Saturday, September 4, 2021


 

আমার অঙ্গীকার

অমিতাভ সরকার


আমি শিক্ষক আমি শিক্ষিকা
         ভাঙ্গতে পারি, গড়তে পারি 
                   আমার আছে মেধা।
আমি শিক্ষক আমি শিক্ষিকা
         শিখতে পারি, শেখাতে পারি 
                    আমার আছে  ক্ষুধা।
আমি তোমাদের অনেক
        বকতে পারি, বোঝাতে পারি 
                   আমার বুকে ভালবাসা।
তোমায় সাথে নিয়ে পেরোব --
        দুর্গম গিরি, অরণ্য, মরু
                  আমার দুচোখ ভরা আশা।
আমি শিক্ষক আমি শিক্ষিকা 
        শিক্ষার্থী আমার সম্বল
                  খাতা, বই, কলম হাতিয়ার।
পাল্টে দিতে আমিই পারি 
        আলোর শিখা আমিই ধরি
                  ভাঙ্গতে অন্ধকারের কারাগার।
অস্ত্রহাতে রক্তচক্ষু শাসকের
       সম্মুখে, আমিই বলতে পরি--
                 " দড়ি ধরে মারো টান "।
আমার শ্রমে আর যত্নে 
      ললিত হয়,  অঙ্কুরিত হয়
                  নবজীবনের জয়গান।


শিক্ষক: সেকাল ও একাল

পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় 


আজ  এই  বিশেষ  দিনটিতে  হারিয়ে   যাওয়া স্কুল  জীবন,  আর  সেই  সব  শিক্ষকদের কথা মনে  পড়ছে  যারা  শিখিয়েছিলেন, " আমি ভয় করব  না , ভয়  করব  না,  দু'বেলা মরার আগে মরব  না , ভাই  মরব  না।"  যাদের শিক্ষায় বড়ো হয়েছি।  জীবনের  বিভিন্ন  সময়ে তাদের শিক্ষা কে  কাজে  লাগিয়েছি।  কেউ  কেউ  দ্রোণাচার্য হয়ে  পাশে  দাঁড়িয়েছেন,  ফ্রেন্ড  ফিলোসফার, গাইড হয়ে।

জন্মাবার  পর "মা"  ডাকটা  বোধকরি   কাউকে শিখিয়ে   দিতে  হয়  না।  একটু  যখন  বুঝতে শিখলাম,    তখন   মাকেই   অনুকরণ   করা শিখলাম।  মায়ের  শিক্ষায়  এবং  আদরে  বড় হলাম।  

জাতীয়  শিক্ষা  নীতি,   বিভিন্ন  সময়ে  বিভিন্ন শিক্ষা  কমিশন  এর  নির্দেশ  মেনে  নির্ধারিত হয়। কিন্তু  মা  যে  ভাবে  তার  শিশু  সন্তানকে বড়ো  করে  তোলেন,   সেটা  কোন  কমিশন,  নীতি  ইত্যাদির  ওপরে  ভিত্তি  করে  হয় না। 

ব্যাক্তিগত  ভাবে  চোখ  রাঙানী  বা  কানমলা খেলেও  মা  এবং  বাবার  কাছে  কখনো জোর বকাবকি  বা  মার খাইনি,  অথচ  তাদের  গড়া মূল্যবোধের  ওপর    ভিত্তি  করেই  স্কুল  বা কলেজ  জীবন  এর  পাঠ  নিয়েছি।  আজকের এই  পূন্য  দিনটিতে  তাদের  আভূমি  প্রণাম জানাই,   তাঁদের  স্মরণ  করি।


স্কুল  জীবনে  নীলডাউন,  বেঞ্চের  ওপর  কান ধরে  দাঁড়ানো  ও  কান  মলা,  কখনো  কখনো হাতের  তালুতে   কাঁচা  কঞ্চি  বা স্কেল  এর চপেটাঘাত।   এমনই  কঠিন  ও  কঠোর শাসনের মধ্যে  আমাদের  বড়  হয়ে  ওঠা।  যে শাসন থেকে বোধকরি   স্বয়ং কবিগুরুও নিস্কৃতি  পান নি । মাষ্টারমশাই  এর  একবার  তাকানো  বা না তাকানোর  মধ্যে  ফারাক  ছিল  বিস্তর।  সব থেকে  বড়ো  বিষয়  যে  কথা  না  বললেই  নয়,  তা  হ'ল  মূল্যবোধ  এর  শিক্ষা।  যৌথ  পরিবার ভাঙবার  সাথে  সাথে  ভাঙতে   শুরু   করল সমাজ  ব্যবস্থা। 

আমরা  যে  সকল  পাড়ার  দাদা,  কাকা,  দের ভয়ে  সন্ধ্যার  পর  বাড়ির  বাইরে থাকতাম না। সিনেমার  হলে  যেতাম  না,  অাজকের  দিনে,  আজকের  প্রজন্ম  ( সকলে  অবশ্যই নয়)  সেই পাড়ার  দাদা  বা  কাকার  কাছে গিয়ে,  " মিস্টার সেন, বা  মিস্টার  বোস,  ফায়ার   প্লিজ। "  বলে আগুন  চাইতে,   পিছুপা  হচ্ছে  না।

আজকের  দিনে  স্কুল  শিক্ষা  লাটে  উঠেছে। অনলাইনে  শিক্ষার  সবচেয়ে  বড়  বিপদ, নেটদুনিয়ার   গ্লোবাল  ইনভেশান,  ছাত্রকে তার জীবন  গড়া  এবং  মানুষের  মতো মানুষ হওয়ার পথে  বড়ো  প্রতিবন্ধক  হয়ে  দাঁড়িয়েছে।


 ভঙ্গুর মেরুদণ্ড 

মৌসুমী চৌধুরী 


   দূর থেকে জটলাটা দেখে মনে মনে একটু থমকে যায় দীপ্ত। ভীষণ একটা অস্বস্তি যেন ঘিরে ধরে। এই তো এখুনি আবার হাত তালি বাজিয়ে "টাকা দে" বলে রে রে করে ধরবে। ঋজুকে টিউশন পড়িয়ে বাড়ি ফিরছে দীপ্ত। সন্ধেটা একটু গড়িয়ে গেছে৷ একটা অঙ্ক কিছুতেই মিলছিল না। সেটা মেলাতে গিয়েই দেরী। এদেরকে তো আগে কখনও এ পথে দেখেনি!কে জানে বাবা, নতুন আমদানি হল নাকি! দমবন্ধ করে কোনক্রমে জায়গাটা পেরোনোর সময় দীপ্তর কানে আসে,
— "এই চিকনা, আমাদের কিছু না দিয়ে কোথায় চললি রে ? দে,  দে রে ... কিছু তো দিয়ে যা..."
গাঁকগাঁক আওয়াজে দীপ্তকে ঘিরে ধরল তিন চারজন কিন্নরী। জোরে জোরে তালি বাজাতে লাগল তারা। ভয়ে ঘামতে থাকে দীপ্ত। আজই মাস মাইনের টাকাটা দিয়েছেন ঋজুর বাবা। শুনেছে আজকাল এরা নাকি চুরি-ছিনতাই প্রভৃতি নানা ক্রাইমের সঙ্গে যুক্ত থাকে।  
      হঠাৎই কিন্নরী দলের একজন ভালো করে দীপ্তর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,
— " আরে স্যার, আপনি?" 
অস্বস্তিতে সিঁটিয়ে যায় দীপ্ত। মুখ থেকে কথা সরে না।
— " আমায় চেনেননি, তাই না? আমি কিন্তু আপনাকে ঠিক চিনেছি। আপনি দীপ্ত স্যার না?"
বলেই ঢিপ করে দীপ্তকে প্রণাম ঠোকে ফর্সা বিনুনি ঝুলনো দীর্ঘদেহী কিন্নরীটি।
   অস্বস্তিতে মুহূর্তের জন্য একটু যেন পিছিয়ে সরে আসে দীপ্ত। তার বাইশ বছরের শিক্ষকতা 
জীবনের মাথায় হাতুড়িপেটা করেও কোন কিন্নরী ছাত্রের কথা মনে পড়ল না তার। 
— " চিনতে পারলেন না তো, স্যার। আমি পলাশ। এখনকার নাম যদিও পাপড়ি। সেই যে "সৃষ্টি কোচিন সেন্টার"-এ পড়তাম। আপনারা রাখলেন না,  বাবাও বের করে দিল বাড়ি থেকে...।"
 

       তখন চাকরি পায়নি দীপ্ত। সকাল সকাল "সৃষ্টি কোচিন সেন্টার"-এর মালিক বিপ্লবদার ফোন আসে ,
— " আপনার ক্লাসে যে একটা হাফ-লেডিজ রয়েছে,  ওই গে আর কি। এতদিন বলেননি তো স্যার?"
 — " কেউ  হাফ-লেডিজ হলে আমি কি করব?
আমি বলতে যাব কেন? আশ্চর্য তো!"
বিরক্তি আর বিষ্ময়ে উত্তর দেয় দীপ্ত।
— " আরে ওই পলাশ। অন্য গার্জিয়ানরা তো দল বেঁধে  অবজেকশান করছেন। ওকে আর এই কোচিনে রাখা যাবে না। তাঁদের ছেলেদের এমন একজনের সঙ্গ থেকে দূরে রাখতে চান তাঁরা।"
       শেষদিন পলাশ খুব কেঁদেছিল। আর্তনাদ করে বলেছিল, 
— "স্যার আমাকে বের করবেন না। তাহলে যে
 রাস্তায় দাঁড়াতে হবে। অনেকের অনেক  বিদ্রূপ-অবজ্ঞা নিয়েই তো টিঁকে ছিলাম। আমাকে থাকতে দিন। আমাকে বাঁচান, স্যার।"
        কেউ কিছুই করেনি পলাশের জন্য। কেউ বাঁচায়নি তাকে। আর দীপ্ত তো খুব সুচারুভাবে বিষয়টি ইগনোর করেছিল। 
       পাপড়ি হঠাৎ তার ঝোলা থেকে একটা বড় ক্যাডবেরি বের করে দীপ্তর হাতে গুঁজে দিয়ে বলে,
— " নিন, স্যার। সামান্য গুরুদক্ষিণা। একদিন আপনি অঙ্ক শিখিয়েছিলেন। যদিও জীবনের অঙ্ক মেলাতে পারিনি। অ্যাই তোরা স্যারকে যেতে দে, সর সর যা ..." 

     মাথা নিচু করে নিজের পথে এগিয়ে যায় দীপ্ত। পিছন থেকে কিন্নরীদলের হাততালির ফটাস ফটাস শব্দ যেন জাতির মেরুদণ্ডের ভঙ্গুর দিকটিকে বিদ্রুপ করতে থাকে। 


 মাষ্টারমশাই

কাকলি বিশ্বাস সরকার


    আমাদের গাঁয়ের সেই ননি মাষ্টারকে
   দেশ, দুনিয়ার লোক সবাই জানে।
কত কত ছাত্র তার , আছে বটে দুনিয়া জুড়ে।
 ঐ যে রায়পুরের বিডিও সাহেব,
              তারই ছাত্র বটে ,
এখনও সেই বাবুটা , সময় বার করে,
 প্রতি বছর আসে গুরু প্রণামের লাগি।
  আমি গাঁয়ের সাধারণ বৌ বটে,
 কত কথা গুছিয়ে বলতে না জানি,
      আমাদের গাঁয়ের মাষ্টারমশাই,
তাকে লিয়ে  সকলে গর্ব করে।
   গত বছরই ইস্কুল থেকে  রিটারড হয়েছে বটে,
      দু বেলা নেয়ম  করে ছ্যত্র  পড়ায় রোজ।

        কারুর  থেকে কানাকড়িও লেয় না নিজে।
    সেই পুরানা ছাতাটা  রোজের সাথী,
          মুখে গালভরা হাসি বটে।
      পরনের প্যান্টালুনটা অনেক পুরনো।
   নাই  কোন  বাইরের সাজ,
       শিক্ষায় তার মূল্যবান সম্পদ।
      আমাদের গাঁয়ের ননিবাবুই
            আদর্শ মাষ্টারমশাই।
       মানুষ গড়ার  কল।
   ননিমাষ্টার তুমি দীর্ঘজীবী হও।

         এ সমাজের  লাগি।


শিক্ষকের ছড়াছড়ি 

সুশান্ত পাল 

শিক্ষক আর শিক্ষার্থী ব্যাপারটা শুধু মাত্র চারদেয়ালে কৃষ্ণফলকের মধ্যে সীমাবদ্ধ এটা ভাবা সত্যি বোকামি,, সভ্যতার প্রায় সর্বত্র শিক্ষার এক অগাধ পরিধি,, জীবনে বেঁচে থাকার শিক্ষা কিন্তু  পরিবারের ও সমাজের এক অনুকরণ অনুসরনের অভিব্যাক্তি,, আসলে প্রকৃত শিক্ষক হিসাবে কাকে প্রাধান্য দেবো তা নিয়ে আমার একটু ধর্মসংকট আছে,, একবার ভাবি মা, আর একবার ভাবি বাবা পরে অবশ্য বুঝলাম না আরও অনেকেই আছে অন্তত জীবন বুঝতে যারা আমার চোখ খুলিয়েছে তারা প্রত্যকেই আসলে আদর্শ থেকে আদর্শতর,, একটা গ্রন্থাগার হতে পারে পথ প্রদর্শক অন্তত আমার কাছে।  তাহলে কাকে এগিয়ে রাখবো এটা নিয়ে ফাঁপরে আছি,, 

যাইহোক শিক্ষার আর একটু নমুনা পেস করি... একদিন এক ভদ্রলোক তার মেয়ের সঙ্গে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছেন, হঠাৎ একটা রিক্সা দেখায় সেই ব্যক্তি রিক্সাওয়ালাকে ডাকলেন "ও রিক্সা ও রিক্সা এদিকে শোন্।'  এই শুনে সেই মেয়েটি তার বাবাকে বললো, 'এভাবে উনাকে সম্বোধন করাটা অসম্মানের  তুমি দাদা করেও ডাকতে পারতে!` সত্যি সেদিন অনেক কিছু শিখলাম,, 
আর একটা ঘটনা বলি,  আমার দিদি তখন স্কুলে পরে, সরস্বতী পুজোর জন্যে স্কুলে সব মেয়েরা ঝাড়ু দিচ্ছে, যথারীতি এক শিক্ষিকার মেয়েও ঝাঁট দিচ্ছিল,, এই দেখে সেই শিক্ষিকা তার মেয়েকে নাকি সরিয়ে আনার জন্যে বললেন, `তোমার ধুলো লেগে শরীর খারাপ করবে চলে এসো...` তার মেয়ের উত্তর দিল, `এদের সবাইকে তুমিতো পরিষ্কার করতে বললে,  আর আমি তোমার মেয়ে বলে বাদ!` অনেক কিছু শিখলাম সেই দিদির বান্ধবীর কাছ থেকে,, 

আসলে শিক্ষা ব্যাপারটাই এত শক্তিশালী যে সব কিছু বদলে দিতে পারে,, তাইতো শিক্ষার্থী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সবাইকে শিক্ষকও হতে হবে, তবেই তো এক মুক্ত পৃথিবী আমরা পরের প্রজন্মকে উপহার দিতে পারব ||


আমাদের আই সি স্যার

বিজয় বর্মন 


অনেকদিন হলো, আমার কিছু বলার ছিল,
শৈশব কৈশোর পেরিয়ে আবদ্ধ আমি চিরাচরিত সংসার মায়াজালে,
দারিদ্রতা আর আমার লুকোচুরিতে সব ভুলে থাকার এক কৌশল আয়ত্ত করেছি,
এক কথায় বলা যায় " স্বার্থপর "

তবু বাধ মানে না, না বললে নয় দু-চার কথা,
জীবনে যার কাছে যতটুকু শিখেছি, শিখে যাচ্ছি এখনো,
প্রত্যেকে আমার গুরুস্থানীয়,
নত মস্তকে আমি স্বীকার করি।

আজ বিশেষ দিনে, আমার মনবিতানে স্কুল জীবনের কিছু স্মৃতি কথা উদ্ভাসিত,
সেদিনের সংস্কৃত ক্লাস, সাদা ধুতি পাঞ্জাবিতে প্রাঞ্জল একজন ব্যক্তিত্বের পরম স্নেহ,
তার তত্ত্বাবধানে চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডাক্তার পিনাকি রঞ্জনের,
কাছে যাওয়া,
দূরের জিনিস যে কিছু দেখতে পাই না,
সেদিন তিনি বুঝতে পারলেন কেন আমি প্রশ্নগুলির সঠিক উত্তর দিতে পারছিলাম না,
দুটো চোখের পাওয়ার যে( -3 )সেই কিশোর বয়সে,
হয়তোবা আমি জানতেও পারতাম না।

অকৃতজ্ঞের মত,
জানানোর প্রয়োজন টুকুও বোধ করিনি,
অনেক চেষ্টা করেছি পরবর্তীকালে, টানাটানির সংসারে আর হয়ে উঠেনি স্যারের সাথে দেখা করতে,
তাই বিশেষ দিনে, স্যার কে আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা,

আমার কৃতজ্ঞতা স্বীকার করবেন,
আমাদের প্রাণের প্রিয় আইসি স্যার,
শ্রীযুক্ত রুণু বোস মহাশয়।


 শিক্ষাগুরু

বিপ্লব গোস্বামী


শিক্ষা হলো প্রদীপ শিখা
ঘুচায় আঁধার কালো,
শিক্ষক হলেন আলোর দিশারী
জ্বালান মনে আলো।

ধূপের কাঠির ন‍্যায় শিক্ষক
নিজেই পুড়ে যান,
শূন‍্য করে নিজের ভাণ্ড
জ্ঞান করেন দান।

যেদিন আমার চোখ ফোটেনি
নিকষ কালো রাত,
তিনিই সেদিন দেখিয়ে ছিলেন
আলোর সুপ্রভাত।

যার কাছেতে শিক্ষা নিয়ে
যাত্রা হলো শুরু,
তিনিই হলেন আলোর দিশারী
তিনিই শিক্ষা গুরু।

যার আশিসে পদ‍্য লিখি
যার আশিসে কবি,
এসব কিছুই আমার নয়তো
তার শেখানো সবই।  


 

শিক্ষা, চেতনা ,বর্তমান ছাত্রসমাজ ও শিক্ষক দিবস
আফতাব হোসেন
শিক্ষক দিবসের কি আদৌ কোন গুরুত্ব আছে এখন ?

