স্যানিটাইজারের মৃত্যু
কল্যাণময় দাস
চরিত্র
বিপুল, রাজেন্দ্র, রামদুলাল (নেপথ্যে), সান্ত্রি (নেপথ্যে)
সময়ঃ অধিক রাত্রি
স্থানঃ রাজেন্দ্র দোতলা বাড়ির ছাদ
(বিপুল আর রাজেন্দ্র মুখোমুখি বসে আছে। বিপুল রাজেন্দ্রর খাতা দেখতে দেখতে কথা বলে।)
বিপুল : আপনাকে যদি এখোনিই এনকাউন্টারে মেরে দেই তাহলে কি হয়, বলুন ?
রাজেন্দ্র : সেটা আপনাদের বিষয়, তবে হ্যাঁ, স্বপক্ষে সওয়াল করলে আমাকে জিগ্যেস করতে হয় যে, আমার দোষ কি ?
বিপুল : জনতাকে উত্তেজিত করা, দেশের বিরুদ্ধে কন্সপিরেসি ...
রাজেন্দ্র : চ্যাংড়ামো হচ্ছে না কি?
বিপুল : এতো রাতে, আপনার বাড়িতে, আমার বাড়ির বৌ বাচ্চা ছেড়ে, আপনার সাথে তো ছাদের চ্যাংড়ামো করতে এসেছি, তাই না? এই লেখাটা ছাপা যাবে না, আন্ডারস্ট্যান্ড? এই খাতায় যা লেখা আছে তা ছাপার অক্ষরে বই হিসেবে প্রকাশ করা যাবে না, আমি বোঝাতে পারলাম?
রাজেন্দ্র : মানে? আমার লেখা আমি ছাপাতে পারবো না?
বিপুল : সেরকমটাই নির্দেশ
রাজেন্দ্র : নির্দেশ? মানে কার নির্দেশ? কিসের নির্দেশ?
বিপুল : সব জেনেশুনেই তো লিখতে বসেছেন, এখন ন্যাকামো করছেন, অ্যাঁ?
রাজেন্দ্র : দেখুন, আপনার এই বিষয়ে আমার বলার কোন ভাষা নেই।
বিপুল : (রাজেন্দ্রর খাতাটা আবার নেয়, পাতা ওল্টায়, একটা লেখা পড়তে থাকে) ‘পরদিন সকালে পিন্ডারির বাবা রামভক্ত হরিজনের দেহটা পাওয়া গেল রামমন্দিরের কাছে। তার পরনে একটা ধূতি, আর গায়ে পাঞ্জাবি, পকেটে একটা রুমাল, যার রংটা লাল’। গেল গেল গেল।‘অথচ সবাই দেখলো একজন হিন্দুর শরীর রক্তে ভেসে যাচ্ছে আরও কিছু হিন্দুর ভয়ঙ্কর আঘাতে’।
রাজেন্দ্র : ইয়েস!
বিপুল : আই রিপিট, গেল।‘অথচ সবাই দেখলো একজন হিন্দুর শরীর রক্তে ভেসে যাচ্ছে আরও কিছু হিন্দুর ভয়ঙ্কর আঘাতে’।
রাজেন্দ্র : ইয়াস!
বিপুল : মানেটা বুঝেছেন আপনি কি লিখেছেন? অতি জঘন্য, অতি নিম্নমানের লেখা।
রাজেন্দ্র : হ্যাঁ হতে পারে, কিন্তু সত্যিই একটা লকের শরীর রক্তে ভেসে যাচ্ছিল অনেকগুলো লোকের ভয়ঙ্কর আঘাতে। এটা নিয়ে আপনাদের এতো মাথাব্যাথা কেনো?
বিপুল : লেখাটা তো সাধারণ পাবলিক পড়বে, তাই না?
রাজেন্দ্র : হ্যাঁ, পড়বে। মানে পড়তেই পারে, পড়ার জন্যই তো লেখা।
বিপুল : সাহিত্য ফাহিত্য আপনি বোঝেন? বাস্তবে যা হচ্ছে সেটাকে লিখে দিলেই সাহিত্য হয়ে গেলো? হউঃ
রাজেন্দ্র : আমি একটা কথা বুঝতে পারছি না, হঠাৎ আপনারা আমাকে নিয়ে পড়েছেন কেনো? ও ও ও, আই সী, আই সী, আচ্ছা আচ্ছা আচ্ছা আচ্ছা, মানে আমার লেখাগুলো … এই যেমন ধরুন, ভারভারা রাও, কিম্বা রাহাত ইন্দরির শায়েরি অথবা অথবা সফদার হাসমির নাটকগুলোকে আপনারা টার্গেট করেন! মানে, এগুলোকে আপনাদের ক্রাইম বলে মনে হয়, এছাড়া দেশে আর কোন ক্রাইম নেই!... শুনুন রাজনীতি আশ্রিত অপরাধ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক অপরাধ প্রতিনিয়ত প্রতিমুহূর্তে এদেশে ঘটে চলেছে, সেগুলো দেখা কি আপনাদের বিষয় নয়? একটা লেখা ছাপা হবে, সাধারণ মানুষ পড়বে, এটা নিয়ে আপনাদের এতো ইনিশিয়েটিভ, কেনো? একটা মানুষকে হ্যারাজ করতে আপনাদের এতো স্পেস! অথচ, অথচ একটা দেশ দিনদিন অধঃপাতে যাচ্ছে সেদিকে আপনাদের কোন খেয়াল নেই! কী করছেন এসব, এসব কী শুরু হয়েছে?
