Tuesday, February 20, 2024


 

ভাষা আন্দোলন সঞ্জয় সাহা প্রতিটি সকাল উজ্জ্বল হতে থাকে এগারটি স্বরবর্ণ! সারা শরীর জুড়ে ছড়িয়ে চল্লিশটি ব্যঞ্জনবর্ণ! পাখির স্বরে শুনতে পাই য-র-ল-ব ভাষার আন্দোলন রফিক-সালাম-জব্বরের বিদ্রোহ অন্তরে আগুন জ্বলে.... রাস্তায় বরকতের রক্ত ! কপালে গুলিবিদ্ধ রফিক! শৃঙ্খলমুক্ত বর্ণমালা..... স্বাধীন আজ মাতৃভাষা।





 

মায়ের ভাষা

মনোমিতা চক্রবর্তী


বাংলা আমার মায়ের ভাষা

বাংলা আমার প্রাণ ।

বাংলা ভাষায় গাই গো মোরা,

বাংলার জয়গান ।


বাংলা আমার প্রাণের ভাষা

আমার অস্তিত্ব ।

বাংলা আমার অবিচ্ছেদ্য অংশ,

জানে এই বিশ্ব।


বাংলা আমার মায়ের ভাষা

আছে আমার এ ভাষায়  বলার অধিকার ।

সহজে ছিনিয়ে নেবে আমার মুখের ভাষা,

এ সাহস কি কারো আছে আর?


বাংলা ভাষা রক্ষার জন্য

যাঁরা সেদিন এগিয়ে এসেছিল

গুলিতে গুলিতে বুক তাদের,

ঝাঁঝরা হয়ে ছিল ।


তাদের জন্যই পেয়েছি আজ

মোদের বাংলা ভাষা,

স্মৃতির মাঝেই আছেন তারা 

মিটিয়ে  সবার আশা।






একুশে ফেব্রুয়ারি

পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় 


বার বার তুমি ফিরে ফিরে আস
একুশে ফেব্রুয়ারি 
চোখে ভেসে ওঠে মৃত্যুমিছিল
আঁকা হয় সারি সারি 
ভাষার সে গান শহীদের দান
আজও হায় শোনা যায় 
রক্ত ঝরানো ফোটা ফুল গুলি 
আসে না তো ফিরে হায়।

সাঁঝের আজানে শঙখ ধ্বনিতে
শুনি মর্মর ধ্বণি 
রফিক সালাম জব্বার ভাই 
মাতৃভাষার মণি 
কেঁপে ওঠে বুক ছুঁয়ে যায় মন
একুশ কে কাছে পেলে 
ভাষার লড়াইয়ে কতগুলো প্রাণ 
অকালে গেল যে চলে।





 

দুয়োরানী

লীনা রায় 


খাপ ছাড়া ভাষাতে

হাতছাড়া শব্দ,

মুখ ভার পদ্যের

বৈরাগী গদ্য।


তোলপাড় তল্লাশি

হয়রানি হদ্দ,

চুরি গেছে শব্দের

রূপ রস গন্ধ।


এক ঝুলি রাজা রানী

সাথে বুড়ো আংলা,

সন্দেশ শুকতারা

লাখপতি বাংলা।


রবিকবি নজরুল

বঙ্কিম সুকুমার,

গরবিনী বাংলা

গুনতিতে রাত পার।


আজ শুধু হাঁসফাঁস

আলসেমি ভাবনার,

বিস্মৃত বলিদান

দুয়োরানী বাংলার।






মর্মে জাগুক একুশ অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী 


বাহা বাহা দেখো আমি কত পারদর্শী! বিদেশীতে ডুব দিতে ছিপে গাঁথি বড়শি.. চুরি করি ভিনদেশী কবিতা ও গল্প, নকলনবীস আমি গানে, সুরেও অল্প.. নিপুণ ছকেতে ফেলি চুরি মহাবিদ্যা, টুকে নিতে অনুবাদে আমি স্বয়ংসিদ্ধা.. এতকিছু করি শুধু খেতাবের জন্য, কলার উঁচিয়ে বলি, 'আমি মহামান্য..' আমার বাড়িতে 'মা'- কে 'মাম্মি' বা 'মম' ডাকি, এটাই আধুনিকতা নাহলে লজ্জা নাকি! কাকিমণি,মাসিমণি সব দূর অস্ত, সুমধুর প্রিয় ডাক 'আন্টি' -তে ন্যস্ত.. ঘুম ভাঙে, রাত হয় সবটাই বিদেশীতে, খাবারেও নানা দেশ অনলাইন আদেশেতে.. বুকশেলফ ঠাসা থাকে বিজাতীয় গ্রন্থে, অতিথির মন কাড়ে 'সম্ভ্রম' মন্ত্রে.. নিজের জাতীয় সাজ সখে সাজি কদাচিৎ, কমফোর্ট জোনে থেকে বিদেশীর হয় জিত.. সাইনবোর্ড ঝলমলে ভিনদেশী হরফে, গোটাটাই ফাঁকি শুধু আমাদের তরফে.. একুশ একুশ করে জুড়ি যত হইচই, স্বার্থবাদীর বোলে একুশের ভাষা কই? ছোট থেকে,গোড়া থেকে ঘষামাজা জারি থাক, নিজের মাতৃভাষা ভালোবাসা ফিরে পাক.. আশার আলোর ফাঁকে সোচ্চার সোনারোদ, আবার জন্ম দিক রফিক,সালাম,বরকত





 

বাংলা ভাষা ও কিছু প্রশ্ন

বিশ্বজিৎ সাহা


বিগত শতকের দুটো উল্লেখ্যযোগ্য ঘটনা বাংলা ভাষাকে বিশ্বদরবারে  পৌঁছে দেয়। প্রথমটি রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি গীতাঞ্জলির প্রকাশ এবং দ্বিতীয়টি  বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে স্বীকৃতি । ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারী ছিল বাংলা ভাষা নিয়ে বাঙালির আবেগের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশের দিন। ভাষার জন্যও প্রাণ দেয়া যায় সেটা গোটা বিশ্ব সেদিন প্রথম প্রত্যক্ষ করেছিল। ফলস্বরূপ ১৯৭১ এ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলা রাষ্ট্রের জন্ম। ১৯৬১ সালে আসামের বরাক উপত্যকায় অসমিয়ার সাথে বাংলা ভাষাকে সরকারি  ভাষার স্বীকৃতি প্রদানের জন্য জোরদার আন্দোলন হয় এবং ১১ জন বাঙালি মৃত্যুবরণ করেন।সেইসব ইতিহাসে ভর করে ইউনেস্কো ১৯৯৯ সালে একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা প্রদান করে।


প্রতি বছর এই দিনটি মহা সমারোহে পালিত হয়।  বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা, আলোচনা সভা, নানান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে শুধু সেদিনই আমরা হয়ে উঠি বাঙালি। আর বছরের বাকি দিনগুলোতে? সত্যি কি বাঙালি বাংলা ভাষার জন্য ভাবিত? বাংলা ভাষার প্রতি সত্যি কি বাঙালি কোনো টান অনুভব করে? বাংলাভাষার প্রতি কি সত্যি কোনো দায়বদ্ধতা বাঙালির দছে? বাংলা ভাষা কী আজ বিপন্ন নয়?


আমরা এমন একটি ভাষায় কথা বলি যে, ভাষার অধিকার নিয়ে সংগ্রামে শহিদ হওয়ার ইতিহাস আছে, আছে বিপুল সাহিত্য ও কাব্যের ভান্ডার, আছে অসংখ্য পত্রপত্রিকা ও পুস্তক প্রকাশনী,আছে নিজস্ব সংস্কৃতি, নিজস্ব কৃষ্টি।


উপনিবেশিক বৈদেশিক অনুপ্রবেশ  শুধু দেশের মাটিতে হয়নি, তার অনুপ্রবেশ ঘটেছে আমাদের সংস্কৃতিতে আমাদের ভাষায়। সেই থেকে ভাষার বিপন্নতা শুরু। একথা অস্বীকার করা যায় না যে, যুগে যুগে বিভিন্ন বিদেশী ভাষা দ্বারা বাংলা ভাষা অনেক সমৃদ্ধ হয়েছে।


আরবী, পার্সি , ফারসি এসব ভাষার প্রভাব বাংলায় প্রত্যক্ষ। কিন্তু ইংরেজি ভাষা শেখা, বলা এবং ব্যবহার করার মধ্যে বাঙালি যে আত্মশ্লাঘা অনুভব করে সেটা মাতৃভাষার ক্ষেত্রে করে না। তাইতো বাংলা বলা বা লেখার সময় তার মাঝে অনাবশ্যক ইংরেজির ব্যবহার আজ সর্বত্র।ইংরেজি অবশ্যই শিখতে হবে, যেহেতু কর্মক্ষেত্রে সর্বত্র তার ব্যাবহার। উচ্চশিক্ষার সমস্ত পুস্তক ইংরেজিতে, সর্বভারতীয় কোনো পরীক্ষা দিতে গেলে ইংরেজিতে আমাদের নখদর্পণে রাখতেই হবে।কিন্তু সাথে মাতৃভাষা নিয়েও কেনো আমরা ভাববো না?


কেন শিক্ষিত বাঙালি যারা উচ্চ শিক্ষার বই লিখছেন তারা বাংলায় লিখবেন না, কেন শুধু মাত্র বাংলা ভাষার একটি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠে না, কেন সরকারি কাজে বাংলা ভাষা ব্যাবহার করা হবে না?


একথা অস্বীকার করার জায়গা নেই যে আমাদের বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলির স্বাস্থ্যের দিন দিন  অবনমন ঘটছে। সাথেই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের সংখ্যা। তাতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু কেন ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোতে বাংলা আবশ্যিক হিসেবে পঠিত হবে না? আসলে বাংলা ভাষায় আমরা কথা তো বলি, কিন্তু বাংলা ভাষা নিয়ে কথা বলি না। কিন্তু অবস্থা সবসময় এমন ছিল না। 


রবীন্দ্রনাথ জীবনস্মৃতি-তে লিখেছিলেন একবার তার বাবার কাছে কোন এক আত্মীয়ের চিঠি এসেছিল। চিঠিটি ছিল ইংরেজিতে লেখা। দেবেন্দ্রনাথ সেই চিঠি তৎক্ষণাৎ সেই  চিঠি লেখকের কাছে ফেরত পাঠিয়েছিলেন। তখন জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি ছিল বাংলা ভাষা চর্চার একটি  পীঠস্থান। বাংলা ভাষা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের পর্যবেক্ষণ, অনুসন্ধান কম ছিল না।তিনি হাত লাগিয়েছিলেন বাংলা ভাষার সংস্কারে, সংকলনে।তখন স্বাধীনতাকামী বাঙালির কাছে বাংলা ভাষাপ্রীতি ও স্বদেশপ্রীতি ছিল সমার্থক।


‘বঙ্গালদেশ’ শব্দটি পাওয়া যায় প্রথম রাজেন্দ্র চোলদেবের (১০১২-১০৪৪ খ্রিস্টাব্দ)  তিরুমলয় পর্বতের তামিল লিপিতে। বঙ্গালদেশের পরিচয় দিতে গিয়ে সেখানে বলা হয়েছে এমন একটি জায়গার কথা যেখানে ঝড়-বৃষ্টির কোন বিরাম নেই। খুব বেশি বৃষ্টি হলে সেখানে জমিতে আল দিতে হয়। সেই আল থেকেই  বঙ্গের অধিবাসীরা একসময় পরিচিত হয় বাঙালি নামে।যে ভূখণ্ডকে আমরা এখন বঙ্গভূমি বলি সেটা অতীতে বিভক্ত ছিল বঙ্গ, হারিখেল, সমতট,পুণ্ড্র, রাঢ়ী , গৌড় ইত্যাদি জায়গায়। পাল (৭৫০-১১৬১) ও সেন (১০৭০-১২৩০) রাজাদের আমলে এটি বৃহত্তর বঙ্গদেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ পায় এবং জন্ম হয় তথাকথিত বাঙালির।


কিন্তু এই হাজার বছরের বাঙালি আজ আত্মবিস্মৃত।ভাষা হল আমাদের মূল, ভাষা  আমাদের চিন্তা ও বোধের ধারক, ভাষা আমাদের অবলম্বন।ভাষা আমাদের চেতনা ও দর্শনের বাহক। ভাষা আসলে একটি অর্জন। কিন্তু ডারউইনের তত্ত্ব ধরে এগোলে বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎকে আঁধারে পথ হাতড়াতে হবে।


আসলে আমরা যে বাঙালি এই বোধটি সর্বপ্রথম জাগ্রত করতে হবে, স্মরণ করতে হবে আমাদের বাংলা ভাষার গৌরবের কথা, স্মরণ করতে হবে ভাষা নিয়ে আমাদের পূর্বসূরিদের  আত্মত্যাগের কথা। নচেৎ আগামীতে বাংলা ভাষা শুধু ইতিহাস হয়ে রয়ে যাবে অন্য কোনো ভাষার বইয়ের পাতায়।






 

পলাশ ভালোবাসা
দেবযানী সেনগুপ্ত

রক্তলাল পলাশ বেদি
 বরকত- রফিক ঘুমিয়ে ওই
 মাতৃভাষার মান বাঁচাতে
 শহিদ আমার হাজার ভাই।
 রক্তে রাঙা একুশ আসে
শাহবাগের শহিদ মিনার
 রক্তঝরা হৃদয় এখন -
পলাশ হয়ে ছড়িয়ে পড়ে!
 ফাগুন -আগুন আলিঙ্গনে
 ঘুমিয়ে আছে আমার ভাই,
 পলাশ ফুলের ভালোবাসা,
 আমরা তোদের ভুলবো না।।






 

সমিয়া সাহা





 আ মরি বাংলা ভাষা

শ্রাবণী সেন পাখির ডাকের মত মিষ্টি আমার বাংলা ভাষা আমার স্বপ্ন, আমার আশা, আমার ভালোবাসা। এই ভাষাতেই লেখেন কবি চর্যাপদের গান বাংলা ভাষার নানান ছবি নানান তুলির টান! জয়দেবের লেখনি লেখে মধুর পদাবলী চন্ডীদাসের ভাষায় মেশে মানবকথার কলি। মধুকবি রচনা করেন কপোতাক্ষের গান দেশের মাটি, মায়ের ভাষা স্নেহের ধারা স্নান। রবিকবি মাথার উপর সূর্য কিরণ প্রায় কবি নজরুল পদ্মার ঢেউ হৃদয় নিয়ে যায়। জীবনানন্দের বাংলার মুখ কোন সে বনলতা আবহমান বাংলার রূপ, বাংলার রূপকথা। বাংলা আমার মায়ের ভাষা, মায়ের স্নেহের ধারা বাংলা ভাষা রত্নখনি, আকাশভরা তারা।





একুশে ফেব্রুয়ারির জন্য

বেলা দে

তমসার ঘোর কাটিয়ে মাতৃভাষা অর্জন এসেছে কতিপয় তাজা প্রাণের বিনিময়ে, মাতৃভাষা বাংলা আমার খোলা জানালা, ফুসফুস ভরা অক্সিজেন, বাস্তব জীবনের প্রয়োজন, জাতির পরিচয়, ইংরেজী ও হিন্দী দুই ভাষার চৌহদ্দিতে ঢুকে আজ-- বাংলাভাষা বিপন্ন। জনগোষ্ঠীর সম্মুখে দাঁড়ানো বিরাটাকায় এক সুড়ঙ্গ।





 মাতৃভাষা

মাথুর দাস মাতৃভাষা মায়ের ভাষা জানি যা এর মধুরতা, বলতে সহজ বুঝতে সহজ মনের মতো করে । আর কি কোনও ভাষায় পাবে এমনতর কথা, যা শুনলে মনে আনন্দেরই ঝর্ণাস্রোত ঝরে ? এই ভাষাতেই হর্ষ বিষাদ নিখাদ ভালোবাসা, আহা কী স্বাদ পাই দুটি কথা মাতৃভাষায় বলে ! গানের কলি কন্ঠ জুড়ে করে যাওয়া আসা, এই ভাষাতেই ভালোবাসার মুক্তোমাণিক জ্বলে । জগৎ জুড়ে হাজারো ভাষা মানুষ অগণন, কত যে ভাষার কথার স্রোত বইছে কত সুরে ! ছাপিয়ে সেসব মাতৃভাষায় আবিষ্ট হয় মন, বাংলা আমার মাতৃভাষা, বাংলা হৃদয় জুড়ে ।




Sunday, February 4, 2024


 

 মু   না  ই 

অনলাইন সাহিত্য পত্রিকা 

মাঘ ১৪৩০ সংখ্যা 


সম্পাদকের কথা 

নতুন বছরের শুরুতে একটি বিশেষ ঘটনাকে কেন্দ্র করে আমরা যেভাবে মেতে উঠলাম, তাতে মনে হচ্ছে এই দেশের সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। কেউ নিরন্ন নেই। কেউ বস্ত্রহীন নয়। প্রত্যেকের মাথার ওপর  ছাদ রয়েছে। বাস্তব ও পরিসংখ্যান অবশ্য অন্য কথা বলছে। কিন্তু সেসব কে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার অথবা অখন্ড মৌনব্রত পালন করবার একটি বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে আমাদের। আমরা মনে করি, সবই সাজানো। আমরা ভেবে নিই একশো শতাংশ কাজ আমরা করে ফেলেছি। আকাশের সীমাকে ছাড়িয়ে গেছি নিজেদের সুকৃতিতে। কিন্তু পাহাড়চূড়ো থেকে সেই যে কালপ্যাঁচা আজও যে অন্নহীন আশ্রয়হীন দুঃখী মানুষের জন্য কেঁদে চলেছে সেটা আমরা শুনতে পাই না। দেখতে পাই না উন্মাদনা আমাদের মানসিকভাবে পিছিয়ে দিচ্ছে। কবে এর থেকে পরিত্রান পাব আমরা কেউ জানে না। আর সেই না জানার সঙ্গে বুঝতে না চাওয়া আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা। আমাদের ট্র্যাজেডি।            



