দশমীর দিন বিকেল ৩টা থেকেই উত্তেজনার পারদ তুঙ্গে উঠতো, কারণ শুরু হয়ে যেত অপেক্ষার পালা, কখন একের পর এক গাড়ি দুর্গা প্রতিমা নিয়ে পাড়ি দেবে ফালাকাটার মুজনাই নদীর বিসর্জন ঘাটের উদ্দেশ্যে। আমাদের বাড়িটি যেহেতু বীরপাড়া-ফালাকাটা সড়কপথের একেবারে পাশেই, বারান্দায় অপেক্ষা করতাম কখন দূর থেকে ঢাকের আওয়াজ শুনতে পাবো। শেষপর্যন্ত অপেক্ষার পালা সাঙ্গ করে হৈ হৈ করে চলে আসতো প্রতিমার ট্রাকগুলো। প্রতিটি ট্রাকে ঠাসাঠাসি করে লোকজন। পুরুষ, মহিলা, বাচ্চা নির্বিশেষে সে কী আনন্দ! সব ট্রাক থেকেই চিৎকার ভেসে আসতো, "দুর্গা মা কি, জ-য়। আবার কবে, বছর পরে!" কাঁসর ঘন্টা সহযোগে ঢাক বাজতো তুমুল আওয়াজে। রীতিমতো জমজমাট এক আবহ। কিন্তু বলতে দ্বিধা নেই, বহিরঙ্গের এই উৎসবমুখর পরিবেশের গভীরে ছিল অসম্ভব এক বিষাদের সুর, কারণ আবার সেই গোটা একটি বছরের অপেক্ষা। ভেতরে ভেতরে মনটা যে কী খারাপটাই লাগতো, তা আর বলার নয়। পুজো শেষ মানে তো আর শুধু পুজো শেষ নয়, বিশ্বকর্মা পুজোর সময় থেকে যে শুরু হয়েছিল দিন গোনার পালা, মহালয়া, তারপর একে একে পঞ্চমীর সন্ধ্যায় প্রতিমা আসা থেকে শুরু করে, ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী পেরিয়ে শেষপর্যন্ত এই বিষাদের দশমী। যাহোক, মনের গভীরের বিষাদকে বিস্তৃত হতে না দিয়ে, আমরাও নতুন জামাকাপড় পরে, বাড়ি তালাবন্ধ করে একছুটে পৌঁছে যেতাম পেছনের বল খেলার মাঠে, কারণ ইতিমধ্যেই সেখানে উপস্থিত হয়ে পড়েছে আমাদের বাস, যে বাসে চড়ে আরেকটু পরেই আমরা রওনা দেব ফালাকাটা বিসর্জন ঘাটের উদ্দেশ্যে। শুধু তো বিসর্জন ঘাটে গিয়ে প্রতিমা বিসর্জন দেখা নয়, ওদিকটায় দেখা হয়ে গেলে পায়ে পায়ে পৌঁছে যাওয়া মেলার মাঠে। যেসব বাড়ির বড়দের ও ছেলেমেয়েদের বাসে চড়ে যাওয়ার পরিকল্পনা থাকতো, সেসব মানুষজনের আসা সম্পন্ন হতেই বাস ছেড়ে দিত ফালাকাটার উদ্দেশ্যে। রাস্তায় বিক্ষিপ্তভাবে প্রতিমা নিয়ে যাওয়া দুতিনটি ট্রাকের দেখাও মিলতো। দলগাঁও চা বাগান, তাসাটি চা বাগান, জটেশ্বর পেরিয়ে আমরা শেষপর্যন্ত ফালাকাটার কাছাকাছি পৌঁছে যেতাম। উত্তেজনার আঁচ পাওয়া যেত অনেক আগে থেকেই। রাস্তার দুপাশে শতসহস্র মানুষ, সবার গন্তব্যস্থল হয় মুজনাই নদীর বিসর্জন ঘাট অথবা মেলার মাঠ। আমরা স্বভাবতই বিসর্জন ঘাটে যেতাম সবার আগে। গাড়ি থেকে নেমে একে অন্যের হাত শক্ত করে চেপে ধরে আমরা পৌঁছে যেতাম সেখানে। কী ভিড়, কী ভিড়! যুৎসই কোনো উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে যে দিকে তাকাই শুধুই মানুষের মাথা আর অনেক দূরে প্রায় বৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে সব প্রতিমাগুলো। যে প্রতিমার যখন পালা, বিসর্জনের জন্য নিয়ে যাওয়া হবে নদীতে। তাই বিসর্জনের আগে শেষ মুহূর্তের নাচানাচি ঢাক আর কাঁসর ঘন্টার তালে। এর মাঝে মাঝে আবার বিসর্জন শেষ করে খালি ট্রাকগুলো নীচু থেকে উঁচুতে সবেগে উঠে আসতো আর সদা-তৎপর স্বেচ্ছাসেবক দলের ছেলেরা তথা পুলিশের দল ট্রাকগুলোর গতিপথ আর মানুষের ভিড় নিয়ন্ত্রণ করতো। সব মিলিয়ে সে এক ধুন্দুমার কান্ড, যার প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করতাম তারিয়ে তারিয়ে। একটা সময় আসতো যখন বড়দের সম্মিলিত সিদ্ধান্তে আমরা পায়ে পায়ে বেরিয়ে পড়তাম বিসর্জন ঘাট থেকে। তবে বেরিয়ে পড়তে চাইলেই কি আর বেরিয়ে পড়া যায়! এতটাই বিস্তৃত সেই পরিসর যে শেষ হতেই চাইত না। শেষপর্যন্ত আমরা বিসর্জন ঘাটের মায়া ত্যাগ করে পৌঁছে যেতাম মেলার মাঠে। ঐ মেলা আরো এক বিস্ময়। প্রতি বছর মেলা থেকে নিয়ম করে কাঠের ট্রাক কিনতাম, যাকে নিয়ে ঘরে ফিরে মালপত্র চাপিয়ে দড়ির সাহায্যে গোটা উঠান জুড়ে টেনে নিয়ে যাওয়ার মধ্যে যেন স্বর্গীয় এক সুখ অনুভব করতাম। ঐ মেলায় যে সংখ্যায় আসবাবপত্রের দোকান বসতো এবং সেসব জিনিসপত্র ঘিরে আগত দর্শনার্থীদের মধ্যে যে আগ্রহ দেখতাম, তা এককথায় অভাবনীয়। আসবাবপত্রের সারি সারি দোকান একদিকে, আর রকমারি খাবারের স্টল পাল্লা দিয়ে। সব মিলিয়ে বিশালাকার এক উৎসব। আমাদের নিজেদের কেনাকাটা যে বিরাট পর্যায়ের হতো, তা হয়তো নয়, কিন্তু ঠাকুরঘরের জন্য ঠাকুরের আসন, খেলনা ট্রাক, রুটি বানানোর চাকি-বেলনা, এসব খর্বাকৃতি জিনিসপত্র, যেগুলো গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া সম্ভব, সেসব কিনে নিয়ে, আমাদের মধ্যে কেউ কেউ বিজয়া দশমীর মিষ্টি, বিশেষ করে, বোঁদে, আমিত্তি, কুঁচো নিমকি, এসব পরিমাণমতো কিনে চেপে পড়তাম বাসে ঘরে ফেরার উদ্দেশ্যে। রাত দশটার আশেপাশে চা বাগানের মাঠে বাস থেকে নেমে প্রথমেই কাজ ছিল একে অন্যের সাথে শুভ বিজয়ার পারস্পরিক প্রাথমিক সম্ভাষণ সেরে ফেলা। তবে পুরোটাই রাখা থাকতো পরের সন্ধ্যার জন্য, যে সন্ধ্যা আমাদের কাছে ছিল আনুষ্ঠানিক বিজয়া দশমীর সন্ধ্যা। দশমীর পরের যে সন্ধ্যা, অর্থাৎ একাদশীর যে সন্ধ্যা, সেই সন্ধ্যার জন্য আমরা ছোটরা হাপিত্যেশ করে অপেক্ষা করে থাকতাম। সন্ধ্যা নামার একটু পরেই ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে আমরা এক এক করে সবগুলো বাড়িতে যেতাম। বড়দের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতাম প্রথমেই। বড়রা প্রণাম