ঠিক কোন দিকে যাচ্ছি আমরা ?

কাদের হাতে আমাদের ভবিষ্যৎ ?

ছাত্র ছাত্রীরা কি সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে ?

ভাবুন.. ভাবতেই হবে ...


আজ থেকে বছর কুড়ি আগেও স্কুল , বাসস্থান আর ধর্মস্থানের মধ্যে খুব একটা পার্থক্য চোখে পড়তো না । স্কুলের দেওয়ালে অশান্ত যৌবনের কারুকার্য আর টেবিল চেয়ার সব বিষয়ের এনসাইক্লোপিডিয়ার চূড়ান্ত রূপ হয়ে থাকলেও  কোনদিনও অশ্লীলতার সীমা পের করেনি বলেই হয়ত আজ অব্দি ওগুলোই স্মৃতি হয়ে মনের মণিকোঠায় কোথাও যেন রয়ে গেছে সক্কলের । অনেক বয়স্ক মানুষ কেও অনেক সময় স্মৃতি হাতড়ে  তার পুরোনো স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে যেমন দেখেছি তেমনি সদ্য মা হওয়া রমণীকে স্কুলের রি ইউনিয়নে সন্তান স্নেহে নিজের পুরোনো বসার জায়গাকে হাত বুলিয়ে চোখ ছলছল করতেও দেখেছি । প্রিয় শিক্ষক শিক্ষিকার আনন্দ বা দুঃখে এক হয়ে লন্ডনের ইঞ্জিনিয়ার রমেন আর লালনপুরের রাজমিস্ত্রি রাজেশ কেও একাত্মতার সুরে  বাঁধতে দেখেছি একসময়ে। আসলে একটা টান ছিল ।   একাত্মতা ছিল  । সম্মান ছিল ।


পরীক্ষায় ফল নিয়ে  একটা সময় ছাত্র ছাত্রীদের চেয়েও অনেক বেশি মানসিক উদ্বেগের মধ্যে শিক্ষক শিক্ষিকারা থাকতেন । অনেক সময় দেখেছি মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্ট ছাত্র ছাত্রীদের কাছে আসার আগেই টিচার্স কমন রুমে শিক্ষক শিক্ষিকারা নিজেদের মধ্যেই সলা পরামর্শ করে ছাত্র ছাত্রীদের গুন আর ত্রুটি গুলো বের করে আনতেন । তারপর বাহবা বা মিঠা তিরস্কার জুটতো ছাত্রছাত্রীদের । ছাত্র ছাত্রীরাও মাথা পেতে নিত সব কিছু আর সঙ্গে নিজেদের ফলাফলের পর্যালোচনা করতে সাহস করতো । এমনকি ' ফেল করলে বাড়িতে আর পড়াবেনা ' জাতীয় ছাত্র ছাত্রীদেরও বাড়িতেও বোঝানোর কাজটিও একসময় স্কুল থেকেই নিয়ন্ত্রিত হত । সে সব স্বর্ণযুগ ছিল হয়ত ।

এরপর যুগের নিয়মে সে সবের পরিবর্তন হয়েছে । শিক্ষা স্থান এখন শিক্ষা স্থানের পাশাপাশি নানারকম সুবিধা উপলব্ধের স্থানে রূপান্তরিত হয়েছে । এতে একদিকে যেমন অনেক শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীদের ভীষন রকমের সুবিধা হয়েছে ঠিকই ,  তেমনি শিক্ষক শিক্ষিকা দের হাত থেকে ' শাসন ' নামক অধিকার কেড়ে নিয়ে শিক্ষাদানকে ' ব্রতর ' থেকে অনেক বেশি ' পেশা ' হিসেবে আত্মপ্রকাশ করিয়েছে নতুন নতুন সব নিয়মের বেড়াজাল । শিক্ষা স্থান যা কিনা ধর্ম স্থানের সমতুল্য হয়ে যুগ যুগ ধরে পূজিত হত ছাত্রদের কাছে তার ওপর বিভীষিকা নেমে এসেছে । প্রায় প্রতি দিনই শুনছি কোন না কোন স্কুলের ওপর ছাত্রছাত্রীদের হামলার খবর । কখনও রেজাল্ট খারাপ হবার জন্য, কখনও আবার শিক্ষা বহির্ভূত কোন পরিষেবার মান নিয়ে অসন্তুষ্টির জন্য । শিক্ষক আর শিক্ষা কর্মীরাও প্রতিনিয়ত আক্রান্ত হচ্ছেন । দুর্ভাগ্যের ব্যাপার এই সব ঘটনার প্রায় সিংহভাগ এর প্রধান আরোপি হিসেবে প্রিয় ছাত্র ছাত্রীদের নাম উঠে আসছে । এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক । ঘটনা প্রবাহগুলোর হার যে হারে বাড়ছে তার থেকে এটা পরিষ্কার যে ছাত্র ছাত্রীদের কর্তৃক বা ছাত্র ছাত্রীদের নাম নিয়ে এই সব হামলা বা আক্রমন বিক্ষিপ্ত বা হঠাৎ ঘটে যাওয়া কোন ঘটনা নয় । ইহা এখন এক প্রকারের সামাজিক ব্যাধিতে পরিনত হয়েছে ।

শিক্ষক শিক্ষিকা শিক্ষাকর্মী সর্বপরি কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কখনই কোন ছাত্র বা ছাত্রীর খারাপ দিকটির কথা চিন্তা করেন না । বরং সমস্ত খারাপ দিক কে কিভাবে ভালোর দিকে উন্নীত করা যায় তার চেষ্টায় সদা উদগ্রীব থাকেন । কোন এক ক্ষণিক সময়ের সিদ্ধান্তের বশবর্তী হয়ে শিক্ষককুল বা শিক্ষা স্থানকে অপমানিত করার বা  শিক্ষা স্থানে পরিকল্পিত আক্রমন করার একটি   কারন যেমন শিক্ষক শিক্ষিকা বা শিক্ষা কর্মীদের ওপর তীব্র শ্রেনিসৃষ্ট অসন্তোষ , ঠিক তেমনি অপমানকারীর বা আক্রমণকারী মধ্যে শিক্ষা ঢুকলেও সঠিক চেতনার বিকাশ  না ঘটাও আরো একটি কারণ । দীর্ঘদিনের এই অপচেতনা একদিকে যেমন শিক্ষার প্রসারকে বাধাপ্রাপ্ত করছে ঠিক তেমনি শিক্ষা র মানকেও নিম্নমুখী করেছে । 

তাই হয়ত সময় এসেছে শিক্ষা র নীতি বা শিক্ষা দান পদ্ধতি বা সার্বিক শিক্ষাদানের ক্ষেত্র হিসেবে শিক্ষাস্থানের ব্যবহার এর দিকগুলো কে নিয়ে আরো একবার আলোচনা করার । না হলে যে শিক্ষা চেতনা আনতে পারে না , সেই শিক্ষা বিবর্তন ও আনতে পারবে না ।

আর বিজ্ঞান বলে বিবর্তনহীন সভ্যতার অবলুপ্তি নিশ্চিত ।


বিঃদ্রঃ - আন্দোলন,পার্টিবাজি,লবিবাজি,পশুপতি ঘোষ,ডি আই অফিস, ৫০০ টাকার এপ্রুভাল ,সবুজ সাথি, স্কলারশিপ,মিড ডে মিলে ডিম, কন্যাশ্রী , শিক্ষাশ্রী , ঐকাশ্রী , ভোটের ডিউটি , নেতারত্ন, আয়রন ট্যাবলেট , কেঁচোর ওষুধ, চাল ,ডাল, আলু, এমনকি ছোলা বা চিরুনী আয়নাকে ছাত্রদের নিকটে পৌঁছে দেবার কর্মসংস্থান কে একদিনের মোড়কে ডিজে বাজিয়ে পালন করাকে যদি ' শিক্ষক দিবস ' বলে চালান হয় ...


তাহলে আমি এর বিপক্ষেই রইলাম ।



 বটবৃক্ষ

মাথুর দাস


শিক্ষার জট বৃক্ষটি বট

ধারণ ক'রে মাথায়,

ঢাকে মস্তক ছায়া ইস্তক

পত্রবহুল ছাতায় ।


দৃঢ় মূল আর ঋজু কান্ড

রসভান্ডে কত জ্ঞান তার !

বসো নীচে তার ছায়া প্রকান্ড

ভরো সুশিক্ষা মনে এন্তার ।


শিক্ষক জেনো বৃক্ষসমান

জ্ঞানগম্ভীর ন্যগ্রোধ,

সম্বিত হলে ধরো সোপান

বিম্বিত হোক বুদ্ধিবোধ ।


শিক্ষক দিবস

রীতা মোদক



   ছোটো বেলায় দেখতাম মা সারাদিন শুধু কাজে ব্যস্ত  থাকতো । আমরা চার বোন , বাবা - মা , ঠাকুমা ঠাকুরদাদা মিলে আটজন ছিলাম । মা একা হাতেই সব সামলাত। মা রান্না ঘরে রান্না করতো , আমি একটা বড় পিঁড়িতে বই রেখে , আর একটা পিঁড়িতে বসে জোরে জোরে পড়তাম। ভুল হলে মা খুন্তি নাড়তে নাড়তেই পড়া বলে দিত । দৌঁড়ে এসে লেখা ঠিক করে দিত । গরমের রাতে উঠোনে চট পেতে মাঝখানে একটা হেরিকেন রেখে চার বোন একসাথে পড়তাম । মা পাশে বসে   কাগজের ঠোঙ্গা বানাতে বানাতে আমাদের পড়া দেখিয়ে দিতো । আমার কাছে আমার  মা প্রথম শিক্ষাগুরু ।

আমি তখন ক্লাস টেন এ । স্কুলের দিদিমনিরা আমাকে নিয়ে খুব চিন্তিত । মধ্যমিক এর রেজাল্ট ভালো করার  জন্য আমার দুঃসম্পর্কের এক দিদি মাথাভাঙ্গা হাই স্কুলের  এক স্যার এর কাছে যেতে বলেন । আমি সন্ধায় মাকে নিয়ে উনার বাড়ি যাই । তিনি আমাকে প্রথমেই জিজ্ঞেস করেন -"তুমি বড় হয়ে কি হতে চাও । "
আমি বলেছিলাম -- "স্কুলের দিদিমনি হতে চাই ।" একথা শুনে খুব খুশি হলেন এবং পরের দিন থেকে আমি   উনার কাছে আমি টিউশন পড়তে থাকি ।
  .ইলেভেন এ উঠেও আমি উনার কাছে বায়োলজি  পড়তাম । একদিন স্যার আমাকে সব বন্ধুদের মাঝখান থেকে ডেকে বলেন -- "তোমার কাকিমা তোমাকে ডাকছে ।"  কাকিমার কাছে গেলে উনি অনেকগুলি ঘড়ি আমাকে দেখিয়ে বলেন -- "দেখোনা তোমার স্যার কতগুলো ঘড়ি নিয়ে এসেছেন ,
আমাকে একটা পছন্দ করে দেবে ? "
একটা ঘড়ি পছন্দ করে দিলে  কাকিমা বলেন -"এই ঘড়িটা তোমার , তোমার স্যার তোমাকে দিতে বলেছেন ।"
আমি স্যার এর কাছে বিনা বেতনে টিউশন পড়েছি , উপহার পেয়েছি । পরিবর্তে উনাকে কিছুই দিতে পারিনি ।  আজ শিক্ষক দিবসে স্যারকে আমি প্রণাম ও শ্রদ্ধা জানাই ।


 












মৌমি ঘোষ 


 












অদ্রিজা বোস 




















তানভি দাম  




প্রকৃত শিক্ষা 
অদিতি মুখার্জী সেনগুপ্ত 


অঙ্কের  অধ্যাপক বিপত্নীক কিঙ্কর বাবু জীবনের অনেক অঙ্কই মেলাতে পারেননি। আজ জীবনের শেষ প্রান্তে এসে একটাই কথা ভাবছিলেন, কি পেলেন আর কি হারালেন। অল্প বয়সে স্ত্রী বিয়োগের পর ছেলে-মেয়ে দুজনকে খুব আগলে রেখে মানুষ করেছিলেন। পাছে সৎ মা দুর্ব্যবহার করে সেই ভয় উনি আর বিয়েই করেননি।

ছেলে,ইন্দ্রনীল বর্তমানে এক প্রতিষ্ঠিত ইঞ্জিনিয়ার আর মেয়ে ইন্দ্রাণী একটি সরকারী স্কুলের শিক্ষিকা। এখন তো তার পায়ের ওপর পা তুলে আনন্দ করার দিন, কিন্তু না, এখন তার ঠিকানা "আকাশ কুঞ্জ" বৃদ্ধাশ্রম। নিজেকে এই পরিবেশে একটু একটু করে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। 

আজ শিক্ষক দিবস, বৃদ্ধাশ্রমের বাগানে বসে মনটা চলে গেল সেই দিনগুলোর স্মৃতিতে যখন কিঙ্কর বাবুকে ছাত্র-ছাত্রীরা ঘিরে থাকতো।কি আনন্দটাই না হতো সেই দিনটায়। সম্বিত ফিরে পেলেন কেয়ার টেকারের ডাকে। সে বলল," স্যার, আপনার সাথে আমাদের ম্যানেজার বাবু দেখা করতে চান।" কিঙ্কর বাবু আকাশ-কুসুম ভাবতে লাগলেন।এখানে আসা অবধি ম্যানেজারের সাথে ওনার সাক্ষাত হয়নি। হলঘরে গিয়ে যাকে দেখলেন, তাকে প্রথমে চিনতে পারেননি। তন্ময় নিজের পরিচয় দিলো।

সে বলল,"স্যার, আজ আমি যা হয়েছি সবই আপনার অবদান।বাবার মৃত্যুর জন্য আমার পড়াশুনা বন্ধ হতে চলেছিল। আপনিই তো আমাকে ভরসা দিয়েছিলেন,ও আর্থিক সাহায্যও করেছিলেন। আজ শিক্ষক দিবসে আমার এই অনুরোধটা আশাকরি রাখবেন। আপনি আর এখানে থাকবেন না। আজ থেকে আমার ঠিকানাই হবে আপনার ঠিকানা। পিকলু ও খুউব খুশি হবে ওর দাদুভাইকে পেয়ে। আর আজ পিকলুর জন্মদিনে এটাই হবে ওর সবচাইতে অমূল্য উপহার।  তন্ময় ওনাকে প্রণাম করল আর উনি প্রেক্ষাপটে গান শুনতে পেলেন,"গুরু থেকো আমার পাশে সারাটা জীবন।" কিঙ্কর বাবু একটু চমকেই গেলেন। মনে মনে ভাবলেন, শিক্ষা প্রদানের সার্থকতা তো এখানেই।ছাত্র-ছারী শিক্ষক কে এমন আসনে বসায়, যেখানে আজীবন তারা তাকে মনে রাখে। ওনার চোখের কোনটা চিকচিক করে উঠল।


 

কারিগর
নন্দিতা পাল

শিক্ষক দিবসে মনের কোণে ভিড় করে আসে কত ভরসার মুখ। শুধু আমার জীবনে কেন, আমার ছেলে মেয়েদের জীবনে দেখছি কিভাবে সেই একই অনুরণন। শিক্ষাস্থল, পরিপ্রেক্ষিত, জায়গা সব বদলায় ফ্রেমের মত কিন্তু শিক্ষক শিক্ষিকা তাদের যে মূল কাজ মানুষ তৈরিতে তা কিন্তু চিরন্তন। অনেক রকম শিক্ষক শিক্ষিকাকে সামনে দেখে বড় হয়েছি, অবাক হয়ে যেতাম স্কুলের হেডস্যর নাম ধরে ডেকে পাঠাতেন ক্লাস ইলেভেনে এটা জিগ্যেস করতে কোনও বিষয়ে আরো সাহায্য লাগবে কিনা, ঠিকঠাক সব বুঝতে পারছি কিনা। কোন অসুবিধে আছে বললে তার কিভাবে সমাধান করা যায় পথ ভাবতেন। আবার একবার খুব কস্ট, বকা খেয়ে অনেকদিন ধরে রিহার্সাল করে নৃত্যনাট্য ‘তাসের দেশে’ ছক্কা হয়েছিলাম আমি। দারুণ হাততালি পড়েছিল শো এর পরে। কিন্তু যখন স্টেজ থেকে নামছিলাম নাচের দিদিমণি বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন, সেটাই ছিল আমার কাছে বড় ছক্কা। পরবর্তীতে বিশ্ব বিদ্যালয়ের গন্ডিতে এসে গুরু গম্ভীর সব বিষয়ের মধ্যে দেখেছি তাদের ই খুব মনে রেখেছি যারা অসময়ে ভরসা দিয়েছেন, বলেছেন ঠিক পারবে চেষ্টা করে যাও। সেই স্যরকে এখন ও মনে আছে যখন চাকরি হচ্ছে না, বাংলা মিডিয়াম থেকে আসা বলে ইংরেজির সেই গ্রুপ ডিশকাসন গুলোতে কাত হয়ে যাচ্ছি, উনি বুঝিয়েছিলেন কিভাবে তৈরি হতে হবে। বুঝিয়েছিলেন পয়েন্ট করে কথা বলা, যা কিনা ‘বুলেট’ শক্তি। বাংলায় ভেবে ইংরেজির বুলেট হয়ে বেড়িয়ে আসা আর কি! সেই শিক্ষা আজও কাজে লাগে দুর্দান্ত। মনে পড়ে আমার মেয়ের প্রথম নার্সারি স্কুল, তার এত ভালো লেগে গেলো যে সে স্কুল থেকে আসার সময় কান্নাকাটি। মনে পড়ে মিস আমায় ডেকে বলেছিলেন আমার যদি অসুবিধে নাহয় উনি স্কুলের পর যতক্ষণ বাকি কিছু কাজ করবেন আমার মেয়ে থাকতে পারে ততক্ষণ। সেই মিসকে আমরা কেউ ই ভুলতে পারিনি আজও। কারণ সে মেয়ের মনে যে স্কুল ঘিরে যে আনন্দ তাকে সন্মান করেছিলেন।

