ভাষা আন্দোলন সঞ্জয় সাহা প্রতিটি সকাল উজ্জ্বল হতে থাকে এগারটি স্বরবর্ণ! সারা শরীর জুড়ে ছড়িয়ে চল্লিশটি ব্যঞ্জনবর্ণ! পাখির স্বরে শুনতে পাই য-র-ল-ব ভাষার আন্দোলন রফিক-সালাম-জব্বরের বিদ্রোহ অন্তরে আগুন জ্বলে.... রাস্তায় বরকতের রক্ত ! কপালে গুলিবিদ্ধ রফিক! শৃঙ্খলমুক্ত বর্ণমালা..... স্বাধীন আজ মাতৃভাষা।
Tuesday, February 20, 2024
মায়ের ভাষা
মনোমিতা চক্রবর্তী
বাংলা আমার মায়ের ভাষা
বাংলা আমার প্রাণ ।
বাংলা ভাষায় গাই গো মোরা,
বাংলার জয়গান ।
বাংলা আমার প্রাণের ভাষা
আমার অস্তিত্ব ।
বাংলা আমার অবিচ্ছেদ্য অংশ,
জানে এই বিশ্ব।
বাংলা আমার মায়ের ভাষা
আছে আমার এ ভাষায় বলার অধিকার ।
সহজে ছিনিয়ে নেবে আমার মুখের ভাষা,
এ সাহস কি কারো আছে আর?
বাংলা ভাষা রক্ষার জন্য
যাঁরা সেদিন এগিয়ে এসেছিল
গুলিতে গুলিতে বুক তাদের,
ঝাঁঝরা হয়ে ছিল ।
তাদের জন্যই পেয়েছি আজ
মোদের বাংলা ভাষা,
স্মৃতির মাঝেই আছেন তারা
মিটিয়ে সবার আশা।
একুশে ফেব্রুয়ারি
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়
মর্মে জাগুক একুশ অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী
বাহা বাহা দেখো আমি কত পারদর্শী! বিদেশীতে ডুব দিতে ছিপে গাঁথি বড়শি.. চুরি করি ভিনদেশী কবিতা ও গল্প, নকলনবীস আমি গানে, সুরেও অল্প.. নিপুণ ছকেতে ফেলি চুরি মহাবিদ্যা, টুকে নিতে অনুবাদে আমি স্বয়ংসিদ্ধা.. এতকিছু করি শুধু খেতাবের জন্য, কলার উঁচিয়ে বলি, 'আমি মহামান্য..' আমার বাড়িতে 'মা'- কে 'মাম্মি' বা 'মম' ডাকি, এটাই আধুনিকতা নাহলে লজ্জা নাকি! কাকিমণি,মাসিমণি সব দূর অস্ত, সুমধুর প্রিয় ডাক 'আন্টি' -তে ন্যস্ত.. ঘুম ভাঙে, রাত হয় সবটাই বিদেশীতে, খাবারেও নানা দেশ অনলাইন আদেশেতে.. বুকশেলফ ঠাসা থাকে বিজাতীয় গ্রন্থে, অতিথির মন কাড়ে 'সম্ভ্রম' মন্ত্রে.. নিজের জাতীয় সাজ সখে সাজি কদাচিৎ, কমফোর্ট জোনে থেকে বিদেশীর হয় জিত.. সাইনবোর্ড ঝলমলে ভিনদেশী হরফে, গোটাটাই ফাঁকি শুধু আমাদের তরফে.. একুশ একুশ করে জুড়ি যত হইচই, স্বার্থবাদীর বোলে একুশের ভাষা কই? ছোট থেকে,গোড়া থেকে ঘষামাজা জারি থাক, নিজের মাতৃভাষা ভালোবাসা ফিরে পাক.. আশার আলোর ফাঁকে সোচ্চার সোনারোদ, আবার জন্ম দিক রফিক,সালাম,বরকত
বাংলা ভাষা ও কিছু প্রশ্ন
বিশ্বজিৎ সাহা