রাজেন্দ্র : অ্যাই বোস বোস বোস এখানে। দাদা? দাদা হয়ে উঠছেন? কে, কে দিয়েছে আপনাকে এই সাহস? শালা হাফ-টাউনের বিদ্রোহী নকশাল, … আমার মনটাকে না মানবিকতার বাইরে যেতে বাধ্য করবেন না, প্লিজ।
(দোতলা বাড়ির নিচ তোলা থেকে একটা আর্তনাদ পায় রাজেন্দ্র এবং বিপুল)
রাজেন্দ্র : নিচে আমার স্ত্রী আমার ছেলের সঙ্গে আপনার কোলিগরা কি এইরকমই করছে?
বিপুল : হ্যাঁ, করতে পারে, যদি ওরা আপনাকে সাপোর্ট করে ইন্টার্যা কশন করে তাহলে এতক্ষণ ওদের হয়তো
রাজেন্দ্র : হয়তো? কিন্তু ওরা আমার এই অবস্থা … (রাজেন্দ্র বিপুলের মুখোমুখি হতে যায়)
বিপুল : (হাত নেড়ে বিপুল পিছিয়ে যেতে যেতে রাজেন্দ্রকে দূরে থাকতে ইশারা করে।)
রাজেন্দ্র : (থেমে যায়) আমার এই অবস্থা ওরা জানতে পারলে ওরা ভীষণ কষ্ট পাবে!
বিপুল : সেজন্যই তো বলছি, যাতে ওরা আর কোনদিনও কষ্ট না পায় (থামে) তারজন্য লেখাটা ছেড়ে দিন। আর এই খাতাটা আমরা পুড়িয়ে ফেলবো।
রাজেন্দ্র : পুড়িয়ে?
বিপুল : হ্যাঁ, আপনার ভালোর জন্য (বুক পকেট থেকে একটা স্যানিটাইজারের স্প্রেগান বের করে) আমাদের মানবিকতাকে আঘাত করবেন না, মিস্টার রাজেন্দ্র দাশগুপ্ত, একটু স্যানিটাইজার নেবেন নাকি? (ওর দিকে স্প্রে করে)
রাজেন্দ্র : (ছিটকে দূরে সরে যায়)
বিপুল : সোসাইটিকে স্যানিটাইজ করা আমাদের কাজ, আপনার কাজ নয়, আপনি প্রেমের গান লিখুন।
রাজেন্দ্র : হ্যাঁ, আমি প্রেমের গানই লিখি (টেবল থেকে খাতা নিয়ে দেখাতে যায়)
বিপুল : (খাতা কেড়ে নিয়ে আবার পড়ে) হ্যাঁ, এইতো এখানেই আছে একটা … ‘আমার বাড়ির পাশের বাড়ি, করিম চাচার ঘর / মাঝখানেতে খেলা করে’
রাজেন্দ্র : মাঝখানেতে খেলা করে দুজন প্রাণের দোসর / হঠাৎ কেনো উঠলো তুফান, আকাশ কালো করে / আবার আবার দেশে বর্গি এলো, রক্ত অগাধ ঝরে।
বিপুল : (হঠাৎ লাথি মারে রাজেন্দ্রকে) এটা প্রেমের গান? বাঞ্চোৎ! স্যরি স্যরি স্যরি, অফিশিয়াল টার্ম, হ্যাঁ। ডোন্ট মাইন্ড, কিছু মনে করবেন না। (ছাদ থেকে অ্যাসিস্ট্যান্ট রামদুলালকে ডাকে আর রাজেন্দ্রর লেখার খাতাটা নিচে ছুঁড়ে দেয়) রামদুলাল, রামদুলাল, ইসকো পকড়ো, হাঁ, মিস্টার রঘুকো দে দো ইয়ে খাতা, ইয়ে রাজেন্দ্র বাবুকা …
রামদুলাল : (নেপথ্যে) দে রাহা হুঁ, স্যার
বিপুল : (মোবাইলে কল আসে) হ্যালো, হাঁ, হাঁ বলিয়ে মিস্টার রঘু, খাতা মিলা? হাঁ ঠিক হ্যায়, ঠিক হ্যায়। আচ্ছা শোন, নিচের ঘরে ওদের ইন্টারোগেশন শেষ হয়ে গেলে ওদের ছেড়ে দাও। আর হ্যাঁ, শোন, ছাদে ফোর্স আর নার্স পাঠাও। নার্সকে পিপিই কিট পড়িয়ে পাঠাতে ভুলো না।হুঁ। (মোবাইল কাটে, পকেটে রাখে) আমার নাম বিপুল সরকার, বিপুল মানে বিশাল, বিরাট, এই দেশটার মতো বিরাট।
রাজেন্দ্র : এই দেশটায় কি সত্যিই কোন কথা বলার অধিকার আছে?