এসব কথা বলতে গেলে রাত ফুরিয়ে যাবে কিন্তু শেষ হবে না। শিক্ষক শিক্ষিকারা আমাদের বড় করেছেন, আগলে রেখেছেন, জেদ তৈরি করেছেন আমাদের মধ্যে এগিয়ে যাবার। এঁরা কারিগর, কারিগর মানুষ তৈরি করবার, মানুষের মধ্যে সত্তা টাকে জাগিয়ে তোলবার। আমার জীবনের এইরকম অনেক পান্না হারিয়ে গিয়েছেন অনন্তে। কিন্তু আমার বিশ্বাস তাদের ই নতুন জন্ম আবার হয়েছে এই পৃথিবীর মানুষের কারিগর হয়ে। তাদের সবাইকে আমার প্রণাম আজ এই পুন্যদিনে।


 

শিক্ষণীয় বিষয়ের প্রতি  শ্রদ্ধার্ঘ 
           কবিতা বণিক


পৃথিবীর সমস্ত শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের প্রতি আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম ও আন্তরিক  শুভেচ্ছা রইল।
বিশ্বের ক্ষুদ্রতম অণু-পরমাণু থেকে সূর্য , গ্রহ, নক্ষত্র  আমরা সবার কাছেই শিক্ষা নিতে পারি। আকাশ, বায়ু, পাহাড়, মাঠ, সূর্য, চাঁদ, নদী, মাটি  এদের সবার আমরা  ছাত্র। এরা  কেমন সুন্দর,  সবাই এক নিয়মে এক ভাবে শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়ে তাদের কাজ যথানিয়মে করে চলেছে।  পূর্বদিকে সূর্য ওঠে ভোর হয়। পশ্চিমে সূর্য অস্ত যায় তখন সন্ধ্যা নামে। শৃঙ্খলা বদ্ধ হয়ে কাজ করে চলেছে বলেই প্রকৃতি এত সুন্দর।গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত, বসন্ত সব ঋতুই পর পর শৃঙ্খলাবদ্ধ ভাবেই আসে। আমরা সে কারণে প্রকৃতির সৌন্দর্য কে উপভোগ করতে পারি। মানব সভ্যতার  বিকাশের মূলেও প্রকৃতির দান অনস্বীকার্য। সূর্যের আলো আমাদের শরীর সুস্থ ও সবল রাখে।  এর ফলে শরীরের বৃদ্ধি হয়। আমরাও শিশু অবস্হা থেকে শৈ্শব, কৈশোর, যৌবন ও বৃদ্ধাবস্হায় পৌঁছই। চাঁদ , তারাদের আলোর ঝিকিমিকি আমাদের মনে আনন্দ দেয়। রাতের অন্ধকারে কিছু আলোও  দেয়।  মানুষের জীবনকেও সুন্দর সুশৃঙ্খল ও সংযত হয়ে চলার শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে।প্রকৃতির কাছে আমরা সুশৃঙ্খল জীবন যাপন শিখব। জীবনে শ্রী, কল্যাণ, আনন্দ, শান্তি এগুলো সুশৃঙ্খলতার মধ্য দিয়েই আসে।
ছাত্রজীবনেই  জীবনের ভিত্তি গঠিত হয়। তাই ছাত্রজীবনেই গঠন করতে হবে নিয়মানুবর্তিতা ও সুশৃঙ্খল জীবন। তবেই আমরা সর্বত্র বিজয়ী হতে পারব। সেনা বিভাগের লোকেরা সবচেয়ে বেশি সুশৃঙ্খল জীবন ও  নিয়মানুবর্তিতার মধ্য দিয়ে কাটায়। আমরাও দেখি শৃঙ্খলাবদ্ধ,নিয়মানুবর্তী ও সুসংহত সৈন্যবাহিনীই যুদ্ধে জয়লাভ করতে পারে। আমরাও  এমন সুশৃঙ্খল ও সুসংহত জীবন যাপন করলে সবক্ষেত্রে অবশ্যই বিজয়ী হব।
সব কিছু আমাদের শরীরের ওপর নির্ভর করে। তাই শরীরকে সুস্থ রাখতে শরীর চর্চা ও খেলাধুলো  করা  প্রয়োজন।তাহলে শরীর ও মন দুটোই শৃঙ্খলাবদ্ধ হতে পারবে।
মানুষ তার শরীরটাকে জন্মমুহূর্তে লাভ করে। এই শরীর টার বৃদ্ধি হয়, অসুখ হয় ইত্যাদি কারণে শরীর কে সুস্থ রাখা জরুরি। সুস্বাস্থ্য জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ। রবীন্দ্রনাথের কবিতার লাইন থেকে এই শিক্ষা নিই--
" অন্ন চাই, প্রাণ চাই,আলো চাই, চাই মুক্ত বায়ূ, চাই বল, চাই স্বাস্হ্য, আনন্দ- উজ্জ্বল  পরমায়ূ, সাহস বিস্তৃত বক্ষপট।" 

দেহের সৌন্দর্য্য  অলংকার । আত্মার সৌন্দর্য শিষ্টাচার। অলংকার বা গহনা দিয়ে দেহটাকে সাজানো হয়। কিন্তু লক্ষ্যনীয় একটা মানুষ যতই সেজে থাকুক, যদি তার আচার আচরণ ভদ্রচিত না  হয় তবে কেউ তাকে পছন্দ করে না। তাই সবার সাথে মিলে মিশে থাকা, বন্ধু ভাবে  থাকার জন্য চাই শিষ্টাচার শিক্ষা। মানুষের চারিত্রিক সম্পদ হল শিষ্টাচার ।  এই শিক্ষা মানুষের সাথে মানুষের ভালবাসার  বন্ধনকে দৃঢ় করে। শিষ্টাচার এর মধ্য দিয়ে আমরা বাবা, মা, শিক্ষক, গুরুজনদের শ্রদ্ধা ও সম্মান করতে শিখি। প্রত্যেক ছাত্র-ছাত্রীদের  নিজেদের জীবনকে সুন্দর ও গৌরবময় করার জন্য  শিষ্টাচার ও সৌজন্যবোধে শিক্ষিত করা। এটা সমাজজীবনে ও একটা গৌরবময় অধ্যায় । এই জীবনকে পূর্ণ করার দায়িত্ব ছাত্র-ছাত্রীদের। যে কোন শিক্ষাই  ধৈর্য ধরে  ভালোবেসে শিখলে তার সুফল নিশ্চিত।

Thursday, September 2, 2021


 

সম্পাদকের কথা 

শরৎ চলে এলো। শুরু হয়ে গেল অপেক্ষার প্রহর। আর কয়েকদিন পরেই বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসবে মেতে উঠবে এই রাজ্য। যদিও কেউ জানিনা এবারেও কী হতে চলেছে দুর্গাপূজার ভাগ্য! কেননা এখনও অতিমারীর ভ্রূকুটি কাটে নি। ফলে যে বাঁধনহারা উচ্ছাস দেখা যায় এই সময়, তা অবশ্যই স্তিমিত। এবারেও মায়ের কাছে আমাদের চাওয়া হবে এমন এক পৃথিবীর যেখানে থাকবে না কোনও মহামারীর ভয়, নিরন্ন মানুষ পাবে পর্যাপ্ত খাদ্য, ঘুচবে বেকারত্বের অসহায় অবস্থা। একই সঙ্গে প্রার্থনা করব সন্ত্রাসমুক্ত সেই পৃথিবীর, যেখানে গোলাপ ফুটবে নির্ভয়ে, নারীদের ভাগ্য লিখবে না কোনও মৌলবাদী ফতোয়া। শরৎ প্রভাতে সেই স্বপ্ন তাই মনে। জানিনা স্বপ্ন কেবল স্বপ্নই থেকে যাবে কিনা! 

 


মুজনাই সাহিত্য সংস্থা 

রেজিস্ট্রেশন নম্বর- S0008775 OF 2019-2020

হসপিটাল রোড 

কোচবিহার 

৭৩৬১০১

ইমেল- mujnaisahityopotrika@gmail.com (মাসিক অনলাইন)

- mujnaiweekly@gmail.com (সাপ্তাহিক)


প্রকাশক- রীনা সাহা 

সম্পাদনা, প্রচ্ছদ,  অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায় 

মুজনাই অনলাইন ভাদ্র সংখ্যা 



এই সংখ্যায় আছেন যাঁরা 


রবীন্দ্রনাথ চৌধুরী, মাথুর দাস, কুমকুম ঘোষ, সুমন ব্যানার্জি, গৌতম চক্রবর্তী, চিত্রা পাল, পার্থ বন্দোপাধ্যায়, অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী, অদিতি মুখার্জি সেনগুপ্ত, ধ্রুবজ্যোতি পাল, সুব্রত দত্ত, শ্রাবণী সেন, নারায়ণ দত্ত, শ্রাবণী সেনগুপ্ত, মহাজিস মণ্ডল, মৌসুমী চৌধুরী, অরবিন্দ মাজী, অপর্ণা ঘোষ, অভিমন্যু, প্রতিভা পালসেন, চন্দন কুমার দাস, কবিতা বণিক, সুনন্দ মন্ডল, অলকানন্দা দে, পৌলমী চক্রবর্তী, বিজয় বর্মন, দীপ মুখার্জি, চন্দ্রানী চৌধুরী, মুনমুন সরকার, মজনু মিয়া, অভ্রদীপ ঘোষ, অদ্রিজ বোস, তানভী দাম, অন্বেষা সরকার, উৎসব সাহা, রাশি সাহা, সায়ন ব্রহ্ম, সুজল সূত্রধর


মুজনাই অনলাইন ভাদ্র সংখ্যা ১৪২৮



শরৎ প্রবন্ধ 

রবীন্দ্রনাথের বিরহচেতনার গান ও গল্প : সংক্ষিপ্ত আলোচনা

সুমন ব্যানার্জি



   রবীন্দ্রনাথের প্রেমের গান আসলে এক বিরহ-বিপ্রলম্ভের গান। মৃত্যুজনিত শোক, বেদনা, দুঃখ রবীন্দ্রনাথের গানে বারবার এসেছে। রবীন্দ্রনাথের জীবনে আবাল্য মৃত্যু জনিত যন্ত্রণা (বিশেষত নতুন বৌঠান কাদম্বরী দেবীর আত্মঘাতী হওয়া, আরও নির্দিষ্ট করে বললে আত্ম-বিসর্জন) এসেছে। এবং যত এসেছে ততই তাঁর গীতিকাব্য হয়েছে পরিণত, সূক্ষ্ম ইঙ্গিতবাহী। কাদম্বরী যদি রবীন্দ্রনাথের জীবনে না উপস্থিত হতেন এবং তিনি যদি অকালে প্রয়াত না হতেন তাহলে রবীন্দ্রনাথ কবি হতেন ঠিকই কিন্তু পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গীতিকবি ও মহাকবি হতে পারতেন কি ? এর উত্তর না। কাদম্বরীই তাঁর 'জীবনদেবতা' (সংস্কৃতে দেবতা স্ত্রী লিঙ্গ), যাঁকে রবীন্দ্রনাথ জীবনের অধিষ্ঠাত্রী ও নিয়ন্ত্রী শক্তি বলেছেন তিনিই বিশ্বদেবতা হয়ে উঠেছেন জীবন সায়াহ্নে।
 
     রবীন্দ্রনাথের গান ও কবিতার একটি পরিচিত ইমেজ হল সমুদ্র ও তরী। এই সমুদ্র বেশিরভাগ সময়েই মৃত্যুর বা দুঃখের সমুদ্র : মৃত্যুর মতোই তার বিস্তার, অসীম বিস্ময়ের। তরী যেন জীবনতরী। এই জীবনতরীরই কর্ণধার হলেন একজন নারী (আসলে কাদম্বরী। যেমন -- সোনার তরী)। আর চাঁদ/চন্দ্রের ইমেজ তো রোম্যান্টিক কবিরা ব্যবহার করেই থাকেন। চাঁদ প্রেম ও সৌন্দর্যের শাশ্বত ইমেজ।



     'রক্তকরবী' নাটকে বিশু পাগল গেয়েছিল নন্দিনী-কে হারিয়ে ---
" ও চাঁদ , চোখের জলে লাগল জোয়ার..

ঈশানী পাড়ার ছেলে ‘বিশু’ (পাগল)। এই নামটির মধ্যেই 'বিশ্বনাথ' অর্থাৎ শিবের নামের ইশারা লুকিয়ে। বাস্তু শাস্ত্র মতে ঈশান কোণ হল শিবের এলাকা। নাটকে কবি ঈশানকে ঘুরিয়ে ঈশানী করেছেন। সেই ঈশানী পাড়া থেকেই যক্ষপুরী অর্থাৎ কুবেরের এলাকায় এসে পড়েছে সে। এবং প্রায় অপ্রত্যাশিতভাবেই নন্দিনীরও দেখা পেয়েছে। আবার ‘নন্দিনী’ হল শিব-জায়া পার্বতী বা দুর্গার অন্য নাম। এই নন্দিনীর উদ্দেশেই বিশু পাগল গান গায়, যা রক্তকরবীর শ্রেষ্ঠতম গান ---  

"ও চাঁদ, চোখের জলের লাগল জোয়ার দুখের পারাবারে,
হল কানায় কানায় কানাকানি এই পারে ওই পারে।
আমার তরী ছিল চেনার কূলে, বাঁধন তাহার গেল খুলে,
তারে হাওয়ায় হাওয়ায় নিয়ে গেল কোন্‌ অচেনার ধারে।"

      এই দমবন্ধ করা যক্ষপুরী : যা বস্তুত ধনতন্ত্রের রূপক, যেখানে প্রত্যেক মানুষই কমবেশি দিন দিন ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে এবং নিজের এই যন্ত্রণাময় স্থিতিকেই নিজের অনিবার্য ভবিতব্য হিসেবে গণ্য করছে। মানুষের জীবনের গভীরতা, আনন্দ এমনকি বেদনাবোধও ক্রমশ অসাড় হয়ে আসে। ঠিক সেইখানে বিশু ভাবছে (আসলে কবি) ও চাঁদ, তোমার এই পূর্ণ আবির্ভাব যে বিস্ময় উদ্রেক করেছে। আমার মনের অনেক দিনের নিরুদ্ধ অশ্রুরাশিকে হঠাৎ উৎসারিত করে দিল। আমার এই দুঃখ-রূপ সমুদ্রের গতানুগতিক নিস্তরঙ্গতার উপরে ঝরে পড়া সেই অশ্রুরাশি এমনই জলস্ফীতি এমনই জোয়ার এনে দিল যে শুরু হল ‘কানায় কানায় কানাকানি এই পারে ওই পারে’।নন্দিনীকে বিশু বলেছে, “তুমি আমার সমুদ্রের অগম পারের দূতী”। নন্দিনীও যেহেতু 'রক্তকরবী'-র একেবারে শেষ পর্যন্ত বিশুর সমুদ্রের ‘অগম’ পারেই রয়ে গেল।

    এই নন্দিনীর প্রেমিক হল রঞ্জন। নন্দিনীকে নিয়ে ‘হারজিতের খেলা’য় যেদিন রঞ্জন নন্দিনীকে জিতে নিয়েছে। আর সেইদিন সেই ‘বাজিখেলার ভিড় থেকে একলা’ বিশু বেরিয়ে আসে, ‘যাবার সময় কেমন করে’ নন্দিনীর মুখের দিকে তাকায়, আর তারপর সে কোথায় চলে যায়। নন্দিনীর এই প্রশ্নেরই উত্তর দেয় বিশু এ গানের শেষে --
"আমার তরী ছিল চেনার কূলে, বাঁধন তাহার গেল খুলে,
তারে হাওয়ায় হাওয়ায় নিয়ে গেল কোন্‌ অচেনার ধারে।''



     নন্দিনীর সঙ্গে বিশুর সম্পর্কের সূত্র ধরেই বিশুর অতীত জীবন আর রবীন্দ্রনাথের নিজের অতীত জীবনের অন্তর্গূঢ় সাদৃশ্য রয়েছে। রবীন্দ্রনাথের জীবনসত্য সর্বাঙ্গীণ হয়ে ওঠে। ঠিক কোন্‌খানে বিশুর অতীত আর রবীন্দ্রনাথের অতীত অন্তর্গূঢ়ভাবে সদৃশ? ‘বুনো ঘোড়ার কেশর ধরে’ নন্দিনীকে ‘বনের ভিতর দিয়ে ছুটিয়ে নিয়ে’ যাওয়া রঞ্জনকেই নন্দিনী চায়। আর এটাই কবির অভিমান। তাই বিশু তার ‘চেনার কূল’ ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছিল ‘কোন্‌ অচেনার ধারে’।

      কবিও নিজের অনুরূপ অভিমানের স্মৃতি স্মরণ করেই যেন রবীন্দ্রনাথ ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪ মার্চ একটি চিঠিতে নির্মলকুমারীমহলানবিশকে লিখেছেন যে -- ''জৈদা  (জ্যোতিরিন্দ্রনাথ) তখন বিবাহিত, তাঁর জন্যে ভাববার লোক ছিল, … আমি ছিলুম সংসার-পদ্মার বালুচরের দিকে, অনাদরের কূলে—সেখানে ফুল ছিল না, ফল ছিল না, ফসল ছিল না—কেবল একা বসে ভাববার অবকাশ ছিল। আর জৈদা (জ্যোতিরিন্দ্রনাথ) পদ্মার যে-কূলে ছিলেন সেই কূল ছিল শ্যামল—সেখানকার সেই দূর থেকে কিছু গন্ধ আসত, কিছু গান আসত,সচল জীবনের ছবি একটু আধটু চোখে পড়ত। বুঝতে পারতুম ওইখানেই জীবন-যাত্রা সত্য—কিন্তু পার হয়ে যাবার খেয়া ছিল না—তাই শূন্যতার মাঝখানে বসে কেবলই চেয়ে থাকতুম আকাশের দিকে।’' (এই অসামান্য ব্যাখ্যাটি করেছেন অধ্যাপক তপোব্রত ঘোষ)