মুজনাই অনলাইন মাঘ  সংখ্যা ১৪৩০

 রেজিস্ট্রেশন নম্বর- S0008775 OF 2019-2020

হসপিটাল রোড 

কোচবিহার 

৭৩৬১০১

ইমেল- mujnaisahityopotrika@gmail.com (মাসিক অনলাইন) 

প্রচ্ছদ- বাবুল মল্লিক 

প্রকাশক- রীনা সাহা    

সম্পাদনা, অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায় 

মুজনাই অনলাইন মাঘ সংখ্যা ১৪৩০



এই সংখ্যা আছেন যাঁরা 


উমেশ শর্মা, চিত্রা পাল, নিতাই দে, শ্রাবণী সেনগুপ্ত, 

বাসব বন্দোপাধ্যায়, গৌতমেন্দু নন্দী, লীনা রায়, 

পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়, মাথুর দাস, উৎপলেন্দু পাল, 

কবিরুল ইসলাম কঙ্ক, উদয় সাহা, স্বপন কুমার দত্ত, 

রথীন পার্থ মণ্ডল, দেবদত্তা বিশ্বাস, দেবর্ষি সরকার, অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী,  

স্বপন কুমার সরকার, রীতা মোদক, আকাশলীনা ঢোল, 

দেবযানী সেনগুপ্ত, দেবদত্তা লাহিড়ী, অলকানন্দা দে, 

সুমন্ত সরকার, আশীষ কুমার বিশ্বাস, বুলবুল দে, 

রেজাউল করিম রোমেল, মজনু মিয়া, মনোমিতা চক্রবর্তী, 

মুহাম্মদ আলম জাহাঙ্গীর, বটু কৃষ্ণ হালদার, প্রিয়াংকা নিয়োগী, 

দেবারতী দে, অহনা সেন, শুভমিতা দেব, বাবুল মল্লিক



মুজনাই অনলাইন মাঘ সংখ্যা 

১৪৩০






শিল্পী- অহনা  সেন 





প্রবন্ধ/ নিবন্ধ 

মাঘোৎসব
শ্রাবণী সেন গুপ্ত

ব্রাহ্ম ধর্মাবলম্বীদের বাৎসরিক উৎসব হল মাঘোৎসব ।প্রতিবছর মাঘ মাসের ১১ তারিখ এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। সপ্তদশ -অষ্টাদশ শতাব্দী জুড়ে সনাতন হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদের যে অন্ধ আচার সর্বস্বতা ,কুসংস্কার, সংকীর্ণতা ,তার থেকে মুক্তি খুঁজতে পৌত্তলিকতার বিপ্রতীপে নিরাকার ব্রম্ভের সাধনার উদ্দেশ্যে ২০ আগস্ট ১৮২৮,রাম কমল বোসের বাড়িতে রাজা রামমোহন রায় তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে মিলে প্রতিষ্ঠা করলেন ব্রাহ্মসভা । প্রতিষ্ঠার প্রায় দুই বছর পর 1830 খ্রিস্টাব্দের ৩০ শে জানুয়ারি ১১ই মাঘ রাজা রামমোহন রায়ের উৎসাহে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে একটি অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে ব্রাহ্মসমাজ এর ঘোষণা করা হয়, পরে এই বিশেষ দিনকে ব্রাহ্ম ধর্মাবলম্বীরা মহোৎসব হিসেবে পালন করতে শুরু করেন। বেদ উপনিষদ থেকে পাঠ ও উপাসনা, রাজা রামমোহন রায় কেশবচন্দ্র সেন ,মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখের রচিত ব্রহ্ম সংগীতের সুগম্ভীর সুরমূর্ছনায় এই দিনটি উদযাপিত হয়। 
কলকাতায় যা এখন ব্রাহ্ম ধর্মের প্রধান কেন্দ্র -যেমন সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ ,নববিধান ব্রাহ্মসমাজ, ব্রাহ্ম সম্মিলন সমাজ এ সপ্তাহব্যাপী এই উৎসব উদযাপন করা হয়। ১১ই মাঘ জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে একটি বিশেষ সভা অনুষ্ঠিত হয় ,তাতে সংগীত পরিবেশন করেন প্রয়াত ও সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত সংগীত গোষ্ঠী বৈতানিক। ভারতের অন্যান্য সমাজ এবং গ্রাম্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, শান্তিনিকেতনেও এই মহোৎসব পালিত হয়। 
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯২২ সালে শ্রীনিকেতনে কুঠি বাড়িতে গ্রাম পুনর্গঠন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন ।এই দিনটিকে উদযাপন করতে শ্রীনিকেতন প্রাঙ্গণে প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হয় মাঘোৎসব। রবি ঠাকুর চেয়েছিলেন কর্মমুখী শিক্ষার প্রচলন করতে,  পড়ুয়াদের হাতে-কলমে শিক্ষা দিয়ে তাদের স্বনির্ভর করার উদ্দেশ্যে তিনি কর্মমুখী শিক্ষা ব্যবস্থার উদ্যোগ নিয়েছিলেন ।নিজের গ্রাম এবং অন্যান্য পাশাপাশি অঞ্চলের বাসিন্দাদেরও এই কাজে অংশগ্রহণ করিয়ে প্রশিক্ষণ দেবার কথা তিনি ভেবেছিলেন ।বিভিন্ন হস্তশিল্প ,কৃষি শিল্প সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ ও প্রদর্শনী ঘিরেই তখন অনুষ্ঠিত হতো মাঘোৎসব।তারপর থেকেই মাঘোৎসবে এইপ্রদর্শনে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে ।কবিগুরুর উদ্যোগে সেই সময় গ্রামে তৈরি হয়েছিল ব্রতীদল।সেই দল থেকে শ্রীনিকেতন এলাকার বিভিন্ন গ্রামে একজন করে ব্রতী নায়ক ও নায়িকা নির্বাচিত হতো। তারা গ্রামবাসীদের খালি হাতে ব্যায়াম অভ্যাস করাতো। মাঘোৎসবের প্রথম দিনে এই ব্রতী দলের মেয়েরা প্রদর্শনী করে থাকে। মাঘোৎসব এর সূচনা প্রদীপ  প্রজ্জলন বৈদিক মন্ত্র পাঠ রবীন্দ্রসংগীত বিভাগীয় প্রতিবেদন পাঠ এর মধ্যে দিয়ে হয়। এই উৎসবে প্রদর্শনীর জন্য আসে নানা ধরনের কৃষি শিল্প। এছাড়া পড়ুয়ারা নিজেদের নানান হাতের কাজ দিয়ে চল গুলি সাজিয়ে তোলে। মেলার দ্বিতীয় দিনে সাধারণত আতশবাজি উৎসব অনুষ্ঠিত হয় ।
     মাঘোৎসবের উল্লেখযোগ্য স্মৃতিচারণ পাই ঠাকুরবাড়ির কন্যা সরলা দেবী চৌধুরানীর কলমে -"11ই মাঘের উৎসব ছিল উপাসনা ও সঙ্গীত প্রধান। সেকালের ১১ই মাঘের বেদীতে উপবিষ্ট হতেন তিন জন আচার্য। কখনো কখনো দ্বিজেন্দ্রনাথ বা সত্যেন্দ্রনাথও একজন আচার্য হতেন। তাঁদের সমবেত কন্ঠে বিশুদ্ধ সংস্কৃত উচ্চারণের ধ্বনিতে কর্ণ তৃপ্ত হত।ভক্ত দর্শকে অর্ধেক উঠান ভরে যেত ,বাকি অর্ধেক আগন্তুক আসত সংগীতের মোহে ।এমন বেদ মন্ত্র ধ্বনিও বাংলায় কেউ কোথাও শোনেনি,আর এমন গুরু গম্ভীর অথচ সুমধুর সংগীত রসে প্লাবিত হয়নি বাংলার অঙ্গন। বিশেষত রবীন্দ্রনাথ যখন তাঁর ভ্রাতাদের সহ ১১ই মাঘের সঙ্গীতের আসরে নামলেন তখন ব্রম্ভের উপাসনায় হৃদয়ের কোণে কোণে যেখানে যত নদী খাল বিল শুকনো ছিল সব ভরে উঠলো।
 'যখন ছোট ছিলাম '-এ পাই ব্রাহ্মদের মাঘোৎসবে হিন্দু পূজার মত হইহললা
 নেই, কেবল ব্রম্ভ উপাসনা আর ভগবানের বিষয়ে গান শোনা। একটি ব্রম্ভ উপাসনা মানে দেড় থেকে দু'ঘণ্টা।ব্রাহ্ম মন্দির একটি ভবানীপুরেও আছে আর সেখানেও মাঘোৎসব হয়। কিন্তু আমরা যখন গড়পাড় ছেড়ে ভবানীপুরে চলে আসি তখনও ১১ই মাঘের বড় উৎসবের দিন আমরা কর্ণওয়ালিস স্ট্রিট এর ব্রাহ্ম মন্দিরেই যেতাম। ওই পাড়াটাকেই বলতো সমাজ পাড়া। শীতকালে ভোর সাড়ে চারটেয় উঠে স্নান করে যেতে হতো। প্রথমে হতো ঘন্টাখানেক ব্রহ্ম কীর্তন তারপর ঘন্টা আড়াই গান ও উপাসনা। শুধু তিনটে দিন আমাদের একটু আমোদ হতো। সেটা হল একটা বিশেষ দিনে উপাসনার পর খিচুড়ি খাওয়া ,একটা দিন পিকনিক ,আর একটা দিন বালক বালিকা সম্মেলন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর  মাঘোৎসব উপলক্ষে লিখেছেন -"আমি বলছি আমাদের এই উৎসব মানব সমাজের উৎসব ।এ কথা যদি সম্পূর্ণ প্রত্যয়ের সঙ্গে আজ না বলতে পারি ,তাহলে চিত্তের সংকোচ দূর হবে না ,তাহলে এই উৎসবের ঐশ্বর্য ভান্ডার আমাদের কাছে সম্পূর্ণ মুক্ত হবে না। আমরা ঠিক জেনে যাবনা কিসের যজ্ঞে আমরা আহূত হয়েছি। আমাদের এই উৎসবকে ব্রহ্মোৎসব বলব কিন্তু ব্রাহ্মোৎসব বলবো না ।যিনি সত্যম্ তাঁর আলোকে এই উৎসবকে সমস্ত পৃথিবী আজ প্রসারিত করে দেখব; আমাদের এই প্রাঙ্গণ আজ পৃথিবীর মহাপ্রাঙ্গন; এর ক্ষুদ্রতা নেই। "





সামাজিক আন্দোলনে জলপাইগুড়ির নারীরা            
 উমেশ শর্মা

নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে কিছু বলবার আগে মনে হয় মানুষের ক্ষমতায়ন নিয়ে কিছু বলা দরকার। খ্রিস্টের জন্মের আগে গ্রিস দেশে করিন্থ নগরীতে ডায়োজিনিস নামে এক দার্শনিক ছিলেন। তিনি দিনের বেলায় লন্ঠন জ্বালিয়ে সৎ মানুষ খুঁজতেন। কুকুরদের সঙ্গে একত্রে খাবার খেতেন। এভাবে আদারে বাদারে ঘুরতে দেখে লোকেরা জিজ্ঞেস করত,, আপনার ভয় করে না? উত্তরের তিনি বলতেন, তিনি কাউকে ভয় পান না। কথাটা নেপোলিয়নের কানে পৌঁছায়।একদিন তিনি ডায়োজিনিসের সামনে হাজির হয়ে বলেন, 'আমি  আপনার কী উপকার করতে পারি?' নির্ভীক দার্শনিক বললেন, 'একটু সরে দাঁড়ান। আপনার ছায়ায় রোদটা আমার গায়ে লাগছে না।'

       নেপোলিয়নের মতো ক্ষমতাশালীকে স্পর্ধা দেখাতে পারেন একজন সাধারন মানুষ। তিনি সেই  ক্ষমতা অর্জন করেছিলেন। জলপাইগুড়ি জেলা গঠনকালে জলপাইগুড়ি  জেলাতে বেশ কয়েকজন ব্রাহ্ম ও ব্রাহ্মিকা ছিলেন। আমাদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে যামিনী মোহন চন্দ ও হেমপ্রভা দেবীকে আমরা উল্লেখ করছি।

 হেমপ্রভা দেবী রক্ষণশীল হিন্দু সমাজে একটা আলোড়ন তুলেছিলেন। তিনি জুতো পরতেন, সেমিজ পরতেন এবং প্রয়োজনে ইংরেজিতে কথা বলতেন। একটা অনগ্রসর জেলায় তাঁর এই স্পর্ধা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ঢাকা থেকে জালাল মিঞা এবং প্যারী বিবি নামে জাতে মুসলমান ও ধর্মে ব্রাহ্ম দম্পতিটির ঢাকায় প্রাণ সংশয় হয়ে উঠেছিল। জলপাইগুড়িতে তখন ম্যাজিস্ট্রেট ভগবানচন্দ্র বসু এবং কমিশনার ব্যাকেট সাহেব । এঁনারা  ওই দুই  দম্পতিকে জলপাইগুড়িতে এনে আশ্রয় দেন। একটি অনগ্রসর জেলায় শুরু হয় শিক্ষা আন্দোলন। প্রতিষ্ঠা হয় বালিকাদের জন্য প্রথম বিদ্যালয়, যা আজ সুনীতি বালা বালিকা বিদ্যালয় নামে পরিচিত। সেখানকার শিক্ষিকা হন প্যারী বিবি। ব্রাহ্মসমাজের এই সুফল ভোগ করছেন  গোটা  জলপাইগুড়িবাসী ।
       এভাবেই শেকল ভাঙ্গার গান শুনিয়েছিলেন আমাদের প্রতিবেশী জেলা রংপুরের পায়রাবন্দ জমিদার বাড়ির কন্যা বেগম রোকেয়া।   স্ব প্রচেষ্টায়  ভাষাচর্চায়  তিনি নারী পুরুষের সমকক্ষতা, সামাজিক স্বাবলম্বিতা, নারী শিক্ষা প্রসারে হয়ে উঠেছিলেন অগ্রণী। তিনি  গড়ে তুলেছিলেন এক সামাজিক আন্দোলন।

       জেলার স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ইতিহাস অনুসন্ধান করতে গিয়ে নিভাননী দেবীর কাপড় কাচা বালতিতে করে রিভলভার সরানোর ইতিহাস কিংবা সুভাষিনী ঘোষের অবদান জানতে পেরেছি। সমাজ সংস্কারে, শিক্ষা বিস্তারে ও স্বাস্থ্যপরিসেবা প্রদানে রানী অশ্রুমতি দেবীর ভূমিকা স্মরণীয়। অরুণা দাশগুপ্তা স্থাপন করেছিলেন শিশু নিকেতন বিদ্যালয়। লেডি ডাক্তার অশ্রুকণা দাশগুপ্তা প্রসূতি চিকিৎসায় দিগন্ত প্রসার ঘটিয়েছিলেন। নীরবে গড়ে উঠতে থাকে একটি সামাজিক চেতনা।
       স্বাধীনতা সংগ্রামে তেভাগা আন্দোলন একটি বড় সামাজিক বিপ্লব। কলকাতার কলেজের পড়া ছেড়ে দিয়ে বোদা পচাগড়ে ভাগচাষীদের তেভাগা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন কল্যাণী দাশগুপ্তা। পুর্ণেশ্বরী বর্মন,মাকিরী,বিদ্যা প্রভৃতি বহু রাজবংশী রমণী তাঁর সঙ্গে হয়েছিলেন একাত্ম। তোলা গাণ্ডী আদায় তেমনি একটি আন্দোলন। ১৯৩৫ সালে দিনাজপুরে প্রাদেশিক কংগ্রেসের সম্মেলনে কংগ্রেসের সোসালিস্ট গ্রুপ নিজেদের পৃথক করার চেষ্টা করলেও সেটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে ১৯৩৮ সালে জলপাইগুড়ি জেলার বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনে। তেভাগা আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে। চালসার গয়ানাথ জোতদারের খোলানেই পুলিশের গুলিতে নিহত হন একজন অজ্ঞাত নামা কৃষক রমণী সহ বুধনী, রাউতি এতোয়ারি ওঁরাও এর মত চা শ্রমিক কন্যারা । তেতাল্লিশের আকালে খাদ্যের দাবিতে গড়ে ওঠে আত্মরক্ষা সমিতি। খাদ্যের দাবিতে মাঠে নামেন মহিলারা।
        দেশভাগ,খাদ্য আন্দোলন, নকশাল আন্দোলন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত মহিলারা প্রতিবাদী হলেও এদের কথা অনেকটাই অজানা ।সাহিত্যে সমরেশ মজুমদারের মতো লেখকদের লেখায় সেসবের ছায়াপাত ঘটেছে। মরিচঝাঁপিতে ছিন্নমূল মানুষদের উপর গুলি চালনায় মানুষ প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে ফেলেছিল। সিঙ্গুর নন্দীগ্রামে যে গণআন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন তার সুফল ভোগ করছেন আজকের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নন্দীগ্রামে গণহত্যায় নিহত সন্তানের মাতা ফিরোজা বিবিও এসেছিলেন ক্ষমতার অলিন্দে।
      এসব আন্দোলনের ছায়াপাত ঘটেছিল জলপাইগুড়িতেও । বীরপাড়ার এক ইট ভাটায় কাজ করতে করতে কাঁদছিলেন কোন আদিবাসী তরুণী। সেদিন তার বিয়ে, কিন্তু বর পছন্দ নয়। স্বাধীনতা সংগ্রামী ইটভাটার মালিক জিজ্ঞেস করলেন, 'কেমন বর তোমার পছন্দ?' উত্তরে মেয়েটি বলল, 'তোমার মতো।' মেয়ের বাবাকে ডেকে এনে ওই মেয়েটিকে বিয়ে করেন বাঙালিবাবু।ঐ সোনামনি পাল  লেখাপড়া শিখে পরবর্তী জীবনে স্বনামে হন পরিচিতা।




