Monday, January 1, 2024


 

সম্পাদকের কথা 

নতুন দিনের আলো নিয়ে আবার একটি নতুন বছর। চলে যাওয়া বছরের মতো এই বছরকে ঘিরেও  আমাদের প্রত্যাশা অনেক। বৃহত্তর পৃথিবীতে বন্ধ হোক যুদ্ধ ও নরমেধ যজ্ঞ। এই রাষ্ট্রে সমানাধিকার পাক সকলে। এই রাজ্যে চাকরি-না পাওয়া তরুণ প্রজন্মের মুখে ফুটুক হাসি। এটুকু আমরা আশা করতেই পারি। আশা করতেই পারি, উন্নয়নের নামে গ্লোবাল বয়েলিংয়ের হাত থেকে বিপন্ন এই গ্রহের পরিবেশ রক্ষা পাক। আমাদের চাওয়া আসলে অনেক। কিন্তু আজ অবধি কোনও নতুন বর্ষ তা পূরণ করেনি। আগামী ৩৬৪ দিন সেই ইচ্ছেগুলির খানিকটা পূর্ণ হলেও ভাবব বছরটি সার্থক হল। নতুন বছরে মুজনাইয়ের সকল পাঠক-পাঠিকা, লেখক-লেখিকা ও শুভানুধ্যায়ীকে প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানাই। ভাল থাকুন সকলে। 


মুজনাই অনলাইন পৌষ  সংখ্যা ১৪৩০

 রেজিস্ট্রেশন নম্বর- S0008775 OF 2019-2020

হসপিটাল রোড 

কোচবিহার 

৭৩৬১০১

ইমেল- mujnaisahityopotrika@gmail.com (মাসিক অনলাইন) 

প্রকাশক- রীনা সাহা    

সম্পাদনা, প্রচ্ছদ, অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায় 

মুজনাই অনলাইন পৌষ সংখ্যা ১৪৩০


এই সংখ্যায় আছেন যাঁরা


উমেশ শর্মা, ত্রিদিবেশ রায়, শমিতা রাহা, চিত্রা পাল, বেলা দে, 

দীপায়ন ভট্টাচার্য,  লিপিকর, গৌতমেন্দু নন্দী, পার্থ বন্দোপাধ্যায়, 

দেবযানী ভট্টাচার্য, সপ্তাশ্ব ভৌমিক, দেবযানী সেনগুপ্ত, লীনা রায়, মাথুর দাস, 

রীনা মজুমদার, উৎপলেন্দু পাল, শ্রাবণী সেনগুপ্ত, তীর্থঙ্কর সুমিত, 

স্বপন কুমার সরকার, লালন চাঁদ, দেবর্ষি সরকার, সঞ্জয় (এস সাহা), 

প্রিয়াঙ্কা পিহু কর্মকার, অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী, প্রদীপ কুমার দে,  

রাজর্ষি দত্ত, অমিত মুখোপাধ্যায়, রেজাউল করিম রোমেল, বিনয় বর্মন, 

প্রতিভা পাল, মজনু মিয়া, বটু কৃষ্ণ হালদার, স্বপন কুমার দত্ত, মোহন,  

রথীন পার্থ মণ্ডল, অলকানন্দা দে, রূপক রায়, রীতা মোদক, 

সৈকত দাম, আকাশলীনা ঢোল, রবিনা সরকার, শাহীন খান, 

সালমা আক্তার চাঁদনী, সুমন্ত সরকার, সন্দীপন দাস 



মুজনাই অনলাইন পৌষ সংখ্যা 

১৪৩০





শিল্পী- শমিতা রাহা 



নতুন ভাবনার আগামী 


নতুন দিনের আশায়
লিপিকর

এ বছরের কলকাতা Rainbow Pride March ছিল গত ১৭ই ডিসেম্বর। গত বছরে ইচ্ছে থাকা সত্বেও আসা হয় নি, তাই এ বছরেরটাই ছিল আমার প্রথম Pride। যেহেতু আমি queer সমস্ত আন্দোলন ও উদযাপনে ally হিসেবে আত্মপরিচয় দিই, তাই ঠিক করেছিলুম floatee থেকে ভাসমান রামধনু পতাকা স্পর্শ করা নিয়ে করব না কোনও আকুলিবিকুলি, কোনও আদিখ্যেতা। নিজের মত হাঁটছি, চেনা-মুখচেনাদের সঙ্গে বিনিময় হচ্ছে হাসি, শুভেচ্ছা, আলিঙ্গন। চারপাশে স্লোগান আর গানের মাঝে সুশৃঙ্খাল পদক্ষেপে মিশে যাচ্ছে স্বতঃস্ফূর্ত নাচ, বিচিত্র পোশাকের পাশাপাশি স্বাধীনতার দাবী সোচ্চার হচ্ছিল পোস্টার-এর ধারালো বক্তব্যেও। আমিও কখনো এক ব্যানার ধরে, কখনো মুঠোফোনে মুহূর্ত বন্দী করার চেষ্টা করে সঙ্গে চলছিলুম। ম্যাজিকটা ঘটল পার্ক স্ট্রীট থানা পেরনোর ঠিক পরে। হঠাৎ দেখলুম, গাড়ির খুব কাছে এসে পড়েছি, আর আমি ব্যগ্র না হলেও রামধনু পতাকা কিভাবে যেন আমাকে ঢেকে নিয়েছে, ডেকে নিয়েছে তার ছায়ায়। মিনিটখানেক তার তলায় হাঁটছি, এখন চারপাশের মানুষদের উদ্দীপনা, উত্তেজনা অনেক বেশি, এমন সময়ে আমার ঠিক সামনে দুটো মেয়ে, উচ্চতা ও বয়েস দুটোতেই আমার কোমরের থেকে বেশি হবে না, তারা দু’জনে দুজনের ঠোঁটে ঠেকাল ঠোঁট, আর তাঁদের চুম্বন শেষ হতেই আমাদের মাথার ওপর থেকে সরে সামনে এগিয়ে গেল রামধনু পতাকা। শীতের অস্তগামী দিবাকরকে সাক্ষী রাখা এই ভালবাসার প্রকাশকে অস্ফুটে বললাম, “ব্লেস ইয়ু।” 

এই ভালবাসাটুকুকে দেখবার জন্যেই তো এই বিচ্ছিন্ন, উত্তর-চল্লিশ বেঁচে থাকা।




কবিতার সেই প্রজন্ম 


আত্মার আত্মীয়
উমেশ শর্মা

যৌবনে প্রতি রাতে করেছি কতো আত্মক্ষয়
সঞ্চয় যা ছিল বেশিরভাগ ছিল অপচয়,
সঞ্চয় বলি কেন সৃষ্টিশীল যত সৃজন।
জীবন উপান্তে ভাবি কত আপন জন?
নবান্নে ধানের স্তূপে ছিল শস্যকণা যত
নিষ্ফল আক্রোশে দানাহীন কতোশত, 
গাছ, চারা গাছ, ফুল ফল যত ফুটে আছে
কাউকে নয়,  কেউ  নিজে পায় না কাছে।




পাহাড়পরী
দীপায়ন ভট্টাচার্য


কয়লাতোড়   ইঞ্জিনের কু-ঝিক্ -ঝিক্ শ্বাস ফেলে ছুটে গেল 
শৈশবের সেই পাহাড়কুড়োনো ট্রেন
আর
তার
বাইরের হিম-ছোঁয়ানো অন্ধকারে 
সুর-সাধনে নতুন অথচ যুগযুগান্তের ঝিঁঝিঁকীটদল
 তারাও কি বিস্ময়াবেশে আকাশ দেখবে কাল?

পার হল কত নিমগ্ন স্টেশন
 একদম ঘুমিয়ে-পড়া কম কম বাড়ি 
আর কুয়াশার একটানা স্রোত

শব্দ তাল দিয়ে গেল
 চল্ শকট 
 ঘটাং ঘট
 মৌমাছির ডানা-তানের মত
এক সময় গন্তব্য-স্পর্শে তা মিলিয়েও গেল 
লণ্ঠনের স্তিমিত আলোয় সৌন্দর্যবিতান
           জয়ন্তী স্টেশন

আঃ- এই নাকি সেই কলানা-কাঁপানো
 পাহাড়পরী – পাহাড়তলি – পাহাড়পুর!



আত্ম জাগরণ 
গৌতমেন্দু নন্দী 

আমার অমিকে ভাঙতে বলি 
মিথ্যে স্তুতির বেড়াজাল
জীবন-মঞ্চে নিজেই দাঁড়িয়ে
বাহ্যিক সব করি আড়াল।

 জয়মাল্য নিজেই পরি
 নি‍জেকেই দেই পুরস্কার
 কখনও নিন্দে তিরস্কারে
 নিজেকেই করি আবিষ্কার।

 মিথ্যে স্তুতির স্তাবকতা থেকে
 নিজেকে রাখি মুক্ত
 যেমনটি হয় "দুর্ভিক্ষ"-তে 
 সবাই যেন "অভুক্ত"!

  আঘাত করি নিজেই নিজেকে
  গড়ে তুলি প্রতিরোধ
  উপেক্ষা করি রক্তচক্ষুর
  বাহ্যিক যত প্রতিশোধ।



ঋণ স্বীকার
দেবযানী ভট্টাচার্য

একটি জানালার কাছে কতো ঋণ থেকে যায় ?
রাত গভীর হলে জানালাটি ডাকে আয়, আয়
আহা ! স্বপ্নীল রাত জুড়ে নেমে আসে প্রেমজ সময়, 
জানালাটি বুনে দেয় আমাদের যৌথ অভিসার ---
 আমাদের দেখা হয়নি কিছুই !
একটি দীর্ঘস্থায়ী চুম্বনের অছিলায় খুঁজিনি ঝাউবনের আড়াল, 
সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের তীরে দাঁড়িয়ে একাই গুনেছি ঢেউ !
নোনা জলে ভেসেছে চিবুক,
অথচ জানলায় হৃদয় রাখতেই শুনেছি তোমার বৃদ্ধ বুকের সামুদ্রিক আহ্বান,
বেলাভূমি জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে আমাদের রমণীয় মুহূর্ত যাপনের উল্লাস !  



আবিতথ
সপ্তাশ্ব ভৌমিক

মানুষ কৃতঘ্ন হতে পারে 
মানুষ ঘাতক হতে পারে 
মানুষ দানব হতে পারে

তবুও যেতে হবে 
মানুষেরই খোঁজে 
শুধু মানুষই মানুষ হতে পারে

এত ধ্বংস, এত মৃত্যু, এত ঘৃণা,
শেষ কথা নয় 
ক্রোধে- পাপে - উত্তাপে
ভালোবাসা আজ অক্ষয়।



দুটি কবিতা 
লীনা রায় 

ফেরার ইচ্ছে
           
গোটা কুড়ি ইচ্ছে
কিছু শখ আহ্লাদ,
ভাল লাগা বেশ কিছু
এলোমেলো দিনরাত।

খাপছাড়া ভাবনার
টুপটাপ হরদম,
বেলাগাম ইচ্ছের
মাপজোক বেশ কম।

চৈত্রের হাঁফ ধরা
ঘুঘু ডাকা দুপুরে,
ইচ্ছের লয়কারী
সুরে বা বেসুরে।

লুকোচুরি ইতিউতি
মুখচোরা ইচ্ছে,
আশকারা, আবদারে
ফিরছেই ফিরছে।


এক মুঠো রোদ


মান করেছে,মান করেছে
মুখ ঢেকেছে মেঘ আষাঢ়,
মান ভাঙানি গান বেঁধেছি
বানভাসি হই সই আবার।

মাপ ভুলেছি, মাপ ভুলেছি
নিক্তি হাতে হা- পিত্যেশ,
ফিরিয়ে দিয়েও কে বা পেল
গুলিয়ে হিসেব, লাগছে বেশ।

থই মেলে না, থই মেলো না
গভীর অতল মাঝপুকুর,
হাতড়ে খুঁজি রত্ন ঝাঁপি
ডুব সাঁতারে , ভর দুপুর।

মেঘ কেটে যা, মেঘ কেটে যা
রোদ ভাসি হোক মেঘলা দিন,
মাপজোক আজ বড্ড ক্লিশে
পল অনুপল ফাগ রঙ্গীন।


আশা

মাথুর দাস


নতুন দিনের নতুন আশায়

মানুষ আশার ভেলা ভাসায়

আশা ভরসায় বাঁচে চাষায়

চিরটা কাল ।


বছরশেষেও মছর কাটে

দোষ দূষণও মাঠে ঘাটে

আগুন জ্বলে বাজার হাটে

হই নাকাল ॥


রোগ ভাইরাস ব্যাকটিরিয়ায়

দাঁত কিড়মিড় কিরকিরায়

ক্ষমতা-দানব চিড়বিড়ায়

কী উল্লাসে !


দিনের পরে যায় কেটে দিন

নিত্য অভাব বাড়ায় যে ঋণ

আহা, দু'চোখ ভরে স্বপ্ন রঙীন

তবুও ভাসে ॥


নতুন ভোর

রীনা মজুমদার


কাজের ফাঁকে, একটু সময় রেখো
জল দিই রোজ চারা গাছে
ফুটবে ফুল, ফলবে ফল
মিলবে ছায়া, মহান মহীরুহ
 বাঁচবে প্রাণ, গাছ অতি প্রিয়।

বৃষ্টি আসুক, ফলবে সোনা। উর্বর মাটি
ভরবে কুশি, দুটি পাতা একটি কুঁড়ি
আসবে কুটো-খড়, বাড়ুক শ্রম
জ্বালাব সন্ধ্যা প্রদীপ, কুলুঙ্গি আলোয়
  বাঁচবে প্রাণ, পেট অতি প্রিয়।

 আগাছা আগেও ছিল, আছে, থাকবেই
 আগুনেই শুদ্ধি, পোড়াব জঞ্জাল
 শপথে-ই  আনব অগ্নি অক্ষর
 বাঁচতে হবে, বাঁচাতে হবে আগামী
 আমরাই পারি, আনব এক আকাশে 
  প্রতিটি নতুন ভোর, ভালোবেসে 

  বাঁচবে প্রাণ, জীবন অতি প্রিয়..



ছাই  
উৎপলেন্দু পাল 

উঠোনের একফালি ঘাসে 
লেগে আছে ঘষটে যাওয়া রক্তের দাগ 
এক কোণে পড়ে আছে হুক ছেঁড়া একটা ব্লাউজ 
বাতাসে এখনো পাক খাচ্ছে কান্নাভেজা গোঙানির শব্দ 

উঠোন পেরিয়ে ওপারে 
আধপোড়া খড় কাঠ আর একটা লাশ 
জ্বলে যাওয়া চামড়ায় লেখা ছিল আগামীর স্বপ্ন 
ছুঁড়ে ফেলা কাপড়ের খুঁটে লেগে আছে নির্লজ্জ পৌরুষ 
 
এখন আমার আঙিনায় 
জেগে আছে এক অসহায় নিস্তব্ধ বিলাপ 
অন্ধকারে শোনা যায় দাম্ভিক পুরুষালী পদধ্বনি 
আর উলঙ্গ সমাজের মাথার পঁচা ঘায়ের অসহ‍্য দূর্গন্ধ 

এভাবেই আমার যাপন 
মননে পাশবিক নখরের তাজা ক্ষতচিহ্ন 
নুয়ে পড়া মেরুদন্ডে অজস্র দূর্বহ স্মৃতির বোঝা 
জীবন্মৃত অস্তিত্ব জুড়ে ছড়িয়ে থাকা রাশি রাশি ছাই ।  




আশা 
শ্রাবণী সেনগুপ্ত 

ভাঙা মন ভাঙা কাঁচ 
প্রতিবিম্ব আনাচ কানাচ।
 টুকরো টুকরো আশা
প্রতিনিয়ত সস্তার ভালোবাসা ।
পথে যেতে যেতে ফেরারি মনের খোঁজ 
অশ্রুত কথা স্মৃতিময় দিনভর ।
পুরাতন যত পিছু ডাক দিয়ে যায় 
নতুন প্রভাত আগামি গান শোনায়। 
এই শুভক্ষণে ইচ্ছাপত্র হোক-
 হতাশ মনের কোনে জাগে আলো আশা,
 পাতে ভাত আর ছোট্ট একটি বাসা।



লবঙ্গ পাতায়
তীর্থঙ্কর সুমিত



কারুকার্যহীন লবঙ্গ পাতায়
গত কয়েক বছরের বিকেল দেখেছিলাম
ডোবার শামুকে হাঁসের চঞ্চুর মিলন
কিম্বা আকাশরঙা নীলে...
ভোরের শালিকের মিলিয়ে যাওয়া
স্বপ্নবিভোর মুহূর্তে আজ
শৈশবের নদী চরাচর জুড়ে

ইমারতের ভিড়ে মিলিয়ে গেছে। 




বায়োনেট
স্বপন কুমার সরকার
     
     
কয়েকটা এলোপাতাড়ি গুলি
ধোঁয়া ধোঁয়া কিছু বিষাক্ত অক্সিজেন 
 মৃত্যুরা জানতেই পারেনি 
 কখন নিস্তেজ হয়ে গেছে তার
 ইমিউনিটি

ধূসর ধূলোর সাথে বাতাসের সন্ধি
ভাঙা অট্টালিকার ইট পাথরের উঁকিঝুঁকি
নিরপরাধ পড়ুয়ার দিকে ফ্যালফ্যাল করে
চেয়ে থাকে প্রত্যাশায়

মৃত্যুঞ্জয় ঈর্ষার বিষ ছড়ানো থালায়
গ্রাসে গ্রাসে উদ্বৃত্ত সংক্রমণ
কঙ্কালেরা যখন হাড় চিবোয় তখন আর
কিসের নগরায়ন

পরিকল্পিত যন্ত্রমানব কালো উর্দিধারী
ডান হাতে বা হাতে কুড়িয়ে খাচ্ছে
যুদ্ধবাজ বুমারু বিমান 
সে প্রাণ গেজেটে তৈরি তাই ওখানে
মানুষের মতো হদয় থাকেনা



উতল হাওয়া
লালন চাঁদ
                          

কথামুখ থেকে বেরিয়ে আসে লাভা
অগ্নেয়গিরি
চাঁদের মাটি দখল করে পৃথিবীর নতুন ইঞ্জিনিয়ার

হতাশার বুকে আজও আগাম সন্ত্রাসী কষাঘাত

নষ্ট হাওয়ার সুড়ঙ্গ বেয়ে পেরিয়ে আসে হৃদয়
সমীক্ষায় গুণে নিই রোদ
কথা থাকে। কথা ফুরিয়ে যায়। পড়ে থাকে দীর্ঘদ্বাস.

শিশির কুড়িয়ে জমা করি পাঁজরের হাড়ে 
উতল হাওয়ায় দেখি তার হরিণ চোখ

তোমাকে  উপহার  দেবো বলে সাজিয়ে রাখি গোলাপ
তুমি এলে আমি খুশি
না এলে আমি খুনি হবো। খুন করবো নিজেকেই



ব্যথা-গাছ 
মো হ  ন 

যে ক'দিন বর্ষা নেই পৃথিবীতে 
মুছড়ে পড়োনা ব্যথা-গাছ 
জল দেব আমি 

যদি শুকিয়ে যায় নদীনালা 
আগুন হয়ে ওঠে নীল আকাশ 
ভয় নেই 
আমার সজল দুচোখ রেখে যাব 

ক্লান্ত হয়ে এলে তুমি 
আমি ভেজা মাটির গান শোনাব 
মনে করিয়ে দেব মেঘের বিরহ সুর 

তুমি ঘুমিও না ব্যথা-গাছ 
এই দ্যাখো আমার বুকে আবার এসেছে বেদনা 
আবার আরক্ত হয়েছে চোখ পথ চেয়ে চেয়ে 
স্মৃতির বর্ষা নেমে আসছে ঝরঝর 

ব্যথা-গাছ মুছড়ে পড়োনা তুমি 
এইতো জল নামছে দু'চোখ ফেটে 


 
প্রবন্ধ 

বৈষ্ণব পদাবলীতে প্রকৃতি
দেবর্ষি সরকার

বৈষ্ণব কবিতা আস্বাদন করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ যেমন তাকে বৈকুন্ঠের বিষয় হিসেবে গ্রহণ না করে মৃত্তিকালগ্ন মানুষেরই নানা সম্পর্কের বিষয় হিসেবে দেখেছেন তেমনি সেই সব মানব মানবের বিচিত্র অনুভবকে দেখেছেন প্রকৃতির পটভূমিতে। সে প্রকৃতি জড় নয়, সে সপ্রান। তার বৈচিত্র্য মানুষের আবেগ অনুভবের কার্যকারণ সম্পর্কে গ্ৰথিত।

বৈষ্ণব পদাবলীতে প্রকৃতির এই ভূমিকাও বিশেষ প্রাকৃতিক অনুষঙ্গে রবীন্দ্রানুভবে যথার্থ রূপ পেয়েছে। আষাঢ়ের বর্ষণমুখর পটভূমিতে তাঁর মনে পড়েছে অন্ধকার যমুনার তীরে বর্ষাভিসারের কথা। ভরা ভাদ্রের পটভূমিতে বিরহিণী রাধার বেদনা কবি চিত্তকে স্পর্শ করেছে। 'রজনী শাঙ্ন ঘন ঘন দেয়া গরজন' এর মাঝখানে রাধার স্বপ্ন মিলনের রোমাঞ্চিত আনন্দকে কবি যেন নিজেও অনুভব করেছেন। শুধু বৈষ্ণব পদাবলীতেই নয়, সমগ্র ভারতীয় প্রেম কবিতার ধারায় বর্ষা ঋতু বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। বাল্মিকী রামায়ণ থেকে শুরু করে আধুনিক কাল পর্যন্ত ভারতীয় সাহিত্যের সার্থক বিরহের কবিতা বর্ষারই কবিতা। বৈষ্ণব কবিতাতেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। এই বর্ষার সঙ্গে আবার নিবিড় যোগ রয়েছে ভারতবর্ষের কদম্বকুঞ্জের। হয়তো সেজন্যই কদম্বকুঞ্জ এমন করে বৈষ্ণব সাহিত্যে প্রধান হয়ে উঠেছে। আর রাধা কৃষ্ণের প্রেমলীলায় তা অবিচ্ছেদ ভাবে জড়িয়ে গেছে। বর্ষায় ফুটে ওঠা কদম ফুলের সৌন্দর্য পৃথিবীর অন্যত্র দুর্লভ। তাই নীপ পরিমল সম্পৃক্ত বর্ষা সজলসুরভি বৈষ্ণব কবিতার রসাবেদনকে অনেকখানিই বাড়িয়ে তুলেছে।

