চারা গাছ ভালোবাসাময়
গাছ সমগ্র পৃথিবীর প্রাণ ও সৌন্দর্য 
মাটির বুকে বৃষ্টির জল গাছের
   শেকড়কে করে শক্তিশালী

একটি নবজাতক শিশু ভালোবাসাময়
শৈশব সমগ্র পৃথিবীর প্রাণ ও সৌন্দর্য
অশান্ত সমাজ কখনো শৈশবকে করে
   হিংস্রতার চেয়ে শক্তিশালী 

যেমন, স্রোতস্বিনী জল পাথরের চেয়ে,
ভালবাসাও সর্বশক্তির চেয়ে শক্তিশালী 

একটি কুঁড়ি যেমন গাছের প্রস্ফুটিত ফুল!
 শৈশবও গড়ে ওঠে গৃহস্থ বাড়িতেই, তাই
ঘরে ঘরে জীবনবোধ হোক ভালোবাসাময়
  তবেই সমাজ ও প্রকৃতি কল্যাণময় 

  নতুন বছর উজ্জ্বল আলোকময়...



চৈত্রর চৌকাঠ

প্রতিভা পাল

 

শেষ বসন্তর চৌকাঠে কড়া নাড়ে 

বৈশাখের খর রোদ, নব সূচনার আঙ্গিকে ;

তারিখের ধারাপাত সময়ের খেয়াঘাটে 

দাগ রেখে যায় সংখ্যার রাত-দিন মেপে ;   

পঞ্জিকার নতুন গন্ধে কেবল আগামীর জলছবি,

পুরনো পৃষ্ঠারা কাগজের নৌকা হয়ে 

ভেঙেচুরে ভেজে অতীতের এক কোণে ;

টুকরো টুকরো সব কেবল এক অবয়ব ঘিরে ! 

মন, মনের মনে হওয়া সমস্ত কেন্দ্র করে

ঋতুর ঘূর্ণন;

অথচ মুহূর্তর ঘূর্ণাবর্ত অস্তিত্বে স্থিত হলেও 

ঘূণাক্ষরে জানতে পারে না জীবন !

সারাবছরের যত হিসাব, বেহিসাবি হলে 

চৈতী হাওয়ায় ভাসে নির্ভার এক উপসংহার, 

নববর্ষের শিহরণে….




বৈশাখ 

সুভাষিতা ঘোষ (দাস)


শিশিরের গন্ধ বুঝি ফুরিয়েছে আজ
কৃষ্ণচূড়ার মধুভারে উষ্ণতা সুসজ্জিত 
সাদা ধূলো চেয়ে আছে ঈশানের কোণে
অনুভূতির শব্দজুড়ে চাতকের তৃষ্ণার্ত !

পর্নমোচীর জীবনজুড়ে সবুজের আশীর্বাদ 
শিরায় শিরায় পাচ্ছি তবু নোনা আদরের ঘ্রাণ 
বয়স কি কভু আগলে থাকে শিকলের বাঁধনে .......
বসন্তের বিদায়ে নতুন সূর্য দেখে আবেগী প্রাণ !

ভ্রমরের প্রেমালাপ জমে ওঠে কড়িকাঠে
চালের বাতায় গোঁজা থাক্,যত রোগ-শোক-তাপ
আম্রপত্রে সুসজ্জিত ঘরের বাহির 

অন্তরে জোয়ার উঠুক-সুস্বাগতম্ বৈশাখ।



নতুন ও পুরাতন
 সুনন্দ মন্ডল

চৈত্র এল প্রখর তাপে
আসল বোশেখ নতুন হাওয়ায়।
প্রাণের প্রতি ছন্দে গাঁথা
সুগন্ধ ওঠে নববর্ষের ছোঁয়ায়।

পয়লা তারিখ আর হালখাতা
মিষ্টিমুখে বিনিময়।
জীবন বাঁধা ভাগ্যলিপিতে
পুরাতন হোক অক্ষয়।

বসন্তে দোলের ছোঁয়া
ফাগুন এলেই উঠে গা'য়।
নতুন যখন খবর পাঠায় 
পুরাতনের শেষ বিদায়।




জলেশ্বরের স্মৃতি 
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় 

কলেজ জীবনে  চৈত্র সংক্রান্তিতে জলেশ্বরের মেলার অপেক্ষায় থাকতাম,  সারা বছর ধরে।  ছোট বেলা থেকে দেখে আসছি চৈত্র মাস এর পয়লা তারিখ থেকে তুলসীমঞ্চের তুলসীগাছের উপর ,  বাঁশের   ভারা বেঁধে,   মাটির   ভাঁড় বা কলসি   টাঙিয়ে, তাতে  ছিদ্র করে এমন ভাবে জল  রাখা   হত যে, চৈত্রের  কাঠফাটা  রোদে, সারাদিন ধরে তুলসীগাছের মাথায় চুঁইয়ে চুঁইয়ে জল পড়ত।    দিনের   মধ্যে   ১৫/২০ জন সন্ন্যাসী, ও সন্ন্যাসীনি বাড়ির উঠোনে আসতেন।  গেরুয়া  বসন   ছিল    তাঁদের।  তাঁদের     কেউ,  " তারকেশ্বরের শিবো মহাদেব " কেউ কেউ,  বাবা জলেশ্বরের শিবো মহাদেব " বলে ভিক্ষা প্রার্থনা করতেন। তাঁরা  কেউ ই অর্থনৈতিক দিক থেকে কমজোর তা নয়। তাঁরা বাবা বুড়ো শিবের কাছে মানত করতেন যে  ভিক্ষা করে (বাড়ি বাড়ি চাল, ডাল  অর্থ সংগ্রহ করে) সেই অর্থে তারকেশ্বর বা জলেশ্বরে চৈত্র সংক্রান্তিতে শিব ঠাকুরের মাথায় জল ঢালতে যাবেন।

উত্তর চব্বিশ পরগণা র গাইঘাটা ব্লকে প্রায় চার একর জমির উঁচু ঢিপি র উপর,  বট, অশ্বত্থের গাছের সংলগ্ন সুবিশাল দুধপুকুরের ধারে বাবা জলেশ্বরের মন্দির। শুরুতে সেখানে পর্বত প্রমাণ  উঁচু ঢিপি ছিল না। দুধপুকুর ও ছিল না।  কথিত আছে একবার চৈত্র সংক্রান্তিতে সন্ন্যাসীরা যখন তারাপাঠ ভাঙছেন তখন সেই খানে একজন অশ্বারূঢ় ইংরেজ  সাহেব এসে, সব শুনে অবিশ্বাস প্রকাশ করেছিলেন।  বলেছিলেন, " তোমরা অস্ত্রের উপর ঝাঁপ দিতেছ সেগুলি ভোঁতা।  তোমরা যদি আমার তরবারির উপরে ঝাঁপ দিতে পার, তাহা হইলে আমি তোমাদের   শিব ঠাকুর আছেন বলিয়া  বিশ্বাস করিব।" 

 বাবা বুড়ো শিবের উপর সব  সন্ন্যাসীদের বিশ্বাস থাকলেও,  কারো কারো কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছিল। অবশেষে মূল সন্ন্যাসী লক্ষ্য করলেন, একটি বড় ডাঁস মাছি ইংরেজ সিপাহির তরবারির উপর অনেক সময় ধরে  বসে আছে। বাবা বুড়ো   শিবের নাম করে,  মূল সন্ন্যাসী সেই তরবারির উপর ঝাঁপ দিলে, তরবারিটি ভেঙে গেল, কিন্তু মূল সন্ন্যাসীর কোন রক্তপাত বা কিছুই হলনা। তখন ইংরেজ সিপাহি ঘোড়া ছুটিয়ে পালাতে গেলে, কয়েক হাজার মানুষ এক মুঠো করে মাটি ছুঁড়ে মেরে দুধপুকুরের ও পর্বত প্রমাণ উঁচু ঢিপির  সৃষ্টি করেন। 

বাবা জলেশ্বর সারা বছর দুধপুকুরেই থাকেন। সন্ন্যাসীরা নীলপুজোর দিন  তাঁকে খুঁজে নিয়ে এসে, তাঁকে রাজবেশ পরিয়ে, সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করান। বছরের এই শেষ দিনটি উপলক্ষে সাত দিন ধরে মেলা বসে। মেলায় খাবার, দাবার, খেলনা ছাড়াও  সংসারের নানা নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের পসরা বসে। সার্কাসের মাইকের গান,  নাগরদোলার শব্দ, বাঁশের বাঁশী  উথাল-পাতাল বাতাসে বট অশ্বত্থের পাতা উড়ে এসে পড়ে।  গবাদি পশু আনন্দে লেজ তুলে খেলা করে।   ছোট বড় বহু প্রজাতির পাখি ও আনন্দে গান গায়। দর্শনার্থীরা  মন্দিরের সংলগ্ন গাছের গায়ে, লাল কার দিয়ে, মানষিক করে ইঁট বেঁধে যান। মনস্কামনা পূর্ণ হলে, মন্দিরে পুজো দিয়ে, বট অশ্বত্থ এর ডাল থেকে ইঁট খুলে ফেলেন। অনেকে দুধপুকুরে স্নান করে ভিজে শরীরে দন্ডি কেটে উঁচু নিচু, কাঁকর বিছানো পথে, মন্দিরে আসেন। পুজো দেন, ধামা ধামা লাল বাতাসার হরির লুঠ হয়। 

শৈশব  থেকে কলেজ জীবন অবধি নিয়ম করে সপরিবারে আমরা জলেশ্বরের মন্দিরে যেতাম।  পুজো দিতাম  এখন  কর্মসূত্রে বিদেশ বিভুইয়ে থাকার ফলে  আর জলেশ্বরের মেলায় যাওয়া না হলেও,  মন টা সব সময়  জলেশ্বরেই পড়ে থাকে।



সেদিন চৈত্র মাস 
স্বপন কুমার দত্ত 

আবার একটা বছর হয়ে গেল শেষ। চারদিকে উদাসী মন পাগল করা হাওয়া বোধহয় বুঝিয়ে দেয় -- এখন চৈত্র মাস। শুকনো পাতা উড়িয়ে, ধূলো ছড়িয়ে, পুরোনোক সরিয়ে নতুনের আবাহনে তাই মাতোয়ারা চৈত্র মাস।
      সেকারণেই বোধহয় সঠিকভাবেই কবি লিখেছিলেন,-- " সেদিন চৈত্র মাস, তোমার চোখে দেখেছিলেম আমার সর্বনাশ।"
       সর্বনাশের শুরুতো চৈত্রের প্রথম থেকেই। চৈত্র সেলের বড় বড় সাইনবোর্ড বক্ষ বিদীর্ণ করা লক্ষ্মণের শক্তিশেলের থেকেও আরো ভয়ঙ্কর। আপনি আপনার অর্ধাঙ্গিনীকে যতই বোঝান, যে সেলের জিনিস ভালো হয়না, কোন ব্যবসায়ী অত বোকা নয়,যে লাভ ছেড়ে দিয়ে ফিফটি পার্সেন্ট ডিসকাউন্টে মাল দেবে। ভবি ভোলবার নয়, আপনাকেই বুদ্ধু বলে অভিহিত করে একগাদা বাজার হবে সেলের হাট থেকেই। উল্টে বোঝাবে, গোটা বছরের প্রেজেন্টেশন, মাসীর শাড়ি আরও কত কী যে সস্তায় হল--তুমি
বুঝবে কোত্থেকে? ছাত্র ঠেঙিয়ে ঠেঙিয়ে বুদ্ধিটাও করে ফেলেছ ভোঁতা!  কিন্তু ওনার তখন বোধোদয় হয়, তখনতো সব শেষ! এক ধোয়ার পর? লাভের গুড় খায় পিঁপড়েয়! সেলে‌ কেনা বারো হাতের শাড়ি ন' হাত হলে বপুতে আর কুলোয় না। আরে কলেবর হস্তীসম হলে সেলের মালের আর দোষ কি? ডাইনে টানলে বিয়ে হয়না, আর বায়ে টানলে.... সাধে কি আর বলে, " বারো হাত কাপড়েও কাছা দিতে পারে না।"
         চৈত্র মাসে বের হয় , গাজনের সঙ। ঢাকের বাদ্যির সাথে সাথে শিব পার্বতীর নাচ, হনুমানের লম্ফঝম্ফ, মুন্ডমালিনী কালিকার ভয়াল মূর্তিসহ শোভাযাত্রা আরও কত কী! সারাবছর আমজনতা যে সঙ সেজে নেত্যসহ সংসার করে, এটা বোধহয় তার‌ই প্রতীকী! গিন্নির মন পাবার জন্য ভেতরে চাপা রাগ থাকলেও হাসি হাসি মুখ করে প্রেমিক পতি সাজতে হয়।‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌গাজনের সঙ এর চেয়ে এগুলো কম কিসে?
        এমাসের কল্যানে আছে, সিদ্ধি,ভাঙ, গাঁজা, আফিমের নেশার মৌতাতে বুঁদ হয়ে থাকার ঢালাও ব্যবস্থা। অবশ্য বাঘছাল পরিহিত ভোলে বাবার ঐ ব্যাকডেটেড ফর্মুলার নেশা এখন একেবারেই অচল। বরং বিশ্বায়নের কল্যানে মুক্ত বানিজ্যের ছত্রছায়ায় প্রদান করে নিয়েছে, চরস,ড্রাগস,ব্রাউন সুগার,হাসিস আর সর্বকালের প্রাণহরা সোমরস " বিপিনবাবুর কারণ সুধা!"
        এরপর চরকের বনবন পাক খাওয়া। পাক খাওয়ার শুরুতো জন্মের আগে থেকেই। মাতৃজঠরে থাকবার সময়েই ডাক্তারের কাছে পাক খাওয়া! পাক খেয়ে ভূমিষ্ঠ হয়েও নেই নিস্তার। এরপর স্কুলে ভর্তির জন্য শুরু হয় পাক খাওয়া। সেও দারুণ রকমারী। মার ইন্টারভিউ, বাবার পারসোনালিটি টেষ্ট, তারপর অবোধ শিশুটির লটারির পাক খাওয়ার পর বরাত ভালো হলে ছিড়বে ভর্তির শিকেয়। পাক খাওয়ার শেষ হয়না সহজে। পাশ করে চাকরির জন্য অবিরাম পাক খাওয়া। দরজায় জানালায় পাক খেতে খেতে কপালের জোর থাকলে ঘুচতে পারে বেকার নামের বদনাম। হল এবার চাকরি, এবার চাই নারী। অর্থাৎ বিয়ে, সেখানেও পাক খাওয়া। ছাদনাতলায় না ছ্যাদা হবার তলায় - একেবারে গুণে গুণে সাতটি পাক খেয়ে তবে আপনার মোক্ষলাভ! সবথেকে হালকা শোলার টোপর পড়িয়ে দিয়ে পরে বিরাশি সিক্কা ওজনের মাল বহনের উপযুক্ত করবার জন্যই বোধহয় চোখকান বুঁজে সাতপাক খাওয়ানোর ব্যবস্থা! 
           এক বন্ধুর বিয়েতে বরযাত্রী গিয়ে হাত পাক ঘোরাবার সময় লেগে গেল ধুন্দুমার কান্ড। পাত্রপক্ষের বক্তব্য , সাতপাক হয়ে গিয়েছে। অথচ কন্যাপক্ষ মানতে নারাজ, তাদের নাকি হয়েছে ছ' পাক। কেউ রাজি নয়, এক ইঞ্চি জমি ছাড়তে। অগত্যা আমাকেই নামতে হয় ময়দানে। বন্ধুকে বলি, "ডরো মত্, তুমিতো এখন ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছ সূর্যের মতো, তোমার চারদিকে পাক খাচ্ছে তোমার অর্ধাঙ্গিনী। যাহা সাত,তাহাই আট। ওতে কিছু যায় আসে না। এরপর তোমার প্রিয়তমা থাকবেন ঠাঁয় বসে আর তুমি বেকুব তার চারপাশে পাক খেয়ে মরবে লাট্টুর মতো। মুখে ' রা ' কাড়বার থাকবেনা ক্ষমতা। সর্বদাই মোলায়েম করে বলতে হবে," দেহি পদপল্লব মুদারম"! বিয়ে বাড়ীর লোকজন সব হাসিমুখে আর একপাক ঘুরিয়ে হন ক্ষান্ত।
        এরপরতো জীবনের অন্তিম কাল পর্যন্ত শুধু পাক খাওয়ার পালা। প্রাত্যহিক জীবন যাত্রা, ছেলের পড়াশোনা, মেয়ের বিয়ে, সংসারের খুঁটিনাটি বিষয়ে অবিরাম একই পাক খেয়ে চলা। পিঠে বড়শি সেঁধিয়ে চরকের খুঁটিতে ঝুলিয়ে মানুষের পাক খাওয়ানোটা তাইতো সংসার আবর্তে পাক খাওয়ার সমার্থক। বেঁচে থাকবার লোভে মানুষতো আগেই টোপ লাগানো বড়শি গিলে বসে আছে। টোপ ও যায়না খোলা, আবার বড়শিও যায়না খোলা। এ এক আজব " খুড়োর কল"!
           সংসারী মানুষই যে শুধু পাক খাওয়ার যন্ত্রণায় বিদ্ধ তা নয়, সংসার বিবাগী রামপ্রসাদ ও ওই বেদনায় দীর্ণ। তাইতো তিনি গেয়েছিলেন, " মা আমায় ঘোরাবি কত, কলুর চোখ ঢাকা
বলদের মতো।" 
          তবুও আসে চৈত্র মাস, আসে চৈত্র সেলের বাজার, বাজে গাজনের ঢ্যাম কুড়াকুড় বাদ্যি, চলে গাজনের সঙ। মন আনচান করা এলোমেলো হাওয়ায় গাছের পুরোনো পাতা ঝরিয়ে চৈত্রমাস ঘোষণা করে নতুন বছরের আগমন বার্তা। পুরোনোকে সরিয়ে তবেই তো জায়গা নেবে নতুন।






ছন্দ-ছড়ায় ভ্রমণ

ত্রিবেনী/পেশক/ লামাহাটা
গৌতমেন্দু নন্দী

তিস্তাবাজার পাশে রেখে
        পাহাড় বাঁকের মুখে-----
                      মুগ্ধ চোখে তিস্তা তখন
                      শুয়ে আছে সুখে।

         পান্নাসবুজ জলের আঁচল
         বিছিয়ে পাহাড় তলে---
                        তিস্তা, দুই পাহাড় মাঝে
                        এঁকেবেঁকে চলে।

         চলার পথে প্রেমের মিলন
         "রঙ্গিত"এর সনে-----
                         "ত্রিবেনী"তেই প্রেম-সঙ্গম
                           সঙ্গী দুই জনে।

          ধন্য হোল দুটি চোখ
          ত্রিবেনীর এই সঙ্গমে------
                           থাকবে এই মিলন স্মৃতি
                            চির- হৃদয়ঙ্গমে।

           চা বাগানের চড়াই পথে
           এলাম পেশক বাঁকে------
                           পাহাড় চূড়োয় আকাশ তখন
                            নীল আঁচলে ঢেকে।

            নীল আঁচলের আকাশ তলে
            দাঁড়িয়ে "দৃশ্য বিন্দু"তে--------
                              তিস্তা এলো দৃশ্যপথে
                              আবার কোন্ জাদুতে?!

            পেশক ছেড়ে পাহাড়-পথে
             মেঘ কুয়াশায় ভেসে---------
                               এলাম শেষে লামাহাটায়
                                "পাইন-ধুপী"র দেশে।

             সড়ক পাশে ধাপে ধাপে
              পাইন বনের সারি----------
                                  মেঘ-কুয়াশার চাদরে
                                  যেন, রহস্যময় নারী?!
             