কত অজানারে 


ফিরিঙ্গি বিপ্লবী
বাসব বন্দ্যোপাধ্যায়



১৯৪২ সালের ৮ আগস্ট গোয়ালিয়ার ট্যাঙ্ক ময়দানে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে গর্জে উঠেছিল আসমুদ্র হিমাচল। "করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে" বজ্রনাদে উত্তাল হয়ে ওঠে ভারতবাসী। আইন অমান্য আন্দোলনের সাথে শুরু হয়েছিল ভারত ছাড়ো আন্দোলন। বিক্ষোভের তান্ডব বেঙ্গলে (বঙ্গে) চূড়ান্ত পর্যায়ে দাঁড়ায়। পরিস্থিতি সামলাতে হিমশিম খেতে হয়েছিল ব্রিটিশ সৈনিকদের। সেই সমসাময়িক চট্টগ্রামের উত্তর-পূর্বে চল্লিশ মাইল দূরে কর্ণফুলী নদীর ধারে শাপলাফুলী গ্রামে থাকতেন গৌরীদেবী। গ্রামের পূর্বপাড়ায় বারোটি লাগোয়া ঘর। বিপ্লবী রাধানাথ মজুমদার তেরোবছর আগে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের পরবর্তীকালে, পুলিশের নির্মম হানায় শহীদ হয়েছিলেন। তারপর থেকে বিধবা গৌরীদেবী একাই থাকতেন।

সেইরাতে বজ্রবিদ্যুৎ সহ প্রবল বর্ষণ । উঠোনের উল্টোদিকে ঘরের মধ্যে একটা বেশ জোরে শব্দ হলো। গৌরীদেবী জানালা খুলে বারদুয়েক "কে-কে" আওয়াজ করলেন কিন্তু কোনো উত্তর এলোনা।
আধঘন্টা বাদে একসাথে অনেক ভারী বুটের শব্দ। ইংরেজের পুলিশ দোরগোড়ায় এসে ডাকলো।
-"একজন অপরাধী পালিয়ে এসেছে, আমরা তাকে খুঁজছি।"
গৌরীদেবী প্রচন্ড রেগে উত্তর দিলেন,"তোমরা নিজের দেশবাসী কে বিপ্লবী বলে ডাকতে পারোনা? অপরাধী আবার কি? এখানে কেউ আসেনি!"
মুখের ওপর সজোরে জানালা বন্ধ করে দিলেন, সিপাহীরা চলে গেলো।
রাতে উৎকন্ঠায় ঘুম এলোনা। উনি নিশ্চিত যে শব্দটা ঠিকই শুনেছিলেন।

নির্ভয়া গৌরীদেবী প্রত্যক্ষভাবে না পারলেও গোপনে বিপ্লবীদের সাহায্য করতেন। বিপ্লবীরা প্রায়ই এসে অস্ত্রশস্ত্র লুকিয়ে রেখে যেত। আবার কখনো কাজী নজরুল ইসলামের "ধূমকেতু" পত্রিকার প্রতিলিপি বা অন্যান্য স্থানীয় বিপ্লবী কার্যকলাপের খবর দিয়ে যেত । সেইসব দেশপ্রেমের কাহিনী পড়ে উদ্দীপনায় তিনি শিহরিত হয়ে উঠতেন।

ভোরের আলো ফুটতেই বাইরের ঘরে উঁকি মারলেন। কয়েকটা কাঠের পাটাতন বিক্ষিপ্তভাবে মাটিতে পড়ে ছিল। পাশের গাদা করা বস্তাগুলোর নিচে মনেহলো কেউ লুকিয়ে আছে।
-"কে? বেরিয়ে এস, ভয় নেই।"
বয়েস কুড়ি-বাইশের দীর্ঘকায় ফর্সা এক রুগ্ন যুবক হাতজোর করে বের হলো। ভর্তি চুল-দাড়ি। মলিন পরিধান। ভয়ে মাথা নিচু করেই দাঁড়িয়ে রইল।
-"কে তুমি?"  
-"আজ্ঞে আমি তপন দাশ,চট্টগ্রাম থেকে আসছি।
-"পেছনে ওই ফেউ গুলো কেন লেগেছে?"
সে কোনো উত্তর দিলোনা। কিছুতেই গৌরীদেবীর সাথে চোখে চোখ মেলাচ্ছিলোনা।  
গৌরীদেবী বুঝতে পারলেন বেচারা সারারাত অভুক্ত। বললেন "যাও পুকুরে ডুব দিয়ে এসো। গাঁয়ের কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবে স্বর্গীয় মজুমদার বাবুর দূরসম্পর্কের ভাগ্নে। ত্রিপুরা থেকে এসেছো।"
সে মাথা নিচু করেই সায় দিলো।
ঘন্টাখানিক বাদে তপন এসে হাজির। গৌরীদেবী একটা পুরোনো ধুতি ছুড়ে দিয়ে বললেন, "নোংরা কাপড় ছেড়ে রাখো,পরে আমি ধুয়ে দেব। ধুতিটা পড়ে আগে একটু ভাত খেয়ে নাও।"
তপনের গোগ্রাসে গেলার ধরণ দেখেই বুঝলেন হয়তো গতকাল সারাদিনে পেটে কিছু পড়েনি। প্রাতঃরাশের পর্ব  শেষ হতেই কথোপকথন শুরু করলেন। তপন নিজে থেকে কোনো কথাই বলতে চায়না। এমনকি মাথা নিচু করেই থাকে। গৌরীদেবী অনবরত বড়শি মেরেই চলেছেন।
-"বাবার নাম কি? কি করেন?"
-"বাবা-মা নেই, কাকার কাছে মানুষ।"
-"উনি কি করেন?"
তপন কিছুক্ষন চুপ করে রইল,"সরকারি মুহুরী"
-"তুমি যে বিপ্লবী, তা তোমার কাকা জানেন?"
তপন হঠাৎ কেঁদে ফেলল,"আ-আমি বিপ্লবী নই, দেশদ্রোহী নই, কিচ্ছু নই!"
গৌরীদেবী বুঝলেন বেচারার কিছু একটা গোপন দুঃখ আছে, খোলাখুলি ভাবে বলতে চাইছেনা।
বললেন,"দুঃখ পেওনা বাছা।"
বলেই নিজের কাজে লেগে গেলেন।


বাড়ির পেছনে, তিনবিঘা জমি, শাক সবজি, ফলমূলের গাছে ভর্তি। গৌরীদেবী একাএকাই যতটা পারতেন করতেন। এবার তপন হাত মিলিয়ে কাজে লেগে গেলো। সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে মাসছয়েকের মধ্যেই বাগানের চেহারাই পাল্টে দিলো তপন। সহৃদয়া গৌরীদেবী'র ভীষণ মায়া পড়ে গেলো। এমনকি প্রতিবেশীরাও তপনকে খুব ভালোবাসতো । কিন্তু তপনের একটাই সমস্যা, প্রশ্ন না করলে তপন কোনো কথাই  বলেনা, এমনকি মুখ তুলেও চায়না।

"তুমি কথা বলোনা কেন? খারাপ ভালো সব কথা মনখুলে বলতে হয় বাবা।" গৌরীদেবী স্নেহের স্বরে বললেন।
তার মাথা নিচেই রইলো,"না। তেমন কোনো কথা নেই, তাই বলিনা।"


এর পরের ঘটনার জন্য গৌরীদেবী একদম প্রস্তুত ছিলেন না।

একদিন তপন বারান্দায় বসে ঘাসের আঁটি বাঁধছিল। বাঁশের বাতার মাঝে ধারার বেড়া'র ফাঁক দিয়ে রান্নাঘর থেকে গৌরীদেবী যে তাকে মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করছেন তা তপন কিন্তু বুঝতে পারেনি। গৌরীদেবী এই প্রথম তপনের মুখটা খুব কাছের থেকে স্পষ্ট ভাবে দেখলেন। অন্যথায় সারাক্ষন তপন মাথা নিচু করেই  থাকে, অদ্যাবধি চোখে চোখ কখনো মেলায় নি।
তপনের চোখের দিকে তাকিয়েই গৌরীদেবীর বুক কেঁপে উঠলো। বিক্ষিপ্ত চুলদাঁড়ির মাঝেও বোঝা গেলো তার অতিরিক্ত ফর্সা গায়ের রং। ইংরেজদের মতো ফ্যাকাশে গোলাপি। হালকা সবুজাভ রঙের চোখের মনি। ও কোনোমতেই ভারতবাসী নয়। নির্ঘাৎ ফিরিঙ্গি !
শক্ত হাতে খোলা বঁটি নিয়ে বারান্দায় বেরিয়ে এলেন। তারপর সজোরে চিৎকার করে বললেন,"কে তুমি?

তপন কয়েক মিনিট বাকরুদ্ধ হয়েই ছিল। তারপর গৌরীদেবী'র দিকে প্রথম চোখে চোখ মিলিয়ে তাকালো। বহুকাল ধরে চেপে রাখা গোপন দুঃখের কাহিনী চোখের জলের সাথে উপচে ফেললো।

-"আমার বাবা ত্রিলোচনচন্দ্র দাশ, ব্রিটিশ সরকারের অধীনে প্রশিক্ষন নিতে ইংল্যান্ড গিয়েছিলেন। ফিরেছিলেন বিদেশিনী স্ত্রীর সাথে, যিনি আমার মা। দুর্ভাগ্যবশতঃ আমার জন্মের তিনমাসের মধ্যেই মাতৃবিয়োগ হয়। বাবা আমাকে কাকা কাকিমার কাছে চট্টগ্রামে পাঠিয়ে দেন। তারপর আমার বাবাও এক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান।
আমার বন্ধুবান্ধবীরা বিপ্লবী মনস্ক ছিল ও ব্রিটিশ বিরোধী ছিল। আমি ওদের মতোই হতে চেয়েছিলাম কিন্তু ওরা কেউ আমাকে মন থেকে সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাস করতনা, শুধু শিউলি ছাড়া। আমি শিউলিকে খুব ভালোবাসতাম কিন্তু কোনোদিনও প্রকাশ করতে পারিনি। গত মাসে শিউলির বিয়ে হয়ে চলে গেছে।"
তপন চোখের জল মুছে নিয়ে আবার বলতে শুরু করল।
 
-"আমার কাকা আমাকে জোর করেই সিপাহী'র দলে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। আমি ব্রিটিশের অধীনে চাকরি করতে একদম রাজি ছিলাম না। লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করতাম। চুল দাড়ি কাটতাম না। প্রখর রোদে কাজ করে শ্যামলা হবার চেষ্টা করতাম। সেদিন আমি চট্টগ্রাম থেকে বাসে উঠে পালিয়ে যাচ্ছিলাম। পেছনে পুলিশ লেগেছিলো তাই মাঝরাস্তায় নেমে এইদিকে পালিয়ে এসেছিলাম আর ওই বাইরের ফাঁকা ঘর দেখে ঢুকে পড়েছিলাম।"

তপন হাউহাউ করে কাঁদছিলো। যেন চোখের জলের বাঁধ ভেঙেছে। গৌরীদেবী স্নেহবশতঃ তার মাথায় হাত রেখে নিজেও ভীষণ দুঃখী ও অনুতপ্ত হয়ে পড়লেন। গৌরীদেবী বিপ্লবী বলরাম সেন কে ডেকে পাঠালেন। তারপর সব খুলে বলতেই বলরাম উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলো। আবেগে আপ্লুত হয়ে সে তপনকে বুকে জড়িয়ে ধরে, নিজের বৃদ্ধাঙ্গুল কেটে তপনের মাথায় রক্ততিলক পড়িয়ে দিলো।
বুক ভরে নিশ্বাস নিলো তপন। মাটিতে কপাল ঠেকিয়ে গৌরীদেবীকে প্রণাম করে আবেগে আবিষ্ট হয়ে বলে উঠলো, " আমি মনে বিশ্বাস ছিল আমার এই মাটিতেই জন্ম। কেউ একদিন আমাকে চিনতে পারবে। যে আমি ভারতবাসী।”


বিপ্লবীদের গোপন পরিকল্পনা অনুযায়ী, তপনকে আবার চট্টগ্রামে সেই কাকার বাড়িতেই ফেরানো হলো, ইংরেজ সরকারের সিপাহী'র চাকরি করতে। বিদেশী চেহারার সুবাদে তপনের ব্রিটিশদের গোপন ক্লাবে যাবার অনুমতি ছিল। মাস ছয়েকের মধ্যেই “ট্যাপনড্যাশ” ইংরেজ সৈন্যের গুরুত্তপূর্ণ পদে বহাল হলো। তপন শহরে এসে বিপ্লবী সাথীদের সাথে চোখের ও হাতের ইশারায় কথা বলতো। খুব জরুরী খবর থাকলে কাগজে লিখে গোপনে চিঠি চালাচালি চলতো।

এক কুখ্যাত ইংরেজ সেনা'র অফিসার মাইক স্ক্রোভার কে হত্যার পরিকল্পনা চলছিল। কাজটা এত সহজ ছিলোনা কেননা মাইকের রক্ষীরা সর্বদা সজাগ ছিল। উপরন্তু ইংরেজ পুলিশের কাছে আগে থেকেই মাইকের ওপর হামলার পূর্বাভাস ছিল। বিপ্লবী "ট্যাপনড্যাশ" ও অনেক চেষ্টা করে মাইকের সাথে বন্ধুত্ত পাতাতে পারেনি।

প্রলয়ঙ্কর এক ঝড়বাদলের রাতেই মাইককে আক্রমণের তাৎক্ষণিক পরিকল্পনা হয়েছিল। বর্ষাধারার তালে মাতাল হবার পারদর্শী ছিল আমাদের বঙ্গসন্তানেরা। আঁধার ঘনিয়ে আসতেই বিপ্লবীরা একদম প্রস্তুত। তপনের কাজ ছিল শুধু মাইককে রাস্তায় বের করা। তপন নৈশক্লাবের নর্তকীর মাধ্যমে মাইক কে খবর পাঠালো ক্লাবে আসতে। তারপর অধৈর্য তপনও বৃষ্টি-বাদল উপেক্ষা করে ছুটলো ওই নির্ধারিত রণক্ষেত্রে।

মাইকের গাড়ি নজরে আসামাত্রই বিপ্লবীরা দুটো ষাড়কে খুঁচিয়ে উত্ত্যক্তকরে একদম রাস্তায় নিয়ে ছাড়লো। সময় নির্ধারণের হিসাবে কয়েক মুহূর্তের পার্থক্য হওয়ায় সোজা ধাক্কা লাগলোনা। মাইকের গাড়ির দুটো ঘোড়া দুই পা তুলে দিয়ে ভয়ে চিৎকার করতেই দেহরক্ষীরা লাফিয়ে নেমে মাইককে ঘিরে দাঁড়ালো।

মুখোমুখি আক্রমণের জন্য প্রস্তুত সশস্ত্র রক্ষীদের মোকাবিলা করাটা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ নয়। কিন্তু রাস্তার ধারে জঙ্গলে লুকিয়ে থাকা বাইশ জন বিপ্লবীর মনে উদ্দীপনার ফুটন্ত রক্তের উত্তাপ আর অদম্য সাহসের প্রভাব ছিল অনেক বেশি। বর্ষার শীতল জলধারাও সেই উত্তাপ উপশমে অক্ষম।
প্রথম আটজন বিপ্লবী গুলির আঘাতে লুটিয়ে পড়লেও দ্বিতীয় দফা গুলি চালানোর সুযোগ ব্রিটিশ রক্ষীরা পায়নি। বাকি চোদ্দজন বিপ্লবীর অদম্য সাহস আর আক্রোশের প্রতাপ দেখেই মাইক পালাবার উপক্রম করেছিল। ততক্ষনে তপন এসে পড়ে মাইকের মুখোমুখি। পরস্পরকে গুলি চালিয়ে দুজনেই লুটিয়ে পড়ে।

আটজন দেশদ্রোহী পুলিশের ও এগারোজন শহীদ বিপ্লবীর মৃতদেহর মধ্যেই ছিল বিপ্লবী "ট্যাপনড্যাশের" নিথর দেহ, উপুড় হয়ে দেশের মাটিকে জড়িয়ে ধরে। আহত মাইক পালিয়ে গেলেও পরে হাসপাতালে মারা যায়।  

সেইরাতে দেশের আকাশ অঝোরে কেঁদেছিলো। শহীদ বিপ্লবীদের বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, ওদের রক্ত ধুয়ে, দেশের মাটিতে মিশিয়ে, ভাসিয়ে দিয়ে তুলেছিল মেঘমল্লারের অন্য কোনো বেদনার সুর।









