বাঙালির পরিপূর্ণ সাহিত্য, সংস্কৃতির একটি স্তম্ভ যদি হয় রবীন্দ্রনাথ,তবে দ্বিতীয় স্তম্ভটি নিঃসন্দেহে সত্যজিৎ রায়।
চিত্র পরিচালক, চিত্রকর, সাহিত্যিক, সংগীতজ্ঞ ----ভার্সেটাইল প্রতিভার স্ফূরণে আক্ষরিক অর্থেই
সাহিত্যে একটি কথা খুব প্রচলিত ---"ইকনমি অফ ওয়ার্ডস", অর্থাৎ কম কথাতে বেশি কিছু বলা।
এরজন্য ভিসুয়ালস, সংলাপ আর তার সাথে মিউজিকের সঠিক মেলবন্ধন দরকার। প্রয়াত বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালক তপন সিংহ বলেছিলেন সেই মেলবন্ধন ঘটাতে পেরেছিলেন এশিয়ার দুইজন অস্কার জয়ী ----একজন জাপানের আকিরা কুরোশোওয়া,অন্যজন সত্যজিৎ রায়।
চলচ্চিত্র পরিচালক শ্যাম বেনেগাল বলেছিলেন সত্যজিৎ হলেন ভারতীয় চলচিত্র যুগের একজন যুগ প্রবর্তক যিনি প্রচলিত প্রথাবদ্ধতা থেকে বেরিয়ে গতানুগতিকতা থেকে চলচিত্রকে মুক্তি দিতে পেরেছিলেন।
ঠিক তাই,সত্যজিৎ রায় চলচিত্রে এক মৌলিক বা স্বাতন্ত্র্য ভাষা এনেছিলেন। সত্যজিৎ রায় যখন কোন ধ্রুপদী সাহিত্য থেকে কোন কাহিনী নির্বাচন করতেন,তখন মৌলিক সৃজনতায়, তাঁর প্রতিভার গুনে সেই সৃষ্টি নিছক অনুবাদ না হয়ে হয়ে উঠত নতুন সৃষ্টি। চলচিত্র জগতের পাশাপাশি গ্রন্থের প্রচ্ছদ এবং লিপি শিল্পী হিসেবেও তিনি ছিলেন অনন্য ।
তিনি সফল গীতিকার এবং একজন দক্ষ সংগীত পরিচালকও। চলচিত্রে তাঁর নিজস্ব ধারার মতো ডিজাইন ও গ্রাফিক্স শিল্পেও তাঁর একটা আকর্ষণীয় মুগ্ধতা লক্ষ্য করা যায়। তা্ঁর নিজস্ব গল্পের সঙ্গে তাঁরই হাতের ইলাস্ট্রেশনগুলোতেও তাঁর বিস্ময়কর প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়। যার সাক্ষ্য বহন করছে ফেলুদা সিরিজ, প্রফেসর শঙ্কু সহ অন্যান্য গ্রন্থসমূহ।
ভারতীয় কৃষ্টি, সংস্কৃতি কে আত্মস্থ করলেও পাশ্চাত্য সংগীতেও ছিল তাঁর সমান দখল। ভারতীয় শিল্প-সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত হয়েও তিনি এক নিজস্ব সাংগীতিক ঘরানা তৈরি করেছিলেন। যার প্রভাব আমরা পাই "গুপী গাইন বাঘা বাইন"," হীরক রাজার দেশে"র মতো বিখ্যাত সংগীত বহুল ছবিগুলোতে।
আমরা ভুলতে পারিনি আজও"পথের পাঁচালী"র সেই "আইকনিক"দৃশ্য ------ অপু-দুর্গার কাশ বনের মধ্যে দিয়ে ছুটতে ছুটতে রেল গাড়ি দেখার সেই দৃশ্য!!
সিনেমাটিক দৃশ্যকে শুধু যন্ত্র সংগীতের ব্যবহারে কোন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া যায় তার উদাহরণ দুর্গার মৃত্যুর পর সর্বজয়ার সেই বাকরুদ্ধ কান্নার দৃশ্যায়ন-----দুর্গার জন্য আনা ডুরে শাড়ি সর্বজয়া দাঁত দিয়ে চেপে বাকরুদ্ধ কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছে , ঠিক তখনই ব্যাকগ্রাউন্ডে তার সানাইয়ের সেই আর্তনাদ--সুর!! ----অসাধারণ, অনবদ্য সেই ভিসুয়াল! সংলাপ হীন দৃশ্যকে সাংগীতিক বোধের দক্ষতায় এমন নিখুঁত ভাবে পর্যবেক্ষণ!!
তাইতো পন্ডিত বিলায়েত খান সত্যজিৎ রায় সম্পর্কে উচ্চারণ করেছিলেন " মানিক দা হলেন
আত্মজা (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
কাকলি ব্যানার্জী মোদক
রবিঠাকুর, ও... রবিঠাকুর, তোমাকে আজ কতো সুন্দর লাগছে, আকাশের তারারা তোমার মাথার উপরে ঝিকমিক করছে ,মনে হচ্ছে ওরা যেন নিমন্ত্রিত ,ওরা আজ আহ্লাদে আটখানা মেতে উঠেছে উৎসবের আনন্দে।
একফালি চাঁদ যে তোমাকে রোজ দেখে, চন্দ্রকণা থেকে পূর্ণচন্দ্র, মাথার উপর প্রতিটি রজনীতে পাহারা দেয় তোমাকে, মানে আমাদের রবিকে, তোমার ঘরে জ্বালায় আলো, যেন রবির কপালে চন্দ্র টিকা," আলোকেই ঝরর্ণা ধরায় ধুইয়ে দাও" শব্দগুলো বেশ মানিয়েছে আজ।
কতো ........ কতো... ফুলের মালায় ঢাকা পড়ে গেছে তোমার চোখ দুখানি। রবিঠাকুর জানি তবুও ,তবুও তুমি আমাকে দেখতে পাচ্ছ, জোৎস্নার আলোতে তুমি কি সুন্দর।"আজ জোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে " যখন লিখেছিলে তখন, তখন তুমি আমার কথা ভেবে লিখেছিলে ?একবার বলো এই শব্দগুলো আমার জন্য কি সৃষ্টি?
আমি ক্ষুদ্র আমার কথা কে আর ভাবে , তোমার ভাষাতে হোক আমার গৌরব গাঁথা।
এখন দিন গিয়েছে অন্ধকার হয়ে এসেছে চারিদিক নিঝুম জনমানবের চিহ্ন নেই,ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ খুব ক্ষীণ গতিতে শোনা যাচ্ছে। তোমার মাথার উপর অন্ত বিহীন বিশাল চাঁদোয়া, সেখানে মেঘেরা খেলা করে আপন খেয়ালে , এক পশলা বৃষ্টির পর তখন রামধনুর সাতটা রঙ তোমার মাথা স্পর্শ করে, মনে হয় আমাদের রবি জরির পোশাক পড়ে আছে, ঝলমল করছে সাতটি রঙে। আকাশ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে তার ব্যাপ্তি।
সেই- সেই দিনের কথা মনে আছে তোমার ? হঠাৎ আকাশ ভেঙে বৃষ্টি। যেন থামতে চাইছিলো না ,আমি তোমার পায়ের নিচে শুয়ে ভিজে জড়োসড়ো হয়ে কাঁপছিলাম , যেন ভৌরবীর তান্ডবে মেতেছিল প্রকৃতি ,মনে হচ্ছিল তুমি আনন্দে গান ধরেছো, মনে হচ্ছিল তুমি চিৎকার করে গাইছিলে "শ্রাবনের ধারার মতো পড়ুক ঝরে" বেশ, বেশ রাগ হয়েছিল তোমার উপরে তোমার শান বাঁধানো বেদিটা আমার খুব পছন্দের গ্রীষ্ম, বর্ষা ,শরৎ, হেমন্ত এই ভাবেই কাটে তোমার পদতলে আমার বেশ.... বেশ ভালো লাগে মনে হয় এইতো ... এইতো আমি রবির পাশে।।
সকালে ঘুম ভাঙলেই তুমি গান ধরো, "ওঠো ওঠো রে বিফলে প্রভাত বয়ে যায় যে" তোমার আলো এসে পড়ে আমার চোখে, শিশিরে চোখ ধুয়ে দেয় আমার ধরিত্রী মা, সবুজের গালিচার ফাঁক দিয়ে দেখি তোমাকে। তোমার হাতে বসা, কিম্বা মাথায়, কিম্বা তোমার বিশাল কাঁধে এসে বসে বিশ্ব চরাচর মুক্ত বিহঙ্গ, মাঝে মাঝে সবাই প্রতিবাদের আসর বসায় সমবেত কন্ঠে বলে "এখন আর দেরি নয় ধর গো তোরা" ওরাও তোমার কষ্ট বোঝে।
কাল, মানে গতকাল তোমার বেদির নীচে জড়ো হলো ময়লা সাফাই এর প্রস্তুতি , কতো গুলো ছেলে মেয়ে এসে আমার বুকের উপর বসিয়ে দিলো মস্ত,মস্ত থান ইট, চলল যুদ্ধ কালীন প্রস্তুতি তোমাকে সাজানোর ব্যস্ততা, আজ যে তোমার জন্মদিন, আজ পঁচিশে বৈশাখ উৎসবে মেতে উঠেছে ওরা, তোমার বুকেতে ভর দিয়ে লাগানো হলো সিঁড়ি, ঘসে যাচ্ছিল তোমার বুক, ঘসে মেজে পরিস্কার হচ্ছিলে তুমি,
আমার বুকের উপর দাঁড়িয়ে আরো আরো গোটা দশেক ভারতবাসী সিঁড়ির অনবরত ঘর্ষনে খসে পড়ছিস তোমার টুকরো টুকরো পাঁজর আমার বুকের উপরে। তোমার চোখে দেখলাম বেদনায় অশ্রু । নীরবে তুমি গান ধরেছিলে "এই করেছো ভালো নিঠুর হে,এই করেছো ভালো"।
আজ তখন রবির রক্তিম আভা এসে স্নান করে দিচ্ছিলো তোমাকে ।ঝলমল করছিল তোমার রূপ, কি সুন্দর তুমি রাজকীয় চালে পিছনে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে ,আর পা পর্যন্ত জোব্বা বেশ নতুন নতুন লাগছে, আজ তো তোমার জন্মদিন। বিশ্ব জোড়া তোমার নাম, কতো কবিতা, গান, নাটক লিখেছ কেনই বা হবেনা, তোমার কত ,কত গুণ কত নাম। তুমি সব ক্ষত ভুলে আমার দিকে তাকিয়ে। আমি ইটের ফাঁক দিয়ে দেখছিলাম তোমাকে।
হঠাৎ এসে পড়লো গোটা পঞ্চাশ ভারতবাসী বিরাট, বিরাট মালা পড়ানো হলো তোমাকে, তোমার চোখ ঢাকা পড়ে গেলো, সারাদিন চলল নাচ, গান, সুগন্ধি ধূপ কাঠির ভগ্নাংস এসে জড়ো হলো আমার বুকের উপরে ,অর্ধদগ্ধ অবস্থায় আমি দাঁড়িয়ে, দিন গিয়ে রাত বাড়লো ফেলে রাখা ভাঁড় , আর আমোদে সব আয়োজন আমার বুকের উপরে, নিঃশ্বাস যেন অসহায়। জানি, তোমাকে পড়ানো বাসী ফুলের মালা শুকিয়ে, গন্ধ হয়ে, একসময়ে ঝরে পড়বে আমার ই বুকে।
দিনান্তে কেউ আর মনে করবেনা তোমায় ।
তোমার শরীরে জমবে ধুলোর আস্তরণ। আবার অপেক্ষায় আরো একটা বছর, আবার আমার বুকের উপর দাঁড়াবে অন্য কোন একদল ভারতবাসী, হয়তো বা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে তুমি।
আমাকেও নির্মূল করে ছেঁটে ফেলে তৈরি হবে কংক্রিটের স্বপ্ন সুন্দরী,আকাশ চুম্বন ঝাঁচকচকে স্বপ্নের রাজমহল ।
বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা থাকবে মৃণালিনী বা গীতাঞ্জলি অথবা সোনার তরী।
তোমার পা স্পর্শ করার মতো সৌভাগ্য আমার কোনদিনই হয়নি, তোমার পায়ের নিচেই আমার স্থান। আমি ক্ষুদ্র "তৃণদল" তোমাকে স্পর্শ করতে চাইনা, শ্রাবনের ধারায় তোমার ধৌত পদরেণু যেন আমার বুকের উপর দিয়ে বয়ে যায় আজন্ম কাল। ভালো থেকো তুমি ভালো থেকো রবিঠাকুর ।।
“জল পড়ে না, পাতা নড়ে না কলকাতা শহরে!”
