"...ডালে ডালে ফুলে ফলে পাতায় পাতায় রে, আড়ালে আড়ালে বনে বনে।" বহুত্ববাদী এই দেশের নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধান এর মধ্যেও এক মিলন ক্ষেত্র। দেশের কোনো প্রান্তে বিহু উৎসব তো কোথায় পোঙ্গল। কোথাও মকর সংক্রান্তি, তো কোথাও হোলি উৎসব।
হিন্দু মাইথোলজি অনুসারে রাধা কৃষ্ণের প্রেম ই হোলি উৎসবের একমাত্র উৎস হলেও কেউ কেউ হোলিকা দহন ও রঙ্গোলী র বিষয় টিতে নানা ভাবে বর্ণনা করে থাকেন। সে যাই হোক আমাদের জীবনের অতি প্রয়োজনীয় জল থেকে আমরা শিক্ষা পাই সবত্র মিশে যাবার। সব জাতী, সব ধর্মের মিলন ঘটানোর যেমন আবশ্যকীয়, ঠিক সবার রঙে রঙ মেশানো এবং রেঙে ওঠা বা অন্তরআত্মা কে বসন্ত রাঙিয়ে নেওয়াও অতি প্রয়োজনীয় বিষয়।
হোলি বা রঙের উৎসব অবশ্য অতি জনপ্রিয়তা লাভ করেছে শান্তিনিকেতনে র " বসন্ত উৎসব " থেকে। কবির অতি আদরের কনিষ্ঠ পুত্র শমীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে বসন্ত উৎসবের প্রবর্তন করেছিলেন। এ কথা বলবার কোন অবকাশই নেই শান্তিনিকেতন ই ভারত ভূমির সেই তীর্থ ক্ষেত্র যেখান থেকে রাখি পূর্ণিমা, পৌষমেলা এবং বসন্ত উৎসব জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
বসন্তে আজ ধরার চিত্ত
চিত্রা পাল
নবীন বসন্ত
এসেছে তার রঙের বাহার নিয়ে। সে রঙ ছড়িয়ে
দিয়েছে আকাশে বাতাসে।হরষে রাঙা কপোলে ঘুম ভাঙা চোখে পুষ্প কোরক পুলকিত, পাতায়
পাতায় দলে দলে সে আনন্দের শিহরণ। রাঙা
রঙের লালিমা লাগে শিরিষ পলাশের কোরকে। বনে বনে নব নব মুকুলে দখিনা পবনের ছন্দ।নবীন পাতায় আজ রাঙা হিল্লোল। বসন্তের
অভিনন্দনে আজ ধরার চিত্ত উতলা। কম্পিত নব কিশলয়
শিহরে মলয়ের চুম্বনে।গাছের সবুজ,
আকাশের নীল,সন্ধ্যার সূর্যাস্ত এখন বসন্তের রঙে রঙীন। নবীন রঙের তানে বনে বনে যে
ঢেউ জেগেছে, সে রঙের দোলা যে আমাদের জন জীবনকেও দুলিয়ে দিয়েছে। এসেছে রঙে রঙে রঙীন
দোল মহোৎসব। সকল আকাশ সকল বাতাস বসন্তের আগমনে চল চঞ্চল। জনম-ভরা অতলা ব্যথা
দুলিয়ে বসন্তে ধরার চিত্ত যে আজ বড়ই উতলা। মৃত্যু আবেশ হারিয়ে সেই সুরে সুর মিলিয়ে
বেজে উঠুক আমাদের আনন্দগান এই নবীনবর্ণা ধরণীতে।
প্রবন্ধ
লাল পলাশের আগুন ঝরানো বাহার দেখলে মনটা ভরে ওঠে
বটু কৃষ্ণ হালদার
গত এক বছর ধরে সমগ্র সভ্যতার উপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেল।২০২০ সাল বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মানব সভ্যতার কাছে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।