শিল্পী- শুভমিতা দেব 





কবিতা (প্রথম পর্যায়)

 

নতুন দিনের ছবি 
গৌতমেন্দু নন্দী 

ইচ্ছে হল রং তুলিতে নতুন বছর আঁকি
নদী, পাহাড়, আকাশ,বন নতুন রংয়েই ঢাকি।

সবুজ,নীলের গাঢ় রংয়ে রঙিন হল ক্যানভাস
নদী,পাহাড়,বন, আকাশে ফুটল নতুন উদ্ভাস।
   
উড়ে এল নতুন পাখি সবুজ গাছের ডালে
রং তুলিতে আরও পাখি নাচল তালে তালে।

লাল, হলুদে উঠল ফুটে নতুন দিনের আলো
মন থেকে সব মুছে গেল আঁধার দিনের কালো। 

রংয়ে রংয়ে রঙিন হল আমার হাতের ক্যানভাস
রং তুলিতেই উঠল ফুটে নতুন দিনের পূর্ণাভাস।





একটি সন্ধ্যার গল্প
             লীনা রায়

পাট ভাঙা সোনা রোদ
ঝুপ করে হারিয়ে,
শীত শীত দুপুরটা
সাঁঝবেলা পেরিয়ে
কাল রাতে, আলো জ্বেলে বন্দি।

সাপ সিঁড়ি কাটাকুটি
ছক্কা পুটেতে মেতে,
একরোখা ঘড়ি তবু
সময় বইতে দিতে
রাতে সাঁঝে, কুট অভিসন্ধি।

নেই নেই চারদিকে
খুঁজে খুঁজে হয়রান,
ফিচেল সময়টার
অভ্যাসে হাতটান,
ঘন্টা মিনিটের, ছক ভাঙা ফন্দি।




রাজর্ষী 
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় 

জমাট বাঁধা কতই কথা রাজ বাড়িটার অন্তরালে 
দেড়শ বছর জাল বুনে যায়  ঐ দিঘিটার অতল জলে।
জানলে পরে অবাক হবে কেমন ছিলেন এ রাজা হায়
তিনিই রাজা তিনিই ঋষি  প্রাসাদ ছেড়ে ভাটাখানায়।
ইংরেজ তুমি ভারত ছাড়ো কন্ঠে যে তার তিনিই তো বীর
সঙ্গীত আর শিল্পকলায় এই বঙ্গের উন্নতশির। 
এমন মানুষ জগদীন্দ্র এ যুগে আর কে কোথা পায়
তাঁর প্রেরণায় আমরা বাঁচি আমরা বাঁচি তাঁর  সাধনায়। 
তোমার স্বপ্নে আমরা বিভোর এ ঘুম যেন  আর না ভাঙে
তোমার গানে আজও যেন ঐ আকাশের পূর্ব রাঙে।



সঙ্গদোষে

মাথুর দাস


রঙ্গ হাজার সঙ্গদোষে কি ভালো কি মন্দ,

গন্ধ পেলেই নেশার কত সঙ্গী হারায় ছন্দ ।

সঙ্গদোষের মন্দ-ভালো

দ্বন্দ্ব ঢাকে সাদা-কালো,

সৎ মানুষের সঙ্গ পেলে কতই না আনন্দ !




শীত পরব 
উৎপলেন্দু পাল 

মেঘলা আকাশ আর ঘন কুয়াশায় ঢেকেছে সূর্য 
হিমেল হাওয়ায় কাঁপুনি ধরেছে মেরুদন্ড জুড়ে 
চারপাশে এখন উৎসবের রেশ , পিঠের মিঠে গন্ধ 
শীত পসরা সাজিয়েছে তার রূপ রস বর্ণ গন্ধে 
শুনশান রাস্তায় এখন কারনে অকারনে হরতাল 
লোম ওঠা নেড়ি কুকুরের দল খাবারের সন্ধানে 
পিঠের সঙ্গে লেপ্টে যাওয়া পেট ভর্তি শুধুই খিদে 
সংক্রামক রোগের মতোই তা ছড়িয়ে গেছে সর্বত্র 
কঙ্কালসার ভিখিরিটা শীত ঢাকছে ছেঁড়া কম্বলে 
নলেন গুড়ের সুবাসেও মাতেনি তার পৌষপার্বণ 
তার নাক এখন দুমুঠো ভাতের গন্ধ খুঁজে চলেছে 
ভাতের গন্ধ মঁ মঁ করে তার প্রাগৈতিহাসিক নাকে 
ছেঁড়া কম্বল ভেদ করে ঢুকে আসে উনুনের আঁচ 
তার সকল স্বপ্ন জুড়ে শুধু ধোঁয়া ওঠা সাদা ভাত 
শীত গ্ৰীষ্ম বা বর্ষা তার কাছে কোনো ঋতুচক্র নয় 
প্রতিটি ঋতু জুড়েই বর্তমান অনন্ত প্রখর দাবদাহ 
রিক্ত পৃথিবীতে নেই কোনো তুলতুলে লেপের ওম 
ভাগ‍্যাকাশ জুড়ে এখন শুধু অন্তহীণ বিদ‍্যুতের কশা 
স্মৃতিতে হারিয়েছে তার নলেন গুড়ের নষ্টালজিয়া 
তিনশো পঁয়ষট্টি দিন শুধুই খিদের বিরুদ্ধে বিপ্লব । 



ফাগুনবেলার বাঁশি 

কবিরুল ইসলাম কঙ্ক 


ফিরিয়ে দিলাম পড়ে পাওয়া যত প্রেম 
ফিরিয়ে দিলাম জাতক কথার গল্প 
যদি ভেবে থাকো -- খুব ভালো আছি 
তো, ফিরিয়ে দিলাম ভালো থাকাও।

এই অধ্যয়ে শুধই আঁধার চেতনা 
মিশে আছে ভাবনার গূঢ় শিকড়ে 
প্রত্যহ শেষ হতে থাকে প্রিয় মাটির 
খনিজ দ্রব্য এবং আত্মকাল।

ঘরের কোণে জমছে একাকীত্বের শিশির 
একলা পড়ে আছে ফাগুনবেলার বাঁশি।





 রম্য রচনা 



জিভ আনকাট্
উদয় সাহা 

এতসব পিঠেপুলির সাম্রাজ্যে পাটিসাপটা খেতে বেশী ভালবাসতাম৷ বিশেষ করে ক্ষীরটুকু৷ অপেক্ষা করতাম কখন সেই ক্ষীরে মিষ্টির পরিমাণ চেখে দেখতে মা হাঁক দেবে৷ বেগুন-বোটা আর তাওয়ার কথা মনে পড়ে। তেল ছড়িয়ে দিতে যে বাষ্প ঘরবাড়িময়, সেই পিচ্ছিল বাষ্পে আমাদের শীতকাল লেখা। 

বরফকুচি পড়ুক। হাড় হিম হয়ে যাক৷ রবিবার রেশন দোকানে আমি যাবই৷ বড়ো মামা রেশন দোকানে খাতা লেখেন। দীর্ঘ লাইনে আমার জায়গাটা স্পেশাল। দোকানের ভেতরটায় আলো কম। বড়ো ড্রাম থেকে পাইপ দিয়ে ছোটো ড্রামে নীল কেরোসিন তেল ঢালা হ'তো। তেল ঢালা একটা শিল্প৷ দেখতাম। ভালোলাগতো৷ চটের বস্তা ভর্তি চিনি৷ ড্রামের সংখ্যা নেহাত কম নয়৷ একদিকে সুন্দর করে গোছানো ফাঁকা বস্তার স্তূপ। আমার নজর চিনির বস্তার দিকে। ধপধপে মখমল চিনি৷ চিনি খেতে খেতে বাড়ি ফিরতাম।

বিশ্ব ক্রিকেটে যেমন ভারত বনাম পাকিস্তান, তেমনি কোচবিহারে রামভোলা বনাম জেনকিন্স। আমরা রামভোলিয়ান৷ খেলা থাকলে ছুটি পেতাম। দ্বিতীয় পিরিয়ডের পর। ততক্ষণে খেলা শুরু হয়ে গ্যাছে৷ রাজবাড়ী স্টেডিয়াম যেন কুয়াশার জঙ্গল। এসময় ছোটো কুল খেতাম। স্বাদু৷ পুঁতির মতন। চকচকে। মিষ্টি। খেলা চলাকালীন উত্তেজনা বাড়াতো মিষ্টি কুলের সাথে বিটলবণ। অনেকে একে বলত বনকুল৷ কোন বন তার ঠিকানা, জানা ছিল না৷ জিতলে ফেরার পথ অন্তহীন -- এক দুই তিন চার, জেনকিন্স... খেলার ফলাফল আমাদের বিরুদ্ধে গেলে কুয়াশা আরো ধূসর ; রাস্তায় পড়ে থাকা প্লাস্টিক বোতল আমাদের ঘেন্নার ফুটবল ; পরের দিন বনকুল ভীষণ তেতো৷

মামাবাড়ি গেলে আমি ধার্মিক৷ ভীষণ ঠাকুরভক্ত প্রাণ৷ দিদা ঠাকুরঘরে, আমি দরজার কাছে। নজর ঠাকুরের বাটার দিকে। একে শীত, দুইয়ে খেজুর গুড়ের নাড়ু, পায়েস। সেই থেকেই আমি ঈশ্বরবাদী৷ ভীষণ আস্তিক।

প্রতি মাসের একটা তেইশ আছে। জানুয়ারিতেও আছে৷ ওইদিন ফিবছর সুভাষ দূর থেকে স্মিত হাসেন। হাত নাড়েন৷ আমরা স্যালুট জানাই৷ চলতি পথে সঙ্গে সুভাষ না থাকলেও, আমাদের একটা সুভাষপল্লী ছিল। অমোঘ টান৷ রাস্তার দিকে মুখ করে আছে তেলে ভাজা দৈত্যাকার পরোটার ঢিপি৷ পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে আমাদের জিভ বুম বুম বুমার৷

জিভ আর নাবালক নেই। সাবালক। অনুরোধ- উপরোধ করে না৷ বরং ঘরমুখো। একটা মাত্র ব্যায়াম। ডুবসাঁতার। জলের উপর ভাসতে থাকে গুড়ো গুড়ো প্যাস্টেল রঙ ৷





পৌষ পার্বণের বিড়ম্বনা
স্বপন কুমার দত্ত 

পৌষ পার্বণের সার কথাই হ'ল, পিঠেপুলির উৎসব। শীতের সকালে বা দুপুরে রকমারি পিঠে দিয়ে ভূরিভোজ তুলনা বিহীন। ভাপাপিঠা, পুলিপিঠা, মুগেরপুলি, পাটিসাপটা, ,চন্দ্রপুলি, পুলির পায়েস আহা: পিঠের অষ্টোত্তর শতনাম করতে করতে জিভেই জল এসে গেল। আজ প্রৌড়ত্বে পৌঁছে বয়সের বাধা এবং হত চ্ছাড়া সুগারের বিধিনিষেধের গেরোয় শুধুমাত্র স্মৃতি রোমন্থন করা ছাড়া পিঠার রসাস্বাদন নৈব নৈব চ। 
           সদ্য বিবাহিত। বয়স কতই বা, পঁচিশ কি ছাব্বিশ। সুঠাম দেহ, ভালোই খেতে পারি। সস্ত্রীক শ্বশুরবাড়িতে পৌষ পার্বণে নিমন্ত্রণ। শুধু পিঠের নিমন্ত্রণ হলে কথা ছিল। চিতল মাছের মুইঠা দিয়ে শুরু করে কচি পাঁঠার ঝোল সহ মাংস সহ দুপুরে ভোজনের পর রাতে কম সে কম পাঁচ ছ রকমের পিঠে খেয়ে আমার অবস্থা কেরাসিন। আর পেট বলে তো কথা, এতো জলের ড্রাম নয়। শাশুড়ি মাতার জামাই সেবা সঙ্গে শালাশালীদের অনুরোধ রাখতে গিয়ে জীবন জেরবার। ভোররাত থেকে শুধু বাথরুম যাওয়া আসা। পিঠে খেলে পেটে সয়না, আগে জানতাম না। শালাশালীদের মুচকি হাসি আরো মর্মান্তিক। নতুন বউকেও লজ্জায় কিছু বলতে পারছি না। এক কথায়, আমার মত দুরবস্থায় না পড়লে কারোর পক্ষেই বোঝা সম্ভব নয়। 
          এবার আবার নতুন করে বিড়ম্বনা। সন্ধ্যায় আবার খেতে হবে পিঠেপুলি। আমার শ্বশুরবাড়ি গ্রামে। সন্ধ্যায় শাশুড়ি মা কাঠের উনুনে রকমারি পিঠে তৈরি করতে বসে গেছেন। আমরা সবাই অর্থাৎ শশুর মশাই, শালা শালী আমার বউ গরম গরম পিঠা খাওয়া শুরু করেছি।
            ইতিমধ্যে আমার শালাবাবু সকলের সামনে বললো, " কি জামাইবাবু, খুঁটে খুঁটে পিঠে খাচ্ছেন। চলুন বাজি রেখে পিঠে খাওয়া যাক। যে খাওয়া ছেড়ে উঠে পড়বে, সে হেরো, তাকে সবাইকে সিনেমা দেখাতে হবে।" ভীষণ আত্মসম্মানে লাগলো। আমি সম্মতি দিলাম। এরপর দুজনার পিঠে খাওয়ার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল। শ্বশুর মশাই দুজনকেই আর খেতে বারণ করলেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা। দুজনার প্রেষ্টিজ বলে কথা। অবশেষে শালাবাবু রণে ভঙ্গ দিয়ে উঠে পড়লো। আমিও খাওয়া বন্ধ করলাম।
             কিন্তু মাঝরাত থেকে আমার সেই দুরবস্থার শুরু। শুধু ঘর আর বাথরুম। হাতের জল আর শুকোয় না। এভাবেই সকাল হয়ে গেল। লজ্জায় গিন্নিকেও বলতে পারছি না। ওদিকে শালাবাবুর দশাও তথৈবচ। সেও যাচ্ছে আর আসছে। কিন্তু মুখে স্বীকার করতে নারাজ। আমি বাইরে বেড়িয়ে গুচ্ছের মেট্রোজিল ট্যাবলেট খেয়ে ফেললাম। কিন্তু সার্ভার নামগন্ধ নেই। এবার শালাবাবু আমার দশা দেখে বললো, " জামাইবাবু,এক কাজ করুন, একটা গোটা বিলিতি আমড়া গিলে খেয়ে নিন। বোতলের ছিপি বন্ধ হয়ে যাবে।"
        আমার এবার উত্তর দেওয়ার পালা। আমি বললাম, " ভাই, তোমার অবস্থাও খুব সুবিধের নয়। তুমি একটা গোটা লুচি গিলে খেয়ে ফেলো। ওটা খাদ্যনালী দিয়ে প্যারাসুটের মতো নেমে লিকেজ বন্ধ করে দিলেই " কেল্লা ফতে!'' বলা বাহুল্য, শালাবাবু আর সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা উচিত মনে করেনি।
          পৌষ পার্বণের বিড়ম্বনা যেন আমার পিছু ছাড়তে চাইছিল না। পরদিন নিজের বাড়িতে ফেরার পালা। অফিস রয়েছে। শাশুড়ি মা প্রায় জোর করেই একটা মাটির হাঁড়িতে ঝোলাগুড় দিয়ে দিলেন। বাড়ি গিয়ে আয়েস করে খেতে বললেন। গিন্নিও সানন্দে রাজি হয়ে হাতে হাঁড়ি নিয়ে নিল।
         এবার বাসে চেপে দুজনে রওনা দিলাম। গুড়ের হাঁড়ি বাসের সিলিং এ রাখা হয়েছে। বাস ভাঙা রাস্তায় হেলেদুলে চলছে। হঠাৎ ঝাঁকুনিতে গুড়ের হাঁড়ি উপর থেকে আমার মাথায় পড়ে একেবারে চৌচির। গলা গুড়ে কর্তা গিন্নী দুজনেই মাখামাখি। শাশুড়ির উপর ভীষণ রাগ হচ্ছিল, কিন্তু বউয়ের  ভয়ে কিছু বলার উপায় নেই। হাতের কাছে কিছুই নেই,যা  দিয়ে গা মুছতে পারি। গুড় গড়িয়ে নাকের উপর থেকে গোঁফের উপর পড়লেও চাটতে পারছি না। মনে পড়ছিলো, সেই গানটার কথা,--   "চিটেগুড়ে পিঁপড়ে পড়লে নড়তে চড়তে পারে না......."!

বাসশুদ্ধ যাত্রীর দ্রষ্টব্য কেবল আমরাই দুজন। শেষে কনডাক্টরকে বলে বাস থামিয়ে মাঝ রাস্তায় নেমে পড়লাম।
           
পৌষ পার্বণে যে এহেন বিড়ম্বনা ঘটে,তা আগে জানা ছিল না।









শিল্পী- শুভমিতা দেব 




গল্প 

দুটি অণুগল্প

রথীন পার্থ মণ্ডল 

১. টেনশন

ট্রেনে উঠতে না উঠতেই অর্ণবের উদ্দেশ্যে ধেয়ে এলো

-- আচ্ছা দাদা, আপনার কি সুগার আছে?

-- না।

-- আচ্ছা দাদা, আপনার কি প্রেশার আছে?

-- না।

-- আচ্ছা দাদা, আপনার কি হাইপারটেনশন আছে?

-- না। আচ্ছা একটা কথা জানতে পারি?

