মুজনাই
অনলাইন শারদ (আশ্বিন) সংখ্যা ১৪৩১
প্রবন্ধ/ নিবন্ধ
নারীশক্তি ও নিরাপত্তা
রাজর্ষি দত্ত
দুর্গাপূজা আসন্ন। মাতৃ আরাধনায় আপামর বাঙালি প্রতিবারের মত তৈরি হচ্ছেন। তবে এইবার পূজাকে ঘিরে সেই উন্মাদনা বেশ স্থিমিত।
মায়ের পূজা বাঙালীদের চিরাচরিত। সে দুর্গা, কালী, জগদ্ধাত্রী, লক্ষ্মী, সরস্বতী – যাই হোক না কেন ! উত্তর-পূর্ব ভারতের মত সম্পূর্ণ মাতৃতান্ত্রিক সমাজ না হলেও আজকের দিনে এই বঙ্গে মেয়েদের গুরুত্ব কম নয়।বাঙালি মেয়েরা যে মানসিক দিক থেকে পুরুষের চেয়ে শক্ত – সেকথা অনেক অবাঙালিই বলে থাকেন। বৃদ্ধ বয়সে পুরুষের মনের জোর যখন তলানিতে ঠেকে তখন পদে পদে তার স্ত্রীকে দরকার। সেখানে উঠতে-বসতে খোঁটাও যেন মোটিভেশনের কাজ করে।
বিবাহিত বাঙালি পুরুষ উচিৎ অনুচিত অনেককিছুই শেয়ার করেন তার অর্ধাঙ্গিনীর সাথে। প্রিয় বন্ধুর টিপ্পনী থেকে উপরওয়ালার ঝাড় অবধি।এরপর স্বামীর যথাযোগ্য কন্ডাক্ট-টিও ঠিক করে দেয় গৃহিণী। আজকের শিক্ষিতা নারীদের মধ্যে স্বাধীনতাবোধ এতটাই তীব্র যে তার সীমারেখার বিচার অন্যপক্ষের মতামতের ওপর নির্ভর করে না। সোসাল মিডিয়ায় অবাধ বিচরণের কথা উহ্য থাকলেও হয়।
কিন্তু ঘরে বাইরে মেয়েদের স্বাধীনতা কতটা প্রশ্নসাপেক্ষ তা তিলোত্তমার ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল।অন্য রাজ্যে তো হয় বলে জানি, এবার পশ্চিমবঙ্গেও ? ঘটনার নৃশংসতা নাড়িয়ে দিয়েছে পুরো বিশ্বকে যা সংগঠিত হয়েছে নিজের কর্মক্ষেত্রের আঙিনায়।
নিদারুণ যন্ত্রণার শরিক হয়ে প্রবলভাবে এগিয়ে এসেছেন বঙ্গের নারীরা – সুতীব্র প্রতিবাদ ও জাষ্টিসের দাবী নিয়ে। সাথে যোগ দিয়েছেন সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষেরা। এই স্বতঃস্ফূর্ত জনজোয়ার বিগত বহু দশকে দেখা যায়নি এই বাংলায়। গোড়ার দিকে প্রতিবাদ ছিল ‘অমানবিক ধর্ষণ’-কে কেন্দ্র করে।সময়ের সাথে সাথে জানা গেছে এটি একটি ‘হত্যা’ – পরিকল্পিত বা অপরিকল্পিত, ধর্ষণ যার একটি অংশ। উল্লেখ করা দরকার, সাম্প্রতিক এই প্রতিবাদের ঝড়ের উৎসও হল আরেকটি প্রতিবাদ। একটি মেয়ে- চোখের সামনে অনেক দুর্নীতি দেখে তার বিরুদ্ধে একা রুখে দাঁড়াতে গিয়ে প্রাণ দিল।
কিন্তু ক্রাইমের নেচার যাই হোক না কেন, তাতে মুল দাবী জাষ্টিসের কিছুমাত্র বিচ্যুতি ঘটে না।কারণ জাষ্টিস শব্দটির বিস্তৃতি অনেক। অথচ আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য – যা ছিল হয়তো সরকার নয়, সিস্টেমের বিপক্ষে তা দানা বাঁধার সময় পেল না। পরবর্তী জনজোয়ার অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে কাজ করলো ব্যক্তিগত অপ্রাপ্তি, বঞ্চনা প্রচারের প্লাটফর্ম হিসেবে এবং সেই সুযোগে ঢুকে পড়লো ঘোলা জলের রাজনীতি।বহু মানুষের যোগদান যেন গনতন্ত্রের উৎসবে সামিল হওয়া বা মিছিলগঙ্গায় আবগাহনে নিজের দ্বিধা ও পাপ ধুয়ে ফেলা। যে যা পাবার সবই পেল – ব্রেকিং নিউজ, বাইট, ফিজ, অক্ষর, পরিচিতি, ফুটেজ... আর যে হারালো একমাত্র সেই পেল মোচড়ানো তালগোল পাকানো একবুক যন্ত্রণা ! অতএব রেপ কেস বন্ধের আপাততঃ কোন খবর নেই। প্রতিটি সেশন আদালতে যেমন জমা হয়েছে শত শত ধর্ষণ মামলা, তেমন আরও হয়ে চলেছে।সেইসাথে বাইরের দুনিয়ায় সর্বত্র সেই ভয়ের বাতাবরণটা যেন আবার ফিরে আসছে নিজস্ব গতিতে। ফিরে আসছে পথেঘাটে অচেনা ছেলেদের সম্পর্কে মেয়েদের বিচার করার সেই অনন্ত প্রক্রিয়া।
সবার আগে যেটা প্রয়োজন – নারীর প্রতি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন- তা কিন্তু একদিনে হয় না।প্রশ্ন উঠতে পারে ছেলে সন্তানদের বয়ঃসন্ধিকালে তার মানসিক কাঠামোর কতটা যত্ন আমরা নিচ্ছি ? তাতে কোন ফাঁক রয়ে যাচ্ছে কি না ? টিন এজ শেষের আগেই ওরা জানতে পারছে ভবিষ্যতে চাকরি বাকরি নেই, উপার্জনে নেই কোন স্থিরতা। তাই মন নেই স্কুল-কলেজে পঠন পাঠনে (যা কিছুটা হয়তো চরিত্র ও মানসিক গঠনের সহায়ক)। ফলতঃ অচিরেই গ্রাস করে হতাশা – আচরণে দেখা যায় বিক্ষুদ্ধতা বা বিকৃতি। ক্ষণিকের আনন্দ দেয় পর্ণসাইট। লিবিডো অপেক্ষা করে সুযোগের – নরম মাংসের লোভ হতে থাকে ঊর্ধ্বমুখী। আদিম রক্তের প্রবাহকে কি অত সহজেই ঝেড়ে ফেলা যায় ? পশু থেকে মানুষে উত্তরণে যে মূল কথা বুদ্ধের বাণীতে পাই – “ It is better to conquer yourself than to win a thousand battles...” তা কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী সাধনার অংশ।
নিরাপত্তার জন্যই হোক বা সুস্থ সমাজের নিমিত্তে, নারীর ভুমিকা এখানে অনস্বীকার্য যেহেতু পুরুষরা এখনও তৈরি নয়। রবীন্দ্রনাথের ‘চার অধ্যায়’ উপন্যাসে মাস্টারমশাই যখন এলাকে বলেন “ তোমরা বলে থাক মেয়েরা মায়ের জাত। কথাটি আদৌ গৌরবের নয়। মা তো প্রকৃতির হাতে সতঃই বানানো – জন্তু জানোয়ারেরাও বাদ যায় না। তার চেয়ে বড় কথা তোমরা শক্তিরূপিণী। আর এইটাকেই প্রমাণ করতে হবে দয়া মায়ার জলাজমি পেরিয়ে শক্ত ডাঙায়। শক্তি দাও...পুরুষকে শক্তি দাও !”
