Saturday, October 15, 2022


 

সম্পাদকের কথা

শরতের ঝকঝকে আকাশে এখন লুকিয়ে বিষণ্ণতা। মা এসেছিলেন। মা ফিরে গেছেন আবারও। কয়েকদিনের প্রবল আনন্দ শেষে বেদনার চোরা স্রোত তাই সকলের মনে। তবে এই যাওয়া, আবার ফিরে আসবার জন্য। আসলে আমরা যাই, ফিরব বলেই। আমাদের যাওয়াতেই লুকিয়ে থাকে প্রত্যাবর্তনের ছন্দ। কিন্তু বুঝি না বলেই কষ্ট পাই, শোকে ভাসি।

কিছুদিন বিরতির পর, মায়ের চলে যাওয়ার এই সময়ে, মুজনাই সাপ্তাহিক আবার ফিরে এলো। বিষয় `বিজয়া` হলেও তা কিন্তু চলে যাওয়ার বার্তা দিতে নয়। বরং ফিরে আসবার শুভেচ্ছা নিয়েই পথ চলা আবারও আগামীর পথে। আর সেই চলাতে এবারও  যোগ হচ্ছে  অশুভর বিরুদ্ধে শুভর জয়লাভের সত্যিকারের বিজয়া।  

শুভেচ্ছা ও শুভকামনা সকলের জন্য। মঙ্গল হোক সকলের। 


মুজনাই  সাপ্তাহিক        

রেজিস্ট্রেশন নম্বর- S0008775 OF 2019-2020

হসপিটাল রোড 

কোচবিহার 

৭৩৬১০১

ইমেল- mujnaisahityopotrika@gmail.com (মাসিক অনলাইন)

- mujnaiweekly@gmail.com (সাপ্তাহিক) 

প্রকাশক- রীনা সাহা 

সম্পাদনা,  অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায়

প্রচ্ছদ ছবি- সংগৃহিত   

মুজনাই সাপ্তাহিক 


 


লেখা ও ছবিতে রয়েছেন 

যাজ্ঞসেনী, সুবীর, শ্রাবণী সেন, ডঃ সৌরভ দত্ত, গৌতম চক্রবর্তী, পার্থ বন্দোপাধ্যায়, রুদ্র সান্যাল, আফতাব হোসেন, শ্রাবণী সেনগুপ্ত, অলকানন্দা দে, স্বপন কুমার দত্ত, অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী, কাকলি ব্যানার্জি মোদক, কুমার বিজয়, যীশু চক্রবর্তী, সুদীপ দাস, দেবর্ষি সরকার, সজল সূত্রধর   



বিজয়া এবং বিজয়া  

প্রতীক্ষা পদাবলী 
যাজ্ঞসেনী 

বিজয়া। চারদিক কেমন যেন খাঁ খাঁ শূন্য। যেন কোনও শোক সংবাদে স্তব্ধ চরাচর। যে তরুণ যুগল গতকালও হাত ধরে হেঁটে গিয়েছে চেনা অথচ, অচেনা রাস্তা বরাবর- আজ তারা কোথায়? 
নিষ্প্রাণ মন্ডপে বিষণ্ণতায় ডুবে যাচ্ছে দেবীর মুখ। উৎসবের শেষ পর্বে কিছু সিঁদুর খেলা। তারপর সব শেষ। আবারও প্রতীক্ষা। এই যান্ত্রিক সময়ে আবেগ হারিয়ে যায়। প্রতীক্ষায় কে থাকে কেই বা জানে!
থাকে হয়তো কেউ। কেউ আর ফিরবে না জেনেও।
কিছু পথ একমুখীই হয়। চলে যাওয়ার। যে যায়, আর ফেরে না সে।
স্মৃতি শুধু সাজিয়ে রাখে প্রতীক্ষা পদাবলী।

আগমনী বিজয়ার গান

সুবীর 


"মাটির কন্যার গান এইতো সেদিন বাজিল। নন্দী ভৃঙ্গী শিঙা বাজাইতে বাজাইতে গৌরী শারদাকে এই কিছুদিন হইল ধরা-জননীর কোলে রাখিয়া গিয়াছে, কিন্তু বিজয়ার গান বাজিতে আর দেরি নাই। শ্মশানবাসী পাগলাটা এল বলিয়া, তাকে ফিরাইয়া দিবার জো নাই...  চন্দ্রকলা তার ললাটে লাগিয়া আছে, কিন্তু  তার জটায় জটায় কান্নার মন্দাকিনী " -- রবীন্দ্রনাথ।  পিত্রালয় ছেড়ে উমার পতিগৃহে যাত্রার করুণ আবহে কবির উপলব্ধি। 

আগমনী বিজয়া বিষয়ে শাক্তপদাবলীর কবিগণ বহু পদ রচনা করে গেছেন যেগুলি মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। গিরিকন্যাকে বিয়ে দিয়ে আত্মজার সুখ দুঃখের কথা ভেবে মা মেনকার উদ্বেগ, দীর্ঘ  অদর্শননে ব্যাকুল চিত্ত... তার প্রাণের ধন গৌরীকে দীর্ঘদিন না দেখে, বিশেষত পাগল স্বামীর ঘর করতে বাছার কত কষ্ট -- ভেবে ভেবে মা মেনকা স্থির হয়ে ওঠে, স্বামী গিরিরাজকে বারবার অনুরোধ  জানায় মেয়েকে ঘরে নিয়ে আসতে। জামাতা সম্পর্কে অনেক কথা শুনেছে -- " শুনেছি নারদের ঠাঁই / গায়ে মাখে চিতা ছাই / ভূষণ ভীষণ তার গলে ফণীহার " -- তিনি যেন কৈলাসে গিয়ে অবিলম্বে গৌরীকে নিয়ে আসেন, --" যাবে যাবে বল গিরিরাজ গৌরী আনিতে " -- মেনকার তাড়নায়  গিরীশ মেয়েকে আনতে যান। মায়ের তর আর সয় না যেন -- " গৌরী  আমার এল কৈ ?" অবশেষে প্রতীক্ষার অবসান,  কন্যার আগমন বার্তা পেয়ে পাগলপারা জননী দুয়ারে ছুটে যায় -- " অমনি উঠিয়ে পুলকিত হৈয়ে ধাইল পাগলিনী /  চলিতে চঞ্চল, খসিল কুন্তল,  অঞ্চল লোটায় ধরণী "।  মেয়েকে কোলে নিয়েও মায়ের মন স্বস্তিতে নেই, কেমন কেটেছে স্বামীর  ঘরে !  সদা ভয়  -- " শুনি লোকমুখে শিববিহীন বৈভব / ফণীসব নাকি তার ভূষণ " ,  " কও দেখি উমা, কেমন ছিলে মা, ভিখারি হরের ঘরে " -- ইত্যাদি।  পিতৃগৃহে কদিন কতো আদর, স্নেহের বন্যা, ভালোমন্দ কতো আহার আপ্যায়ন।  দেখতে দেখতে ২/৩ দিন কেটে গেল নিমেষে, ওই বুঝি এল ফিরে যাবার বিষাদ মুহূর্ত নবমী নিশি...  ``নবমী নিশি রে তোর দয়া নাই রে তোর দয়া নাই, কেন ভোর হলি, ওই যে শোনা যায় মহাদেবের  ডম্বরু ধ্বনি...  এখনি দেবে হানা উমারে নিতে``, মনে মনে ভাবে মা মেনকা--" কালকে ভোলা এলে বলবো / উমা আমার নাইকো ঘরে ", কখনো বা আর্তস্বরে বলে ওঠে " ওরে নবমী নিশি না হইও রে অবসান/ শুনেছি তুমি দারুণ না রাখো সতের মান " 

দশমীর কালান্তক সকাল, যমরাজ সদৃশ দেবাদিদেব শঙ্কর মায়ের স্নেহের আঁচল থেকে উমাকে ছিনিয়ে নিতে হাজির। " বিছায়ে বাঘের ছাল, দ্বারে বসে মহাকাল / বেরোও গণেশমাতা ডাকে বার বার "। 
কন্যাবিদায় বেলায় ব্যথাতুরা জননীর বুকভাঙা হাহাকার -- " ফিরে চাওগো উমা / অভাগিনী  মায়েরে বধিয়া কোথা যাওগো  " -- মান সম্মান বিসর্জন  দিয়ে আকুলআবেদন  আর্তনাদে দুখিনী মা ভূমিতে লুটিয়ে পড়ে,  " গিরিরাজ, যায় যে লয়ে হর প্রাণকন্যা গিরিজায়, ধর গঙ্গাধর পায় " 

আগমনী বিজয়া পর্যায়ের পদগুলির আবেদন  চিরন্তনীন ও সার্বজনীন, এ যেন বাংলাদেশের পাঁচাপাঁচি জীবনেরই প্রতিচ্ছবি , স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ  এ প্রসঙ্গে বলেছেন পদাবলী সাহিত্যে মায়ের ব্যাকুলতা, বিষম এক বাৎসল্যরস ছত্রে  ছত্রে  ফুটে উঠেছে।  যা সর্বকালের উপজীব্য বিষয় ও ভাবনা, অন্তর ছোঁয়া....  

শুভ বিজয়া সব বন্ধুরা



দশমী তিথি
অলকানন্দা দে


গমগমে চারিদিক থমথমে হয় বিজয়ার পাড়ে!
ভারপীড়িত মন নীলে আর নীল পায় না খুঁজে! আড়ালে চলে যায় পৃথিবীর মেয়ে! নিঃশ্বাসের ফাঁকে ফাঁকে দিয়ে যায় উদাসীনতা! সবকটা মনই বোধহয় কাঁদে বিরহের চাপে! দিয়ে যাওয়া অঙ্গীকার শুধু সম্বল! আবার আসবে হাওয়ার ঘোড়ায় চেপে আশ্বিন! বিস্তীর্ণ শারদীয় দোলায় বোধন হবে স্বপ্নের!

সতেজ মুক্তির আশা থাকে শারদীয়ার কাছে প্রতি বছর। এই রোদই বুঝি রোধ করতে পারে মনের অবক্ষয়। অকাল-বোধনের কাছে হাত পাতা যায় দ্বিধাহীন। চাওয়া যায় জীবনের উপত্যকায় কয়েকটা দিন রূপ নেবে প্রমিত শান্তির! জড়ো করে মনের রসদ কেটে যাবে বছরটা দিন গুনে গুনে। এই সুখরেশ বিলম্বিত! প্রত্যাশিত ঘরে ঘরে! আকাশ বাতাস নিকট সুদূর পিয়াসী এই ঘনিষ্ঠ পরশের! বিজয়া যেন মেঘের রূপান্তর! হঠাৎ ধূসর ঝুঁকে পড়ে সহমর্মী নীলের ঘরে!

তবু জীবন চলে, চালাতে হয় বিষাদ উত্তীর্ণ হয়ে! বিজয়া অনন্ত প্রসাদ রেখে যায় স্মৃতির!আশা রুয়ে যাও অগণন! আলেখ্য আঁকো আগামীর! প্রবাহিত দিন মিলে যাবে ঠিক আর এক শরৎ তীরে! পোড়া মাটির মর্মে ফুল ফোটানোই এক কর্তব্য হয় তখন! এই কর্তব্যকে মাথায় রেখে ভালো র উপাসনার ব্রতই নিতে বলে বিজয়া!

প্রাত্যহিকের অনন্ত পথে আলো যেন থাকে! সুস্থ মন নিয়ে এগিয়ে চলুক নিখিল আর এক মনোরম আশ্বিন খুঁজতে! ভালোবাসার ভারে ভারী হোক বসুন্ধরা! সকলের জীবনে আনন্দের আকাশ সুবিস্তৃত যেন হয়! এটাই বিজয়ার সুর!

তবু এ কথা উল্লেখ না করা বুঝি অনুচিত হবে। দুঃখের প্রতিবাদ থাকবে না তাও কি হয়! এবছরের বিজয়া বড় রূঢ় ছিলো! বিদায়ী বেলার নিরঞ্জনে নদীতে আমরা মন ভাসাই, দেহ তো নয়! মাল নদীতে ভেসে যাওয়া জীবনগুলো মায়া খুঁজেছিল হয়তো চিরন্তনীর কাছে! পায় নি! দুঃসংবাদের অশ্রু মুছেছে পাড়ে দাঁড়ানো ঢাকাই শাড়ির আঁচল! এই ঘটনা মনের তেপান্তরে খরা নামায়! বিবর্ণতা সন্ত্রাসে হাসে! আগামীর আর্য্যা ভালোবাসার মান রাখবেন সহমর্মীতায়, কোনো কার্পণ্য না করে! এই মঙ্গলের অন্বয় প্রার্থী আমরা সকলে!



শুভ বিজয়া
শ্রাবণী সেন

এখনো শিউলি ঝরছে অঝোরে ভোরে
এখনো আকাশে সাদা মেঘ খেলা করে
এখনো কাশেরা দুলে যায় অবিরত
তুমি ফিরে গেলে আবার নিজের ঘরে।

 অপেক্ষা শুধু তোমার জন্যে যেন
একটি, দুইটি, প্রতিটি পলের  আশা 
বছরের পরে আবার আসবে ফিরে
 তাও জানি তবু মন উচাটন কেন!

নিঝুম দুপুর নিঃসাড়ে চলে হাওয়া
হিসেব নিকেশ মিলেছে নিঃসংশয়ে
মাটির প্রতিমা, খড়ের কাঠামো খোলা
শুধু শুভ হোক,  শুভ হোক এ বিজয়া।




বিজয়া দশমী ও মুজনাই 

বীরপাড়া চা বাগানে শৈশবের বিজয়া দশমীঃ একটি স্মৃতিচারণা
ড. সৌরভ দত্ত

দশমীর দিন বিকেল ৩টা থেকেই উত্তেজনার পারদ তুঙ্গে উঠতো, কারণ শুরু হয়ে যেত অপেক্ষার পালা, কখন একের পর এক গাড়ি দুর্গা প্রতিমা নিয়ে পাড়ি দেবে ফালাকাটার মুজনাই নদীর বিসর্জন ঘাটের উদ্দেশ্যে। আমাদের বাড়িটি যেহেতু বীরপাড়া-ফালাকাটা সড়কপথের একেবারে পাশেই, বারান্দায় অপেক্ষা করতাম কখন দূর থেকে ঢাকের আওয়াজ শুনতে পাবো। শেষপর্যন্ত অপেক্ষার পালা সাঙ্গ করে হৈ হৈ করে চলে আসতো প্রতিমার ট্রাকগুলো। প্রতিটি ট্রাকে ঠাসাঠাসি করে লোকজন। পুরুষ, মহিলা, বাচ্চা নির্বিশেষে সে কী আনন্দ! সব ট্রাক থেকেই চিৎকার ভেসে আসতো, "দুর্গা মা কি, জ-য়। আবার কবে, বছর পরে!" কাঁসর ঘন্টা সহযোগে ঢাক বাজতো তুমুল আওয়াজে। রীতিমতো জমজমাট এক আবহ। কিন্তু বলতে দ্বিধা নেই, বহিরঙ্গের এই উৎসবমুখর পরিবেশের গভীরে ছিল অসম্ভব এক বিষাদের সুর, কারণ আবার সেই গোটা একটি বছরের অপেক্ষা। ভেতরে ভেতরে মনটা যে কী খারাপটাই লাগতো, তা আর বলার নয়। পুজো শেষ মানে তো আর শুধু পুজো শেষ নয়, বিশ্বকর্মা পুজোর সময় থেকে যে শুরু হয়েছিল দিন গোনার পালা, মহালয়া, তারপর একে একে পঞ্চমীর সন্ধ্যায় প্রতিমা আসা থেকে শুরু করে, ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী পেরিয়ে শেষপর্যন্ত এই বিষাদের দশমী। যাহোক, মনের গভীরের বিষাদকে বিস্তৃত হতে না দিয়ে, আমরাও নতুন জামাকাপড় পরে, বাড়ি তালাবন্ধ করে একছুটে পৌঁছে যেতাম পেছনের বল খেলার মাঠে, কারণ ইতিমধ্যেই সেখানে উপস্থিত হয়ে পড়েছে আমাদের বাস, যে বাসে চড়ে আরেকটু পরেই আমরা রওনা দেব ফালাকাটা বিসর্জন ঘাটের উদ্দেশ্যে। শুধু তো বিসর্জন ঘাটে গিয়ে প্রতিমা বিসর্জন দেখা নয়, ওদিকটায় দেখা হয়ে গেলে পায়ে পায়ে পৌঁছে যাওয়া মেলার মাঠে। যেসব বাড়ির বড়দের ও ছেলেমেয়েদের বাসে চড়ে যাওয়ার পরিকল্পনা থাকতো, সেসব মানুষজনের আসা সম্পন্ন হতেই বাস ছেড়ে দিত ফালাকাটার উদ্দেশ্যে। রাস্তায় বিক্ষিপ্তভাবে প্রতিমা নিয়ে যাওয়া দুতিনটি ট্রাকের দেখাও মিলতো। দলগাঁও চা বাগান, তাসাটি চা বাগান, জটেশ্বর পেরিয়ে আমরা শেষপর্যন্ত ফালাকাটার কাছাকাছি পৌঁছে যেতাম। উত্তেজনার আঁচ পাওয়া যেত অনেক আগে থেকেই। রাস্তার দুপাশে শতসহস্র মানুষ, সবার গন্তব্যস্থল হয় মুজনাই নদীর বিসর্জন ঘাট অথবা মেলার মাঠ। আমরা স্বভাবতই বিসর্জন ঘাটে যেতাম সবার আগে। গাড়ি থেকে নেমে একে অন্যের হাত শক্ত করে চেপে ধরে আমরা পৌঁছে যেতাম সেখানে। কী ভিড়, কী ভিড়! যুৎসই কোনো উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে যে দিকে তাকাই শুধুই মানুষের মাথা আর অনেক দূরে প্রায় বৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে সব প্রতিমাগুলো। যে প্রতিমার যখন পালা, বিসর্জনের জন্য নিয়ে যাওয়া হবে নদীতে। তাই বিসর্জনের আগে শেষ মুহূর্তের নাচানাচি ঢাক আর কাঁসর ঘন্টার তালে। এর মাঝে মাঝে আবার বিসর্জন শেষ করে খালি ট্রাকগুলো নীচু থেকে উঁচুতে সবেগে উঠে আসতো আর সদা-তৎপর স্বেচ্ছাসেবক দলের ছেলেরা তথা পুলিশের দল ট্রাকগুলোর গতিপথ আর মানুষের ভিড় নিয়ন্ত্রণ করতো। সব মিলিয়ে সে এক ধুন্দুমার কান্ড, যার প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করতাম তারিয়ে তারিয়ে। একটা সময় আসতো যখন বড়দের সম্মিলিত সিদ্ধান্তে আমরা পায়ে পায়ে বেরিয়ে পড়তাম বিসর্জন ঘাট থেকে। তবে বেরিয়ে পড়তে চাইলেই কি আর বেরিয়ে পড়া যায়! এতটাই বিস্তৃত সেই পরিসর যে শেষ হতেই চাইত না। শেষপর্যন্ত আমরা বিসর্জন ঘাটের মায়া ত্যাগ করে পৌঁছে যেতাম মেলার মাঠে। ঐ মেলা আরো এক বিস্ময়। প্রতি বছর মেলা থেকে নিয়ম করে কাঠের ট্রাক কিনতাম, যাকে নিয়ে ঘরে ফিরে মালপত্র চাপিয়ে দড়ির সাহায্যে গোটা উঠান জুড়ে টেনে নিয়ে যাওয়ার মধ্যে যেন স্বর্গীয় এক সুখ অনুভব করতাম। ঐ মেলায় যে সংখ্যায় আসবাবপত্রের দোকান বসতো এবং সেসব জিনিসপত্র ঘিরে আগত দর্শনার্থীদের মধ্যে যে আগ্রহ দেখতাম, তা এককথায় অভাবনীয়। আসবাবপত্রের সারি সারি দোকান একদিকে, আর রকমারি খাবারের স্টল পাল্লা দিয়ে। সব মিলিয়ে বিশালাকার এক উৎসব। আমাদের নিজেদের কেনাকাটা যে বিরাট পর্যায়ের হতো, তা হয়তো নয়, কিন্তু ঠাকুরঘরের জন্য ঠাকুরের আসন, খেলনা ট্রাক, রুটি বানানোর চাকি-বেলনা, এসব খর্বাকৃতি জিনিসপত্র, যেগুলো গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া সম্ভব, সেসব কিনে নিয়ে, আমাদের মধ্যে কেউ কেউ বিজয়া দশমীর মিষ্টি, বিশেষ করে, বোঁদে, আমিত্তি, কুঁচো নিমকি, এসব পরিমাণমতো কিনে চেপে পড়তাম বাসে ঘরে ফেরার উদ্দেশ্যে। রাত দশটার আশেপাশে চা বাগানের মাঠে বাস থেকে নেমে প্রথমেই কাজ ছিল একে অন্যের সাথে শুভ বিজয়ার পারস্পরিক প্রাথমিক সম্ভাষণ সেরে ফেলা। তবে পুরোটাই রাখা থাকতো পরের সন্ধ্যার জন্য, যে সন্ধ্যা আমাদের কাছে ছিল আনুষ্ঠানিক বিজয়া দশমীর সন্ধ্যা। দশমীর পরের যে সন্ধ্যা, অর্থাৎ একাদশীর যে সন্ধ্যা, সেই সন্ধ্যার জন্য আমরা ছোটরা হাপিত্যেশ করে অপেক্ষা করে থাকতাম। সন্ধ্যা নামার একটু পরেই ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে আমরা এক এক করে সবগুলো বাড়িতে যেতাম। বড়দের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতাম প্রথমেই। বড়রা প্রণাম নিতেন। তাঁরা মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করতেন। বড়দের মধ্যে যাঁরা পুরুষ, তাঁরা আমাদের মতো ছেলেদের প্রণাম নেয়ার পর আমাদেরকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরতেন প্রথাগত কোলাকুলি করার জন্য। এসব মিটতেই আমরা বসার ঘরে বসতাম। নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব করতাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাড়ির কাকিমা বা জ্যেঠিমা প্লেট ভরে বিভিন্ন ধরণের মিষ্টি ও নোনতা খাবার একযোগে আমাদের পরিবেশন করতেন। নোনতা খাবারের মধ্যে ঘুগনি খুব জনপ্রিয় ছিল। অনেক বাড়িতে ঘুগনির কৌলিন্য বাড়ানোর জন্য পাঁঠার মাংসের ঘুগনি বানানো হতো। কেউ আবার নিজেদের পরম্পরা অনুযায়ী মিষ্টির সঙ্গে একটি করে সেদ্ধ ডিম পরিবেশন করতেন। মিষ্টি খাবারের মধ্যে তোক্তি, বরফি, নিমকি, আমিত্তি, নাড়ু, মিহিদানা, এগুলো বেশি করে প্রচলিত ছিল। শুরুর দিকে বাড়িগুলোতে ঠিকঠাক খাওয়া যেত, কিন্তু পরের দিকে পেট ভরে যেত, পরিবেশিত সবকিছু ঠিকঠাক করে খাওয়া যেত না। এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়িতে ছোট ছোট দলে ঘুরতে ঘুরতে কখনো কখনো কোনো বাড়িতে ঢুকতে গিয়ে বা কোনো বাড়ি থেকে বেরনোর সময় অন্য দলের সঙ্গে দেখা হয়ে যেত এবং পরিণামে দুই বা ততোধিক দল মিলেমিশে দলের আকার বেড়ে যেত। এভাবে ঘুরতে ঘুরতে একটা সময় আসতো যখন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হতাম যে বাকি সামান্য যে কয়েকটি বাড়ি আছে, সেগুলোতে পরবর্তী সন্ধ্যায় যাওয়াই শ্রেয়। কিন্তু পরবর্তী সন্ধ্যায় বেরোলেও একাদশীর সন্ধ্যায় বিজয়া দশমীর যে আনন্দটা পাওয়া যেত, সেই আনন্দ আর নতুন করে মিলতো না।