বিগত শতকের দুটো উল্লেখ্যযোগ্য ঘটনা বাংলা ভাষাকে বিশ্বদরবারে পৌঁছে দেয়। প্রথমটি রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি গীতাঞ্জলির প্রকাশ এবং দ্বিতীয়টি বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে স্বীকৃতি । ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারী ছিল বাংলা ভাষা নিয়ে বাঙালির আবেগের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশের দিন। ভাষার জন্যও প্রাণ দেয়া যায় সেটা গোটা বিশ্ব সেদিন প্রথম প্রত্যক্ষ করেছিল। ফলস্বরূপ ১৯৭১ এ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলা রাষ্ট্রের জন্ম। ১৯৬১ সালে আসামের বরাক উপত্যকায় অসমিয়ার সাথে বাংলা ভাষাকে সরকারি ভাষার স্বীকৃতি প্রদানের জন্য জোরদার আন্দোলন হয় এবং ১১ জন বাঙালি মৃত্যুবরণ করেন।সেইসব ইতিহাসে ভর করে ইউনেস্কো ১৯৯৯ সালে একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা প্রদান করে।
প্রতি বছর এই দিনটি মহা সমারোহে পালিত হয়। বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা, আলোচনা সভা, নানান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে শুধু সেদিনই আমরা হয়ে উঠি বাঙালি। আর বছরের বাকি দিনগুলোতে? সত্যি কি বাঙালি বাংলা ভাষার জন্য ভাবিত? বাংলা ভাষার প্রতি সত্যি কি বাঙালি কোনো টান অনুভব করে? বাংলাভাষার প্রতি কি সত্যি কোনো দায়বদ্ধতা বাঙালির দছে? বাংলা ভাষা কী আজ বিপন্ন নয়?
আমরা এমন একটি ভাষায় কথা বলি যে, ভাষার অধিকার নিয়ে সংগ্রামে শহিদ হওয়ার ইতিহাস আছে, আছে বিপুল সাহিত্য ও কাব্যের ভান্ডার, আছে অসংখ্য পত্রপত্রিকা ও পুস্তক প্রকাশনী,আছে নিজস্ব সংস্কৃতি, নিজস্ব কৃষ্টি।
উপনিবেশিক বৈদেশিক অনুপ্রবেশ শুধু দেশের মাটিতে হয়নি, তার অনুপ্রবেশ ঘটেছে আমাদের সংস্কৃতিতে আমাদের ভাষায়। সেই থেকে ভাষার বিপন্নতা শুরু। একথা অস্বীকার করা যায় না যে, যুগে যুগে বিভিন্ন বিদেশী ভাষা দ্বারা বাংলা ভাষা অনেক সমৃদ্ধ হয়েছে।
আরবী, পার্সি , ফারসি এসব ভাষার প্রভাব বাংলায় প্রত্যক্ষ। কিন্তু ইংরেজি ভাষা শেখা, বলা এবং ব্যবহার করার মধ্যে বাঙালি যে আত্মশ্লাঘা অনুভব করে সেটা মাতৃভাষার ক্ষেত্রে করে না। তাইতো বাংলা বলা বা লেখার সময় তার মাঝে অনাবশ্যক ইংরেজির ব্যবহার আজ সর্বত্র।ইংরেজি অবশ্যই শিখতে হবে, যেহেতু কর্মক্ষেত্রে সর্বত্র তার ব্যাবহার। উচ্চশিক্ষার সমস্ত পুস্তক ইংরেজিতে, সর্বভারতীয় কোনো পরীক্ষা দিতে গেলে ইংরেজিতে আমাদের নখদর্পণে রাখতেই হবে।কিন্তু সাথে মাতৃভাষা নিয়েও কেনো আমরা ভাববো না?
কেন শিক্ষিত বাঙালি যারা উচ্চ শিক্ষার বই লিখছেন তারা বাংলায় লিখবেন না, কেন শুধু মাত্র বাংলা ভাষার একটি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠে না, কেন সরকারি কাজে বাংলা ভাষা ব্যাবহার করা হবে না?
