সম্পাদকের কথা
সারা বিশ্ব এখন মেতে উঠেছে ফুটবলে। খুব স্বাভাবিক ব্যাপার এটি। চার বছর পর পর বিশ্ববন্দিত খেলোয়াড়দের একসঙ্গে দেখবার এত বড় সুযোগ তো আর হয় না! তাই খেলা এরকম নিয়ে উৎসাহ-উদ্দীপনা চলবেই। চমক দিয়েছে আয়োজক মরু-রাষ্ট্র কাতারও। এত ছোট্ট দেশ, অথচ কী নিদারুন আয়োজন। এত আনন্দের মাঝে অবশ্য একটি কাঁটা সবসময় খচখচ করে। সেটি হল, নিজের দেশের এই মঞ্চে সুযোগ না পাওয়া। আমাদের অনেকের জীবদ্দশায় এই সুযোগ হয়ত হবেও না। কেন আমাদের দেশ সুযোগ পায় না তার নানা কারণ থাকতে পারে। সেই বিশ্লেষণ থাকে। আপাতত বিশ্ববাসীর সঙ্গে আমরাও রয়েছি দর্শক হিসেবে।
মুজনাই অনলাইন অগ্রহায়ণ সংখ্যা ১৪২৯
রেজিস্ট্রেশন নম্বর- S0008775 OF 2019-2020
হসপিটাল রোড
কোচবিহার
৭৩৬১০১
ইমেল- mujnaisahityopotrika@gmail.com (মাসিক অনলাইন)
- mujnaiweekly@gmail.com (সাপ্তাহিক)
প্রচ্ছদ ছবি পরিচিতি - ধান ঝাড়াইয়ের কাজে টোটো রমণী
প্রচ্ছদ ছবি- শৌভিক রায়
প্রকাশক- রীনা সাহা
সম্পাদনা, অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায়
মুজনাই অনলাইন অগ্রহায়ণ সংখ্যা ১৪২৯
এই সংখ্যায় রয়েছেন
চিত্রা পাল, ঋতুপর্ণা বসাক দাশগুপ্ত, বেলা দে, শ্রাবণী সেনগুপ্ত,
গৌতম চক্রবর্তী, বাপ্পা সরকার, পার্থ বন্দোপাধ্যায়, রীতা মোদক,
বিনয় বর্মন, অপর্ণা দেবনাথ, রূপক রায়, সুদীপ দাস,
মাথুর দাস, মজনু মিয়া, সৈকত দাম, সারণ ভাদুড়ী, সুনন্দ মন্ডল,
বটু কৃষ্ণ হালদার, সোমনাথ বণিক, রিসা দাস
মুজনাই অনলাইন অগ্রহায়ণ সংখ্যা ১৪২৯
ক্রোড়পত্র: হেমন্ত ও শীত
হেমন্ত ফুরায়ে যায়
চিত্রা পাল
এসে গেলো মনোরম দিন, আর কোমল রাত। হ্রস্ব দিন দীর্ঘ রাত। ফসল শূন্য প্রান্তরে পড়ে থাকেফসল তোলা গোড়া। শীত মাঝে মাঝে এসে বেশ ঝান্ডা ঘুরিয়ে যায়, পিঠোপিঠি একটু বড় দাদা দিদির মতো।প্রতি পুজোয় যেমন বিজয়া মিশে থাকে, তেমনি হেমন্তে মিশে থাকে শীত। একটু ঈশারা পেলেই উইংস-এর আড়াল থেকে মঞ্চে প্রবেশ করবে সদর্পে। মাঝে মাঝেই চলবে শিশির কুয়াশার হাতে হাত রেখে চলা। মাঠের ফসল ঘরে তোলা হলে কত রঙীন বাসনারা উঁকি দিয়ে যায় মনের মাঝে। কিছু রূপ নেয়, কতক ভোরের কুয়াশার মতো মিলিয়ে যায়। তবু বুদবুদের মতো জেগে ওঠে সেই সময়ের পটে। হেমন্ত আসে তার ফসলের সম্ভার নিয়ে। সে সম্ভারে মিশে থাকে দীর্ঘ সময়ের কত শ্রম স্বেদ সামর্থ্য। তাতে লক্ষ্য থাকে আগত দিন যেন হয় সুসামঞ্জস্য। জীবনের চলার পথে হেমন্তের আসা অত মসৃণ হয় না। উঁচু নীচু নিক্তিমানও থেকে যায়। কত নিরুপম সূর্যালোক মিশে গেছে অন্ধকারে।প্রতিশ্রুতির পথ থমকে দাঁড়ায় সময়ের কুয়াশায়। ফসলের চিহ্ন নিয়ে পড়ে থাকে প্রান্তর।ফসল চলে যায় সাগরের ওপারে।স্বেদ রক্ত ঘামের বিনিময়ে যে হেমন্ত এসেছিলো আমাদের আঙ্গিনায় সেই হেমন্ত কি ফুরিয়ে যায় কে জানে।