এই শক্তি আসলে মানসিকভাবে বলীয়ান হবার পাঠ। মা, দিদি, স্ত্রী, বন্ধু হিসেবে ছেলেদের যত্ন ও মানসিক সুস্থতার দেখভাল হয়তো একদিন বঙ্গ সমাজের মাথা হেঁট করাবে না – আজকের মত।
------------
পুনশ্চঃ মাতৃ আরাধনা, আদিম রক্ত, বুদ্ধের বাণী ও চার অধ্যায় ছাড়া বাকি সব মিডিয়া থেকে প্রাপ্ত। তাই প্রকৃত সত্যের ভার বইতে এই কলম অপারগ।
এবারের দুর্গোৎসব : এক অন্য শরৎ
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়
হাইল্যান্ড পার্ক থেকে আর জি কর অবধি মানুষের মিছিল। মিছিল বললে ভুল হবে, একেবারে জনসমুদ্র। বারাসত থেকে শ্যামনগর মানবশৃঙ্খল যে কোনো মামুলি বিষয় নয় একথা আশাকরি সকলেই স্বীকার করবেন। আর জি কর কান্ডের পর জনমানসের আন্দোলনের এই ঢেউকে যারা শহুরে আন্দোলন বা মধ্যেবিত্তের আন্দোলন বলতেন তাদের একটু অন্য চিত্র দেখাতে চাই। জলপাইগুড়ি শহর থেকে কোরানিপাড়া, সানুপাড়া, টোপামারি, পান্ডাপাড়া চেকপোস্ট এর দুরত্ব অনেকটাই এগুলো খড়িয়া এবং পাহাড়পুর গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীনে ছোটো ছোট গ্রামসভাতে পথসভাগুলোতে প্রতিবাদী মানুষের ভিড় উপচে পড়ছে।
একটা সময় ছিল যখন সকালের সংবাদপত্র ধর্ষণের খবর ছাপলে সংবাদপত্রটা পড়বার আগ্রহ হারিয়ে ফেলতাম। ছোটোদের নজরে পড়বার আগেই লুকিয়ে ফেলতাম খবরের কাগজ। ক্রমান্বয়ে ধর্ষণের খবর কেমন যেন গা সওয়া বিষয় হয়ে গেল। একটু একটু করে সমাজের অপরাধীরা রাজনৈতিক ছাতার তলায় আশ্রয় পেতে থাকলো। কোন বিশেষ দলের বা শাসক দলের ছাতার তলায় আশ্রিত হলে দুস্কৃতিদের সব অপরাধ লঘু করে দেখবার প্রবনতা দেখা দিল। আর জি করের ধর্ষণ এবং পরিকল্পিত খুন সব নারকীয় কান্ডকে ছাপিয়ে গেল।
এই বছরের শরৎ এবং শারদোৎসব একটু অন্য রকম। মহালয়ার ভোরে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চন্ডিপাঠের মন্ত্রোচ্চারণ শোনার প্রত্যাশায় প্রহর গোনার অতীতকে স্মরণ করে নিজেকেই প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে " এ কোন সকাল, রাতের চেয়েও অন্ধকার।
এ যেন এক অন্য শরৎ। এবার কাশফুল আছে, মেঘমুক্ত পেঁজা তুলোর মেঘ আছে, স্থলপদ্ম শিউলিরা আছে, কিন্তু জনমানসে উৎসব নিয়ে উৎসাহ কেমন যেন বেশ ক্ষীন। বাতাসে হিমেল হাওয়ার স্পর্শ বেশ স্পষ্ট। কিন্তু গনেশ চতুর্থী থেকেই মন্ডপের প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে আর জি করের হতভাগিনী মৃতা চিকিৎসকের বিচারের পোষ্টার পড়েছে। একটা সাদা-কালো গন আন্দোলনের ছবি চারিদিকে।
দুর্গাপূজা হিন্দু দেবী দুর্গাকে নিবেদিত একটি উৎসব, যিনি শক্তি, সাহস, সততা এবং ন্যায়বিচারের প্রতীক। দুর্গাপূজার উৎপত্তি প্রাচীন ভারতে। খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দের দিকে দূর্গা পুজো এই বঙ্গদেশে অনুষ্ঠিত হয়েছিল বলে মানা হয়ে থাকে। বৈশাখে মা গন্ধেশ্বরী পুজো থেকে শুরু করে চৈত্রে বাসন্তী পুজো অর্থাৎ বছরের প্রতি মাসেই দেবী দূর্গা পুজিত হয়ে থাকেন। তন্ত্রশাস্ত্র মতে সব জায়গাই দেবী দূর্গার স্থান। বছরের যে কোনো সময়ই দূর্গাপুজো করা যায়। তবে হিন্দু মতে বছরে চারটি নবরাত্রিতে দুর্গাপুজো করা হয়ে থাকে। আশ্বিন মাসের দুর্গাপুজোকে শারদীয় দুর্গাপুজো এবং বসন্তকালের দুর্গাপুজোকে বাসন্তী পুজো বলা হয়ে থাকে। দুর্গাপূজার ইতিহাস অত্যন্ত সমৃদ্ধ এবং বৈচিত্র্যময়। এই পূজার উৎপত্তি এবং বিকাশ ভারতীয় সংস্কৃতি ও ধর্মের সাথে গভীর ভাবে জড়িত।
দেবী দূর্গা পর্বতরাজ হিমালয়ের কন্যারূপে আদিশক্তির সরূপ। দেবাদিদেব মহাদেবের জায়া রূপে তিনি সদা সর্বদাই পরমাপ্রকৃতি, স্নিগ্ধ, শান্ত,মাতৃরূপে বিরাজমান। যখন ধর্ম ও অধর্মের মধ্যে সংকট উৎপন্ন হয়,তখন এই পরমাপ্রকৃতি দেবী দূর্গা রূপ ধারণ করে অধর্মের নাশ এবং ধর্মের প্রতিষ্ঠা করেন। প্রাচীন কালে দূর্গম নামে একজন অসুরকে মা দূর্গা পরাস্ত করেছিলেন। তার পর থেকে মহাদেব তার নামকরণ করেন দূর্গা। এভাবেই যখন মহিষী মাতার পুত্র মহিষাসুর স্বর্গ মর্ত পাতালে, অন্যায় অত্যাচারে ভরিয়ে তুলেছিলেন। তখন স্বর্গের দেবতাগন ও ত্রিদেব একত্রিত হয়ে দেবী দূর্গার শক্তি বৃদ্ধি করেন। মহিষাসুর বধ করে তিনি মহিষাসুর মর্দিনী নামে খ্যাত হন। এছাড়াও তিনি নানা নামে নানা মতে খ্যাত হলেও, সর্বজন তাকে দেবী দূর্গা নামে ই আরাধনা করেন। পুরাণে বলা হয়েছে নিয়ম নিষ্ঠাভরে দূর্গার আরাধনা করলে অশ্বমেধ যজ্ঞের ফল লাভ হয়। এই মন কেমন করা শরতে উৎসব ভালো ভাবে সম্পন্ন হোক এই প্রত্যাশা বেঁচে থাকুক মনের গভীরে।
অন্য পুজোর গল্প
ঋতুপর্ণা ভট্টাচার্য