-- হ্যাঁ, বলুন।

-- এসব কথা আমাকে জিজ্ঞেস করছেন কেন?

পাশ থেকে চন্দনবাবু বলে উঠলেন, " আরে বাবা, ও সবাইকেই এই কথাগুলো জিজ্ঞেস করে, যাতে ওর ওষুধ বিক্রি হয়।"


২. বাড়ি

ফজরের নামাজ শেষে মসজিদ থেকে বের হতেই রহমান সাহেব দেখলেন একটা বয়স্ক মহিলা শীতে কাঁপতে কাঁপতে এসে ঠিক তার পায়ের সামনে মাথা ঘুরে পড়ে গেলেন। রহমান সাহেব জিজ্ঞেস করলেন," মা, কে তুমি? থাকো কোথায়?"

বয়স্ক মহিলা কাঁপতে কাঁপতেই বললেন, "বাবা, আমি এক অভাগী মা। কষ্ট করে ছেলেকে মানুষ করার ফলে আজ আমি বাড়িছাড়া। ওই যে কি এক পাড়া আছে না‍, ও হ্যাঁ মণ্ডলপাড়া।  ওখানেই আমার বাড়ি।"

রহমান সাহেব বললেন, "মা, এক বাড়ি ছেড়েছো তো কি হয়েছে? এক ছেলে তাড়িয়েছে তো কি হয়েছে মা, তোমার তো আরেক ছেলে আছে। তুমি তার কাছেই থাকবে। চলো মা, আমার সাথে আমার বাড়ি চলো। মা-ছেলেতে একসাথে থাকবো।"




রিমির দুনিয়া
        দেবদত্তা বিশ্বাস

                     রিমির আজ খুব রাগ হয়েছে।রাগের চোটে কান আর গাল দুটো লাল টকটকে হয়ে আছে।রাগ হবে নাই বা কেন?সাত বছর বয়স হল,সে স্কুলের জন্য নিজে নিজে তৈরি হতে পারে তবুও বাবা মায়ের কত বিধি নিষেধ।ওষুধপত্র থেকে শুরু করে ছুড়ি ,কাঁচি সব  রিমির হাতের নাগালের বাইরে রাখতে বাবা হরহামেশাই উঁচু আলমারির উপর, ফ্রিজের উপর তুলে রাখে।একেক সময় মা তো বলে বড় হয়ে গিয়েছ, নিজের দায়িত্ব নিজে নিতে শেখ। তারপরেই আবার এসব ব্যবহার কেন?রিমির চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসে।সে কি আর বোনের মত ছোট্ট এক বছরের বাচ্চা?বুনু তো হাতের সামনে যা পায় সব মুখে পুরে নেয়।।তাকেও তো রিমি কত শেখায় যেকোন জিনিস মুখে দিতে নেই।তাহলে তাকে কেন ছোট ভাবা হবে?মন খারাপের চোটে আজ পড়াশোনাতেও মন লাগছে না।গুণ অংক গুলো সব ভুল হয়েছে আজ।এমন সময় একটা টিকটিকি ছাদের কাছে টিকটিক করে উঠলো।রিমি ভাবে টিকটিকিটার কি মজা।উপর থেকে নিচের সব দেখতে পায়।ফ্রিজের উপর, আলমারির উপর,টেবিলের উপর যা যা রাখা আছে সব ওর চোখে পড়ে।ভ্যাঁ ভ্যাঁ!মন খারাপ করে এক সময় রিমি ঘুমিয়েই পড়ে।রিমির ঘুমটা যখন ভাঙে যখন সন্ধে নামতে একটু বাকি।কিন্তু বাড়ির সবাই তো ঘুমিয়ে।মা বুনুকে নিয়ে পাশের ঘরে শুয়ে আছে।বাহ্! এই তো সুযোগ।রিমি একটা ছোট টুল নিয়ে নিজের ঘরের আলো জ্বালে।লাইটের সুইচ গুলো এত উপরেই বা থাকে কেন বাবা?সে যাকগে!রিমি গুটি গুটি পায়ে টুলটাকে নিয়ে যায় ফ্রিজের কাছে।ফ্রিজের উপর রাখা ছিল দাদু দিদার ওষুধগুলো।রিমিকে দেখে ওষুধ গুলো বলে তুমি কে? তোমাকে তো চিনি না?রিমি বলে আমি রিমি।এ বাড়ির মেয়ে।তোমাদের সাথে আমার দাদু দিদার তো খুব ভাব।রোজ তোমাদের উল্টেপাল্টে দেখে,মুখে পুরে খেয়ে নেয়।আজ একটু তোমাদের সাথে গল্প করতে এসেছি।তুমি কি আবার আমাদের খেয়ে ফেলবে নাকি?জিজ্ঞেস করে গোল গোল ওষুধটা।রিমি বলে একটু খেয়ে দেখতে ক্ষতি কি বল?রোজ যখন দাদু দিদা খায়,তাহলে নিশ্চয়ই খুব ভালো খেতে হবে।পাশ থেকে একটা লম্বা কালো ক্যাপসুল বলে দাদু দিদা খাবার পরে যখন আমরা পেটে যাই তখন কি দেখতে পাই জানো?রিমি গোল গোল চোখ পাকিয়ে চুপ করে থাকে।ক্যাপসুল বলে তোমার দাদুর তীব্র শ্বাসকষ্ট হয়।আমি যখন গলা দিয়ে নামতে থাকি দেখতে পাই কি কষ্টই না পাচ্ছেন দাদু।যতই শ্বাস নিতে চেষ্টা করেন গলাটা যেন বন্ধ হয়ে আসে।আমি তখন চেষ্টা করি ওনাকে কিভাবে একটু স্বস্তি দেওয়া যায়।গোল গোল ওষুধটা বলে ওঠে আমার দিদা কি পেট ব্যথায় কষ্ট পান জানো?পেটে ব্যথায় একদম কুকরে থাকেন যখন আমি পেটের ভিতরে গিয়ে একটু ব্যথাটা কমানোর চেষ্টা করি।রিমি ভাবে ধুর! এদের সাথে বন্ধুত্ব হবে না।কেমন যেন ভয় ভয় লাগছে।তার চেয়ে বরং আমি টেবিলের উপরটা দেখি।রিমি টুলটা আস্তে আস্তে সরিয়ে টেবিলের কাছে যায়।
          টেবিলের উপর উঠতেই দেখে একটা কাঁচি আর ছুঁচ নিজেদের মধ্যে গল্পে মশগুল।কাঁচি ছুঁচকে বলছে আজ সকালে কি রক্তারক্তি কান্ডটাই না হল।ছুঁচ বলে কেন কি হয়েছে?কাঁচি বলে সকালে কাপড় কাটতে  গিয়ে রিমির মায়ের কতটা হাত কেটে গেল জানো?আমি কিন্তু দিব্যি কাপড়টাকেই কাটছিলাম ওনার সাথে সাথেই।কিন্তু কিভাবে অলক্ষে যে আমার দাঁত দুখানা রিমির মায়ের হাতে কচ করে বসে গেল বুঝতেই পারলাম না।আমি কিন্তু ইচ্ছে করে করিনি।ছুঁচ বলে হ্যাঁ একদিন তাড়াহুড়োতে আমাকে তো রিমির মা নিজের হাতেই ফুটিয়ে বসলেন। কাজের তাড়াহুড়োতে মাঝে মাঝেই এমন হয়।এখন ওই দেখো হাত ফুলিয়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে বসে আছেন।রিমি ভাবে সত্যিই তো। আজ মায়ের হাতে একটা ব্যান্ডেজ লাগানো।এবারে খুব কষ্ট হয় রিমির। চোখ দিয়ে টস টস করে দু ফোঁটা জল পড়ে।ধীরে ধীরে টুল থেকে নেমে আসে রিমি।রিমি বুঝতে পারে  উপরে তুলে রাখা বড়দের ওই জিনিসগুলোর মধ্যে জড়িয়ে রয়েছে হয় অনেকটা পরিশ্রম না হয় বেদনা।রিমির আর সেসব দিকে ফিরে তাকাতে ইচ্ছে করেনা।রঙ পেন্সিল আর আঁকার খাতা নিয়ে রিমি নিজের জগৎ সাজায় নতুন নতুন রঙে।




কবিতা (দ্বিতীয় পর্যায়)


চাহিদা
দেবর্ষি সরকার

শরীরে ওভারকোট আর মাথায় ক্যাপ পরে যেদিন পাড়ার মোড়ে বিউটি পার্লারে গিয়ে বলেছিলাম, আমার চুলগুলোতে ইতিহাসের সাল লিখে দিন সেদিন আমার পাশের বাড়ির ছেলেটি প্রথম প্রেমে পড়েছিল।

শরীরে ওভারকোট আর মাথায় ক্যাপ পরে যেদিন পাড়ার মোড়ে বিউটি পার্লারে গিয়ে বলেছিলাম, আমার ভ্রু দুটি উড়িয়ে দিন সেদিন আমার কবিতার খাতা আমাকে বাড়িতে ঢুকতে দেয়নি।


শরীরে ওভারকোট আর মাথায় ক্যাপ পরে যেদিন পাড়ার মোড়ে বিউটি পার্লারে গিয়ে বলেছিলাম, আমার মোচটিকে কেটে বাদ দিয়ে দাও সেদিন বাগানের হাসনুহানা আমাকে দেখে পরিহাস করেছিল।


শরীরে ওভারকোট আর মাথায় ক্যাপ পরে যেদিন পাড়ার মোড়ে বিউটি পার্লারে গিয়ে বলেছিলাম, আমার হাতের লোমগুলো উপড়ে নাও সেদিন তোমাকে লেখা কবিতা নীল আগুনে ডুবে ছিল।


শরীরে ওভারকোট আর মাথায় ক্যাপ পরে যেদিন পাড়ার মোড়ে বিউটি পার্লারে গিয়ে বলেছিলাম, আমার চোখের মনি লালচে করে দাও সেদিন তুমি আমাকে বিষ খেতে অনুরোধ করেছিলে।

শরীরে ওভারকোট আর মাথায় ক্যাপ পরে যেদিন পাড়ার মোড়ে বিউটি পার্লারে গিয়ে বলেছিলাম, আমাকে তুমি মেয়ে বানিয়ে দাও সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত আমি ফাঁসির দড়িতে ঝুলে আছি।




গেম 
স্বপন কুমার সরকার
        

ওটা আগেও ছিল, যেমনটা অনভিপ্রেত!
ইলিয়াড-ওডিসি, রামায়ণ কিংবা মহাভারত;
সবেতেই সাজানো গেম প্লেন।

দশকুমারচরিতম্ বা মূদ্রারাক্ষসম্ দেখো!
কিরূপ প্রতিপক্ষের রহস‍্যঘন নাটকীয়তার-
সাজানো বিশুদ্ধ কারু উপক্রম।

অভিযোজন জীবনের হয়েছে, বদলায়নি-
ভাড়,বিদূষক,খলনায়ক ছলচাতুরি রূপরেখা;
যুগ-যুগান্তের কূটনৈতিক ষড়যন্ত্র।

রাজনীতি আজ গ্রাস করছে সমাজ কে,
স্কুল ,কলেজ ,বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গন কলঙ্কিত;
কলুষিত মানবতা আর গণতন্ত্র।

"যেই যায় লঙ্কায়,সেই হয় রাবণ"-প্রবচন
যদি সত‍্য,তবে রামচন্দ্র কে বা কারা?
বিরোধীরাই তো আগামীর স্বপ্ন।

আজ যারা আসীন সিংহাসনে, চিহ্নিত
বিভীষিকাময় পরিস্থিতির উদ্গাতা প্রতিনিধি;
অতীতে তাদের কি করিনি যত্ন?

মিথ‍্যা প্রতিশ্রুতি আর সুমধুর ভাষণে-
বোকা হয়ে এসেছে আমজনতা চিরকাল;
দেখো আজ দেওয়ালে তার পিঠ।

সুস্থ সংস্কৃতি ফেরাতে এবার একহও,
তোমাদের হাতেই চাবিকাঠি জেনে রেখো-
নইলে থাকবে কি নিজের ভিত?





রোদ
রীতা মোদক

ওদের পাড়ায় রোদ এসেছে
আমাদের পাড়ায়  মাঘের শীত

তোমার উঠোন রোদ ঝলমলে
আমার উঠোন শীত কনকনে

তোমার ঠোঁটে লাল গোলাপ
আমার ওষ্ঠ ফেটে লাল

তুমি দেখো সূর্য্যমুখী 
আমার চোখে সর্ষে ফুল

তোমার- আমার বিভেদ ভাঙবো
আমায় একটু রোদ দেবে?






দুটি কবিতা
আকাশলীনা ঢোল

মরশুমের শীতলতম দিনে

আগুনের তাপে সারারাত পুড়ে কাঠগুলো
এখন ক্লান্ত,
ফুটপাতবাসী ঘুমিয়ে আছে কুয়াশার
চাদর জড়িয়ে,
পথে আনাগোনা কেবল সাইকেল আরোহী
কাগজ বিক্রেতার।
উত্তুরে হাওয়ার দাপট, ধীরে ধীরে রোদ ওঠা,
বাড়তে থাকা বাজারের কোলাহল,
তারই মধ্যে উৎসবের প্রস্তুতি।
দুপুরের রোদে মনে পড়ে পুরনো
বইয়ের গন্ধ, মায়ের হাতে
বোনা উলের পোশাকের স্পর্শগুলি -
সূর্য অস্ত যায়, নগরের পথে মাথা
তুলে দাঁড়ায় হ্যালোজেনের স্তম্ভগুলি।
রাস্তায় ভিড়, শৌখিন মানুষগুলি
ঠোঁট রাখে কফির কাপে -
গলির মোড়ে ধোঁয়া ওঠা মোমোর গন্ধ
কিংবা মাংসের চপে কামড়
দিতে ব্যস্ত কিছু ক্ষুধার্ত পথচারী -
আপাদমস্তক শীত-পোশাকে ঢাকা মানুষগুলির
ওপর দৃষ্টি রাখে ফুটপাতবাসী,
লোভনীয় খাবারের ঘ্রাণেই সারে
অর্ধভোজন।
রাত্রি নেমে আসে, না পাওয়ার বেদনাগুলি
তলিয়ে যেতে থাকে, মরশুমের শীতলতম
দিনের অতল তিমিরে।



পারদ যখন নিম্নমুখী

জানলার কাঁচে ঘনীভূত কুয়াশার
জলকণাগুলি এখনও জমে আছে,
এখনও অদৃশ্য দূরের গাছ থেকে মানুষ -
ঘড়ির কাঁটা অবশ্য জানান
দিচ্ছে, এখন বেলা এগারোটা,
তবু, এখনও নিম্নমুখী থার্মোমিটারের
পারদের স্তম্ভ।
মনে মনে ছক কষে নিচ্ছে অজানা
এক শঙ্কা,
দেহের ভেতর বাসা বেঁধে চলেছে
সংক্রামক কোনও জীবাণু -
চোখের সামনে সে কি ধোঁয়াশা?
নাকি ধোঁয়ার কোনও আভরণ?
ফারেনহাইটে বাড়তে থাকছে
রূপোলি কাঠির দম্ভ। 
জানলার কাঁচ, কাঁচ পোকাদের জলসা
বসেছে এখন,
আগুনের তাপ ঝিমিয়ে এসেছে
মন কেমনের সুরে -
নাগরিকের কন্ঠে এখন শিলাবৃষ্টির গান,
ঘড়ির কাঁটা জানান দিচ্ছে
এখন দুপুর একটা,
তবু, এখনও নিম্নমুখী সেলসিয়াসের
পারদ স্তম্ভ।



বিদায় বেলা
দেবযানী সেনগুপ্ত

বিদায় বাঁশি বাজলো এবার
 সময় হল যাবার!
 সুদূর থেকে হাতছানি দেয়
 হারিয়ে যাওয়া বিকাল।
 নদীর থেকে একটু দূরেই
 সবুজ ছাওয়া বাগান,
 আমলকি আর শিমুল চাঁপা
 ছড়ায় ডালপালা।
 রং বে রঙের ফুলের বাহার
 ঝরা পাতার গান,
 ও পথ দিয়ে যাওয়া আমার
 হবে না তো আর !
শুকনো পাতার পায়ে পায়ে
 নূপুর বাজার তান ,
শূন্য নিঝুম অলিন্দের
 একলা চলার গান ।
ক্লাসরুম আর বেঞ্চ- চেয়ারের
 মিলিত ঐক্যতান,
 অষ্টাদশীর গল্পকথা-
 মুখর চারিপাশ ।
সবাই তারা থাকবে এখন
 যেমন ছিল আগে!
 আমিই শুধু থাকবো না আর
 হারিয়ে যাবো দূরে।।





