Monday, December 5, 2022


 

সম্পাদকের কথা 

সারা বিশ্ব এখন মেতে উঠেছে ফুটবলে। খুব স্বাভাবিক ব্যাপার এটি। চার বছর পর পর বিশ্ববন্দিত খেলোয়াড়দের একসঙ্গে দেখবার এত বড় সুযোগ তো আর হয় না! তাই খেলা এরকম নিয়ে উৎসাহ-উদ্দীপনা চলবেই। চমক দিয়েছে আয়োজক মরু-রাষ্ট্র কাতারও। এত ছোট্ট দেশ, অথচ কী নিদারুন আয়োজন। এত আনন্দের মাঝে অবশ্য একটি কাঁটা সবসময় খচখচ করে। সেটি হল, নিজের দেশের এই মঞ্চে সুযোগ না পাওয়া। আমাদের অনেকের জীবদ্দশায় এই সুযোগ হয়ত হবেও না। কেন আমাদের দেশ সুযোগ পায় না তার নানা কারণ থাকতে পারে। সেই বিশ্লেষণ থাকে। আপাতত বিশ্ববাসীর সঙ্গে আমরাও রয়েছি দর্শক হিসেবে। 


মুজনাই অনলাইন অগ্রহায়ণ সংখ্যা ১৪২৯ 

                                              রেজিস্ট্রেশন নম্বর- S0008775 OF 2019-2020

হসপিটাল রোড 

কোচবিহার 

৭৩৬১০১

ইমেল- mujnaisahityopotrika@gmail.com (মাসিক অনলাইন)

- mujnaiweekly@gmail.com (সাপ্তাহিক) 

 

প্রচ্ছদ ছবি পরিচিতি  - ধান ঝাড়াইয়ের কাজে টোটো রমণী

প্রচ্ছদ ছবি- শৌভিক রায়

প্রকাশক- রীনা সাহা  

সম্পাদনা,  অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায়  

মুজনাই অনলাইন অগ্রহায়ণ সংখ্যা ১৪২৯


এই সংখ্যায় রয়েছেন

চিত্রা পাল, ঋতুপর্ণা বসাক দাশগুপ্ত, বেলা দে, শ্রাবণী সেনগুপ্ত, 

গৌতম চক্রবর্তী, বাপ্পা সরকার,  পার্থ বন্দোপাধ্যায়, রীতা মোদক,

বিনয় বর্মন, অপর্ণা দেবনাথ, রূপক রায়, সুদীপ দাস, 

মাথুর দাস, মজনু মিয়া, সৈকত দাম, সারণ ভাদুড়ী, সুনন্দ মন্ডল,

বটু কৃষ্ণ হালদার, সোমনাথ বণিক, রিসা দাস  


মুজনাই অনলাইন অগ্রহায়ণ সংখ্যা ১৪২৯




ক্রোড়পত্র: হেমন্ত ও শীত 



হেমন্ত ফুরায়ে যায় 

চিত্রা  পাল                                    

এসে গেলো মনোরম দিন, আর কোমল রাত। হ্রস্ব দিন দীর্ঘ রাত। ফসল শূন্য প্রান্তরে পড়ে থাকেফসল তোলা গোড়া। শীত মাঝে মাঝে এসে বেশ ঝান্ডা ঘুরিয়ে যায়, পিঠোপিঠি একটু বড় দাদা দিদির মতো।প্রতি পুজোয় যেমন বিজয়া মিশে থাকে, তেমনি হেমন্তে মিশে থাকে শীত। একটু ঈশারা পেলেই উইংস-এর আড়াল থেকে  মঞ্চে প্রবেশ করবে সদর্পে। মাঝে মাঝেই চলবে শিশির কুয়াশার হাতে হাত রেখে চলা। মাঠের ফসল ঘরে তোলা হলে কত রঙীন বাসনারা উঁকি দিয়ে যায় মনের মাঝে। কিছু রূপ নেয়, কতক ভোরের কুয়াশার মতো মিলিয়ে যায়। তবু বুদবুদের মতো জেগে ওঠে সেই সময়ের পটে।  হেমন্ত আসে তার ফসলের সম্ভার  নিয়ে। সে সম্ভারে মিশে থাকে দীর্ঘ  সময়ের কত শ্রম স্বেদ সামর্থ্য। তাতে লক্ষ্য থাকে আগত দিন যেন হয় সুসামঞ্জস্য। জীবনের চলার  পথে হেমন্তের আসা  অত মসৃণ হয় না। উঁচু নীচু নিক্তিমানও থেকে যায়। কত নিরুপম সূর্যালোক মিশে গেছে অন্ধকারে।প্রতিশ্রুতির পথ থমকে দাঁড়ায় সময়ের কুয়াশায়। ফসলের চিহ্ন নিয়ে পড়ে থাকে প্রান্তর।ফসল চলে যায় সাগরের ওপারে।স্বেদ রক্ত ঘামের বিনিময়ে যে হেমন্ত এসেছিলো আমাদের আঙ্গিনায় সেই হেমন্ত কি ফুরিয়ে যায় কে জানে। 


         


ছোঁয়া
ঋতুপর্ণা বসাক দাশগুপ্ত 

এতটা পথ দাবদাহ সহ্য করে উজিয়ে আসলাম, বোঝো নি?
একবার তো বলতে পারতে,"খুব গরম লাগছে, না?
এসো, শীতল হবে"।

কতটা পথ বৃষ্টিতে ভিজে সারা হয়ে আসলাম, দেখেছ তো?
একবার তো বলতে পারতে ,"আহা! এতো টা ভিজে গেলে কি ভাবে?
এসো, জল মুছিয়ে দিই"।

এতটা পথ শরতের মেঘের ভেলায় ভেসে ভেসে এলাম, ভাবো নি?
একবার তো বলতে পারতে," ভাসতে চাই কিন্তু একা পারি না।
আমায় সঙ্গে নেবে"?

কতটা পথ হৈমন্তী কুয়াশায় নিরাভরণ ধানক্ষেত পেরিয়ে এলাম, দেখলে না?
একবার তো বলতে পারতে," কতকাল কুয়াশা মাখা হয় নি তোমার হাত ধরে!
মাখিয়ে দেবে?"

এতটা পথ শীতে কাঁপতে কাঁপতে পাড়ি দিলাম, দ্যাখো নি?
একবার তো বলতে পারো, " ইস! খুব শীত করছে বুঝি?
একটু আগুন জ্বালি?"

কতটা পথ বসন্তের রঙীন ফুলের মায়ায় ঘুরে আসলাম, বুঝলে না?
একবার তো বলতে পারতে," কত ফুল এনেছ দু'হাত ভ'রে!
এসো, একসাথে মালা গাঁথি"।


না, এসব বলো নি কখনো। 
রোজ এসে বসি তোমার কাছে  আর ভাবি হয়ত...
ভুলে যাই তুমি নদীর ধারে পড়ে থাকা পাথর-
নদীকে শুধু বইতে দেখেছ, ছুঁতে পারো  নি!



হেমন্ত প্রসব 
বেলা দে

অঘ্রাণের সুঘ্রাণ বাতাস
ঘ্রাণেন্দ্রিয় সহ জাপটে ধরে সর্বাঙ্গ
তুমি সুন্দর ছবি অতি সুন্দর 
তাথৈ নৃত্য মূর্ছনায়, 
রূপান্তরের শিশির বিন্দুরা
প্রকৃতির গান গায়
অনাবৃত শাশ্বত ইশারায়, 
জীবনেরা পৃষ্ঠা খুলে দিলে
রোমে রোমে দোসর মেলায়
মিলনের পরাগ বিছানায়। 
গর্ভবতী ধানবাগান
আলটুসে শরীর ছেড়েছে
বাদামি নকশিকাঁথায়
বিয়োবার সময় হয়ে এলো
প্রাক নবান্ন সন্মুখ সময়।



অগোছালো দিন
শ্রাবণী সেনগুপ্ত

শীতের কুয়াশা স্তরে স্তরে জমাট বাঁধে
অস্পষ্ট হয় ভিতর,বাহির।
ডাক দিয়ে যায় কবেকার সুখ,
দানা বাঁধে পাওয়া না পাওয়া ।
চলমান যান চলে যায়,
পড়ে থাকে বুড়ো বট,
অভিমান মান ভাঙে অনুরাগে 
আহ্ ভেসে যাওয়া কনে দেখা আলো ।
শেষের মাঝে অশেষের পদধ্বনি
ঘিরে থাকা আদর,আবেশ।
অগোছালো দিনের শেষে 
গরবিনী মেঘের বুকে একফালি চাঁদ
মাজা রঙে ভরে দেয় চারপাশ
বেহুলার ভেলায় চড়ে নিশিযাপন
বাউলের আখড়ায় -
কি আগুন জ্বলে জলের ভিতরে।