দিনকাল বদলেছে। আমাদের সময় যে বিসর্জন দেখতাম, বিসর্জনের উদ্দেশ্যে যে প্রতিমা নিয়ে যাওয়া ট্রাকের মিছিল দেখতাম, বিসর্জনের প্রাক্ মুহূর্তে কাঁসর ঘন্টা ও ঢাকের তালে যে সমবেত নাচ দেখতাম, সবটাই দেখতাম হাঁ করে, নিজের চোখে, আজকাল যত না আমরা নিজের চোখে দেখি, তার চেয়ে বেশি দেখি মুঠোফোনের ক্যামেরায় চোখ দিয়ে। ইউটিউব ইত্যাদির বদান্যতায় ঘটে যাওয়া সবকিছুই বারবার করে দেখি, তাই ঘটনা চলাকালীন তা স্বচক্ষে দেখতে যত না আগ্রহ, ভবিষ্যতের জন্য ঘটনার প্রতিটি মুহূর্তকে সংরক্ষণ করে রাখতে আগ্রহ যেন তার চাইতে অনেক বেশি। পড়শী কাকিমার ঘরে বিজয়ার প্রণাম করতে গিয়ে প্রণামপর্ব সেরে আমরা যতক্ষণ অপেক্ষা করতাম মিষ্টির প্লেটের জন্য, ততক্ষণ নিজেরা গল্পগুজব করলাম, কিন্তু এখনকার দিনে তেমন কিছু পরিস্থিতিতে যে যার নিজস্ব মুঠোফোনে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। দিনকালের এই বদল ভালো না খারাপ, তা এখানে অপ্রাসঙ্গিক, কিন্তু শৈশবের ঐ বিজয়া স্মৃতিতে থেকে যাবে আজীবন।





বিজয়া গল্প 

বিসর্জন

আফতাব হোসেন

                                                                       (১)

ঘোষেদের ছোট ছেলেই প্রথম দেখেছিল । মূর্তিটা জলে ফেলার পর ওজন এর ভারে ডুবে যাবার ঠিক আগে যখন কয়েকবার খাবি খেল জলের মধ্যে , যখন প্রায় আশি হাজারের মা দুর্গার ঘরসমেত খাবি খেতে খেতে জলসমাধি হবার অন্তিম মুহূর্ত , যখন হিন্দিগানের লাউড স্পিকারের বিষ তরঙ্গে ক্লান্ত ভাসান যাত্রীরা ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ঘরমুখো , ঠিক তখনই ঘোষবাড়ির ছোট ছেলের চোখে পড়লো মা এর মুখ টা ভাঙ্গা । চোখ পুরোটা ফোকাস করে দেখলো ভাঙা না, মায়ের মুখটাই নেই । সামনে এগিয়ে রহস্য ভেদী দৃষ্টিতে চোখে পড়লো বছর এগারোর শেমিজ পরা লিকপিকে শরীরটা তীব্র বেগে সাঁতরে ওপারে , হৈ হৈ করে উঠতে টের পেল লিকপিকে শরীরটা ওপারে সাঁতরে উঠেই তীব্র বেগে দৌড় , গয়না সমেত …মায়ের মুখটা হাতে ধরা ।

                                                                   (২)

শনিদেব ইদানিং দুর্বল বড় । ওনার মধ্যেও উচ্ নিচের প্রভাব এসেছে মনে হয় । না হলে যত বিপদ গরিবদের মধ্যেই কেন আসে তা আজও বুঝতে পারেনি হারান ,মানে হারু । যেবার লোকাল ট্রেন বন্ধ হব হব করছিল,সেবার রুজি রুটির অভাব টা আগেই  টের পেয়ে ওভারটাইম শুরু করেছিল হারু । বউ কে বলেও ছিল সপ্তাহে চারদিন রাতের ট্রেনগুলো ও কভার করবে । রোজ দু হাড়ি ঘুগনি বিক্রি করলেও এই কতদিন আরো এক হাড়ি বাড়াতে গিয়ে বিপদ টা হল । বিক্রি বাটার সঙ্গে টেনশনটাও বাড়ছিল । শুনছিল রোজ যে কোনদিন ট্রেন বন্ধ হতে পারে । তারপর ঠিক যেদিন খবরের কাগজবালা পটল খবরটা দিল সেদিন অন্যমন করে নাকি কপালফেরে হাত টা স্লিপ করে পা গুলো রেলের চাকার তলায় গেল। হারুর বউ হারুকে ফেরালেও পা দুটো ফেরাতে পারলো না,সাথে পাঁচ অক্ষরের সামনের দিকে জমানো হারুর ব্যাংক এর পাস বই টা যখন এক অক্ষরে এসে থামলো তখন হারু ভাবলো ফাঁড়া কাটলো মনে হয় । বুঝলো কত অসহায় হতে হয় মানুষকে । বোঝেনি অসায়তায় মনে হয় শেষ বলে কিছু হয় না। শেষ হল যখন তখন হারুর লাজুক বউ পাশের হাসপাতালের আয়া । পা ছাড়া লোকটাকে নিজের বুকের মাঝে শক্ত করে বেঁধে শুনিয়েছিল হারুর বউ -

- ' বুঝলা এবার আমি কাম না করলে সংসার চলবে না । ফুলিটাও এবার ফাইবে উঠবে , পাশের পেরাইভেট হাসপাতাল টায় করুনা রুগী দেখার লোক চাইছে, রোজ তিনশো দিবে । আমি যাবো ভাবছি ' হিসহিস করে ফর্সা গলাটা টিপে জোর দিয়ে হারু বললো ওর বউ কে…- ' কেনে ? আমি কদিন মাত্র বসেছি , পা নাই বলে কি আর তোকে সুখ দিতে পারবো নাই ?

টুটি চাপা গলায় ভেঙে ভেঙে বললো হারুর বউ,

- 'পারবে গো … সুখ নিয়া চিন্তা নাই , চিন্তা  প্যাট নিয়ে '।

সেদিন থেকেই ঘুগনি হারুর ল্যাংড়া হারু আর হারুর বউ লোকাল আয়া । করুণা রুগীদের আয়া ।

হারু বুঝলো এই বেশ ।

সুখ আবার দরজায় টোকা মারার আগেই,

ব্যাংকের খাতা আবার তিন অক্ষরে আসার আগেই হারুর আয়া বউ লোকের বিষ নিজের শরীরে নিল ।

সব্বাই একঘরে করার আগেই বাতাস কমলো রক্তে , সংসারেও বাতাস কমার আগেই বাতাস শেষ হল হারুর বউ এর । হারু বুঝলো এটাই মনে হয় শনি বলে ।

হাতের দুটা  আংটিি বাড়ালো হারু , সাথেসাথে রাতে নতুন সঙ্গী  । দু বোতল রোজ ।


                                                                    (৩)

পাড়ার নতুন মাস্টার প্রীতম ।

মাস্টার বলে নাম ধাম আর টুকটাক ইমেজ তৈরী করেছে নিজেই । স্কুল পাড়ার মুরুব্বিরা মানে খুব ।কচিকাঁচা গুলো কয়েকদিন ধরেই মরচে লাগা নীল সাদার ফ্যাকাসে বিল্ডিং টার বাইরে । ভিড় করে । দেখতে পেলেই অমায়িক হাসি ,

- ' সার , বেঞ্চে বসবো না আমরা , ছোট কিলাস এ ভূঁয়ে বসি বসি ভাল্লাগেনা যে '

ছোটগুলো বড্ড প্রিয় প্রীতমের । আসলে প্রীতমের ছেলে ছোট বেশ । মাত্র ছয়ের কোটায় । সেদিন বলছিল মোবাইল স্ট্যান্ড না হলে নাকি অনলাইনে মাথা কাটে । কিনবো কিনবো করেও কেনা হয়নি প্রীতমের । ছেলে ছেড়ে স্কুলে এলে 'ভূঁয়ে' বসা ছেলেমেয়েগুলোকেই ছেলের মত লাগে ওঁর । ওদেরও মোবাইল স্ট্যান্ডের মত উচা বেঞ্চ লাগে , না হলে নাকি বড় ইস্কুলে পড়ার মজা নাই ।

চোখ বড় করে প্রীতম বললো -' ওরে দাঁড়া , এখনো সরকার বলেনি বেঞ্চে বসতে । তোদের পাড়ায় যাবো। দাওয়ায় পড়াব । কাল থেকে ' ….

চললো কদিন বেশ । ওই স্কুলেই সাতের ঘরের নামতা একটানা বলে যখন ত্রি থেকে ডাইরেক্ট ফাইভ ক্লাসে উঠেছিল ফুলি , তখন থেকেই পড়ায় আর মন নাই । সব্বাই যখন ভাবলো ট্রেনের হকারের ঘরে সরস্বতী জন্মেছে তখনই ফুলির ডাক ছেড়ে ইচ্ছে করতো সব্বাইকে বলতে যে ওর পড়তে ভালো লাগে না । বেশ কয়েকদিনের মধ্যেই যখন টপাটপ করে পুরো সংসারটা চোখের সামনে শেষ হতে দেখলো তখন এগারো বছরের মনের মধ্যে কি হয়েছিল কেউ না জানলেও সব্বাই দেখলো ফুলি কাঁদেনি এক ফোঁটাও । তারপর থেকেই ফুলি চুপচাপ খুব সারাদিন । বাপ মদ ধরতে ঝামেলা কমেছে ফুলির । সকাল বেলা শাক ভাত দুটো ফুটিয়ে দিয়ে হারুকে খাওয়াতে পারলেই ফুলির মুক্তি । বলেনি কাউকে কখনো এসব । শুধু নুরবাণু জানে , ওর ও মা নেই যে। নুর বানু জানে ওই আকাশের খুদার কাছে মা আছে , যে খুদাকে নুর বানু দেখেনি কখনো । নুরবাণু ওর একই ক্লাসের । অবসরে নতুন মাস্টারকে শুধায় নুরবানু - ' ' সার , ফুলির মা কে কে লিল ? কুথায় গেল ? উর যে খুব কস্ট '

                                                                                (৪)

নতুন মাস্টার ভালো খুব । মুসলমান না হিন্দু এখনো বুঝে উঠতে পারেনি নুর বানু ,তবে স্যারকে ওর আব্বা আব্বা মনে হয় । ওর আব্বা কেরালায় থাকে বছরভর । কুরবানীর শেষে যাবার আগে  আব্বা ওকে বলে গেছে '  শুন বিটি , তুই এখন ম্যায়াছেনা ,মায়ের জাত , অন্য বিটি গুলার দায়িত্ব নিস ' । 

ওর স্যার ও সবসময় জিজ্ঞাসা করে নূর বানুকে , তোর আব্বা তো বাইরে রে বছরভর, তুই একা হাতে সংসার সামলাস কি করে ? নূর বানু হ্যাংলা হাসে খালি , সাথে শুধায় মাস্টার কে , ও সার ফুলির মা কে কে লিল ? কুথায় গেল ? উর যে খুব কস্ট ।

মাস্টার জানে এর উত্তর নেই । ফিসফিসিয়ে উত্তর দেয় তোর আল্লা জানে ।

আজ নুরবানুর মন খারাপ। কেরালায় চাচা ফোনে বলেছে ওর আব্বার কাশি থামে না । ওকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে যেন গ্রামের কেউ আসে । ফোন পেয়ে নুর বানু খুঁজেছে খুব সব্বাইকে । কেউ কথা দেয়নি । তবে হাসিম চাচা একশ দিয়েছে । মাস্টার বলেছে টিকিটের দাম জোগাড় করতে আরো পাঁচশো লাগবে। না আনলে আল্লা রহম করবে নুরবানুর বাপকেও । ফুলি আর নুর বানু চুপ করে শুনেছে সব ।

                                                                   

                                                                    (৫)

ফুলি প্রানপনে ছুটছে…

গয়না গুলো ওর চাইই চাই…

মাস্টার বলেছে আল্লা জানে ফুলির মা কোথায় ,মাস্টার বলেছে হিন্দুদের ঠাকুর মানেই মুসলমানের আল্লা ।ফুলি জানে আল্লার কাছে গেলে কেউ ফেরে না । ফুলি জানে নুরবানুর আর কেউ নাই । ফুলি জানে টিকিটের দাম মাত্র পাঁচশো টাকা ।

ছোট ঘোষ গলা ছেড়ে চিৎকার…ওরে ধর ধর…গয়না সমেত নিয়ে পালাল সালী ছোটলোকের মেয়েটা … ধর ধর…ওই ... সব্বাই … ধর….

মাস্টার এখন মিষ্টির দোকানে । নূর বানুকে মিষ্টি খাওয়াচ্ছে বিজয়ার । ল্যাংড়া হারু আজ চার বোতল মেরেছে ..একসাথে..

সাথে চিল চিৎকার…কুথাই গেলি ফুলির মা.. ও ঠাকুর … ফিরাই দে ফুলির মাকে.. ফিরাই দে…

এ  দিকে  ঠাকুরটা ডুবছে…ডুবেই যাচ্ছে…ওজনে , না কি বিসর্জনের নিয়মে...কে জানে….



দশমীর আখ্যান
কাকলি ব্যানার্জী মোদক 

এই....এই..... ছুঁলি আমাকে? কাকা বললেন না ছুঁলে প্রণাম করবে কিভাবে?দশমী বলে কথা ,
কাকিমা অসন্তুষ্ট স্বরে বলেই বসলেন, যা আবার আমায় স্নান করতে হবে। 
আমার সবাই  বলে উঠলাম এই তো এলাম ছুঁলাম কখন ,কাকিমা গদগদ স্বরে বলে উঠল, বস মিষ্টি খেয়ে যাবি। সবাই পা ঝুলিয়ে বসে পড়লাম খাটে ।

ছুঁইনি শব্দটা কাকিমার খুব প্রিয় ।কাকিমা ছুঁচিবাই তাই আমরা জানি কি বলতে হবে । আমাদের সবার হাতে একটা করে ঠোঙা।  ঠোঙায় তখন অনেক খাবার, হাতে তৈরি নিমকি, নাডু, গজা , মিহিদানা। সব একসাথে থেকে ঘেঁটে ঘন্ট,  দশমীর পরের দিন কোন বাড়ি ছাড়া যাবেনা তাই সবাই বেড়িয়ে পড়েছি দলবল নিয়ে।

পায়ে হাত  দিয়ে প্রনাম কোন ব্যাপার নয়। শ্রদ্ধ শব্দটার  মানেই বুঝতাম না । শুধু জানতাম গেলেই মিষ্টি দেবে তাই অকপটে টুক  করে একটা প্রনাম, রাম আর রহিমের তফাত  বুঝতাম না । 
 
 বেশ খানিকক্ষণ পর কাকিমা নিয়ে এলো, সুজির বরফি, আর  নারকেল দেওয়া ঘুগনি , ঘুগনি তো খেলাম কিন্তু বরফি? অত্যাধিক হাতে জল ব্যবহার করায় কাকিমার আঙুলের চেহারা ক্ষণভঙ্গুর  সাদাটে।
আমরা একে অপরের দিকে তাকিয়ে ,কি করি, কি করি  হঠাৎ একদাদা ইশারা করে বলল খাটের নিচে ফেলে দে। সুযোগ বুঝে এক এক করে ফেলতে লাগলাম খাটের ধারে।  তারপর বেড়িয়ে অন্য বাড়ি ।  
পরের দিন,অবশ্য কাকার কাছে খুব বকুনি খেয়েছিলাম সবাই। মা শুনে রাগ করে বলেছিলেন এমন কাজ করতে নেই,ছোটবেলার স্মৃতি আজও মনে পড়ে। বিজয় দশমী মানে মিষ্টি আর আনন্দ ।।



বিজয়া গদ্য 

বিজয়ার চিঠি
রুদ্র সান্যাল

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের জীবনে কত কিছুরই আজ পরিবর্তন ঘটে গেছে। সংস্কার থেকে শুরু করে দৈনন্দিন জীবনের অনেক কিছুই। একই ভাবে দুর্গাপুজোর ক্ষেত্রেও তাই। পুজোর  অধ্যাত্মিকতার পরিবর্তে থিম এখন গুরুত্বপূর্ণ। ঠিক সেই রকম ভাবেই বিজয়ার দিনটির পরিবর্তন ঘটেছে বিরাট ভাবে। 

শুভ বিজয়ার দিনে সকল ধর্মের মানুষ শত্রু মিত্র ভেদাভেদ এবং তিক্ততা ভুলে পরস্পরকে আলিঙ্গন এবং মিষ্টিমুখ করিয়ে সব দুঃখ ভুলে যাওয়ার প্রচেষ্টা। ছোটবেলার থেকেই এই দিনটিকে বিশেষ দিন হিসেবে মাথায় থাকে। প্রীতি আর শুভেচছায় ভরা থাকে এই বিশেষ দিন।

কিন্তু আধুনিকতার যুগে এখন বিজয়ার দিনে সেই চিঠি লেখার সময়গুলো কেমন যেন হারিয়ে গেছে। ফেসবুক আর হোয়াটসআপের যুগে দাঁড়িয়ে মাত্র দুই তিন দশক আগের সেই বিজয়ার দিন গুলো এখন মনে আসে না। পোস্টকার্ড বা ইনল্যান্ড লেটারে চিঠি লেখার অভ্যাস ক্রমশ বিলুপ্তির পথে। একটা হাই হ্যালো বা সকলকে একবারে শুভেচছা জানিয়ে ফেসবুক বা হোয়াটসআপ বোধহয় আমাদের খুব দ্রুত অসামাজিক করে তুলেছে। এ যুগের ছেলে মেয়েরা চিঠি লেখা কী বস্তু তা শুধু তারা পরীক্ষার খাতায় ছাড়া আর কোথাও জানে না বললেই চলে। বিজয়া বা বাংলা নববর্ষে বড়দের চিঠি লেখা দেখতাম সেই ছোট বয়স থেকেই। বাবা যখন চিঠি লিখতেন, তার শেষের দিকে কিছুটা জায়গা ফাঁকা রেখে দিতেন, আমার চিঠি লেখা এবং প্রণাম জানানোর জন্য। সেখানে লিখেই প্রথম পরীক্ষার বাইরে চিঠি লেখার অভ্যাস ঝালিয়ে নিতাম। কীভাবে যেন সব এখন শেষ হয়ে গেলো। এখন সব যান্ত্রিক। বড়দেরকে শ্রদ্ধা বা প্রণাম জানানোটাও যেন একটা যান্ত্রিক বিষয় হয়ে গেছে। কর্তব্যবোধের শুধু একটা পরিচয় দেওয়া মাত্র! দুঃখ হয়, যখন দেখি এখনকার ছেলে মেয়েরা এসবের কিছুই প্রায় জানেনা। বা বোঝে না। দোষটা অবশ্য আমাদেরই। আমরাই হয়তো এগুলো বোঝাতে ব্যর্থ। কারণ নিজেরাও নিজেদের অজান্তে ফেসবুক বা হোয়াটস আপের মতন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দাস হয়ে গিয়েছি। 

