উপনিষদের আলোকে বিবর্তনবাদ
জয়তী ব্যানার্জী
ওঁ স্হাপকায় চ ধর্মস্য
সর্বধর্মস্বরূপিণে
অবতার বরিষ্ঠায় রামকৃষ্ণায় তে নম:...
নম: যথাগ্নের্দাহিকা শক্তি
রামকৃষ্ণে স্হিতা হিয়া
সর্ববিদ্যা স্বরূপাংতাং সারদাঙ্ প্রণমাম্যহম্।
ওম্ নমঃ শ্রী যতিরাজায়
বিবেকানন্দ সূরয়ে
সচ্চিৎ সুখ স্বরুপায় স্বামীনেতাপ হারিণে।।
উপনিষদ হল বৈদিক সাহিত্যের চতুর্থ বা শেষ স্তর ।
উপনিষদ শব্দের আক্ষরিক অর্থ হল যে বিদ্যা নির্জনে গুরু সামনে উপনিবিষ্ট করতে হয় অর্থাৎ যাকে আমরা চলিত ভাষায় গুহ্য জ্ঞান বলতে পারি।
তবে ব্যবহার অনুসারে শব্দের অর্থের বিভিন্ন রকম পার্থক্য হয়।
বেদ কিন্তু কোন পুস্তক বিশেষ নয়। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সাধকের আধ্যাত্মিক আবিষ্কারের সঞ্চিত ভান্ডার ।বেদ আর উপনিষদ কিন্তু একে অপরের ওপর নির্ভরশীল।
বেদ হল ত্রিকান্ডক। যথা _____
কর্মকাণ্ড
জ্ঞান কান্ড এবং
উপাসনা কান্ড।
কর্মকাণ্ডের আবার দুটি ভাগ ।
যথা ____
মন্ত্র বা সংহিতা এবং ব্রাহ্মণ।
মন্ত্র বা সংহিতা একটি ভাগ হলেও অপরটি যে ব্রাহ্মণ তার আবার প্রথম ভাগ আরণ্যক এবং পরবর্তী ভাগ উপনিষদ বা জ্ঞানকাণ্ড।
আবার যদি আমরা অপরদিকে দেখি,
চতুর আশ্রম অর্থাৎ গৃহস্থ্যাশ্রমে ব্রাহ্মণ অংশে ব্রহ্মচর্যাশ্রম -এর মন্ত্রাদি সহায় অধীত বিদ্যার প্রয়োগ প্রসার ও আরণ্যকের প্রস্তুতি হেতু ই হল চিত্ত শুদ্ধি।
এর পাশাপাশি আরণ্যকে আমরা পাই শুদ্ধ চিত্তে গৃহস্থ্য আশ্রমের কর্মকাণ্ডের মনন দ্বারা কর্মকাণ্ডের কারণের উপলব্ধি, যার প্রকাশ উপনিষদে রয়েছে।
যেখানে জ্ঞানযোগ এর অনুশীলন শুরু এবং সন্ন্যাস আশ্রমে উপনিষদের সাহায্যে ধ্যান সমাধি, এইসবের দ্বারা ব্রম্ভজ্ঞান উপলব্ধি হয়ে থাকে।
মানুষ কিন্তু অতি প্রাচীনকাল থেকেই কার্যকারণের তত্ত্ব জানত। কিন্তু পরে আমরা দেখেছি আমাদের পন্ডিতেরা বা দার্শনিকেরা দর্শন ও ন্যায়ের ভাষায় এই সমস্ত তথ্য বর্ণনা করেছেন। কিন্তু সেই বর্ণনাও অস্পষ্ট ।এগুলি কিন্তু সবই অন্তরের অনুভূতি।
তবে এটা আগে কার্যে পরিণত হয়, তারপরে তা দর্শনের রূপায়িত হয়েছে ।
প্রাচীন ঋষিদের সাথে বিশ্ব প্রকৃতি কথা বলতো ।পশু পাখি চন্দ্র সূর্য কথা বলতো ,কিন্তু আধুনিককালের নিয়ম অনুযায়ী অন্যের মস্তিস্ক প্রসূত কতগুলি বিষয় সংগ্রহ করে একটা বই রচনা করাই কিন্তু মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল না ।
আবার সুদীর্ঘ বক্তৃতা দেওয়াও উদ্দেশ্য নয়, উপনিষদের বিবর্তনের উদ্দেশ্য হল____
সত্য আবিষ্কার ।
যার অভ্যাস ছিল সাধনা এবং যা চিরকাল থাকবে ।
ধর্ম চিরকাল ব্যবহারিক বিজ্ঞানরূপে থাকবে, এমন ধর্ম কখনোই থাকবে না_______
যা শুধু দেবতা তত্ত্বের ওপর প্রতিষ্ঠিত।
প্রথমে অভ্যাস তারপর জ্ঞান।
জীবাত্মা ------যে এখানে ফিরে আসে ।এ ধারণা কিন্তু উপনিষদে রয়েছে ....