বিপুল : এগুলো বলা বা লেখা যাবে না।আর তাছাড়া আপনি নিজেকে কি স্যানিটাইজার ভাবছেন, নাকি এই সরকারটাকে কোভিড-নাইনটিন ভাবছেন? শুনুন, মনে রাখবেন, আপনি, আমি, দেশের কোটি কোটি মানুষ একটা সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকারের অধিনে।
রাজেন্দ্র : সংখ্যাগরিষ্ঠ? হাঃহাঃহাঃহাঃ … সরকার? হাঃহাঃহাঃহাঃ … মনে রাখবেন সংখ্যাগরিষ্ঠ মানেই কিন্তু সব নয়, এই পৃথিবীতে ভাইরাসও কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ, প্রতিমুহূর্তে আমাদের আক্রমন করছে তারা, কিন্তু সেই সংখ্যাগরিষ্ঠ ভাইরাসের বিরুদ্ধে এই মানুষ, এই জীবজগৎ লড়াই করে বেঁচে থাকে, বেঁচে থেকেছে, বেঁচে আছে, এবং বাঁচবে। আমার মতো দু’একজন মারা গেলেও, শেষ অব্দি ভাইরাসের বিরুদ্ধে ইতিহাস সৃষ্টি করে মানুষ।
বিপুল : তারমানে …
রাজেন্দ্র : তারমানে আমি আমার প্রতিবাদ আমার বিদ্রোহ করবই। হ্যাঁ হ্যাঁ, আর আমাকে সেটা করতে হবে আমার নিজের বাঁচার তাগিদে।এসবকে আমরা ভয় পাই না।
বিপুল : কিসের প্রতিবাদ? কি কারণে বিদ্রোহ ? মনে রাখবেন, নিজেকে অ্যান্টিভাইরাস ভেবে প্রবল ইন্টেলেকচ্যুয়ালিপনা করতে যাবেন না, দেশে একটা মানবিক সরকার চলছে, চলবেও। পাবলিকের ভালোমন্দ সেই সরকারটাই দেখছে, আপনি বা আপনার মতো ফালতু প্রশ্নতোলা কিছু পাবলিক … আপনি যথেষ্ট বুদ্ধিমান, আপনাকে এইমুহূর্তে এর ব্যাখ্যা আমি না বললেও চলবে।
সেন্ট্রি : (যেন ছাদে এসেছে) স্যার
বিপুল : আপনাকে যেতে হবে।
রাজেন্দ্র : ওই সংখ্যাগরিষ্ঠ শক্তি দিয়ে, জোর করে?
বিপুল : নাঃ, আইনের হাত ধরে
রাজেন্দ্র : হোয়াট?
বিপুল : (দ্রুত দর্শকের মুখোমুখি দাঁড়ায় ডাউন স্টেজে)রাজেন্দ্রবাবু, মানে আপনাদের বিদ্রোহী বিপ্লবী লেখক কবি রাজেন্দ্র দাশগুপ্ত, আর লিখতে পারছেন না, তিনি করোনায় আক্রান্ত, তাঁকে সরকারি সহায়তায় সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তার প্রবল শ্বাসকষ্টের কারণে তাকে আইসিইউতে ভর্তি করা হয়েছে। (আর এককদম দর্শকের দিকে এগিয়ে আসে) আপনারা সবসময় মুখ বন্ধ রাখুন, ভীড় এড়িয়ে চলুন, আর মনে রাখবেন রুগির সাথে নয়, আমাদের রোগের সাথে লড়াই করতে হবে। (মোবাইল কল আসে) হ্যালো, ইয়েস স্যার। (মোবাইলে কথা শুনতে শুনতে বেরিয়ে যায়)
(রাজেন্দ্র বিপুলের যাওয়ার দিকে এবং সেন্ট্রির দিকে ভয়ে আতঙ্কে তাকাতে তাকাতে পিছোতে থাকে দর্শকের দিকে। তারপর আচমকা দর্শকের দিকে আতঙ্ক এবং প্রশ্ন নিয়ে তাকায়। আলো নেভে।)
(পর্দা নেমে আসে)
লাইন
শঙ্খনাদ আচার্য
(শ্মশানে সারি-সারি মৃতদেহ পড়ে আছে। পাশাপাশি শায়িত করোনায় মৃত এক প্রখ্যাত অভিনেতা ও দুর্ঘটনায় মৃত এক পরিযায়ী শ্রমিকের দেহ)
- জীবনের বেশিরভাগ সময় যে মানুষটা 'স্পটলাইটের' নিচে কাটিয়ে গেল, যার নাম শুনলে অগণিত হৃদয়ে আজও বেপরোয়া ঢেউ ওঠে, যাকে পর্দায় দেখবার জন্য দিনের আলো ফুটতেই টিকিট কাউন্টারে লাইন পড়ে যেত, যে স্বপ্নের নায়ককে একবার দেখবার জন্য হাজার-হাজার মাইল পাড়ি দিয়েও ভক্তকুলের চোখে ক্লান্তি নামতো না, যাকে একবার ছোঁয়ার জন্য বাড়িয়ে থাকা হাতের সার অপেক্ষা করত ঘন্টার পর ঘন্টা - অন্তিমযাত্রায় তাঁকেই কিনা নির্জনপথে জৌলুসহীনভাবে 'একাকী' চলতে হলো! শুধু তাই নয়, শবদাহের পূর্বে তাঁকেই আবার অপরিচিতের ন্যায় দীর্ঘ প্রতীক্ষায় অনাদরে পড়ে থাকতেও হচ্ছে! হায় রে মরণ!......... (সামনে পড়ে থাকা দেহটিকে উদ্দেশ্য করে) আচ্ছা এই যে, শুনছেন! আমায় চিনতে পারছেন?
- আপনার কণ্ঠস্বরটি ভারী চেনা চেনা লাগছে, কিন্তু আপনার দেহখানি তো কালো প্লাস্টিকে মোড়া তাই ঠিক চিনতে পারছিনা! আপনি কি আমার পূর্ব পরিচিত?
- আমি নিজেকেই ঠিক করে চিনতে পারছিনা, আর আপনাকে! কে আপনি?
- আমি সেই পরিযায়ী শ্রমিকের একজন যারা রেললাইনে বেঘোরে প্রাণ দিয়েছিল! যাদের না-খাওয়া পূর্ণিমার চাঁদের মত রুটিতে লেগেছে তাজা রক্তের দাগ! যেগুলো এখনো হয়তো পড়ে রয়েছে ওই দু-লাইনের মাঝখানে! যারা আর কোনদিনই অক্ষত শরীরে ফিরতে পারবে না তাদের প্রিয়জনদের কাছে! আর আপনি?
- সহস্র লোকের ভিড়েও যাকে এক ঝলকেই লোকে চিনে ফেলে রুপোলি পর্দার সেই বেতাজ বাদশা 'জয়'-কেও কিনা আত্মপরিচয় দিতে হচ্ছে! 'করোনার থাবা' বোধহয় একেই বলে ! বিশ্বাস করুন, শেষ কবে যে নিজের পরিচয় দিয়েছিলাম আজ আর মনে পড়ে না। তবে শেষযাত্রায় নিজের পরিচয় দিতে ভারী অদ্ভুত লাগছে বুঝলেন!