কিন্তু শুধু বর্ষা ঋতুই তো নয় বৈষ্ণব কবিদের আকার রাধা কৃষ্ণের নিভৃত নিবিড় প্রেমলীলার অজস্র বৈচিত্র্যকে স্তরপরম্পরাকে আর স্বরূপকে পরিস্ফুটো করেছে বিচিত্ররূপা প্রকৃতি। বৈষ্ণব কবিদের তুলিকায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে গ্রীষ্মের দাবদাহ, শরতের স্নিগ্ধতা, হেমন্তের ম্লানিমা, প্রখরশীতের রুক্ষতা আর বসন্তের উত্তাপময় রূপ প্রাচুর্য। শুধু ঋতুইবা বলি কেন দিন রজনীর চিহ্নিত ভগ্নাংশের রূপরেখাও রাধাকৃষ্ণলীলায় পৃথক মাত্রা যোজনা করেছে। প্রভাত, মধ্যাহ্ন, সায়াহ্ন, সন্ধ্যা আর রাত্রি তাদের পৃথক বৈশিষ্ট্য পঠভূমি হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে জীবন্ত হয়ে উঠেছে বৈষ্ণব কবিদের কবিতায়। জয়দেবের 'গীতগোবিন্দ' শুরু হয়েছে বর্ষা ঋতুতে নিকুঞ্জ মিলনের প্রসঙ্গ দিয়ে আর তার বসন্ত ঋতু হয়েছে বিরহের পটভূমি। জয়দেব যে বর্ষা ঋতুর ছবি এঁকেছেন তা একান্তভাবেই যেন বাংলাদেশের বর্ষ ঋতুর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা। মেঘ মেদুর আকাশ আর শ্যামতমালের নিবিড়ছায়া কাব্যের প্রথম স্বর্গের বাসন্তী পটভূমির রূপোচ্ছলতার ওপর যেন স্নিগ্ধতার সঞ্চার করেছে। জয়দেব গীতগোবিন্দের প্রথম স্বর্গেই রাসলীলার বর্ণনা করতে গিয়ে ভাগবত এবং শরৎ ঋতুকে পরিহার করে বসন্তের পটভূমিকেই ব্যবহার করেছেন। এর কারণ সম্ভবত ভাগবতের রাসলীলা পরিপূর্ণভাবে আধ্যাত্মিক এটি কাব্যগুনাম্বিত হলেও ধর্মগ্রন্থ। অন্যদিকে জয়দেবের গীতগোবিন্দ হরিস্মরনের কাব্য হয়েও নর নারীর বিলাস কলার কৌতূহল চরিতার্থ করায় সমানভাবে উৎসাহী। তাই প্রেমের ঋতু বসন্তই তার কাব্যের রাসলীলার পটভূমি। গোটা প্রথম অধ্যায় জুড়েই বসন্তের একটি জীবন্ত মনোরম বর্ণনা রূপ রস প্রকৃতিকে জীবন্ত করে তুলেছে। প্রকৃতি বর্ণনায় জয়দেবের এই কৃতিত্বকে কোন কোন সাহিত্যরসিক সপ্রশংস অভিনন্দন জানিয়েছেন 'বসন্তে সকলই বিকশিত, প্রফুল্লিত, চালিত, কূজনিত ও সকল কথাই পুরাতন, সকল কথাই জানি কিন্তু সেই সঙ্গে যদি শুনিতে পাই যে জগতের লজ্জা গলিয়া গিয়াছে তাই ছোট চারাটি, ক্ষুদে লতাটি, বৃহৎ বটরাজি, গভীর বন, অনন্ত আকাশ সকলেই হাসিতেছে, সকলেই হাসিতেছে, সকলেই গাহিতেছে, সকলেই মাতিয়াছে তাহা হইলে বসন্তের বসন্ত বুঝিতে জয়দেবের কবিতা চিনিতে পারি।' জয়দেবের কাব্যের অন্যত্র প্রকৃতির এই ধরনের বিস্তৃত বর্ণনা নেই। কিন্তু রাধা এবং কৃষ্ণ দুজনের ওই রূপ বর্ণনায় কবি প্রকৃতি জগৎ থেকে উপমা আহরণ করে নায়ক নায়িকার সৌন্দর্য বর্ণনা করেছেন।
 
বড়ু চন্ডীদাসের 'শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' এ শরৎ ঋতুর প্রসঙ্গ অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত হয়ে গেছে। বৃন্দাবন খন্ডে জয়দেবেরই রাসলীলার অনুসরণে কবি পুষ্প বিকশিত বৃন্দাবনের পটভূমিতে রাধা কৃষ্ণ ও গোপীদের প্রেমলীলা বর্ণনা করেছেন। রাধাবিরহে বর্ষার আর বসন্তের মাঝখানে রাধার কন্ঠে ফুটে উঠেছে তার বিরহের আর্তি। এখানে প্রকৃতি পটভূমি নির্মাণ করেছে। রাধাকৃষ্ণের রুপ বর্ণনাতেও কবি প্রকৃতির ব্যবহার করেছেন নিপুন হাতে। 

কিন্তু বৈষ্ণব পদাবলীতে প্রকৃতি চেতনার বিশিষ্টতা ভিন্ন আবেদনে রূপায়িত হল বিদ্যাপতির পদাবলী থেকে। আমরা জানি বিদ্যাপতি কেবলমাত্র রাধা কৃষ্ণ লীলা নিয়ে পদ রচনা করেননি অন্যান্য ধরনের কবিতার সঙ্গে কিছু ঋতু বিষয়ক কবিতাও তিনি রচনা করেছেন। আর এই ঋতু হল বসন্ত। বসন্তের ওই উজ্জ্বল সজীব সৌন্দর্যের মাঝখানে কবিতার একটি অপরূপ পদে বৃন্দাবনের পটভূমিতে রসরাজ কৃষ্ণের সঙ্গে রসবতী যুবতীদের সান্নিধ্যের মাধুর্য বর্ণনা করেছেন ' মধুঋতু মধুকর পাঁতি/ মধুর কুসুম মধুমতি/ মধুর বৃন্দাবন মাঝ/ মধুর মধুর রসরাজ/ মধুর যুবতীগন সঙ্গ/ মধুর মধুর রসরঙ্গ।' 

এই বসন্তেরই পটভূমিতে কবি বিদ্যাপতি বর্ণনা করেছেন রাধাকৃষ্ণের মিলনের বিচিত্র লীলা। বিদ্যাপতির পদে আরেকটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে বর্ষা প্রকৃতি। তাঁর রাধা, মেঘান্ধকার বর্ষণমুখরিত রাত্রিতে অভিসারে বেরিয়ে পড়েন। কাজলের মতো নিবিড় নিকষ অন্ধকার উদগীরনকারী রাত্রি, বিষধর সর্প ও বজ্রের গর্জন কিছুই রাধাকে দমিয়ে রাখতে পারে না। আসলে বর্ষণমুখরী রাত্রিতে প্রকৃতির তীব্র প্রতিকূলতার পটভূমি অভিসারিকার অভিসারের যেমন উপযুক্ত সুযোগ তেমনি তার সর্ববিঘ্নজয়ী প্রেম ও সুদূর সংকল্পকে প্রকাশ করারও সর্বোৎকৃষ্ট উপায়। তাই এই দুঃখদায়িনী প্রকৃতি অভিসারিকা রাধার প্রেম সহায়িকা বন্ধু। বিদ্যাপতির রাধা শ্রাবণের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চান, আর মেঘকে কোটি রত্নের লোভ দেখান। যাতে সে শ্রাবন রজনীর নিবিড় তমিস্রাকে আরো নিবিড় করে তোলে। এখানে মেঘদূতের বিরহোন্মাদ যক্ষের মতোই রাধাও প্রেমোন্মাদিনী। যক্ষ মেঘকে সজীব ভেবে তাকে দিয়েই প্রিয়ার কাছে সংবাদ পাঠিয়েছিল। আর রাধা মেঘকে অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে বশীভূত করতে চেয়েছেন। বর্ষা ঋতু প্রেমিক-প্রেমিকার মনে প্রিয় বিরহ বেদনাকে উদ্ধাল করে তোলে। কালিদাসরে মেঘদূত সেই অমর বিরহ গাথা। কিন্তু মেঘদূত এ বর্ষার মাঝখানে বিরহিনীর আবেগ ফুটে ওঠেনি। অন্যদিকে বৈষ্ণব পদাবলীতে বর্ষার পটভূমিতে রাধার বিরহ বেদনাকে কবিরা যেন প্রকৃতির সঙ্গে এক সূত্রে মিলিয়ে বর্ণনা করেছেন। বিরহ প্রেম আর বর্ষা একসঙ্গে মিলেমিশে গিয়ে যেন অসীমের জানালা খুলে দিয়েছে। বিদ্যাপতির 'এ ভরা বাদর মাস ভআদর' শীর্ষক পদটি তারই উদাহরণ। বর্ষার দিনে রবীন্দ্রনাথের এই বিরহের পদটির কথা মনে পড়েছে। 'বর্ষাযাপন' কবিতায় তিনি বলেছেন 'আসাঢ় হতেছে শেষ, মিশায়ে মল্লার দেশ/ রুচি 'ভরা বাদরের সুর।' আর বুদ্ধদেব বসু বলেছেন 'এ ভরা বাদর মাহ ভাদর শূন্য মন্দির মোর' বলা মাত্র সারা আকাশ বেদনায় ধ্বনিত হয়ে ওঠে, আদিগন্ত বিরহের উপর বৃষ্টির ধারা বয়ে যায়। এই বেদনা শুধু কোন নির্দিষ্ট দয়িতের জন্য নয়, যে এলে আমার মন্দির পূর্ণ হবে আমি তাকে চিনিনা এর মধ্যে এ কথাও বলা আছে।' এই ভাবে বর্ষা ঋতুর পটভূমি অনির্দেশ বেদনার অনুভূতি ফুটিয়ে তুলেছে। রূপ বর্ণনা করতে গিয়ে বিশেষত রাধার রূপ বর্ণনা করতে গিয়ে বারবার প্রকৃতির জগৎ থেকেই উপমা আহরণ করেছেন। সব কবিই প্রকৃতি থেকে উপমা আহরণ করেন কিন্তু এই ক্ষেত্রে বিদ্যাপতি প্রাকৃতিক বস্তুগুলিকে আলংকারিক চমৎকারীত্বে অভিনব করে তুলেছেন। যেমন রাধার চোখের বর্ণনা দিতে গিয়ে কবি বলেন 'নীরে নিরঞ্জন লোচন রিতা/সিন্দুরে মন্ডিত জনু পঙ্কজ পাতা।' স্নানের পর রাধার ঈশ্বৎ আরক্ত অঞ্জনহীন দুটি চোখের সঙ্গে সিন্দুরমণ্ডিত পদ্মের পাপড়ির তুলনা বিদ্যাপতির বিশিষ্ট প্রকৃতি চেতনার পরিচায়ক।

পদাবলীর চন্ডীদাস তার পদে গ্রাম বাংলার নিবৃত পরিবেশের একটি অন্তরঙ্গ পরিচয়ই যেন তুলে ধরেছেন। কোনো কল্পলোক নয়, বাঙালি জীবনকে প্রত্যক্ষ করে তার একান্ত বাস্তব পরিচয় তার কবিতার সাজিয়েছেন। তার রাধা প্রেমকে তুলনা করেন গ্রাম বাংলার একটি পুস্করিণীর সঙ্গে। কিন্তু সে তুলনা দিতে গিয়ে তিনি এখানেই থামেন না, গ্রাম বাংলার বিভিন্ন অনুষঙ্গ কে জীবন্ত করে তোলেন। দুঃখের মকর, জলের শ্যাওলা,জিওল মাছ,পানি ফল আর পানা সবকিছু নিয়ে গ্রাম প্রকৃতির প্রত্যক্ষ বাস্তব অভিজ্ঞতাই কবির পদে প্রতিফলিত হয়। আবার কখনো নদীর জোয়ার ভাটা, কুমিরের কথা, হাতি হরিণী পাখি পিঞ্জর এই সমস্তই তার কবিতায় ব্যবহৃত হয় যেন অনিবার্যভাবে। রাধার চোখকে কবি তুলনা করেন চঞ্চল পাখির সঙ্গে। রাধার বিরহজ্বালা উপনীত হয় দাবানল দগ্ধা হরিণীর সঙ্গে। আবার যখন রাধা আত্মহত্যা করতে চান তখনো তিনি আশ্রয় চান বাংলাদেশের কালো দিঘির জলে। চন্ডীদাসের রাধা বর্ষণমুখর রাত্রিতে অভিসারের জন্য প্রস্তুত হয়েও পথে বেরতে পারেন না। তার প্রতীক্ষারত প্রেমিকই দরবীগলিত ধারাবর্ষণে সিক্তদেহে অঙ্গনে এসে অপেক্ষা করেন। এই বর্ষা চিত্রটি সংক্ষিপ্ত হয়েও উজ্জ্বল করে তোলে রাধার উৎকণ্ঠা এবং রাধাকৃষ্ণের পারস্পরিক প্রেমের গভীরতাকে। প্রকৃতির এই ব্যবহারের ভেতর দিয়েই কবি হিসেবে চন্ডীদাসের নিজস্ব প্রবণতার পরিচয়ও স্পষ্ট হয়ে যায়।

চৈতন্যোত্তর যুগের বিশিষ্ট কবি গোবিন্দদাস প্রকৃতির বিচিত্র রূপকে রাধাকৃষ্ণ প্রেমলীলার আবহরূপে নানাভাবে ব্যবহার করেছেন। বিশেষ করে বর্ষা আর শরৎ ঋতু অভিসার এবং রাসের পদগুলিকে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করেছে। কিন্তু শুধু বর্ষা ঋতুতেই নয়, গোবিন্দ দাস গ্রীষ্মের দাবদগ্ধ দিনেও রাধার অভিসার বর্ণনা করতে গিয়ে বাংলাদেশের ওই প্রখর তপন তাপে তাপিত পৃথিবীর ছবি এঁকেছেন 'মাথহিঁ তপন,তপত পথ বালুক/আতপ দহন বিথার/ননিক পুতলি তনু,চরন কমলজনু/দিনহি কয়ল অভিসার।' আবার কখনো গ্রীষ্মাভিসারে বেরিয়ে রাধা 'মারুত মন্ডল ধূলি' অর্থাৎ ধুলোর ঘূর্ণির মধ্যে পড়ে যান। এইভাবে গ্রীষ্মের তীব্র তপ্ত পটভূমি জীবন্ত হয়ে ওঠে গোবিন্দ দাসের পদাবলীতে। গোবিন্দদাসের পদে প্রবল বৃষ্টি, দশদিক চকিত করা বিদ্যুতের ঝলক, আর বজ্রপাতের ভয়ংকর শব্দের মাঝখানে রাধা অভিসারে চলেন। রাধার সেই চলার পথও বাংলাদেশের 'শঙ্কিল পঙ্গিল বাট।' কেবল গ্রীষ্ম বর্ষা নয়, পৌষের প্রবল শীতের মাঝখানেও রাধা অভিসারে বেরিয়ে পড়েন। প্রবল শীতে ঘরে ঘরে দ্বার রুদ্ধ। যমুনাতীরে কুঞ্জকুটীরের লতাগুলিও যেন শিশির পড়ার ফলে তরল হয়ে গেছে। কিন্তু এই প্রবল শীতকে উপেক্ষা করেই রাধা চলেছেন অভিসারে। প্রকৃতির প্রতিকূলতা এখানে ব্যবহৃত হয়েছে রাধার প্রেম গভীরতাকে প্রকাশ করার জন্য। রাধা কখনো অভিসার করেন অন্ধকার রাত্রিতে আবার কখনোবা ধবল জোৎস্নায়। নীল মৃগমদে অনুলিপ্তা, নীলবাসন ভূষণে সজ্জিতা রাধার বর্ণনা দিতে গিয়ে কবি বলেন 'নীল নলিনি জনু শ্যামর সায়রে/লখই না পারই কোই।' তিমিরাভিসারিকা রাধা যেন অন্ধকারের সরোবরে ফুটে থাকা নীলকমল। জীবন্ত এই উৎপ্রেক্ষাটি গোবিন্দ দাসের প্রকৃতি চেতনার বিশিষ্টতাকেই শুধু তুলে ধরেনা তত্ত্বের নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে একজন স্রষ্টা কি অসাধারণ কৃতিত্ব দেখাতে পারেন এ তারই উদাহরণ। গোবিন্দ দাসের রাধা জোৎস্না রাত্রেও অভিসারে যাওয়ার সময় শুভ্র বসন ভূষণ সজ্জিত হয়ে যখন পথ চলেন তখন মনে হয় চন্দ্রকিরণের সঙ্গে তার শরীরও মিশে গেছে। গোবিন্দদাস প্রকৃতিকে অভিসারের পদে এত বিচিত্রভাবে বর্ণনা করেছেন, বিশেষ করে এটা বোঝানোর জন্যই যে রাধার অদম্য কৃষ্ণমিলন বাসনা কোনো বিশেষ অনুকূল সময়ের অপেক্ষায় থাকে না। যেকোনো প্রাকৃতিক পরিস্থিতির মাঝখানে তিনি এগিয়ে যান। রাসলীলা বর্ণনা করতে গিয়ে কবি গোবিন্দদাস ভাগবত অনুযায়ী শরতের বর্ণনা করেছেন। শরৎকালের পূর্ণিমা রাত্রির স্নিগ্ধ সৌন্দর্যও ছাড়াও গোবিন্দদাসের রাসলীলার প্রসঙ্গে প্রকৃতি একটি চরিত্রে পরিণত হয়েছে। কবি বলেছেন কৃষ্ণের মধুর বংশীধ্বনিতে শুধু গোপীরাই ব্যাকুল হয়ে ছুটে আসে না, শুকনো কাঠে নতুন পল্লব সঞ্চারিত হয়। যমুনা উজানে বয়। পাহাড়ে পাথর গলে যায়। মাছ জল ছেড়ে উঠে আসে। বৎসরা দুগ্ধ পান ত্যাগ করে আর মৃগীরা অরণ্য ত্যাগ করে ছুটে যায়। এইভাবে গোবিন্দদাস তার কাব্যে প্রকৃতিতেও যেন মানুষেরই চেতনা আরোপ করেছেন।

কবি জ্ঞানদাস তার স্বপ্ন মিলনের পদে বর্ষণমুখর প্রকৃতির সংগীতময়তাকে রাধার প্রেম স্বপ্নের সার্থক পটভূমিরূপে ব্যবহার করেছেন। রবীন্দ্রনাথের কবিচিত্তকেও এই কবিতা বিশেষভাবে স্পর্শ করেছে সে কথা আমরা আগেই উল্লেখ করেছি। মেঘের ঘন গর্জন, রিম ঝিম বর্ষা, কুহু ও কেকার মুখরতা, দাদুরী ডাহুকী, ঝিঁঝিঁর মত্ততা জ্ঞানদাসের রাধার স্বপ্নকে যেন আরো মধুর করে তুলেছে। কৃষ্ণ প্রেমে বিমুগ্ধা জ্ঞানদাসের রাধার কাছে কৃষ্ণের যৌবনকে মনে হয়েছে শ্যামল অরণ্যের মতো। তাঁর রাধাও অভিসারে বেরিয়েছেন 'মেঘ যামিনী অতি ঘন আন্ধিয়ার' এর প্রাকৃতিক পটভূমির মধ্যে।

এই সমস্ত প্রধান প্রধান কবি ছাড়াও সমগ্র বৈষ্ণব পদাবলীতে বিভিন্ন কবি নিঃসর্গের রূপ চিত্র অঙ্কনে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। যেমন পুরুষোত্তম দাস কৃষ্ণবিরহে বেদনাভিভূত প্রকৃতির বর্ণনা দিয়েছেন 'সাগর জঙ্গমে কীটপতঙ্গম/বিরহ দহনে দহি যাহ। শ্রীরূপের 'ভক্তিরসামৃত' সিন্ধুতেও আমরা দেখি পুত্রবিয়োগকাতরা জননী যশমতি কদম্ববৃক্ষ, হরিণ এবং ভ্রমরকেও ব্যাকুল ভাবে তার পুত্রের কথা জিজ্ঞাসা করেছেন। তার অভিসারের পদে বর্ষার পটভূমি বৈষ্ণব পদাবলীতে বিদ্যাপতি, গোবিন্দদাস ছাড়াও রায়শেখর প্রমুখ অন্যান্য কবিদের কাব্যোও ব্যবহৃত হয়েছে। রায়শেখরের একটি অভিসারের পদে মেধাবৃত বিদ্যুৎদীপ্ত বজ্রগর্জন মুখরিত বর্ষার দিনে উৎকণ্ঠিতা গৃহবন্ধিনী রাধা সংকেতকুঞ্জে অপেক্ষমান কৃষ্ণের কথা ভেবে বিচলিত হয়েছেন ।এইভাবেই রাধা কৃষ্ণের মিলন - বিরহ, আনন্দ - বেদনার প্রায় প্রতিটি স্তরই প্রকৃতির বিচিত্র সৌন্দর্যের নানা উপাদানের ব্যবহারে জীবন্ত হয়ে উঠেছে।

তথ্যসূত্র:
১. বৈষ্ণব পদাবলী, শ্রীহরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত
২. বৈষ্ণব পদাবলী, ড. সত্য গিরি
৩. বৈষ্ণব রস প্রকাশ, ড. ক্ষুদিরাম দাস
৪. শ্রীশ্রীব্রজধাম ও শ্রীগোস্বামীগন, গোবর্ধন দাস
৫. শ্রীরাধার ক্রমবিকাশ, দর্শনে ও সাহিত্য, শশীভূষণ দাশগুপ্ত
৬. রবীন্দ্র রচনাবলী, জন্মশতবার্ষিকী সংস্করণ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
৭. ষোড়শ শতাব্দীর পদাবলী সাহিত্য, বিমানবিহারী মজুমদার
৮. পদাবলী কীর্তনের ইতিহাস, স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ



হৃদয়ের উৎসব নবান্ন আজ শুধুই  কাহিনি 
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় 

নতুন অন্নের সাথে নবান্ন কথাটির যোগ রয়েছে।  রবীন্দ্রনাথ বলেছেন " নতুন ধানে হবে নবান্ন তোমার ভবনে ভবনে ।  রাঢ় বাংলার সব থেকে বড় উৎসব নবান্ন। দূর্গা পুজোর থেকেও অনেক বৃহৎ পরিসরে এই উৎসব পালিত হয় এই অঞ্চলে।  কার্তিক মাসের শেষে এবং অগ্রহায়ণ মাসের প্রথমে কোনো এক শুভদিন দেখে নবান্ন অনুষ্ঠিত হয়। বছরের প্রথম মাস বৈশাখ হলেও, অগ্রহায়ণ মাসকে সব মাসের প্রথম এবং প্রধান মাস হিসেবে ধরা হয়। অগ্র শব্দের অর্থ আগে এবং হায়ন শব্দের অর্থ মাস। এই অগ্রহায়ণ মাসেই কৃষক পরিবার তার নিজের চাষ করা  জমি থেকে কিছুটা ধান সংগ্রহ করে।  সেই ধান থেকে ঢেঁকি পাড় দিয়ে  চাল বানিয়ে (এখন অবশ্য চালকলেই নতুন আমন ধান ভাঙানো হয়) , সেই চালকে গুড়ো করে বাড়ির সামনে নিকোনো উঠোনে আলপনা দেওয়া হয়। যত অভাব অভিযোগ থাকুক বাড়ির গৃহকর্তা তার সবটুকু উজাড় করে নবান্নের আয়োজন করেন।নবান্নের দিন সকালে কলার পাতায় আতপচাল, ফল মিষ্টি অর্ঘ নিবেদন করা হয়। কাক কে যমরাজের দুত হিসেবে প্রসাদ নিবেদন করা হয়। তাছাড়া  পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে  তুলসীতলায় ও দেবদেবীর মন্দিরেও নবান্নের ভোগ নিবেদন করা হয়। 