নিতেন। তাঁরা মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করতেন। বড়দের মধ্যে যাঁরা পুরুষ, তাঁরা আমাদের মতো ছেলেদের প্রণাম নেয়ার পর আমাদেরকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরতেন প্রথাগত কোলাকুলি করার জন্য। এসব মিটতেই আমরা বসার ঘরে বসতাম। নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব করতাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাড়ির কাকিমা বা জ্যেঠিমা প্লেট ভরে বিভিন্ন ধরণের মিষ্টি ও নোনতা খাবার একযোগে আমাদের পরিবেশন করতেন। নোনতা খাবারের মধ্যে ঘুগনি খুব জনপ্রিয় ছিল। অনেক বাড়িতে ঘুগনির কৌলিন্য বাড়ানোর জন্য পাঁঠার মাংসের ঘুগনি বানানো হতো। কেউ আবার নিজেদের পরম্পরা অনুযায়ী মিষ্টির সঙ্গে একটি করে সেদ্ধ ডিম পরিবেশন করতেন। মিষ্টি খাবারের মধ্যে তোক্তি, বরফি, নিমকি, আমিত্তি, নাড়ু, মিহিদানা, এগুলো বেশি করে প্রচলিত ছিল। শুরুর দিকে বাড়িগুলোতে ঠিকঠাক খাওয়া যেত, কিন্তু পরের দিকে পেট ভরে যেত, পরিবেশিত সবকিছু ঠিকঠাক করে খাওয়া যেত না। এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়িতে ছোট ছোট দলে ঘুরতে ঘুরতে কখনো কখনো কোনো বাড়িতে ঢুকতে গিয়ে বা কোনো বাড়ি থেকে বেরনোর সময় অন্য দলের সঙ্গে দেখা হয়ে যেত এবং পরিণামে দুই বা ততোধিক দল মিলেমিশে দলের আকার বেড়ে যেত। এভাবে ঘুরতে ঘুরতে একটা সময় আসতো যখন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হতাম যে বাকি সামান্য যে কয়েকটি বাড়ি আছে, সেগুলোতে পরবর্তী সন্ধ্যায় যাওয়াই শ্রেয়। কিন্তু পরবর্তী সন্ধ্যায় বেরোলেও একাদশীর সন্ধ্যায় বিজয়া দশমীর যে আনন্দটা পাওয়া যেত, সেই আনন্দ আর নতুন করে মিলতো না।
দিনকাল বদলেছে। আমাদের সময় যে বিসর্জন দেখতাম, বিসর্জনের উদ্দেশ্যে যে প্রতিমা নিয়ে যাওয়া ট্রাকের মিছিল দেখতাম, বিসর্জনের প্রাক্ মুহূর্তে কাঁসর ঘন্টা ও ঢাকের তালে যে সমবেত নাচ দেখতাম, সবটাই দেখতাম হাঁ করে, নিজের চোখে, আজকাল যত না আমরা নিজের চোখে দেখি, তার চেয়ে বেশি দেখি মুঠোফোনের ক্যামেরায় চোখ দিয়ে। ইউটিউব ইত্যাদির বদান্যতায় ঘটে যাওয়া সবকিছুই বারবার করে দেখি, তাই ঘটনা চলাকালীন তা স্বচক্ষে দেখতে যত না আগ্রহ, ভবিষ্যতের জন্য ঘটনার প্রতিটি মুহূর্তকে সংরক্ষণ করে রাখতে আগ্রহ যেন তার চাইতে অনেক বেশি। পড়শী কাকিমার ঘরে বিজয়ার প্রণাম করতে গিয়ে প্রণামপর্ব সেরে আমরা যতক্ষণ অপেক্ষা করতাম মিষ্টির প্লেটের জন্য, ততক্ষণ নিজেরা গল্পগুজব করলাম, কিন্তু এখনকার দিনে তেমন কিছু পরিস্থিতিতে যে যার নিজস্ব মুঠোফোনে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। দিনকালের এই বদল ভালো না খারাপ, তা এখানে অপ্রাসঙ্গিক, কিন্তু শৈশবের ঐ বিজয়া স্মৃতিতে থেকে যাবে আজীবন।
বিসর্জন
আফতাব হোসেন
(১)
ঘোষেদের ছোট ছেলেই প্রথম দেখেছিল । মূর্তিটা জলে ফেলার পর ওজন এর ভারে ডুবে যাবার ঠিক আগে যখন কয়েকবার খাবি খেল জলের মধ্যে , যখন প্রায় আশি হাজারের মা দুর্গার ঘরসমেত খাবি খেতে খেতে জলসমাধি হবার অন্তিম মুহূর্ত , যখন হিন্দিগানের লাউড স্পিকারের বিষ তরঙ্গে ক্লান্ত ভাসান যাত্রীরা ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ঘরমুখো , ঠিক তখনই ঘোষবাড়ির ছোট ছেলের চোখে পড়লো মা এর মুখ টা ভাঙ্গা । চোখ পুরোটা ফোকাস করে দেখলো ভাঙা না, মায়ের মুখটাই নেই । সামনে এগিয়ে রহস্য ভেদী দৃষ্টিতে চোখে পড়লো বছর এগারোর শেমিজ পরা লিকপিকে শরীরটা তীব্র বেগে সাঁতরে ওপারে , হৈ হৈ করে উঠতে টের পেল লিকপিকে শরীরটা ওপারে সাঁতরে উঠেই তীব্র বেগে দৌড় , গয়না সমেত …মায়ের মুখটা হাতে ধরা ।
(২)
শনিদেব ইদানিং দুর্বল বড় । ওনার মধ্যেও উচ্ নিচের প্রভাব এসেছে মনে হয় । না হলে যত বিপদ গরিবদের মধ্যেই কেন আসে তা আজও বুঝতে পারেনি হারান ,মানে হারু । যেবার লোকাল ট্রেন বন্ধ হব হব করছিল,সেবার রুজি রুটির অভাব টা আগেই টের পেয়ে ওভারটাইম শুরু করেছিল হারু । বউ কে বলেও ছিল সপ্তাহে চারদিন রাতের ট্রেনগুলো ও কভার করবে । রোজ দু হাড়ি ঘুগনি বিক্রি করলেও এই কতদিন আরো এক হাড়ি বাড়াতে গিয়ে বিপদ টা হল । বিক্রি বাটার সঙ্গে টেনশনটাও বাড়ছিল । শুনছিল রোজ যে কোনদিন ট্রেন বন্ধ হতে পারে । তারপর ঠিক যেদিন খবরের কাগজবালা পটল খবরটা দিল সেদিন অন্যমন করে নাকি কপালফেরে হাত টা স্লিপ করে পা গুলো রেলের চাকার তলায় গেল। হারুর বউ হারুকে ফেরালেও পা দুটো ফেরাতে পারলো না,সাথে পাঁচ অক্ষরের সামনের দিকে জমানো হারুর ব্যাংক এর পাস বই টা যখন এক অক্ষরে এসে থামলো তখন হারু ভাবলো ফাঁড়া কাটলো মনে হয় । বুঝলো কত অসহায় হতে হয় মানুষকে । বোঝেনি অসায়তায় মনে হয় শেষ বলে কিছু হয় না। শেষ হল যখন তখন হারুর লাজুক বউ পাশের হাসপাতালের আয়া । পা ছাড়া লোকটাকে নিজের বুকের মাঝে শক্ত করে বেঁধে শুনিয়েছিল হারুর বউ -
- ' বুঝলা এবার আমি কাম না করলে সংসার চলবে না । ফুলিটাও এবার ফাইবে উঠবে , পাশের পেরাইভেট হাসপাতাল টায় করুনা রুগী দেখার লোক চাইছে, রোজ তিনশো দিবে । আমি যাবো ভাবছি ' হিসহিস করে ফর্সা গলাটা টিপে জোর দিয়ে হারু বললো ওর বউ কে…- ' কেনে ? আমি কদিন মাত্র বসেছি , পা নাই বলে কি আর তোকে সুখ দিতে পারবো নাই ?