হারিয়ে যাওয়া শীতকালের সেইসব গল্পগাথা
গৌতম চক্রবর্তী
ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে দিয়ে আগুন জ্বালানোর জন্য আমাদের ছোটবেলায় আসতো শীতকাল। আর তখন থেকেই তোড়জোড় শুরু হত শীতকালকে আমন্ত্রণের। সেই তখনকার শীতকালে ত্বকের যত্ন নেওয়া দিনে পিয়ার্স সাবানের গন্ধে আমাদের বেঁচে থাকার গল্পগুলো আজ রূপকথা। স্নান করতে যাওয়ার আগে নারকেল তেল গলিয়ে নেওয়ার জন্য আমরা রোদের কাছে, উনুনের পাশে গিয়ে দাঁড়াতাম। এখনকার প্রজন্মের মনে হবে “কি গেঁয়ো ভুত” রে বাবা! প্রতিবার ভাবতাম পুজোর আগে কুল খাবো না। কিন্তু শেষ রক্ষা হত না কিছুতেই। ইট দিয়ে কুল পাড়ার মজা ছাড়া যায়? যায় না বলেই পকেটে পকেটে ভর্তি থাকতো কাঁচা পাকা কুল। এখনকার প্রজন্ম ভাববে “কি রে বাবা, কুল আবার খাওয়ার বিষয় হল”? “তার জন্য এত কিছু”? আচারের শিশির গায়ে রোদ পড়তো আর আমরা ছোটরা, খুড়তুতো, জেঠতুতোরা লোলুপ চোখে তাকিয়ে থাকতাম। আর ঠিক এই সময় ধীরে ধীরে বসন্ত পঞ্চমী' নামটি বুঝিয়ে দিত রং লেগেছে বনে বনে, ঢেউ জেগেছে সমীরণে। একদিকে সার্কাসের ট্র্যাপিজের খেলা দেখতে দেখতে মনে হতো জীবনের আসল রং খুব সম্ভবত অ্যাডভেঞ্চার, আবার স্কুল থেকে সরস্বতী পুজোর স্বেচ্ছাসেবক হবার প্রতিযোগিতাও ছিল জীবনের আর এক ধরনের অ্যাডভেঞ্চার। মেয়েদের স্কুলে কে কে কার্ড দিতে যাবে এই নিয়ে কত রঙ্গরস! কাঁধে ব্যাগ, চুল উড়ছে, হিরো সাইকেলে চড়ে হাতল ছেড়ে হিরো হওয়ার বাসনাতে যেন দিগবিজয় করে ফিরতাম। গার্লস স্কুল থেকেও কেউ কেউ আসত মাঝে মাঝে। বুকের ভেতর কেমন একটা হত যা খালি চোখে দেখা যেত না। একটু উঁকিঝুঁকি, সামান্য চোখাচোখি। ঘুরে ফিরে তাকানোর পঞ্চমী প্রহর। নতুন শাড়ি সামলে নেওয়ার বয়ঃসন্ধি। আসলে প্রত্যেকের জীবনেই কিছু 'অকথা' থাকে। বন্ধুরা সে কথা জানবেই। স্কুলের পুজোর দ্বাদশ শ্রেণী। সারস্বত উৎসব। পরিবেশনের দায়িত্ব। সে আসে ঠিক। নিজের হাতে খেতে দিই। স্যার বলেন দেখে দিবি কিন্তু। হ্যাঁ দিই তো। প্রসাদের সঙ্গে সন্দেশ দিই। হাতে একটু ছোঁয়া লাগে। এক পলকে দুজনের দেখা। সে সময়কাল শীতকাল।
কত কবি বন্ধু ছিল