কোনো কোনো গ্রামে সমবেত ভাবে শিবের ( নারদ সহ) অন্নপূর্ণার পুজো হয়। ছেলে বুড়ো সবাই স্নান করে নবান্নের  প্রসাদ গ্রহণ করেন। নতুন আতপ চালের গুঁড়োর সাথে দুধ চিনি মধু কলা ও অনেক রকম ফল আদা মুলো নারকেল ইত্যাদি কুচি করে মেশানো হয়। উপরে ছড়িয়ে দেওয়া হয় বোঁদে ও জিলিপি।  প্রসাদের সাথে পান্তুয়া চমচম রসগোল্লাও পরিবেশন করা হয়। 

দুপুরে হয় নতুন আতপচালের ভাতের সাথে পাঁচ রকম ভাজা,বিভিন্ন শাক সবজি, তরি তরকারি।  ধরা হয় পুকুর থেকে মাছ। হয় ছোটো মাছের  অম্বল, ঝাল এবং অবশ্যই শেষ পাতে পায়েস। এই ভাবেই আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধবদের আপ্যায়ন। পর দিন  হয় বাসি নবান্ন। বাসি নবান্নের পাতে কোথাও কোথাও কচি পাতায় ব্রাহ্মণ ভোজনের আয়োজন করা হয়।  আয়োজন করা হয় গ্রাম্য মেলার। গ্রামের ছেলেদের উদ্যোগে আয়োজিত হয় নাটক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। 

ইঁট, কাট,পাথরে মোড়া শহর সভত্যায় সব অনুষ্ঠানে আড়ম্বর  প্রাচুর্যের ছড়াছড়ি থাকলেও এমন আন্তরিকতা এবং  হৃদয়ের সাথে হৃদয়ের মেলবন্ধনের চিত্র দেখতে পাওয়া যায় না বলেই আমার বিশ্বাস।



নাটাই পুজো দিয়ে শুরু গ্রামবাংলার নবান্ন উৎসব/ নাটাই চন্ডী ব্রতের প্রচলিত পৌরাণিক কাহিনী।
সঞ্জয় (এস.সাহা)



কবি জীবনানন্দ দাশের অঘ্রাণ কবিতায় একটি সময়কালের গ্রাম বাংলার বাস্তব চিত্র ধরা পড়েছে। তিনি লিখেছিলেন, "এখন অঘ্রাণ এসে পৃথিবীর ধরেছে হৃদয়"।

পৃথিবীর হৃদয় যে সময় এসে এমন উদ্বেলিত হয় সেই মরশুমে এক অলৌকিক পরিবেশ তৈরি হবে এটাই স্বাভাবিক। শীতকালে নতুন ফসল ওঠার পর অগ্রহায়ণ মাস থেকে শুরু হয় নানা রকম পিঠেপুলির উৎসব, চলে সারা মাস ধরে। এই সময়ের অন্যতম একটি ব্রত হল নাটাই ব্রত। ছোটবেলার নাটাই পূজোর কিছু স্মৃতি আজও মনে নাড়া দেয়। উৎসব প্রিয় বাঙালি সুযোগ পেলেই মেতে ওঠে উৎসবে। তার উপর যখন বাংলার সোনালী ফসল ওঠার মরশুম শুরু হয় নতুন ফসলের আনন্দে মেতে ওঠে গ্রাম বাংলা। অঘ্রাণ মাসের শীতের মৌসুম তাই গ্রামবাংলা এক আনন্দের বাতাবরণ তৈরি করে। 

গ্রামবাংলায় নাটাই পুজোর মধ্য দিয়ে নবান্ন উৎসবের সূচনা হতো। নাটাই পূজো অনুষ্ঠিত হতো অগ্রহায়ণ মাসের প্রত্যেক রবিবার। নাটাই পূজো আসলে নবান্ন উৎসবের একটি অংশ। কৃষি প্রধান গ্রামবাংলায় অধিকাংশ বাড়িতেই শীতের শুরুতে আমন ধান ওঠে। আরে নতুন ধান কে ঘিরে গ্রামবাংলায় অন্যতম প্রধান পার্বণ ছিল এই নাটাই পুজো। অঘ্রাণ মাসের প্রথম রবিবার নাটাই পূজার সূচনা হতো। পূজোর নিয়ম অনুযায়ী অঘ্রাণ মাসের যে কটি রবিবার পড়বে তার মধ্যে যেকোনো একটি রবিবার পূজা বন্ধ থাকবে। মাসের শেষ রবিবার পূজার সমাপ্তি ঘটবে। সেই রীতি অনুযায়ী আমাদের বাড়ির উঠোনে পূজার আয়োজন করা হতো। বাড়ির বয়স্করাই এই পুজোর আয়োজন করে থাকতো। আমাদের বাড়িতে ঠাকুরমা নতুন ধান থেকে আতপ চাল তৈরি করত। আর সেই চাল গুঁড়ো করে তৈরি কথা হতো দুই রকমের পিঠে লবণযুক্ত এবং লবণছাড়া। আমরা বাড়িতে অনেক ভাইবোন একসঙ্গে থাকতাম বলে সকলে মিলে এই পুজো নিয়ে একটা আলাদা আনন্দ উপভোগ করতাম। পরীক্ষা শেষে অর্থাৎ রেজাল্ট বের হওয়ার আগ মুহূর্তে এই পুজো হতো বলে আমাদের মধ্যে একটা আলাদা উদ্দীপনা ছিল। আমাদের মধ্যে একটা ধারণা ছিল যে এই পুজোয় যে লবণযুক্ত পিঠে পাবে সে পাস করবে আর যে লবণ ছাড়া পিঠে পাবে সে ফেল করবে । এই লবণযুক্ত পিঠেকে আমরা বলতাম  নুলুইনা আর লবণ ছাড়া পিঠা কে বলতাম নুলুইনা। আমরা ঠাকুমাকে দেখতাম উঠোনের মাঝে একটি ছোট পুকুর তৈরি করতে। সেই পুকুরে কাঁচা দুধ আর পিঠে দেওয়া হতো। মূল প্রসাদ পিঠে দেওয়া হতো কচুপাতা বা কলাপাতা বা ভ্যারেন্ডা পাতায়।  পুকুরের দু-দিকে দুটি পাতায় সাতটি করে লবণযুক্ত আর লবণ ছাড়া পিঠে দিয়ে সাজিয়ে দেওয়া হতো। পুজোর শেষে প্রসাদের একটি অংশ গোয়াল ঘরে বসে খাওয়া হত। বাড়ির বয়স্ক লোকেরা বলতেন এই ব্রত পালন করলে নাকি সংসারে অভাব দূর হয় আর সংসার ধন-সম্পদে ভরে ওঠে। ঠাকুমা বাড়ির উঠোনে সকলকে একসাথে বসিয়ে নাটাই পূজা ব্রত সম্পর্কে বিভিন্ন কাহিনী বা গল্প বলতেন, আমরা সেই কাহিনী বা গল্প মনোযোগ সহকারে শুনতাম।
 
জেনে নেওয়া যাক এই ব্রত পালনের পেছনে প্রচলিত কাহিনী----
এক দেশে এক সওদাগর বাস করতো,তার ফুটফুটে একটি ছেলে ও মেয়ে ছিল। সওদাগরের বউ মারা যাওযায় সে আবার বিয়ে করে। কিছুদিন যাওযায় পর তার আবার দুটি ছেলেমেয়ে হয়। কিন্তু ছোট ছেলেমেয়ে দুটিকে বড়বৌয়ের বাচ্চাদের মতো সুন্দর দেখতে হয়নি বলে ছোটবৌয়ের মনে খুব দুঃখ ছিল। একদিন ছোটবউ সওদাগরকে বলে, "এইভাবে বসে বসে আর কদিন চলবে? এইবার বাণিজ্য করতে বেরোও।"
তা শুনে সওদাগরের মনে ভাবনা হলো, কারণ আগের দুই ছেলেমেয়ের প্রতি ছোটবউয়ের কেমন মমতা তা সওদাগরের জানা ছিল, তাই সে লুকিয়ে গোয়ালা ও ময়রাকে ডেকে বলে গেল তার ওই ফুটফুটে ছেলেমেয়ে দুটিকে তারা যেন রোজ খাবার দেয়, বাণিজ্য করে দেশে ফিরে সে তাদের সব দাম মিটিয়ে দেবে। এরপর ছেলেমেয়েদের জড়িয়ে খুব কেঁদে, মা চন্ডীকে স্মরণ করে, শুভ দিন দেখে সওদাগর বাণিজ্য করতে বাইরে গেল। কিছুদিন যাওয়ার পর ছোটবউ রাখাল ছাড়িয়ে দিলো, সে বড়বৌয়ের বাচ্চাদের দিয়ে মাঠে গরু চড়াবার কাজ করাতো আর তারা বাড়ি ফিরলে তাদের পান্তাভাত খেতে দিত। তারা তাইই আনন্দ করে খেয়ে নিত।

বড়বৌয়ের বাচ্চারা যখন মাঠে গরু চড়াতে যেত সেইসময় গোয়ালা ও ময়রা এসে তাদের দুধ, নানারকম মিষ্টি খাইয়ে যেত। তাই তারা দিনদিন মুটিয়ে যাচ্ছিল। তা দেখে ছোটবৌয়ের বুক ফেটে যায়। সে ভাবে তার বাচ্চারা রোজ ক্ষীর, মাখন ,ফল,খায় তাও শুকিয়ে যাচ্ছে আর পান্তাভাত খেয়ে কী করে ওরা দিনদিন গোলগাল সুন্দর হয়ে যাচ্ছে। একদিন ছোটবউ তার বাচ্চাদের ওদের সাথে মাঠে গরু চড়াতে পাঠাল, সারাদিন ওরা কি করে তা জানার জন্য। সারাদিন পর চার ভাই বোন বাড়ি ফিরলে ছোটবৌ নিজের বাচ্চাদের খুব আদর করে বড়বৌ এর বাচ্চাদের খুব বকাবকি করল। তা দেখে তার ছেলেমেয়ে বলল, "মা তুমি ওদের বকো না ওরা খুব ভালো। আমাদের আজ কতকিছু খাবার খাইয়েছে আমরা তার নামও জানি না।"
ছোটবৌ এবার ওদের মোটা হবার কারণ বুঝতে পেরে গোয়ালা, ময়রাকে ডেকে বারণ করে দিল। তাদের বলল কর্তা চিঠি পাঠিয়েছে তার বড় অসুখ ,তার দুটো নৌকা ডুবে গেছে, সে আর টাকা দিতে পারবে না। তাই ওরা যেন বাচ্চাদের আর খাবার না দেয়।

এইদিকে খেতে না পেয়ে তারা দিনদিন শুকিয়ে রোগা হতে থাকল। একদিন সকালে উঠে তারা মাঠে গরু, বাছুর চড়াতে গেছে, সারাদিন পর খিদের জ্বালায় তারা গাছ তলায় শুয়ে ঘুমিয়ে পরে, তারপর উঠে দেখে তাদের গরু,বাছুর নেই। তারা তাদের গরুবাছুর খুজঁতে খুজঁতে এক গৃহস্থ বাড়ির সামনে হাজির হল। ফুটফুটে দুই ছেলেমেয়ে দেখে বাড়ির গিন্নি তাদের ডেকে ঘরে বসাল। তারপর তাদের সব কথা শুনল। সব শুনে গিন্নি বলে আজ অগ্রহায়ন মাসের রবিবার বাড়িতে নাটাইচন্ডীর পুজো, তোমরাও এই ব্রত করো তোমাদের সব দুঃখ দূর হয়ে যাবে। তারাও সেইমতো সব করলে ,তারপর বাড়ির গিন্নি বলল এবার তোমরা মা চন্ডীর কাছে বর চেয়ে নাও, তা শুনে ছেলেমেয়ে দুটো বলে তাদের বাছুরগরু ফিরিয়ে দিতে। তা শুনে সবাই হেসে অস্থির। গিন্নি বলে, "ও আবার কি রকম বর চাওয়া। মা চন্ডীর বল যেন তোদের বাবাকে চোদ্দডিঙি ধন-হিরে-মানিক,রাজকুমার ,রাজপুত্র নিয়ে দেশে ফিরিয়ে দেয়। আর বল মা চন্ডী আমাদের সব দুঃখ দূর করে দাও।"

তারপর গিন্নি তাদের ভালোমন্দ খাইয়ে দুদিন তাদের বাড়িতে থাকতে বলল।

ওই দিকে সওদাগর চোদ্দডিঙি ধনহিরে রাজকুমার রাজপুত্র নিয়ে দেশে ফিরল। সওদাগর বাড়ি এলে ছোটবৌ কেঁদে অস্থির,বলে ছেলেমেয়ে গুলো কোথায় গেছে এখনো বাড়ি আসেনি লোকে বলছে তাদের বাঘে খেয়েছে। সওদাগর সে কথায় কান না দিয়ে তাদের খুঁজতে বেরোয়। খুঁজতে খুঁজতে দেখে ছেলেমেয়েরা পথে গরু ছড়াচ্ছে,তাদের ফিরে পেয়ে সওদাগর বুকে করে খুব আদর করে।

ওই দিকে ছোটবৌ সওদাগরের ধন, হিরেরবালা,টাকা যত পারে নিয়ে বাগানে পুঁতে আসছিল। এই ভাবে যাওয়া-আসা করতে করতে সে পাত-কুয়োতে পরে মারা যায়। তা দেখে তার বাচ্চারা কাঁদতে থাকে। সওদাগর তার বাচ্চাদের নিয়ে বাড়ি ফিরে দেখে চারিদিক লোকে লোকারণ্য, বাগানে ছোট বাচ্চারা দাঁড়িয়ে কাঁদছে। সে সব বুঝতে পেরে চার ছেলেমেয়েকে নিয়ে বাড়ির ভিতরে যায় ।তারপরে ছোটবৌয়ের  পারলৌকিক কাজকর্মের পর রাজকুমার ও রাজকুমারীর সাথে বড় মেয়ে ও ছেলের বিয়ে দেয়। যে গৃহস্থ বাড়ির গিন্নি তাদের নাটাইচন্ডীর ব্রত করিয়েছিল সওদাগর তাদেরও অনেক ধন দান করে। আর তার ছেলেরা ছোটবৌএর ছেলেমেয়েকে নাটাইচন্ডীর ব্রত করতে শিখিয়ে দেয়। সেই থেকে নাটাইচন্ডীর ব্রত চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে।




ভাবনা 

বড় লেখক , ছোট লেখক

প্রিয়াঙ্কা পিহু কর্মকার

আমরা সাধারণ মানুষ ।
আমাদের সবার চিন্তাই কম বেশি সাধারণই হয় ।
সাহিত্য চর্চার জগতটা বড়ই গোলকধাঁধা । অনেকটা মুর্শিদাবাদের হাজারদুয়ারীর মত , ঢুকে পড়া সহজ কিন্তু কোন দরজা দিয়ে লক্ষ্যে পৌঁছাবো সেটাই চেনা দায় ।
যাই হোক ,, এখনকার সার্কুলারের যুগ ,তাই আজকাল প্রায়ই একটা কথা খুব শুনতে পাই  সে বড় লেখক ও ছোট লেখক, কিন্তু এই বড় লেখক আর ছোটো লেখকের কনসেপ্ট আমার ঠিক মাথায় আসে না ।
আচ্ছা বড় বড় কল্পনা আর চিন্তার অবয়বেই কি বড় লেখক সৃষ্ট হয় । নাকি সেক্সোপিডিয়ার তথ্য দিয়ে চড়া রগরগে কিছু লিখে ফেলার অসাধারণ ক্ষমতা রাখা , নাকি সাধারণ চিন্তার মধ্য দিয়ে ও  সুক্ষ কল্পনার অবয়বকে নিয়ে নিজের না বলা কথা গুলো কলমে বলার চেষ্টা করা । কোনটা !
আমি ভাই জানি না ।
হ্যাঁ এটা সত্য যে কবি গুরু ও আমাদের মনন চেতন চিন্তন কে প্রাধান্য দিয়েই বলেছেন -
আমাদের চেতনার রঙেই পান্না হয় সবুজ গোলাপ লাল ।
কিন্তু তিনি তো কখনই বড় লেখক , ছোট লেখকের ব্যবধান টানেননি (  ব্যক্তিগত অভিমত ) ।
সাধারণ মানুষের মধ্যেই অসাধারণত্ব লুকিয়ে থাকে । হয়তো সুপ্ত থাকে ।সব আগ্নেয়গিরি থেকে লাভা নিঃসৃত হয় না ।
আজকার শুধু দেহ তত্ত্বের উপর লেখার চাহিদা পাঠক পাঠিকার প্রবল.....
ফ্রয়েডের তত্ত্বে কথাকার মানিক বন্দোপাধ্যায়ের " সরীসৃপ" কিংবা " প্রাগৈতিহাসিক" রচনার কথা বা তুলনা কোনোটাই করা উচিত নয় এখনকার সাহিত্যের সাথে । কারণ সময় বদলেছে , কিন্তু ভাবতত্ত্বের চাহিদা একই আছে ।
লেখকরা ও বোধহয় তাই ভাবতত্ত্বের সেই নির্দিষ্ট্য আঙ্গিকের সঙ্গে চুক্তি বদ্ধ হয়ে আছেন ।
এই আমরা কিছু মানুষ আছি যারা বিভাজনকে বড্ড ভালোবাসি ।তুলনামূলককর্ম কে বড্ড মনোযোগ সহকারে পালন করি। হয়তো আমারই এই বড় লেখক , ছোট লেখক বিভাজনকে অতি প্রিয়তার সাথে পালন করেছি বা  করে চলেছি হয়তো করে যাব ।
কারণ আমরাই লেখকদের কলমের মস্তিষ্কে বপন করেছি "এই টপিকটা পাবলিক খাচ্ছে পবলিক খাবে"
এই হল আজকে সাহিত্য বাজারের হিসাব কষাকষি , যেখানে বড় লেখক ও ছোট লেখক বিষয় টা চলে আসে !!! না না টেনে আনা হয় ।
কিন্তু ভাবের কি বিভাজন হয় ?
সকল ব্যক্তির ভাবনার ভান্ডার আছে ।সেই ভান্ডার থেকে ভাবনার নিত্য রপ্তানী আমদানি হয় ।
কিন্তু সঠিক প্রয়োগ কজন করতে পারে তার ?
যারা পারে তারাই বোধহয় লেখক ।
তা সে বড় লেখকই হোক আর ছোট লেখকই হোক ।
লেখক তো লেখকই হয় ।
তাঁরা মাপের এককে বিচার্য নয় ।
তাই কালিদাসদের কথা সবাই মেনেছে কিন্তু
ভবভূতিরা এখনো অপেক্ষায় আছে ।
আর প্রাচীন আলংকারিকরা যাকে বলেছেন -
"  স্বয়ং প্রজাপতি ব্রহ্মা  " ।


জলছবি
অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী 

বহতা নদীটি বারোটি ঘাটের নানান রং ছুঁয়ে পরিক্রমার শেষে হঠাৎ থেমে যায় নির্দিষ্ট এক তটে এসে।যাত্রাপথের হাজারো উপলব্ধি ও অনুভূতির ভাঁড়ারগুলি স্মৃতি নামে কিছু উজ্জ্বল বা ধূসর চাদরে মুড়ে পড়ে থাকে বিস্তীর্ণ মাঠ পেরিয়ে বাঁশের সাঁকোর ওপারে। এপাড়ে তখন নতুন এক বহমানতায় চাঁদ উপুড় করে ঢেলে দেয় মায়াবী জ্যোৎস্নাকে। সময়ের ফুলে মালা গাঁথে সাড়ম্বর এক স্বাগত সম্ভাষণ। হাতছানিতে থাকে সমধুর এক বয়ে চলার প্রতিশ্রুতি আর স্বপ্নের মিশেল। রাতজাগা পাখির কাকলিতে জাগে উল্লাস।যা কিছু নতুন,তাই প্রাণময়,তাই সুন্দর।তাতেই ডুব দেয় মন,যেমন মুগ্ধতার নিবিড় ডুব নয়নে নয়নে।আবারো কিছুটা চেনা,কিছুটা অচেনা বা আকষ্মিক কোনো দিশায় পাড়ি জমায় স্রোতের টান। অদৃষ্টের অমোঘ বিধানে হয়তো বা লেখা থাকে শক্তপোক্ত বাঁধের বাঁধনে সোনালী এক ঝিলমিল বয়ে চলা,নতুবা পাড় ভাঙার করুণ আখ্যান। সময় না এলে চলা থামেনা তবুও।ফেলে আসা বাঁশের সাঁকোর ওপারে চাদর জুড়ে পড়ে থাকে স্বপ্নীল ফুল ফোটানো জাফরান গাছের বিষন্ন ছায়া অথবা মনকাড়া কোনো জারুল প্রান্তর।যাপনের ছোট ছোট ঢেউয়ের ওঠা নামায় সরোদে নিমগ্ন বিষন্ন সুন্দর কোনো সুরের মোহ  যেন জুড়ে জুড়ে থাকে।। সময়ের নোনাধরা দেওয়ালে উঁকি দেয় কেবল নাম হয়ে বেঁচে থাকা কিছু মুখের আদল। বাতাসে জড়ানো কিছু আর্তনাদ বছরঘুরে আবারও বুমেরাং হয়ে ফিরে আসার প্রতীক্ষায় দিন গোনে।ভাঙাগড়ার প্রতিযোগিতা চলে প্রতিনিয়ত। কখনো জিত,কখনো হার।কখনো জিতে হেরে যাওয়া আবার কখনো হেরে জেতা অনেকগুণ বেশি করে।প্রতিযোগিতা চলে আখেরে নিজের সঙ্গে.. নিজের ছায়ার সঙ্গে অবিরাম।কখনো আনন্দ গান বাজে বাতাসে আবার কখনো হতাশার হুতাশনে জমাট বাঁধে কালো মেঘ।দুর্যোগ,ঝড়, বিদ্যুতের ভ্রুকুটির সঙ্গে লড়াই প্রতিনিয়ত এই আপন বেগে বয়ে চলার.....
ভালোবাসার কোনো পাড়ে স্থিরচিত্র হয়ে তবুও রয়ে যাক কোনো সুরেলা সিম্ফনির আসর। তরী বেয়ে আসা চাবিওয়ালার গানে অন্ধ মনের বন্ধ তালার হদিশ মিলুক। জলোচ্ছ্বাস উঠুক হাতে হাত রাখা বন্ধুত্বের উষ্ণতায়, নিবিড় ভালোবাসায়,আগলে রাখার আদরে।প্রবল বান এসে ভাসিয়ে নিয়ে যাক ধর্মান্ধতা, ঈর্ষা,ঘৃণা ও লিপ্সাকে। যুদ্ধের বারুদ গন্ধময় ঘোলাটে আকাশ যেন ছায়া না ফেলে স্রোতস্বিনীর বুকে। জলতরঙ্গে বাজুক শান্তির আবহ।স্বপ্নের সুর্মা চোখে আশার রঙিন কারুকাজে আগামীর রমনীয় এক নক্সীকাঁথার মাঠ তো চোখ জুড়োতেই পারে এই বয়ে চলা পথপ্রান্তে। জলে ডোবা অজস্র বোবাকান্নার শেষে জলকেলি করুক দলছুট খুশিরা।সময়ের নির্মল আকাশ এই স্রোতে ভাসার অতন্দ্র প্রহরী হোক এর বুকে নিজের ছায়া মেখে। ঘনঘোর আঁধার রাতের যবনিকা পতনের  শেষে মেঘ সরে যাওয়া সেই নির্মলতায় এক টুকরো চাঁদের হাসির বান ডাকুক  'নতুন বছর' নামে তটিনীর চালচিত্রে। বিভেদ,বিদ্বেষ, ষড়যন্ত্রের ঘেরাটোপের বাইরে অন্তহীন মিলনের শুভ এক আলোর যাত্রা জারি থাকুক মোহনা পর্যন্ত।



গল্প 


অক্ষিকোটর

ত্রিদিবেশ রায় 

সেবার  আমার আস্তানা জঙ্গলের ভিতর নদীর ধারের বাঙলো।

 
সন্ধ্যা বেলা বারান্দায় বসে আছি। সামনে কুয়াশার চাদরে মোড়া অমাবস্যার জঙ্গল। কানে আসছে নদীর জলের আওয়াজ। হাওয়ায় একটা হালকা শির শিরানি। হাতের বইটাতে কিছুতেই মন বসাতে পারছিনা। বারবার চোখ চলে যাচ্ছে সামনের ঝুপসি জমাট বাঁধা অন্ধকার টার দিকে। 

চৌকিদার চা খাইয়ে মোরগের যোগাড়ে গেছে। বইটা খুলে পড়বার চেষ্টা করতেই একটা খড়মড় শব্দ কানে এল। কুয়াশার পর্দাটা ভেদ করে অন্ধকারের ভেতর থেকে কেউ যেন আসছে। জন্তু জানোয়ার নয়ত !! একটু সতর্ক হয়ে শরীর শক্ত করে বসলাম। নাঃ নিছকই একজন গ্রাম্য লোক।  হাঁটু অবধি ময়লা ধুতি, একটা খসখসে বাদামী রঙের চাদর গায়ে।কাছে এসে নমস্কারের ভঙ্গিতে হাতজোড় করে দাঁড়াল। 

আমি চমকে যাওয়া ভাবটা কাটিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মুখের দিকে তাকাতেই লোকটা বলে উঠল,
- বাবু আমার নাম জীবন।

- থাকো কোথায়??  