এখন আর সেই চিঠিও নেই, সেই পোস্টম্যান দাদাও খুব কমই আসেন বাড়িতে। শুধু স্পিড পোস্ট-এর কিছু জিনিস বা ব্যাংকের ডকুমেন্টস দিতে আসা ছাড়া। ছোটবেলার চিঠি লেখা শুরুই হত এই বিজয়া বা নববর্ষের দিনে। একদিকে প্রণাম জানানো আবার অন্যদিকে বাংলা ভাষা চর্চাও হত এই চিঠি লেখার মাধ্যমে। 

বিজয়া এখনও আসে- চলেও যায়। বিজয়া আবারও আসবে। কিন্তু সেই চিঠি লেখার আনন্দ আর কোনও দিনও ফিরে আসবে না। চিঠি রাখার বাক্সও আর নেই। হয়তো বয়স যত বাড়ছে, ততই অতীত কে ধরে বাঁচার ইচ্ছে তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। শুধু মাঝে মাঝে এখন একটা চাপা কষ্ট মাথায় ঘুরপাক খায়। সত্যিই 'দিন গুলি মোর সোনার খাঁচায় রইলো না।'


আমার পঞ্চইন্দ্রিয়ের সর্বসুখ তোমাতেই থাক

গৌতম চক্রবর্তী

দেবীপক্ষের দিন ছাড়া সারা বছর জগজ্জননী কেউ কোন খোঁজ রাখে নাকি তোমার? বরফ ঢাকা কৈলাসে গাঁজাখোর তোমার আধাপাগলা স্বামীর সঙ্গে মাঝেমধ্যে শুনি মানিয়ে গুনিয়ে নিতে বড়ই কষ্ট। সেইসময় কেউ তোমার সুখদুঃখের খোঁজখবর রাখে কি? দেখতে যায় কি? খোঁজখবর করে, চিঠি বা মানিঅর্ডার পাঠিয়ে তোমার বাপ গিরিরাজ মাঝেমধ্যে সাহায্য-টাহায্য করে কি? কে জানে, আমি তো কখনও শুনিনি। আর তাই বিসর্জনের ঢ্যাং কুড়াকুড় বাজনা বেজে বেজে তার অনুরণন শেষ হয়ে গেলে একেলা বসে মন খারাপের এই অনুষঙ্গে বিজয়ার চিঠি লিখতে বসে একটু আবোল তাবোল ভাবনা চলে আসছে মনে। দিনের পর দিন দেখে আসছি নিয়ম করে মাত্র চার দিনের এক রাতও বেশি মেয়েকে রাখে না বাপ। কখনও পাবলিক ডিম্যান্ড বা নেতাদের খেয়াল, কখনও মহরমের মিছিল বা আরও নানা কারণে এক দুদিন একস্ট্রা থাকলেও তোমার সে থাকা দেখি বড়ই অপমানের। ঘট বিসর্জন, মানে অন্নজল, খাতিরদারি সব বন্ধ করে অনেকটা ট্রেনের কনফার্ম টিকিট না পেয়ে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে পড়ে থাকার মতো। বড়োই কষ্টকর। জানি তার থেকে হিমশীতল কৈলাসবাস অনেক শ্রেয় বলে স্বামীসঙ্গসুখ লাভের প্রত্যাশাতেই আবার সদলবলে স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন। কিন্তু আমাদের যে মন মানে না মা। এতো উদ্যোগ আয়োজন। মাত্র চারটে দিনেই শেষ? জানি এখন দিন বদলেছে। তামাম ভক্তকুলের প্রতিক্রিয়াও বদলেছে। তাই বিসর্জনের বাজনা বেজে উঠলেই চোখে জল আসে না। পায়ে আসে নাচ। বলো তো দেখি মা ঢ্যাং কুড় কুড় বাজনা শুনলে কোন বঙ্গসন্তানের চোখে জল আসতো না আমাদের ছোটবেলাতে? দেবীপক্ষের শুরুতে অন্ধকার কাটিয়ে আলোর পথে যাত্রা। দিন কয়েক উৎসবমুখর এই দেশ। পিতৃপক্ষ শেষ, কৃষ্ণপক্ষের অবসানে শুক্লপক্ষের আবির্ভাব। নৃত্যরত কাশবন, শিউলি সুবাস, নীলাকাশ, শুভ্র মেঘ, তরল সোনার মতো আদুরে রোদ, ঘাসের উপরে হিরের কুচির মতো শিশির নিয়ে সাজো সাজো রব প্রকৃতিতে। দেবী আসেন। দুর্গতিনাশিনী, দুঃখশোকহারিণী, সুখ অভয়দায়িনী, মঙ্গলময়ী, জগজ্জননী আসেন। তাকেই স্বাগত জানাতে এত আয়োজন, এত মাতোয়ারা সবাই। অথচ সবকিছু শেষ মাত্র চারদিনেই? চলছে না, চলবে না।

 শারদোৎসবকে ঘিরে পুজো, উৎসব, আড়ম্বর। আসলে বিনাশর্তে দেবীকে নিজের যথাসর্বস্ব উজার করে দেওয়ার নামই পুজো, আরতি, প্রণাম। আমাদের এই ভঙ্গুর মাটির শরীর যা কিছু দিয়ে তৈরি সেই ‘পঞ্চভূত’কেই একে একে দেবীর পায়ে নিবেদন করে দিয়ে আরতি করি আমরা। দেবী আসবেন এই গৃহে। তাঁকে যথাসর্বস্ব দিয়ে প্রণাম করতে হবে। তাই ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুত, ব্যোম এই ‘পঞ্চভূ্ত’কে আরতির উপাচারগুলোর মন্ত্রে নিবেদন করি দেবীর পদমূলে। ধূপের সুবাস দিয়ে ক্ষিতিকে নিবেদন করি, অপ কে নিবেদন করি শঙ্খের মধ্যে গঙ্গাজল ভরে, তেজ নিবেদিত হয় কর্পূর দিয়ে ধুনোর আগুণ জ্বালিয়ে, মরুতকে ধরে ফেলি চামরের দোলাতে বাতাস ছড়িয়ে, আর ব্যোমকে ছোঁয়া যায় ঘন্টার শব্দে, ওঙ্কারের ধ্বনিতে। পাঁচ সলতের পঞ্চপ্রদীপ তার পাঁচটি মুখ নিয়ে হয় আমাদের জাগ্রত পঞ্চেন্দ্রিয়ের পাঁচটি প্রতীক। আমরা তাই দেবীর কাছে নিবেদন করি আমার এই পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের সর্বসুখ তোমাতে নিমজ্জিত হয়ে থাক। তুমিই তাদের ভার নাও, দেখাশোনা কর। আর দেখাশোনা কর তোমার ‘পঞ্চভূতকেও’। তাদের পাঁচজনকে হিসেব মিলিয়ে একসঙ্গে বেঁধে রাখো মা। তুমি না দেখলে ওদের রক্ষা করবে কে? শেষে আসে দর্পণ, মুকুর। এখানেই আত্মসমর্পনের শেষ পরীক্ষা। দেবীর মুখের দিকে তাকিয়ে তাই বিদায়বেলাতে বলি আমি যেন সারাবছর তোমার ভক্ত হয়ে আমার সমস্ত সততা, কর্তব্যনিষ্ঠা, নিয়মানুবর্তিতা নিয়ে এমনভাবে চলতে পারি যাতে তোমার মনের মুকুরটি থাকবে ধূলিবিহীন, নির্মল। সেই স্বচ্ছ মনের আয়নায় নিজের মুখটি দেখতে গেলে নিজের মুখের পরিবর্তে তাতে আরাধ্যের প্রিয়মুখটি যেন সবসময় ভেসে ওঠে। ভক্তির সেটাই শেষকথা। এ তো তোমারই কথা। তুমিই তো মা শিখিয়েছ হিন্দু, মুসলিম, জৈন, বৌদ্ধ, ক্রিশ্চান - ধর্মে তুমি যাই হও না কেন, এই পঞ্চভূত আর পঞ্চইন্দ্রিয় নিয়েই তোমার তুমি। যে কোনো ইষ্টদেবতার প্রতি ধরিত্রীর সন্তানদের সকলেরই হতে পারে এই প্রণাম, এই আরতি হতেই পারে সব মানুষের নিজের কথা।

মাগো, আমরা ভক্তকুল বড়ই স্বার্থপর। কয়েকটা দিন দেবীর জন্যে বরাদ্দ, খুব খাতির, প্রচুর আড়ম্বর, খাওয়া দাওয়া, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আরও কত কি। যদি ভাবা হয় সবই শ্রদ্ধা ভালোবাসায় আপ্লুত হয়ে করি তবে ভুল হবে। যতটা করি তার চার আনা ভক্তি আর বারো আনা দেখনদারি, প্রচার, সেলফি, ফটো, ফেসবুক পোস্ট। এখানে স্বার্থ আছে বইকি। সস্তা দেখনদারি। তুমি আসামাত্রই অনবরত ঘ্যানঘেনিয়ে ‘রূপং দেহি, জয়ং দেহি, যশো দেহি দ্বিষো জহি’, এটা দাও, সেটা দাও, এটা করে দাও, ওটা করে দাও। আচ্ছা মা, তুমি কি শুধু দেওয়ার জন্যই? তাহলে কি হড়কা বানে হারিয়ে যাওয়া ভক্তবৃন্দের দেহগুলোতে প্রাণসঞ্চার করে তাদের ফিরিয়ে দিতে? বা পাহাড়ের ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোকে। কেন তুমি এতটা নির্দয় হলে মা? সবকিছুই তো তোমার অঙ্গুলিহেলনে। হ্যা, তোমার বঙ্গভূমে রক্তবীজের বংশধরেদের মতো বাড়ছে শিক্ষাসুরেরা। এটা সত্যিই। কিন্তু তার জন্য নিরীহ, নির্দোষ শাস্তি পাবে কেন মা? আসলে বুঝেছি মা, শাস্ত্র, আচার সব ধূলিসাৎ হয়ে যাচ্ছে। নিষ্ঠা, ভক্তির বদলে স্থান করে নিচ্ছে আড়ম্বর। প্রশিক্ষিত পুরোহিতের অভাবে অশাস্ত্রীয় উচ্চারণে না বুঝে অচেনা ভাষায় বিশুদ্ধ মন্ত্রোচ্চারণ না শোনার ফলে কুপিতা হচ্ছো তুমি। হয়তো পিতৃপক্ষে তোমার বোধনপর্ব সুনিশ্চিত করে, সহজ মন্ত্রোচ্চারণকে অযথা জটিল করতে গিয়ে, শাস্ত্র, আচার জলাঞ্জলি দেওয়ার ফলে তোমার প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা প্রদর্শনে খামতি থেকে যাচ্ছে যে ভক্তকুলের, তাদের প্রতি তুমি কুপিতা হচ্ছো। কিন্তু তার জন্য আমরা তোমার নিরীহ ভক্তকুল পাপের শাস্তি ভোগ করব কেন মা? প্রকৃতির এই রূদ্ররূপকে তুমিই তো পারো নিয়ন্ত্রণ করতে। মা, মাগো, পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ করে, তোমার সঙ্গে অভিন্ন হয়ে যাওয়ার মন্ত্র উচ্চারণেই তো পুজো শেষ। আমি আমার প্রাণ, বুদ্ধি, দেহ, ধর্ম, অধিকার--সর্বস্ব তোমাকে সমর্পণ করেছি। জাগরণে, স্বপ্নে, সুষুপ্তিতে, কর্মে, মননে, বাক্যে, যা কিছু আমি স্মরণ করেছি, যা কিছু উচ্চারণ করেছি, সব আমি আজ তোমাকে উৎসর্গ করলাম। রুদ্ররূপ নয়, এ ধরিত্রীর বুকে নেমে আসুক তোমার বরাভয় আগামী দিনে। শিক্ষাসুরদের কঠোরতম সাজা দাও মা। শিক্ষিত বেকারদের মুখে হাসি ফোটাও। সত্যের জয় চিরকালীন একথা বিশ্বাস করতে আমাদের সাহস যোগাও মা। 




কথা কিছু কিছু
শ্রাবণী সেনগুপ্ত 

মেয়েটির ছোটবেলায় পুজোর ঠাকুর ভাসানের আগ দিয়ে   ছিল  মায়ের হাত ধরে মামারবাড়ি যাওয়া।তখন সেখানে দাদু,দিদা,মামা,অবিবাহিত মাসিদের ভরা সংসার।উপরি পাওনা হিসেবে ছিল তার  মামারবাড়ির পাশেই তার  মায়ের মামারবাড়ি।

সেখানেও ছিল ভারি মজা। আসলে হয়েছিল কি,তার মায়ের বাবা মা আর মামা পিসির মধ্যে হয়েছিল বদল সম্বন্ধ।তাই তার মায়ের পিসি ছিলেন মামী,আর মামা পিসেমশাই।ভারি ভাব ছিল দুই পরিবারের মধ্যে।আর ছোটদের অবারি ত দ্বার।পুজোর কটাদিন খুব মজায় কাটত বলাই বাহুল্য।তখন বড়ো মেয়ের মেয়ে এবং ঐ বাড়িতে একমাত্র বাচ্চা হিসেবে তার  প্রচুর আদর।মামারবাড়িতে সকলে তাকে চোখে হারায়।দশমীর দিন মায়ের সঙ্গে গিয়ে দুগ্গা ঠাকুরের পায়ে বই ছোঁওয়ানো।দুগ্গা মায়ের বিসর্জন-নিকটবর্তী পুকুরে।সে মাসিদের সঙ্গে দেখতে  যেত।অবাক হয়ে দেখত বয়স্ক পুরোহিতমশাই মায়ের বিদায়বেলায় কিভাবে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে কান্নায় ভেঙে পড়তেন।বিসর্জন দিয়ে পুকুরের জল ছিটিয়ে দেওয়া হত পুকুরের পাড়ে দাঁড়ানো সবার মাথায়,গায়ে।আর বিসর্জন দেখে বাড়ি ফিরে দিদার হাতের ভাজা পুঁটি মাছ খাওয়া।একে বলা হত যাত্রা পুঁটি।দশমীর ঠাকুর বরণের পর সেই বরণের কুলো হাতে নিয়ে দিদিমা যেতেন  কাছাকাছি কিছু বাড়িতে।মেয়েটিও সামিল হত তাতে।সেখানে দিদিমা বাড়ির এয়োদের সিঁদুর দিতেন,আর সঙ্গে থাকা নাড়ু দিয়ে মিষ্টিমুখ হত,ঐ বাড়ির বড়োরা সঙ্গে থাকা মেয়েটিকে ঘরে বানানো মিষ্টি খেতে দিতেন।বলতে গেলে বিজয়ার শুরু তখন থেকেই।তখন বাড়িতে বানানো হরেকরকম মিষ্টি,নারকোলের ছাঁচ,নিমকি,ঘুগনি এইসব দিয়েই অভ্যর্থনা জানানো হত বিজয়া করতে আসা অতিথিদের।

পরের কয়েকদিন বাড়িতে বিজয়া করতে আসা আত্মীয়,অনাত্মীয়র ভিড় লেগেই থাকত।মেয়েটিও বড়দের সঙ্গে যেত এবাড়ি,সে বাড়ি।তখন এতো বাইরের খাবারের চল ছিল না, কিন্তু তারজন্য কোনো অভাববোধও ছিল না।কতোরকমের যে খাবার-নোনতা,মিষ্টি বিজয়াতে ঘরে বানানোরই চল ছিল।সেই সময় রাস্তাতে যেতে যেতে  বড়দের কারোর সঙ্গে দেখা হলেও প্রণাম করত সবাই। আর ছিল প্রবাসে থাকা আত্মীয়স্বজনকে চিঠি লেখা।খুব আনন্দ পেত মেয়েটি এই চিঠি লেখাতে।বিশেষ করে তাঁর এক দূর সম্পর্কের জ্যেঠু ছিলেন আসামে,ইনি আবার বাড়িতে কোনো বাচ্চা হলে তাদের নাম দিতেন।সেই নতুন নাম বহন করে চিঠি আসত ।মেয়েটির নামও সেই জ্যেঠুর দেওয়া।মেয়েটির একান্নবর্তি পরিবারে তো বিজয়া মানে সেইসময় প্রায় প্রতিদিনই কেউ না কেউ আসা-কোনোদিন তার মামা মাসিরা,কোনোদিন জ্যেঠিমাদের,কাকিমার বাপের বাড়ির সবাই।যে কোনো ঘরেই কেউ আসুকনা কেন,মূল আকর্ষণ ঠাকুমার ঘর।ওখানেই সবার বসা,আড্ডা দেওয়া।সেইসময় আপন পর ভেদাভেদ ছিলনা।তারাও যেত বিভিন্ন আত্মীয়স্বজনের বাড়ি।বাবার মামার বাড়ি,মাসির বাড়িও গেছে এই সুবাদে।আরো খুব মনে পড়ে তার বাবাদের এক মামাতো দাদার কথা,তিনি তাদের খুব কাছের জ্যেঠু।জ্যেঠিমাকে নিয়ে আসতেনই আসতেন।আর এলেই খুব হৈ হৈ আড্ডা হত,বিশেষ করে তার বাবার সঙ্গে খুব জমত।বিজয়াতে তখন সবাই সবার বাড়ি যেতেন,সেইটি ছিল আবশ্যিক।আর ছিল বিজয়া সম্মিলনী-যা ঠাকুর বিসর্জনের পর প্যাণ্ডেলেই অনুষ্ঠিত হত।

                        তারপর দিন কাটে,দিন কাটে, আজ সে মেয়ে অনেক বড়ো,সংসারেতে সড়গড়।চোখের সামনে সেই বেড়ে  ওঠার সময়ের দিনগুলির বিজয়া-কেমন বদলে গেল।এখন বেশিরভাগই মোবাইলে মেসেজ আসে-হ্যাপি বিজয়া।সময়ের অভাবে খুব কাছের মানুষেরাও আর বাড়ি এসে বিজয়া করতে পারে না,আর সেই নীল ইনল্যান্ড এ আসা বিজয়ার বার্তা এখন পুরাতন গন্ধমাখা মধুর স্মৃতি।সে কিন্তু এখনো বিজয়া সারে বাড়ি বাড়ি গিয়ে,শত কাজ আর অসুবিধার মধ্যেও।এখনো তার এক বয়স্কা আত্মীয়া বানান সেমুইয়ের পায়েস,ঘুগনি-এখন আর পেরে ওঠেন না,তাও এইগুলি করবেনই করবেন।মেয়েটি বাড়িতে আজও বানায় নারকেল নাড়ু,নিমকি,আর ঘুগনি-কেউ বিজয়া করতে আসবে এই আশায়-শুভ বিজয়ার এই  ঐতিহ্য যে জড়িয়ে গেছে তার যাপনে।  তার মধ্যেই সে ফায়ার পে তার পিছুটান।                 


বিজয়া: সেদিন ও আজ 
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় 

শতাব্দী প্রাচীন গোবরডাঙ্গা জমিদার বাড়ির সামনে দিয়ে বয়ে যাওয়া যমুনা নদীর কথা খুব মনে পড়ে।  চোখে  ভেসে  ওঠে  যমুনা  নদীতে   দলে দলে কচুরিপানা মৃদু মন্থর গতিতে,  সগর্বে নীল  সাদা  ফুল  নিয়ে  পেঁজা  তুলোর মেঘদের সাথে  একান্ত  মনে  রঙিন গল্প  জমিয়ে  পাড়ি দিত  ইছামতীর  দিকে ।  বিজয়া দশমীর  সন্ধ্যায় কুলুকুলু  বয়ে  যাওয়া  যমুনা নদীর নীরবতা ভঙ্গ করত , রেল ব্রিজ -এর উপর  দিয়ে ছুটে যাওয়া লৌহদানব,  বনগাঁ  লোকালের তীব্র  হুইসিল, আর  দুর্গাপুজো কমিটিগুলির "আসছে বছর  আবার  এসো মা গো " এই প্রার্থনাতে।  এরই মাঝে চলত প্রতিমা বিসর্জ্জন। ভারত বাংলাদেশ সীমান্তের প্রতিমা নিরঞ্জনের সাথে ছিল বেশ মিল। 

