বাংলা ভাষা ও কিছু প্রশ্ন
বিশ্বজিৎ সাহা
বিগত শতকের দুটো উল্লেখ্যযোগ্য ঘটনা বাংলা ভাষাকে বিশ্বদরবারে পৌঁছে দেয়। প্রথমটি রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি গীতাঞ্জলির প্রকাশ এবং দ্বিতীয়টি বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে স্বীকৃতি । ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারী ছিল বাংলা ভাষা নিয়ে বাঙালির আবেগের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশের দিন। ভাষার জন্যও প্রাণ দেয়া যায় সেটা গোটা বিশ্ব সেদিন প্রথম প্রত্যক্ষ করেছিল। ফলস্বরূপ ১৯৭১ এ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলা রাষ্ট্রের জন্ম। ১৯৬১ সালে আসামের বরাক উপত্যকায় অসমিয়ার সাথে বাংলা ভাষাকে সরকারি ভাষার স্বীকৃতি প্রদানের জন্য জোরদার আন্দোলন হয় এবং ১১ জন বাঙালি মৃত্যুবরণ করেন।সেইসব ইতিহাসে ভর করে ইউনেস্কো ১৯৯৯ সালে একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা প্রদান করে।
প্রতি বছর এই দিনটি মহা সমারোহে পালিত হয়। বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা, আলোচনা সভা, নানান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে শুধু সেদিনই আমরা হয়ে উঠি বাঙালি। আর বছরের বাকি দিনগুলোতে? সত্যি কি বাঙালি বাংলা ভাষার জন্য ভাবিত? বাংলা ভাষার প্রতি সত্যি কি বাঙালি কোনো টান অনুভব করে? বাংলাভাষার প্রতি কি সত্যি কোনো দায়বদ্ধতা বাঙালির দছে? বাংলা ভাষা কী আজ বিপন্ন নয়?
আমরা এমন একটি ভাষায় কথা বলি যে, ভাষার অধিকার নিয়ে সংগ্রামে শহিদ হওয়ার ইতিহাস আছে, আছে বিপুল সাহিত্য ও কাব্যের ভান্ডার, আছে অসংখ্য পত্রপত্রিকা ও পুস্তক প্রকাশনী,আছে নিজস্ব সংস্কৃতি, নিজস্ব কৃষ্টি।
উপনিবেশিক বৈদেশিক অনুপ্রবেশ শুধু দেশের মাটিতে হয়নি, তার অনুপ্রবেশ ঘটেছে আমাদের সংস্কৃতিতে আমাদের ভাষায়। সেই থেকে ভাষার বিপন্নতা শুরু। একথা অস্বীকার করা যায় না যে, যুগে যুগে বিভিন্ন বিদেশী ভাষা দ্বারা বাংলা ভাষা অনেক সমৃদ্ধ হয়েছে।
আরবী, পার্সি , ফারসি এসব ভাষার প্রভাব বাংলায় প্রত্যক্ষ। কিন্তু ইংরেজি ভাষা শেখা, বলা এবং ব্যবহার করার মধ্যে বাঙালি যে আত্মশ্লাঘা অনুভব করে সেটা মাতৃভাষার ক্ষেত্রে করে না। তাইতো বাংলা বলা বা লেখার সময় তার মাঝে অনাবশ্যক ইংরেজির ব্যবহার আজ সর্বত্র।ইংরেজি অবশ্যই শিখতে হবে, যেহেতু কর্মক্ষেত্রে সর্বত্র তার ব্যাবহার। উচ্চশিক্ষার সমস্ত পুস্তক ইংরেজিতে, সর্বভারতীয় কোনো পরীক্ষা দিতে গেলে ইংরেজিতে আমাদের নখদর্পণে রাখতেই হবে।কিন্তু সাথে মাতৃভাষা নিয়েও কেনো আমরা ভাববো না?