লোকটা হাতজোড় করা ভঙ্গিতেই বলল,
- এই এদিক ওদিক। বাবু কিছু অসুবিধে হলে বলবেন সব জোগাড় করে দেব। 

আমি সশব্যস্ত হয়ে বললাম,
-  আরে বাংলোর চৌকিদার তো আছেই। 

লোকটি মৃদু হেসে বললো,
- বড্ড নেশা করে বাবু। কোথায় পড়ে আছে কে জানে। 

রাতের খাবার নিয়ে এবার একটু চিন্তা হতে লাগল। সঙ্গে একটা বিস্কুটের প্যাকেট আছে বটে, কিন্তু দেশী মুরগীর লাল ঝোল আর গরম ভাতের আশা সুদূর পরাহত বলে মনে হতে লাগল। একটা সিগারেট ধরাব কিনা ভাবছি, জীবন জিজ্ঞেস করল,
-  বাবু বিরক্ত হচ্ছেন তাই না ? একটু চা খাবেন ? 

হঠাৎ মনে হল যেন বাংলোর ভেতর হাঁটাচলা আর কাপপ্লেটের ঠুংঠাং আওয়াজ পাচ্ছি। একঝলক শাড়ির আঁচলের আভাসও পেলাম বলে মনে হল। 

- বাবু চা।  

ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি বারান্দার সিঁড়ির শেষ ধাপটাতে কে এক কাপ চা রেখে গেছে। ভুলভাল দেখছি না তো !!  চুমুক দিতেই প্রাণ জুড়িয়ে গেল। চৌকিদার বা তার উর্ধতন চতুর্দশ পুরুষের হাত দিয়ে এমন চা গলবে না। এবার একটা সিগারেট ধরাতেই হয়। কি আশ্চর্য !!  ছ` ছটা কাঠি নষ্ট হল, দেশলাই জ্বালাতেই পারলাম না। যাকগে !!  চা-টাই শেষ করি আগে। 

হঠাৎ শব্দ পেয়ে ভাবলাম চৌকিদার টা এলো বোধহয়। দেখি একটা বড়সড় সাইজের বাছুর  স্থির দৃষ্টিতে জীবনের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আচমকা  ভয় পেয়ে তীর বেগে ছুটে পালাল, যেন কিছুতে তাড়া করেছে। জীবনের খোঁচাখোঁচা দাড়ি ভর্তি মুখটা  অস্বাভাবিক শান্ত  শুধু চোখ দুটোর অন্তর্ভেদী শীতল দৃষ্টি কেমন যেন অস্বস্তি জাগানো। হঠাৎ ওর গলার আওয়াজে সম্বিত ফিরল,
- বাবু রাত হল খাওয়া দাওয়ার জোগাড় করতে হয়। 
জিজ্ঞেস করলাম,
-  রান্না করবে কে?
- সে সব হয়ে যাবে বাবু। ও তো আছে। 

আঁচলের রহস্য ভেদ হল। জীবন আবার বলল,
-  রাতে ও এখানেই থেকে যাবে বাবু। কোনো চিন্তা নেই।

এইবার সব পরিষ্কার  হয়ে গেল। কিছু রজতমুদ্রার বিনিময়ে নারীসঙ্গের তোফা ব্যবস্থা। গলাটা যথা সম্ভব রুক্ষ করে বললাম,
-   তুমি ভুল লোককে ধরেছ জীবন আমার ওসবের দরকার নেই। তোমরা এখন যেতে পারো। চৌকিদার এসে রান্না বান্না সব করে দেবে।

জীবনের কোনো ভাবান্তর নেই,
- না বাবু একবারটি দেখুন পছন্দ হবেই।

কখন জানিনা সবুজ ডুরে শাড়ী পরা একগলা ঘোমটা দেওয়া একটি মেয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে।
- একটু দেখুন বাবু। 

জীবন তার জায়গা থেকে যেন হাওয়ায় ভেসে বারান্দায় উঠে গিয়ে মেয়েটির ঘোমটা তুলে ধরল। 

তারপর আমার আর কিছু মনে নেই। আজও বড়ো ঘোমটা টানা মহিলা দেখলে মেরুদণ্ড দিয়ে হিমশ্রোত বয়ে যায়। 

করোটিতে সিঁদুর মাখা কপাল আর অক্ষিকোটরে ধ্বক ধ্বক করে জ্বলা চোখ আজও আমাকে তাড়া করে বেড়ায়। 



এমিলির বিশ্বাস
প্রদীপ কুমার দে

শনিবার এখানে ছুটির দিন। অধিকাংশ অফিস বন্ধ থাকে। রাজপুত্র আর রাজকুমারীরা ঘোরাঘুরি করে আর প্রকাশ্যে মাঠে ঘাটে বসে একে অন্যের কাঁধে মাথা রেখে বিশ্রামের দিন অতিবাহিত করে।

আর এই বিশ্রামের জন্য বে;শ ভাল মজুরি দিতে হয় এমিলিকে।

লন্ডন থেকে বেঙ্গালুরু এসেছিল সে সফটওয়্যার ট্রেনিং কোর্স করতে। কোর্স শেষে প্লেসমেন্ট এর বাহানা ছিল। ক্লাসেই পরিচয় হয় মান্টুর সাথে।  মান্টু হল বাবা মায়ের অবাধ্য সন্তান। পলিটিক্স করে, ঝামেলা বাঁধাতে ওস্তাদ। নিজের বিষয়ে খুব সজাগ আদায় করে নিতে জানে। এমিলিকে দেখেই তার মনে লাগে।

এনিলিকে প্রেমের প্রস্তাব দেয়। এমিলি এত কিছু বোঝে না। মান্টুর উদ্দাম উচ্ছ্বাস দেখে। মান্টুর লোভনীয় ফাঁদে পা দিয়ে ফেলে।

মান্টু শয়তান। হাজারো মেয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা রাখে। ধরে,কাজ সারে ছেড়ে দেয়। ঘুড়ি যেমন করে ওড়ায় তেমন করে সুতা ছেড়ে ওড়ায় তারপর সুতা টেনে নামায় অথবা সুতা ছিঁড়ে ভোকাট্টা করে উড়িয়ে দেয়।

মেয়েরা মান্টুর বাহ্যিক রূপ আর পয়সায় মাতে। এমিলি বহিরাগত। সে এখানকার হালচাল বোঝে না। মান্টু কোর্স চলাকালীন ভদ্র ব্যবহারে এমিলির মন জয় করে। এমিলি খুব খুশী। তার কিশোরী মনে প্রেমের বিশাল প্রভাব পড়ে। 

কোর্স শেষে মান্টু তার পরিবারের ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে একটা চাকরি জুটিয়ে নেয়। এমিলি এখনই চাকরি করতে রাজী নয়। সে চায় একবার লন্ডনে ফিরে যেতে। পাকা ডিসিশন পরে নিতে চায়। কাজ সে করবে তবে তা ইন্ডিয়ায় না লন্ডনে তা বলা বড় শক্ত।

এমিলি মান্টুকে জানায়,
--  এখনি চাকরি নিও না আমার সাথে চল আমাদের বাড়ি। সব জানাই তারপর না হোক চিন্তা কর।

মান্টু চালাক, তার মাথায় অনেক মজা। এমিলিকে বোকা পেয়ে যথেচ্ছ ব্যবহার করা হয়ে গেছে। এখন নতুন মুরগি ধরেছে। তাই এমিলিকে বোঝায়,
--  সে কি করে হয়। তারচেয়ে তুমি লন্ডন ঘুরে এস। বাপ মাকে জানাও। আমি অপেক্ষা করবো। ফিরে এলে দুজনায় রেজেষ্টি করে নেব। নতুন চাকরি ছেড়ে লাভ নেই।

এমিলি কাঁদে। অনেক বোঝায়। হার মানে। উপরন্তু মান্টু একপ্রকার ভুলভাল বুঝিয়ে লন্ডনে ফেরত পাঠায়।

মান্টু বেঙ্গালুরু ছাড়ে। সঙ্গিনীর অভাব নেই। বাপের টাকায় অন্যত্র পাড়ি দেয়। বাপকে মানে না কিন্তু তার অর্থেই রোয়াব দেখায়। 

অন্যদিকে এমিলি লন্ডন ফিরে দেখে ইন্টারন্যাশনাল কলে মান্টু বেপাত্তা। বারাবার মান্টুকে খোঁজে, নিরাশ হয়ে ভয় পেয়ে যায়। ভয় পায় মান্তুর বিপদের আশংকায়। ছটফট করে তা ভালোবাসা। কিশোরী মনের মতই তার এই ছটফটে প্রেম।

বাবা মা কে সব জানিয়ে ফিরে আসে বেঙ্গালুরু। পরিচিত স্থল, কোম্পানি , বন্ধু বান্ধব সব খুঁজে ফেরে কিন্তু মান্টু নেই। সে যেন হাওয়ায় হারিয়ে গেল। উবে গেল। তবুও বিশ্বাস রাখে, হন্যে হয়ে খোঁজ চালায় অবিরত দিনরাত!

আজও সেই সদ্য যুবতী এমিলি বসে অপেক্ষায় থাকে তার মলিন বেশে, উস্কখুস্ক চুলে, অসহায় অবস্থায় নির্লিপ্ততার দৃষ্টি মেলে রাখে দৃশ্যপটে যদি পার্কের গেটে মান্টুর পদচারণা দেখতে পায়!
বড় করুণ সে দৃশ্য!

আজ শনিবার। ছুটির দিন। বিকাল থেকেই পার্কে অবস্থানরত সব জোড়ায় জোড়ায় ঘনিষ্ঠ প্রেমিক প্রেমিকারা। 

এমিলি ই শুধু একা!

এ দৃশ্য বড় অসহনীয় এবং বেদনাদায়ক।
পরিচিত জনের থেকেই সব শোনা।



ল্যামিনেটেড 
রাজর্ষি দত্ত 

সব রাগ গিয়ে পড়লো তের বছরের ছেলেটার উপর।

মশারী খুলে এক হ্যাঁচকা টানে ঘুমন্ত ছেলেটাকে বাইরে বের করে আনে অর্ণব।বাচ্চার চুল ধরে ঝাঁকাতে থাকে- 

“বেলা সাড়ে আটটা অবধি ঘুম –নবাবপুত্তর –তোর কোনো ভবিষ্যৎ আছে?”

ছেলেটা পিটপিট করে চোখ খুলেছে, মুখটা কাঁদো কাঁদো। অর্ণবের বউ দৌড়ে আসে– 

“করছো কি? আজ তো রবিবার, একটু শুয়ে থাকুক না–অন্য দিন স্কুল থাকে –কত সকালে…”

“ব্যাস, হোম মিনিস্টার বলে দিয়েছেন…তবে ঘুমোও চাঁদু…”

গত রাতে অর্ণবের ঘুমটা চটে গেছিলো। কাল শনিবার ছিল; প্রাইভেট কোম্পানি হলেও ইচ্ছে হল যে একটু তাড়াতাড়ি বেরুবে। কিসের কি? ঠিক সোয়া চারটায় কতগুলি ইম্পরট্যান্ট ফাইল এসে জমা হল টেবিলে। বস সোমবার সকালেই সে সব নিয়ে বেরিয়ে যাবে।বেগতিক হলে রবিবারেও ডাক পরতে পারে ভেবে শনিবারে প্রায় আড়াই ঘণ্টা বেশি কাজ করেছে।প্রতিদানে ছুটির সময় বস ফাইলগুলো নেড়েচেড়ে বলেছে,

 “আশা করি ঠিক মত দেখে নিয়েছেন! আপনাদের উপর তো ভরসা নেই–বুর্বকের মত কোথাও না কোথাও ঠিক বাম্বু গুঁজে দেবেন! এইসব এলিমেন্টদের নিয়ে আমাকে চলতে হয়! যান, বাড়ি যান!”

নিউটন বলেছেন সকল ক্রিয়ার সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া থাকে। তাই রাতে ঘুম না আসাটা কি খুব দোষের?

এখন তাঁর বয়স বাহান্ন। চাকরি ষাট অবধি কি টানতে পারবে? পারলেও কি ছেলেটা দাঁড়াবে নিজের পায়ে? অসম্ভব!

আকাশপাতাল চিন্তার মধ্যে মনে পড়ে বলাইদার কথা। উনি এখন একটা স্কুলের উপদেষ্টা কমিটিতে আছেন। ওখানে নন-টিচিং স্টাফ নেবে শুনেছিল। কন্ট্রাক্টচুয়াল। যা দেবে তাতে চলবে না ঠিকই তবু সময় ও সুযোগ দুই খোলা থাকবে অন্য ধান্দা করার। তাই ভোর হতেই ও খুঁজতে লেগেছে সার্টিফিকেটগুলো। সব একটা ফাইলের মধ্যেই যত্ন করে রাখা ছিল। যদিও অর্ণব জানে এ বয়সে এগুলির আর কোন মুল্য নেই!

একদম প্রথম দিক ছেড়ে দিলে প্রাইভেট কোম্পানিতে সার্টিফিকেটের বিশেষ দরকার পড়ে না।তখন ম্যাটার করে এক্সপেরিয়েন্স, এফিসিয়েন্সি। তবে স্কুলের ক্ষেত্রে ওরা তো দেখতে চাইবেই।

পরের এক ঘণ্টা চরম উত্তেজনায় সকালটা সবাইকে ব্যাতিব্যস্ত করে শেষে ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ে অর্ণব। চতুর্দিকে ফাইল, কাগজপত্র ছত্রাখান অথচ আসল জিনিসটাই গায়েব।

মুখ ঢেকে বসে আছে অর্ণব। শরীরটা মৃদু মৃদু কাঁপছে। কি করলো এই বাহান্নটা বছরে? চূড়ান্ত অসফল বলে এখন নিজেকে্ই সে ঘৃণা করে। কেন যে জন্মেছে– এত অপমান সহ্য করে কে বাঁচে?

খানিক পরে চোখ তুলে তাকিয়ে দেখলো ছেলের হাতে হলুদ রঙের একটা ফাইল। সে দেখেই চিনলো।এটা নাকি তার আলমারির লকারে রাখা ছিল! উফফ্, মাথাটাই গেছে!

ফাইলের ভেতর পর পর সাজানো মার্কসশিট আর সার্টিফিকেট। সব ল্যামিনেটেড। আগে ছিল না।বছর দশেক আগে জেরক্স সেন্টারের হরেনদা বলেছিল, `ল্যামিনেশন করে রাখ। সুরক্ষিত থাকবে।`

তা সুরক্ষিতই আছে! স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটির সার্টিফিকেটগুলি চকচক করছে। অনেক অধ্যয়ন,  পরিশ্রমের বিনিময়ে অর্জন করা মোটা কাগজগুলো আজকের জীবনে অর্থহীন! চারপাশে এত অরাজগতা,অবিচার। সমাজের-দেশের-দশের! সেখানে বই পড়া শিক্ষা কোন প্রতিবাদের ভাষা জোগালো না। সব বুঝে, এটাকেই নিয়ম ভেবে, সকল আঁচ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে তার মত অনেকেই ‘ল্যামিনেটেডসার্টিফিকেট’  হয়ে আজীবনসু-সুরক্ষিত রয়ে গেল ।

ফাইলটা রেখে দিতে ছেলেকে একবার ডাকতে গিয়েও ভাবছে অর্ণব। দিশেহারা অর্ণব!



নতুন দিনের আশায়
                                

অমিত মুখোপাধ্যায়

 

পল্টুর মা রেবা বড্ড রোগা ছিলেন। তবে অসুস্থতা দেখে নি কেউ। খাটতেও পারতেন খুব। ছেলের পড়াশোনার দিকে নজর রাখতেন। মাস্টার যখন পড়ায় তিনি শুনে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করতেন যে ছেলে নিতে পারছে কিনা। একা যখন পড়ত, ছেলের মুখ ও চোখের দিকে খেয়াল রাখতেন। ফলে পল্টু জানত যে মা প্রায় অনুসরণ করে তাকে। ফাঁকি মারার উপায় না পেয়ে ক্রমে পড়ায় ভালোই ফল করতে থাকে সে। রান্না বা ঘরের কাজ সেরে কখনো পড়াও ধরতেন তিনি। ছেলে তাই মুখস্থ না করে বুঝে পড়ত। জানতও তার সহপাঠীদের থেকে বেশি।

বাবা বিজয়ের সব কিছু ছিল মাপসই, আর পাঁচটা লোকের মতোই। অথচ সেই বাবা সংসারের মাঝপথে পট করে গেলেন মরে। কেউ কিছু বুঝতে পারে নি, ডাক্তারও নয়। রেলে বাবার চাকরি করার মতো পড়াশোনা ছিল না মায়ের। তাই সহানুভূতির খাতিরে পিওনের কাজ পেলেন। দপ্তরে অমন পাকা চুলের দিদিমা-মার্কা রাশভারী রেবাকে জল বা টিফিন ইত্যাদি কাজ বলতে বাধত কেরানিদের। ওই ফাইল আনা নেওয়া করতেন। বরাদ্দ হলে দপ্তরের কলম ফিতে আঠা ছুরি কাগজ ইত্যাদি এনে দিতেন। ছেলের জন্য ঘরে দিনভর কাজ ও দেখাশোনার জন্য বিধবা মহিলা ছায়াকে রাখা হলো।

রেবার আসল পরিশ্রম ছিল যাওয়া আসায়। অত ভিড় ঠেলে যেতে রোগা মানুষ চাপে আর ঘামে ছেঁড়া পরোটা হয়ে যেতেন। তারও সমাধান হলো দোতলা সাংস্কৃতিক বাস, চলা শুরু হতেই ভেতরে গান আবৃত্তি শুরু হয়ে যেত। সেখানে রেবার আসন ছিল বাঁধা, ভিড়ের চাপের বদলে সুরের আলাপ। তা ছাড়া বাকি সকলকে পালা করে কন্ঠ নিবেদন করতে হলেও অপারগতার কারণে সেদিকেও তার ছাড় ছিল। এভাবে রেলের কাজে আর বাসের সাংস্কৃতিক সাজে চলছিল বেশ। তবু তিনিও মারা গেলেন। এবারও কেউ বুঝতে পারে নি কিছু, তবে দুর্বলতাকে কারণ হিসেবে ধরে নিয়েছিল। তখন পল্টু ক্লাস সেভেনে।

আত্মীয় স্বজনের আসা বেড়ে যেতে লাগল। উত্তরাধিকার কিছু তো আছেই, তার সঙ্গে বাড়ি আর অনেকটা জমি। সেভেনের ছেলে শোকের অনুভূতির চাপে, পরিস্থিতির ঠেলায় মনের মাধ্যমিক পেরিয়ে গেল। পড়া কমতে লাগল, অন্য কাজ বাড়তে লাগল। সে ব্যাঙ্ক বোঝে না, সংসারের খরচ জানে না, ছায়া প্রাণপণ চেষ্টা করে সে সব সামলে দিতে থাকে। নিজের ঝুপড়ি ডেরার পাট চুকিয়ে দিয়ে সে এখানে বাইরের ঘরে থাকতে শুরু করে।

উঁচু পাঁচিল দেওয়া বাড়ি বলে কিছুটা সুবিধে ছিল। কিন্তু গাছে ফল-সবজি ধরলে বাইরের অত্যাচারের ফলে এক দিকে ফাটল ধরে যায়। ভাঙা অংশ দিয়ে উঠে আসে ছোকরার দল। বিজয়ের বড় শখ ছিল বাগান করার। পরে সেই ভাঙা দিকটাও মেরামত করা হলো। ছায়া যেহেতু অন্য সব কাজ ছেড়ে দিয়েছে, সময় পেলে বাগানও দেখে রাখে। কিন্তু কিছুতেই  আত্মীয় স্বজনের আসা আর নানা অজুহাতে থেকে যাওয়া আটকানো যায় নি। এক সময় পল্টু ব্যবহারে কড়া হলো, ভাষায় কর্কশ হলো। প্রথমে অতিথিদের রাত্রিবাস করা বন্ধ হলো, সেই সঙ্গে ঘরের এটা সেটা হারানো কমে গেল। বছর দুই পরে নিরুৎসাহ হয়ে দিনের শুভার্থীদের আনাগোনাও আঙুলে গোনা হয়ে এলো। জিনিস হারানোর ব্যাপারটা অতীত হয়ে গেল।

বাপমায়ের যেটুকু যা সঞ্চয়, তাতে দু’টো প্রাণীর কোনও রকমে চলে যায়। পল্টুর আর আসল মাধ্যমিক পাশ করা হলো না। সামাজিক মানুষও হয়ে উঠতে পারলো না সে। বাজারে গেলে চেনা লোকের হাজার কৌতূহল। কি করে বাপ-মা দু’জনেই মারা গেল! কোন আত্মীয়কে কাছে রাখছে না কেন! মন খারাপ লাগলে কী করে! একা এতবড় বাড়ি আর বাগানের মালিক হয়ে সামলায় কেমন করে! পড়াই বা ছেড়ে দিল কেন?