- ও আপনিই তাহলে সেই 'হাউসফুল' নায়ক জয়! জানেন, আপনার সিনেমা দেখবার জন্য কতবার টিকিটের লাইনে দাঁড়িয়ে মারামারি করেছি এমনকি পুলিশের লাঠির বাড়িও খেয়েছি, তবুও সিনেমা দেখেই ফিরেছি। আর আপনি কিনা আজ 'লাইনে' আমার পেছনে! একেই বোধহয় অদৃষ্ট বলে! আর অদ্ভুত লাগবার তো কিছুই নেই, কারণ একমাত্র এখানেই এখনো 'সাম্য' শব্দটি অক্ষত আছে। একসময় আপনার অন্ধ ভক্ত ছিলাম। ভীষণ শ্রদ্ধা করতাম! কিন্তু পরশুদিন থেকে আর কোনো নায়ক-নায়িকাকেই শ্রদ্ধা করিনা।
- কেন ? কেন?
- আমরা যেদিন মারা গেলাম সেদিন বিকেলে আপনাদের মত কিছু স্বনামধন্য অভিনেতা-অভিনেত্রী ঠাণ্ডা ঘরে বসে সমাজ মাধ্যমে, টিভি চ্যানেলে তাচ্ছিল্যভরা বার্তা দিলেন আমরা নাকি আর 'শোবার জায়গা পাইনি'! আসলে আপনারা কোনদিন আমাদের মানুষ বলেই মনে করেননি! তাই আমাদের মত অতি সাধারন দেশবাসী বাঁচল না মরল তাতে আপনাদের কিচ্ছু যায় আসে না! আমরাই শুধু পাগলের মত আপনাদেরকে দেবতুল্য মনে করে ঘরের দেয়ালে টাঙিয়ে রাখি। সাফল্য পেয়ে আপনারা ভুলেই যান যে আমরা আছি বলেই আপনাদের এত নাম-যশ-খ্যাতি। ওই দু-লাইনের মাঝে পড়ে থেকে এটুকু বুঝতে পেরেছি আপনাদের 'লাইন' আর আমাদের 'লাইন' সম্পূর্ণ ভিন্ন! যা কোনদিন এক ছিল না, হতেও পারবে না!
পলাশ তলায়
শ্রাবণী সেন
দুটি নরনারী, স্বামী স্ত্রী তারা...ব্যক্তিগতভাবে দুজনেরই সামাজিক অবস্থান এবং পশ্চাৎপট অতি আকর্ষণীয়। কোনো একটি পলাশে ছাওয়া গাছের তলায় নারীটি বসে আছে, একটি পলাশ বনে।
নর - পৃথু মিত্র
নারী- সোমশুক্লা বসু মিত্র
মিষ্টি সুরে রিনরিন করে শব্দ... মেসেজ নয়, ফোন কল নয় সোমা অর্থাৎ সোমশুক্লা অনর্গল কথা বলে চলেছে।
সোমাঃ পৃথু, কতদিন পরে এই পলাশ তলায় এলাম বল, তোমার প্রিয় জায়গা, আমারও।
পৃথুঃ হুঁ, তা এত জায়গা থাকতে এখানে কেন, সোমা?
সোমাঃ দেখছ না, পলাশে পলাশে লাল হয়ে আছে চারিপাশ! আমি কলেজে পড়ার সময় তুমি কতবার আনতে এখানে, মনে আছে?
( পৃথু হাতের ক্যামেরায় পলাশ ডালে বসা পাখির ছবি তুলতে তুলতে এগিয়ে যায়, দূর থেকে)
পৃথুঃ মনে আছে।
দুটো পলাশফুল এনে সোমার হাতে দেয় পৃথু।
সোমাঃ আগে হলে তুমি বিনুনিতে লাগিয়ে দিতে, তাইনা! এখন পুরোনো হয়ে গেছি, পৃথু।
পৃথুঃ আজ এখানে আসতে চাইলে কেন সোমা?
সোমাঃ তোমার কাছে ক্ষমা চাইব বলে!
পৃথুঃ আমি বুঝতে পারছিনা ঠিক কী বলছ! তুমি ক্ষমা চাইবে কেন?
সোমাঃ আমি তোমার কাছে অপরাধী পৃৃথু, আমি তোমায় অহেতুক সন্দেহ করেছি। শ্রীজাতা আর ওর বর প্রীতম তোমার ছোটবেলার বন্ধু আমি জানি। তাও তো শ্রীজাতাকে আমি সব সময় সন্দেহ করে এসেছি, তোমাকেও।
পৃথুঃ আমি তো বলেছি তোমায়,ওরা দুজনেই আমার স্কুল বেলার বন্ধু। পরে আলাদাভাবে পড়াশোনা করলেও তিনজনেই একই রকম বন্ধুই আছি। তোমায় কত ভালোবাসে ওরা।
সোমাঃ হ্যাঁ, তোমার অসুখের সময় ওরা আমার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল পরমাত্মীয়র মতই। প্রীতমদার মত ডাক্তার ছিল বলেই তোমায় এ যাত্রায় ফিরিয়ে আনতে পেরেছি পৃথু। আর শ্রীজাতা দি বড় দিদির মত আমায় সস্নেহে জড়িয়ে রেখেছিল ওইদিনগুলো। সন্দেহের বশে তোমায় আমি কতদূরে সরিয়ে দিয়েছিলাম। তুমি আমায় মাফ কর পৃথু। শ্রীজাতাদির কাছে আমি ক্ষমা চেয়ে নিয়েছি গো।
পৃথুঃ পলাশ ফুল বিনুনিতে গেঁথে দিই সোমা, আগের মত? আমার দিকে ফেরো তো, চোখ মুছিয়ে দিই।
পরম আস্থায় পৃথুর কাঁধে মাথা রাখে সোমশুক্লা।
এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়
...এই যে শুনুন কিং সাহেব এর ঘাটটা কোন দিকে বলতে পারবেন?