টুটি চাপা গলায় ভেঙে ভেঙে বললো হারুর বউ,
- 'পারবে গো … সুখ নিয়া চিন্তা নাই , চিন্তা প্যাট নিয়ে '।
সেদিন থেকেই ঘুগনি হারুর ল্যাংড়া হারু আর হারুর বউ লোকাল আয়া । করুণা রুগীদের আয়া ।
হারু বুঝলো এই বেশ ।
সুখ আবার দরজায় টোকা মারার আগেই,
ব্যাংকের খাতা আবার তিন অক্ষরে আসার আগেই হারুর আয়া বউ লোকের বিষ নিজের শরীরে নিল ।
সব্বাই একঘরে করার আগেই বাতাস কমলো রক্তে , সংসারেও বাতাস কমার আগেই বাতাস শেষ হল হারুর বউ এর । হারু বুঝলো এটাই মনে হয় শনি বলে ।
হাতের দুটা আংটিি বাড়ালো হারু , সাথেসাথে রাতে নতুন সঙ্গী । দু বোতল রোজ ।
(৩)
পাড়ার নতুন মাস্টার প্রীতম ।
মাস্টার বলে নাম ধাম আর টুকটাক ইমেজ তৈরী করেছে নিজেই । স্কুল পাড়ার মুরুব্বিরা মানে খুব ।কচিকাঁচা গুলো কয়েকদিন ধরেই মরচে লাগা নীল সাদার ফ্যাকাসে বিল্ডিং টার বাইরে । ভিড় করে । দেখতে পেলেই অমায়িক হাসি ,
- ' সার , বেঞ্চে বসবো না আমরা , ছোট কিলাস এ ভূঁয়ে বসি বসি ভাল্লাগেনা যে '
ছোটগুলো বড্ড প্রিয় প্রীতমের । আসলে প্রীতমের ছেলে ছোট বেশ । মাত্র ছয়ের কোটায় । সেদিন বলছিল মোবাইল স্ট্যান্ড না হলে নাকি অনলাইনে মাথা কাটে । কিনবো কিনবো করেও কেনা হয়নি প্রীতমের । ছেলে ছেড়ে স্কুলে এলে 'ভূঁয়ে' বসা ছেলেমেয়েগুলোকেই ছেলের মত লাগে ওঁর । ওদেরও মোবাইল স্ট্যান্ডের মত উচা বেঞ্চ লাগে , না হলে নাকি বড় ইস্কুলে পড়ার মজা নাই ।
চোখ বড় করে প্রীতম বললো -' ওরে দাঁড়া , এখনো সরকার বলেনি বেঞ্চে বসতে । তোদের পাড়ায় যাবো। দাওয়ায় পড়াব । কাল থেকে ' ….
চললো কদিন বেশ । ওই স্কুলেই সাতের ঘরের নামতা একটানা বলে যখন ত্রি থেকে ডাইরেক্ট ফাইভ ক্লাসে উঠেছিল ফুলি , তখন থেকেই পড়ায় আর মন নাই । সব্বাই যখন ভাবলো ট্রেনের হকারের ঘরে সরস্বতী জন্মেছে তখনই ফুলির ডাক ছেড়ে ইচ্ছে করতো সব্বাইকে বলতে যে ওর পড়তে ভালো লাগে না । বেশ কয়েকদিনের মধ্যেই যখন টপাটপ করে পুরো সংসারটা চোখের সামনে শেষ হতে দেখলো তখন এগারো বছরের মনের মধ্যে কি হয়েছিল কেউ না জানলেও সব্বাই দেখলো ফুলি কাঁদেনি এক ফোঁটাও । তারপর থেকেই ফুলি চুপচাপ খুব সারাদিন । বাপ মদ ধরতে ঝামেলা কমেছে ফুলির । সকাল বেলা শাক ভাত দুটো ফুটিয়ে দিয়ে হারুকে খাওয়াতে পারলেই ফুলির মুক্তি । বলেনি কাউকে কখনো এসব । শুধু নুরবাণু জানে , ওর ও মা নেই যে। নুর বানু জানে ওই আকাশের খুদার কাছে মা আছে , যে খুদাকে নুর বানু দেখেনি কখনো । নুরবাণু ওর একই ক্লাসের । অবসরে নতুন মাস্টারকে শুধায় নুরবানু - ' ' সার , ফুলির মা কে কে লিল ? কুথায় গেল ? উর যে খুব কস্ট '
(৪)
নতুন মাস্টার ভালো খুব । মুসলমান না হিন্দু এখনো বুঝে উঠতে পারেনি নুর বানু ,তবে স্যারকে ওর আব্বা আব্বা মনে হয় । ওর আব্বা কেরালায় থাকে বছরভর । কুরবানীর শেষে যাবার আগে আব্বা ওকে বলে গেছে ' শুন বিটি , তুই এখন ম্যায়াছেনা ,মায়ের জাত , অন্য বিটি গুলার দায়িত্ব নিস ' ।
ওর স্যার ও সবসময় জিজ্ঞাসা করে নূর বানুকে , তোর আব্বা তো বাইরে রে বছরভর, তুই একা হাতে সংসার সামলাস কি করে ? নূর বানু হ্যাংলা হাসে খালি , সাথে শুধায় মাস্টার কে , ও সার ফুলির মা কে কে লিল ? কুথায় গেল ? উর যে খুব কস্ট ।
মাস্টার জানে এর উত্তর নেই । ফিসফিসিয়ে উত্তর দেয় তোর আল্লা জানে ।
আজ নুরবানুর মন খারাপ। কেরালায় চাচা ফোনে বলেছে ওর আব্বার কাশি থামে না । ওকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে যেন গ্রামের কেউ আসে । ফোন পেয়ে নুর বানু খুঁজেছে খুব সব্বাইকে । কেউ কথা দেয়নি । তবে হাসিম চাচা একশ দিয়েছে । মাস্টার বলেছে টিকিটের দাম জোগাড় করতে আরো পাঁচশো লাগবে। না আনলে আল্লা রহম করবে নুরবানুর বাপকেও । ফুলি আর নুর বানু চুপ করে শুনেছে সব ।
(৫)
ফুলি প্রানপনে ছুটছে…
গয়না গুলো ওর চাইই চাই…
মাস্টার বলেছে আল্লা জানে ফুলির মা কোথায় ,মাস্টার বলেছে হিন্দুদের ঠাকুর মানেই মুসলমানের আল্লা ।ফুলি জানে আল্লার কাছে গেলে কেউ ফেরে না । ফুলি জানে নুরবানুর আর কেউ নাই । ফুলি জানে টিকিটের দাম মাত্র পাঁচশো টাকা ।
ছোট ঘোষ গলা ছেড়ে চিৎকার…ওরে ধর ধর…গয়না সমেত নিয়ে পালাল সালী ছোটলোকের মেয়েটা … ধর ধর…ওই ... সব্বাই … ধর….
মাস্টার এখন মিষ্টির দোকানে । নূর বানুকে মিষ্টি খাওয়াচ্ছে বিজয়ার । ল্যাংড়া হারু আজ চার বোতল মেরেছে ..একসাথে..
সাথে চিল চিৎকার…কুথাই গেলি ফুলির মা.. ও ঠাকুর … ফিরাই দে ফুলির মাকে.. ফিরাই দে…
এ দিকে ঠাকুরটা ডুবছে…ডুবেই যাচ্ছে…ওজনে , না কি বিসর্জনের নিয়মে...কে জানে….