দোকানে গেলে পাড়ার ছেলেদের অত্যাচার। এই, তোমার তো দাদা অনেক পয়সা, কিছু কিনে দাও না! বন্ধুরা নানা অজুহাতে বাড়িতে এসে অন্যায় সুযোগ নিতে চায়। দাদারা বোতল খেতে চায়। ব্যাঙ্কেও নানা সমস্যা। কেন অত টাকা সেভিংসে ফেলে রেখেছে! এতে বা ওতে অথবা তাতে ইনভেস্ট করো, অনেক লাভ হবে! ফলে বাইরের কাজ বেড়ে গেল ছায়ার। আর পল্টুকুমার ঘরের কিছু কাজ নিজে করে নিতে শিখল, তবে কেবল হালকা কাজই করতে দিত ছায়া। তাই বাগানের দেখাশোনা শুরু করে পল্টু।

একেকটা গাছ, চারা আর লতানো সবজির সঙ্গে পরিচয় হতে থাকে তার। সকাল আর বিকেলের খানিকটা সবুজের ঘোরে কেটে যায়। বাগানের যেন কোনও ঘড়ি নেই, থাকলেও সে অনেক ধীর, প্রায় বোঝাই যায় না এমন। একেক ডাল পাতা এমন নজর কেড়ে নেয় যে সময়ের বোধ তার হারিয়ে যায়। কাঠটগর গোড়ায় মাটি দিতে বলে, মরা ডাল-পাতা দুলিয়ে ছেঁটে দিতে দাবি জানায়। কারিপাতার গাছ সকালের আলো গায়ে নিয়ে দেখিয়ে দেয় কোথায় খুদে মাকড়সা জাল বুনেছে। লঙ্কার চারা পিঁপড়ে সরাতে হাওয়ায় কাঁপে। জলের ছিটে দিতে হয় পাতায়। বেচারা উচ্ছেলতা সবুজরঙা শুঁয়োপোকার কামড় থেকে বাঁচতে মাচা থেকে খসে পড়তে চায়। হলুদ্গুঁড়ো দেয়। কুমড়ো ঘাড় উঁচু করে ডগার আঁকশির আঙুল নাড়িয়ে অবলম্বন খোঁজে। মরা ডালের আশ্রয় জোগানো দরকার। এদের দিকে নজর না দিয়ে কি পারা যায়! দিন তো ছার, বছরগুলো পর্যন্ত দিব্যি পার হয়ে চলে।

বাকি সময়ে বই পড়ে পল্টু। না, স্কুলের বই নয়, সে তো আর পরীক্ষা দেবে না! তার আগ্রহের বই সে খুঁজে বার করে নেয় বাবার ভাণ্ডার থেকে। একটা ঠাসা আলমারি, নানা তাকেও আছে বই। একেক জায়গায় হাত দেয়, পছন্দের বই বার করে পড়ে। ভালো না লাগলে মাঝপথে ছেড়েও দেয়। টিভি খারাপ হবার পরে সারায় নি। বিরক্তি বাঁচাতে খবরের কাগজ রাখাও বন্ধ করে দিয়েছে। তবে সকাল সাঁঝে রেডিওর খবর মন দিয়ে শোনে। অপোগন্ডদের ছবি দেখতে বা গল্পমার্কা কেচ্ছা পড়তে হয় না। মোবাইল ফোন নেয় নি সে কোনও দিনই। তবে ছায়ার এক খণ্ড ছোট মুঠোফোন আছে।

ব্যাঙ্কের ম্যানেজার ডেকে পাঠিয়েছিল তাকে। এখন আর চেক কেটে টাকা তোলা চলবে না, ও সব ব্যবস্থা উঠে গেছে, কার্ড করতে হবে, এ টি এম, নয়ত ডেবিট কার্ড। পল্টু যে চেক কেটে নিয়ে গেছিল, সেটা ম্যানেজারের সামনে দেখিয়ে বলে, আমি জমা দিচ্ছি, আপনি রিজেক্টেড লিখে দিন। ম্যানেজার বোঝে খবর রাখে ছেলেটা। নরম করে বলে, না না, এখন চলবে, এর মধ্যে একটা কার্ড করিয়ে নিতে হবে।… সেই বস্তুটি আজও করে নি সে।  

চাঁদা নিতে এসেও চ্যাংরার দল বেশি সুবিধে করতে পারে না। একে তো উঁচু পাঁচিল, তার সঙ্গে মানানসই বড় আর ভারি লোহার গেট, তালা দেওয়া থাকে ভেতর থেকে। পল্টুর আর একটা কাণ্ড পাড়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। বাপ-মা নেই বলে সে নাকি লাইসেন্স করিয়ে রিভল্ভার রেখেছে। দু’এক বার সেই অস্তর দেখেছে নাকি কেউ কেউ। একে ছিটিয়াল ছেলে, রাগীও বটে! বাইরের দুনিয়ার থেকে পাগলের মতো নিজেকে আলাদা করে রেখেছে! সারা দিন কী করে কে জানে! এখন যে চাঁদার দল আসে, গেটের চৌকো খোপ খুলে, ছেলেদের ওজন বুঝে ছায়া টাকা দিয়ে চলে আসে। বেশি বেগড়বাই করলে ছায়া মুখঝামটা দেয়, মা-বাপ মরা ছেলেরে একদম জ্বালাবা না! কত লুক তো খালি হাতে ফিরাই দেয়! তখুন?

বেল বাতাবি গন্ধরাজ লেবু সুপুরি আর পেয়ারা হয় অনেক, পাকলে টুইটারকে ডেকে পাড়িয়ে নিয়ে পাইকারি দরে বেচে দেয় তাকেই। টুইটার বড় বিশ্বাসী খাটিয়ে ছেলে, কে যে তার নাম পাল্টে দিল! শোনা যায় ত-কে ট উচ্চারণ করে বলে এমন নাম হয়েছে। সে যা হোক, টুইটার ভালো দর দিয়ে কেনে, বেচেও দেয়। তা ফল পাকার সময় রাতের দিকে প্রায়ই চোরের উৎপাত হয়। চিনের প্রাচীর টপকানোর চেষ্টা চলে। কেউ শক্ত লগি নিয়ে আসে। একবার তো বাঁশের মই নিয়ে এসেছিল। এমনিতেই পল্টু অনেক রাত অবধি পড়ে, ছবি আঁকে, সকালে দেরি করে ওঠে। শব্দ শুনে পল্টু ছাদে উঠে যন্তর বাগিয়ে তাক করেছিল। তারা মই ফেলে পালিয়েছিল।

আজকাল আর চোরের উপদ্রব হয় না। সাধারণ মানুষের প্রাণের দাম কমলেও চোর অত কম পয়সার জন্য জান দিতে চায় না। তবে সবজি তেমন হয় না বলে নিজেরাই খায়। কখনো অবশ্য পেপের ফলন বেশি হলে তা-ও বেচে দেয়। আজকাল ভেতরের দিকের বাড়িতেও প্রোমোটারের নজর পৌঁছে যায়। এঁদো গলিতেও হাওয়াই বস্তি জেব্রা হয়ে মাথা তোলে। বার দুয়েক তাদের লোক এসে চেষ্টা করেও সুবিধে করতে পারে নি। লোভে বশ করার তো প্রশ্নই নেই, পল্টু একাই থাকতে চায়। কিন্তু তার চেয়ে বড় কথা পল্টুর সঙ্গে আলোচনা করার সুযোগই পায় নি কেউ। দূরত্ব, দেওয়াল, রাজতোরণ, আলোচনার অভাব, ছায়াদেবীর কর্কশ কায়া- এত সব গণতান্ত্রিক বাধাই তো ব্যবস্থার শক্তি, বাইরের লোক পৌঁছতেই পারে না!

আরেক বিরাট বিপদ এসেও পদক্ষেপ করতে গিয়ে সেখানে থমকে যায়। প্রথমে তার নাম হলো সর্দি-জ্বর, গলায় সংক্রমণ, মহামারি, তারপরে সকলে একমত হয়ে অতিমারি বলে সব ফেলে তার পুজোয় জয়ধ্বনি দিতে থাকে। নেতা থেকে ন্যাতা, মাতব্বর থেকে ধুরন্ধর সকলে জনস্থান থেকে স্রেফ হাওয়া হয়ে যায়। ফাঁকির মঞ্চে জয়গান গাওয়ার সমান্তরালে সাফাইকর্মী, নার্স, ডাক্তার ও জরুরি পরিষেবাকে ফ্রন্টলাইনে ঠেলে তাদের নরমবীরচক্র দেওয়া হতে থাকে। কিন্তু তাদের পরিকাঠামো দেয় কে? চাইলে গুঁতো খেতে হয়, বীরু হয়ে যায় ভীরু! নানা সন্দেহজনক ওষুধ আর অজস্র টোটকার প্রচার উপেক্ষা করে বাগানের ফল খাওয়া বাড়িয়ে দেয় পল্টু। অঙ্কুর-ওঠা ছোলা, বাদাম চিবোয়। ছোঁয়া বাঁচাতে বাগানে লাউ ঝিঙে ঢেঁড়স আর লালশাকের নতুন বীজ পোঁতে।

দু’বেলা জল দেওয়া ছাড়াও বাগানের যত্ন করার কাজ বেড়ে যায়। দু’এক দিন সাত সকালে বেরিয়ে দোকান আর যেটুকু বাজার আনা যায় নিয়ে আসে ছায়া। সকাল সাঁঝ ছাড়াও এখন রেডিওতে দুপুরের খবরের ঝাঁজ আর আঁচ পোয়ায় পল্টু। সারা দুনিয়া দাপিয়ে দানবীয় দামামা বাজিয়ে যুদ্ধ চলেছে! সকলে গেড়ি গুগলি শামুক কচ্ছপ হয়ে সন্তর্পণে মাথা বাড়ায়। মেপে বিচার করে  টুক করে বাতাস নেয় নাক-ঠুলির আড়াল থেকে। সে সব বালাই তার ক্ষেত্রে নেই, তবে পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেটের বেগুনি জল দিয়ে দশ মিনিট বাজারের সবজি ধোয়া হয় তার ঘরে, অন্যান্য সতর্কতা মানা হয়। আর বাড়তি পাওনা থাকে অখণ্ড নীরবতা। গাছের ডালপালার গান শুনে বই পড়া আর ছবি আঁকার পরিমাণ বেড়ে যায়। যেন এমন “আপন পেছন বাঁচাও, পরকে ছেড়ে দাও” শান্তিচুক্তি চেয়েছিল সে!

শারীরিক ভাবে দুর্বল অপুষ্ট আর অসুস্থ মানুষের সঙ্গে ডাক্তার নার্স মারা যাবার সংখ্যা লাফ দিয়ে বাড়ে শুনে ছায়া কাঁপে। দরকার ছাড়া তার দু’এক বার বাইরে যাবার যে শখ ছিল, মিটে যায়। তারপর বোনের বর মরেছে শুনে তাকে প্রথম বার কাঁদতে দেখে পল্টুঃ ভাগ্যি দাদাবাবু তুমার মায়ির কথা শুনি সোব ছাড়েছুড়ে ইখানে আসে ছিলুম, বাহিরে থাকলে বরবাদ হয়ি যেতাম! আমি জানি তুমি শেষ দিন উবধি দেখবা আমারে। আমার ত কুনো কেউ নাই। জানো, বুনটার ছেলা এখন কষ্ট দিছে তারে।

বাপের কথা তুলে কিছু বাগাতে এসেছিল সেই বুনটার ছেলা। যত বোঝে কিছু সুবিধে হবে না, সে আক্রমণাত্মক হতে থাকে। তার আবেদন, যুক্তি, এবং শেষের হুমকি শুনে খেপে যায় পল্টুঃ তুমি আমাকে সামাজিক হওয়া শেখাবে? এখন কে সামাজিক? কত আগে থেকেই আড্ডা গ্রন্থাগার ক্লাব মেলামেশা নেই, লোকের বাড়ি যাওয়া নেই। বিয়ে আর বাড়িতে হয় না, বিজয়ার পাট উঠে গেছে। সামাজিকতা সব এখন বোকাবাক্সে আর চালাকফোনে! আর এই মড়কের পরে তো বাকি মুখ-দেখাদেখিও থাকবে না! সামাজিকতা দেখাচ্ছে!

রাতে শুয়েও শান্ত হতে পারে না পল্টু। লোকটা তাকে অভিযুক্ত করেছে পয়সা দিয়ে তার মাসিকে কিনে স্বার্থপরের মতো একা থাকার জন্য! বাইরের পৃথিবীর খবর তো সে পায়। মানুষের সম্পর্ক কোথায় গিয়ে ঠেকেছে, তা কি সে জানে না! আতঙ্কে নিজের লোকের খবর নেয় না কত লোক! হাসপাতালে না নিয়ে অন্য কোথাও ফেলে দিয়ে যায়! কাজের জায়গায় সহকর্মীরা এ ওর পেছনে লেগে ক্ষতি করে নিজে ওঠার জন্য এখন আরও মরিয়া হয়ে উঠেছে। …ব্যাটা এখন নিজের মা-কে কষ্ট দিয়ে টাকা আদায় করতে এসেছে! কত হিসেব করে যে তাকে নিজে চলতে হচ্ছে! পৃথিবীর ওপরে চাপানো হাজার বাঁধুনি, হুমকি, লোভ আর ঠকানোর জাল এড়িয়ে বাঁচা কি সোজা নাকি? নিজের মেরুদণ্ড স্বাধীনতা এবং সম্মান বজায় রাখার কত মূল্য যে তাকে দিতে হচ্ছে, তা লোকে বুঝবে!        

চোরের সেই ফেলে যাওয়া মই এখন কাজে লাগে। ফেরিওয়ালা আসে অনেক, তাই বাজার যায় না ছায়া। পাড়ার দোকানিও নিয়মিত মাল দিয়ে যায়। আর গেট খোলে না। মই চড়ে দেওয়াল থেকে দড়ি বাঁধা ব্যাগ ঝুলিয়ে মাল নেয়, দাম দেয়। অন্য কেউ এলে এপার ওপারে তেমন ভাবেই কথা চালাচালি হয়। একটু সাবান লাগে কখনো, তবে ছাল তুলে ঘষাঘষির স্যানিটাইজার তাদের গ্রহে অজানা, মুখোশের উঁকি নেই, আতঙ্কের বাড়তি কাচাকাচিও নেই।

এক সকালে টুইটার বিনা ডাকে এসে হাজির। ও দা গো, দিন চলে না, কিছু কাজ দাও।

-কিন্তু কাজ কই, আমাকে কেউ কাজ দেয় না বলে নিজের কাজ করি, তারপরও কত বাড়তি সময় পড়ে থাকে রে! কিছু পয়সা নিয়ে যা।

-না দা, অমনি নেব না! টাহলি কিচু ফলপাকুড় দাও দিনি, বাজার কিন্টু টেজি আছে গো!

-এখন তো আমরা ফল খেয়েই আছি রে! গাছে তেমন বেশি তো হয় নি এখনো।

-ও ঝা হবে, সম মিলে কুড়্যে বাড়্যে নে ঝাব’খন। দর ঝা নিবে লিও, টুমি ট ঘরের লুক!

-চল তাহলে দু’জনে মিলে বাগানে যাই, দেখি কতটা কি করা যায়।

পল্টু দেখে কী অবলীলায় বাতাবির কাণ্ড বেয়ে উঠে যায় টুইটার। অল্প কিছু বাতাবি বড় হয়েছে। পেয়ারা অবশ্য অনেক ফলেছে। ছাদে উঠে কিছু বেলও মেলে। পাওয়া যায় তিনটে বড় গন্ধরাজ।

এবার এমনিই নিয়ে যা তুই, কিছু দিতে হবে না।

না না করেও খুশি হয় টুইটার। বলে, টুমি ট দুনিয়াদারদের হারায়ে দেছ, ও দা! এট বড় ঢেউ মোটে টুমারে ধরটি পারে নি! টুমি কারেও পরোয়া কর নাহি? পাড়ার লুক কইটাসে পল্টু লুভ করে নাই, বান্ধন নেয় নাই। আরামের পিছনে ছুটে নাই। বাহিরের আপদ অর করবে কী! … কয়জনা আজি নিজির করি থাকটি পারে, কও দেহি! মিথ্যা করি ভালা সাইজে দুকখু লুকাটে হয় না টুমারে! উরা জোরাজুরিটে ঘরবন্দী, টুমি টো আপন মর্জিটে! কট কথা যি হয় টুমারে নিয়া! কে জানে, উরা টুমারে হিংসে করে কিনা!

দিনের আলো যত কমে, ভেতরে তত আলোময় হতে থাকে পল্টু। জোড়া আঘাতে মন খারাপ করে বাধ্য হয়ে যে জীবন শুরু করেছে, তা আজ ভালো লাগতে থাকে। আদতে সে তো নিজের শান্তি চেয়েছিল, তাই যেমন মনে হয়েছে করেছে। আজ ব্যঙ্গ বন্ধ, আর প্রশ্ন, লোভ, উদগ্র কৌতূহল বেড়ে গেছে বটে, কিন্তু তাকে ছুঁতে পারে না। এর চেয়ে বেশি তার আর কিই বা চাই!

রাতে ছাদে উঠে ঘোরার সময় কখন যে তুমুল আনন্দ ছেয়ে ফেলে তাকে! বলা যায় বিপুল এক পুলক জাগে পল্টুর। এমনিতে সে রোজ সাঁঝে আসে, ছাদ ঘিরে ঘোরে। চুপ করে আকাশের আঁধারে আলোর বুটিদার নকশা দেখে, বাতাসের বদল অনুভব করে। সারা দিন আটকা থেকে আশেপাশের ছাদে দম নিতে আসে পাড়ার অন্যান্য মানুষও। আজ তারা দেখে কত রকম নাচ মিলিয়ে মিশিয়ে আজব এক নাচ নেচে ঘুরছে সে। হাতে ওটা কী, অস্তর নয় তো! যেন অদৃশ্য দুশমনের দিকে তাক করতে চায়! একেক ছাদে লোকে হাসে, মন্তব্য করে কেউ, বলতে থাকে, অস্তরটি আসল না নকল, কে জানে! খবর, ছবি, তথ্যর আসল নকলও তো আজ বোঝা দায়। সাবধান থাকাই ভালো। কখন বেপথু ছুটে এসে লেগে যায়! আরেকজন বলে, হেসো না, ও ব্যাটা পোকাধরা হাওয়াকে শুদ্ধ করে নিচ্ছে!


শূন্য

রেজাউল করিম রোমেল


রাতুল মিথিলা ও সাঈদ ক্লাস সেভেনে পড়ে। তিনজনই ক্লাসের সেরা। এক দুই তিন রোল তাদের মধ্যে থেকেই হয়। পড়াশোনাখেলাধুলাসাধারণ জ্ঞানে তাদের সাথে কেউ পারে না। তিনজনের ভিতরে সবসময় কমপিটিশন চলেপড়াশোনায় কে কত ভাল রেজাল্ট করতে পারে। খেলাধুলা ও সাধারণ জ্ঞানে কে কার চেয়ে ভাল করতে পারে। তবে তাদের মধ্যে কমপিটিশন থাকলেও তারা খুব ভাল বন্ধু যেন একজন আর একজনকে ছাড়া বাঁচে না।

একদিন অংক ক্লাসে মহিউদ্দিন স্যার সবাই-কে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেন,

-বলো তো শূন্য অর্থ কি?

সবাই বললো,

-শূন্য মানে আবার কি-ই-বা হবে। শূন্য মানে কিছুই না অর্থাৎ যার কোনো অস্তিত্ব নেই। 

আবার কোনো কোনো ছাত্রছাত্রী বললো,

-শূন্য-র আবার কোনো মানে আছে নাকি?

মহিউদ্দিন স্যার রাতুল এবং সাঈদ-কেও জিজ্ঞেস করলেন,

-রাতুল এবং সাঈদ তোমরা বলো শূন্য বলতে তোমারা কি বোঝ?

মিথিলাকেও মহিউদ্দিন স্যার একই প্রশ্ন করলেন। মিথিলা বললো,

-স্যার আমি বুঝতে পেরেছি শূন্য শব্দের একটি বিশেষ কোনো অর্থ আছে। যার অর্থ আমি এখন বলতে পারছি না। তবে আমাকে একদিন সময় দিলে শূন্য-র অর্থ খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে পারি।

-ঠিক আছে। আজকে যেহেতু বৃহস্পতিবার। তাহলে তোমরা রবিবারে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করে আনবে।

রাতুল এবং সাঈদ-ও একই কথা বললো। তারা মিথিলার সাথে একমত পোষণ করলো।

স্কুল ছুটির পর রাতুল সাঈদ ও মিথিলা একসাথে বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা হল। এবং তিনজন মিলে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিল যে শূন্য-র অর্থ তাদের খুঁজে বের করতে হবে। তাই এখন তাদের প্রথম কাজ হবে বিভিন্ন বই পুস্তক ও ইন্টরনেট ঘেটে এর অর্থ কি হবে তা জানার চেষ্টা করা। এবং কে কি তথ্য পেল সেটা স্টেডিয়ামে ক্রিকেট কোচিং করার পর একে অপরকে জানাবে।

স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পর তিন জনই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজ শুরু করল। কিন্তু মহিউদ্দিন স্যারের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মত তেমন কোনো তথ্য পাওয়া গেল না।

স্টেডিয়ামে ক্রিকেট কোচিং শেষ করার পর রাতুল সাইদ ও মিথিলা এক সাথে মিলিত হল। কেউ-ই কোনো উত্তর খঁজে পাইনি বলে জানাল। কিন্তু তারা হার মানতে রাজি নয়। তাই তারা পরবর্তী সিদ্ধান্ত নিল যে বাড়িতে বাবা-মাভাই-বোনআত্মীয়-স্বজন যারা আছে তাদের কাছে শূন্য শব্দের অর্থ জানার চেষ্টা করবে। তারা যে মতামত প্রকাশ করবে তার উপর ভিত্তি করে এবং ইন্টারনেট ও বিভিন্ন বই পুস্তক থেকে তথ্য সংগ্রহ করে তারা নিজেরা একটি উত্তর তৈরী করবে। সেই উত্তরটি মহিউদ্দিন স্যারের কাছে উপস্থাপন করবে।

আবারও সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজ শুরু করলো মিথিলা সাঈদ ও রাতুল। শুক্রবারে ঘুম থেকে উঠে ক্লাসের পড়া শেষ করে ইন্টারনেটে বসে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করলো। এখন পরবর্তী কাজ হল বাড়িতে যারা আছে তাদের কাছে শূন্য শব্দের অর্থ জিজ্ঞাসা করা। রাতুল প্রথমে জিজ্ঞেস করলো তার বড় ভায়ের কাছে।

-ভাইয়া বলতো শূন্য অর্থ কি?