সেইসময় আমার ক্লাশে তা কি জানতাম? কার মধ্যে কি সুপ্ত প্রতিভা আছে কি করে জানবো? বঙ্কিমচন্দ্রের
বাবু পড়াবার সময় নির্মলবাবু মজা করে মদনকে বলেছিলেন ‘বলতো মদন, ‘মদন আগুণ কি’? মদন
অবলীলাক্রমে বলেছিল ‘মদন আগুণ’ হল এমন আগুণ যা বালতি বালতি জল ঢাললেও নেভে না’। সেই
মদন বাসন্তীকে চিঠি লিখল ‘পলাশ ও শিমূল পাশাপাশি / আঙ্গুলে শাড়ির খুট, লজ্জা…… ভালোবাসাবাসি’।
এটা নিয়ে কয়েকদিন বন্ধুমহলের জমজমাট আলোচনা ক্রমে ক্রমে জমে ক্ষীর। মদন-বাসন্তীর এখন
এক ছেলে এক মেয়ে। অশোকবাবুর কাছে পড়তে যাওয়ার সময় যখন সাইকেলের বেল বাজাতাম তখন সোহারই
মোড়ের সেই সাদামাটা মেয়েটা, যার নাম ছিল বীণা, কেন যে ভালো লাগত আমিও জানি না, চোখের সামনে ঝুঁকে থাকা অবাধ্য চুল কানের পাশে
তুলে রাখত। সে জেনে যেত এবং বুঝে নিত বেল বাজিয়ে যে আসছে পেছনে
না তাকালেও দেখা যায় সেই আসা। আচ্ছা সাইকেলের বেলেরও কি মোবাইলের মত ভিন্নধর্মী রিংটোন ছিল
নাকি? কোনদিন শাড়ি পড়তো, আবার কোনদিন সালোয়ার কামিজ। আমার এক বন্ধুর কাছে যখন বলেছিলাম
শাড়ি পড়লে মেয়েদের বড় বড় লাগে তখন ‘প্রেমিকার
বুকের সেফটিপিন' কবিতা লিখে ফেলে সেই কবি বন্ধু সাহিত্য মহলে জবরদস্ত মুরগী। শাড়ি
আসলে খুবই সংক্রামক। আসলে আমাদের অনেকের জীবনের ভালোবাসার বর্ণমালার
প্রথম প্রকাশ ঘটেছিল এইসব শীত বিকেলে। আমরা
মফস্বলের মাঠ জুড়ে স্বপ্ন ফেরি করতাম। হাফ সেঞ্চুরি অতিক্রম করা এই
বয়সে ডাকাবুকো প্রেমিকের দলকে কেউ
মনে রাখে কিনা এইকথা ভাবতে ভাবতেই ছোটবেলার মুগ্ধতা ভিড় করে আসে চোখের পাতায়। বাণী
বন্দনার শীতসকালে অঞ্জলি দিতে গিয়ে হৃদয়ে অবাধ্য ছেলে কার মুখ ভেবেছিল মন কি তা
জানে? মনের গতিবিধি বোঝা দায় যে।
শীত এলেই সন্ধেবেলায় এলাকার ছোট খালি জমিতে ব্যাডমিন্টন খেলা হত অনেক জায়গাতেই। শীতের শীতলতাকে চ্যালেঞ্জ জানাতেই যেন সন্ধেবেলায় এই ঘাম ঝরানোর আয়োজন। আমরাও খেলতে যেতাম। শীতের গোটা সময়টাই সান্ধ্য এই খেলা চলত। শীতের শেষভাগে কোন টুর্নামেন্ট আয়োজন করে খেলার পাট চোকানো হত সে বছরের মতো। নেটের দুই প্রান্তের খুটির মাথায় বোর্ডের বালবগুলো জ্বলে উঠতেই চারপাশ আলো আঁধারির মধ্যে ঝলমল করে উঠত রাতের ব্যাডমিন্টনের কোর্ট। না, এখন আর চিলতে জমি ফাঁকা পড়ে থাকে না, মাটি ফুঁড়ে সেখানে বিল্ডিং গজিয়ে গিয়েছে। হয়তো হাতে নেই খেলার মতো অবসরও। তাই সান্ধ্য এই খেলার উদ্যোগ কমে গিয়েছে অনেকটাই। শীত হারিয়েছে তার এই সান্ধ্য খেলার