...হ্যাঁ, চলুন আমি কিং সাহেবের ঘাটেই যাচ্ছি।
...আপনি কি এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জে চাকরি করেন ?
...না, করি না, কিন্তু এ কথা কেন?
...আমি এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জেই যাব কি না, তাই।
...আচ্ছা, সেখানে কি কাজ? আপনার? কারো সাথে দেখা করবেন?
...না আমি আমার ছেলের এক্সচেঞ্জের কার্ডটি রিনিউ করব।
...তা আপনি কেন? আপনার ছেলে এল না কেন?
...ছেলে বাড়িতে নেই। সেই কবে বন্ধুদের সাথে কেরলায় গিয়েছিল। সেখানেই ইঁট ভাঁটায় কাজ করে। মাসে মাসে টাকা পাঠায়, ওর টাকাতেই সংসার চলে, আমার ডাক্তার খরচ, অসুখ বিসুখ এর ওষুধ.... আমরা বুড়োবুড়ি বেঁচে আছি। ১৯৯৭ সালে মাধ্যমিক পাশ করার পর এক্সচেঞ্জে কার্ড করেছিল, ২০ বছর হয়ে গেল এখনো ছেলেটা কোন চাকরির কল পেল না। তবুও মাঝে মাঝে আশায় বুক বাঁধি হয়তো একদিন ও এক্সচেঞ্জের থেকে চাকরির কল পাবে। ছেলেটা আমার বাড়ি ফিরবে।
...তাও তো আপনি শান্তিতে আছেন, আমি দশ লক্ষ টাকা ঘুঁস দিয়ে ছেলেকে কোলকাতা পুলিশের চাকরিতে ঢুকিয়েছিলাম। ওর চাকরিতে অনেক পয়সা। মাইনের টাকায় হাত দিতে হয় না। এই অগাধ টাকা আমাদের পরিবারটাকে ছারখার করে দিল। ছেলেটা আমার মদের নেশায় অমানুষ হয়ে গেল। হোলির ছুটিতে বাড়িতে এসেছে ঠিক ই, চব্বিশ ঘন্টাই করলার পাড়ে কিং সাহেবের ঘাটে বেহুঁশ হয়ে পড়ে থাকে। ওর খোঁজ নিতেই সেখানে যাচ্ছি....হ্যাঁ ভালো কথা, ওই সামনের বাঁদিকের বড় বাড়িটাই এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ।
আয়নার ভাঙা টুকরো
সুদীপা দেব
(পাড়ার মোড়ে একটি চায়ের দোকানে বসে আছেন লেখক রমেন দত্ত। পথচলতি সুগত রায় রমেন দত্তর জুনিয়র এবং বন্ধু স্থানীয়। তাঁদের দুজনের কথোপকথন)
―রমেনদা ভালো আছো? কোথাও যাচ্ছ না আসছো?
রমেন কিছুক্ষণ চুপ থেকে উত্তর দেয়
―দুনিয়াটা জালিয়াতে ভরে গেছে বুঝলি। সব শালা চোর!
―কার ওপর চটলে আবার? বসন্তের পড়ন্ত বেলায় সাথে কেউ নেই!
―রমেন দত্ত এসবের ধার ধারে না বুঝলি! কলমের জোর এখনো আছে! এইটুকু সৎসাহস রাখি।
সুগত চা এগিয়ে দিয়ে বলে
―এই নাও, আর এক কাপ ধরো। এবার বলতো কি হয়েছে?
―কি আর হবে! গোটা বাংলা একেবারে সাহিত্যিকে ভরে গেছে।
―ভালোই তো। মায়ের মাটিতে সংস্কৃতি বাড়ছে। উর্বর মাটিতে ফসল তো ফলবেই।
―ধুস। আগাছায় ভরে গেছে। কার কথা বলবো বল? এখন তো হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া, নীল মুখোবই। কারো মুখটি বাদ নেই। যত্তসব! রাবিশ! ওই রাজদীপকে চিনিস নিশ্চয়ই। এমন ধান্দাবাজ যে কি বলবো তোকে। এখান থেকে এক খাবলা ওখান থেকে এক খাবলা তুলে পর পর বই ছাপাচ্ছে। একটা ফেসবুক পেজ খুলে গুচ্ছের মেয়েদের জন্য ন্যাপকিন ফেলার জায়গা করে দিয়েছে। ওটা ওদের খুব প্রয়োজন বুঝলি। এই মেয়েগুলো রাতে খেলা বাদ দিয়ে পাশ ফিরে এমন সব কবিতা আর গল্প লিখছে, চারলাইন পড়তেই পোয়াতির মতো বমি পায়। এদের না আছে পড়াশোনা না জানে সামান্য বানানটুকু। রাজদীপের মতো সাহিত্যিকের সাথে ইন্টুমিন্টু করে বিভিন্ন সাহিত্য সভা আলোচনা এমনকি বইমেলা পর্যন্ত পৌঁছে যায়।
―তোমার লাগছে কেন এত? উৎসাহ দিতে না পার, চেষ্টাকে ছোট করতে পারনা। আমাকে বলছো তুমি ঠিক আছে। প্রকাশ্যে সেসব বলতে যেও না। সাবধান করে দিলাম। তুমি যা ঠোঁট কাটা!