              স্নিগ্ধ,শীতল লামাহাটা
               মোহময় তার রূপ ----------
                                  আশ্রয় তার নির্জনতায়
                                   অনাবিল নিশ্চুপ।



ভ্রমণ 

ডাম্বুলা, শ্রীলংকার প্রথম শিক্ষায়তন

                চিত্রা পাল

শ্রীলংকার কলম্বো এয়ারপোর্টে নেমে বেরিয়ে যাবার পথে প্রথমেই চোখে পড়ে এক সুউচ্চ বিশাল ধ্যানগম্ভীর বুদ্ধমুর্তি। তিনি যেন সবার হয়ে এই দ্বীপরাষ্ট্রকে দুহাতে আগলে রেখেছেন।বুদ্ধদেবকে দর্শন করে শুরু হলো আমাদের সিংহল ভ্রমণ। সিংহলি বিমানবালারা বিমান থেকে অবতরনের সময় হাতজোড় করে জানিয়েছিলো আইওয়ান্‌, মানে স্বাগতম। আর কলম্বো শহরটাও যেন আমাদের বললো আইওয়ান্‌। কেননা এই নগরের পরিবেশেই যে ভারতীয় পরশ। দোকানের সাইনবোর্ডে ভারতীয় নাম, পোশাক পরিচ্ছদ,অলংকার,ব্যবহারিক জিনিসপত্র সবেতেই সেই চেনা ছাপ।

   আমরা অনুরাধাপুরা থেকে চলেছি শ্রীলংকার আর এক শহর ক্যান্ডির দিকে। ক্যান্ডি প্রায় শ্রীলংকার মধ্যাঞ্চলে।মোটামুটি ১০০০ ফুট উঁচু এ অঞ্চল চা বাগান সমৃদ্ধ। এই উচ্চতা ক্রমশঃ  ঢালু হয়ে নেমে এসেছে। আর পথটাও খুব সুন্দর। একেবারে আমাদের পরিচিত পরিবেশ। আমকাঁঠালের ছায়ায় ঘেরা ঘর বাড়ি। পথের ধারে জলাশয়ে ফুটন্ত শালুক। এখানেই প্রথম  দেখলাম নীল শালুক।

   ঠিক দুপুরের আগেই পৌঁছে গেলাম ডাম্বুলায়। শ্রীলংকার প্রথম শিক্ষায়তন।ডাম্বুলা কলম্বো  থেকে১৪৮ কিমি উত্তর পুর্বে,শ্রীলংকার বেশ বড় শহর। ডাম্বুলার কাছে ইব্বানকাটুয়ায় যে প্রাগঐতিহাসিক নিদর্শন আবিষ্কার করা হয়েছে, মনে হচ্ছে তা বর্তমান ভারতীয় সভ্যতার আগেকার সেই সিন্ধু সভ্যতার আমলের।  

 আমরা যে প্রাংগনে জড়ো হয়েছি তার সামনেই সুউচ্চ ধ্যানস্থ বুদ্ধমূর্তি। বুদ্ধমূর্তির পেছনেই মিউজিয়াম, পাহাড়ের ভেতরেই যার অনেকটা ঢুকে গেছে। এই মিউজিয়ামের কার্ণিশ পদ্মপাপড়ির আকারে কারুকার্য করা।  দূর থেকে দেখা মেলে এই গোলাপি পদ্মদলের। মিউজিয়ামের গা ঘেঁসে সিঁড়ি উঠে গেছে ধাপে ধাপে গুহা মন্দিরের  দিকে। পাশে পাশে পথও চলেছে। এই পথে পর পর বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মূর্তি এমনভাবে স্থাপন করা আছে, মনে হয় যেন ওরাও চলেছে পথিকের সঙ্গে মন্দিরে। প্রায় ৫০০ ফিট ওপরে গুহা মন্দির। সেখানে রয়েছে পাথর কেটে তৈরি অপরুপ বুদ্ধমূর্তি। দুটো বুদ্ধমূর্তি খুবই বড় আকারের শায়িত অবস্থায়। এক মূর্তির চোখ বন্ধ মানে নিদ্রিত অবস্থায় আর অপরটার চোখ অল্প খোলা, ঘুম থেকে ওঠা অথবা নিদ্রা আসার সময়েরঅজস্র ছোট বড় বুদ্ধমূর্তি, ছাদে অপরূপ মুর‌্যালের কারুকার্য। আগে আরও কারুকার্য ছিলো,এখন জল চুঁইয়ে ছাদ নষ্ট হবার সঙ্গে সঙ্গে বহু ছবি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ থেকে জোর কদমে রক্ষনাবেক্ষনের কাজ চলছে দেখলামপাহাড়ের চারপাশের সব অঞ্চল ঘিরে রচনা করা হয়েছে ঘন বনানীর। এই গুহা মন্দির চত্বর  শ্রী লংকার সবচেয়ে বড় আর সবচেয়ে যত্নে রক্ষিত। এ মন্দির আবার ভারতীয় সভ্যতার এক প্রাচীন নিদর্শন।  এ অঞ্চলের বসতি প্রায় খৃষ্টপূর্বসপ্তম থেকে তৃতীয় শতাব্দী কালের প্রাচীন। এখানকার জনজীবন এতটাই তথাগত প্রাণ যে, শোনা যায় বুদ্ধদেব যখন ধর্ম প্রচার শুরু  করেছিলেন, তখন আকাশে দেখা গিয়েছিলো নীল হলুদ সাদা  কমলা রং। তাই এদেশের জাতীয় পতাকাতেও থাকে এই চার রঙ।এখান থেকে এরপরে রওনা দিলাম আর এক শহর ক্যান্ডির দিকে।

  কোন অঞ্চল বা শহর কেমন তা ছবি দেখে বা ফটো দেখে বোঝা যায় না, সেখানে গিয়ে না  অবস্থান করলে। তাই ছোটবেলা থেকে যতই সিংহল সম্পর্কে পড়ি ওখানে গিয়ে বুঝতে পারলাম  ওরা কতখানি বুদ্ধের ও বৌদ্ধধর্মের উপাসক। এই অনুভূতি আমার মধ্যে সঞ্চারিত  হলো এক অন্য মাত্রায়, যা রয়ে গেলো নিজ দেশে ফেরার পরেও ।    



প্রবন্ধ 

কেমন আছেন সুন্দরবনের আদিম অধিবাসী মৌলীরা?