নবান্ন
রীতা মোদক

কৃষকের মাথায় সোনার ফসল
পাইকার কষে লাভের অঙ্ক

গৃহস্থের নিকানো আঙিনায়
নবান্নের পুজো হয়

 হটাৎ আমার নাকে কাছে
সাদা ভাতেরর গন্ধ আসে
তখন
অকারণে ফানুস উড়ে মনের ভেতর





হারিয়ে যাওয়া শীতকালের সেইসব গল্পগাথা

গৌতম চক্রবর্তী 





ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে দিয়ে আগুন জ্বালানোর জন্য আমাদের ছোটবেলায় আসতো শীতকাল আর তখন থেকেই তোড়জোড় শুরু হত শীতকালকে আমন্ত্রণের। সেই তখনকার শীতকালে ত্বকের যত্ন নেওয়া দিনে পিয়ার্স সাবানের গন্ধে আমাদের বেঁচে থাকার গল্পগুলো আজ রূপকথাস্নান করতে যাওয়ার আগে নারকেল তেল গলিয়ে নেওয়ার জন্য আমরা রোদের কাছে, উনুনের পাশে গিয়ে দাঁড়াতাম। এখনকার প্রজন্মের মনে হবে “কি গেঁয়ো ভুত” রে বাবা! প্রতিবার ভাবতাম পুজোর আগে কুল খাবো না কিন্তু শেষ রক্ষা হত না কিছুতেই ইট দিয়ে কুল পাড়ার  মজা ছাড়া যায়? যায় না বলেই পকেটে পকেটে ভর্তি থাকতো কাঁচা পাকা কুল। এখনকার প্রজন্ম ভাববে “কি রে বাবা, কুল আবার খাওয়ার বিষয় হল”? “তার জন্য এত কিছু”? আচারের শিশির গায়ে রোদ পড়তো আর আমরা ছোটরা, খুড়তুতো, জেঠতুতোরা লোলুপ চোখে তাকিয়ে থাকতাম। আর ঠিক এই সময় ধীরে ধীরে বসন্ত পঞ্চমী' নামটি বুঝিয়ে দিত রং লেগেছে বনে বনে, ঢেউ জেগেছে সমীরণে। একদিকে সার্কাসের ট্র্যাপিজের খেলা দেখতে দেখতে মনে হতো জীবনের আসল রং খুব সম্ভবত অ্যাডভেঞ্চার, আবার স্কুল থেকে সরস্বতী পুজোর স্বেচ্ছাসেবক হবার প্রতিযোগিতাও ছিল জীবনের আর এক ধরনের অ্যাডভেঞ্চার। মেয়েদের স্কুলে কে কে কার্ড দিতে যাবে এই নিয়ে কত রঙ্গরস! কাঁধে ব্যাগ, চুল উড়ছে, হিরো সাইকেলে চড়ে হাতল ছেড়ে হিরো হওয়ার বাসনাতে যেন দিগবিজয় করে ফিরতাম। গার্লস স্কুল থেকেও কেউ কেউ আসত মাঝে মাঝেবুকের ভেতর কেমন একটা হত যা খালি চোখে দেখা যেত না। একটু উঁকিঝুঁকি, সামান্য চোখাচোখি। ঘুরে ফিরে তাকানোর পঞ্চমী প্রহর নতুন শাড়ি সামলে নেওয়ার বয়ঃসন্ধি। আসলে প্রত্যেকের জীবনেই কিছু 'অকথা' থাকে বন্ধুরা সে কথা জানবেই স্কুলের পুজোর দ্বাদশ শ্রেণী। সারস্বত উৎসব। পরিবেশনের দায়িত্ব। সে আসে ঠিক নিজের হাতে খেতে দিই স্যার বলেন দেখে দিবি কিন্তু হ্যাঁ দিই তো প্রসাদের সঙ্গে সন্দেশ দিই। হাতে একটু ছোঁয়া লাগে এক পলকে দুজনের দেখা। সে সময়কাল শীতকাল।




 

কত কবি বন্ধু ছিল সেইসময় আমার ক্লাশে তা কি জানতাম? কার মধ্যে কি সুপ্ত প্রতিভা আছে কি করে জানবো? বঙ্কিমচন্দ্রের বাবু পড়াবার সময় নির্মলবাবু মজা করে মদনকে বলেছিলেন ‘বলতো মদন, ‘মদন আগুণ কি’? মদন অবলীলাক্রমে বলেছিল ‘মদন আগুণ’ হল এমন আগুণ যা বালতি বালতি জল ঢাললেও নেভে না’। সেই মদন বাসন্তীকে চিঠি লিখল ‘পলাশ ও শিমূল পাশাপাশি / আঙ্গুলে শাড়ির খুট, লজ্জা…… ভালোবাসাবাসি’। এটা নিয়ে কয়েকদিন বন্ধুমহলের জমজমাট আলোচনা ক্রমে ক্রমে জমে ক্ষীর। মদন-বাসন্তীর এখন এক ছেলে এক মেয়ে। অশোকবাবুর কাছে পড়তে যাওয়ার সময় যখন সাইকেলের বেল বাজাতাম তখন সোহারই মোড়ের সেই সাদামাটা মেয়েটা, যার নাম ছিল বীণা, কেন যে ভালো লাগত আমিও জানি না, চোখের সামনে ঝুঁকে থাকা অবাধ্য চুল কানের পাশে তুলে রাখত সে জেনে যেত এবং বুঝে নিত বেল বাজিয়ে যে আসছে পেছনে না তাকালেও দেখা যায় সেই আসা। আচ্ছা সাইকেলের বেলেরও কি মোবাইলের মত ভিন্নধর্মী রিংটোন ছিল নাকি? কোনদিন শাড়ি পড়তো, আবার কোনদিন সালোয়ার কামিজ। আমার এক বন্ধুর কাছে যখন বলেছিলাম শাড়ি পড়লে মেয়েদের বড় বড় লাগে তখন ‘প্রেমিকার বুকের সেফটিপিন' কবিতা লিখে ফেলে সেই কবি বন্ধু সাহিত্য মহলে জবরদস্ত মুরগীশাড়ি আসলে খুবই সংক্রামক আসলে আমাদের অনেকের জীবনের ভালোবাসার বর্ণমালার প্রথম প্রকাশ ঘটেছিল এইসব শীত বিকেলেআমরা মফস্বলের মাঠ জুড়ে স্বপ্ন ফেরি করতামহাফ সেঞ্চুরি অতিক্রম করা এই বয়সে ডাকাবুকো প্রেমিকের দলকে কেউ মনে রাখে কিনা এইকথা ভাবতে ভাবতেই ছোটবেলার মুগ্ধতা ভিড় রে আসে চোখের পাতায়বাণী বন্দনার শীতসকালে অঞ্জলি দিতে গিয়ে হৃদয়ে অবাধ্য ছেলে কার মুখ ভেবেছিল মন কি তা জানে? মনের গতিবিধি বোঝা দায় যে।




 মনে আছে টিভি তখনও শুরু হয়নি। শীত এলেই আমাদের মফস্বলের ছোট মাঠে বা একটু বড় খোলা জায়গায় চারপাশ ঘেরা ছাউনি পড়ত। মাটি থেকে একটু উঁচুতে ছোট্ট মঞ্চ বরাবর মাটিতে ত্রিপল পেতে পুরুষ ও নারীর বসার জায়গা আলাদা করে দেওয়া হত। টিকিটের দাম খুব বেশি না হওয়ায় এবং প্রতিদিন বিভিন্ন কাহিনী পরিবেশিত হওয়ায় প্রায়দিনই এই আসরে ভিড় জমত। স্ট্রিং, রড আর গ্লাভস এই তিন ধরনের পাপেটের মধ্যে স্ট্রিং অর্থাৎ দড়ি দিয়ে উপর থেকে ঝোলানো পুতুল দিয়ে চলত এই পুতুল নাচ। সুরেলা সংলাপ আর কীর্তনের সুরে গান গেয়ে রাজা হরিশচন্দ্র, নিমাই সন্ন্যাস, কালীয় দমন, বেহুলা লক্ষ্মীন্দর, সীতাহরণ, শহিদ ক্ষুদিরাম ইত্যাদি নানান কাহিনীর সঙ্গে শৈশবকে আলাপ করিয়ে দিতে শীতের পুতুল নাচের একটা বড় ভূমিকা ছিল। এখন সারা বছরব্যাপী টেলিভিশনের অ্যানিমেশন চ্যানেলগুলো শৈশবের দখল নিয়েছে। শীত সেখানে অনাহুত। শৈশবের আচরণে কিছুদিনের জন্য হলেও বড় হওয়ার ভাব এনে দিত এই শীত। শীত এলেই দুই আঙুল মুখের সামনে সিগারেটের মতো ধরে বেশ লম্বা করে শ্বাস নিয়ে মুখ দিয়ে ধোঁয়া ছাড়বার সময়ে বড়দের সামনে বড়গিরির সুযোগটা শীতই এনে দিত। ঘুম থেকে উঠেই কিংবা দিনের অন্যান্য সময়েও মুখের ধোঁয়া বের হতে দেখাটা ছিল আমরা যারা ছোট ছিলাম আমাদের কাছে শীতের এক উপরি আকর্ষণ। এখনও চাইলে শীত শৈশবকে সেই সুযোগ দেয়, কিন্তু দেখি শীতকে জড়িয়ে আজকের শৈশবের সেইসব আবেগ, অনুভূতির সময়টাই নেই। ফলে শীত নীরবে আসে, আবার একদিন নীরবে চলেও যায়। বদলে যাওয়া জীবন-শৈলীর বিনোদনের পসরা শীতের জন্য আলাদা করে কোনও জায়গা ছেড়ে দেয় না। তাকে ছেড়ে গিয়ে অথচ তাকে মনে রেখেই আজ তার সঙ্গীরা দিয়েছে শীত ঘুম।




