মুজনাই
অনলাইন শারদ (আশ্বিন) সংখ্যা ১৪৩১
গদ্য
আশ্বিনে আন্দোলনের আবাহন
জয়িতা সরকার
আশ্বিনের এই প্রভাতে, নদীর চরে কাশের বনে শিরশিরে বাতাসে ছন্দ মিলিয়ে মাথা দুলিয়ে আগমনী সুর তাল কাটছে এই শারদ বেলায়। মিছিল নগরী হাঁটছে প্রতিবাদের পরিভাষায়। মৃত্যু প্রাবল্যের ঢেউ আছড়ে পড়েছে শহর ছাড়িয়ে মফস্বলে। শোক রূপান্তরিত হল দ্রোহে। উৎসব হল আন্দোলনের সমার্থক, এমন জনজাগরণের শারদীয়া বাংলার শ্রেষ্ঠ উৎসবের নতুন স্মারক।
একটা অযাচিত মৃত্যু কতশত অনিয়মের দরজায় কষাঘাত করছে, প্রতি মুহুর্তে আতঙ্কগ্রস্থ থেকে তটস্থ করছে শাসককূলকে, দুর্নীতির হিমস্রোতে ভয়ের উষ্ণস্রোতের আকস্মিক অনুপ্রবেশ, হুমকি সংস্কৃতির শান্ত সমুদ্রকে উত্তাল করছে। একটা ঘটনামাত্র হয়ে থাকা দস্তুর রাজ্যে ওলিগলি ছাড়িয়ে রাজপথ দখলে আটপৌরে বাঙালীর রাত অধিকারের ছবি নতুন ইতিহাসের সাক্ষী।
প্রতিবাদের প্রতিটি ভাষার দৃঢ়তা-প্রত্যয়ে প্রশাসকের মেরুদণ্ডে যে হিম শীতল প্রবাহ বয়ে চলেছে তা প্রত্যেক প্রতিক্রিয়ায় সুস্পষ্ট। কন্ঠরোধ করার যে মরিয়া প্রয়াসে ব্রতী করেছেন নিজেদের, তাতে ঝাপসা হয়েছে ভবিষ্যতের দেওয়াল লিখন। নাগরিক স্পন্দনের উত্তাপের অপ্রতিরোধ্য আঁচ অনুভূত না হলে অতি বড় দূরদর্শীও ছারখার হতে পারেন।
উৎসবপ্রিয় বাঙালী এমন তকমা যেমন বয়ে নিয়ে চলেছি শত শত বছর, তেমন আবেগপ্রবণ বাঙালী থেকে প্রতিবাদে মুখর বিশেষণে ভূষিত জাতি উৎসবকে আন্দোলনের মলাটে বাঁধিয়ে 'শুভ শারদীয়া, বিচার পাক অভয়া', এমন শ্লোগানে ঢাকের বোলে এবার পুজোর নতুন রূপকার হলে হুমকি সংস্কৃতির শিকড়ে যে টান পড়বে তার আন্দাজ করতে পেরে প্রতিরোধের নানা ফরমান জারি হয়েছে ইতিমধ্যে। তবে ইতিহাস বলছে, নাগরিক সমাজ সুপ্ত আগ্নেয়গিরির ন্যায়, ঘুম ভেঙে উদগীরণ শুরু হলে সেই লাভাস্রোত যে কতটা সুদূরপ্রসারী, আর সেই উত্তাপে পুরাতন ভেঙে নতুনের সৃষ্টি, এমন উদাহরণ অজস্র।
মানবিক সমুদ্রে জোয়ার এসেছে, প্রতিবাদের ভাষা সংক্রামক হয়েছে পথে পথে। রাজপথ রুদ্ধ হলে মানুষের স্বর উঠছে স্যাঁতস্যাঁতে অন্ধকার গলির ছোট্ট এক ঘরের নিভে যাওয়া আলোর ভেতর থেকে। আওয়াজ উঠেছে পাশে থাকার, সুর ভাসছে অঙ্গীকারের। উৎসবের প্রাকলগ্নে উৎসবে ফেরার নির্দেশ নয়, উদযাপনের নবরূপে উৎসব হোক শপথের, হোক ন্যায়ের। হাতে হাত রেখে, কাঁধে কাঁধ রেখে স্বর জোরালো হোক সুবিচারের। রক্তমাখা চোখের বিনিময়ে শিরদাঁড়া সোজা করে লড়াকু মনের বাঙালীর শারদ উৎসবের বোধন হোক প্রতিবাদের।
চারদিকে পাপের আঁধারে কোথায় পাবো আলো?
গৌতমেন্দু নন্দী
বর্তমান বিপন্ন এই সময়ে অনেক বছর আগে প্রয়াত সংগীত শিল্পী কিশোর কুমারের সেই বিখ্যাত ও জনপ্রিয় গানটির দুটি লাইন খুব মনে পড়ছে -----
" চারিদিকে পাপের আঁধার নেইকো কোথায়
আলো, মনে হয়রে অন্ধ হওয়া ছিল অনেক ভালো.."
পাপের এই আঁধারের অন্যতম কারণ হলো সর্ষের মধ্যেই ভূতের অবস্থান। "নিরাপত্তা", "প্রতিশ্রুতি"র মতো জনকল্যাণকর শব্দবন্ধ রাজনৈতিক স্বার্থে, নির্বাচনের আগে যতোই উচ্চারিত হোক,আসলে এইসব উচ্চারণ নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার, ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণের উদ্দেশ্যে প্রণোদিত হয়ে মিথ্যাচারেই পর্যবসিত হয়। ধারাবাহিক এই "খেলা" চলছে নিরন্তর।
সংবিধান, গণতন্ত্রের মতো জনহিতকর "অদলীয়" শব্দবন্ধ এখন " দলীয় রাজনীতি"র যাঁতাকলে বারবার পিষ্ট হচ্ছে বলেই শাসকের "মসনদ" দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠতে ব্যর্থ হচ্ছে। জনপরিসরে যার অভিঘাত জন্ম দিচ্ছে দুর্নীতির। নির্দিষ্ট "পক্ষ" নিয়ে অবাধে চলা এই দুর্নীতির সঠিক বিচার কে করবে? "পক্ষ" অবলম্বনের এই "সাত খুন মাফ"-এর সামনে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর প্রাণ আজ ওষ্ঠাগত। "তোলাবাজ"," কাট মানি" "জমি মাফিয়া", শিক্ষামাফিয়া "য় নব সংযোজন এখন স্বাস্থ্যও। নিরাপদ নয় হাসপাতালে মর্গের লাশও । চোরাপথে রাতের অন্ধকারে লাখ লাখ টাকায় পাচার হয়ে যাচ্ছে আস্ত লাশ বা তার অঙ্গ প্রত্যঙ্গ।
দুর্নীতির টাকার পাহাড়ে বসে ক্ষমতাধর চোখ রাঙাচ্ছে, ভয় দেখাচ্ছে দলীয় রাজনীতির অস্ত্র হাতে নিয়ে। যার পরিণামে দুর্নীতি, চক্রান্তের বিরুদ্ধে সোচ্চার সৎ, আদর্শনিষ্ঠ কন্ঠ স্তব্ধ হয়ে পরিণত হচ্ছে অত্যাচারিত লাশে। ইদানিং বাতাসে ভাসছে এই বাক্যবন্ধ----- "এসব নাকি দুর্নীতির হিমশৈলের চূড়া মাত্র"
কী সাংঘাতিক! অন্যায়, অবিচার, অপরাধের সঙ্গে ক্ষমতার এই অনৈতিক সহাবস্থানের সঠিক বিচার তবে করবে কে? জনতার আদালতে যাঁরা দোষী সাব্যস্ত হয়েই আছেন তাঁদের বাঁচাতে আজ কোন্ অশুভ শক্তি সচেষ্ট ?বর্তমানের এই সংকট, বিপন্নতা থেকে মুক্তিরএকমাত্র পথ কি তবে এই ধারাবাহিক গণজাগরণ?! সংবিধান, গণতন্ত্রের কোন মূল্যই কি আজ আর নেই? অন্যায়-অপরাধের যে বিচার-অভিমুখ বিচার ব্যবস্থার স্বাভাবিক পথেই নির্দেশিত হওয়ার কথা সেই ব্যবস্থায় আজ কেন এতো জটিলতা? কেন ক্ষমতার এতো আস্ফালন?