একথা অস্বীকার করার জায়গা নেই যে আমাদের বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলির স্বাস্থ্যের দিন দিন অবনমন ঘটছে। সাথেই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের সংখ্যা। তাতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু কেন ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোতে বাংলা আবশ্যিক হিসেবে পঠিত হবে না? আসলে বাংলা ভাষায় আমরা কথা তো বলি, কিন্তু বাংলা ভাষা নিয়ে কথা বলি না। কিন্তু অবস্থা সবসময় এমন ছিল না।
রবীন্দ্রনাথ জীবনস্মৃতি-তে লিখেছিলেন একবার তার বাবার কাছে কোন এক আত্মীয়ের চিঠি এসেছিল। চিঠিটি ছিল ইংরেজিতে লেখা। দেবেন্দ্রনাথ সেই চিঠি তৎক্ষণাৎ সেই চিঠি লেখকের কাছে ফেরত পাঠিয়েছিলেন। তখন জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি ছিল বাংলা ভাষা চর্চার একটি পীঠস্থান। বাংলা ভাষা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের পর্যবেক্ষণ, অনুসন্ধান কম ছিল না।তিনি হাত লাগিয়েছিলেন বাংলা ভাষার সংস্কারে, সংকলনে।তখন স্বাধীনতাকামী বাঙালির কাছে বাংলা ভাষাপ্রীতি ও স্বদেশপ্রীতি ছিল সমার্থক।
‘বঙ্গালদেশ’ শব্দটি পাওয়া যায় প্রথম রাজেন্দ্র চোলদেবের (১০১২-১০৪৪ খ্রিস্টাব্দ) তিরুমলয় পর্বতের তামিল লিপিতে। বঙ্গালদেশের পরিচয় দিতে গিয়ে সেখানে বলা হয়েছে এমন একটি জায়গার কথা যেখানে ঝড়-বৃষ্টির কোন বিরাম নেই। খুব বেশি বৃষ্টি হলে সেখানে জমিতে আল দিতে হয়। সেই আল থেকেই বঙ্গের অধিবাসীরা একসময় পরিচিত হয় বাঙালি নামে।যে ভূখণ্ডকে আমরা এখন বঙ্গভূমি বলি সেটা অতীতে বিভক্ত ছিল বঙ্গ, হারিখেল, সমতট,পুণ্ড্র, রাঢ়ী , গৌড় ইত্যাদি জায়গায়। পাল (৭৫০-১১৬১) ও সেন (১০৭০-১২৩০) রাজাদের আমলে এটি বৃহত্তর বঙ্গদেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ পায় এবং জন্ম হয় তথাকথিত বাঙালির।
কিন্তু এই হাজার বছরের বাঙালি আজ আত্মবিস্মৃত।ভাষা হল আমাদের মূল, ভাষা আমাদের চিন্তা ও বোধের ধারক, ভাষা আমাদের অবলম্বন।ভাষা আমাদের চেতনা ও দর্শনের বাহক। ভাষা আসলে একটি অর্জন। কিন্তু ডারউইনের তত্ত্ব ধরে এগোলে বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎকে আঁধারে পথ হাতড়াতে হবে।
আসলে আমরা যে বাঙালি এই বোধটি সর্বপ্রথম জাগ্রত করতে হবে, স্মরণ করতে হবে আমাদের বাংলা ভাষার গৌরবের কথা, স্মরণ করতে হবে ভাষা নিয়ে আমাদের পূর্বসূরিদের আত্মত্যাগের কথা। নচেৎ আগামীতে বাংলা ভাষা শুধু ইতিহাস হয়ে রয়ে যাবে অন্য কোনো ভাষার বইয়ের পাতায়।