শীত এলেই সন্ধেবেলায় এলাকার ছোট খালি জমিতে ব্যাডমিন্টন খেলা হত অনেক জায়গাতেই। শীতের শীতলতাকে চ্যালেঞ্জ জানাতেই যেন সন্ধেবেলায় এই ঘাম ঝরানোর আয়োজন। আমরাও খেলতে যেতাম। শীতের গোটা সময়টাই সান্ধ্য এই খেলা চলত। শীতের শেষভাগে কোন টুর্নামেন্ট আয়োজন করে খেলার পাট চোকানো হত সে বছরের মতো। নেটের দুই প্রান্তের খুটির মাথায় বোর্ডের বালবগুলো জ্বলে উঠতেই চারপাশ আলো আঁধারির মধ্যে ঝলমল করে উঠত রাতের ব্যাডমিন্টনের কোর্ট। না, এখন আর চিলতে জমি ফাঁকা পড়ে থাকে না, মাটি ফুঁড়ে সেখানে বিল্ডিং গজিয়ে গিয়েছে। হয়তো হাতে নেই খেলার মতো অবসরও। তাই সান্ধ্য এই খেলার উদ্যোগ কমে গিয়েছে অনেকটাই। শীত হারিয়েছে তার এই সান্ধ্য খেলার আসরকে। শীত হারিয়েছে গোলকুন্ডের আগুণে আড্ডাকেও। তীব্র শীতের দিনের যে কোনও সময় বিশেষত সন্ধ্যের পর কাঠকুটো পাতায় লাগানো আগুন গোল করে ঘিরেই বাবা কাকুদের আড্ডা জমে উঠত দেখতাম। মাঝেমাঝে পড়া শেষ হয়ে গেলে নিভন্ত আগুণের সামনে গিয়ে দাঁড়াতাম আমরাও। আধো অন্ধকারে উষ্ণ আগুণ ঘিরে থাকা অনেকগুলো মুখ মানেই অনেক দৃষ্টিভঙ্গি, অনেক আদর্শ, অনেক স্বপ্ন চারণ, অনেক আশাভঙ্গের গল্পগাথা। তাকে ঘিরে না থাকত কোন উচ্চ-নীচ ভেদাভেদ, না থাকত বয়সের তারতম্য। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই জটলা আজ প্রায় চোখেই পড়ে না। তথাকথিত আধুনিকতা আর বৃক্ষ সংরক্ষণ এই দুইয়ে মিলে শীতে আগুন পোহানো কোথায় যেন মিলিয়ে গেছে। সমাজের নিম্নবিত্ত লোকজনদের মধ্যে কালেভদ্রে শীতের সন্ধ্যায় কাঠকুটো জড়ো করে আগুণ পোহানোর ছবিও এখন কালেভদ্রে চোখে পড়ে। এখন একলা রাতে নরম কম্বলের ওমে শীতের সেই চেনা গন্ধ আসে কই! এখন শীত মানে শুধুই ঠান্ডা, আর ধোঁয়া মেশা কুয়াশার আভরণ। সেই ধোঁয়াশার আড়ালে যেন ওত পেতে থাকে কোনও বিপদ, কোনও অজানা আতঙ্ক। তাই এখন শীতের অস্তিত্ব শুধু শরীরেই, মননে নয়।




সদ্য শেষ হল টোয়েন্টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। উন্মাদনা ছিল, ছিল আবেগ। কিন্তু তার থেকেও বেশি ছিল খেলাকে কেন্দ্র করে বেটিং তথা জুয়ার রমরমা কারবার। বাচ্চা থেকে বুড়ো প্রায় সকলেই এখন এই সিনিড্রোমে আক্রান্ত। ফলে উন্মাদনা তো থাকবেই। আমাদের ছোটবেলাতেও ছিল। আমাদের ছোটবেলাতে শীতের পথেঘাটে বাতাসে ভেসে আসত হিন্দি ও ইংরাজিতে অদ্ভুত নরম আওয়াজের ধ্বনি। তার সঙ্গে মাঝে মাঝেই দর্শকের উল্লাসের ঢেউ এসে আছড়ে পড়ত রেডিয়োর মধ্যে দিয়ে। কানে ছোট্ট রেডিয়ো ধরে পথ চলা কারও উদ্দেশে ‘দাদা কত হল? প্রশ্নটা ছিল খুব কমন। কোথাও বা খানিক বড় রেডিও ঘিরে জটলা। রেডিয়োতে ক্রিকেট কমেন্ট্রি ততদিন শুধুই শোনার জিনিস ছিল। যতদিন না সাদাকালো টিভি এসে সেই জায়গার দখল নেয়। এখন সারা বছরের ক্রিকেট তার চরিত্র বদলেছে। শুধুমাত্র শীতের সঙ্গে ক্রিকেটের যে বন্ধুত্ব সেই সম্পর্কে চিড় ধরেছে অনেকদিন। আসলে কারও পৌষ মাস, কারও সর্বনাশ। সেই নিয়মে আজ পৌষের নিজেরই সর্বনাশ। বদলে গিয়েছে তার আদল। তখন বাংলা ছবির যুগ। আর বাংলা ছবি মানেই বেশিরভাগ সাদাকালো। তাই হিন্দি ছবি দেখার বাড়তি আকর্ষণই ছিল তার রঙিন চেহারা। এই রংয়ের কারণেই হিন্দি সিনেমার টিকিটের দামও ছিল বেশি। খেলার মাঠে অনেকটা জায়গা বেড়া দিয়ে ঘিরে তার ভিতরে বাঁশের ফ্রেমে বড় সাদা পর্দা টাঙিয়ে সপ্তাহব্যাপী চলত ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল। সন্ধে ও রাতে প্রতিদিন দু’টো করে শো হতো। প্রতি শোয়ের রোজের টিকিট কিংবা সারা সপ্তাহের সিজন টিকিটের ব্যবস্থা থাকত। শো চলাকালীন বেড়ার ফাঁক দিয়ে আমাদের মত ইচড়ে পক্কদের কৌতূহলী চাউনি ছিল রোজের অঙ্গ। এখন ঘরে ঘরে টেলিভিশনের পর্দায় প্রতি মুহুর্তে নানান সিনেমার সম্ভার। শীত এলে বড় শহরে ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের আয়োজন হয়। কিন্তু সে এখন মাঠ ছেড়ে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত প্রেক্ষাগৃহে উঠে এসেছে। বদলে গিয়েছে তার আঙ্গিক ও লক্ষ্য। শীত হারিয়েছে তার মাঠের সঙ্গীকে।




সকালে হাঁটতে বেরিয়ে দেখেছি গরিব মানুষের কাছে শীতের নির্দয় রূপ। অনেকবার দেখেছি, বিশেষ করে শীতকালেই, নিথর শায়িত শরীরের পাশে দাঁড়িয়ে প্রাজ্ঞ ব্যবস্থাপক টাইপের কিছু মানুষের প্র্যাকটিকাল পরামর্শ। ঝুঁকি না নিয়ে সকাল সাড়ে ছ’টায় শীতবস্ত্রে আপাদমস্তক মুড়ে মর্নিং ওয়াকে বেরিয়ে দেখি জীবনসংগ্রামে জর্জরিত মানুষ ছেঁড়া সস্তার সোয়েটার আর রোঁয়া-ওঠা মাঙ্কি ক্যাপ পরে তাঁদের চ্যালাকাঠ আর জং-ধরা টিনের ডালাগুলি খুলে চায়ের জন্য আদা পিষছেন বা খোসাসুদ্ধ দাগী আলু কাটতে শুরু করছেন তরকারির জন্য। কোথাও বা লিট্টি সেঁকার আগুনেই জমে যাওয়া হাত একটু গরম করে নেওয়ার প্রচেষ্টা চলছে। ফুটপাতে এ সবের মধ্যেই পড়ে থাকে জরাজীর্ণ ভুষোকম্বলে আপাদমস্তক মোড়া আধপাগলা ভবঘুরে যে তার কাঠকুটো আর কার্ডবোর্ডের প্রাত্যহিক বেডরুম ভেঙে উঠে বসে সকালের প্রথম বিড়িটি ধরায়। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে আমাদের শিরদাঁড়া বেয়ে এক প্রবল শৈত্যপ্রবাহ স্থায়ী হচ্ছে ধীরে ধীরে। শীতকে উপেক্ষা করে আমার দেশের অগণিত সংগ্রামী মানুষ লড়াই করছেন, অবস্থান করছেন, যুঝে চলেছেন অনেক জায়গায় সামান্য চাকরির জন্য। তীব্র শীতকালকে উপেক্ষা করে কত মানুষ এগিয়ে এসে খাবার তুলে দিয়েছেন অগণিত বুভুক্ষু জনতার পাতে, কিন্তু সহযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষের উষ্ণতা কি শীতের প্রকোপ কমিয়েছে একটুও? হয়তো একটু হলেও। সঙ্গোপনে হলেও এটুকুই আশা শীতের এই সমবেত লড়াই বিফলে যাবে না।

 






শীতল দিনের তরল ভাবনা
 বিনয় বর্মন

"শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা আমি তিনমাস ঘুমিয়ে থাকব- প্রতি সন্ধ্যায়
কে যেন ইয়ার্কি করে ব্যাঙের রক্ত
ঢুকিয়ে দেয় আমার শরীরে- আমি চুপ করে বসে থাকি ....  " 
( ভাস্কর চক্রবর্তী )

বাস্তবিকই , শীতকালে আমি ব্যাঙের মতো হয়ে যাই। সারাদিন কম্বল আর ঘন ঘন অম্বল -  সৌজন্যে গিন্নির ( একটাই সম্বল ) হরেক রকম মরশুমী শাকফাঁক (  বাংলায় সবজি এবং তার অনুকার অর্থে প্লিজ ) - এই নিয়ে প্রায় শীতঘুমে চলে যাই !
 
             হেমন্তের ফসলহারা মাঠ আর টুপটাপ শিশির ভেজা পাতাঝরা গাছেদের দেখলেই আজন্ম অলস আর কুঁড়ে আমি শীত ঘুমের প্রস্তুতি নিয়ে নেই। কাথা কম্বল লেপ মুড়ি দিয়ে হেমন্তোত্তর কিংবা প্রাক্-শীত নানাবিধ  'হ্যাজ' নামাতে শুরু করি ... পেটে পরুক না পড়ুক তরল , ভাবনা হয়ে যায় অতি সরল ! এই যে এখন ভাবছি ... 
  
Depression  আর elation এর মাঝে যে ছোট ছোট ফাক ( বাংলা !  বাংলা ! ) তাতে জুড়ে থাকে অনন্ত আকাঙ্ক্ষা উল্লাসের চিৎকার , সাহিত্য সম্ভোগের শীৎকার  ! হেমন্তের দুঃখবিলাস ভুলে শীতের স্থবিরতায় মানিয়ে নেওয়া l হাফ গার্লফ্রেন্ড কিংবা ফুল গেরস্থ , কারোও কথা বলার সময় নেই , সবাই ভীষণ ব্যস্ত ! আসন্ন শীতযাপনে ভার্চুয়ালি আলাপ l অনলাইনে শেয়ার করা ফসলহারা মাঠের বিলাপ l ভাব-বিলাসের বাড়াবাড়ি l 'ফেক'বুকে দেখাদেখি পারাপারি , পোষ্টানো ছবি কিংবা লেখার  প্রশংসা অথবা নিন্দার বৃন্দগান l অপ্রয়োজনে ল‍্যাদ খেয়ে অযথা ব্যস্ততার ভান l শীত নিয়ে আদিখ্যেতা - শীত কার ? কারো কারো আত্মরতির শীৎকার !       