সমাজ--প্রতিষ্ঠান কেন আজ "থ্রেট কালচার"এ আক্রান্ত? অন্যায়-প্রতিবাদের কন্ঠরোধ করা হুমকির নেপথ্যে কে বা কারা? ভয় দেখিয়ে মুখ বন্ধ করার এই "সংস্কৃতি" কাদের মদতপুষ্ট? ক্ষমতা লোভী পৌরুষের ক্ষমতা প্রদর্শনের শেষ অস্ত্র কি ধর্ষণ? ধর্ষকের বিলম্বিত সাজা বা আইনগত জটিলতায় ধর্ষকদের সংখ্যাও আজ ক্রমবর্ধমান।
মনে পড়ছে বারো বছর আগে ডিসেম্বর মাসের সেই শীতের রাতে দিল্লির ২৩ বছরের প্যারামেডিকেল ছাত্রীর কথা! দিল্লির রাজপথে রাতের অন্ধকারে নৃশংসভাবে ধর্ষিতা হওয়ার পর হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে ঢোকার মুখে তাঁর মাকে বলছেন---"মা, ম্যাঁয় জিনা চাহতি হুঁ।" না, তাঁকে বাঁচানো যায় নি। আমাদের কাছে যিনি হয়ে উঠেছিলেন "নির্ভয়া"----- প্রত্যাশা ছিল এমন মর্মান্তিক ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেন না হয়। কিন্তু তারপরও "কামদুনি","পার্ক স্ট্রিট" "হাথরস"," সন্দেশ খালি" ---- ধারাবাহিক ধর্ষণের ঘটনা ঘটতে ঘটতেই কলংকিত হয়ে থাকল সেই তারিখটি --৯ই আগস্ট! কর্মরত অবস্থায় নিজ হাসপাতালেই পাশবিক অত্যাচারে ধর্ষিত ও খুন হলেন তরুনী পড়ুয়া--চিকিৎসক। "নির্ভয়া"র হত্যাকারীদের মতোই এই সমাজকে আবার কলঙ্কিত করল "তিলোত্তমা"র ধর্ষক-হত্যাকারি/ হত্যাকারীরা। অত্যাচারিত "নির্ভয়া " চিকিৎসার সুযোগ পেলেও "তিলোত্তমা "কে চিকিৎসার সুযোগ না দিয়ে হত্যা করে রাতারাতি মর্গে পাঠিয়ে প্রমাণ লোপাট করার ঘৃণ্য চেষ্টার অভিযোগে অভিযুক্ত সেই ষড়যন্ত্রকারীরা।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হওয়ার মাশুল যদি নিজের প্রাণ দিয়ে এইভাবে দিতে হয় তবে সৎ, আদর্শবাদী, নির্ভীকতার সামাজিক মূল্যবোধকে বিরাট প্রশ্ন চিহ্নের সামনে দাঁড়াতে হয় আর তার সাথে যদি এমন প্রলম্বিত বিচার ব্যবস্থা হয় তাহলে নাগরিক জীবনে ভরসার জায়গা কি আর থাকে?!
অশিক্ষিত, কুসংস্কারের আর একটি মর্মান্তিক ঘটনা সম্প্রতি ঘটে গেল উত্তরপ্রদেশের এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে--যেখানে বিদ্যালয়ের উন্নতি নামে কুসংস্কারের বশে এক চতুর্থ শ্রেণীর পড়ুয়াকে বলি দেওয়া হয়। এটাই কি শিক্ষা? এটাই কি সভ্যতার অগ্রগতি? শিক্ষা, সংস্কৃতি শুধু নয় আমরা বিপন্ন পরিবেশগত দিক দিয়েও। একদিকে ঘটা করে পরিবেশ দিবস উদযাপন, অন্যদিকে শাসকের হাতেই উন্নয়নের নামে ব্যাপক বৃক্ষ-ছেদনে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করা হচ্ছে। এখানেও শাসকের ক্ষমতার সামনে পরিবেশ-কর্মীদের প্রতিবাদী কন্ঠরোধ করা হয়। আর উন্নয়নের নেপথ্যে থাকে সেই তোলাবাজি,কাটমানির গল্প। এ খেলা চলছে নিরন্তর। বৃক্ষ নিধনের সাম্প্রতিক সংযোজন নিকোবর
আইল্যান্ডে বিমান বন্দর নির্মাণ। যার ফলশ্রুতি নিকোবর আইল্যান্ডের বৃহৎ পরিসরে লক্ষ লক্ষ বৃক্ষ নিধনের অপরিণামদর্শীতার পরিচয়। এখানেও হয়তো নেপথ্যে সেই "বরাত" পাওয়ার বহু চর্চিত গল্প। "এলোমেলো করে দে ,সব লুটেপুটে খাই".....কিছু ক্ষমতাধরদের এই চিন্তা ভাবনার মধ্যেও এই সমাজেরই কিছু সুস্থ চেতনা সম্পন্ন মানুষ এখনও স্বপ্ন দেখে এক উজ্জ্বল, সুস্থ নাগরিক জীবনের।আমাদের ভরসার জায়গা সেখানেই।
উপলব্ধি (২৭)
দেবযানী ভট্টাচার্য
"পাশের মানুষটা থেকে তুমি নিঃশব্দে সরে পড়ো আর গলা ফাটাও: হিংস্রতা থেকে আমাদের পৃথিবীটাকে মুক্ত করুন ।" (ভাস্কর চক্রবর্তী )
সমাজের এমতবস্থায় একটি ধর্ষণজনিত খুন আমাদের চেতনায় হঠাৎ প্রচন্ড ধাক্কা দিয়ে গেল , এই যে স্বতঃস্ফূর্ত গণ জাগরণ ঘটলো তা কি কেবল একটি ঘটনার জন্যই ? না, এমন ঘটনা আগেও ঘটেছে, এবং আবারও এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে আমরা জানি। শাস্তি যতই দৃষ্টান্তমূলক হোক এ থামবে না, কারণ এই স্বল্প মুহূর্তের আন্দোলনে গোটা সমাজটা পাল্টে যেতে পারে না, কিন্তু এই জনরোষ যা বুঝিয়ে দিচ্ছে তা হলো আমরা এতদিনে নিজেদের আয়নার মুখোমুখি দাঁড় করাতে পেরেছি! আর এই যে ক্ষতের ভিতর থেকে ক্ষোভের পুঁজ রক্ত গলগল করে বেরিয়ে আসছে তা দীর্ঘকালীন পুঞ্জীভূত ক্ষোভের উদগীরণ ! একটা দীর্ঘকালীন অন্ধকার সুড়ঙ্গের ভিতর দিয়ে ক্লান্তিকর এক যাত্রা শেষে যেন আমরা সামান্য আলোর সন্ধান পেয়েছি।
আমরা বিচার চাইছি, বোবা স্বরগুলি হঠাৎ গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে এ দেখে অনেকেই বিস্মিত হচ্ছেন যে দিব্যি সহিষ্ণু একটা সমাজের হঠাৎ হলো টা কি ? শাসকের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে এই গণ বিক্ষোভ ! আসলে আমরা আমাদের বঞ্চনাগুলোকে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিলাম হৃদয়ের গভীরে, মানিয়ে নিতে নিতে সরীসৃপের মতো আমরা হেঁটে চলছিলাম, কিন্তু সব কিছুরই একটা ডেড লাইন থাকে ! আমরা চেয়েছিলাম একটি সুন্দর ধর্ম নিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, কিন্তু জোর করে আমাদের ধর্মের আফিম খাওয়ানো হলো ! আমরা বিচার চাইতে ভুলে গিয়েছিলাম, না বলতে ভুলে গিয়েছিলাম,আমরা চেয়েছিলাম নাগরিকের সুষ্ঠ অধিকার, বৈষম্যহীন একটি আর্থ সামাজিক পরিকাঠামো কিন্তু পেলাম একনায়কতন্ত্রের রাঙা চোখ, আমরা ক্ষোভ বুকে নিয়েও সহিষ্ণুতা দেখলাম ! আমরা চেয়েছিলাম কর্মের অধিকার, কিন্তু আমাদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হলো অনুদান আর ভিক্ষার যোগ্য একটি বাটি! আমরা চুপ করে রইলাম,আমরা চেয়েছিলাম সুষ্ঠ সামাজিক পরিকাঠামোর ভিতর দিয়ে সুষ্ঠ নাগরিক পরিষেবা, কিন্তু আমাদের এই চাওয়াগুলোকে গুরুত্বহীন করে দিয়ে ধূর্গন্ধ যুক্ত পুতিময় ব্যবস্থায় মানিয়ে নিতে শেখানোর প্রচেষ্টা। আমরা চেয়েছিলাম মানুষের