দশমীর আখ্যান
কাকলি ব্যানার্জী মোদক
এই....এই..... ছুঁলি আমাকে? কাকা বললেন না ছুঁলে প্রণাম করবে কিভাবে?দশমী বলে কথা ,
কাকিমা অসন্তুষ্ট স্বরে বলেই বসলেন, যা আবার আমায় স্নান করতে হবে।
আমার সবাই বলে উঠলাম এই তো এলাম ছুঁলাম কখন ,কাকিমা গদগদ স্বরে বলে উঠল, বস মিষ্টি খেয়ে যাবি। সবাই পা ঝুলিয়ে বসে পড়লাম খাটে ।
ছুঁইনি শব্দটা কাকিমার খুব প্রিয় ।কাকিমা ছুঁচিবাই তাই আমরা জানি কি বলতে হবে । আমাদের সবার হাতে একটা করে ঠোঙা। ঠোঙায় তখন অনেক খাবার, হাতে তৈরি নিমকি, নাডু, গজা , মিহিদানা। সব একসাথে থেকে ঘেঁটে ঘন্ট, দশমীর পরের দিন কোন বাড়ি ছাড়া যাবেনা তাই সবাই বেড়িয়ে পড়েছি দলবল নিয়ে।
পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম কোন ব্যাপার নয়। শ্রদ্ধ শব্দটার মানেই বুঝতাম না । শুধু জানতাম গেলেই মিষ্টি দেবে তাই অকপটে টুক করে একটা প্রনাম, রাম আর রহিমের তফাত বুঝতাম না ।
বেশ খানিকক্ষণ পর কাকিমা নিয়ে এলো, সুজির বরফি, আর নারকেল দেওয়া ঘুগনি , ঘুগনি তো খেলাম কিন্তু বরফি? অত্যাধিক হাতে জল ব্যবহার করায় কাকিমার আঙুলের চেহারা ক্ষণভঙ্গুর সাদাটে।
আমরা একে অপরের দিকে তাকিয়ে ,কি করি, কি করি হঠাৎ একদাদা ইশারা করে বলল খাটের নিচে ফেলে দে। সুযোগ বুঝে এক এক করে ফেলতে লাগলাম খাটের ধারে। তারপর বেড়িয়ে অন্য বাড়ি ।
পরের দিন,অবশ্য কাকার কাছে খুব বকুনি খেয়েছিলাম সবাই। মা শুনে রাগ করে বলেছিলেন এমন কাজ করতে নেই,ছোটবেলার স্মৃতি আজও মনে পড়ে। বিজয় দশমী মানে মিষ্টি আর আনন্দ ।।
বিজয়া গদ্য
বিজয়ার চিঠি
রুদ্র সান্যাল
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের জীবনে কত কিছুরই আজ পরিবর্তন ঘটে গেছে। সংস্কার থেকে শুরু করে দৈনন্দিন জীবনের অনেক কিছুই। একই ভাবে দুর্গাপুজোর ক্ষেত্রেও তাই। পুজোর অধ্যাত্মিকতার পরিবর্তে থিম এখন গুরুত্বপূর্ণ। ঠিক সেই রকম ভাবেই বিজয়ার দিনটির পরিবর্তন ঘটেছে বিরাট ভাবে।
শুভ বিজয়ার দিনে সকল ধর্মের মানুষ শত্রু মিত্র ভেদাভেদ এবং তিক্ততা ভুলে পরস্পরকে আলিঙ্গন এবং মিষ্টিমুখ করিয়ে সব দুঃখ ভুলে যাওয়ার প্রচেষ্টা। ছোটবেলার থেকেই এই দিনটিকে বিশেষ দিন হিসেবে মাথায় থাকে। প্রীতি আর শুভেচছায় ভরা থাকে এই বিশেষ দিন।
কিন্তু আধুনিকতার যুগে এখন বিজয়ার দিনে সেই চিঠি লেখার সময়গুলো কেমন যেন হারিয়ে গেছে। ফেসবুক আর হোয়াটসআপের যুগে দাঁড়িয়ে মাত্র দুই তিন দশক আগের সেই বিজয়ার দিন গুলো এখন মনে আসে না। পোস্টকার্ড বা ইনল্যান্ড লেটারে চিঠি লেখার অভ্যাস ক্রমশ বিলুপ্তির পথে। একটা হাই হ্যালো বা সকলকে একবারে শুভেচছা জানিয়ে ফেসবুক বা হোয়াটসআপ বোধহয় আমাদের খুব দ্রুত অসামাজিক করে তুলেছে। এ যুগের ছেলে মেয়েরা চিঠি লেখা কী বস্তু তা শুধু তারা পরীক্ষার খাতায় ছাড়া আর কোথাও জানে না বললেই চলে। বিজয়া বা বাংলা নববর্ষে বড়দের চিঠি লেখা দেখতাম সেই ছোট বয়স থেকেই। বাবা যখন চিঠি লিখতেন, তার শেষের দিকে কিছুটা জায়গা ফাঁকা রেখে দিতেন, আমার চিঠি লেখা এবং প্রণাম জানানোর জন্য। সেখানে লিখেই প্রথম পরীক্ষার বাইরে চিঠি লেখার অভ্যাস ঝালিয়ে নিতাম। কীভাবে যেন সব এখন শেষ হয়ে গেলো। এখন সব যান্ত্রিক। বড়দেরকে শ্রদ্ধা বা প্রণাম জানানোটাও যেন একটা যান্ত্রিক বিষয় হয়ে গেছে। কর্তব্যবোধের শুধু একটা পরিচয় দেওয়া মাত্র! দুঃখ হয়, যখন দেখি এখনকার ছেলে মেয়েরা এসবের কিছুই প্রায় জানেনা। বা বোঝে না। দোষটা অবশ্য আমাদেরই। আমরাই হয়তো এগুলো বোঝাতে ব্যর্থ। কারণ নিজেরাও নিজেদের অজান্তে ফেসবুক বা হোয়াটস আপের মতন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দাস হয়ে গিয়েছি।
এখন আর সেই চিঠিও নেই, সেই পোস্টম্যান দাদাও খুব কমই আসেন বাড়িতে। শুধু স্পিড পোস্ট-এর কিছু জিনিস বা ব্যাংকের ডকুমেন্টস দিতে আসা ছাড়া। ছোটবেলার চিঠি লেখা শুরুই হত এই বিজয়া বা নববর্ষের দিনে। একদিকে প্রণাম জানানো আবার অন্যদিকে বাংলা ভাষা চর্চাও হত এই চিঠি লেখার মাধ্যমে।
বিজয়া এখনও আসে- চলেও যায়। বিজয়া আবারও আসবে। কিন্তু সেই চিঠি লেখার আনন্দ আর কোনও দিনও ফিরে আসবে না। চিঠি রাখার বাক্সও আর নেই। হয়তো বয়স যত বাড়ছে, ততই অতীত কে ধরে বাঁচার ইচ্ছে তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। শুধু মাঝে মাঝে এখন একটা চাপা কষ্ট মাথায় ঘুরপাক খায়। সত্যিই 'দিন গুলি মোর সোনার খাঁচায় রইলো না।'
আমার পঞ্চইন্দ্রিয়ের সর্বসুখ তোমাতেই থাক
গৌতম চক্রবর্তী
দেবীপক্ষের দিন ছাড়া সারা বছর জগজ্জননী
কেউ কোন খোঁজ রাখে নাকি তোমার? বরফ ঢাকা কৈলাসে গাঁজাখোর তোমার আধাপাগলা স্বামীর সঙ্গে
মাঝেমধ্যে শুনি মানিয়ে গুনিয়ে নিতে বড়ই কষ্ট। সেইসময় কেউ তোমার সুখদুঃখের খোঁজখবর রাখে
কি? দেখতে যায় কি? খোঁজখবর করে, চিঠি বা মানিঅর্ডার পাঠিয়ে তোমার বাপ গিরিরাজ মাঝেমধ্যে
সাহায্য-টাহায্য করে কি? কে জানে, আমি তো কখনও শুনিনি। আর তাই বিসর্জনের ঢ্যাং কুড়াকুড়
বাজনা বেজে বেজে তার অনুরণন শেষ হয়ে গেলে একেলা বসে মন খারাপের এই অনুষঙ্গে বিজয়ার
চিঠি লিখতে বসে একটু আবোল তাবোল ভাবনা চলে আসছে মনে। দিনের পর দিন দেখে আসছি নিয়ম
করে মাত্র চার দিনের এক রাতও বেশি মেয়েকে রাখে না বাপ। কখনও পাবলিক ডিম্যান্ড বা নেতাদের
খেয়াল, কখনও মহরমের মিছিল বা আরও নানা কারণে এক দুদিন একস্ট্রা থাকলেও তোমার সে থাকা
দেখি বড়ই অপমানের। ঘট বিসর্জন, মানে অন্নজল, খাতিরদারি সব বন্ধ করে অনেকটা ট্রেনের
কনফার্ম টিকিট না পেয়ে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে পড়ে থাকার মতো। বড়োই কষ্টকর। জানি তার