         আমরা থাকি শীতের পিকনিক জলসা পানাহারে l মরুক শ্রমিক চা বাগিচায় শীতে কিংবা অনাহারে ! শীত তো সবার l  ক্ষমতা যার যেমন নেবার !

বাহারি ব্ল্যাঙ্কেট কিংবা খয়রাতি কম্বল l রেয়াজী খাসি কিংবা চুনো পুটির অম্বল l কারো জীবনে " রস নাই " l কারো জীবনটাই রোশনাই !  মাতিয়ে রাখতে খেলা মেলা বাউল l ভোটারের পলিটিক্যাল ফাউল l জিতে যায় ভুলভাল নেতা লাল বাতি বড় গাড়ি নিয়ে কত কেতা ! ফুড স্টল আর সেলফি-জোনে ভীড়  নিয়ে বইমেলা l গুটিকয়েক বই পাগল লিটিল ম্যাগ সম্পাদক আর তার চেলা l চিন্তিত প্রকাশক l উদাসী পাঠক l প্রেসের খরচা উঠবে ? পাইরেটরা পিডিএফ নিয়ে ফুটবে ! 

" শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা " ? অফিস পিকনিকে যাব তুমি আমি আর প্রবেশনের অপর্না !

পিকনিক মানে কি জঙ্গলে গিয়ে মদ খাওয়া ? জঙ্গলে হয় আমার রোজই যাওয়া l আর মদ যায় বাড়িতেই পাওয়া। খেঁকিয়ে ওঠেন 'মদ-অন'দা l অনলাইনের দাপটে তার পার্ট টাইম ব্যবসার মন্দা !

কুয়াশামাখা শীতের রাতে দূর থেকে ভেসে আসে জলসার গান l হোয়াটসঅ্যাপে স্ট্যাটাস দিয়ে ভালো থাকার ভান l 

ভুটান পাহাড় থেকে নেমে আসা রয়াল বেঙ্গল-কে বক্সা'র বলে চালিয়ে দিচ্ছে বনদপ্তর। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের খাড়া নিয়ে জয়ন্তীবাসী গুনছে প্রহর l টেক ইট ইজি l আমাদের তো খোলা থাকলেই হল রিসোর্ট আর বার l রিলাক্স ব্রো , কি দরকার অত চাপ নেবার !

নায়িকার প্রকাশ্যে কিস l দিল্লিতে ৩৫ পিস l  পাবলিক কেচ্ছাতে খুশি l আম ফেলে আটি চুষি l মিডিয়াও ব্যবসা l শাসকের চামচা l খবর শুধু ছাপে না , চাপেও l স্ক্যান্ডাল আর কেচ্ছা নিয়ে খবর গড়ে l ফাক তালে জরুরী প্রশ্ন চাপা পড়ে l স্বাস্থ্য শিক্ষা কর্মসংস্থানে রাষ্ট্রের বরাদ্দ বৃদ্ধি কই ? তার চেয়ে সোজা  সেলেবদের-প্রেম-বিয়ে-ব্রেকআপ নিয়ে হইচই l প্রমোদে ঢালি দাও মন l ' নেতা মন্ত্রীর ঘরে টাকার পাহাড় l দেশের আগামীরা খাচ্ছে মিড ডে মিলে নিম্নমানের আহার l এই টাকার আসল মালিক কে ?  প্রশ্ন তুললেই তুমি আপদ ! ঘনাতে পারে শিয়রে বিপদ l তার চেয়ে 'এনজয়' প্রতিক্ষণ l ধামাধরাই সুলক্ষণ। চাপা দিতে গণদাবি , আছে অনেক কাঠি চাবি l তোলো সেকশনাল সেন্টিমেন্ট। হিন্দু-মুসলিম রাজবংশী ভাটিয়া উচ্চবর্ণ দলিত যখন যেমন রিকোয়ারমেন্ট l

মাঠ ছেড়ে মোবাইলে কচি মন l  তারই মাঝে দামি কিট ব্যাগ নিয়ে ক্রিকেট কোচিংয়ে কিছু কচিকাঁচা , সঙ্গে মাম্মি ড‍্যাডি l  কোন ফাঁকে হারিয়ে গেল দারিয়াবান্দা, কবাডি l 

পিঠে পুলির রেসিপির সঙ্গে ঠাকুমা দিদিমাদের সান্নিধ্যও ব্যাকডেটেড l কেজি দরে পায়েস আর রেডিমেড পিঠে পুলিই ওভাররেটেড l 

মুদ্রিত বইয়ের দিন গেল বুঝি l  পিডিএফ, কিনডেল আর ই-বুক খুঁজি l 

 এটাই বিবর্তন l
 ভরসা , নবীনরাই আনবে পরিবর্তন l 

কোন শীতে নিশ্চয়ই  !
      
সেই "শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা ? "




কবিতা 



উড়াল 
অপর্ণা দেবনাথ

যতটা ভাঙলে, নদী পাল্টে ফেলে গতিপথ
পাথরের বুকে জমে অলিখিত জল
ততটাই ভাঙি
প্রত্যেক সকালে ।
ঢাকে মুখ, কুয়াশা চাদর
হাজার অক্ষর...

কখনও হাঁটতে শুরু করে
এলোমেলো
বন্ধ দরজায় কড়া নেড়ে
ফিরে যায় শেষে
পশ্চিম আকাশে।

আবার কখনও দেয়
অযাচিত রাজকীয় উড়াল।
ভেঙে পড়ে যাবতীয় গৃহস্থালি
ছত্রাকারে পড়ে থাকে
অফিসের টিফিন বক্স, নিভন্ত বার্নারে পোড়ে
বিষন্ন ডাল, লুটোয় বিছানা, নালিশ
মেঝের ওপর ধেবড়ে থাকা কোলে
সহস্র নক্ষত্রেরা অক্ষর হয়ে জ্বলে...




অভিমান
রূপক রায়

জীবন জুড়ে শুধুই হাহাকার
একটু বাঁচা একটু মরা ভালো
নাইবা গেলাম তোমার ক্ষেতের আলে
অন্ধকারে একটু আলো জ্বালো।

ভোরের বেলা শিশির ভেজা ঘাসে
হাঁটতে যদি চাও খোলা পায়ে
কাউকে যদি নাইবা পেলে পাশে
উষ্ণ কিছু জড়িয়ে নিয়ো গা'য়ে।

আমি যদি ভীষণ জ্বরের ঘোরে
কাঁপতে থাকি একলা ঘরে শুয়ে
তোমার হাতের শীতল স্পর্শ নিয়ে
আসবে বলো চেনা পথটি দিয়ে।

দূরের ওই বট গাছটির নিচে
কত গল্প লুকিয়ে আছে আজও
হাওয়ার মতো নরম আলো নিয়ে
সময় পেলে একটু ভালোবেসো।


খুনি স্মৃতি
সুদীপ দাস

আমাকে সবার সাথে থাকতে দাও
আমি নির্জন থাকতে পারি না।
আমায় নির্জনতায় একা পেলেই
তোমার সাথে কাটানো সব স্মৃতিগুলো,
আমার গলা টিপে ধরে। আমায় খুন করবে বলে!
তখন আমার খুব কষ্ট হয়,
আমি ছটফট করি যন্ত্রনায়,
আমার বাক যেন বন্ধ হয়ে আসে।
অশ্রুর ধারা বয়ে আসে দুই চোখে,
রোমকূপ উপচে পড়ে শরীর স্নাত হয় ঘামে।
ঐ ঋতু গুলো, কেন আসে ফিরে ফিরে?
সাথে নিয়ে আসে স্মৃতি গুলো বারে বারে।
গ্রীষ্মের বকুলের ছায়াতল , 
বর্ষায় ছাতার ভাগাভাগি, ভিজে যাওয়ার কত ছল।
নির্জনতায় স্মৃতি গুলো কষ্ট দেয়।
শীতের বিকেলে নেই আজ কফির পেয়ালার কদর
নির্জনতায় স্মৃতি গুলো দিয়ে গেল এই খবর।
বসন্তের রং কখন যে মলিন হলো, হিসেব রাখিনি,
আমাকে সবার সাথে থাকতে দাও,
নির্জনতায় ঐ স্মৃতি গুলো সব খুনি খুনি খুনি।



মরীচিকা 
সৈকত দাম

তোমার আমার মাঝে আবু ধাবির বালিয়াড়ি ....  
একই বিছানায় তোমার আমার মিলিত পায়চারি ....
একই আঁতর তুমি আমি মেখেছি দুজনে ....
সেই একই ছুটি তুমি আমি চাইছি একই ক্ষণে ....
তুমি শুধু তাকিয়ে দেখছো আকাশ ,
আকাশের বালি .....
আর আমাকে ভালোবাসছে রাতের সোমালী .....
শুধু এই যা পার্থক্যের দেওয়াল উঠেছে ,
মিলন ক্ষেত্র মাঝে .....
আর বাকি ব্যতিব্যস্ত উষ্ণতায় ধসে যায় আজ ....
এই " আজ " বড় মোহময় ....
বড় বেশি প্রাণ চঞ্চল ......
কখনো ঘুরে আসে নদী খাত ,
কখনো গোটা ভূগোল ......
তারপর সকালের স্নিগ্ধ রোদে ভেসে যায় অবিন্যস্ত চাদর .....
তারপর মায়া প্রলেপ উঠে যায় অসম্পূর্ণ রৌদ্রমুখ থেকে .....
ভেসে যায় আরও কিছু দক্ষিণ ,
না ভোলা দিন .....
তবু আমি ভুলে যাই, 
তোমার চাওয়া আছে, আমার নেই .....
বালিয়াড়িতে সকলই মরীচিকা .....
তা দেখে পথ হারাতে নেই .........