সুরক্ষা, আইনের সুন্দর প্রয়োগ, সুষ্ঠ বিচার ব্যবস্থা ,নারীর অধিকার, লিঙ্গবৈষম্য হীন, জাত পাত হীন , ধর্ষণ হীন একটি সমাজ কিন্তু উপহার হিসেবে পেলাম অসুরক্ষিত, অধিকার কেড়ে নেওয়া , বিক্রি হয়ে যাওয়া বিচার ব্যবস্থা, আইনের ফাঁকে জিতে যাওয়া, লিঙ্গবৈষম্য যুক্ত, অ- এ, দাঙ্গা বাঁধিয়ে দেবার রাজনীতি, মিনিটে ১৮ টি ধর্ষণ যুক্ত, বৈষম্য যুক্ত আর্থ সামাজিক পরিকাঠামো। যেখানে একজন কিশোর ধীরে ধীরে পরিণত হয়ে ওঠে ধর্ষক রূপে, খুনী রূপে। আমাদের চেতনায় জ্বলেনি আলো, অন্ধকার একটি ঘরের মধ্যে মেরুদন্ডহীন, হাত পা বাঁধা দলদাস অবস্থায় জন্তুর মতো বেঁচে ছিলাম আমরা, আমাদের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে! আমরা তাই সমস্বরে চিৎকার করে উঠলাম " আমরা বিচার চাই " এ অসহায় বন্দিদশা থেকে মুক্তি চাই।
আমাদের নৈতিক চরিত্রের পতন ঘটে গেছে বহুদিন !দুর্নীতির, লোভের কালো হাত আমাদের চেতনাকে দখল করে নিয়েছে অবচেতনে, আমাদের ভালোবাসাতে মিশে গেছে স্বার্থের বিষ! আমাদের শোকের আয়ু কমতে কমতে মুহূর্তে স্থান নিয়েছে, আমাদের হিংস্র, চৌর্য মনোবৃত্তি জিতে গেছে শুভ বুদ্ধির বিরুদ্ধে, ভেঙে গেছে যৌথ পরিবার, আমাদের প্রেমের আয়ু তিন দিন ! পর্যটকের মনোভাব নিয়ে একটি ঘুণ ধরা সমাজের অংশ হিসেবে বেঁচে আছে আমাদের অস্তিত্ত্ব ! পরিবার - সমাজ - রাষ্ট এই ত্রিভুজের ভীত টি নড়ে গেছে অনেক আগেই, আমরা অন্ধ ভিখারীর মতো স্টেশনে বসে ছিলাম বহুদিন, অবধের মতো উৎসবের আফিম খেয়ে ঘন ঘোর আচ্ছন্ন চেতনায় দিশাহীন ঘুরে ফিরছিলাম পথে পথে আর অসংবদ্ধ ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে রাস্তা ঘাটে কেবল থুথু ছিটিয়ে যাচ্ছিলাম ! গালাগালি, গণ প্রহারের মাধ্যমে ক্ষোভের উদগীরণ করছিলাম আর আখেরে গোছাতে শিখে গেছিলাম। আর ঠিক এই অবস্থাতেই একটা ধাক্কায় আমাদের চেতনা হঠাৎ জ্বলে উঠলো, এভাবেই বিপ্লব আসে ,স্ফুলিঙ্গের ধিকি ধিকি আগুন হঠাৎ দাউ দাউ জ্বলে ওঠে , ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরী জেগে ওঠে, আমরা লাভা উদগীরণ করতে করতে বলে উঠলাম " আমরা বিচার চাই ।"
কিন্তু প্রশ্ন হলো শুধু চাই বলেই কি আমরা আমরা আমাদের দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারি ? যে কারণে শাসক দল মিছিলে হাঁটলে আমরা হেসে উঠি! সিস্টেম তো একদিনে একা কোনো মানুষ বা দল গড়ে তুলতে পারে না, আমরাও সম দোষে দোষী। আমরাই এই সিস্টেমের অংশ, কতদিন আমরা আয়নার মুখোমুখি হই না ! তাই শুধু চাইলেই হবে না, শুদ্ধিকরণ দরকার প্রতিটি মানুষের , প্রতিটি পরিবারের, সমাজের ,রাষ্ট্রের। আমাদের চেতনার আগুন জ্বলে উঠেছে, সে আগুনে সেঁকে যেন তৈরি হয় এক নতুন সমাজ , এ আগুন নিভিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা হবে, এ গণরোষকে হাইজ্যাক করে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের খেলা চলবে,আমাদের অন্তরের দীপশিখাটি প্রচন্ড ঝড়ের রাতেও যেন দীপ্যমান থাকে এই প্রয়াস জারী রাখতে হবে। তবেই আসবে নতুন ভোর। গঠন হবে আমাদের সমস্ত চাওয়া পূরণ করা নতুন একটি সামাজিক পরিকাঠামো। আমরা যেন বলতে পারি,
" আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি "( শঙ্খ ঘোষ )
বিপন্ন এ সময়
শুভেন্দু নন্দী
এই সুমহান ভারতবর্ষ সমেত গোটা বিশ্ব আজ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও অন্যান্য আরও অনেক কারনে দারুণভাবে বিপর্যস্ত ও জর্জরিত।
ইতিমধ্যে এক অদৃশ্য শত্রুর ভয়ারহ আক্রমনে সমগ্র গ্লোবাল ওয়ার্লডে সর্বক্ষেত্রে অর্থনৈতিক ধস
নেমে এসেছিল। Human mortality দারুণভাবে দেখা দিয়েছিল এই অদেখা শত্রু করোনার চারিদিক থেকে আক্রমনের কারণেয। জীবনের মূল সুর,ছন্দে পৌঁছুতে অনেকটা সময় লেগেছিল। এ ঘোর সংকট কাটতে না কাটতেই শুরু হোলো অস্থিরতা সারা বিশ্বে । ইউক্রেন-রাশিয়ার খন্ড যুদ্ধ। সেখানের মেডিক্যাল পড়ুয়া ভারতবাসীর দলে দলে কোর্স অসম্পূর্ণ রেখে এখানে প্রত্যাবর্তন নিরাপত্তার কারনে। ইজরায়েল-প্যালেসটাইনের লাগাতার সংঘর্ষ, গনঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের হাসিনা সরকারের পতন কোটা সংস্কারের কারণে ও অন্তর্বতী সরকার গঠন, অগ্নিগর্ভ মণিপুর, শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাপক ও পাহাড়প্রমান
ও অর্থনৈতিক দুর্নীতি , বিলি বন্টন ব্যবস্থায় ব্যাপক অনিয়ম, নিট ও নেট পরীক্ষায় চরম scam ,ইত্যাদি ইত্যাদি। এর সাথে আছে ragging এর মত দুঃখজনক ঘটনা। এর সাথে আছে পথে ঘাটে শিশু নির্যাতন ও যৌননিগ্রহের মত বিশ্রী ঘটনা,নারীদের সম্ভ্রম নষ্ট,নিপীড়ন ও লাঞ্ছনার মত ঘৃণ্য ঘটনা, নারী-শিশু পাচার,সিন্ডিকেটরাজ ও তোলার মত জঘন্য পীড়াদায়ক ঘটনা - যা প্রতিনিয়ত সমাজকে কলুষিত ও বিপথে চালিত করছে। বিরাট সামাজিক অবক্ষয় দেখা যাচ্ছে। সবচেয়ে burning question হোলো ক্রমবর্ধমান বেকার সমস্যা।
ট্র্যাফিকিং,মাস্টারমাইন্ড ,racket,হিমশৈলের চূঁড়া ইত্যাদি term গুলো এখন খুবই পরিচিত সবার কাছে।
সাম্প্রতিককালে আর.জি.কর মেডিক্যাল কলেজে এক পড়ুয়া চিকিৎসকের বর্বরোচিত খুন ও ধর্ষনের ঘটনায় রাজ্য সহ,গোটা দেশ ও বিদেশে বিক্ষোভের ঢেউ আছড়ে পড়েছে। নাগরিক কমিটি, নারীমহল, ছাত্রছাত্রী, চিকিৎসক মহল(জুনিয়র-সিনিয়ার),
বুদ্ধিজীবী এ ঘটনার তীব্র নিন্দা করে অপরাধীদের কঠোর থেকে কঠোরতম শাস্তির দাবীতে পদযাত্রা ও মিছিলে সামিল হয়েছেন -যা এখনও অব্যাহত।
পাহাড়-ধস,ভাঙন,বন্যা,ভিনরাজ্যে গিয়ে পরিযায়ী
শ্রমিকদের মৃত্যু, রেল দুর্ঘটনা ও এর সাথে আছে global warming. সব দেখে শুনে মনে হচ্ছে পৃথিবীর doomsday কী আসন্ন?