      বিশুর উপলব্ধিতে মূর্ত হয়ে উঠেছিল এক সুগভীর জীবনসত্য -- '‘কাছের পাওনাকে নিয়ে বাসনার যে-দুঃখ তাই পশুর, দূরের পাওনাকে নিয়ে আকাঙ্ক্ষার যে-দুঃখ তাই মানুষের’'। পশু শুধু জৈবিক ভাবে স্থূল ভোগ করে কিন্তু মানুষের আছে বিবেক, সৃজনক্ষমতা (বিশেষত শিল্পীর), তাঁর রয়েছে মানবিক অনুভূতি। সৌন্দর্য তো সব সময়েই দুরবগাহ : শিল্পী তাঁর কল্পনা বলে সৌন্দর্য সৃষ্টি করলেও তৃপ্ত হন না। শাশ্বত সৌন্দর্যের প্রতি আকাঙ্ক্ষাই মানুষকে অতৃপ্ত রাখে। এখানেই পশু ও মানুষ পৃথক হয়ে পড়ে।



      ‘রক্তকরবী’-র শেষে কিশোর, রঞ্জন, রাজা এবং তাঁর মরার আগে সর্দারের বর্শায় বিদ্ধ হয়ে নন্দিনীও মরে। বিশু ছিন্নশৃঙ্খল বন্দীদের সঙ্গে একজোট হয়ে লড়াই করে এবং সম্ভবত  সর্দারপক্ষসুদ্ধ যক্ষপুরী বিধ্বস্ত  হয়। বিশুর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ অপৃথক বলেই তিনি লিখতে পারেন যে - পথিকরা সবাই চলে গেল।শুধু আমি একাই পড়ে রইলাম দিশাহারা রাতে আর রইল একা চাঁদ - "হয়তো গান শুনতে চাইবে! আমার পাগলি!”
তাই পাড়ি দিতে হবে কোন্ অজানার ধারে। এ যেন রোম্যান্টিক কবি মনেরই মর্মকথা।একটি নৌকা, সমুদ্র, বিশু আর আকাশের একটি পূর্ণচাঁদ। ঠাকুর বাড়িতে কাদম্বরী কে রবীন্দ্রনাথ 'হেকেটি' (গ্রীক চন্দ্রদেবী) বলে ডাকতেন। কাজেই পূর্ণচন্দ্র কি গ্রীক চন্দ্রদেবী হেকেটি-র জোড়াসাঁকোর কাদম্বরী নন ?  তবে বিশুর এই 'একলা মহাযাত্রা'-য় তিনি আর সরাসরি তরীর কর্ণধার নন।



    রবীন্দ্রনাথের বিরহ-চেতনার প্রসঙ্গে আমরা একটি গল্পের অবতারণা করব - 'পোস্টমাস্টার'।
     রবীন্দ্রনাথের 'পোস্টমাস্টার' দেখুন গল্পে যখন পোস্টমাস্টারের সঙ্গে রতন নিজের হৃদয়ের প্রায় অবিচ্ছেদ্য নৈকট্য অনুভব করেছিল। রতন ছিল কার্যত অনাথই। মায়ের চেয়ে তার বাবাকেই বেশি মনে পড়েছে। পোস্টমাস্টারের মধ্যে পিতার প্রত্নস্মৃতিই যেন জাগ্রত হয়ে উঠেছিল। একইভাবে পোস্টমাস্টারও ঘরের কথা অর্থাৎ মা, ছোটভাই, দিদির কথা বলতেন। একলা প্রবাসে স্মৃতিচারণ ও মনের কথা বলার একজনকে পেয়েছিলেন রতনের মধ্যে। পোস্টমাস্টার এই অশিক্ষিত গ্রাম্য মেয়েটিকে পড়াশোনা শিখিয়েছিলেন। একদিন অসুস্থ হয়ে পড়ায় বালিকাটি তাঁকে সেবা করে সুস্থ করে তোলে। এই সময় 'বালিকা রতন আর বালিকা রহিল না'। অর্থাৎ সে যেন সেবিকা বা মা'য়ের পর্যায়ে উন্নীত হল -- 'সেই মুহূর্তেই সে জননীর পদ অধিকার করিয়া বসিল, বৈদ্য ডাকিয়া আনিল, যথাসময়ে বটিকা খাওয়াইল, সারারাত্রি শিয়রে জাগিয়া রহিল, আপনি পথ্য রাঁদিয়া দিল ...''।

     আরোগ্য লাভের জন্য পোস্টমাস্টার বদলির দরখাস্ত লেখেন এবং তা মঞ্জুরও হয়। ঘরের বাইরে পুরনো পড়া পড়ে রতন বারবার অন্য মনস্ক পোস্টমাস্টারের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করছিল। লেখক জানাচ্ছেন যে -- 'পাছে যেদিন সহসা ডাক পড়িবে সেদিন তাহার যুক্ত-অক্ষর সমস্ত গোলমাল হইয়া যায়, এই তাহার একটা আশঙ্কা ছিল।' এখানে যুক্তাক্ষর আসল প্রতীকী অর্থ হল একে অন্যের সঙ্গে জুড়ে থাকা। দু'জনের মধ্যে রক্তের সম্পর্কের মতো পারিবারিক সম্বন্ধ। রতনের মধ্যে ভাবী বিচ্ছেদের পূর্বাভাস ছিলই এবং তা বাস্তবায়িতও হল। রতনের মনের আকাশ জুড়ে তখন মনখারাপের , নিঃসঙ্গতার ঘন কালো মেঘ ।পোস্টমাস্টার তাকে প্রবোধ দিয়েছে।গল্পে দেখুন বৃষ্টির প্রসঙ্গ আছে 'টপটপ করিয়া বৃষ্টির জল পড়িতে লাগিল। 'দুজনের নিঃশব্দ ব্যবধানকে আরো তীব্র করার জন্য লেখক এই চিত্রটি অঙ্কন করলেন।



    রতন যখন পোস্টমাস্টারের সঙ্গে তাঁর বাড়ি যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন তখন তা হেসে উড়িয়ে দিয়েছেন পোস্টমাস্টার। এবং বলেছেন যে, পরবর্তী পোস্টমাস্টারকে তিনি বলেন যাবেন তাঁর মতোই যত্নের কথা। এতে রতনের নীরব অভিমান আরও গাঢ় হল। গল্পকারের সুগভীর ইঙ্গিতবাহী বক্তব্য যে -- 'নারীহৃদয় কে বুঝিবে'। নতুন পোস্টমাস্টার তাঁর সমস্ত দায় দায়িত্ব বুঝিয়ে দিলেও রতনের কথা বলেননি। অর্থাৎ তিনি হয়তো ভুলেই গেছেন। সে রতনকে যাবার আগে কিছু টাকা দিয়ে যেতে চেয়েছে কিন্তু রতন তা নেয়নি। হৃদয়ের মূল্যকে কাঞ্চনমূল্য দিয়ে পোস্টমাস্টার মাপতে চেয়েছিলেন যা রতনের শূন্যতাকে আরও বাড়িয়ে দিল। কিন্তু রতন তা করতে দেয়নি। তার কাছে ভালোবাসা ছিল প্রতিদান-হীন। রতন একা রয়ে গেল প্রতিদান হীন ভালোবাসার নীরব বেদনাকে নিয়ে অন্যদিকে চলে গেলেন পোস্টমাস্টার ---

''ভূতপূর্ব পোস্টমাস্টার নিশ্বাস ফেলিয়া, হাতে কার্পেটের ব্যাগ ঝুলাইয়া, কাঁধে ছাতা লইয়া মুটের মাথায় নীল ও শ্বেত রেখায় চিত্রিত টিনের পেঁটরা তুলিয়া ধীরে ধীরে নৌকাভিমুখে চলিলেন।''

অধ্যাপক তপোব্রত ঘোষ এই অংশটিকে অসামান্য ব্যাখ্যা করেছেন --- 'চারটি অসমাপিকা চলে-যাওয়ার এই মুহূর্তটিকে যেন বাঁধন-ছেঁড়ার রক্তক্ষরা বেদনায় আরো বিলম্বিত করে তুলেছে।' (রবীন্দ্র-ছোটগল্পের শিল্পরূপ, দে'জ প্রকাশনী, পৃষ্ঠা - ৫৭)

    যখন পোস্টমাস্টার চলে গেলেন তখন 'বর্ষাবিস্ফরিত নদী ধরণীর উচ্ছ্বলিত অশ্রুরাশির মতো চারিদিকে ছলছল করিতে লাগিল'। গভীর ও ব্যাপ্ত বিষাদের প্রতীক হিসাবেই রবীন্দ্রনাথ এই ইমেজটিকে ব্যবহার করেছেন। পোস্টমাস্টারের 'একবার' মাত্র ইচ্ছে হয়েছে প্রত্যাবর্তনের, তাঁর এও মনে হয়েছে যে -- 'জগতের ক্রোড়বিচ্যুত সেই অনাথিনী'-কে সঙ্গে নিয়ে আসি : একজন সামান্য গ্রাম্য বালিকার করুণ 'মুখচ্ছবি যেন বিশ্বব্যাপী বৃহৎ মর্মবইটা প্রকাশ করিতে লাগিল'। খরস্রোতে শ্মশানের পাশ দিয়ে নৌকা এগিয়ে যেতে লাগল এবং এর পরেই তাঁর মনে ('উদাস পথিকের হৃদয়ে') এক গভীর তত্ত্ব ও জীবনসত্য প্রকাশ পেয়েছে যে ---

"জীবনে এমন কত বিচ্ছেদ, কত মৃত্যু আছে, ফিরিয়া ফল কী। পৃথিবীতে কে কাহার।"

এখানে শ্মশান জীবনের অনিবার্য শূন্যতারই প্রতিচ্ছবি তুলে ধরছে। ঠিক এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ 'ছিন্নপত্রাবলী'-এর একটি লেখার কথা মনে পড়ে ---

"বিদায়কালে এই নৌকো করে নদীর স্রোতে ভেসে যাওয়ার মধ্যে যেন আরও একটু বেশি করুণা আছে। অনেকটা যেন মৃত্যুর মতো --- তীর থেকে প্রবাহে ভেসে যাওয়া --- যারা দাঁড়িয়ে থাকে তারা আবার চোখ মুছে ফিরে যায়, সে ভেসে গেল সে অদৃশ্য হয়ে গেল।"



    কিন্তু রতনের মনে কোনো বিশেষ তত্ত্বের উদয় হল না। সে সেই পোস্টআপিসের চারি দিকে কেবল কেঁদে বেড়াতে লাগল। বোধ করি তার মনে ক্ষীণ আশা জাগেছিল যে, 'দাদাবাবু যদি ফিরিয়া আসে'। তাই সেই বন্ধনের অমোঘ টানে সে কিছুতেই দূরে যেতে পারছিল না। হায় বুদ্ধিহীন মানবহৃদয়! আসলে হৃদয়ের সম্পর্ক তো আর বাস্তব সমাজ সম্পর্কের নিয়মে চলে না। প্রেম তো জ্ঞানের বা বিচারের পথে চলে না, যুক্তিশাস্ত্রের প্রমাণ চট্ করে মাথায় প্রবেশ করে না। তার কাছে গুরুত্ব পায় আবেগ আর অনুভূতি। কখন চৈতন্যোদয় হয় কিন্তু পরক্ষণেই আবার মন চায় ভ্রান্তিতে জড়াতে। রতন মুক্ত হতে পারে না ভ্রান্তি পাশ থেকে ---

"দুই বাহুপাশে বাঁধিয়া বুকের ভিতরে প্রাণপণে জড়াইয়া ধরা যায়, অবশেষে একদিন সমস্ত নাড়ী কাটিয়া হৃদয়ের রক্ত শুষিয়া সে পলায়ন করে, তখন চেতনা হয় এবং দ্বিতীয় ভ্রান্তিপাশে পড়িবার জন্য চিত্ত ব্যাকুল হইয়া উঠে।''

    রবীন্দ্রনাথ জানেন সারা জীবন ধরে তিনি যাঁকে ভালোবাসেন, যাঁর জন্য এত অধীর প্রতীক্ষা, যে তাঁর সমস্ত সৃষ্টির আলম্বন-স্বরূপিণী --- সে কখন পার্থিব লোকে আর ফিরে আসবে না। তবু তাঁকে ফিরে পেতে চান, ভাবেন যে ফিরে পেয়েছেন, তাঁকে নতুন করে পাবার জন্যই হয়তো হারান (তোমায় নতুন করে পাবো বলে হারাই ক্ষণে ক্ষণ)। এটাই কবি চিত্তের ব্যাকুলতা। এখানে রতন আর কবি রবীন্দ্রনাথ একাকার হয়ে যান। রতনের 'বুদ্ধিহীন মানবহৃদয়' তো আসলে কবিরই ব্যক্তিগত মানবহৃদয়।।





শরৎ ভাবনা 

‘আশ্বিনের শারদপ্রাতে’ ই আনন্দের অ্যাড্রিনালিন ক্ষরণের সূচনা

(আসছে পুজো। ‘আশ্বিনের শারদপ্রাতে’র প্রস্তুতি চলছে। আসছে তৃতীয় ঢেউ এর বার্তা বহনকারী করোনাসুরও। বিমর্ষ বাঙালী। পুজোর আনন্দ কেড়েছে দুটো বছর। এবারে? সতর্কতা জরুরী। তা থেকেও জরুরী গনসচেতনতা। তাই আনন্দ তো অবশ্যই হবে। কিন্তু তা হোক সংযত। মুজনাই-এর ‘আশ্বিনের শারদপ্রাতে’ এই বার্তা দিয়ে কলম ধরেছেন গৌতম চক্রবর্তী )




পুজো এলেই যে বাঙালি আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে যায় ওটা আসলে পাতি টেনশন রিফ্লেক্স। কোনও এককালে পুজোয় আনন্দ হত, তাই রেডিয়োতে ‘আশ্বিনের শারদপ্রাতে’ বেজে উঠলেই আনন্দের অ্যাড্রিনালিন ওভারটাইম করতে আরম্ভ করে। না হলে কোনও সুস্থ স্বাভাবিক লোক পুজো আসছে বলে জুলাই মাসের খুঁটিপুজোর হোয়াটস অ্যাপ বা ফেসবুক ফরওয়ার্ড করতে পারে না। জাস্ট ইম্পসিবল। কাতারে কাতারে লোক এক সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ছে রাস্তায়, এ ওর পা মাড়িয়ে দিচ্ছে, হিসু পেলেও অন্তত সাড়ে তিন ঘণ্টা চেপে রাখা ছাড়া গতি নেই। কারণ 'আমি ঠাকুর দেখব না, আমায় লাইন থেকে বেরোতে দে বাপ’ বললেও কেউ এক ইঞ্চি জায়গা ছাড়বে না ।নতুন জুতোয় ফোসকা পড়েছে বলে ছেলে আর চাউমিন দেখে খিদে পেয়েছে বলে বউ কানের মাথা খেয়ে ফেললেও ভিড় দেখলে আর পচা বাসি খাবারের ভয়ে যেখানে করোনারি থ্রম্বোসিস হবার উপক্রম সেখানে এর মধ্যে আনন্দ? পুজোয় আনন্দ হয় এটা আসলে একটা পাতি অন্ধবিশ্বাস। জ্যোতিষের আংটির মত, হোমিয়োপ্যাথির শিশির মত বিশ্বাসে মিলায় মস্তি, তর্কে বহু দূর। রাত দেড়টার সময় ফোসকা পড়া পা, পোড়া তেলের চাউমিনের ঢেকুর তোলা পেট, ‘তোমার সঙ্গে বেরোনোটাই ভুল হয়েছে বলে বেগুণপোড়া মুখের বউ যখন সম্মিলিত ভেঙচি কেটে বলে ‘আনন্দ করবি, আনন্দ?’– ঠিক সেই মুহূর্তটায় বাঙালি বুঝতে পারে তার গোটা জীবনটা আসলে একটা মিথ্যে, সমাজ তাকে মুরগি করেছে। অবশ্য পর দিন সে আবার শোধ তুলতে বেরোয় আনন্দ শিকারে। কিন্তু দু দুটো বছর আম বাঙালী শোকে মুহ্যমান। আনন্দ হারিয়ে গেছে জীবন থেকে।




 হয়তো এবারেও এই আনন্দ শিকারে বেরোবে আম বাঙালী। করোনাসুরকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েই হয়তো। আসলে দুর্গাকে সব বাঙালিই খুব ভালবাসেন। চেহারায়, কাজকর্মে এবং লোককাহিনীতে বঙ্গভূমির দুর্গা-মা বাকি দেশের থেকে একেবারে আলাদা। শরৎকালে ভারতবর্ষের আর কোথাও কখনই পরিবারের সব্বাইকে নিয়ে তিনি এরকম ঢাকঢোল পিটিয়ে আসেন না। অন্য কোনও প্রদেশে তাঁকে এমন আবেগে ভেসে স্বাগত জানানো হয় না। এখানে তাঁর এমন কদর যেন তিনি একলা। মেনকারই কন্যা নন, সমগ্র জনগোষ্ঠীরই আদরের মেয়েটি। এর বাইরেও অবশ্য আমার মত একটা সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আছে যারা পুজোর বিভীষিকা থেকে নিজেদের প্রাণপণ আড়াল করতে চায়। আড্ডা মারতে চায় যে কোন জায়গাতে। এই যেমন আমি। কিন্তু আমি আনন্দ চাই আর না চাই, পুজো কি আমায় ছাড়ে? সপ্তমীতে শিলিগুড়িটা মেরে দিতে পারলে অষ্টমীতে জলপাইগুড়ি। এ রকম একটা হিসেব চলে আমার পরিবারের। ও মা, তুই সেন্ট্রাল কলোনী দেখলি না? আরে বামনপাড়ার পুজো মিস করিসনি তো?— যেন চিত্রগুপ্তের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে হিসেব দিতে হয়। বাঙালি হয়ে জন্ম নিয়ে পুজোয় নিদেনপক্ষে জলপাইগুড়ি শহরে অন্তত পঞ্চাশটা ঠাকুর না দেখলে তো নরকেও ঠাঁই হবে না। কে বোঝাবে জলপাইগুড়ি শহরে বড় পুজোই হয় হাতে গোনা কয়েকটা। কাজেই লাইনে দাঁড়ানো জনতাকে মেনেই গৃহিণী এবং তস্য পরিবারের আত্মীয় স্বজনের ইচ্ছাতে এক রাতের মধ্যে শহরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত শাসন করতে হয়। কিন্তু দুটো বছর এই অনুশাসন থেকে ছাড় পেয়েছিলাম। এটাই যা বাঁচোয়া।