অলকানন্দা দেঅমার্জনীয় অপরাধের পাপের হলকা গায়ে লাগবে না তাও কি হয়! “কি গরম, কি গরম যে বোঝাতে পারব না”এই কথার জ্বালায় এখন কে না জ্বলছি। গাছপালাকে বিদায় জানিয়ে বাতানুকূল অহঙ্কারী ঘরের আয়োজন কেন যে পারছে না স্বস্তির সংসার পেতে দিতে এটাই গবেষণার। পৃথিবীটা গরম হচ্ছে তো হচ্ছেই। এ হয়তো তাকে নিরন্তর অপমান ও যন্ত্রণার জ্বালা যা শাস্তি হিসেবে ভোগ করছি দশ বাই দশ ঘরে বসে। খাটের কোণায় বসে ভাবছি পারিপার্শ্বিকটা কবে ব্যতিব্যস্ত হবে ঝঞ্ঝাবাদলের উচ্চস্বরে। কিন্তু সে গুড়ে বালি! মানুষ ও পরিবেশের মধ্যে ব্যবধান এখন প্রচুর। প্রকৃতির সার্বিক অমঙ্গল সাধনে মানুষের তো জুড়ি নেই, তাই পরিবেশের আচরণ যে স্বাভাবিকভাবেই অনৈতিক হবে তাতে আর দ্বিমত কি। পৃথিবী কুরে খাওয়া মানুষ এতেই হয়তো মস্ত লাভ দেখেছে। বেপরোয়া গাছপালা নিধন, জলাভূমির জলাঞ্জলি দিয়ে কংক্রিট সাধনা এই অন্যায্য গরমের কারণ বৈকি। বদলে গেছে বসুন্ধরা প্রচণ্ড অত্যাচারে। তার এই তপ্ত মায়াহীন রূপ দেখলে ভয় হয়। শাবল দিয়ে খুঁড়ে তোলা গাছটার শিকড় যেতে যেতে অভিশাপ দিয়ে গেছে, তলিয়ে যাবে সব যান্ত্রিক সুখ। হাহাকার করবে প্রাচুর্যের ভিখিরিরা একফোঁটা জল দু ফোঁটা বাতাসের মধুরের জন্যে। তাই তো হচ্ছে। অক্ষরে অক্ষরে ফলে যাওয়া কথা সাফল্যের চুড়ায় দাঁড়িয়ে প্রতিশোধের স্বাদ নেয়। আরও নেবে, সেই প্রহর গুনছে এখন সে অন্তরাল থেকে।তবু কি মানুষ শোধরাবে। বেঁচে থাকার এই উল্লাস যে সাময়িক এ কথা বোঝাতে পারছে না ধর্ষিতা প্রকৃতি। গাছপালার বিনাশে যে নিঃশব্দ ধ্বংসের ঝড় বইছে তা উড়িয়ে দিতে পারে এই বিলাসিতা অচিরে। ঠাণ্ডা মেশিনের সাধ্য সীমিত এবং বাড়িতে বাড়িতে এর প্রচণ্ড প্রতাপ পরিবেশের যে সমূহ ক্ষতি করছে তা ভেবে দেখছে না অসামান্য মানুষ। মুষ্টিবদ্ধ রিমোট যন্ত্রটির বোতাম টিপলেই যখন কাঙ্ক্ষিত ঠাণ্ডার অধিক মিলে যাচ্ছে তখন আর দখিনার কি প্রয়োজন। কিন্তু হায় রে! অলক্ষ্যে হাসে দুর্ভাগ্য যা প্রলয় গভীর। নীরবে এগিয়ে এসেছে অনেকখানি। মাশুল বিনা কিন্তু পাপ মোচন হয় না। এই অভিনব গরমের একটানা দুর্যোগ সামান্য ঝলক মাত্র প্রাকৃতিক অসহযোগীতার। সোনার কাঠিতে আর সোনা নেই যা ঠেকিয়ে দেবে প্রকৃতি সৌভাগ্য ললাটে। এত চড়া বৈশাখের কোনো রূপ নেই, মানে নেই। জলের হাহাকারে পশুপাখি নাকাল। গাছ নেই মহানগরীর মাটিতে যে বলা যায়, ‘আয় বৃষ্টি ঝেঁপে’। এত অসুস্থ পরিবেশের শোকাতুর ছবি কি টোকা দিতে পারবে সেই বেভুল বোধের তন্ত্রীতে! উদাসীনতা মুছে পরিবেশ শুশ্রূষায় একাগ্র হলেই বাঁচার আশা উঁকি দিতে পারে।আর দু দণ্ড দেরির কিন্তু অবকাশ নেই।গাছ লাগাতে হবে প্রচুর। স্মৃতির ভূগোলে যে পৃথিবী আছে তাকে ফিরিয়ে আনতে পারলে গাছপালার মিছিলে প্রাণযাত্রা করবে আগামীর শিশুদল। সেটাই সাধনা হওয়া উচিত। পরিবেশকে শুদ্ধ রাখা সুস্থ রাখা এবং পরিচ্ছন্ন রাখা দায়িত্ব তো বটেই সেইসাথে ভালোবাসাও! সকলেই পালন করুক এই গুরুদায়িত্ব নিজস্ব শিক্ষার মান রাখতে। এবং অবোধকেও উৎসাহিত করুক বা বাধ্য করুক প্রকৃতি সচেতন হতে।মানুষ হিসেবে শ্রেষ্ঠত্বের দাবি করা যায় তখনই যখন জলমাটির বন্ধনে বৃক্ষশিশুদের বেড়ে ওঠা আমার সদর-অন্দরে যাদুশিহরণ তোলে। চোখে চোখে রাখা চারাগাছটা মহীরুহের তালিকায় নাম লেখাবে, দেখব শ্যামসমারোহ দু চোখ ভরে! তবেই হয়তো ফসফরাসের আলো নিয়ে খেলবে জোনাকি হৃদয়! ভালোবাসার কিছু পুঁজি জমা রাখলে প্রকৃতির কাছে, ফিরে পাওয়া যায় দ্বিগুণ করে। এই সত্য পরখ করে দেখার নয়। প্রকৃতিকে ভালোবাসি সকলে মিলে! সেই কাজে মেলাই হাত ও মন! পরমার্থ আদরে সোহাগে তাকে প্রাণবতী করে তুলি। দেরি হোক, তবু যায় নি সময় পাথর প্রহরে ঘষা খেয়ে।
কবিতা
নিশি ডাক
বিনয় বর্মন
রাত হলেই তোমার কথা বেশি মনে পড়ে l
হয়তো সারাদিনের ক্লান্তিতে তুমি ঘুমিয়ে কাদা ,
পাশে ছড়িয়ে আছে বেড়াতে গিয়ে পাওয়া খাদা l
কিংবা তোমার হঠাৎ জ্বর ,
রক্তিম তোমার গাল নিঝুম ঘর ,
কোন ম্যাজিকে হব তোমার পাইরোজেসিক l
প্লিজ খুঁজো না লজিক !
ঘুমন্ত তোমার মাথায় কিংবা চোখের পাতায় ,
বুলিয়ে দেবো স্নেহের পরশ আলতো চুমোয় !
রোজই যাব যাব করি , কিন্তু আর হয়ে ওঠে না l
কোন একদিন ঠিক যাবই।
সেদিন চোখে মেখে রেখো কিমিউলোনিম্বাসের কাজল ,
ঢেকে রেখো স্তনসন্ধি জড়িয়ে
কিমিউলাসের আঁচল l
স্বপ্ন মৈথুনের চেপে রাখা শীৎকার ,
আর ব্রেইন ফিভার পাখির রাতভর বিলাপে অনুরনণিত পাহাড় l
ব্ল্যাক উইডো সিকাডার লুব্ধ ডাকে ,
পাকদণ্ডীর বাঁকে ,
আদিম রায়মাটাং আদমা চুনাভাটি লাল বাংলা বক্সাদুয়ার হয়ে লেপচাখার পথে ,
ক্লান্তিহীন হেঁটে যাবো l
পথ শেষে দেখা হবে তোমার সাথে l
মাপ
মাথুর দাস
মাফ কর ভাই, ও দাদারা,
তোমার মাপে নই আমি ;
আমার মাপে তোমরাও নও,
সবার থেকে হই দামী ।
নিক্তিমাপে ব্যক্তিবিশেষ,
মাপামাপির হয় কি শেষ ?
লাফালাফি হোক না যতই,
মাপের সীমা থই-কামী ।
দুটি কবিতা
রূপক চট্টোপাধ্যায়
বাগানে কজনে
আমাদের বাগান আছে
বৃক্ষ নেই।
বৃক্ষের বদলে আমরাই দাঁড়াই
হাত উঁচিয়ে, আকাশ ডাকি
পাখি ডাকি, ঝড়ের ঝুঁকি আটকে দি
হাড়ের খাঁচায়। আমাদের
ছেলেমেয়েরা আমাদের ছায়ার নীচে ফড়িং ধরে
শুঁয়োপোকা থেকে প্রজাতির জন্ম দেখে।
যুবতীরা দোপটী ফুলের পাশে হেসে ওঠে যখন,
সেদিন শ্রাবনী হিল্লোলেও বসন্ত হয়ে যায় আমাদের পাড়া।
বেঁচে থাকতে থাকতে এই ভাবেই আমাদের
বাগান বয়স পেরিয়ে যায় একদিন!
জাগ্রত
তুমি গীতবিতান হয়ে দেখো
আজীবন আঁকড়ে থাকবো তোমায়।
কেননা আমিও স্থবির অক্ষর পেরিয়ে
সুলভ পাঠাগার চেয়েছি, তোমার অন্তরে!
দুই পাট রুটির ভাঁজে এক টুকরো মাংস
আর দু বোতল মদের তৃষ্ণায় আমিও যাযাবর
হেঁটেছি নরক থেকে নরকের দিকে চাঁড়াল বেশে।
ক্ষতবিক্ষত পায়ে, ধূসর ছিন্ন পোষাকে আমি
কত শতাব্দীর দুঃখ গুলি
রঙিন করবো বলে, জেগে আছি
তোমার কবরস্থ অতীতের পাশেই!
১
সারণ ভাদুড়ী
আকাঙ্খাকে জয় করতে পারিনি,সে আমায় ধরে রেখেছে।
আমিও রয়ে গিয়েছি সঙ্গ ছাড়িনি..
পুরাতন তন্ত্র তো ধ্বসে গিয়েছে ,
বাম দিকের পতাকা দ্যাখোনি?
সেটা তো পুড়ে গিয়েছে!
সূচনা করেছি আমি আমার নতুন জীবনের
শ্মশানের চিতায় ভস্ম সেই পুরাতনী , দ্যাখোনি ?
গান্ধারী তুমি চোখ খোলো আজ
দ্যাখো আজ দুয়ারে কে..
শত দুর্যোধন মূর্ছা গেল যে
বৃকদরের সঙ্গে যুদ্ধে...!
যে প্রেমের মৃত্যু অনিবার্য
নবনীতা সরকার
নক্ষত্রের আলোর নীচে যে রাত
তার মৃত্যু অনিবার্য ৷
ঠিক যেমন অনিবার্য তোমার প্রেম ...
অথবা তার মৃত্যু ৷
তোমার প্রেম যেন
এক দীর্ঘ ময়াল সাপ
যা নিঃশব্দ বিচরণে
একটু একটু করে শরীরে জড়িয়ে যায়
দীর্ঘ সময় নিয়ে জরিপ করে তার
ভালবাসার , অতি পছন্দের শিকারটিকে
সে জানে এর সাথে ছলনা করা চলে
চলে ঘোরতর অভিনয়
কাম , প্রেম সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় প্রেমে
থুড়ি অপ্রেমে
অথচ কি নিদারুণ সুখানুভূতি
শিকারের মুখে চোখে
কি অকৃত্রিম দ্যুতি প্রতি আবর্তে ছড়িয়ে পড়ে
শরীরের গোপন আনাচে কানাচে
অনুভূতির সুগভীর এক প্রলেপ
তপ্ত নিঃশ্বাসের ভেতরে বয়ে যায়
ঘোর সন্নিবেশ লেগে থাকে ঠোঁটে ...বুকে
নাভির পাশে উত্তপ্ত ফেনিল সুখ বলে দেয়
যেমন চরম প্রেমিক তুমি
তেমন কঠিন শিকারী
কি নির্দ্বিধায় , কি পরম আগ্রহে
প্রতিনিয়ত শিকার করে চলেছ
নারী শরীর !
কিন্তু প্রেমিক তুমি জানলে না
যে প্রেম দেহজ চাওয়ার উর্ধ্বে উঠতে পারে না
সে প্রেমের মৃত্যু অনিবার্য
যেমন নক্ষত্রের আলোর নীচে একটি রাত...
দেশ ভাগ
আশীষ কুমার বিশ্বাস
দেশ ভাগ , ভাগ !
সে তো জমির বুকে ,
কাঁটা তারের বেড়া !
এক বুক যন্ত্রনা নিয়ে বাঁচা
সাম্প্রদায়িকতার বীজ মন্ত্র ।
কিন্তু সবাই কি সাম্প্রদায়িক ছিল ?
মোটেই না , তা হতে পারে না !
তবুও যাঁরা রয়ে গেল , স্মৃতির টানে
ভালোবেসে ,রক্তের টানে , দেশের টানে ।
তাঁদের ঘটলো রক্তপাত , নির্মম ব্যাবহার নির্যাতন
গালিগালাজ , অমানবিকতা ।
দিন কে দিন চললো লুটতরাজ , খুন -
সংখ্যালঘুদের বাড়ি বাড়ি ।
সংখ্যাগুরুরা সবাই যে মেনে নিল , তা নয়!
কিন্তু দেশ ভাগ , দেশ ভাগ-ই ।
জন্ম নিল উগ্র জাতীয়তাবাদ , ভিন্ন ধর্ম ।
উগ্রতা , হিংস্র হৃদয় ।
তবে আগের দিন , এখন আর নয় ।
তুলনামূলক অনেক কম ।
ইলিশ ভাপার গন্ধ __________
সৈকত দাম
অমন করে তাকিয়ো না সুচরিতা ,
এখনো তোমার বুকে বৈশাখ আসে নি ....
এখনো ভেঙ্গেচুড়ে যায়নি তোমার গাল ....
তোমার 64/1 ডোভার লেনের বাড়ি টা থেকে ,
এখনো আসে ইলিশ ভাপার গন্ধ .....
এখনো তোমরা মেতে ওঠো হুল্লোরে .....
এখনো চলে আদিখ্যেতা নতুন জামা কেনার ....
অমন করে তাকিয়ো না সুচরিতা .....
এখন আমি অন্য রকম ,
কালচারের মাদকতায় ভরে যায় ,
আমার প্রাইভেট সেক্টর .....
বেলুনে বেলুনে ভরে ওঠে ডেস্ক .....
কেকের লোভে ছুটে আসে ঠোঁট .....
মুখে পুরে নেয় কালচার .....
অমন করে তাকিয়ো না সুচরিতা ,
ঠোঁটের লোভে পড়িনি আমি এখনো ......
বাড়ি ফিরে এলে হাড়ির নিচে রাখা থাকে পোড়া ভাত .....
তোমাকে ঠকাবার কথা ভাবতে পারি না আমি ,
শুধু তোমার ঠোঁটের থেকে জন্ম নেবে ,
বাংলার আগামী .....
অমন করে তাকিয়ো না সুচরিতা ,
এখনো ইলিশ ভাপার গন্ধ ভুলিনি আমি .....
দিন যায়... রাত যায়...
দীপাঞ্জন দত্ত
যে ফুলের প্রাণ নেই,
আছে শুধু ঘৃণায় জড়ানো আবেশ
যেখানে নক্ষত্রপুঞ্জ কেবলি নিজেকে দগ্ধ করে,
সেখানে আমি মৃত।
সভ্যতা যেখানে প্রকাশিত হয় আঁধারের আধার হাতে
আমাকে দুঃখ দিতে চায় বারবার, সেখানে আমি ব্রাত্য,
তাকে চলে যেতে বলি।
আমাকে অতর্কিতে ঘিরে ধরে
মৃত্যুর দুত, চক্রবু্হ্যের মতন।
যেমনি করে দিন যায় রাত যায়...
তেমনি করে চলেযেতে থাকে
যার থাকার অভিপ্রায় ছিলনা আদৌ।
পাপে পুণ্যে বেসামাল হয়ে টলতে থাকে মাতালের মতন।
যে ফুলের প্রাণ নেই,
আছে শুধু ঘৃণায় জড়ানো আবেশ...