চেনা পরিবেশ মানুষজন,রাস্তাঘাট,বড্ড অচেনা হয়ে উঠেছিল। লক ডাউনের সময় জনগণ সংবাদমাধ্যমগুলো তে নজর রেখেছিল আর দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলেছিল। প্রতিনিয়ত মৃত্যুর মিছিলে হাঁটছিলো বিশ্বের তাবড় তাবড় দেশগুলো। ভারত বর্ষ সেই তালিকা থেকে বাদ যায়নি।সেলফোন বেজে উঠলে হৃদপিণ্ড ছটফট করে উঠত। কারণ প্রতি সেকেন্ড কেউ-না-কেউ হারিয়েছে তাদের প্রিয়জনকে, সেই খবর শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে যেত।চোখের সামনে মা সন্তান হারিয়েছে, স্ত্রী স্বামী হারিয়েছে, আবার কেউ কেউ হারিয়েছে তাদের প্রিয়জনকে। অগণিত মানুষ কর্মহারা হয়েছে। প্রায় এক বছর যাবত সাধারন জনগন নিজেদেরকে গুটিয়ে রেখেছিল শামুকের খোলস এর মধ্যে। মানবজাতির কাছে এ ছাড়া কোনো উপায় ছিল না।মানুষ এই এক বছর উৎসব বিহীন জীবনযাপন কাটিয়েছে।ধীরে ধীরে বিভীষিকাময় আধারের কালো মেঘ সরে গিয়ে আবার একটু একটু করে আলোর মুখ দেখতে চলেছে।
আমাদের ভারত বর্ষ এক ঋতু বৈচিত্র্যময় দেশ। ৬ টি ঋতুর সমাহার এ ভারতবর্ষকে বিশ্বের দরবারে শস্য-শ্যামলা করে তুলেছে। ভারত বর্ষ শুধু ঋতু সমাহার দেশ নয়, ভিন্ন ভাষা সংস্কৃতির মিলনক্ষেত্র বটে। তাই ভারতবর্ষে প্রতিনিয়ত কোন না কোন সংস্কৃতি উৎসব লেগেই থাকে। এরই জন্য বিদেশীরা পবিত্র ভারত ভূমির টানে ঘর ছাড়া হয়। তেমনি এই ভারতের এক অন্যতম জনপ্রিয় লোকো উৎসব হলো দোল। যাকে পাতি বাংলা ভাষায় বলা হয় বসন্ত উৎসব।এই বসন্ত উৎসবের সঙ্গে গ্রাম বাংলার মানুষদের নাড়ির সম্পর্ক। বসন্ত উৎসব হলো বাঙ্গালীদের প্রাণের উৎসব। এ সময় বনময় নতুন বৃন্তে আচ্ছাদিত হয়ে সবুজ সতেজ হয়ে উঠে। কোকিলের মন মাতানো কুহু কন্ঠে মুখরিত হয়ে ওঠে পরিবেশ।বসন্তের রঙে রঙিন। হয়ে ওঠে উৎসব মুখরিত বাঙালির হৃদয়।বসন্ত মানেই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন। নতুন বর্ণে সেজে ওঠে শান্তিনিকেতন।বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ কখন রঙের খেলা চালু করেছিলেন, তা নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। কিন্তু শান্তিনিকেতনে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ যে বসন্তোৎসব চালু করেছিলেন, তা নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। ১৯২৫ সালে প্রথম পথ চলা শুরু হয় এই বসন্ত উৎসবের। উৎসবের মূল সুর যেন তখন থেকেই বেঁধে দেওয়া হয়ে গিয়েছিল।
বসন্ত উৎসবের একদম প্রাচীনতম রুপ প্রোথিত আছে দোলযাত্রার মাঝে। ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে অনুষ্ঠিত হয় দোলযাত্রা।এর প্রাণকেন্দ্রে থাকেন রাধা-কৃষ্ণ। তাদেরকে দোলায় বসিয়ে পূজা করা হয়। উত্তর ভারতে যেটিকে বলা হয় হোলি, বাংলায় সেটিই পরিচিত দোল হিসেবে।
ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চলের প্রাচীন আর্য জাতির হাত ধরে এই উৎসবের জন্ম। খ্রিস্টের জন্মেরও বেশ কয়েকশো বছর আগে থেকে উদযাপিত হয়ে আসছে এই উৎসবটি। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দে পাথরের উপর খোদাই করা এক পাথরে পাওয়া গেছে এই উৎসবের নমুনা। এছাড়া হিন্দুদের পবিত্র গ্রন্থ বেদ ও পুরাণেও রয়েছে এই উৎসবের উল্লেখ।
এছাড়াও এই উৎসবের ফিরিস্তি রয়েছে আরো বহু জায়গায়। তৃতীয়-চতুর্থ শতকে বাৎস্যায়ন রচনা করেছিলেন তার জগদ্বিখ্যাত 'কামসূত্র'। সেখানে দেখা যায় দোলায় বসে নর-নারীর আমোদ-প্রমোদের বিবরণ। সপ্তম শতকের দিকে রাজা হর্ষবর্ধনের শাসনামলে সংস্কৃত ভাষায় লেখা হয়েছিল একটি প্রেমের নাটিকা, সেখানেও ছিল হোলির বর্ণনা। সপ্তম শতকে রচিত শ্রীকৃষ্ণের 'রত্নাবলী' এবং অষ্টম শতকের 'মালতী-মাধব' - এই দুই নাটকেও দেখা মেলে এই উৎসবের। তালিকা থেকে বাদ দেয়া যাবে না জীমূতবাহনের 'কালবিবেক' ও ষোড়শ শতকের 'রঘুনন্দন' গ্রন্থের কথাও। পরবর্তী সময়ে ভারতবর্ষজুড়ে অনেক মন্দিরের গায়েও হোলি খেলার নমুনা বিভিন্নভাবে ফুটে উঠতে দেখা যায়।প্রথমদিকে ভারতবর্ষে এসে ইংরেজরা এই উৎসবকে রোমান উৎসব 'ল্যুপেরক্যালিয়া'র সাথে গুলিয়ে ফেলেছিল। অনেকেই আবার একে গ্রিকদের উৎসব 'ব্যাকানালিয়া'র সাথেও তুলনা করত।
কথায় আছে বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ।পহেলা বৈশাখের পর অন্যতম জনপ্রিয় লোক উৎসব হলো দোল উৎসব। নীল সাদা মেঘের ভেলা ও দখিনা বাতাসের তালে তালে কাশফুলের মাথা দোলালো যেমন জানান দেয় ঘরের মেয়ে উমার আগমন ঘটতে চলেছে। ঠিক তেমনই ,পলাশ,শিমুল, কৃষ্ণচূড়া কেশর উঁচিয়ে জানান দেয় বসন্ত এসে গেছে।এ সময় বহু প্রেমিক-প্রেমিকাদের হৃদয়ে আকুতি র দুয়ার খুলে যায়। প্রেমিকের বুকে প্রেমিকা মাথা রেখে স্বপ্নের মায়াজাল বুনতে থাকে। এসময় তরতাজা হয়ে ওঠে আমাদের শৈশব। আমাদের শৈশবে দোল খেলা ছিল একটু অন্যরকম।কারণ আমার শৈশব কেটেছে সুন্দর বনের এক প্রত্যন্ত গ্রামে।গ্রামের নাম গোসাবা ব্লকের পাঠান খালি নামক জায়গার কামার পাড়া গ্রামে। গ্রামের মানুষ জন মাটির সাথে মিশে গিয়ে উৎসব পালন করেন।তখন আমাদের কাছে টাকা পয়সা ছিল না কিন্তু অনাবিল সুখের ঢেউ উপছে পড়ত সহজ সরল জীবনে। দোল উৎসবের আগের দিন গ্রামে ন্যাড়াপোড়া চালু আছে। যুগ যুগ ধরে বাংলার মানুষ এই সংস্কৃতিকে বহন করে চলেছে।অশুভকে বিনাশ করে শুভ শক্তির জয় উদযাপনই হোলি উৎসব। রঙের পাশাপাশি তাই ন্যাড়া পোড়াকেও সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়। যা নিয়ে বাংলায় মজার ছড়াও প্রচলিত, 'আজ আমাদের ন্যাড়া পোড়া কাল আমাদের দোল, পূর্ণিমাতে চাঁদ উঠেছে বল হরি বোল।' হোলির একদিন আগে অনুষ্ঠিত হয় হলিকা দহন। তার জন্য আগে থেকে শুকনো ডাল, কাঠ এবং শুকনো পাতা জোগাড় করা হয়। তারপরে ফাগুন পূর্ণিমার সন্ধ্যায় পোড়ানো হয় সমস্ত স্তূপাকার করে। এই দহন অশুভ শক্তি বিনাশের প্রতীক।