 আসলে লাইনে দাঁড়িয়ে ঠাকুর দেখার চেষ্টা হল অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসের প্রপিতামহ। প্রতিটা প্যান্ডেলের লাইনে সেই দৌড় চলে। সেই লাইন যে কোনও সময় অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বলে ধাক্কা দিতে পারে। পুজোর মাসখানেক আগে থেকেই দিকে দিকে ব্যারিকেড গড়ে তোলেন প্রশাসনের সিভিক নামধারী সৈনিকেরা। পুজো নামক কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের সূচনা হয় পুজোর ঢের আগে। বেগুনটারি, দিনবাজার, এমনকি হাসপাতাল যাবার রাস্তাই বন্ধ হয়ে যায় অন্তত মাসখানেক আগে থেকে। কম্যান্ডো ট্রেনিং, লজিক্যাল রিজনিং স্কিল, সত্যাগ্রহের ভাবনা এ সব মাথায় না থাকলে পুজোর মাসখানেক আগে থেকে জলপাইগুড়ির মত শহরে চলাফেরা করার কথা ভাবা বারণ। শহরের দিকে গেলেই প্যাকেটধারী জনতা। কলকাতাতে শ্রী লেদার্সে জুতো কিনতে গিয়ে দেখেছি দেড় মাইল লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে জুতো কেনার মধ্যে যে সাম্য এবং সংগ্রাম আছে সেটা পুজোর অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। অফিসফেরত বেলার রুদ্ধশ্বাস ভিড়ে প্যাকেট হাতে ‘ছোট পরিবার সুখী পরিবারেরা’ নিরন্তর গুঁতো মারতে থাকে। ইচ্ছাকৃত না বাধ্যতামূলক সেই প্রশ্নের মীমাংসা কখনও হবে না। কিন্তু বাঙালিকে যদি কিঞ্চিৎ চিনে থাকেন নিঃসন্দেহে জানবেন প্রতিরোধ ক্ষমতাহীন সহযাত্রীকে জুতোর বাক্সের শক্ত ছুঁচলো কোনা দিয়ে খোঁচা মারার কাজটা সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত হতে পারে না।



ষষ্ঠী থেকে দশমী কোন দিন কী পরা হবে, কোথায় কোথায় যাওয়া হবে, কোন কোন রেস্তোরাঁয় খাওয়া হবে, পুজোর কটা দিন আগে থেকে প্ল্যানিং না করে রাখলে পরে পস্তাতে হয়। নামী-দামি ব্র্যান্ডগুলোও কিন্তু পুজোর প্ল্যানিং শুরু করে দেয় বহু দিন আগে থেকে। তার কারণ একটাই। পুজো নিজেই একটা বিরাট বাজার। কে বলবে অর্থনীতিতে মন্দা আসছে? বাঙালি সেই মন্দাকে থোড়াই কেয়ার করে। এক নামী জুতোর কোম্পানির পুজোর বিজ্ঞাপনের লাইনকে একটু বদলে নিয়ে বলা যায় পুজোয় চাই নতুন ‘ছুতো'। কেনাকাটার ছুতো। পুজোর ছুতোয় আমার মত বাঙালি আবার যেন বেশ খানিকটা উদার হয়ে যায়। নিজের এবং পরিবারের জন্য তো বটেই, তার সঙ্গে খুকু পিসির জন্য শাড়ি, মেজ ননদের ব্যাগ, ছোট ভাই এর 
 জুতো, ড্রাইভারের জন্য শার্ট ও উপহারের সামগ্রী কেনার এই তো সেরা সময়। এমনকি আজকের এই বছরে চার বার সেল এর যুগেও। আর তাই ব্র্যান্ডগুলোও পিছিয়ে নেই। জুলাই-অগস্ট মাস নাগাদ বিভিন্ন মলে মলে সেল। তার কারণ? আমার মত অনেকেই পুজোর একপ্রস্থ বাজার সেই সময় করে ফেলেন। দামটাও একটু কম হয়, তাই একসঙ্গে অনেক কিছু কিনে ফেলা যায় সহজেই। কিন্তু হায়! সেল শেষ হওয়ার পরে বিভিন্ন দোকানে চলে আসে নতুন কালেকশন। দাম যথেষ্ট চড়া, কিন্তু ডিজাইনগুলো নতুন, হাল ফ্যাশনের। তাই তখন আবার এক প্রস্থ বাজার করতেই হয়। সব মিলিয়ে পুজোর মাস দুই আগে থেকে বাজার একেবারে গরম। এই একটা উপলক্ষ্য ঘিরে এই বিপুল পরিমাণ কেনাবেচা, সারা দুনিয়ায় এর তুলনা মেলা ভার।



না বেরনোর অধিকার আমার আছে। বাড়ি থেকে বেরোব না
 বলে পণ করলাম। যেহেতু শিক্ষকতা করি তাই একমাস ছুটি, ফ্রিজে বাজার, আকাশে পেঁজা তুলোর মতো মেঘ, আমাকে আমার মতো থাকতে দাও। এই নিরালায় রব আপন কোণে। কিন্তু বাঙালিদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করলে সে গুড়ে বালি। ফোনে, হোয়াটস অ্যাপে, মেসেঞ্জারে, পায়ে চিরকুট বেঁধে কবুতর উড়িয়ে যে ভাবে হোক সবাই পুজোর প্ল্যান বানাবে আর আমার মত অনিচ্ছুকদের ঘাড় ধরে টেনে আনবে সেই প্ল্যানিং কমিশনের আওতায়। পুজো এসে গেছে আনন্দ করবি না মানে? মাথা ঝাঁ ঝাঁ করুক, হাঁটুতে খটখটানি হোক, আনন্দ করতেই হবে। যে ভিড় দেখে প্রতি পুজোয়, প্রতি মুহূর্তে চোখ বুজে থেকেছে সেই আমি কিন্তু তখন উন্মত্ত জলরাশির একটি বিন্দু হয়ে ভেসে যাই আম বাঙালির সঙ্গে। বন্ধুত্বের এই হল প্রাথমিক শর্ত। তাই পুজোয় যদি কাউকে দেখেন যে বিষন্ন মুখে, নিতান্ত অনিচ্ছায় ক্লান্ত, অবাধ্য দেহকে টানতে টানতে এগিয়ে চলেছে, কোনও ক্রমে তাল রাখছে কয়েকজন আনন্দোচ্ছল যুবক যুবতীর সঙ্গে, জানবেন সে আমিই। হে পাঠকবৃন্দ, পুজোর প্রাকমূহুর্তে শুধু একটু সমবেদনা জানাবেন তখন।

 





প্রয়াত কবির অপ্রকাশিত  কবিতা
 

তিস্তা 
রবীন্দ্রনাথ চৌধুরী 

পাহাড়ি উপল পথে
              বাঁধন হারা, 
ছুটে চলে তিস্তা, সে 
               পাগল পারা 
চাহেনা পিছন পানে 
                চলে অবিরাম, 
থামেনা সে কারো ডাকে 
                 জানেনা বিরাম।
নুপুরের নিক্কণ...... 
                   তুলে পায়ে পায়ে 
ব্যাকুলা হরিনী সম 
                    চলে বন ছায়ে। 
লুকোচুরি খেলে কভু 
                     বনরাজি সনে, 
উছল হাসি তার 
                      ফেরে বনে বনে। 
চঞ্চলা বনবালা 
                       নাহি লাজ ভয় 
শ্যামল সবুজে মাখা 
                        রূপ মায়াময়। 
দুই তীরে রাখি তার 
                         গহীন কানন;
ছুটে চলে অজানায় 
                           ছাড়ি গৃহকোন।
ঊষার কিরণ মাখি 
                            দেহখানি তার
রূপোলী পাতেতে মোড়া 
                             উজল আঁধার। 
সাঁঝের আঁধার সবে 
                             নামে বনতলে.... 
পাখিরা কুলায় ফেরে 
                             সবে দলে দলে। 
আকাশে তারারা ধীরে 
                              আঁখি মেলে চায়। 
তারার মানিক গনি 
                            নদী বয়ে যায়।। 
নীরব পাহাড় পথে  
                         তুলি কলধ্বনি.... 
নদী শুধু বয়ে যায় 
                         দিন কাল গনি।। 


বর্ষায় ভরা নদী 
                  স্রোত ক্ষুরধার, 
দিশাহারা পাগলিনী 
                   চলে দুর্বার। 
আপন চলার পথে 
                    যাহা কিছু পায় 
উপাড়ি নখরাঘাতে 
                     নদী ছুটে যায়। 
বন্যার কবলিত... 
                      আর্ত জীবন 
হাহাকারে ভরি তোলে 
                       গগন পবন। 
বুকে নিয়ে সেই ধ্বনি 
                        সুদূরের পথে 
নদী ছুটে যায় বেগে 
                        আপনার রথে।।



এবং বিশ্ব 

পোড়েনি এখনো
কুমকুম ঘোষ

দাহ করে এলাম
আত্মা;  আশ্রয়,মুখোশ
এবং যা ছিল অবলম্বন।

থার্ড বেল বেজে গেলে
পর্দা ওঠে রোজ ;
আলোর ইশারায়।

এখনও পোড়েনি জলের দাগ
নিঃস্ব, স্তব্ধ , অমলিন।





শরৎ গদ্য 

শিউলির চিঠি

চিত্রা পাল

 

ভাই কাশফুল,

                         তুমি কেমন আছ, মনে হয়তো ভালোই। আমি তোমাকে আমার দেশের আকাশ বাতাসের অবস্থাটা একবার মনে করিয়ে দিতে চাই। এতদিন বৃষ্টির মাতামাতি, ঝড়ের দাপাদাপি চলছিলো, তাই আসবার কথা কিছু বলিনি। এবার ওরা ওদের বাক্স প্যাঁটরা নিয়ে চলে যাবার তোড়জোড় করছে। আকাশ মাঝে মাঝে ঘন নীল।সূর্যোদয়ের  কিরণ যখন আমার গাছের পাতায় পাতায় ছুঁয়ে যায়,সে কিরণ স্পর্শে সমস্ত গাছপালা বৃক্ষলতা কেমন কেঁপে  কেঁপেওঠেআমার প্রাণের ভেতরেও  কাঁপন ধরে,কেউ যেন মনে করিয়ে দেয়,আমার প্রকাশ হবার, ফুটে ওঠবার সময় হয়ে এসেছে।এসেছে শরত্‌কাল, যে কাল তোমার আমার,দেশের মানুষজনের একেবারে  একেবারে আপন।   

  সবারই অভিব্যক্তি প্রকাশের সময় থাকে।তো আমার এই শরৎকাল, এই ঋতুই আমার সব,তার সঙ্গে তোমারও সবএর সঙ্গে জড়িয়ে আছে তোমাদের  উত্‌সব আনন্দ। সব জাতিরই কোন এক বিশেষ কাল আছে, যে কাল  তাদের সমারোহের কাল, উৎসবের কাল।তেমনি আমাদের বাঙালীদের এই শরত্‌কাল।শরত এলেই কেমন সকলের এক হয়ে আনন্দ উৎসবশুরু করার মন হয়ে অবশ্য তার শুভ সূচনা হয় আমাকে দিয়েই। প্রথম যেদিন দুটো একটা করে গাছের তলায় ঝরে পড়ি,সেদিন নিজের আনন্দের সঙ্গে অন্যদেরও জড়িয়ে ফেলি।  সেদিন চোখে পড়ে নীল আকাশে  সাদা মেঘের ভেলা, সে মেঘের ছায়া লুকোচুরি খেলে ধানের  ক্ষেতে।ভোরের সোনা রঙের আলোর স্পর্শে আমার কেমন যেন কাঁপন ধরে। আমি জানি তোমারও হয়। নদীর চরে লুকিয়ে থাকা তুমিও সে কাঁপনে শিউরে উঠে মাথা তোলো।  

    সারাদিন সূর্যের আলো বর্ষার জলসিক্ত গাছের পাতায় পাতায় যেন প্রাণের বীণা বাজিয়ে যায়। সে সুর ঝংকারে সাড়া দিয়ে সারা রাত ধরে আমরা কোমল পল্লবের কোলে কোলে এক সাথে ফুটে উঠি। ফুটে ওঠার মৃদু সৌরভ বাতাসে ভাসে। আমাদের কাছে এলেই তা পেয়ে যাবে। সকালে বাতাসের  উড়ন্ত আঁচলের দোলায় গাছের ডালপালা চঞ্চল হয়ে পড়লে আমরা ভূমিতে বিছিয়ে পড়ি, তার ওপরে শিশির পড়ে হাসে, সে হাসি যেন মুক্তোর মতো  ফুলের সাজিতে ভরে উঠে যাই দেবতার পদতলে।সন্ধ্যায়  অন্ধকার যখন ঘন হয়ে আসে, আবার আমরা সেজে উঠি গাছের পাতার কোলে নতুন প্রাণের আবেগে। এমনি করেই আমরা পুনর্জন্ম লাভ করি।শরত তপনে প্রভাতস্বপনে পরাণ  বোধ হয় তাই চায়।  আমার কথা তো বললাম, এবার তোমার কথা বলো।  

ইতি

শিউলি 


ঘরে ফেরার গান 

 অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী

টরন্টো,কানাডা
সকাল ৮ টা
২ রা সেপ্টেম্বর ২০২১

আমি চোখ বুজে এখান থেকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি বিকেলের পড়ন্ত আলোয় তুমি বাবার জন্য চা নিয়ে বাইরের বারান্দাটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছ। তোমার আলতা পরা পায়ের পাতা কতদিন ছুঁয়ে দেখেনি মা। চায়ের কাপ প্লেট এখন অল্প অল্প কাঁপে তোমার হাতে। সেই কাঁপার আওয়াজ, তোমার হাতের শাঁখা, পলা, চুড়ির আওয়াজের সঙ্গে মিশে অদ্ভুত এক অনুরণন সৃষ্টি করে। প্রতিবছর পুজোর আগে এই সময়টায় তোমার হাতে নতুন শাঁখা, পলা ওঠে। আরও উজ্জ্বল হও তুমি। বাবার গায়ে হালকা একটা চাদর যত্ন করে জড়িয়ে দিলে তুমি। বাতাসে এখন অল্প অল্প হিমের ছোঁয়া।  ছাতিম ফুল গন্ধ ছড়াচ্ছে বাতাসে। বাবার হাতে এবারের শারদ সংখ্যার কোনো একটি বই। চেয়ারের পাশে লাঠি। সেবার পড়ে যাওয়ার পর থেকে ওই লাঠিই বাবার সঙ্গী। একটা সময় বাবা কতজনের ভরসার, বিশ্বাসের,  দায়িত্বের অংশীদার হয়েছেন। বটগাছের মতো ছায়া দিয়ে গড়ে তুলেছেন আমাকেও; আজ আমিও বাবার ভরসার সাথী হয়ে কাছে থাকতে পারছিনা। 
                     এখানে কাজ, শুধু কাজ। কেনা কেনা খাবারগুলো খেতে খেতে মুখে অরুচি ধরে গেছে। তোমার হাতের গন্ধ মাখা ভাত, ডাল,  আলু ভাজার কথা মনে পড়ে খুব। এখন তো ভাদ্র মাস। এবছর তোমার গোপালের জন্য তালের বড়া, তাল ক্ষীর করেছো মা? তারপর তো নিজেরা একটুও মুখে না তুলে বিলিয়ে দেবে একে ওকে। তোমার অভি যে তোমার কাছে নেই.....তোমার খুসখুসে কাশিটা কমেছে মা? ফোনে কথা বলেও মন ভরেনা সেই এসে থেকেই। গ্রামে  নেটওয়ার্কের সমস্যার জন্য খুব অস্পষ্ট ভাবে আমার কাছে পৌঁছোয় তোমাদের গলার আওয়াজ। রান্নাঘরে তোমার হলুদ মাখা আঁচল,  পিঠময় ভেজা চুল ছড়িয়ে সাজি হাতে বাগানময় ঘুরে তোমার ফুল তোলা, তুলসীতলায় প্রদীপ জ্বালানো, বছরের এই সময়টা জুড়ে  ভোরের আলো আঁধারিতে কমলা বোঁটায় টলমলে জলের কণা মাখানো শিউলি কুড়োনোর ছবি ; সবই আমার পিছুটান। 
                          এই শরৎ কালের সময়টায় প্রতিবছর আমাকে হাতছানি দেয় সকালবেলার ধানগাছের ওপরের শিশির বিন্দু, ভোরের আবছা কুয়াশা,  শিউলি, কামিনী, মল্লিকা, ছাতিম, হাসনুহানার পাগল করা গন্ধ,ফল বাগানের কামরাঙা, চালতা, আমলকী, ডালিম ,দিঘির  পদ্ম, শাপলা, শালুক,পাড়ের কাশবন, তোমার হাতের নাড়ু, মোয়া, মুড়কি।  
                            ছবির মতো ভেসে ওঠে,   ব্যানার্জী বাড়ির ঠাকুর দালানে সিধু কাকার নিপুণ হাতের কারসাজিতে গড়ে উঠছে একচালায় মা দুর্গার ডাকের সাজ। দুর্গাপুজোর আমেজ এখন গ্রামের আকাশে, বাতাসে। ওখানকার পুজো পুজো গন্ধ মাখানো নরম মিষ্টি হাওয়া আমার কাছেও ভেসে আসছে যেন।আমার মনেও বেজে উঠেছে ছুটির বাঁশি।দুর্গা ঠাকুরের মুখ মনে করলে কপালে সিঁদুর পরা তোমার মুখই চোখে ভাসে মা। 
                                বিগত দিনগুলোতে  মহামারীর এই ভয়াবহতার মধ্যে হাজার হাজার মাইল দূরে থেকে তোমাদের কথাই সবচেয়ে বেশি মনে পড়েছে..  আতঙ্ক গ্রাস করেছে তোমাদের একাকীত্ব আর অসহায়তার কথা চিন্তা করে। এই ধুলো বর্জিত পলিশ করা জীবনকে ছাপিয়ে আমার গ্রামের আঁকাবাঁকা পথ ধরে ঘরের চেনা পরিসরে ফেরার ছুটি চেয়েছে মন। 
                আমি বরাবরের মতো ফিরে যাচ্ছি তোমাদের কাছে, তোমাদের পাশে, আমার সহজ সরল গ্রামের মানুষদের কাছে; আধুনিকতায় না হলেও আন্তরিকতায় যাঁরা সত্যিকারের খাঁটি। এই দুর্বিষহ পরিস্থিতিতে কর্মসংস্থানহীন কিছু মানুষকে নিয়ে শুরু হবে আমার আগামীর পথচলা। আজকে সকালের সূর্যকে সাক্ষী রেখে আসন্ন শারদীয়ার প্রাক্কালে আমার স্বপ্ন দেখার শুরু। শরতের আনন্দময়তা ও তোমাদের আশীর্বাদ তোমাদের ছেলেকে যেন সঠিক পথের দিশা দেখায়। 
                                 রোজকার মতো আজও আমার ডায়েরির পাতা জুড়ে মনের কথাগুলো সাজিয়ে দিলাম তোমার নামে।  এরপর শুধু দিনগোনা..ভোরের স্বপ্ন সত্যি হওয়ার মতো করেই এই শরতেরই আগামী কোনো এক ভোরে আমি পৌঁছে যাব তোমাদের কাছে, আগামী প্রতিটি ভোরকে আরও সুন্দর, আরও সার্থক করে তুলতে। 
 