ফুটফুটে জোছনার দিনে
চাঁদের আলো যেখানে পড়ে না,
পড়ে থাকে শুধু একটুকরো অন্ধকার
সেখানে আমি অর্থ হীন,সেখানে আমি মৃত।
আমি যেতে চাই
মনোমিতা চক্রবর্তী
আমি যেতে চাই সবুজ গালিচা পাতা ঘাসে,
নূপুর পায়ে হেঁটে হেঁটে ।
আমি যেতে চাই তারা ভরা রাতে ,নক্ষত্রের দেশে
নূপুর পায়ে হেঁটে হেঁটে ।
আমি যেতে চাই মায়া মাখা সবুজ সমারোহে,
নূপুর পায়ে হেঁটে হেঁটে ।
আমি যেতে চাই বনবিথির ছায়ায় ছায়ায়, সাদা মেঘের ভেলায়
পাখির ধূসর ডানায় সন্ধ্যে নামার আগে,
নুপুর পায়ে হেঁটে হেঁটে ।
আমি যেতে চাই বৃষ্টি ভেজা অরণ্যে স্যাঁতস্যাঁতে পথে
কিংবা শরতের কাশফুলের বনে বনে,
নূপুর পায়ে হেঁটে হেঁটে।
রাত জাগা চোখে ঘুম আসে না ফিরে ,
বারে বারে ফিরে আসে শুধু স্মৃতি ,ভিন্ন ভিন্ন অবয়বে;
আমি শিকড়ে আটকে থাকা কোন মহীরুহু হতে চাই না,
আমি ক্লান্ত ঘড়ির কাঁটার সময়ও হতে চাইনা,
আমি যেতে চাই কালো মেঘের বৃষ্টি ভেজা দেশে
বাবুই চড়ুই শালিক কিংবা ময়ূরের বেশে,
নূপুর পায়ে হেঁটে হেঁটে।
দুটি কবিতা
রথীন পার্থ মণ্ডল
সেই গন্ধটা
পারফিউমের গন্ধটা অনেক দিনের চেনা,
দক্ষিণের দরজাটা আজ বোধ হয় খুলে গেছে
নিঃসঙ্গতায় ভরা মনে
চাপা অন্ধকার বয়ে বেড়ায়
অনুভবে অস্তিত্বের স্বাদ
আজ যেন পেয়ে বসেছে
রক্তপলাশের রক্তিমতায় ভরে ওঠে মন
এখন এক ঝলক ঠাণ্ডা বাতাস চাই
এক মুঠো ঝরাপাতা নিতে নিতে
শয্যায় আঁকিবুকি খেলে আলপনার ছন্দ
কে যেন বসন্তের আবির রং মাখিয়ে দেয় মাথায়
ছুঁলো মনের প্রান্তর, উঁকি মারে আকাশে
চোখে অশ্রু জলের বন্যা বয়
তবুও দেখি পরশপাথরের ছোঁয়া লাগে
তুমি এসেছো আজ এখানে
তাই চন্দনী পারফিউমের গন্ধটা
আজ ফিরে এসেছে ঘরে।।
আশ্চর্য সময়
এ এক আশ্চর্য সময়!
যখন শুধু রং কথা বলে
ফুল পাখি চাঁদ সবাই নীরব।
এ এক আশ্চর্য সময়!
মাতৃদুগ্ধে জাগে কীট-পতঙ্গ
সূচবিদ্ধ শৈশব একাকী
আশ্রয় খোঁজে ভরা সন্ধ্যায়
বন্ধ্যা মাটির বুকে।
এ এক আশ্চর্য সময়!
যখন বিশ্বাসহীন ভালোবাসা
সুখের দরজা আটকে
সেলফি তোলে সারাবেলা।
এ এক আশ্চর্য সময়!
যখন বৃদ্ধ শহরটা প্রতিদিন
থাকে ডাকপিওনের অপেক্ষায়
মনে মনে পড়ে না লেখা সেই সব চিঠি!
এ এক আশ্চর্য সময়!
যখন কোথাও আগুন নেই
আগুনের তাপ নেই
জনশূন্য রাত একাই কথা বলে যায়...
তোমার ছোঁয়ায়
সুনন্দ মন্ডল
অস্থির সময়ে সবকিছু অস্থির লাগে
অসহ্য লাগে তোমাকেও।
কিন্তু তুমি এলে
ক্ষণিকের প্রাণটা জুড়ায়
অশান্ত হৃদয়ে
তোমার ছোঁয়া পবিত্র হয়ে যায়।
পুরাতন যা কিছু
মুছে গিয়ে, মাটি
নতুনের গন্ধ পায়।
সৃষ্টির অমোঘ অমরতায়
প্রদীপ্ত সুখ ফিরে আসে!
প্রকৃতি ও আমি তখন একাকার হয়ে যায়।
ছবি আঁকা
সব্যসাচী নজরুল
আপন মনে বসে খুকু
আঁকছে গাঁয়ের ছবি
ডান কোণেতে চাঁদ মামাটা
বাম কোণেতে রবি।
বিকেল হলে ছেলের দলে
মাঠে ওড়ায় ঘুড়ি
তেমন ঘুড়ি আকলো খুকু
পাশে চাঁদের বুড়ি।
আঁকছে দেখ নদীর ঘাটে
নৌকো দু'খান বাঁধা
ঘর দু’টোর উঠোন পাশেই
খড়ের বড় গাদা।
বাড়ির ধারে আকলো খুকু
ফসলেরও বাগান
যা দৃশ্যপটে ছড়ায় যেন
ফুলফলেদের ঘ্রাণ।
গাছগাছালি পাখপাখালি
আকলো কত কি
তবুও ভাবে আরো কিছু
বাকি রইল কি!
গল্প
লকডাউন
বিবেক গুণ
গুগল মিট-এ অফিসের মিটিংটা সেড়ে ল্যাপটপটা রেখে যখন মোবাইলটা হাতে নিলাম, দেখি ১০:০৫ বাজে । ঘর থেকে বেরোতেই মা রান্নাঘর থেকে চিৎকার করে বললো,
- কখন খাবি, রাত বারোটায়?
মা যথারীতি রাতে খেতে দেড়ি হলে একটু রেগে যায় । তাই আমি সঙ্গে সঙ্গেই বললাম,
- এইতো এক্ষুনি খাবো।
আজ শনিবার। এই পনেরো দিনের সমস্ত কাজ আমি সেড়ে ফেলেছি। এখন আমার হাতে অতিরিক্ত তিনদিন আছে, একটু রিল্যাক্স করা যাবে। না হলে শেষের এই তিন-চারটা দিন খুবই ব্যস্ততায় চলে। সারাক্ষণ ক্লাইন্টদের ফোন, ফোন আর ফোন। একটু স্বস্তিতে শ্বাস ফেলাও কঠিন হয়ে যায়।
খাওয়ার সময় মা-কে বললাম,
- কাল একটু খাসির মাংস নিয়ে আসবো মা, অনেকদিন হয়ে গেল খাসির মাংস খাওয়া হচ্ছে না! আর তাছাড়া সারাক্ষণ তো বাড়িতেই আছি, একটু বাজারটাও ঘুরে আসবোনি।
মা বলল,
- এই অবস্থায় তোর বাজারে যেতে হবে না। হরিকে বললেই তো ও এনে দেবে । তোর যাওয়ার কি দরকার?
হরিদা আমাদের বাড়ির কেয়ারটেকার । আমাদের বাড়ির যা যাবতীয় কাজ সব হরিদাই সামলান আর রান্নার দিকটা হরিদার মেয়ে দেখে । হরিদা আর ওনার মেয়ে আমাদের বাড়িতেই থাকে কারন হরিদার স্ত্রী তাদের মেয়ের জন্মলগ্নেই মারা যান! মা-মরা মেয়েকে নিয়ে হরিদা যখন আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন তখন থেকে বাবা হরিদাকে এখানেই থাকতে বলে।
আমি মা-কে বললাম,
- আসছি থেকে তো সারাক্ষণ এই বাড়িটাতেই আছি, আর কত থাকবো বলতো?
হঠাৎ বাবা বলে উঠল,
- আরে যাক, বাইরেটা একটু বেড়িয়ে আসুক। বাড়িতে আর এভাবে কতদিন থাকে? হ্যাঁ, আনিস তো বাবা। পারলে একটু বেশি করে খাসির তেলটা আনবি বুঝলি!
ওমনি মা রেগে বাবাকে বলল,
- আজই তো মাছ খেলে আবার কালকেই মাংস! ডাক্তার কী বলেছে মনে নেই?
বাবা তৎক্ষণাত চুপ হয়ে আবার টিভিতে মন দিলো।
বাবার ডায়াবেটিস, সঙ্গে হাই ব্লাড পেসার! ডাক্তার তেল-মশলা খেতে একদম বারণ করেছেন। তাও বাবা একটু-আধটু খায়।
তাই মা-কে বললাম,
- অল্প নিয়ে আসবো তুমি তেল-মশলা কম দিয়ে হালকা করে রান্না করো ।
দিনগুলো বেশ ভালোই যাচ্ছে। অফিসের সব কাজগুলো বাড়িতে বসে অনলাইনেই হয়ে যাচ্ছে। মাঝে মধ্যে একটা-দুটো মিটিং থাকলে ঘন্টা পাঁচেক ওই ল্যাপটপটার সামনে বসে থাকতে হয় কোট-টাই পড়ে। এছাড়া তেমন কোনো কাজ নেই, আর তাছাড়া করোনার যা বাড়বাড়ন্ত তাতে বাড়ির বাইরে পা রাখাই মুশকিল। সন্ধ্যায় বাবার সাথে খবর দেখি আর দুজনের মধ্যে শুরু হয় প্রবল কথাকাটাকাটি। মাঝে মা এসে সিরিয়াল দিয়ে দেয় তখন দুজনেই চুপ। এইতো! আর কী দরকার জীবনে । মাঝে মধ্যে মনে হয় যে এই লকডাউনটা এমনই থেকে গেলেই ভালো হয়।
খেয়ে বিছানায় এসে কেবল শুয়েছি, এমন সময় ফোনটা বেজে উঠল। না, অফিসের কোনো কলিগের জরুরি ফোন নয় তবে তার থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ফোন, যেটা না ধরলে পরে হাজার কৈফিয়তেও কোনো কাজ হবে না।
তাই যথারীতি ফোনটা রিসিভ করলাম। হ্যালো বলতেই ওদিক থেকে একটা করুনামাখা স্বর ভেসে এলো,
- জানো আজ কি হয়েছে?
আমি বললাম,
- কী?
ও বললো, ওদের এলাকায় যেই পাগলটা ঘুরে বেড়াত সেই পাগলটা নাকি সকালে মারা গেছে! শুনে আমারও একটু খারাপ লাগল। কারণ যতোবারই ঋতমাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে গিয়েছি পাগলটা আমার কাছে খেতে চাইতো। আমিও ওই তিন টাকার একটা পার্লে-জি বিস্কুটের প্যাকেট কিনে দিতাম। কিন্তু তাতেই ওই পাগলটা এতটাই খুশি হতো, হয়তো আমাকে কেউ এক প্লেট বিরিয়ানি খাওয়ালেও আমি ততোটা খুশি হতাম না! লোকে নাকি বলাবলি করছিল যে পাগলটার কাল রাত থেকেই জ্বর ছিল তাই করোনার ভয়ে কেউ এগিয়ে যায়নি আর তাছাড়া লকডাউনের কারনে না খেতে পেয়ে নাকি মারা গেছে!
তারপর আমরা আরও কিছুক্ষণ কথা বলে ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরদিন সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেছি। এমনি সময় ১০টার আগে উঠি না তবে আজ যেহেতু বাজারে যাবো সেই জন্যেই একটু তাড়াতাড়ি উঠলাম। গ্রামের বাজার, একটু সকাল সকাল গেলে টাটকা সবজি পাওয়া যাবে। মুখ-হাত ধুয়ে, চা খেয়ে মুখে ডাবল মাস্ক লাগিয়ে সাথে হ্যান্ড স্যানিটাইজার নিয়ে বেড়িয়ে পরলাম। রাস্তা একদম ফাঁকা, দু-একজন করে কিছু কিছু লোক যেসব দোকান খোলা রয়েছে সেই দোকানগুলোর সামনে ফাঁকা ফাঁকা করে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে। বাজারে গিয়ে প্রথমেই মাংস নিলাম। দোকানদার প্রথমে বলছিল যে কাটবে না, বিক্রি নাকি নেই বললেই চলে! তাও তো আমি কিছুটা জোড় করাতে এবং আরও দুজন লোক বলাতে শেষে রাজি হল। তারপর বাজার খরচ করলাম এবং বাবার জন্য দই নিলাম । কারন মাংস হলে বাবার দই ছাড়া চলে না।
হঠাৎ অমিতের সঙ্গে দেখা। দুজনে গল্প করতে করতে একটা চায়ের দোকানে বসলাম। অমিত পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা বের করে আমাকে একটা দিল আর ও একটা ধরালো।
অমিত আর আমি ছোটোবেলার বন্ধু। উচ্চমাধ্যমিকের পর বাবা আমাকে কোলকাতা পাঠিয়ে দেয়। তখন থেকে ওর সাথে খুব একটা কথা হতো না তবে এখানে আসলে আমরা ঠিক দেখা করতাম। তারপর মাঝে অনেকদিন কোনো কথা হয়নি। শেষবার ওর বোনের বিয়েতে এসেছিলাম। আর আজকে দেখা হলো! স্বভাবতই একটু খুশি আমি কিন্তু অমিতের মুখটা কেন জানি বিষাদগ্রস্ত হয়ে আছে। 'কেমন আছিস' জিজ্ঞাসা করতেই ও বললো,
- ভালো নেই রে, এই লকডাউন সব নষ্ট করে দিচ্ছে!
আমি 'কেন' বলতেই আবার বলল,
- তুই তো জানিস যে আমি টিউশনি করে সংসার চালাই। কিন্তু এই লকডাউনে অর্ধেকের বেশি টিউশন বন্ধ, ব্যাচগুলোও পড়াতে পারছি না, আর তাছাড়া যেটুকু জমি আছে, তাতে যেটুকু ফসল হয় সেটুকু তো সারাবছর বাড়িতেই লাগে বরঞ্চ আবার কখনো কখনো চাল কিনতে হয়! বাড়িতে বউ আছে, বাচ্চা আছে, মা আছে, কী করবো কী না করবো, কিভাবে যে সংসারটা চালাবো কিছুই বুঝতে পারছি না!
- আরে অতো দুশ্চিন্তা করিস না।
বলতে না বলতেই অমিত ওর পকেটটা আমাকে দেখিয়ে বলল,
- এই দ্যাখ, পকেটে এই সিগারেটের প্যাকেটটা ছাড়া আর কিছুই নেই! একটা টাকা নেই পকেটে আর তুই বলছিস চিন্তা না করতে!
এমন সময় হঠাৎ পেছন থেকে কিছু লোকের কথাবার্তা শুনতে পেলাম। কিসের জন্যে জানি আপসোস করছে তারা। তবে কোন বিষয়ে ওরা কথা বলছে সেটা স্পষ্ট বোঝা না গেলেও অমিত বলল ওরা নাকি লাল্টু দা-র ব্যাপারে আলোচনা করছে।
আমি অমিতকে জিজ্ঞাসা করলাম,
- কেন, লাল্টু দা-র আবার কি হয়েছে?
অমিত বলল,
- বেশ কয়েক দিন আগে লাল্টু দা-কে জ্বরের কারনে নার্সিং হোমে ভর্তি করা হয়েছিল, পরে জানা যায় ওর নাকি করোনা হয়েছে। তার ঠিক দুইদিন পরে লাল্টু দা মারা যায় । সংসারে লাল্টু দা আর লাল্টু দা-র বউ ছাড়া কেউ নেই...
ওকে থামিয়ে আমি জিজ্ঞাসা করলাম,
- কেন, লাল্টু দা-র না একটা ছেলে ছিল?
- হ্যাঁ ছিল। এখন আর নেই।
- কেন মারা গেছে নাকি?