বটু কৃষ্ণ হালদার

সুন্দরবন শুধু ভারতবর্ষের অহংকার বা গর্বের নয়, সমগ্র বিশ্বের দরবারে এক আবেগপ্রবণ ও মাধুর্যকর পর্যটনকেন্দ্র।যে পর্যটন কেন্দ্রকে ঘিরে সমগ্র বিশ্বের মানুষের কাছে একমাত্র অন্যতম গবেষণা কেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।বছরের পর বছর আবেগ প্রবণ সুন্দরবনে বিদেশ থেকে আগত হন বহু পর্যটক।যুগের পর যুগ ধরে ভ্রমণ পিপাসু মানুষের অন্তরের খিদে মিটিয়ে আসছে। যার ফলে ভারতবর্ষ ও সমৃদ্ধশালী হয় এমনকি হতভাগ্য সুন্দরবনের মানুষদের রুজিরুটির ব্যবস্থাও হয়।
সুন্দরবন সমুদ্র উপকূলবর্তী নোনা পরিবেশের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনভূমি হিসেবে অখন্ড বন যা বিশ্বে সর্ববৃহৎ অববাহিকার সমুদ্রমূখী সীমানা ।এই বনভূমি গঙ্গাও ব্রহ্মপুত্রের মোহনায় অবস্থিত এবং বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে বিস্তৃত ।১০,০০০ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে গড়ে ওঠা সুন্দরবনের ৬,০১৭ বর্গ কিলোমিটার রয়েছে বাংলাদেশে। সুন্দরবন ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
“সুন্দরবন”-এর আক্ষরিক অর্থ “সুন্দর জঙ্গল” বা “সুন্দর বনভূমি”।সুন্দরী গাছ থেকে সুন্দরবনের নামকরণ হয়ে থাকতে পারে,কারণ এখানে প্রচুর সুন্দরী গাছ জন্মায়,সেই সঙ্গে আছে হেঁতাল,গরান,গেঁওয়া,জলপাই আরো বহু জংলি গাছের সমাগম।অন্যান্য সম্ভাব্য ব্যাখ্যা এরকম হতে পারে যে, এর নামকরণ হয়তো হয়েছে “সমুদ্র বন” বা “চন্দ্র-বান্ধে (বাঁধে)” (প্রাচীন আদিবাসী) থেকে।তবে সাধারণভাবে ধরে নেওয়া হয় যে সুন্দরী গাছ গাছ থেকেই সুন্দরবনের নামকরণ হয়েছে।
অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে সুন্দরবনের আয়তন বর্তমানের প্রায় দ্বিগুণ ছিল।বনের উপর মানুষের অধিক চাপ ক্রমান্বয়ে এর আয়তন সংকুচিত করেছে।ভারতীয় সুন্দরবনের নানা প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গেলেও বর্তমান জনবসতি বা আবাদের গোড়াপত্তন ঘটে অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে ও উপনিবেশিক শাসনের হাত ধরে। কালেক্টর জেনারেল ক্লড রাসেলের নেতৃত্বে প্রথম সুন্দরবনের বাদাবন কেটে মনুষ্য বসতি ও চাষাবাদ শুরু করার প্রচেষ্টা আরম্ভ হয়।রাসেলের ঠিক পর পরই ১৭৮৫ খ্রিস্টাব্দের তদানীন্তন যশোর জেলার ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট টিলম্যান হেঙ্কেলের  নেতৃত্বে সুন্দরবনের এক বড় অংশের বাদাবন কেটে মনুষ্য বসতি স্থাপন করা হয়। এ কারণে হেঙ্কেলকে সুন্দরবনের জঙ্গল হাসিলের জনক বলে আখ্যা দেওয়া হয়।উত্তর ২৪ পরগনা জেলার একেবারে পূর্ব ভারতীয় সুন্দরবনের মনুষ্য বসতিপূর্ণ দ্বীপ হিঙ্গলগঞ্জ এখনো তাঁর কীর্তির স্বাক্ষর বহন করে চলেছে।বাদাবন গুলিকে পরিষ্কার করে চাষযোগ্য করে তুলে খাজনা আদায়ের উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বা পরবর্তীকালে ব্রিটিশ সরকার জঙ্গল হাসিলের কাজ শুরু করে।ফ্রি সিম্পল রুল,ফরেস্ট গ্রান্ড রুল,ওয়েস্টল্যান্ড রুল,লার্জ ও স্মল ক্যাপিটালিস্ট রুল, রাইট কেয়ারি ব্যবস্থা প্রভৃতি আইন বলে এই বাদাবন গুলি বিভিন্ন সাহেব দেশীয় জমিদার বা রায়তদের মধ্যে লিজে বন্টন করা হয়। তবে শুরুর দিকে জঙ্গল হাসিল মোটে সহজ ছিল না। হান্টারের রিপোর্টে প্রথম দিকের জঙ্গল হাসিলের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা পাওয়া যায়। হান্টার ওয়েস্টল্যান্ড এর রিপোর্ট থেকে লিখেছেন:_"Embanking is usually done is November after the river s have gone down when the tide is low the channels are opened and the water from inside drains off"
 ১৮২৮ সালে বৃটিশ সরকার সুন্দরবনের স্বত্ত্বাধীকার অর্জন করে।১৮৭৮ সালে সমগ্র সুন্দরবন এলাকাকে সংরক্ষিত বন হিসাবে ঘোষণা দেয়া হয় ।১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের সময় সুন্দরবনের ৬,০১৭ বর্গ কিলোমিটার বাংলাদেশ অংশে পড়ে। যা বাংলাদেশের আয়তনের প্রায় ৪.২% এবং সমগ্র বনভূমির প্রায় ৪৪%।
গাড় সবুজ রঙের সুন্দরবন  যার উত্তর দিকে ঘিরে আছে হালকা সবুজ রঙের কৃষি জমি, তামাটে রঙের দেখা শহর এবং নদীগুলো নীল রঙের।পুরো পৃথিবীর মধ্যে সর্ববৃহৎ তিনটি ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের একটি হিসেবে গঙ্গা অববাহিকায় অবস্থিত সুন্দরবনের বাস্তুসংস্থান যথেস্ট জটিল। দুইপ্রতিবেশি দেশ বাংলাদেশ এবং ভারত জুড়ে বিস্তৃত সুন্দরবনের বৃহত্তর অংশটি (৬২% ) বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে অবস্থিত। দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর; পূর্বে বালেশ্বর নদী আর উত্তরে বেশি চাষ ঘনত্বের জমি বরাবর সীমানা। উঁচুএলাকায় নদীর প্রধান শাখাগুলো ছাড়া অন্যান্য জলধারাগুলো সর্বত্রই বেড়ি বাঁধ ও নিচু জমি দ্বারা বহুলাংশে বাঁধাপ্রাপ্ত।প্রকৃতপক্ষে সুন্দরবনের আয়তন হওয়ার কথা ছিলো প্রায় ১৬,৭০০ বর্গ কি.মি. (২০০ বছর আগেরহিসাবে)। কমতে কমতে এর বর্তমান আয়তন হয়েছে পূর্বের প্রায় এক-তৃতীয়াংশের সমান। বর্তমানে মোট ভূমির আয়তন ৪,১৪৩ বর্গ কি.মি. (বালুতট ৪২ বর্গ কি.মি. -এর আয়তন সহ) এবং নদী, খাঁড়ি ও খালসহ বাকি জলধারার আয়তন ১,৮৭৪ বর্গ কি.মি.।সুন্দরবনের নদীগুলো নোনাপানি ও মিঠাপানির মিলন স্থল।সুতরাং গঙ্গা থেকে আসা নদীর মিঠাপানি,বঙ্গপোসাগরের নোনাপানি হয়ে ওঠার মধ্যবর্তী স্থান হলো এই এলাকাটি। এটি সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, পটুয়াখালী অঞ্চল জুড়ে রয়েছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চলেসুন্দরবন অবস্থিত।সুন্দরবনের প্রধান বনজ বৈচিত্রের মধ্যে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে সুন্দরী,গেওয়া,গরান এবং কেওড়া। 
সুন্দরবনকে জালের মত জড়িয়ে রয়েছে সামুদ্রিক স্রোতধারা, কাদা চর এবং ম্যানগ্রোভ বনভূমির লবণাক্ততাসহ ক্ষুদ্রায়তন দ্বীপমালা। মোট বনভূমির ৩১.১ শতাংশ, অর্থাৎ ১,৮৭৪ বর্গকিলোমিটার জুড়ে রয়েছে নদীনালা, খাঁড়ি, বিল মিলিয়ে জলাকীর্ণ অঞ্চল। বনভূমিটি, স্বনামে বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার ছাড়াও নানান ধরনের পাখি, চিত্রা হরিণ,  কুমির  ও সাপসহ  অসংখ্য প্রজাতির প্রাণীর আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত। জরিপ মোতাবেক ১০৬ বাঘ ও ১০০০০০ থেকে ১৫০০০০ চিত্রা হরিণ রয়েছে এখন সুন্দরবন এলাকায়। ১৯৯২ সালের ২১ মে সুন্দরবন রামসার স্থান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। সুন্দরবনে প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক ঘুরতে আসে। প্রতি বছর দেশ-বিদেশের অসংখ্য পর্যটক সুন্দরবনের অপরূপ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে সুন্দরবন ভ্রমণ করার মাধ্যমে প্রকৃতি থেকে বিভিন্ন জ্ঞান অর্জন করে।
সর্বাধিক প্রচুর গাছের প্রজাতি হল সুন্দরী (Heritiera fomes) এবং গেওয়া (Excoecaria agallocha)। বনে ২৯০ টি পাখি, ১২০ টি মাছ, ৪২ টি স্তন্যপায়ী, ৩৫ টি সরীসৃপ এবং আটটি উভচর প্রজাতি সহ ৪৫৩ টি প্রাণী বন্যপ্রাণীর বাসস্থান সরবরাহ করে।তবে
১৯০৩ সালে প্রকাশিত প্রেইনের হিসেব মতে, সর্বমোট ২৪৫টি শ্রেণী এবং ৩৩৪টি প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে সেখানে।সময় পরিবর্তনশীল, প্রেইনের প্রতিবেদনের পর সেখানে বিভিন্ন ম্যানগ্রোভ প্রজাতি ও তাদের শ্রেণীকরণের  উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে।বনজ প্রকৃতিতে খুব কমই অনুসন্ধান করা হয়েছে এসব পরিবর্তনের হিসেব রাখার জন্য ।
ভাঙ্গা গড়ার সুন্দরবন কথাটি আমাদের কাছে অত্যন্ত পরিচিত  শব্দ। সুন্দরী,গরান,গেওয়া, হেতালের জঙ্গলে ঘেরা সুন্দরবন যেন আক্ষরিক অর্থে ভয়ংকর সুন্দর। পৃথিবীর  বহু অরণ্য গুলোর মধ্যে বিস্ময়কর ও আশ্চর্যতম ম্যানগ্রোভ অরণ্যের মধ্য দিয়ে অসংখ্য নদী নালা খাঁড়ি পরস্পরের সাথে আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়ে মিশেছে বঙ্গোপসারে।গঙ্গা,ব্রহ্মপুত্র এবং মেঘনা নদী বিধৌত পৃথিবীর বৃহত্তম নদী বদ্বীপের প্রায় ১০,২০০ বর্গ কিমি বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অরণ্য বিস্তৃত এবং ইউনেস্কো স্বীকৃত পৃথিবীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্যমন্ডিত স্থান রূপে স্বীকৃতি লাভ করেছে। বিগত কয়েক বছর ধরে আমরা সভ্য হয়ে ওঠার প্রমাণ দিয়ে চলেছি। এই আধুনিক নগর জীবনের বরদান বিষাক্ত কার্বন ও অন্যান্য দূষিত কনাকে প্রতিনিয়ত শোষন করে চলেছে এই অঞ্চলের অসংখ্য লবণাম্বু উদ্ভিদ। শুধু তাই নয় তার পাশাপাশি ঘূর্ণিঝড় সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস সহ বহু প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরুদ্ধে যুগের পর যুগ রক্ষা কবজ হিসাবে নিজেদেরকে মেলে ধরেছে।এই সুন্দরবনের মানুষদের কাছে প্রাকৃতিক প্রতিকূল একেবারে গা সওয়া।বার বার ঝড় বয়ে যায় আর সুন্দরবনকে বিধ্বস্ত করে যায়। পুনরায় সুন্দরবনের মানুষ নিজের জন্মভূমিকে সাজিয়ে গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে।এই ইতিহাস তো আজ থেকে নয় যুগ যুগ ধরে দেখে আসছি।অথচ কেন্দ্র কিংবা রাজ্য সরকার স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও এই মানুষগুলোর কথা ভাবেনা।
ভারতীয় সুন্দরবন যার পশ্চিমে প্রবাহমান হুগলি নদী দক্ষিনে বঙ্গোপসাগর উত্তরে ডাম্পিয়ার হজেস রেখা এবং পূর্বে ইছামতি কালিন্দী রায়মঙ্গল নদী,তার মোট  ৪২৬০ বর্গ কিমি অঞ্চল জুড়ে অবস্থান করেছে। যার মধ্যে ১০২ টি রয়েছে ছোট বড় দ্বীপ। এরমধ্যে ৫৪টি দ্বীপে মানুষ বসবাস করে। এই সুন্দরবন কেবলমাত্র ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ,নদী-নালা, এবং অসংখ্য জীব জন্তুর বাসস্থানী নয়,তার সঙ্গে ৪.৫ মিলিয়ন মানুষের আশ্রয়স্থল।তবে ভাবনার বিষয় প্রতিনিয়ত ভারতের তথা পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা হু হু করে বৃদ্ধি পাচ্ছে তার সঙ্গে জমি জমা সীমিত হয়ে উঠছে।এর ফলেই বসতি গড়ার লক্ষ্যেই সুন্দরবনের উপর চাপ বাড়ছে। বাড়ছে খাদ্য বাসস্থানের চরম সংকট তার ফল
 ফলশ্রুতি হিসাবে বনভূমির পরিমাণ দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। শুধু তাই নয় তার সঙ্গে সরকারের পরিচর্যার অভাবে নদীর বাঁধগুলো মেরামতি না হওয়ার ফলেই বন জঙ্গল সমেত মাটি ধসে নদী গর্ভে তলিয়ে যাচ্ছে।সুন্দরবনের প্রত্যন্ত গ্রামগুলিতে বসবাস করে মানুষ প্রায় সকলেই দারিদ্র সীমার নিচে বসবাসকারী তার ফলে বিপদ সংকুল অরণ্যের মধ্যে বেঁচে থাকার জন্য অথৈ জলে কুমির আর ডাঙ্গায় বাঘের সাথে লড়াই করে তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হয়। পরিবারের সদস্যদের মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেদের প্রাণের মায়া ত্যাগ করে তাদেরকে গভীর জঙ্গলে কাঠ কাটতে,মাছ,কাঁকড়া ধরতে এমনকি শামুক মধু  সংগ্রহ করতে গিয়ে বাঘ, কুমির,বিষাক্ত সাপের কবলে পড়তে হয়। এর ফলেই স্বাভাবিক ভাবেই সংঘাত দেখা দিচ্ছে বন্যপ্রাণীর সাথে মানুষের।বিপদ সংকুল পরিস্থিতিতেই উভয়ের প্রাণ বলি দিতে হচ্ছে।এমন নজির সুন্দরবনে বহু আছে।তবে তা নিয়ে কোন সরকারের মাথাব্যথা নেই।
তবে সুন্দরবন সম্বন্ধে কথায় আছে জলে কুমির আর ডাঙায় বাঘ।উভয় বিপদ কে সঙ্গী করে ও যুগের পর যুগ এখানেই বসবাস করে আসছে সুন্দরবনের আদি অধিবাসীরা। কলকারখানা না থাকার দরুন এখানকার অধিবাসীদের প্রধান জীবিকা হল চাষবাস,মাছ কাঁকড়া ধরা,সেই সঙ্গে বিপদ সংকুল গভীর অরণ্য মধু সংগ্রহ করা। যার ফলে অনেক সময় মৎস্যজীবী ও মধু সংগ্রহকারী মৌলীদের প্রাণ সংশয়ের ঘটনাও সংবাদমাধ্যমে বারবার উঠে আসে।সুন্দরবনের গভীর অরণ্যে সুন্দরী,গরান,গেওয়া, কেওড়া প্রভৃতি কাছে মৌমাছিরা চাক বেঁধে মধু সংগ্রহ করে সঞ্চিত করে।আর এই খাঁটি মধুর চাহিদা বিশ্ব জুড়ে রয়েছে। বিদেশী,এমনকি যারা যারা সুন্দরবনে ভ্রমণ করতে যায় সুন্দরবনের অপরূপ মাধুর্যের সাথে নিজের আত্মা কে বিলীন করে,ঠিক তারপরেই খোঁজ পড়ে খাঁটি মধুর।বাজার চলতি কৃত্রিম উপায়ে চাষ করা মধুর তুলনায় গুণ মানে এই মধু অত্যন্ত সুস্বাদু ও উৎকৃষ্ট হয়, তাই শুধু ভারত বর্ষ নয় ভারতবর্ষের বাইরে এর চাহিদা অনেক বেশি। তবে একথাও তেমন সত্য যা কিছু উৎকৃষ্ট তা কখনোই সহজলভ্য নয়।তাই খাঁটি মধুর সন্ধানেও প্রবেশ করতে হয় গহীন অরণ্যে, নিজেদের জীবন বিপন্ন করে। ভোট পশ্চিমবাংলার রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সরকার বদল হয় কিন্তু সুন্দরবনের অসহায় মানুষগুলোর ভাগ্য আজও পরিবর্তন হয়নি। রাজনৈতিক স্বার্থে বহিরাগত অনুপ্রবেশকারীদের নানান সুযোগ-সুবিধা সহ চাকরির ব্যবস্থা করলেও যুগের পর যুগ সুন্দরবনকে বুকের মধ্যে আগলে রাখা মানুষগুলোর কথা কেউ ভাবে না।তবে বর্তমানে কৃত্রিম উপায়ে মৌমাছির বাক্স বসিয়ে মধু সংগ্রহ করা হয় কিন্তু তা তুলনামূলকভাবে খরচ সাপেক্ষে হওয়ার ফলেই সুন্দরবনের প্রান্তিক পরিবারগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গভীর অরণ্যে প্রবেশ করেই প্রাকৃতিক উপায়ে মৌমাছির তৈরি মৌচাক কেটে মধু সংগ্রহ করতে যায়।অন্যান্য শিকারীদের মতোই এটাও এক ধরনের অবৈধ শিকার।কিন্তু তাদের এ ছাড়া আর কোন উপায় নেই। মৌচাক থেকে মধু সংগ্রহ করে নিয়ে আসে বলে এদেরকে চলতি কথায় "মৌয়াল" বা মৌলি বলা হয়। এই অঞ্চলের হতদরিদ্র মানুষগুলোর কাছে দু পয়সা রোজগারের সামান্য সুযোগ টুকু হয়ে ওঠে অরণ্যের দান বা স্বয়ং ঈশ্বরের আশীর্বাদ এই ধ্রুব সত্য কথাটি উপেক্ষা করার সাহস কারো নেই। তবে মৌলি বা মধু শিকারীদেরকে বিভিন্ন সরকারি বিধি-নিষেধ অনুসরণ করে তবেই গভীর অরণ্যে মধু শিকারে যেতে হয়। আশির দশকের শেষ পর্যন্ত মধু সংগ্রহের নিয়ম-কানুন একেবারে মৌলিকের সহযোগী ছিল না। জন প্রতি মধু শিকারের উর্ধ্বসীমা ও সরকারের পক্ষ থেকে নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়ে থাকে। যত বেশি সংখ্যক মানুষ মধু শিকারের উদ্দেশ্যে জঙ্গলে প্রবেশ করবে সেই হিসেবে জনপ্রতি মধু শিকারের বৈধ উধ্যসীমা হ্রাস পেতে থাকে। কিন্তু বহু প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা সরকারি বিধি নিষেধের গণ্ডি অতিক্রম করে এমনকি বেশ কিছু টাকা পয়সা খরচ করে এই দরিদ্র মানুষগুলো তাদের প্রধান জীবিকার পাশাপাশি জঙ্গলে মধু শিকার করতে যায়। প্রথাগত শিক্ষার আলো যে সমস্ত গ্রামে আজও তেমনভাবে প্রবেশ করেনি সেখানে মৌলীরা মূলত আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্য ছাড়াই মধু সংগ্রহের যায় এবং তারাও তাদের পরিবারের সকলের প্রতি মুহূর্তে নিজেদের জীবন প্রার্থনা করে দক্ষিণ রায় অর্থাৎ ব্যাঘ্র রুপী ঈশ্বরের কাছে এবং অরণ্যের দেবী বন বিবির মঙ্গল প্রার্থনা করে। মধু সংগ্রহের প্রক্রিয়াটি মূলত চারটি পর্যায়ে সম্পন্ন হয়।যথা_১) প্রস্তুতিমূলক পর্ব, ২) অনুসন্ধানমূলক পর্ব, ৩) সংগ্রহ পর্ব, ৪) বিক্রয় পর্ব।
উন্নতমান মধু সংগ্রহ কেবল মতো মার্চ থেকে মে মাস অর্থাৎ বাংলায় চৈত্র, বৈশাখ ও জৈষ্ঠ মাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। কারণ এই সময় সুন্দরবনের গাছগুলিতে বসন্তের ফুলে ফুলে ভরে ওঠে এবং জলবায়ু ও মধু সংগ্রহের অনুকূল থাকে। বর্ষাকালেও মধু পাওয়া যায় ঠিকই কিন্তু অতিরিক্ত আদ্রতার কারণে বাজার চাহিদা তেমন থাকে না। ৫ থেকে ১০ জনের মৌলির দলগুলি নিজের ইচ্ছামত মধু শিকারে যেতে পারে না।১৫ দিনের জন্য দাদনে যাওয়ার আগে তাদেরকে বনদপ্তরের অনুমতি পত্র যোগাড় করে নৌকা ভাড়া করার জন্য বেশ কিছু টাকা জমা রাখতে হয়।আবার অনেক সময় মধু শিকারে যাওয়ার পর জঙ্গলের দস্যদের হাতে বন্দি হয় তখন নিজেদের প্রাণ বাঁচানোর জন্য চাহিদা অনুযায়ী টাকা দেওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। এই সমস্ত ঝুঁকি-ঝামলা সামলানোর জন্য অসহায় গরীব মানুষগুলো প্রায়ই স্থানীয় মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা ধার নেয়। এমনকি মধুর একটি বড় অংশও তাদের দিতে হয়।এ সমস্ত বাধা-বিপত্তি শেষ নয়,জঙ্গলের আঁকে বাঁকে প্রতি পদে রয়েছে পথ হারিয়ে যাওয়ার ভয়। তাই দলের একজন সদস্য নৌকা নিয়ে সর্বদা তীরেই অপেক্ষা করেন এবং নির্দিষ্ট সময় পরে পরে সিংগা বাজিয়ে জানান দেয় যাতে জঙ্গলের ক্রমশ গভীরে যাওয়ার সময়ে দলের বাকি সদস্যরা পথ ভুল না করে ফেলে।মৌলিরা বহুদিন যাবত এই কাজে লিপ্ত থাকেন,যার ফলে কোন গাছে বেশি মৌমাছি বাসা বাঁধে এবং কোন মৌচাকে মধু আছে তা সহজেই তারা উপলব্ধি করতে পারে।মৌমাছির চাকগুলো খুঁজতে খুঁজতে যখন সন্ধান পায় গাছের ডালের দিকে তাকানোর ফলে নিচে বিষাক্ত সাপ এমনকি বাঘের খপ্পরে পড়তে হয়। মৌচাক থেকে মধু সংগ্রহ করার বিভিন্ন পন্থা অবলম্বনের কথা আমরা জানতে পারি।প্রথমে হেতাল পাতায় ধোঁয়া দিয়ে চাক থেকে মৌমাছি তাড়ায় এবং তারপর চাকের ছোট ছোট মৌমাছিও ডিম গুলিকে অক্ষত রেখে নিচের অংশ যেখানে বেশি পরিমাণে খাঁটি মধু থাকে তা কাটারি বা হাঁসুয়া দিয়ে কেটে নেয়। একটি পূর্ণ আকারের মৌচাক থেকে প্রায় ১০ কিলো মধু সংগ্রহ করা যায়। সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটিকে শেষ করার জন্য দলের প্রতিটি সদস্যের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সহযোগিতার প্রয়োজন হয়। এইভাবে তারা সারা বছর ধরে প্রায় ২০০ কুইন্টাল মধু এবং হাজার কিলোগ্রাম মোম সংগ্রহ করে।মধু সংগ্রহ করার পর বনদপ্তরের অনুমিত মাটির কলসিতে বা কাচের জার সংরক্ষণ করতে হয়। জন প্রতি ন্যূনতম ২৫ কেজি মধু বনদপ্তর এর কাছে ৮৫ থেকে ১২৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি করতে হয়।। তবে আসার কথা এই যে ২০১০ সালে এই মধুর দাম ছিল ৪৮ টাকা প্রতি কেজি। সমস্ত মধুই বাধ্যতামূলক বনদপ্তর এর কাছে বিক্রি করতে হতো আবার ডাবর বৈদ্যনাথের মত বহুজাতিক সংস্থার কাছে মধু বিক্রি করতে হলে তার গুণগত মান পরীক্ষার কঠিন ধাপে সফলভাবে উত্তীর্ণ হতে হত। কেবলমাত্র কিছু সমবায় সমিতি রয়েছে যাদের কাছে মোটামুটি বাজার দামে মৌলিরা মধু বিক্রি করতে পারে।
অপরিশোধিত মধুর খাদ্যগুণ প্রচুর। পাস্তুরীকৃত মধুর থেকে এটি আলাদা। অপরিশোধিত মধু সরাসরি মৌচাক থেকে সংগ্রহ করা হয়।তাতে থাকে মৌমাছির পরাগ, যা খুবই উপকারী।এছাড়া মৌমাছির আঠা এবং বেশ কিছু অ্যান্টি-অক্সিডেন্টে ভরপুর।অনেকেই প্রচার করে যে বিশুদ্ধ মধুতে অনাক্রম্যতা বাড়ে। সেই প্রচারে বিভ্রান্ত না হওয়াই ভালো। বহু লোকই জানেন না যে অপরিশোধিত মধুর উপকারিতা অনেক। 
অপরিশোধিত মধুকে ছাঁকা হয় না। মধুকে পরিশোধন করলে অনেক উপাদান বেরিয়ে যায়। পাস্তুরীকরণের ফলে ইস্ট কোষের মৃত্যু ঘটে। স্বাদে পরিবর্তন আসে। মধু অনেকদিন টেকসই হয়, রং হয় বাদামি ঘেঁষা সোনালি। কিন্তু মধুর অনেক খাদ্যগুণই তাতে নষ্ট হয়ে যায়। 
মধু যখন প্রকৃতির মধ্যে থাকে, তার ভিতর কিছু জীবাণুনাশক এবং অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট পাওয়া যায়। ক্ষতস্থান নিরাময় করতে, দীর্ঘদিনের সর্দিকাশি সারাতে, প্রদাহের উপশম ঘটাতে সেগুলি কাজে লাগে। অপরিশোধিত মধু অনেক খনিজ পদার্থে সমৃদ্ধ। যেমন নিয়াসিন, রিবোফ্লাভিন, প্যান্টোথেনিক অ্যাসিড, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, পটাসিয়াম, ফসফরাস এবং দস্তা। এক টেবিলচামচ অর্থাৎ ২১ গ্রাম অপরিশোধিত মধুতে ৬৪ ক্যালোরি এবং ১৬ গ্রাম শর্করা থাকে। সেই শর্করার অর্ধেকের বেশি যদিও ফলশর্করা, যা সবার উপকারী নয়। ফলশর্করা বাদ দিলে চিনির থেকে মধু বেশি উপকারী। কোনো গবেষকের মতে মধু ডায়বেটিস থেকে রক্ষা করে, এবং  কিছু ধরনের মধু কোলেস্টেরল লেভেলের উন্নতিতে সাহায্য করে।তবে গভীর জঙ্গল দিয়ে খাঁটি মধুর চাহিদা মেটাতে অনেক তাজা তাজা প্রাণ অকালে চলে যায়।
এ সম্পর্কে জেনে রাখা ভালো ১৯৯৯ সাল থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে জন অরন্য সুন্দরবনে যতজন মৌলি বাঘের আক্রমণে মারা গেছে তাদের মধ্যে প্রায় ৬৭.২৪ শতাংশ মানুষ গোসাবা ব্লকের বাসিন্দা। আবার এ সময় বাড়ির পুরুষ সদস্যরা যতদিন না সুস্থভাবে বাড়ি ফিরে আসে তাদের স্ত্রীরা বিভিন্ন রকম আচার রীতিনীতি পালন করে থাকেন।যেমন গায়ে সাবান না মাখা,চুলে তেল না দেওয়া,সিঁদুর না পরা।সুন্দরবনের মানুষ অসহায় পরিস্থিতির শিকার অথচ এই ছোট্ট ছোট্ট বিশ্বাস গুলো তাদেরকে বাঁচিয়ে রাখে।এক্ষেত্রে অবশ্যই বলে রাখা ভালো পেটের জ্বালা বড় জ্বালা। এই জ্বালা নিবারনের জন্য ভয়ংকর বিপদের মাঝেও ঝুঁকি নিতে ভয় পায় না। তাই দেখা যায় সুন্দরবনের গভীর অরণ্যে মধু স্বীকার করতে গিয়ে সেখানকার অসহায় দরিদ্র মৌলিদের প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর হাতছানি কে উপেক্ষা করে এগিয়ে যেতে হয়। এরপরেও ন্যায্য মূল্য থেকে তারা বঞ্চিত হন। শুধু জঙ্গলের বাঘ,সাপের আতঙ্ক নয় এরা মারা যায় ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাসে।মৌলি ও কেতার মাঝখানে স্বার্থন্বেষী মধ্যস্থতা কারি বা দালালদের অবস্থান সুস্পষ্ট। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় মৌলিরা স্ত্রীর হাত ধরে হাসিমুখে ফিরে আসার আশ্বাস দিলেও আর ফেরা হয় না। না ফেরার দেশে পাড়ি দেন। সে ক্ষেত্রে তাদের স্ত্রীদের বাকি জীবনটা বৈধর্মের যন্ত্রণা আর নির্ধারণ দারিদ্রদের সঙ্গে লড়াই করে সন্তান-সন্ততির মুখের দিকে তাকিয়ে বেঁচে থাকতে হয়। সরকারি হিসাব অনুযায়ী প্রতিবছর দুই থেকে চার জন মৌলিক প্রাণ কেড়ে নেয় দক্ষিণ রায় অর্থাৎ বাঘ। আর বিধবাদের এই পাড়াগুলি লোকমুখে"বাঘ বিধবার গ্রাম" বা "বিধবা পাড়া" নামে পরিচিত হয়ে আছে। তবে সর্বক্ষেত্রে আজ পরিবর্তনের ডাক শোনা যাচ্ছে সেক্ষেত্রে শিক্ষার আলো হলো কিছুটা অত্যন্ত গ্রামগুলিতে পৌঁছেছে। যুব সমাজ শিক্ষিত হচ্ছে এবং তুলনামূলকভাবে আর্থিক সচ্ছলতার জীবন যাপনের জন্য কলকাতা শহর বা রাজ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে মধু শিকারের নিযুক্ত মৌলীদের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে।প্রমাণ হিসেবে দেখা যাচ্ছে, ২০১৫,১৬ সালে যেখানে মোট ৯৭৯ জন মৌলিক সংগৃহীত মোট অপরিশোধিত মধুর পরিমাণ ছিল ৩৩ হাজার ৫১৫ কেজি, বর্তমানে ২০১৭-১৮ সালে তা কমে গিয়েছে অনেকটাই। মৌলিদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে গড়ে ৪৮৬ জন। আর ১৫০০০ কেজি মধু বাজারে আসছে তার ফলে সাদে গুনে প্রাকৃতিক উপায়ে মধুর চাহিদা বাড়ছে। কিন্তু চাহিদা বাড়লে তা পরিপূর্ণ করছে কৃত্রিম উপায়ে সংগৃহীত মধু। তাই বনদপ্তর মৌলীদের এই পেশায় আসার জন্য উৎসাহিত করতে মধু শিকারদের সুরক্ষিত করার জন্য বাঘের মুখোশ, সুরক্ষা প্রদানকারী বিশেষ বস্ত্র,ওয়াকিটকি ইত্যাদির ব্যবস্থা করেছে।সেই সঙ্গে স্বল্প সুদের হারে ঋণ পাওয়ার ব্যবস্থাও করা হয়েছে তাদের জন্য।

গভীর ম্যানগ্রোভ অরণ্যের সীমান্তবর্তী গোসাবা হিঙ্গলগঞ্জ এবং বাসন্তীর মত ব্লকগুলিতে বহু মানুষ মধু শিকারের পেশার সাথে যুক্ত। সুন্দরবন বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভের অন্তর্গত প্রত্যন্ত অঞ্চল জুড়ে অবস্থান করছে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার সর্বাপেক্ষা অনুন্নত গোসাবা ব্লক।মুখোমুখি দৈনন্দিন জীবন যুদ্ধের কথা শুনে কিছু অঞ্চল নির্বাচন করা হয় যেখানে মধু শিকারীদের সংখ্যা তুলনামূলক বিচারে বেশি যেমন ঝিলা সংরক্ষিত বনভূমির প্রায় লাগোয়া লাহিড়ি পুর,সাতজেলিয়া এবং হেঁতাল বেড়িয়া গ্রামগুলি যথাক্রমে ছোট মোল্লাখালি গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত।যেগুলির প্রায় ৭৭% মানুষ মধু শিকারে নিযুক্ত থাকেন।তবে সর্বাঙ্গীণ পরিস্থিতি অনুযায়ী কেন্দ্র কিংবা রাজ্য সরকারের উচিত এই সমস্ত গ্রামের মানুষ গুলোর পাশে দাঁড়ানো। কারণ তারাও ভোট দেয়।নদী বাঁধের সংরক্ষণ করে সুন্দরবনকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব কিন্তু সরকারের।আর বিশেষ করে সরকার যেখানে হাতির হানায় ,বিষ মদ খেয়ে,ভূমিকম্পে ,ব্রিজ চাপা পড়ে,নৌকা ডুবিতে মৃত ও বিসর্জনে হড়পা বানে ভেসে যাওয়া সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা কারীদের যেভাবে সরকার সাহায্য করেন ঠিক তেমন ভাবে সুন্দর বনের বাঘে খাওয়া, কুমিরে,কামটে কাটা অসহায় পরিবার গুলোর পাশে দাঁড়ানো নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য বলে মনে করি।কারণ সুন্দর বনের ওই সমস্ত মানুষ গুলো জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমাদের সমাজের প্রাচীন ঐতিহ্য কে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে আসছে যুগের পর যুগ।


গল্প 


ভাতসরা
মৌসুমী চৌধুরী

        তারপর...কথাটা কানে গিয়েছিল বিজন চক্রবর্তীর। কিন্তু বেশ অনেকদিনই হল তিনি সে কুলাঙ্গারের মুখোমুখি হননি। সে ছেলে তো রাতদিনই টো টো করে বেড়ায়। তাই তাকে কিছু বলার মওকা পাননি। কিন্তু আজ ঠিক করলেন এক্কেবারে হাতে নাতে ধরবেন।  নিষ্ঠাবান ব্রাক্ষ্মণের ছেলে হয়ে কিনা এমন মহাপাতকের কাজ! ভালোমন্দ খাবার লোভে মরা বাড়ির ভাতসরার থালা সাবাড় করবার জন্য ছোঁক ছোঁক করা! ছিঃ! ছিঃ! অন্তরাত্মা ঘুলিয়ে ঘৃণা উঠে আসে বিজনবাবুর!
     এ পাড়ায় তেরো দিন হল মারা গিয়েছেন নীতিশ হালদার। আদ্যশ্রদ্ধ শেষে আজ তাঁদের বাড়িতে মৎস্যমুখ। তাই আজ তক্কে তক্কে আছেন বিজন চক্রবর্তী। একটা সিগারেট ধরিয়ে আধো-অন্ধকার দীঘির ধারে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন তিনি। নীতিশ হালদারের পাঁচছেলে দীঘির ধারে পাঁচটি ভাতসরা দিয়ে গেছে। তারা চলে যেতেই সতর্ক হয়ে যান বিজনবাবু। আর তখনই দেখেন তাঁর পুত্র শ্রীমান সুজন এসে হাজির। ভাতসরা থেকে পটাপট দু'তিনটি টিফিনবক্সে তুলে নিচ্ছে শুক্তুনি, ডাল, ভাজা, মাছ, মাংস, চাটনি, পায়েস যাবতীয় খাবার। তারপর টিফিনবক্সগুলো একটা বড় থলেতে ভরে হনহনিয়ে হাঁটতে শুরু করে শহরের বড় মাঠটি পেরিয়ে রেললাইনের ধারের ঘিঞ্জি এলকার দিকে। অদম্য কৌতুহলে পিছু নেন বিজনবাবু। আজ একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বেন । দেখি কোথায় বসে গিলিস মরা বাড়ির পিন্ডি!!!
             বিকেল মরে গুটি গুটি সন্ধে ঘনিয়ে আসছে শহরের বুকে। বিষ্ময়ে বিজন চক্রবর্তী দেখেন স্ট্রীট লাইটের নিচে কতগুলো ময়লা ছেঁড়া ন্যাকড়া পরা বাচ্চা চকচকে মুখে বহুদিন পর দুটি ভালোমন্দ খাচ্ছে!
 