                     

আজি শরত তপনে প্রভাত স্বপনে 

পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়


আজও  চোখে   ভাসে  অতীত  দিনের   সোনা মাখা  স্মৃতি।   বাড়ির  উঠোনে  আলো  করে ফুটতো  স্থলপদ্ম।  গোলাপি  স্থলপদ্মের ভারে নুইয়ে  পড়া  গাছটার   সাথে,   আকাশের তারার মতো  ফুটে  থাকা  শিউলি  গাছটার ভাব ছিল। সাঁঝের  আঁধারে  বা  পূর্ণিমা  রাতে  একটু ফাঁকা ফাঁকা  থাকলেও,   জোনাকি  জ্বলা   আঁধার রাতে,   শিউলি - স্থলপদ্মের  মিলন  ঘটত। 

মাতৃপক্ষের  শুরুতে  শিশির  ভেজা পাতার ফাঁক দিয়ে   চাঁদের  আলো  চুপটি  করে   ওদের লুকোচুরি   খেলা  দেখত।  আমাদের  বাড়িতে ঢোকবার  রাস্তায়,  সার  সার  রজনীগন্ধা মাথা উঁচু  করে  স্বাগত  জানাতো, অতিথি -অভ্যাগতদের।

মহালয়ার  ভোরে,   মা '  ঘরের  সব   জানলা খুলে,  পরদা  সরিয়ে  দিয়ে,   নিজের   হাতে জ্বেলে  দিতেন  গ্রীনচম্পা  ধুপের  কাঠি। গোবর নিকোনো  উঠোনে,  আলো  করে  ঝরে  পড়ত হলুদ  সাদা  শিউলি  ফুল।  ভোরের  সে আবেশ দুপুর,  বিকেল  পার  করে  সাঁঝবেলা   অবধি মাতিয়ে   রাখতো। 

মাতৃপক্ষ  জুড়ে  কত  না  আয়োজন  মণ্ডপে মণ্ডপে  ঘুরে  ঘুরে  ঠাকুর  দেখা  ও  প্রসাদ খাওয়া।   কোন  বন্ধু  ক'টা  ঠাকুর  দেখল তার হিসাব   নিকাশ  চলতো।  

খুব  শৈশবে  একবার  চার-পাঁচটা  জামা -প্যান্ট এর  সেট  পেয়েছিলাম।  এক  একদিন   এক একটা  সেট  পরে,  অন্য  আর  একটা   সেট হাতে  ঝুলিয়ে,   পুজো  মণ্ডপে   ঘুরতে  বের হতাম।

শ্রাবণ  মেঘের  বিদায়  বেলায়  এখনও  সেই রবি কিরণ  তার  পূর্ণ   ছটা  ঢেলে  দেয়। পূর্ণিমা চাঁদ তুলসীমঞ্চের  গায়ে  ঢেলে  দেয়  তার   কোমল আলোর  বর্ণছটা।  আজও  শরত  তপনে প্রভাত স্বপনে  ভেসে  আসে  পেঁজা  তুলোর  মেঘের পাহাড়।   দূর  গ্রামে  কাশবনের   দেশ  থেকে ভেসে  আসে  আগমনী  গান।  



আজি শরত তপনে প্রভাত স্বপনে 

অদিতি মুখার্জী সেনগুপ্ত 


প্রতিদিন মানুষ যদি নিরিবিলি প্রকৃতির সাথে একান্ত সময় কাটাতে পারে, তবে সে মানসিক শারীরিক সব দিক দিয়ে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হবেন। আসলে আমরা তো প্রকৃতিরই অংশ।প্রকৃতি আমাদের দেহে মনে তো প্রভাব ফেলবেই সেটাই স্বাভাবিক। প্রকৃতি বলতে; প্রকৃতির যে কোন কিছু; যে কোন ঋতু, বনজঙ্গল, গাছপালা, সাগর, নদী, কিংবা দিগন্ত ভরা সাদা কাশফুল মন ভালো করে দেবার জন্য যথেষ্ট।

ষড়ঋতুর দেশ আমাদের এই বাংলাদেশ। প্রতিটি ঋতু ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। সকালে প্রকৃতি অপরূপ সাজে সজ্জিত হয়। শরৎ সকালের প্রকৃতির প্রসন্ন হাসি আর সুবর্ণ মােহন কান্তি দর্শনে মানুষ মাত্রই মুগ্ধ হয় । শরতের প্রকৃতির স্নিগ্ধ শান্তরূপ সকলকেই আকৃষ্ট করে।

ভাদ্র-আশ্বিন-এ দুই মাস শরৎকাল। বর্ষা যখন যাই যাই করে তখন বাংলাদেশের প্রকৃতির নাট্যমঞ্চে নেপথ্যে শরৎ সুন্দরীর আবির্ভাবের অদৃশ্য আয়ােজন চলতে থাকে । নিঃশব্দ চরণে সে যে কখন এসে হাজির হয় তা কেউ টেরই পায় না। অনেক সময় বর্ষা চলে গেলেও শরৎ আসতে কিছুটা দেরি হয়। হঠাৎ একদিন ভােরে ঘুম থেকে উঠে যখন দেখতে পাই, শিশিরসিক্ত দূর্বাঘাসের উপর সূর্য কিরণ পড়ে হাজারও মুক্তোদানার রূপ ধারণ করেছে আর আমাদের চারপাশে পথে ঘাটে টুকটাক দুই একটা সাদা কাশফুল উঁকি দিচ্ছে তখন জানতে পারি যে শরত ঋতু এসেছে। 

কাশফুল এর শুভ্রতা এমনই যে এর ফুরফুরে হাল্কা আকৃতির মতনই মন দ্রুতই হাল্কা হতে থাকে। আমাদের আর কোনাে সন্দেহ থাকে না যে শরৎ সুন্দরী বাংলাদেশের বুকে এসে হাজির হয়েছে। বাংলাদেশে শরৎকাল সামান্য কিছুদিন স্থায়ী হয়। এ অল্প সময়েই প্রকৃতিতে নিয়ে আসে নতুন ছন্দ, নতুন সৌন্দর্য ।

শরতের প্রভাতে হালকা কুয়াশা আর বিন্দু বিন্দু জমে ওঠা শিশির এ ঋতুর প্রধান উপহার । এ সময় পূর্ণ যৌবনা নদী প্রাণচাঞ্চল্যে, খরতর বেগে ছুটে চলে আপন গন্তব্যে। রক্তিম সূর্য পূর্বাকাশে উদিত হয়। আকাশে সারসের দল সাই সাই করে উড়ে চলে কোনাে মানস সরােবরের দিকে। সুনীল আকাশে ভেসে বেড়ায় খণ্ড খণ্ড অসংখ্য সাদা মেঘের ভেলা। সুনীল আকাশের ছায়া পড়ে শান্ত নদীর বুকে। নদীর কোল ঘেঁষে ফোটে অজস্র কাশফুল। মৃদু বাতাসে ঢেউ খেলে যায় সেই সাদা কাশবনে। আকাশের স্নিগ্ধ সূর্যকিরণে মাঠ-ঘাট ঝলমল করে। হাঁটুজলে সাদা সাদা বক নিবিষ্ট মনে দাঁড়িয়ে থাকে। লােকালয়ে খেকশিয়াল আর বনবিড়ালের আনাগােনা বৃদ্ধি পায়। দোয়েল-কোয়েল আর বিভিন্ন পাখির কলকাকলিতে মুখরিত থাকে চারদিক। শরতের শারদীয় প্রভাতে নানা রঙের ফুল ফোটে। জুই, টগর আর মালতি ফুলের শুভ্র সৌন্দর্যে চারদিক মােহিত থাকে। শরতের প্রভাতে শিশির ভেজা শেফালি ফুল অনুপম সৌন্দর্য নিয়ে ঘাসের বুকে হাসে। আকাশে, বাতাসে আর দূর্বাঘাসে শরৎ তার স্নিগ্ধ সৌন্দর্য বিলিয়ে দেয়। এর অপূর্ব সৌন্দর্যে বাংলার প্রকৃতি ও পরিবেশ মােহনীয় হয়ে ওঠে। 

শরতের শিশির ভেজা প্রকৃতির আস্তরণ ভেদ করে সুয্যিমামা আলাে ছড়ায়। সকালের মিষ্টি রােদ খুবই ভালাে লাগে। শরতের সকালের স্নিগ্ধ বাতাস শরীরে শিহরণ জাগায় । মাঠভরা ফসলের খেতে যখন সূর্যের প্রথম আলাে পড়ে তখন সবকিছু যেন চিকচিক করে। মােটকথা শরতের সকালের অপরূপ সৌন্দর্য এক মনােমুগ্ধকর পরিবেশের সৃষ্টি করে।

শরতের সকালের মনােরম পরিবেশ মানবমনকে প্রফুল্ল করে। সারা আকাশ জুড়ে বৃষ্টিহীন সাদা মেঘের বিচরণ মানুষের মনে প্রশান্তি এনে দেয়। সকাল বেলার মিষ্টি রােদ মানুষের মনকে ভাবুক করে তােলে । প্রভাতে ঘাসের ওপর বিন্দু বিন্দু শিশির কণা, বিভিন্ন গাছে গাছে ফুটে থাকা ফুলের সমারােহ, গাছে গাছে ডাকা পাখিদের কলকাকলি, বিভিন্ন ফুলের সুবাস প্রভৃতি থেকে যে আনন্দ পাওয়া যায় তার তুলনা রহিত।

শরতের সকালে নানান পিঠা বানানাে বাঙালি সংস্কৃতির একটি অংশ। প্রতিদিন সকালে গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতে সকালবেলা পিঠা দিয়ে নাস্তা করা হয়। তাছাড়া আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের পিঠার নিমন্ত্রণ জানানাে হয় । এভাবে গ্রামে বাঙালি সংস্কৃতিকে ধরে রাখা হয়েছে সুপ্রাচীনকাল থেকে।

বাংলাদেশ একটি কৃষিভিত্তিক দেশ। এদেশের অধিকাংশ লােক কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। বর্ষার পরপরই আসে শরৎকাল । তখন কৃষকরা খুব খুশি হয়। কেননা এ ঋতুতে ফসলের সম্ভাবনা জেগে ওঠে। বর্ষার দীর্ঘ সময় মাঠ-ঘাটে শুধু পানি আর পানি থাকে।কৃষক ফসলের যথাযথ পরিচর্যা করতে পারে না। তাই শরৎঋতুর আগমনে কৃষকরা আবার নতুন ফসলের আনন্দে থাকে। ঝিরঝির বাতাস ধানের খেতে ঢেউ দিয়ে যায় আর কৃষকের মনে দোলা দেয়। প্রকৃতিতে বহমান ঝিরঝির বাতাস কৃষকের সব ক্লান্তি দূর করে। তারা মনের আনন্দে জমিতে ফসলের পরিচর্যা করে আর মনে মনে সুখের স্বপ্ন বােনে। 

শরতের সকাল জনজীবনে নতুন আমেজ এনে দেয়। তখন পল্লির পথঘাট শুকনাে থাকে। কোথাও কোনাে কাদা থাকে না। সকাল হতেই মানুষের মধ্যে কর্মব্যস্ততা শুরু হয়। সবাই যার যার কর্মস্থলে ছুটে চলে। গ্রামাঞ্চলের খেয়াঘাটে মানুষের ভিড় জমে।

শরতের সকাল কবি-সাহিত্যিকদের মনে বিশেষভাবে ধরা দেয়। শরতের অনাবিল সৌন্দর্য মানুষকে মােহিত করে। এ সময় বাংলাদেশ এক অপরূপ সাজে সজ্জিত হয়। বিশেষ করে শরতের সকাল সবার মন কেড়ে নেয় বিচিত্র সৌন্দর্য বিলিয়ে দিয়ে। তাইতাে অনেকের প্রিয় ঋতু শরতকাল।

               


শরৎ কবিতা


শরতে

মাথুর দাস


শরৎ তপনে প্রভাত স্বপনে স্ব-পণ বপন করলে মনে

কোপন সময় কি জানি কী হয় গোপন করেই কিছু ;

বরষা শেষে ফরসা আকাশ জানায় কথা সঙ্গোপনে

ভুলোমনা সব তুলোপেঁজা মেঘ বেগহীন ভাসে পিছু ।


শিউলি ও কাশ  কীসের প্রকাশ  স্পষ্ট ঘটাতে চায় !

সবুজের ঢেউ ধানখেত জুড়ে, সুরে গান গায় রাখাল ;

কলকল বয় নদীজল  প্রকৃতি উজল রং তুলিকায়,

অমল দীঘিতে কমলকলিরা মুগ্ধ অলির মন-মাতাল ।


শরত তপনে প্রভাত স্বপনে শুধুই খুশির বন্যা বয়,

হাসে প্রতিবেশ দুখ-নিঃশেষ,ভাসে পুজো-পুজো গন্ধ ;

বর্ষ ঘুরে হর্ষ সুরে পিত্রালয়ে বাঙালী হয় কন্যাময়,

তাই তো শরতে  পরতে পরতে  শারদীয়া অনুবন্ধ ।



সময় এবং সময়

ধ্রুবজ্যোতি পাল

সে একটা সময় ছিল।
বেশ একটা সময় ছিল।
করলাতে জল ছিল
জলের একটা আয়না ছিল
আয়নাতে ছবি ছিল
আলোভরা উঠোন ছিল
উঠোনেরও হাসি ছিল
আম-শিরীষের ছায়া ছিল
ছায়া-আলোর খেলা ছিল
গোটা একটা আকাশ ছিল
আকাশের নীল রং ছিল
‘অনুরোধের আসর' ছিল
বিকেল আলোয় ঘোরা ছিল
কাদামাঠে খেলা ছিল
হৃদয় তখন খোলা ছিল
হৃদয়ের রং সবুজ ছিল
এইচ. এম. ভি-র রেকর্ড ছিল
হেমন্ত আর সন্ধ্যা ছিল
কথা বলা পুতুল ছিল
যাত্রা-নাটক-গান ছিল
প্রাণ ছিল প্রাণ ছিল
আরো কত কিছু ছিল।
এখনো তো অনেক আছে।
আগের চেয়ে বেশি আছে।
সব পেয়েছির টান আছে
আরো পাওয়ার খিদে আছে
বাক্স বাক্স খেলা আছে
বাক্স বাক্স বাড়ি আছে
বাড়ির ভেতর বাক্স আছে
বাক্সের গায়ে খাঁচা আছে
খাঁচার ভেতর জীবন আছে
প্রাণ আছে, জীবন আছে?
অসম্ভবের চাওয়া আছে
গ্রীলের পাশে গাছ আছে
গাছেরও তো প্রাণ আছে
গাছেরও তাই মুক্তি আছে
দূরের সবুজ ছায়া আছে
ছায়াঘেরা বাড়ি আছে
বাড়ির সামনে বাক্স আছে
বাক্সে অনেক মানুষ আছে
মানুষেরা ভালো আছে?
অ্যান্ড্রয়েড আর ফোর-কে আছে
ভার্চুয়ালি বন্ধু আছে
বন্ধুদের হাসি আছে
হাসির মধ্যে ভাবনা আছে
মনের ভেতর পাঁক আছে
পাঁকের ভেতর সাপ আছে
বেঁচেবর্তে থাকা আছে
সৃষ্টি আছে বৃষ্টি আছে
প্রলয় আছে ধ্বংস আছে
বেনিয়মের নিয়ম আছে
নিয়ম কানুন ভাঙা আছে
ভাঙার পরেও গড়া আছে
রাতের পরে দিন আছে
কালোর পর সাদা আছে
আছে আছে সবই আছে

খুঁজে দেখলে আজও আছে।।



খুশির শরৎ
      সুব্রত দত্ত
    

শরৎ মানে --- বর্ষার অত্যাচার থেকে বাঁচা,
শরৎ মানে --- প্রকৃতির নতুন রূপে সাজা।
সদ্যস্নাতা তরুণীর মত পরিতৃপ্ত হাসা,
সোনারোদে ঝিকিমিকি আনন্দেতে ভাসা।

শরৎ মানে --- হিমের পরশ লাগা,
শরৎ মানে --- শিউলি-গন্ধে জাগা।
কাশবনের দুলুনিতে কাঁপন লাগা প্রাণে,
পুজোর গন্ধ হৃদমাঝারে খুশির লহর আনে।

শরৎ মানে --- ধানের ক্ষেতে ছায়া-রোদের খেলা,
শরৎ মানে --- আকাশনীলে সাদা মেঘের মেলা।
বিলের জলে শাপলা ফুলের স্বপ্নে জাল বোনা,
ঢ্যাম কুড়কুড় ঢাকের বাদ্যে পুজোর দিন গোনা।

শরৎ মানে --- শিশির ভেজা ঘাস মাড়িয়ে যাওয়া,
শরৎ মানে --- পদ্ম-ঘ্রাণে নিজেকে ফিরে পাওয়া।
দেবী দুর্গার বিদায় বেলায় বিষন্ন সিঁদুর খেলা,
বছর পরে ফিরবে আবার, বসবে প্রাণের মেলা।।



শরৎ  এলো

শ্রাবণী সেন

এক টুকরো আকাশ দেখি 
আমার খোলা জানলা দিয়ে
আকাশ এসে হাতছানি দেয়
শরৎ সাদা মেঘকে নিয়ে।

সোনার আলো মেখে মেখে
রোদে সোনার ছোঁয়াচ লেগে
কাশের ফুলে খুশির হিলোল
মনের মাঝে উঠছে জেগে।

ভোরের বাতাস বইল আবার
শিউলি ফুলের গন্ধ নিয়ে।
একটুখানি আলো মাখি 
ওইটুকু ওই জানলা দিয়ে।

জানলা আমার খোলা শুধু 
আলো হাওয়ার আসা যাওয়া
বর্ষা গেলে শরত আসে 
একই থাকে চাওয়া পাওয়া।




শূন্যতার বুক চিরে
নারায়ণ দত্ত

বৃষ্টি চেয়েছিলাম। চেয়েছিলাম শরৎ-বসন্তের
রঙিন সম্ভার, এক আঁজলা বিশুদ্ধ বাতাস,
মুঠো মুঠো রোদ্দুর আর
নিকোনো একটি উঠোন...