থেকে হিমশীতল কৈলাসবাস অনেক শ্রেয় বলে স্বামীসঙ্গসুখ লাভের প্রত্যাশাতেই আবার সদলবলে
স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন। কিন্তু আমাদের যে মন মানে না মা। এতো উদ্যোগ আয়োজন। মাত্র চারটে
দিনেই শেষ? জানি এখন দিন বদলেছে। তামাম ভক্তকুলের প্রতিক্রিয়াও বদলেছে। তাই বিসর্জনের
বাজনা বেজে উঠলেই চোখে জল আসে না। পায়ে আসে নাচ। বলো তো দেখি মা ঢ্যাং কুড় কুড় বাজনা
শুনলে কোন বঙ্গসন্তানের চোখে জল আসতো না আমাদের ছোটবেলাতে? দেবীপক্ষের শুরুতে অন্ধকার
কাটিয়ে আলোর পথে যাত্রা। দিন কয়েক উৎসবমুখর এই দেশ। পিতৃপক্ষ শেষ, কৃষ্ণপক্ষের অবসানে
শুক্লপক্ষের আবির্ভাব। নৃত্যরত কাশবন, শিউলি সুবাস, নীলাকাশ, শুভ্র মেঘ, তরল সোনার
মতো আদুরে রোদ, ঘাসের উপরে হিরের কুচির মতো শিশির নিয়ে সাজো সাজো রব প্রকৃতিতে। দেবী
আসেন। দুর্গতিনাশিনী, দুঃখশোকহারিণী, সুখ অভয়দায়িনী, মঙ্গলময়ী, জগজ্জননী আসেন। তাকেই
স্বাগত জানাতে এত আয়োজন, এত মাতোয়ারা সবাই। অথচ সবকিছু শেষ মাত্র চারদিনেই? চলছে না,
চলবে না।
শারদোৎসবকে ঘিরে পুজো, উৎসব, আড়ম্বর।
আসলে বিনাশর্তে দেবীকে নিজের যথাসর্বস্ব উজার করে দেওয়ার নামই পুজো, আরতি, প্রণাম।
আমাদের এই ভঙ্গুর মাটির শরীর যা কিছু দিয়ে তৈরি সেই ‘পঞ্চভূত’কেই একে একে দেবীর পায়ে
নিবেদন করে দিয়ে আরতি করি আমরা। দেবী আসবেন এই গৃহে। তাঁকে যথাসর্বস্ব দিয়ে প্রণাম
করতে হবে। তাই ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুত, ব্যোম এই ‘পঞ্চভূ্ত’কে আরতির উপাচারগুলোর মন্ত্রে
নিবেদন করি দেবীর পদমূলে। ধূপের সুবাস দিয়ে ক্ষিতিকে নিবেদন করি, অপ কে নিবেদন করি
শঙ্খের মধ্যে গঙ্গাজল ভরে, তেজ নিবেদিত হয় কর্পূর দিয়ে ধুনোর আগুণ জ্বালিয়ে, মরুতকে
ধরে ফেলি চামরের দোলাতে বাতাস ছড়িয়ে, আর ব্যোমকে ছোঁয়া যায় ঘন্টার শব্দে, ওঙ্কারের
ধ্বনিতে। পাঁচ সলতের পঞ্চপ্রদীপ তার পাঁচটি মুখ নিয়ে হয় আমাদের জাগ্রত পঞ্চেন্দ্রিয়ের
পাঁচটি প্রতীক। আমরা তাই দেবীর কাছে নিবেদন করি আমার এই পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের সর্বসুখ
তোমাতে নিমজ্জিত হয়ে থাক। তুমিই তাদের ভার নাও, দেখাশোনা কর। আর দেখাশোনা কর তোমার
‘পঞ্চভূতকেও’। তাদের পাঁচজনকে হিসেব মিলিয়ে একসঙ্গে বেঁধে রাখো মা। তুমি না দেখলে
ওদের রক্ষা করবে কে? শেষে আসে দর্পণ, মুকুর। এখানেই আত্মসমর্পনের শেষ পরীক্ষা। দেবীর
মুখের দিকে তাকিয়ে তাই বিদায়বেলাতে বলি আমি যেন সারাবছর তোমার ভক্ত হয়ে আমার সমস্ত
সততা, কর্তব্যনিষ্ঠা, নিয়মানুবর্তিতা নিয়ে এমনভাবে চলতে পারি যাতে তোমার মনের মুকুরটি
থাকবে ধূলিবিহীন, নির্মল। সেই স্বচ্ছ মনের আয়নায় নিজের মুখটি দেখতে গেলে নিজের মুখের
পরিবর্তে তাতে আরাধ্যের প্রিয়মুখটি যেন সবসময় ভেসে ওঠে। ভক্তির সেটাই শেষকথা। এ তো
তোমারই কথা। তুমিই তো মা শিখিয়েছ হিন্দু, মুসলিম, জৈন, বৌদ্ধ, ক্রিশ্চান - ধর্মে তুমি
যাই হও না কেন, এই পঞ্চভূত আর পঞ্চইন্দ্রিয় নিয়েই তোমার তুমি। যে কোনো ইষ্টদেবতার
প্রতি ধরিত্রীর সন্তানদের সকলেরই হতে পারে এই প্রণাম, এই আরতি হতেই পারে সব মানুষের
নিজের কথা।
মাগো, আমরা ভক্তকুল বড়ই স্বার্থপর। কয়েকটা
দিন দেবীর জন্যে বরাদ্দ, খুব খাতির, প্রচুর আড়ম্বর, খাওয়া দাওয়া, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান,
আরও কত কি। যদি ভাবা হয় সবই শ্রদ্ধা ভালোবাসায় আপ্লুত হয়ে করি তবে ভুল হবে। যতটা
করি তার চার আনা ভক্তি আর বারো আনা দেখনদারি, প্রচার, সেলফি, ফটো, ফেসবুক পোস্ট। এখানে
স্বার্থ আছে বইকি। সস্তা দেখনদারি। তুমি আসামাত্রই অনবরত ঘ্যানঘেনিয়ে ‘রূপং দেহি,
জয়ং দেহি, যশো দেহি দ্বিষো জহি’, এটা দাও, সেটা দাও, এটা করে দাও, ওটা করে দাও। আচ্ছা
মা, তুমি কি শুধু দেওয়ার জন্যই? তাহলে কি হড়কা বানে হারিয়ে যাওয়া ভক্তবৃন্দের দেহগুলোতে
প্রাণসঞ্চার করে তাদের ফিরিয়ে দিতে? বা পাহাড়ের ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে হারিয়ে যাওয়া
মানুষগুলোকে। কেন তুমি এতটা নির্দয় হলে মা? সবকিছুই তো তোমার অঙ্গুলিহেলনে। হ্যা, তোমার
বঙ্গভূমে রক্তবীজের বংশধরেদের মতো বাড়ছে শিক্ষাসুরেরা। এটা সত্যিই। কিন্তু তার জন্য
নিরীহ, নির্দোষ শাস্তি পাবে কেন মা? আসলে বুঝেছি মা, শাস্ত্র, আচার সব ধূলিসাৎ হয়ে
যাচ্ছে। নিষ্ঠা, ভক্তির বদলে স্থান করে নিচ্ছে আড়ম্বর। প্রশিক্ষিত পুরোহিতের অভাবে
অশাস্ত্রীয় উচ্চারণে না বুঝে অচেনা ভাষায় বিশুদ্ধ মন্ত্রোচ্চারণ না শোনার ফলে কুপিতা
হচ্ছো তুমি। হয়তো পিতৃপক্ষে তোমার বোধনপর্ব সুনিশ্চিত করে, সহজ মন্ত্রোচ্চারণকে অযথা
জটিল করতে গিয়ে, শাস্ত্র, আচার জলাঞ্জলি দেওয়ার ফলে তোমার প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা প্রদর্শনে
খামতি থেকে যাচ্ছে যে ভক্তকুলের, তাদের প্রতি তুমি কুপিতা হচ্ছো। কিন্তু তার জন্য আমরা
তোমার নিরীহ ভক্তকুল পাপের শাস্তি ভোগ করব কেন মা? প্রকৃতির এই রূদ্ররূপকে তুমিই তো
পারো নিয়ন্ত্রণ করতে। মা, মাগো, পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ করে, তোমার সঙ্গে অভিন্ন হয়ে
যাওয়ার মন্ত্র উচ্চারণেই তো পুজো শেষ। আমি আমার প্রাণ, বুদ্ধি, দেহ, ধর্ম, অধিকার--সর্বস্ব
তোমাকে সমর্পণ করেছি। জাগরণে, স্বপ্নে, সুষুপ্তিতে, কর্মে, মননে, বাক্যে, যা কিছু আমি
স্মরণ করেছি, যা কিছু উচ্চারণ করেছি, সব আমি আজ তোমাকে উৎসর্গ করলাম। রুদ্ররূপ নয়,
এ ধরিত্রীর বুকে নেমে আসুক তোমার বরাভয় আগামী দিনে। শিক্ষাসুরদের কঠোরতম সাজা দাও মা।