প্রতিমা বিসর্জ্জন দিয়ে আমরা ফিরে আসতাম পাড়ায়।  এখন আর সেই পাড়া সংস্কৃতি  নেই।  নেই গুরুজনদের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম বা সমবয়সীদের সাথে কোলাকুলি। পুজোর আগেই কেনা থাকত পোস্টকার্ড এবং ইনল্যান্ড লেটার। সমস্ত আত্নীয় পরিজনদের লেখা হত বিজয়ার প্রণাম এবং আশীর্বাদের চিঠি। ডাক পিয়ন এসে দিয়ে যেতেন পোস্টকার্ড, ইনল্যান্ড লেটার ও শারদীয় সংখ্যার ক্ষুদ্র পত্র পত্রিকা।  তোড়জোড় চলতো বিজয়া সম্মিলনের প্রস্তুতি ও গান, নাচ, নাটকের মহড়া।

ধীরে ধীরে আত্মপ্রকাশ ঘটলো ডি,জে'র। বিসর্জনের সময় চটুল হিন্দি গান, গানের থেকেও তার বাজনা বেশি।  তার সাথে কুৎসিত নাচ ও অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি। আমাদের পাড়া সংস্কৃতিতে সন্ধ্যার পর বাড়ি ফেরা নিষিদ্ধ ছিল। পাড়ার জ্যাঠা কাকারাই জানতে চাইতেন, কেন অন্ধকার হওয়ার পরও কেউ কেন বাড়ির বাইরে আছে। এখন বিসর্জনে যথেচ্ছ ধুমপান,  মদ্যপান এবং ডি, জের হিন্দি গান এর ফলে  ঘটে চলছে নানা ধরনের অঘটন। 

দূর্গা প্রতিমা মন্ডপের মধ্যে থাকা কালীনই দর্পন বিসর্জনের আগেই মোবাইলের হোয়াটসআপে  আসতে থাকে শুভবিজয়ার প্রণাম শুভেচ্ছা। মোবাইল গ্যালারি ভরে যাওয়ার আশঙ্কায় চলতে থাকে মায়ের ছবি ডিলিট করার ধুম। কলাপাতার ওপর বেলের কাঁটা দিয়ে একশ আটবার "দুর্গা " নাম লেখা, মা'য়ের পায়ে বই, খাতা, ডাইরি ছোঁয়ানো, অপরাজিতা ফুলের গাছ ও ফুল স্পর্শ করা, নীলকণ্ঠ পাখির ছবি দেখা,  সবটা অধরাই থেকে যায়।



আনন্দ আবেশ 
অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী

বহুপ্রতীক্ষিত শারদীয়ার উৎসবমুখর দিনগুলি পায়ে পায়ে কখন যেন শেষ প্রহরের দিকে এগোয়।মন বলে, এই মধুর ক্ষণের অধীর প্রতীক্ষাই ছিল শ্রেয়, আগমনীর দিনগোনাই ছিল আনন্দের। দশমীর উজ্জ্বল সিঁদুর খেলাতেও বিষাদের রং ঘনায় হঠাৎ।দর্পণে উমার মুখের ছায়ায় সে বিষাদে মায়া জড়ায়। অগণিত মা বোনের হাতের সিঁদুরের ছোঁয়া নিয়ে, ভক্তি, বিশ্বাস, একবুক ভালোবাসা নিয়ে মিষ্টিমুখে ঘরের মেয়ে উমার ঘর ছেড়ে চলে যাওয়ার পরোয়ানা জারি হয় তিথি, লগ্ন, সময়সূচি অনুযায়ী। চারিদিক খুশিতে ভরে তুলে সন্তানসন্ততি নিয়ে উমার পিতৃগৃহে আগমন ও কয়েকটি দিনের আনন্দ, হাসি,গানের শেষে পতিগৃহে প্রত্যাবর্তনের বিষাদ মেদুর মুহূর্তটি যেন ঘরের এক সাধারণ মেয়ের জীবনেরই চালচিত্র।যার আগমনের সবটা জুড়ে ছিল শুধু আলো আর আলো, তাঁর বিদায়বেলাকে এতটুকুও ম্লান হতে না দিয়ে ঢাকে কাঠি পড়ে দ্বিগুণ উৎসাহে।উন্মাদনায় মেতে ওঠে ভক্তের দল।এত আনন্দ আয়োজনের শেষে উমাকে বিসর্জন দেওয়া হয় জলে।জলে উমার মুখটি পুরোপুরি অদৃশ্য হওয়ার আগে পর্যন্ত যে মুহূর্তটুকুও দৃশ্যমান থাকে, করজোরে কপাল ছুঁয়ে শতসহস্র অশ্রুসজল চোখ তার বন্ধ পাতায় আগলে রাখতে চায় সেই নয়নাভিরাম স্নিগ্ধতাকে। আকুল হয়ে ওঠে মন। ঠিক সেসময় থেকেই অসংখ্য হৃদয়ে প্রতীক্ষার সূচনা হয় আগামী বছরের কোনো এক শারদ প্রাতে এক আলোক মঞ্জীরের বেজে উঠবার।শিল্পীর নিপুণ তুলির টানে তিলতিল করে গড়ে তোলা উমার মনোলোভা মুখচ্ছবি আর বসনে ভূষণে সাজানো টানটান অবয়বের মূ্র্তি থেকে কাঠামোটুকু শুধু ভেসে বেড়ায় জলে।শান্তিজলের স্পর্শটুকু রয়ে যায় আশীর্বচন হয়ে। মহিষাসুরের সঙ্গে নয় দিন, নয় রাত যুদ্ধের শেষে দশমদিনে বিজয়িনী বিজয়া বিদায় নিয়েও শুভ বিজয়ায় তাঁর অনুরণনটি রেখে যান আপামর ভক্তের হৃদয়ে। বিজয়া এক অনন্ত শক্তি।অশুভর বিনাশ ও শুভর উন্মেষ।যে শুভ স্নেহ, ভালোবাসা ও আশীর্বাদ হয়ে বছরের আর পাঁচটি সাধারণ দিনের বাইরেও বয়োজ্যেষ্ঠদের থেকে কনিষ্ঠদের উপরি পাওনার একটি দিন হয়ে থেকে যায়।যে শুভ ছোটদের শেখায় গুরুজনদের সামনে অবনত হতে। শুধুমাত্র পা স্পর্শ করে বা সংস্কারের বোঝা চাপিয়ে নয়;শিক্ষায়, সম্মানে, বোধে ও আত্মচেতনার আলোয় অন্তরকে বিকশিত করে প্রকৃত শ্রদ্ধার ফুল প্রস্ফুটনেই শ্রদ্ধার বিজয়া আসে, সার্থক হয় বিজয়া। বিজয়াকে উপলক্ষ করে প্রণাম, স্নেহাশিস, কোলাকুলি, মিষ্টিমুখ সবটাই আসলে এক মিলন উৎসব। আধুনিকতার ছোঁয়া লেগে আজ যা অনেকটাই ম্লান। হারিয়ে গেছে সেই নীলরঙা, হলদে রঙা ইনল্যান্ড, পোস্টকার্ড।যারা অনেক দূরপথের অনেক অলিগলি বেয়ে  উড়ে এসে মনের সবটা জুড়ে বসতো বিজয়ার অনেক শুভেচ্ছাবার্তা নিয়ে। হারিয়ে গেছে বিজয়ার চিঠিগুলি তাদের আদরের সম্বোধন নিয়ে।কাঁচা হাতের আঁকাবাঁকা অক্ষরও নেই আর।বিজয়া সম্মিলনীর আনন্দ উচ্ছ্বাস আজ অনেকটাই ফিকে, অনেক ম্রিয়মান। কোথাও কোথাও সম্পূর্ণই হারিয়ে গেছে এই মিলনোৎসব। কোথাও বা আধুনিকতা বিকৃতি হয়ে জৌলুস ছড়াচ্ছে এর নামে। কৃত্রিমতার মোড়ক হারিয়ে দিয়েছে সেই স্পর্শকাতর উজ্জ্বল দিনগুলিকে। ঐতিহ্যের সেই বিজয়ার ছবি অনেকখানি পাল্টে গেলেও সময় সবটুকু কেড়ে নিতে পারেনি আজও।এ প্রজন্মেও কিছু সংবেদনশীল মন আছে, শ্রদ্ধা আছে, বেঁধে বেঁধে থাকা আছে, আগলে রাখা আছে।সেই সঙ্গে আছে অশুভ শক্তির বিনাশিনী শক্তিরূপিণী সর্বজয়ার অন্তরের শক্তিমন্ত্রের দীক্ষা।বিজয়া সেই শক্তির আলোয় আলোকিত হোক। কৃত্রিম আনুষ্ঠানিক লোকাচার না হয়ে আন্তরিকতা ও সহজতায় বিজয়া আবার খুঁজে পাক তার হারানো ঐতিহ্যকে।সত্যিকারের মঙ্গলকামনার দীপ্তিতে উদ্ভাসিত হোক, সার্থক হোক বিজয়ার মায়াময় দিনটি। তবেইতো সমস্তটা মন উজাড় করে কান পাতলে নিশ্চিত শোনা যাবে সেই পদধ্বনি।শরৎ সকালে আলতা রাঙানো পা দুটি শিউলিঝরা শিশিরভেজা ঘাসে ডুবিয়ে ডুবিয়ে আসতেই হবে তাঁকে। তাঁর অস্তিত্বের মায়াময় নিমগ্নতার প্রতিটি আকূল আহ্বানের সাড়া হতে, ভক্তের হৃদয়ের ভক্তি হতে, আরাধনার শক্তি হতে আসবেন তিনি। তাঁকে ঘিরে উৎসবের শেষে তাঁকে ছুঁয়েই তো বিজয়ার শুভারম্ভ। সারাবছরের সঞ্জীবনী হয়ে তিনিই তো থাকেন সমস্ত ভালো কাজে, ন্যায়বিচারে, মানবিকতায়।তাই বিজয়ার গোধূলিবেলায় তাঁকে স্মরণ করেই ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে সমস্ত প্রাপ্তি বা না পাওয়ার উর্ধ্বে উঠে মনকেমনের সঙ্গে আশ্চর্য এক আনন্দধ্বনির মধ্য দিয়ে অভিন্ন সুরের মূর্ছনায় ঝংকৃত হয় অগণিত হৃদয় হয়তো বা এমনই কৃতজ্ঞ উচ্চারণে....
'এমন এক প্রহর আসে তোমার ছোঁয়ায়
সব দুখ সুখ হয়ে হয়ে যায়....
আমি ধন্য..আমি ধন্য..আমি ধন্য..আমি ধন্য..'



বিজয়ার সেকাল ও একাল 
স্বপন কুমার দত্ত 

মা দুর্গা প্রতি বছর আসেন বাপের বাড়ি। চারদিন থেকে দশমীতে ফিরে যান শ্বশুর বাড়ি কৈলাশে। দশমীতে দুর্গাপ্রতিমা বিসর্জন হলেই শুরু হয়ে যায় ' বিজয়া ' ।
        বিজয়ার সেকাল ছিল অত্যন্ত মধুময়। মায়ের বিদায়ের পর মন খারাপের পালা শুরু হলেও আমরা ছোট ছোট পোলাপানরা বিজয়ার মিষ্টিমুখ অর্থাৎ নারকেলের নাড়ু, মুড়ি চিড়ার মোয়া, বোদে পাওয়ার লোভে বুঁদ হয়ে থাকতাম।
        সকাল থেকেই গুরুজনদের প্রণাম করার পালা হয়ে যেত শুরু। তাঁরাও মন খুলে আশীর্বাদ
করতেন। শুধু বাড়িতেই নয়, পাড়া প্রতিবেশীদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে চলতো,প্রণাম করার পালা।যতটা না নিয়ম রক্ষার, বেশিটাই ছিল নাড়ু পাওয়ার লোভে। সবটা একসাথে খাওয়া যেতনা বলে একটা ছোট থলেও থাকতো হাতে। এতে কোন লজ্জা ছিলনা। বড়রা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কোলাকুলি করতো। শত্রু মিত্র কোন ভেদাভেদ থাকতোনা। মহিলারা একে অপরকে হাত জোড় করে নমস্কার করে বিজয়া পালন করতো।
             কিন্তু একালে এসে বিজয়া কেমন যেন ম্যারম্যারে হয়ে গেছে। এখন মাইক্রো পরিবারে সন্তানের সংখ্যা এমনিতেই কম। তারপর বাচ্চারা কেউ কারোর বাড়ি যায়না বা যাবার সময় পায়না। আর ঐসব নাড়ু মোয়াতেও তাদের নেই আসক্তি। চাউমিন, মোমো,নুডুলস ইত্যাদি খাবারেই তাদের বেশি রুচি। আর বড়দেরতো ভীষণ সময়াভাব। বিজয়া করে সময় নষ্ট করার কোন মানে হয়? তার থেকে বরং সেই সময়টা ফেসবুকে ডুবে থাকাই শ্রেয়। তাছাড়া গত দুবছর সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ না রেখে অভ্যাসটাও চলে গেছে। তাই কখনো পথেঘাটে পরিচিত কারোর সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে " হাই হ্যালো" করেই বিজয়ার পাট চুকে যায়। আর আধুনিক যুগে ছেলেমেয়েরা তো পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতেই ভুলে গেছে। অথচ এই বিজয়ার মাধ্যমে একটা
প্রেম প্রীতি ও নৈকট্যের বন্ধন যে গড়ে উঠতে পারে, একথা নি:সন্দেহেই বলা যায়।
         আজ বিশ্বজুড়ে যে হানাহানি,হিংসা,সন্দেহ পারস্পরিক শত্রুতা,খুনোখুনি চলেছে, এই বিজয়া একটা শান্তির বাতাবরণ তৈরি করতে পারে বলে আমার বিশ্বাস।



বিজয়া পদ্য 

চিরন্তন
কুমার বিজয়

পূজা আর উৎসব, 
গুলিয়ে ফেলেছি,
ভাবের অভাব যেন চিরন্তন,

সযত্নে কাঁদে আপন সংস্কার,

সমর্পণের ভঙ্গিতে,
করতলে বন্দি শূন্যতা,
অম্লান হাসি টুকুই সম্পদ,

উঁচু আর নীচু, ব্যবধানি বিস্তার,

আমি দুই পা এগিয়ে যাই,
তুমিও এসো না দুই পা,
মুছে ফেলি মিলনের অন্তরায়।



শিরোনামে-খবর
  যীশু চক্রবর্তী 

১)সামগ্রিক লাইফ সেটিং এ বিজয়া নেই
কিংবা জোনাকি দিয়ে হ্যাজাকের আলো সাজানো
কতটুকু ভুল করলে পরে ইকুয়েশন মেলে
সেসবের হিসেব খাতায় বাতিল

২) চোখ বন্ধ বা কায়দা মন্দ হলেই কি সময় জব্দ
বাজ পড়লেই নিজেকে চিনে নেওয়া যায়
এপাশ ফিরলে লাওয়ারিশ লাশ,হয়তো শরৎ এর কাশ

৩) ভয় পেলে পর্দা নামিয়ে ফেলো বুঝি? 
নাকি কার্নিভালের পোশাকেই মরে যায় দেবতা
রাজনীতি করে অরাজনৈতিক চাদর কিনে ফেলি
হড়কা বানে দেউলিয়া দেশ ও জাতি...


দশমী
সুদীপ দাস

সেই দিন দশমীর সকাল,
বিসর্জনের মন্ত্র পাঠ শেষ।
মন খারাপের বার বেলা,
যখন আগমনীর যাবার পালা।
ঠিক সেই সময়েই আগমন হয়েছিল "দশমীর"!
ফুটফুটে মেয়ে, নামটি দেওয়া ঠাকুরমার,
মৃন্ময়ীর বিসর্জনের দিন যে জন্মেছে, 
"দশমী" ছাড়া আর অন্য নাম কি মাথায় আসে!
"ও মেয়ে বড় ভাগ্যবতী" বলে পারাপড়সী
বিজয়ার দিনে মিষ্টি মুখে সবার মুখে হাসি।
মধ্যবিত্ত বাবা-মায়ের কোল আলো করে
বছর পাঁচেক আগে দশমী এসেছিল ঘরে।

এই বছরও আবার, মায়ের সিঁদুর ছোঁয়া,
ছোট্ট মেয়ের গালেও তাই আলতো রাঙিয়ে দেওয়া।
নতুন জামায় মিষ্টি ভারী প্রান চঞ্চল মেয়ে,
আজ তো "দশমী"র জন্মদিন বাবা কোলে নেয় আদর দিয়ে।
সন্ধে হল ঢাকের আওয়াজ, হবে মায়ের ভাসান,
ঘাটে কত মানুষের ভিড় সবাই দেখবে বিসর্জন।
মায়ের সাথে দশমীও দেখবে বিসর্জন
ঘাটের কাছে দাঁড়িয়ে দেখে কত মানুষ জন।
বাবা গেছেন একটু দূরে খেলনা কিনবে কত
দশমীর যে ভীষণ প্রিয় মাটির পুতুল যত।
হঠাৎ এল হড়পা বান পাহাড়ী নদীর কূলে
দশমী তখনও দিব্যি মায়ের কোলে।
এক নিমেষেই জলের তোড়ে ভাসলো বহু প্রান
সারি সারি মায়ের মূর্তি স্রোতেই ভাসমান।
মায়ের বাঁচানোর শত চেষ্টা বৃথা, ভেসে গেল জলে
ছোট্ট মেয়েও হারিয়ে গেল বানের কবলে।
দশমীতে দশমীর ভাসান কান্নার রোল চারিপাশ
বাবার হাতে মাটির পুতুল, শুধুই আর্তনাদ এক রাশ।
কেন রে তুই খরস্রোতা কেড়ে নিলি এত প্রান?
আজ তো শুধুই হবার ছিল মাটির মূর্তির ভাসান!
মাটির পুতুল আগলে বুকে বাবা ফেরেন বাড়ি
মায়ের কোলে দশমী আর ফিরবে না কখনো বাড়ি!