- না না, মারা যায়নি, দুবছর হলো একটা মেয়েকে পালিয়ে বিয়ে করে বাড়িতে নিয়ে এসেছিল, কিন্তু লাল্টু দা না মানায়, তখন থেকে ছেলেটা শ্বশুরবাড়িতেই থাকে। বাপ-মায়ের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই । এদিকে নার্সিং হোমের বিলের জন্য যে টাকাটা ধার করেছিল লাল্টু দা-র বউ সেই টাকার জন্যে পাওনাদার রোজ দু-তিনবার করে ফোন করত, মাঝে মাঝে বাড়িতেও আসতো টাকার জন্য।
লাল্টু দা-র এইরকম হওয়ার পর লাল্টু দা-র বৌ তার একমাত্র ছেলের কাছে গিয়েছিলো কিন্তু ছেলে টাকা দিতে অস্বীকার করায় কোথায় পাবে এতোগুলো টাকা, কিভাবে কী করবে না করবে এইসব ভেবে সে কাল রাতে আত্মহত্যা করেছে। পুলিশ এসেছে, প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলছে, লাল্টু দা-র ছেলেকে নিয়ে আসা হয়েছে, এবার দেখা যাক কী হয়!
আমি শোনা মাত্র নিস্তেজ হয়ে গেলাম। আমার সমস্ত ধারনাটাই একেবারে বদলে গেল মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে। আকাশ থেকে এবার পা-টা এসে ঠেকলো আমার মাটিতে! কেবলমাত্র কয়েক ঘন্টাতেই আমি জীবনের রূঢ় বাস্তবতাকে উপলব্ধি করতে পারছিলাম। জীবনের প্রতিটা মুহূর্তই যে শুধুমাত্র মৃত্যুকে উপেক্ষা করে ক্ষনিকের সুখ নিয়ে বেঁচে থাকা ছাড়া আর কিছুই নয় সেটা চোখের সামনে ভাসতে লাগল। এমন সময় মৃত্যু এসে হঠাৎ ডাক দিলে আপসোস করা ছাড়া আর কিছুই থাকে না।
এই লাল্টু দা-র আমাদের বাড়ির সঙ্গে একটা পুরোনো সম্পর্ক ছিল। ছোটবেলা থেকেই লাল্টু দা-কে বাড়ির যে কোনো কাজ হোক সবেতেই দেখেছি। আসলে লাল্টু দা বাবার খুব বিশ্বস্ত ছিল। বাবা প্রতিবছর পুজোতে লাল্টু দা-র পরিবারকে নতুন কাপড় দিতো। অনেক ভালো ছিল লোকটা।
বিগত কয়েক বছর থেকে মানে আমি চাকরি পাওয়ার পর তো বাবা-মা কে নিয়ে কোলকাতা চলে যাই, তখন থেকে আর লাল্টু দা-র সাথে তেমন কথা হয়নি। এই করোনাও এসেছে আর আমরাও দেশের বাড়িতে ফিরেছি। কিন্তু লকডাউনের কারনে বাড়ি থেকে বেরোনোর উপায় নেই তাই এখানে আসার পর এখনো সবার খবর করা হয়নি। কিন্তু আজ লাল্টু দা-র খবরটা শুনে খুবই খারাপ লাগছে।
এতোদিন শুধু নিজেরটাই দেখে আর বুঝে গেছি কিন্তু আজ অমিতের সাথে দেখা হওয়ার পর বাস্তবটাকে দেখতে পাচ্ছি। এতোদিন মনে হতো আমিই খুব কষ্ট করে টাকা উপার্জন করছি, একা হাতেই সমস্তটা সামলাচ্ছি। এই কারনে এখনো বিয়ে করিনি, ভেবেছিলাম প্রমোশনটা পেলেই বাড়িতে আমার আর ঋতমার সম্পর্কের ব্যাপারটা বলবো। এই ছিল আমার ফিউচার প্ল্যান। কিন্তু এখন যখন লাল্টু দা-র জীবনটাকে অথবা অমিতের জীবনটাকে আমার জীবনের সঙ্গে তুলনা করছি তখন নিজেকে অনেকগুণে বেশি সুখী মনে হচ্ছে। কিন্তু যেখানে আমার বন্ধুর পকেটে খরচ করার মতো একটা টাকাও নেই সেখানে আমি এই মাংসের প্যাকেটটা নিয়ে কেমন জানি হীনমন্যতায় ভুগছিলাম। অমিতের সাথে আজ চোখে চোখ মেলাতে পারছিলাম না। নিজেকে শুধুই স্বার্থপর মনে হচ্ছিল।
এরকম যে আরও কতো মানুষ আছে যারা অমিতের মতো অসহায়ভাবে দিন কাটাচ্ছে, আবার লাল্টু দা-র বউ এর মতো কতো মানুষকেই যে অসহায়ভাবে মৃত্যুকেই বেছে নিতে হচ্ছে, আবার ওই পাগলটার মতো কতো মানুষই যে এই লকডাউনে না খেতে পেয়ে মারা যাচ্ছে কে জানে!
এরপর আর বেশি দেড়ি না করে আমি উঠে পরলাম। চায়ের দোকানটা থেকে বেড়িয়ে যখন বাড়ি ফিরছি তখন হঠাৎ মোবাইলে একটা ম্যাসেজ ঢুকলো। মোবাইলটা খুলে দেখি আমার প্রমোশনটা কনফার্ম হয়ে গেছে। আমার বেতন এখন আগের চেয়ে আরও অনেকটা বেড়ে গেল। কিন্তু তাও কেন জানি না মনে কোনো আনন্দ নেই। নিজেকে সত্যিই কেন জানি স্বার্থপর মনে হচ্ছে! কাল যেই 'লকডাউন'-টাকে আমার ভালো লেগেছিল আজ আর সেটাকে আমার ভালো লাগছে না।
মুক্ত গদ্য
সময়ের হিসেব
অনিন্দিতা মন্ডল
একটা শ্রাবণ এসে ধুয়ে দিয়ে যায় খরার বুকের গভীর ফাটল।নির্বাক বৃক্ষের বুক জুড়ে সন্তানহারা মায়ের কান্নার আওয়াজ সব পাতা ঝরিয়ে দিচ্ছে।একটা হলুদ অটো এলো ,নিমেষে নামিয়ে দিয়ে গেলো কয়েক জোড়া মাথা।অবশ্য তোমার অতো সময় কোথায় ,জীবন মাপার ? জানালার জং ধরা গ্রিলের গায়ে জমছে বৃষ্টির মনখারাপ।পায়েসমাখা জন্মদিনের দিনগুলো শেষ হয়ে যায় মৃত্যুর কাছে পৌঁছাতে।যত্নে বসানো পিটুনিয়ার গায়ে রোদের ভিড় শিশিরকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে অনায়াসে।প্রাণবন্ত ব্যাথাগুলো হঠাৎ করেই কিরকম ফ্যাকাসে জলপাই রঙের হয়ে যায়।মাঝে মাঝে মনে হয় ,সময় কি অদ্ভুত এ বাড়িতে যে সময় শেষ হয়ে যায় ,অন্য বাড়িতেও কি সেই সময় একইভাবে শেষ হয়!শহরের সব ধুলোবালি গোগ্রাসে কেন গিলে নিতে পারেনা সময় ,কেন বদরাগী মানুষগুলোর রাগগুলো হুট করেই মুছে দেওয়া যায়না?সবকিছু গলা টিপে শেষ করে দিতে পারলে বেশ হতো ।কিন্তু সময় ! সময়কে কিভাবে গলা টিপে শেষ করা যায়?সময় যেন নীলকণ্ঠ ; নীল দাগটার এপারে কিছু অনিয়মী কুয়াশাকে সংশোধন করে ওপারে গিলে নেয় ,তারপর সব খিদে শেষ!- 'না'। এপারে বিছিয়ে রয়েছে আগলে ধরার মতো অনেককিছু ; মায়ের বিয়ের বেনারসি ,বাবার পুরোনো ফ্রেমের চশমা ,ঠাম্মার হাতের স্পর্শমাখা লাঠি ,কাকুর হঠাৎ চলে যাওয়া অল্প স্মৃতি ,শানবাঁধানো ঘাট ,নাম না জানা চারাদের পাতার আওয়াজ ,আরো কত কী!শুধু সময়কে আগলে রাখার চেষ্টা করিনি ,হৃৎপিণ্ডের কাছে কিংবা তোমার কাছে।
এমনটা ভাবিনি কোনোদিন ,যে বাড়ির মাথায় সময় এসে হানা দেবে যেভাবে সহজ সমাধানের পাশে সূত্ররা এসে হানা দেয়।আসলে ইচ্ছা করে কেউই থাকেনা ; সে জীবন হোক বা মৃত্যু। তবু বেঁচে থাকতে কিছুটা সময় লাগে ,বেঁচে থাকাটাকে গুছিয়ে নিতে কিছুটা সময় লাগে।সময়ের হিসেব ফুরিয়ে যাওয়া দিয়ে মাপলে তা শুধু ফুরিয়েই যায় ,যেভাবে একাকিত্বের কাছে শূন্যতা ছাড়া কিছুই থাকেনা।মানুষটার অতো সময় ছিলোনা তাই সে খুব সহজেই সাদা চাদরে মুখ ঢেকে নিতে পেরেছে ,পেরেছে গোটা একটা আকাশসমান ঋণ ফেলে যেতে।অপমানের জবাবে সময় বিশল্যকরনী হয়ে যায় নীরবে।ভয়ও হয় এই সময় নীল দাগ পেরিয়ে গেলে আর তাকে ছোঁয়া যাবেনা। মা বলে -"এ সময় ,এ সুখের দিন আর আসবেনা"। সত্যি তাই ,তবে সব সময় কি সুখের হয় নাকি আমরা চাই সব সময় ফিরে আসুক? তবু সময় যেন অজানা কোনো অসুখ যার ঐশ্বরিক টানে আমরা ছুটে চলি অন্ধের মতো ,না ধরতে পেরেও।সময় ঠিক মায়ের মতো শুয়ে থাকা রোদ যার তাপে চাইলে শুধু শীত না গ্রীষ্মেও তৃপ্ত হওয়া যায় শুধু যথাযথ আগলে নিতে পারলে।অতো সময় তোমার কোথায় ,যে একদন্ড আমার দিকে ঘুরবে ,জিজ্ঞাসা করবে - হৃৎপিণ্ডের খবর!আমি তবু অগোচরে থামিয়ে দিই ঘড়ির কাঁটা ,ভেবে নিই নীল দাগটা একটু থামবে তারপর গিলে নেবে । কিন্তু দেখি , না ওর খিদে ক্ষুধার্ত শিশুর থেকেও সাংঘাতিক।
ভ্রমণ
স্মৃতিপটে আঁকা এক সে ভ্রমণ
বুলবুল দে হৈ হৈ করতে করতে যখন আমরা মামাতো, মাসতুতো ভাইবোনেরা আর আমাদের দুই মাসি বাস থেকে নামলাম তখন সেই মেঘলা দুপুরে (১২ টা হবে) চারপাশটা কেমন যেন ঘোলাটে হয়ে এসেছে। সেই আলোআঁধারিতেেও সেখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে আমি একেবারে বিমহিত! জায়গাটা আর কোথাও নয়,আমাদের ঘরের পাশের সেবক। আমরা ভাইবোনেরা তখন সব কিশোর কিশোরী। মাসিরাও কম বয়সী,বিয়ে হয়নি। সেবার গ্রীষ্মের ছুটিতে আমরা সবাই শিলিগুড়িতে বড়মাসির বাড়িতে মিলিত হয়েছিলাম। প্রতিবারের মত সেবারও বাড়ি ফেরার দিন জুতো লুকিয়ে রেখে আমাদের বাড়ি ফিরে যাওয়াকে বিলম্বিত করেদিল বড়মাসির দুই ছেলে। মাসির বড় ছেলে(সে আজ আমাদের মধ্যে আর নেই) প্রস্তাব দিলো, "চল কালকে সবাই মিলে সেবক ঘুরে আসি।" আমরা তো মহা আনন্দে লাফিয়ে উঠলাম। তখনও জয়ন্তী, জলঢাকা,ফুন্টসিলিং এই সব জায়গায় পিকনিক ছাড়া তেমন কোনও পাহাড়ি জায়গায় যাওয়া হয়নি। সেবক তখন বেশ নির্জন আর দারুণ রোমাঞ্চকর। এত কাছ থেকে পাহাড় আর তার গায়ের আঁকাবাঁকা পথ দেখে আমি একেবারে আত্মহারা! তার আগে পর্যন্ত জিগজাগ রোড তো শুধু ক্যালেন্ডারেই দেখেছি,আর পিকনিক করতে গিয়ে সবার সাথে গাড়ি করে পিকনিক স্পটে নেমেছি সেখানেই সামান্য কিছু ঘুরে খেয়ে দেয়ে বাড়ি ফিরেছি। যাই হোক, সেবকে ব্রিটিশ আমলের করোনেশন ব্রিজের ঐতিহাসিক স্যাঁতা গন্ধে আমি অভিভূত! আমার মনের কল্পনার বইয়ের পাতা ততক্ষণে ফুরফুরে বাতাসে ফরফর করে ওল্টাতে শুরু করে দিয়েছে, তাতে কত ঘটনার ঘনঘটা,কত রঙবেরঙের ছবি দেখতে শুরু করে দিয়েছি! এখন এই বয়সে সে বইয়ের পাতা আর সহজে ওল্টাতে চায়না। তাই বড় আফসোস হয়, ইস্ সেই বয়সে যদি একটু খাতা কলম নিয়ে বসতাম! যাগগে সে সব কথা, সেদিনের সেবকে আবার ফিরে যাই। প্রথমেই দারুণ আনন্দে লাফাতে লাফাতে খাঁড়া পাহাড়ি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে মহাকাল মন্দির দেখলাম। মন্দিরের পিছনের জঙ্গলটাও দারুণ টানছিল।