তখন কার সময়ে গ্রাম বাংলার জনগণ বাজার দিয়ে কেনা পিচকারি আনা হতো না।দোল উৎসব এর কয়েক দিন আগে পিচকারীর বানানোর জন্য বাড়ির গুরুজন রা বাঁশ কেটে জলে ফেলে রাখতেন।তার পর দোলের দিন সেই বাঁশ জল থেকে তুলে সুন্দর করে পিচকারি বানিয়ে দিতেন।রং বলতে বাজার দিয়ে ১/২ টাকা দিয়ে আবির কেনা হতো।সেই রং বালতি করে গুলে তার সাথে জবা ফুল বেটে মিশিয়ে নেওয়া হতো।রং ফুরিয়ে গেলে কাদা জল গুলে দোল উৎসব পালন করা হতো। রঙ ও কাদা জল মেখে এমন অবস্থা হতো কেউ কাউকে চিনতে পারতো না। রং খেলার পরে শুরু হতো জল স্নান।পুকুরে নেমে সাবান দিয়ে রং তুলতে তুলতে নাজেহাল হয়ে যেতাম। অনেকের সেই রঙের দাগ চোখে মুখের সাথেই হৃদয়ে লেগে যেত।তার পর চলত বাঙালির খাওয়া দাওয়া।আমরা সবাই জানি বাঙালি খাদ্য রসিক।নানান বাঙালি পদ রান্নার সুগন্ধে পরিবেশ ভরে যেত।গ্রামের মানুষ গ্রামে ফিরে আসেন।আবার কারো বাড়িতে আসেন অতিথি,আত্মীয়।সারাদিন সারারাত হৈ-হুল্লোড় গল্প আড্ডায় মজায় দিন কাটতো।
বর্তমান সময়ে প্রতিযোগিতার পাল্লা বেড়ে চলেছে। সময় কাঁধের উপর ফেলছে দীর্ঘশ্বাস। একে অন্যের কাঁধে পা রেখে আকাশ ছুঁয়ে ফেলার প্রয়াস। প্রতিযোগিতার ভারে ঝুঁকে গেছে বিবর্ণ মুখ। বাংলার কর্মচ্যুত,শিক্ষিত,বেকার,যুবকরা হয়ে পড়ছে পরিযায়ী শ্রমিক। তাই এই সময়কে লাগাম দিতে গিয়ে মানুষ ভুলে যাচ্ছে উৎসব আনন্দের কথা। বর্তমানে এই দোল উৎসবের সাথে সাথে বহু লোকসংস্কৃতি বাংলার বুক থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। হয়তো এমন ভাবে চলতে থাকলে এই বসন্ত উৎসব একদিন অতীতের স্মৃতিতে পরিণত হবে।
রম্য রচনা
আজ সবার রঙে রঙ মিশাতে হবে
স্বপন দত্ত
হিন্দু বৈদিক ধর্মগ্রন্থে উল্লিখিত একজন অসুরা অর্থাৎ নারী অসুর হোলিকা যিনি রাজা হিরণ্যকশিপুর বোন ও প্রহ্লাদের পিসিকে বিষ্ণুর সহায়তায় পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। অগ্নিতে প্রহ্লাদকে দগ্ধ করতে চেয়ে সে নিজেই দগ্ধ হয়। এই হোলিকা দহন থেকেই বহি:বঙ্গে হোলি উৎসব এবং বাঙলায় দোলযাত্রা বা বসন্ত উৎসব। আজও কুঁড়েঘর বানিয়ে ন্যাড়া পুড়িয়ে হোলিকাদহন প্রতীকী হিসাবে পালিত হয়।
" দলে দলে রং দিন, পারলে রং বদলে দিন"। এটা শুধু আওয়াজ নয় বরং রেওয়াজ। দোল হ'ল রঙের খেলা, সঙ্গে সঙ্গে রঙ পাল্টানোরও। পাড়ায় পাড়ায় মাস্তানরা আস্তিন গুটিয়ে তোলা আদায়ের জন্য রঙ দেখানোর পরও জনতা ওই একদিন বা দুদিন নানা রঙ ভরা বালতি নিয়ে রঙে অবগাহন করে মহাজোটের রঙিন সমুদ্রে।