―ওই সাহিত্যিকরা গলায় দড়ি কড়ি গামছার মালা গলায় স্লিভলেসে যখন কবিতা গল্প পাঠ করে খুব অসুস্থ মনে হয় নিজেকে।
―আরে তোমার এই ফ্যাসিবাদী কথার সমর্থন করতে পারছি না। পুরুষ সাহিত্যিকরা সবাই ভালো লেখেন! আঁতেলমার্কার তো অভাব নেই কোন কালে। সোশ্যাল মিডিয়া হয়ে কত সুবিধা হয়েছে বলো! সবইতো খারাপ না। কিছু ভালো লেখাও থাকে। কত প্রতিভা প্রকাশ পাচ্ছে! বই ছাপানোর ব্যাপারটা আগের মতো ততটা নেই। অনেক বেশী প্রফেশনাল, টাকার ব্যাপার। সবার পক্ষে সম্ভব হয় না। যুগের সাথে প্রেসেন্টেশনও বদলে যাচ্ছে। তোমাকে তা মানতে হবে। শুধু রাজদীপ কেন, যুগযুগ ধরে ইন্টুমিন্টু শিল্পীর একটা ইউনিভার্সাল ক্যারেক্টারাইস্টিক্স। ভালো করে ভেবে দেখ।
―তুইও তাই বলিস! সেজন্য রমরমা সাহিত্যিকের বাজারে পাঠকের চারগুণ লেখক।
―শোন রমেনদা, এই চুরিচামারী আগেও ছিল। নেহাত সোশ্যাল মিডিয়ার ডানার জোর কম ছিল বলে বেশি দূর খবর উড়তে পারেনি। কলকাতা শহরের বিখ্যাত এক লেখকের নামটা মনে আছে বোধহয় তোমার। একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট রেখেছিলেন। সে অ্যাসিস্ট্যান্ট ছেলেটি গরীব এবং সাহিত্যপ্রেমী। বিভিন্ন সাহিত্যসংস্থা, সাহিত্যসভায় সাহিত্য-আলোচনাতে হাজিরা দিয়ে সেখান থেকে আইডিয়া টুকে নিত। সেই আইডিয়া ওনাকে দেবার বদলে টাকা পেত। সাহিত্যিকের নাম আর বাজারদর ক্রমশ উজ্জ্বল হয়েছে। মনে নেই!
―ভালো খবর রাখিস তো!
―আমাকে উঠতে হবে এবার রমেনদা। তুমি বসবে? ওই দেখ তোমার ডার্লিং আসছে। আমি চললাম।
নতুন ভোরের স্বপ্ন
ডালিয়া রায় চৌধুরী
(প্রবাসে থাকা একমাত্র মেয়ের সাথে মায়ের সংলাপ)
মা- হ্যাঁ রে,কতদিন তোর সাথে কথা হয় না,দু দিন ছুটি কি পাবি আমার কাছে আসার জন্য?
মেয়ে- না মা,শুধু দুদিনের জন্য যাওয়ার কোন অর্থই নেই,মনটা আরও খারাপ হয়ে যাবে।তাছাড়া জানোই তো ,প্রাইভেট কোম্পানী ছুটি নিলেই স্যালারি কেটে নেবে।
মা- সবই বুঝি,কিন্তু মন মানে না।
মেয়ে- একটু কষ্ট কর মা,আমরা খুব তাড়াতাড়ি এক সাথে থাকবো।
মা- আমি বোধহয় সেই ভাগ্য করে আসিনি ।তোর বাবা চলে যাবার পর থেকে একটাই চিন্তা,আমার কিছু হয়ে গেলে তুই একা হয়ে যাবি যে।
মেয়ে- তোমার কিছুই হবে না দেখো,তোমাকে সবাই ভালোবাসে।তোমার হাসি মুখটা সব কিছুকে জয় করে নেবে।নেগেটিভ তিন্তা একদম নয়।
মা-চিন্তা কি শুধু হয়।এক সময় মনে হয়,তোকে যদি একটা সৎ পাত্রের হাতে সপে দিতে পারতাম।
মেয়ে- (জোরে হাসি )হা..হা.হা,খাসা বলেছো।আচ্ছা মা কোন পাত্রটা সৎ কি করে বুঝবে?আর যদি সপেই দাও তবে সমাজের উপযুক্ত করে গড়ে তুললে কেন?
মা-বুঝতে পেরেছি অনেক বুদ্ধি হয়ে গিয়েছে আমার মেয়ের।
মেয়ে- আমি খুব স্পষ্ট বাদি মা,কেউ হয়তো আমাকে মানিয়ে নিতে নাও পারে।তোমার মত মানিয়ে চলার শক্তি আমার নেই মা।
মা- আমার সাথে তুই নিজেকে গুলিয়ে ফেলিস না।তোকে নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন।।
মেয়ে- আমার স্বপ্ন গুলো আমাকেই সার্থক করে তুলতে হবে তো,নাকি?তার সাথে তো তুমিও জড়িত।তুমি তোমার স্বপ্ন গুলো নতুন করে সাজাও,অন্য কাউকে আমাদের মধ্যে জড়িয়ে ফেলো না।দুজন মিলে নতুন একটা আলোর ভোর দেখি,যা আমরা আগে দেখি নি।
মা- নতুন ভোর,ভাবতেই আনন্দ হচ্ছে!নতুন ভোরের স্বপ্ন তোর জীবনে বয়ে আনুক নতুন আলোর দিশা।আমি সেই অপেক্ষায় রইলাম।
মেয়ে- আমার মত প্রতিটি মেয়ে মাকে নিয়ে নতুন ভোরের স্বপ্ন দেখুক তাই আমি চাই। এগিয়ে চলুক নতুন যুগের ভোরের আলোর পথে......।
মা ,স্বপ্নের ভোর টা খুব কাছেই।বহু দেশ ভ্রমণ করবো এক সাথে,হাতটা শক্ত করে ধরে রেখো,ছেড়ে দিও না বাবার মত....।
(মেয়ের কথা শেষ হতে না হতেই মায়ের চোখ জলে ভরে যায়, রিসিভারটা নামিয়ে রাখেন।)
সেল না শেল!