বর্তমান বিপন্ন সময়
বেলা দে
এ কোন শরত নিয়ে তুমি পিত্রালয়ে আসছো মা? এই পুতিগন্ধময় শরত তো আমরা চাইনি, কেউ চিনিও না, তুমি আমাদের কল্যাণময়ী মা বলেই জানি জবাব দাও দেখিনি--পুঙ্গব এক পুরুষের জন্ম তো নারী শরীর থেকেই সে নিজেও কন্যাসন্তানের পিতা হয়ে থাকতে পারে, তার একবারের জন্যে মনে হয় না কন্যা,জায়া,জননী সব তার ঘরেই আছে। কন্যাসন্তানের মা কেন টিউশন থেকে স্কুল কলেজ এমনকি স্বাবলম্বী হওয়ার পরও চাকুরীতে একা বাইরে ছেড়ে নিশ্চিত যাপনে দিন কাটাতে পারে না। কেন আমরা এই দুর্জনদের রাজত্বে হীনমন্যতায় নিরাপত্তাহীনতায় বাঁচবো, সে প্রশ্নের উত্তর চিন্ময়ী হয়ে এবার হাতের ত্রিশুলটায় দেখাও। পুকুরপাড়ে রেললাইনের ধারে কাশদাদুর পক্ককেশে দোল লেগেছে হাওয়ায়, কুমোরপাড়ায় মায়ের গায়ে পড়েছে মাটির প্রলেপ কিন্তু আবেগ উন্মাদনা নেই কোথাও, কুমোরভাই তড়িঘড়ি হাত ধুয়ে চলেছে মিছিলশুরুর মাঠে নিজের ঘরের মেয়ের বিচার পাইয়ে দিতে, ভয়ে বুক কেঁপে ওঠে জড়িয়ে রাখে মেয়েকে, কদিন পরেই তো দয়িতা হয়ে উঠবে সে। এমনটা যদি আমার "সোনামনি"র সাথে হয় আর ভাবতে পারে না " we want Justiccces" বলতে বলতে এগিয়ে যায়। কি পার্থক্য আছে তার মেয়ে "সোনার" সাথে ডাক্তার মেয়েটির সেও তো বাপমায়ের আদরে লালিত সন্তান, কত আশা,ইচ্ছে অঙ্গীকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বাবামাকে তাদের সব অভাব দূর করবে,নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার কষ্টার্জিত অর্থে তাঁর আকাঙ্খা ডাক্তার হওয়ার প্রমিত স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার শেষরক্ষাও হল না। বর্বরোচিত হামলার শিকার হয়ে প্রাণটাও চলে গেল। অর্থলোলুপদের ক্ষমতাচ্যুত হবার ভয় নাকি স্বৈরাচারী শাসকের ষড়যন্ত্র ফাঁসের ভয় নামিয়ে দিয়েছে সর্বনাশী খেলায়। দুনিয়ায় জনগণমন এক হলে কোথায় পালাবে শাসক। ধরা কিন্তু ওরা পড়ে যাবেই পাপ ছাড়েনা বাপকে, দেশ ছাড়িয়ে ঝড় বইছে বিদেশেও শুধু নারী নয় নরও এবার সাথে। লড়াই যেনো থেমে না যায় হোক গ্লোবাল ওয়ার্মিং। নতুন যৌবনের দূত জুনিয়র চিকিৎসকরা পিছু হটতে যাবে না, সামনে অনেক সামাজিক দায়িত্ব তোমাদের। ১৪১ কোটি জনতার উচ্চরোল কণ্ঠস্বর "Justice for RGKAR" কিসের জন্য কার জন্য বিশ্বের সমস্ত নারীকুলের সম্ভ্রম বাঁচিয়ে রাখার জন্য কুমোরভাই নিতাই তার ছোট্ট একটুখানি মেয়ে "সোনামণি"কে বলে বল মা জোরে জোরে বল " we want Justice, we want Justice" থামবি না।
আশ্বিনে নব আনন্দ, উৎসব নব
অনিতা নাগ
উৎসব আসে। উৎসব যায়। যুগের সাথে, সমাজ ব্যবস্থার সাথে তাল মিলিয়ে উৎসবের রূপ বদলায়। সাবেকী প্যান্ডেলে আটচালার মূর্তি বদলে যায়। শুরু হয় থিমের পূজো। উৎসব প্রিয় বাঙালী মেতে উঠে। এ'বছরটায় সব কেমন অন্যরকম।
অনুদের আবাসনের শিউলি গাছগুলো ফুলে ফুলে ভরে উঠেছে। শিউলি মানেই তো মা'এর আসার অপেক্ষা। ছোটবেলা থেকে এই এক, দেড় মাস শিউলি কুড়োনোর নেশা অনুর। কলকাতায় ফিরে এই সময়টায় সকালের হাঁটা সে বাদ দিতো না পারতপক্ষে। ফেরার পথে কুড়িয়ে আনতো একমুঠো শিউলিফুল। সারাদিন একটা হাল্কা সুবাসে তাঁর চরণধ্বণি কানে বাজতো। এই সময়টা বড্ড বিশেষ অনুর কাছে। তার অপু দুগ্গাও বাড়ী আসতো। চারটে দিন দেদার মজা, খাওয়া, ঘোরা, আনন্দ। সারাবছরের একা থাকার ফাঁক টুকু ভরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা।
এ’ বছরটায় সব কেমন অন্যরকম হয়ে গেলো। সবই চলছিলো চেনা ছন্দে। গাছে গাছে শিউলি ফুটেছে, পূজোর প্যান্ডেল ক্রমশঃ মাথ চাড়া দিয়ে উঠছে। হঠাৎ ছন্দপতন। এক সাহসী মেয়ে, এক লড়াকু মেয়ে, সর্বোপরি এক ডাক্তার মেয়ে তার কাজের জায়গায়, সরকারি হাসপাতালে ধর্ষিতা হলো, নৃশংস ভাবে খুন হয়ে গেলো। এ’ কোন অন্ধকার সমাজে আমরা বাস করছি! অন্যায়কে বিচারের আবরণে ঢেকে প্রশাসন তৎপর হলো ন্যায় বিচার দিতে। হঠাৎ অন্ধকার আকাশে গর্জে উঠলো আলো। চারদিকের সমস্ত অন্যায় আর অরাজকতা মেনে নিয়ে পাশ কাটিয়ে চলা মানুষগুলোর মনে সেই আলোর ঝলকানি এসে পড়লো। সাধারণ নাগরিক, যারা অহরহ আগামী প্রজন্ম’র ছেলে-মেয়ে গুলোকে স্বার্থ সর্বস্ব, উদাসীন বলে নিজেদেরকে আড়াল করতো তাদের সক্কলকে নাড়িয়ে দিলো এই ছোট ছোট ছেলেমেয়ে গুলো। হঠাৎ এই নবীন চিকিৎসকের দল প্রত্যয়ী হলো আপন বিশ্বাসে। বিচারের দাবীতে অনড় তারা। সেই প্রতিবাদের ঢেউ আছড়ে পড়লো দিকে দিকে। শহর থেকে গ্রাম। গলি থেকে রাজপথ। দেশের প্রান্ত ছেড়ে সেই ঢেউ ছড়িয়ে পড়লো বিদেশে। নিরীহ মধ্যবিত্ত মানবকুল দিব্যি ছিলো রসে বসে। সব কিছুতে থেকেও না থাকাতে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া সেই মানুষগুলো জেগে উঠলো। এ’ যেনো অনেকটা সমুদ্রের পাড়ে বসে সমুদ্রের ঢেউ গোণার মতো। সমুদ্রের পারে বসে ঢেউ গুনতে গুনতে হঠাৎ একটা ঢেউ এসে যখন ভিজিয়ে দেয় পায়ের পাতা, তখন ভয় যায় মুছে। ভেজা জলের স্পর্শে এক অদ্ভুত উন্মাদনা পায়ে পায়ে টেনে নিয়ে যায় পার থেকে সমুদ্রের কাছে। তেমনি করে প্রতিবাদের ঢেউ সকলকে স্পর্শ করলো। নবীন থেকে প্রবীণ, আট থেকে আশি,বিচারের আশায় সবাই পথে নামলো। বিচার চাই। একটাই দাবি।
টালির ঘরে শত কষ্টের মধ্যে যে মেয়ে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন বুনেছিলো, সে স্বপ্নকে সত্যি করা সহজ ছিলো না। ছোট্ট মেয়েটি কাগজে একটা কোচিন সেন্টারের বিজ্ঞপন দেখে মা কে প্রশ্ন করেছিলো এখানে কি হয়? মা বলেছিলেন এখানে ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য তৈরী করা হয়। সেই শুরু হয় স্বপ্ন বোনার পালা। নানা রঙে বোনা উলের কার্পেটের মতো সেই স্বপ্নের বুনন চলতে থাক। মা বাবা আর মেয়ে, তিনজনের স্বপ্ন একদিন সত্যি হয়। মেয়ে ডাক্তার হয়। স্বপ্নের কার্পেট বুননের কাজ কিন্তু থামে না। স্বপ্নের বুনন সেই মেয়েকে এগিয়ে নিয়ে চললো নতুন পথে। হৃদয়, যা মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে, সেই বিভাগে সেরার সেরা হবে সে। কতো স্বপ্ন তার। কিন্তু বাধ সাধলো তার সততা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে তার প্রতিবাদ।