যারা ফল কামনা করে কোন সৎকর্ম করে, তারা সেই সৎকর্মের ফলপ্রাপ্ত হয় ।কিন্তু ওই ফল নিত্য নয় ।
এখানের উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো কার্যকারণ বাদ।
কারণ অনুসারেই কার্য হয়ে থাকে। কারণ যা কার্য তাই হবে ।কারণ যখন অনিত্য তখন কার্য অনিত্য হবে। কারণ নিত্য হলে কার্য নিত্য হবে ।
কিন্তু সৎকর্ম করা কারণগুলি অনিত্য বা অসীম। সুতরাং তার ফল কখনোই নিত্য হতে পারে না।
আবার যদি আমরা উপনিষদে ফিরে যাই ,তাহলে দেখব____
উপনিষদ সাধারণভাবে বেদান্ত নামেই অভিহিত হয়ে থাকে।
এই শব্দটির অর্থ ব্যাখ্যা হয় বেদের শেষ অধ্যায় গুলিতে ।আবার যে বিকল্প অর্থ করা হয়ে থাকে সেটা হল বেদের বিধেয় বা সর্বোচ্চ উদ্দেশ্য।
ব্রম্ভ ও আত্মা শব্দ দুটি উপনিষদে ব্যবহৃত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি শব্দ।
ব্রম্ভ হলেন বিশ্বের সত্তা আর ব্যক্তিগত সত্তা হলো আত্মা ।
শব্দ দুটির বুৎপত্তি নিয়ে পন্ডিতদের মধ্যে যথেষ্ট মতভেদ আছে।
ব্রম্ভ শব্দটি ব্র থেকে এসেছে যার অর্থ হলো বৃহত্তম ।
ব্রম্ভ হলেন স্থান কাল ও পাত্র কার্যকারনের অতীত এক অখণ্ড সত্তা। তিনি অব্যয় অনন্ত ও চির মুক্ত শাশ্বত অতীন্দ্রিয় ।আত্মা বলতে বোঝায় জীবের অন্তর্নিহিত অমর সত্তাটিকে।
উপনিষদের মন্ত্রদ্রষ্টাদের মতে,
আত্মা ও ব্রম্ভ এক এবং অভিন্ন এটাই উপনিষদের সর্বশ্রেষ্ঠ মতবাদ।
তবে আবার কর্মজীবনে বেদান্ত মানে, কর্মের মাধ্যমে জীবনের উন্নতি ও আধ্যাত্মিক বিকাশে বেদান্ত দর্শনের প্রয়োগ ________যা স্বামী বিবেকানন্দের মতো দার্শনিকদের দ্বারা বিশেষভাবে উৎসাহিত হয়েছে।
বেদান্তের মূল শিক্ষা হলো ,
কর্মফল ও পুনর্জন্মের ধারণা। যেখানে প্রতিটি চিন্তা ও কাজের ফলস্বরূপ ভবিষ্যতের অভিজ্ঞতা তৈরি হয়।
কর্মজীবনে বেদান্তের প্রয়োগের অর্থ হল কর্মের প্রতি মনোযোগ দিয়ে ভালো কাজ করা এবং অন্যের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে জীবনকে অর্থপূর্ণ করা।
উপনিষদের ধারণায় ,
পৃথিবীতে ব্রহ্ম কেবল প্রজ্ঞাই নয়,ঈশ্বর ও বটে। তিনি আইনের অধীন নন ।তিনি কেবলমাত্র প্রক্রিয়া ব্যবহার করেন।
এটি কেবল অজ্ঞতার অবস্থায় থাকা স্বতন্ত্র আত্মা, যার ওপর ক্রিয়া বা প্রক্রিয়া দিয়ে নিজেকে আইন হিসেবে চাপিয়ে দেয় বলে মনে হয় ।