স্বপন কুমার দত্ত
স্ত্রী :- কিগো, শুনতে পাচ্ছো? খবরের কাগজটা একেবারে মুখস্থ করে ফেললে।
স্বামী:- বলতে থাকো। দুটো কানইতো খোলা আছে। তোমার বাজখাই গলাতেও যখন এখন পর্যন্ত বধির হইনি, তখন যাওয়ার দিন পর্য্যন্ত ঠিক থাকবো। মানে একেবারে হিয়ারিং প্রুভড।
স্ত্রী:- আমার বাজখাই গলা? একবার বললে তো উত্তর দাওনা । বুঝতে পারিনা, শুনলে না শুনেই ভুলে গেলে!
স্বামী: (স্বগোতক্তি) সব কিছু শুনে ফরমায়েশ মেনে চলতে গেলে তো পকেট গড়ের মাঠ হতে বেশীদিন লাগবেনা। (প্রকাশ্যে) না না, বলো বলো। হরিণের মতো দুকান খাড়া করে রেখেছি। কী ফরমায়েশ আছে ম্যাডাম?
স্ত্রী:- ন্যাকামি দেখে মরে যাই। বলি চৈত্রমাস সে খেয়াল আছে? দোকানে দোকানে শুরু হয়েছে সেল। বলি, এখনো তো কোন হেলদোল দেখছিনা ।
স্বামী:- সাধে কী আর কবি লিখেছিলেন, "তোমার চোখে দেখেছিলেম আমার সর্বনাশ"! বলি, আবার সেলের চক্করে পড়তে চলেছো? ওটা সেল নয়, লক্ষণের শক্তিশেলের থেকেও ভয়ঙ্কর। গতবারের কথা কী ভুলে গেলে?
স্ত্রী :- ম্যালা ফ্যাচফ্যাচ কোরোনা। একবার ঠকেছি বলে কী বারংবার ঠকবো নাকী? তোমার কিপটেমির জন্য সেলের বাজারে শেষমেশ হাজির হলে তো ওরকম বস্তাপচা মালই নিতে হবে।
স্বামী :- তা তোমাদের মতো অত বিচক্ষণ কাস্টমারকে যে নাকের জলে চোখের জলে এক করে ছাড়লে। আহারে এক কাচাতেই গামছা। রঙতো আগেই উঠে গেল, মাছ ধরার জালও এর থেকে ছিল ভালো।
স্ত্রী :- ছাড়োতো, পাঁচ হাজার টাকা ছাড়ো। সারা বছরের কাপড় চোপড় তুলবো। নিজেদের ছাড়াও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রেজেন্টেশান দিতে কত লাগে। টেরতো পাওনা, কত সস্তায় এখন মার্কেটিং হয়ে যাবে।
স্বামী:- তা আমি টের না পেলে আর কী কেউ আছে নাকী টের পাওয়ার। যত্ত সব! এখন টাকাপয়সা নাই, মাসের শেষ। নাসিকে বড় নোট ছাপানো বন্ধ হয়ে গেছে শুনেছি। আবার যদি ......
স্ত্রী :- ও এখন মাসের শেষ দেখাচ্ছো। মাসের প্রথমেই কী তুমি হড়পা বান দেখাও নাকী? তাড়াতাড়ি টাকা বার করো। তা না হলে অনর্থ ঘটিয়ে ছাড়বো।
স্বামী:- অর্থই নাই,আর আবার অনর্থ ! কেউ আমার রক্ত কিনবে কিনা খোঁজ নিয়ে জানাও, এবার রক্ত বিক্রী করে টাকার যোগান দেবো।
( ইতিমধ্যে কন্যারত্নটিও এসে হাজির)
কন্যা :- বাবা আমার কিন্তু এবার একটা সুন্দর পালাজো চাই। মার সাথে সেলের বাজারে গিয়ে নিয়ে আসবো।
স্বামী অর্থাৎ কন্যার বাবা স্বগোতক্তি করতে থাকে, ' একা রামে রক্ষা নেই, সুগ্রীব দোসর।'
স্বামী/ বাবা:- তা মা, প্যালাজোটা কী জিনিষ? শুনেইতো আমার বাড়ি ছেড়ে পালাতে ইচ্ছে করছে। না, মা, এই বয়সে পালিয়ে আর যাবো কোথায়?
স্ত্রী/ মা:- শুন্ ছিস, তোর বাপের কথা। সাতটা না পাঁচটা না, একটাই মেয়ে তুই। তোর সামান্য আবদারটাও কোন দাম দিলনা। আমি সেই কোন সকাল থেকেই ঘ্যান ঘ্যান করছি, মাত্র পাঁচহাজার টাকা চেয়েছি, সেটাই বার করছেনা।
স্বামী :- তোমার কাছে পাঁচহাজার সামান্য আমার কাছেই সেটা অসামান্য। আমার ওষুধ ফুরিয়ে গেছে, সেগুলো আনতে হবে।
স্ত্রী :- (চোখ মুছতে মুছতে) বছরে একবার মাত্র সাধ আহ্লাদ পূরণ করবার জন্য টাকা চেয়েছিলাম সেটাও পেলামনা। অথচ ভাতকাপড়ের সময় কী সুন্দর বলেছিলে, " তোমার সারা জীবনের জন্য ভাত কাপড়ের দায়িত্ব আজ থেকে নিচ্ছি।" এখন সেসব কোথায় গেল?