বৈষ্ণব বিশ্বাস অনুযায়ী ফাল্গুনী পূর্ণিমা বা দোলের দিন বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ আবীর বা গুলাল নিয়ে রাধিকা ও অন্যান্য গোপীনিগনের সঙ্গে রঙ খেলায় মেতে ওঠেন। সেই ঘটনা থেকেই দোল উৎসবের উৎপত্তি।
বাঙালির ভ্যালেন্টাইন্সডের মতো দোলের দিনটিও কিশোর কিশোরী,যুবক যুবতীদের কাছে আর একটি খুল্লাম খুল্লা দিন। ঘর থেকে না বেরোলে হতে পারে রঙের অনা কাঙ্ক্ষিত অনুপ্রবেশ। তাইতো শুনি," খেলবো হোলি রঙ দেবোনা, তাই কখনো হয়, এসো এসো বাইরে এসো, ভয় পেয়োনা ভাই।" তবে রঙের প্রথাগত সঙ্ঘ্যা হারিয়ে সবাই নিজের মনের মত অন্যকে রাঙাতে হয় ব্যস্ত। খুণ না হয়েও খুন খারাপি রঙের গুণে লাল রঙের বন্যা। বাঁদরের সাথে সাযুজ্য সৃষ্টির বাসনায় বাঁদুরে রঙ। এক দিনের জন্য হলেও পূর্বপুরুষের উপস্থিতি স্মরণ করে একাত্মতা লাভের প্রচেষ্টা। হাজারো চেষ্টায় গালের চামড়া উঠে গেলেও বাঁদুরের আদুরে চিন্হ থাকে বিদ্যমান। গাইতে ইচ্ছে করে," রঙ শুধু দিয়েই গেলে, আড়াল থেকে অগোচরে, দেখেও তুমি দেখলে নাতো, সে রঙ কখন লাগলো এসে মনে, গেলো জীবন মরণ ধন্য করে শুধু রঙ দিয়েই গেলে।"
এরপরও আছে বার্নিশ ছাপাখানার কালি, পরিশেষে নর্দমার সুগন্ধী জলে ফেস পাউডার, রুজ ক্রিম মাখা মুখ হ' তে পারে একে বারে ছয়লাপ। এককথায়, ঠিক শিল্পীর হাতে পড়লে সাক্ষাৎ " বেগুন ক্ষেতের কাক তাড়ুয়া".। মনে মনে রাগ হলেও মুখে কিছু বলবার নেই উপায়। রঙ খেলার সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে মানিকজোড় হল, --" রঙ বাজি"! সেজন্য বোধহয় রয়েছে, অঞ্জন দত্তের বিখ্যাত গান,-- " পাড়ায় ঢুকলে ঠ্যাং খোঁড়া করে দেবো"....। তাই ধমকির ঝক্কিতে না পড়ে অম্লানবদনে মেনে নেওয়া ভালো , দোলের মেকআপে। তবে ওই বিচিত্র মেকআপে অর্ধাঙ্গিনী কর্তৃক গলাধাক্কা খেলে,সেকথা স্বতন্ত্র। তবে এখন " রঙ বরষে ভিগে চুনরিওয়ালা রঙ বরষে" র সাথে সংযোজিত হয়েছে -- " সুরা বরষে ভিগে চুনরিওয়ালা" । অনাহারে, অর্ধাহারে ভি আচ্ছা হ্যায় লেকিন পানাহার বন্ধ কভি নহী।
দোলযাত্রা উৎসব শান্তিনিকেতনে বসন্ত উৎসব । পূর্বরাত্রে হয় বৈতালিক। দোলের দিন সকালে, " ওরে গৃহবাসী, খোল্ দ্বার খোল্, লাগলো যে দোল"--- উদাত্ত কণ্ঠে হয় গীত।সন্ধ্যায় নানা ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের থাকে আয়োজন। কিন্তু এখন সেখানেও দল বদলের হাওয়া। প্রেম,ফুর্তি,রঙ খেলার আয়োজন,শুধু ভেজ নয়, অবশ্যই প্রয়োজন ননভেজ। দোলের দিন একটু বিলিতিতে আচ্মন,এখন স্ট্যাটাস সিম্বল, সমাজেরই সাজবদলের ইঙ্গিত। নেশার মৌতাতটা ঠিকমত জমে