আমাদের প্রতি মুহূর্তেই মনে রাখতে হবে যে ,
উপনিষদের অভ্যুদয়ের সময় কর্মকাণ্ড এত জটিল ও বর্ধিতায়ন ছিল যে তা থেকে মুক্ত হওয়া ছিল প্রায় অসম্ভব। কিন্তু কর্মযোগের মাধ্যমে স্বামীজি বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে ,
প্রত্যেক কর্মকাণ্ডের ভেতর একটি উচ্চতর গভীর অর্থ আছে।
প্রাচীনকালে যেসব যাগ যজ্ঞ ,কর্মকাণ্ড ছিল তাকে কিন্তু আধুনিক সংস্কারকরা মিথ্যে বলে উড়িয়ে না দিয়ে ওগুলির উচ্চতর তাৎপর্য বুঝিয়ে দিয়ে মানুষের সামনে নব দিগন্তের উন্মোচন করলেন।
এই প্রসঙ্গে আমরা বলতে পারি ,
ব্রহ্মাণ্ড ও জগত সবকিছুই ঈশ্বর দ্বারা আচ্ছাদিত অর্থাৎ
"লোভ কোরো না ধনে কি আছে "______
পরবর্তীতেই শ্রী শ্রী মাতা ঠাকুরানী বলছেন ,
নির্বাসনা
অর্থাৎ নির্বাসনা না হলে ব্রম্ভজ্ঞান হয় না ।
এত সহজভাবে মা বুঝিয়ে দিয়েছেন, বেদবেদান্ত উপনিষদ সব কথার সার ই যেন মায়ের নিদান______ এই হল বিবর্তনের ধারা।
আবার স্বামীজীর "বনের বেদান্তকে ঘরের বেদান্তে " উপনীত করার যে উদ্যোগ ____এই ধারণার প্রথম পথপ্রদর্শক হলেন শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব ।
"শিব জ্ঞানে জীব সেবা"
স্বামীজীর এই উক্তি যেন হৃদ্ কন্দর আলোড়িত করে ।এ যেন উপনিষদের মহাবাক্য গুলির মতো আত্মা ও পরম আত্মার সম্পর্কের জটিল তত্ত্বের সহজ নিদান।
তাইতো তিনি মঠ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যতে লিখছেন ,
"আত্মানো মোক্ষার্থায়
জগৎ হিতায় "
ঠাকুর যেমন বেদের সব সার বোঝাতে বলেছেন ,
ব্রম্ভ সত্য জগত মিথ্যা ।
তিনি এই বাক্যকে বলেছেন জ্ঞান ।
কিন্তু ত্যাগী পুরুষ যখন 'নেতি-নেতি 'করে উত্তরণের শেষ প্রান্তে পৌঁছান সেই বিজ্ঞানী পুরুষ দেখে_____
সিঁড়ি যে চুন সড়কি দিয়ে তৈরি ছাদ ও সেই একই চুন সড়কি দিয়েই তৈরি।
স্বামীজি এই কথারই প্রতিধ্বনি করেছেন তার প্রতিটি ভাষণে চিঠিতে।
তাইতো ঠাকুর যদি কথামৃতের স্রষ্টা হন বা আধুনিককালের জগত স্রষ্টা হন, তাহলে স্বামীজি হলেন তার পথপ্রদর্শক আর মা অর্থাৎ জগৎ জননী সারদা দেবী হলেন তার ইমপ্লিমেন্টেশন বা রূপকার।
যা কিনা বেদ বেদান্ত উপনিষদের ধারায় মিলেমিশে একাকার।
প্রাচীন সাধুদের মতে,
একে তিন তিনে এক।