এই সাধারণ মেয়ের কথা সব্বার অজানা ছিলো। এমন তো কতো পরিবার থাকে, কে আর তার খবর রাখছে! কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের শেষ যাত্রায় যখন সামিল নাগরিক সমাজ, সেই ক্ষণে, চুপে চুপে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা ব্যর্থ করে দেয় কলেজের জুনিয়ার ডাক্তাররা। যে ডাক্তাররা বহু অন্যায় মেনে নিয়েছে এতোকাল, সে’দিন তারা গর্জে উঠলো। ছত্রিশ ঘন্টা ডিউটি করা সেই মেয়ে স্বপ্ন বুনতে বুনতে ক্লান্ত চোখের দু'পাতা এক করেছিলো তার কর্মস্থলের এক কক্ষে। যে কর্মস্হল ডাক্তারদের মন্দির, সেখানে সে ধর্ষিতা হলো, খুন হয়ে গেলো। তারপর থেকে বিচারের দাবিতে লড়াই চলছে। এ’ লড়াই সহজ নয়। রাজনীতি! নানান প্যাঁচ। তাকে বোঝার সাধ্য কোথায় সাধারণ মানুষের! তাই তাদের লড়াই পথে নেমে, মোমবাতি নিয়ে, গলা ছেড়ে চিৎকার করে। তারা গলা উঁচু করে বলে ‘মুক্ত করো ভয়’। ভয়ের অন্ধকার যখন সরে যায় তখন আলো জ্বলে উঠে। মেয়েদের সম্মান রক্ষায় আট থেকে আশি স্বোচ্চার হয়েছেন। এমন বিপ্লব, এমন গণ জাগরণ বাঙালি কবে দেখেছিলো জানা নেই।
মা’ এর আসার সময় হলো। মন্ডপে মন্ডপে তার প্রস্তুতি। কিন্তু মা গো, এবার তুমি আসছো বলে আনন্দ করতে পারছি না যে! সেই মেয়েও তো তোমার পূজো করতো। শুনেছি সে নিজের হাতে আলপনা দিয়ে সাজিয়ে দিতো তোমার বেদী। তার গানের সুরে সে তোমাকে অর্ঘ দিতো। শ্রী রামচন্দ্র দুষ্টের দমন করার আগে শরতকালে তোমার পূজো করেছিলেন। তারপর দশদিন ধরে চলেছিলো রাম রাবণের যুদ্ধ। তোমার বরে তিনি জয়ী হয়েছিলেন। তারপর অযোধ্যায় উৎসব হয়েছিলো। এ'বার তুমি জাগো মা। ওই দশপ্রহরণধারিণী, রণসজ্জায় সেজে তুমি জাগো মা। শক্তিময়ী, এ’বার তুমি জাগো। আর তুমি চুপ করে থেকো না মা। চোখ মেলে দেখো সেই মেয়ের ঘরে তোমার শূন্য পূজা বেদী। সন্তান হারা বাবা মা চোখের জলে বিচারের অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন। শ্রী রামচন্দ্র একশো আটটি পদ্মে তোমার পূজো করবেন মনস্থ করেছেন। তুমি ছলনা করে একটি পদ্ম লুকিয়ে রেখেছিলে। সেই পদ্ম না পেয়ে শ্রীরামচন্দ্র তাঁর চক্ষু তোমাকে অর্ঘ্য দিতে উদ্দ্যোত হলে তুমি তাঁকে বিরত করেছিলে। আর এই মেয়ের তো জীবনটাই চলে গেলো। সে’ যে আজ সকলের মেয়ে। তার যন্ত্রণার কান্না তোমার কাছে কি পৌঁছোয় নি মা গো! জাগো মা। অসুরদলনী, পাপ বিনাশিনী তুমি জাগো। তোমার অভয় হস্তে আসুক বিজয়ের জয়ধ্বজা। আমরা সর্বান্তকরণে করবো তোমার পূজো। উৎসব হবে।
এবার তো তোমার পূজোতেও রাত দখলের উৎসব। এমন পূজোর নির্ঘন্ট আগে কখনো কি এসেছিলো? বরাবর তো সারাদিন ধরে চলে তোমার পূজো। মাইকে ভেসে আসে সেই মন্ত্রের সুর। চন্ডী পাঠের শব্দগুলো সুর হয়ে ভেসে বেড়ায়। এ’ বছর তোমার পূজো রাতে। সাতসকালে মহাষ্টমীর অঞ্জলি। সকাল সাতটায় সন্ধিপূজো শেষ। কি ব্যাপার, কৈলাসে বসে হাসছো যেনো! জানি গো মা,তুমি যে অন্যায়কে কখনো মেনে নিতে পারো না। আমরা তোমার সন্তান। সাহস দাও। শক্তি দাও। অন্যায়কে অন্যায় বলতে পারার শক্তি দাও। আমরা বিচার ছিনিয়ে নেওয়ার উৎসবে আছি। এবার পথেই হবে উৎসব। সম্মিলিত বিচারের দাবিতে মুখরিত হবে এ'বারের উৎসব। বিচারের দাবি প্রতিধ্বনিত হবে এ'বারের উৎসবে। কখনো নির্ভয়া, কখনো তিলোত্তমা! আর কতো! এবার সময় হলো। আঁধার পেরিয়ে আলোর উৎসবের অপেক্ষায় সকলের সম্মিলিত পথচলা সফল হোক।
“পথে এবার নামো সাথী পথেই হবে এ পথ চেনা
জনস্রোতে নানান মতে মনোরথের ঠিকানা।
হবে চেনা, হবে জানা।
অনেক তো দিন গেল বৃথাই সংশয়ে
এসো এবার দ্বিধার বাধা পার হয়ে
তোমার আমার সবার স্বপন মিলাই প্রাণের মোহানায় “
অন্ধকার কেটে ভোর আসুক। সেই শুভক্ষণে উৎসবের আঙিনায় মিলবো সবাই।
এবার নবীন মন্ত্রে হবে....
অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী
আবারও একটি বছর ঘুরে শারদীয়ার দ্বারপ্রান্তে আমরা সবাই।ঋতুর নিজস্ব মহিমায় প্রকৃতি নিমগ্ন নিজেকে শরতের সেরা সাজটিতে সাজিয়ে নিতে।আশ্বিনের গাঢ় নীল আকাশের গায়ে শঙ্খশুভ্র মেঘ কখনো ময়ূরপঙ্খী নৌকো,কখনো বা একতাল তুলোর সাম্রাজ্য, কখনো বলাকার শ্বেতাভ মসৃণ পাখা আবার কখনো বা মনে হয় ওই বুঝি পথের ধারের কাশবন নিজেকে উৎপাটিত করে উজাড় করে নীল নীলিমায় ছড়িয়ে দিয়ে বহুদিনের ইচ্ছেপূরণ করেছে সাজো সাজো রবে।
কুঁড়ি থেকে ফুটে ওঠা শিউলির দল ভোরের অনাবিল এক আনন্দ হয়ে,মায়াবী বাসের চাদর বিছিয়ে ঝরে পড়ছে মাটির বুকে।কচি ধানের ক্ষেতে মিঠে হাওয়ার অবিরাম ভালোবাসার কানাকানি।মাধবী বিতানে মন আকুল করা সুগন্ধ।দিঘির স্বচ্ছ জলে নিজের মনোমুগ্ধকর ছায়া দেখে শরত প্রকৃতি নিজেই নিজের রূপ রস গন্ধে মন্ত্রমুগ্ধ,নিজের প্রেমে আত্মহারা নিজেই।ছোট্ট মধুকরটিও নিজস্ব গুঞ্জরণে গাইছে শরতের জয়গান।এ হেন সমুজ্জ্বল রমনীয়তার কাছেই তো বাঁধা পড়েছে শারদোৎসব।এমন দিনেই তো মানায় উমার আনন্দের পদার্পণ। অথচ সে আনন্দ যে একটি বছর ঘুরতেই এমন মন কেমনের ছবি আঁকবে তা জানা ছিল না কারোরই।
কত বিপুল ফারাক প্রকৃতি আর মনুষ্য সমাজের। চোখের অবিরত দেখায় প্রকৃতিকে প্রত্যক্ষ করেও মানুষ কেনো পারেনা প্রকৃতির মতো সুন্দর হতে, অকৃপণ হতে।কেনো পারেনা সবটুকু মাধুরী উজাড় করে নিজের মনটিকে ঢেলে সাজাতে! শুধু নিজের কথা না ভেবে কেনো পারেনা অন্যের খুশিতে সামিল হতে, অন্যের মনের খোরাক আর প্রাণের রসদ হতে! স্থিতধী, নমনীয়, সহনশীল আর নির্লোভ হতে!
