Wednesday, July 2, 2025


 

মুনা 

অনলাইন আষাঢ়  সংখ্যা ১৪৩২


সম্পাদকের কথা

সাম্প্রতিক বিমান দুর্ঘটনা আমাদের প্রত্যেককে ব্যথিত করেছে। জীবন যে অতি ক্ষণস্থায়ী সেটা বুঝেছি সকলেই। কিন্তু তবু এই এক জীবনে কত সংঘাত, কত মনোমালিন্য। যেভাবে মধ্যপ্রাচ্যে দুটি রাষ্ট্র নিজেদের মধ্যে প্রবল যুদ্ধে মেতে উঠল সেটিও একটি সংকেত। আরও দুই রাষ্ট্রের যুদ্ধ কবে থামবে কে জানে। আসলে যে এই রকম যে  কোনও লড়াইয়ে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাধারণ মানুষেরা। তারা যুদ্ধ চায় না। সেটি করেন রাষ্ট্রনায়কেরা। আমাদের মতো তুচ্ছ মানুষদের জীবনের বিনিময়ে। 

নিজেদের রাজ্যে কিছুদিন আগে যে ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটল একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, সেটি দেখে আমরা প্রত্যেকেই হতবাক। এ কোথায় চলেছি আমরা। এইভাবে একের পর এক সমাজবিরোধী কাণ্ডকারখানার কেন্দ্র হয়ে উঠছে রাজ্যের নানা জায়গা। এর থেকে পরিত্রাণ কবে কেউ জানি না। কিন্তু এইটুকু বুঝতে পারছি যে, আগামী দিনগুলি বড্ড কঠিন হয়ে উঠছে ক্রমশ।     



মুনা 

অনলাইন আষাঢ়  সংখ্যা ১৪৩২



রেজিস্ট্রেশন নম্বর- S0008775 OF 2019-2020

হসপিটাল রোড 

কোচবিহার 

৭৩৬১০১

ইমেল- mujnaisahityopotrika@gmail.com 

প্রকাশক- রীনা সাহা  

প্রচ্ছদে ব্যবহৃত ছবি- ছিপছিপি, সেন্ট্রাল ডুয়ার্স চা বাগান 

সম্পাদনা, প্রচ্ছদ ছবি, অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায় 


    এই সংখ্যায় আছেন যাঁরা

 রণজিৎ কুমার মুখোপাধ্যায়, অভিজিৎ সেন, গৌতমেন্দু নন্দী, জয়তী ব্যানার্জী, 

শ্রাবণী সেনগুপ্ত, মৌসুমী চৌধুরী, শুভেন্দু নন্দী,  মাথুর দাস, 

উৎপলেন্দু পাল, প্রাণেশ পাল,  প্রিয়াঙ্কা চক্রবর্তী,  

কবিতা বণিক, রুদ্র, লীনা রায়, অর্ণব ঘোষ, 

অশোক কুমার ঠাকুর, ঋতুপর্ণা ধর, দেবর্ষি সরকার, 

চন্দন দাশগুপ্ত, রাণা চট্টোপাধ্যায়, পার্থপ্রতিম বন্দোপাধ্যায়, প্রাণজি বসাক,

দয়াময় পোদ্দার, উৎপলেন্দু পাল, প্রতিভা পাল, অমিতাভ কর,

দীপজয় সরকার, নিবেদিতা দে, মজনু মিয়া, মোঃ আব্দুল রহমান, 

 ছবি ধর, আকাশলীনা ঢোল, প্রিয়াঙ্কা চক্রবর্তী, আ সি ফ  আলতাফ, 

মনোমিতা চক্রবর্তী, নাহিদ সরদার, সুজয় সরকার, অমিতাভ চক্রবর্ত্তী,

এরশাদ, মোহিত ব্যাপারী, মোঃ আব্দুল রহমান, প্রাণেশ পাল, নজর উল ইসলাম 

শ্যামল বিশ্বাস লামশ্যা, রীতা মোদক, সুজল সূত্রধর



অনলাইন জ্যৈষ্ঠ  সংখ্যা ১৪৩২


 

স্মরণ 

নারায়ণ দত্ত 

লেখক ও বাচিক শিল্পী, ফালাকাটা।  মুজনাই সম্মাননা ২০১৭ প্রাপক।  মুজনাইয়ের প্রকাশকাল থেকে লিখেছেন মুজনাইতে। আমরা তাঁর প্রয়াণে মর্মাহত। তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি।  





 

উপনিষদের আলোকে বিবর্তনবাদ 

                    জয়তী ব্যানার্জী 
 
ওঁ স্হাপকায় চ ধর্মস্য 
       সর্বধর্মস্বরূপিণে
অবতার বরিষ্ঠায় রামকৃষ্ণায় তে নম:...

নম: যথাগ্নের্দাহিকা শক্তি 
         রামকৃষ্ণে স্হিতা হিয়া 
সর্ববিদ্যা স্বরূপাংতাং সারদাঙ্ প্রণমাম্যহম্। 

ওম্ নমঃ শ্রী যতিরাজায়
        বিবেকানন্দ সূরয়ে
সচ্চিৎ সুখ স্বরুপায় স্বামীনেতাপ হারিণে।।


       উপনিষদ হল বৈদিক সাহিত্যের চতুর্থ বা শেষ স্তর ।
উপনিষদ শব্দের আক্ষরিক অর্থ হল যে বিদ্যা নির্জনে গুরু সামনে উপনিবিষ্ট করতে হয় অর্থাৎ যাকে আমরা চলিত ভাষায় গুহ্য জ্ঞান বলতে পারি। 
           তবে ব্যবহার অনুসারে শব্দের অর্থের বিভিন্ন রকম পার্থক্য হয়।

       বেদ কিন্তু কোন পুস্তক বিশেষ নয়। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সাধকের আধ্যাত্মিক আবিষ্কারের সঞ্চিত ভান্ডার ।বেদ আর উপনিষদ কিন্তু একে অপরের ওপর নির্ভরশীল।
           
            বেদ হল ত্রিকান্ডক। যথা _____
       কর্মকাণ্ড 
         জ্ঞান কান্ড এবং 
            উপাসনা কান্ড। 

কর্মকাণ্ডের আবার দুটি ভাগ ।
যথা ____
      মন্ত্র বা সংহিতা এবং ব্রাহ্মণ। 

মন্ত্র বা সংহিতা একটি ভাগ হলেও অপরটি যে ব্রাহ্মণ তার আবার প্রথম ভাগ আরণ্যক এবং পরবর্তী ভাগ উপনিষদ বা জ্ঞানকাণ্ড। 
           আবার যদি আমরা অপরদিকে দেখি, 
      চতুর আশ্রম অর্থাৎ গৃহস্থ্যাশ্রমে ব্রাহ্মণ অংশে ব্রহ্মচর্যাশ্রম -এর মন্ত্রাদি সহায় অধীত বিদ্যার প্রয়োগ প্রসার ও আরণ্যকের প্রস্তুতি হেতু ই হল চিত্ত শুদ্ধি। 
            
        এর পাশাপাশি আরণ্যকে আমরা পাই শুদ্ধ চিত্তে গৃহস্থ্য আশ্রমের কর্মকাণ্ডের মনন দ্বারা কর্মকাণ্ডের কারণের উপলব্ধি, যার প্রকাশ উপনিষদে রয়েছে।
        যেখানে জ্ঞানযোগ এর অনুশীলন শুরু এবং সন্ন্যাস আশ্রমে উপনিষদের সাহায্যে ধ্যান সমাধি, এইসবের দ্বারা ব্রম্ভজ্ঞান উপলব্ধি হয়ে থাকে। 
 
               মানুষ কিন্তু অতি প্রাচীনকাল থেকেই কার্যকারণের তত্ত্ব জানত। কিন্তু পরে আমরা দেখেছি আমাদের পন্ডিতেরা বা দার্শনিকেরা দর্শন ও ন্যায়ের ভাষায় এই সমস্ত তথ্য বর্ণনা করেছেন। কিন্তু সেই বর্ণনাও অস্পষ্ট ।এগুলি কিন্তু সবই অন্তরের অনুভূতি। 



               তবে এটা আগে কার্যে পরিণত হয়, তারপরে তা দর্শনের রূপায়িত হয়েছে ।

                     প্রাচীন ঋষিদের সাথে বিশ্ব প্রকৃতি কথা বলতো ।পশু পাখি চন্দ্র সূর্য কথা বলতো ,কিন্তু আধুনিককালের নিয়ম অনুযায়ী অন্যের মস্তিস্ক প্রসূত কতগুলি বিষয় সংগ্রহ করে একটা বই রচনা করাই কিন্তু মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল না ।

আবার সুদীর্ঘ বক্তৃতা দেওয়াও উদ্দেশ্য নয়, উপনিষদের বিবর্তনের উদ্দেশ্য হল____
           সত্য আবিষ্কার ।

যার অভ্যাস ছিল সাধনা এবং যা চিরকাল থাকবে ।

ধর্ম চিরকাল ব্যবহারিক বিজ্ঞানরূপে থাকবে, এমন ধর্ম কখনোই থাকবে না_______
 যা শুধু দেবতা তত্ত্বের ওপর প্রতিষ্ঠিত। 

         প্রথমে অভ্যাস তারপর জ্ঞান।

 জীবাত্মা ------যে এখানে ফিরে আসে ।এ ধারণা কিন্তু উপনিষদে রয়েছে ....