স্বামী:- সে তো অনেক যুগ আগের কথা। কী বলেছি না বলেছি ভুলে গেছি। আর যদি বলেও থাকি, ভাত কাপড়ের বোঝা যে এতো ভারী ,সেটা জানতাম না। জানলে হাঁড়িকাঠে মাথা দিতাম না।
( এবার বীর দর্পে ছেলেরও ময়দানে প্রবেশ)
পুত্র:- অনেকক্ষণ ধরেই তোমাদের সেলের বাজার করা নিয়ে ক্যাচাল শুনে শুনে আমার কাঁচা ঘুমটা চটকে গেল। মাত্র সকাল সাড়ে নয়টা বাজে। যাকগে,কখন মার্কেটিং এ যাচ্ছো? মা আমার সাইজ তো তোমার জানাই আছে।একটা ফেড জিন্স আর একটা টি শার্ট নিয়ে এসো। পয়লা বৈশাখে বন্ধুদের নিয়ে ডুয়ার্স ঘুরতে যাবো।
স্বামী/বাবা:- তা বাবা তোমার ফেড জিনসের কথা শুনে আমার মুখই ফেড হয়ে গেল তা পাশ করেতো বসে আছো অনেক দিন। কিছু রোজগারের চেষ্টা করো।
স্ত্রী :- আমার বাছাধনকে এরকম খোঁটা দিয়ে কথা বললে? ওর কী এখন রোজগারের বয়স?
স্বামী:- না না, আমার বুড়ো বয়সেই তো রোজগারের কথা। দেখো আমার এখন একটু বিশ্রামের প্রয়োজন। আমি কিছু দিতে পারবনা।
স্ত্রী :- তাহলে আমিও আজ কর্মবিরতি ঘোষণা করছি। কোথায় খাবে, কি খাবে বুঝে নাও।
স্বামী:- দেখো কী আর করবো? " পড়েছি যবনের হাতে, খানা খেতে হবে একসাথে।" ওই ওষুধ কেনার জন্য চার হাজার টাকা তোষকের নিচে রাখা আছে। সেলের বাজারে গিয়ে আমার শ্রাদ্ধানূষ্ঠানে পিন্ড দেবার ব্যবস্থা করে এসো।
স্ত্রী :- ছি: ছি: কী কথার ছিরি! পথে এসো বাছা, ভারীতো চারহাজার টাকা দিচ্ছ। তার জন্য এতো কথা। যাক, আজ ওটা নিয়েই সেলের বাজারে যাবো।
চন্দ্রাবতী ও রাজা
সাগরিকা কর্মকার
চন্দ্রাবতী : রাজা, আপনি কি নিষ্ঠুর! যুদ্ধজয়ের নেশা আপনার রক্তে বইছে, শুধুমাত্র রাজ্য জয়েৱ লোভে শত শত প্রাণ অনায়াসে কেড়ে নিচ্ছেন।
রাজা : সাধারণ নারী তুমি শুধুমাত্র কিভাবে বুঝবে যুদ্ধজয়ের উদ্দেশ্য ও একজন রাজার ক্ষমতা ।
চন্দ্রাবতী : ভুল আপনি রাজা , একজন নারীকে অতটাও সাধারণ ভাববেন না , আপনি যে শক্তির আরাধনা করেন, সে একজন নারী , এ কথা ভুলে যাবেন না ।
রাজা : হাহাহা ! তোমার কথায় অবাক হলাম, শুধু সৌন্দর্যতায় পুরুষকে আকৃষ্ট করা , তার সংসার ও সন্তান নিয়ে থাকাই নারীর ধর্ম । এটা তুমিও ভুলে যেও না ।
চন্দ্রাবতী : আপনাকে প্রণাম , আপনার প্রতিটি কথায় আজ খুব হাসি আসছে। আমাকে ক্ষমা করবেন ।
রাজা : হাসি! ঠিক তোমার ঐ ঠোঁটে হাসিটা মানায় , তবে এই ভাবনার জন্যে আমি তোমাকে শাস্তি দিতে পারি ।
চন্দ্রাবতী : শাস্তি ! আপনার সব শাস্তি আমি মেনে নিতে পারি, এমনকি মৃত্যুদণ্ডও। কিন্তু আমার অপরাধ ?
রাজা : রাজার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা, যা একজন সাধারণ নারীর কোন অধিকার নেই।
চন্দ্রাবতী : আমি আপনাকে ভালোবাসি রাজা, তাই অন্যায় করতে বারণ করছি , পাপ বাড়াবেন না ।
রাজা : যুদ্ধ কোন অন্যায় নয় ।
চন্দ্রাবতী: মায়েদের বুকফাটা আর্তনাদ শুনেছেন কখনো ? কাছ থেকে দেখেছেন অনাথ শিশুদের মুখ , সদ্যবিবাহিতা নারীদের বৈধব্য যন্ত্রনা অনুভব করেছেন কখনো ? রাজা , একটা যুদ্ধ মানে সেই দেশের পশুপাখি, বনভূমি সবকিছু ধ্বংস করা। এই যুদ্ধ বন্ধ করুন রাজা। সাধারণ প্রজাদের বাঁচতে দিন।
রাজা : ( অবাক চোখে চন্দ্রাবতীর দিকে তাকিয়ে) কি বলতে চাইছো ?
চন্দ্রাবতী : আজ আমি আপনার ভালোবাসার প্রিয়তমাটি নই , একজন সাধারন প্রজা হয়ে প্রার্থনা রাখছি, আর রক্তবন্যা নয়, শুধু শান্তি চাই। এই আকাশ- বাতাস শুধু ভালবাসায় ভরে থাকুক, পাখিদের সুরে ; ভ্রমরের গুঞ্জনে ; ফুলেদের হাসিতে আর সূর্যের সাত রঙে লেখা থাক আমার-আপনার একটি প্রেমকথা ।।
মুজনাই সাপ্তাহিক বিশ্ব নাট্য দিবস বিশেষ সংখ্যা