শিক্ষিত বেকারদের মুখে হাসি ফোটাও। সত্যের জয় চিরকালীন একথা বিশ্বাস করতে আমাদের সাহস
যোগাও মা।
কথা কিছু কিছুশ্রাবণী সেনগুপ্ত
মেয়েটির ছোটবেলায় পুজোর ঠাকুর ভাসানের আগ দিয়ে ছিল মায়ের হাত ধরে মামারবাড়ি যাওয়া।তখন সেখানে দাদু,দিদা,মামা,অবিবাহিত মাসিদের ভরা সংসার।উপরি পাওনা হিসেবে ছিল তার মামারবাড়ির পাশেই তার মায়ের মামারবাড়ি।
সেখানেও ছিল ভারি মজা। আসলে হয়েছিল কি,তার মায়ের বাবা মা আর মামা পিসির মধ্যে হয়েছিল বদল সম্বন্ধ।তাই তার মায়ের পিসি ছিলেন মামী,আর মামা পিসেমশাই।ভারি ভাব ছিল দুই পরিবারের মধ্যে।আর ছোটদের অবারি ত দ্বার।পুজোর কটাদিন খুব মজায় কাটত বলাই বাহুল্য।তখন বড়ো মেয়ের মেয়ে এবং ঐ বাড়িতে একমাত্র বাচ্চা হিসেবে তার প্রচুর আদর।মামারবাড়িতে সকলে তাকে চোখে হারায়।দশমীর দিন মায়ের সঙ্গে গিয়ে দুগ্গা ঠাকুরের পায়ে বই ছোঁওয়ানো।দুগ্গা মায়ের বিসর্জন-নিকটবর্তী পুকুরে।সে মাসিদের সঙ্গে দেখতে যেত।অবাক হয়ে দেখত বয়স্ক পুরোহিতমশাই মায়ের বিদায়বেলায় কিভাবে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে কান্নায় ভেঙে পড়তেন।বিসর্জন দিয়ে পুকুরের জল ছিটিয়ে দেওয়া হত পুকুরের পাড়ে দাঁড়ানো সবার মাথায়,গায়ে।আর বিসর্জন দেখে বাড়ি ফিরে দিদার হাতের ভাজা পুঁটি মাছ খাওয়া।একে বলা হত যাত্রা পুঁটি।দশমীর ঠাকুর বরণের পর সেই বরণের কুলো হাতে নিয়ে দিদিমা যেতেন কাছাকাছি কিছু বাড়িতে।মেয়েটিও সামিল হত তাতে।সেখানে দিদিমা বাড়ির এয়োদের সিঁদুর দিতেন,আর সঙ্গে থাকা নাড়ু দিয়ে মিষ্টিমুখ হত,ঐ বাড়ির বড়োরা সঙ্গে থাকা মেয়েটিকে ঘরে বানানো মিষ্টি খেতে দিতেন।বলতে গেলে বিজয়ার শুরু তখন থেকেই।তখন বাড়িতে বানানো হরেকরকম মিষ্টি,নারকোলের ছাঁচ,নিমকি,ঘুগনি এইসব দিয়েই অভ্যর্থনা জানানো হত বিজয়া করতে আসা অতিথিদের।
পরের কয়েকদিন বাড়িতে বিজয়া করতে আসা আত্মীয়,অনাত্মীয়র ভিড় লেগেই থাকত।মেয়েটিও বড়দের সঙ্গে যেত এবাড়ি,সে বাড়ি।তখন এতো বাইরের খাবারের চল ছিল না, কিন্তু তারজন্য কোনো অভাববোধও ছিল না।কতোরকমের যে খাবার-নোনতা,মিষ্টি বিজয়াতে ঘরে বানানোরই চল ছিল।সেই সময় রাস্তাতে যেতে যেতে বড়দের কারোর সঙ্গে দেখা হলেও প্রণাম করত সবাই। আর ছিল প্রবাসে থাকা আত্মীয়স্বজনকে চিঠি লেখা।খুব আনন্দ পেত মেয়েটি এই চিঠি লেখাতে।বিশেষ করে তাঁর এক দূর সম্পর্কের জ্যেঠু ছিলেন আসামে,ইনি আবার বাড়িতে কোনো বাচ্চা হলে তাদের নাম দিতেন।সেই নতুন নাম বহন করে চিঠি আসত ।মেয়েটির নামও সেই জ্যেঠুর দেওয়া।মেয়েটির একান্নবর্তি পরিবারে তো বিজয়া মানে সেইসময় প্রায় প্রতিদিনই কেউ না কেউ আসা-কোনোদিন তার মামা মাসিরা,কোনোদিন জ্যেঠিমাদের,কাকিমার বাপের বাড়ির সবাই।যে কোনো ঘরেই কেউ আসুকনা কেন,মূল আকর্ষণ ঠাকুমার ঘর।ওখানেই সবার বসা,আড্ডা দেওয়া।সেইসময় আপন পর ভেদাভেদ ছিলনা।তারাও যেত বিভিন্ন আত্মীয়স্বজনের বাড়ি।বাবার মামার বাড়ি,মাসির বাড়িও গেছে এই সুবাদে।আরো খুব মনে পড়ে তার বাবাদের এক মামাতো দাদার কথা,তিনি তাদের খুব কাছের জ্যেঠু।জ্যেঠিমাকে নিয়ে আসতেনই আসতেন।আর এলেই খুব হৈ হৈ আড্ডা হত,বিশেষ করে তার বাবার সঙ্গে খুব জমত।বিজয়াতে তখন সবাই সবার বাড়ি যেতেন,সেইটি ছিল আবশ্যিক।আর ছিল বিজয়া সম্মিলনী-যা ঠাকুর বিসর্জনের পর প্যাণ্ডেলেই অনুষ্ঠিত হত।
তারপর দিন কাটে,দিন কাটে, আজ সে মেয়ে অনেক বড়ো,সংসারেতে সড়গড়।চোখের সামনে সেই বেড়ে ওঠার সময়ের দিনগুলির বিজয়া-কেমন বদলে গেল।এখন বেশিরভাগই মোবাইলে মেসেজ আসে-হ্যাপি বিজয়া।সময়ের অভাবে খুব কাছের মানুষেরাও আর বাড়ি এসে বিজয়া করতে পারে না,আর সেই নীল ইনল্যান্ড এ আসা বিজয়ার বার্তা এখন পুরাতন গন্ধমাখা মধুর স্মৃতি।সে কিন্তু এখনো বিজয়া সারে বাড়ি বাড়ি গিয়ে,শত কাজ আর অসুবিধার মধ্যেও।এখনো তার এক বয়স্কা আত্মীয়া বানান সেমুইয়ের পায়েস,ঘুগনি-এখন আর পেরে ওঠেন না,তাও এইগুলি করবেনই করবেন।মেয়েটি বাড়িতে আজও বানায় নারকেল নাড়ু,নিমকি,আর ঘুগনি-কেউ বিজয়া করতে আসবে এই আশায়-শুভ বিজয়ার এই ঐতিহ্য যে জড়িয়ে গেছে তার যাপনে। তার মধ্যেই সে ফায়ার পে তার পিছুটান।
বিজয়া: সেদিন ও আজ
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়
শতাব্দী প্রাচীন গোবরডাঙ্গা জমিদার বাড়ির সামনে দিয়ে বয়ে যাওয়া যমুনা নদীর কথা খুব মনে পড়ে। চোখে ভেসে ওঠে যমুনা নদীতে দলে দলে কচুরিপানা মৃদু মন্থর গতিতে, সগর্বে নীল সাদা ফুল নিয়ে পেঁজা তুলোর মেঘদের সাথে একান্ত মনে রঙিন গল্প জমিয়ে পাড়ি দিত ইছামতীর দিকে । বিজয়া দশমীর সন্ধ্যায় কুলুকুলু বয়ে যাওয়া যমুনা নদীর নীরবতা ভঙ্গ করত , রেল ব্রিজ -এর উপর দিয়ে ছুটে যাওয়া লৌহদানব, বনগাঁ লোকালের তীব্র হুইসিল, আর দুর্গাপুজো কমিটিগুলির "আসছে বছর আবার এসো মা গো " এই প্রার্থনাতে। এরই মাঝে চলত প্রতিমা বিসর্জ্জন। ভারত বাংলাদেশ সীমান্তের প্রতিমা নিরঞ্জনের সাথে ছিল বেশ মিল।
প্রতিমা বিসর্জ্জন দিয়ে আমরা ফিরে আসতাম পাড়ায়। এখন আর সেই পাড়া সংস্কৃতি নেই। নেই গুরুজনদের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম বা সমবয়সীদের সাথে কোলাকুলি। পুজোর আগেই কেনা থাকত পোস্টকার্ড এবং ইনল্যান্ড লেটার। সমস্ত আত্নীয় পরিজনদের লেখা হত বিজয়ার প্রণাম এবং আশীর্বাদের চিঠি। ডাক পিয়ন এসে দিয়ে যেতেন পোস্টকার্ড, ইনল্যান্ড লেটার ও শারদীয় সংখ্যার ক্ষুদ্র পত্র পত্রিকা। তোড়জোড় চলতো বিজয়া সম্মিলনের প্রস্তুতি ও গান, নাচ, নাটকের মহড়া।