বছর ঘুরে আবার এল শরৎ। সারা বাংলার আকাশ জুড়ে এবারের আশ্বিনে কখনও অকাল বর্ষণের ঘনঘোর ভ্রুকুটি, কখনও আবার মেঘমুক্ত স্বচ্ছ নীল আকাশে মনকেমনের পেঁজা পেঁজা তুলোর মতো সাদা মেঘেদের আনাগোনা। প্রকৃতির অস্থিরতার রেশ ধরে বাংলার মাটিতেও এবার এক অন্য পুজোর গন্ধ। মৃন্ময়ী মায়ের আদলে এবারে যেন চিন্ময়ী অভয়া নারীশক্তিরই অকালবোধন হচ্ছে সারা বাংলা জুড়ে। যে বাঙালি এতকাল জাতি হিসেবে নেহাতই আত্নকেন্দ্রিক, সুবিধেবাদী, স্বজাতিবিরোধী, পরশ্রীকাতর, আলসে, সর্বপ্রকারের ঝুটঝামেলা থেকে শতহস্ত দূরের শান্তিপ্রিয় বলে পরিচিত হয়ে পড়েছিল, সেই বাঙালিই যেন কোন এক অজ্ঞাত মন্ত্রশক্তিবলে হঠাৎই জাতি ধর্ম বর্ণ লিঙ্গ নির্বিশেষে এবারে একসাথে গর্জে উঠল তার ঘরের কন্যার জন্য। আদ্যন্ত অহিংস অথচ অসীম শক্তিময় এই পবিত্র নাগরিক বিপ্লবের জাগরণে কতকাল পরে আবারও শুদ্ধ হল এ বঙ্গের মাটি! অশুভের দমন ও শুভশক্তির আরাধনার এ মহাযজ্ঞের আগুনে মহাশক্তি এবারের দুর্গাপুজোকে সত্যি সত্যিই একেবারে আলাদা করে দিল আর সববারের পুজোর থেকে। এ পুজো তাই বরাবরের মতো কোনও হুল্লোরে আমোদমিশ্রিত উৎসব নয়, প্রকৃত অর্থেই যেন সমাজের কোণে কোণে লুকিয়ে থাকা বাস্তবের সব অসুরশক্তিকে দমন করে অন্তরে অন্তরে শুভশক্তির আলো জ্বালানোর অমৃত আরাধনা।
এবারের বেশ অন্যরকমের দুর্গাপুজোর আবহে যে প্রশ্নটি আজ সবচেয়ে বড় হয়ে উঠে এসেছে তা হল এবারের শারদে উৎসব হবে না পুজো? চিরকাল বাঙালি বিশ্বাস করে এসেছে তাদের সেরা বাৎসরিক উৎসব হল শারদোৎসব। এক বছরের বিসর্জনের মাঝেই দিন গোনা শুরু হয় আগামী বছরের আবাহনের, আসছে বছর আবার হবে! সেই মানসিক আশা আকাঙ্খা অপেক্ষার জায়গা থেকে বিচ্যুত হয়ে শারদকালীন এই বহু প্রতীক্ষিত দুর্গোৎসবের বিরোধিতা কি বাস্তবে সত্যিই সম্ভব! এবারের দুর্গাপুজো কি তবে উৎসব হিসেবে পালিত হবে, নাকি, শক্তিরূপিণী সর্ব পাপহারিণী অশুভের বিনাশকারিণী মাতৃ আরাধনা হিসেবে? এই দারুণ এক নৈতিক দোলাচলের জায়গা থেকেই পেছন ফিরে দেখলে মনে হয় আমাদের সেই ছোটবেলা থেকে বড় হয়ে ওঠার পথের একটা বড় অংশ জুড়ে দুর্গাপুজো কিন্তু আসলে একটা সময় অবধি শুধু পুজোই ছিল, আজকের চলতি মানদণ্ডের হিসেবে সার্বজনীন ব্যাপক আকারের গণউৎসব নয়।
আর তাতে সেসময় পুজোর আয়োজনে হয়তো কিছু ঘাটতি থাকত, কিন্তু পুজোতে আনন্দ উৎসাহ উদযাপন কিছুমাত্র কম ছিল না। এখন কথা হচ্ছে, এই উৎসব মানে আসলে কি? সাবেক অর্থে অনেকগুলি মানুষ একত্রে স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাদের মনের আনন্দের প্রকাশ ও উদযাপন করতে পারে যে অবসরে, তাই আপন শক্তিতে উৎসব হয়ে ওঠে। উৎসবের আর কোনও অন্য অর্থ বা ব্যাখ্যা নেই। বহু মানবের অন্তরের নির্ভেজাল আত্মিক সহজ স্বাভাবিক আনন্দেই তার যথার্থ এবং একমাত্র প্রকাশ। অথচ মুশকিলটা হল, বেশ অনেকটা সময় ধরেই উৎসবের এই আত্মিক যোগটুকু কেমন করে যেন শিকড়চ্যুত হয়ে ভীষণরকম বাজারকেন্দ্রিক এবং বাহ্যিক আড়ম্বরসর্বস্ব হয়ে পড়েছে। মাতৃমূর্তির ও মাতৃশক্তির আরাধনাকে ছাপিয়ে একে অন্যকে আড়ম্বরে ঐশ্বর্যে আয়োজনে টেক্কা দেওয়ার যে নির্লজ্জ ইঁদুর দৌড়ে সামিল আজকের বারোয়ারি পুজোর আয়োজকেরা তাতে উৎসবের চোখধাঁধানো চাকচিক্যটা বেশ চোখে পড়ে, কিন্তু আন্তরিক স্বতঃস্ফূর্ত আবেগমথিত মূল ভাবনাটা নয়। সেই কারণেই হয়তো এই উত্তাল সামাজিক পরিস্থিতিতেও কেউ কেউ নিতান্ত অসংবেদনশীলভাবে উৎসবে ফেরার ডাক দিতে পারেন, পুজোতে নয়।
আমাদের ছোটবেলায় পুজো ব্যাপারটা ছিল অনেকটাই ঘরোয়া। বারোয়ারি ক্লাবের পুজোগুলোতেও তেমন জাঁকজমকের আতিশয্য ছিল না। প্রতিবারই প্রতি পুজোতেই মোটের ওপর প্রায় একইরকম সুদৃশ্য কারুকার্যওয়ালা মন্দিরের মতোন একটা প্যান্ডেল হত। প্রতিমাও সাবেক ধরনের। আলোর কারসাজিও বিশেষ ছিল না। বড় রাস্তা বা গলির দু’ধার দিয়ে সাদা টিউবলাইটের সারিই বলে দিত সামনে কোথাও পুজো আছে। পুজো প্যান্ডেলের কাছাকাছি মুখরোচক নানা খাবারের দোকান বসত সার দিয়ে যার মধ্যে চাট ফুচকা ঘুগনি এগরোল আর হাওয়া মিঠাইয়ের দোকান থাকতই। ঠাকুর দেখে বেড়িয়ে মহানন্দে সবাই মিলে পুজোর চার চারটে দিন এইসব ছাইপাঁশ খাওয়া ছিল অবধারিত, আর, দশমীতে ভাসানের পরে আত্মীয় পরিজনদের বাড়ি ঘুরে ঘুরে মিষ্টিমুখ করে অবশেষে এই দীর্ঘ পুজোপর্বের সমাপ্তি।