নিরক্ষর
দেবদত্তা লাহিড়ী 

পাতার পর পাতা উল্টে আমি
তোমার লেখা খুঁজে যাই।
কেউ জানেনা এখনো তবু
 সকাল সন্ধ্যা  হোক বা রাতে 
আমার তুমি আর কোথাও নেই।
নির্দ্বিধায় গোলাপের পাঁপড়ি করি হত্যা
কাল নির্ণয় হারিয়ে যেতে থাকে
ব্ল্যাকবোর্ড এর চৌহদ্দিতে ।
নিচু হয়ে দেখি
চকের গুঁড়ি তে ঢেকেছে জুতোজোড়া 
অথচ সামনে কালো পর্দা চকচকে
লিখতে পারিনি একবর্ন তাতে।
ঘামেভেজা ঘুমভাঙা রাত্রি হিসেব কষে জেনেছে
অঙ্ক হয়েছে ভুল।
ইতিহাসের পাতা থেকে মুখখানি
ভুল করে  যায় বারবার মুছে 
জোর করে ধরে রাখি ।
ভূগোল বলে বহুদূর পথ
পায়ে হেঁটে পাড়ি দেওয়া সে অসম্ভব।
আলোকবর্ষ নাকি আরো দুরে
কারন ভর ও ভারের পার্থক্য দিয়ে
যায়না মাপা মায়ার খেলা
নাকি কেবল ই রসায়নের 
দ্রবণ শূন্যতা  রাখবে না কিছু
বাঁচতে হবে মরতে হবে 
অভিযোজন  নিয়ম আপন করে নিয়ে। 
হিজিবিজি গাদা গাদা আঁকিবুকি মেলা 
এইভাবে কাব্য লিখে আমরা বেঁচে থাকি।
বইয়ের বাক্সে সবটা জুড়ে স্বপ্ন মেখে রাখি।




আক্ষেপ
অলকানন্দা দে


হে প্রকৃতি! মানুষ চেনো?
চতুর্দিকে যারা তোমার ছড়িয়ে থাকে দলে দলে
উপমাতে অসামান্য, আদর্শতে পূর্ব জ্বলে,
এরাই মানুষ।
শান্তি খোঁজে পাতার ফাঁকে, মেঘ দেখতে খুব উচাটন
মনটা কাঁদে মৌন যখন,
যায় ছুটে যায় সুদূর পেতে
কিংবা কাছের সর্ষে ক্ষেতে
খুঁজে পেল অবসাদের শতেক মহৌষধ।
যত মায়া নিলো লুটে, বন্ধুনী আর বন্ধু জুটে
মাথাপিছু আনন্দটা অভিমানের স্তব।
এরাই মানুষ।

ফিরতি পথে আত্মহারা সেই মানুষই ছন্নছাড়া
নগ্ন বোধে দিচ্ছে ছুঁড়ে আবর্জনার ক্লেশ।
শালবীথিকার অন্তরালে ব্যথার পরিবেশ।
নষ্ট নিয়ম ভ্রুক্ষেপহীন, অনুভবে প্রচণ্ড দীন
বধির চেতন শোনে না এই রোদন প্রকৃতির।
জঞ্জালে তার মলিন হল সবুজতর নীড়।
এরাও মানুষ।

সমাপ্তিহীন আক্ষেপে আজ এই পরিবেশ
কখনো প্রলাপ কখনো প্রলয় আঘাতের রেশ।
সুপরিসর ভোরের বাতাস রূঢ় জ্ঞানে
বুঝিয়ে দেবে অপমানের সঠিক মানে।
বুঝলে মানুষ?
কি সংকেত আসছে শোনো বাতাসটাতে
একশো শরৎ এই আকাশের আছে কি হাতে?
আরও অজ্ঞান হবে নাকি বোধের বরন
ঋণ মেটাবে সেবক হয়ে স্থির আমরণ,
ভেবে দেখ নিঃশব্দ বিনাশটাকে
রোধ করতে পার কিনা মেধার ডাকে।




অবসন্ন জীবন
সুমন্ত সরকার

আমার গল্প তখনই সুন্দর ছিলো,
যখন তুমি ছিলে অপরিচিত।
আমার গল্প তখনই সুন্দর ছিলো,
যখন ছিলো না কোনো প্রেম,
ছিলো না সেই মায়ায় আটকে রাখা মানুষটি।
আমার গল্প তখনই সুন্দর ছিলো,
যখন খেলে বেড়াতাম মাঠে,
আর বকুনি খেতাম মায়ের কাছে।
আমার গল্প তখনই সুন্দর ছিলো,
যখন পড়তে না বসলে খেতাম দুমদাম মার।
আমার গল্প তখনই সুন্দর ছিলো,
যখন সেই স্কুল ছিলো রোজ।
আমার গল্প তখনই সুন্দর ছিলো,
 যখন পরিচয় হয়নি তোমার সাথে। 
আমার গল্প তখনই সুন্দর ছিলো, 
যখন ছিলোনা হতে মোবাইল ফোন।
আমার গল্প তখনই সুন্দর ছিলো,
যখন সব কথা মায়ের কাছে বলতাম। 
আমার গল্প তখনই সুন্দর ছিলো,
যখন পড়া না পারলে খেতাম পিটুনি।
আমার গল্প তখনই সুন্দর ছিলো,
 যখন ছিলোনা এতো ব্যস্ততা,
ছিলোনা এতো একঘেয়ে জীবন।
আমার গল্প এখন হয়েছে ম্লান
যখন ছেড়ে গেলে তুমি,
সুন্দর  এই জীবন হলো 
কেবলই অবসন্নতায় ম্লান।




বিকলাঙ্গ মুক ও বধির  
আশীষ কুমার বিশ্বাস
           
এঁরা পারে না হাঁটতে
পারে না ভালো ভাবে কথা বলতে
চলতে ফিরতে অচল জীবন ।

জানে তাঁরা, প্রতি পদে পদে বাঁধা আছে
অ-পারার হাত ছানি আছে
অনুকুল অবস্তা নেই তাঁদের কাছে !

শুধু এইটুকু জানে , এইটুকু মানে
"পারবোনা নেই তাঁদের মনে "
অসম্ভব যা কিছু , পার হতে জানে ।

হেলেন কেলার , স্টিফেন হকিং
তাঁরা এক এক জনে
সে কথাটি রাখা আছে মনে ।

এঁরা বড় হোক , এঁরা সার্থক হোক
অ -পরাজিত জীবন
অক্ষয় হোক এদের সুধা সঞ্জীবন


পাঠ প্রতিক্রিয়া 


মেঘ মেঘ বাদল বাদল: শৌভিক রায়  
(ছোট গল্প সংকলন)
আলোচনা- অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী 

আমাদের উত্তরের স্বনামধন্য সুপরিচিত লেখক শ্রীযুক্ত শৌভিক রায় সদ্য ত্রিবৃত্ত পুরস্কারে সম্মানিত হলেন তার ছোট গল্প সংগ্রহ 'মেঘ মেঘ বাদল বাদল' - এর জন্য। আমার মতো সাধারণ পাঠকের ক্ষুদ্র বুদ্ধি দিয়ে যেটুকু উপলব্ধি করি যে, পুরস্কারই কোন কিছুর ভালো মন্দ বিচারের সঠিক বা চূড়ান্ত মানদন্ড নয় যদিও, কিন্তু সাফল্যের এই উদযাপন কৃতিকে অনেকটা আনন্দ দিয়ে যায়, তাঁর মেধা, শ্রম ও ভালোবাসার ফসল তাঁর বইটিকে ছুঁয়ে এই সার্থকতা তাঁর আগামীকে আরো উজ্জ্বল করে। 

আদপে 'মেঘ মেঘ বাদল বাদল' বইটি নিজেই একটি অনেক বড় পুরস্কার লেখকের তরফ থেকে পাঠকদের জন্য। মোট উনিশটি নানান রঙের গল্পে সাজানো এই বইটি সমস্ত পাঠকদের মনোরঞ্জন করবার মতো সুখপাঠ্য ও উপভোগ্য একটি গল্প সংকলন।'অমৃত বাবু আর লোকটা'- প্রথম যে গল্পটি দিয়ে লেখক এই বইয়ের যাত্রা শুরু করেন,সেটির সঙ্গে পাঠক একাত্ম হতে বাধ্য। নিজের পরিবার, পরিজন, প্রিয়জন ও নিজেকে আবিষ্কারের গল্প হয়ে শুরুর এই গল্পটি পাঠকের হাত ধরে আগ্রহভরে পৃষ্ঠা উল্টে দেয় পরবর্তী গল্পের। সাবলীল বলে চলায় পাঠকের মনোসংযোগ ধরে রাখবার এক অনবদ্য ভূমিকা পালন করেছেন লেখক জীবনের চেনা ছবির বুননে এবং তাঁর ভিন্ন ভাবনার গল্পগুলিতে। সিরুই খাসঙের রিনসিমের ব্যথাতুর জীবন থেকে অনির্বচনীয় অসীমতায় উত্তরণ থেকে শুরু করে গাজনের সাধু তার ভস্মমাখা মহাদেবকে নিয়ে বা মাদেরু তার বাঘজীবনের প্রাণময়তা থেকে যন্ত্রণায় কিংবা ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলা সুপ্রিয় লেখকের কলমের আঁচড়ে জীবন্ত হয়ে উঠেছে,রক্ত মাংসের চরিত্রে ধরা দিয়েছে পাঠকের মনে। অনেকখানি মেধা,বাস্তব অভিজ্ঞতা, ভিন্ন দৃষ্টিকোণ ও যথেষ্ট হোমওয়ার্ক থাকলে তবেই গাজনের সাধু, বাঘজীবন,পরমা,প্রহ্লাদের হাসি,ফেরা,বেহুলা উপাখ্যান ও  ত্রয়োদশীর চাঁদ - এর মতো গল্প লেখা সম্ভব। `বাস্তুসাপ`, `সি -অফ`, `পাগল`, `মেঘ মেঘ বাদল বাদল`,`একটি মৃত্যুর প্রস্তুতি`, `বয়স`, `পড়াশোনা` এই গল্পগুলিতে অনুভবের গভীরতা ছুঁয়ে গেছে লেখকের কলম। কিছুটা হালকা মেজাজে লেখা গল্প `বিষাদপ্রতিমা` মন ছুঁয়ে যায় ও হাস্যরসের গল্প `কেউ খাবে আর কেউ খাবে না` গুরুগম্ভীর পাঠকের ঠোঁটেও হাসির রেখা আঁকবেই নিশ্চিত। 






বর্তমান সময়, সামাজিক পরিকাঠামো,নারীজীবন, ভাবাবেগ বা অনুরাগ,টান, জীবিকার জন্য সংগ্রাম, ফিরে দেখা,ভালোবাসা,কল্পনা, জাতিভেদ সবকিছুর মিশেল এই বইটির গল্পগুলির পাতা জুড়ে। হয়তো বা পাঠক ভাবেন  'কেউ খাবে আর কেউ খাবে না' আর 'বেহুলা উপাখ্যান'  এই একই লেখকের লেখা তো? এখানেই একজন লেখকের জিৎ, তিনি ভার্সেটাইল হয়ে ওঠেন নিজের কলমের ছন্দময় জাদুতে জীবনের সমস্ত রকম বিষয়ের গল্পে প্রাঞ্জল ও স্বচ্ছন্দ বলে চলায়। লেখকের সুচারু কলমে অমৃতবাবুর মুখটা যখন ছোটর নিজের মুখ হয়ে যায়, রিনসিম যখন সিরুই খাসঙের প্রজাপতি হয়ে সর্বত্র উড়ে বেড়ায়, গাজনের সাধু যখন বিষক্রিয়ায় নীল হতে হতেও নীলবর্ণ নীলকন্ঠকে দেখে বা গুরুপদবাবু বহুদিন আগের সেই বাস্তুসাপকে, মিমোসার আত্মমর্যাদাবোধ, বয়স্ক রিক্সাওয়ালার অস্তিত্বের সংকট, বছরের নির্দিষ্ট একটি দিনে হাউরির বুকে অদ্ভুত একটি পাথরে বসে কাঁদতে কাঁদতে পরমার বিড়বিড় বলে চলা, সনাতনের ঠোঁটের কোণে প্রহ্লাদের হাসি , সুবলের বোন নিভাকে ফিরে পাওয়া, আলগোখরোর জীবনের, যাপনের, ভ্রাতৃত্বের অনুভূতির আদিম রিপুর আশ্চর্য সুন্দর এক কথন, লেখকের কলমের এই সবকিছুই একসঙ্গে বলে ওঠে 'মেঘ মেঘ বাদল বাদল ' লেখকের এক সার্থক সৃষ্টি আর পাঠকের অমূল্য সংগ্রহ।

২০১৯-২০ সালে গাঙচিল থেকে প্রকাশিত এই বইটি নিয়ে অনেক বিদ্বজনেরা হয়তো মতামত দিয়েছেন বিগত দিনগুলিতে। গল্পগুলির ওপর আলোকপাত করেছেন নানান আঙ্গিকে। লেখকের কাছে সে প্রাপ্তি আপ্লুত হবার মতো, অনেক খুশির, গর্বের ও আনন্দের। যৎসামান্য বোধ ও অনুভবের আলোয় খুব সাধারণ ভাবে বইটি নিয়ে দুচার কথা বলতে ইচ্ছে হলো শুধুমাত্র  সংগৃহীত এই বইটিকে যথার্থ, যোগ্য মর্যাদায় উন্নীত হতে দেখে। পাঠক হিসেবে এ একপ্রকার আনন্দ উদযাপন। যদিও মনের অন্দরমহলে সমকালীন এই বইটির স্থান ছিল সেরার শীর্ষেই।

অগণিত পাঠকের পড়া ও মনের কাছাকাছি এই বইটি নিয়ে আলোচনার ধৃষ্টতাটুকু ও লেখার ভুলভ্রান্তি লেখক সহ সমস্ত পাঠকদের কাছে ক্ষমার যোগ্য হবে এই আশা রাখি।

লেখকের সুযোগ্য সহধর্মিনী মাননীয়া শ্রীমতী রীনা সাহাকে উৎসর্গ করা এই বইটির প্রচ্ছদ পরিকল্পনা ও রূপায়ণ অত্যন্ত সুন্দর।  






ভ্রমণ 

বক্সা দুয়ার

চিত্রা পাল

জলপাইগুড়ি থেকে বক্সাদুয়ার এতো কাছে, মনে মনে ভেবেওছি কতবার যাব তাও যাওয়া হয়ে ওঠেনি। এইবার একটা সুযোগ হতেই আর না করিনি, একবারে বেরিয়ে পড়লাম ওই স্বাধীনতার তীর্থস্থানের উদ্দেশ্যে। স্বাধীনতার তীর্থস্থান বলছি কেন, তখন স্বদেশী আন্দোলনের সবচেয়ে অপ্রতিরোধ্য বন্দীদেরই এখানে রাখা হতো। কেননা এ জায়গাটা দুর্গম, আর ভয়ংকর এখানকার রক্ষীবাহিনী। শুনেছিআন্দামানের সেলুলার জেলের পরেই ছিলো এর কুখ্যাতি।

  যাই হোক আমরা প্রথমে গিয়ে পৌঁছলাম রাজাভাতখাওয়া গেস্ট হাউসে। সেখানে একরাত কাটিয়ে পরের দিন সকালে প্রাতরাশ সেরেই বেরিয়ে পড়লাম বক্সাদুয়ারের উদ্দেশ্যে। রাজাভাতখাওয়ার কাছেই সান্তালাবাড়ি। সেখানে পৌঁছে আর একদফা চা খাওয়া হলো । সেখানে শুনলাম, পাশেই যে রাস্তাটা চলে গেছে বক্সাদুয়ার সে রাস্তায় খানিক গিয়েই আমাদের গাড়ি থামাতে হবে। কারণ ওই অবধি গাড়ি যাবে, তার পরের ওই পাহাড়ি দেড়দুমাইল রাস্তা স্রেফ পদব্রজেই যেতে হবে। পাহাড়ি রাস্তায় অতখানি হাঁটতে পারবো কিনা জানিনা, তাও উত্‌সাহভরে চলতে শুরু করলাম সবাই মিলে।  

  এই রাস্তা কিন্তু বড় সুন্দর। একেবারে সবুজেসবুজ বনভূমি। খুব বেশি খাড়াই উত্‌রাই নেই। মাঝে মাঝে ছোট ছোট সাঁকো সেতু। আমরা সেই সেতুর ওপরে বসে খানিক বিশ্রাম নিয়ে আবার চলতে শুরু করি। আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছিলো এখানে প্রচুর পাখী দেখে। কত নাম না  জানা পাখী দেখলাম। যেতে যেতে দেখা পেলাম একটা গাছের গায়ে ঝোলানো একটা লাল রঙা ডাকবাক্সর। যেন আমাদের ফেলে আসা জীবনের প্রতিভূ। সেখানেই ছোট্ট চায়ের দোকান। সেখানে বসে চা খেয়ে আবার চলতে শুরু করলাম। এইভাবে পৌঁছে গেলাম বক্সাফোর্টে।   

সেখানে পৌঁছে হলো এক অন্য অনুভূতি। এই দুর্গম জায়গায় এইভাবে এখানে বন্দীদের রাখা হয়েছিলো।   কত কষ্ট পেয়েছে যে তারা সে কথা ভাবলেই কষ্ট হয়। শুনলাম এই দুর্গটা নাকি আগে বাঁশের ছিলো, পরবর্তীতে বৃটিশরা এটিকে পাথরের দুর্গে রূপান্তরিত করে। শুনেছি এখানে নাকি নেতাজী সুভাসচন্দ্রও বন্দী জীবন কাটিয়েছেন। পরবর্তীকালে কমুনিষ্ট বিদ্রোহীরাও এইখানে বন্দী ছিলেন। কবি   মুখোপাধ্যায়,বিনয় চৌধুরি প্রমুখ সব বন্দীরা এখানে ছিলেন।

একবার এখানকার বন্দীরা সবাই মিলে রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন করে। রবীন্দ্রনাথ সে সময় ছিলেন দার্জিলিং-এ। উনি একথা জানতে পেরে তার প্রত্যুত্তর দেন এইবলে,’’অমৃতের পুত্র মোরা কাহারা শোনালো বিশ্বময়, আত্ম বিসর্জন করি আত্মারে কে জানিলো অক্ষয়’’।  কালো গ্রানাইট পাথরের স্তম্ভে উত্‌কীর্ণ করা আছে তাঁর বাণী। আমরা আমাদের সকল শ্রদ্ধা অবনত মস্তকে জানিয়ে  বিদায় নিলাম। আরও একটু থাকার ইচ্ছে ছিলো। কিন্তু আবার ওই অতোটা পথ হেঁটে যেতে হবে, আসার সময় দেখার উত্‌সাহে এসেছি, যাবার সময় সে উত্‌সাহে ভাঁটা থাকবে,আর আমরা ক্লান্তও, সময় বেশি লাগবে খানিক। ওদিকে দিনের আলো নিবে গেলে হবে আর এক বিপদ।  তাই আর দেরী না করে আবার রওনা দিলাম ফেরার পথে। সঙ্গে নিয়ে এলাম এক অমলিন স্মৃতি যা কখনও ভুলে যাবো না।   



শিল্পী- বাবুল মল্লিক 



ছন্দে ভাসি 

 শীত এলে

 নিতাই দে
    
 ফুলের হাসি রাশি রাশি
      হলুদ সর্ষে ক্ষেতে--
 মৌমাছিদের আনাগোনা
       ফুলের মধু খেতে।

 খেজুর গাছে হাঁড়ি বাঁধে
      পাড়ার শিউলি কাকা,
 দিনের আলো নিবু নিবু
      কুয়াশাতে ঢাকা।

 রবি চাষে মাঠ ভরেছে
    গোলায় উঠেছে ধান,
 গুড় পাটালি পিঠে পুলি
      পৌষ পার্বণের ঘ্রাণ।

মিঠে রোদে মাদুর পেতে
   অংক গুলো কষি 
 সার্কাস খেলা শীতের মেলা
    নিয়ে যাবে পিসি।

 আমার ক্লাশে বন্ধু আছে
    পড়াশোনায় ভাল,
 কাজ না করে পেট চলে না
      ইস্কুল ছেড়ে দিল!