পরিবর্তন আসবে

 সারণ ভাদুড়ী

ওঁরা বেঁচে থাকুক,
ওঁরা চালিয়ে যাক লড়াই
ওঁরা হার মানতে জানে না ।
জীবন তো নয়, এটা চ্যালেঞ্জ
এটা চ্যালেঞ্জ বাঁচার জন্যে, 
এটা কুঠারাঘাত ; সেই সব লোকেদের জন্যে ,
যারা মানুষ মেরে হেঁটে যায় লাশের ওপর
তাদের জন্য যারা শুধুই প্রতিশ্রুতি দেন, 
আবার ভুলেও যান ক্ষণিকে।
সাদা ঝান্ডা আজ রক্তে ভিজে হয়েছে লাল,
ওই শোনা যায় তেপান্তরে রুদ্র দেবের ডাক।
অনশনে ওঁরা বসে থাকে,
চাই নিজের ন্যায্য পাওনা
তোমার কিসের ভয় হে রাজা ?
তুমি কি জবাব দিতে চাও না ?
সবার মুখে তালা ঝোলাবে, লাগবে শুধুই দাঙ্গা
ওই শোনা যায় তেপান্তরে রুদ্রদেবের বাজনা।
প্রতিবাদকে ভয় করো তুমি, প্রতিবাদীকে হত্যা
তোমার ওই কাপড়েই বয়েছে আজ কত রক্তের বন্যা!
গণতন্ত্র লোপাট করে
জনগণের পিঠে চড়ে,
সবাই কি আজ মূর্তি সেজে থাকবে?
মনে রেখো রাজা আজ লিখে গেলাম
পরিবর্তন আসবে।।