ধীরে ধীরে আত্মপ্রকাশ ঘটলো ডি,জে'র। বিসর্জনের সময় চটুল হিন্দি গান, গানের থেকেও তার বাজনা বেশি। তার সাথে কুৎসিত নাচ ও অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি। আমাদের পাড়া সংস্কৃতিতে সন্ধ্যার পর বাড়ি ফেরা নিষিদ্ধ ছিল। পাড়ার জ্যাঠা কাকারাই জানতে চাইতেন, কেন অন্ধকার হওয়ার পরও কেউ কেন বাড়ির বাইরে আছে। এখন বিসর্জনে যথেচ্ছ ধুমপান, মদ্যপান এবং ডি, জের হিন্দি গান এর ফলে ঘটে চলছে নানা ধরনের অঘটন।
দূর্গা প্রতিমা মন্ডপের মধ্যে থাকা কালীনই দর্পন বিসর্জনের আগেই মোবাইলের হোয়াটসআপে আসতে থাকে শুভবিজয়ার প্রণাম শুভেচ্ছা। মোবাইল গ্যালারি ভরে যাওয়ার আশঙ্কায় চলতে থাকে মায়ের ছবি ডিলিট করার ধুম। কলাপাতার ওপর বেলের কাঁটা দিয়ে একশ আটবার "দুর্গা " নাম লেখা, মা'য়ের পায়ে বই, খাতা, ডাইরি ছোঁয়ানো, অপরাজিতা ফুলের গাছ ও ফুল স্পর্শ করা, নীলকণ্ঠ পাখির ছবি দেখা, সবটা অধরাই থেকে যায়।
আনন্দ আবেশ
অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী
বহুপ্রতীক্ষিত শারদীয়ার উৎসবমুখর দিনগুলি পায়ে পায়ে কখন যেন শেষ প্রহরের দিকে এগোয়।মন বলে, এই মধুর ক্ষণের অধীর প্রতীক্ষাই ছিল শ্রেয়, আগমনীর দিনগোনাই ছিল আনন্দের। দশমীর উজ্জ্বল সিঁদুর খেলাতেও বিষাদের রং ঘনায় হঠাৎ।দর্পণে উমার মুখের ছায়ায় সে বিষাদে মায়া জড়ায়। অগণিত মা বোনের হাতের সিঁদুরের ছোঁয়া নিয়ে, ভক্তি, বিশ্বাস, একবুক ভালোবাসা নিয়ে মিষ্টিমুখে ঘরের মেয়ে উমার ঘর ছেড়ে চলে যাওয়ার পরোয়ানা জারি হয় তিথি, লগ্ন, সময়সূচি অনুযায়ী। চারিদিক খুশিতে ভরে তুলে সন্তানসন্ততি নিয়ে উমার পিতৃগৃহে আগমন ও কয়েকটি দিনের আনন্দ, হাসি,গানের শেষে পতিগৃহে প্রত্যাবর্তনের বিষাদ মেদুর মুহূর্তটি যেন ঘরের এক সাধারণ মেয়ের জীবনেরই চালচিত্র।যার আগমনের সবটা জুড়ে ছিল শুধু আলো আর আলো, তাঁর বিদায়বেলাকে এতটুকুও ম্লান হতে না দিয়ে ঢাকে কাঠি পড়ে দ্বিগুণ উৎসাহে।উন্মাদনায় মেতে ওঠে ভক্তের দল।এত আনন্দ আয়োজনের শেষে উমাকে বিসর্জন দেওয়া হয় জলে।জলে উমার মুখটি পুরোপুরি অদৃশ্য হওয়ার আগে পর্যন্ত যে মুহূর্তটুকুও দৃশ্যমান থাকে, করজোরে কপাল ছুঁয়ে শতসহস্র অশ্রুসজল চোখ তার বন্ধ পাতায় আগলে রাখতে চায় সেই নয়নাভিরাম স্নিগ্ধতাকে। আকুল হয়ে ওঠে মন। ঠিক সেসময় থেকেই অসংখ্য হৃদয়ে প্রতীক্ষার সূচনা হয় আগামী বছরের কোনো এক শারদ প্রাতে এক আলোক মঞ্জীরের বেজে উঠবার।শিল্পীর নিপুণ তুলির টানে তিলতিল করে গড়ে তোলা উমার মনোলোভা মুখচ্ছবি আর বসনে ভূষণে সাজানো টানটান অবয়বের মূ্র্তি থেকে কাঠামোটুকু শুধু ভেসে বেড়ায় জলে।শান্তিজলের স্পর্শটুকু রয়ে যায় আশীর্বচন হয়ে। মহিষাসুরের সঙ্গে নয় দিন, নয় রাত যুদ্ধের শেষে দশমদিনে বিজয়িনী বিজয়া বিদায় নিয়েও শুভ বিজয়ায় তাঁর অনুরণনটি রেখে যান আপামর ভক্তের হৃদয়ে। বিজয়া এক অনন্ত শক্তি।অশুভর বিনাশ ও শুভর উন্মেষ।যে শুভ স্নেহ, ভালোবাসা ও আশীর্বাদ হয়ে বছরের আর পাঁচটি সাধারণ দিনের বাইরেও বয়োজ্যেষ্ঠদের থেকে কনিষ্ঠদের উপরি পাওনার একটি দিন হয়ে থেকে যায়।যে শুভ ছোটদের শেখায় গুরুজনদের সামনে অবনত হতে। শুধুমাত্র পা স্পর্শ করে বা সংস্কারের বোঝা চাপিয়ে নয়;শিক্ষায়, সম্মানে, বোধে ও আত্মচেতনার আলোয় অন্তরকে বিকশিত করে প্রকৃত শ্রদ্ধার ফুল প্রস্ফুটনেই শ্রদ্ধার বিজয়া আসে, সার্থক হয় বিজয়া। বিজয়াকে উপলক্ষ করে প্রণাম, স্নেহাশিস, কোলাকুলি, মিষ্টিমুখ সবটাই আসলে এক মিলন উৎসব। আধুনিকতার ছোঁয়া লেগে আজ যা অনেকটাই ম্লান। হারিয়ে গেছে সেই নীলরঙা, হলদে রঙা ইনল্যান্ড, পোস্টকার্ড।যারা অনেক দূরপথের অনেক অলিগলি বেয়ে উড়ে এসে মনের সবটা জুড়ে বসতো বিজয়ার অনেক শুভেচ্ছাবার্তা নিয়ে। হারিয়ে গেছে বিজয়ার চিঠিগুলি তাদের আদরের সম্বোধন নিয়ে।কাঁচা হাতের আঁকাবাঁকা অক্ষরও নেই আর।বিজয়া সম্মিলনীর আনন্দ উচ্ছ্বাস আজ অনেকটাই ফিকে, অনেক ম্রিয়মান। কোথাও কোথাও সম্পূর্ণই হারিয়ে গেছে এই মিলনোৎসব। কোথাও বা আধুনিকতা বিকৃতি হয়ে জৌলুস ছড়াচ্ছে এর নামে। কৃত্রিমতার মোড়ক হারিয়ে দিয়েছে সেই স্পর্শকাতর উজ্জ্বল দিনগুলিকে। ঐতিহ্যের সেই বিজয়ার ছবি অনেকখানি পাল্টে গেলেও সময় সবটুকু কেড়ে নিতে পারেনি আজও।এ প্রজন্মেও কিছু সংবেদনশীল মন আছে, শ্রদ্ধা আছে, বেঁধে বেঁধে থাকা আছে, আগলে রাখা আছে।সেই সঙ্গে আছে অশুভ শক্তির বিনাশিনী শক্তিরূপিণী সর্বজয়ার অন্তরের শক্তিমন্ত্রের দীক্ষা।বিজয়া সেই শক্তির আলোয় আলোকিত হোক। কৃত্রিম আনুষ্ঠানিক লোকাচার না হয়ে আন্তরিকতা ও সহজতায় বিজয়া আবার খুঁজে পাক তার হারানো ঐতিহ্যকে।সত্যিকারের মঙ্গলকামনার দীপ্তিতে উদ্ভাসিত হোক, সার্থক হোক বিজয়ার মায়াময় দিনটি। তবেইতো সমস্তটা মন উজাড় করে কান পাতলে নিশ্চিত শোনা যাবে সেই পদধ্বনি।শরৎ সকালে আলতা রাঙানো পা দুটি শিউলিঝরা শিশিরভেজা ঘাসে ডুবিয়ে ডুবিয়ে আসতেই হবে তাঁকে। তাঁর অস্তিত্বের মায়াময় নিমগ্নতার প্রতিটি আকূল আহ্বানের সাড়া হতে, ভক্তের হৃদয়ের ভক্তি হতে, আরাধনার শক্তি হতে আসবেন তিনি। তাঁকে ঘিরে উৎসবের শেষে তাঁকে ছুঁয়েই তো বিজয়ার শুভারম্ভ। সারাবছরের সঞ্জীবনী হয়ে তিনিই তো থাকেন সমস্ত ভালো কাজে, ন্যায়বিচারে, মানবিকতায়।তাই বিজয়ার গোধূলিবেলায় তাঁকে স্মরণ করেই ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে সমস্ত প্রাপ্তি বা না পাওয়ার উর্ধ্বে উঠে মনকেমনের সঙ্গে আশ্চর্য এক আনন্দধ্বনির মধ্য দিয়ে অভিন্ন সুরের মূর্ছনায় ঝংকৃত হয় অগণিত হৃদয় হয়তো বা এমনই কৃতজ্ঞ উচ্চারণে....
'এমন এক প্রহর আসে তোমার ছোঁয়ায়
সব দুখ সুখ হয়ে হয়ে যায়....
আমি ধন্য..আমি ধন্য..আমি ধন্য..আমি ধন্য..'