        যারা ফল কামনা করে কোন সৎকর্ম করে, তারা সেই সৎকর্মের ফলপ্রাপ্ত হয় ।কিন্তু ওই ফল নিত্য নয় ।

       এখানের উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো কার্যকারণ বাদ। 

           কারণ অনুসারেই কার্য হয়ে থাকে। কারণ যা কার্য তাই হবে ।কারণ যখন অনিত্য তখন কার্য অনিত্য হবে। কারণ নিত্য হলে কার্য নিত্য হবে । 
             কিন্তু সৎকর্ম করা কারণগুলি অনিত্য বা অসীম। সুতরাং তার ফল কখনোই নিত্য হতে পারে না। 

        আবার যদি আমরা উপনিষদে ফিরে যাই ,তাহলে দেখব____
            উপনিষদ সাধারণভাবে বেদান্ত নামেই অভিহিত হয়ে থাকে।

         এই শব্দটির অর্থ ব্যাখ্যা হয় বেদের শেষ অধ্যায় গুলিতে ।আবার যে বিকল্প অর্থ করা হয়ে থাকে সেটা হল বেদের বিধেয় বা সর্বোচ্চ উদ্দেশ্য। 

ব্রম্ভ ও আত্মা শব্দ দুটি উপনিষদে ব্যবহৃত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি শব্দ। 
ব্রম্ভ হলেন বিশ্বের সত্তা আর ব্যক্তিগত সত্তা হলো আত্মা ।
         শব্দ দুটির বুৎপত্তি নিয়ে পন্ডিতদের মধ্যে যথেষ্ট মতভেদ আছে। 
      ব্রম্ভ শব্দটি ব্র থেকে এসেছে যার অর্থ হলো বৃহত্তম ।
       ব্রম্ভ হলেন স্থান কাল ও পাত্র কার্যকারনের অতীত এক অখণ্ড সত্তা। তিনি অব্যয় অনন্ত ও চির মুক্ত শাশ্বত অতীন্দ্রিয় ।আত্মা বলতে বোঝায় জীবের অন্তর্নিহিত অমর সত্তাটিকে। 

উপনিষদের মন্ত্রদ্রষ্টাদের মতে, 
          আত্মা ও ব্রম্ভ এক এবং অভিন্ন এটাই উপনিষদের সর্বশ্রেষ্ঠ মতবাদ। 

তবে আবার কর্মজীবনে বেদান্ত মানে, কর্মের মাধ্যমে জীবনের উন্নতি ও আধ্যাত্মিক বিকাশে বেদান্ত দর্শনের প্রয়োগ ________যা স্বামী বিবেকানন্দের মতো দার্শনিকদের দ্বারা বিশেষভাবে উৎসাহিত হয়েছে। 

বেদান্তের মূল শিক্ষা হলো ,
          কর্মফল ও পুনর্জন্মের ধারণা। যেখানে প্রতিটি চিন্তা ও কাজের ফলস্বরূপ ভবিষ্যতের অভিজ্ঞতা তৈরি হয়।

       কর্মজীবনে বেদান্তের প্রয়োগের অর্থ হল কর্মের প্রতি মনোযোগ দিয়ে ভালো কাজ করা এবং অন্যের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে জীবনকে অর্থপূর্ণ করা।
 

            উপনিষদের ধারণায় ,
  
পৃথিবীতে ব্রহ্ম কেবল প্রজ্ঞাই নয়,ঈশ্বর ও বটে। তিনি আইনের অধীন নন ।তিনি কেবলমাত্র প্রক্রিয়া ব্যবহার করেন।
                      এটি কেবল অজ্ঞতার অবস্থায় থাকা স্বতন্ত্র আত্মা, যার ওপর ক্রিয়া বা প্রক্রিয়া দিয়ে নিজেকে আইন হিসেবে চাপিয়ে দেয় বলে মনে হয় ।

 আমাদের প্রতি মুহূর্তেই মনে রাখতে হবে যে ,
      উপনিষদের অভ্যুদয়ের সময় কর্মকাণ্ড এত জটিল ও বর্ধিতায়ন ছিল যে তা থেকে মুক্ত হওয়া ছিল প্রায় অসম্ভব। কিন্তু কর্মযোগের মাধ্যমে স্বামীজি বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে ,

                  প্রত্যেক কর্মকাণ্ডের ভেতর একটি উচ্চতর গভীর অর্থ আছে।


            প্রাচীনকালে যেসব যাগ যজ্ঞ ,কর্মকাণ্ড ছিল তাকে কিন্তু আধুনিক সংস্কারকরা মিথ্যে বলে উড়িয়ে না দিয়ে ওগুলির উচ্চতর তাৎপর্য বুঝিয়ে দিয়ে মানুষের সামনে নব দিগন্তের উন্মোচন করলেন। 

             এই প্রসঙ্গে আমরা বলতে পারি ,



          ব্রহ্মাণ্ড ও জগত সবকিছুই ঈশ্বর দ্বারা আচ্ছাদিত অর্থাৎ 
"লোভ কোরো না ধনে কি আছে "______
       পরবর্তীতেই শ্রী শ্রী মাতা ঠাকুরানী বলছেন ,
           নির্বাসনা 
অর্থাৎ নির্বাসনা না হলে ব্রম্ভজ্ঞান হয় না ।

এত সহজভাবে মা বুঝিয়ে দিয়েছেন, বেদবেদান্ত উপনিষদ সব কথার সার ই যেন মায়ের নিদান______ এই হল বিবর্তনের ধারা। 

আবার স্বামীজীর "বনের বেদান্তকে ঘরের বেদান্তে " উপনীত করার যে উদ্যোগ ____এই ধারণার প্রথম পথপ্রদর্শক হলেন শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব ।
             "শিব জ্ঞানে জীব সেবা"
                স্বামীজীর এই উক্তি যেন হৃদ্ কন্দর আলোড়িত করে ।এ যেন উপনিষদের মহাবাক্য গুলির মতো আত্মা ও পরম আত্মার সম্পর্কের জটিল তত্ত্বের সহজ নিদান। 

তাইতো তিনি মঠ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যতে লিখছেন ,
     "আত্মানো মোক্ষার্থায়
              জগৎ হিতায় "
ঠাকুর যেমন বেদের সব সার বোঝাতে বলেছেন ,
       ব্রম্ভ সত্য জগত মিথ্যা ।

তিনি এই বাক্যকে বলেছেন জ্ঞান ।

          কিন্তু ত্যাগী পুরুষ যখন 'নেতি-নেতি 'করে উত্তরণের শেষ প্রান্তে পৌঁছান সেই বিজ্ঞানী পুরুষ দেখে_____

সিঁড়ি যে চুন সড়কি দিয়ে তৈরি ছাদ ও সেই একই চুন সড়কি দিয়েই তৈরি।

 স্বামীজি এই কথারই প্রতিধ্বনি করেছেন তার প্রতিটি ভাষণে চিঠিতে।

 তাইতো ঠাকুর যদি কথামৃতের স্রষ্টা হন বা আধুনিককালের জগত স্রষ্টা হন, তাহলে স্বামীজি হলেন তার পথপ্রদর্শক আর মা অর্থাৎ জগৎ জননী সারদা দেবী হলেন তার ইমপ্লিমেন্টেশন বা রূপকার।

 যা কিনা বেদ বেদান্ত উপনিষদের ধারায় মিলেমিশে একাকার।
 প্রাচীন সাধুদের মতে,
           একে তিন তিনে এক।


 

সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বাংলা সাহিত্যে ও স্বাধীনতা আন্দোলনে অবদান

রণজিৎ কুমার মুখোপাধ্যায়



বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮–১৮৯৪) বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র এবং আধুনিক বাংলা গদ্য ও উপন্যাসের জনক হিসেবে খ্যাত। তাঁর সাহিত্যকর্ম শুধুমাত্র সাহিত্যিক পরিপক্বতা নয়, বরং জাতীয়তাবাদ, সমাজসংস্কার এবং স্বাধিকার চেতনার উন্মেষ ঘটিয়েছিল। বাংলার সাহিত্য এবং ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁর অবদান বাঙালি জাতি যতদিন থাকবে ততদিন তাকে শ্রদ্ধার সহিত মনে রাখবে।


বাংলা সাহিত্যে অবদান:

১. বাংলা উপন্যাসের ভিত্তি নির্মাতা:

বঙ্কিমচন্দ্র বাংলা সাহিত্যে উপন্যাস ধারার সূচনা করেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘দুর্গেশনন্দিনী’ (১৮৬৫) বাংলা সাহিত্যের প্রথম পূর্ণাঙ্গ রোমান্টিক উপন্যাস হিসেবে স্বীকৃত। এরপর কপালকুণ্ডলামৃণালিনীচন্দ্রশেখররজনীআনন্দমঠবিষবৃক্ষকৃষ্ণকান্তের উইল প্রভৃতি উপন্যাস বাংলা সাহিত্যকে নতুন দিগন্তে পৌঁছে দেয়।

২. ভাষার সরলীকরণ ও সৌন্দর্যবোধ:

তাঁর লেখনীতে খাঁটি বাংলা ভাষার স্বাদ মেলে। সংস্কৃতঘেঁষা ভাষার পরিবর্তে তিনি সাধু ভাষার রীতিতে সাহিত্য রচনা করেন, যা পরবর্তীতে বাংলা সাহিত্যে মান্যতা পায়। তাঁর গদ্যশৈলী ছিল সুসংহত, ছন্দোময় ও অলঙ্কারপূর্ণ, কিন্তু পাঠযোগ্যতায় সহজ ও সাবলীল।

৩. চরিত্রচিত্রণ ও বাস্তবধর্মিতা:

বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের চরিত্রগুলি জীবন্ত। নারীর আত্মমর্যাদা, প্রেম, সমাজে নারী-পুরুষ সম্পর্ক, জাতি, ধর্ম, সমাজ সংস্কার সবকিছু নিয়ে তিনি ভাবতেন এবং উপন্যাসে তা প্রতিফলিত হত। উদাহরণস্বরূপ, বিষবৃক্ষ-এ নারীর আত্মবোধ এবং ব্যক্তিস্বাধীনতার চিত্র চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে।

৪. সামাজিক ও ধর্মীয় চিন্তা:

তিনি কেবল সাহিত্য রচনাই করেননি, বরং সাহিত্যকে সমাজসংস্কারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন। সমাজে ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুসংস্কার, বিধবা বিবাহ নিষেধ, জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে তিনি তীব্র অবস্থান লক্ষ্য করা যায় । তাঁর বাঙালির আত্মপরিচয় গড়ে তোলার মধ্যে এই সামাজিক দায়বদ্ধতা প্রবলভাবে প্রকাশ পায়।


স্বাধীনতা আন্দোলনে অবদান:

১. 'বন্দে মাতরম্‌' – জাতীয়তাবাদের রণহুঙ্কার:

বঙ্কিমচন্দ্রের শ্রেষ্ঠ কীর্তি আনন্দমঠ (১৮৮২) উপন্যাসে ‘বন্দে মাতরম্‌’ গানটি রচিত হয়। এই গানটি ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রেরণার উৎস হয়ে ওঠে। এটি প্রথমে সাহিত্যে, পরে রাজনীতিতে এমনভাবে মিশে যায় যে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে এটি কার্যত এক "জাতীয় মন্ত্র"-তে রূপান্তরিত হয়। এই গানটি পরবর্তীতে ভারতের জাতীয় গানের মর্যাদা পায়।

২. 'আনন্দমঠ' উপন্যাসে বিপ্লবের চিন্তা:

আনন্দমঠ উপন্যাসে সন্ন্যাসীদের ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র বিদ্রোহ একটি রূপক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। সেখানে দেশমাতৃকার পূজা, শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, জাতীয় ঐক্য – এসব বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। এই উপন্যাস জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারাকে উসকে দেয় এবং বহু বিপ্লবী এই বই থেকে প্রেরণা পান।

৩. জাতীয় চেতনার জাগরণ:

বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর রচনার মাধ্যমে ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয় আত্মচেতনা জাগিয়ে তুলতে চেষ্টা করেন। উপন্যাস ও প্রবন্ধে তিনি অতীতের গৌরবগাথা, সংস্কৃতি ও আত্মমর্যাদার ধারণা পুনর্জীবিত করেন। তিনি মনে করতেন, একমাত্র শিক্ষিত, আত্মসচেতন, আত্মবিশ্বাসী জাতিই নিজেদের অধিকার ছিনিয়ে নিতে পারে।

৪. হিন্দু সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের পুনরুজ্জীবন:

বঙ্কিমচন্দ্র চেয়েছিলেন ভারতীয়রা তাদের নিজস্ব ইতিহাস, ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রতি গর্ববোধ করুক। তিনি হিন্দুধর্মের আধ্যাত্মিক শক্তিকে সামাজিক জাগরণ এবং রাজনৈতিক চেতনার সঙ্গে যুক্ত করতে চেয়েছিলেন। যদিও তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গি পরে সমালোচনার মুখেও পড়ে, তবে তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় চেতনাকে জাগ্রত করা।


উপসংহার:

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কেবল একজন সাহিত্যিক নন, তিনি জাতির শিক্ষক, সমাজ-সংস্কারক এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের বুদ্ধিবৃত্তিক পথপ্রদর্শক। তাঁর রচনায় সাহিত্য ও রাজনীতির যে অপূর্ব সংমিশ্রণ ঘটে, তা বাংলা সাহিত্যকে যেমন সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ভিতও গড়ে তুলেছে। আজও তাঁর “বন্দে মাতরম্‌” ভারতবাসীর হৃদয়ে এক অমোঘ স্পন্দনের মতো ধ্বনিত হয়। তাই বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় শুধু সাহিত্য সম্রাট নন, বরং তিনি ছিলেন জাতীয় চেতনার মহান স্থপতি।



 






বড়িশার রথযাত্রা
শ্রাবণী সেন গুপ্ত

এক সময়ে দক্ষিণবঙ্গের স্বনামধন্য ভূস্বামী পরিবার ও তৎকালীন সময়ের অবিভক্ত বাংলাদেশের এক পঞ্চমাংশ ভূমির রাজস্ব আদায়ের কর্তা সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের সুসন্তান রায় কৃষ্ণদেব মজুমদার চৌধুরী বড় বাড়ির প্রতিষ্ঠাকল্পে ১৭১৯ খ্রিস্টাব্দে প্রজাদের আনন্দবর্ধন করার জন্য বড়িশা গ্রামে বাঙালির অন্যতম প্রধান উৎসব রথোৎসবের প্রচলন করেন। সেকালে জমিদার বাড়ির শালগ্রাম নারায়ণ শিলা শ্রীধরদেব কে নিয়ে এক সুবৃহৎ ত্রিতল রথযান জনপদের গ্রাম পরিক্রমা করতো। কবিগান, যাত্রাপালা, মহানাম সংকীর্তন, হোম যজ্ঞ ও অন্নসত্রে উৎসবের দিনগুলি মুখরিত হয়ে থাকতো। পরবর্তীকালে কৃষ্ণদেব পুত্র রায় নন্দলাল, তৎ পুত্র রাঘবেন্দ্র, তৎ পুত্র তারিণীচরণ ,তৎ পুত্রদ্বয় সূর্য কুমার ও তারা কুমারের সময়ে এই উৎসবের উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি ঘটে। আরো পরে বড় বাড়ির জ্যেষ্ঠ শরিক বাবু লাল কুমার রায়চৌধুরী ১৯১১ সালে সখের বাজারে এক মন্দির নির্মাণ করে সেখানে মহাপ্রভু শ্রী শ্রী জগন্নাথ দেব, দেবী সুভদ্রা ও শ্রী বলভদ্র দেবের দারুবিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন। উড়িষ্যা প্রদেশের শ্রী পরমানন্দ পান্ডা দেব সেবার ভার গ্রহণ করেন। প্রাচীন শৈলী অনুযায়ী তৈরি হয় এক সুবৃহৎ ত্রিতল রথযান। প্রথমে সাবর্ণ রায় চৌধুরীদের জ্ঞাতি ব্যানাকি  বাড়িতে , পরে ১৯৩২ সাল থেকেঘোষপাড়ার স্বর্গীয় হীরালাল বসুর গৃহে শ্রী শ্রী জগন্নাথ দেবের গুন্ডিচা নিবাসের প্রথা আরম্ভ হয়। ১৯৭৫ সাল নাগাদ ডায়মন্ড হারবার রোডের সম্প্রসারণের প্রাক্কালে পুরনো রথযাত্রীর ঘর ভাঙ্গা পড়লে সেটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৯৮৪ সালে পূর্বতন উৎসব সমিতির অধ্যক্ষ শ্রী কিংশু কুমার রায়চৌধুরী , মহাসচিব প্রয়াত শ্রী গোরাচাঁদ রায়চৌধুরীর নেতৃত্বে এবং বড়িশার বিশিষ্ট নাগরিকবৃন্দের প্রচেষ্টায় সর্বজনীন উদ্যোগে পুরীধাম থেকে কারুকৃৎ এনে নতুন রথযান নির্মাণ করে বড়িশার প্রাচীন উৎসবকে আবার সগৌরবে ও স্বমহিমায় সু প্রতিষ্ঠিত করা হয়। ২০১৮ সালে সাড়ম্বরে বড়িশা সার্বজনীন রথ উৎসব এর ত্রিশত বর্ষ মহামহোৎসব মহাসমারোহে পালিত হয়। বিভিন্ন সময়ে বড়িশা গ্রামের বিশিষ্ট অধিবাসীবৃন্দের অকুণ্ঠ সহযোগিতায় এই ত্রি শতাব্দী প্রাচীন রথযাত্রা উৎসব আজ কলকাতা শহরের প্রাচীনতম।।
        বর্তমানে বিকেল চারটের সময় সখের বাজারের জগন্নাথ মন্দির থেকে বেরিয়ে বড় বাড়িতে গিয়ে রথের স্থাপন করা হয়। তারপর বিকেল পাঁচটায় রথ টানা হয় চৌরাস্তা পর্যন্ত এবং দক্ষিণে শীলপাড়া ভজনা আশ্রম পর্যন্ত। এই উৎসব উপলক্ষে জগন্নাথ মন্দির থেকে ভজনা আশ্রম পর্যন্ত বিভিন্ন রকম পসরা নিয়ে রথের মেলা বসে।