আমরা ছোটবেলার পুজোটা প্রতিবারই কাটিয়েছি আমাদের মালদার বাড়িতে। মালদার দক্ষিণ সর্বমঙ্গলা পল্লীতে আমাদের জেঠুর বাড়ির দুর্গাপুজো প্রতি বছরই আমার ঠাকুরদা নিজে হাতে করতেন। ঠাকুমা জেঠিমা পিসিরা আর মা কাকিমারা মিলে সামলাতেন ফলপ্রসাদ তৈরি, ভোগরান্না আর পুজোর জোগাড়ের যাবতীয় খুঁটিনাটি ঘরোয়া কাজ। বাড়ির ছেলেদের ওপর দায়িত্ব ছিল বাইরের বাজারহাট, পুজোর মূল কাজ এবং অতিথি আপ্যায়নের। পঞ্চমীর দিন বিকেলে কুমোরপাড়া থেকে ছোট ট্রাকে করে ঠাকুর আনা হত। পুজোর পাঁচ দিন সারা বাড়িতে হৈ হৈ রৈ রৈ কাণ্ড। এর মধ্যে আমাদের ছোটদের আনন্দই ছিল সবচেয়ে বেশি। এই ক’টা দিন আমাদের ওপর থাকত না কোনও বিধিনিষেধের শাসন। পাড়ার সমবয়সী আরও সব কুচোকাঁচাদের সঙ্গে মিলে এই অবসরে চলত দেদার গল্প মজা খুনশুটি আর খেলাধুলোর বিরামহীন পর্ব। সপ্তমীর দিন বিকেলবেলায় আমাদের ছোটদের নিয়ে বাড়ির কাকা বা জেঠু শহরের বারোয়ারি পুজোগুলোর ঠাকুর দেখাতে নিয়ে যেতেন। বাকি সময়টা বাড়ির পুজোয় আনন্দ করেই কাটত। সে সময়ের কথা মনে পড়লে সব ছাপিয়ে পুজোর নির্মল স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দের স্মৃতিটাই ভীষণভাবে মনে পড়ে, আজকের বাহুল্য জর্জরিত আতিশয্যের ভিড়ে যা অনেকাংশেই মলিন হয়ে গেছে। এখন প্যান্ডেলে ঠাকুর দেখতে গিয়ে কিভাবে যেন আসল পুজো ছাপিয়ে অভিনব সব মাতৃমূর্তি আর ততোধিক অভিনব শৈল্পিক ভাবনায় ঋদ্ধ প্যান্ডেলের কারুকাজগুলিই চোখ টেনে নেয়। দক্ষিণ থেকে উত্তর, দুই বঙ্গেই একই পরিস্থিতি। এতে বাংলা জুড়ে দুর্গাপুজো আজ বিশ্বমানের এক উৎসবে পরিণত হতে পেরেছে ঠিকই, তবে তার ভেতরের অমৃত নির্যাসটাই কখন যেন গেছে ফিকে হয়ে। বহুদিন বাদে আজ যখন তাই উৎসব আর পুজোর মাঝে দড়ি টানাটানির পালা আসে, নিজের দল নির্বাচন করতে গিয়ে সত্যিই থমকে যেতে হয়।
স্কুলের পড়া শেষ করে উত্তরবঙ্গ ছেড়ে দক্ষিণে যখন কলেজে পড়তে গেলাম, কলকাতার ঠাকুর দেখার অভ্যেস হয়ে পড়ল নিয়মিত। সেটা ২০০০ সালের গোড়ার দিক। কলকাতায় তখন সবে সবে থিমনির্ভর পুজোর চলন শুরু হয়েছে। আজীবন সাবেক পুজো দেখে বড় হওয়া আমার চোখ আর মন দুইই ধাঁধিয়ে গেল পুজোর সাথে শিল্পের সেই অনন্য মেলবন্ধন দেখে। একডালিয়া, সিংহী পার্ক আর বাগবাজার এবং দু চারটি পাড়ার ছোটখাট পুজো বাদে সারা কলকাতা জুড়ে সব ছোট বড় ক্লাব তখন পুজোতে বাংলার অসামান্য প্রতিভাসম্পন্ন ছোট বড় সব শিল্পীদের নিয়ে একের পর এক অনবদ্য কাজ করে চলেছে। যেমন সেই সব কাজের পেছনের ভাবনার অভিনবত্ব, তেমনই আশ্চর্য তার অতুলনীয় মনোমুগ্ধকর বাস্তবায়ন। থিমনির্ভর শৈল্পিক পুজোর অভাবিত জোয়ারের সেই প্রবল ঢেউয়ে খড়কুটোর মতো ভেসে গেল ছোট ঘরোয়া ভাবনার সাবেক পুজোগুলি। শিল্পের উদ্দাম উদযাপনের হাত ধরে চলতে চলতে এরপর একটা সময়ে গিয়ে এই মাতৃ আরাধনা পর্যবসিত হল উল্লাসপূর্ণ আড়ম্বরসর্বস্ব চড়াদাগের এক কেজো উৎসবে।চারিদিকে তখন নিজের নিজের পুজোয় ভিড় টানার কি নিদারুণ নগ্ন অসুস্থ এক প্রতিযোগিতা, সবার সেরা পুজো আয়োজনের দৌড়ে লাগামহীন ব্যয়ের হিরিক আর যেকোনও মূল্যে শারদ সেরা পুরস্কার জেতার অন্তহীন এক আকাশ খিদে। এই অর্থহীন অসহনীয় উন্মাদনার ফলেই একটা সময়ের পর এই বাহ্যিক আতিশয্যে মুখ ঢেকে যাওয়া হৃদয়হীন উৎসবের থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলি আমি এবং কলকাতা চষে আমার বহু বছরের ঠাকুর দেখার পর্বে ইতি পড়ে।
পুজোর সময় পরবর্তীকালে অনেকবারই পরিবারসহ বাইরে বেড়াতে গেছি আমরা এবং অন্য প্রদেশের নানা স্বাদের দুর্গাপুজো দেখেছি। এর মধ্যে মনে সবচেয়ে বেশি দাগ কেটেছিল উত্তরপ্রদেশের বেনারসের দুর্গাপুজো। বঙ্গের বাইরের দুর্গাপুজোয় থিমের জৌলুস থাকে না বললেই চলে। পুজো হয় এলাকার সব বাঙালিদের স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতায় এবং পঞ্জিকা নির্ধারিত নিয়মনীতি মেনে। বেনারস শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বেশ কিছু দুর্গাপুজো হলেও এখানকার ভারত সেবাশ্রমের দুর্গাপুজো, চৌখাম্বার মিত্তিরদের বাড়ির চারশো বছরের পুরনো পুজো আর মদনপুরার বাঙালিটোলায় পুরাতন দুর্গাবাটীতে মুখার্জিদের আড়াইশো বছরের পারিবারিক দুর্গাপুজোই সর্বাধিক পরিচিত। বেনারসের ভারত সেবাশ্রমের পুজো এখানকার আশ্রমের পুজোর মতোই নির্ধারিত নিয়ম মেনে নিষ্ঠাসহকারে হয়। এখানে প্রতিদিনই ভোগের ব্যবস্থা আছে। আশ্রমের একটি অংশ জুড়ে প্যান্ডেল খাটিয়ে সুবিধামতো চেয়ারে বা মাটিতে বসে সুস্বাদু অন্নভোগের সুসংগঠিত সুন্দর আয়োজন। এখন গঙ্গায় বিসর্জন বন্ধ হয়ে গেলেও প্রায় এক দশক আগেও পুজো শেষে দশমীর বিসর্জনে বেনারসের দশাশ্বমেধ ঘাটে প্রতিমা নিরঞ্জন হেতু ভারত সেবাশ্রমের জন্য একটা পৃথক সময়ের ব্যবস্থা থাকত। বিকেলের পড়ন্ত আলোয় গঙ্গার বুকে নিজস্ব বিশাল বজরার ওপর প্রতিমার সামনে বিসর্জনের আগে আশ্রমের মহারাজদের সুদক্ষ ক্ষিপ্র লাঠিখেলা ও শারীরিক কসরৎ প্রদর্শন ছিল সত্যিই এক দারুণ দর্শনীয় অভিজ্ঞতা। বেনারসের অন্য দুই আদ্যন্ত পারিবারিক বাঙালি পুজোর মধ্যে মুখার্জিদের দুর্গাবাটীর পুজোর বিশেষত্ব হল এনাদের মৃন্ময়ী দুর্গা প্রতিমাটি বিসর্জন হয় না। হুগলির জনাই থেকে প্রায় আড়াইশো বছরেরও আগে গিয়ে বেনারসে বসতি স্থাপন করা মুখার্জি পরিবারের প্রথমবারের দুর্গাপুজোর পর