আ মরি বাংলা ভাষাশ্রাবণী সেন পাখির ডাকের মত মিষ্টি আমার বাংলা ভাষা আমার স্বপ্ন, আমার আশা, আমার ভালোবাসা। এই ভাষাতেই লেখেন কবি চর্যাপদের গান বাংলা ভাষার নানান ছবি নানান তুলির টান! জয়দেবের লেখনি লেখে মধুর পদাবলী চন্ডীদাসের ভাষায় মেশে মানবকথার কলি। মধুকবি রচনা করেন কপোতাক্ষের গান দেশের মাটি, মায়ের ভাষা স্নেহের ধারা স্নান। রবিকবি মাথার উপর সূর্য কিরণ প্রায় কবি নজরুল পদ্মার ঢেউ হৃদয় নিয়ে যায়। জীবনানন্দের বাংলার মুখ কোন সে বনলতা আবহমান বাংলার রূপ, বাংলার রূপকথা। বাংলা আমার মায়ের ভাষা, মায়ের স্নেহের ধারা বাংলা ভাষা রত্নখনি, আকাশভরা তারা।
মাতৃভাষামাথুর দাস মাতৃভাষা মায়ের ভাষা জানি যা এর মধুরতা, বলতে সহজ বুঝতে সহজ মনের মতো করে । আর কি কোনও ভাষায় পাবে এমনতর কথা, যা শুনলে মনে আনন্দেরই ঝর্ণাস্রোত ঝরে ? এই ভাষাতেই হর্ষ বিষাদ নিখাদ ভালোবাসা, আহা কী স্বাদ পাই দুটি কথা মাতৃভাষায় বলে ! গানের কলি কন্ঠ জুড়ে করে যাওয়া আসা, এই ভাষাতেই ভালোবাসার মুক্তোমাণিক জ্বলে । জগৎ জুড়ে হাজারো ভাষা মানুষ অগণন, কত যে ভাষার কথার স্রোত বইছে কত সুরে ! ছাপিয়ে সেসব মাতৃভাষায় আবিষ্ট হয় মন, বাংলা আমার মাতৃভাষা, বাংলা হৃদয় জুড়ে ।
Sunday, February 4, 2024
মু জ না ই
অনলাইন সাহিত্য পত্রিকা
মাঘ ১৪৩০ সংখ্যা
সম্পাদকের কথা
নতুন বছরের শুরুতে একটি বিশেষ ঘটনাকে কেন্দ্র করে আমরা যেভাবে মেতে উঠলাম, তাতে মনে হচ্ছে এই দেশের সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। কেউ নিরন্ন নেই। কেউ বস্ত্রহীন নয়। প্রত্যেকের মাথার ওপর ছাদ রয়েছে। বাস্তব ও পরিসংখ্যান অবশ্য অন্য কথা বলছে। কিন্তু সেসব কে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার অথবা অখন্ড মৌনব্রত পালন করবার একটি বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে আমাদের। আমরা মনে করি, সবই সাজানো। আমরা ভেবে নিই একশো শতাংশ কাজ আমরা করে ফেলেছি। আকাশের সীমাকে ছাড়িয়ে গেছি নিজেদের সুকৃতিতে। কিন্তু পাহাড়চূড়ো থেকে সেই যে কালপ্যাঁচা আজও যে অন্নহীন আশ্রয়হীন দুঃখী মানুষের জন্য কেঁদে চলেছে সেটা আমরা শুনতে পাই না। দেখতে পাই না উন্মাদনা আমাদের মানসিকভাবে পিছিয়ে দিচ্ছে। কবে এর থেকে পরিত্রান পাব আমরা কেউ জানে না। আর সেই না জানার সঙ্গে বুঝতে না চাওয়া আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা। আমাদের ট্র্যাজেডি।
মুজনাই অনলাইন মাঘ সংখ্যা ১৪৩০
রেজিস্ট্রেশন নম্বর- S0008775 OF 2019-2020
হসপিটাল রোড
কোচবিহার
৭৩৬১০১
ইমেল- mujnaisahityopotrika@gmail.com (মাসিক অনলাইন)