উঠলে সুরতালহীন ব্যক্তিত্ব গাইতে পারে, " নীল দিগন্তে ওই ফুলের আগুন লাগলো।"
তা আগুন লাগুক একশোবার,ক্ষতি নেই যদি থাকে ফায়ার ব্রিগেড। কচি পাঁঠার খোঁজে গিয়ে বাজারে, নিজেই বোকাপাঁঠা। অগত্যা গাছপাঁঠা এঁচোরের খচরামিতে হতে হয় তুষ্ট। বাকি রইলো, মালপোয়া। তবে সামাজিক নৈকট্য বর্জনের যে খুড়োর কল সামনে রয়েছে টাঙানো, তাতে মালপোয়ার টাল সামলানো ভারী মুশকিল।ক্রমশ: অসামাজিক জীবে পরিণত হতে হতে এখন স্বতন্ত্র থাকা ছেলে বৌমার ফ্ল্যাটে যেতেও অনুমতি নিতে হয় মুঠোফোনে, নচেৎ গিয়ে দেখতে হবে বড়ো তালা লাগানো। পাড়াপড়শীদের বাড়িতে আবীর দিতে যাওয়াতো আরো দূরে। মনে পড়ে, ছোট বেলার কথা। ইজেরের উপর একটা ফতুয়া চাপিয়ে দুটো থলের একটাতে আবীর নিয়ে পাড়ায় বাড়ি বাড়ি আবীর দিয়ে বেড়ানো আর অন্য ব্যাগে মালপোয়া জমা করার কথা এখনকার ছেলে মেয়েরা শুনলে বলবে," ছ্যা ছ্যা, কী হ্যাংলা ছিলে গো তোমরা?"
যাকগে, বিখ্যাত কমেডিয়ান ভানু বন্দোপাধ্যায় যেভাবে --- " মাসিমা মালপোয়া খামু" -- বলে মাসিমার ঘরে হামলে পড়ে মালপোয়া খেয়েছিলেন, এখন সেগুড়ে বালি। কারণ চিনি আর সর্ষের তেলের যাঁতাকলে পড়ে মালপোয়ার এখন পোয়াবারো, এখন শুধুই নির্বাক ছবি। আর কাজু কিসমিসের কিস্, সত্যিই মিস। তাই মালপোয়ার মোহমায়ায় ভুলেও ওর চিন্তা
না করাই ভালো।
তবে একটি দিন," যেমন খুশী সাজো'র বিভাগে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার নস্টালজিকতায় গা ভাসানোর সুযোগ দোলের দৌলতে পাওয়া গেলেও রঙ বদলের বিপাকে বাঙালি এখন দিশেহারা। স্বেচ্ছায় রঙ না বদলালে তোমার রঙও বদলে দিতে পারে, একথা এখন বোঝে পাগলেও। তাই এখন, --- " ছাতা ধর হে দেওড়া, যেদিক পানে বৃষ্টি আসিছে" গানটিই উপযুক্ত। দল বদলের কলরোলে নিজেকে মেলাতে না পারলে বিনা প্লাস্টিক সার্জারিতে বদলে যেতে পারে শ্রীবদনের চালচিত্র। তাইতো এখন শুরু হয়ে গেছে,সত্যিকারের রঙ দেখানোর প্রতিযোগিতা। একই লোক হরেক মিছিলে, মিটিংয়ে বাস, টেম্পোয় আসছে অবলীলায়। কারণ বিনে পয়সায় রঙ এর রঙ্গ দেখবার এমন সুযোগ আসে ক' বার? এরপরও রঙ পাল্টানোর জন্য নিজেকে এগিয়ে না দিলে জীবনের রঙ্গমঞ্চ থেকে ঘটবে মাহাপ্রস্থান । তাই এখন পিচকিরি থেকে রঙের ফুলঝুরি না বেরিয়ে ছড়ড়ার
ফুলঝুরি। তাই রঙের বদলে রক্তের হোলিখেলা। কিন্ত একটা অশুভ পরিনামেই যে চলে গেল, তার জীবনতো আর কোনদিনই হবেনা রঙিন।
তাই ছাপোষা বাঙালি আজ ভীত সন্ত্রস্ত। দোলের আহ্বানে হৃদয় হয়না পুলকিত বা রোমাঞ্চিত। বরং সদাই ভয়ঙ্কর শঙ্কিত।রঙবদলের এই নিষ্ঠুর খুনোখুনি বন্ধ হবে কবে?