আসরকে। শীত হারিয়েছে গোলকুন্ডের আগুণে আড্ডাকেও। তীব্র শীতের দিনের যে কোনও সময় বিশেষত সন্ধ্যের পর কাঠকুটো পাতায় লাগানো আগুন গোল করে ঘিরেই বাবা কাকুদের আড্ডা জমে উঠত দেখতাম। মাঝেমাঝে পড়া শেষ হয়ে গেলে নিভন্ত আগুণের সামনে গিয়ে দাঁড়াতাম আমরাও। আধো অন্ধকারে উষ্ণ আগুণ ঘিরে থাকা অনেকগুলো মুখ মানেই অনেক দৃষ্টিভঙ্গি, অনেক আদর্শ, অনেক স্বপ্ন চারণ, অনেক আশাভঙ্গের গল্পগাথা। তাকে ঘিরে না থাকত কোন উচ্চ-নীচ ভেদাভেদ, না থাকত বয়সের তারতম্য। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই জটলা আজ প্রায় চোখেই পড়ে না। তথাকথিত আধুনিকতা আর বৃক্ষ সংরক্ষণ এই দুইয়ে মিলে শীতে আগুন পোহানো কোথায় যেন মিলিয়ে গেছে। সমাজের নিম্নবিত্ত লোকজনদের মধ্যে কালেভদ্রে শীতের সন্ধ্যায় কাঠকুটো জড়ো করে আগুণ পোহানোর ছবিও এখন কালেভদ্রে চোখে পড়ে। এখন একলা রাতে নরম কম্বলের ওমে শীতের সেই চেনা গন্ধ আসে কই! এখন শীত মানে শুধুই ঠান্ডা, আর ধোঁয়া মেশা কুয়াশার আভরণ। সেই ধোঁয়াশার আড়ালে যেন ওত পেতে থাকে কোনও বিপদ, কোনও অজানা আতঙ্ক। তাই এখন শীতের অস্তিত্ব শুধু শরীরেই, মননে নয়।
সদ্য শেষ হল টোয়েন্টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। উন্মাদনা ছিল, ছিল আবেগ। কিন্তু তার থেকেও বেশি ছিল খেলাকে কেন্দ্র করে বেটিং তথা জুয়ার রমরমা কারবার। বাচ্চা থেকে বুড়ো প্রায় সকলেই এখন এই সিনিড্রোমে আক্রান্ত। ফলে উন্মাদনা তো থাকবেই। আমাদের ছোটবেলাতেও ছিল। আমাদের ছোটবেলাতে শীতের পথেঘাটে বাতাসে ভেসে আসত হিন্দি ও ইংরাজিতে অদ্ভুত নরম আওয়াজের ধ্বনি। তার সঙ্গে মাঝে মাঝেই দর্শকের উল্লাসের ঢেউ এসে আছড়ে পড়ত রেডিয়োর মধ্যে দিয়ে। কানে ছোট্ট রেডিয়ো ধরে পথ চলা কারও উদ্দেশে ‘দাদা কত হল? প্রশ্নটা ছিল খুব কমন। কোথাও বা খানিক বড় রেডিও ঘিরে জটলা। রেডিয়োতে ক্রিকেট কমেন্ট্রি ততদিন শুধুই শোনার জিনিস ছিল। যতদিন না সাদাকালো টিভি এসে সেই জায়গার দখল নেয়। এখন সারা বছরের ক্রিকেট তার চরিত্র বদলেছে। শুধুমাত্র শীতের সঙ্গে ক্রিকেটের যে বন্ধুত্ব সেই সম্পর্কে চিড় ধরেছে অনেকদিন। আসলে কারও পৌষ মাস, কারও সর্বনাশ। সেই নিয়মে আজ পৌষের নিজেরই সর্বনাশ। বদলে গিয়েছে তার আদল। তখন বাংলা ছবির যুগ। আর বাংলা ছবি মানেই বেশিরভাগ সাদাকালো। তাই হিন্দি ছবি দেখার বাড়তি আকর্ষণই ছিল তার রঙিন চেহারা। এই রংয়ের কারণেই হিন্দি সিনেমার টিকিটের দামও ছিল বেশি। খেলার মাঠে অনেকটা