দ্বন্দমূলক বস্তুবাদ 

বিনয় বর্মন


স্বাভাবিক নিয়মেই প্রয়াত হলেন অমিতাভ সরকার l হয়তো আরও  কিছুদিন বাঁচতেন l কিন্তু বাঁচার আর কোন আকাঙ্ক্ষা ছিল না তার। কঠোর বস্তুবাদী অমিতাভও আসলেই যেন স্বেচ্ছা প্রয়াত হলেন l বাগানের কাজের সূত্রে মেধাবী ছাত্র অমিতাভ শ্রমিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে হয়ে উঠেছিলেন শ্রমিক আন্দোলনের মুখ l সরল অনাড়ম্বর জীবন যাপনে দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছিলেন -  রাজনীতি মানেই দুর্নীতি নয় , বরং ত্যাগ ও সেবা l পরিবারের চাপে বিয়ে সংসার করলেও কোনদিন বিলাসিতার ভাবনাকে প্রশ্রয় দেননি। একমাত্র মেয়ে সম্প্রীতিকে বরং কষ্টে সৃষ্টেই মানুষ করেছিলেন স্ত্রী যুথিকা  তার বেসরকারি চাকরির দৌলতে l  মেধাবী সম্প্রীতি নিজের চেষ্টাতেই ডাক্তার হয়েছে l অমিতাভর ইচ্ছে ছিল মেয়ে গ্রামে জনসেবায় নিযুক্ত হবে l কিন্তু সে কর্পোরেট হসপিটালে নামি ডাক্তার হয়েছে। তবে মা-বাবার নিয়মিত খেয়াল রাখে l নিজের কাছে শহরে নিয়ে যাবার চেষ্টাও করেছে। কিন্তু অমিতাভর জেদের কাছে হার মেনেছে l অবসরের পর বাগান ছেড়ে আলিপুরদুয়ারে এসে ভাড়া বাড়িতেই থাকতে হয়েছে অসুস্থতার জন্য। আসলে দ্বিতীয়বার স্ট্রোক হওয়ার পরেই অমিতাভ জীবনী শক্তি হারিয়ে ফেলেন l যেন অপেক্ষাই করছিলেন মৃত্যুর l 

রাজনীতিতে ক্ষমতা বৃত্তের বাইরে গেলেই মূল্যহীন l শেষ ইচ্ছে ছিল দেহ দান করে যাবেন মেডিকেল কলেজে l কিন্তু ছোট শহরে অনেক সমস্যা l সবচেয়ে বড় ব্যাপার পরিবারের অসম্মতি l দলের পতাকায় মুড়ে শেষ যাত্রায় যাওয়ার ইচ্ছেটা অবশ্য পূরণ হলো কিছু পুরানো সঙ্গীর দৌলতে l  ইলেকট্রিক চুল্লিতেই যেতে হল l ছাই হয়ে ভেসে বিলীন হয়ে গেলেন নোনাই নদীর জলে l

 আগাগোড়া নীরবে পাশে ছিলেন যতীন l যৌবনকালের বন্ধু l কিন্তু রাজনীতিতে বরাবরই মতের অমিল l শ্মশানে বসে বিড়বিড় করে বলছিলেন : চলে গেলি !  হয়তো অভিমান নিয়েই l  যেতে তো হবেই সবাইকে একদিন না একদিন l দুঃখ করিস না বন্ধু। তোর দর্শনে দ্বন্দই তো মূল l থিসিস , এন্টি-থিসিস , সিন্থেসিস -  এই নিয়ম মেনে আমাদের নানাবিধ ভাবনার সংশ্লেষেই তো নতুন সমাজ গড়ে উঠবে l ... তোর আমার প্রিয় কবি আমাদের খলিল জিব্রান আর তার 'দ্রষ্টা'র বাণী তো জানাই আছে :

Your children are not your children. 
They are the sons and daughters of Life's longing for itself .
They come through you but not from you ,
And though they are with you yet they belong not to you .
You may give them your love but not your thoughts. 
You may house their bodies but not their souls ,
For their souls dwell in the house of tomorrow, 
which you cannot visit, not even in your dreams ...

         বাগান থেকে একদল বৃদ্ধ শ্রমিক এসেছিলেন খবর পেয়ে l
 গম্ভীর ভাবে স্লোগান দিচ্ছিলেন তারা : অমিতাভ সরকার লাল সেলাম l অমিতাভ সরকার অমর রহে l




সোনালীদির ইংরেজি বচন
বেলা দে  

যে বয়সটায় অতি অল্পেই বিশ্বাস, ভাবপ্রবণ, আবেগপ্রবণ, ভীতি উৎপাদন, উৎকম্পন ঠিক কৈশোর ছাড়িয়ে যৌবনের আনন্দদুয়ার, ব্যপারটা  ঠিক সেই সময়কার। ফিরছি কলেজ থেকে আমি আর সহপাঠী দীপ্তি, আমরা চার বান্ধবী একটা  মেস করে থাকি, আমি ফালাকাটায় বাকি তিনজন চা বাগানের মেয়ে।  কলেজ থেকে ফিরে কলতলায় হাত মুখ ধুতে গিয়েই এক বিপত্তি মস্ত এক ঢিল হঠাৎ  কোত্থেকে ছুটে এলো আমাদের সম্মুখে।  বাড়িওয়ালা মাসিমাকে হাঁক দিতেই সে উপস্থিত  তার বক্তব্য শুনে তো আমরা ভয়ে কাঠ, পাশের বাড়ির সোনালীদিকে নাকি ভূতে পেয়েছে, শেষ  চৈত্রের ভূত সংক্রান্তিতে মধ্যদুপুরে দিনবাজার থেকে ১লা বৈশাখের কেনাকাটা করে সেও আবার লম্বা হাটুছোঁয়া চুলে ছাতিমগাছ থেকে নাকি ঝাঁপিয়ে পড়েছে তার উপর।  গোল গোল চোখ বিস্ফারিত করে কখনো অট্টহাসি হেসে হিন্দি ভাষী কখনো  ইংরেজি বচন, মাসিমার কথা শেষ না হতেই গলা ছেড়ে প্রবল কান্নার আওয়াজ, মাসিমা বলেন `ওই শোন সোনালীর গলা` আমরা একে অন্যকে জড়াজড়ি করে কাঁপছি রীতিমতো, সাহস যোগান মাসিমা `ভয় কোরো না আমি একবারটি গিয়ে দেখে আসি`।  আমাদের মধ্যে অতি-সাহসী বন্ধু সর্বানী বলে মাসিমা দাঁড়ান আমিও যাই। ওরা ফিরে এলে যা শুনলাম চেহারা নাকি আধিভৌতিক হয়ে গেছে মন খুলে শ্যামাসংগীত গাইছে আসলেও সোনালীদি খুব ভালো একজন গাইয়ে কিন্তু  ক্লাস এইট বিদ্যায় ইংরেজি বচন এলো কোত্থেকে  সবাইকে অবাক করে গড়্গড়িয়ে ইংরেজি বলছে পড়শিরা ধরেই নিয়েছে এটা নিশ্চয়ই কোনো শিক্ষিত ভূত, পরের দিন অপরাহ্নবেলায় এলো ভূত ছাড়ানোর তান্ত্রিক সে তার কমন্ডুলু থেকে  মন্ত্রপুত জলের ছিটেফোঁটা সোনালীদির গায়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিলে তফাৎ যাও তফাৎ যাও বলে চেঁচাতে থাকে সোনাদির কাঁধের ভূতটা কিছুক্ষণ  পরে নিস্তব্ধ নিস্তেজ হয়ে পরে সে, আচ্ছা যাচ্ছি দাঁড়া বলে বিরাট একটা শব্দ করে চলে যায়। মিনিট দশেক পরে মাটি থেকে ঝেড়েফুরে উঠে পরে সোনালী দি, কি ব্যাপার কি হয়েছে আমার আমি মাটিতেই বা কেন। উনি কি সন্নাসী? কেউ সাড়া দেয় না, হাল্কা হতে থাকা পড়শিদের ভীড় থেকে একজন বলে ওঠে "আচ্ছা ভূতটা কি ইংরেজি  পড়িয়েছিল সোনালীকে"?





সবিতা 
সীমা  সাহা 
     

ওযে মেয়ে ,ওকে দেয় না ভালো  ভালো  খাবার ।যা কিছু ভালো  খাবার  এনে দেয় ছোট  ভাইকে।ঘরের কোণে দাঁড়িয়ে চুপি চুপি  কাঁদে সবিতা।বাবাতো কথাই বলে‌‌না সবিতার সাথে।খুব  কষ্ট হয় সবিতার, সারাক্ষন শুনতে  হয় তুই মেয়ে, বাড়ির অলক্ষী।আত্মীয় স্বজন রাও বাড়িতে  এলে সবিতাকে ভালো  চোখে  দেখে না।তার মধ্যে  সবিতার গায়ের রঙ কালো ।সেজন্যও শুনতেহয়  কালো মেয়ে‌,এই মায়ের বিয়ে  দিতে  গেলে বিধুর অনেক  টাকা  লাগবে ।বিধু সবিতার  বাবার  নাম ।ভাইকে স্কুলে  ভর্তি  করে  দিয়েছে।সব ছেলেটাকে  ডাক্তার  ইন্জিনিয়ার  বানাতে  হবে ।সবিতা বাড়িতেই থাকে।বাড়ির সব কাজ বাসন মাজা  উঠান ঝাড়ু করা ,রান্না পর্যন্ত  করতে  হয়।তার ভাইকে  স্নান  করিয়ে‌,খাইয়ে স্কুলে  পাঠানো  সব দায়িত্ব  সবিতার  উপর।সবিতা একদিন  ভয়ে  ভয়ে মাকে বলে  মা আমিও‌ স্কুলে  যাবো ।শুনে  মা ধমক দিয়ে  বলে,তুই স্কুলে  গেলে  ঘরের  কাজ  কে করবে  শুনি,ভাইকে  স্কুলে  পাঠানো  দেখাশোনা‌ কে করবে? আমি তোর‌ বাবা জমিতে কাজে  যাই।না‌ তোমার  স্কুলে  যাওয়ার দরকার  নাই ।চোখে  জল নিয়ে  চুপ করে  যায় সবিতা।একদিন  গ্রামের  স্কুলের  দিদিমনিরা সবিতাদের বাড়িতে  এসে  ওর বাবা মাকে  বলে মেয়েকে স্কুলে ‌ভর্তি করাও নি কেনো? ওর বয়স কতো  হলো ।ওর বাবা বলে ঐ হবে  আট কি নয়।দিদিমনিরা বলে ওর ছোট  ভাই তো স্কুলে  পড়ে ।ওর বাবা  বলে ওতো ছেলে,  ওতো‌ স্কুলে  পড়বেই।মেয়েদের  বড়ো  হলেই বিয়ে দিতে  হবে ।ওর স্কুলে  পড়ার দরকার  নাই ।বরং ঘর কান্নার কাজ শিখুক  শশুর  বাড়িতে  সুনাম হবে ।দিদিমনিরা  ওদের  বোঝাল মেয়েরাও উপযুক্ত  শিক্ষা  পেলে চাকরি  করে  বাড়ির অভাব মেটাতে  পারে।দেখছ না আমরা  পড়াশুনা করে শিক্ষিত হয়ে পরিবারের সাহায্য  করি।সবিতার  বাবা বলে মেয়েকে লেখা  পড়া শেখানোর মতো ‌টাকা নেই ।ছেলেকে  লেখা  পড়া শিখিয়ে  উপযুক্ত  করি সেই ভালো ।মেয়েকে  পড়ার টাকা ‌আপনারা দেবেন।আপনারা  শহরের  মানুষ  আমাদের  অবস্থা  বুঝতে  পারবেন না।যান এখন ।সবিতার  মায়েরও একই মত।দিদিমনিরা  বোঝালো সরকারি  স্কুলে  পড়তে কোনো  টাকা  লাগবে  না ।স্কুল  থেকেই বিনাপয়াসায় বই দেবে ,দুপুরে  ভাত খেতে  দিবে।কোনো  কোনো দিন ডিম ভাত, সোয়াবিন দেয়।বছরে  স্কুলে যাওয়ার  জন্য দুটো  করে নতুন  জামা দেবে ।এছাড়া  ফাইভ থেকে  সরকারি  প্রকল্পের থেকে  টাকাও পাবে ।বাবা মায়ের  চোখ জ্বলজ্বল  করে  উঠলো।ওরা  করে ফেলে ।অভাবের সংসারে  সবিতা স্বস্তির  আনন্দ  নিয়ে ‌এলো।



উত্তরণ
অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী 

এলোমেলো বাতাস বইছে বাইরে।চৈত্রের টান ধরা তপ্ত দুপুর রোদ মেখে বসে আছে একটু দূরের কৃষ্ণচূড়ার দিকে চেয়ে।মনও বড় এলোমেলো আজ।মেজ মেয়ের বাড়িতে এসেছেন মনোরমা তার আসানসোলের বাড়ি থেকে।মনীশ নিয়ে এসেছে সঙ্গে করে।এক ছেলে আর তিন মেয়ে তিনজনই কাছে, দূরে থেকে যে যেভাবে পারে আগলে রাখে মাকে। আত্মীয়স্বজন, পাড়াপড়শি সকলে বলে 'তুমি রত্নগর্ভা।'  অনেকটা ভালোলাগা ছুঁয়ে থাকে এই শব্দটির সঙ্গে।তবুও বুকের মধ্যে খচখচ করে কোথাও।বড় ছেলে মনীশ যখন দশ বছরের তখন তার স্বামী একদিনের জ্বরে হঠাৎ করেই চলে যান তাদের ছেড়ে। আধা সরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে সাধারণ মানের চাকরি ছিল ওনার।তার মৃত্যুর পর  এককালীন কিছু টাকা, সামান্য পেনশন আর মাথার ওপর শশুরবাড়ির ছাদ এটুকুই সম্বল তখন মনোরমার।চারটি ভাত কাপড়ের অভাব না হলেও  ছোটছোট এতগুলো ছেলেমেয়ে নিয়ে অকুল পাথারে পড়েছিলেন তিনি।তারই বা তখন কী এমন বয়স। এক বসন্তে হঠাৎই হারিয়ে গিয়েছিল তার জীবনের সমস্ত রং। বসন্ত কেড়ে নিয়েছিল আরও একজনকে। বসন্ত এলে তাই বুক দুরুদুরু করে এখনও। ঠাকুরকে ডাকেন মনেপ্রাণে।তার সন্তানেরা, বৌমা, জামাইরা, নাতি নাতনি সবাই ভালো থাকুক। কিছু বুঝে উঠবার আগেই স্বামীকে হারিয়েও সেসময় মনোবল হারাননি।কঠোর হাতে ছেলেমেয়েদের মানুষ করেছেন। অবশ্য মনীশ তার হীরের টুকরো ছেলে। খুব অল্প বয়স থেকে সে যেমন রোজগারপাতি শুরু করেছিল, তেমনই ছোট ভাই বোনদের প্রতি তার ছিল সদাসতর্ক দৃষ্টি ও অফুরন্ত স্নেহ। প্রতিটি ধাপে খুব ভালো রেজাল্ট ও পড়াশোনার প্রতি অনুরাগী, পরিশ্রমী এই ছেলেটির তাই উচ্চপদস্থ চাকরি পেতে খুব বেশিদিন লাগেনি। একে একে তিন বোনকে সুপাত্রে, ভালো পরিবারে বিয়ে দিয়ে মনীশ যথার্থ বড় দাদার কর্তব্য পালন করেছে।
'মা, এবার ধীরেসুস্থে তৈরি হয়ে নাও। যেখানকার ঠিকানা দিয়েছে তোমার জামাই,বেশ অনেকটা সময় লাগবে যেতে....' 
মেয়ের কথায় জানলা থেকে মুখ ফেরালেন। বললেন,
 'কত জায়গাতেই তো গেলাম..তোরা, বড়খুকি, মনীশ নিয়ে গেছিস যখনই যেতে চেয়েছি..যখনই যেখান থেকে যেমন জানতে পেরেছি তোদের কাছে আর্জি রাখলে কখনো বাধা দিসনি কেউ..লাভ তো হলোনা কিছু..এই বৃদ্ধ বয়সে আবারও এলাম তাও..আশা যে মরেনা....'  গলা বুজে এল মনোরমার।