বিষাদ এবং বিজয়া
দেবর্ষি সরকার

বাইরে বৃষ্টি পড়ছে অনবরত,
ঠিক অনেকটা এক্কা দোক্কা খেলার মত।
তবে সে বৃষ্টি উমার কান্না বিশেষন লাভ করেছে,
তবে একে আমি দেখছি প্রিয়জন হারানোর হতাশার ন্যায়।
যে হতাশা কুরে কুরে খাচ্ছে প্রতিনিয়ত,
ঠিক অনেকটা গ্রহণের মত।
কাশ ফুলগুলো আজ আর সাদা নেই,
শিউলি হারিয়েছে তার সুবাস,
আমি কেবল চাই মানবতার স্পর্শ।
দুঃখের আয়নাটি আরো গভীর হয় আমার মনে।
সেই মনের এককোনে একটি আয়না আছে,
তাতে মনের রাগ, অভিমান প্রতিনিয়ত দেখা যায়।
আব্দারের মানুষ আজ আর নেই,
শরৎ দিনের চেয়েও বেশি স্নিগ্ধ ছিল তার সঙ্গ।
এই জরাজীর্ণতা কেও মনে রাখেনি,
এই বিজয়ায় নেই কোন মিষ্টতা,
আছে কেবল বন্ধু হারানোর তিক্ততা।




বিজয়া অঙ্কন 

সজল সূত্রধর 



Monday, October 10, 2022


 

সম্পাদকের কথা 

পশ্চিমবঙ্গের শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপুজো  শেষ হল। অবশ্য উৎসবের এখনও বাকি কিছুটা। আর কয়েকদিনের মধ্যে দীপাবলির আলো এই রাজ্য সহ সারা ভারতকেই আলোকিত করে তুলবে। 

দুই বছর করোনা অতিমারির জন্য রাজ্যবাসী সেভাবে মেতে উঠতে পারেননি বলে এইবারের পুজো ঘিরে উৎসাহ-উদ্দীপনা ছিল দেখবার মতো। ইউনেস্কোর বিশেষ স্বীকৃতি পাওয়ার পর উন্মাদনাও ছিল তুঙ্গে। সরকারিভাবে ধন্যবাদ-জ্ঞাপন শোভাযাত্রা ও কার্নিভাল আয়োজন ছিল তারই অঙ্গ। 

বিপুল আনন্দ অবশ্য শেষ হয়ে গেল জলপাইগুড়ি জেলার মালবাজারে, দশমীর ভাসানে, অসংখ্য মৃত্যুতে। মাল নদীর হড়পা বান যে ভয়ঙ্কর দুর্যোগ নিয়ে এলো তাতে ম্লান হয়ে গেল সবকিছু। অবশ্য তারপরেও জীবন থেমে থাকেনি, উৎসব থেমে  থাকেনি। `দা শো মাস্ট গো অন`-এর পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে কেবল জলপাইগুড়ি জেলা বাদে সর্বত্রই কার্নিভালে মেতে উঠলাম আমরা। 

শোকের এই আবহে এরকম আনন্দ অনুষ্ঠান আয়োজন করা উচিত হল কিনা তার বিচার অবশ্য করবে মহাকাল। সব মিলে নিউ নর্মাল পরিস্থিতির প্রথম দুর্গোৎসব স্মরণীয় হয়ে রইল নানা কারণে।

মুজনাই তার অগণিত পাঠক-পাঠিকা, লেখক-লেখিকা ও শুভানুধ্যায়ীদের বিজয়ার প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। সকলের মঙ্গল কামনা করছে। 


   মুজনাই  অনলাইন আশ্বিন সংখ্যা ১৪২৯         

রেজিস্ট্রেশন নম্বর- S0008775 OF 2019-2020

হসপিটাল রোড 

কোচবিহার 

৭৩৬১০১

ইমেল- mujnaisahityopotrika@gmail.com (মাসিক অনলাইন)

- mujnaiweekly@gmail.com (সাপ্তাহিক) 

প্রকাশক- রীনা সাহা 

সম্পাদনা, প্রচ্ছদ ছবি,  অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায়  

মুজনাই অনলাইন আশ্বিন সংখ্যা ১৪২৯


এই সংখ্যায় আছেন  যাঁরা 

সন্দীপ দেবনাথ, চিত্রা পাল, সীমা সাহা, বিনয় বর্মন, 

সুজাতা কর, পার্থ বন্দোপাধ্যায়, মৌসুমী চৌধুরী, 

রীনা মজুমদার, সৈকত দাম, সারণ ভাদুড়ী, মজনু মিয়া, অঞ্জলী দেনন্দী, 

বটু কৃষ্ণ হালদার, স্বপন কুমার দত্ত

শৌভিক কার্য্যি, চিত্রাক্ষী রায় 


মুজনাই অনলাইন আশ্বিন সংখ্যা ১৪২৯ 




দুর্গার সংসার 

ছবি- শৌভিক রায় 



বিদেশের চিঠি 

   ভ্রমণ   


গোলাপি বালির অভিযান ও অন্যান্য

সন্দীপ দেবনাথ

লটসা মটসা পিজা । খুঁজে পেতে শেষে কি না পাওয়া গেল এই একটি দোকান। রাত পৌনে এগারোটা বাজে এখন  এই অজ পাড়াগাঁয়ে এত রাতে কোন খাবারের দোকান যে খোলা আছে সেই বেশি আলো আঁধারি একটা পার্কিং এসে গাড়িটা দাঁড় করালাম টিম টিম করে একটা নিয়নের হলুদ আলো জ্বলছে দোকানের নামটা  ভাল করে বোঝাই যাচ্ছে না। শুধু ওই ওপেন লেখাটাই যা দেখা যাচ্ছে সে নাম দেখা না যাক, ওপেন থাকলেই হবে তুমি বাবা আমাদের ভরসা। এখানে আর কোথাও কিছুই খোলা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না পুরো পার্কিং জুড়ে শুধু দুটো গাড়ি, ওই যেখানে একটু আলো ওদিকটায় মনে হয় দোকানের লোকজনেরই গাড়ি আর তিনটে হারলে-ডেভিডসন-এর মোটর সাইকেল আসে পাশে কেউ কোথাও নেই একটু একটু ভয় করছে আমাদের। ইংরিজি সিনেমায় দেখা যায় এই সব জায়গায় খুন খারাবি হতে। হঠাৎ করে একটা ট্রাক এসে পড়বে আর শুরু হবে বন্দুকবাজি

আপাতত সেসব চিন্তা এখন মাথাতে নিতে পারছি না পেটে  ছুঁচো ডন বৈঠক মারছে। অগত্যা দরজা ঠেলে ঢুকে পরলাম আমরা পাঁচজন চারজন গিয়েছি সিয়াটেল থেকে একজন শিকাগো এই এত রাতে পাঁচজন এশিয়ানদের দেখে দোকানের মেয়েটি বেশ অবাক। নিরামিষ পিজা অর্ডার দেওয়া হলআমাদের মধ্যে একজন নিরামিষাশী। এবারে অপেক্ষার পালা

এদিক ওদিক তাকাতেই চোখ পরে গেল এক কোনের টেবিলে বসা চারজনের দিকে পোশাক দেখেই বোঝা গেল, বাইরের মোটর সাইকেলগুলো এদেরই এইসব মোটর বাইকারদের একটা বিশেষত্ব থাকে বেশ হোমড়াচোমড়া টাইপের হয় এইসব লোকজনরা এরা আবার বিশেষ দলের হয়, শিকাগো চ্যাপ্টার, ন্যাশভিল চ্যাপ্টার কত কিছু ইয়া বড় বড় দাঁড়ি, গোঁফ।  হাতের এক বিরাশি সিক্কার থাবা যদি বসায় আমি তো সঙ্গে সঙ্গেই কুপোকাত হয়ে যাব রোগা পাতলা শিং মাছের ঝোল খেয়ে বড় হওয়া বাঙালি আমি নেটফ্লিক্সের দৌলতে এদের একটা ডকুমেন্টরি দেখে মোটামুটি একটা ধারনা হয়েছে আমাদের এদের এক গ্যাং-এর সাথে আর এক গ্যাং-এর মতের মিল হয় না মাইলের পর মাইল এরা বাইক চালিয়ে চলে যায় এক রাজ্য থেকে আর এক  দুর থেকে দেখলেই না দেখার ভান করে করে চলে যাই অন্যদিকে দ্রুত মাথায় আমেরিকার জাতীয় পতাকার আদলে তৈরি রুমাল দিয়ে ফেট্টি বাঁধা, চামড়ার জ্যাকেট, হাতে চামড়ার গ্লাভস, পকেট থেকে বেরিয়ে আসছে মোটা মোটা চেন, এসব দেখেই ভয় পেয়ে  যাই আমি

হঠাৎ চোখাচুখি হতেই ইশারায় ডাকলেন একজন আমি তো ভয়ে আত্মহারা এই অজানা অচেনা জায়গায় এত রাতে ডাকলেই তো মুশকিল লালমোহনবাবুর কথা মনে পরে গেল, সেই যে জয় বাবা ফেলুনাথ-এ বেনারস-এ ভোজালির ম্যাজিক দেখার পর যেমনটা হয়েছিল, আমিও মনে মনে প্রমাদ গুনছি। মনে তবু সাহস সঞ্চয় করে ভীরু পায়ে এগোলাম। আমরা অন্তত পাঁচজন আছি যা হবে দেখা যাবে। জিগ্যেস করলেন, তোমরা কোথা থেকে এসেছ ? আর এই অজ পাড়াগাঁয়ে এসেছই বা কেন ?


(এঞ্জেলস ল্যান্ডিং, জিয়ন ন্যাশনাল পার্ক )


দিন পনেরো আগে একদিন এক বিকেলবেলায় অফিসের চূড়ান্ত বোর হয়ে আনমনে ইন্টারনেট ঘাঁটাঘাঁটি করছিলাম। দেখতে দেখতে চোখ আটকে গেল একটা লেখায় কানাবের কাছাকাছি একটা জায়গায় কাইবাব মালভূমির মধ্যে একটা বালিয়াড়ির ছবি দেখলাম যেন। বালির রঙ নাকি গোলাপিছবিতে অবশ্য অনেক সময় এডিট করে রঙ পালটে দেওয়া যায় তাই নিজে চোখে না দেখলে বিশ্বাস নেই আগে কখনও দেখিনি। আঁচাতে হবে মনে হচ্ছে। একটু আধটু নাড়াচাড়া করতে করতে বুঝলাম এই জায়গাটার আশেপাশে অদ্ভুত সুন্দর কিছু জায়গা আছে  ট্রেকিং করার জন্য একেবারে উপযুক্ত বেলে পাথরের প্রাকৃতিক সব নির্মাণ চোখকে তাক লাগিয়ে দেয়। কাছাকাছি বড় এয়ারপোর্ট হল লাস ভেগাস বাস, সাথে সাথেই গুগলে টিকিট দেখতে শুরু করলাম। সপ্তাহান্তের প্লেনের টিকিটের দাম একশ ডলারের মধ্যেই পাওয়া গেল। যদিও খুব কম পয়সার স্পিরিট এয়ারলাইন্স। কিন্তু নিয়ে তো যাবে শেষ পর্যন্ত। দাঁড়িয়ে তো আর যেতে হবে না, তাহলেই হবে বিকেলে টেবিল টেনিস খেলতে গিয়ে কথাটা পারলাম তিনজন বন্ধুদের মধ্যে। শুক্রবার রাতে বেরিয়ে রোববার রাতে ফেরা অফিসে ছুটি নেবার দরকার নেই। থাকব ওই কোথাও একটা ক্যাম্প করে ওই বালিয়াড়ির কাছেই। উঠলো বাই তো কটক যাই। যে কোথা সেই কাজ। রাতে যোগাযোগ করা হল শিকাগোর বন্ধুর সঙ্গে। সে তো একবাক্যেই রাজিব্যাস বুক হয়ে গেল টিকিট। আমাদের গন্তব্যস্থল লাস ভেগাস

 লাস ভেগাস এর কথা শুনেই তো অফিসের সব বন্ধুদের উৎসাহ চরমে কিন্তু আমাদের পাঁচজনের সেরকম কোন উত্তেজনা নেই আমাদের লক্ষ্য অন্য লাস ভেগাস আমাদের জাস্ট ফ্লাই-ইন ফ্লাই-আউট এয়ারপোর্ট

শিকাগোর বন্ধু পৌছবে আমাদের আগেই তাই ওর ওপর দায়িত্ব পড়ল একটা ভাল 4X4 গাড়ি ভাড়া করার আমরা পৌছব রাত ২টোয় পৌঁছে  একটা হোটেলে কোনমতে গড়িয়ে নিয়ে সকালে উঠেই আমাদের যাত্রা এতদিন পর শিকাগোর বন্ধুর সাথে দেখা ফলে যা হবার তাই হল। শিকেয় উঠলো আমাদের রাতের ঘুম। রাত ভর আড্ডা আর আড্ডা। দেখতে দেখতে কখন যে পুব আকাশ রঙ হতে শুরু করেছে বুঝতেই পারিনি তড়িঘড়ি রেডি হয়ে নিলাম সবাই অনেক বড়দিন আজ সিয়াটেল থেকে বেরনোর আগেই ওই কোরাল পিংক স্যান্ড ডিউন স্টেট পার্কের মধ্যেই একটা ক্যাম্প গ্রাউন্ড বুক করেছি রাতে থাকা হবে ওখানেই তাঁবু টাঙিয়ে রাতের তাপমাত্রা শূন্যের নিচেই ঘোরাফেরা করবে বলে দেখে নিয়েছি সেরকম ব্যাবস্থাও আছে স্লিপিং ব্যাগ, জ্যাকেট সব ব্যাকপ্যাকে ভরে নেওয়া হয়েছে দরকার সকালের ব্রেকফাস্ট বানানোর সরঞ্জাম ঠিক হয়েছে রাস্তা থেকে তুলে নেওয়া হবে ফ্রাইং প্যান, তেল, ডিম, ম্যাগি, চা পাতা ইত্যাদি ক্যাম্প গ্রাউন্ডেই আগুন জ্বালাবার কাঠ পাওয়ার কথাদেখা যাকপ্রস্তুতি সম্পূর্ণ

 

******

গাড়ি ছুটছে প্রবল গতিতে, হাইওয়ে ১৫ ধরে। মুহূর্তের মধ্যে পেরিয়ে গেলাম লাস ভেগাস স্ট্রিপ ওই তো ম্যান্দালয় বে, এক্সক্যালিবার, বেলাজ্জিও, সিজারস প্যালেস, ফ্লেমিঙ্গো, স্ট্রাটোস্ফিয়ার একে একে পার হয়ে যাচ্ছি লাস ভেগাসের বিখ্যাত সব হোটেল আর ক্যাসিনো এদিকটায় দ্রুত বদলে যাচ্ছে বাইরের দৃশ্য তাল মেলানো খুব কঠিন মসৃণকালো পিচ ঢালা রাস্তায় আমাদের গাড়ি চলছে লাস ভেগাসকে পিছনে ফেলে মাঝে মাঝে ওই বড় বড় সেমি ট্রাক গুলো বিশাল দৈত্যের মত ছুটে আসছে মনে হচ্ছে এক্ষুনি গিলে ফেলবে ছোট ছোট গাড়ি গুলোকে বুঝি বন্ধুরা অবাক দৃষ্টি তে তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে বিশেষ করে বেলে পাথরের নানা রকম কারুকার্যে , যা শত শত বছর ধরে জল আর বাতাসের ক্ষয়ের মাধ্যমে ভাস্কর্যের মত তৈরি হয়েছে দেখলে মনে পাথর গুলো কীরকম ঢেউয়ের মত হয়ে থমকে গেছে এক জায়গায় চিরায়ত একটি দৃশ্য এদিকের দৃশ্যপট ওয়াশিংটনের থেকে একদম আলাদা এখানে সবুজের সমারোহ ওখানে লালের খেলা

আমি অ্যারিজোনায় ছিলাম অনেকদিনএইরকম প্রাকৃতিক দৃশ্য আমার কাছে একদন চেনা। সোনোরান আর মোহাবে মরুভূমিতে ঘুরে বেরিয়েছি অনেক বিখ্যাত, অল্প খ্যাত অনেক জায়গায় ট্রেক করেছি আগেও আমার মনে তখন চলছে নস্টালজিক আনাগোনা  পার হয়ে যাচ্ছি ধুধু মরুপ্রান্তর আবার কোথাও দুরে মালভূমির মত চ্যাপ্টা পাহাড়ের দিগন্তরেখা। শিরশির করে হাওয়া দিচ্ছে বাইরে  গাড়ির জানালাটা খুলে দিলাম। নভেম্বর মাস। বাতাসে ঠাণ্ডার ছোঁয়া। এদিকে বৃষ্টি হয়না তেমন সিয়াটেল-এর মত  ঝকঝকে রোদ্দুর চারিদিকে  হাওয়াটা বেশ ভাল লাগছে সবারই   আমাদের পরবর্তী গন্তব্য সেন্ট জর্জ  উটার প্রান্তিক এই শহরটি ট্রেকারদের স্বর্গ  এখান থেকেই একঘণ্টার দূরত্বে বিখ্যাত সব ট্রেকিং-এর জায়গা সর্বোপরি আছে জিয়ন ন্যাশনাল পার্ক এখানে আমরা থামব। দুপুরের খাবার, ক্যাম্পিং-এর বিভিন্ন সামগ্রী কিনতে হবে। জল নিতে হবে, কিছু শুকনো খাবার, এনার্জি বার নেব তারপর ছুটব স্প্রিংডেল-এ। গেটওয়ে অফ জিয়ন । এখনও অনেক পথ বাকি

 

(গোলাপি বালি, কোরাল পিঙ্ক স্যান্ড ডিউন পার্ক) 


যেমনটা ভাবা হয় তেমন হয় না কোনদিন হয় নি। এই যেমন একবার দিল্লি গেলাম সকালের ফ্লাইট ভাবলাম হাতে বেশ কিছুটা সময় আছে , ঘুরে দেখব একটু পুরনো দিল্লি, দেখব চাঁদনি চক , ধূলা কুয়া, কুতুব মিনার বা হুমায়ুন সৌধ কিন্তু না, সেবার এরোপ্লেন এত দেরিতে পৌঁছল যে হাতে একটুও সময় রইল না আবার এই যেমন গতবছর, ভাবলাম আপার ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার ৯৯ রুটের যে লুপটা হয় চিলিয়াক হয়ে হোপ আর তারপর লিলোএট হয়ে পেম্বারটন আর শেষ মেষ ভাঙ্ক্যুবারইচ্ছে ছিল একদিনে একটা রোড ট্রিপ করব। বাদ সাধল আমার গাড়ি। হোপ-এ পৌঁছনোর  আগেই টায়ার পাঙ্কচারব্যাস। রোড ট্রিপের ইতি সেখানেই। আবার যেমন এই সরস্বতী পুজোয়, আইফোনে মেয়ের নাচের একটা ভিডিও রেকর্ডিং করব ঠিক করলাম ও হরি সারাক্ষণ ফোনের স্ক্রিনে নাচ দেখেই গেলাম, রেকর্ডিং যে হচ্ছে না বুঝতেই পারি নি। নাচ শেষ হল, আমি ভাবলাম রেকর্ডিং বন্ধ করি এবারে। দেখলাম তখন শুরু হল রেকর্ডিং। তো এই হল অবস্থা। প্ল্যান করে কিছুই হয় না। যত বেশি পরিকল্পনা , তত বেশি প্ল্যান ফেল

স্প্রিংডেলের ২২ মাইল আগে সে বিশাল এক ট্র্যাফিক জ্যাম। রাস্তায় কোথায় একটা কাজ হচ্ছে , একটা লেন দিয়ে আপ আর ডাউনের গাড়ি চলছেবুঝতে পারলাম সময় হাতে খুব অল্প। আমাদের যে কোনো একটা হাইক ঠিক করতে হবে। এঞ্জেলস ল্যান্ডিং নাকি জিয়ন নার‍্যো। ওদিকে আবার ন্যাশনাল পার্কের ভিজিটর সেন্টারে গাড়ি রেখে আমাদের যেতে হবে পার্কের শাটল বাসে করে। টস করা হল। সবার এক রায়, এঞ্জেলস ল্যান্ডিং হাইক করা হবে। আমরা মোটামুটি সব ধরনের পড়াশোনা আর রিসার্চ করেই এসেছি এঞ্জেলস ল্যান্ডিং, পৃথিবীর সবথেকে ভয়ঙ্কর হাইকের মধ্যে একটি শুধু দুটো পা রাখা যায় এরকম একটা সরু ব্লেডের মত রিজ, যার দুপাশেই ১৪০০ ফুট সোজা ক্যানিয়ন-এর দেয়াল পা পিছলে পড়লেই একেবারে ১৪০০ ফুট নিচে অক্কা আবার সবথেকে সুন্দরের মধ্যেও এক।।সেজন্যই সাধ করে নাম রাখা এঞ্জেলস ল্যান্ডিং স্বর্গ থেকে পরী এসে এখানে নেমে বিশ্রাম নেবে বলে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় থেকে ধার করে একেই বলা যায় ভয়ঙ্কর সুন্দর

ভার্জিন নদী পার হয়েই সামনে বিশাল দৈত্যাকৃতি সেই এঞ্জেলস ল্যান্ডিং নিচ থেকে দেখলে মনে হয় ক্যাথিড্রালের মত গগনচুম্বী একটা পাহাড়ের চুড়ো ওপরের দিকে তাকিয়ে থাকলে ঘাড় ব্যাথা হয়ে যায় এতটাই বড় আমাদের গন্তব্য ওই চুড়ো মাঝে অনেক চড়াই উৎরাই পেরতে হবে আমাদের হাতে সময় কম বাস থেকে যখন নামলাম তখন অলরেডি সাড়ে চারটে বেজে গেছে এখানে সন্ধ্যে নামে ঝুপ করে আমাদের শেষ বাস আটটায় তার মধ্যেই আমাদের নিচে নেমে আসতে হবে ঘুরঘুট্টি অন্ধকারে কিছুই দেখা যাবে না

পা চালিয়ে চল ভায়া হাঁক দিলাম আমি আমাদের সাথে হেড ল্যাম্প রয়েছে যদি দরকার হয় যখন সেই বহু প্রতীক্ষিত জায়গায় গিয়ে পৌঁছলাম তখন সবাই ফিরছে আমরা বোধহয় শেষ দল যারা তখন ট্রেক করে ওপরে ওঠার চেষ্টা করছিল কিছু কিছু জায়গায় পাথর এত মসৃণ যে পা রাখাই যায় না কিছু কিছু জায়গায় ইস্পাতের চেন লাগানো রয়েছে যাতে চেন ধরে ওপরে ওঠা যায় প্রতিপদে বিপদ কিন্তু আমাদের একটা অদম্য ইচ্ছের কাছে সেসব কিছু মনে হচ্ছিল না যাইহোক, আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল বিকেলের সূর্যাস্ত পড়ন্ত বিকেলের আলোতে জিয়ন ক্যানিয়ন এক অদ্ভুত মায়াবী আলোতে ভেসে যাচ্ছিল আমরা ওপর থেকে দেখলাম ভার্জিন নদী সূর্যাস্তের প্রতিফলনে রুপোর মত চিকচিক করছে।। সে এক অভাবনীয় দৃশ্য আমাদের মনে তখন এক পরম প্রাপ্তি সেই ভয়ঙ্কর সুন্দর ল্যান্ডিং এ নিজে দাঁড়িয়ে থেকে এই দৃশ্য দেখা সবার ভাগ্যে হয় নাসারাদিনের ক্লান্তি, রাস্তার ট্র্যাফিক জ্যাম সব যেন উধাও হয়ে গেল এক মুহূর্তেইচ্ছে হচ্ছিল অনেকক্ষণ বসে থাকি ওখানে কিন্তু জানি ঝুপ করে অন্ধকার নেমে আসবে হঠাৎ  শেষ শাটল বাস মিস হয়ে গেলে কি করব জানি না অতঃপর মন না চাইলেও নেমে আসবার জন্য পা বাড়ালাম। শেষ বারের জন্য দেখে নিলাম এই পরম সুন্দরীকে। শেষ অবধি হেড ল্যাম্পের সাহায্যে নেমে এলাম পুরো পথ। চারিদিকে অন্ধকার। আকাশে তারা ফুটেছে কতএকসাথে এত তারা  বোধহয় শেষ দেখেছিলাম ডেথ ভ্যালিতে