সবার নিষেধ সত্বেও সেই জঙ্গলে কিছুটা এগিয়ে যখন দেখলাম কেও আমার সাথ দিচ্ছেনা তখন বাধ্য হয়ে অতৃপ্তি নিয়ে ফিরে এলাম। এরপর নিচে নেমে একটা চায়ের দোকান থেকে চা বিস্কুট কিনে সবাই মিলে গল্প করতে করতে খাচ্ছি আর জুলজুল চোখে পাহাড়ের গায়ের আঁকাবাঁকা রাস্তাটার দিকে তাকাচ্ছি। ভীষণ ইচ্ছে করছে ঐ রাস্তা ধরে হেঁটে যাই। কিন্ত তখন সেই রাস্তা এতটাই নির্জন ছিল যে একটা লোক তো দুরের কথা একটা মালবাহী ট্রাকেরই দেখা মিলত কচিৎ কদাচিৎ। তার ওপর চারপাশটা কেমন অন্ধকার অন্ধকার হয়ে রয়েছে।তাই আমি আমার ইচ্ছেটা প্রকাশ করতে সাহস পাচ্ছিলাম না। হঠাৎই আমার এক দিদি বলল,"জানিস,এই রাস্তা দিয়ে সোজা কালিঝোরা যাওয়া যায়, ওখানেই তো একটা ডাকবাংলোয় অনুসন্ধান সিনেমার শুটিং হয়েছিল।" শুনে তো আমি আনন্দে বিস্ময়ে একেবারে ফেঁটে যাবার জোগার। বায়না শুরু করে দিলাম, "চলনা চলনা,সবাই মিলে হাঁটতে হাঁটতে যাই চলনা।" কিন্তু দলের বড়রা একটু কিন্তু কিন্তু করছিল কারণ একে নির্জন রাস্তায় আমরা সবাই ছোট ছোট, তার ওপর আকাশ কালো মেঘে ঢাকা,যে কোনো মুহূর্তে বৃষ্টি নামতে পারে। কিছুটা তর্ক বিতর্কের পর শেষমেশ আমরা সবাই মিলে সেই পথে রওনা হলাম। সে এক ভারি সুখের যাত্রা। সবাই আমরা ছোটোর দল, বড়দের শাসনের বেড়ি নেই, মুক্ত বিহঙ্গের মত এই উড়ছি তো সেই উড়ছি। সেই সাধারণ জার্নিকেও অসাধারণ এডভেঞ্চারাস লাগছিল। বুকের ভেতর রোমাঞ্চের উথাল পাথাল ঢেউ। রাস্তা ঘেঁষে খাড়া উঠে যাওয়া পাহাড়ের গায়ে হঠাৎ হঠাৎ অচেনা অজানা রঙিন ফুল আর বেশ বড় বড় অদ্ভুত সুন্দর প্রজাপতি দেখে আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠছি। কখনও রাস্তার অপরদিকে ছুটে গিয়ে দেখছি হাড় হিম করা গভীর খাদ,আবার নীচে বয়ে চলা উচ্ছল ক্ষরস্রোতা নদী দেখে মনটা চঞ্চল হয়ে উঠছে। দূরের গাঢ় সবুজ পাহাড়টা দেখে গা ছম ছম করছে অজানা ভয়ে। ঐ বয়সে অনুভূতিগুলো তীক্ষ্ণ ছিল, এখন ভোঁতা হয়ে গেছে। ঠিক সেই মুহূর্তেই মামাতো বোন হঠাৎ ভয়ে চিৎকার করে উঠল, "ওরে বাবারে! ওটা কি?" আমরা সবাই তো ভয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছি। তারপর ওর হাতের ইশারা লক্ষ্য করে তাকিয়ে, আমাদের থেকে অল্প দুরত্বে পাহাড়ের গায়ে যে প্রাণীটিকে দেখতে পেলাম তাকে তো আমরা কিছুতেই সনাক্ত করতে পারছিনা। একজন বলল ওটা বোধহয় কুমিরের বাচ্চা। আমরাও সমস্বরে বলে উঠলাম হ্যাঁ হ্যাঁ তাই হবে। পরক্ষণেই নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে হো হো করে হেসে ফেলে বললাম ধুর পাহাড়ের গায়ে আবার কুমিরের বাচ্চা কোত্থেকে আসবে। দলের সবচেয়ে ছোট সদস্য আমার ভাই বলে উঠল---পাহাড়ের ওপরে বোধহয় পুকুর আছে! আর সেই মুহূর্তেই আমরা লক্ষ্য করলাম প্রানীটার মাথার রঙটা লাল হয়ে গেল আর তার ঘাড়ে কতগুলো কাঁটা খাড়া হয়ে উঠল। আমরা বুঝতে পারলাম ওটা একটা গিরগিটি। বাপরে! অতো বড় গিরগিটি আগে কখনও দেখিনি,ঠিক কুমিরের বাচ্চার সমান। আবার আমরা কল কল করতে করতে হাঁটা শুরু করলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই আর এক চমৎকারের মুখোমুখি হলাম। দেখলাম এক টুকরো ধূসর রঙের মেঘ আমাদের মাথার সমান উচ্চতায় রাস্তার ওপর দিয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে, তখন ব্যাপারটা আমার কাছে একেবারেই অভাবনীয়। আমি তো অবাক বিস্ময়ে হাঁ করে দেখছি আর ভাবছি সেই সুদূর আকাশের অধরা মেঘ আমার এত কাছে! স্থানুর মত দাঁড়িয়ে দেখতে দেখতে কখন যে মেঘটা আমাকে পেরিয়ে গেল! সম্বিত ফিরতেই দৌড়ে পিছনে গিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে মেঘ টাকে ধরতেই ঝরঝর করে কিছুটা বৃষ্টি ঝরে আমাকে খানিকটা ভিজিয়ে দিল। আমি আনন্দে আত্মহারা! আবার শুরু হল আমাদের হাঁটা। ঠান্ডা হাওয়া আর প্রাকৃতিক শোভায় সাঁতরে সাঁতরে তরতর করে এগোচ্ছি, হঠাৎ দেখি সামনে কিছুটা দূরে রাস্তার খাদের দিকের রেলিং এ একটা মা বাঁদর তার বাচ্চার উকুন বাছতে বসেছে।ব্যাস্, ভয়ে আমরা আর এগোতে পারছিনা। সবাই বলা বলি করতে শুরু করল যে আর এগিয়ে কাজ নেই ফিরে যাওয়াই ভাল, বাঁদর গুলো যদি তাড়া করে তালে আর রক্ষে থাকবেনা। কিন্তু আমি তা কিছুতেই মানতে পারছিলাম না। এতটা রাস্তা আসার পরও কালিঝোরার বাংলোটা না দেখে ফিরে যাব তা কি করে হয়? শেষে আবার এগিয়ে যাওয়াই সাব্যস্ত হল। দুই মাসতুতো দাদা পাহাড়ের গায়ের একটা গাছ থেকে ডাল ভেঙে হাতে নিল তারপর আমরা সবাই অতি সন্তর্পনে জায়গাটা পার হয়েই দৌড় লাগালাম। বাঁদর গুলো আমাদের দিকে ফিরেও তাকালোনা। এই ভাবে মজা,আনন্দ আর উত্তেজনা পূর্ণ পথচলা শান্ত হল তখন, যখন আমরা কালিঝোরার সেই বাংলোটার কাছাকাছি এলাম। এতটা রাস্তা ছিল নির্জন শুধুমাত্র দুটো মালবাহী ট্রাক আমাদের অতিক্রম করেছিল। যাই হোক, সেই বাংলো দেখে আমরা ভীষণ উত্তেজিত! এই সেই বাংলো যেখানে আপামর ভারতীয়ের হার্ট -থ্রব অমিতাভ বচ্চন শুটিং করে গেছেন! উত্তেজনা যখন প্রশমিত হল তখন খেয়াল করলাম সময়টা প্রায় শেষ বিকেলে এসে পৌঁছেছে।এতক্ষণে আমাদের টনক নড়ল, এবার ফিরব কি করে? হেঁটে ফেরা তো সম্ভব নয় তাহলে মাঝ রাস্তাতেই অন্ধকার ঘনিয়ে আসবে। এদিক ওদিক তাকাতেই একটু দূরে ছোট্ট একটা ঝুপরি চায়ের দোকান দেখতে পেলাম। তার কাছে এগিয়ে গিয়ে কৌটোর মধ্যে লেড়ো বিস্কুট দেখে আমাদের পেটের ভেতর ছুঁচো গুলো তারস্বরে চেঁচামেচি শুরু করে দিল! সেই কোন সকালে দুটো ভাত খেয়ে এসেছি, উত্তেজনার উত্তাপে ক্ষুধা মহাশয় এতক্ষণ কাছে আসার সাহস পাননি। এবার সুযোগ পেয়ে পেট খামচে ধরলেন। সাথে জলও নিয়ে আসিনি। সেই সময় কালে এগুলো নিয়ে কোন চিন্তাভাবনার বালাই ছিল না। হাতে কোনও ব্যাগেরও বালাই নেই, মাসিদের ছোট্ট মানি ব্যাগে সামান্য কিছু টাকা ছিল তা থেকেই চা বিস্কুট কিনে খেয়ে একটু চাঙ্গা হলাম।দোকানীর কাছে জানলাম এই সময় নাকি একটা বাস শিলিগুড়ির দিকে যায়। আমরা তো দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি কিন্তু বাস আর আসেনা, মনে মনে ভয়ে সিটকে আছি যদি বাস না আসে তাহলে কি যে হবে! অবশেষে আমরা হাঁটা শুরু করলাম এই ভেবে যে আমরা এগোতে থাকি, বাস যদি আসে তাকে দাঁড় করিয়ে উঠে পরব। হাঁটছি আর ভাবছি বাস না পেলে কি দুর্দশা আছে কপালে কে জানে।তখন তো আর মোবাইল ফোন ছিলনা। এমন সময় একটা গাড়ির আওয়াজ পেয়ে বাস ভেবে উচ্ছ্বসিত হয়ে পিছনে তাকাতেই বিমর্ষিত হয়ে পড়লাম। একটা জিপে এক নেপালি দম্পতি আসছে।আমি মনে মনে ভাবছি ইস্ ওরা যদি আমাদের লিফ্ট দেয় তাহলে কি ভালোই না হয়। ভাবতে ভাবতেই গাড়িটা পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল। যাঃ এই আশাটাও জলে গেল। নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হতে লাগল। আমার জোরাজুরির জন্যই তো এখানে এসে সবাইকে বিপদে পরতে হল। ভাবতে ভাবতেই দেখি কিছু দূরে গিয়ে গাড়িটা দাঁড়িয়ে পড়ল। আমরা কাছে যেতেই হিন্দিতে জিজ্ঞেস করল যে কোথায় যাব। শিলিগুড়ি যাব শুনে চলনসই হিন্দিতে বলল, " আ যাও আ যাও ,হামলোগ ভি উহা পর যা রহি হু।" আমরা একটু ইতস্তত করছিলাম, যদি ওরা খারাপ লোক হয়। ওরা আবার বলল, "অভি শিলিগুড়ি যানেকা কয়ি গাড়ি নেহি মিলেগা,তুমলোগ আ যাও ডরনে কা কয়ি বাত নেহি হ্যায়, আ যাও।" আর কোনও উপায় নেই দেখে সবাই ঐ জিপেই উঠে বসলাম ।দেখলাম ওরা নিউ কাপল্ আর দারুণ সুন্দর ও সম্ভ্রান্ত চেহারার। ওরা আমাদের সাথে বেশ গল্প জুড়ে দিল এবং শেষে যখন শিলিগুড়ির পানি ট্যাঙ্কির কাছে আমাদের নামিয়ে দিল তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে অন্ধকার হয়ে গেছে। এখনও মনে পড়লে ভাবি ভগবানই বুঝি দেবদূত করে ওদের পাঠিয়েছিল। বাড়ি ফিরে খুব বকুনি খেয়েছিলাম।
পরদিন সকালে আধো আধো ঘুমে শুনতে পেলাম সবাই যেন কোঁকাচ্ছে, "উঃ, উরিবাবা, কি ব্যাথা!" ঘুম ভেঙে গিয়ে শুনলাম ভাই ও কান্না জুড়ে দিয়েছে, "ওমা আমার পায়ে কি হল, পা নড়াতে পারছিনা। ধরমর করে উঠে বসে নিজের পা টা নাড়িয়ে দেখে বললাম, " কই আমার পায়ে তো ব্যাথা নেই। " তারপর যেই মাটিতে নেমেছি আর পা নড়াতে পারছিনা! আগের দিন অতটা হাঁটার ফলস্বরূপ পরদিন পুরো অর্ধেক দিন সবাই খোঁড়া হয়ে বসেছিলাম। উঃ সে একটা দিন ছিল বটে!!