প্রচ্ছদ- বাবুল মল্লিক
প্রকাশক- রীনা সাহা
সম্পাদনা, অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায়
মুজনাই অনলাইন মাঘ সংখ্যা ১৪৩০
এই সংখ্যা আছেন যাঁরা
উমেশ শর্মা, চিত্রা পাল, নিতাই দে, শ্রাবণী সেনগুপ্ত,
বাসব বন্দোপাধ্যায়, গৌতমেন্দু নন্দী, লীনা রায়,
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়, মাথুর দাস, উৎপলেন্দু পাল,
কবিরুল ইসলাম কঙ্ক, উদয় সাহা, স্বপন কুমার দত্ত,
রথীন পার্থ মণ্ডল, দেবদত্তা বিশ্বাস, দেবর্ষি সরকার, অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী,
স্বপন কুমার সরকার, রীতা মোদক, আকাশলীনা ঢোল,
দেবযানী সেনগুপ্ত, দেবদত্তা লাহিড়ী, অলকানন্দা দে,
সুমন্ত সরকার, আশীষ কুমার বিশ্বাস, বুলবুল দে,
রেজাউল করিম রোমেল, মজনু মিয়া, মনোমিতা চক্রবর্তী,
মুহাম্মদ আলম জাহাঙ্গীর, বটু কৃষ্ণ হালদার, প্রিয়াংকা নিয়োগী,
দেবারতী দে, অহনা সেন, শুভমিতা দেব, বাবুল মল্লিক
মুজনাই অনলাইন মাঘ সংখ্যা
১৪৩০
বাসব বন্দ্যোপাধ্যায়
সঙ্গদোষে
মাথুর দাস
রঙ্গ হাজার সঙ্গদোষে কি ভালো কি মন্দ,
গন্ধ পেলেই নেশার কত সঙ্গী হারায় ছন্দ ।
সঙ্গদোষের মন্দ-ভালো
দ্বন্দ্ব ঢাকে সাদা-কালো,
সৎ মানুষের সঙ্গ পেলে কতই না আনন্দ !
ফাগুনবেলার বাঁশি
কবিরুল ইসলাম কঙ্ক
ফিরিয়ে দিলাম পড়ে পাওয়া যত প্রেম
ফিরিয়ে দিলাম জাতক কথার গল্প
যদি ভেবে থাকো -- খুব ভালো আছি
তো, ফিরিয়ে দিলাম ভালো থাকাও।
এই অধ্যয়ে শুধই আঁধার চেতনা
মিশে আছে ভাবনার গূঢ় শিকড়ে
প্রত্যহ শেষ হতে থাকে প্রিয় মাটির
খনিজ দ্রব্য এবং আত্মকাল।
ঘরের কোণে জমছে একাকীত্বের শিশির
একলা পড়ে আছে ফাগুনবেলার বাঁশি।
অলকানন্দা দে
হে প্রকৃতি! মানুষ চেনো?
চতুর্দিকে যারা তোমার ছড়িয়ে থাকে দলে দলে
উপমাতে অসামান্য, আদর্শতে পূর্ব জ্বলে,
এরাই মানুষ।
শান্তি খোঁজে পাতার ফাঁকে, মেঘ দেখতে খুব উচাটন
মনটা কাঁদে মৌন যখন,
যায় ছুটে যায় সুদূর পেতে
কিংবা কাছের সর্ষে ক্ষেতে
খুঁজে পেল অবসাদের শতেক মহৌষধ।
যত মায়া নিলো লুটে, বন্ধুনী আর বন্ধু জুটে
মাথাপিছু আনন্দটা অভিমানের স্তব।
এরাই মানুষ।
ফিরতি পথে আত্মহারা সেই মানুষই ছন্নছাড়া
নগ্ন বোধে দিচ্ছে ছুঁড়ে আবর্জনার ক্লেশ।
শালবীথিকার অন্তরালে ব্যথার পরিবেশ।
নষ্ট নিয়ম ভ্রুক্ষেপহীন, অনুভবে প্রচণ্ড দীন
বধির চেতন শোনে না এই রোদন প্রকৃতির।
জঞ্জালে তার মলিন হল সবুজতর নীড়।
এরাও মানুষ।
সমাপ্তিহীন আক্ষেপে আজ এই পরিবেশ
কখনো প্রলাপ কখনো প্রলয় আঘাতের রেশ।
সুপরিসর ভোরের বাতাস রূঢ় জ্ঞানে
বুঝিয়ে দেবে অপমানের সঠিক মানে।
বুঝলে মানুষ?