কেন শিক্ষিত বাঙালি যারা উচ্চ শিক্ষার বই লিখছেন তারা বাংলায় লিখবেন না, কেন শুধু মাত্র বাংলা ভাষার একটি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠে না, কেন সরকারি কাজে বাংলা ভাষা ব্যাবহার করা হবে না?
একথা অস্বীকার করার জায়গা নেই যে আমাদের বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলির স্বাস্থ্যের দিন দিন অবনমন ঘটছে। সাথেই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের সংখ্যা। তাতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু কেন ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোতে বাংলা আবশ্যিক হিসেবে পঠিত হবে না? আসলে বাংলা ভাষায় আমরা কথা তো বলি, কিন্তু বাংলা ভাষা নিয়ে কথা বলি না। কিন্তু অবস্থা সবসময় এমন ছিল না।
রবীন্দ্রনাথ জীবনস্মৃতি-তে লিখেছিলেন একবার তার বাবার কাছে কোন এক আত্মীয়ের চিঠি এসেছিল। চিঠিটি ছিল ইংরেজিতে লেখা। দেবেন্দ্রনাথ সেই চিঠি তৎক্ষণাৎ সেই চিঠি লেখকের কাছে ফেরত পাঠিয়েছিলেন। তখন জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি ছিল বাংলা ভাষা চর্চার একটি পীঠস্থান। বাংলা ভাষা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের পর্যবেক্ষণ, অনুসন্ধান কম ছিল না।তিনি হাত লাগিয়েছিলেন বাংলা ভাষার সংস্কারে, সংকলনে।তখন স্বাধীনতাকামী বাঙালির কাছে বাংলা ভাষাপ্রীতি ও স্বদেশপ্রীতি ছিল সমার্থক।
‘বঙ্গালদেশ’ শব্দটি পাওয়া যায় প্রথম রাজেন্দ্র চোলদেবের (১০১২-১০৪৪ খ্রিস্টাব্দ) তিরুমলয় পর্বতের তামিল লিপিতে। বঙ্গালদেশের পরিচয় দিতে গিয়ে সেখানে বলা হয়েছে এমন একটি জায়গার কথা যেখানে ঝড়-বৃষ্টির কোন বিরাম নেই। খুব বেশি বৃষ্টি হলে সেখানে জমিতে আল দিতে হয়। সেই আল থেকেই বঙ্গের অধিবাসীরা একসময় পরিচিত হয় বাঙালি নামে।যে ভূখণ্ডকে আমরা এখন বঙ্গভূমি বলি সেটা অতীতে বিভক্ত ছিল বঙ্গ, হারিখেল, সমতট,পুণ্ড্র, রাঢ়ী , গৌড় ইত্যাদি জায়গায়। পাল (৭৫০-১১৬১) ও সেন (১০৭০-১২৩০) রাজাদের আমলে এটি বৃহত্তর বঙ্গদেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ পায় এবং জন্ম হয় তথাকথিত বাঙালির।
কিন্তু এই হাজার বছরের বাঙালি আজ আত্মবিস্মৃত।ভাষা হল আমাদের মূল, ভাষা আমাদের চিন্তা ও বোধের ধারক, ভাষা আমাদের অবলম্বন।ভাষা আমাদের চেতনা ও দর্শনের বাহক। ভাষা আসলে একটি অর্জন। কিন্তু ডারউইনের তত্ত্ব ধরে এগোলে বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎকে আঁধারে পথ হাতড়াতে হবে।
আসলে আমরা যে বাঙালি এই বোধটি সর্বপ্রথম জাগ্রত করতে হবে, স্মরণ করতে হবে আমাদের বাংলা ভাষার গৌরবের কথা, স্মরণ করতে হবে ভাষা নিয়ে আমাদের পূর্বসূরিদের আত্মত্যাগের কথা। নচেৎ আগামীতে বাংলা ভাষা শুধু ইতিহাস হয়ে রয়ে যাবে অন্য কোনো ভাষার বইয়ের পাতায়।
No comments:
Post a Comment