বুনোহাঁসের ডানা
শ্যামলী সেনগুপ্ত
বুনো হাঁসের ডানায় ভর করে 'সে'আসে।কর্কশ রুক্ষ কন্ঠে হাঁক পাড়ে-'সময় হয়েগেছে।চলো,চলো।আর একমুহূর্ত দেরি নয়।তোমার কাল ফুরিয়েছে-এবার কালযাত্রা।'প্রাণটি ছটফটকরে,বেরোতেচায়,সাড়া দিতেচায় বুনো হাঁসের ডাকে।আধার হাত জোড়করে-'যাস নি,দোহাই তোর,এখনি যাসনে।ঐ যে তোর আপনজন,তোর ভালবাসার মানুষজন---ওদের চোখে জল,মুখ বিষণ্ণ,বুকে হাহাকার।বুক চাপড়ে বুনোহাঁস কে ফিরেযেতে বলছে।'
সম্ভবত,হৃদয় বিদারক হাহাকারকে সামান্য মর্যাদা দিয়ে বুনোহাঁস নিজের ডানা খুলে সরিয়ে রাখে একপাশে,কিছুটা বিরতি---যেতে তো হবেই।
'জন্মিলে মরিতে হবে
অমর কে কোথা কবে'
মধুকবি না বললেও এই সারসত্য সকলে জানতো।তাঁর জন্মের আগেও জানতো।তিনি শুধু আমাদের চেতনাকে জাগিয়ে দিয়েছেন।কিন্তু সেই জানা আর এই জানার মধ্যে অনেক বিষাদ,অনেক চোখেরজল,অনেক আশার বিনাশ।
তবু কেউকেউ মৃত্যুকে বড় ভালোবাসে।মৃত্যু যেন শ্যামময় অথবা শ্রীরাধার হাতছানি।পথজুড়ে দাঁড়ানো কালো জটিলতার মুখোমুখি হতে ভয়পায়,আর ভালোবেসে গলায় পরেনেয় ফাঁস,ঠিক যেভাবে কবরীতে জড়ানো থাকে যুঁইএর মালা।মৃত্যুর কাছে সমর্পণ করে নিজেকে।মরেবাঁচতে চায়।
আর,যে সত্যিই বাঁচতে চায়,অথচ তিলে তিলে মৃত্যুদূত তাকে নিয়েচলে যমের দুয়ারে!বছর বছর বোনটি তাকে ফোঁটা পরিয়েছে ভ্রাতৃদ্বিতীয়ায়।ফোঁটা দিতে দিতে বিড়বিড় করে আউড়েছে '---যম দুয়ারে দিলাম কাঁটা--'তবু কি ছাড় পেলো যমযাতনা থেকে!সারা শরীরে হেঁটেবেড়াচ্ছে এক অশান্ত বিছে-লেজ উঁচিয়ে দাপটে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর প্রতি মুহূর্তে হুলটি গেঁথে দেওয়ার ভয় দেখাচ্ছে।কর্কট আক্রান্ত মানুষটি নার্সিংহোমের বিছানায় শুয়ে একইসঙ্গে আত্মীয়জন ও মৃত্যুর অপেক্ষায়---বারেবারে দরজায় চোখ যায়-এই বুঝি এলো!এলো কি কেউ!এক এক করে চেঁছেফেলা হচ্ছে বাড়তি কোষ,ছেঁটে ফেলাহচ্ছে আক্রান্ত প্রত্যঙ্গ--সাদা অ্যাপ্রনের প্রশান্ত মুখের আড়ালে শমনের বিকট ছায়া।মুখব্যাদানকরা সেই ভয়ংকর রূপ কল্পনা করতে
করতে মনেপড়েযায় প্রিয়,প্রিয়তম মানুষের কথা,বাবা-মা ভাইবোন আত্মীয়-বন্ধু জীবনসঙ্গিনীর চিন্তাভারাক্রান্ত মুখের সাদা-কালো ছবি।কোথাও বুনোহাঁস ডেকেওঠে--তবে কি শীত এসেগেলো!ঝরেযাবে সব পাতা!প্রায় ঠুঁটোগাছটির মাথার ওপর দিয়ে পরিযায়ী হাঁসের কর্কশ ডাক আকাশ চিরে ভেসেআসে,বেডের পাশের জানলার দুধসাদা পর্দা সরিয়ে যেন ঢুকেই পড়বে 'সে'।ক্রমশ এগিয়ে আসে শেষদিন,ততোই পা গেঁথেযায় সংসারের আনাচেকানাচে---প্রিয় খাট,নরম কম্বল,আলো ঝলমলে ব্যালকনি,মেলা থেকে কেনা হলুদ গোলাপ আর ফুলেফুলে ছেয়েথাকা মোতিয়া-বেলীর গাছদুটি পিছু টানে।ক্রমশ ফুরোতে থাকে একটা জীবনের গল্প।
[২]
পেরিয়েগেল আরেকটি জন্মদিন।একইসঙ্গে বিজয়া ও জন্মদিনের প্রণাম জানাতেই আমার সেজমামীমা বলে উঠলেন--'আয়ুষ্মতী হও।'আমি মাথা ওঠাই।কী ভাবে!একেকটি জন্মদিন তো আমাদের জীবন রেখাটিকে একবছর ছোট করেদেয়!এগিয়েচলি মৃত্যুর দিকে।তবে এই আশীর্বাদের কী মানে?আসলে জন্মেই তো মৃত্যুর দিকে এগোতেথাকি প্রতি পলে-অনুপলে।পায়েস,কেক,পাঁচভাজা,পোলাউ,মাছ-মাংস এসব তো ছেলেভোলানো ছড়ার মতো।হাঁউমাউ করে যেন ব্যঙ্গ করে--'খায়্যা লও খায়্যা লও,দু'দিন বৈ তো নয়!'
মৃত্যু নিয়ে এই ভাবনা বেশ বিলাসী।পোলাউ খেতে খেতে ভাবছি,মৃত্যুর দিকে একধাপ এগোলাম।সুস্থ শরীরে আত্মীয়জন পরিবৃত হয়ে এসব ভাবনা ভাবতে বেশ ভালোই লাগে!
[৩]
ভালোবাসার চরম উৎকর্ষে পৌঁছে দয়িতা বলেওঠে'আমাকে মেরেফেলো'---সে ও মরতে চায়।এ বড়ো সুখের মরণ!বুনোহাঁসের ডানায় ভর করেআসে ঐ উদ্দাম মরণ।চরম উৎকর্ষে পৌঁছেদেওয়া সেই মৃত্যুই বুনেদেয় একটি জীবনের বীজ-একটি জন্মের প্রস্তুতি।
[৪]
অসুখ থেকে সুখ---সব মৃত্যুতেই বুনো হাঁসের পৌরুষ প্রকট হয়।তার ডানা ঝাপটানোর শব্দে শেষবারের মতো খুলেযায় চোখের পাতা।উদ্ভাসিত হয় কনীনিকা,কিন্তু কেমন যেন উদাসীন,নিষ্প্রাণ,ঘোলাটে,প্রত্নপ্রাচীন সেই দৃষ্টি।
মৃত্যুর দিকে এক পা এগিয়ে ,আশীর্বাদের হাতদুটি মাথায় ছুঁইয়ে জন্মদিনে পাওয়া উপহারের মোড়ক খুলতে থাকি একটি একটি করে আর আনন্দের সঙ্গে বিষাদও বাসা বুনতেথাকে শরীর ও মনে।আমি কান খাড়া করি-পরিযায়ী বুনো হাঁসের ডানার শব্দ শুনতে-----
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~