কি সংকেত আসছে শোনো বাতাসটাতে
একশো শরৎ এই আকাশের আছে কি হাতে?
আরও অজ্ঞান হবে নাকি বোধের বরন
ঋণ মেটাবে সেবক হয়ে স্থির আমরণ,
ভেবে দেখ নিঃশব্দ বিনাশটাকে
রোধ করতে পার কিনা মেধার ডাকে।
বক্সা দুয়ার
চিত্রা পাল
জলপাইগুড়ি থেকে বক্সাদুয়ার এতো কাছে, মনে মনে
ভেবেওছি কতবার যাব তাও যাওয়া হয়ে ওঠেনি। এইবার একটা সুযোগ হতেই আর না করিনি, একবারে
বেরিয়ে পড়লাম ওই স্বাধীনতার তীর্থস্থানের উদ্দেশ্যে। স্বাধীনতার তীর্থস্থান বলছি
কেন, তখন স্বদেশী আন্দোলনের সবচেয়ে অপ্রতিরোধ্য বন্দীদেরই এখানে রাখা হতো। কেননা এ
জায়গাটা দুর্গম, আর ভয়ংকর এখানকার রক্ষীবাহিনী। শুনেছিআন্দামানের সেলুলার জেলের
পরেই ছিলো এর কুখ্যাতি।
যাই হোক
আমরা প্রথমে গিয়ে পৌঁছলাম রাজাভাতখাওয়া গেস্ট হাউসে। সেখানে একরাত কাটিয়ে পরের দিন
সকালে প্রাতরাশ সেরেই বেরিয়ে পড়লাম বক্সাদুয়ারের উদ্দেশ্যে। রাজাভাতখাওয়ার কাছেই
সান্তালাবাড়ি। সেখানে পৌঁছে আর একদফা চা খাওয়া হলো । সেখানে শুনলাম, পাশেই যে
রাস্তাটা চলে গেছে বক্সাদুয়ার সে রাস্তায় খানিক গিয়েই আমাদের গাড়ি থামাতে হবে।
কারণ ওই অবধি গাড়ি যাবে, তার পরের ওই পাহাড়ি দেড়দুমাইল রাস্তা স্রেফ পদব্রজেই যেতে
হবে। পাহাড়ি রাস্তায় অতখানি হাঁটতে পারবো কিনা জানিনা, তাও উত্সাহভরে চলতে শুরু
করলাম সবাই মিলে।
এই রাস্তা কিন্তু বড় সুন্দর। একেবারে সবুজেসবুজ
বনভূমি। খুব বেশি খাড়াই উত্রাই নেই। মাঝে মাঝে ছোট ছোট সাঁকো সেতু। আমরা সেই
সেতুর ওপরে বসে খানিক বিশ্রাম নিয়ে আবার চলতে শুরু করি। আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছিলো
এখানে প্রচুর পাখী দেখে। কত নাম না জানা পাখী
দেখলাম। যেতে যেতে দেখা পেলাম একটা গাছের গায়ে ঝোলানো একটা লাল রঙা ডাকবাক্সর। যেন
আমাদের ফেলে আসা জীবনের প্রতিভূ। সেখানেই ছোট্ট চায়ের দোকান। সেখানে বসে চা খেয়ে
আবার চলতে শুরু করলাম। এইভাবে পৌঁছে গেলাম বক্সাফোর্টে।
সেখানে পৌঁছে হলো এক অন্য অনুভূতি। এই দুর্গম
জায়গায় এইভাবে এখানে বন্দীদের রাখা হয়েছিলো। কত কষ্ট
পেয়েছে যে তারা সে কথা ভাবলেই কষ্ট হয়। শুনলাম এই দুর্গটা নাকি আগে বাঁশের ছিলো,
পরবর্তীতে বৃটিশরা এটিকে পাথরের দুর্গে রূপান্তরিত করে। শুনেছি এখানে নাকি নেতাজী