বিসর্জনের জন্য প্রতিমা পুজোস্থল থেকে কিছুতেই ওঠানো যাচ্ছিল না। পরে মায়ের স্বপ্নাদেশে প্রতিমা ওখানেই রয়ে যান এবং এই একই প্রতিমা আজ অবধি পূজিত হয়ে আসছেন। এ পুজো পুরোপুরিই পারিবারিক পুজো। পুজোর দায়িত্বে থাকেন পরিবারেরই সদস্যরা এবং বাঙালিটোলার বাঙালি বাসিন্দাদের সকলেই পুজোর ক’দিন অঞ্জলি ও প্রসাদ গ্রহণ এই দুর্গাবাটীতেই করেন। আমরা যে বার তিনেক পুজোর সময় বেনারসে গেছি একদিন হলেও দুর্গাবাটীর পুজোয় যেতামই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আর্থিক সঙ্গতি ও লোকবলের অভাবে পুজোর জৌলুস অনেক কমে এলেও এ পুজোর স্বতঃস্ফূর্ত আন্তরিকতা সত্যিই চোখে পড়ার মতো। মূল রাস্তা থেকে ঘিঞ্জি সরু অপরিসর গলিপথ দিয়ে এঁকে বেঁকে অনেকটা পথ হেঁটে পৌঁছতে হয় মুখার্জি বাড়িতে। বাড়ির বাইরের শক্তপোক্ত পুরনো আমলের কাঠের বাহির দরজার ওপর প্রায় মুছে যাওয়া অক্ষরে লেখা পুরাতন দুর্গাবাটী। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে লম্বাটে করিডোর মতো একটা অংশ দিয়ে খানিকটা গেলেই খোলা প্রশস্ত চাতাল ও তার সামনেই মুখার্জিদের পারিবারিক ভদ্রাসন। এই ভদ্রাসনের সামনের চাতাল লাগোয়া উঠোনেই পুজোর ব্যবস্থা। প্রথামাফিক নিয়মনীতি মেনে নেহাতই পারিবারিক ঘরোয়া আয়োজন। বাড়ির লোকজনেরা মিলেই পুজোর যাবতীয় দায়িত্ব থেকে দর্শনার্থীদের ভিড় সামলান। বহুকাল পরে এ বঙ্গ থেকে বহুদূরে বাঙালিটোলার ওই পুজোতেই কেমন করে যেন আমাদের ছোটবেলার বাড়ির পুজোর গন্ধ পেয়েছিলাম। সেই নির্ভেজাল আন্তরিকতা, সেই সবাই মিলে হাতে হাতে পুজোর কাজ সারা, সেই অহেতুক বাহুল্যবর্জিত নির্মল মাতৃ আরাধনা। আসলে শেষ অবধি বাহ্যিক চাকচিক্য নয়, অন্তরের পবিত্র ভক্তি শ্রদ্ধা আর সমর্পণটুকুই বোধহয় পুজোর আসল নির্যাস, আর, যেখানে যেখানে তা খুঁজে পাওয়া যায় উৎসবের চোখধাঁধান ঔজ্জ্বল্য না থাকলেও মন সেখানেই শান্তি পায়, আরাম পায়, শক্তি পায়। আমি এখন যেখানে থাকি অর্থাৎ শিলিগুড়িতে, সেখানকার বাঘাযতীন পার্কের দুর্গাপুজোতেও সেই একই পারিবারিক আন্তরিকতার ছোঁয়া পাই। যদিও বারোয়ারি পুজো, তবুও কিভাবে যেন দুর্গাপুজোর মানুষে মানুষে আত্মীয়তার বন্ধনটিকে বড় সহজেই সুন্দর করে আষ্টেপৃষ্টে ধরে রাখতে পেরেছে এ পুজোও। সাবেক ধরনের প্যান্ডেলে সাবেক প্রতিমায় সবরকম নিয়ম মেনে সুষ্ঠুভাবে পুজোর আয়োজন আর সেই সাথে প্রতিদিন পাড়ার সকলের জন্য ভোগের ব্যবস্থা ও নবমীতে আবার একসাথে বসে খাওয়ানোর পর্ব পুজোর এই ক’টা দিনে সকলকেই যেন অদৃশ্য এক আত্মীয়তা ও সৌভাতৃত্বের বাঁধনে বেঁধে দেয় যা আজকের সময়ে বড়ই বিরল। এজন্যে সত্যি সত্যিই কোনও উৎসব আড়ম্বরের দরকার হয় না, অন্তরের স্বাভাবিক নিষ্ঠা, ভক্তি ও পারস্পরিক সৌহার্দ্য সৌজন্য সহমর্মিতাটুকুই এক্ষেত্রে যথেষ্ট। তাই পরিস্থিতি অনুকূল প্রতিকূল যাই আসুক, আজকের অভূতপূর্ব কালবেলার এই টালমাটাল সময়ে শেষপর্যন্ত এটুকুই কেবল চাওয়া, যত প্রলোভনই থাক, আমাদের দুর্গাপুজোর শেকড়টা অন্তত যেন শেষ অবধি পুজোতেই থাকে, বাহ্যিক উৎসবে নয়।
জীবন্ত দূর্গা বিসর্জনে সবাই নীরব দর্শক কেন
বটু কৃষ্ণ হালদার
বিসর্জন কথার অর্থ হল বিষণ্নতা,একরাশ নীরবতা। এই শব্দটার সঙ্গে একদিকে জড়িয়ে রয়েছে বাঙালির আবেগ।দুর্গাপূজার বিসর্জনে একদিকে যেমন নেমে আসে নীরবতা,বিষন্নতার কালো মেঘ। তেমনি অপরদিকে সমাজে নারীদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া অমানবিক ঘটনায় জীবন্ত প্রতিমার বিসর্জন হলেও বর্তমান সমাজের একাংশ পাথর কিংবা মাটির মূর্তিতে রূপান্তরিত হয়ে যান দুটি বিসর্জনের ক্ষেত্রে দুটি চিত্র ফুটে ওঠে বাস্তবের আঙিনায়।
"নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধান/বিবিধের মাঝে দেখো মিলন মহান" এই মহান উক্তির মাঝে আমাদের ভারত বর্ষ বিশ্বের দরবারে নিজেকে মেলে ধরেছে।ভিন্ন ভাষা,সংস্কৃতির মিলনক্ষেত্র ভারতবর্ষেই এর জন্যই সারা বছর ধরে কোন না কোন উৎসব পালিত হয়।এর মধ্যে অন্যতম উৎসব হোল বাঙ্গালীদের অন্যতম প্রাণের উৎসব দুর্গাপূজা।সর্বধর্ম সমন্বয়ের দেশে জাত ধর্ম নির্বিশেষে দুর্গাপূজার চার পাঁচ দিন সবাই উৎসবে মেতে ওঠে এটাই ভারতবর্ষের প্রাচীন সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য।