দুপাশে পলাশের গেরুয়া আভাকে পাশে রেখে এগিয়ে চলেছিল গাড়িটি। রাজ্যের পশ্চিম দিকের এই জেলাটিকে প্রকৃতি বসন্তের অকৃপণ সাজে সাজিয়ে তোলে ঋতুর আসা যাওয়ার খেলায়। এড়িয়ে যেতে চাইলেও এ আবেশ মনকে টানবেই টানবে।
বাবার অফিসে বাবার শূন্য পদে যোগ দেওয়ার জন্য যখন ওনার চলে যাওয়ার অনেকগুলো বছর পর ডাক এসেছিল, মনীশ তখন তার যোগ্যতার ভিত্তিতে চাকরির বিভিন্ন পরীক্ষায় ব্যস্ত।সে জানতো তার জন্য এর চাইতে অনেক ভালো সুযোগ অপেক্ষা করছে।তার ছোট ভাইও সেসময় প্রাপ্তবয়স্ক। তাকে ওই পদে নিয়োগ করলে তার মন বাঁধা পড়বে হয়তো।একটা গতি হয়ে যাবে আর পরিবারেরও সুরাহা হবে।
মনীশের ছোটভাই.. হ্যাঁ, মনোরমার বাউন্ডুলে ছোট ছেলে।যার পড়ায় কোনো মন ছিল না কোনদিনই।একটু বড় হতেই হঠাৎ হঠাৎ উধাও হয়ে যেত কোথায়। আবার হঠাৎ এসে হাজির হয়ে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে আবদার করতো এটা সেটা খাওয়ার।মা রান্না করে দিলে সেগুলো কোথায় কোথায় গিয়ে বিলি করে আসতো। নিজের পরার দুচারটে জামাকাপড় থেকেও দিয়ে দিত একে ওকে। দুপুরবেলা খাওয়ার সময় ভিখিরি এলে নিজের খাওয়ার থালা ধরে দিয়ে দিত। অনেকদিনের জন্যও নিখোঁজ হতো মাঝেসাঝে। প্রশ্ন করলে একটা উত্তরও পাওয়া যেতনা।কতলোক কত কথা বলতো।খারাপ সঙ্গে পড়েছে, নেশার চক্রে জড়িয়েছে এমন আরও কত কথা কানে আসতো থেকে থেকে। খুব জোরজার করে তাকে ওই চাকরিতে নিযুক্ত করালেও সকলের তিন তিনবারের চেষ্টাকে বিফল করে সে একদিন অফিস থেকেই চিরতরে হারিয়ে গিয়েছিল। প্রথম ও দ্বিতীয় বার চাকরি ছেড়ে চলে গেলেও কিছুদিন পর হয়তো বা মায়ের টানেই ফিরে এসেছে বাড়িতে। অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়েও তৃতীয়বার আর তাকে আটকে রাখা যায়নি।বসন্তের ঝোড়ো একটা রাত পুরোটা জেগে কেটেছিল মনোরমার তার অপেক্ষায়।বেশ কয়েকবার কেউ কেউ হঠাৎ বাড়িতে এসে বা অন্য সূত্রে খবর দিয়েছে তার। তাকে দেখতে পেয়েছে নাকি সে বা তার পরিচিত কেউ।মনোরমা কেঁদে আকুল হয়েছেন। মনীশ সাধ্যমতো সব জায়গায় ছুটেছে ভাইয়ের খোঁজে। যেখানে সম্ভব মাকেও সঙ্গে নিয়েছে।মেয়ে জামাইরাও এগিয়ে এসেছে,বাড়িয়ে দিয়েছে সাহায্যের হাত। কিন্তু এতগুলো বছরে কোথাও গিয়েই পাওয়া যায়নি তাকে।তার নাম করলে কেউ চিনতেও পারেনি..ছবি দেখালেও কোনো কাজ হয়নি।
                            উপাসনার বড় হলঘরটির ঠিক মাঝখানে শ্রীরামকৃষ্ণের মূর্তি।যার দিকে তাকালে সহজ সরল এক যাপন আর ভক্তি ও বিশ্বাসের ছবি চোখে ভাসে। অপরূপ ফুলের সাজে সাজানো মূর্তির বেদি থেকে শুরু করে তার আশপাশ ও পিছনের দিকটি। মায়া জড়ানো মুখে ঠাকুর চেয়ে আছেন ঘরটিতে সারে সারে বসা ভক্তদের দিকে। একপাশে আশ্রমবাসী ছেলের দল সান্ধ্যসঙ্গীতে অঞ্জলি দিচ্ছে ঠাকুরকে।সেই গানে তাদের সঙ্গে একক সুরে আছেন গেরুয়া বসন পরা একজন স্বামীজি।ভরাট গলায়, নিখুঁত সুরে ও স্পষ্ট উচ্চারণে তিনি গেয়ে চলেছেন।তাঁর মুখ সামনে ঠাকুরের দিকে ফেরানো। কপালে হাত ঠেকালেন মনোরমা ঠাকুরের দিকে চেয়ে। বসলেন সবাই। গান শেষ হলে স্বামীজি ঘুরে বসলেন ভক্তদের দিকে। শ্রীরামকৃষ্ণকে স্মরণ করে তাঁর জীবন ও বাণীর কিছু অংশ তুলে ধরলেন তাঁর সাবলীল বক্তব্যে। 
                          মনোরমার মেজ জামাইকে একজন খবর দিয়েছিল শহরের এই অঞ্চলটিতে পলাশকে দেখা গেছে কোথাও। পলাশ অর্থাৎ মনোরমার ছোট ছেলে।ওনারা এখানে পৌঁছোনোর আগেই জামাই নিজে এসে অনেক খোঁজখবর করেছে সম্পূর্ণ এলাকাটিতে।কিন্তু কোনো হদিস মেলেনি তার। মনোরমার কানে কথা পৌঁছোতে তিনি আকুল হয়ে ছুটে আসেন মনীশকে সঙ্গে করে।গাড়ি থেকে নেমে নেমে ওরা সবাই মিলে খবর নিচ্ছিল পথের অনেকের থেকেই।নিরাশ হয়ে ফিরবার পথে একবার শুধু প্রণাম করতে এই আশ্রমে আসা।
স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে ছিলেন মনোরমা স্বামীজির দিকে। বুক টনটন করে উঠছিল অসম্ভব এক কষ্ট মিশ্রিত আনন্দে। সেই অনুভূতি জল হয়ে নেমে আসছিল চোখ থেকে গাল বেয়ে।কত? ঠিক কতগুলো বছর পার করে দেখলেন আবার? হিসেব মেলাতে লাগলেন মনে মনে।  তোলপাড় করে উঠলো বুকের ভেতরটা।স্বামীজিও সামনের দিকে চোখ মেলে অন্যমনস্ক রইলেন কিছুটা সময়।গাল বেয়ে নেমে এল জলের ধারা। ওনার দিকে তাকিয়ে উপস্থিত ভক্তদের মৃদু গুঞ্জন উঠেই আবার নীরব হলো তৎক্ষণাৎ।ধরা গলায় বক্তব্যের শেষটুকু বলে নমস্কার জানালেন স্বামীজি।টলোমলো পায়ে এগিয়ে গেলেন অন্দরের দিকে।
মনোরমা নিজেকে সামলাতে না পেরে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লেন এবার।সবটা বুঝতে পেরে ঝাপসা চোখে মনীশও জড়িয়ে ধরলো মাকে। 
আশ্রমের চাতালে বসে ছিলেন ওরা সবাই। অপেক্ষা করছিলেন। একজনকে দিয়ে বলে পাঠানো হয়েছে..সে যদি একবার আসে,যদি সামনাসামনি একবার দেখা হয় কাছ থেকে..দুটো কথা হয়। বসে থাকতে থাকতেই এখানকার অনেকের মুখে অকুন্ঠ প্রশংসা শুনলেন ওই স্বামীজির। ওনার বড় মন,ওনার জ্ঞান, ওনার কর্মযজ্ঞ নিয়ে বলছিলেন কিছু প্রবীণ মানুষ। আশ্রমের অন্য আর একজন স্বামীজিকে দেখে তাঁর কাছে এগিয়ে গিয়ে মণীশ উপাসনার জায়গায় দেখা সেই স্বামীজির বিষয়ে জানতে চাইলো পরিচয় গোপন রেখে। ওনার জীবনের পূর্বকথা এখানে কেউ জানেনা আর জানলেও বলা বারণ এমনই বললেন সেই স্বামীজি ,মুখে স্মিত হাসি রেখে।
'পড়াশোনায় নিবিড় মনোযোগ ওনার। প্রচুর পড়াশোনা করেন সারাদিন।সর্ব বিষয়ে ওনার জ্ঞান ও সমস্ত কাজে পারদর্শিতা মুগ্ধ করে আমাদের। বেশ অনেকগুলো বছর উনি আমাদের এখানকার প্রধান স্বামীজি হয়ে আছেন। তবে খুব শীঘ্রই উনি চলে যাবেন অন্য কোথাও, অন্য আশ্রমে। ওনাকে হারিয়ে আমরা সবাই অনাথ হয়ে পড়বো....' বিষন্নতার ছায়া নামে তাঁর মুখ জুড়ে।
আবেগ মিশ্রিত গলায় উনি বলে চলেছিলেন, ' সংসারের সমস্ত মায়া ত্যাগ করে এই ধর্মের পথে পা বাড়াতে হয়। একনিষ্ঠ থাকতে হয়।একচুল এদিক ওদিক হলেই, মায়ায় জড়ালেই এই নিষ্ঠার পথে, মানব সেবার পথে বাঁধা আসবে ....'
মনীশের পাশে দাঁড়িয়ে মনোরমা ও তার মেয়েও কথাগুলো শুনছিলেন কানপেতে। অদূরে দাঁড়িয়ে ছিল ছলোছলো চোখে সেই ছেলেটি, যাকে সবকিছু বলে খবর দেওয়া হয়েছিল স্বামীজিকে একবার দেখবার বাসনায়।সে এগিয়ে এসে বলল 'স্বামীজী ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন। ওনার সঙ্গে আর দেখা হয়নি।'
কথাগুলো বলতে বলতে সেই ছেলেটির  চোখে ভাসছিল স্বামীজির সেই হৃদয় বিদারক কান্না।টেবিলে মাথা রেখে কাঁদছিলেন স্বামীজি। সমস্ত শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছিল ওনার। ওকে দেখে হাত নেড়ে নেতিবাচক ভঙ্গি করে আবার ভেঙে পড়েছিলেন কান্নায়।
ফিরে চলেছিল ওরা সবাই। অনেকগুলো বছরের ভুল বোঝাবুঝি, অভিমান, অভিযোগ অনুযোগ, হয়তো বা কিছুটা রাগও গলে গলে জল হয়ে যাচ্ছিল সকলেরই।পেয়েও হারানোর দুঃখ ছাপিয়ে মনের কোণে জমা হচ্ছিল অনেকটা শান্তি, স্বস্তি, ভালোলাগা আর গর্বও কিছুটা। মনীশ বলে চলেছিল,
'আমার ভাইটা কত বড় হয়ে গেল মা, কত পরিণত। পড়াশোনা ওর ধ্যানজ্ঞান হবে ভেবেছি কখনো? ধীরস্থির, নম্র, বিনীত। আমার খুব গর্ব হচ্ছিল মা, যখন ও বক্তব্য রাখছিল এত লোকের মাঝে।এত সুন্দর গান ভাই কেমন করে শিখলো বলো তো? সাধনার কোন মার্গে গেলে মানুষের এতটা পরিবর্তন হতে পারে ভেবে দেখো। আমি হীরের টুকরো নই মা, তুমি সবসময় যেমন বলো। তোমার আসল হীরে তোমার ছোট ছেলে..যে তার ভক্তি আর জ্ঞানের আলোয় ভালোবাসা আর আত্মত্যাগের মন্ত্রে সকলের মনে আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। শুধুমাত্র সংসারের মধ্যে আবদ্ধ না থেকে নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছে দশের কাজে....'
মন ভরে উঠছিল মনোরমার। চোখে জল নিয়েও হাসিমুখে বললেন,' পলাশের বরাবরই সুন্দর একটা মন ছিল রে।সেটার অধিকারী হতে পারলে জীবনে সব কঠিন কাজই সহজ হয়ে যায়।' 
হাত রাখলেন ছেলে আর মেয়ের মাথায়। বললেন, 'যেমন তোদের সকলের আছে।'
কান্না জড়িত গলায় মেয়ে বলে উঠলো 'আমরা তো সবাই কমবেশি স্বার্থের দাস, নিজেদের গোচরে বা অগোচরে অন্যের জন্য কিছু করবার মধ্যেও আমাদের নিজেকে বড় দেখানোর প্রবণতা লুকিয়ে থাকে। ছোড়দার মতো নিজেকে এভাবে বিলিয়ে দিতে ক'জন পারে বলো....'
'একদমই তাই। সংসারে থেকে সংসারধর্ম ও সকলের জন্য কর্তব্য করবার মধ্যেও আত্ম অহংকার কাজ করে নিজেরও ভেতর মনের কোথাও গোপনে। আরও..আরও সুনাম, আরও প্রশংসা দাবি করে মন। সেগুলো পাওয়ার আশাতেই দায়িত্ব কখন অভ্যেস হয়ে পড়ে। কিন্তু ভাই যে পথে গেছে সেখানে কোনো চাওয়া পাওয়া নেই। শুধু অকৃপণ দেওয়া আছে....মুখে পরিতৃপ্তির হাসি নিয়ে কথাগুলো বলছিল মনীশ।
                       কথাগুলো গোধূলির গেরুয়া আলোয় মিলেমিশে দুধারের পলাশবনের গেরুয়ায় মিশে যাচ্ছিল। পলাশ ফুলের ঝাঁকে দ্যুতি ছড়াচ্ছিল পড়ন্ত বিকেলের সেই উজ্জ্বলতা।
সেই আলোয় আলো হচ্ছিল এক মায়ের মুখ।মন বলছিল,আজ আর 'রত্নগর্ভা' শব্দটি শুনতে দ্বিধা নেই কোনো। জীবনের অন্তিম লগ্নে এসে বারে বারে ঋণী থাকছিলেন তিনি হঠাৎ পাওয়া এক আনন্দ বসন্তের কাছে।



অভিশাপ

টিনা ভট্টাচার্য 

ভোররাতে আচমকা ঘুম ভেঙে যায় প্রমিলার। একটা ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন দেখেছে সে। টেবিল থেকে জলের বোতলটা নিয়ে ঢক ঢক করে জল খেয়ে নিল ও। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। দেওয়ালে টাঙানো ছবিগুলো যেন ওর দিকে তাকিয়ে আছে। মাত্র দু'দিন হয়েছে প্রমিলা, ঋক আর ওর শ্বশুর শাশুড়ি এবং দিদিশাশুড়ির সাথে গ্রামের এই জমিদার বাড়িতে এসেছে। প্রমিলার শ্বশুরের ঠাকুরদা ছিলেন এই  নবাবগঞ্জের শেষ  জমিদার। পুরনো আমলের জমিদার বাড়িতে ওরা এসেছে গ্রামের লোকেদের ওদের বিয়ের ভোজ খাওয়াতে। ঋকদের বংশের এটা রীতি। বাড়িতে কোনো অনুষ্ঠান হলে তার কিছুদিন পর গ্রামেও ছোটো করে একটা অনুষ্ঠান করে গ্রামের লোকেদের খাওয়ানো হয়। ঋক  আর প্রমিলা বিয়ের পর হানিমুন থেকে ফিরল, আর তারপরই সারা পৃথিবী জুড়ে মারণরোগের প্রকোপ। তাই সেসব কাটিয়ে উঠতে প্রায় একবছর হয়ে গেছে। আর ঋক আর প্রমিলার বিবাহবার্ষিকীতেই এখানে বড় করে অনুষ্ঠান করে গ্রামের লোকেদের ভোজ খাওয়ানো হবে। তবে প্রমিলার যিনি দিদিশাশুড়ি আছেন, মানে ঋকের ঠাকুমা তিনি এখানে আসতে বারংবার বাধা দিচ্ছিলেন। কারণটা ঠিক খোলসা না হলেও প্রমিলা শুনেছে ওর শ্বশুরমশাইকে বলতে, " আহ মা, এখনকার দিনে ওসব পুরনো গল্প মনে রাখলে চলবে? আর তাছাড়া এই সুবাদে অনেকদিন পর সপরিবারে গ্রামেও ঘুরে আসা হবে আর সব আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে বেশ কিছুদিন কাটানো যাবে। "
প্রমিলা ঋক কে এব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে ঋক বলে সে কিছু জানেনা। চরম অনিচ্ছা সত্ত্বেও দিদিশাশুড়ি আসেন প্রমিলাদের সাথে।

গ্রামের জমিদার বাড়ির ঘরগুলোর উচ্চতা বেশ অনেকটা, প্রায় বারো একর জায়গা জুড়ে এই জমিদার বাড়িটি নির্মিত। বাড়িটিতে আটটা ভবন এবং দুটো বড় পুকুর আছে। একটা পুকুরে পানা আর আগাছা ভরে গেছে। আরেকটা পুকুরে জল আছে, সেটা  এখানকার গ্রামবাসীদের বর্গা দেওয়া আছে । তারা মাছ চাষ করে। ঋকের পিসিমারা ত্রিপুরাতে থাকেন, তারাও এসেছেন এই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। ঋকের কাকা কাকিমা,তাদের ছেলে- ছেলের বৌ, মেয়ে জামাই সকলেই এসেছে। প্রমিলা কে সকলেই খুব ভালোবাসে। তাছাড়া আরও আদর যত্ন বেড়ে গেছে কারণ প্রমিলা তিন মাসের গর্ভবতী। সদ্যই এই সুখবর জানতে পেরেছে সকলে।
কিন্তু এখানে আসার পর থেকে প্রমিলা লক্ষ করেছে ঋকের ঠাম্মি কেমন যেন থম মেরে আছেন। সর্বদা একটা ভীতসন্ত্রস্ত ভাব। সন্ধ্যেবেলায় প্রমিলাকে পুকুর পাড়ে যেতে বারণ করেন, একা এদিক সেদিক যেতে না করেন কিংবা মাথার চুলে একটা লোহার পেরেক রাখতে বলেন। যদিও প্রমিলা এর কিছুই মানে না। আজ একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে এসব অন্ধবিশ্বাস ছাড়া ওর কাছে আর কিছু নয়। কিন্তু ও এমন ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন দেখছে কেন যখনই ঘুমাতে যাচ্ছে?! প্রেগন্যান্সির সময় অবশ্য  মেয়েদের অনেক হরমোনাল চেঞ্জ হয়; তার ফলেই কি এসব হচ্ছে নাকি ও কোনো স্ট্রেস নিচ্ছে বলে হচ্ছে?  উত্তর খুঁজে পায় না প্রমিলা।


আজ ওদের বিবাহবার্ষিকী। ঋক ওকে একটা সুন্দর পেনডেন্ট দিয়েছে। সকাল থেকেই বেশ কোলাহল জমে উঠেছে। সব আত্মীয়রা গতকালই এসে গিয়েছে। সবাই রাতে আড্ডা দিচ্ছিল। কিন্তু প্রমিলা শুয়ে পড়েছিল; শরীরে দিচ্ছিল না। সবসময়ই বলতে গেলে ওর কেমন একটা মাথা ঘোরা গা বমি ভাব কাজ করে এখন। আর ঘুমটা যখনই গাঢ় হয় তখনই ও সেই ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন দেখে আঁতকে ওঠে। একটি মহিলা দু হাত বাড়িয়ে বলছে, " তোর পেটের টাকে আমায় দিয়ে দে। বাঁচতে দেব না তোদের। এ বাড়িতে আর কোনো বাচ্চা জন্মাতে পারবে না। তার আগেই আমি শেষ করে দেব। " বলেই তিনি যেন এগিয়ে আসেন প্রমিলার দিকে। আর পেটের দিকে হাত বাড়াতে যান;- ঠিক সেই মুহুর্তে প্রমিলা ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। বুঝে পায় না এর কারণ কি। ঋক জাপটে ধরে প্রমিলাকে শান্ত করে। বোঝায় যে প্রেগন্যান্সি নিয়ে ও হয়ত একটু বেশিই চিন্তা করছে, তাই এমন দুঃস্বপ্ন দেখছে। কিন্তু প্রমিলা বলে,  " না ঋক। আমি কলকাতায় থাকাকালীন ও তো প্রেগন্যান্ট ছিলাম কিন্তু এরকম ভয়াবহতা তো কখনো গ্রাস করেনি?! "
ঋক এর উত্তর খুঁজে পায় না। অগত্যা প্রসঙ্গ এড়িয়ে যায়।

সকালের ব্রেকফাস্ট সেরে নিয়ে প্রমিলা স্নান সেরে নেয়।  ইতিমধ্যেই এখানকার লোকজন বউ দেখতে চলে এসছে। ঠাম্মি সবসময় প্রমিলাকে চোখে চোখে রাখছে। সেজে গুজে তৈরি হয়ে নিল প্রমিলা আর ঋক। কাকিমা- কাকু,পিসি পিসেমশাই সকলেই উপহার দিয়ে আশীর্বাদ করলেন প্রমিলাকে। কিন্তু ঠাম্মি আশীর্বাদ করে বললেন  "কু'নজর থেকে আমার বংশধর কে রক্ষে কোরো ঠাকুর।" এই বলে প্রমিলার হাতে একখানা তাবিজ বেঁধে দিলেন। সমস্ত কিছু মিটতে রাত হয়ে গেল। সবাই ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়ল। প্রমিলাও ঋকের সাথে শুতে গেল কিন্তু ঘুমাতে পারল না। সেই দুঃস্বপ্ন ওকে নিশ্চিন্তে চোখ বুঝতে দিল না। শরীরের ক্লান্তি আর দুশ্চিন্তা এই দুই মিলে প্রমিলাকে যেন বিধ্বস্ত করে ফেলছে। মাত্র তিনদিনেই চোখের তলায় কালি পড়ে গেছে। সমস্ত গয়না খুলে শোবার সময় ঠাম্মির দেওয়া সেই তাবিজটাও খুলে যায় প্রমিলার অলক্ষ্যে। ফোনের গ্যালারিতে আজকে সবার সাথে তোলা সেলফিগুলো দেখতে দেখতে তন্দ্রা এসে যায় প্রমিলার। আবারও সম্মুখীন হয় সেই ভয়ংকর সময়ের। এবার দেখে সেই মহিলা এগিয়ে আসছে ওর দিকে, আর বলছে,  "বলেছিলাম না তোকে বাঁচতে দেব না। এখন তুই আর তোর পেটের ছাওয়াল দুটোই আমার খাদ্য" বলে এক পৈশাচিক হাসি দেয় সে।
প্রমিলার গোঙানির আওয়াজে ঋক উঠে বসে। প্রমিলাকে ডাকতে গিয়ে দেখে ওর মুখ দিয়ে ফেনা উঠে এসেছে; গায়ে ধুম জ্বর। ঋক তাড়াতাড়ি ওর বাবা কে ডাকে। একে একে সকলেই আসতে শুরু করে। সদর থেকে ডাক্তার আনতে যায় এই জমিদারবাড়ির সত্তর বছরের ম্যানেজার বাবু রমেন কাকা। ডাক্তার এসে সব কিছু দেখে জ্বরের ওষুধ দিয়ে চলে যান। কালকের মধ্যে যদি জ্বর না কমে তাহলে সদর হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
প্রমিলা জ্বরের ঘোরে বলতে থাকে, " ও নিয়ে যাবে বলেছে আমার পেটের টাকে খেয়ে ফেলবে বলেছে.. মেরে ফেলবে সবাইকে.."
ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলেই একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগলো। কেবল ঠাম্মি বলে উঠল, "বলেছিলাম বার বার, গর্ভবতী বউটাকে নিয়ে এখানে আসার দরকার নেই। শোনেনি আমার কথা কেউ। ওই অভিশাপের ফল এসব , বংশের অভিশাপ যাবে কোথায়? কোথায় যাবে ওই নারীর হৃদয় বিদারক যন্ত্রণার হাহাকার?!!"