গল্প 



জোড়া পাহাড়
বাপ্পা সরকার



এবছর আকাশ খুব খারাপ যাচ্ছে, টানা বৃষ্টি হচ্ছে মাঝে মাঝে I যখন বৃষ্টি নামে তখন, ঘর থেকে বের হওয়া মুশকিল I কাল সকাল সকাল কাঠ ধরতে নদীতে যেতে হবে I এই কথা বলতে বলতেই ডেভিড হাঁক দিল, দানিয়াল ও দানিয়াল……… I কাঠের দোতলা ওপর টিনের চালের বৃষ্টির শব্দে, কিছু না বুঝে দানিয়াল জবাব দিল হা….. বল ডেভিডI জোরে জোরে বলতে লাগল “সুনাহে পাহাড় মা ধ্বসা হো রাহা হে” I নদী কা পানি পুরা গন্দা হো গায়া I
বৃষ্টি কমলে যাবI
সারারাত ধরে অঝোরে ভারী বৃষ্টি হলো ভোরের দিকে বৃষ্টি থামল I কাঠের খুটিতে ঝুলানো খুকরী ( বড় ছুরি ) কোমরে বেঁধে দানিয়েল নদীর পাড় ধরে এগিয়ে চলল I ঘন এলোমেলো শাল সেগুন শিমুল পেরিয়ে জঙ্গল এর মধ্য দিয়ে পাহাড়ের দিকে এগিয়ে চলল I জঙ্গল একটু হালকা হতেই দানিয়াল আঁতকে উঠলো I কোন ভুল রাস্তায় ঢুকে পড়ে নি তো ? না রাস্তা তো ঠিকই আছে ? তাহলে জোড়া পাহাড় গেল কোথায় ? দানিয়াল মনে মনে ভাবছে পাহাড় আবার হারায় নাকি ? তাহলে পাহাড়ে আরেকটি মাথা কোথায় গেল? যে জোড়া পাহাড়ের মাথা দেখে দানিয়াল তার শৈশব কৈশোর ও যৌবন জীবন কাটিয়ে যৌবন এর শেষ পর্যায়ে পৌঁছেছে I এই জোড়া পাহাড়ের কোলে দানিয়াল গরু চরিয়েছে প্রতিদিন সূর্য ওঠা দেখেছে, চাঁদের আলোয় দুটি পাহাড় কে এক হতে দেখেছে, রোদ-বৃষ্টির, গাছপালাগুলো বড় হতে দেখেছে I নদীর দু'ধারের জঙ্গল পাহাড় এর মাথায় গিয়ে শেষ হয়েছে I সেই জোড়া পাহাড়ের জোড়া কোথায় ? আতঙ্কে , ভয়ে , আপন হারানোর আশঙ্কায় পাহাড়ের দিকে ছুটতে লাগলো দানিয়ালI এক হাতে খুকরী চাপ দিয়ে ধরে শাল , শিমুল, সেগুন, বহেরা, অশ্বথ জঙ্গল এর মধ্য দিয়ে ছুটছে, আপন মানুষের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের আগে মানুষ যেমন দেখার জন্য সবকিছু উপেক্ষা করে চলে আসতে চায় ঠিক তেমন জোড়া পাহাড় তার আপনজন হারিয়ে নিঃস্ব I
চারিদিকে গুড়ুম গুড়ুম আওয়াজ, জোড়া পাহাড়ের মাঝে কালো মেঘ জমেছে আজ সূর্য ওঠেনিI বছরের প্রতিটি দিন জোড়া পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে সূর্য ওঠে, আলো ছড়িয়ে পড়ে ভুটিয়া বস্তির ওপর, আলো এসে পড়ে স্থানীয়দের কাঠের দোতলা বারান্দায়, তার সুপারি বাগানের ওপর দিয়ে আলো ঝলমল করে I সেই আলোয় নেচে ওঠে টিয়া পাখির ঝাঁক, ময়ূরের কেকা ধ্বনি, ভয়ঙ্কর সুন্দর আওয়াজ, তক্ষকের ক্ষণে ক্ষণে আওয়াজ বেরিয়ে আসে I আধুনিক পরিবেশ থেকে শত মাইল দূরে পাহাড়ের কোলে অবস্থিত এই বস্তিতে প্রকৃতির সৌন্দর্য ঢেলে দিয়েছে I
এই সর্বোপরি একটি অন্যতম পাহারাদার জোড়া পাহাড়ের জোড়া খসে পড়েছে I দানিয়াল মানতে পারছে না…….. ছুটছে… দানিয়াল ছুটছেI পাহাড় যতই এগিয়ে আসতে লাগল দানিয়েলের ছোটার গতি বাড়তে লাগল I মনে হচ্ছিল পাহাড় আগের মতই আছে I গানের সাথে যেন আজ পুরো গ্রাম ছুটছে শাল সেগুন, শিমুল, বট, জঙ্গল, জন্তু-জানোয়ার আকাশ বাতাস সবাই যেন ছুটছে দানিয়ালের এর পেছনে পেছনে I
পাহাড়ের ক্ষতস্থানে এসে দাঁড়ায় দানিয়াল, পাহাড়ের পূর্ব দিকের অংশটি পুরো খসে পড়েছে নদীর উপর I দেখতে দেখতে নদী বিশাল জলাধারের পরিণত হয়ে গেছে I দানিয়াল মাছ মারার জায়গা গুলো আজ শুকনো হয়ে গেছে জল নেই, মনে হচ্ছে যেন পুরো নদী শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে I ব্রিটিশদের তৈরি একমাত্র ঢালাইয়ের ব্রিজ এর গোরা উন্মুক্ত হয়ে পড়েছে I বড় বড় গাছপালা পাথর নদীর মুখে আটকে পড়েছে, মাঝেমধ্যে ঝপাৎ করে গাছের গুড়ি ভেঙে পড়ছে কখনো পাথর খসে পড়ছে I নদীর পশ্চিম দিকের অংশটি ভরে গিয়েছে, কিছুটা জল পশ্চিমের গা ঘেঁষে বেরিয়ে যাচ্ছে I
এই স্বল্প সময়ে গড়ে ওঠা জলাধারের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে দানিয়াল ভাবছে, এই নদীর বুকে মাছ ধরার সময় নদীর জলকে অল্প সময়ের জন্য বাঁধ দিয়ে তার জলধারা অন্যদিকে বাঁকিয়ে দেওয়া হয় এবং কিছুটা নিচে গিয়ে জাল পাতা হয় I জল যত কমতে থাকে মাছের ঝুরি তত তাড়াতাড়ি ভরতে থাকে I স্বল্প সময়ের জন্য নদী শুকিয়ে যায়, কিছুক্ষণ পর আবার বাঁধ খুলে দেওয়া হয়I নদী আবার আপন বেগে চলতে থাকেI এরকম কিছু একটা যদি করে নদীকে যদি বের করে দেওয়া যেত তাহলে হয়তো গ্রাম কে বাঁচানো সম্ভব I আজ গ্রামের বড় বিপদ I ডেবিট কে দানিয়াল জানালো এই বাঁধ কে ভাঙতে হবে কিছুটা, যদি পশ্চিম দিকে কিছুটা অংশ খুলে দেওয়া যায় তাহলে কিছুটা জল সেই দিক দিয়ে নেমে গেলে আমাদের এই নদীর পূর্বদিকে গ্রাম বেঁচে যাবে I
ডেভিড তারস্বরে বলে উঠলো—-- কোন জায়গা মরণে কে লিয়ে I
ঝুঁকি নিতে চায় না গ্রামের জন্য কেউই I দানিয়াল একাই একবার চেষ্টা করতে গেল, সবাই চেঁচিয়ে উঠলো মরনে কে লিয়ে যা রেহে হো I
বুড়ো হর বাহাদুর বলে, কুচ নেহি হো গা নদিকো I ইসকো কোন রোক সাকতা হ্যা , জিতনি ভি আয়ে বাধায় , এ আপনা রাস্তা খুদ বানায়েগা I
এই আশ্বাসে দানিয়েলের মন কিছুটা শান্ত হয় I দক্ষিণ আকাশে মেঘের গর্জন আবার শুরু হল, দু চার ফোঁটা বৃষ্টি এসে পরল I সকলেই গ্রামের দিকে পা বাড়ালো I দানিয়াল যেতে চায়না I একপ্রকার জোর করেই গ্রামবাসী ডেকে নিয়ে আসে দানিয়াল কেI সকলেই এখন একজনের উপরেই ভরসা, তাদের মোড়ের পাথরের সেই ভগবান I গতবছর নদী থেকে সুন্দর দুটি পাথর এনে বসিয়ে পুজো শুরু হয়েছিলI
গ্রামের কারো বাড়িতে আজ হাড়ি চরে নি I নিস্তব্ধ গ্রাম, প্রাণীগুলো আজ তেমন ডাকছে না, ময়ূরের কেকাধ্বনি ও শোনা যাচ্ছে না I গরুগুলো জঙ্গলের ধারে বৃষ্টিতে এরমধ্যে দাঁড়িয়ে আছে, হাঁস মুরগি গুলো নিচে চুপ করে বসে আছে, বনের ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজ নেই, নিস্তব্ধ, প্রলয়ের আগের অবস্থায় চারিদিক গুমোট পরিবেশ I
বৃষ্টি কিছুটা কমতেই দানিয়াল বেরিয়ে পরলো, হাতে একটি গাছের ডাল আর কোমরে খুকরীটা বেঁধে একা একাই বেরিয়ে পরলো I মনে হচ্ছে যেন কেউ পায়ে পাথর বেঁধে দিয়েছে, নিঃশ্বাস নিতে পারছি নাI তার ভালবাসার পাহাড় হারিয়ে গেছে, গ্রাম বড় সংকটে I অন্যরা বুঝতে না পারলেও দানিয়ালের মন জানান দিচ্ছে I শাল বাগানের জঙ্গলের রাস্তা ধরতেই ডান দিকে তাকিয়ে বলল তোদের আজ কেউ হারালো I এবারে কেঁদে ওঠে দানিয়াল I স্বজনহারা কান্না কতক্ষণ চেপে রাখা যায় ? গোটা পঞ্চাশেক বাঁদর গোল হয়ে বসে আছে, হাতে প্রত্যেকের একটা করে লাঠি, তারা শোক পালন করছে , নিশ্চুপে সকলে বসে আছে I কোথায় তাদের স্বজনকে দাহ করবে এটাই হয়তো ….তাই আজ ওরা নিশ্চুপ I দানিয়াল জঙ্গলের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলছে I
জল আরো বেড়ে গিয়েছে বৃষ্টি থামার লক্ষণ নেই I দানিয়ালের মনে হলে জল না নামতে পারলে রক্ষে নেই I পশ্চিম দিক দিয়ে নদীকে ঘুরিয়ে দিতে পারলে গ্রাম বেঁচে যাবে I আর জয়ন্তী কে তো ওরা দিনে কয়েকবার পাল্টায় , মাছ ধরার সময় গ্রামবাসি নদীকে কখনো পূর্বে কখনো পশ্চিমে সরিয়ে দেয় I এই কথা ভাবতে ভাবতেই গ্রামের দিকে ছুটতে থাকে দানিয়াল, জঙ্গল, বন, পাথর, উঁচু রাস্তা পেরিয়ে ছুটছে দানিয়াল, কোন দিকে হুশ নেই তার I পায়ের কাছ দিয়ে দুবার কালাচ , শঙ্খচূড়া হুস করে বেরিয়ে গেল, তাতে রাতে হুঁশ নেই দানিয়ালের I
গ্রামে রাস্তার মোরে পাকুর গাছের নীচে দাঁড়িয়ে সবাইকে জড় করলো I সকলকে বুঝিয়ে দানিয়াল নদীর দিকে আবার চলল, এবার গ্রামের আবালবৃদ্ধবনিতা সকলেই যোগ দিলো , গ্রামকে বাঁচাতে হবে I সেগুন গাছের গোড়ায় জল পেরোতেই ডেবিট চিত্কার করে উঠলো, কিরে দানিয়াল তোর পা দিয়ে রক্ত কেন?
হাত দিয়ে পায়ের কাদা কেচে ক্ষতস্থান দেখতেই আঁতকে ওঠে, শরীরে হিম বয়ে যায় I গ্রামবাসীরা সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, এমতাবস্থায় দানিয়াল পেছানো সম্ভব নয় I হাতে সময় নেই দানিয়ালের ও জয়ন্তী নদীর I দুজনের লড়াই এর শেষ প্রান্তে I সামনে আসতেই দানিয়াল বলে ও কিছুনা গাছের ডালের খোঁচা লেগেছে I
আকাশের মেঘ কালো থেকে ঘন কালো হয়ে যাচ্ছে, এক্ষুনি পশ্চিম দিক টা খুলে দিতে হবে I দানিয়াল, ডেভিড, সোনাদা সকলে মিলেই পশ্চিম দিকের গাছের গুড়ি গুলো ধীরে ধীরে সরা তে থাকে পাথরগুলো সরিয়ে নদীর জল বেরোনোর রাস্তা করতে থাকে I নদী কিছুটা গতি পায় পশ্চিম দিকে কিছুটা জল বের হতে থাকে I জল যত বেরোতে লাগলো দানিয়াল তত দুর্বল হতে লাগলো I দানিয়াল এপারে এসে ডেবিট কে বলে সবাইকে দেখে রাখিস, বলতে বলতেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে দানিয়াল I ডেবিট ভালো করে দানিয়েলের পা দেখেই চমকে ওঠে I প্রধান কে ডাকতে থাকে , ডেবিট দানিয়ালের শরীরটা কাঁধে নিয়ে ছুটতে থাকে গ্রামের দিকে I ওদিকে নদীর গর্জন বাড়তে থাকে I নদী আরেকটু খুলে দিলে জল কমে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিলI গ্রামে পাকুর গাছের নিচে দানিয়াল কে শোয়াতেই দানিয়াল এর চোখ-মুখ নীল হয়ে যায় I ওদিকে নদী গর্জন বাড়তে থাকে, দানিয়াল নারী স্পন্দন যত কমছে নদীর গর্জন তত বাড়ছেI শেষ স্পন্দন টি দপ করে উঠে নিভে গেল, ওদিকে গর্জন করে বাঁধ ভেঙে তুমুল বেগে এগিয়ে চলল জয়ন্তী নদী I পশ্চিমের বাংলো বাড়ি, ফরেস্ট রেঞ্জার অফিস, রেললাইন অফিস সব ভেঙেচুরে নিয়ে এগোতে থাকলো I বড় বড় গাছপালাগুলো এসে আটকে পড়ল ঢালাইয়ের ব্রিজে I উপরের অংশ , রাস্তা ভেঙে চলে গেল এবং অনেক বালি পাথর এসে ব্রিজকে ঢেকে ফেলল I
ভুটিয়া বস্তি সেইদিন রক্ষা পেয়ে গেল I কিন্তু চিরতরে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল মূল গ্রাম জয়ন্তীর সাথে I নদী দিনের পর দিন চওরা হতে লাগলো I শীতকালের নদীর উপর দিয়েই যাতায়াত করে দানিয়াল এর নাতি সোনাম থাপা I বর্ষাকালে পুরো তিন মাস কালাপানি নির্বাসন I পূর্বে ভুটান পাহাড়, আর চারিদিকে জয়ন্তি নদী I দক্ষিণ জয়ন্তি নদী আর ঘন বন I এই তিন মাস লেপার্ড হাতি বন্য জীবজন্তুর সাথে একসাথে বাস করতে হয় দানিয়েলের বংশধরদের I
দানিয়ালের স্মৃতির উদ্দেশ্যে পাকুড় গাছের তলায় বানানো শালকাঠের চাবুতারা এর ওপর বসে সোনাম থাপা ভাবছে আগামী বছর এই চাবুতারা রক্ষা করতে পারবে কিনা I প্রতিবছর জোড়াপাহাড় এর অবশিষ্টাংশ যেভাবে ক্ষয় হচ্ছে, তাতে নদীর বেড উঁচু হয়ে গেছে ভুটিয়া বস্তি নদীর থেকে অনেক নিচেI বালির দেওয়া বাঁধ কতদিনই বা টিকবে ? মাছ ধরার সময় নদীকে সহজেই বানিয়ে দিতে পারলেও বর্ষায় এই নদীর যে ভয়ঙ্কর রূপ তা বন জঙ্গল কিছুই মানে না I 100 ঘর বাড়ি থেকে এখন ২০-২৫ এ নেমে এসেছে I আগে দলোমাইট উত্তোলন এর জন্য বহু গাড়ী ঘোড়া লোকজন আসতো । অনেকের বাড়িঘর নদীতে ভেঙে গেছে কারো বা বালি পাথর দিয়ে বাড়ি ঢেকে গেছে I বসবাস করার জায়গা কমে যাচ্ছে I ফরেস্ট অফিস থেকে হাতির করিডোর হিসেবে এই ভুটিয়া বস্তি চিহ্নিত হয়েছে I গ্রাম খালি করতে হবেI সোনাম মনে মনে ভাবে এই বন জঙ্গল ছাড়া, এই জয়ন্তি নদী ছাড়া, এই জোড়া পাহাড়ের মাথা ছাড়া, ওই ভুটান পাহাড়ের কোল ছাড়া, শাল সেগুন, এখানকার তক্ষক, লেপার্ড হাতি, শেয়াল, জীবজন্তু গরু-ছাগল ছাড়া কিভাবে বাঁচবে …………………………
গ্রামের মানুষের এক মাত্র জিরানোর জায়গা পাকুরতলা নিচের এই চাবুতারা I এই চাবু তারায় যত পথচলতি লোক বসবে ততই বিদেহী আত্মার শান্তি পাবেI চাবুতারার মালিকের আত্মার শান্তি পাচ্ছে কিনা কে জানে? আগামী বছর এই ভয়াবহ অবস্থায় চাবুতারা থাকে কিনা সন্দেহ……………………….