 

(মরুর দেশে নাম না জানা হলুদ ফুল) 


ক্যাম্প গ্রাউন্ডে যখন পৌঁছলাম তখন প্রায় রাত বারোটা পিজা খেয়ে এসেছি শেষমেশ এত রাতে বোধহয় কেউ ক্যাম্প গ্রাউন্ডে চেক-ইন করে না গাড়ির হেড লাইটের আলোতে খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে আমাদের নির্দিষ্ট স্পটে পৌঁছলাম আশেপাশে কারো কোন সারা শব্দ নেই থাকার কথাও নয় এত রাতে সবাই নিশ্চয়ই নিজেদের তাঁবুতে গভীর নিদ্রায় মগ্ন তড়িঘড়ি করে দুটো তাঁবু টাঙিয়ে ফেললাম দ্রুত রাতে এখানে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা উষ্ণতা এতক্ষণে শূন্যের নিচে নেমে গেছে সারাদিন প্রচুর খাটুনি গেছে স্লিপিং ব্যাগের মধ্যে ঢুকে পড়লেই নিশ্চিত ঘুম গুড নাইট

রাত তখন প্রায় দুটো বাজে হঠাৎ বাইরের একটা খচখচ আওয়াজে ঘুমটা ভেঙ্গে গেল মনে হল তাঁবুর আশেপাশেই কিছু একটা যেন চলাফেরা করছে ভয়ে শরীরে একটা শিহরন খেলে গেল নীতিশ পাশেই ঘুমচ্ছে ডেকে তোলা প্রায় অসম্ভব  অথচ বুঝতে পারছি না কি করব পাশের তাবুতে রোহিত আর মন আমাদের থেকে প্রায় ১০ ফুট দুরে ওদিক থেকে নাক ডাকার আওয়াজ আসছে আমরা তো কোন খাবার বাইরে রাখিনি বা খাবার তৈরিও করিনি ভাল্লুক যদি আসে তাহলে সাধারণত খাবারের গন্ধেই আসে কিন্তু এখানে তো কোন খাবারই নেই, তাহলে কি ? শুনেছি ভাল্লুক এলে মড়ার মত করে পড়ে থাকতে হয় আমি একদম চুপ কোন নড়াচড়া করছি না অথচ বুঝতে পারছি পাশেই কিছু একটা ঘোরাফেরা করছে এত ঠাণ্ডা তবু ভয়ে শরীর দিয়ে ঘাম ঝরছে এইরকম ঠাণ্ডাতে তো ভাল্লুক নিশ্চয়ই শীতঘুমে গিয়েছে তাহলে কি ঘোরাফেরা করছে ? আচ্ছা আশেপাশের তাঁবুতে  যারা আছে তারা কি কিছু টের পাচ্ছে না? এত রাতে নিকষ কালো অন্ধকারে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না কোথায় আছি তাও জানি না আশেপাশে কাউকে দেখিও নি যখন ক্যাম্প গ্রাউন্ডে ঢুকি মনে মনে ভাবছি কখন ভোরের আলো দেখব

সাহস করে উঠে বসলাম। তাঁবুর জানালাটা একটু ফাঁক করে বাইরে তাকিয়েই শরীর হিম হয়ে গেল আমাদের স্পটেই দু দুটো চোখ জ্বলজ্বল করছেআর কিছুই দেখতে পেলাম নাবুঝলাম আমাদের কেউ একজন নজর রাখছে সারারাত আর আমার ঘুম এলো না গতকাল রাতেও ঘুম হয় নি একফোঁটা কালকে আবার আর একটা বড়দিনভোরের আলো ফুতেই বাইরে বেরিয়ে এলামসূর্য ওঠেনি তখন কিন্তু পুব আকাশে রঙের খেলা শুরু হয়ে গেছে ঠাণ্ডা আছে ভালই জ্যাকেটটা গায়ে জড়িয়ে বেরিয়ে এলাম সামনে বালিয়াড়ির পাহাড় যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই সকালের আলোয় স্পষ্ট দেখতে পেলাম মিষ্টি গোলাপি রঙ ওই বালির মনে হল, এই ক্লান্তি, ঘুমহীন রাত, জ্বলজ্বলে চোখের শাসন, ঠাণ্ডা হাওয়া সব যেন ভুলে গেলাম এত অপূর্ব দৃশ্য মনে হয় দেখিনি আগে কখনওএই জন্যই তো শতবার জন্ম নেওয়া যায় লক্ষ্য করলাম এই ক্যাম্প গ্রাউন্ডে আমরা ছাড়া আর কোন মানুষ ছিলনা রাত্রিবেলা বন্ধুরা সবাই তখন ঘুমে মগ্ন আমি একা পিকনিক চেয়ারে বসে রইলাম অনেকক্ষণ এই অপূর্ব রূপ যেন শুধু আমারই জন্য

সম্বিত ফিরল রোহিতের ডাকে! স্যান্ডি, চা রেডি!

 

 

(বাকস্কিন গালচ ক্যানিয়নের ওই পাথর, ১২৭ ঘন্টার সিনেমার মতো)


বাকস্কিন গালচ। তর্কাতীতভাবে পৃথিবীর দীর্ঘতম সরু স্লট ক্যানিয়ন। লম্বায় পনেরো মাইল মতকিছু কিছু জায়গায় পাথরের উপর দিয়ে যেতে হবে, কিছু কিছু জায়গায় এত সরু যে পিঠে ব্যাকপ্যাক নিয়ে হাইক করা কঠিন। অথচ এত সুন্দর স্লট ক্যানিয়ন খুব কমই আছে গোলাপি, বেগুনি, লাল, কমলা কত ধরনের রঙের খেলা এই ক্যানিয়নে। ড্যানি বয়েলের ১২৭ আওয়ার সিনেমার কথা মনে পড়ে সেই যে ছেলেটার  একটা হাত স্লট ক্যানিয়নের মধ্যে আটকে গিয়েছিল আর তারপর ১২৭ ঘণ্টা থাকতে হয়েছিল ওই ক্যানিয়নের মধ্যে! আর শেষমেশ হাত কেটে বেরিয়ে এসেছিল ওটা ছিল ব্লু জন ক্যানিয়ন বাকস্কিন গালচ অনেকটা এইরকমই অয়্যার পাস ট্রেল হেড থেকে শুরু করতে হবে আমাদের ট্রেকিং সেই যে বিখ্যাত ওয়েভ এর ছবি আমরা দেখি, ইন্টারনেট-এ, উইন্ডোজ-এর ওয়ালপেপারে, সেই ওয়েভ-এ যেতে গেলেও এই ট্রেল হেড থেকেই যেতে হয় তার জন্য দরকার পারমিট সে পারমিট পাওয়া খুবই ভাগ্যের ব্যাপার আমরা এবারে লটারিতে নাম দিই নি তাই ওদিকটা যাওয়া যাবে না কিন্তু এই জায়গায়টাও কোন অংশে কম সুন্দর নয় মেঠো রাস্তায় ধুলো উড়িয়ে আমাদের গাড়ি চলছে অ্যারিজোনা-উটা সীমান্ত বরারর এদিকটা বেশ রুক্ষ ছোট ছোট টাম্বলউইড গাছ এদিক ওদিক চোখে পড়ছে একটা শুকনো নদীর বুক পার হয়ে এলাম গাড়ি চালিয়ে ট্রেল হেডে দেখলাম লেখা আছে, ক্যানিয়নে ঢোকার আগে আকাশ দেখে নিতে হবে দূরদূরান্তেও যেন কোন কালো মেঘ না দেখা যায় হঠাৎ বৃষ্টি হলে এইসব নদীতে হড়কা বান এসে ভাসিয়ে নিয়ে যায় সবকিছু আর এই হড়কা বান যদি একটা স্লট ক্যানিয়ন এ ঢোকে তবে  আর রক্ষে নেই এখান থেকে বেরনো খুব কঠিন বলা আছে ১০০ মাইল দুরেও যদি কোথাও বৃষ্টি হয়, ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে সব কিছুই এবং খুব দ্রুত

জয় মা বলে ঢুকে পরলাম ক্যানিয়ন-এ যারা অ্যান্টিলোপ ক্যানিয়নে গেছেন তারা দেখেছেন ক্যানিয়নের অপূর্ব সৌন্দর্য এই ক্যানিয়ন ও কোন অংশে কম যায় না শুধু এখানে লোকজনের ভিড় নেই, বাণিজ্যিকতা এখনও  এখানে ছুঁতে পারেনি শুধুই প্রকৃতির অকৃপণ উদারতা এখানে এ এক অন্য গ্রহ যেন  হঠাৎ চোখে পড়ল পাথরের ওপর হলুদ রঙের ছোট্ট ফুল ফুটে আছে না মঙ্গল গ্রহ নয়, এ আমাদেরই পৃথিবী এখানেই তো  প্রাণের ছোঁয়া   কেমন যেন ঝাপসা দেখছি মনে হচ্ছে গাল বেয়ে দু ফোঁটা জল পড়ল শুকনো লাল মাটির ওপরে। নত হয়ে এলো আমার মাথা

 

****                                                    

লাস ভেগাস এ গিয়ে ফ্রেমন্ট স্ট্রিট এ যাব না তাই কি হয়। রাত দশটায় ফ্লাইট। হাতে কিছুটা সময় আছে এবারেদিল্লির মত অবস্থা হয়নি। শরীর খুব ক্লান্ত কিন্তু মন ভরপুরনিয়ে যাচ্ছি এক আকাশ অভিজ্ঞতা। সবে মাত্র মার্গারিটায় চুমুক দিয়েছি একবার, হঠাৎ করে কেউ যেন কানে ফিসফিসয়ে বলল, সিয়াটেল ? নিয়ে যাবে, আমায় ?

চকিতে ঘুরে তাকিয়ে দেখি এক লাস্যময়ী। হাতে ওই মার্গারিটা চোখে দুষ্টুমি খেলা করছে মৃদু হাসলাম


ফুলের জলসায় 

চিত্রা পাল                                            

কবি বলেছিলেন ফুলের জলসায় নীরব কেন কবি, কিন্তু এখানে এই ফুলের জলসায় কেউ নীরব নয়, সবাই সরব। সবাই এক বাক্যে বলছে, বাঃ,কি সুন্দর।  সত্যিই এমন মন পাগল করা সুন্দর পুষ্পবনে যেদিন বিহার করেছিলাম, সেদিন মনে হয়েছিলো আমার চক্ষু সার্থক ,আমার জীবন সার্থক। এমন সুন্দর ফুলের বাগান এর নাম কুকেনহট গার্ডেন।(kukenhot Garden)অনেকে বলে গার্ডেন অফ ইউরোপ।এই বাগান আছে হল্যান্ডের আর্মস্টারডাম শহরের কাছে।

আমরা ইংল্যান্ডের হারউইচ বন্দর থেকে জাহাজে উত্তরসাগর পাড়ি দিয়ে হল্যান্ডে এসে পৌঁছোলাম মে মাসের এক সুন্দর সকালে। সেদিন দুপুরের কিছু আগে চলে এলাম এই রাজকীয় উদ্যানে যেখানে শুধুইফুল, যেদিকে চোখ যায় যতদূরে চোখ যায় শুধুই ফুলের মেলা।




আর্মস্টারডাম থেকে ১৫ মাইল দূরে ছোট্ট শহর লিস্‌। সেখানেই এই বাগান।এই বাগান টিউলিপ ফুলের জন্য বিখ্যাত। প্রত্যেক বছর এখানে ৭০,০০,০০০/- লক্ষ  বাল্ব বা গোড়া পোঁতা হয়   মাটিতে। এত রকমের এত বিচিত্র রঙের টিউলিপ যে ফোটে তা জানতাম না। আমরা বিশেষ করে বাঙ্গালীরা সাধারণভাবে টিউলিপের সঙ্গে পরিচিত নই। এখানে এসে এমন মাইলের পর মাইল টিউলিপবাগান দেখে আমরা অবাক আবার মুগ্ধও। তবে আমাদের ভাগ্যে ছিলো তাই দেখা হয়ে গেলো, কারণ বছরে মাত্র আট সপ্তাহ মার্চ থেকে মে মাসের আদ্ধেক অবধি খোলা থাকে। আমরা বাগান খোলা থাকার সময়েই এসে ছিলাম বলে দেখতে পেয়েছি।বাগান দেখার সবচেয়ে ভালো সময় সকালে সাড়ে দশটার আগে অথবা বিকেলে চারটের পরে। তো তা আমাদের হয়ে ওঠেনি। আমরা দুপুরেই বাগানে ঘুরে বেড়ালাম। অবশ্য  ওখানে মে মাসের দুপুর আমাদের কাছে খুব  আরামদায়ক।  



এই বাগান যা আমরা দেখছি তা আগে কুকেনহাম  ক্যাসেলের ফল ও সব্জি বাগান ছিলো। ১৯৪৯ সালে এভাবে ফুল চাষ শুরু হয়, আর জনসাধারণের জন্য ১৯৫০ সালে খুলে দেওয়া হয়। ব্ল্যাক টিউলিপ যা খুব কম দেখা যায়,যারবাজারে মূল্যও খুব বেশি, তাকেও প্রচুর দেখলাম। এখান  থেকে সারা পৃথিবীতে দূর-দূরান্তে টিউলিপ চালান যায়। সিলসিলা ছবিতে যে ফুলের বাগান দেখা গেছে তা এই বাগানটাই। এমন অপরূপ পুষ্পোদ্যান আজও আমার স্মৃতিতে ভাস্বর। যখনই মনে পড়ে দেখি সেই ফুলের জলসা,একরাশ অসামান্য উজ্জ্বল  টিউলিপ যা আজও আনন্দদায়ক।           

 

মুক্তগদ্য 

চা‌ বাগানের পুজোর আনন্দ

সীমা সাহা
     ‌    

পুজোর ছুটিতে  অরুন,  মধু শৌভিক, মুনমুন, ওরা বাগানে চলে এসেছে।ওদের বাবা বাগানেই চাকরি করে,তাই ছুটি পেলেই বাগানে চলে আসে।পড়াশোনার জন্য জলপাইগুড়ির একটি  স্কুলের হোস্টেলে থাকে।

বাড়িতে‌ এসে়ই মাকে জিজ্ঞেস করে,  "মা‌‌ বোনাস হয়ে গেছে ?" " বাগানে বোনাস হওয়া "  মানে আলাদা একটা  আনন্দের  জোয়ার বয়ে চলে।বোনাসের একদিন আগের সন্ধ্যা থেকেই শ্রমিক লাইনে ‌মাদল বাজিয়ে, আদিবাসী ভাষায় গানের তালে তালে  নাচের আসর বসে যায়। বাবুদের বাড়িতেও খুশির জোয়ার  চলে। কার কার বাড়িতে এবার নতুন কি কি জিনিস  কেনা হবে এটা নিয়েই বিকেলে বাড়ি বাড়ি আলোচনা চলে। সব বাড়ির ছেলে মেয়েরা পুজোর ছুটিতে বাড়ি এসেছে। ওরাও সবাই মাঠে খেলতে নেমে যায়। এমন খেলার মাঠ শহরের কোথাও  সাধারণত  পাওয়া যায় না।বাগানের চারিদিকে সবুজ গাছপালা দিয়ে ঘেরা ।সবার বাড়ির সামনেই শৌখিন সব বিভিন্ন রকম বাহারী  ফুলের বাগান।

বোনাস দেবার দিন সব বাড়ির মহিলারা তাড়াতাড়ি রান্না শেষ করেই সবাই মিলে কারো বাড়িতে বসে গল্প আড্ডায় মেতে যায়।শ্রমিকরা়ও  ওই দিনটিতে সেজেগুজে  বাগানের অফিসে  যায়  বোনাস আনতে। সেদিন ওরা কাজ থেকে ছুটি পায় । সবাইকে ম্যানেজার নিজে  ছুটি দিয়েছে। তাই সবার মধ্যেই সেদিন  খুশির জোয়ার। সব মিলিয়ে বাগানে উৎসব এর মেজাজ  শুরু হয়ে যায়।চা বাগানের কাছেই  বীরপাড়া বাজার। ওখানে হাটও বসে।তবে তাদের  কেউ কেউ  জলপাইগুড়িতেও বাজার করতে আসে । দলমোড় চা বাগানে শ্রমিক লাইনে ঘটা করে  দুর্গাপুজা হয়। বাবুরা এবং  ম্যানেজারেরা  ক্লাস বিভাজনের জন্য  ‌সে পুজোতে বড় একটা  আসে  না। পুজা দেখতে যাওয়ার জন্য বাবুদের জন্য বাগান কর্তৃপক্ষ   গাড়ি দেয় । সবাই দল বেধে সব বাড়ির স্ত্রী, কন্যা,  ছেলে, মেয়েরা সেজেগুজে গাড়িতে গিয়ে বসে।   অবশ্য  সবার বাড়ি থেকেই  চেয়ার  টুল  নিয়ে গাড়িতে বসার জন্য তোলা হতো। লরি গাড়ি কিনা, তাই।  সবাই  গল্প , গুজব, হৈহুল্লোড় করতে করতে বানারহাটে অনুষ্ঠিত  পুজো উপলক্ষে মেলায় যায়।  মেলায় যাওয়ার প্রতি  ছেলে মেয়েদের আলাদা আকর্ষণ ।  ফালাকাটায় বিসর্জনে যাওয়া দিয়ে পুজো শেষ হয় ।

এবার  লক্ষীপুজোয় সব বাড়ি ঘুরে ঘুরে খিচুড়ি ভোগ খাওয়া,  আবার  কোনো বাড়িতে পোলাও ভোগ খাওয়া মজাটাই আলাদা। তারপর আবার  কালীপুজো। বাবুরা কালিপুজো  করে  তাদের নিজেদের  কোয়াটারের সামনের মাঠে। সেই পুজো কে ঘিরে বাগানের ছেলমেয়দর মধ্যে এক অন্যরকম উন্মাদনা শুরু হয়ে যায় । মন্ডপ তৈরি করা ,প্রতিমা আনা,পুজোর আয়োজন সবকিছুইতেই মিশে থাকে  আনন্দ। সারারাত ধরে পুজো হয়।ছোটো বড়ো সবাই রাত জেগে পুজো উপভোগ করে ।সেইসময় নানা রকম ভুতের গল্প,  গানের অন্তাক্ষরী লড়াই, চুটকি সহ বিভিন্ন মজার মজার  অনুষ্ঠান নিয়ে সময় কেটে যায়। ভোরবেলা  পুজা শেষ হয় পুজো ।  সাত সকালে সবাই যে যার বাড়ি ফিরে যায় । 

বেলা ১০/১১থেকে প্রসাদ বিতরণ, ছোট ছেলে মেয়েরাই সেই দায়িত্ব পালন করে। প্রতি বছরই পুজো শেষে  পিকনিক হয়  ঐ বাগানের   মাঠে ।

এবার তো স্কুল খোলার পালা। ফিরতে হবে সবাইকে স্কুলের  হোস্টেলে। সবাই অধীর আগ্রহে  থাকে পরের বছরের ছুটির  অপেক্ষায়। 



আশ্বিনের আশা- আশঙ্কা- আকাঙ্ক্ষা

                  বিনয় বর্মন

আশ্বিন মানে আনন্দ , আশ্বিন  মানে আশা , আশ্বিন মানে আশঙ্কা !  বাতাসে হিমেল ভাব , পুজো পুজো গন্ধ ! নতুন পোশাক হবে , তাই ছোটদের আনন্দ l  সঠিক সময়ে ন্যায্য বোনাস হবে কিনা , বা আদৌ হবে কিনা ,  তা নিয়ে সংগঠিত শ্রমিকের আশঙ্কা l  অসংগঠিতদের সে আশাও নেই ,  আশঙ্কাও নেই  !

 ছোটবেলায় পুজোর গন্ধ পেতাম কাশফুল আর চাষীদের রাস্তা জুড়ে পাট শুকানো দেখে l  চাষির বাড়ির ছেলে হওয়ায় জানতাম শিল্পবিহীন কোচবিহার , দিনহাটায় পাটের মূল্য কতখানি কৃষকের কাছে। অর্থকরী ফসল বলতে তামাক আর পাট l প্লাস্টিকের সর্বগ্রাশি আক্রমণে পাটেরও সুদিন গেছে চাষিরও l এখন চাষির ছেলে  অনঅভ্যস্ত হাতে কারখানার মেশিন চালাচ্ছে গুজরাট , হরিয়ানায় ....