"ঠাম্মি কিসের অভিশাপ?" ঋক বলে ওঠে। 
" মা তুমি শুধু শুধু সেই পুরনো গল্প শুরু করলে। কিছু না ঋক। তুই বউমাকে নিয়ে বিশ্রাম কর। "  এই বলে ঋকের বাবা ঠাম্মি কে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। সাথে পিসি,পিসেমশাই,  কাকা কাকি সবাই একে একে যে যার ঘরে চলে গেলেন।

পরের দিন ভোর ভোর পিসিমারা রওনা দিলেন ত্রিপুরার উদ্দ্যেশ্যে। কাকা কাকিরাও বিকেলে রওনা দিলেন। পুকুরের বর্গার টাকা কাকা এবং ঋকের বাবা সমান ভাগে ভাগ করে নিয়েছিলেন।
বিকেলের দিকে প্রমিলা একটু হাঁটতে বেরিয়েছিল। বারো একর জমির ওপর এই বিশাল জমিদার বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখছিল। প্রতিটা ভবনেরই সুন্দর সুন্দর নাম আছে। কিন্তু পুকুরপাড় ধরে সোজা এগিয়ে বাঁ হাতে যেই দোতলা ভবন সেটার কোনো নাম নেই। তবে এই ভবনটি বেশ জরাজীর্ণ। এখানে কেউ মনে হয় থাকে না আর তাই হয়ত পরিচর্যার অভাবে এইরকম ভাঙাচোরা অবস্থা। এগিয়ে যায় প্রমিলা বাড়িটির দিকে। নানারকম আগাছা জন্মেছে, মাটি ফুঁড়ে আবার বেশ কিছু লতাও গজিয়েছে। বাড়ির দেওয়াল গুলোয় শ্যাওলার আস্তরণ।  প্রথম ঘরের দরজাটা বন্ধ। কিন্তু দ্বিতীয় ঘরের দরজায় দুটো বড় বড় তালা ঝুলছে। কেবলমাত্র এই দ্বিতীয় ঘরটা ছাড়া বাকি যে দুটো ঘর এই একতলায় রয়েছে সবের দরজাই এমনি বন্ধ। কিন্তু.....
তালা দুটোয় হাত দিতেই যেন ক্যাঁ অ্যাঁ চ শব্দ করে দরজাটা খুলে গেল। প্রমিলা যেন কোন সম্মোহনী শক্তির দ্বারা চালিত হয়ে এগিয়ে চলেছে। ঘরের ডানদিকে একটা পুরনো আমলের খাট। আর সোজাসুজি দেওয়ালে একটা সাদা কালো পোর্ট্রেট। ধুলোর আস্তরণে ছবিটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। প্রমিলা হাত দিয়ে ধুলোটা মুছতেই চমকে দু'পা সরে গেল। এই ভদ্রমহিলাকেই তো ও রোজ স্বপ্নে দেখে। ইনিই তো ওর বাচ্চাকে আর ওকে মেরে ফেলার কথা বলেন বারংবার।
প্রমিলার কানের কাছে যেন সেই মহিলার কন্ঠস্বর বেজে ওঠে আবার, " আয় আমার কাছে চলে আয়.....বাঁচতে পারবিনা তুই.. তোর পেটেরটাও থাকবেনা.... শেষ হয়ে যাবি, এই বাড়িতে আর কোনো সন্তান প্রসব হবে না.... হা হা হা...."

"না.....  না....." প্রমিলা পিছিয়ে আসতে থাকে।

" নতুন বৌমা??? " ম্যানেজার রমেনকাকার প্রশ্নে হুঁশ ফেরে প্রমিলার।

" কার সাথে কথা বলছ বৌমা? আর এই ভর সন্ধ্যেতে তুমি এইখানে কি করছ"

" না, আ.. আ.... আমি মানে এই ঘরে...."  ঘরের দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখাতে গিয়ে প্রমিলা আবার ধাক্কা খায়। ঘরের দরজা যেমন তালা দিয়ে বন্ধ ছিল তেমনই আছে। তাহলে ও এই কয়েক মিনিটে  এখানে যে ঘটনার সম্মুখীন হয়েছিল সেটা কি আদৌ বাস্তব নাকি অলীক জগতে পৌঁছে ছিল ও?!!
ভাবতে পারে না প্রমিলা। মাথা ঘুরে পড়ে যায়।


জ্ঞান ফিরলে প্রমিলা দেখে ও শুয়ে আছে, ঋক ওর মাথার কাছে বসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। শ্বশুর শাশুড়ি ঠাম্মি  এবং রমেন কাকা সবাই যেন এতক্ষণে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিল।
সবার মধ্যে থেকে রমেন কাকা প্রমিলার শ্বশুর মশাইয়ের উদ্দ্যেশ্যে  বলল, " মেজ কর্তা যদি কিছু মনে না করেন তবে বলি কি নতুন বৌমার এ অবস্থায় এখানে থাকা ঠিক নয়। বৌমা আর দাদাবাবুকে বরং কলকাতায় পাঠিয়ে দিন। আজ সন্ধ্যে তে আমি মালির বাড়ি যাওয়ার সময় নতুন বৌমাকে ভাঙা দালানে দেখতে পাই। এগিয়ে গিয়ে দেখি নতুন বৌমা কার সঙ্গে যেন কথা বলছে। আমি জিজ্ঞেস করতেই বৌমা মাথা ঘুরে পড়ে গেল আর আমি আপনাদের ডাক দিই। "

" আমি বার বার বলেছিলাম...." ঠাম্মি বলে উঠল কান্না ভেজা গলায়।

" আমাকে খুলে বলো ঠাম্মি। কি ইতিহাস লুকিয়ে আছে এই বাড়ির সাথে? প্রমিলার সাথে কেন এমন হচ্ছে ? আজ আমাকে জানতেই হবে।"  ঋক বলে ওঠে উত্তেজিত হয়ে।

ঠাম্মি আঁচলে চোখ মুছে বলতে শুরু করে, " আঠারো ও উনিশ শতকের গোড়ার দিকে বাংলার বাজারের জন্য কেবল আফ্রিকাই নয়, বরং আরব, চীন, মালয়,আরাকান ও আসাম হতেও ক্রীতদাস আমদানি করা হত। অভাব, নদীভাঙন, দুর্ভিক্ষ, পরিবারের উপার্জনকারী সদস্যের মৃত্যু- প্রভৃতি দুর্যোগ কবলিত ব্যক্তিরা বেঁচে থাকার তাগিদে স্বেচ্ছায় দাসত্ব গ্রহণ করত। উনিশ শতকের প্রথম দিকে শিশু ও বৃদ্ধদের বাজার দর ছিল পাঁচ থেকে সাত টাকা। স্বাস্থ্যবান তরুণ দাসদের মূল্য হত কুড়ি থেকে পঞ্চাশ টাকা। অভাব ও দুর্ভিক্ষ হলে বাজার দাসে ছেয়ে যেত।  পুরুষ দাসদের নিয়োগ করা হতো কৃষি এবং চাষাবাদের যাবতীয় কঠোর শারীরিক পরিশ্রমের কাজে। লাঙল দিয়ে জমি চাষ, ক্ষেত নিড়ানো, আগাছা পরিষ্কার করা, জমি ঠিক করা, মাছ ধরা, কাঠ কাটা, গবাদিপশুর জন্য ঘাসবিচালি কাটা, পশু লালনপালন করা, ফসল মাড়াই করে গোলা ভর্তি করা ছিল তাদের কাজ। এছাড়াও এঁটো থালাবাসন মাজা, নদী থেকে খাবার জল আনা, মনিবের জন্য হুক্কা এবং পান সাজানো তাদের অন্যতম কাজ। ভাণ্ডারী বা গোলামের মালিক আশেপাশের ছয় সাতটা দাসীবাঁদীদের সাথে তাদের বিয়ে দিতো যাতে তাদেরকে রক্ষিতা হিসেবে ব্যবহার করা যায়। বিয়ে হলেও দৈহিক সম্পর্ক স্থাপিত হতো মালিকের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে। বিয়ের খরচাপাতি দাসের মালিকই বহন করত কিন্তু এই সাজানো বিয়েতে নারীদের কোন লাভ ছিল না বরং নারীদের যথাসম্বল জমানো টাকা খরচ করে বিয়ের ব্যয় নির্বাহ করা হতো এবং কিছু অর্থের মালিক হয়ে যেত দাস পুরুষটি।একসময়ের স্বাধীন জীবিকার অধিকারী মানুষগুলো প্রকৃতির নিষ্ঠুর খেলায় এক নিমিষে তাদের পূর্বপুরুষের ভিটেমাটির মায়া ত্যাগ করে অনিশ্চয়তার কাছে নিজেদের সঁপে দিয়ে পাড়ি জমালো শহরে। এদের স্থান হলো রেললাইনের বস্তিতে। আর এই ছিন্নমূল মানুষের নতুন নাম হলো চাকর। তখনকার দিনে হিন্দু পুরুষ চাকরের নাম ছিল ভাণ্ডারী বা ক্রীতদাস আর মুসলমান পুরুষ চাকরের পরিচয় গোলাম বা নফর। নারীদের ক্ষেত্রে হিন্দু এবং  মুসলিম ভেদে দাসী ও বান্দি নামে ডাকা হতো।

           পঞ্চাশের মন্বন্তরের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সময় এমন অনেক পরিবারই ছিল যাদের স্বামীরা খাদ্যের সন্ধানে শহরে গিয়েছিল অথবা যাদের স্বামীরা অভাবের তাড়নায় 
স্ত্রী -সন্তানকে বেচে দিয়েছিল জোতদার - জমিদার কিংবা মহাজনদের হাতে। ঠিক সেইরকম ভাবেই  বিক্রি হয়ে  গিয়েছিল এক রমনী কুখ্যাত এক জমিদারের কাছে। আর তার প্রতি হওয়া অত্যাচারের অভিশাপ বর্ষিত হয় সেই বংশের উপর। সেই বংশ হল এই রায়চৌধুরী বংশ। আর সেই রমনী ছিলেন হাসিনা। ঋক তোর বাবার ঠাকুরদার যিনি তৃতীয় পূর্বপুরুষ ছিলেন তিনি ছিলেন সেই সময়ের জমিদার। হাসিনা দাসী হয়ে আসে ঠিকই কিন্তু থাকতে হয় ওই জমিদারের রক্ষিতা হয়ে। প্রতি রাতে নিজেকে জমিদারের কাছে অর্পণ করতে করতে একসময় ও গর্ভবতী হয় ; কিন্তু জমিদারের কড়া আপত্তি তাই বাধ্য হয়ে গর্ভপাত করতে হয় হাসিনাকে।
বছর ঘুরতে না ঘুরতেই আবারও গর্ভবতী হয় হাসিনা। কিন্তু এবার আর জমিদার প্রতাপচন্দ্র রায়চৌধুরীর কথায় গর্ভপাত করতে রাজি হয় না হাসিনা। ফলত, জমিদার মশাইয়ের ক্রোধের স্বীকার হয় হাসিনা। জমিদারের বারংবার হুমকি তে যখন কাজ হয়নি, তখন তাকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। খাবারে বিষ মিশিয়ে দেওয়া হয়। মুখ দিয়ে রক্ত উঠে মারা যায় হাসিনা। শেষ অবস্থায় নিজের রক্ত দিয়ে দেওয়ালে লিখে গিয়েছিল সেই অভিশাপ বাণী,   "আমি যেমন সন্তান সুখ চেয়ে আজ মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছি,  ঠিক তেমনি ভাবেই এই বংশের কেউ কখনো সন্তান সুখ পাবে না। আমি এই ভাঙা দালানেই থাকব। কাউকে শান্তি দেব না। কোনো বাচ্চা আর জন্মাবে না এই জমিদার বংশে। "

সবাই যেন সেই শতকে পৌঁছে গেছে। ঋক প্রশ্ন করল,  তাহলে " ঠাম্মি এই যে আমিও তো এই বংশের বংশধর। বাবাও তো তাই আর দাদুভাই ও তাই....."

ঠাম্মি আবার বলতে শুরু করলেন, " হ্যাঁ তোরাও এই বংশেরই বংশধর। তোদের পূর্বপুরুষ রাও তাই। এখন প্রশ্ন হল তোরা কিভাবে বেঁচে থাকতে পারলি এবং তোদের পূর্বপুরুষরা বেঁচে ছিলেন কি করে এই অভিশাপের মধ্যেও, তাহলে বলি শোন।
প্রতাপচন্দ্র রায়চৌধুরীর স্ত্রী দুইবারই মরা সন্তান জন্ম দিয়েছিলেন। তারপর এক তান্ত্রিক কে ডেকে যজ্ঞ করালে তিনি বলেন, গর্ভবতী হওয়ার শুরু থেকে সন্তান জন্মানোর পর সন্তানের পাঁচবছর বয়স পর্যন্ত এবাড়িতে থাকা যাবে না। তাই জমিদারের স্ত্রী তৃতীয় বার যখন গর্ভবতী হন তখন তিনি তার বাপের বাড়ির গ্রামে চলে যান। কন্যা সন্তান পাঁচবছর হলে তিনি ফিরে আসেন। এভাবেই তিনি আরও দুই পুত্র সন্তানের জন্ম দেন। সেই তান্ত্রিকের বিধান মেনেই এই বংশ এগিয়েছে কিন্তু ওই শাপ কেউ খন্ডাতে পারেনি। এই জমিদার বাড়িতে কোনো সন্তান জন্মায়নি। সব বংশধর তাদের মাতুলালয়ে জন্মেছে। জন্মের পাঁচবছর পর এই ভবনে ফিরে এসেছে। ভাঙাদালানে কারোর যাওয়ার সাহস হয় না। ওটা তাই পরিত্যক্ত। "  ঠাম্মি থামলেন।

"আমি লাগেজ গোছাচ্ছি প্রমিলা। কালই বেরিয়ে যেতে হবে আমাদের। আজ রাতটা কষ্ট করে থাকো।"  ঋক বলে ওঠে। 

সেই রাতে সবাই প্রমিলাকে পাহারা দেয়। ঘুমের মধ্যে দু'বার কেঁপে উঠেছিল কিন্তু এর বেশি কিছু আর হয়নি। পরের দিন কাকভোরে ঋকরা সপরিবারে কলকাতার উদ্দ্যেশ্যে রওনা দেয়। ফেরার সময় গাড়ির কাচ নামিয়ে  দিয়ে জমিদার বাড়িটাকে দু'চোখ ভরে দেখে প্রমিলা। এত সুন্দর এত ঐতিহ্য থাকতেও সমগ্র বাড়ির ভবনগুলো থেকে যেন ভেসে আসছে এক নারীর হৃদয় নিংড়ানো যন্ত্রণার প্রতিধ্বনি। এক গর্ভবতী মায়ের সন্তানকে কাছে পাওয়ার তীব্র আকুতি।


সময়
মনোমিতা চক্রবর্তী


রোজকার মতো খাবার খেয়ে টিফিন বক্সটা ব্যাগে ভরিয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে অতনু। বাড়ি থেকে অফিসটা বেশ দূরেই তার। ঘুম থেকে উঠতে আজ একটু দেরি হয়ে গেছে তার, তাই বেরোতেও আধ ঘন্টা মত লেট সে আজ ।
তাই একপ্রকার তাড়াহুড়ো করে গ্যারেজ থেকে মোটরসাইকেলটা বের করে কোনমতে স্টার্ট দিয়ে অতনু বেরিয়ে পড়ে।
 মনে মনে যে ভয়টা ছিল অতনুর সেটাই হলো ।কদমতলার ডি বি সি রোডটা পুরো আটকে গেছে জ্যামে।
 এই হলো প্রতিদিনের সমস্যা।একে স্কুল, অফিসের সময় তাতে ছোট রাস্তা ।এখন  লোকসংখ্যা অনেক বেশি তাই যানবাহনও অনেক বেশি এই রাস্তায়। এটা প্রায় রোজকার সমস্যায় দাঁড়িয়েছে। এই জায়গাটাকেই এড়ানোর জন্য অতনু রোজ আধঘন্টা সময় হাতে নিয়ে বের হয়। কিন্তু আজ ঘুম থেকে উঠতেই যে দেরি হয়ে গেল ।তাই যথারীতি বেরোতে দেরি হলো।
 কি আর করা যাবে ,অপেক্ষা করা ছাড়া। জ্যামটা তো মনে হচ্ছে কদমতলা মোড় থেকে শুরু হয়েছে,মনে মনে ভাবে অতনু ।
এমন সময় মুখটা ঘোরাতেই অতনুর চোখ যায় ডি বি সি রোডের পাশের ফুলের দোকান গুলোর দিকে ।কত সুন্দর সুন্দর রং বেরঙের ফুল রয়েছে দোকানগুলিতে। 
ঐতো জুঁই ফুলের মালা ও রয়েছে!
জুঁই ফুলের মালা দেখে অতনু কোথায় যেনো হারিয়ে যায়।
 এক মনে জুঁই ফুলের মালার দিকে তাকিয়ে অতনু ভাবে আজ ফেরার পথে তনুর জন্য জুঁই ফুলের মালা নিতেই হবে। 
এমন সময় পেছনের গাড়িগুলোর তীব্র হর্ণে সম্বিৎ ফেরে অতনুর । জ্যাম খুলে গেছে, সবাই এগিয়ে যাচ্ছে নিজস্ব গন্তব্যে।অতনুও তার টু হুইলার কে স্টার্ট দিয়ে বেরিয়ে পড়ে অফিসের উদ্দেশ্য।
অফিসে আজ ঠিক মত মন বসছিল না অতনুর। যদিও এখন এটা প্রায় রোজই হচ্ছে তার ।একপ্রকার জোর করেই কাজে মন দেয় অতনু। 

ফেরার পথে তনুর জন্য জুঁই ফুলের মালা আর একগুচ্ছ গোলাপ নিয়ে নেয় অতনু।
 
অতনু বাড়ি ফিরে সোজা চলে যায় শোবার ঘরে। তনুুর সামনে দাঁড়িয়ে তাকে দেখিয়ে জুঁইফুলের মালা আর গোলাপ গুলো রেখে দেয় অতনুু। 
ছল ছল চোখে তনুর দিকে তাকিয়ে অতনু বলে দেখো তনু তোমার জন্য  তোমার পছন্দের জুঁই ফুলের মালা এনেছি। সাথে কিছু গোলাপও। 