ক্রোড়পত্র: নববর্ষ
উদযাপনের নববর্ষ
মৌমিতা বর্মন
বাঙালির উৎসবে মেতে ওঠার আরেকটি অন্যতম দিন হলো নববর্ষ। নব বর্ষ মানেই নতুন বছরের সূচনা। নতুন বর্ষপঞ্জী। ইতিহাস বলে, নববর্ষ উদযাপন সম্রাট আকবরের হাত ধরে বাংলার সিংহ দুয়ারে প্রবেশ করে। সম্রাট আকবর মূলত রাষ্ট্রীয় কাজে রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে আরম্ভ করেছিলেন বাংলা সন বা বঙ্গাব্দ। তার আগে বাংলায় প্রচলিত ছিল হিজরি সন। এই হিজরি সন হলো ইসলামী চন্দ্রপঞ্জিকায় ব্যবহৃত পঞ্জিকা সাল। যা শুরু হয়েছিল ৬২২ খ্রিস্টাব্দে। ঐতিহাসিক দের মতে হজরত মোহাম্মদ মক্কা থেকে মদিনা যাত্রা করেছিলেন এই সময়। কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশে প্রচলিত এই হিজরি সনের সাথে বাংলার কৃষি প্রধান অঞ্চলের মানুষরা ফসলি মৌসমের সমন্বয় ঘটাতে ব্যর্থ হতো। তারা ফসল বাজার জাত করার আগেই হিজরি সন অনুসারে খাজনা দেবার সময় চলে আসতো। সম্রাট আকবর সমস্যা উপলব্ধি করেন ও সমাধানের পথ হিসেবে বেছে নেন নতুন বর্ষপঞ্জী তৈরীর ভাবনা। যে সন হবে চন্দ্র নয় সৌরের উপর ভিত্তি করে। এই গুরুভার দেওয়া হলো জোতির্বিজ্ঞানী আমির ফতে উল্লা সিরাজি কে। যিনি পরবর্তীতে অর্থাৎ ১৫৮৪ সালে সৃষ্টি করলেন নতুন বাংলা সন বা বঙ্গাব্দ। আর এই বাংলা সন এর হাত ধরেই এলো নববর্ষ কে উদযাপন করার দিন। বছর শেষে খাজনা মেটানোর পর পহেলা বৈশাখে কৃষকদের মধ্যে মিষ্টি বিতরণ করতেন ভুস্বামীরা। সঙ্গে থাকতো আনন্দ, উৎসব, বিভিন্ন মেলা। সারাবছরের গ্লানি, কষ্ট যেন দূর হয়ে যেত নতুন বছরের আগমনে। অর্থাৎ পুরাতন ভুলে নতুন কে বরণ। সেই থেকে পহেলা বা পয়লা বৈশাখ হয়ে উঠেছে বাঙালিদের প্রাণের উৎসব। যা আজও বাঙালিরা এক ঐতিহ্য বাহী,জাতীয় দিন হিসেবে পালন করে আসছে। নববর্ষের সাথে আরেকটি যে গুরুত্ব পূর্ণ জিনিস জড়িয়ে আছে তা হলো হালখাতা। সাধারণত ব্যবসায়ীরা নববর্ষে লক্ষী ও গনেশ পূজোর মধ্য দিয়ে নববর্ষে নতুন খাতা খোলেন। নিঃসন্দেহে সে খাতা হিসেব রাখার খাতা। সারা বছর ক্রেতা দের সাথে লেন দেন বজায় রাখতেই এই খাতার প্রয়োজন। প্রসঙ্গ ক্রমে বলাই যায় হাল শব্দের অর্থ যেহেতু লাঙ্গল তাই বোঝাই যাচ্ছে কৃষক দের সাথে ব্যবসায়ী দের ধার বাকির হিসেব ফুটে উঠছে এই হালখাতা শব্দের মধ্য দিয়ে।
সব বাঙালির মতো আমার নববর্ষ অর্থাৎ ছোটবেলার নববর্ষ ছিল উৎসব মুখর। চৈত্র মাস এলেই বাড়িতে জ্যান্ত শিব পার্বতী এসে হাজির হতো। ঢাকের আওয়াজ হলেই দে ছুট নিজের বাড়ির চার পাঁচটা আগের বাড়ির থেকেই শিব পার্বতী র পেছন পেছন ঢুকতাম নিজের বাড়িতে। চরক মেলার জন্য তারা টাকা, পয়সা, চাল, ডাল সংগ্রহ করতো। চৈত্র সংক্রান্তি তে এই পূজো হতো। আর পহেলা বৈশাখ থেকে দু তিন দিন চরক পূজো উদযাপন ও মেলা চলতো। সেই মেলা দেখতে যেতাম নববর্ষে বাবা মা এর সাথে।
যে হালখাতার উল্যেখ করেছিলাম আগে আমাদের শৈশবের সঙ্গেও মিলে মিশে ছিল হালখাতা। রাজবংশী পরিবারে জন্মানোর সুবাদে সুবচনি পূজোর বাতাসা আর পান দিয়ে শুরু হতো নববর্ষের সকাল। পাশে মাসির বাড়িতে সেই প্রসাদের জন্য সকাল সকাল স্নান সেরে নতুন জামা পড়ে প্রণাম ঠুকতে যেতাম। সারাদিন ভালো , মন্দ খাওয়া দাওয়ার পাশাপাশি থাকতো হালখাতা করতে যাবার অপেক্ষা। মুদির দোকান, সোনার দোকান আর জামাকাপড়ের দোকানের নেমন্তন্য সেরে ঘরে ফেরার পালা। মিষ্টির প্যাকেট আর বাংলা ক্যালেন্ডার বগল দাবা করে হাসি ছড়াতে ছড়াতে বাড়ি ফেরাই ছিল সেই ছেলেবেলার নববর্ষ উদযাপন। পরবর্তীতে নববর্ষ পালনের ব্যকরণ অনেকটাই বদলে গেলেও উদযাপনের হাসি আজও অমলিন। শুভ নন্দন বলতে পারবো না শুভ নববর্ষ ই তোলা থাক সকলের জন্য আর নতুন প্রজন্মের জন্য থাক নববর্ষের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।
নবরূপে পুরাতন বর্ষ
দেবর্ষি সরকার
সারাটা দিন মার পেছনে সদ্য গজিয়ে ওঠা লেজের মত বাড়ির উত্তর কোণ থেকে দক্ষিণ কোন ঘুরে ঘুরে মাকড়সার জাল আর ধুলোর আস্তরণ উড়িয়ে স্নানসেরে সেই সাতসকালে উঠে রান্না করে রাখা ঠান্ডা ভাত ডাল দিয়ে মেখে মুখেপুরে চৈত্রের শেষ বিকেলে কড়া অথচ মিষ্টি রোদের মধ্যে নিজের গা একটু শেকে নিয়ে যেই বিছানার মধ্যে এলিয়ে পড়তে যাব অমনি মার শাসন বাক্যে আত্মস্থ হয়ে ইটের বোঝার ন্যায় বইয়ের ব্যাগটি কাঁধে ঝুলিয়ে অনিচ্ছাসত্ত্বেও বেরিয়ে পড়তে হোতো বর্তমান প্রজন্মে পাশ করার একমাত্র পন্থা ব্যাচে পড়বার উদ্দেশ্য। এই ছিল আমাদের নববর্ষের প্রাক কাজকর্ম। আদৌতে ঘরের কোনো অংশে নুতানের ছোঁয়া লাগতো কিনা তা সত্যি করে বলে উঠতে পারি না তবুও ওই যে আমরা সাধারণ মানুষ চিরটাকাল প্রচলিত কিছু বিশ্বাস অথবা অবিশ্বাসকে সঙ্গী করেই দিকবিদিগ জ্ঞান শূন্য হয়ে ছুটে চলেছি নিজ নিজ লক্ষের দিকে তাই হয়তো মায়ের করা শাসনের সামনে আমার বুকের পাটার শক্তিও গলে গিয়ে গরমের দিনে বাড়ির সামনে দিয়ে আইসক্রিম নিয়ে যাওয়া কাকুটার দিনশেষে অবশিষ্ট বরফ গলা জলের মতন হয়ে যেত একেবারে ঠান্ডা, শীতল কেবল বাষ্প হওয়ার অপেক্ষা। তাই প্রত্যেকবার নববর্ষ আসবার ঠিক আগে আমার বাবা স্কুলে যাওয়ার আগে যত করেই মাকে বারণ করে যাক না কেন তবুও আমাকে সঙ্গে নিয়ে তার ঘর পরিষ্কারের কাজ প্রত্যেকবারই ঠিকঠাক ভাবে চলে এসেছে।
ছোটবেলায় আমি দেখেছি এই সময় বিশেষ করে দুর্গাপুজোর আগে ও নববর্ষের আগে আমার বাড়ির যে সমস্ত জিনিসপত্র বহুদিন যাবত অবশিষ্ট হয়ে পড়ে আছে কেবল তাদের সদগতির আশায় তারাও চলে যেতো খুব অল্প সময়ের মধ্যে কোনো এক অচেনা জগতে। ঠিক কোথায় যেত তা আজ পর্যন্ত বলতে পারব না। আর কাঠের আসবাবপত্রের কথা তো ছেড়েই দিলাম, কোনটি যে ঘরের উত্তরে যাবে আর কোনটি যাবে সুদূর দক্ষিণে তা হয়তো স্বয়ং ভগবানোও বলতে পারবেন না। আর আমি তো পুকুরের পুটি মাছ। এই সব কিছু নির্ভর করতো কেবল আমার বাড়ির রক্তমাংসে গড়া মা দুর্গার ইচ্ছের উপর। "সকলি তোমারি ইচ্ছা ইচ্ছাময়ী--------------- "এরপরটা আপনারা নিজেই খুঁজে নিন।
এইভাবে কিছুদিন কেটে যাওয়ার পর একদিন ঠিক বুঝতে পারতাম সামনেই বাঙালির দুর্গাপূজার পর আরেক চিরাকাঙ্খিত বস্তু, আহ্ বস্তুর বিশেষণে বিশেষিত করে তাকে লজ্জা দেবো না। বস্তু বলতে বোঝায় একমাত্র জড় পদার্থকে। যার হাত নেই, পা নেই, মুখ নেই, দাঁত নেই কিছু নেই তাকে যদি আমরা জোর করে অবস্তুতে পরিণত করতে চাই তবে তাকে সভ্য সমাজে নিয়ে আসে "ভদ্র" করবার মানুষের বড়ই অভাব। যে আসে সেতো আমার,আপনার মতই মানুষ। হ্যাঁ যেকোনো উৎসবোই নিছক জড়ো পদার্থ তাকে আমরা টেনে নিয়ে এসে বুকে ধরে আগলে, মমতাদিয়ে ছোট উৎসব থেকে বড় উৎসব এ পরিণত করি । না হলে যে দুর্গাপূজো একসময় শুধু বনেদি বাড়ি গুলোর ঠাকুরদালানে সীমাবদ্ধ ছিল তাকে ধরে টেনে এনে পাড়ায় পাড়ায় গড়ে ওঠা ক্লাব গুলিতে নিয়ে আসলো কে? হ্যাঁ , সেই মানুষ এই আমরা আপনার মতন মানুষ। যাই হোক, স্কুলের স্যারদের দেওয়া হোমওয়ার্ক আর টিউশন স্যারের মারের ভয়ে ত্রস্ত হয়েই কোন একদিন "শিব শিব" করে চেঁচিয়ে ওঠা গাজনের সন্ন্যাসী জানান দিয়ে যেত যে 'ওঠ খোকা সময় এসে গেছে, সময়ের বেশি দেরি নেই। নতুন কে গায়ে মেখে উৎসাহের সাথে জীবনের সব কাজগুলিতে লেগে পড়।' তারপর সত্যি বলতে এই মাঝখানের সময়টিতে আমার সাথে যে প্রত্যেক বছর কি ঘটনা ঘটে যেত তা আমি সত্যি বুঝে উঠতে পারতাম না। কয়দিন ঠিকঠাক ভাবে অঙ্গীকার করতাম সব অংক ঠিকঠাক করে প্র্যাকটিস করে যেতাম। আশ্চর্যভাবে প্রত্যেকটির উত্তর মিলে যেত। ইতিহাসের সাল তারিখ ঠোঁটের আগায় নিয়ে বসে থাকতাম। কোন রাজা অথবা কোন সম্রাট কোন দিন কি পদ দিয়ে ভাত মেখে খেয়েছিল তাও বলে দিতে পারতাম। কিন্তু ওই যে বাংলাতে একটি কথা আছে "স্বভাব যায়না মোরে" , তেমনি আবার আগের মতো যেই কে সেই গা এলিয়ে পড়ে রইতাম বিছানায়। শুয়ে শুয়ে দেখতাম আগের সপ্তাহেও মায়ের সাথে যে স্থানটি ঝারু নিয়ে পরিষ্কার করে দিয়েছি সেই জায়গাটিতেও মাকড়সা আশ্চর্যভাবে বাসা বানিয়েছে। সত্যি ওদের যেন চিরটা কাল নববর্ষ লেগেই থাকে। তারপর হঠাৎ একদিন দুপুরে নিমপাতা সহযোগে আমডাল খেতে গিয়ে আর জিজ্ঞেস করবার প্রয়োজন বোধ করতাম না। সহজেই বুঝে যেতাম আজ চৈত্র সংক্রান্তি , কাল নতুনার দিন। আমাদের আবার চৈত্র সংক্রান্তির দিনে আরেক বিশেষ প্রথা ছিল, যাকে "ভাইছাতু" বলা হয়। ভাই এসে বোনের সামনে হাত পাতবে তারপর বোন ভাইয়ের হাতে তিনবার ছাতু দিয়ে মুখের বাতাস সহযোগে সেই ছাতু শূন্যে উড়িয়ে দেবে। কি অদ্ভুত নিয়ম তাই না? ভাবলেই আনন্দবোধ হয়। এসব কিছুই তো আমাদের মত মানুষদেরই সৃষ্টিজাত পদার্থ। আমার বাপ মায়ের আমি একমাত্র সন্তান ছিলাম। বোন বা দিদি ভাই বলতে কেউ ছিল না । তাই এইনিয়ম বংশ নদীর জলে মিশে এসে এখনো মোহনায় মিশেছে আমাদের পরিবারের হাত ধরে। আমাদের বছরের শেষ দিনটি এমন ভাবেই কাটতো।
ছাপোসা বাঙালি গৃহস্থের যা আশা থাকে, একটু সরকারি চাকরিতে অনেকটা আনন্দ আমাদের সংসারও সেই রকমই চাওয়া পাওয়ার মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই ছিল। বাবার ছিল সরকারি স্কুলের চাকরি অর্থাৎ শিক্ষকতা। সেই সূত্রে বদলীর ছিল মহাসুযোগ। কিন্তু ভাগ্যক্রমে কি জানি কেন দৈব অভিপ্রায় আর পাচটা স্কুল শিক্ষকের মত আমার বাবার চাকরির জীবনে বদলির সুযোগ হয়নি। তাই প্রথমে যে স্থানে চাকরি পেয়েছিলেন বাড়ির ভাত খেয়ে অবসরের দিন পর্যন্ত ঠিক সেখানেই মহা আনন্দে চাকরি করে গেছে । বিশেষ করে এই সমস্ত সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য এইসব বাৎসরিক উৎসব উদঘাটন করে দেয় এক অনন্য পৃথিবীর। তারা ঝেরে ফেলে দেয় বাদ বাকি দিনগুলোর ধূসর রঙের ক্লান্তি গুলোকে। তাই বছরের প্রথম দিনের সকাল আমাদের কাছে শুরু হতো স্নানের মধ্য দিয়ে। সেদিন সকালে স্নান সেরে প্রথমে ভগবানকে ও তারপরে বাড়ির সকল বড়দের কে প্রণাম করে তারপর মুখে জল তুলবার চিরাচরিত প্রথা আমি সেই ছোট বয়স থেকেই সমানভাবে পালন করে আসছি। সেদিন যদি কোনো মতে আজ্ঞার প্রতিপালন থেকে বিরত থাকতাম তাহলে মাতৃ জননীর ব্রজশুলোকণ্ঠ আমার হৃদয়ের গোপন অলিন্দ ভেদ করে আমার শরীরের এক বিশেষ অংশটিতে ছুঁয়ে যেত। সব থেকে মন খারাপ হতো যখন দেখতে পেতাম সেই সকালেও পরীক্ষায় পাশ করে যাওয়ার স্বভাবস্বরূপ সেই মূর্তিমান মানুষটি অর্থাৎ আমার গৃহশিক্ষক নতুন বছরের প্রথম দিন মাথায় সব জায়গায় জ্ঞানের গুলি গুঁজে আমার জন্য অপেক্ষা করে বসে আছে। সুযোগ পেলেই সেই গুলি দিয়ে আমার শরীরটাকে এফোর ,ওফোর করে দিবে। সেই বয়সে আমার মনে সেই মানুষটিকে দেখবার পর যে একরাশ ভাব জাগ্রত হত তার বর্ণনা এই প্রবন্ধে দিতে গেলে প্রবন্ধটি নিছক কতগুলো শব্দের সমষ্টি হয়ে পড়ে এবং প্রবন্ধটি বিশাল আকৃতি হয়ে পড়ে। মাতৃ জননীর করা আদেশ মত ওই "উরখোই গোবিন্দায় নমঃ" এমনি করেই এক থেকে দেড় ঘন্টা " নম নম " করে কোন রকমে তার কাছে জ্ঞানের পাঠ নিয়েই এমনি তার চলে যাওয়ার সাথে সাথেই আমাকে পায় কে? আমি তখন গত সপ্তাহে আমার বন্ধুর স্টিলের খাঁচা থেকে যে বন্দি পাখি পালিয়ে গেছে তার মত স্বাধীন। তারপর এক ছুটে কল ঘরে গিয়ে জল দিয়ে কোনরকমে স্নান সরে এসে প্রথমে মা সরস্বতীকে তারপর বাবা ও মাকে প্রণাম করেই গায়ে জড়াতাম বাবার এনে দেওয়া সেই স্যান্ডোগেঞ্জিটি । গায়ের সাথে এটে বাসে থাকা গেঞ্জিটিতেই ছিল আলাদা এক অদৃশ্য শক্তির ভালোবাসা । তার স্পর্শ যেন আমার শরীরের সকল শিরা, ধমনীকে এক আলাদা রসের ধারায় স্নান করিয়ে তুলত। প্রত্যেক বছর নতুন দিনের প্রথম সকালে একটি জিনিস আমাদের বাড়িতে বাধা ধরা ছিল। সেটি হলো গরম গরম ফুলকো লুচি তার সাথে আলুর দম। আমাদের প্রত্যেক নববর্ষের সকাল শুরু হতো এমন বিচিত্র সাঁড়াশি ভঙ্গিতে।