গ্রীষ্মের দাবদাহকে জুড়িয়ে আসে অতিমেদুর মেঘছায়া বর্ষারানী।বর্ষার আগমনে শুষ্ক রুক্ষ ও পরিবেশ ভাষা খুঁজে পায়।নতুন প্রাণের সঞ্চার উজ্জীবিত হয় শাখা প্রশাখায়।শুষ্ক তৃণ নতুন প্রান সঞ্চারে আঁচলখানি মেলে দেয় পরিবেশে।আলো-আঁধারির খেলা মিলিয়ে বর্ষার বিদায়ী সুরে ফিরে আসে বাঙালি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রিয় ঋতু শরৎকাল।নীল সাদা মেঘের ভেলায় বাঙালি মনকে বিমোহিত করে।দখিনা বাতাসে তালে তালে মাথা দোলায় সাদা কাশের ফুল ।উড়ন্ত সাদা বকের দল পথ হারায় দিগন্তের সীমানায়। শিউলি ফুলের সুবাস সাদা কাশবনের মৃদু মাথা নোয়ানো জানান দেয় মা আসছেন পূর্ণ ধরাধামে।দূর হতে ভেসে আসে পূজার গান। মহালয়ার পুণ্য তিথিতে শুরু হয়ে যায় দেবীর আগমন।"বাজলো তোমার আলোর বেনু",গান দিয়ে শুরু হয় মহালয়া।বছরের ওই কয়েকটা দিনের জন্যে আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকি।
একদিকে যেমন মানুষের হাহাকার নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠে অন্যদিকে কোটি টাকা ব্যয় বিলাসবহুল প্যান্ডেল সমাহারে উৎসবে মেতে উঠি, এ ধারণা অনেকেইকরে থাকেন।তবে সেই সঙ্গে আরো জানতে হবে যে কোটি কোটি টাকার পূজার সঙ্গে যেমন জড়িয়ে রয়েছে আবেগ ও প্রাচীন সংস্কৃতি ঠিক তেমনই এই পূজার সঙ্গে জুড়ে রয়েছে জীবনের একঘেঁয়েমি,অবসাদ, অবিচ্ছন্নতার অবসান আর নানান কর্মের সংস্থান। প্রতিমা তৈরি করা থেকে শুরু করে প্যান্ডেলের উপকরণ এমনকি বিসর্জন পর্যন্ত একের সঙ্গে রয়েছে ব্যবসার যোগসূত্র।প্রতিটি উপকরণ কেনাকাটি করতে হয়। মাইক জেনারেটর,লাইটিং এর ব্যবস্থাও করতে হয়।পূজার সঙ্গে সঙ্গে বহু দোকানপাট,গাড়ি ঘোড়া,জামা প্যান্ট থেকে শুরু করে বহু জায়গায় ব্যবসা মুখরিত হয়ে ওঠে। পূজার ওই কটা দিন বহু গরীব মানুষ ব্যবসা করে নিজেদের রুজি রুটির সংস্থান করেন।বহু অসহায় পরিবারের সদস্যদ ও ছোট ছোট উলঙ্গ শিশুদের মুখে হাসি ফোটে তা ভুলে গেলে চলবে না।
যে সংস্কৃতি যুগের পর যুগ একই ধারা প্রবাহমান।কলকাতা তথা বাংলার প্রধান ও প্রাণের এই উৎসব আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্থান করে নিয়েছে। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা- ইউনেস্কো বাঙালি হিন্দুদের এই উৎসবকে ‘ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি’ তথা মানবতার জন্য আবহমান অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। প্যারিসে অনুষ্ঠিত ২০২১ সালে আবহমান বিশ্ব সংস্কৃতি রক্ষা সংক্রান্ত ইউনেস্কোর আন্তঃসরকারি কমিটির ষোড়শ সম্মেলনে (১৫ই ডিসেম্বর) কলকাতার দুর্গাপূজা তালিকাভুক্তির স্বীকৃতি লাভ করে। যা বাঙ্গালীদের কাছে অত্যন্ত গৌরবের।
বাঙালির অতি প্রিয় দুর্গোৎসব মানে বছরের ওই কটা দিন জন্মভূমিতে ফিরে আসার প্রবল ইচ্ছা। বাবা মা আত্মীয় পরিজন পাড়া-প্রতিবেশী বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে কয়েকটা দিন সময় কাটানো, চুটিয়ে আড্ডা,প্রাণের কথা বলা আর খাওয়া দাওয়া। নতুন জামা প্যান্ট পরে কচিকাচাদের হইহুল্লোড়,দৌড়ঝাপ,কলতানে মুখরিত হয়ে ওঠে প্যান্ডেলের মন্ডপ।দুর্গাপূজা মানেই একটু বেহিসাবি হয়ে ওঠা।নতুন করে প্রেমে পড়া।কাউকে প্রথম ভালোবাসি বলা। নতুন নতুন সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া আবার অনেক ভেঙে যাওয়া সম্পর্কের অশ্রুসিক্ত চিৎকার চাপা পড়ে যায় পূজার উচ্ছ্বাসে। কয়েকটা দিন আমোদ প্রমোদ ইহুল্লোড়ের মধ্যে দিয়ে বেজে ওঠে করুণ সানাইয়ের সুর।বিসর্জনের পালা মানে মন খারাপের শুভারম্ভ। ঘরের মেয়ে উমা তার বাড়িতে ফিরে যাবে যেন আনন্দের মধ্যেই যেন বিষাদের কালো মেঘ গ্রাস করে নেয় উচ্ছ্বাসের মুহূর্তগুলো। ঠিক যেন চরম সুখ পাওয়ার মাঝে বেদনার অবারিত ধারা জড়িয়ে ধরে হৃদয়কে।
একটা ফুলের কুঁড়ি ধীরে ধীরে সময় অনুসারে ফুলে পরিণত হয়। কয়েকদিন গাছে থাকার পর আপনার থেকেই ধীরে ধীরে শুকিয়ে যেতে যেতে বৃন্ত দিয়ে ঝরে মাটিতে মিশে যায়।ঠিক তেমনই সবার প্রথমে কাঠের ফ্রেমের উপর কাদা মাটির প্রলেপের মধ্যে নানান উপকরণ মিশিয়ে সেই প্রলেপ দিয়ে মূর্তি গঠনের প্রাথমিক কাজ শুরু হয় এরপর রং করে শাড়ি,গয়না পরিয়ে মায়ের মাটির মূর্তি কে পূর্ণতার রূপ দিয়ে মন্দিরে প্রবেশ করানো হয়। বিভিন্ন আলোর রশ্মাইতে ঝলমল করে ওঠে পূজার প্যান্ডেল। কয়েকদিন পর সেই আলো ঝলমল উৎসবের রেওয়াজ শেষ হয়ে যায়। পূজার ওই কটা দিন হইচই করে কিভাবে শেষ হয়ে যায় তা বুঝতে পারা যায় না।এরপরে বিসর্জনের পালা। বিসর্জনের পালা মানে বিষন্নতার পরিবেশ। অশ্রুসিক্ত হয়ে সিঁদুর মাখিয়ে ঘরের মেয়েকে বরণ করে শেষ বিদায় জানায়। ভাসানের কয়েক দিন পর বিভিন্ন নদী বড় বড় পুকুরে শুধু কাঠের ফ্রেম পড়ে থাকতে দেখা যায়।মাটির সঙ্গে সঙ্গে শরীরের নানা উপকরণ ও জলের স্রোতে ভেসে যায়।পরিবেশ ফিরে আসে তার চেনার রূপে।আর সেটাই হলো বিসর্জন।মানব সমাজে এই নিয়ম একই ধারায় প্রবাহমান।