তাই বলতে ইচ্ছে হয়, " রঙ বদল জাগ্রত দ্বারে, বুঝছি মোরা হাড়ে হাড়ে।"
কবিতা
রাঙিয়ে দিয়ে
শ্রাবণী সেন
সবার রঙে মিশিয়ে নিতে রঙ
এই তো এল আবার হোলিখেলা
সাতটি রঙে ভরিও তোমার মুঠি
রঙিন হয়েই কাটুক না হয় বেলা!
আকাশ পাঠায় অনন্ত নীল তার
উষা ছড়ায় আবীর এমন করে
পলাশ শিমূল মাখল তনু মনে
অশোকফুলের সাজিও ওঠে ভরে।
তোমার রঙে মিলিয়ে আমার রঙ
এবার তবে মনেই আবীর লাল
সবার রঙে মিশিয়ে নিয়ে রঙ
ভালোবাসার ছড়িও গুলাল।
দোল
মাথুর দাস
দোল বা হোলি যাই বা বলি, উৎসব !
রঙ মাখিয়ে রঙ মেখে হই ভূত সব ।
রঙিন দিনে পার হয়ে যাই সঙ্গীন বাধা,
আজ এ দিনে সব যুগলই কৃষ্ণ-রাধা ।
সবার রঙে
সাগরিকা কর্মকার
আমার তো কোন রঙ নেই চিত্রকুমার,
কোন এক মন খারাপের চৈত্রের দিনে
প্রজাপতির পাখায় ; কৃষ্ণচূড়ায়
যত রঙ ছিল সেদিন
মিলিয়ে ছিলে তোমার রঙ তুলির পাতায়
আর এঁকেছিলে আমার ছবি, অনুরাগের ছোঁয়ায়
আবিরের নেশা আজ আকাশে-বাতাসে
তবুও ঝাপসা কেন?
থাক না, আমাদের যত রঙ মনের গোপনে
এসো, মিলে যাই সবার রঙে।।
আনন্দছবি
অলকানন্দা দে
নয়নাভিরাম রোদের কলরবে
যুগে যুগে অর্জিত যে সুখ,
ঊষার বাগানে সুহৃদ বসন্ত
আসন পাতে রঙিন অদ্ভুত!
বন্ধনহারা একাকার উল্লাসে
ছড়ায় শূন্যে অনন্য রামধনু,
উৎসবনাটে সেতু বাঁধে ফাল্গুন
আবীরগুলাল ঐকতানে তনু।
প্রতিটি সুরে ফোটে আনন্দমীড়
পথ পেয়ে যায় রঙিন বিচিত্র ভাষা,
আলিঙ্গনে বিশ্বাস ওড়ে তীব্র
আকাশ মাটিতে রঙ খেলে ভালোবাসা!
প্রিয় যৌবন শোভাযাত্রী আজ
সুখরেশ শুধু শিশুর জয়রোলে,
নারকেল ফাঁকে চাঁদের সাম্পান
পূর্ণতা পায় হৃদয় দিঘির জলে!
প্রাকৃত সাজে অলঙ্কারী ঋতু
প্রতিটি দিনের আরতি স্বভাবজাত,
স্বপ্নে পোষা অপার প্রেমের নামে
সার্বিক সুখী অনন্য গান বাঁধো।
ছবি
অনুস্মিতা বিশ্বাস
অদ্রিজা বোস
তানভি দাম
মুজনাই সাপ্তাহিক বিশেষ সংখ্যা দোল পূর্ণিমা ২০২২
No comments:
Post a Comment