আশ্বিন মানে মধ্যবিত্ত গৃহকর্তার কপালে ভাঁজ l এখন আর আগের মত  থানের  কাপড় কিনে স্থানীয় দর্জিকে দিয়ে পোশাক বানানোর রীতি বিলুপ্তপ্রায়। সব কিছুই রেডিমেড l অনলাইন আর মল সংস্কৃতির আগ্রাসনে স্থানীয় ক্ষুদ্র মাঝারি ব্যবসায়ীদের নাভিশ্বাস উঠেছে l সময়ের নিয়ম l  কালের বিবর্তনে যেমন রিকশা উধাও হয়ে " টোটো " বা  "ই রিক্সা"  এসেছে , তেমনি ছোটখাটো দোকানদাররাও পেশা পরিবর্তন করছে , অথবা বৃহৎ  পুজির বিরুদ্ধে অসম লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। আশ্বিন এদেরও আশা আর আশঙ্কার মাস l

        উত্তরবঙ্গের টি , টিম্বার ,  ট্যুরিজম নির্ভর জীবনে প্রথম দুটির সুদিন অনেক আগেই অস্তমিত হয়েছে। সবেধন নীলমণি ট্যুরিজম এ চাপ বাড়ছে। প্রতিযোগিতা বাড়ছে l বাড়ছে দালাল বা ফড়েদের দাপট l বড় সংখ্যক হোমস্টের মালিকানা স্বনামে বা বেনামে বহিরাগত ব্যবসায়ীদের হাতে l ব্যবসা করা দোষের নয় l কিন্তু ট্যুরিজম ইন্ডাস্ট্রির যে মূল ভাবনা :  স্থানীয় কর্মসংস্থান ও সংরক্ষণ , তা এতে বিঘ্নিত হয় l  আর বঞ্চনা কিন্তু বিচ্ছিন্নতার ভাবনাকে উসকে দেয়  l 

         তবুও লাভ নেই জেনেও চাষী যেমন চাষ করে যায় ,  নিয়ম মেনে ফুটে ওঠে কাশফুল ,  কৈশোর উত্তীর্ণ যৌবনও পূজোর আনন্দে কদিন মাতোয়ারা হওয়ার আশায় তাকিয়ে থাকে  আশ্বিনের দিকে। সব না পাওয়া বঞ্চনা গুলো ভুলে থাকতে চায় পুজোর কদিন l বেকারত্ব  ,  উপযুক্ত কাজ না পাওয়া , দুর্নীতি , রাজনীতির পঙ্কিল আবর্তে যৌবনের অপচয়...  আশাহত করে অসংখ্য হৃদয়। কোন পেশাই অসম্মানের নয় ,  কিন্তু কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রী নেওয়া তরুণ বা তরুণীকে যখন চপ , ঘুগনি , চা বিক্রির উপদেশ দেওয়া হয় , তখন তো এই প্রশ্ন উঠবেই :  এই সমস্ত কাজের জন্য এত এত পড়াশোনার কি দরকার ?!  এই আশ্বিন কি কোন আশার বার্তা বয়ে আনতে পারবে সেইসব হতাশ যৌবনের জন্য ? বরাবর চমৎকার রেজাল্ট ,  তুখোর বাগ্মী , সপ্রতিভ ইংরেজি বলতে পারা তরুণ বা তরুণীটি যখন ৩/৪/৫ হাজার টাকার বিনিময়ে অমানুষিক পরিশ্রম করে মালিকের মুনাফা যুগিয়ে চলে ,  এই আশ্বিন কি কোন সুবাতাস বয়ে আনবে তার জন্য ? 

আশ্বিন মাতৃ বন্দনার মাস !  মাতৃরূপেন ও সংস্থিতা l  কেরিয়ারের পেছনে দৌড়ে , মা-বাবার মুখে হাসি ফোটানোর জন্য , প্রিয় মানুষটিকে আগলে রাখার জন্য , স্বেচ্ছায় সন্তানের মুখ দেখেনি যে মেয়েটি... নিঃসন্তান বলে তার দিকে তির্যক মন্তব্য ছুঁড়ে দিয়ে মাতৃ বন্দনা করার ভন্ডামি বন্ধ হবে কি এই আশ্বিনে?!



গল্প 

মমতা
সুজাতা কর


বিয়ে বাড়িতে সানাই বাজছে।চারিদিকে ব্যস্ততা।সবাই সেজেগুজে ঘুরছে।এইমাত্র বর-বউ বিয়ে সম্পন্ন করে ঘরে ঢুকেছে।আভা গয়না,বেনারসি পরে বসে আছে কিন্তু মনটা ঘুরছে তার বাবার পেছন পেছন।সারাদিন উদভ্রান্ত বৃদ্ধর মুখ যতবার চোখে পড়েছে আভার মনটা হু হু করে উঠেছে।তার বিয়ের জন্য বাবা তাঁর জমানো সব টাকা মায় বাড়ির লাগোয়া পাঁচ কাঠা জমি বিক্রি করেছে।আভা জানেনা সে শ্বশুর বাড়ি চলে গেলে বৃদ্ধ সংসার চালাবে কী করে! বাসর শেষ হল একসময়।সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।গরমে নতুন বর পাঞ্জাবি খুলে গেঞ্জি গায়ে শুয়ে পড়ল।মাঝরাত।আভা পা টিপে টিপে পাঞ্জাবির কাছে গেল।পাঞ্জাবির পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করল।দেখল টাকায় ঠাসা মানিব্যাগ।আভার মনে ঝড় চলল।কী করবে,একটা দু হাজার টাকার নোট বের করে নেবে?কাল দুপুরে বরের খাওয়াটা হয়ে যাবে।কিন্তু শেষ পর্যন্ত কী ভেবে টাকাটা নিলনা।শুধু চোখ দিয়ে দু ফোঁটা জল পড়ল মাটিতে।




গল্প দাদু
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় 

একটা গোটা হাঁসের মাংস ছিল তার পথ্য। এমনই আদেশ করেছিলেন বদ হজমের বিশেষজ্ঞ হুসলুরডাঙার  কবিরাজ মশাই। আজ কোনা ভট্টাচার্য বেঁচে নেই,  কিন্তু বামুন পাড়ার কোনা ঠাকুরের জীবনে ঘটে যাওয়া নানা কাহিনি এভাবেই সবার মুখে মুখে ফেরে।

এসব গল্প অবশ্য আমরা গল্প দাদুর মুখেই শুনেছি।  গল্প দাদুর সব গল্পই ছিল সত্যি। তিনি বলতেন," রূপকথার গল্প তেপান্তরের রূপকথায় গোটা কাহিনিই সাজানো।  সেসব গল্প  শৈশবেই শোনা মানায়।  আসল কাহিনিই  তো মানুষের জীবন। আর সেসব গল্প থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা আমাদের জীবনকে  সুন্দর করে সাজাতে পারি। "

কস্মিনকালে শরৎকালে দুর্গাপূজার আগে ঘর ঝাড়াঝাড়ির সময় হস্তরেখাবিদ কিরো'র "হস্তরেখা দর্পন" হাতে এসেছিল। একদিন  আমাকে সেটা পড়তে দেখে গল্প দাদু তার দুই হাত বাড়িয়ে দিলেন। খুব  সুন্দর  হাতের  রঙ,  সব রেখা গুলো  ও  খুব  সুন্দর।   গল্পদাদু  কেন্দ্রীয় সরকারের অফিসে কাজ করেন। হাত দেখে  যা বলি সব মিলে যায়।  গল্পদাদুও  নাছড়বান্দা, "আমার হাতে আর কি কি আছে বলো"
...আপনার রাগটা একটু বেশি,  রাগ সংবরণ না করতে পারলে,  যে কোন সময় দূর্ঘটনা ঘটে যাওয়া অসম্ভব নয়।

গল্পদাদুর সাথে পরের শনিবার  বাড়ি ফিরবার পথে  দেখা। হাতে প্লাসার,বুকে ডায়নাপ্লাস্টের ব্যান্ডেজ নিয়ে বাড়ির সামনে পায়চারি করছে।আমাকে দেখে  যেন ঈশ্বর দর্শনের মতো বসবার ঘরে নিয়ে গেলেন।  চা পর্বে একথায়  সেকথায়  বললাম,  " শুনেছি দোমহনী রেলস্টেশনে সন্ধ্যা হলেই ভুতের উপদ্রব ছিল।  ভুত পেত্নীর  ভয়ে কেউ সেখানে যেতে চাইত  না। আপনি কখনো ভুত দেখেছেন? "

"....হ্যাঁ একবার সত্যি সত্যিই ভুতের কবলে পড়েছিলাম।" গল্পদাদু   বললেন,  "তিস্তা নদীর বাঁধে থাকতেন আমাদের পারিবারিক বন্ধু স্বপন সোম।  একদিন বিকেলে  স্বপন দা ফোন করলেন,  "মা পিঠে বানিয়েছে, সন্ধ্যায় চলে এস।"

গল্পদাদু ইয়া মোটা গোঁফ আর বড় বড় চোখ করে বলে চললেন, "আমি স্বপন দা'র বাড়িতে পিঠে খাচ্ছি আর ৬৮ সালের বন্যার গল্প শুনছি।  বন্যায় চারিদিকে যখন জলে জলাকার তখন পানীয় জলের সংকট হয়েছিল। বন্যায়  বহু গবাদি পশুর সাথে   অনেক মানুষও মারা গিয়েছিল।  একই বাড়িতে ছয় জন মারা গিয়েছিল।  তাদের বডি তোলার সময় দেহ থেকে হাত, পা খুলে খুলে আসছিল, নিয়ম মেনে শ্রাদ্ধ শান্তি কারও হয় নি, হয় নি পারলৌকিক ক্রিয়া কর্ম।  সে সব ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন স্বপন দা।

ফেরার সময় স্বপন দা'র মা বাড়ির জন্য পিঠে দিয়ে দিলেন।  দোমহনী রেলস্টেশনের কাছে আসতেই আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে এল। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকারে মিটিমিটি জোনাকি জ্বলছে।  অন্ধকারের মধ্যেই এক সুবিশাল ছায়ামূর্তি।  যত কাছে যাই ছায়ামূর্তি দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে।  তার পর একটা সময়ের পরে আমার আর কিছু মনে নেই। সকালে যখন জ্ঞান ফিরলো তখন আমি বাড়ির বিছানায়। আমার তখন ধুম জ্বর, মা মাথায় জলপট্টি দিচ্ছেন। সকালে তন্য তন্য করে খুঁজেও  বাড়ির লোকজন টিফিন বক্স,আমার পায়ের জুতো জোড়া  পিঠে কোনকিছুরই হদিশ করতে পারেন নি।"

মাঝে মাঝেই গল্পদাদু 'র ফোন আসে।  আমি ও অবসর পেলেই চলে যাই গল্পদাদুর অফিসে। কেন্দ্রীয় সরকারের অফিসে সবাই কাজে ব্যাস্ত। আমি গিয়েছি তেলের  বিলের চেক আনতে।  গল্পদাদু  দুহাত বাড়িয়ে দিলেন। আর বললেন " সেবার তো জীবনের মতো বেঁচে গেলাম। আগে তোমার কাছে  আমার হাতটা দেখালে, কুনুই বুকের পাঁজর ভাঙত না।  অত  বড় দূর্ঘটনা থেকে বাঁচতে পারতাম।" 

.....কি যে করেন, চারিদিকে সিসি ক্যামেরা চলছে আর আামি হাত দেখব? 

গল্প দাদু নাছোড়বান্দা।  সাথে তার প্রায় সব অফিসের স্টাফ। সেকেন্ড রাউন্ড চা এর কাপ নামিয়ে দিয়ে চাপরাশি বলে গেল,' যাবার সময় চিফ ইন্জিনিয়ার সাহেবের হাতটা একটু দেখে দিয়েন।'

তারপর অফিসে তেলের বিলের তাগাদা করতে গেলেই একঝাঁক হাত আমার সামনে আসত। তাদের হাত দেখার ভয়ে পরে  ওই অফিসে যাওয়াই কমিয়ে দিয়েছিলাম।




অপারেশন সাকসেসফুল 
              মৌসুমী চৌধুরী       

      প্রথম দিন অয়নদের বাড়ির চৌহদ্দির বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে করে ফিরে গিয়েছিল সুরভি। অয়নকে একবার দেখবার জন্য অনেক কাকুতি মিনতি জানিয়েছিল সে।  কিন্তু তাদের বাড়ির দারোয়ানেরা সুরভিকে ঢুকতে দেয় নি। 
       কিছুদিন থেকে ডায়ালিসিস চলছে অয়নের। গত সপ্তাহে ডাক্তার জানিয়ে দিয়েছেন তার দুটি কিডনিই নষ্ট হয়ে গেছে !  প্রাণ বাঁচাতে কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট ছাড়া আর কোন উপায় নেই। তাই হন্যে হয়ে তাঁর একমাত্র সন্তানের জন্য কিডনি ডোনার খুঁজে চলেছেন বিজনেস টাইকুন অর্ণব রায়।
           তাই আজকের ছবিটা এক্কেবারে আলাদা। অর্ণব রায়ের কেয়ারি করা সুইমিং- পুলের ধারে ঘাড় বাঁকিয়ে বসে আছে সুরভি। পরনে হলুদ রঙের ওপর বেগুনি ফুলছাপ সস্তার সালোয়ার-কুর্তা। এইসব গ্রাসরুট লেভেলের লোকেদের সঙ্গে কথা বলা দূরে থাক, এদের দিকে তাকাতেও ঘৃণা বোধ করেন অর্ণব রায়। কিন্তু বিধি বাম! ছেলে অয়ন বিজনেস ম্যানেজমেন্ট না পড়ে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সোস্যাল ওয়ার্কে ব্যাচেলর এবং মাষ্টার ডিগ্রি করল। তারপর থেকে তাঁদের "রায় অ্যান্ড সন্স ফার্মাসিউটিক্যাল" মেডিসিন ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানির সোস্যাল ওয়ার্ক বিভাগটা অয়নই দেখাশোনা করে। আসলে সোস্যাল ওয়ার্ক বিভাগটা তো শিখন্ডি মাত্র। সরকারকে দেয়-ট্যাক্স বাঁচাবার ফিকির মাত্র। কিন্তু কে শোনে কার কথা, ছেলে তার সত্যি সত্যি দেশোদ্ধার করে বেড়াচ্ছে। সেই সুবাদেই বস্তির মেয়ে সুরভির সঙ্গে অয়নের পরিচয় আর ভাব-ভালোবাসা!  যত্তসব!!!
        মিঃ রায়ের চোখের দিকে সোজাসাপটা  তাকিয়ে সুরভি বলে, 
—" দেখুন, আমি অয়নকে ভালোবাসি। আমার আর অয়নের ব্লাড গ্রুপ এক, আমি জানি। অনেকবার আমরা একসঙ্গে রক্তদান করেছি।  আমি একটি কিডনি অয়নকে দেব। তাহলে আমরা দু'জনেই বেঁচে থাকতে পারব এ পৃথিবীতে । তা বাদে আপনি বা আপনার সম্পত্তি বিষয়ে আমার কোন রকম আগ্রহ নেই।"
— " হ্যাঁ হ্যাঁ, তোমার কথা তো খুব শুনেছি, মা। তোমার তো মা-বাবা নেই। আমার ছেলে সুস্থ হয়ে উঠলে তোমাদের চারহাত এক করে দেব আমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে। আমার বাড়িতে বৌ নয়, মেয়ে হয়ে আসবে তুমি।"
            প্রায় সাত ঘন্টা পর অপারেশন থিয়েটারের লাল আলোটা নিভে গেল। বেরিয়ে এলেন ডঃ সেন। হাসি মুখে বললেন,
—" অপারেশন সাকসেসফুল। দুটো কিডনিই ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা হয়ে গেছে। আপনি বডিটার ব্যবস্থা করুন।"
স্মিত মুখে মিঃ রায় বললেন,
— " চিন্তা করবেন না। বাকী সবটা আমি সামলে নেব।"
     তারপর অর্ণব রায়ের অ্যাকাউন্ট থেকে একটা মোটা অঙ্কের টাকা ট্রান্সফার হল ডঃ সেনের অ্যাকাউন্টে। আর একটা বড় দুর্ঘটনায় বাসের চাকার তলায় খুঁজে পাওয়া গেল সুরভির মৃতদেহ!



কবিতা 

শরতের ক্যানভাসে মায়ের পরশ
         রীনা মজুমদার

অষ্টমীর চাঁদকে টোকা দিয়ে
   দেখেছ কখন?
দুঃখের সাগরকে শান্ত করে, কেমন
ছড়িয়ে পড়া সে জোছনা!

আঁধারে দেবীর নাকছাবি দ্যুতির পরশ
   পেয়েছ কখন?
অন্তরের প্রেমকে মানবিক করে, কেমন
 ছড়িয়ে পড়া সে আলো!

শরতের আকাশকে তুলিতে এঁকে
     নিয়েছ কখন?
রিক্ত হৃদয়কে সিক্ত করে, কেমন
  ছড়িয়ে পড়া সে রঙ!

সন্তানপিঠে রমনীর হাতে বীজধান
     কুড়িয়েছ কখন?
মেদিনীর বুককে বিকশিত করে, কেমন
   ছড়িয়ে পড়া সে দানা!  

দশমীর পান্তাভাতেই তো থাকে
   বিজয়ার আশিস গাঁথা...
জীবনের ক্যানভাসে থাকে সব ঋতুই

     তবু শরতের আঁচলে যেন
       নিজের মা'য়েরই পরশ।




আবাহন
সৈকত দাম

" যা দেবী সর্বভুতেষু শক্তি রূপেণ সংস্থিতা "
ফারজানার বুকে তখনো জ্বলছে 
নবমী নিশির সন্ধ্যা প্রদীপ .....
তখনো ধোঁয়ার উদ্গীরণ জ্বালিয়ে দিচ্ছে চোখ ,
সুগন্ধি ধুনোর আবেশ ভীষণ জড়িয়ে রয়েছে তাকে ...
ফারজানা আকাশের দিকে দেখে নেয় এক ফাঁকে ......
একটা মুক্ত আকাশে খেলছে মেঘের শাবক ....
" হ্যালো ফারজানা, কোথায় তুমি ?
চলে এসো, আমি এখন শ্রীভূমি ....... "
দেবী প্রিন্টের শাড়ি পরে দাড়ায় এসে কাছে ,
এতোটা কাছে, যতোটা কাছে উপগ্রহের ধুলো .....
এতটা কাছে, যতোটা কাছে নিশ্বাস রাখা আছে .....
বেরহেম পৃথিবী তবে শেষ করেনি তাকে ,
আগের মতোই ফারজানাকে বেশ সুন্দর লাগে .....
ফারজানা এভাবেই তুমি কাঁটাতার ভেঙ্গে এসো,
ফারজানা এভাবেই তুমি ব্যারিকেড ভেঙ্গে এসো,
শক্তি এসো, সত্যি এসো,
এসো ভিনদেশি তারা হয়ে ......
বিসর্জিত হৃদয়ের জলে দেখবো তোমার মুখ ....
দুরন্ত এক কিশোরীর মতো বুকে ,
আমাকে পাবার সুখ .......
হয়তো অন্য মাটিতে মূর্তি গড়েছি আমি ......
বেনকাব সেই চোখের কালোতে আটকে রয়েছে মন ,
বটের পাতায় করিনি আমি শক্তির আবাহন ........



স্মৃতি আঙিনায় - স্বপ্ন গোলাপ 
সারণ ভাদুড়ী 

স্মৃতি আঙিনায় আজ ফুটেছে আমার স্বপ্নের গোলাপ,
 বেরঙিন জীবনকে রাঙিয়ে দেওয়ার জন্যই
 আজ তা ফুটেছে।
স্মৃতির আঙিনায় আজ ডানা মেলেছে কত প্রজাপতি
অথচ ক্ষণিক আগেই এটা ছিল 
এক ধ্বংসস্তূপ !
হ্যাঁ বিস্মৃতি- বেদনা- বিমূঢ়তার স্তুপ
যেখানে আজকের ফোটা স্বপ্নের গোলাপ
পড়ে ছিল শুকনো হয়ে.....



বন্ধু পরস্পর জীবনঘনিষ্ঠ 
মজনু মিয়া 

লোহা কাষ্ঠ বন্ধু হয়ে গভীর জলে ভাসে 
আশা নিরাশায় তারা পাশাপাশি হাসে।
জলের সাথে মাছের পিরিত জনম জনম হয়
জল বিনে যে মাছের মরণ সর্ব লোকে কয়।
গাছের সাথে লতার বন্ধু জড়িয়ে থাকে বুকে
ঝড় তুফানেও আগলে রাখে সুখে কিংবা দুখে।

বন্ধু তুমি আমার বন্ধু হৃদ আসনে থেকো
আপদ বিপদ সুখ, সুখে কাছে পাশে ডেকো।



গীতিকার্নী
অঞ্জলি দেনন্দী

বাংলার নদীর তীরে
জন্মে জন্মে জন্মে আসি 
ফিরে ফিরে ফিরে।
বাংলার মাটি
আমি বড় ভালোবাসি।
বাংলার বায়ু চির খাঁটি।
এর শুদ্ধ জল
দেয় অনন্ত বল।
আলো এর অশেষ।
এ আমার প্রিয় দেশ।
বাংলায় গান গাই।
অমরত্ব পাই।
কত কত কত 
দেশে দেশে দেশে যাই।
এ দেশের মত 
এমন দেশটি আর নাই।
সেরা দেশ এ দেশ তাই।
আমি বাংলার প্রাণ।
আমার এ জীবন বাংলারই দান।
বাংলা আমার আত্মসম্মান।
এই বাংলাতে জন্মেছি আমি।
প্রার্থনা করি, হে অন্তর্যামী!
বাংলার বুকে
মরণ হয় যেন সুখে!
আমার বাংলা গান যেন থাকে
সকলের মুখে মুখে মুখে।
মৃত্যুর পরেও যেন 
এ বাংলা আমায়
নিজেদের অন্তরে রাখে!
আমার বাংলা গান যেন 
কেউ না থামায়!
আমার সৃষ্টি যেন 
যুগে যুগে যুগে প্রেমাশ্রু নামায়!