ভাইয়া বললো,

-শূন্য! কেনশূন্য অর্থ দিয়ে তুই কি করবি?

-মহিউদ্দিন স্যার আমাদের শূন্য শব্দের অর্থ খঁজে বের করতে বলেছে।

-ও আচ্ছা। 

কিছুক্ষণ চুপ থেকে বড় ভাই বললো,

-এসব ছোট খাটো প্রশ্নের উত্তর তুই আমার কাছে জানতে চাইবি না। কারণ এসব সহজ ও ছোট খাটো প্রশ্নের উত্তর আমার দিতে ভাললাগে না। জটিল বিষয় গুলোর উত্তর দিতে আমার ভালোলাগে। তারপরও তুই যখন জানতে চাচ্ছিস তাই বলছি। শোন শূন্য একটি ইংরেজী। যার শব্দ হল জিরো। জিরো অর্থ শূন্য এবং শূন্য অর্থ জিরো। বোঝা গেলএই সামান্য বিষয়টি তুই পারিস না?

কথাগুলো বলে হাতের আঙ্গলে চাবির রিং ভরে দিয়ে ঘুরাতে ঘুরাতে চলে গেল। রাতুলের বড় ভায়ের নাম রাহাত। সে এবার এস এস সি পরীক্ষা দেবে। কিন্তু সে রাতুলের সামনে এসে এমন একটা ভাব দেখায় যেন সব কিছুই তার জানা। তার কাছে অজানা বলে কিছু নেই।

রাতুল কোনো কথা না বলে সোজা চলে গেল মামার ঘরে এবং ঘরে গিয়ে দেখল মামা চেয়ারে বসে টিভি দেখছে। মামাকে সালাম দিয়ে মামার সাথে টিভি দেখতে শুরু করল। কিছুক্ষণ পর রাতুল তার মামাকে জিজ্ঞেস করলে,

-আচ্ছা মামা শূন্য বলতে আপনি কি বোঝেন?

-শূন্য! এর আবার কোনো অর্থ আছে নাকি?

তারপর রেগে গিয়ে বললেন,

-ফাজলামি করছিস আমার সাথেএমনিতে তোর মামি তিন দিন ধরে বাড়িতে নেই । কে রান্না করবে,কে ঘর দেখাশোনা করবে সেই চিন্তায় অস্থির আর তুই আমার সাথে ফাজলামি করতে এসেছিসতুই আমাকে রাগাতে এসেছিস?

রাতুল কোনো কথা না বলে তাড়াতাড়ি মামার ঘর থেকে বেরিয়ে ঐশীর ঘরে চলে গেল। ঐশী মামার একমাত্র ছোট মেয়ে। ক্লাস টু-তে পড়ে। ঐশীর কাছে রাতুল জিজ্ঞেস করল,

-ঐশী বলতো শূন্য কি?

ঐশী কাগজের উপরে বড় একটা গোল এঁকে দিয়ে হাসতে হাসতে চলে গেল।

এদিকে মিথিলা তার মা-বাবার কাছে শূন্য বলতে কি বোঝ এটি জানতে চায়লে তাঁরা কিছুক্ষণ হাসতে থাকল। তারপর বললো,

-শূন্য শব্দের অর্থ দিয়ে তুমি কি করবে?

-মহিউদ্দিন স্যার আমাদের কাছে জিজ্ঞাসা করেছিল। কিন্তু আমরা কেউই এর উত্তর দিতে পারিনি। আমরা এর উত্তর খুঁজে বের করার জন্য সময় চেয়েছিলাম। স্যার আমাদের দুইদিন সময় দিয়েছে। আগামী রবিবারে শূন্য শব্দের অর্থ আমাদেরকে জানাতে হবে।

বাবা-মা কিছুক্ষণ চুপ থাকল। তারপর বাবা বললো,

-মনে করো এই ঘরে যখন খাটচেয়ারটেবিলটেলিভিশন কিছুই ছিল না তখন ঘরটি শূন্য ছিল। এখন সবই আছে। আবার যখন এই ঘরে কিছুই থাকবে না তখন ঘরটি শূন্য হয়ে যাবে।

মা বললো,

-তুমি হলে আমাদের একমাত্র সন্তান। যখন তোমার জন্ম হয়নি তখন আমাদের কোনো সন্তান ছিল না। তখন আমাদের ঘর শূন্য ছিল। কিন্তু যখন তোমার জন্ম হল তখন আমাদের ঘর আর শূন্য থাকল না। বুঝতে পেরেছ?

-হ্যাঁ মাআমি বুঝতে পেরেছি। 

সাইদ তার খালাত ভায়ের কাছে শূন্য শব্দের অর্থ জিজ্ঞেস করলে সে বললো,

-মহাবিশ্বে যখন কোনো কিছুই সৃষ্টি হয়নি তখন মহাবিশ্ব ছিল শূন্য এবং এক সময় সৃষ্টি হল গ্রহউপগ্রহনক্ষত্রউদ্ভিতপ্রাণী ইত্যাদি অর্থাৎ মহাবিশ্ব প্রথম অবস্থায় শূন্য ছিল। 

সারাদিন বিভিন্ন মাধ্যম থেকে তথ্য সংগ্রহ করে রাতে বই পড়তে পড়তে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল মিথিলারাতুল ও সাঈদ। সকালে ঘুম থেকে উঠে তাড়াতাড়ি গুছিয়ে স্কুলে গিয়ে তিনজন একসাথে বেশ কিছুক্ষণ আলাপ আলোচনা করল। তারপর মহিউদ্দিন স্যার ক্লাসে এসেই মিথিলারাতুল ও সাঈদ-কে বললেন,

-শূন্য শব্দের অর্থ বের করার জন্য তোমরা আমার কাছে একদিনের সময় চেয়েছিলে। এখন বলো কে কি উত্তর এনেছ।

মিথিলা বললো,

-একটি ঘরে যখন কোনো কিছুই থাকে না তখন ঘরটি শূন্য থাকে। কিন্তু যখন চেয়ার টেবিল ইত্যাদি জিনিসপত্র ঘরটিতে রাখা হয় তখন সেটি আর শূন্য থাকে না। আবার চেয়ার টেবিল ইত্যাদি জিনিস সরিয়ে নিলে ঘরটি আবার শূন্য হয়ে যায়।

রাতুল বললো,

-কোনো একটি স্থানে একটি বস্তু ছিল কিন্তু যখন বস্তুটি সে জায়গা থেকে সরিয়ে নেয়া হয় তখন সে স্থান শূন্য হয়।

সাঈদ বললো

-মহাবিশ্বে এক সময় কোনো কিছুই ছিল না। তখন মহাবিশ্ব ছিল শূন্য কিন্তু যখন গ্রহউপগ্রহমানুষউদ্ভিতপ্রাণী ইত্যাদি সৃষ্টি হয়েছে। এখন মহাবিশ্বকে শূন্য বলা যায় না।

মহিউদ্দিন স্যার বললেন,

-তোমরা যে উত্তর দিয়েছ তা ঠিক আছে। এতে কোনো ভুল নেই। তবে ভালভাবে ব্যাখ্যা করলে বিষয়টি তোমরা আরো সহজে বুঝতে পারবে। যেমন গাণিতিক সংখ্যা শুরু হয় শূন্য থেকে। শূন্য এক দুই তিন চার ... । আবার দ্যাখ এখানে একটি সাদা কাগজ আছে। এখানে কিছু লেখা নেই। এখন কাগজটি শূন্য। কিন্তু যখন কাগজটিতে কিছু লেখা হবে তখন সেটি আর শূন্য থাকবে না। অর্থাৎ সঠিক উত্তরটি হল শূন্য থেকে শুরু।

বিষয়টি সবাইকে বুঝিয়ে দিয়ে মহিউদ্দিন স্যার ক্লাসের পড়া পড়াতে শুরু করল। রাতুল মিথিলা ও সাঈদ অনেক খুশি হল কারণ বিষয়টি সম্বদ্ধে তারা যে তথ্য সংগ্রহ করেছিল তা সঠিক ছিল এবং শূন্য শব্দের সঠিক উত্তর তারা জানতে পারল।



ভ্রমণ 


শোণপুর মেলা

চিত্রা পাল

আমরা বেরিয়েছিলাম বিহার পর্যটনে। সেইমত নিউজলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে ট্রেনে পাটনা পৌঁছই সকাল সকালই। পরেরদিন  সকালে প্রাতঃরাশ সেরে রওনা হলাম বিহারের অন্যতম দ্রষ্টব্য স্থান বৈশালির দিকে। পথে যেতে যেতে চোখে পড়ে শোনপুর মেলার বড় বড় হোর্ডিং। সেই হোর্ডিং দেখে আমরা চারজন গাড়ি আরোহী নিজেদের মধ্যে বলাবলি করি, ওমা এখন শোণ পুর মেলা চলছে নাকি, তাই এত বিজ্ঞাপন। সঙ্গে সঙ্গে আমার পাশের জন বলে ওঠে,সেই শোণপুর মেলা যেখানে হরিহর ক্ষেত্রে মহারাজা হর্ষবর্ধন খুব দানধ্যান করতেন? আমি বললাম, হ্যাঁ, শুনেছি, সমস্ত কিছু দান করার পরেও কোন কোন দাতাকে তিনি সামান্য বস্ত্র পরিধাণ করে তাঁর মূল্যবান রাজবেশও দান করে দিতেন। এইসব কথা বার্তায় যখন আমরা মশগুল, তখন হঠাত্‌ আমাদের গাড়ির চালক মশায় বলে ওঠেন, যাবেন নাকি, শোণপুর মেলায়, এখন তো মেলা চলছে, যদি বলেন, তাহলে মেলায় যেতে পারি। আমাদের তো তখন হাতে চাঁদ পাওয়ার অবস্থা। আমরা সকলেই রাজি, তাই আর দেরি না করে গঙ্গা পার হয়ে আমরা চললাম, শোণপুর মেলায়। 

শোণপুর মেলা শুরু হয় কার্তিকী পূর্ণিমায়। চলে প্রায় একমাস দেড়মাস। আমরা এসেছি নভেম্বরের  শেষদিকে, তাই মেলা তখন জমজমাট। এই মেলাকে আবার হরিহর ক্ষেত্রের মেলাও বলে। এই মেলা হচ্ছে এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বড় জীবজন্তুর মেলা। এই মেলা কবে থেকে শুরু হয়েছে কে জানে।অনেকে  বলে সম্ভবত বৈদিক যুগ থেকেই এই মেলার প্রচলন।তবে কথিত আছে,মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য গঙ্গা পেরিয়ে এসে এইখান থেকেহাতি ঘোড়া খরিদ করতেন। এই মেলায় বহু দূরদূর থেকে লোকজন আসে, সুদূর দক্ষিণভারত, তামিলনাড়ূ থেকেও আসে লোকজন। শোনা যায়, মধ্য এশিয়া থেকেও লোকজন আসতো ওই সব কেনাকাটার জন্য।

আমরা মেলার কাছে পৌঁছবার অনেক আগে থেকেই  একটা উত্তাল জনসমুদ্রের কলরব টের পাচ্ছি। যত কাছাকাছি হচ্ছি তত যেন সে কলরবের আঘাত আরও জোরালো হচ্ছে। ঢুকে পড়লাম মেলায়। কত ধরণের যে জীবজন্তু বিক্রি হতে পারে তা এখানে না এলে বোধগম্য হতো না। হাতি ঘোড়া বাঁদর কুমির কি নেই, সব। এই শোণপুর মেলা একমাত্র মেলা যেখানে প্রচুর সংখ্যায় হাতি বিক্রি হয়। শুনলাম ২০০৪ সাল থেকে গভর্নমেন্ট  হাতি কেনাবেচা বন্ধ করে দিয়েছে।  আমরা অত ঘুরে দেখিনি, মানে দেখার ক্ষমতা ছিলো না। তবে পাখির স্টল প্রচুর দেখা হলো। পায়রা যে এত ধরণের হয় তা জানা ছিলো না। তার মধ্যে প্রথম দেখলাম,কালো পায়রা। একেবারে  কুচকুচে কালো। শুনেছি এখানে আগেকার কালে মানুষ পর্যন্ত কেনা বেচা চলতো। এখন আইন করে সেসব বন্ধ করা হয়েছে। এমনকি জীবজন্তু কেনাবেচার ক্ষেত্রেও অনেক নিয়ম জারি হয়েছে।

এতোবড় মেলা এতো ধরণের লোকসমাগম যে হারিয়ে যাবার সুযোগ থাকে বড় বেশি। ক্রমাগত মাইকে সেই হারানোর বিজ্ঞপ্তি শুনতে শুনতে ওখান থেকে বিদায় নিলাম।আসার পথে আমরা এই কথা ভাবছিলাম সবাই, যে কত ঐতিহাসিক এই মেলা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলে আসছে। এই আমাদের ভারতবর্ষ যা এখনও সেই ঐতিয্যে বহমান।

 

 বকসায় বারবার

 বিনয় বর্মন

এখন আর কেউ বলে না , কবে যাচ্ছিস ? বরং উল্টোটা , "কবে এলি ?" মানে , বক্সায় যাতায়াতটা এখন প্রায় জীবন যাপনের অঙ্গ হয়ে গিয়েছে l ট্রেকিং বল , এডভেঞ্চার বলো, গোসা ঘর বল সব কিছুরই হাতে খড়ি কিংবা পায়ের ঘস্টানো শুরু ওই বক্সায় l প্রথম কারণ , ঘরের পাশের আরশিনগর l দ্বিতীয়তঃ তার অভিনবত্ব l প্রতি ঋতুতে , প্রতিমাসে , এমনকি প্রতিদিনই বক্সা আলাদা রকম l তৃতীয়ত , তার আদিমতাl

সেবার চলেছি তিন মূর্তি - সঙ্গী রতন ও তোতন l আলিপুরদুয়ার জংশন থেকে রওনা দেওয়ার আগে যে যার লিস্টি মিলিয়ে নিই l  রতনের লিস্টি অভিনব : হুইস্কি তিনটা , বিয়ার তিনটা ,দিশিএকটা l 
- সেকি দিশিও  !!
- শোন যতই ফিল্টার ফোকো বিড়ির মৌতাতের সঙ্গে সে কি পাল্লা দিতে পারে ?  দিশির ধক বিলিতি তে নেই রে পাগলা  !!
রতনের গুরু বাক্য l

 সানতালাবাড়িতে হেমা বইনির দোকানে মোমো ব্রেক l  যে  মোমো খাওয়ার জন্য ৩০ কিলোমিটার গাড়ি বাইক স্কুটার করে , এমনকি কখনো পাঁচ কিমি হেঁটে গেছি , আলিপুরদুয়ার থেকে ভায়া জয়ন্তী মোর l সেখানে মোমো না খাওয়া মানে মন্দিরে গিয়ে দেবতা দর্শন না করে আসা l হেমা দিদির অমায়িক অকৃত্রিম হাসির আপ্যায়নের সঙ্গে পাতলা , মুখে দিলেই গলে যায় , রসনায় তৃপ্তির স্বাদ এনে দেওয়া মোমো চালান করতে  থাকি ধীরে ধীরে l ভালো জিনিস রসিয়ে খেতে হয়। সঙ্গে সুখ দুঃখের গল্প l হেমা দিদির ছোট বোন কলকাতায় মাস্টার ডিগ্রী পড়ছে। আই সি এস সি তে খুব ভালো রেজাল্ট করেছিল l আলিপুরদুয়ারে হোস্টেলে থেকে পড়েছে l

রওনা দেবো l দেখি রতন নেই l একটু পরে হাজির l ঠোঁটে মুখে গন্ধ l একটা বোতল খালি ! চড়াই ভেঙে উঠতে থাকি। জিরো পয়েন্ট যেতে যেতে আরো একটা বিয়ার উড়িয়ে দেয় l ফলে দুর্বল লিভার , পুরনো ব্যথা নিয়ে গতি স্লথ  হয়ে আসে  বেচারার l তোতন খিচিয়ে :  ওঠে শালা ঘুম থেকে উঠেই লাল জলে কুলকুচি করিস নাকি ! আরো কতটা পথ উঠতে হবে...  না পারলে ওখানেই পড়ে থাকবি l  ধুঁকতে ধুঁকতে উঠতে থাকে l ক্রমশ উঁচু হয়ে ওঠা পথ  ধরে চলতে থাকি আমরা l জিরো পয়েন্টে দাঁড়ালে জয়ন্তী , বালা , বক্সা ঝোরার দৃশ্যে শব্দে মন ভালো হয়ে যায়।

দূরের পাহাড়ি গ্রাম থেকে রঙিন প্রার্থনা পতাকার বাতাস যেন বুদ্ধের শান্তির বাণী বয়ে আনে l টুকটুক করে ঘন্টাখানেকের মধ্যেই পৌঁছে যাই সদর বাজার l ইন্দ্র শঙ্কর থাপার ব্লু হোমস্টে , রোভারস ইন l অকৃত্রিম হাসি নিয়ে স্বাগত জানায় ইন্দ্র। দুপুরের খাবার গিলে ঘরের পিছনে ভিউ পয়েন্টে বসি l মেঘ রোদ্দুরের খেলা চলে সারা বেলা l ফোন আপাতত টাওয়ারের  দুয়ারে গোসায় খিল দিয়েছে l দূর থেকে রোভারস পয়েন্ট হাতছানি দিতে থাকে। টুক করে সূর্য ডুবে গেলে হোমস্টে তে ফিরে এসে বারান্দায় চা পানের আসর l রতনের তৃতীয় বোতল শেষ l দূরে বস্তির আলো জ্বলে ওঠে l সান্ধ্য আসর জমে  ওঠে ইন্দ্রর ব্যাঞ্জো আরো নানারকম ইমপ্রভাইজড ইন্সট্রুমেন্ট এর সঙ্গতে l অদ্ভুত অবিশ্বাস্য সব গল্পের স্রোতে l বিশ্বাস না করলেও পরিবেশ ও পরিবেশন তৈরি করে সুররিয়ালিজম এর আবহ l  হাজার হোক আখ্যানকর্তা যখন তৎকালীন বক্সার মহকুমা শাসক এর নাতি l

হোমস্টের খাবারে বৈচিত্র নেই l তাও স্বাদ বদলে তা অমৃত l পথশ্রম , সংগীত আর সুরার প্রভাবে ঘুমের ওষুধ ছাড়াই গভীর ঘুম l সকালবেলা বক্সা ফোর্টের  মধ্যে সূর্যোদয় দেখা l ব্রেকফাস্ট সেরে লেপচাখার পথে l রোদ ছায়া চড়াই উৎরাই চড়াই উতরাই নির্জনতা দু একটা বাড়ির উঠোন আদা , স্কোয়াশের ক্ষেত , গবাদি পশুর খামার পেরিয়ে ঘণ্টাখানেক মডারেট ট্রাকিং এর পরে একসময় টেবিল টপ লেপচাখা l এক সময় শুধুমাত্র একটি হোমস্টে থাকা স্থানটি এখন ধীরে ধীরে নির্জনতা হারাচ্ছে l তাও যা আছে তাই পড়ে পাওয়া চৌদ্দ আনা  !  পথশ্রমের ক্লান্তি দূর করে দেয় সিনিক বিউটি l সত্যিই হেভেন অফ ডুয়ার্স l কতবার এসেছি মনে নেই l প্রতিবারই পুরানো ব্যথা ভুলিয়ে দেওয়া নতুন প্রেমিকের মতো মনে হয় l প্রাক্তনকেও ভুলিয়ে দেয় l আর সে আসেনি বলে মন খারাপের দাওয়াই হয় সিনচুলার রহস্যময় হাতছানি l praying flag এর বাতাস ফিসফিস করে বলে যায় ,  নিশ্চয়ই একদিন আসবে l ... নিজের ছোটবেলার টাইম ট্রাভেলার হয়ে আসে মঙ্গলয়েড পাহাড়ি শিশুরা l আয়না হয়। আমার গোমরা থোবড়াতেও হাসি ফোটে !