 শীত এলে সে নাড়া তোলে
       আগুন পোহায় রাতে,
 জীবন যুদ্ধে নিশি কাটে
        হাড় কাঁপানো শীতে।

 খালের ধারে বসত করে
      ছোট্ট কুঁড়ে ঘরে,
 বন্ধুর কথা মনে এলে
    মনটা কেমন করে।




 মাঘের শীতে ----
   বুলবুল দে


মাঘের দিনে শীতের বুড়ি দুষ্টুমি তুই করিস ভারি,
সাদা ঘোমটায় মুখটি ঢেকে ঘাপটি মেরে থাকিস; 
সূয্যি মামার সাথে খেলিস যখন তখন লুকোচুরি,
দুষ্টু খুকু রাগকরে তাই জানায় আমায় নালিশ।

কনকনে তুই শীতের বুড়ি খনখনে তোর তীক্ষ্ণগলা,
শনশনে হিম হওয়ার পিঠে চেপে আসিস ভেসে ;     
খামচে ধরিস যখন তখন সকালসন্ধ্যা রাত্রিবেলা,
হি হি করে ফোকলা দাঁতের শীতল হাসি হেসে।

লেপকম্বল জড়িয়ে ধরে খুকু বলে মিহি সুরে,
কুয়াশা ভরা ধুয়াশা সকাল মা, অঙ্ক থেকে কঠিন ;
তবুও যে মা স্নেহ ভ'রে বলেন তারে কোলে করে,
ছাড় দিয়েছি দুদিন আজ মানতে হবে রুটিন ।

উঃ লাগে মা ঠোকাঠুকি কেন এত দাঁতে দাঁতে ?
হাত ঠকঠক পা ঠকঠক কেঁপে বলে খুকি ;
বায়না করে চায়না করতে দাঁতন সে যে প্রতি প্রাতে,
তবু কি স্কুলে যেতেই হবে পরে মাংকি টুপি !

মাঘের শীতে বাঘে কাঁপে, কাঁপে বাঘের মাসি পিসি,
থরথরিয়ে কাঁপে শহর-গ্রামের নর নারী ;
আকাশ কাঁপে বাতাস কাঁপে,কাঁপে জগৎ দিবানিশি,
এই কাঁপুনি থামাতে মা আসবে সে কোন পরী ?

শিয়রে মরণ বুঝেই বুঝি এমন মরণ কামড় মারিস,
মারণ এ শীত চায়না খুকু আর যে কোনও মতে ;
এবার তুই নে না বিদায় পরের বছর আবারআসিস,
রোদ ঝলমল কোমল রূপে খুকুর বন্ধু হতে।



বাংলাদেশ
রেজাউল করিম রোমেল 

সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা
আমার বাংলাদেশ,
আমাদের এই বাংলাদেশে
রূপের নেইকো শেষ।

ধনী গরিব জেলে চাষি
সবার বাংলাদেশ,
গর্বে আমার বুক ভরে যায়
এটাই আমার দেশ।

রক্ত দিয়ে জয় করেছি
সোনার বাংলাদেশ,
এগিয়ে যাচ্ছে দেশটি আমার
দেখতে লাগে বেশ।


শীত ও নিদ
মজনু মিয়া 

তীব্রতা বেড়ে গেলে নিদ হারা রজনী শীতের কাছে
চোখে কাঁপন দেখায় প্রকৃতির মাটি গাছপালা যাচে।
কুকুর শেয়ালের হাউমাউ কান্না শুনি প্রহরে প্রহরে 
ঝাপসা মাঠের পরে বিন্দু বিন্দু জলের ফোঁটা ঝরে।

এপাশ ওপাশ করে রজনী পার করার চেষ্টা কেবল
ঠাণ্ডায় আকুতি মিনতি বুঝে না সর্বত্র তার দখল।
খাটাখাটুনি মাঠের পরে কৃষক কৃষাণী জবুথবু হয়
তারপর রজনী যেন নিদারুণ এক নিষ্ঠুর সময়!




থুত্থুরে বুড়ি
মনোমিতা চক্রবর্তী

এক যে ছিল  থুত্থুরে বুুড়়ি  
ধামা ধামা ভাজতো শুধু মুড়ি।
বেঁচত হেঁকে সুর করে,
রোজ সকালের রোদ্দুরে ।

তিন কুলে কেউ নেই যে বুড়ির 
নাতি - পুতি, ছেলে ।
মুড়ি ভেজে খায় সে,
বাঁচে মাথা তুলে।
 
টানা টানা চোখ তার 
দাঁতগুলো নড়বড়ে,
মাথা ভরা সাদা চুলে 
লম্বা বেনুনি ঝোলে ।

চোখের জলে জানায় বুড়ি
তার জীবনের গল্প,
ছোট্ট হলেও তার গল্পটা ভাই
আস্ত এক মহাকাব্য।

কম বয়সে বুড়ির নাকি 
বিয়ে হয়েছিল।
আধমরা এক বুড়ো বরকে 
কে যে জুটিয়ে ছিল ?

বছর দুয়েক যেতে না যেতেই 
বুড়ো গেল মরে।
সেই থেকে থুত্থুরে বুড়ি, 
একাই কাজ করে। 

জীবনটা তার বড় দুঃখের 
 পায়নি কোন সুখ ।
আত্মীয়-স্বজন যে যা ছিল ,
সবাই  ফিরিয়েছিল মুখ।
 
সেই থেকে থুত্থুরে বুড়ি 
ভাজতো যে মুড়ি ,
মুড়ি বেঁচেই চালাতো  সে ,
তার আপন জীবন তরী।

 বুড়ির হঠাৎ শরীর খারাপ 
হাঁটে আস্তে ধীরে।
শুয়ে বসে কোন রকমে ,
 দিন  কাটে বিছানাতে ।

কাল সকালে মায়ের কাছে
বুড়ির কথা বলতেই,
মা বললো আর নেইকো বুড়ি 
এই মহাবিশ্বে।
বুড়ি নাকি ঘুমিয়ে আছে ,
তারার দেশে ।

হঠাৎ করে থুত্থুরে বুড়ি 
দিল কোথায় পাড়ি ?
এই বিশ্বে আর নেইকো বুড়ি,
বৃথায় খুঁজে মরি ।





খামার
মুহাম্মদ আলম জাহাঙ্গীর

অট্রালিকায় করি যদি
পশু-পাখির খামার,
তার আমিষে পূরণ হবে
দেহ তোমার আমার।
হাইব্রিড পশু-পাখির ছানা
লিফট ও সিড়ি করে,
উঠাই রুমে ইচ্ছে মতো
শত তালার পরে।
ফিড ভুষি আর কুঁড়ো খাইয়ে
মোটাতাজা করি,
পশু-পাখি বিক্রি করে
দু্-হাত টাকা ভরি।
পশু-পাখি করলে পালন
অট্রালিকার মাঝে,
অধিক ভূমি লাগে না,রে
সময় বাঁচে কাজে।
ভবন মাঝে আমরা যদি
সেচ্ছাই করি খামার,
ধনী গরীব সুখে রবো
বরষা কিংবা সামার।।



শিল্পী- বাবুল মল্লিক 




ব্যক্তিগত গদ্য  

তুমি ফিরে এসো মহারাজা,তোমার আসন আজও শূন্য
বটু কৃষ্ণ হালদার

তোমরা আমায় রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেবো
 
এই ছিল তোমার উক্তি 
ভারত বর্ষ স্বাধীন হল কিন্তু মিললো কি তোমার যুক্তি? 
যে অখণ্ড ভারত গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলে,তা অধরা রয়ে গেছে সুপ্ত হৃদয়ের মাঝে।
এখন ও মাঝে মাঝে দুর হতে ভেসে আসে, সেই চেনা প্রতিবাদী গান টা,"_মাগো ভাবনা কেন/
আমরা তোমার শান্তি প্রিয় শান্ত ছেলে/ তবু শত্রু এলে অস্ত্র হাতে ধরতে জানি/ তোমার ভয় নেই মা/
আমরা প্রতিবাদ করতে জানি।

সত্যই কি এই সময় আমরা প্রতিবাদ করতে জানি?  
না কি আজ ভুলে গেছি প্রতিবাদের ভাষা? 
তুমি দেশ ছেড়ে যাবার পর প্রতিবাদের ভাষা, 
মানচিত্রে মুখ থুবড়ে পড়েছে, 
প্রতিবাদীদের শীরদাঁড়া ভেঙে দেওয়া হয় প্রকাশ্যে,  
নয় তো বুলেটের গুলিতে বুক ঝাঁঝরা করে দেওয়া হয়। 
সেই  রক্তে হাত রঙিন করে খেলা হয় রঙিন বসন্তের দোল 
তুমি ফিরে এসো হে বীর,অসীম,অনন্ত নীলিময়  নীল হয়ে।
মিথ্যা স্বাধীনতার নামে কিছু স্বার্থবাদী বর্বর অসভ্য নোংরা ছেলে জুটে 
তাদের উত্তর সুরীরা আজ দেশের সম্পদ খাচ্ছে লুঠে পুটে।
ভারত চীন,জাপান,জার্মান ঘুরে চলে গেছো আজ তুমি বহুদূরে 
ফিরে এলে নাতো আর
আজকে যা কিছু আঙুল দিয়ে ছুঁয়েছি,উপভোগ করছি
মিছে নয় সবই কিছু তোমার সিংহ দুয়ার।তাই 
তোমাকে যে ফিরে আসতেই হবে 
 কারণ তোমার সিংহাসন আজও শূন্য 
আমরা যারা তোমায় ভালো বাসি,তোমার নামে মালা জপি সন্ধ্যা সকাল, 
আমরা যারা তোমায় বিশ্বাস করি
তুমি অমর,তুমি আবার আসবে ফিরে স্বমহিমায়, সশরীরে, বীর বিক্রমে
তোমাকে যে আসতেই হবে ফিরে এই জরা জীর্ণ বঙ্গে
তোমার মৃত্যু আমরা মানি না,
কেঁদে কেঁদে চোখের জল শুকিয়ে গেছে,বঙ্গ জননী, 
আজও দুয়ারে দাঁড়িয়ে,তোমায় বরণ করবে বলে প্রদীপ খানি জ্বালিয়ে রোজ অপেক্ষা করে।
নগরের  প্রান্ত হতে ও প্রান্ত ঘুরে বেড়ায়, প্রতিটি অলিগলি, রাজপথ, ওই ঘুমন্ত ফুটপাথ বাসি,উলঙ্ পথ শিশুদের অনাহারে মৃত্যুর পরোয়ানা জারির মাঝে।
স্বাধীনতার এতগুলো বছর পরে রক্ষকরা আজ ভক্ষক হয়ে উঠেছে
সভ্যতা,সংস্কৃতি আইন কানুনকে বিসর্জন দিয়েছে পচা নর্দমার জলে
নিজেরাই আজ পুতুল নাচের আসরের বিধাতা
দেশটাকে বিলিয়ে দিতে চলেছে বৈদেশিক মুদ্রার প্রলোভনে।
চলেছে আখের গোছানোর 
প্রতিযোগিতার লড়াই
তবে তুমি কেনো আজ মুখ লুকিয়ে রাখবে?
কি ছিল তোমার অপরাধ?
জানতে চায়নি কেউ কোনোদিন
কেনো? 
কিসের ভয়ে তোমাকে রাষ্ট্র সঙ্ঘের হাতে তুলে দেবার প্রতিশ্রুতির সময় ১৯৯৯ টা কে বাড়িয়ে ২০২১ করা হয়েছে? 
প্রশ্ন করেনি কেউ,
তবে জাপানের তাইহোকু বিমান বন্দরে বিমান দুর্ঘটনায় তোমার মৃত্যুর রহস্য,এই সব যে মিথ্যা, বুজরুকি, ছেলে ভোলানো,সাজানো নিছক কাহিনী তা আমার মনে প্রাণে বিশ্বাস করি।
বর্বর স্বার্থবাদীরা তো ভয় পাবেই
,যদি স্ব মহিমায় ফিরে আসো আবার তবে মিথ্যা হয়ে যাবে এই সব ইতিহাস,মহিমা  মাটির ধুলায় লুন্ঠিত হবে,গৌরব অধ্যায়  ম্লান হয়ে যাবে।
কারণ তুমি তো শিখিয়েছো, অত্যাচারীরা ভয় পাবে আর প্রতিবাদীরা শির দাঁড়া সোজা করে থাকবে।
কেঁচো খুঁজতে খুঁজতে কেউটে সাপ  বেরিয়ে আসবে
বন্ধ হয়ে যাবে ছলনাময়দের ছল,চাতুরি,বুজরুকি মিথ্যা সাজানো ব্রজবুলি
বন্ধ হয়ে যাবে নোংরা রাজনীতির নামে লুঠ পাঠের খেলা
কুসংস্কারের আছন্ন থেকে মুক্তি পাবে এই সমাজ
 আবার নতুন আন্দোলনের জোয়ার আসবে 
অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে জেগে উঠবে যুব সমাজ
তারই তো ভয়,এই ভয়, মিথ্যাটা কে সঙ্গী করে বয়ে নিয়ে চলেছি যুগের পর যুগ
বিশ্বাস করি তুমি আসবে ফিরে স্ব_মহিমায়, স্ব_ শরীরে
তুমি বীর, অসীম, অনন্ত
তুমি ফিরে এসো  বঙ্গ ললনার বুক চিরে,কালো আঁধারে ঢাকা আকাশকে কঠিন বজ্রের দ্যুতি দিয়ে
তছনছ করে দাও আধারের বেড়াজাল।
তুমি ফিরে এসো  ছত্রপতি শিবাজির তরবারি হয়ে
তুমি ফিরে এসো হে সত্য,ন্যায় এর তরবারি হয়ে 
বন্ধ করে দাও সবার চক্রান্ত, রক্তে রাঙানো হোলি খেলা
রোজ রোজ তাজা তাজা রক্তে রঙিন হয়ে ওঠে কাঁটা তারের বেড়া 
হাজারো মায়ের চোখের জল মুছিয়ে দিতে তুমি আবার আসবে ফিরে
তুমি ফিরে স্বার্থান্বেষী তুঘলকদের আত্ম অহংকার  ধ্বংস করে নব বধূর বেশে সাজাবে
যে দেশটাকে মায়ের,ভাইয়ের,বোনের ভালোবাসা দিয়ে গড়ে তুলতে চেয়েছিলে।
সত্য ন্যায় দিয়ে মুড়ে দাও,আমরা তার জীবন্ত সাক্ষী হয়ে থাকবো,তোমার হাতে ধ্বংস হয়ে পাপ মোচন করে নেবো।
সোনালী রঙিন খামে মোড়া চিঠি দিও,মেঘের ঠিকানায়/নয়তো দখিনা বাতাসের হাত দিয়ে
আমরা থাকব তারই অপেক্ষায়,
হয় তো কোনো এক রঙিন বসন্তের সকালে 
তুমি এসে দরজায় টোকা দিয়ে বলবে
ওঠো, জাগো আমি এসেছি ফিরে তোমাদের মুক্তি দাতা হয়ে।।

যারা নেতাজি সুভাষকে ভালোবাসেন,তারা আমৃত্যু ভগবান নেতাজির জন্য অপেক্ষা করেছিল করছে এবং আগামী ভবিষ্যতেও করবে।কারণ তিনি সূর্যের ন্যায় সত্য। ব্রিটিশদের দালালি করবে না বলেই আইসিএস পদত্যাগ করে ও জীবনের সিংহভাগ দেশের স্বার্থে বিলিয়ে দেওয়ার পরও তাকে শুনতে হয়েছিল কলকাতা কর্পোরেশন তাকে নাকি আইসিএস এর থেকেও বেশি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে সাহায্য করেছে।কিন্তু আমরা জানি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস মানেই আত্মত্যাগ। তাই নেতাজি প্রেমীদের কাছে কয়েকটা প্রশ্ন এই জানুয়ারি মাসেই তুলে ধরা হলো, আমরা বাঙালি রাই নেতাজি সুভাষ বস কে কতটা মূল্যায়ন করতে পেরেছি? আর যদি করে থাকি তাহলে নেতাজি ভক্তদের বাড়িতে তাদের ছবি কেন টাঙ্গানো হয় যারা নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোসকে একেবারে আঁধারে  ঠেলে দিয়েছিল?