ভেজাল 

পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়

মোহনপুর গ্রামে শম্ভু চ্যাটার্জি ছিলেন  আমাদের প্রতিবেশী।  এক্কেবারে  নিপাট  ভালো  মানুষ তিনি।   সাদামাটা  মানুষটিকে  সবাই  খুব পছন্দ করত।  সর্বজন শ্রদ্ধেয় এবং  অজাতশত্রু  এই মানুষটি   গান  ভালোবাসতেন।  বলতেন,   "গান ই প্রাণ, গান ই ওষুধ  এবং  অমৃত সমান।" 

 রোজই  দিনের  শেষে  একটা  গলা  ছেড়ে গান তিনি  গাইবেন, এটাই  ছিল  তার রুটিন।  এছাড়া
তিনি   সব সময় গান বাজনা,  আঁকা লেখা এবং ছোটো বাচ্চাদের নিয়ে থাকতে ভালোবাসতেন।

দিন দুয়েক হল আর শম্ভু দা'র গান শোনা যাচ্ছে না।  সেজন্য  এপাড়ায় সবাই বেশ চিন্তিত।

 সেদিন  খুব সকালে মর্নিং ওয়াকের সময়  তার বসবার ঘরে ঢুকে  দেখি,  চিন্তিত শম্ভু দা একটা চিনি ভর্তি  বাটির দিকে একনজরে তাকিয়ে আছেন। 

"আপনি কি দেখছেন,?  চিনির বাটিতে কি হয়েছে ? " আমি জিজ্ঞেস করলাম।

"আর বলো না ভাই,  আজ দিন পনেরো হল এই বাটি আলগা করে রেখেছি,  কিন্তু সে বাটিতে একটাও পিঁপড়ের দেখা  নেই। " তিনি বললেন।

...তাতে কি হল?  এত ভাববার কি আছে ? 

...না, ভেজাল চিনি আর কি।  চিন্তার বিষয় বই কি। 

আমি বিষয়কে অন্য দিকে ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, "আপনি দু' দিন  কোথায় ছিলেন?  আপনার গান শোনা গেল না ? "

...আমি গত চব্বিশ ঘণ্টা এক গেষ্ট হাউসে  নজরবন্দি ছিলাম।

...সে কি ?  কোথায় নজরবন্দি ছিলেন?  কারা আপনাকে নজরবন্দি করেছিলো? 

....গত পরশু আমি নহাটা গিয়েছিলাম।  নিজের জন্য  টুকিটাকি কিছু জিনিস কিনতে ।  ফেরার পথে  বাজারের পিছনে একটা চাতালে যা দেখলাম তাতে আমার তো  চক্ষু চড়কগাছ। 

....কি দেখলেন সেখানে? 

...একবস্তা হলুদের সাথে এক বস্তা আটা মেশানো হচ্ছে। 

...তারপর? 

....তারপর আর কি?  আমাকে তারা পারলে ধরে মারে আর কি?  আমি কেন সেখানে গেলাম।  আমি তাদের কাছ থেকে কোনো ভাবেই  নিস্কৃতি পেলাম না। আমার সঙ্গে তারা খারাপ ব্যবহার করেনি ঠিকই,  কিন্তু তাদের গেষ্ট হাউসে আমাকে এক রাত্রি থাকতে হল। একেবারে  যাকে বলে জামাই আদরে । বহু কষ্টে আমার স্বর্গগত পিতার নামে শপথ করে আমাকে বলতে হল, " আমি কিছুই দেখিনি । "

...তিনবার একই কথা,  আমি তাদের বললাম, " আমি কিছুই দেখি নি। "

...হলুদের সাথে আটা মেশালে কি হবে ? 

....কি  হবে ? দুই বস্তা হলুদ হবে।  হলুদ দু'শ টাকা কেজি, আর  আটা  ত্রিশ টাকা। দুপুরের রান্না তরকারি সন্ধ্যের মধ্যে টক হয়ে যাবে। গ্যাস অম্ল ইত্যাদি  হবে,  ডাক্তারের  কামাই  বাড়বে।  আর পেটের বারোটা বাজবে।  সেই  টোকো তরিতরকারি স্বাদ আনতে গৃহিনীরা চিনি ব্যবহার করবে চিনি মানেই তো সোডিয়াম সাইক্লোমেট।

শম্ভু দা এমন ভাবে  বলে চললেন, যেন তিনি একজন  বিজ্ঞানের শিক্ষক।  এবং তার প্রিয় ছাত্রদের তিনি  ক্লাস নিচ্ছেন। 

"নিষিদ্ধ ঘন চিনি (সোডিয়াম সাইক্লামেট) হাজার হাজার টন আমদানি হয়ে দেশে ঢুকছে। সাইট্রিক এসিড নামে আমদানি হচ্ছে এই বিষ। দেয়া হচ্ছে, মিষ্টি, বেকারি আইটেম, আইসক্রিম, বেভারেজ, জুস, চকোলেট, কন্ডেন্সড মিল্ক প্রভৃতি মিষ্টি
জাতীয় খাদ্য দ্রব্যে।

চিনির চেয়ে প্রায় পঞ্চাশ গুণ বেশি মিষ্টি এই ঘন চিনি পৃথিবীর অনেক দেশেই নিষিদ্ধ। ক্যান্সার, কিডনি বিকল, হজম শক্তি হ্রাস সহ নানাবিধ জটিল রোগের সৃষ্টি করতে পারে এই চিনি।
সাইট্রিক এসিডের মত দেখতে হুবহু এক রকম বলে অসাধু ব্যবসায়ীরা অতি সহজেই আমদানি করছে।সোডিয়াম সাইট্রেট দেখতেও ঘন চিনির মত ।   ঘন চিনির কেজি ২২০ টাকা হলে ভেজাল ঘন চিনি ১৪০ টাকা কেজি !
ভেজাল মিশাতে হলে তো ঘন চিনির মতই অন্য কোন একটি দ্রব্য মেশাতে হবে, যার দাম হবে খুব কম এবং মিষ্টি অথবা টেস্টলেস হতেই  হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষককে জিজ্ঞেস করলাম,  “চিনির মত দানাদার সার কি আছে
তবে কি ইউরিয়া?  তিনি বললেন, " ম্যাগনেসিয়াম সালফেট সার দেখতে চিনির মত দানাদার, দাম কম ১৫/২০ টাকা কেজি এবং সেটা  স্বাদহীন।ঘন চিনি এবং ম্যাগনেসিয়াম সালফেট সার দেখতে একই রকম। বিশ্বাস হচ্ছিল না, যে আমাদের সার খাওয়াচ্ছে আর সেটা একটা  বিষের সাথে। সেই সার মিশ্রিত ঘন চিনির প্যাকেট বা নমুনা না দেখে, একথা সহজেই  অনুমেয়।

 ম্যাগনেসিয়াম সালফেট সার সাথে ঘন চিনি!! হেসে তাঁরা বললেন,  এটি শরীরে গেলে দুনিয়ার কোন অসুখ থেকে বাদ যাবেন না এবং প্রথমশেষ হবে বাচ্চারা"।

নানা ধরণের মিষ্টি জাতীয় খাদ্যে দীর্ঘদিন ধরে এক বিষ ঘন চিনির সাথে আর এক বিষ রাসায়নিক সার ম্যাগনেসিয়াম সালফেট খেয়ে আমাদের অর্জিত সব পয়সা চলে যাচ্ছে ডাক্তারের ঘরে। 

অনুরূপ ভাবে জীরার গুড়োর সাথে তেজপাতার গুড়ো মেশানো হচ্ছে।  রাস্তার কলের জলে ড্রাম ভরে লেভেল লাগিয়ে মিনারেল ওয়াটার বানানো হচ্ছে। 

একটু নিশ্বাস নিয়ে বললেন এই দুই দিন রাত একই কথা ভাবছি। গেষ্ট হাউসে রাত্রিবাসের স্মৃতি আমার গান গাওয়া ভুলিয়ে দিয়েছে।



কবিতা 



অগ্রহায়ণ

মাথুর দাস


অগ্র মানে প্রথম আর হায়ণ মানে বছর,

এই ভাবে হয় যে-মাসের নামকরণ –

বুঝতে হবে সে মাসেই শুরু নতুন বছর,

এক কালে সে মাসে হতই বর্ষবরণ ।


নতুন ধান্যে হয় নবান্ন এবং লক্ষ্মীপুজো,

বিশেষত এই মাসকে বলি যে 'লক্ষ্মীর মাস' –

চাষীর জীবন-ইতিহাসে অর্থটি তার খুঁজো,

এ সময়ের জন্য যে তার অপেক্ষা বারোমাস ।


ধার দেনা আর দাদন ছিল এক সময়ের ভীতি,

মহাজন আর খাজনাদারের মুহুর্মুহু চাপ –

ভিন্ন রূপে হয়তো আছে এখনও সে সব রীতি,

না দিলে তার শাস্তি কড়া, নেইতো কোন মাফ ।


সোনালি ধানের মর্যাদাটি বুঝবে না কেউ অন্য,

কনক ধান্য কত যে মান্য কৃষক কুলের কাছে !