জায়গা বেড়া দিয়ে ঘিরে তার ভিতরে বাঁশের ফ্রেমে বড় সাদা পর্দা টাঙিয়ে সপ্তাহব্যাপী চলত ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল। সন্ধে ও রাতে প্রতিদিন দু’টো করে শো হতো। প্রতি শোয়ের রোজের টিকিট কিংবা সারা সপ্তাহের সিজন টিকিটের ব্যবস্থা থাকত। শো চলাকালীন বেড়ার ফাঁক দিয়ে আমাদের মত ইচড়ে পক্কদের কৌতূহলী চাউনি ছিল রোজের অঙ্গ। এখন ঘরে ঘরে টেলিভিশনের পর্দায় প্রতি মুহুর্তে নানান সিনেমার সম্ভার। শীত এলে বড় শহরে ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের আয়োজন হয়। কিন্তু সে এখন মাঠ ছেড়ে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত প্রেক্ষাগৃহে উঠে এসেছে। বদলে গিয়েছে তার আঙ্গিক ও লক্ষ্য। শীত হারিয়েছে তার মাঠের সঙ্গীকে।
সকালে হাঁটতে বেরিয়ে দেখেছি গরিব মানুষের কাছে শীতের নির্দয় রূপ। অনেকবার দেখেছি, বিশেষ করে শীতকালেই, নিথর শায়িত শরীরের পাশে দাঁড়িয়ে প্রাজ্ঞ ব্যবস্থাপক টাইপের কিছু মানুষের প্র্যাকটিকাল পরামর্শ। ঝুঁকি না নিয়ে সকাল সাড়ে ছ’টায় শীতবস্ত্রে আপাদমস্তক মুড়ে মর্নিং ওয়াকে বেরিয়ে দেখি জীবনসংগ্রামে জর্জরিত মানুষ ছেঁড়া সস্তার সোয়েটার আর রোঁয়া-ওঠা মাঙ্কি ক্যাপ পরে তাঁদের চ্যালাকাঠ আর জং-ধরা টিনের ডালাগুলি খুলে চায়ের জন্য আদা পিষছেন বা খোসাসুদ্ধ দাগী আলু কাটতে শুরু করছেন তরকারির জন্য। কোথাও বা লিট্টি সেঁকার আগুনেই জমে যাওয়া হাত একটু গরম করে নেওয়ার প্রচেষ্টা চলছে। ফুটপাতে এ সবের মধ্যেই পড়ে থাকে জরাজীর্ণ ভুষোকম্বলে আপাদমস্তক মোড়া আধপাগলা ভবঘুরে যে তার কাঠকুটো আর কার্ডবোর্ডের প্রাত্যহিক বেডরুম ভেঙে উঠে বসে সকালের প্রথম বিড়িটি ধরায়। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে আমাদের শিরদাঁড়া বেয়ে এক প্রবল শৈত্যপ্রবাহ স্থায়ী হচ্ছে ধীরে ধীরে। শীতকে উপেক্ষা করে আমার দেশের অগণিত সংগ্রামী মানুষ লড়াই করছেন, অবস্থান করছেন, যুঝে চলেছেন অনেক জায়গায় সামান্য চাকরির জন্য। তীব্র শীতকালকে উপেক্ষা করে কত মানুষ এগিয়ে এসে খাবার তুলে দিয়েছেন অগণিত বুভুক্ষু জনতার পাতে, কিন্তু সহযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষের উষ্ণতা কি শীতের প্রকোপ কমিয়েছে একটুও? হয়তো একটু হলেও। সঙ্গোপনে হলেও এটুকুই আশা শীতের এই সমবেত লড়াই বিফলে যাবে না।
পাথরের বুকে জমে অলিখিত জল
ততটাই ভাঙি
প্রত্যেক সকালে ।
ঢাকে মুখ, কুয়াশা চাদর
হাজার অক্ষর...