বিজয়ার সেকাল ও একাল
স্বপন কুমার দত্ত
মা দুর্গা প্রতি বছর আসেন বাপের বাড়ি। চারদিন থেকে দশমীতে ফিরে যান শ্বশুর বাড়ি কৈলাশে। দশমীতে দুর্গাপ্রতিমা বিসর্জন হলেই শুরু হয়ে যায় ' বিজয়া ' ।
বিজয়ার সেকাল ছিল অত্যন্ত মধুময়। মায়ের বিদায়ের পর মন খারাপের পালা শুরু হলেও আমরা ছোট ছোট পোলাপানরা বিজয়ার মিষ্টিমুখ অর্থাৎ নারকেলের নাড়ু, মুড়ি চিড়ার মোয়া, বোদে পাওয়ার লোভে বুঁদ হয়ে থাকতাম।
সকাল থেকেই গুরুজনদের প্রণাম করার পালা হয়ে যেত শুরু। তাঁরাও মন খুলে আশীর্বাদ
করতেন। শুধু বাড়িতেই নয়, পাড়া প্রতিবেশীদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে চলতো,প্রণাম করার পালা।যতটা না নিয়ম রক্ষার, বেশিটাই ছিল নাড়ু পাওয়ার লোভে। সবটা একসাথে খাওয়া যেতনা বলে একটা ছোট থলেও থাকতো হাতে। এতে কোন লজ্জা ছিলনা। বড়রা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কোলাকুলি করতো। শত্রু মিত্র কোন ভেদাভেদ থাকতোনা। মহিলারা একে অপরকে হাত জোড় করে নমস্কার করে বিজয়া পালন করতো।
কিন্তু একালে এসে বিজয়া কেমন যেন ম্যারম্যারে হয়ে গেছে। এখন মাইক্রো পরিবারে সন্তানের সংখ্যা এমনিতেই কম। তারপর বাচ্চারা কেউ কারোর বাড়ি যায়না বা যাবার সময় পায়না। আর ঐসব নাড়ু মোয়াতেও তাদের নেই আসক্তি। চাউমিন, মোমো,নুডুলস ইত্যাদি খাবারেই তাদের বেশি রুচি। আর বড়দেরতো ভীষণ সময়াভাব। বিজয়া করে সময় নষ্ট করার কোন মানে হয়? তার থেকে বরং সেই সময়টা ফেসবুকে ডুবে থাকাই শ্রেয়। তাছাড়া গত দুবছর সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ না রেখে অভ্যাসটাও চলে গেছে। তাই কখনো পথেঘাটে পরিচিত কারোর সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে " হাই হ্যালো" করেই বিজয়ার পাট চুকে যায়। আর আধুনিক যুগে ছেলেমেয়েরা তো পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতেই ভুলে গেছে। অথচ এই বিজয়ার মাধ্যমে একটা
প্রেম প্রীতি ও নৈকট্যের বন্ধন যে গড়ে উঠতে পারে, একথা নি:সন্দেহেই বলা যায়।
আজ বিশ্বজুড়ে যে হানাহানি,হিংসা,সন্দেহ পারস্পরিক শত্রুতা,খুনোখুনি চলেছে, এই বিজয়া একটা শান্তির বাতাবরণ তৈরি করতে পারে বলে আমার বিশ্বাস।
বিজয়া পদ্য
চিরন্তন
কুমার বিজয়
পূজা আর উৎসব,
গুলিয়ে ফেলেছি,
ভাবের অভাব যেন চিরন্তন,
সযত্নে কাঁদে আপন সংস্কার,
সমর্পণের ভঙ্গিতে,
করতলে বন্দি শূন্যতা,
অম্লান হাসি টুকুই সম্পদ,
উঁচু আর নীচু, ব্যবধানি বিস্তার,
আমি দুই পা এগিয়ে যাই,
তুমিও এসো না দুই পা,
মুছে ফেলি মিলনের অন্তরায়।
শিরোনামে-খবর
যীশু চক্রবর্তী
১)সামগ্রিক লাইফ সেটিং এ বিজয়া নেই
কিংবা জোনাকি দিয়ে হ্যাজাকের আলো সাজানো
কতটুকু ভুল করলে পরে ইকুয়েশন মেলে
সেসবের হিসেব খাতায় বাতিল
২) চোখ বন্ধ বা কায়দা মন্দ হলেই কি সময় জব্দ
বাজ পড়লেই নিজেকে চিনে নেওয়া যায়
এপাশ ফিরলে লাওয়ারিশ লাশ,হয়তো শরৎ এর কাশ
৩) ভয় পেলে পর্দা নামিয়ে ফেলো বুঝি?
নাকি কার্নিভালের পোশাকেই মরে যায় দেবতা
রাজনীতি করে অরাজনৈতিক চাদর কিনে ফেলি
হড়কা বানে দেউলিয়া দেশ ও জাতি...
দশমী
সুদীপ দাস
সেই দিন দশমীর সকাল,
বিসর্জনের মন্ত্র পাঠ শেষ।
মন খারাপের বার বেলা,
যখন আগমনীর যাবার পালা।
ঠিক সেই সময়েই আগমন হয়েছিল "দশমীর"!
ফুটফুটে মেয়ে, নামটি দেওয়া ঠাকুরমার,
মৃন্ময়ীর বিসর্জনের দিন যে জন্মেছে,
"দশমী" ছাড়া আর অন্য নাম কি মাথায় আসে!
"ও মেয়ে বড় ভাগ্যবতী" বলে পারাপড়সী
বিজয়ার দিনে মিষ্টি মুখে সবার মুখে হাসি।
মধ্যবিত্ত বাবা-মায়ের কোল আলো করে
বছর পাঁচেক আগে দশমী এসেছিল ঘরে।
এই বছরও আবার, মায়ের সিঁদুর ছোঁয়া,
ছোট্ট মেয়ের গালেও তাই আলতো রাঙিয়ে দেওয়া।
নতুন জামায় মিষ্টি ভারী প্রান চঞ্চল মেয়ে,
আজ তো "দশমী"র জন্মদিন বাবা কোলে নেয় আদর দিয়ে।
সন্ধে হল ঢাকের আওয়াজ, হবে মায়ের ভাসান,
ঘাটে কত মানুষের ভিড় সবাই দেখবে বিসর্জন।
মায়ের সাথে দশমীও দেখবে বিসর্জন
ঘাটের কাছে দাঁড়িয়ে দেখে কত মানুষ জন।
বাবা গেছেন একটু দূরে খেলনা কিনবে কত
দশমীর যে ভীষণ প্রিয় মাটির পুতুল যত।
হঠাৎ এল হড়পা বান পাহাড়ী নদীর কূলে
দশমী তখনও দিব্যি মায়ের কোলে।
এক নিমেষেই জলের তোড়ে ভাসলো বহু প্রান
সারি সারি মায়ের মূর্তি স্রোতেই ভাসমান।
মায়ের বাঁচানোর শত চেষ্টা বৃথা, ভেসে গেল জলে
ছোট্ট মেয়েও হারিয়ে গেল বানের কবলে।
দশমীতে দশমীর ভাসান কান্নার রোল চারিপাশ
বাবার হাতে মাটির পুতুল, শুধুই আর্তনাদ এক রাশ।
কেন রে তুই খরস্রোতা কেড়ে নিলি এত প্রান?
আজ তো শুধুই হবার ছিল মাটির মূর্তির ভাসান!
মাটির পুতুল আগলে বুকে বাবা ফেরেন বাড়ি
মায়ের কোলে দশমী আর ফিরবে না কখনো বাড়ি!
বিষাদ এবং বিজয়াদেবর্ষি সরকার
বাইরে বৃষ্টি পড়ছে অনবরত,
ঠিক অনেকটা এক্কা দোক্কা খেলার মত।
তবে সে বৃষ্টি উমার কান্না বিশেষন লাভ করেছে,
তবে একে আমি দেখছি প্রিয়জন হারানোর হতাশার ন্যায়।
যে হতাশা কুরে কুরে খাচ্ছে প্রতিনিয়ত,
ঠিক অনেকটা গ্রহণের মত।
কাশ ফুলগুলো আজ আর সাদা নেই,
শিউলি হারিয়েছে তার সুবাস,
আমি কেবল চাই মানবতার স্পর্শ।
দুঃখের আয়নাটি আরো গভীর হয় আমার মনে।
সেই মনের এককোনে একটি আয়না আছে,
তাতে মনের রাগ, অভিমান প্রতিনিয়ত দেখা যায়।
আব্দারের মানুষ আজ আর নেই,
শরৎ দিনের চেয়েও বেশি স্নিগ্ধ ছিল তার সঙ্গ।
এই জরাজীর্ণতা কেও মনে রাখেনি,
এই বিজয়ায় নেই কোন মিষ্টতা,
আছে কেবল বন্ধু হারানোর তিক্ততা।
বিজয়া অঙ্কন
সজল সূত্রধর
No comments:
Post a Comment