বিপন্ন এ সময় অসৎ পথে দুর্নীতির সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার লোভ,আত্মপ্রচার,দুরাচার, অন্যের ক্ষয়ক্ষতি, ঈর্ষা, শত্রুতা,হত্যা ধর্ষণ এমন সব ভয়াবহ অসুখে আক্রান্ত।একজনও কোনো ধন্বন্তরী নেই এই কঠিন অসুখ থেকে মানব সমাজকে মুক্তি দেওয়ার মহৌষধ জোগানোর জন্য।যে যার নিজস্ব স্বার্থ কায়েম করতে বা বাধ্যতামূলক ভাবে মনের বিপরীতে গিয়েও বশ্যতা স্বীকার করে অনুগত হয়ে রয়েছে কালিমালিপ্ত এই সামাজিক পরিকাঠামোর কাছে। স্বচ্ছ বিচারব্যবস্থা নেই,পাপের কঠোর শাস্তি নেই। আছে শুধু মুঠো মুঠো টাকার খেলা।যে খেলায় প্রতিদিন বিকিয়ে যাচ্ছে কিছু আদর্শচ্যুত অমানুষের দল,পিছিয়ে যাচ্ছে তিলোত্তমার সঠিক ন্যায়বিচার।
এক ঘরের মেয়ে উমার লাঞ্ছনা আর বঞ্চনার এমন নিগূঢ় করুণ আখ্যানের পর উমা মা সত্যিই কি হাসিমুখে পদার্পণ করতে পারবেন এবারের শারদীয়ার পুণ্যলগ্নে? সেই রাতের লগ্নটিও তো এক পুণ্যলগ্ন হতে পারতো সাধারণ ঘরের সেই অসাধারণ চিকিৎসক মেয়েটির জন্য। 'সাধারণ ঘরের'- বলেই এত হেনস্থা! এত দুঃসাহস, এত স্পর্ধা চক্রান্তকারী হাতগুলির! মন্ত্রী বা আমলার ঘরের দুহিতা হলে কার বুকের পাটা ছিল ওকে ছুঁয়ে দেখে! হায়রে সমাজ!অন্যায়ের প্রতিবাদের মাশুল যে এভাবে দিতে হবে এত মেধাবী হয়েও বোধগম্যতার বাইরে ছিল তাঁর। আসলে সে যে ভেঙে গুড়িয়ে যাবার আগে পর্যন্তও নিজের শিরদাঁড়া বিক্রি করে দেয়নি বস্তাপচা এই সমাজ প্রনালীর কাছে। পরিকল্পিত ধর্ষণ ও নিষ্ঠুর হত্যার পরও তাই সে বেঁচে আছে দৃষ্টান্তমূলক মানবতার এক পৃথিবীজোড়া আলোর আন্দোলনে,বিচার চাওয়া অসংখ্য আন্তরিক স্বরে, তীক্ষ্ণ কলমের জোরালো দাবিতে, শুভ মনস্ক প্রতিজনের প্রতিদিনের পথচলায়, আলাপে,প্রতীক্ষায় ও তাঁর বঞ্চিত দুঃখী বাবা মায়ের মনের মণিকোঠায়।
শরত নিজস্ব প্রকৃতিগত তাগিদে উজ্জ্বল হলেও এবারের শারদীয়া তাই ম্লান। শরত মেঘের স্নিগ্ধতায়,মনোরম সরোবরে,শিউলির নম্রতায়, কাশবনের আলোড়নে, সোনাঝরা রোদে কেমন যেন এক বিষাদের সুর।আসলে সৌন্দর্য্যকে লুটেপুটে নেওয়ার মনগুলোই যে বড় বিষন্ন আজ।তাই সুন্দরও তার সবটুকু নিয়েও ফিকে, অন্তর্নীল।
তবুও উমা আসবেন।তাঁর আলতা রাঙা পা দুটি ভোরের শিশিরে ডুবিয়ে মুঠোভরা শিউলি সুগন্ধে অভিষেক হবে নবীন মন্ত্রোচ্চারণের এক আলোর বোধনের।সে মন্ত্র দূরদূরান্তে বার্তা জোগাক বিবেকবোধের, মানবতার, সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও শান্তির। প্রতিটি দিনের মায়ের পুজোর মূলমন্ত্র হোক পৃথিবীর আনাচেকানাচে প্রতিটি মেয়ের সুরক্ষা, পাপের বিনাশ ও শুভ শক্তির বিজয়। উৎসব নয়, এবারের শারদীয়া হোক এক আন্তরিক মন উজাড় করা নিবিড় ভক্তির শুদ্ধ আরাধনা। আপামর শুভবোধের কড়জোড়ের প্রার্থনায় সাড়া জাগুক চিন্ময়ী মায়ের বুকের গভীরে। ফুটপাতের দীনহীন মেয়েটিই হোক বা নিম্নবিত,মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত কন্যার দল, এককথায় পৃথিবীজোড়া নারীরা কুদৃষ্টি থেকে, নির্যাতন ও লাঞ্ছনা থেকে, কুচক্রীর ফাঁদে পড়া থেকে মুক্তি পাক। শিশু, কিশোরী, যুবতী, প্রৌঢ়া, বৃদ্ধা সব কালের সমস্ত নারীর সমনাম 'মা'- শব্দটিতে পর্যবসিত হোক।দুর্বৃত্তের চোখ যেন তাঁদের পায়ের পাতা টুকুর বাইরে আর কোনকিছুকে স্পর্শ করতে না পারে। নারী যেন নারীর শত্রু না হয়।পরম ভালোবাসায় একে অন্যের বল ভরসা হয়ে যেন পথচলা জারি থাকে নারীশক্তির। তবেই তো তাঁদের সম্মিলিত উচ্চকিত স্বর ' তফাৎ যাও ' বলে যাবতীয় আবর্জনাকে দূরে ঠেলে একযোগে জীবনের জয়গান গেয়ে উঠবে।
তিলোত্তমার শরীর থেকে মাংস খুবলে নেওয়া অপরাধীদের কঠোর সাজা না ফেরার দেশে থেকেও জ্বালা জুড়োবে হতভাগ্য সেই নিষ্পাপ মেয়েটির।পরম আদরের একমাত্র মেয়ে বিয়োগের চরম কষ্টের এক ধূসর শারদীয়ার শরিক হতে হবে তিলোত্তমার মা বাবাকে। নশ্বর শরীর জ্বলেপুড়ে যাবার পরও যদি পরলোকে কোনো অলৌকিক জাদুঘরে আত্মার অভিষেকে প্রাণের সঞ্চার থাকে তবে সেই অজানা অচেনা প্রান্তরে বাবা মা বিহীন এক দুঃখিনী মেয়ের মন আকুল হবে ঘরে ফেরার টানে।উন্মনা হবে প্রিয়জনের জন্য,নিভৃত ভালোবাসার সঙ্গীটিকে মনে করে। এমন ফেরা যে হয়না আর। তবুও ন্যায়বিচার কিছুটা উপশম হবে তীব্র যন্ত্রণার।দশভূজার পায়ের কাছের সবচেয়ে উজ্জ্বল কোমল পদ্মটিতে কৃতজ্ঞতার শিশিরবিন্দু লিখবে জীবনের কথা, বেদনা থেকে উত্তোরণের মন্ত্র.....
'শান্তি দিলে ভরি।
দুখরজনী গেল তিমির হরি।
প্রেমমধুর গীতি
বাজুক হৃদে নিতি নিতি মা।
প্রাণে সুধা ঢালো
মরি গো মরি....'
কন্ঠে তুমি
জয়তী ব্যানার্জী
ভাবছি আজ একটা চিঠি লিখব তোমায় রবিবাবু। চারিদিক আজ অশান্ত বাতাসে বিষবাষ্পের ঘনঘটা। জনতা উত্তাল- রাত দখল, ভোর দখল ,রাস্তা অবরোধ, পোড়া পোড়া গন্ধে নাকে আসে না শিউলির মিষ্টি সুবাস। চোখে পড়ে না। যেদিকে তাকাই সোনার আলোয় ,
দেখি যে ছুটির ছবি ।
পূজার ফুলের বনে ওঠে ওই
পূজার দিনের রবি ।
কিন্তু এসবের মাঝেই যে রবিবাবু তোমাকে আমাদের ভীষণ প্রয়োজন। তুমি চলে যাওয়ার প্রায় ৮৫ বছর অতিক্রান্ত, কিন্তু তবুও রবি ঠাকুর তোমার উজ্জ্বল উপস্থিতি প্রতিনিয়ত প্রতিক্ষণে আমরা অনুভব করি ।পথেঘাটে, সুখে দুখে, জয়ে- বিজয়ে সবেতেই তো তুমি! তোমাকে না বলে যে কোন পদক্ষেপেই আমরা এগিয়ে যেতে পারি না। আবাল বৃদ্ধবনিতার মুহূর্ত গোনা যখন শেষ, তখনই যে আমরা বারংবার শুনতে পাই সেই পদধ্বনি; সেই হৃদয় কাঁপানো ধ্বনি- "আমি এসেছি তোমার ই দ্বারে"।
আমজনতা যেন রুখে দাঁড়িয়েছে ।তারাও যে অঙ্গীকারবদ্ধ, সুতীব্র চিৎকার ধ্বনিত হচ্ছে আকাশে বাতাসে-
'যেতে নাহি দিব '
হায়! তবু চলে যেতে হয়!
প্রতিক্ষণে প্রতিমুহূর্তে তুমি অনুরণিত হও, ধ্বনিত হও আমাদের হৃদয়ে। জনজোয়ারে কান পাতলে ভেসে আসে-
"সংকোচেরও বিহ্বলতা
নিজেরই অপমান ,
সংকটেরও কল্পনাতে
হয়ো না ম্রিয়মান "!
পথেঘাটে, সুখে দুখে, জয়ে বিজয়ে সবেতেই তো তুমি। তোমাকে না নিলে কোন পদক্ষেপেই আমরা এগিয়ে যেতে পারি না। তিলোত্তমার রুদ্ধশ্বাস ডাক বোধ হয় তুমি শুনতে পেয়েই বলেছ-
"মাগো
আমায় ছুটি দিতে বল !