ভুল শরোশয্যায় কবিতা বাষ্প হয়ে উড়ে যায়
হামাম দিস্তায় পিষ্ট হৃদয় মৃত্যুবীজ বোনে
শিশুর মতো কাঁদে আকাশ-শরীর!
শুধুই আঁধার কুহক, নির্জন গাঢ় বেদনা
বুকের গভীরে বাজে অহর্নিশ, বিবর্ণ অতীত...
নীড় হারা পাখির মতো নিদ্রাভঙ্গ চোখ।

সহসা শিউলি গন্ধ ভাসে বিশুদ্ধ বাতাসে
মুছে যায় নোনামাখা স্মৃতি...
শিশিরের শব্দের মতো শুনি কাশ ফুলের
নুপুর ছন্দ, স্বপ্ন উত্তাপে কী একটা উম...
সেঁকে নিই হিম শীতল কলজেটাকে
নতুন জলে ভাসাই মান্দাস।

উঠোনের ঘাসে ফোটে কাঙ্ক্ষিত পারিজাত
মন-বলাকা উড়ে যায় শূন্যতার বুক চিরে
অবেলায় লিখি অনাবিল আনন্দ লিপি।

পোড়া কাঠের বিমূর্ত বেদনা ঝেড়ে আবারও
ছুটে যায় ভাদ্রের সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে
তরলিত চাঁদের চুম্বক নয়নে পৌষালি মৌতাতে।




ফুল্লরার স্বপন 
শ্রাবনী সেনগুপ্ত

"অ ফুল্লরা কাজে যাবিক লাই?"
"হ গ মা,নদীর ধারটতে একটুকু যাই -"
"অখানে আবার কি আছে রে!"
"কাশফুল মা-কি সোন্দর যে-
এই শরৎকালটয় পেঁজা তুলোর মেঘ,
মা গ এই ভোরেতে দেখতে লাগে বেশ।"
"তা বললে হবেক রে ছুঁড়ি-
কাজের বাড়ি যা তাড়াতাড়ি।
পূজোর বোনাস পাবিক লাই তবে-
লতুন জামাটও লিতে হবে।"
ফুল্লরা তাই ছুট লাগালো জোর 
গায়ে মেখে শরৎকালের ভোর।
শরত প্রাতের রবির কিরণ
নরম আদরে করলো বরণ।
এই বাংলার প্রতি ঘরে ঘরে
ফুল্লরাদের স্বপনেতে ভরে।


ভাদ্রমাস

মহাজিস মণ্ডল


"আজি শরত তপনে প্রভাত স্বপনে"
ঝরঝর ঝরিছে ওই শিশির ধারা
দিগন্তবিসারী আকাশের নীল পাখায়
আনন্দ অশ্রু বিহ্বল সে পাগলপারা।

চকিত চোখের চাহনি চমকিত
দিগ্বিদিক শূন্য হরষে সরসে ভাসে
ভাদ্রমাসে ভাবনার ভরসার ভিড়ে
ভালবাসা অবাধ শিহরণে হাসে।




শরৎ গল্প 

আলো মানুষ 
মৌসুমী চৌধুরী 

        এতদিন ধরে এই ভরা ভাদ্রমাসেও বৃষ্টি হচ্ছিল ঝমঝমিয়ে। বৃষ্টির টুপটাপ, ঝমঝম নাচের ছন্দ ফুটে উঠছিল রূপসার পায়েও!
— "এ ভরা বাদর মাহ ভাদর শূন্য মন্দির মোর...।"
কিন্তু  আজ সকালে ঘুম ভেঙে উঠে রূপসা দেখল শরৎ আলোয় ভেসে যাচ্ছে আকাশ। ভেসে যাচ্ছে মাটি, গাছ-গাছালি, পথ-ঘাট, ঘর-বাড়ি। মানুষেরাও যেন শরৎ আলো গায়ে মেখে কেমন আলো মানুষ হয়ে উঠেছে... রূপসার অন্তর ঘুলিয়ে উঠে আসছে নাচের এক একটি মুদ্রা। তার পায়ের স্ট্রোকে আজ যেন ফুটে উঠতে চাইছে শরৎ প্রকৃতির ছন্দময়তা —
"শরৎ, তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি।/ছড়িয়ে গেল ছাপিয়ে মোহন অঙ্গুলি॥"
আজকের এই শরত সকাল অনেকদিন বাদে আবার উৎসবমুখরতায় ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে রূপসাকে। 
        ছোটবেলা থেকেই প্রকৃতির মধ্যে  নাচের তাল-লয়-মুদ্রা খুঁজে পায় রূপসা। এই যে বাগা -নের গাছগুলো কেমন সবুজ ডানা মেলে ছন্দে ছন্দে বেড়ে ওঠে। প্রতি ঋতুতে যেন আলাদা আলাদা ডান্সিং কস্টিউমস পরে গাছেরা নেচে ওঠে প্রাণের আনন্দে। আর ওই বাতাস, সেও তো নেচে নেচে চলে নানা বিভঙ্গে। ফুল, পাখী, নদী, ঝর্না সব্বার মধ্যেই লুকোনো নাচের মুদ্রা স্পষ্ট দেখতে পায় রূপসা। নাচ রূপসার প্যাশান, নাচ তার পুজো। 
       সেই ঘটনার পর নাচই তো তাকে ঢেকে দিয়েছিল স্নিগ্ধ আশ্রয় আঁচলে। নাচ তাকে কোল পেতে দিয়েছিল, যে কোলে তার আবার নতুন জন্ম হয়েছে। সেই দুর্ঘটনার পর সে এতটাই ভেঙে পড়েছিল যে কি করে আবার জীবন শুরু করবে বুঝে উঠতে পারছিল না! সৌম্য আর শ্বশুরবাড়ির লোকজনেরা পাশে থেকে সান্ত্বনা এবং সাহস যুগিয়ে গেলেও কিছুতেই যেন ক্ষতের উপশম হচ্ছিল না। দিনের পর দিন নটরাজের পায়ের কাছে বসে চোখের জল ফেলত সে। ভেবেছিল কোনদিনই বুঝি আর নচের জগতে ফিরতে পারবে না। আর তারপরই একদিন গুরুজি এসে হাত রাখেন পিঠে ,
— " এভাবে কেঁদে নিজেকে আরও অসুস্থ করলে কারও কিছু যাবে আসবে না, রূপসা। তোমায় তো বাঁচতে হবে। আঁকড়ে ধর নাচ- কে। ওঠ, আবার উঠে দাঁড়াও।..."
গুরুজিই রূপসাকে একটু একটু করে স্থিতিতে ফিরিয়ে দিয়েছেন। এখনও চিকিৎসা চলছে তার। চলছে নানা সূক্ষ্ম অপারেশন। কিন্তু পাশাপাশি গুরুজির আন্তরিক উৎসাহে চলছে নাচের কঠোর রেওয়াজও। গুরুজিই শিখিয়ে- ছেন দুঃখের মধ্যেও ছন্দ আছে, আছে তাল, লয়। 
        সেই ঘটনার আগে স্বামী ও পরিবারের বাইরে রূপসার জীবন তীব্রভাবে আবর্তিত হত তার নাচের স্কুল "সঞ্জীবনী"কে ঘিরে। তার সকাল বিকেলগুলো মুখরিত হয়ে থাকত নানা বয়সের ছাত্র-ছাত্রীদের কলকাকলিতে। তাদের হাতে ধরে একটু একটু করে শিখিয়ে তোলার মধ্যে রূপসা যেন ফিরে পেত নিজেকেই। ছেলে -মেয়েগুলো তার কাছে যেমন প্রশ্রয় পেত খুব। আবার অমনোযোগী হলে প্রচুর বকাও খেত মাথা নিচু করে বসে। আর সে সময়ই ঘটনাটা ঘটেছিল তার প্রিয় ছাত্রী শরন্যাকে কেন্দ্র করে। প্রায় দিনই নাচের স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে একটি বখাটে ছেলে উত্যক্ত করত তাকে। একদিন সেটা খুব বাড়াবাড়ির পর্যায়ে পৌঁছে গেল। মাঝ রাস্তায় ছেলেটি নাকি শরন্যার হাত ধরে টানাটানি করছিল। আর কোনক্রমে আঁচড়ে-কামড়ে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে পালিয়ে এসে রূপসার কাছে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল শরন্যা। শুনে রাগে ফেটে পড়েছিল রূপসা। তার বাড়ির কাছে মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছিল ছেলেটি। রূপসা কাছে গিয়ে তার গালে সপাটে এক চড় কষিয়েছিল। কড়া ধমক দিয়ে বলেছিল,
— " এরপর বেশি বাড়াবাড়ি করলে ইভ-চিজিং
-য়ের জন্য জেলের ঘানি টানিয়ে ছাড়ব।" 
কোন জবাব না দিয়ে রূপসার দিকে হিংস্র দৃষ্টি 
ছুঁড়ে দিয়ে চলে গিয়েছিল ছেলেটি।
          তারপর মাস ছ'য়েক কেটে গিয়েছিল।  ছেলেটিকে রাস্তাঘাটে কখনও আর পিছু নিতে দেখতে পায় নি শরন্যা। তবুও প্রথম প্রথম ভয়ে কুঁকড়ে থাকত বাপ-মরা মেয়েটা। কিন্তু দিন তো কেটে যেতেই থাকে। আবার নির্ভয়ে চলাফেরা করতে লাগল সে। নাচের বিভিন্ন বাঁক, বিভঙ্গ, তাল, মুদ্রার খুটিনাটি শিখে নিতে লাগল আগ্রহ ভরে। রূপসাও তাকে উজাড় করে দিতে লাগল সব। তারপরেই আসে সেই  কালো দুর্যোগময় দিনটি, যে দিনটি থেকে আমূল বদলে যায় রূপসার জীবন। 
         পাঁচ বছর আগের সেই দিনটিও ছিল আজকের মতোই। গভীর নীল আকাশের বুক থেকে ঝরে পড়া সোনা রোদ্দুরমাখা এক উৎসবের দিন। কলকাতার এক বিখ্যাত পুজো কমিটির আমন্ত্রণে তাদের 'বিজয়া সম্মিলনী'তে নাচের অনুষ্ঠান করতে রূপসা গিয়েছিল তার ট্রুপ নিয়ে। খুব সুন্দর ও সফল হয়েছিল সেই অনুষ্ঠান। উদ্যোক্তারা আর্থিক পুস্কার সহ নানা পুরস্কারে সম্মানিত করেছিল রূপসা ও সহ-শিল্পীদের। সেই ট্রুপে ছিল তার প্রিয় ছাত্রী শরন্যাও। ফেরার পথে রাত প্রায় এগারোটা বেজে গিয়েছিল। নাচের মেয়েদের  নিয়ে রূপসা গাড়িতে ওঠার জন্য কিছুটা হেঁটে পার্কিং জোনের দিকে এগোচ্ছিল। হঠাৎ কোথা থেকে একটা বাইক এসে রূপসা আর শরন্যার দিকে কিছু একটা ছুঁড়ে দেয়। যেন আগুনের গোলা! রূপসার মুখের বাঁদিকটা প্রচন্ড জ্বলতে থাকে। ততক্ষণে সে বুঝতে পারে তার মুখে অ্যাসিড ছোঁড়া হয়েছে। কিছুটা অ্যাসিড ছিটকে পড়ে শরন্যার হাতেও। তখনই সেই ছেলেটিকে দেখতে পায় রূপসা যে শরন্যাকে উত্যক্ত করত। বোধহয় তার মুখেই অ্যাসিড ছুঁড়তে এসেছিল সে, আর লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে সেটা এসে লাগে রূপসার মুখে। নাচের মেয়েরা সবাই ভয়ে চিৎকার করতে থাকে। সেখানেই জ্ঞান হারায় রূপসা। 
       দীর্ঘদিন কোমায় থাকার পর যখন তার জ্ঞান ফেরে তখন রূপসা দেখে তার মুখের বাঁদিকটা, বাঁ-কানের লতি সম্পূর্ণ পুড়ে বিকৃত হয়ে গেছে। সবটা এবড়ো খেবড়ো মাংস্পিন্ড যেন। জীবন সম্পূর্ণ বদলে গেল রূপসার। লোকে তাকে কেমন এড়িয়ে চলতে লাগল। বাচ্চারা তাকে দেখলে কেঁদে উঠত। এমনকি তার ছাত্রছাত্রীদের বাবামায়েরাও বাচ্চাদের তার কাছে নাচ শিখতে পাঠানো বন্ধ করে দিলেন। দিনরাত্রি  তীব্র হতাশা টুঁটি চেপে ধরতে লাগল। সেই কষ্টের দিনগুলিতে শুধু শরন্যাই সবসময় পাশে ছিল তার। খুব অপরাধবোধে ভুগত মেয়েটা, 
— " আমার জন্যই তোমার এত কষ্ট পেতে হল, আন্টি। আমাকে ক্ষমা কর।"
— " দূর পাগলী, এ তো দূর্ঘটনা, আমার কপা- লে ছিল। এমন করে ভাবিস না কক্ষনো।"
    ধীরে ধীরে একটু একটু করে শরন্যার হাত ধরে চলতে লাগল রূপসা। ঘন্টার পর ঘন্টা সে আর শরন্যা নাচের অনুশীলন করত। তারপর একদিন একের পর এক ফিরে এল অন্য ছাত্রছাত্রীরাও। আবার তাদের কলকন্ঠে ভরে উঠল রূপসার "সঞ্জীবনী"। যে ছেলেটি অ্যাসিড ছুঁড়েছিল, একদিন ধরা পড়ল সে। যাবজ্জীবন সাজা হল তার। 
   বহু পরিশ্রম করে আজ অ্যাসিড আক্রান্ত মেয়েদের নিয়ে একটি সংগঠন তৈরি করছে রূপসা। নাম তার "আলো"। "আলো"র সদস্যারা অনবরত লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে তাদের মতো মেয়েদের আর্থ-সামাজিক প্রতিষ্ঠার জন্য। খোলা বাজারে যাতে অ্যাসিড বিক্রি বন্ধ  হয় সেই বিষয়ে তারা সোচ্চার। অ্যাসিড বিক্রির ক্ষেত্রে  দোকানদারেরা যাতে সজাগ ও সতর্ক থাকেন সেরজন্য তারা প্রতিনিয়ত পথসভা, মিটিং, মিছিল করে সচেতনতার বার্তা ছড়িয়ে দিচ্ছে। রূপসা এই সংগঠনের সভাপতি। আজকাল  "আলো" রূপসাকে কানায় কানায় ভরিয়ে রেখেছে।
হঠাৎ শরন্যার ডাকে সম্বিত ফিরে পায় রূপসা
— " একি আন্টি, তুমি এখনও এখানে বসে আছ? ওদিকে মেকআপ আর্টিস্ট যে এসে যাবেন একটু পরেই। তাছাড়া আলোর সদস্যরাও অনেকেই এসে গেছেন। নিচের ঘরে তারা সাজগোছও শুরু করে দিয়েছেন।"
    পাঁচ বছর পর আবার সেই পুজো কমিটির 
উদ্যোক্তাদের আমন্ত্রণে 'বিজয়া সম্মিলনী'র অনুষ্ঠানে পারফর্ম করতে এসেছে রূপসা। এবার তার সহশিল্পীরা হলেন "আলো"র সদস্যরা, অ্যাসিড হামলায় আক্রান্ত সব মেয়েরা। জীবনের সমস্ত অন্ধকার অলিগলি পেরিয়ে যারা হেঁটে যাচ্ছে আলোকময় উত্তোরণের পথে। দু'চোখ ভরে রূপসা দেখছে স্টেজের ওপর দুরন্ত পারফর্ম করছে সেইসব আলোময় মানু্ষেরা। আর তারা যেন দু'হাতে লুটেপুটে নিচ্ছে এই শরতের সবটুকু সোনারঙা আলো, 
   —" আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে,/ আমার মুক্তি ধুলায় ধুলায় ঘাসে ঘাসে॥"
    আবেগে ঝাপসা হয়ে আসে রূপসার চোখ।




শরৎ কবিতা 

শব্দকথা
অরবিন্দ মাজী


অক্ষরদের ঘোরাফেরা-
আঙ্গুলের চঞ্চল স্রোতে, 
ক্লান্তিহীন  বিবমিষায়-
শব্দরা নিঃশব্দে ভাসে, 
অতিদূর নীল আকাশে... 

যখন মৌনমুখ পক্ষিকূল-
নিশ্চিন্তে পাখনা  মেলে-
সপরিবারে আপন কুলায়-
ফিরে যায় ঝাকে ঝাকে-
দিন শেষে গোধূলি বেলায়... 

মন্দিরের ঘন্টায় শব্দরা বাতাসে-
জীবন্ত হয়,আজানের আওয়াজে-
অক্ষরেরা শব্দমালা গেঁথে চলে, 
চঞ্চলা যুবতী চুলের বেনী-বন্ধনে, 
অনড় পাথরও সুমধুর কথা বলে...