দ্বিতীয়তঃ সুভাষ ঘরে ফিরে নাই,নাকি সুভাষকে  ঘরে না ফেরার জন্য সুভাষ বিদ্বেষী মানুষদের সঙ্গে কোন বাঙালি কি জড়িত ছিল না?নেতাজি,আবেগ,বিশ্বাস, তাই এখনো চারিদিকে কান পাতলেই শোনা যায় তিনি নাকি ভারতবর্ষেই ছিলেন বহু বছর তাহলে আমরাই তাকে চিনতে পারি নি কেনো?তিনি কেনো স্বাধীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে স্বীকৃতি পেলেন না?আর কেনো বা তিনি জাতির জনক নন?আজও কেনো ভারতের সব টাকায় তার ছবি নেই? এ সব কিছুর তো একমাত্র ন্যায্য দাবিদার হলেন বাংলার অগ্নি সন্তান,ভারতের মুক্তি সূর্য নেতাজি সুভাষের।

যিনি অনুশাসিত এবং সংস্কৃত; যার ব্যক্তিত্ব আছে, তিনিই নেতা। সবাই 'নেতা' নন, কেউ কেউ নেতা। সংগঠনের অনুশাসন মেনে চলতেই হয়,শৃঙ্খলা জরুরি।কিন্তু নিজের ব্যক্তিত্ব যদি না থাকে,যুক্তি-নিষ্ঠার অতল গভীরে যদি রাষ্ট্রবোধ না থাকে,তাহলে তার/তাদের উপর চেপে বসতে পারে ভ্রান্ত নির্দেশ।সৌকর্যের সঙ্গে দিকভ্রান্তি সরানোর নামই 'চরৈবেতি'।সবচেয়ে বড় কথা,মানুষের মধ্যে যতটা সম্ভব খাঁটি প্রভাব বজায় রাখা।কেউ কাউকে শূন্যতা থেকে নেতা বানিয়ে দিতে পারেন,কিন্তু নিজস্বতা ও সংগঠন-সততা না থাকলে সেই নেতৃত্ব আদৌ ধরে রাখা যায় না।নির্মোহ হয়ে পদ চালানো যে সহজ নয়,এটা আগে নিজেকে বুঝিয়ে তবে রাজনীতিতে আসতে হবে।কার্যকর্তাকে ভুল বোঝার সম্ভাবনা যেমন থাকে,ভুল সংশোধন করার ক্ষমতাও জন্মায় তার নেতৃত্বের সদর্থকতার গুণে। সব নেতাই 'নেতা' নয়।তবে বর্তমান সময়ে এখন নেতা হতে গেলে শিক্ষা,আদর্শ,নীতির দরকার হয় না।তাই তো নেতাজি নামক শব্দটি মরশুমের ফল ফুলের মত একেবারে শেষ হয়ে যায়নি, তিনি যুগ যুগ ধরে আলোচিত গবেষণার বিষয় ছিল আছে এবং থাকবে।

"বহু আগে একটা কথা প্রচলিত ছিল - ইংল্যাণ্ড নাকি ভয় পায় না, অন্যায় করেও নতি স্বীকার করে না, ক্ষমা চায় না ।কিন্তু একমাত্র নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু সেই নেতা তিনি অন্ধদের চোখেও আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন, ইংল্যাণ্ডের গালে কষে চড় দিতে পারলে তবেই সে ভয় পায়,অন্যায়ের ক্ষমা চায়, তার আগে নয়"।

সবথেকে লজ্জাজনক বিষয় হলো এই বাংলায় মহাসমুদ্রের মত কানায় কানায় আদর্শে পরিপূর্ণ মানুষটি ভোট ব্যাংকের স্বার্থে ব্যবহৃত হয়।নিজেদের নেতা মনে  করা অযোগ্য ব্যক্তিরা  ২৩ শে জানুয়ারি এলে রাজনৈতিক মঞ্চে দাঁড়িয়ে মূর্তিতে মাল্য দান করে। কারণ এই ২৩ শে জানুয়ারি এলে বহু জায়গায় শাহজাহান শেখদের মত নেতাদের আমন্ত্রণ করে নিয়ে যাওয়া হয়।এ সব আমরাই বাঙালিরাই মেনে নিয়েছি। ভোট ব্যাংকের স্বার্থে তাকে নিয়ে কিভাবে ব্যবহার করতে হয় তা চোখে আঙ্গুল দিয়ে আমরাই সমগ্র ভারতবর্ষের মানুষকে শিখিয়েছি। ভারতীয়দের দোষ দিয়ে লাভ কি? আপনি যদি সত্যি বাঙালি হন তাহলে আপনার বিবেককে প্রশ্ন করুন আমরা কতটুকু তাকে মূল্যায়ন করেছি? কতটুকু ভালোবেসেছি অন্তরে দেবতাকে? কারণ ওই মানুষটাই আপনার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় হয়ে উঠুক সেটাই চেয়েছিলে। অথচ সেই মানুষটাকেই আমরা অন্ধকারে ঠেলে দিলাম?





নতুন হাতে 

যৌতুক
প্রিয়াংকা নিয়োগী

বিয়ের দিন ঠিক করতে এলো পাত্রপক্ষ। অপেক্ষার তিন ঘন্টা পরে । দুপুর দুটোয় আসার কথা অর্থাৎ সময়ের থেকে তিনঘন্টা পরে পাঁচটায় আসে।

অলীক বাবুর মধ্যবিত্ত পরিবার।তার মধ্যেই বড়ো মেয়েকে বিটেক পড়াশোনা করিয়েছেন।ছোটো মেয়ে মাস্টার অফ সাইন্সের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী।বড়ো মেয়ে বেসরকারী কম্পানিতে চাকরিও করে।কথা আছে বিয়ের পর চাকরি ছেড়ে বরের ওখানে গিয়ে চাকরি করবে।

বড়ো মেয়ের নাম মনোনিতা। তারই  আজ বিয়ে ঠিক হবে। ছোটো মেয়ে আকাশী। সে সময়মতো তৈরী হয়ে গেছে। অলীক বাবু বড়ো মেয়ের বিয়ে ঠিক হবে উপলক্ষ্যে সব আত্মীয় প্রতিবেশীদেরই নিমন্ত্রণ  করেছেন। তাই বাড়ি জমজমাট। এবার কথা বার্তা নিয়ে বসলো দুপক্ষ‌ । অর্থাৎ দাবি দাওয়া নিয়ে কথা বলছিলো দুপক্ষ। ছেলে কেন্দ্রীয় সরকারী অফিসার। তাই ছেলের যৌতুক তো লাগবেই বলে বসল পাত্রের বাবা। অলীক বাবু বললেন, `এমন তো কোনো কথা ছিলোনা যৌতুক নেওয়া হবে।` পাত্রের বাবা বললেন, `সে আবার বলতে হবে নাকি  দাদা! আমার ছেলে এম.কম, কেন্দ্রীয় সরকারী চাকরি। ছেলে বিয়েতে অনেক কিছু পাবে সে তো সহজ কথা।` পাত্রের মাও মুখ নেড়ে সম্মতি জানান। পাত্র পক্ষ থেকে যে আটজন এসেছিলেন প্রত্যেকেরই মুখে একই ছাপ। সবুজা দেবী বললেন ঠিক কি কি চাই এই বিয়ে হওয়ার জন্য। ছেলের জেঠু বললেন তিন লাখ টাকা, জেঠিমা বললেন আসবাবপত্র কাঠের দেবেন। ছেলের কাকু বললেন ছেলেকে হাতে সোনার ব্রেসলেট‌ ও সোনার চেইন দিয়ে আশীর্বাদ করতে‌ হবে। এছাড়াও মেয়েকে সোনাদানা সেন্কো গোল্ডের থেকে দিতে হবে। আর ছেলের পিসি বললেন বাড়ির প্রত্যেকের জন্য যে প্রণামী পাঠাবেন তা যেন ব্র্যান্ডেড হয়। এই সমস্ত কথা চুপ করে শুনছিলেন মনোনিতা। তার মনে হচ্ছিলো তার কোনো মূল্য নেই এই লোকদের কাছে। তার বাবার প্রতি যে চাপ ছেলের বাড়ি তৈরী করছে তা মনোনিতার কাছে অপমান ও নিজেকে মূল্যহীন‌ মনে হচ্ছিলো। তার নিজেকে নীচু মনে হচ্ছিলো । আর নিতে পারছিলো না তাকে নিয়ে যে দর‌ কষাকষি চলছিল। ছেলের জেঠু বলছেন বিয়ের আগের দিন সমস্ত কিছু পৌঁছে দিতে। অলীক বাবুর এক প্রতিবেশী আরেক প্রতিবেশীকে ঈশারায় বলছে, `দেখ ছেলের বাড়ির দাবীর বাহার।` আত্মীয়রাও একে অপরের দিকে সুযোগ পেলেই তাকাচ্ছে। পাত্রী পক্ষের সবার মুখই শুকিয়ে গেছে। এরপর ছেলের পিসেমশাই বললেন, `একটা চারচাকা দিলে ভালো হয়। আপনাদের মেয়েই তো চড়বে।` এই বলতে বলতেই নুপুরের শব্দ।সবাই দেখলো মনোনিতা প্রবেশ করেছে। অলীক বাবু ও সবুজা দেবী সহ প্রত্যেকেই অবাক। অলীক বাবু বললেন, `কি রে মা !`

ঘরের প্রত্যেকেই চুপ। মনোনিতা পাত্রপক্ষের কাছে জানতে চাইল, `আপনাদের লিস্টে আর কি কি আছে দাবীর ?`

মনোনিতার এমন রূপ দেখে পাত্রপক্ষ কিছুটা অবাক হল। পাত্রের মা বললেন, `সেগুলি নিয়ে তো তোমার বাবার সাথে কথা হচ্ছে।  তুমি এসেছো কেন মা এগুলা জানতে?` 

       মনোনিতা বলল, `বা রে আমার জন্য চাইছেন, আমাকে বিষয় করে চাইছেন আমি আসবো না এগুলোর মধ্যে? আর আপনাদের চাওয়া হয়ে গেলে তো এরপর আমাদের পাত্রীপক্ষের দাবী চাওয়া শুরু হবে।` এবার বুঝতে পারলো আকাশি তার দিদির পাত্রপক্ষের মুখোমুখি হওয়া। দিদিকে সঙ্গ দিতে আকাশিও এসে দিদির পাশে দাঁড়ায়। পাত্রীপক্ষ থেকে শুরু করে পাত্রপক্ষ সবাই সঙ্গে সঙ্গে তৈরী হয়ে গেলো শোনার জন্য। পাত্রী পক্ষের লোকজনদের বেশি কৌতুহল মুখের মধ্যে ফুটে উঠল।পাত্রপক্ষ বুঝতে পারল তাদেরও বেকায়দায় ফেলা হবে।

আকাশি পাত্রপক্ষের কাছে জানতে চাইলো, আপনাদের শেষ হোলো না আরও বাকি আছে চাওয়ার?`
মেয়ের এমন রূপ  দেখে কিছুটা লজ্জা পাচ্ছিলেন মনোনিতার বাবা । কারণ সমাজে এমন‌ কখনও হয়নি যে, পাত্রী চলে এসেছেন কথা বলতে তার বিয়ের ব্যাপারে।

অলীকবাবু বললেন,  `তোরা যা মা এখান থেকে।` 
- কথা বলতে এসেছি যখন কথা হয়ে যাওয়ার পরেই যাবো। বাবা তোমরা এখন আর কোনো কথা বলবে না। যা বলার আমি আর দিদি বলব যতক্ষণ আমাদের হিসেব না মিলবে।

পাত্রী পক্ষের প্রতিবেশীদের কেউ নাক সিটকানো মিচকি হাসছে। আত্মীয়রা তৈরী দুই বোনের কীর্তি দেখার জন্য। পাত্র পক্ষ তৈরী তাদের কথা শোনার জন্য।

মনোনিতা বলল, `আপনাদের শেষ নাকি আরও বাকি আছে?`

সবুজা দেবী আর কথা বাড়ালেন না। সমস্তটাই মেয়েদের উপর ছাড়লেন। আকাশী বলল,
-  এখন  শুধুই দুবোন কথা বলব।আর পাত্রী পক্ষের প্রত্যেককে অনুরোধ করবো আমাদের কথার মাঝে কথা বলতে না। এমন কি মা-বাবা তোমাদেরও অনুরোধ করব আমাদের দুবোনের কথা শেষ না হওয়া পর্যন্ত না।
ছেলের বাড়ির থেকে বলল, `আমাদের দাবী শেষ হয়ে গেছে।`
আকাশি বলল, `এবার তো আমাদের পালা।`
মনোনিতার হাত থেকে কাগজের লিস্টটা নিয়ে সে বলে চলল, `আমাদের বি.টেক মেকানিক্যাল ইন্জিনিয়ার, প্রাইভেট চাকরি করা পাত্রীর জন্য চাই ডায়মন্ডের জরোয়া সেট,আংটিটাও ডায়মন্ডের লাগবে, আর গাড়িটা  মার্সিডিজ হলে ভালো হয়,আপনাদের ছেলেই তো চড়বে। আর এই ইন্জিনিয়ার পাত্রীর জন্য একটি ফ্ল্যাট‌ লাগবে, আর এই ফ্ল্যাটে তো আপনার ছেলেও থাকবে। আশা করি আপনারা ভালো ফ্ল্যাট দেবেন। আর অবশ্যই প্রণামী যা পাঠাবেন তা কোনো নামকরা বা সেলিব্রিটি ডিজাইনারের ডিজাইন করা পাঠাবেন, যাতে আমাদের আত্মীয়দের কাছে আমাদের মুখ থাকে।` 

এই শুনে পাত্রপক্ষের চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে। তারা বুঝেছিলেন দুই বোন তাদের টাইট দিতে এসেছে। কিন্তু এমন টাইটের মুখে পড়বেন তা কল্পনাও করতে পারেননি। একই দশা হোলো পাত্রের বাবার। হ্যাঁ বা না কিছুই বলতে পারছেন না। একটু আগে পাত্র পক্ষের দাবী ঘোষণার চাপ যেভাবে পেয়েছিলেন অলীক বাবু। ঠিক একই পরিস্থিতি পাত্রের বাবার। এতগুলো লোকের সামনে না বলাটাও একটা লজ্জার ব্যাপার। 

           পাত্রপক্ষের পরিস্থিতি দেখে মনোনিতার হালকা লাগছে নিজেকে। তারও দাম আছে, সেও  ফ্যালনা নয়। নিজেই বলল সে, `আমি অলীকবাবুর বড়ো মেয়ে অর্থাৎ আমি মনোনিতা পাল কোনো ফ্যালনা নয়। ছোট থেকেই প্রতিটি ক্লাসে প্রথম হয়েছি। এখন উপযুক্ত হয়েছি। একজন কেন্দ্রীয় সরকারী অফিসারকে বিয়ের জন্য যদি আমার বাড়ির থেকে পণ দিতে হয়, তাহলে আমাকে বিয়ে করতে‌ হলে পাত্রপক্ষকেও  পণ দিয়ে বিয়ে করতে হবে। পাত্রের দাম থাকলে পাত্রীরও মূল্য আছে। 

                এসব কথা শুনে পাত্রের মা থতমত হয়ে‌ গেলেন। পাত্রের বাবা বললেন, `আজ চলি আমরা।গিয়ে ভাবতে হবে। ` পাত্রপক্ষ বের হয়ে গেল। আত্মীয়দের অনেকেই বলাবলি করছিলেন যে ঠিকই আছে। অনেকে একে অপরের কানে ফিসফিস করছিলেন বাবাগো মেয়েগো। এমন করলে আর বিয়ে হবে না। 
অলীক বাবু বললেন, `মা রে তুই এ কি করলি । আমি যেমন করেই হোক চেষ্টা করতাম।` 
মনোনিতা বলল, `থামো তো । তুমি একা কেন চেষ্টা করবে, তারাও চেষ্টা করুক। আর যদি পণ  দিয়ে‌
বিয়ে করতে হয়,তাহলে আমিও পণ  নিয়ে বিয়ে করব। এই বলে রাখলাম। যদি মেয়েকে কিছু দিতে হবে ইচ্ছে হয়, সেটা দিও। কিন্তু কারোর কথায় নয়।`


রাজা ও তার পুত্ররা
দেবারতী দে (বয়স ৬) 


এক দেশে এক রাজা থাকত। তার দুই পুত্র ছিল। তাঁরা সবসময় ঝগড়া করত। তাই রাজা খুব দুঃখ পেত। তারপর একদিন সে তার পুত্রদের ডেকে বলল,বাবারা দেখো এখন তুমি আমাদের সাথে এমন করছ, এরপর তোমরা বাইরের লোকেদের সাথে ঝগড়া করবে। তখন তারা সব বুঝতে পেরে ক্ষমা চাইল।

(কোনো বাড়তি সংযোজন হয়নি)



মুজনাই অনলাইন মাঘ সংখ্যা ১৪৩০