কখনও হাঁটতে শুরু করে
এলোমেলো
বন্ধ দরজায় কড়া নেড়ে
ফিরে যায় শেষে
পশ্চিম আকাশে।
আবার কখনও দেয়
অযাচিত রাজকীয় উড়াল।
ভেঙে পড়ে যাবতীয় গৃহস্থালি
ছত্রাকারে পড়ে থাকে
অফিসের টিফিন বক্স, নিভন্ত বার্নারে পোড়ে
বিষন্ন ডাল, লুটোয় বিছানা, নালিশ
মেঝের ওপর ধেবড়ে থাকা কোলে
সহস্র নক্ষত্রেরা অক্ষর হয়ে জ্বলে...
ভোরের বেলা শিশির ভেজা ঘাসে
হাঁটতে যদি চাও খোলা পায়ে
কাউকে যদি নাইবা পেলে পাশে
উষ্ণ কিছু জড়িয়ে নিয়ো গা'য়ে।
আমি যদি ভীষণ জ্বরের ঘোরে
কাঁপতে থাকি একলা ঘরে শুয়ে
তোমার হাতের শীতল স্পর্শ নিয়ে
আসবে বলো চেনা পথটি দিয়ে।
দূরের ওই বট গাছটির নিচে
কত গল্প লুকিয়ে আছে আজও
হাওয়ার মতো নরম আলো নিয়ে
সময় পেলে একটু ভালোবেসো।
পরিবর্তন আসবে
সারণ ভাদুড়ী
অগ্রহায়ণ
মাথুর দাস
অগ্র মানে প্রথম আর হায়ণ মানে বছর,
এই ভাবে হয় যে-মাসের নামকরণ –
বুঝতে হবে সে মাসেই শুরু নতুন বছর,
এক কালে সে মাসে হতই বর্ষবরণ ।
নতুন ধান্যে হয় নবান্ন এবং লক্ষ্মীপুজো,
বিশেষত এই মাসকে বলি যে 'লক্ষ্মীর মাস' –
চাষীর জীবন-ইতিহাসে অর্থটি তার খুঁজো,
এ সময়ের জন্য যে তার অপেক্ষা বারোমাস ।
ধার দেনা আর দাদন ছিল এক সময়ের ভীতি,
মহাজন আর খাজনাদারের মুহুর্মুহু চাপ –
ভিন্ন রূপে হয়তো আছে এখনও সে সব রীতি,
না দিলে তার শাস্তি কড়া, নেইতো কোন মাফ ।
সোনালি ধানের মর্যাদাটি বুঝবে না কেউ অন্য,
কনক ধান্য কত যে মান্য কৃষক কুলের কাছে !
পিঠে পায়সে নবান্ন উৎসব পালিত হয় অনন্য,
চাষীর অভাব দূর হয় কিছু ঠিক অঘ্রাণ মাসে ।
অগ্রহায়ণ ও নবান্ন