 

উঠোন 
মৌসুমী চৌধুরী 

        সক্কাল সক্কাল উঠে নারকেল কাঠির ঝাঁটার থমকে আম-জাম- কাঁঠাল-পেয়ারা-আতা প্রভৃতির হলুদ ঝরা পাতাগুলোকে ঝাঁটিয়ে সাফাই করতেন জেঠিমা। গোটা উঠোন জুড়ে তখন একটা মিষ্টি মসমস-সরসর আওয়াজ উঠত । তারপর গোবর ছড়া দিয়ে চতুর্ভূজাকার পেল্লাই সেই উঠোনটিকে তিনি খুব সুন্দরভাবে নিকোতেন। সেই লেপনটা শুকিয়ে গেলে গোটা  উঠোনটা বেশ খটখটে হয়ে উঠত। আর আমরা তাতে স্কুল থেকে নিয়ে আসা চক দিয়ে কোর্ট কেটে এক্কাদোক্কা খেলতাম। কখনও কুমীর ডাঙা খেলতাম, কখনও বৌচুরি ও কখনও খেলতাম ইচিং বিচিং ... জেঠিমা আমার রক্তীয় কেউ ছিলেন না। আর সে সময় আমাদের আপন পর বোধগুলো একেবারেই আলাদা ছিল। আমাদের বাবা মায়েদের আমাদেরকে
 নিজের ঘরে আটকে রাখার প্রবণতা একদম ছিল না। তাঁদের জীবন দর্শন ছিল—
"আমায় রাখতে যদি আপন ঘরে বিশ্ব ঘটে পেতাম না ঠাঁই... "
 তাঁরা আমাদের বিশ্ব ঘরেই ঠাঁই দিয়েছিলেন। ফলে জেঠিমা আমার অনুভূতিতে কোনদিন বাড়উলি জেঠিমা নন, প্রকৃত জেঠিমা-ই ছিলেন।
        যে সময়টাতে উ
ঠোন ঘিরে পাতা ঝরে পড়ার মতো গাছ প্রায় সব বাড়িতেই ছিল,  আবার গাছেদের সামনেও পাতা ঝরিয়ে দেবার মতো উঠোনের দু'বাহু বাড়ানো উদাত্ত আহ্বান ছিল। আর সেই সময় আমাদের জীবন ছিল মাথার ওপরের হালকা নীল তুলি বুলোনো আকাশের মত। আর জীবন জুড়ে জেঠিমা ছিলেন গাছেদের মতোই স্নেহের ছায়া-শীতলতা বিছিয়ে।
 
   উঠোনের এককোণে ছিল জেঠিমার তুলসীমঞ্চ। সকালে স্নান সেরে এসে এক পিঠ ভেজা চুলে তিনি পিতলের ঘটি থেকে  তুলসী গাছের গোড়ায় জল দিতে দিতে চোখ বুজে মন্ত্রোচ্চারণ করতেন। সকালের নরম ফিকে হলুদ আলো জেঠিমার মুখে এসে পড়ত।  মুখে তাঁর খেলে যেত এক স্বর্গীয় দীপ্তি। 
আবার সেই উঠোনেই ছোট্ট এক পুকুর কেটে জেঠিমা নাটাই পুজো করতেন। কখনও শনি-সত্যনারায়ণ পুজো করতেন। প্রিয় সেই উঠোনটিতে পাত পেড়ে বসে আমরা পুজোর প্রসাদ খেতাম। দোলের দিন উঠোনের এককোণে উনুন খুঁড়ে আমাদের পিকনিক হত খিচুরি, আলু ভাজা, ডিম কষা দিয়ে। হাসি মুখে গরম গরম খিঁচুরি রাঁধতেন জেঠিমা। কাঠের জ্বালের লালাভ হলুদ আভায় তাঁর ফর্সা
মুখখানিতে নরম আদুরে ভাব ফুটে উঠত।
        উঠোনের পুব দিকে ছিল জেঠিমাদের শোবার ঘর, বারান্দা আর বারান্দা লাগোয়া আরও একটি ছোট্ট ঘর। পশ্চিমে ছিল মা আর জেঠিমার রান্নাঘর পাশাপাশি, পরিচ্ছন্ন নিকোনো দাওয়া। উঠোনের উত্তর দিকের শোবার  ঘরটিতে আমরা থাকতাম। আর উঠোনের দক্ষিণ প্রান্তের পুরোটা জুড়ে ছিল জেঠিমার কিচেন গার্ডেন। লাউ, কুমড়ো , ঝিঙে, ঢ্যাঁরশ, লঙ্কা, লেবু ফলত সারা বছর। আর ছিল মস্ত একটা সজনে গাছ। ফাল্গুন মাসে সেই ফুলবতী সজনে সুন্দরী সাদা মুকুট মাথায় বড় আহ্লাদে মাথা নাড়ত। আর উঠোনখানা ঘিরে মায়ের মতো আঁচল বিছিয়ে ছড়িয়ে দিত ফুলেল আদর। আবার ফলবতী সজনের সবুজ ডাঁটাগুলোও তিরতিরে মিহি বাতাসে দুলে দুলে উঠত। উঠোন ঘিরে সম্ভ্রমে মাথা উঁচু করে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকত আম, জাম, আতা এবং  কাঁঠালেরাও। আর  উঠোনের অনতিদূরে পাতকুয়োটি  এক বুক ঠান্ডা জল নিয়ে অপেক্ষা করত কখন আমরা জল তুলে ঝুপ ঝুপ স্নান করব। আর গা মুছিয়ে দিয়ে জেঠিমা আমাদের সারা গায়ে তেল মেখে দেবেন। শীতকালে সর্ষের তেল আর আর বাদবাকি সারাটা বছর নারকেল তেল।
      গ্রীষ্মের সন্ধেতে হ্যারিকেনের ফিকে হলুদ আলোয় ওই উঠোনেই মাদুর পেতে আমরা দাদুর কাছে পড়তে বসতাম। দুলে দুলে পড়া মুখস্থ চলত। জেঠিমার বাগান থেকে তখন লেবুফুলের মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসত। স্কুলের বইতে "রাতের আকাশ" পড়তে পড়তে কালপুরুষ, সপ্তর্ষিমন্ডল প্রভৃতিকে বইয়ের পাতা থেকে সোজা আকাশের গায়ে ছড়িয়ে থাকতে দেখতাম। মিলিয়ে নিতাম সত্যি সত্যি সপ্তর্ষিমন্ডলকে প্রশ্নবোধক চিহ্নের মতো দেখাচ্ছে কিনা! আর মিলে গেলেই আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠতাম। কখনও কখনও উঠোন পেরিয়ে জেঠিমার ঠাকুরঘর থেকে  ভেসে আসত ঠাকুরের গান,  "... হরি নাম পরম ব্রক্ষ্ম/ জীবের মূল ধর্ম/ অধর্ম কুকর্ম ছাড়রে।..." সে গানের মানে তখন বুঝতাম না। শুধু বুকে এসে বাজত একটি শব্দ "কুকর্ম", মনেহত বুঝিবা জেঠিমা আমাদের কুকর্মগুলো জেনে গেছেন। দুপুরের উঠোনে শুকোতে দেওয়া জেঠিমার আচার, আমসত্ত্ব সাবাড় করবার কুকর্ম যে করে ফেলেছি। খুব লজ্জা হত তখন।