সকাল থেকে পড়েছি যে মেলা ;
এখন আমি তোমার সাথে,
করব শুধু পড়া পড়া খেলা"।
রক্তাক্ত তিলোত্তমা লাল চাদর মুড়ি দিয়ে চলে গেল অসীম অনন্ত লোকে। কিন্তু রেখে গেল ঘূণ ধরা সমাজকে উপড়ে ফেলার জন্য কিছু বিধ্বংসী চোয়াল। রেখে গেল সেই রক্তকরবীর তোমার ই হাতে তৈরি 'সন্দীপ'কে ।আর রেখে গেল তাদের -যারা তোমার কথা মতো 'বিদ্যাকে বহন না করে সারা জীবন বাহন করে' চলবে ।নেমে এলো একদল তরুণ- তরুণী বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ থেকে ।দৃপ্ত কঠিন কন্ঠে ঘোষিত হল -
" পুড়িয়ে ফেলো
ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা
পুড়িয়ে ফেলে
আগুন জ্বালো"।
সত্যি !রবি ঠাকুর, আগুন জ্বালার দিনই এসেছে। কোথাও আবার দইওয়ালা নাকি বলছে 'বিচার চাইগো, বিচার চাই'। ঝোলা হাতে কাবুলিওয়ালা তার ছোট্ট মিনি কে শেখাচ্ছে-
"খর বায়ু বায় বেগে ,
চারিদিক ছায় মেঘে ;
ওগো নীড় নাওখানি
বাইও ,
হাই মারো -মারো টান
হাই ও হাই ও।"
এখানেও তো তোমার মুক্তি নেই রবি ঠাকুর! তিলোত্তমাকে যখন টালা থানা থেকে তড়িঘড়ি নিয়ে যায়, সে যে তখন ও ভুলতে পারেনা তার ওই দুঃসহ রাতটার ছবি ।সে যে শ্বাপদের গ্রাস থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারেনি। সে তার শুভ বুদ্ধি কে অনেক চেষ্টা করেও মাথা তোলাতে পারেনি। তার যে হাড়গোড়, হৃৎপিণ্ড, সুষুম্না সব গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গিয়েছে।সে যে ক্লান্ত এক শব ,যাকে নিয়ে উৎ-শবে মেতেছে রাজবাড়ি। ক্লান্ত-শ্রান্ত পথচারীকে সে শোনায় -
"ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু,
পথে যদি হারিয়ে"।
তারপর- সব শেষ!হায়,গো জনান্তিক, কিছুক্ষণের মধ্যেই কালো কালো ধোঁয়া তে ঢেকে গেল সব স্বপ্নেরা। তাকিয়ে তাকিয়ে আমরা সবাই দেখলাম অনাচারের যূপকাষ্ঠে নিজেকে বলি দিয়ে কিভাবে তোমাকে সঙ্গী করে গাইতে হয়,
"উড়ে চলে দিক্ দিক্
দিগন্তেরও প্রান্তে ,
নি:সীম শুণ্যে শ্রাবণ বরষণ
সংগীতে।"
তুমি তো রয়েছো সেই অনন্ত লোকে। তুমি কি ভাবতে পেরেছিলে রবি ঠাকুর, কোনদিন এভাবে এই অভাগার জন্য তোমাকে রাতের পর রাত জাগতে হবে? তুমি কি এজন্যই সেদিন শিলাইদহে বসে লিখেছিলে -
'বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে'।
অভায়া, নির্ভয়া, তিলোত্তমারাও বোধ হয় এখন তোমার পাশে শুয়ে গুনগুন করে গাইছে,
"তোমারও অসীমে,
প্রাণ মনো লয়ে
যতদূর এই আমি ধাই-ই!"
তবুও উত্তল জনতা হয় না রবি ঠাকুর । রাত দখলের অভিপ্রায়ে নিশুতি রাতে হাতে মোমবাতি নিয়ে শান্ত সমাহিত চিত্তে তারা গাইতে থাকে,
"আগুনের পরশমণি
ছোঁয়াও প্রাণে ;
এ জীবন পুণ্য করো,
এ জীবন পূর্ণ করো ,
দহন দানে"।
রবি ঠাকুর এইতো তুমি! সেই ছোটবেলা থেকেই তোমার হাত ধরেই তো যেমন শিখেছিলাম,
"ছুটিয়ে ঘোড়া গেলেম
তাদের মাঝে ;
ঢাল তলোয়ার ঝনঝনিয়ে বাজে,
কী ভয়ানক লড়াই হল মা যে !
শুনে তোমার গায়ে দেবে কাঁটা -"
এভাবেই ছোট থেকে বড়, বড় থেকে কৈশোর, কৈশোর থেকে যুবতী, যুবতী থেকে প্রাপ্ত- সকলেরই যে তুমি না বলা কথার আশ্রয়স্থল। তুমিই শিখিয়েছো কমনীয় হতে, আবার তুমি বলেছ ,
"শক্ত করো হাল
আপনা মাঝে শক্তি ধরো
হয়ো না ম্রিয়মান"।
অবলা নারী তোমার হাত ধরেই হয়েছে প্রতিবাদী। আবার এই ভোর দখলেই বিচারের আশায় নারী সমাজ গেয়ে উঠেছে,
'বাজলো তোমার আলোর বেণু,
শারদ ও প্রাতে'-
আর রাস্তার ওইপার থেকে ছেলের দল গাইতে গাইতে আসে,
"নিশিদিন ভরসা রাখিস
হবেই হবে ,
যদি পণ করে থাকিস
সে পণ তোমার রবেই রবে।"
ভালো থেকো রবি ঠাকুর।
একটি চিঠি
রীতা মোদক
প্রিয় মাথাভাঙ্গা ,
কেমন আছো ? তোমার বুকে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠা , কত খেলাধুলা -হৈ হুল্লুর -ছুটাছুটি , কত হাসি -কান্নার স্মৃতি, সে কি ভুলতে পারি ? ধূধূরা ব্রিজ পাড় হয়ে পঁচাগড় তেপথীর পর সুটুঙ্গা নদীর কাঠের ব্রিজের উপর দিয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে হেঁটে রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ আর আর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়তে যেতাম । এটি ছিল মাথাভাঙ্গা গার্লস হাই স্কুলে , মর্নিং স্কুল । স্কুল ছুটির পর মালী বাগানে দোলনায় দোল খাওয়া , সুটুঙ্গার জলে মাছেদের খেলা , পানকৌরির ডুব দেওয়া দেখতে দেখতে বাড়ি আসতাম । মানসাই এর জলের কুল কুল শব্দ , চড়ে তরমুজ ক্ষেত , তেকোনিয়ার সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে কত মানুষ কবি হয়ে গেলো । তারপর স্কুল -কলেজের গন্ডি পেরিয়ে যখন উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই তোমার কথা ভীষন মনে পড়ত । দীর্ঘ দুবছর তোমার থেকে দূরে ছিলাম । হোস্টেলের রুমে ঘুম আসত না কিছুতেই , মন পরে থাকতো তোমার উপর । ইউনিভর্সিটির ক্যাম্পাসে তোমার কোল থেকে আসা কোনো লোক চোখে পরলে মনটা খুশিতে লাফিয়ে উঠতো । লোকটি আমাকে চিনুক বা না চিনুক দৌঁড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করতাম --
-"তোমার বাড়ি মাথাভাঙ্গা না ? ওখানকার সবাই ভালো আছে ? বর্ষায় সুটুঙ্গার কাঠের ব্রীজটা ঠিক আছে তো ? নাকি ভেঙে গেছে ? "
লোকটা একসঙ্গে এতো প্রশ্ন শুনে প্রথমে থতমত খেয়ে গেলো । পরে বলেছিল --"আমি মাথাভাঙ্গা থেকেই এসেছি । "
মাঝে মাঝে লাইব্রেরী থেকে বই আনতে যেতাম । এন্ট্রি করার আগে যদি কেউ জিজ্ঞেস করত --"বাড়ি কোথায় ? "
আমি গর্ব করে তোমার নাম বলতাম -"মাথাভাঙ্গা । "
তখন লাইব্রেরী থেকে বলত --"ওরে বাবা ! এ মেয়ে তো মাথাভাঙ্গা থেকে এসেছে , এখন ও আমাদের মাথা ভেঙে দেবে ? "
এখনো মাঝে মাঝে এসব কথা মনে পরে ,আর হাসি পায় । শিলিগুড়িতে "মাথাভাঙ্গা " লেখা বাস দেখলে খুব ভালো লাগতো । বাসে করে বাড়ি ফেরার সময় জানালা দিয়ে দেখতাম গাছপালা , নদ-নদী । চোখ খুঁজে বেড়াতো চেনা মানুষ , চেনা জায়গা । ক্রমে মহানন্দা , তিস্তা , ধরলা নদী পেরিয়ে , জামালদহ পেরিয়ে মাঝিরবাড়ি এলেই মনটা আনন্দে দুলে উঠতো -- তোমার সীমান্তে পৌছে গেছি ! বাড়ি পৌছে পরের দিনই সাইকেল নিয়ে বেড়িয়ে পরতাম প্রিয় শহরটাকে দেখার জন্য ।
এখন তুমি অনেক জমজমাট । সাহিত্য , সংস্কৃতি , শিক্ষা- দীক্ষা ---- সবদিক দিয়ে তুমি পরিপূর্ণ । কিন্তু কিছুদিন ধরে আর জি করের
ভয়ানক ঘটনার খবর শুনে তুমি খুব চিন্তিত । তোমার রাজপথ জুরে চলছে প্রতিবাদ মিছিল। এক তিলোত্তমার মৃত্যুতে হাজারো তিলোত্তমা যেনো জেগে উঠেছে। জানি অপরাধীর কঠিন শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত তোমার শান্তি নেই।দেখতে দেখতে শরৎ কাল চলে এলো। তুমি আর আতঙ্কিত হয়ে থেকো না মাথাভাঙ্গা । এবারের পুজোয় তুমি নতুন রূপে সেজে ওঠো। তোমার রাজপথ জুড়ে আঁকা হোক প্রতিবাদী চিহ্ন। তোমার পাড়ার -পাড়ায়, ক্লাবে অথবা যেখানেই মৃণ্ময়ী মূর্তি স্থাপন হবে, তারা যেনো চিন্ময়ী হয়ে অসুর বিনাশিনী রূপে দেখা দেন।তোমার বুকের আগাছাকে উপড়ে ফেলে তোমাকে সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন রাখতে আমরা বদ্ধপরিকর । কারণ , আমরা তোমাকে খুব ভালবাসি । তুমি ভালো থেকো , সুস্থ থেকো ।
ইতি --
তোমার নাগরিক
রীতা
স্বপ্ন দেখাও তুমি
পূর্বা দাস
আকাশ জুড়ে দীর্ঘশ্বাস জমাট বাঁধলে গুঁড়ো গুঁড়ো বৃষ্টির মতন কবিতারা নেমে আসে পৃথিবীতে। ল্যাম্পপোস্টের ডগা থেকে ঝরে পড়া নিয়ন আলোয় যেন কোনো নিঃসঙ্গ সন্ধ্যার ব্রতকথা। শরতে মেঘেরা এলে নাকি আকাশের গায়ে আপনিই কবিতা লেখা হয়ে যায়! আমি যে কেন দেখতে পাই না কে জানে। সবকিছু বড্ডো থমথমে। চারিদিকে শুধু স্বপ্ন ভাঙার শব্দ। মেঘ মেদুর আকাশে কোথায় তুমি ঘনশ্যাম!