প্রবন্ধ 

শিশুশ্রম বর্তমান আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় চরম লজ্জার
বটু কৃষ্ণ হালদার

সাল ২০২২,স্বাধীনতার ৭৫ বছর অতিক্রান্ত,দেশ আধুনিক সভ্যতার আঙিনায় পা রেখেছে।অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যাবহারে ভারত বর্ষ ডিজিটাল ইন্ডিয়া তে রূপান্তরিত হয়েছে।কিন্তু আদপে ভারত বর্ষ কি সত্যিই সভ্য হয়ে উঠেছে? কারণ যে আধুনিকতার রঙে আমরা সবাই রঙিন হয়ে উঠেছি সেই সভ্য সমাজের মুখোশের পেছনে রয়েছে আরও একটি অন্ধকারের বিভীষিকা ময় রূপ। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর এবং সেটি হল আমাদের সমাজের জ্বলন্ত সমস্যা গুলির মধ্যে অন্যতম ও গুরুত্বপূর্ণ।সেই  জ্বলন্ত সমস্যার নাম শিশু শ্রম।দেশ স্বাধীন তার প্রায় ৭৫ বছর অতিক্রান্ত, দেশের সরকার বারবার এই জীবন্ত সমস্যার উপর আলোকপাত করলেও রাস্তার পাশের ছোট ছোট দোকান ,ইটভাটা ,হোটেল চাষের ক্ষেত বিড়ি বাধা, বোতল কুড়ানো, গৃহভিত্তিক কর্ম,রাজমিস্ত্রি জোগাড়ে,এমনকি ভিক্ষা করতে  ছোট ছোট শিশু দের ব্যাবহার করা হচ্ছে। ছোট ছোট শিশুদের দিয়ে ভিক্ষা করানোটা আজকাল ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। তাতে বহু ক্ষেত্রে দেখা গেছে রাজনৈতিক অনেক রথি মহারথীরা যুক্ত রয়েছেন। বিটিশা প্রায় ২০০ বছর যাবত আমাদের ভারতবর্ষকে লুণ্ঠন করে তাদের সন্তানদের মুখে তুলে দিয়েছে সোনার চামচ, আর আমাদের দেশের সন্তানরা জন্ম নিচ্ছে মাথায় ঋণের বোঝা নিয়ে।তবে স্বাধীনতার পরে শিশু শ্রমের বিরুদ্ধে নানা আইন তৈরি হলেও তার হয়ে গেছে খাতা কলমে। ব্রিটিশরা যেটুকু ভারতবর্ষে রেখেছিল তা বর্তমান সময়ে আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতারা লুটেপুটে খাচ্ছে। তাতে ভারত বর্ষ আরো গরীব দেশে পরিণত হচ্ছে।বেড়ে চলেছে শিশু শ্রমের সংখ্যা।শিশু শ্রমের বিরুদ্ধে নানান আইন তৈরি হলে তা খাতা কলমে লিপিবদ্ধ হয়ে রয়েছে।
মানব জীবনের অনেকটা অংশ জুড়ে রয়েছে শৈশবের অবস্থান।এই বয়সে তাদের হাসি খেলা এবং পড়াশোনা নিয়ে থাকার কথা সেই বয়সে তারা হয়ে উঠছে কর্মমুখী। অথচ এই শিশুদেরকে বলা হচ্ছে আগামীর ভবিষ্যৎ।কর্মমুখী হওয়ার ফলে বহু শিশুদের প্রতিভা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ঠিকঠাক মতো ভাবে পরিচর্যা করলে হয়তো দেখা যেত ওই সমস্ত শিশুগুলোর মধ্যে দিয়ে কেউ কেউ দেশের মুখ উজ্জ্বলকারী সন্তান হয়ে উঠতে পারতো। কিন্তু
 সমাজের বুকে জায়গা করে নিচ্ছে শিশু শ্রমিক হিসেবে। আর এইসব শিশু শ্রমিকদের কাজে লাগিয়ে মুনাফা লুটছে একদল স্বার্থান্বেষী মানুষ। তারা তাদের কম পয়সা দিয়ে অথবা দুবেলার খাবার দিয়ে অমানুষিক পরিশ্রম করিয়ে নিচ্ছে।
২০১৯ এর করানো মহামাড়িতে দেশে লকডাউন চলতে থাকায় বন্ধ ছিল সমস্ত মানুষের রোজগার। উল্লেখযোগ্যভাবে বন্ধ ছিল স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়। 
যার ফলে অনেক ছোট ছোট পড়ুয়ায় পড়াশোনার ব্যাগ কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে শিশু শ্রমিক হিসেবে যোগ দেয় বিশেষত ফুটপাতের দোকানগুলিতে। পরবর্তীকালে বিদ্যালয়ে খুললেও আর বিদ্যালয় মুখী হয়নি সেই সব ছেলেমেয়েরা। তারা শিশু শ্রমিক হিসেবে থেকে গেছে সমাজের বুকে।শিশুদের দিয়ে কাজ করানো বন্ধ করার জন্য আমাদের দেশে রয়েছে বিভিন্ন আইন, রয়েছে শিশু সুরক্ষার জন্য বিভিন্ন কমিটি। 
উল্লেখ্য, বর্তমানে সরকার এই শিশুশ্রমকে বন্ধ করার জন্য আইন করে ১৪ বছর বয়সের কম শিশুদের দিয়ে কাজ করানো বেআইনি বলে ঘোষণা করেছে।তাতে ও চাইল্ড রাইটস অ্যান্ড ইউ,র তথ্য অনুযায়ী শিশু শ্রমিকদের যে পরিসংখ্যান সামনে এসেছে তা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত লজ্জাজনক।সমগ্র ভারতে ৫_১৮ বছরের প্রতি ১১ জন শিশুর মধ্যে একজন শিশু শ্রমিক।১৫_১৮ বছরের শিশুদের পাঁচ জনে একজন শ্রমিক।২০০১_২০১১ সালের মধ্যে শহরের শিশু শ্রমিক বেড়েছে ৫০ শতাংশ। গ্রামাঞ্চলে সেই পরিসংখ্যান আরো ভয়ংকর, প্রায় ৮০ শতাংশ।২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গে পাঁচ থেকে চোদ্দ বছরের শিশু শ্রমিক ছিল প্রায় সাড়ে ৫ লক্ষ।কিন্তু তবুও আইন লঙ্ঘন করে এই কাজ করে চলেছে অনেকে।যার ফলে নষ্ট হচ্ছে শিশুদের ভবিষ্যৎ ভেঙে পড়ছে আমাদের জাতির মেরুদন্ড।
আমাদের সকলেরই জানা ভারতবর্ষের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশে এই সমস্যা সমাধান করা অত্যন্ত কঠিন একটা কাজ।কিন্তু কোন কাজই কঠিন হবে না যদি আমরা সকলে মিলে একসঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে এবং এই বিষয়ে সচেতন হওয়াটা খুবই জরুরী।কিন্তু আমরা যদি এখন থেকে শিশুশ্রম এর মত একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে ছোট ঘটনা বলে এড়িয়ে যেতে থাকি তবে ভবিষ্যতে এর জন্য আমাদেরকে বড় মূল্য দিতে হবে। পঙ্গু হয়ে পড়বে আমাদের ভারত বর্ষ।কারণ শিশুরাই হল জাতির ভবিষ্যৎ। সেই ভবিষ্যৎকে আমরা যদি ঠিকমতো সুরক্ষা দিতে না পারি তবে ভবিষ্যতে আমাদের জন্য বড় অভিশাপ অপেক্ষা করছে।তাই ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আমাদের উচিত এই জঘন্য ক্রিয়াকলাপ অর্থাৎ শিশু শ্রমিক দিয়ে কাজ করানো বন্ধ করা। তবেই ভবিষ্যতে আমরা সোনার ভারতবর্ষ গড়তে পারব।এখন ই করো,শিশুশ্রমের সমাপ্তি এই সংকল্প নিয়েই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। আর যারা শিশুদেরকে দিয়ে শ্রম করানোর চেষ্টা করছে তাদের বুঝতে হবে তাদের ঘরের সন্তান আর যারা শ্রম করছে তারাও এই ভারতবর্ষের সন্তান। আর বুঝতে হবে যতদিন শিশু শ্রমের মত সামাজিক ব্যাধি এই দেশ থেকে ধ্বংস না হচ্ছে ততদিন ভারতবর্ষ কখনোই সোনার ভারতবর্ষ হয়ে গড়ে উঠতে পারবে না।
দা ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন ২০০২ সালে বিশ্ব শিশু শ্রম বিরোধী দিবস হিসেবে আজ অর্থাৎ ১২ই জুন কে বেছে নিয়েছিল।সেই থেকে পালিত হয় আসছে আজকের এই দিন।এখনো সারা বিশ্বে প্রায় ১৫২মিলিয়ন শিশু শ্রম করে ।আন্তর্জাতিক স্তরে তাই ক্যাম্পেন করে শিশুদের দিয়ে কাজ করানো টা যে অপরাধ তার প্রচার ও প্রসার হয়ে চলেছে সারা বিশ্ব জুড়ে। আর্থিক অবস্থা খারাপ থাকার জন্য অসংখ্য বাবা মা তাঁদের শিশুদের কাজ করতে পাঠায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে।যা একেবারেই প্রযোজ্য নয় ।শিশুদের দ্বারা শ্রম দণ্ডনীয় অপরাধ জেনে ও আজ ও চলছে এই শিশুদের নিয়ে কাজ করানোর প্রবণতা।আইনের ঊর্ধ্বে ফাঁক ,তাই এই ধরনের সমস্যা আজও দেখতে পাওয়া যায় সামাজিক দৃষ্টি ভঙ্গিতে নজর রাখলেই অনুমেয়।
আজ একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে আমরা এখনো শিশুদের খাটনি চায়ের দোকানে,হোটেল রেস্টুরেন্টে, চলচ্চিত্রে প্রমুখ স্থানে শিশুদের পরিশ্রম করতে দেখতে পেলেও প্রতিবাদ করতে পারি না।এই প্রতিবাদ যেদিন কলরবে উচ্চারিত হবে সেদিন আমরা হয়ত আমাদের লজ্জা কে ঢাকতে পারবো।এই বিশ্বে মন ভালো করার সবথেকে সুন্দর জিনিস হল শিশুর হাসি।তাদের কে প্রাণ খুলে খেলতে,হাসতে দিন।ওরা ও এই ধরিত্রীর অমূল্য সম্পদ।ওদেরকে প্রাণ খুলে বাঁচার সুযোগ করে দিন।বিশ্বের সকল শিশু শ্রমের সাথে যুক্ত ক্ষুদেদের প্রতি সমবেদনা জানাই,আর এর পরিবর্তনের উদিত সূর্য্যের অপেক্ষায় রইলাম।
সর্ব ধর্ম সর্বধর্ম সমন্বয়ের দেশে ১২ মাসে ১৩ পার্বণের উৎসব রেশ সর্বদা বজায় থাকে। এই উৎসবগুলো পালন করতে লক্ষাধিক টাকা এমনকি কোটি কোটি টাকা ও ব্যয় করা হয়। যে দেশে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে উৎসব পালন হয় সেই দেশে শিশু শ্রমিকের হার বেড়ে চলা, কিংবা ছোট ছোট শিশুরা দুই হাত পেতে ভিক্ষা করার চিত্র কি সামাজিক লজ্জা নয়? এ সমস্ত ঘটনাগুলো কি আমাদের বিবেককে নাড়া দেয় না? মনে রাখবেন এই সামাজিক লজ্জা শুধু আমার আপনার নয় সমগ্র ভারতবাসীর? তবে যে যার মত করে উৎসব পালন করুন, সেই উৎসবে ওই অসহায় শিশুগুলোকে আলোর রোশনাই ও প্রাণোচ্ছল জীবন থেকে দূরে সরিয়ে দেবেন না। তাদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিন।



রম্যরচনা 

রসিক চোর 
স্বপন কুমার দত্ত  

সেদিন ছিল পূর্ণিমার রাত। সমস্ত চরাচর ভেসে যাচ্ছে, চাঁদের শুভ্র আলোয়। ঘরে সবাই ব্যস্ত ধন সম্পদের দেবী লক্ষ্মী দেবীর পূজা অর্চনায়।
              এদিকে হয়েছে কি, এক চোর সুযোগ বুঝে বেরিয়েছে চুরি করতে। ও চিন্তা করেছে, এখন তো সবাই ব্যস্ত, এই সুযোগে হাতানো যাক বেশ কিছু মাল। যেমন ভাবা তেমন কাজ।ঢুকে পড়েছে,এক গেরস্থের রান্নাঘরে। একটা বস্তায় বেশ কিছু বাসনপত্র  ভরার সময় হাত ফসকে একটা কাঁসার বাটি পড়ে গিয়ে ঝন ঝন করে শব্দ হওয়ায় " কে রে" " কে রে"  করায় বাড়ির লোকজন তেড়ে আসে। আর কপাল খারাপ থাকায় একেবারে ধরা পড়ে ' বামাল অবস্থায়' ।
এমন সময়, ওই বাড়ির এক কিশোরী আপন মনে গেয়ে ওঠে, " মার ঝাড়ু মার, ঝাড়ু মেরে ঝেঁটিয়ে বিদেয় কর"। মনে হয়, কিছুদিন ধরে ও ঐ গানটাই করছিল রেওয়াজ।
                কিন্তু এদিকে তো চোর বাবাজীও একাধারে রসিক ও সঙ্গীত প্রেমিক তা জানা ছিল না।আড়ঙ্গ ধোলাই খাবার ভয়ে সঙ্গে সঙ্গে সে গেয়ে ওঠে, " পাখিটার বুকে যেন তির 
মেরোনা, ওকে পালাতে দাও".......
                এবার এগিয়ে এলেন, স্বয়ং গৃহকর্তী। এগিয়ে এসে বললেন, " বহুদিন ধরে তক্কে তক্কে
ছিলাম। এবার তোকে পেয়েছি, হাতেনাতে ধরেছি ।সুর করে গাইলেন, " আর কি আমি
ছাড়বো তোরে ..... জোর করে রাখিব ধরে।"
               রসিক চোর আবার আশ্রয় নেয় গানের। " যদি আমায় তুমি বাঁচাও, তবে তোমার নিখিল ভুবন ধন্য হবে।"
                ইতিমধ্যেই জমায়েত হয়েছে, অনেক লোকের।এক একজনের মন্তব্য এক একরকম।
" বেঁধে রাখো সারারাত গাছের সঙ্গে", কেউবা " না না পুলিশে খবর দাও" আবার কেউ বলে, " ওসবে লাভ নেই। কিছুইতো নিতে পারেনি,বরং দুচার ঘা মেরে করে নাও হাতের সুখ।"
                এবার চোর দেখলো বেগতিক। যেভাবে বাক্য বান তার দিকে ছুটে ছুটে আসছে, তাতে কতক্ষণ আস্ত থাকা যাবে, তার কোন ঠিক নেই। এখন একমাত্র ভরসা, সেই সুর সাধক রবীন্দ্রনাথ। তাই নিরুপায় হয়েই আবার আশ্রয় করতে হল তাকে । " এই কথাটি  মনে রেখো, তোমাদের এই হাসি খেলায়, আমি যে গান গেয়েছিলেম জীর্ণ পাতা ঝরার বেলায়।"
               এবার গৃহকর্তার পালা। সেতো ভীষণ ক্রুদ্ধ। হাতে গরম জিনিষ যখন পাওয়া গেছে, তখন ছাড়ার প্রশ্ন কেন? তিনিও গেয়ে উঠলেন, " যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক, আমি তোমায় ছাড়বোনা।"
                 রসিক চোর শেষ চেষ্টায় আবার শুরু করে গাইতে, " বাঁচাও কে আছ, মরেছি যে চুরি করে।" কিন্তু না, এইসব সুরেলা  গানেও  টললো না কারোর মন।ডাকা হল, মুঠোফোনে পুলিশকে। সেই এসব ঝামেলা সামলাক।
                 অল্পক্ষণের মধ্যেই হাজির হল  পুলিশ । পুলিশ বাড়ির কম্পাউন্ডের  বাইরে তার পুলিশ বাহিনী নিয়ে দাঁড়িয়ে। অনুমতি না পেলে কিভাবে ঢুকে ভেতরে । তাই সেও চাইল গানের মাধ্যমে অনুমতি। " খোলো খোলো দ্বার, রাখিও না আর বাহিরে আমায় দাঁড়ায়ে/ দাও সাড়া দাও, এইদিকে চাও,এসো দুই বাহু বাড়ায়ে।"
                পুলিশ তার গতানুগতিক জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলেন।তারপর বামাল ধরা পড়ায় আর অন্য কিছু চিন্তা না করে সেই রাতে লকআপে রেখে পরদিন চোরকে চালান করলেন--- আদালতে।
সঙ্গীতানুরাগী চোর পরদিন আদালতের কাঠগড়ায়।
বিচারক -----  তুমি চুরি করেছ?
চোর ----- না হুজুর, চেষ্টা করেছি, সফল হইনি। আর সেও কবিগুরুর নির্দেশ পালন করেছি শুধু।
বিচারক __ তার মানে ?
চোর ----- গতকাল মাঝরাতে একটা গান ভেসে আসছিল,---- " আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে।" তাই ভাবলাম, আমিই বা বসে থাকি কেন? আমিও যাই, তাই বেরিয়ে পড়লাম।
বিচারক --- তারপর?
চোর ----    একটি গেরস্তর বাড়ি থেকে আওয়াজ এলো,-- " এসো এসো আমার ঘরে,এসো আমার ঘরে" আর কী, সাথে সাথে ঢুকে পড়লাম।
বিচারক --  বটে তারপর ?
চোর -----    ঘরে ঢুকে শুনেছিলাম, --- " ঘরেতে ভ্রমর এলো গুনগুনিয়ে"। খানিকটা পেলুম আনন্দ। তারপর ভেসে এলো--- " এবার উজাড় করে লও হে আমার যা কিছু সম্বল।" কবিগুরুর নির্দেশ অমান্য করা যায় না। সব মালপত্র বেঁধেছি। সঙ্গে সঙ্গে কানে ভেসে এলো,--- " আজ দখিন দুয়ার খোলা।'
বিচারক ----  তুমি তো খুব ধুরন্ধর হে। তারপর?
চোর ----      তারপর আর কী! হুজুর কত অনুরোধ করলাম, আমায় আটকে রেখোনা।আমিতো চুরি করতে পারিনি। গাইলাম," ছেড়ে দাও আমায় ধরোনা"। কিন্তু না: ,ওরা শুনলনা, তুলে দিল পুলিশের 
হাতে।
বিচারক --     তা তোমাকে পুলিশে না দিয়ে কী করবে ?তুমি কী চেয়েছিল জামাই আদর?
চোর  --          না হুজুর, আমি পুলিশকে কত বোঝাবার চেষ্টা করলাম, আমি তো চুরি করিনি।শুধুমাত্র
রবীন্দ্রনাথের নির্দেশ পালন করতে চেষ্টা করেছি। তো ব্যাটা বোধহয়, নামই শোনেনি রবীন্দ্রনাথের। সোজা আপনার কাছে নিয়ে এসেছে।
বিচারক ----   ঠিক আছে, তোমাকে ছয় মাসের সাজা দিলাম চুরির চেষ্টার অপরাধে । এই বিষয়ে তোমার
রবীন্দ্রনাথ কিছু বলেছেন?
চোর ----       '" এ পথে আমি যে গেছি বারে বার, ভুলিনি তো একদিনও।"
বিচারক ---    তোমার কোন পরিবর্তন নাই। এই সাজা ঘোষণার পরও তুমি নির্বিকার!
চোর --          হুজুর " এই করেছ, ভালো নিঠুর হে, এই করেছ ভালো।";
বিচারক ---     জেলে যখন থাকবে, তখন তোমার রবীন্দ্রনাথ কী বলবে?
চোর ---          কেন ? " ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে?"


ছবি


শৌভিক কার্য্যি 


















চিত্রাক্ষী রায় 





























মুজনাই অনলাইন আশ্বিন সংখ্যা ১৪২৯