বিসর্জন মানেই তো শেষ হয়ে যাওয়া।আমাদের ছোটবেলায়, মানে প্রায় আড়াই দশক আগের কলকাতা সংলগ্ন আধা মফস্সল পাড়ায় যখন প্রতিমা নিরঞ্জন শেষে পুকুরের জল আঁজলা ভরে জল ছিটিয়ে দিত বড়রা,সেই জলের ফোঁটায় বিষাদ লগ্ন হয়ে থাকত। তখন দশমীর দিনই ভাসান হত।ফেরার পথে মন্দিরের মাঠের খাঁ খাঁ মণ্ডপের দিকে তাকালে মনখারাপ বাঁধা। আলো-ঝলমল ভাল লাগার দিন শেষ হয়ে যাওয়ার মনখারাপ। বিসর্জন মানেই ছিল শেষ হয়ে যাওয়া।
অথবা, বিসর্জনই একমাত্র, যেখানে এই শেষ আর এক শুরুর জন্মমুহূর্ত।যেখানে ভাসানের পরের দিনই কোলাকুলি দেখতে ছেলেরা ঝাঁপিয়ে পড়বে পুকুরে, আঁকশি দিয়ে টেনে আনবে কাঠামো। সেই কাঠামোর ওপর পরের বার ফের মাটি চাপবে, ফের প্রতিমা তৈরি হবে, ফের কুমোরটুলি থেকে ম্যাটাডোরে চাপিয়ে সেই প্রতিমা নিয়ে আসা হবে মণ্ডপে। পুজোই একমাত্র, যেখানে শেষ হওয়ার সঙ্গে এক সুতোয় বাঁধা থাকে পরের বারের সূচনা। দশমীর মনখারাপও, তাই, খানিক সুখের মধ্যে ব্যথা। যা হারিয়ে গেল, তা ফিরে পাওয়া যেখানে অনিবার্য বালিশের পাশে নতুন জুতো রেখে ঘুমিয়ে পড়ার মতোই,শুধু সকাল হওয়ার অপেক্ষা তা বলা বাহুল্য।
বিংশ শতাব্দীর দোরগোড়া এসে জল,স্থল,অন্তরীক্ষে নারীরা পুরুষদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সমানতালে পাল্লা দিয়ে চলেছে। দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির পিছনে শুধুমাত্র পুরুষদের নয় নারীর অবদান অনঅস্বীকার্য সেই নারী সমাজ আজও কি সঠিক সম্মান পেয়েছে?
আমরা গত বছর দেখে ছিলাম স্বাধীনতার ৭৮ বছর পূর্তির উৎসবের আমেজ।বহু নেতা-মন্ত্রীরা নারীদের নিয়ে নানানভাবে আলোচনা,ভাষণ,চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছে।সোনা জয়ী নারীদেরকে দেশের মাটিতে সম্মান জানিয়েছেন।সোনা জয়ী নারীরা সমগ্র বিশ্বের দরবারে উজ্জ্বলতম নজির সৃষ্টি করলে ও ভারতবর্ষের সমাজ ব্যবস্থায় নারীদের সম্মানের বিষয়ে বহু প্রশ্নের উত্তর আজও খুঁজে পাওয়া যায় না।কারণ প্রাচীন পৌরাণিক যুগ সমাজ হতে সুবিচারের আশায় নারী ন্যায়ের দরজার কড়া নেড়ে আসছে।তাঁর জীবন্ত উদাহরণ হোল সীতা ও দ্রৌপদী। প্রাচীন যুগে নানান কুসংস্কারগুলো যেমন সতীদাহ প্রথা,বাল্য বিবাহ, বিধবাদের একাদশী উপবাস,গঙ্গাতে কন্যা সন্তান ভাসিয়ে দেওয়ার মত বহু অযৌক্তিক প্রথাগুলো বিসর্জনের ন্যায় প্রাচীন যুগ থেকে চলে আসছিল।
প্রাচীন ইতিহাসে,অপালা, ঘোষা, লোপামুদ্রা,মৈত্রী,গার্গী কিছু নারীর নাম পাওয়া গেলেও, নারী সমাজ ব্যবস্থা তেমন ভাবে দাগ কাটতে পারেনি আজ। ইতিহাসের পাতায় নামটুকু আবদ্ধ হয়ে রয়ে গেছে।স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসটা একটু পড়ে দেখলে বেশ বোঝা যায় নারীরাও সশস্ত্র আন্দোলনে যোগদান করেছিল। নিজেদের জীবনের কথা না ভেবে, সংসার ধর্মের কথা চিন্তা না করে নিজেদের জীবনকে সঁপে দিয়েছিল স্বাধীনতা আন্দোলনে।অথচ বহু নাম ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ হলেও ৮০ শতাংশ রয়ে গেছে অন্ধকারে। দেশ স্বাধীনতা লাভ করলেও বহু নারীদের জীবন অবাঞ্ছিত, অবহেলায়,বিসর্জন হয়েছে।বর্তমান আধুনিক সভ্যতায় নারী আজও ভোগ্য ,আমদানি ,রপ্তানি,বিলাস,বৈভব,সংসারের যাঁতা কলে পিষে মরা, আর সন্তান উৎপাদনের মেশিন হিসেবে পরিহার্য।পণ্য পরিবহনের মত কেনাবেচা চলছে ছোট কন্যা সন্তানদের জীবন। বেশ কয়েক মাস আগে হাওড়ার এক হোমে নারী পাচার কাণ্ডে জড়িত ছিলেন রাজনৈতিক প্রভাবশালী নেতা।এ ঘটনা তো ভারত বর্ষ তথা পশ্চিমবাংলায় নতুন কিছু নয়।"লিঙ্গ নির্ধারণ আইনা তো অপরাধ", তাতে অপরাধীর জেল ও জরিমানা দুই হতে পারে তা সত্ত্বেও কন্যা ভ্রূণ হত্যা বন্ধ করা গেছে কি? আধুনিক সভ্যতার ছোঁয়ায় সভ্য সমাজের সুষম বিকাশ ঘটেছে।অথচ উত্তরাখণ্ডের এক গ্রামে গত ছয় মাসে একটা শিশুকন্যা জন্মায়নি। কন্যাভ্রূণ নির্মূলন যজ্ঞে যোগ দিয়েছেন অজাত শিশুর পরিবার, শিক্ষিত ডাক্তারবাবুরা এবং আইনের মুখে ছাই দেওয়া প্রশাসন। জন্মাবার আগেই গর্ভপাতের প্রবণতা বেড়েছে।অথচ জন্মের লগ্নেই ১০০০ শিশুপুত্রের তুলনায় ১০৪ জন মেয়ে কম জন্মায় আমাদের দেশে। পৃথিবীর আলো দেখার আগেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় ফুলের কলিরা। জন্ম থেকে ছয় বছর পর্যন্ত কন্যা ও পুত্র সন্তান অনুবাদ কমে চলেছে ১৯৪১ সাল থেকেই। কন্যাভ্রূণ নির্মূলনে চলে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা। পিছিয়ে নেই কলকাতার শিক্ষিত উচ্চ-মধ্যবিত্ত অঞ্চল গুলো।