      সেই উঠোনেই একদিন কলাগাছ দিয়ে  তৈরি হয়েছিল ছাঁদনাতলা। জেঠিমার ছোট মেয়ে রেখাদির বিয়ের আসর বসেছিল  — মালাবদল, শুভদৃষ্টি। পরের দিন বাসি বিয়ে। সাত পাক ঘুরিয়ে সিঁদুর দান, তারপর আংটি খেলা৷ সবশেষে ওই উঠোন ছেড়েই কাঁদতে কাঁদতে রেখাদির শ্বশুরবাড়িতে চলে যাওয়ার ঘটনা খুব কষ্ট দিয়েছিল আমাদের। তারও পরে যেদিন ঘোর কালো এক বৃষ্টির দিনে কানায় কানায় ভরা রাক্ষুসে নদী জেঠিমার বড় মেয়ে শিখাদিকে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। সেদিনও শেষবারের মতো সেই নিকোনো উঠোনেই তার শয্যা পাতা হয়েছিল। "বল হরি হরি বল" বলতে বলতে শিখাদিকে নিয়ে যাবার সময় দুধ সাদা খইগুলো যেন কেঁদে কেঁদে মুক্তোদানার মতো উঠোনের ইতিউতি ছড়িয়ে পড়েছিল। জেঠিমা আর্তনাদ করে কেঁদে চলেছিলেন। সঙ্গে আমরাও কাঁদছিলাম হাপুসনয়নে। উঠোনও কি আমাদের দুঃখের শরিক হয়েছিল সেদিন? নাকি নির্কিকার, নিরাসক্ত সত্য দ্রষ্টার মতো শুধু চেয়ে চেয়ে দেখেছিল শিখাদির চলে যাওয়া? 
    আমাদের সেই দুই-ঘর এক-উঠোন একদিন আর রইল না। বাবা-মায়ের আঙুল ধরে আমরা পাড়ি দিলাম অন্য এক উঠোনে। সে উঠোন নাকি আমাদের নিজেদের বাড়ির উঠোন। কিন্তু মন কেন তাতে সায় দেয় না? কেন আজও নিজের একান্ত উঠোন বলতে জেঠিমার স্নেহবিজরিত সেই উঠোনটিকেই বড় মনেপড়ে? আমি কি সত্যি সত্যিই শুধু আপন ঘরে নয়, বিশ্ব ঘরেও ঠাঁই পেয়েছিলাম? 
 


 


আধুনিক/অতি আধুনিক কবিতা এবং হোমিওপ্যাথি 

গৌতমেন্দু নন্দী


সাহিত্য আর বিজ্ঞান ---আপাতভাবে দুই মেরুতে অবস্থান করলেও  দুটোরই প্রকাশ মাধ্যম ভাষা। সেই ভাষা হোতে পারে বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি --- যে কোন ভাষা। 

      সাহিত্যর একাধিক শাখার মধ্যে অন্যতম হোলো "কবিতা" আর বিজ্ঞানেরও অনেক শাখার মধ্যে একটি হোলো চিকিৎসা বিজ্ঞান। তারও একাধিক  শাখার অন্যতম হোলো "হোমিওপ্যাথি"। 
   
এই কবিতা তথা আধুনিক কবিতা এবং হোমিওপ্যাথি---এই দুটো বিদ্যা বা অনুশীলন-চর্চার মধ্যে একটা সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া গেছে।
   
প্রথমে হোমিওপ্যাথি তেই আসা যাক ----।

       ভদ্রলোকের নাম ঘনশ্যাম সামন্ত। সরকারী চাকরী থেকে অবসর নেওয়ার পর তাঁর সময় কাটছিল না। দুই -একমাস দুই একটা হোমিওপ্যাথির বই ঘাঁটাঘাঁটি করে শুরু করে দিলেন প্র্যাকটিস। বাড়িতেই খুলে ফেললেন ডিসপেনসারি। সামনে  নেমপ্লেটে উজ্জ্বল অক্ষরে লেখা ---ডাঃ ঘনশ্যাম সামন্ত,বি.এস সি। না, হোমিওপ্যাথির উপর তার প্রথাগত কোন ডিগ্রী বা ডিপ্লোমা নেই। রোগীদের  আনাগোনা কিন্ত বাড়তে লাগলো। 
   
"ডাক্তারবাবু,ক'দিন ধরে মাথাটা ছিড়ে যাচ্ছে,জ্বর জ্বর ভাব...." স্টেথোর দুই প্রান্ত দুই কানের মধ্যে ঢুকিয়ে বাকী প্রান্তের গোল  মেটাল চাকতিটি ঘনশ্যাম দাবার চালের মতো রোগীদের বুকের উপর বিভিন্ন অংশে আঙ্গুল দিয়ে যেন চাল দিতে লাগলেন----
" হুম্, ওষুধ দিচ্ছি---ছয়টি করে বড়ি দিনে তিনবার, দুই দিন পরে আসবেন।"যে ওষুধ তিনি দিলেন তা হোল বেলেডোনা 200 এবং রোগী দুই দিন পরে যথারীতি সুস্থ হয়ে এলেন।
    ঘনশ্যাম সামন্ত ধীরে ধীরে চিকিৎসক হিসেবে পরিচিতি পেতে লাগলেন। তিনি ক্রমান্বয়ে প্রেসক্রাইব করতে লাগলেন " ককুলাস ইন্ডিকা--30, একোনাইট--30, আর্নিকা --30.......
     রোগীরাও চার-পাঁচ দিনের মাথায় সুস্থ হয়ে উঠতে লাগলেন। ওষুধের গুনে না সময়ের স্বাভাবিক স্রোতে  জানা গেল না। নো সাইড এফেক্ট,নো রিক্স অ্যাট অল কিন্তু সামন্তবাবু চিকিৎসক হয়ে গেলেন।

       এবার আসা যাক কবিতায/আধুনিক,অতি আধুনিক কবিতায়। কবির নাম উদাসীন হালদার।বয়স মধ্য চল্লিশ। শরীরে মাংস বর্জিত অস্থি সমৃদ্ধ লিকলিকে কাঠামোয় নিত্যনতুন পাঞ্জাবির বিজ্ঞাপন। মাথায় এবং গালে জলাভূমির মতো আগাছার আধিক্য। ঘাড়ে স্নান-খাওয়া বাদে সবসময় ঝুলছে শান্তিনিকেতনী সাইড ব্যাগ। তিনি সমাজে একজন প্রতিষ্ঠিত কবি ---"আধুনিক, উগ্র আধুনিক,অতি আধুনিক"। চোখে কবিতার আগুন। তাঁর কবিতার শব্দ চয়ন কেমন? ---অভিধান বহির্ভূত শব্দভাণ্ডারে তার কবিতা মাথার উপর দিয়ে আকাশ, মহাকাশ কোথায় গিয়ে যে শেষ হয়! কিন্তু তার নিজস্ব পরিমন্ডলে তার গুণগ্রাহী পাঠকদের কাছে উদাসীন হালদার "লাজবাব"! "গুরুর জবাব নেই মাইরি!" "উদাসীন দা কী লিখছেন আজকাল,একদম চাবুক!"
          "----- রমনীর যোনীতে জারজ সন্তান 
                 ধরনীর খনিতে যমজ মস্তান....."
      "উহু!!  ফ্যান্টাস্টিক!!" "গুরুর জবাব নেই"।

না, সাহিত্যের অন্যান্য শাখায় তিনি "উদাসীন" হলেও  কবিতার ক্ষেত্রে একশো শতাংশ অ্যাক্টিভ। বলে বলে কবিতা লেখেন। কলম দিয়ে ফুলঝুরির মতো তার  কবিতা বেরোয়। সেদিন "হঠাৎ উন্মোচন" ক্লাবের  সদস্যরা উদাসীন হালদারের কাছে এসে বললো 
    " উদাসীন দা, এবার ক্লাবের পুজোর সুভিনিয়রের জন্য একটা প্রবন্ধ চাই---একদম ব্যুলেট"।
        "দ্যাখ, ঐসব গল্প, প্রবন্ধ-টোবন্ধ আমার ঠিক  আসে না। কবিতা চাই? ঝুড়ি ঝুড়ি সাপ্লাই দিতে পারি"। 

           কী বুঝলেন? পাঠকরা কি ভাবছেন আমি কবিতার "পিন্ডি" চটকাচ্ছি? বিশ্বাস করুন,মোটেও তা নয়।  "হোমিওপ্যাথি" প্র্যাকটিসে যেমন কোন সাইড এফেক্ট বা ঝুঁকি নেই, তেমনি তথাকথিত এই  "আধুনিক,অতি আধুনিক" কবিদেরও কোন ঝুঁকি নেই। গল্প, উপন্যাস লেখার অনেক হ্যাপা। চরিত্র, সংলাপ নির্বাচন এবং বোধগম্য ভাষার অক্ষর বিন্যাস। ভালো -মন্দে "বিমূর্ততা" নেই বললেই চলে।

 সেখানে পাঠকের প্রতিক্রিয়া সরাসরি ---"ভালো" বা "মন্দ" কিন্তু কবিতার তথাকথিত অতি আধুনিক কবিতার বিচার কে করবেন? পুরো ব্যাপারটাই তো কেমন "বায়বীয়"!  দুর্বোধ্য শব্দে অসামঞ্জস্যপূর্ণ পংক্তির সঠিক বিচার কি হয়? নাকি ছন্দহীন দর্বোধ্যতাই কবিতার অলংকার?! কাকে বলে কবিতা?  যা পড়েন কবি, তা? 