সুভাসচন্দ্রও বন্দী জীবন কাটিয়েছেন। পরবর্তীকালে কমুনিষ্ট বিদ্রোহীরাও এইখানে
বন্দী ছিলেন। কবি মুখোপাধ্যায়,বিনয় চৌধুরি প্রমুখ সব বন্দীরা
এখানে ছিলেন।
একবার এখানকার বন্দীরা সবাই মিলে রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন করে। রবীন্দ্রনাথ সে সময় ছিলেন দার্জিলিং-এ। উনি একথা জানতে পেরে তার প্রত্যুত্তর দেন এইবলে,’’অমৃতের পুত্র মোরা কাহারা শোনালো বিশ্বময়, আত্ম বিসর্জন করি আত্মারে কে জানিলো অক্ষয়’’। কালো গ্রানাইট পাথরের স্তম্ভে উত্কীর্ণ করা আছে তাঁর বাণী। আমরা আমাদের সকল শ্রদ্ধা অবনত মস্তকে জানিয়ে বিদায় নিলাম। আরও একটু থাকার ইচ্ছে ছিলো। কিন্তু আবার ওই অতোটা পথ হেঁটে যেতে হবে, আসার সময় দেখার উত্সাহে এসেছি, যাবার সময় সে উত্সাহে ভাঁটা থাকবে,আর আমরা ক্লান্তও, সময় বেশি লাগবে খানিক। ওদিকে দিনের আলো নিবে গেলে হবে আর এক বিপদ। তাই আর দেরী না করে আবার রওনা দিলাম ফেরার পথে। সঙ্গে নিয়ে এলাম এক অমলিন স্মৃতি যা কখনও ভুলে যাবো না।
ছন্দে ভাসি
শীত এলে
বুলবুল দে
মাঘের দিনে শীতের বুড়ি দুষ্টুমি তুই করিস ভারি,
সাদা ঘোমটায় মুখটি ঢেকে ঘাপটি মেরে থাকিস;
দুষ্টু খুকু রাগকরে তাই জানায় আমায় নালিশ।
কনকনে তুই শীতের বুড়ি খনখনে তোর তীক্ষ্ণগলা,
শনশনে হিম হওয়ার পিঠে চেপে আসিস ভেসে ;
হি হি করে ফোকলা দাঁতের শীতল হাসি হেসে।
লেপকম্বল জড়িয়ে ধরে খুকু বলে মিহি সুরে,
কুয়াশা ভরা ধুয়াশা সকাল মা, অঙ্ক থেকে কঠিন ;
তবুও যে মা স্নেহ ভ'রে বলেন তারে কোলে করে,
ছাড় দিয়েছি দুদিন আজ মানতে হবে রুটিন ।
উঃ লাগে মা ঠোকাঠুকি কেন এত দাঁতে দাঁতে ?
হাত ঠকঠক পা ঠকঠক কেঁপে বলে খুকি ;
বায়না করে চায়না করতে দাঁতন সে যে প্রতি প্রাতে,
তবু কি স্কুলে যেতেই হবে পরে মাংকি টুপি !
মাঘের শীতে বাঘে কাঁপে, কাঁপে বাঘের মাসি পিসি,
থরথরিয়ে কাঁপে শহর-গ্রামের নর নারী ;
আকাশ কাঁপে বাতাস কাঁপে,কাঁপে জগৎ দিবানিশি,
এই কাঁপুনি থামাতে মা আসবে সে কোন পরী ?
শিয়রে মরণ বুঝেই বুঝি এমন মরণ কামড় মারিস,
মারণ এ শীত চায়না খুকু আর যে কোনও মতে ;
এবার তুই নে না বিদায় পরের বছর আবারআসিস,
রোদ ঝলমল কোমল রূপে খুকুর বন্ধু হতে।