শীত বিষয়ক 


আমার নিজস্ব পৌষ 

বেলা দে 


পৌষ মাস বলতে আমি বুঝি কৃষকের ঘরে ওঠা ধান, ধানে বোঝাই উঠোন পোয়াল পুঞ্জি, গোবর ল্যাপা গোলায় ভরা বছরের খোরাক, পরাধীন ভারতের সিংহভাগ বাঙালি ছিল কৃষিভিত্তিক কিছু না কিছু জমিজিরেতের মালিক। পৌষ মানে পরমপ্রাপ্তি, পিঠেপুলির রসনাতৃপ্তি।আমার বাপের বাড়ি জমির মালিকানা থাকার সুবাদে গরুর গাড়ি বোঝাই ধান আসতো বাড়িতে, যে সময়টার কথা বলছি ৫০ থেকে ৬০ এর দশক আমি তখন নিতান্তই বাল্য  কৈশোরে ছুটে বেড়ানো বালিকাবেলায়। সে ধান ছিল আমাদের বারমাস্যার গল্পগাছা চিড়ে,মুড়ি খই, চালগুঁড়া, পিঠে পায়েস নবান্ন সবই হতো  নবান্নের পর পর বাস্তুপূজা দিয়ে, আমার মমতাময়ী  মা এবং দিদিরা লেগেই থাকতো ওকাজের পিছনে সঙ্গে থেকেছে গোটা ৫/৬ কাজের লোক তারা হাত বেটেছে সব কাজে। সিনেমা হলের ব্যবসা গাড়ির  ব্যবসা, আসে জন বসে জন মিলে খুব কম পরিমাণ সদস্য হিসেবের গন্ডিতে বাঁধা থাকে নি, বাবা তাদের অভুক্ত যেতে দেয়নি কখনো সঙ্গে ডাল তরকারি যাই জুটুক। গাটছড়া বেঁধে যখন শশুরঘরে আসা সেখানেও একই দশা বৃহৎ একান্নবর্তী পরিবার সর্বসাকুল্যে  ২৫ টি মাথা, শ্বশুরমশাই পুলিশ অফিসার, তাঁর  বাবাও ছিলেন ওই পদে।দেড়শো বিঘে জমির মালিক, দাদাশ্বশুরের কৃতিত্ব সবটাই। পৌষ মাস  পড়তেই গোলায় উঠেছে ধান সে ধান সেদ্ধ শুকনো  করতো বাড়িতে গ্রাম থেকে একজন মহিলা এসে বাড়িতে মুখের সংখ্যা এমনিতেই কম নয় উপরন্তু  প্রজারা শহরে এলে তাদের না খাইয়ে ছাড়েননি শাশুড়ী মায়েরা, এখনকার মতো জলখাবারের বন্দোবস্ত তো সেইসময় ছিল না। আদর ভদ্রতা

মানেই ভাত, আর পৌষ এলে কথাই নেই মাঝেমধ্যেই পিঠেপুলি, এখন কেউ শুনলে আষুঢে গল্প বই আন্দাজ করতে পারবে না, ২০ কেজি চালগুঁড়া জমির থেকে করে দিয়েছে সংক্রান্তির আগের রাত জেগে জেগে তৈরি হয়েছে চসি,পুলি আর রকমারি সব পিঠে পায়েস নতুন নলেন গুড়ের গন্ধে ম ম করছে এই দে বাড়ির বাতাস। এখন তো ওসব দূর অস্ত, শাশুড়ি মায়েরাও নেই একান্নবর্তীও নেই পৌষ এলেই নস্টালজিক স্মৃতি বুকে মোচড় দিয়ে ওঠে,ইচ্ছে করে আবার সেই শিল্পীত হাতগুলির অনুশীলন পেতে ওনাদের মতো  করিতকর্মা আর হতে পারলাম কই তবু্ও নিয়মের সাথে প্রজন্মের মুখে তুলে দিই কিছু নিজ হাতে। 


শীতের সকাল
দেবযানী সেনগুপ্ত

শীতের কুয়াশার চাঁদর সরিয়ে
 উঁকি দেয় লাল সূর্য। 
গাছেদের পাতায় পাতায়
  ঘাসে ঘাসে তখন -
শিশিরের  টুপটাপ ।
ধান কাটা রুক্ষ মাঠে-
  বয়ে যায় উত্তরে হাওয়া।
 খেজুর গাছে হাড়ি বাঁধে মন।
 আমলকি শিমুলে পলাশে 
 লাগে হুটোপুটি ।
দূরের পাহাড় তখনও-
 কুয়াশা চাদরে ঘুমিয়ে ।
 আলোর ছটায়-
 ঘুম ভাঙ্গে তার ।
রক্তিম কাঞ্চনজঙ্ঘা 
ঝকঝকে রৌদ্রে-
 স্নাত হয়।
 স্লিপিং বুদ্ধ হেসে ওঠেন।।




শীতের সন্ধানে....
প্রতিভা পাল 

শিকড়ের খোঁজে হাঁটছে শীত 
নিরুদ্দেশের আলপথ বরাবর, অবসরে !
অসংজ্ঞাত উষ্ণতার ঊর্ধ্বমুখী গ্রাফ 
পৌষালি বিষণ্ণতা আঁকে কুয়াশার ঠিকানায়,
রাতের খামে !
শীত মাখা স্মৃতির শহরে সেই কবেকার
যৌথ পরিবারের শপথ,
সুখ, অ-সুখের খেলাবেলার ছায়াপথ
প্রহর জুড়ে আজ জোনাকি সাজায় 
ছবির অ্যালবামে !
সরীসৃপ সময়ের সিন্দুকে রাখা 
রোদ পোহানো দুপুরের গল্পগুলো 
পৌষের পশমে আজও জড়িয়ে নেয় মন,
অথচ শীত এখন আনমনা ভীষণ, বড় কৃপণ !
দিনের যাবতীয়, জোড়াতালি দেওয়া রাতও তাই
নতুন আশায় হাঁটছে অবিরত
বছর বছর ধরে, সেই শীতের সন্ধানে.....



শীত ও প্রসঙ্গ
মজনু মিয়া 

কাঁপছে বুড়া ডাকছে খোঁড়া
গরম দিছে ভাতে,
গরম গরম খাও নাই শরম
কাঁপন ছুটবে হাতে।

গা গরমের তা করনের
আগুন জ্বেলে দিয়ে,
ছেলে-মেয়ে দেখছে চেয়ে 
কাপড় গায়ে নিয়ে। 

শীতের এমন কাঁপন যখন
কাঁথা মুড়ি দিয়ে, 
বুড়া বুড়ি ঘুরাঘুরি 
বন্ধ করো গিয়ে। 

পথের মানুষ নয়তো বেহুঁশ 
পেটের ক্ষুধা আছে,
শীত মানে না ধনী জানে না
বাইরে যাওয়ার পাছে।



আদুরেমনা শীত ও নস্টালজিয়া খেজুর গাছ
বটু কৃষ্ণ হালদার

কালের নিয়মে এই ভারতবর্ষে ঋতুচক্রের আবহে পরিবেশ নিয়ন্ত্রিত হয়। এই ঋতু গুলোর মধ্যে অন্যতম জনপ্রিয় হলো আদুরে মেনা শীত। সোনালী আলোর পরশ রেখার ডানায় ভর করে হেমন্তের কাঁধে ভর করে শীতের আগমন হয়। শীত মানে মায়ের হাতে নিখুত বুননে নকশী কাঁথার স্পর্শ। বিছানা ছেড়ে উঠি উঠি করতে কখন যে সূর্য আপন কক্ষ পথ ঘুরে মাঝ বরাবর উঁকি দেয় তা বুঝতেই পারিনা। নব কিশলয়ের কল্লোলের কোল হতে টপটপ করে ঝরে পড়ে শিশির বিন্দু। কচি ঘাসের ডগায় শিশির বিন্দু রাঙা চরণ ছুঁয়ে আলপনা এঁকে যায়।

সাদা কাশফুল যেমন জানান দেয় শরৎকাল এসেছে, ঘরের মেয়ে উমা আসবে বাপের বাড়ি, ঠিক তেমনই সোনালী পাকা ধানের খেত গাঁদা, ডালিয়া,সূর্যমুখী,গোলাপের রঙ্গিন পাখনার উপর ভর করে আদুরেমনা শীতের আগমন ঘটে। সবুজ, সতেজ,বনময়,স্বপ্নীল ভারত এক ঋতু বৈচিত্র্যের দেশ।রঙ্গিন প্রকৃতির ঋতুরঙ্গশালা তার আনন্দময় আগমন বিস্তার ঘটে ঋতু গুলির মধ্যে দিয়ে। ভারতের প্রত্যেকটি ঋতু বৈচিত্র গুরুত্বপূর্ণ। ঋতু পরিবর্তনের বর্ণ বিচিত্রা ধারা পথে নিয়মিত উদ্ভাসিত হয়ে ওঠার খেলায় মগ্ন হয়। প্রতিটি ঋতুতে প্রকৃতির অনন্য রূপের ডালি নিয়ে হাজির হয়। ঠিক তেমনই হেমন্তের ডানায় ভর করে সোনালী আলোর পরশে শিশির রাঙানো আলতো স্পর্শে শীত নিয়ে আসে পৌষ পার্বণ ও নলেন গুড়ের বার্তা। শীত আসে হৃদয়ের আবেগের অনেকখানি পরশ জুড়ে।তন্দ্রায় বিজড়িত চেতনায় দূর বনান্তরালে পাখিদের কূজন,পথচারীদের বিচ্ছিন্ন সংলাপ ভেসে আসে দূর হতে। চারিপাশ কুয়াশার স্তব্ধতায় মগ্ন। এক সীমাহীন বিষন্নতা ও বৈরাগ্যে সকলের হৃদয় কানায় কানায় ভরে ওঠে। শীতের বুড়ি কুয়াশার লেশ হীন মাত্রা ছুঁয়ে কাঁপতে কাঁপতে চলেছে শুকনো পাতার  সন্ধানে বনাঞ্চলে। ঘন কুয়াশার চাদর সরিয়ে পূর্ব দিগন্তে ধীরে ধীরে সোনালী আলোর পরশ ছড়িয়ে পড়ে দিগন্তময়। গাছগাছালি, ডালপালা, পাতা, টিনের চাল, খড়ের ছাউনী হতে সোনালী বিন্দু ঝরে পড়ে মলিন ঘাসের ডগায়। ঝরে পড়ে আম্র মুকুল।মেঠো পথ ধরে কৃষকরা বলদ নিয়ে চলেছে মাঠের পানে। দুটি শালিক শুকনো বাবলার ডালে মুখোমুখি বসে রোদ পোহাচ্ছে। এক ঝাঁক কাক আপন ডানায় ভর করে ঘন কুয়াশার পাহাড় ঠেলে উড়ে চলে যায় দুর সীমাহীন বলাকায়।

লেপের তলা দিয়ে উঠি উঠি করে ও উঠতে ইচ্ছে করে না। শিয়রে হিংস্র শীত কেশ ফুলিয়ে থাবা পেতে বসে আছে। গরম বিছানার রচিত উত্তাপ কেমন দুর্নিবার অলসের চেতনায় ঘিরে ধরে। শীতের সেই কোন ভোরে উঠে মা উনানে ধান সিদ্ধ করতে ব্যস্ত। ঠাকুমা,জেঠিমারা নকশী কাঁথা গায়ে দিয়ে জুবুথুবু হয়ে বসে আগুন পোহাতে থাকে। তাদের কথোপকথন ভেসে আসে। সরিষার ক্ষেতে মৌমাছিরা গুঞ্জন করতে শুরু করেছে। শীতের সকাল যেন এক প্রৌঢ়া কুলবধূ।বদ্যি বাড়ির আটচালা হতে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের পঠনের সুর ভেসে আসে।

ইট কাঠ পাথরের অট্টালিকার নগর জীবন থেকে হাফ ছেড়ে বাঁচতে এই শীত এর সময়ে লাগেজ গুছিয়ে বেরিয়ে পড়ে দূর হতে দূরে।পল্লী গ্রামের মানুষজন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকে শহরের মানুষ কে বরণ করে নেওয়ার জন্য। শীতেই গ্রাম বাংলা র প্রাকৃতিক রূপ আলপনার রঙে নতুন রূপে সেজে ওঠে।শীত মানে শুকনো নাড়ার গাদা পুড়িয়ে তার পাশে জড়ো হয়ে গল্প-স্বল্প করা।শীত মানে পল্লীর কোন এক পোড়ো  গাঁয়ে পিকনিক করে হুল্লোড়ে, খাওয়া-দাওয়াতে মেতে ওঠা। শীত মানেই গ্রাম বাংলার কচি কাচাদের কাছেই সান্ধ্য ফিস্টির আয়োজন। ফিস্টিকে কেন্দ্র করে তাদের আবেগ-উচ্ছ্বাস নেহাত কম নয়। ছোট ছোট বাচ্চারা গ্রামের বিভিন্ন বাগান থেকে সবজি চুরি করে নিয়ে জড়ো হয় তাদের একান্ত চেনা জায়গায়। কচিকাচা বাচ্চাদের মধ্যে কয়েকজন বড় থাকতো যারা রান্নার দায়িত্ব নিত। নানান গল্প হৈচৈ হোলোর এর মধ্যে দিয়ে রান্নাবান্না শেষ করে দিনের বেলায় কেটে রাখা কলাগাছের পাতা তে সেই খাবার পরিবেশন করা হতো। তারপর যে যার ঘরে ফিরে গিয়ে  লেপ কাঁথা মুড়ে ঠাকুমার পাশে শুয়ে রূপকথার গল্প শুনতে শুনতে  যে ঘুমিয়ে পড়তো। এগুলোর মধ্যেই ছিল অনাবিল সুখের মহা আনন্দ।

সেই সঙ্গে শীত মানে নলেন গুড়।

"খেজুর গাছে হাঁড়ি বাঁধ নন্দ", গানটি বেশ জনপ্রিয়। ঠিক তেমনি নলেন গুড় বাংলার মানুষের কাছে অতি প্রিয় এক প্রাচীন ঐতিহ্য, সংস্কৃতি। চারিদিকে ঘন কুয়াশার প্রাচীর, তারই মাঝে খেজুর গাছে ঝুলে থাকে রসের হাড়ি।গ্রামের মানুষরা খড়কুটো জ্বালিয়ে আগুন পোহায়,সেই রস জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি করতে থাকে।দূর হতে ভেসে আসে তার মিষ্টি সুগন্ধ।

শীতকাল আসতেই মনে পড়ে যায় পিঠে পুলি পায়েস এর কথা। শীতকাল মানেই খেজুর-গাছের-রস ও নলেন গুড়। বারবার শহুরে মানুষ এই খেজুর-গাছের-রস বা নলেন গুড়ের টানে গ্রামে ফিরে গেছেন।নলেন গুড় বা খেজুর গাছ থেকে রস তৈরির কিছু পদ্ধতি আছে। তার জন্য কয়েকটি উপকরণ দরকার হয় তা হল হেঁসোদা, বালি,হেঁসোদা শান দেবার জায়গা(যা কাঠ দিয়ে তৈরি হয়), মাটির ভাঁড় বা কলসি, বাঁশের তৈরি নলি,কাছি( পাটের তৈরি দড়ি)। শীত শুরু হওয়ার আগেই মানুষজন তাদের খেজুর গাছ গুলো তে কেটে পরিস্কার করে(গাছের একপাশ)। তারপর বেশ কিছুদিন সেই জায়গা শুকোতে দেওয়া হয়। কিছুদিন পর সে শুকনো জায়গায় নতুন করে কেটে নলি পুঁতে দেওয়া হয়।গাছের থেকে রস মাটির ভাঁড় ভরে ওঠে। বিকালে গাছ কাটা হয় আর পরের দিন সকালে সেইবার গাছ থেকে নামিয়ে এনে রস উনানে জাল দিয়ে খেজুরের গুড় তৈরি করা হয়। যেখানে রস জ্বাল দেয়া হয় সেখান থেকে দারুন সুগন্ধ ওঠে। সেই গন্ধে চারিদিক মম করে।আসল খেজুরের গুড় দিয়ে মোয়া,পাটালি আরো অনেক কিছু তৈরি হয়।

আমার জন্ম সুন্দরবনের গোসাবা জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রামে। জীবনের পনেরোটা বছর গ্রামে কাটিয়েছি, এরপর উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতায় চলে আসি। সেই পুরোটা বছর শীতের সঙ্গে আমার ছিল নাড়ির সম্পর্ক। শিখলেই গ্রামে কাটানো মুহূর্ত গুলো খুব মনে পড়ে। খুব কাছ থেকে দেখেছি বাবাকে খেজুর গাছে উঠছে। গাছ কেটে খেজুর রস পেড়ে আনতে। আর মাকে দেখেছি সেই রস জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি করতে। কর্মসূত্রে কলকাতায় থাকি তাই শীতলেই বাবাকে কিছু বলতে ইচ্ছা করে। মনে পড়ে যায় হারিয়ে যাওয়া সেই সব স্মৃতি।

জানো বাবা ব্যস্ততা জীবন কে অনেক কিছু ভুলিয়ে দিয়েছে।আনন্দ,উৎসব সব হয় তবে এই কলকাতায় নিয়ম মেপে জীবন চলে।তবে তোমাদের খুব মিস করি।মনে পড়ে শীতের দিনে মাঠের আলিপথ বেয়ে ধান গাছের মাড়িয়ে নদীর ধারে প্রজেক্ট এ তপন কাকার কাছে পড়তে যাওয়ার কথা।পা ভিজে যেতো শিশিরের আলতো স্পর্শে।ধানের শীশ স্পর্শ করে হাত ভেজাতাম,ফিরে এসে পুকুরে স্নান করার আগে মা সর্ষের তেল মাখিয়ে দিত সারা শরীর জুড়ে।অনেক ক্ষণ দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতাম।একবার জলে হাত,পা ভেজাতাম আবার তুলে নিতাম।কোন সময় অপেক্ষা করতে করতে এক ঝাঁপ দিয়ে জলে লাফিয়ে পড়তাম।আবার কোন দিন বোন ভাইয়েরা ঠেলে জলে ফেলে দিত। আবার  কখনো পথ চলতি প্রতিবেশীরা পিছন থেকে প্যান্ট টেনে খুলে দিতেই জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে গালাগালি দিতাম।কাঁপতে কাঁপতে উঠে এলে ঠাকুমা গামছা দিয়ে স্নেহ ভরে মুছিয়ে দিতেন।পান্তা আর বেগুন পোড়া আমার খুব প্রিয় ছিল।শুধু আমার জন্য সেই কোন শীতের ভরে উঠে ঠাকুমা  এর ওর বাগান থেকে বাগান দিয়ে বেগুন তুলে এনে পেঁয়াজ শুকনো লঙ্কা পোড়া কাঁচা পেঁয়াজ দিয়ে মেখে রাখত আমার জন্য আমি তৃপ্তি ভরে খেয়ে স্কুলে যেতাম তাতে কখনো কখনো পেট খারাপ করত তাতে কি ওটাই ছিল আমার কাছে অমৃত।মনে পড়ে কাকাদের পাশে শুয়ে জড়িয়ে ধরে গল্প শোনার জন্য খুব বায়না ধরতাম।তবে ঠাকুমার কাছে শুয়ে শুয়ে রূপকথা ঠাকুরমার ঝুলি ডাকাত রাক্ষসদের গল্প শুনতে শুনতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়তাম বুঝতেই পারতাম না।

এই শীতের সময় হলে খেজুর গাছের রস ও নলেন গুড়ের কথা।তুমি মাঠে করে এসেও প্রস্তুতি নিতে খেজুর গাছ কাটার। বাজার দিয়ে হেঁসো দা শান দিয়ে আনতে,সেই সঙ্গে মাটির কলসি।প্রতিদিন দুপুর বেলা সেই  হেঁসোদা একটা লম্বা এবং সমান কাঠের টুকরার উপর বালি দিয়ে ঘষতে ঘষতে চকচকে করে ফেলতে।

তারপর একটা কাছি নিয়ে কোমরে বেঁধে গাছ কাটা শুরু করতে।তার আগে খেজুর গাছে দুই তিন ধাপ লাঠি বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকার জায়গা প্রস্তুত করতে। গাছের ডাল কাটতে কাটতে শাশ ছাড়িয়ে নিচে ফেলতেই আমি ক্যাচ লুফে নিয়ে মহা আনন্দে খেতাম। আরো বোন ভাইরা ছুটে আসতো সেই ফল খাওয়ার জন্য। গাছের এক দিকটা সুন্দর ভাবে পরিষ্কার করে একটা বাঁশের নলি টুকে টুকে পুঁতে দিতে মাঝখানে। সেই নলি পথ বেয়ে গাছের রস মাটির ধুলায় মিশে যেত। মা সংসারের হাজার কাজ ফেলে মাটির হাড়িগুলোকে ভালো করে ধুয়ে উনানে তুষের আগুনের উপর দিয়ে রাখত। মাটির হাঁড়ির ভিতরে চুনের প্রলেপ দিয়ে দিত। বেশ কয়েক ঘন্টা পর দেখতাম সেই মাটির হাড়িগুলো রগ রগে লাল হয়ে গেছে। সেগুলি ঠান্ডা হতেই বাবা তারের গলায় দড়ি পরিয়ে পুনরায় গাছে উঠে সুন্দর ভাবে বেঁধে দিয়ে আসতেন। কোন কোন দিন সন্ধ্যার সময় খেজুর গাছের রস খাব বলে সেই হাড়ির মুখটা সুন্দর ভাবে ঢেকে দিয়ে আসতে।রাতে টিউশন দিয়ে ফিরে এসে দেখি বাবা রসের ভাড় নামিয়ে এনেছে গাছ থেকে।ভাত খাবার পর সেই রস খেয়ে ঘুমিয়ে যেতাম ঠাকুমাকে জড়িয়ে ধরে।

খুব ভোরে বাবা গাছ দিয়ে রসে ভর্তি মাটির হাড়িগুলো নামিয়ে এনে বালতি কিংবা হাঁড়ির মধ্যে রেখে দিত। আমরা ঘুম থেকে উঠে ঢাকনা খুলে আঙ্গুল ডুবিয়ে মুখে পুরে নিতাম। সকালে টিউশনি পরে বাড়ি ফিরে দেখতাম মা রান্না বান্না সেরে উনারে রস জ্বাল দিত।স্কুল থেকে ফিরে সারা বাড়ি খেজুর গুড়ের গন্ধে পেতাম।ভাত খাওয়া বাদ দিয়ে বাটিতে করে গুড়ের মধ্যে মুড়ি ডুবিয়ে মহা আনন্দ করে খেতাম।ঘরের কোনে মাটির হাড়িতে গুড় ভরে  টাঙিয়ে রাখত ভারায়।চুরি করে খেতে গিয়ে কতবার যে কাল মোলা খেয়েছি বাবার কাছে। যেদিন বাড়িতে থাকতাম সেদিন ফুটন্ত রসে আলু বেগুন ফেলে দিতাম।সিদ্ধ হলেই তুলে নিয়ে ভাতের সঙ্গে মেখে খেতাম। নতুন ধান ঘরে উঠলে সুগন্ধি চালের পায়েস বানিয়ে দিত গুড় দিয়ে। তার মধ্যে থাকতো কাঁচা বাদাম আর গাছ থেকে পাড়া ঝুনা নারকেলের কুচি। কি দারুন স্বাদ যেন আজও মুখে লেগে আছে।সেই গুড় দিয়ে মা নারকেল,তিল আর মুড়ির নাড়ু বানাতেন।আর বানাতেন

বাদাম ছাপা।মাটির হাড়িতে রাখা গুড় বেশ কিছুদিন পর চিনি বসে যেত।সেই চাঁই যে কি সুস্বাদু যে না খেয়েছে সে বুঝতেই পারবে না। আমি সবকিছু চোখের সামনে দেখেছি।আজ যেন সব কিছু নস্টালজিয়া।ছুটি পেলে কখনো কখনো গ্রামের বাড়িতে ফিরে যাই। কিছু খেজুর গাছ আছে আবার কিছু নেই।তাদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে চোখে জল ভরে আসে।মুছে যাওয়া কত স্মৃতি তাদের দেখলে আবার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। বোন দিদিদের বিয়ে হয়ে গেছে ভাইরা অনেকেই বাড়ির বাইরে কর্মসূত্রে।সবকিছুর মধ্যে কেমন যেন হাহাকার, বিষাদের সুর। বিশ্বাস কর বাবা মাঝে মাঝে বুকের ভেতরটা হাহাকার করে ওঠে মনে হয় সবকিছু ছেড়েছুড়ে আবার গ্রামে ফিরে যাই।খেজুর গাছ,তালগাছ,নারকেল গাছ, বটগাছ গুলোকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে। প্রাণ খুলে ঘন্টার পর ঘন্টা পুকুরে সাঁতার কাটতে ইচ্ছে করে। কলা গাছ কেটে মান্দাস বানিয়ে খালের এপার ওপার ভেসে বেড়াতে খুব ইচ্ছে করে।যখন একা একা গাছগুলোর পাশে দাঁড়িয়ে থাকি তখন মনে হয় বোন ভাইয়েরা পিছন থেকে দাদা দাদা বলে ডাকছে।কিন্তু আমার ইচ্ছে গুলো আজ কেমন সব বন্দি হয়ে গেছে। তোমরা ভালো থেকো। তোমার বয়স হয়েছে আর খেজুর গাছ কাটতে যেও না।গুড় খাওয়ার ইচ্ছে হলে বাজার দিয়ে কিনে নিয়ে এসো। সময়ের কাছে যেমন আমরা বৃদ্ধ হয়ে গেছি ঠিক তেমনি বাবার আজ বৃদ্ধ। খেজুর গাছের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