পিঠে পায়সে নবান্ন উৎসব পালিত হয় অনন্য,

চাষীর অভাব দূর হয় কিছু ঠিক অঘ্রাণ মাসে ।




অগ্রহায়ণ ও নবান্ন 

মজনু মিয়া 

খুশির ধান সোনালি রূপে খেতে দোলে
ধান পেকেছে মন ভরে যায় আনন্দ
নববধূ ঘরে এলে খুশি আনন্দ 
তেমনি, হেমন্তের ধানে আনন্দ 
উৎফুল্ল মন মানসিকতা ফোলে
দূরে যায় মন ভেতরের নিরানন্দ 

চারিদিকে ফুরসত নেই কাজে কর্মে 
উঠোনে ধান আসে বুক চওড়া হয়
গর্ব লাগে কাজের স্বীকৃতি পেয়ে মনে
অভাব হবে না গৃহের আর অন্নে
গড়ে গহনা, শাড়ি বাসনা পূর্ণময়
ভালো লাগে চলাফেরায় পূণ্য ধর্মে।



শহর থেকে গাঁয়ে
  সুনন্দ মন্ডল
       
কুয়াশার চাদর উঠেছে কেবল
অঘ্রানেরই গা'য়ে।
নবান্নের সুবাস ছুটলো দেখো
শহর থেকে গাঁয়ে।

হাল্কা আমেজ খুশি রঙের
দিক দিগন্তে ছড়ালো।
উৎসবের গন্ধে বাতাস কেমন
জড়ো করে আলো।

হেমন্ত এলো শিশির ফোঁটায়
মানুষ নামলো মাঠে।
চারিদিকে আজ ধানের মেলা
খুশিতে দিন কাটে।



প্রবন্ধ 



বাংলায় হিন্দি আগ্রাসন বাঙালি কিছুতেই মেনে নেবে না
বটু কৃষ্ণ হালদার

সমগ্র বিশ্ব বাসীর কাছে বাঙালি জাতি ও  প্রিয় বাংলা ভাষা আবেগের পরিস্ফুটন।বিশ্বে একমাত্র বাঙালি জাতি ও ভাষাকে নিয়ে যুগের পর যুগ পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে।ইতিমধ্যেই বিশ্বের বহু দেশে বাঙালির বাংলা ভাষা,রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা লাভ করেছে।লন্ডনের রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে বাড়ির নেমপ্লেট এমনকি রাষ্ট্রপুঞ্জে বাংলা ভাষা নিজের আধিপত্য লাভে সচেষ্ট হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষ নিজেদের ভাষা ছেড়ে বাংলা ভাষায় গান গেয়ে সমৃদ্ধি লাভ করছে। বাঙালি হিসাবে এই বিষয়গুলো অত্যন্ত গর্বের। বইপ্রেমী,আড্ডাবাজ,হুল্লোড় ভোজন রসিক বাঙালির অন্যতম পরিচয় হলো বাংলা ভাষায় কথা বলা।এই বাংলা ভাষায় সর্বপ্রথম "মা" শব্দটি উচ্চারণ করে।
বাংলা ভাষা_বাঙলা, বাঙ্গলা,আবার বাঙ্গালা নামেও পরিচিত, এটি একটি ইন্দো-আর্য ভাষা, যা দক্ষিণ এশিয়ার বাঙালি জাতির প্রধান কথ্য ও লেখ্য ভাষা। মাতৃভাষীর সংখ্যায় বাংলা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের পঞ্চম ও মোট ব্যবহারকারীর সংখ্যা অনুসারে বাংলা বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম ভাষা।বাংলা ভাষা বিকাশের ইতিহাস ১৩০০ বছর পুরনো। চর্যাপদ এই ভাষার আদি নিদর্শন।
অষ্টম শতক থেকে বাংলা র রচিত সাহিত্যের বিশাল ভান্ডারের মধ্যে দিয়ে অষ্টাদশ শতকের শেষে এসে বাংলা ভাষা তার বর্তমান ও আদি রূপ ধারণ করে। বাংলা ভাষার লিপি হল বাংলা লিপি।সর্বপ্রথম বাংলায় পদ রচনা করেছিলেন কাহ্নপা। বাংলা ভাষার প্রথম কবি এবং আদি কবি বলা হয় কাহ্নপাকে।এক কথায় কাহ্নপাকে বাংলা ভাষার জনক ও বলা যেতে পারে। বাংলা ভাষার উৎপত্তি সময়কালীন আরো কিছু প্রচলিত লিপির কথা জানা যায় ভাষা সম্পর্কিত। সাহিত্য জগতের অন্যতম তথ্য নির্ভর প্রাচীন গ্রন্থ "ললিতবিস্তর" বই থেকে জানা যায় গৌতম বুদ্ধের সময় বালক গৌতম তাঁর শিক্ষার শুরুতেই ৬৫টি প্রচলিত লিপির কথা জানতে পারেন।সেই লিপিগুলির মধ্যে অঙ্গ, বঙ্গ, মগধ, কিরাত, ব্রাহ্মী ইত্যাদি লিপি ছিল, তবে নাগরী বা দেবনাগরী ছিল না। সে সময় হিন্দি বলে কোন কিছুই ছিল না।আজ যে লিপি প্রয়োগ করে হিন্দি ভাষার আগ্রাসন চলছে তা’ কোথা থেকে, কখন থেকে এলো কেউ বলতে পারেন?
যে ভাষা,লিপির কাঁধে ভর করে হিন্দি ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা দেওয়ার অধিকার চাপানো হচ্ছে সেই সংস্কৃত একটি ভাষা, তা’ লিপি হয় কিভাবে?আবার অতীতে বৈদিক ব্রাহ্মণরা যে লিপি ব্যবহার করতো সেটাই ব্রাহ্মী লিপি। এই লিপি আরামাইক বা খরোষ্টী লিপির মতই,মাত্রা নেই। ব্রাহ্মণরা যখন এই লিপি নিয়ে আসে তখন অঙ্গ, বঙ্গ, মগধ, কিরাত এলাকায় প্রাকৃত ভাষার নিজস্ব লিপি ছিল, নানা পুস্তকও ছিল। বৈদিক ব্রাহ্মণরা গুপ্ত যুগের পরে প্রতিপত্তি হারালে ব্রাহ্মী লিপির ব্যবহার কমে যায় ও প্রাকৃত লিপিগুলি গুরুত্বপূর্ণ হয়।বলতে পারেন হিন্দি ভাষার বয়স কত?বড় জোর মেরেকেটে দেড়শ বছর।অথচ ব্রিটিশ ভারতের কারেন্সি নোটে আটটা ভাষার মধ্যে বাংলা ভাষা স্থান ছিল,হিন্দি নয়।
যারা বাংলা ভাষায় কথা  বলেন তাদের বাঙালী বলা হয়,হিন্দি কে রাষ্ট্রীয় ভাষার স্বকৃতি দিয়ে বাঙালিদের মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চাইছে। ঝাড়খণ্ড,বিহার,সহ হিন্দি ভাষার বহু রাজ্যে প্রায় ৫০_৬০% বাঙালী, অথচ বাংলা ভাষায় লিখতে পারে না, পড়তে পারে না,ওদের কে জোর করে হিন্দি শিখতে বাধ্য করা হয়, ওদের আগামী প্রজন্ম হিন্দি ভাষীতে পরিণত হবে,বাঙালি জাতি সত্তা মুছে দিতে চাইছে,এইভাবে রাজ্যে রাজ্যে বাঙালী জাতি চিরতরে হারিয়ে যেতে চলেছে। অথচ বাংলায় বহু হিন্দি ভাষার জনগন আছেন,তারা বহাল তবিয়তে তাদের ভাষায় কথা বলেন।এখানে জোর করে বাংলা ভাষা চাপিয়ে দেওয়া হয় না।বাংলায় ভাষা সংরক্ষণ না থাকার জন্য হিন্দি ভাষায় কথা বললেও রাজ্য সরকারের বহু দপ্তরের চাকরি ও করছেন। রাজনৈতিক স্বার্থে তাদের সমস্ত সুযোগ সুবিধা করে দেওয়া হচ্ছে আর তাতে বঞ্চিত হচ্ছেন বাংলা ভাষাভাষীর বাঙালি ছাত্র-ছাত্রীরা।
কেন্দ্র সরকারের এক রাষ্ট্র,এক নির্বাচন সমর্থন যোগ্য।কিন্তু ভাষার ক্ষেত্রে স স জাতির স্বাধীনতা অবশ্যই থাকা উচিত। জোর করে কোন ভাষাকে চাপিয়ে দেওয়া যায় না। তাতে প্রত্যেক জাতির আত্মমর্যাদা অবশ্যই ক্ষুন্ন হবে। তবে পশ্চিমবাংলায় হিন্দি ভাষার আগ্রাসন বাঙালি কোনমতেই মেনে নেবে না। কারণ অতীতে এই বাংলা ভাষার আত্মমর্যাদা রক্ষা করার জন্য বাঙালির রক্তে বাংলার মাটি ভিজেছিল। বুকে বুলেটের গুলি খেয়ে তারা বাংলা ভাষার অস্তিত্বকে রক্ষা করেছে। অবিভক্ত বাংলাদেশের মানুষ উর্দু ভাষার আগ্রাসন মেনে নেয়নি। বাংলা ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সর্বপ্রথম আওয়াজ তুলেছিলেন। তাঁকে নৃশংস ভাবে হত্যা করা হয়।১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সালাম ল,রফিক,বরকতদের রক্তে লাল হয়ে উঠেছিল ঢাকার রাজপথ। এর পর ১৯৬১ সালে আসামের শিলচরের বরাক উপত্যকায় অসমীয়া ভাষার আগ্রাসন মেনে নেয়নি বাঙালিরা।অসমীয়া ভাষাকে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল বাঙ্গালীদের উপর। তার বিরুদ্ধে ভয়ংকর আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। সেই আন্দোলনে ভাষা আন্দোলনকারীদের উপর অকথ্য অত্যাচার চালানো হয়।তাদের উপর সরকার নির্বিচারে গুলি চালায়।১৯৬১ সালের ১৯ মে, ষোড়শী কমলা ভট্টাচার্য সহ ১১ জন প্রতিবাদীকে শিলচর রেলওয়ে স্টেশনে আসাম প্রাদেশিক পুলিশ গুলি করে হত্যা করেন। এই সমস্ত মর্মান্তিক ঘটনাগুলো সাক্ষ্য দেয়, বাঙালি তার প্রিয় বাংলা ভাষাকে হৃদয়ে স্থান দিয়েছে। বাঙালি ভাষার জন্য যেমন জীবন দিতে পারে, তেমনি  বাংলা ভাষার জন্য আগামীতে অপ্রতিরোধ্য আন্দোলন গড়ে তুলতেও পারে সেটা কখনোই ভুলে গেলে চলবে না। তাই নিজের ভাষার প্রতি সন্মান জানাত হিন্দি সাম্রাজ্যবাদের এই ঘৃণ্য চক্রান্তের বিরুদ্ধে দিকে দিকে  ঐক্য গড়ে তোলার আহ্বান জানাই।




ছবি 




সোমনাথ বণিকের আঁকা দুটি ছবি 









রিসা দাসের আঁকা একটি ছবি 





মুজনাই অনলাইন অগ্রহায়ণ  সংখ্যা ১৪২৯