শরতের মাধুরী 

অপর্না ঘোষ


ঋতু পরিক্রমায় আজ শ্রাবণ নিয়েছে বিদায় ,
তবুও ভাদ্রের শুরুতেই বৃষ্টি ঝরছে অঝোর ধারায়।
শরতের প্রকৃতিতে রৌদ্র ছায়ার লুকোচুরি দেখা যায়,
নীলাম্বরে সাদা পেঁজা তুলোর ন্যায় মেঘ ভেসে বেড়ায়।
মাঠে মাঠে সবুজ ধান খুশিতে নেচে ওঠে,
নদীর দুকুল ঘেঁষে কাশফুলে খুশির মাতন তোলে।
শিউলি ফুলেরগন্ধ মাখা স্নিগ্ধ পরশে,
ভোরের বেলায় ঘাসের আগায় শিশিরের ছোঁয়া পরে।
শরতের সূর্যাস্ত মোহনীয় দৃশ্য ফুটে ওঠে প্রকৃতিতে,
রাতে রুপালি চাঁদের আলোতে ভরে যায় দিক-দিগন্তে।
মনোরম ও নবরূপে প্রকৃতি উঠেছে সেজে, 
চারিদিকে সাড়া পড়ে উৎসবের আমেজে।
মিষ্টি বাতাসে বেজে ওঠে আগমনী সুর,
উদাসী মন আজ হয়েছে আনন্দে মধুর।
শরৎকাল দুঃখ-বেদনা, ক্লান্তি-গ্লানি দেয় ভুলিয়ে,
জাতি ধর্ম নির্বিশেষে মেতে ওঠে শারদীয়ার আনন্দে।।



কাশের পালকে লেখা
অভিমন্যু

আজি প্রভাতী তপনের কিরণে হাসে প্রকৃতি
শিউলির গন্ধে ম ম এ ভুবন,
পেঁজা তুলোর মতো রুপালি নরম মেঘ জমেছে
সুনীল গগনে পলকেই যায় ছেয়ে
একঝাঁক সাদা বক যায় উড়ে,
তালে তালে নেচে ওঠে দোয়েলের পুচ্ছ
টুনটুনি দেয় আনন্দের শিস ;
বিন্দু বিন্দু শিশির পড়েছে সবুজ ঘাসের বাগিচায়,
কাশের পালকে লেখা হয় অপরূপ সৃষ্টি।

পদ্মপাতার ডালায় প্রদীপখানি জ্বেলে
আপনার করে বরণ করি শরতেরে।

হিমেল বাতাস যায় বয়ে
কানে কানে যায় ভালোবাসার কথা কয়ে,
স্বপনের একটু ছোঁয়ায় কলিগুলো ফুল হয়ে ফোটৈ।

ভাদু উৎসবে মাতে বাঁকুড়া বীরভূম পুরুলিয়া
আগমনির গান দূর থেকে ভেসে আসে।


শারদ আমেজ
প্রতিভা পালসেন
  
মনের-তারে আজ শারদীয়া-সুর,
শিউলির গন্ধ-মাখা ভোরের আমেজ;
শ্রাবণমেঘের মনখারাপ সরিয়ে
সাজিয়ে নিলাম চিলতে-রোদ, সংগোপনে!
মনপিয়নের ঝুলি ভ'রে, 
রাঙিয়ে দিলাম ধূসর ওই আকাশ-কোণ
শরতের অনুরাগে!

জরা-জীর্ণতার আঁধার সরিয়ে
একটু আলো আসুক এবার, নতুন-রূপে;
মনের স্যাঁতসেঁতে চোরাগলির ঠিকানা হোক
 সুদীর্ঘ রাজপথ! 
অভিশপ্ত-সময়ের স্বজনহারা কান্নাগুলো
শুষ্ক-দাগে স্থিত হোক স্মৃতির কোলাজে, 
নিশ্চুপে!

কাশের দোলায় বাউল বাতাস খুঁজে নিক
প্রভাতী অভ্যর্থনা, আনমনে!!  


তুষার কান্তি ভালোবাসা 

চন্দন কুমার দাস 

 মেঘমুক্ত আকাশের মত হৃদয়,
 নিখাদ সোনা রোদের মতো ভালোবাসা ;
এমন লাবণ্যময়ীর সংগ আমি চেয়েছিলাম ।

তোমায় অনুভবে চিনেওছিলাম;

এ যেন তুষার কান্তি ভালোবাসা ।

স্পর্শ পাই নি ঠিকই কিন্তু হৃদয় জুড়ে শীতলতা
 তুমি যেন তুষারশুভ্র হিমালয় ;
সোনা রোদ মেখে তুমি যখন আমার দিকে চেয়েছিলে -------

আমি তখন উড়ে যাচ্ছি এক ঝাঁক পাখি হয়ে শাপলা শালুকের ফুল,

পদ্মের কুঁড়ি গুলো তখনও হিমেল বাতাসের দোলায় দুলছে। 

সবুজ ধানের ক্ষেতে উঠছে হিল্লোল,

কাশ ফুলে ঢাকা বক্ষপট ,বয়ে চলছে স্রোতস্বিনী
মনের অজান্তে কখন অনুচ্চারিত স্বরে  বলে উঠলাম --"মা তুমি !"

তারপর ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে              

দূর দিগন্ত নীল আকাশে আমি মিলিয়ে গেলাম।

কিন্তুু আমার হৃদয় পড়ে রইল তোমার ধূলার 'পরে
        তালপুকুরের সবুজ বিছানো মখমলে।



শরতের মহিমা
 কবিতা বণিক                                                              

বর্ষা বেলার মেঘ,
জল ভরা কলসে করে পৃথিবীর  অভিষেক।
কালো মেঘ, ঘন কালো মেঘ, বজ্র্র মেঘ, 
কোদালে মেঘ মাটিকে সরসিত করে তাদের শীতল ধারায়।
সবুজ করবে বলে।।

বর্ষার শেষ বেলায়
বৃষ্টির অঝোর ধারার শেষে ক্লান্ত মেঘ,
আলোর সাথে লুকোচুরি খেলে ছেঁড়া মেঘের দল আকাশের গায়।
অলস মেঘ ভেসে চলে দূর ঠিকানায়।
শরত আসবে বলে।

মেঘেদের খেলা শেষে
শরতের মেঘেরা পাল তোলে আকাশের গায়।
মেঘেদের বড় সাধ মাটিতে নামার, শিউলি-পদ্মের  সাথে আলাপচারিতার ।
মেঘেরা মাটিতে নামে যেন কাশের  বনে।
দূর্গা আসবে বলে।

পূজোর গন্ধ মেখে 
কালো দিঘীর জলে শালুক-পদ্মের খেলা।
সাদা কাশের বনে লাগে দোলা, পথে শিউলি আঁকে আলপনা।
শারদলক্ষীর আগমনে চলে পূজোর ছুটির জল্পনা।
পূজোয় মাতবে বলে।।



আশ্বিনের ডাকে
  সুনন্দ মন্ডল

এলো যে শরৎ
আকাশের কোলে, মাটির গায়ে।
ফুটল কাশ
দুলছে দেখো, শিউলির বাঁয়ে।

প্রভাতের রবি
জেগেছে আবার, কালো রাত মুছে।
নীল মেঘ যেন
ছেয়ে গেছে দূরে, দিগন্তের কাছে।

ভাদ্রের নামে
আঁকা আছে, কত আল্পনা মেঝেতে।
আশ্বিনের ডাকে

জেগে ওঠে উমা, বাঙালির খুশিতে।



শরৎ যাপন 

অলকানন্দা দে


লক্ষ্মীর ঝাঁপি খুলেছে আকাশআয়না দিঘির জল

কী রং দিলে জুতসই হবে বল না শরৎবল!

মেঘের গায়ে আঁকবো আমি অবাক মনের ছবি

স্বাক্ষর দেবে মেধাবী রৌদ্রবনেদি তারা রবি

বসুন্ধরার খোঁপায় ঘেরা ফোটা শিউলির হার

আলোর নদীতে জীবনযাপন ঘন নীল সংসার

অলস সরস শিশির মেখে মাটির পথে যাব

নদীটার জলে মন ডুবিয়ে একটু উদাস হব!

দুটো হাত ধরে টানাটানি করে শিশু কিশোর কাশ

জীবনরসে ভরে নাও মনথাকি না যে বারোমাস

এই কথা বলে হাসল হঠাৎ বিনিময় করি সুখ

বসুধা বাগানে ফুটেছে শরৎ ভাবনারা উৎসুক

রসদ এনেছে আধার ভরা বিলোবে দাওয়ায় বসে

ধারাবিবরণী করবে বাতাস প্রাণপণ উল্লাসে

লক্ষ্মীমন্ত পূবের লালে শারদীয়া ধরে সুর

সম্মোহনে কবিতা লিখি চোখ পাতি বহুদূর!

সম্প্রসারিত নীলাম্বরে গোধূলি-সন্ধ্যা বেয়ে

আশার কথারা নেমে আসে মনে প্রীতি সরোবরে নেয়ে

মরিয়া আবেগে বায়না করে কানে কানে বলে শোনো

তারায় তারায় জাগ্রত রাতে অথৈ স্বপ্ন বোনো

আবাদ করো অক্রেয় প্রেম দুর্বার অভিমানে

সোনার আভা প্রত্যয় দেবে অমাবস্যার মনে

ঋতুর প্রান্তে অমর শরৎ আত্মজীবনী গড়ে

সাধের পৃথিবী খোলা জানালায় মনঃসংযোগে পড়ে

শ্রেষ্ঠ আমোদে দু-এক চুমুকপরোপকারী বেলা

রোমন্থনে সবুজ প্রহর বছর ভরের চলা!

    

সন্ধে তারা 

পৌলোমী  চক্রবর্তী 

সেই সন্ধের কথা

আজও মনে দেয় নাড়া
পূর্ণিমার দিনে চারিদিক স্তব্ধ
নেই কোনো সাড়া

কি অপরূপ সেই মুহূর্ত
পৃথিবী যে এত  
সুন্দর হতে পারে
ভাবিনি কখনো তাতো

জোৎস্না ভরা আলোরণ
চারিদিকে নেই কোনো মানুষজন
কলকল শব্দে তিস্তা চলেছে বয়ে
দিশেহারা সঙ্গীহীন হয়ে

চাঁদের আলোয় তোমার
সেই মুখখানি দেখে
মনের উদাসতা 
বলছে চোখে

এ যেন  আমার
সেই স্বপ্নে ভরা
প্রথম দেখা
সন্ধে তারা।।



ওগো শরৎ সুন্দরী

বিজয় বর্মন


বর্ষা বিনোদনে আমি ভেসে যাই,

তাথৈ ছন্দ মন গহনে,

ছলাত ছলাত জলের ছোঁয়ায়,

ভাঙ্গন ধরিল মনে।


উদাস দেখি আকাশ পানে,

মেঘেদের ডানা মেলি,

বাতাসের সাথে যাই উড়ে যাই,

প্রান্তহীন প্রান্তরে খেলি।


সুপ্ত বাসনায় শ্যামল ও সুন্দর,

শুকনো কাদায় সুবাসিত প্রাণ,

শিউলির কুঁড়ি উঁকি দিয়ে যায়,

কাশবনে বুঝি করিছো আহ্বান।


আকাশ নীলে মেঘের ছবি আঁকা,

পাতায় ফুলে তোমার আগমন,

জানালায় আমি কান পেতে রই,

বোবা সংলাপে তোমাকে স্মরণ।


বাজিবে ঢাক ঢোল, বাজিবে বাদ্দি,

মায়াজালে আবদ্ধ মহামায়া,

জীবন্ত প্রকৃতি, আমি সঙ্গী হব,

মুছে দিয়ে যেও,মহাকালের ছায়া।



শরৎ -উপাখ্যান

দীপ  মুখার্জি 



ওগো প্রিয়,
হতে পারি আমি তোমার
এই শরতের কাব্যমালা,
হতে পারি তোমার সেই
মনমাতানো নদীর ঢেউ-
হতে পারি আবছা আলোয় 
মায়াবী মুখে দাঁড়িয়ে থাকা
তোমার সেই স্বপ্ন পরী।
হতে পারি তোমার সেই প্রিয়
নীলরঙা পাখি কিংবা হতে পারি
রাগ ইমনের সুর।

প্রিয়তম,
মনে আছে- সেই যে একবার
শেষ ভাদ্রের ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে,
সেই নুতুন ব্রিজের ওপর হাতে হাত রেখে
দাঁড়িয়ে থাকা-আলো আঁধারিতে।
না বলা কত কথা তোমার সেই
চোখের চাউনিতে-
ওগো,তোমার আলিঙ্গন স্পর্শে
দেখা না হওয়া সেই অভিমান গুলো যেনো
শরতের প্রথম কুয়াশা হয়ে নেমে আসলো
চোখ জুড়ে।

প্রাণসখা,
চলো না আবার সেই দুজনে মিলে
হারিয়ে যাই শুভ্র কাশের বনে,
চলো না মেঘনৌকোয় ভেসে যাই দুজনে,
সেই যে মনে আছে না..সন্ধ্যা নামা বিকেলে
শান্ত নদীর ধারে বাঁধের ওপর 
তোমার আলিঙ্গন,কিংবা
সন্ধ্যা আরতি তে ঠাকুর প্রণামের সময়
টুক করে আমার স্নেহচুম্বন-
এটুকু নিয়েই চলো না আবার শুরু করি
নূতুন ভাবে নুতুন রূপে,
নুতুন কাব্যে ভরিয়ে দেই
আমাদের শরৎ উপাখ্যান।।




শরৎ বিশেষ কথা 


রাখিবন্ধন - এক সুখের একতারা 
 চন্দ্রানী চৌধুরী 

সময়ের সাথে সাথে জীবনবৃত্ত  একটু একটু করে ঘুরতে থাকে । আর সেইসাথে হৃদয় নিংরানো নানা অনুভূতি মনের গভীরে জমা হয় । স্মৃতির দেরাজ খুলে সুখের একতারা হাতে আজ ফিরে যাব তেমনই এক আলোর দিনে ।
জীবনের বেশ কিছু বছর আমার একটি ছোট্ট শহরে বাস করার সুযোগ হয়েছিল। সেখানকার মানুষের আন্তরিকতা আজও আমার মনকে নাড়া দেয় । আজ বলব সেই শহরের রাখিবন্ধন  উৎসবের গল্প। 
আমি তখন সেখানে এক বেসরকারী বিদ্যালয়ে শিক্ষিকা  ছিলাম । প্রতি বছর রাখি পূর্ণিমার দিন সেখানে এক অপূর্ব আনন্দমুখর অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হত । সমস্ত ছাত্রছাত্রীরা একে অপরের হাতে রাখি পরিয়ে আনন্দ উৎসব পালন করত। সেইসাথে বিদ্যালয়ের সমস্ত শিক্ষক , শিক্ষিকা ও শিক্ষাকর্মীদের হাতে রাখি  পরিয়ে প্রণাম করত সমস্ত ছাত্রছাত্রীরা । 
রাখি পূর্ণিমার কদিন আগে থেকেই ছাত্রছাত্রীদের গল্পের বিষয়বস্তু থাকত রাখি । কে কেমন রাখি কিনবে তার আলোচনা চলত পরস্পরের সাথে । তারপর সেই বিশেষ দিনে বন্ধুরা সবাই পরস্পরকে পরম উৎসাহে রাখি পরিয়ে দিত । বিদ্যালয়ে ঢুকতে না ঢুকতেই রাখি পরানোর জন্য ওদের  উৎসাহ দেখে এক অদ্ভুত ভালোলাগা তৈরি হত । সবাই নিজের ক্লাসে বসে  সুশৃঙ্খলভাবে একে একে এসে আমাদের রাখি পরিয়ে দিত। এতোজনের রাখি পরে আমাদের সবারই দু হাত ভরে যেত । কি যে আনন্দ হত তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। এই আনন্দ উপভোগ করার জন্য প্রতি বছর সেই বিশেষ দিনটির অপেক্ষায় থাকতাম। 
সেখানকার আরেকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল । ছাত্রছাত্রীরা বিদ্যালয়ের শিক্ষক শিক্ষিকাদের রাখি পরিয়ে বিদ্যালয় থেকে অনুমতি নিয়ে আশেপাশে কোন অফিস থাকলে সেখানে গিয়ে চেনা-অচেনা  সবাইকে রাখি পরিয়ে আসত । এক অপূর্ব পরিবেশ ছিল -রাস্তায় বেরোলেই দেখা যেত সবার হাত ভর্তি রাখি । আনন্দ - হাসি -মজা সবার ঘরে ঘরে । 
দশ বছর হয়ে গেল সেই সুন্দর শহর ছেড়ে চলে এসেছি । তবু মনের মণিকোঠায় সেখানকার রাখি পূর্ণিমা উৎসব জ্বলজ্বল করে । গত বছর থেকে সমস্ত বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে আছে । জানিনা রাখি পূর্ণিমা সেখানে কিভাবে পালন করা হচ্ছে । বুক ভরা আশা নিয়ে আছি জীবনে আর একবার অন্তত পুরোনো বিদ্যালয়ের রাখির উৎসবে যোগদান করে সেই আনন্দের স্বাদ আবারও ফিরে পাব ।



শরৎ ছড়া 

ভাদ্র আসে 
মুনমুন সরকার 

শরতের রঙ মেখে গায়ে 
তাল পাকা গরম নিয়ে 
আকাশ ঝকঝকে সাদা-নীলে
বিলঝিলে ডুবো-ডুবো জলে 
শালুক পাতা জড়িয়ে থাকে 
বাঁশবনে ডাহুকেরা ডাকে 
নদীর চরে ভরা কাশে
শ্রাবণ পেরিয়ে 'ভাদ্র আসে'||


                  মেঘের ভেলায় চড়ে 
                  আকাশ রুদ্রমূর্তি ধরে 
                  বাতাস নিজের মতো চলে 
                  রৌদ্র-বৃষ্টি লুকোচুরি খেলে 
                 কখনও ঝরে অবিশ্রান্ত বর্ষণ 
                 ভরায় সৌন্দর্যপিপাসুদের মন
                 বৃষ্টি ভিজে ঋতুর রানি....
                 এলো বার্তা নিয়ে আগমনী||




ভাদ্র মাসে 
মজনু মিয়া 

ভাদ্র মাসে তাল পাওয়া যায়
তালে -তালের পিঠা,
চিনি, গুড়ের সাথে চাউল
তালে বাড়ায় মিঠা।

তালে কিন্তু রসও হয় খুব
তালের বড়া খেয়ে,
দুধের সাথে মিলিয়ে নেয়
হাতের কাছে পেয়ে।

যত মজাই হোক খেতে তাল
তালে আছে জ্বালা,
তাল তলাতে গেলে পরে 
দিও না চোখে তালা!




ছোটদের শরৎ 


অভ্রদীপ ঘোষ



























অদ্রিজা বোস 





















তানভী দাম






















অন্বেষা সরকার























উৎসব সাহা 


















রাশি সাহা 

























সায়ন ব্রক্ষ্ম
























সুজল সূত্রধর























 মুজনাই অনলাইন ভাদ্র সংখ্যা ১৪২৮