        নিজের অভিজ্ঞতা বলি। একবার কোন এক  পত্রিকার তরফে লেখা চাইতে এসে বলা হোল দুই দিনের মধ্যে একটা লেখা দিতে। বললাম অন্ততঃ চার -পাঁচ দিন সময় দিতে। উত্তরে তারা বললেন, 
" তাহলে অন্তত একটা কবিতা দিন"------।

        আসলে চিকিৎসা শাস্ত্রে হোমিওপ্যাথি এবং সাহিত্য ক্ষেত্রে কবিতা ---দুটোর সঠিক অনুশীলন ও
চর্চার জন্য মেধা এবং পড়াশোনা দুটোরই প্রয়োজন। "আপাত সহজ " --এই ধারণা প্রত্যাহার করে সঠিক  অনুশীলন দরকার।
    
এই লেখায় কেউ আঘাত পেয়ে থাকলে ক্ষমাপ্রার্থী। অনুরোধ এই নিবন্ধকে "রম্য রচনা" হিসেবেই গ্রহণ করবেন।


 

বর্ষাযাপন 

 অভিজিৎ সেন 


একবুক মরুতৃষ্ণা নিয়ে চাতকের মতো আকাশের দিকে চেয়ে  ক্লান্ত শ্রান্ত আতপ্ত দেহ,মন যখন ঘনকৃষ্ণ মেঘপুঞ্জ আকুল  অন্তরে ডেকে যায়--যখন অগ্নি বলয়ের কঠোর তপস্যা ক্ষেত্রে অনুশীলনে প্রকৃতিও ক্লান্ত হয়ে অপেক্ষা করে বৃষ্টি সুধার--যখন অরণ্যে ময়ূর-ময়ূরী অনুরাগে রঙের আল্পনায় পেখম তুলে মোহিনী নৃত্যে স্বাগতম করে--যখন কদমফুল দীপাবলীর মতন আলোক সজ্জায় সজ্জিত হয়ে ওঠে--যখন কালো কুচকুচে অলোকদামের মতন ঘনকৃষ্ণ জলধর অগ্নিবর্ষক আদিত্যকে, উতপ্ত যজ্ঞকুন্ডসম আসমান ঢেকে ফেলে--হয়তো তখনই কোন কৃষক বলে ওঠে 'আল্লা ম্যাগ দে পানি দে'----তখনই যেন পৃথিবীর মানুষের ভালোবাসার প্রবলটানকে উপেক্ষা করতে না পেরে নৃত্যে,সংগীতে,মোহিনী সাজে সুরালোকিত সৌন্দর্য নিয়ে নেমে আসে প্রেমরসে পূর্ণ হয়ে বৃষ্টি, পৃথিবী মঞ্চে অভিনয় শুরু হয় দ্বিতীয় ঋতুর, অর্থাৎ--- মহাকবি কালিদাসের 'মেঘদূতম্' এর পূর্বমেঘ,উত্তর- মেঘ, বিরহী যক্ষ, তার বিরহিণী স্ত্রী, রামগিরি পর্বত, অলকাপুরী প্রভৃতি টুকরো টুকরো ছবির মতো বর্ষাসিক্ত প্রকৃতির চিত্রশালায় একে একে ভেসে ওঠে বিরহের মনে ।

মেঘের কথা শুনেই শেষ পর্যন্ত ধনপতি কুবের যক্ষের প্রতি সদয় হলেন এবং অভিশাপ থেকে মুক্তি দিলেন--" শ্রুত্বা বার্ত্তাং জলদকথিতং তাং ধনেশোহপি সদ্যঃ/শাপস্যান্তং সদয় হৃদয়ঃ সংবিধায়াস্তকোপঃ"
                  এই মেঘ দেখে বৈষ্ণব কবি বিদ্যাপতি যখন বলে ওঠেন "এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর/এ ভারা বাদর/ মাহ ভাদর/ শূন্য মন্দির মোর/..কুলিশ শত শত/পাত মোদির/ ময়ূর নাচত মাতিয়া/মত্ত দাদুরি/ডাকে ডাহুকী/ফাটি যাওত ছাতিয়া" রাধার এই বিরহ কৃষ্ণের জন্য সে তো মানুষের অন্তরের চির বিরহেরই নামান্তর, মেঘেঢাকা আকাশ, ঘন বর্ষণ, ঘন ঘন দামিনীর সশব্দ গর্জন বিরহের একাকীত্বকে, মানুষের অন্তরের চির একাকীত্বকে শতগুনে বর্ধিত করে তোলে। বর্ষার মেঘ যেন তারই প্রতীক। আবার এই বর্ষা মিলনেরও বার্তা বহন করে আনে মানুষের বিরহী একাকিত্বের দ্বীপ সাদৃশ্য জীবনে,যাপনের মতো শুষ্ক বিবর্ণ আনন্দহীন যন্ত্রণাময় কণ্টকময় সরণীতে । ময়ূরের মতই আমাদের মন কি এক অবর্ণনীয় আনন্দে ওঠে মেতে । মন তখনই যেন বলে ওঠে "মন মোর মেঘের সঙ্গী/উড়ে চলে দিগ্ দিগন্তের পানে/ নিঃসীম শূন্যে শ্রাবণ বর্ষণসঙ্গীতে"অথবা মন তখন প্রিয় মানুষটির কাছে ছুটে যায় হংস বলাকার পাখায় আকাশের দূর আলোকে । কবি রবীন্দ্রনাথের কাছে বর্ষাকাল শ্রেষ্ঠ কাল। বর্ষা তাঁর মনে সৃষ্টির প্রেরণা সঞ্চার করেছে চিরকাল। বৃষ্টির প্রতিটি কণার মতো তিনিও ঢেলে দিলেন তাঁর সৃষ্টিকে ।বাঙালির মনকে সিক্ত করেছে সর্বক্ষণ সেই প্রাণরস । তিনি প্রতিটি সৃষ্টিবিন্দু দিয়ে মানুষের অন্তরের ব্যথা,বেদনা,কাম, প্রেম,আনন্দের মতো সহজাত অনুভূতিকে অত্যন্ত সহৃদয় ভাবে ব্যক্ত করেছেন, অতল গহীন মনকে স্পর্শে করেছেন তাঁর সৃষ্টিতে । সাহিত্য এভাবে হয়ে ওঠে মানুষের নিশ্চিত নিরাপদ আশ্রয় ।
             
            এই মেঘলা আকাশ, এই বর্ষার প্রকৃতি কবি জয়দেবের মনেও এনেছে এক অদ্ভুত মোহ-আকুতিপূর্ণ আদিরসাত্মক আনন্দ। সেই আনন্দের বিচিত্র রসসুধারই  প্রকাশ 'গীতগোবিন্দ' । বৃষ্টি নূপুর পায়ে  মোহিনী নৃত্যে সংগীতে পৃথিবীরূপ অভিমানিনী রাধার মান-ভঞ্জনে ব্যর্থ হয়ে বলছে '"স্মরগরল খন্ডনং/মমশিরসি মন্ডনম্/দেহ পদপল্লব মুদারং"-- বর্ষাঋতু আকন্ঠলগ্ন যুগল প্রেমিক প্রেমিকার মনে আবহমান কাল ধরেই প্রেমের অনুঘটকের কাজ করে আসছে। বসন্তের পরে বর্ষা সেই ঋতু  সে-ই‌ পারে বিরহী একাকিত্ব দূর করতে আবার বহুগুণে বর্ধিত করেতেও । শুষ্ক মনে প্রাণরস সঞ্চার করতেও, মানুষের একমাত্র শাশ্বত সম্পদ " প্রেম " যায় টানে দেবতাগণও  মানব রূপে জন্ম নেয় বারেবারে। জয় হয় মানুষের, বর্ষা সেই  প্রেমের বার্তা বহন করে অথবা মিলনের পটভূমির আয়োজন  করে রাখে। মেঘের ক্যানভাসে যখন রামধনু সাতরঙে আল্পনা আঁকে শিখীরা বনে পেখম তুলে নৃত্য শুরু করে, কবি বলেন, 'হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে ময়ূরের মত নাচে রে " । আবার চির বিচ্ছেদ যখন হৃদয়কে ক্ষত-বিক্ষত করে দেয় নিরবচ্ছিন্ন ভাবে ঝরে যায় বেদনা, আজীবন কণ্ঠক-বিদ্ধ  অনুভূতি সহ যাপন করতে হয় ধারাবাহিক ভাবে, কবি নজরুল সেই অসহনীয় ব্যথা অনুভব করে গেয়ে ওঠেন,"শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে/বাহিরে ঝর বহে/নয়নে বারি ঝরে।"তখন রাধার বিরহের অশ্রুধারা আর বৃষ্টিধারা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।
                    