তুমি তো বিয়ের পরপর একবার বলেছিলে জুঁই ফুলের মালা তোমার খুব পছন্দ। তোমার খুব ইচ্ছে সারা ঘর ফুল দিয়ে সাজিয়ে মোম জ্বালিয়ে, হালকা আলোয় আমরা দুজন মিলে রোমান্টিক গান শুনবো । ওই যে তোমার পছন্দের ওই হিন্দি গানটা "তুমসে মিলকে অ্যায়সা লাগা তুমসে মিলকে ,আরমা হুয়ে পুরে দিলকে ....."
জানি তুমি কিছুই তেমন চাওনি আমার কাছে। অথচ এই সামান্য উপহার টুকুও আমি এতদিন তোমায় দিতে পারিনি। এখনো তুমি ড্যাব ড্যাব চোখ করে তাকিয়েই থাকবে আমার দিকে?কিচ্ছু বলবে না?
 বলতে বলতে ডুকরে কেঁদে ওঠে চির গম্ভীর অতনু ।
চোখ মুছে আবারো তনুর দিকে তাকিয়ে বলে অভিমান হয়েছে না তোমার ?হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু আমিও যে নিরুপায় ছিলাম তনু!তুমি তো জানো, প্রাইভেট কোম্পানির চাকরি আমার। চাকরিটা টিকিয়ে রাখতে মালিক পক্ষের কথা মত গাধার খাটুনি তখনো খাটতে হতো এখনো খাটতে হয়। না হলে যে চাকরিটাই থাকতো না আমার। আর চাকরিটা না থাকলে তো বাবা ,মা ,ভাই, বোন এরা যে ভেসে যেতো।
বিশ্বাস করো তনু আমি নিরুপায় ছিলাম। তোমায় আমি ইচ্ছে করে সময় দেইনি এমনটা নয় ।তবে আমারও ভুল ছিল,এটা আমি মানছি তনু।
আমিও চেষ্টা করলে হয়তো এক আধদিন তোমার ইচ্ছে গুলো পূরণ করতেই পারতাম। তখন ভাবিনি গো সময় এত দ্রুত চলে যাবে ।অভিমানের পাহাড়টা যে তোমার মনে এতটাই বড় হয়ে যাবে সেটাও খেয়াল করিনি ।আমায় তুমি ক্ষমা করে দিও তনু, আমি জানি তুমি কাউকে কখনো কষ্ট দিতে চাওনি ।
তুমি চাওনি অসুস্থতার কারণে শয্যাশায়ী হয়ে থাকতে ।আমার,আমার পরিবারের সদস্যদের কষ্ট বেড়ে যাবে এটা ভেবেই তো তুমি ঘুমের ওষুধ খেয়ে চির নিদ্রায় নিদ্রিত হলে। 
বলেই আবারো হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলে অতনু ।
এরপর কিছুটা শান্ত হয়ে অতনু বলে আজ কত মাস হয়ে গেল বলতো তুমি নেই!
 আমি ভালো নেই তনু। তনুর অতনু ভালো নেই।
দ্যাখো আজ এনেছি তোমার পছন্দের জুঁই ফুলের মালা ।
জানি বড্ড দেরি হয়ে গেছে!
 বড় আফসোস হচ্ছে আজ তনু, কেন যে সময় থাকতে তোমার মনের ছোট ছোট ইচ্ছেগুলোকে প্রাধান্য দেই নি। কেন যে বলিনি বড় ভালোবাসি তোমায় ।
টেবিলে রাখা তনুর ডায়েরিটা হাতে নেয় অতনু ।ডাইরিটা খুলতেই দেখে তাতে লেখা _
"তোমার আমার গল্পটা অভিমানের কাব্যই হয়ে থাক ,
সময়ে না বলা কিছু কথার জন্য জীবনটা না হয় আজ ছন্নছাড়াই হয়ে যাক।"
চোখে জল নিয়ে তনুর ছবির সামনে দাঁড়িয়ে অতনু বলে ,সত্যি সময় কারো জন্য অপেক্ষা করে না ।সময়ের কাজ সময়ে করলে হয়তো আমাদের জীবনটাও অন্যরকম হতে পারতো।



স্বপ্ন বেচা
জনা বন্দ্যোপাধ্যায় 

আজ সকাল থেকে পঞ্চানন হালদারের ঘরের দাওয়ায় মেলা লোকের ভিড়। আর কদিন পর শ্মশানের পাশের মাঠে গাজনের মেলা বসবে। এখানে গাজনের আগের দিন সারা রাত বোলান গানের আসর বসে। পঞ্চানন হালদার অকৃতদার। গ্রামের ভাগ চাষী। মাটির টালি ছাওয়া দুটো ঘরে বিধবা বোন লক্ষ্মীকে নিয়ে থাকেন। কয়েক বছর ধরে বোলান গানের আসরে ওস্তাদ হিসাবে গান লিখে ও গেয়ে বিশেষ দায়িত্ব পালন করেন তিনি। পঞ্চাননের গানের সঙ্গে সহযোগিরাও গান। তাঁদের কারোরই বয়স বেশী নয়, বছর পঁয়ত্রিশের মধ্যে। পেশায় বেশীর ভাগই চাষী। কয়েকজনের ছোটখাটো মুদির দোকান আছে।
             মুর্শিদাবাদ ও বর্ধমান জেলার মিলনস্থল দক্ষিণখন্ড গ্রাম। শিবের গাজন উপলক্ষ্যে এখানকার বোলান গান বীরভূম, মুর্শিদাবাদ ও বর্ধমানের অন্যান্য জায়গার মতোই জনপ্রিয়। শিব দুর্গার পৌরাণিক কাহিনী বা দাম্পত্য কলহের মতো সামাজিক কাহিনী নিয়ে বোলান শিল্পীরা গান বাঁধেন খানিকটা পালা গানের আঙ্গিকে। এই লোকগানে লোকনাট্যও লক্ষিত হয়। পঞ্চানন হালদারের দলে ঢোল বাজান নিতাই বায়েন। তিনি এই দলে  প্রৌঢ়,বাহান্ন পেরিয়েছেন, প্রায় পঞ্চানন হালদারের বয়েসী। গান, বাজনার তালে তালে দলে রাঘব, শম্ভু, মনোজ, শিবেন প্রভৃতি কয়েকজন বিভিন্ন চরিত্রের সাজে নেচে আসর মাতান। পঞ্চানন আসরের শুরুতে গুরু বন্দনা করেন প্রত্যেক বার। 
      পঞ্চানন হালদারের বোন লক্ষ্মী সমবেত সকলের জন্য চা, বিস্কুট আর পাঁপড় ভাজা নিয়ে আসে। দলের শিবেন কে লক্ষ্মীর দিকে একভাবে তাকিয়ে থাকতে  লক্ষ্য করেন পঞ্চানন। লক্ষ্মী যুবতী বয়সে বিধবা হলেও বেশ সুন্দরী। চটক আছে চেহারায়, পুরুষের নজর কাড়ে। লক্ষ্মীকে চা পরিবেশনের পর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পঞ্চানন বলেন, " তুই দাঁড়ালি কেন? তুই ভেতরে যা। এটা পুরুষমানুষদের সভা।"
লক্ষ্মী ভেতরে যায়। নিজে সংসার না পেতে পঞ্চানন আঠারো বছরের ছোট বোনকে পিতৃস্নেহেই বড় করেন। দু বছর আগে শহরের পি. ডবলু. ডি-র ড্রাইভারের সঙ্গে সম্বন্ধ করে বিয়ে দেন বোনের। কিন্তু তিন মাস যেতে না যেতেই গাড়ি দুর্ঘটনায় লক্ষ্মীর স্বামীর মৃত্যু হয়। তারপর শ্বশুরবাড়ির গঞ্জনা সহ্য করতে না পেরে লক্ষ্মী দাদার কাছেই ফিরে আসে।
            সভার মাঝে রাঘব হঠাৎ বলে ওঠেন, " গানের বিষয়ে এবার কিন্তু একটু চমক চাই পঞ্চানন কাকা।"
" কি রকম চমকের কথা বলছিস তুই? "
পঞ্চানন অবাক হন। তাঁর গম্ভীর ব্যক্তিত্ব, দোহারা চেহারা, কাঁচা পাকা গোঁফ।
" না বলছিলাম যে, প্রতিবারই তো পুরাণের কাহিনী বা সামাজিক ব্যাপারগুলো গানে থাকে। এবার না হয় একটু রাজনীতি নিয়ে ব্যাঙ্গ রসও থাকুক।"
পঞ্চানন বিরক্তি প্রকাশ করে বলেন, " রাজনীতি ঢোকাবি বোলান গানে? তাতে ঐতিহ্য নষ্ট হবে। তাহলে বাপু তোরাই গান বাঁধ। আমায় ছেড়ে দে।"
"তা কি করে হয় ওস্তাদ? তুমি হলে আমাদের মাথা। তোমার মতো কেউ এ তল্লাটে গান বাঁধতে পারে না।"
মনোজের কথায় শম্ভু, শিবেন এবং দলের অন্যান্যরা সায় দেন ।
পঞ্চানন খুশি হয়ে বলেন, "তাহলে কাল থেকে এবারের গানের কথাগুলো লিখতে শুরু করব। গান, বাজনার সঙ্গে নাচের তাল যেন মেলে। তবে তো জমবে আমাদের পোড়ো বোলান।"
দলের সদ্য যুবক কানু দলে কাঁসর বাজায়। সে আনন্দে তালি দিয়ে এক পাক ঘুরে বলে," আমরা মাঠের একদিকে আসর জমাবো আর কিছু দূরে মড়ার খুলি নিয়ে জাদু দেখানো শুরু করবে দাঁড় বোলানের লোকজন।  সে সত্যি এক হই হই কান্ড! বেড়ে মজা হবে। কত মানুষ সারা বছর এসবের জন্য অপেক্ষা করে থাকে।"
পঞ্চানন সহমত প্রকাশ করে বলেন, " শিল্পীদের এখনো কদর আছে। তবে কিছু বছর পর তোদের ছেলেপিলেরা হয়তো এসব আর ধরে রাখতে পারবে না।"
ঢোল বাদক নিতাই বায়েন বলেন, "জীবিকার তাগিদে পেটের ভাত জোটাতে এরপর এসব শিল্প উঠে যাবে গো ওস্তাদ।"
       সভা শেষ হতে দুপুর গড়িয়ে যায়। সকলে একে একে প্রস্থান করলে পঞ্চানন স্নানাহার সেরে গুরু বন্দনা লিখতে বসেন। লক্ষ্মী পাশে দাঁড়িয়ে মন দিয়ে দেখে দাদার লেখা। পঞ্চানন লেখেন--
" গুরুর নাম নকুল চরণ পাটনি, দক্ষিণখন্ডে বাড়ি। তাঁর চরণ স্মরণ করে কত স্থানে দি পাড়ি।"
পঞ্চানন বোনের মাথায় হাত দিয়ে বলেন, "তোর তো গানের কাব্যি কথা পড়তে ভালো লাগে। তুই প্রথম পড়ে বলবি এবারে কিরকম লেখা হয়েছে।"
লক্ষ্মী সরল ভাবে হাসে।
         গাজনের দিন বোলানের আসর জমজমাট। গায়ক, বাদকের সঙ্গে  নৃত্যশিল্পীরা নানান রকম চরিত্র সেজে নিজ নিজ শিল্প ক্ষমতা প্রদর্শন করে মানুষের মন জয় করেন। ওখানকার গ্রামের শ্মশানে চড়ক মেলা বসে। চড়ক কাঠ পুঁতে সন্ন্যাসীরা ঘোরেন। জিভ ফোঁড়া, ভুরু ফোঁড়া, পিঠে ফোঁড়া--এগুলো গাজনের মেলায় 'বান ফোঁড়া' নামে খ্যাত। দুই বঙ্গের সন্ন্যাসীরা সরু লোহার রড নিজেদের জিভে বিদ্ধ করেন। এসব অভাবনীয় দৃশ্য দেখতে ভিড় করে দূরদূরান্তের মানুষ। চড়কের মেলায় এরকমও দেখা যায় যে, ঝুলন্ত সন্ন্যাসী ভক্তের মুখ নীচের দিকে, যেখানে একটি গর্তে আগুন জ্বলছে। সন্ন্যাসীর গোটা শরীর পেন্ডুলামের মতো ঝোলে। মাথাটি আগুন কুন্ডের এদিক ওদিক করে। এছাড়া সন্ন্যাসীরা ধারালো বঁটির ওপর বুক পেতে ঝাঁপ দেন। এসব মেলায় বাতাসার লুঠও হয়।
        পঞ্চানন গাজনের দিন বিকেলে ভিড়ের মধ্যে শিবেনের অনুপস্থিতি লক্ষ্য করেন। শিবেনের ব্যাপারে কেউই উত্তর দিতে পারে না। আসর শেষ হলে ভোর রাতে ক্লান্ত শরীরে পঞ্চানন বাড়ি ফেরেন। লক্ষ্মীর নাম ধরে ডেকে সাড়া পান না। ঘরের দরজা খোলা। লক্ষ্মী কোথাও নেই। পঞ্চানন দেখেন লক্ষ্মীর চৌকির ওপর এক টুকরো কাগজে লেখা " আমায় খুঁজো না। তোমায় দু:খ দিতে চাই নি। কিন্তু আর কতদিন তোমার গলগ্রহ হয়ে থাকবো! শিবেনদার সঙ্গে কলকাতা চললাম। ওখানে একটা পার্লারে কাজ করব। শিবেনদা ব্যবস্থা করে দেবে বলেছে।"
পঞ্চানন কাগজের টুকরোটা ছুঁড়ে ফেলে বুক ফাটা আর্তনাদ করেন, " লক্ষ্মী তুই জানিস না তুই নিজে তোর কি সর্বনাশ করলি! তুই এই পাপের দুনিয়ায় কাউকে চিনিস না। সব মানুষ এখানে মুখোশধারী। শিবেন যে তোকে দালালের হাতে বেচে দেবে। তুই ফিরে আয় বোন। আমি গান বাঁধলে কে পাশে থাকবে!"
         লক্ষ্মীর খবর আর পঞ্চানন পান নি। শিবেনও সেদিনের পর  গ্রাম থেকে নিখোঁজ। শিবেন ছোট থেকে অনাথ। এই গ্রামে মামা মামীর সংসারে মানুষ।  বিড়ি বাঁধার কাজ করত সে একটা দোকানে।
            পরের বছর গাজনের সময় পঞ্চানন দলের ওস্তাদ হিসাবে আর থাকতে চান না। শুধু দলের নয়, এই পৃথিবীর প্রতি তাঁর টান উঠে গেছে। আজকাল বুড়ো বটের নীচে বসে বিড় বিড় করে আপন মনে পঞ্চানন কি সব বলেন। দলের কেউ এসে কুশল জিজ্ঞাসা করলে একভাবে চেয়ে থাকেন। তাঁর হয়তো মাথার ঠিক নেই এ কথা অনেকেই বোঝেন। নিতাই বায়েন একদিন পঞ্চাননকে বলেন, "দল নিয়ে তোমার কত স্বপ্ন ছিল। কেন তুমি সব ছেড়ে দিলে? তোমার দল যে ভেঙে যাবার মুখে।"
পঞ্চাননের মাথার চুল এলোমেলো। ঘোলাটে চাউনি। মুখ ভর্তি পাকা দাড়ি। পঞ্চানন কিছু ক্ষণ নীরব থাকেন। তারপর উদাস স্বরে বলেন, " আমি স্বপ্ন বেচবো। আমার স্বপ্ন কেউ কিনে নিক! কিনে নিক!"
নিতাই বায়েন বিস্ময়ের দৃষ্টিতে পঞ্চাননকে দেখেন। আর কিছুই বলতে পারেন না।


কবিতা 


শব্দ
পূর্ণিমা বোস

শব্দ  ভেঙে  যায়  জলে  স্থলে
দখিনা  বাতাসে  ডানা  মেলে
এক  দল  মৌমাছির   সাথে
মস্তিষ্কের  মন্দিরে  জাগে।

দুগ্ধ পোষ্য বালক রাতে
আমি বেড়াই খুঁজে অকাতরে
স্নেহ চুম্বন দিয়ে চিবুকে
আমার কবিতার শরীরে।

চঞ্চলতা রং বদলায় ক্ষনিকেই
সম্বল খুঁজে পাই আমার মতো।



যুদ্ধ
টি এইচ মাহির 

যুদ্ধ বাঁধে ঘর ভাঙে
ধ্বংস পথে পথে
ছোট্ট শিশু ছোট্ট দেহ
কাঁদে থরে থরে।

এতিম শিশুর কান্নায়
ঝরে শতো ফুল
অস্ত্র তন্ত্রে লক্ষ্য যেন
মানব বংশ মূল।

দেশে দেশে ভাঙে শুধু
মানব সভ্যতা
শাসকদের শাপাঘাতে
রূদ্ধ মানবতা।

যুদ্ধ শেষে রুগ্ন দেশে
নিত্য হাহাকার
রাজায় রাজায় লড়াই
ধরণী ছারখার।




কবিতা
শতাব্দী সাহা 

১) অন্তহীন ভাবনারা মিলিত হলে জন্ম নাও তুমি।

২) মৃত অক্ষর হয় সঞ্জীবিত কখনও কবিতাময় জীবনে নয়তো জীবনময় কবিতায়।




বেঁচে থাক স্বপ্ন
    লীনা রায়

দু' চোখ জোড়া স্বপ্ন নিয়ে তুই
খুঁটিয়ে দেখিস রাতের কালো আকাশ,
মুঠো মুঠো ছড়িয়ে রাতের তারা
ইচ্ছেমতো স্বপ্নকে তোর সাজাস।

স্বপ্ন নিয়েই তোর নিত্যদিনের বাঁচা
আকাশ ছুঁতে হাতদুটো নিশপিস,
স্বপ্ন-তাড়ায় বেদম তো আজ তুই
স্বপ্নটা তুই দেখেছিলি ভাগ্যিস !

বেঁচে থাকা যুদ্ধ তো নয় কেবল
তুই তা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখাস,
স্বপ্ন জড়াস তাই তো বেঁচে থাকায়
রঙিন করিস মনের সাদা আকাশ।



মহাকাব্য
দেবদত্তা লাহিড়ী 

শোন, বৃদ্ধ হবার আগে তোমার সাথে
ঐ লাস ভেগাস আর মলদিভস টা
 ঘুরে আসতে চাই।

কি বলছ? নদী পাড় আর ফুচকা চুরমুরে
কাটবে চমৎকার জীবন-
যদি তোমাকে পাই।

হাসছি আমি - সেতো চুরমুর আর পচা ডাম্পিং গ্রাউন্ড এর পাশে 
লুকিয়ে চুরিয়ে প্রেম করেই কেটে গেছে কত দিন।
যাকনা সেসব কথা,কিন্তু বলতো
এত কম কেমন করে চাই তোমার কাছে?
তুমিই তো একিলিস।
আমার একিলিস,যাকে কেন্দ্র করে 
লিখে ফেলা যায় একখানা গোটা মহাকাব্য।
তুমিই আমার সেই একিলিস
যে একের পর এক করে যায় অসাধ্য সাধন।
যে মহা নায়কের একমাত্র একটাই দুর্বল অংশ
এই ধরে নাও না - যেমন তোমার আমি।
তাই তোমায় করবো ছোট
এমন সাধ্য আমার নাই।

তবে, এই যে আমার এত চাওয়া, এত কথা।
তার কারণ অবিশ্যি আছে
আমি।
আমি ও কিন্তু খুব তুচ্ছ নই যে তোমায়
একিলিসের আসনে বসাই 
আমাকে পেতেও  তো মূল্য চোকাতে হয়,
অনেকখানি মূল্য। 
নাহলে এত প্রেম পাবে কোথায়।
লেখা হবেই বা কেমন করে?
দেখেছো কি নারী বিবর্জিত কোনও মহাকাব্য?
তুমি ভেবেও কি দেখনা কখনো
তোমার মহাকাব্য ও  হবে অসম্পূর্ণ
যদি আমি চলে যাই।



অন্য গল্পের খোঁজে
 সারণ ভাদুড়ী 

গোলাপ গুলো গাছেই ঝড়ে যায়
তারা আর শোভা পায়না তোমার হাতে,
চাঁদ দিগন্তে ডুবে যায়
সে আর থাকেনা তোমার অপেক্ষায়.....
গলির মোড় গুলো আজ ফাঁকাই থাকে
তাতে আর আমার চিহ্ন নেই।
 এখন ক্লাস নোটগুলো আমিই রাখি
অন্য হাতে যায় না আর;
বাসের সিটটা রিজার্ভ আজ
আর ব্যাগটা আমার পিঠে,
সাইকেলটা হাতে নিয়ে আমি এগিয়ে গেছি
এগিয়ে গেছি হয়তো অন্য গল্পের খোঁজে....