সকালের জলযোগ সেরেই বাবা প্রত্যেক দিনের মত চলে যেত নিজের বসবার ঘরে। ঘরটিতে বসার এমন কোন এলাহী আয়োজন কখনোই ছিল না। ঘরটিতে কেবল থাকার মধ্যে ছিল লাক্ষাধিক মস্ত বড় বড় বই এবং কয়েকটা কাঠের আলমারি, তার বসবার জন্য একটি কাঠের চেয়ার আর টেবিল। সে চেয়ারে বসে আমি এই মুহূর্তে এই লেখাটি লিখে চলেছি। হয়তো অধিকারসূত্রেই পাওয়া। কিন্তু বাবা বেঁচে থাকতে কখনোই এটাতে বসবার সাহস অথবা সুযোগ আমার ঘটেনি। তবে বাবার মৃত্যুর পর এরকম শান্ত নিরিবিলি পরিবেশে বসে একান্তই আমার কথা শুনে কেবল কলমের ঘস ঘস শব্দে লিখে যাওয়ার মজাটা উপভোগ করতেই আমার বাবার এই ঘরটিকে বেছে নেওয়া। যাই হোক সকালে খাওয়ার পর দাদা নিজের কাজগুলো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন আর আমার মাজননী তার সব থেকে ভালোবাসার জায়গা সেই রান্নাঘর থেকে নট নরনচরন। আমার তো কোন ভাই ছিল না, বোন ছিল না, দাদা ছিল না। তাই আমি একাই ছিলাম বাড়িতে। এইসব দিনে আমার বন্ধুগুলোও যে যার মতন "নববর্ষ ভ্যাকেশনে" চলে যেত। তখন সত্যি সত্যি মনে হতো শিক্ষাকর্মী মানুষটি যদি আরো কঠিন কঠিন অংক দিয়ে আমাকে বসিয়ে রাখত তাহলে সময়টার একটি হিল্লে হত, এই যা। কিন্তু সে ব্যাটাও তো কোন সাত সকালে দাদা বৌদির মন রাখবার ভয়ে এক ঘন্টার জন্য এসে কেবল মুখটা দেখিয়ে গিয়ে এখন বর্তমানে শ্বশুর বাড়িতে বসে মুরগিরঠ্যাং চিবোচ্ছে। পরক্ষনে মনে হতো না হয় সময় কাটানোর জন্য স্যারের দেওয়া হোমওয়ার্ক গুলো করে রাখি। কথা মত গুটিগুটি পায়ে এসে খাতা বই টুল ইত্যাদি নিয়ে অংক করতে বসতাম। গুটিগুটি পায়ে বললাম তার প্রধান কারণ হলো পড়াশোনার ক্ষেত্রে আমি চিরটা কাল যাকে বলে মা সরস্বতীর আশীর্বাদ ধন্য মানুষ। কি করেযে আমি পড়াশোনা না করেই প্রত্যেক ক্লাসে অনায়াসে পাশ করে চলছিলাম সেই সম্পর্কে আমার মা-বাবা এবং শিক্ষকটি যদি দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি সমেত বিচার করতে বসেন তাহলে মাসিক আলোচনা চক্রের একখানি সভার আয়োজন করা চলে। হাঁড়ি করাই আর গ্যাসে চরবে না। এইজন্য আমি নিঃসন্দেহে বলতে পারি আমি ফি বছর পড়ি না তাই তারা যদি দেখেন আজ নববর্ষের দিন আমি দুপুরবেলা অংক নিয়ে বসেছি তাহলে তাদের যে হৃদয় ব্যতিব্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হবে আমি স্ব ইচ্ছায় তা চাই না। প্রত্যেক নববর্ষের দিনটিতে দুপুর দুটো অথবা তিনটে পর্যন্ত এভাবে বসে থেকে যেই রান্নাঘর থেকে খাবার ডাক খাসতো অমনি আমি এক দৌড়ে গিয়ে বসে পড়তাম খাওয়ার টেবিলে। প্রথমত অনেকক্ষণ ধরে বৃথা কতগুলো ফালতু অংকতে মুখ লুকিয়ে বসে থাকা ও নববর্ষ এই দিনটিতে প্রত্যেক বাঙালি বাড়ির মেনুতে যে জিনিসটির উজ্জ্বল উপস্থিতি সকলের মনকে কেড়ে নেওয়ার মতন সেই মাংসটির লোভেই আমার এই কাণ্ডজ্ঞানহীন অবস্থা। তারপর বাবা এসে বসতেই মাতারানী ভাতের সাথে পরম কাঙ্খিত বস্তুটি দুটো প্রাণীকে পরিবেশন করে দিতেই যেন হাতের মুঠোতে স্বর্গ পেতাম। দীর্ঘদিন ধরে অভুক্ত অনাহারে খিদের চোটে পাগল থাকা ক্ষুদার্থ সিংহটিও যদি হঠাৎ একদিন মুখের সামনে কোন মরা জন্তু পেয়ে যেমনভাবে জন্তুটির মাংসগুলো আত্মসাৎ করবে আমিও ঠিক তেমনি নববর্ষের দিনটিতে মাংসগুলো আত্মসাৎ করতাম। নিজের আত্মতুষ্টির ছলে একটিবারের জন্যও সে খিটখিতে মহিলাটি মাংস খাচ্ছে কিনা, তার জন্য আদৌতে মাংস আছে তো? সেই ব্যাপারে দৃষ্টিপাত করতাম না। যাই হোক, নববর্ষের দুপুরটায় মাংস দিয়ে খেয়ে তিনটে প্রাণীতেই একেবারে গাদাগাদি হয়ে শুয়ে দেখতাম আর ভাবতাম ছাদথেকে কোন অজানা এক ঐশ্বরিক শক্তি এসে গরমের সুধা ভান্ডো উপুড় করে ঢেলে দিচ্ছে আমার শরীরে সেটা এখন এই বয়সে এসে বুঝে উঠতে পারিনা। তারপর মায়ের সন্ধ্যার শঙ্খের আওয়াজে ধরমরিয়ে ঘুম থেকে উঠে বসতেই চোখের সামনে দেখতে পেতাম এক সুদর্শন পুরুষ নতুন পাজামা পাঞ্জাবিতে নিজেকে মুড়িয়ে নিয়ে আমার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ।তার শরীর থেকে নতুন এর গন্ধ মাখোমাখো একটা পরিবেশ সৃষ্টি করে চলেছে। আমার বুঝতে দেরি হতো না যে আমার ঘুমিয়ে থাকার সুযোগ নিয়েই আমার বাবা মানুষটি দোকনে দোকানে হালখাতা ও মিষ্টির প্যাকেট জোগাড় করতে চলেছে। কিন্তু কোন এক সৎকর্মের ফলে ভগবানের নিমিত্তে মঙ্গল শঙ্খের আওয়াজ অজান্তেই আমাকে জাগিয়ে দিয়ে গেছে। আমি তৎক্ষণাৎ বিছানা ছেড়ে দাঁড়িয়ে নতুন গন্ধ মাখা জামাটা গলা দিয়ে গলিয়ে বাবার হাত ধরে বেরিয়ে পড়তাম দোকানে দোকানে। এখন বড় হয়ে যখন সবকিছু বুঝে উঠতে শিখেছি তখন সেই পরিস্থিতিকে বিচার করে আজ রবীন্দ্রনাথের " রক্তকরবী" নাটকের একটি গান মাথায় আসছে,
"ওগো পুরোবাসি, আমি দ্বারে দারায়ে আছি উপবাসী।"
যদি রবীন্দ্রনাথ আমাকে অভিশাপ না দেন তাহলে আমি এই লাইনটির অতিরঞ্জিত লাইনটি ব্যক্ত করছি,
"ওগো দোকানবাসী, আমি দ্বারে দারায়ে আছি উপবাসী।"
দুপুরে ভরপেট মাংস দিয়ে খেয়ে বাবার সাথে সন্ধেতে হালখাতা করতে বেরোতাম তা সত্ত্বেও মিষ্টি দেখলে আমার আজীবন পেটে যেন নতুন করে খিদার উপক্রম হোতো। যদি মানুষের সহজাত ধারণা বলে কিছু হয় তবে হয়তো আমার সাথে মিষ্টির কোন জন্মগত ধারণা ছিল। তাই আজও বর্তমানে ২৫০ লেভেলের সুগার শরীরে নিয়ে ডাক্তারের কথামতন মিষ্টির "ম" ধনী উচ্চারণ করা যেখানে বারণ সেখানে দাঁড়িয়ে মিষ্টি খাওয়ার বিলাসিতা জেনেও যখন কোন মিষ্টির দোকানের সামনে দিয়ে যাই তখন মনটা কেবল রসগোল্লার হাঁড়িতে নিমজ্জিত থাকে। প্রত্যেক দোকানের মিষ্টির প্যাকেট আর ক্যালেন্ডারটি বগলদাবা করে ঠান্ডার বোতলটি দোকানে বসে শেষ করেই আমাদের তৎকালীন নববর্ষের দিনটি কেটে যেত। তারপর আবার শুরু হতো সহজিয়াজীবন। আজ আর এই সবকিছু আমার জীবনে অবশিষ্ট নেই। প্রথমে বাবার মৃত্যু ও তারপর যেটুকু ধরে বেঁচে ছিলাম সেটুকু বিসর্জন দিয়ে আসলাম এক বছর আজ হতে চললো , মায়ের চিতার আগুনে। ইট,কাঠ পাথর লোহার ধাপ দিয়ে ঘেরা ওই ফ্ল্যাট বাড়িতে এখন কেবল আসে আজ এই পত্রিকার সভা-কাল ওই পত্রিকার বই প্রকাশ, কাল অমুক অনুষ্ঠান এইসবের চিঠিপত্র । একসময় গাজরের সন্ন্যাসীর গানের বদলে প্রত্যেক বছর নববর্ষের অনুষ্ঠানের চিঠিতেই জানতে হয় যে আজ চৈত্র সংক্রান্তি, কাল নববর্ষ।
মায়ের সাথে সমাল তালে কোমর বেঁধে ঘরের মাকড়সার বাসা ভাঙার পালা এই ফ্ল্যাট বাড়িতে তেমন আর হয় না। ধীরে ধীরে এমন কোন রোগ নেই যেটা আমার শরীরের ছাপ ফেলে নি। তাই সেগুলোকে সামলে নিয়ে আর এখন নতুন দিনটির নিয়ম আচার থেকে একটু দূরেই দাড়াই। এদিক দিয়ে পরিচারিকা রাখবো তাও সম্ভবপর হয় না। এই দুর্মূল্যের বাজারে পান্ডুলিপি বেঁচে মাসে যেটুকু উপার্জন করি তা আহার্যবস্তু এবং ওষুধ কিনতেই চলে যায়। বিলাসিতার মূল্য কোথায়? তাই নববর্ষের দুপুরের মাংস ভাত গঙ্গার জলে বিসর্জন দিয়েছি আজ বহু বছর হয়ে গেল।
যদি বলতে হয় তৎকালীন সময়ে কিছু একটা এখনো থেকে গেছে আমার এই বর্তমানের কর্মব্যস্ত জীবনে হ্যাঁ, সেটা হল নববর্ষের সন্ধ্যার মিষ্টির থালাটি। না সেটা দোকানে দোকানে ঘুরে না, প্রকাশনীর নিজস্ব অনুষ্ঠানে ডেকে নিয়ে গিয়ে আদর করে বসে খাওয়ানো মিষ্টির কথা বলছি। তবে সেটা থেকেও তো না থাকার মতই হয়ে আছে।
সেদিনকার প্রকৃতি পরিবেশ আজ আর কিছুই নেই ।তবে যে কথাটি আছে সেই কথা মেনে চলা আমাদের একান্ত কর্তব্য। "সর্বম ক্ষনিকম" , সত্যি সকল কিছুই ক্ষণিক। এখন যা বর্তমান আছে পাঁচ মিনিট পরে তাই আমাদের কাছে কালের ইতিহাস হয়ে দাঁড়াবে। আমরা সত্যি বলতে কখনোই কোন কিছুকেই তেমন ধরে রাখতে পারি না। বেঁচে থাকতে হলে নতুন স্রোতে আমাদের অচলায়তনের তরী ভাষাতেই হয়। ঠিক সেই মাকড়সাটির মত। তার বাসা ভাঙলেও শতবার সে নতুন করে তার বাসা বাঁধবে, যতক্ষণ না সে পঞ্চভূতে বিলীন হয়।
অফুরন্ত ভালোবাসা সুভাষিতা ঘোষ (দাস)
"মুছে যাক গ্লানি ঘুচে যাক জড়া
অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা
বৎসরের আবর্জনা
দূর হয়ে যাক যাক যাক।"
বিদায় নিয়েছে দখিনা বাতাস। শিমুল-পলাশের শাখায় শাখায় বেরঙীন ইস্তেহার। মৃদুমন্দ বাতাসে ঘুমকে আঁকড়ে ধরেছিল যে ভোর, এখন মধ্যরাতের উত্তপ্ত মেজাজে কুহকের গল্প শুনতে পায় ! তবুও, বৈশাখ না এলে বসন্তকে ছোঁয়া যাবে কি করে ? তাইতো, সকলকে একরাশ শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, শুভেচ্ছা আর শুভকামনা জানিয়েই নতুন বছরের পথ চলা। সবার সুস্থতা, হাসি, আনন্দ, ভালোথাকা, ইচ্ছেপূরণ, স্বপ্নপূরণ আমাদের কাম্য। যদিও বিনিময়ের আশাহীন মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে যাওয়াই ঔচিত্যের মধ্যে পড়ে তথাপি, সকলের ভালোবাসা ও আশীর্বাদে যেন সমস্ত ভুল-ভ্রান্তি, দুঃখ-কষ্ট, ব্যথা-বেদনা, চাওয়া- না পাওয়া, আশা-নিরাশাকে জয় করে আগামীর দিনগুলো অতিবাহিত হয়, তারই অক্লান্ত প্রয়াসের শুভ সূচনা। ভালো হোক বা মন্দ, সমস্ত প্রাক্তনকে স্মৃতিপটে সুসজ্জিত রেখেই, কৃত ঠিক আর ভুল আর তার থেকে পাওয়া শিক্ষাই যেন হয়ে ওঠে পথ চলার পাথেয়।
সঙ্গে আছে কৃষ্ণচূড়া, লাল আবীরে আকাশ রাঙিয়ে জীবন করে রঙীন। ঈশানের কোণ আশ্বাস জোগায় চাতকের প্রাণে। ফুটিফাটা মাঠ স্বপ্ন বোনে সিক্ত জীবনের। আম-খেজুরের সচ্ছল সংসার এ মনে সুস্বাদের রসদ জোগায়। মাঠভরা সোনালী ধানের দিকে দৃষ্টি যেতেই রঙীন হয় চাষির হৃদয়। কালবৈশাখীর হঠাৎ অশনি সংকেতে হয়তো বেড়ে যায় ভয়ার্ত স্পন্দন তবুও, তারও তো প্রয়োজন আছে ! উড়িয়ে নিয়ে যায় সে পুরনো যত জঞ্জাল। ঘুচিয়ে দেয় জমানো ক্ষোভ আর বুড়ো বটের গায়ে জড়িয়ে আছে যে সব মরা ডালপালা, তাদেরও পৌঁছে দেয় সঠিক ঠিকানায়। জাগিয়ে দেয় নতুন করে, স্মৃতির পাতায় আগলে রাখা আম কুড়ানোর টক মিষ্টি গাথা, কোন্ সে পোড়ো দালানের এক কোণে হৃদয় দেবার কথা !