এই যুগে দাঁড়িয়ে সমীক্ষায় বলছে পুরুষ শিশুর তুলনায় কন্যা শিশুর সংখ্যা অনেক কমে গেছে। বর্তমান এই আধুনিক সুসভ্য সমাজেও শুধুমাত্র কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়ার অপরাধে বহু নারীকে প্রতিনিয়ত নির্যাতিত হতে হয়,এমনকি অত্যাচার করতে করতে মেরেও ফেলা হয়।আজও আইনের চোখের সামনে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে অবাধে চলছে পণ প্রথা। সংবাদ মাধ্যমের পাতা খুললেই দেখতে পাওয়া যায়,পণ দিতে না পারার জন্য সদ্য গৃহ বধূকে পুড়িয়ে নয়তো হত্যা করে গলায় ফাঁস লাগিয়ে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। নির্দোষ এক ফুলের মত নিষ্পাপ জীবনকে পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে যেতে হয় সমাজের কলুষিত প্রথায়। বহু মা ইতিমধ্যে তাদের সন্তানকে হারিয়েছে।অনেক ছোট শিশু জন্মের পরে মাতৃ স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়েছে।পরবর্তীকালে বহু ক্ষেত্রে দেখা গেছে এমন সন্তানরা দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মে লিপ্ত হয়ে পড়েন।আজও আমাদের সমাজে ঘটা করে কুমারী পূজা করা হয়।অথচ দিনের স্বচ্ছ আলোয় দুধের শিশু থেকে মাঝ বয়সী এমনকি ষাট ঊর্ধ্ব নারী। এটা কি জীবন্ত দুর্গার অপমান নয়? এটা কি বিসর্জন নয়?সমাজের বুদ্ধিজীবী মহলের একাংশ মোমবাতি জ্বালিয়ে মৌন মিছিল করে রামলীলাময়দানে,মনুমেন্টের পাদদেশে কিংবা ধর্মতলার মোড়ে। কিন্তু বুঝতে হবে লেলিহান শিখার মাঝে লুকিয়ে থাকে শিকারি হায়নার নীল চোখ। সমস্যা গোড়া থেকে নির্মূল হওয়ার বিশেষ প্রয়োজনীয়তা আছে বলে মনে হয়।তবে লজ্জার কথা হল এমন ভ্রষ্টাচার,যা কিছু ঘটছে সবই লোক চক্ষুর সম্মুখে।
আদালতের দরজায় গিয়ে খোঁজ করে দেখুন নারী নির্যাতনের ফাইল পাহাড়সম জমে আছে।তার মধ্যে সবথেকে ভয়ঙ্কর খবর হল ইতিমধ্যে ফ্রিতে রেশন,বিদ্যুৎ,জল দেওয়া দিল্লী রাজ্যে নারী নির্যাতনের সংখ্যা নির্দ্বিধায় বেড়ে চলেছে।আমার,আপনার কথা নয়,সমীক্ষা বলছে দৈনিক গড় সংখ্যা ৬।তার পিছনের সারিতে একই পথে হাঁটছে রাজস্থান,বাদ যায়নি পশ্চিম বাংলা।।তার থেকে আরো ভয়ংকর খবর হলো স্বাধীনতার ৭৮ বছর মহোৎসব পূর্তি উপলক্ষে গুজরাটে কিলবিস বানু ধর্ষণকাণ্ডে ১১ জন ধর্ষককে সাজার সমাপ্তি হওয়ার আগেই মুক্তি দেওয়া হয়েছে।যে সংবাদ সমাজের ভিত নড়িয়ে দেওয়ার মতো।পশ্চিমবাংলায় বানতলা কামদুনি,নদীয়ার হাঁসখালি,ধুলাগড় সহ বহু জায়গায় নারী নির্যাতনকারী অপরাধীরা সমাজের বুকে অবাধে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে এটা কি আমাদের সামাজিক লজ্জা নয়?
মাত্র আর কয়েকদিন পরেই বাঙালির সেরা উৎসব দুর্গাপূজা আসন্ন। কলকাতা তিলোত্তমার বুকে আরজিকর হাসপাতালে ঘটে গেল এক নরসংহার নৃশংস হত্যাকাণ্ড। এক জুনিয়র ডাক্তার নাম মৌমিতা দেবনাথ কে পরিকল্পনামাফিক হত্যা করা হলো। জনগণের লাইফ লাইন হাসপাতালের জঘন্য দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্যই তাকে অকালে এই পৃথিবী থেকে চলে যেতে হল। অথচ বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে। আদৌ প্রকৃত দোষীরা বিচার পাবে কিনা তার কোন নিশ্চয়তা দেখা দিচ্ছে না। এজন্য দায়ী আমাদের সমাজের একশ্রেণীর সুবিধাভোগী জনগণন। সরকারের থেকে বসে বসে সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে বলেই সরকারের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে পারছে না রাস্তায় নেমে আসছে না। এই মারাত্মক ব্যাধি থেকে সমাজকে মুক্ত করতে হবে নইলে ভবিষ্যতে আরো এমন ঘটনা ঘটবে তা বলা বাহুল্য।
ধর্ষক মানেই অপরাধী। আর রাজনৈতিক প্রশ্রয় তাদের মুক্তি দেওয়া মানেই দেশের আইন ব্যবস্থার ওপরে সাধারণ জনগণের আস্থা কমে যাওয়া।ধর্ষকরা কখনোই সংস্কারগামী বা মানবতার আদর্শ হতে পারেনা। যে ঘটনা আগামী ভবিষ্যতে নারীদের নিরাপত্তার বিষয়ে হাজারো প্রশ্ন রেখে যায়? একথা অস্বীকার করার উপায় নেই কোটি কোটি টাকা খরচা করে মাটির প্রতিমাকে নিয়ে উচ্ছ্বাস আবেগে মেতে উঠি, ভক্তি শ্রদ্ধা দেখান, বিসর্জনের সময় আবেগপ্রবণ অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে দুটি নয়ন অথচ সেই সমাজেই রোজ রোজ জীবন্ত দুর্গা বিসর্জন হয় সে কথা আমরা কেউ খেয়াল করি না।
তবে সমাজ পরিবর্তন শীল,কেন্দ্র ও রাজ্য দুই সরকার নারীদের জন্য বহু প্রকল্প চালু করেছে।কিন্তু আমাদের দেশে নারী নিরাপত্তা একেবারে বিশ বাঁও জলে।নারী নির্যাতনের পরিসংখ্যান দেখলে তা জলের মত, পরিষ্কার।ভিক্ষা বা অনুদান নয় কর্মসংস্থান হল দেশের সার্বিক উন্নয়ন, ঠিক তেমনি নারী প্রকল্প নয়,সুরক্ষাটা বিশেষ জরুরি।কারণ পুরুষ আর নারী এই সমাজে একে অপরের পরিপূরক।যেমন জীবন,মৃত্যু_আলো, অন্ধকার।শুধু পুরুষ দিয়ে সমাজের সচল প্রক্রিয়া চলে না। তাইতো নারী মা, জগত জননী জগদম্বা।তাই তো বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর অমর সৃষ্টি তে আমাদের কে বার্তা দিয়ে গেছেন:_"বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণ কর/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী,অর্ধেক তার নর"।এটা যেন আমরা ভুলে না যাই।
No comments:
Post a Comment