বর্ষাকাল অংশিককে সম্পূর্ণ করার,শুষ্ককে সিক্ত করার, দগ্ধ পোড়া বিবর্ণ প্রকৃতিকে সবুজ সতেজ প্রাণ- চঞ্চল করার কাল, আবার সে সঙ্গে করে বয়ে আনে রুদ্ররূপও । বিধ্বংসী বান ভূচিত্রের এনে দিতে পারে বদল,হড়পা বান বুঝিয়ে দিতে সক্ষম জীবন কতোটা অনিশ্চিত, ক্ষণিকের -- আকস্মিক বজ্রপাত মৃত্যুর পারিজাত যেন সঙ্গে করে নেমে আসে---দমকা ঝরো হাওয়া কীভাবে তিল তিল করে  গড়ে তোল দারিদ্র্যের দুর্বল আশ্রয়কেন্দ্রেকে কাগজের মতো কোথায় উড়িয়ে দিয়ে চলে যায় কেউ জানে না। মানব বসতি, ফসল, পথের পাশাপাশি অরণ্যেও বুকেও নেমে আসে ধ্বংস  অসহায় মানুষের কাছে,বোবা প্রাণীকুলের কাছে বর্ষাকাল হয়ে ওঠে অসহনীয় কালখন্ড । রূদ্রের তান্ডবের ভয়ানক  বিভীষিকাময় কাল-যাপন । বৃষ্টি বিন্দু এদের জীবনে অ্যাসিড বিন্দুর নামান্তর। বহু চর্চিত জনপ্রিয় বিষন্নতার সাধক আমেরিকান কবি হেনরি ওয়ার্ডসওয়ার্থ লংফেলো তাঁর  "The rainy day" কবিতায় বলেছেন-  "My life is cold and dark and dreary/It rains, and the wind is never dreary/Thy fate is the common fate of all/ Into each life some  rain must fall" I
           
           যদিও বিশ্বের যাবতীয় কৃষককুল বৃষ্টি চেয়ে যুগে যুগে যেন বলে চলেছে "আয় বৃষ্টি ঝেঁপে ধান দেবো মেপে "কারণ তাকে ঘরে ফসল তুলতে হবে তবেই সংসার প্রতিপালন সম্ভব হবে । আবার এই মেঘলা আকাশ দেখে প্রিয় অথবা প্রিয়া গেয়ে ওঠে"जब चली ठंडी हवा/ जब उरी कली घटा/ एय जाने बफा/ तुम याद आए " ভানুসিংহ গেয়ে ওঠেন "গহন কুসুমকুঞ্জ মাঝে মৃদুলা মধুর বংশি বাজে/ বিসরি ত্রাস লোকলাজ সজনি আও আও লো" আচ্ছা পাঠকের কাছে আমার জানতে ইচ্ছা করছে পড়তে পড়তে কি এই গানটি মনে মনে গুনগুনি উঠলো না ?


 

বৃষ্টি ভেজা পাহাড়ি সন্ধ্যায় ভ্রমণ

         কবিতা বণিক


বৃষ্টি! বৃষ্টি! বৃষ্টি! মেঘেরা জলের ধারা ঢালছে নানান ছন্দে। ঝিরঝির, ঝমঝম! নাচের তালের কত না শব্দ।

পথ, ঘাট সব ভেজা। যেদিকে তাকাই সবই রসময়। গাছেরাও হাওয়ায় দোল খেয়ে তাদের সমস্ত পাতার ফোঁটা ফোঁটা রসবিন্দু টুপটাপ ঝরিয়ে দেয়। সমতলের বৃষ্টিতে দেখি , মেঘ-হাওয়ার খেলা নানান ছন্দে হলেও মেঘেদের বড্ড অভিমান। তারা নীচে নামবে না কিছুতেই। আবার পাহাড়ে , মেঘেরা ওপরে-নীচে সর্বত্র আনন্দে ভেসে বেড়ায়। সেখানে চলমান মেঘেদের পাহাড়ের গায়ে গায়ে ভেসে বেড়ানোর যে স্বপ্নের পরীদের মত দেখায় তা দেখতেই গিয়েছিলাম এক বিকেলে পাহাড়ী পথের বাঁকে বাঁকে কার্সিয়াং, ডাউহিল, চিমনি ইত্যাদি নাম না জানা গ্রামের মধ্য দিয়ে। শুধুই বৃষ্টি উপভোগ করতে। এরই মধ্যে সন্ধ্যের আলোয় জঙ্গলের মধ্যে দুটো হরিণ দেখে মনে হল এই বৃষ্টিতে জঙ্গলের পশুরা নিজেদের কিভাবে রক্ষা করে? ঈশ্বর সবার জন্যই ব্যবস্হা করে রেখেছেন। পাহাড়ের গায়ে গায়ে গাছেরাও যেন ঘেঁসাঘেঁসি করে বেড়ে উঠতে চায়। ফার্ণ পাতাগুলোর লম্বা হাত যেন সবাইকে ছুঁতে চায়।এমন ঘন সবুজ বনের মধ্যে রাস্তাও নিজেকে হারিয়ে ফেলে। আর মেঘেরা ঘন পাইনের বনে ঢুকে বৃষ্টি হয়ে ঝড়বার পথ খোঁজে।পাহাড়ীপথে এক এক বাঁকে এক এক সৌন্দর্য ধরা পড়ে। বৃষ্টি ভেজা পাহাড়ের অপরূপ সৌন্দর্য , মেঘের মধ্যে দিয়ে হাঁটা যেখানে কিছুই দেখা যায় না এসব রোমাঞ্চকর অনুভূতি পাহাড়ে না এলে বোঝা যায় না। নীচের পাহাড়ে বৃষ্টি হচ্ছে তো ওপরের পাহাড়ে বৃষ্টি নেই। নীচের পাহাড়ে মেঘ জমেছে , মনে হচ্ছে ইন্দ্রপুরীতে বিচরণ করছি। নারদ মুনির আশীর্বাদে ঝর্ণার ধারা , গানের দ্রুত লয়ের সুরের মুর্ছনায় যেন “ তরলিত চন্দ্রিকা চন্দন বর্ণা” রূপ ধারণ করেছে। সে যে পাহাড়ের বুক চিরে নেমে আসা প্রেমদাত্রী! ঝর্ণার প্রেম প্লাবণেই না নদীগুলো পুষ্ট হয়! ধরণী শষ্যশ্যামলা হয়! তখন মানুষের ক্ষুধা মেটাও তুমিই ‘তাপসী অপর্ণা!’ স্বর্গের সুধাকে মর্ত্যে এনে দাও তুমিই ঝর্ণা! বর্ষায় পাহাড় ভয়ঙ্কর হয় আমরা দেখি। স্বর্গীয় সৌন্দর্য দেখা অনায়াস লভ্য হয় না এটাও যেমন সত্য। তেমনি দেখার পরের সৌন্দর্যানুভূতি অব্যক্তভাবে মনের গভীরে বর্ণময় হয়ে ধরা থাকে। বৃষ্টি কমতে আবার সদ্যস্নাতার মত দেখতে লাগছিল পাহাড়কে।জল হারিয়ে মেঘেরাও তাদের বৈঠকী আড্ডায় মেতেছে নীল আকাশে। এই সুযোগে সূর্যদেব অস্তাচলে যাওয়ার আগে তার লালিমা ছড়িয়ে দিলে আরও মোহময় করে তুলল সেদিনের সেই মনোরম সন্ধ্যা। পাহাড় জুড়েই কত আঁকাবাঁকা রাস্তা,ঘরবড়ি, একটু একটু করে পাহাড় জুড়ে আলো জ্বলতে শুরু করেছে। দীপাবলীর রাত্রি রোজ উপভোগ করতে হলে পাহাড়ের সন্ধ্যা রাণীর আগমনের প্রতীক্ষায় সময় দিতে হবে। একটু বেশি রাত না হতে, পাহাড়ের অনেক আলো নিভে যায়। সন্ধ্যারাণী বিদায় নিতেই দেখা গেল দূরে আলোকমালায় সজ্জিত যেন হীরের কুচি দিয়ে সাজানো শিলিগুড়ি শহর। এই সৌন্দর্য পাহাড় থেকেই দেখা যায়। নেমে আসলাম নীচে আমাদের ঠিকানায়।


 


স্টেশনের আগের স্টেশন 

রুদ্র 

হীরকের চোখে ঘুম নেই আজ রাতেও। ফুটপাতে ত্রিপলের নীচে বৃষ্টি পড়ে টুপটাপ, সেই বৃষ্টির ছাঁটে তার খাতার কাগজগুলো কিছুটা ভিজে যাচ্ছে। তবু সে পড়ে—নিউটনের গতির সূত্র, মানুষের হৃৎপিণ্ডের গঠন, কিংবা আর্কিমিডিসের সূত্র—সব মুখস্থ। না, মুখস্থ নয়, সে বুঝে পড়ে।