যুগ যুগান্তরের নিষ্ঠুরতায় ক্ষতবিক্ষত আমি ঘুমোতে পারি না কত রাত। ভাঙাচোরা এই শহরের পাঁজরে কান পাতলে শুধুই শূন্যতা।
কাকভোরের শিশিরে ভারী হয়ে আসে ক্লান্ত দুচোখের পাতা, বুকের ভিতর আকাশছোঁয়া কথার পাহাড়। সে পাহাড় ডিঙোতে যে স্বপ্ন দেখতে হতো আরো অনেক ! হলো না, কিচ্ছু হলো না। উদ্ভ্রান্ত নগরে স্বপ্নেরা আজ উধাও। আমি ঘাড় গুঁজে পড়ে থাকি এককোণে, ভোরের বাতাসে আগমনী রোদ্দুরের ছোঁয়া। তাকে এক-পা দু-পা করে গ্রাস করছে উৎসবের কটূ গন্ধ। ঘরের বোবা দেয়ালগুলো ক্রমশঃ ঘিরে ধরে আমাকে। অভিমানী জানলার পর্দা উড়ে যায়, তবু অধরা রয়ে যায় আলোর স্নেহস্পর্শ। আশপাশটা কেমন জংলী কাঁটা ঝোপে দ্রুত আড়ষ্ট হয়ে আসে। মৃত জলাশয়ে বন্দী পদ্মপাতায় ছটফট করে জলকণা। কার্নিশে কদিন আগেই বাসা বেঁধেছিল একটা মা-চড়াই, কোনো এক সন্ধ্যায় সে আর ফেরেনি। তার ছোট্ট ছানারা কেবল চিঁচিঁ করে, কেউ কি বোঝে ওদের উড়তে না পারার জ্বালা? এই অভিশপ্ত পৃথিবীতে ওরা চিৎকার করে জানাতে পারে না ওদের দাবি। ওদের মুক্তির গল্পগুলোও কখনো উপাখ্যান হয়ে ওঠে না।
হঠাৎই আমার পাতাবাহারের গাঢ় খয়েরী পাতারা ঝরে যেতে থাকে মার্বেলের মসৃণ মেঝেতে। বাইরে ভীষন ঝড়। ঘুণ ধরা সাম্রাজ্যে একটা একটা করে খসে পড়ছে ইঁট-কাঠ-পাথর, আলাদা হচ্ছে মুখ আর মুখোশ। ব্র্যান্ডেড জামাকাপড়ের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে সভ্যতার কঙ্কাল। পচে গলে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে চারপাশে, দম বন্ধ হয়ে আসছে বিষবাষ্পে। রাজপথে সবাই শুধু ছুটছে অবিরাম। কেউ খুঁজছে সাহস, কেউ বা স্বাধীনতা, কেউ ফুরিয়ে যাচ্ছে হতাশায়, কারোর দুচোখে ঝরছে আগুন, কারোর কবিতারা সব হারিয়ে গেছে ভুল ঠিকানায়। ক্রমশঃ অন্ধকার ঘনিয়ে আসে অলৌকিক। আমার প্রিয় নক্ষত্র যেন তলিয়ে যেতে থাকে কৃষ্ণগহ্বরে। মাথা ঝিমঝিম করে। কোনো বিপ্লবীর তাজা রক্তের গন্ধে ঢাকা পড়ে যায় শারদীয়ার ধূপের ধোঁয়া। ঘুটঘুটে আঁধারেও কিছু ছন্নছাড়ার দল আলোর পথ এঁকে দেয়, ওদের মশালের শিখা যেন ছুঁয়ে নেয় আকাশের সবচেয়ে উঁচু তারা। অবসাদে ক্ষয়েও বারবার আগুন জ্বালার স্বপ্ন দেখায় ওরা।
এ জীবন যেন প্রতিধ্বনির মতো। নিঃশ্বাসের প্রতিটা গন্ধ, বিশ্বাসের ভালো-মন্দ, ঘুণ ধরা অনুভূতির পাহাড়, সত্যি-মিথ্যা, রাখা না-রাখা সব কথারা বারবার ফিরে ফিরে আসে এই আকাশে, পাহাড়ে, মাঠে, বৃষ্টির ফোঁটায়। তাই আমার কথারা ব্যথা হবার আগেই গোপন রাখি নিজের ভিতর, আর একটু একটু করে জমাট বাঁধে মুক্তো। ঝিনুকের মতো আমার নিঝুম অন্তঃপুরে বাসা বাঁধে প্রত্যয়। ফুরফুরে ঝরঝরে কবিতা হয়ে যদি আসে ওরা কোনোদিন! তবে ঝর্ণার মতো নিয়ম ভাঙার খেলায় মাতবো সেদিন আমিও।
এই খুঁটি বাঁধা জীবন, বেঁচে থাকার সোঁদা গন্ধ - কি ভীষন নেশার মতো। পরতে পরতে সাসপেন্স। তবু মাঝেমাঝে নিজেকে রূপকথার রানী ভাবতে বেশ লাগে। আমি যে মহামায়া নই। হে পরমেশ্বর, যদি সম্মতি দাও এ কঠিন ব্রতে, তবে ছুমন্তরে আমার চুপকথারা মেলবে ডানা। শুক্লপক্ষের কোনো মায়াবী রাতে শতাব্দীর যত অন্ধকার ঘুচে যাবে আমার যাদু কাঠিতে ! এ মহাদেশের প্রতিটি কুরুক্ষেত্রে ইন্দ্রজাল জড়িয়ে ঝাঁপিয়ে নামবে বৃষ্টি কোণায় কোণায়, পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ঝমঝমিয়ে নামবে অসময়ি শ্রাবণ গলা প্লাবন! বরফের তীক্ষ্ণ ফলায় চূর্ণবিচূর্ণ হবে অশুভ শক্তি। স্রোতের তীব্র বেগে কেঁপে উঠবে বসুন্ধরা! মনের কোণে ফসফরাস জ্বলে ওঠার আগেই ধুয়ে যাবে বিষের যত নীল। স্নিগ্ধ হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে ঈশান কোণের বিষন্নতা। পড়ে থাকবে শুধু শান্ত সূর্যাস্ত, একটা লালচে আকাশ আর কয়েক মুঠো দূর্বা ঘাস। নদীর জলে পা ডোবানো কোনো সন্ধ্যায় আবার চুনীর মতো রাঙা হয়ে উঠবে প্রেম। অস্তরাগের গোলাপী আভায় চুঁয়ে পড়া আঁধারকে সাক্ষী রেখে যদি হাতে হাত রাখি তোমায়-আমায়, তবে সেদিন সত্যি হবে এ যাদু কথন।
হে মধুসূদন, ফিরে এসো এ জরাজীর্ণ সভ্যতায়। আর্দ্র হোক তোমার পাথর চোখ। শ্রান্ত মুখের ক্লান্ত মিছিলে তুমিও হও সামিল। তোমার মোহন বাঁশী তে জুড়ে যাক বুকপকেটে বন্দি যত ছেঁড়া স্বপ্নের বহর। অসুরনিধন যজ্ঞের পুরোহিত হও তুমি। এ পোড়া দেশে শাশ্বত হোক শুধু প্রেম।
তুমি আসবে বলে রাতঘুমে এখনো স্বপ্নেরা বড়ো দুঃসাহসী। কোনো কোজাগরী রাতের রিনরিনে বৃষ্টিতে পৃথিবীর সব অজুহাতেরা হলে পলাতক, আকাশজুড়ে আবার ভেসে আসবে গতজন্মের স্মৃতি বিস্মৃতির যত অক্ষরমালা। সময় থমকে যাবে আর ডানা মেলে উড়তে থাকবে সদ্যোযৌবনা সপ্তর্ষিমন্ডল। বেপরোয়া কবিতারা জাগিয়ে রাখবে আমায় সারা রাত। চাঁদ চেয়ে থাকবে অপলক, অনন্তকাল, তোমার মতো। কালপুরুষের রেখা ধরে গুণতে থাকা সময় কালের সীমানা ছাড়িয়ে মেঘের গা ঘেঁষে পাতবে মায়ার নীল চাঁদোয়া। আবার কোনো ভোর আদরে শরৎ মাখবে গায়ে, আমার কাগজের পাখি ডানা মেলে উড়বে রূপকথা হয়ে।
আর আমি? ছন্দ না মিললে ছাইভস্ম লিখবো আর “তোমার সঙ্গে চার অক্ষর জীবন কাটাবো”।