রোদ বাগান
অলকানন্দা দে


এক যে ছিল আলসে দুপুরবেলা
হাওয়ার গায়ে দুপুর দুপুর গন্ধ
চিল ওড়া এক আকাশ ছিল বেশ
খরস্রোতা স্মৃতি মায়ায় অন্ধ!

এক যে ছিল গপ্পো বলা রাত
লোডশেডিঙে চাঁদ ধরতো বাতি
রাঙতামোড়া বিশ্বজয়ী কালো
স্বাস্থ্যঘুমে পেরিয়ে যাওয়া রাতি!

এক যে ছিল বোশেখ মাসের ঝড়
উথাল পাথাল তালসুপারির পাতা
আলতো টোকায় বৃষ্টি ঝরায় মেঘ
কোলাহলে ছড়ায় নিজস্বতা!

মানুষ মেলায় দিনের পাড়ে দিন
জড়িয়ে থাকার তন্তু ছিল সোনা
বপন করা আলোর চারাগাছ
অভয়ধারা স্নেহের আনাগোনা!

সবই ছিল অদল বদল সুখে
সোনাবরণ আনন্দ একরাশ
এ-সুখ থেকে ও- সুখ সাঁকো জুড়ে
পারাপারের নেশায় বারোমাস!

পশ্চিমে সেই মিলিয়ে যাওয়া বেলা
পরিব্রাজক মন করে যায় খোঁজ
মৃত্তিকাকে পথ দেখাতে বলে
দলবদ্ধ আকাঙ্ক্ষাতে রোজ!


শুধু মনে রাখা
বিজয় বর্মন 

বাবা আজকাল খুব অন্য মনস্ক থাকেন,
মা অনেক বার ডাকা ডাকি করলে,
তবেই উত্তর মেলে একবার,
যা দেখে,কি যে নিরীক্ষণ,মনে হয় প্রথম বার নজরে এলো তার,

জানিনা কোথায় হারিয়ে যায়,সত্যটা বললেই,
ধৈর্য হারিয়ে ফেলে, ভীষণ রেগে যায়,
মায়ের সাথে হরহামেশা,
যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব,

কিছুক্ষণেই নিরবতা বিরাজ করে বাড়িময়,
মায়ের মুখ ভার,
জানালায় চোখ খোঁজে, হারিয়ে যাওয়া গোলাপ,
তবু জল ঢালে শুকনো গাছে,
ফুল বা কাঁটা যা পাওয়া যায়,

আমার যে মন খারাপ হয় না,
তা নয়,
আত্মশ্লেষের হাসি, মুচকি রূপান্তর,
ওদিকে চাঁদের মালায় লকেট ঝুলেছে,
বিচ্ছেদের খবর কেউ রাখেনা।

মা বলে দেখ,রাগ করিস না,
এখনও অনেক পথ বাকি আছে চলার,
আমরা ভালো আছি,
বাবার কাছে এটাই স্বান্তনার,
মনে রাখিস,সংসারে হারানোর কিছু নেই !




প্রতিবেদন 

হারিয়ে যাওয়ার কথা
 আশীষ  কুমার  বিশ্বাস
           
এই যে আমাদের সমাজ , এই সমাজ থেকে মাঝে মধ্যেই শোনা যায় অবলা ,চপলা , হেমাঙ্গি ,মাধুরী , বা আল্লাদি  হারিয়ে গেছে । বয়ঃসন্দী যখন তেরো-চোদ্দ , কিংবা পনেরো-ষোলো , তখনই এদের হারিয়ে যাওয়ার পালা !

এমনটা কেন ঘটছে , একটু ভেবে দেখা দরকার । সমাজের বিভিন্ন স্তরের লোক বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত , এক শ্রেণীর লোক তাঁরা খোঁজ  রাখে , বা চোখে রাখে এই উর্তি বয়সের মেয়েদের , শুধু তাই নয় তাঁদের সাংসারিক অবস্থা , হাঁটা চলা ,পড়াশোনা , দিন কাল সবই । কেন এটা করে ? কারণ এদের সাথেই যোগ থাকে বিভিন্ন মানব পাচারকারির , সমাজের অন্ধকার জগতের লোকের ।

খুব সন্তর্পনে এরা কাজ করে থাকে , বিভিন্ন অসৎ উপায় অবলম্বন করে এরা সেই সব ঘরে কল্যাণ কামী রূপ নিয়ে আবির্ভুত হয় । এখানে এরা সহজেই টাকার প্রলোভন দেখিয়ে কাজ হাসিল করার দিকে এগিয়ে যায় ।

বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম ,  পত্র - পত্রিকা বা সরকারি রিপোর্টে দেখা যায় যে ভিনদেশে এরা পাড়ি দিয়েছে বা অন্য রাজ্যে গিয়ে ধরা পড়েছে । ধরা পড়ার তালিকায় খুবই কম । এমন ভাবে ভিন দেশে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে যে স্ব-ইচ্ছায় বা পরিবারের কেউ , তাঁদের ই  সাথে যাচ্ছে , অথবা অনেক সময় বোঝার কোনো উপায়ই থাকে না ।

প্রলোভনের মধ্যে অনেক কে  ভালো ভালো চাকরীর কথা , নার্সিং ট্রেনিং , টেলিফোন অপারেটার বা ভিন্ন ধরনের কাজের কথা এবং ভালো আয় আছে এই ধরণের কাজের কথা বলে ,দরিদ্র ঘরের মেয়েদের তুলে আনা হয় !

এমনও আছে ভিন দেশি ছেলেকে পাত্র সাজিয়ে অবলা , চপলা ,  বা আল্লাদির মতো মেয়ে কে
বিয়ে করে ভিন দেশে পাড়ি দিচ্ছে ।

দিন যায় , মাস যায় , বছর যায় , তাঁদের আর খবর  পাওয়া যায় না । মা-বাবা , ভাই বোন  তখন দুঃখের
সাগরে , শুধু দুঃচিন্তা তাঁদের কুঁড়ে কুঁড়ে খায় !

যে মেয়ে বিয়ের ভাবনা ভেবে বিয়ের পিঁড়িতে পা দিলো , তাঁর মনে কিন্তু একটা ভাবনা জেগে ওঠে , সে ভাবে সংসারে যে অবস্থা তাঁতে তার ভবিষ্যতে বিয়ে হওয়া অসম্ভব । সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরোয় , তবুও কোনো দেনা-পাওনা ছাড়াই এই যে বিয়ে হয়ে গেল তাঁতে তার বাবা-মা তো আর্থিক দুর্দশা থেকে  কিছুটা রক্ষা পেল !

কিন্তু এই রক্ষা , শেষ রক্ষা নয়। যে পাত্রের সাথে তাঁর বিয়ে হলো তাঁর কিছুটা বলি । এই যে ট্রেনে এক দিন বা দু,দিন রেল যাত্রা বা দীর্ঘ বাস যাত্রা সেরে যখন বরের বাড়ি যাওয়ার কথা , তখন পাত্রীর ( বউ ) আর বাড়ি পৌঁছায় না । এখান থেকে কোনো ট্রাকের বা মেশিন ভ্যানে যে স্থানে পাড়ি দেয় , সেটা ভয়ানক এক স্থান , পতিতালয় বা বেশ্যাখানা । এখানে নববধূকে বসিয়ে রেখে পাত্র মোটা টাকায় বিক্রি বা নিয়োগ করে , সে কেটে পড়ে । পাত্রীর কপালে ঘনিয়ে আসে চির অন্ধকার , কিছুতেই সেই পরিবেশ বা তাঁর যাপন মেনে নিতে পারে না ।

এই রকমই আরও অন্যান্য মেয়েদের সাথে ভিন্ন ভিন্ন পথ অবলম্বন করা হয় , যাঁরা চাকরি করবে বলে এসেছিল , তাঁদের চাকরী তো দূরের কথা, নিম্ন মানের কাজ , অস্বস্তিকর পরিবেশ , অস্বাস্থ্যকর , হানিকারক জীবনের দিকে ঠেলে দেওয়া হয় । দিনের আলোতে তাঁরা অন্ধকারে , অথই জলে পড়ে হাবু-ডুবু খেতে হয় ।

পরিশেষে কেউ কেউ আবার মেনে নেয় , মানিয়ে নেয় । মনের মধ্যে ঘোরা-ফেরা করে বাড়ি ফেরার ।
পথ খোঁজে কিন্তু খুঁজে পাওয়া দায় !  যে দালাল চক্র এই কাজ গুলি করে তাঁরা ভীষণ চালাক এবং নির্মম। এঁদের যা সম্বল অর্থাৎ তাঁদের কুঁড়িয়ে কাঁচিয়ে যে টাকা পয়সা , তা কেড়ে নেওয়া হয় , এমন কি এদের শিক্ষাগত যা যোগ্যতা বা প্রমান পত্র সব নিয়ে নেওয়া হয় , এর পর এদের আর কোনো উপায় থাকে না।

যাঁরা দুঃসাহসী বা দূরদৃষ্টি সম্পর্ণ , তাঁরা কোনো মতে লুকিয়ে চুরিয়ে এ স্থান থেকে পালিয়ে পুলিশ থানায় খবর দেয় , কিংবা সুষ্ঠ সংগঠনের হাতে পড়ে এদের মুক্তি ঘটে !

এবার ফিরে আসি সেই সব মেয়েদের কথা , যাঁরা বিয়ের মালা পড়েছিল কোনো সুখের ঘর বাঁধবে বলে , তাঁদের জীবনে ঘটে গেছে চরম দুর্দিনের কাহিনী । দালাল তাঁদের নামিয়ে দিয়েছে দেহ ব্যাবসায় । জীবন কাটে পতিতালয়ে !

এ পথে হয়তো পয়সা আসে ঠিকই , কিন্তু মন সেটা চায় না , তাঁর মন বাড়ি ফেরার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ে । বছরের পর বছর ঘুরে ফিরে আসে , বেশ কিছু টাকাও জমায় , টাকা গোনার সময় ফুঁটে ওঠে
তাঁর প্রিয় জনদের মুখ , মা-বাবা , ভাই-বোন কিংবা পাড়ার তাঁর বন্ধুর কথা ! নিঃশ্চুপ কান্নার চোখের জলে টাকা ভিজে যায় , তবুও গুনতে থাকে কারণ বেশ কিছু টাকা হলে সে তাঁর বাবা-মার এবং ভাই-বোনদের জন্য জামা কাপড় নিয়ে যাবে আর মার হাতে তুলে দেবে অনেক টাকা , পরিবার টা যেন সুস্থ ভাবে বাঁচতে পারে !

স্বপ্ন সে তো স্বপ্নই থেকে যায় , পতিতালয়ের থেকে পালিয়ে অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে যখন দীর্ঘ পথ , দীর্ঘ দিন অতিক্রম করে বাড়ি ফেরে , তখন আর বাড়িতে পা রাখতে পারে না । লাজ লজ্জা বদনামের অপ-প্রচারে মা-বাবা আর তাঁকে বুকে তুলে নিতে পারে না , চেনা পরিচিতির জগতে তাঁর আর ঠাঁই হয় না !

আবার তাঁকে ফিরে যেতে হয় অপরিচিত জগতে 
শুধু বেঁচে থাকার জন্য , কিন্তু এই বাঁচা কি সঠিক ভাবে বাঁচা ?

প্রশ্ন রইলো আপনাদের কাছে ।


কবিতা 


স্বপ্নস্মৃতি
দেবযানী সেনগুপ্ত

স্তব্ধ রাতের কড়া নাড়া
 থমকে সময় যুগ,
 ঘুমহীন চোখ প্রহর গোনে
 না বলা ব্যথায় মূক!
 সময় এগোয় আবছা আলোয়
 অদেখা মিছিল মুখ,
 স্বপ্ন জড়ানো ঘুম চোখ খোঁজে
 আলতো হাতের সুখ।
 স্মৃতি দরজায় হাট করে খোলা 
অগোছালো বাড়ি ঘর
 ছেলেবেলার পুতুল খেলার
 ছোটখাটো টুকটাক।
 চিলেকোঠার সান্ধ্য বুকে
 মেঘলা বিকেল  ঝুপ,
 ভুলে যাওয়া এক, কি যেন নাম,
 ডেকে ওঠে চুপ চুপ।।



গালিবের চ্যালা
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় 

বুকে স্টেথো,  হাতে ইনসুলিন এর সূচ
একাকী রাত জাগি, প্রহর গুনি
নিস্পলক জেগে রই, নিকষকালো রাতে,
সভ্যতার  সাদা - কালো  বিছানো চাদরে, 
বাসর সাজাই, শূন্য ঘরে আমি গালিবের চ্যালা। 

হইল চেয়ারখানি হাতে   চাকা ঠ্যালা বড়ো দায়
বেড়েছে ওজন শত জন্মের,  কুড়ানো সে পাপ
উত্তাপে ফেটে যায় দিবালোক, চৈত্রের আকাশ
সাজাই বাতাস আমি  বনফুল দিয়ে, একা আমি 
বেদুইন  তাবুতে  আমি, একা গালিবের চ্যালা। 

নিস্পাপ পাথর মাথা কুটে মরে মনে  পাপবোধ 
দংশনে নীল হয় শিরা উপশিরা,  ক্ষতের গভীরে 
উত্তাপ ধরা দেয় কোন প্রান্তদেশ শুধু  মায়াজালে
ছড়িয়েছি শস্যদানা কোনো অবকাশে ধরণীতে
 পথ  খুঁজি  একা আমি  সেই   গালিবের  চ্যালা।



সংকল্প
এস.সাহা ( সঞ্জয় )                 


নীরবে নিভৃতে তোমাদের এই মহান অভিসার
আমরা বুঝতে পারি না!
নীরবে করে যাও ত্র্যহস্পর্শের
কত তিথি  যেন না ঘুমিয়ে শেষ হয়!

ক্ষুদার্থের মুখে জোটেনা অন্ন
তোমরা যে সংকল্প নিয়েছো কত সংকল্প,
নীরবে করবে একই দিনে তিনটি তিথি পালন
রাতে যে তোমাদের  নাখেয়ে ঘুমানো বারণ l



আগাছার স্তুতি
রথীন পার্থ মণ্ডল 

যে পৃথিবীর কালগর্ভে হারিয়ে যায় না নকশালবাড়ি 
যে সমাজের আঙুল চুষেও নিমেষে উৎখাত হয় জমিদারী 
সেখানেই জন্মেছিল আমাদের মতো বুনো ঘাস
প্রতিপালনের দায়িত্ব না নিলেও যে নিজের গরজে
বাড়তে থাকে, ক্রমশঃ বাড়তেই থাকে 
সাধ্যমতো  বিস্তার করে নিজের সাম্রাজ্য 
তবুও লোকে তাকে আগাছাই বলে। 

পায়ে মাড়াতে মাড়াতে তারই ওপর দিয়ে তৈরি হয় পথ
সে পথে সবুজ শহীদ হয়, তবু টিকে থাকে আগাছা
খটখটে শুকনো হয়ে তখন অপেক্ষারত, আর 
সেই অন্তিমকালে আমি বারুদ মাখবো আঙুলে।
আগাছা বেঁচে থাকে সূর্যের পথ চেয়ে। 



দোলযাত্রা 
ছবি ধর

হৃদয় পুঞ্জে গহন কুঞ্জে দোলযাত্রা আসে ,
পাতায় ফুলে মুকুলে কমলে দোল হাসে ।
নদীর বুকে সাগরের ঢেউয়ে দোল উদ্ভাসে ,
বসন্ত পূর্ণিমা রাঙা বদনে চন্দ্রিকা সম্ভাসে।
সুনীল আকাশে মেঘের পালকে রক্তিমা ছড়ায়,
পূর্নিমা চাঁদ মাতোয়ারা দিগন্তে জোছনা ঝড়ায় ।
অলির ডানায় ভ্রমরের গুঞ্জন আবেশে ভরায়,
পলাশ পলাশ শিমুল শিমুল লালিমা জড়ায়।
রঙের ভাবনায় ঋতুরঙ্গ মননে উচ্ছাস জাগায়,
কোয়েল কুহুকুহু দোসর ডাকে সোহাগের আশায়।
ফুলরেণু পথ পাশে আঁকে সুখে আলপনা,
মালতী , কাঞ্চন,কনক চাঁপার কুঙ্কিত জল্পনা।
কুসুমকলি রাত জেগে রয় বর্ণিল নেশায়,
ধরণী কাননে কুসুমে ফাগুয়ার ফাগ মেশায় ।
দোলের আগমনে মুখরিত ব্রজের বৃন্দাবন ধাম,
খোল ,পাখোয়াজ, করতালে জপে রাধাকৃষ্ণ নাম।
শান্তিনিকেতনে রবিগানে অথৈ বিহ্বল গৌর প্রাঙ্গণ,
শ্যামরাই দোলে দোদুল ঝুলনায় সুসজ্জিত আঙ্গণ। 
ঋতুরঙ্গে বাঁশরির লহরীতে নাচে বসন্ত বিলাসীনি ,
দোলযাত্রার আনন্দ উৎসবে রঙ মাখে সুভাসিনী।



সবই রবে পড়ে
বিপ্লব গোস্বামী


 ক্ষীণ হবে চোখের দৃষ্টি
 পাকবে মাথার চুল,
 কমবে  দেহের বল
 নড়বে মুখের বোল।

 কানে  লাগবে তালা
 কমবে পায়ের বল,
 ভাই বন্ধু ছাড়বে সঙ্গ
 ঈশ্বর হবে সম্বল।

 বাড়ি গাড়ি পয়সা কড়ি
 সবই রবে পড়ে,
 সমন এলে যেতেই হবে
 সাধের দেহ ছেড়ে।


আমার ভেতর........
বিনিময় দাস
                                       
আমার ভেতর আকাশ আছে
         সীমাহীন ঠিকানা,
মেঘের কোলে পাখি উড়ে
         পথ যাদের অজানা ।
রবি হাসবে প্ৰা‍ণটা খুলে
          খুব ছড়াবে আলো,
বৃষ্টি শেষে পাবে তুমি
         রা‍মধনু  খুব ভালো ।
আমার ভেতর সাগর পাবে
            ঢেউয়ের আলিঙ্গ‍‍নে,
কাণটা পেতে শুনতে পাবে
               কত কথা মনে ।
আমার ভেতর পাহাড় আছে
             বুকের মধ্যে চাপা,
মনে হয় যে পাহাড় ভেঙে
             কথারা‍ হোক্ ক্ষ্যাপা ।
আমার ভেতর নদী আছে
              এঁকে বে‌‍কে চলে,
সারা‍টা দিন আপন স্ৰো‍তে
              তোমার কথাই বলে ।
আমার ভেতর ভালোবাসার
তোমায় দেবো ছোঁয়া,
স্বচ্ছ হবে উভয় প্ৰা‍ন্ত
             উড়ে যাবে ধোঁয়া ।



বছর শেষের মাস চৈত্র 
মজনু মিয়া 

বারো মাসের শেষ মাস চৈত্র 
বর্ষায় ভিজে যায় ভাসিয়ে 
পলিমাটি দেয় পবিত্র 
বৈশাখী ঝড় যায় কাঁদিয়ে। 

ফলমূল শাকসবজি ভরে রয়
জৈষ্ঠ্যমাস মধুমাস জেনে
ভাদ্রের তাল রসে মজা হয়
বাঁধা জীবন নিয়ম মেনে।

সোনালি ফসল সবুজ মাঠ
দুলে ওঠে হেমন্তের গান
কাঁঠালের ঘ্রাণ হৃদয়ের পাঠ
শীত কাঁপন জবুথবু প্রাণ। 

ডাল ফেটে মুকুট কুঁড়ি ফুল
ফাগুনের আগুন ধরায় বুক
কোকিলের ডাকে মন আকুল 
চৈত্র ঝরে যায় পুড়ে শোক!




ছবি 




সোমনাথ বণিক 



মুজনাই অনলাইন চৈত্র সংখ্যা ১৪২৯