তার মা বিড়ি বাঁধেন সকাল থেকে সন্ধে, চোখ জ্বলে, হাত ফেটে যায়। বাবা বিছানায় পড়ে আছেন বছর চারেক—বুকের মধ্যে যেন জমে আছে হাজারটা অসুখ। হীরক সব জানে, তবু কাউকে বলে না কিছু। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ, যার সিঁথিতে ফুটো, তবু তাতে আছে অজস্র জেদ।

বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান শিক্ষক শিবেন্দুবাবুই প্রথম বলেছিলেন, “তুই ইঞ্জিনিয়ার হতে পারবি হীরক। শুধু থেমে যাস না।” সেই কথা যেন বুকে পাথরের মতো গেঁথে গেছে ছেলেটার। সন্ধেয় স্কুল ছুটির পর যখন বন্ধুরা গরম সিঙ্গাড়া আর ফুচকা খায়, হীরক রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে পুরোনো বইয়ের দোকান দেখে। না কিনে, না ছুঁয়ে, শুধু পড়ে।

একদিন শিক্ষক তাকে পুরোনো একটা সায়েন্স ম্যাগাজিন এনে দিলেন। ভেতরে ছিল একটা নিবন্ধ—“চাঁদে ভারতের যাত্রা। হীরকের চোখ চকচক করে উঠেছিল সেদিন।

দিন যায়, মাস যায়। হীরক শুধু এগোয়। মাধ্যমিক আসে, হীরক সারা জেলার মধ্যে প্রথম হয়। খবরের কাগজে ছাপা হয় তার ছবি—ত্রিপলের ঘরের ছেলে, যিনি বিজ্ঞান ভালোবাসেন।

সেদিন সন্ধ্যায়, রাস্তার পাশের দোকানে এক কাপ চা খেতে খেতে শিবেন্দুবাবু বলে ওঠেন,
“এই তো, স্টেশনের আগের স্টেশন পার হলি।”

হীরক হেসে বলে, “স্টেশন অনেক দূর স্যার, কিন্তু আমি তো জানি—এই ট্রেনটা থামে না।” 


 

 বন্ধু

লীনা রায় 


রাত আটটায় ডিনার। কাঁটায় কাঁটায় রাত দশটায় ঘুমোতে যায় অমিতেশ। দীর্ঘদিনের অভ্যেস। আজকাল ঘুমানোর আগে প্রতিদিন প্রমিস করেন মর্নিং ওয়াকে যাবার। কিন্তু ভোরে ঘুম ভেঙে গেলেও আলসেমি শরীরে ভর করে। অথচ রণিতা থাকাকালীন দুর্যোগ ছাড়া তার সকালের হাঁটা বাদ যায়নি। আজ দু' মাসের ওপর সকালটা তার বিছানাতেই কাটে। অপরাধবোধ হয়। এত অবহেলা শরীর সইবে তো! কিন্তু তারপরেও বালিশটাকে আরো জোরে আঁকড়ে বিছানাতেই পড়ে থাকে।

সেদিনও সকালে বিছানাতেই ছিল অমিতেশ। হঠাৎ একটা জান্তব শব্দ কানে এলো। গোঙানির মত, খুব বিচ্ছিরি। বাড়ির সামনের দিক থেকে আসছিল শব্দটা। কিছুক্ষন পর বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু পরদিন, তার পরদিন সেই এক রকম শব্দ। আর এই শব্দটার জন্যই অমিতেশ সেদিন বিছানা ছেড়ে সামনের বারান্দায় আসে।

শেষ কবে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিল ভুলে গেছে অমিতেশ। বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই অদ্ভুত দৃশ্য চোখে পড়ল। তার বাড়ির মুখোমুখি রাধাকৃষ্ণ আবাসন। আর সেই আবাসনের ডানদিকের তিনতলায় প্রীতম শাহুর ফ্ল্যাট। ফ্ল্যাটটি দীর্ঘদিন বন্ধ। ওখানে কেউ থাকত না। সেই ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে একটি বছর ষোলোর ছেলে পাখিদেই বিস্কুট দিচ্ছে। আর মুখ দিয়ে অদ্ভুত শব্দ করছে। ছেলেটি মানসিকভাবে প্রতিবন্ধী। হাঁটা চলাতেও সমস্যা রয়েছে। ব্যালকনির রেলিংয়ে রাখা বিস্কুট পাখি ঠোঁটে করে তুলে নিলেই ও অদ্ভুত শব্দ করছে। শব্দটা আনন্দের বহিঃপ্রকাশ সেটা বুঝতে পারে।

ওকে অবাক যায় দেখছিল অমিতেশ। ছেলেটিকে দু' হাতে শক্ত করে ধরে আছে একজন পুরুষ। চোখে চোখ পড়তেই ভদ্রলোক একটু হাসলেন। অমিতেশ হেসে হাত নাড়ে। আর এভাবেই শুরু। অমিতেশ সকালে উঠেই বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। বাবা, ছেলের পাখিকে বিস্কুট খাওয়ানো দেখে। মাঝে মাঝে ছেলেটির মা এসে ওদের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। সুন্দর মুখশ্রী, বড় বড় দুটো চোখ, ঘাড়ের কাছে আলতো করে ফেলে রাখা খোঁপা। ছেলেটির আনন্দ দেখে ওদের স্বামী স্ত্রীর মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। অমিতেশও খুশি হয়। খুশি খুব ছোঁয়াচে। ওরা ঘরে ঢুকে যায়, কিন্তু অমিতেশ বসেই থাকে। রোদের তাত বাড়লে ঘরে ঢোকে।

বারান্দায় বসে বসে সবার ব্যস্ততা দেখে অমিতেশ। রণিতার অবর্তমানে তপুর হাতেই ওর সংসার। রান্না, ঘরের কাজ , বাজার, দোকান অব্দি। সেদিন জলখাবার খেয়ে খবরের কাগজ পড়ছিল অমিতেশ। সে সময় সেই অদ্ভুত শব্দটা শুনতে পায়। শব্দটা বেশ জোরালো। এক নাগাড়ে হয়েই চলেছে। বারান্দায় আসতেই চমকে ওঠে অমিতেশ। ছেলেটি আবাসনের গেটে দাঁড়িয়ে একভাবে চিৎকার করছে। ওর মা প্রাণপনে ওকে টানছে। ঘরে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। অমিতেশ তাড়াতাড়ি গায়ে জামা গলিয়ে ওদের কাছে আসে। মায়ের কাছে জানতে পারে ছেলেটি বাইরে ঘুরতে যাবার জন্য বায়না করছে। কিন্তু ওর মা সাহস পাচ্ছে না।

অমিতেশের খুব মায়া হয়। ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বলে - তোমার নাম কী?
ছেলেটি মাথা নাড়াতে থাকে একভাবে। ওর মা জবাব দেয় – আমরা ওকে রনি বলে ডাকি।
অমিতেশ এবার বলে - ঘুরতে যাবে রনি?
কথাটা শোনা মাত্র রনি জোরে জোরে মাথা ঝাঁকাতে থাকে।
অমিতেশ রনির মাকে বলে- সামনেই তো পার্ক। ওকে নিয়ে গেলেই তো পারেন। সারাদিন ঘরে আটকে রাখা বোধহয় ঠিক হচ্ছে না। আমি আপনাদের সঙ্গে যাব। চলুন।

অমিতেশের গলার স্বরে হয়ত আদেশ ছিল। রনির মা গেট খুলে ওকে নিয়ে বাইরে আসে। গেট খুলতেই রনির সে কী আনন্দ। হাততালি দেবার চেষ্টা করছে, মাথা নাড়ছে। অমিতেশ রনির হাত ধরে।

পার্কে কিছুক্ষন কাটিয়ে রনিকে ওদের ঘরে পৌঁছে বাড়ি ফেরে অমিতেশ। রনির মায়ের কাছ থেকে জানতে পারে রনির অসুখের কথা। জেনেটিকে ডিসঅর্ডার। বাবা বেসরকারি অফিসে চাকরি করে। আগে অফিসের কাছেই থাকত। তাই রনিকে নিয়ে সকালে বের হতে অসুবিধে হত না। কিন্তু এখান থেকে অফিসের দূরত্ব অনেকটা। সেজন্য রনির বাইরে বেরোনো বন্ধ।

পরদিন অমিতেশ ভোরে ঘুম থেকে ওঠে। তৈরী হয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। রাধাকৃষ্ণ আবাসনের তিনতলার ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে তখন রনি ওর বাবা মায়ের সঙ্গে। অমিতেশ খানিকটা গলা তুলে রনিকে ডাকে। বলে- আমার সঙ্গে পার্কে যাবে রনি? এসো…

খুব দুর্যোগ না হলে আজকাল অমিতেশের সকালের হাঁটা বাদ যায় না। সঙ্গী রনি। একজন অপরিণত কিশোর আর ষাটোর্ধ যুবকের মাতামতিতে সকালের ঝিমিয়ে থাকা পার্কেও ঝলমলে খুশি। আর হ্যাঁ, রনি কিন্তু অমিতেশকে বোন..দু..উ বলেই ডাকে।