যে উৎসবে গ্রাম বাংলার মানুষ মেতে ওঠে তার নাম  পৌষ সংক্রান্তি বা পৌষ পার্বণ বা নবান্ন।বর্ষাকালে যে স্বপ্ন তারা মাঠে বুনন করে আসে,তার ইতি টানে নবান্ন বা পৌষ পার্বণে। সোনালী ধানের থেকে তৈরি আতপ চাল দিয়ে আলপনায় ভরিয়ে তোলে দালান বাড়ি আঙিনা। নতুন চাল গুঁড়ো করে ভিন্ন পিঠা তৈরি করার ধুম পড়ে যায়।পৌষ পার্বণ বাংলার জনপ্রিয় প্রাচীন সংস্কৃতি। আর মকরের গঙ্গাস্নান মানে কপিল মুনির আশ্রম। সব তীর্থ  বারবার গঙ্গাস্নান একবার। এই আদুরে মনা শীতের সময় আপনাকে যে কপিল মুনির আশ্রমে আসতেই হবে একবার। বহু মানুষ ও মনীষীদের আগমনে কপিল মুনির আশ্রম প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। কপিল মুনি আশ্রম এই বাংলার অহংকার, গর্ব।

তবে একদিকে যেমন আলো অপরদিকে তেমন অন্ধকার, ঠিক শীতের আগমনে বনভূমিতে শুরু হয় হাহাকার। মালতীলতা পত্রশূন্য,ঝুমকো লতা তার রং ফুরায়।তবুও হাড় কাঁপানো শীতের মধ্য দিয়ে কুয়াশাচ্ছন্ন শিশির ভেজা র  মধ্যে আছে প্রকৃতির মাধুর্যতা। এই শীতের সময় গ্রামে-গঞ্জে নানা মেলা,পার্বণ উৎসবের ধুম লেগে যায়। ঘন কুয়াশার বুক চিরে সোনালী আলোর জন্য অপেক্ষা করতে করতে কতটা সময় চলে যায় ঠিক বুঝতে পারা যায় না। রৌদ্র ঝলমল পরিবেশে রোদে গিয়ে বসে পরম সুখ ভোগ করা মধ্যে অনাবিল আনন্দ। এই শীত কৃষক পরিবারে আনন্দের বার্তা বয়ে নিয়ে আসে। মা লক্ষ্মীর আশীষ সোনালী ফসল মাঠ থেকে ঘরে ফেরার পালা। তবে কথায় আছে কারো" পৌষ মাস তো কারো সর্বনাশ"। শীতের সুখকর অনুভূতি মাঝেও দুঃখের বার্তা বয়ে আসে হতদরিদ্র পরিবার গুলির মাঝে।কলকাতার ফুটপাতবাসী সহ এমন বহু পরিবার আছে যাদের কাছে লেপ-কম্বলের সুখকর বিছানা শুধু স্বপ্ন। যাদের হাড় হিম করা রাত কাটে পাতলা কাপড় গায়ে দিয়ে, নয় তো  খড় কুটো গাছের ডালপালা দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে, তারই পাশে বসে বসে কেটে যায় অগণিত কত রাত। অপেক্ষা করে সূর্যের প্রখর উষ্ণতার জন্য, সূর্য তাদের কাছে এক সুখের জগত। শীতের বিদায়ের অপেক্ষায় মগ্ন থাকে, এ অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে চায়।


রম্য রচনা 

অন্য ভুবন 
স্বপন কুমার দত্ত 

ছেলেবেলায় ভুবন প্রায়শই পাঠশালা থেকে বই, খাতা, খড়ি ইত্যাদি চুরি করে নিয়ে আসতো। ভুবনের মাসী তা দেখেও না দেখার ভান করতেন। এর ফলে ভূবনের চৌর্যবৃত্তি ক্রমে ক্রমে থাকে বাড়তে।

        কিন্তু কথায় আছে, " চোরের বারো মাস, গৃহস্থের একদিন।" ভূবন চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে এবং অবশেষে কারাবাস।

        এবার ভূবনের ভুল ভাঙে। তার সাথে তার মাসী দেখা করতে এলে সে মাসীকে কানে কানে কথা বলে কাছে ডাকে। গরাদের দরজার পাশে মাসী কান লাগালে ভূবন বলে, " মাসী, আমার আজ এ অবস্থার জন্য তুমিই দায়ী। ছেলেবেলায় যখন আমি পাঠশালা ফেরৎ নানা জিনিষ নিয়ে আসতাম, তখন তুমি বাধা দেওয়া দূরে থাক, প্রশ্রয় দেওয়ায় আজ আমার এই দুরবস্থা।" এই কথা বলে এক কামড়ে মাসীর একটা কান ছিঁড়ে নেয়। 

বিদ্যাসাগর মশায়ের এই নীতি শিক্ষা মূলক গল্প আমাদের সকলেরই জানা। কিন্তু আজ এক ভূবন নয়, এমন হাজারো ভূবন ঘুরে বেড়াচ্ছে সর্বত্র -- একথা বিদ্যাসাগর মহাশয় দেখে যেতে পারলেননা। শুধু কী তাই ! এখনকার ভূবনদের চৌর্যবৃত্তিতে হাত পাকানোর জন্য আর ছেলেবেলা থেকে করতে হয়না অভ্যাস। শুধু ধরতে হয়,কোন একটি বড় দলের ছত্রছায়া। তাদের অভয়বাণী সঙ্গে থাকলেই ষোলকলাই পূর্ন। মনের আনন্দে
তখন ' ডু ইয়োর ওউন ওয়ার্ক ইন ফুল সুইং"।
         অবশ্য সেই দলও যদি ক্ষমতাচ্যুত হয় তবুও নেই কুছ পরোয়া। পাল্টাও জার্সি, পাল্টাও ছাতা। একেবারে হার মানাও গিরগিটি কে। মনের আনন্দে তখনও ভূবনরা গায়, " ছাতা ধর হে নেতারা, এইসান সুন্দর কাম হামার মারা যাইছে।" বাস্‌, আর কী? সব ফিটফাট। আলোয় দীপ্ত মান ভূবনদের আর কে ধরে?
          এখন আবার এই জমানায় চুরিরও  হয়েছে উন্নয়ন।এখনতো ওটা পেয়েছে ভদ্রতার তকমা। এখন চুরির পরিবর্তে সর্বত্র শুনবেন " কাটমানি"। তা সেটা বেসরকারী আর সরকারি। সব কিছুতেই চাই ভাগ। খুব জোর ধরা পড়লে ফেরত দিয়ে দাও কাটমানি। আর কিছু হবেনা । না আইন আদালত, শাস্তি তো দূর অস্ত। 
              এখন ভাগ্যিস বিদ্যাসাগর মহাশয় বেঁচে নেই। বেঁচে থাকলে ভূবনদের কীর্তি দেখলে নির্ঘাত খেতেন ভিরমি। হাতে নাতে ধরা পড়েও এরা ঠোঁট মুছে নেয় নোংরা খাওয়া কাকের মতো। এর পড়েও যদি ঘ্যাক করে কেউ ধরে ফেলে, তখন অসুখের ছুতোয় হেটকী মেরে, দাঁত কপাটি লাগিয়ে ভর্তি হয় হাসপাতালের বেডে। জেলখানা নৈব নৈব চ। ওখানে ইঞ্জেকশন, স্যালাইন প্রয়োজনে অক্সিজেন ও মধুরং মধুরং , কিন্তু " গারদের ভেতরে, ওরে বাপরে"। মনে হয় যেন আজকের ভূবনদের সংশোধনাগারের নাম শুনলে পাগলা কুকুরের কামড়ের থেকেও হয় খারাপ অবস্থা। 

           আরও বলি, বিদ্যাসাগর মশায় আপনার ওরকম নীতিশিক্ষায় কী কাজ হল কে জানে? মনে হয় একেবারে পন্ডশ্রম। এখনকার ভূবনরা এসব কুকর্মে হাত পাকিয়ে ও বহাল হয় উন্নত পদে,উন্নত ক্ষমতায় এবং বৃহত্তর সামাজিক জীব হিসেবে হয় প্রতিষ্ঠিত। এখন তাদের আর কারোর কান কামড়াতে হয়না। একটা প্রবাদ আছে," যার এক কান কাটা সে যায় পাড়ার বাইরের সীমানা ধরে আর যার দুকান কাটা সে যায় পাড়ার ভিতর দিয়ে বুক টান করে। তাই আজকের ভূবনদেরও ঘটেছে উন্নয়ন, পরিবর্তন এবং পরিবর্ধন।

            কিন্তু অবাক কান্ড  সেই বোকা জনতার ভুল ভাঙে না এই ভূবনদের কার্য্য কলাপ দেখে এক ভূবন ছেড়ে পিছনে ছোটে অন্যভূবনের। কিন্তু কবে আসবে, সেই সত্যিকারের অন্য ভূবনদের আবির্ভাব, কে জানে? কে দেবে তার সদুত্তর ।




কবিতার এই প্রজন্ম 

দুটি কবিতা

রথীন পার্থ মণ্ডল 

১. সময়

এপাড়ে আমি

ওপাড়ে তুমি

মাঝখানে শুধু বয়ে যায় 
সময় নামের নদী

যার হাত ধরে ফিরতে চাইলেও
ফেরার অপেক্ষায় থেকে যাই এখনও।।

২. পক্ষপাতিত্ব

অনেক তো পক্ষ নেওয়ার খেলা হল
পক্ষপাতিত্বের খেলাও তো অনেক হলো

যুগ যুগ ধরে চলে আসা 
পক্ষের খেলা 
পক্ষপাতিত্বের খেলা 
মিটে যাবার অপেক্ষায় বসে থাকি 
আজও চাতক পাখির মতো

তবুও এ খেলা সহজে মেটে কি, শিউলি?


শুরু হোক পথচলা
অলকানন্দা দে 

খানে তো প্রবঞ্চনা জমাট বেঁধে থাকে
কতদূরে আছে পিয়ালী নদীর বাঁক
বৈরাগী গানে গুমোট ভাঙে একতারা-সুখী বাউল
অমীমাংসিত দুঃখরা পড়ে থাক।

অভিমুখে হাঁটা শুরু করে দিই চলো
উড়ে যাওয়া মেঘ বিপুল প্রণয় প্রতীক
বৈরিতাহীন মানচিত্রে ভাবাবেগ আশ্বাস
হাতে হাত রেখে পৌঁছে যাব, দিব্য যোজন ঠিক!

আশার কপাট উন্মুখ রাখি প্রিয়
হৃত হৃদয় ব্যর্থ হবে না জানি
স্বপ্নের বীজ ছড়িয়ে যাব ভেজা জমিনের দেহে
মনীষী রৌদ্রে শুনি বাতাসের ধ্বনি।

মধুকূপী ঘাস কাঁঠালে জারুলে প্রাণ
মানবীয় সুখে জীবনানন্দ সাথী
সাধু সংসারে আশাই অভিভাবক
তারার আখরে গাঁথা বিশোধিত রাতি!



রাতের আকাশ
রূপক রায়

এখনো ফেরেনি আমার কাছে
সেই কবে এসেছিল_
তোমার অপেক্ষায় সবাই
শেষ ন'টা পনেরোর ট্রেনটা চলে গেল
আজও ফেরা হল না বুঝি,...

দেখো আকাশের দিকে চেয়ে
ওই যে দূরে যেখানে একটু পর সূর্য উঠবে
কত সুন্দর, যেন সেও তোমার অপেক্ষায়
যেন বলছে- ঘুমিয়ে যাও রাত প্রহরী
পৃথিবীতে দুঃখ চুরি হয়না,
ফিরবে না বলো আর
কত দিন কত রাত কত বছর কত শতাব্দী
ওরা ফেরে না ফিরবে বলেও
কেনো মিথ্যে স্বপ্ন দেখাও
কেনো ভালোবাসো সব কিছু ভুলে
কেনো হারিয়ে যাই
কেনো ফিরতে পারিনা আর
অপেক্ষমান সবাই
ঘুমের পাখিরাও

কত নদী শুকিয়ে গেছে জোয়ারের আশায়
কত নদী ভরে গেছে জোয়ারে জোয়ারে
কত পাতা ঝরে গেছে
ফিরে এসো
তবু আর একবার ভালোবেসে
তোমার নদী নয়তো হারিয়ে যাবে একদিন।


নতুন সকাল
রীতা মোদক

তুমি ঘড়িটা ভেঙে দিয়েছো
কাঁটা থেমে গেছে
সময় তো থামে থাকেনি
কালের নিয়মের বাইরে যাবার সাধ্য কার?

তুমি মন ভেঙে দিয়েছো
আমার বাগানটা ক্ষণিকের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেছে
কিন্তু ,ভালোবাসা তো মুছে যায়নি
যুগ যুগ ধরে সঞ্চিত ভালোবাসায়
তৈরি করেছি  -----একটা আস্ত পৃথিবী।

তুমি আলো নিভিয়ে দিয়েছো,
অন্ধকার দিয়েছো ঢেলে
মুক্ত আকাশের দিকে তাকাও---
দেখো  কত তারা উঠেছে আঁধার ঠেলে।
তেমনি আমি সকল  বাঁধা কাটিয়ে
শুধু ভালবাসার জোড়ে
বিন্দু বিন্দু আলো দিয়ে
তৈরী করবো -- একটা নতুন সকাল।



রাজবাড়ী
সৈকত দাম

নতুন বছর আসে না ,
এই রাজবাড়ীর দেয়ালে .....
সান্তা বুড়ো ঠক ঠক করে না ,
এই রাজবাড়ীর দরজায় .....
একটা কাঠ ঠোকরা বসে আছে ,
সামনের বুড়ো গাছে ....
রাতের নিস্তব্ধ নিঃশব্দ ভেঙ্গে ,
শুধু আঘাত হানে তাতে .....
এখানে নেই কমলা লেবুর ডিসেম্বর ,
নেই পলাশের মার্চ ,
যদি জানতেই হয় কেমন আছি ,
দেয়ালে জড়ানো বটের শেকড়কে ছুঁয়ে দেখো ....
অবশ্য যদি জানতে চাও .....
দীর্ঘ শীতের দীঘল বন পেড়িয়ে ,
কুয়াশা জড়িয়ে জড়িয়ে ,
এ পথ কেউ মাড়ায় না .......
তবু নতুন বছর এলে কেঁপে কেঁপে ওঠে রাজবাড়ী ,
সামনের জলাশয়ে ......
যেভাবে কেঁপে ওঠে বন লক্ষ্মীর পাঁচালীতে .....
যেভাবে বসন্ত বাতাস লাগে , সিড়ির পাতায় ,
নিঝুম গলিতে ......
কারণ শীতের রোদ ছুঁয়ে যায় কমলা লেবুর শরীর ,
শরীরের উপশিরা .....
নতুনকে ভালোবাসে ওরা ,
মরতে মরতে ভালোবাসে ,
ফুরোতে ফুরোতে ভালোবাসে ,
আর তুমি, আমি সব অবহেলা পারি ,
একদিন মন বিবাগী ,
সময়ের নাম রাজবাড়ী .........



প্রথম দিন
আকাশলীনা ঢোল

ইংরেজি বছরের প্রথম দিন আমি,
আমার জন্ম হয়েছিল, পৌষের কনকনে ঠান্ডায়
নগরের নামজাদা পাঁচতারা হোটেলের
পাঁচতলার একটি ঘরে -
কিন্তু, আমার মা-বাবা ছিল না,
তাই শোক করার মতো বিষয় থেকে
আমি চিরদিনের জন্য মুক্ত।
জন্মেই আমি পা রেখেছিলাম নগরের রাজপথে -
চারিদিকে তখন আলোর রোশনাই,
আতস বাজীর শব্দ, গান, উৎসব আর উৎসব।
আমার আগমনে সকলের প্রাণে যেন আনন্দের জোয়ার,
ভুল ভাঙল খানিক পরেই -
যখন দেখলাম আমার মতোই সদ্যজাত
বস্ত্রহীন অবস্থায় পড়ে আছে ফুটপাতের এক কোণে,
যখন দেখলাম মুমুর্ষু মানুষটি কাতরাচ্ছে ক্ষুধার তাড়নায় -
যখন দেখলাম নামী-দামী হাসপাতালের করিডোরে 
রোগীর বাড়ির লোকের হাহাকার আর 
উৎসবে সামিল হতে না পারা স্বাস্হ্যকর্মীর বাড়ির লোকের আর্তনাদ -
যখন শুনলাম কচি শিশু কন্ঠের কান্না,
ভুল ভাঙল ঠিক তখনই।
আমি, বছরের প্রথম দিন -
নগরের পথে হাঁটতে হাঁটতে বুঝেছিলাম
কিছু মানুষের জীবনে এই আনন্দ উৎসবের
ছিটেফোঁটাও পৌঁছয়নি -
তখন বুঝেছিলাম, বছর বদলায়, জীবন নয়।



নতুন সকাল
রবিনা সরকার

ফেলে যাওয়া দিনগুলো থেকে যায়
ধূলোমাখা স্মৃতিদের ভিড়ে,
সময় দ্রুতগতিতে ছুটতে ছুটতে
মলিন হাসির ফাঁকে লিখে যায় নতুন সকাল।
শেষরাতের কান্না যখন দাগ কাটে,
ঠিক তখনই গভীর অন্ধকারের পর
আবছা আলোর সঙ্গে ভোর আসে, ভরসা পাই।

আমার জীবনে সেই সকাল
এক দীর্ঘশ্বাসের পর নতুনের সৃষ্টি,
সেই সকাল এক চিলতে রোদের সমাবেশ।
আমার কাছে সেই সকাল
জানালার কাঁচে জমা বৃষ্টি ফোঁটা,
সেই সকাল ঘুরে দাঁড়ানোর পালা।
সেই সকাল স্বপ্ন সত্যি হবার সূচনা,
আমার কাছে সেই সকাল
কংক্রিট এ জন্মানো সদ্য ফুটে ওঠা ফুলের মতো।




বাংলা আমার 
শাহীন খান

বাংলা আমার কাব্য গাঁথা বাংলা আমার মা
কি যে ভালোবাসে আমায় হয় না তুলনা।

তার মাটিতে হাঁটি আমি তার বাতাসে বাঁচি
রক্ত জুড়ে আছে সে যে বুকের কাছাকাছি।

ফাগুন রাতে জোছনা মাতে মাতে চাঁদ ও তারা
জোনাক পোকা দেখে আমার হৃদয়  মাতোয়ারা ।

বর্ষা খরায় শরৎ কালে ফোটায় যখন ফুল
গন্ধে আমি দিশেহারা ভ্রমর হয় আকুল!

অগ্রহায়ণে ফসল ফলে পৌষে মাঘে শীত
পিঠা পুলির আয়োজনে গায় বঁধূরা গীত।

সব মিলেয়ে বাংলা মাগো জাগাও প্রেরণা
যদি কভু অবাধ্য হই আমায় ছেড়না।

লক্ষ্মী মায়ের মতো তুমি শাসন করো মোরে
আমায় তুমি বেঁধে নিও স্নেহের প্রীতিডোরে।



উদাসিনী 
সালমা আক্তার চাঁদনী

জীবনময় উদাসীনতা নিষ্ঠুরতার কাহিনী, 
করাঘাতে ফেঁসে গিয়ে তৈরি করে বাহিনী। 

নিজে নয়তো ভালো কিছু অন্য জনের ও চায়না,
পরের ওপর চড়ে বসলো করলো আবার বায়না।

ভালো নই কেনো আমি? পরের তরে জীবনে,
বুঝবেনা তবুও তারা গতি নাই তাদের মরণে।

বুঝতে চায়না পৃথিবীতে বাস্তবতার ঢেউ, 
মনে করে আপন কেনো হয়না তাদের কেউ!

আপন কি ভাই স্বাদে হয়! কর্ম জীবন  দেখে,
চলে তারা আপন মনে কাজের গতি দেখে।

কাজ করে যাও নিরলসভাবে অলসতা রেখে,
দেখবে তোমায় বাসবে ভালো জগৎবাসী দেখে।



তুমি আসবে বলে
 সুমন্ত সরকার

তুমি আসবে বলে আকাশ মেঘলা
বাতাসে হিমের ছোঁয়া, 
তুমি আসবে বলেই
শারদের কচি ধান রোয়া। 
তুমি আসবে বলে 
আকাশে পাখিরা গান গায়, 
তুমি আসবে বলেই
ব্যথার মলম লাগিয়েছি হাতের ঘায়।
তুমি আসবে বলে 
মাঠে কাশেরা খায় দোল,
তুমি আসবে বলেই
বাতাসে ঢাকের বোল।
তুমি আসবে বলে 
নয়নতারা ফুটেছে সকালে,
তুমি আসবে বলেই
শিশুরা খেলছে মায়ের কোলে।
তুমি আসবে বলে 
মায়েরা শাঁখ বাজায়,
তুমি আসবে বলেই
সবাই বরণডালা সাজায়।
তুমি আসবে বলে
সবাই মেতেছে আনন্দে,
তুমি আসবে বলেই
পড়াশুনা ছেড়েছি সানন্দে।



মনের বাসনা
সন্দীপন দাস


পড়ন্ত বিকেল!!
রোদ্দুরের শেষ সীমানায়,
আবছা ঘনঘটায়
তোমাতে মায়াচ্ছন্ন'
এই অধম।।

 ছুঁতে চাই যতই বারবার;
তোমাকে, পারিনা তব!
তবুও মন শুধুই চায়
তোমাকে ঘিরে;
মরীচিকার বালুকামায় তীরে।।
দিবস রজনীর মাঝে
একলা আমি;

সুদূরের পথের কিনারায় 
মন যে যায় চলে
ধরাতলে।।
তোমার চোখের আড়ালে
ভেসে ওঠে মোর প্রীতিলতা
অদূরই তুমি, তুমি অগ্রগণ্য,
সত্যি বিশ্বকর্তার সৃষ্টির কাছে
সবই নগণ্য।।






মুজনাই অনলাইন পৌষ সংখ্যা ১৪৩০