পশ্চিমের দিগন্তরেখাজুড়ে সেজে ওঠে রক্তসন্ধ্যা। বার্তা আনে, ফিরে গেছে যত ভয় ! আদরে-সোহাগে আগলে রাখার এসেছে সুসময়। বেলির গন্ধে বাতাস হয় মাতাল। রজনীগন্ধায় বাঁধা পরে নবজীবনের নতুন দুই পথিক। বাতাসে ভেসে বেড়ায় শিমুল তুলোর প্রেম। "পিউ কাঁহা" ডাকে চঞ্চল হয়ে ওঠে মধুময় প্রাণ। গোধূলির ঢলে পড়া কমলা আলোকে আগলে রাখতে কোকিলটা তখনো উন্মত্ত ! উদাসী বাউল চৈতন্য লাভ করে নেমে আসে ধুলিপথে। মেতে ওঠে নামসংকীর্তনে। ঝুলিভরা মাধুকরির গভীর তলদেশে অমূল্য মানিকরতন ! অফুরন্ত ভালোবাসায় আগামীর সমস্ত পথ আলোকময় !
কালবৈশাখী
শ্রাবণী সেন
বৈশাখ মাস আগুন দিয়ে গড়া
তাতেই মেশে আকাশভাঙা জল
রুদ্র তাপে দহন ঝরে পড়া
কঠিন দিয়ে কোমল ঢাকার ছল।
বিকেল হলে কালবোশেখী মেঘ
আকাশ জুড়ে বজ্র হানাহানি
শনশনিয়ে হাওয়ার অদম বেগ
বৃষ্টি এসে ভাসাবে সব জানি।
হাত বাড়িয়ে মুঠোয় ধরে নিও
করকাপাত - শীতল কঠিন রূপ
আঁজলা ভরে প্রিয়জনেই দিও
মেঘে আলোয় সাজিয়ে অপরূপ।
বৃষ্টি শেষের ভেজা ভেজা হাওয়ায়
ছড়িয়ে যাবে বেলির গন্ধসাজ
বৃষ্টি মেঘের না বলা কথা কওয়ায়
সন্ধি করুক সকল যুদ্ধবাজ!
বৈশাখ রীনা মজুমদার
কিছু কুড়োনো দিন--
খুলে নিয়ে বসি, সুখ এসে জাপটিয়ে ধরে
যেমন, মা তার সন্তানকে জড়িয়ে পায়!
চৈত্রের শেষ, বৈশাখের অলস দুপুর
উঠোনের আম গাছটিতে থোকা থোকা মুকুল
শৈশব ছেড়ে তারা যৌবন ছুঁই ছুঁই
কালবৈশাখী ঝড়ে, ঝরে পড়ে
কী টক! তবুও মিষ্টি সুমধুর
এক্কা-দোক্কা গালিচা পাতা
সে সুখ কই?
খেলা শেষে, শাঁখ বাজে ওই
হার-জিত ভুলে,
কী রে মনে আছ তো !
কাল আমারা সকালে পুজো পুজো খেলব
আমি ফুল আনব, তোরা মালা গাঁথবি
আকাশ শুনবে, বাতাস কবিগুরুর গান গাইবে..
কিছু কুড়োনো দিন
খুলে নিয়ে বসি, চিলেকোঠার ঘরে
আজ যে পঁচিশে বৈশাখ..।
বৈশাখের শেষলগ্নে
অভিজিৎ সরকার
বৈশাখের এই শেষের বেলায় তাপপ্রবাহের বন্যা,
চারিদিকে তীব্র অসস্তিতে জ্বলে যাচ্ছে শহর থেকে গ্রাম,
জ্বলে যাচ্ছে নদী-নালা, পাহাড় থেকে পর্বত।
সকলে চাইছে তীব্র অগ্নিদহন থেকে মুক্তি!
এমতাবস্থায় ওপরআলার দয়ায় খসে খসে পড়ছে মেগভাঙা বৃষ্টি,
খসে খসে পড়ছে আনন্দের জয়োগান।
জ্বলে ভরাট হচ্ছে নদী থেকে নালা
গাছেরা পাচ্ছে নতুন যৌবন,
গাছের উপর উড়ে আসছে নানান রঙের পাখি
গাছের পাতারা পাচ্ছে তীব্র দহন থেকে মুক্তি।
বৈশাখের শেষে রবি ঠাকুরের জন্মলগ্নে বইছে হালকা মৃদু বাতাস, সঙ্গে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি
আনন্দে মেঘেরা গর্জন করছে।
চারিদিকে উৎসবের ঘনঘটা,
পালিত হচ্ছে রবীন্দ্র উৎসব,
চারিদিকে ভেসে বেড়াচ্ছে রবি ঠাকুরের কবিতা,
ভেসে বেড়াচ্ছে রবিঠাকুরের সেই গান
"এসো হে বৈশাখ এসো এসো ............
কালবৈশাখীপ্রতিভা পাল
গ্রীষ্মের ঝরা পাতার শিরায়
তখনও গত শীতের শিহরণ !
খররোদের ব্যালকনিতে হঠাৎ
গোধূলি রঙের হাতছানি !
হাওয়ার গতিবেগ ঘূর্ণাবর্ত এঁকে ধুলোয় ধূসর,
আকাশের মেঘলা মলাটে যখন মেঘের অবসর,
বৃন্তদের প্রাণপণ প্রচেষ্টা কুঁড়ি আঁকড়ে ধরার,
ঘরহারা আফশোস খড়কুটো চায় একটু বাঁচার,
ঠিক তখনই বৃষ্টিছাটে ভিজে যায় চরাচর,
অঝোর ধারায় !
চোখের পলকে কান্নাভেজা টুপটাপ
গাছের পাতায় !
জানালার একফালি দৃশ্যে কোথাও তখন
ধোঁয়াওঠা চায়ের চুমুক,
কোথাও বা জোড়াতালির আয়ুরেখায়
লড়াইয়ের নিদারুণ সুখ !
কাগজের নৌকায় সময় ভাসে পিছল আঙিনায়!
কালবৈশাখীর চোখে জীবনের জলছবি
কত বৈচিত্র্যময়, কী অদ্ভুত, তাই না?
বৈশাখী ব্যথা
বিজয় বর্মন
সত্যি কথা কি,
আমি সব কিছু ভুলে যাই খুব তাড়াতাড়ি,
তাই আমাকে মনে রাখবে কে,
আর সেজন্যই বুঝি,
চঞ্চল চৌধুরী একটি গানের কয়েকটা লাইন খুব প্রাসঙ্গিক মনে হয়,
আর ওই আমিও গুনগুন করি,
তুমি বন্ধু কালা পাখি,
আমি যেন কি.....!
দিন তো চলে যায়, সব মনে রেখে হবে কি,
স্মৃতি বড় কষ্ট দেয়,
এইযে ,
ছেলেমেয়েরা এখন বড় হয়ে গেছে যে যার মত স্বাবলম্বী,
একটা সুখ অনুভব হয় বৈকি,
কিন্তু কিছু কথা তো এখনো দাগ কাটে মনে,
পহেলা বৈশাখ আসলেই,
তাদের কত বায়না ছিল,
জামা চাই প্যান্ট চাই, না পারলেও চাই,
তাদের চাওয়ার কোন শেষ নাই,
যতটা পারতাম দিতাম,
তাদের হাত ধরে হই হই করে হালখাতা করতে যাওয়া,
শত কষ্টের মধ্যেও একটা সুখ ছিল,
চৈত্র মাসের ঢাকের কাঠি পরে টাং টাং শব্দ দূর থেকে শোনা যায়, চরক মেলা বসে,কত ছিল তাদের বায়না,কত ছিল তাদের উৎসাহ,
ওরাও এখন যার যার মত,সংসার নিয়ে ব্যস্ত, বদলে গেছে দিন বদলে গেছে পরিস্থিতি, বদলে গেছি আমিও,
কয়েক বছর হল তাদের মাও ছেড়ে চলে গেল, ফেলে গেল একা।
বসন্তকাল আসলেই চৈত্র আসে আর চৈত্র আসলেই বৈশাখ আসে, তাদের যাওয়া-আসা চলতেই থাকে নিয়মিত,
কিন্তু,
এখন আর কেউ আমার কাছে, দাবি নিয়ে আসে না,
ওই সব খুব সহজেই ভুলে থাকি, ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করি,
তাই আমাকে আর, মনে রাখবে কে?
নববর্ষ
মুনমুন সরকার
উত্তাপে ভোগবিলাসী বিরক্ত যখন
রাস্তা আর গাছের নীচে ভিড় তখন
রকমারি খাওয়া তবু জিহ্বা স্বাদহীন
ঋতুর কাছে সকলে সমান,হোক দীন
অসংখ্য কৃষকের গোপন চিৎকার....
আমরা মনের অসুখে এত হাহাকার
নিজেদের সারাক্ষণ ব্যস্ত রাখি কাজে
লোভে অশান্ত,অস্থির সুখের খোঁজে
গ্রীষ্ম প্রকৃতি পরিবর্তন মনুষ্যত্বের কাছে
অভিমানে "নববর্ষ" হারিয়ে যাচ্ছে।।
কালবৈশাখীর প্রতীক্ষায়
আকাশলীনা ঢোল
তুমি কি আসবে? বৈশাখের এই উত্তপ্ত দিনে?
দগ্ধ ধরণীর তৃষ্ণা নিবারণে,
তীব্র দহনের দিনে, সুধারস বিতরণে
তুমি কি আসবে?
শুষ্ক গরম হাওয়ায়, নদীর বুকের জল বাষ্প হয়ে
আকাশের নীল ছুঁলে-
মেঘেদের মিনারে তুমি কি দেখা দেবে?
-'বৈশাখী ঝড় '?
সাঁঝের আকাশে হঠাৎ আগুনখেলা
দেখা দিলে, রবিঠাকুরের গানে
তুমি কি আসবে?
আসবে কি তুমি মানব মনের
উত্তাপ প্রশমনে ?
আসবে কি তুমি, বিশুদ্ধ বাতাস বুকে
ঝড়ের ডানা মেলে?
গ্রীষ্মের দুপুরে চাতকের মুখে বারিধারা
ঢেলে দিতে, এসো, এসো একবার-
দাবদাহে জর্জরিত প্রাণীকুল, আজ একটা
কালবৈশাখীরই প্রতীক্ষায়।
নতুন রূপে তোমায় পাবোমজনু মিয়া
আশা বুকে ভাসা ভাসা, স্বপ্ন চোখে পুরো
বয়স যতই হোক না তাতে, যৌবন কেবল শুরু।
এই বৈশাখে পণ করেছি, মন করেছি ঠিক
মিশে যাব প্রকৃতিতে, খুঁজব না দিক বিদিক।
মানুষ যাতে ভালো রবে,মানুষের ভালো হয়
এমন কর্মই করে যাব,ভাবছি ঠিক নিশ্চয়।
দেশ দশের ভালো হলে,জগৎ ভালো হবে
মানুষ জনে মুখে মুখে,ভালো বলবে তবে।
বৈশাখ এসে নতুন বছর, উপহার দিয়ে যাবে
নতুন কে নতুনত্ব দিয়ে, শান্তি সুখ মন পাবে।
অমঙ্গল দূর হোক,মঙ্গলের কামনা করি
নতুন রূপে বৈশাখ তোমায়, সম্মুখে তুলে ধরি।
তুমি এসেছিলে
শ্রেয়সী সরকার
শেষ চৈতালি সন্ধ্যা দুঃসহ হয়ে ওঠে
বিন্দু বিন্দু আক্ষেপের দাবদাহে ,
পথ হারিয়ে তুমি এসেছিলে গোলাকার বৃত্তে ।
রাহু কেতুর নজর লাগে, লুচিরা কষ্ট পায়,
পাঁচফড়নএর পদ , মাটির কলস উদকের সন্ধান করে ,
পাগলের প্রেম, কাঁচ ভাঙার মত সম্পর্কে
কাকদের কণ্ঠে বর্ষ শুরুর গান বাজে ,
হারমোনিয়াম না থাকলেও হয় ।
জীবন বরণের তত্ত্ব সাজানোর শিল্পীরা
অনাহারে মরে,
বাড়ির উঠোন ব্যাস্ত জংশনের মত।
আম কাঁঠাল এর মুকুলপাতা একটু কবরের জায়গা পায়না !
গন্ধ বাতাস ছড়াবে কিভাবে
তবু তুমি এসেছিলে !
আমি তও প্রেম নিবেদন করতে চেয়েছি
হালখাতার পৃষ্ঠাতে জায়গা পায়নি ,
খুঁজে বেড়িয়েছি নদীর বালুচরের তাপ
দৈত্যরা সেখানেও নোঙর ফেলে ।
সমুদ্রের ফেনার মতো কোমল
সুতির কাপড়,
চরকা কাটার বুড়ি মিউজিয়াম এ ঘুরে বেড়ায় ।
টিকিটের চড়া দাম ,বাজপাখিদের ভিড়ে
নতুন সম্পর্ক বন্ধু খুঁজে পায়,
বাবা মায়ের কষ্ট হয় না !
সিনেমায় সম্পর্কের পরিণতি , কনে বিদায়ে যন্ত্রনা নেই ।
শুধু তোমার আমার কাব্যে প্রেম যোগ্যতা পায়না সংখ্যাগত ডিগ্রীর ভিড়ে।।
এলোরে বৈশাখ
বিপ্লব গোস্বামী
এলোরে এলো বৈশাখ
রবীন্দ্র সঙ্গীতে,
হালখাতা গণীপূজা
সিদ্ধি আর হিতে।
এলোরে এলো বৈশাখ
ঝড় বৃষ্টির সাথে,
বটতলার মেলায়
ইলিশ পান্তা ভাতে।
এলোরে এলো বৈশাখ
নব ফলে ফুলে,
নব পল্লবেতে এলো
শ্যামলীর দুলে।
নববর্ষে দু:খে হরষে
স্বপন কুমার দত্ত
প্রতিবারের মতো আবার এলো পয়লা বৈশাখ। বছরের অন্যান্য দিনের থেকে একটু হলেও কেমন যেন স্বতন্ত্র। সারা বছরের দু:খ দৈন্য,ক্লান্তি, হতাশার মাঝে এ যেন ক্ষণিকের জন্য হলেও ফাগুনের দখিনা বাতাস। প্রতিটি মানুষ চায় আবার একটি নতুন বছরে নতুন করে বাঁচতে, প্রত্যাশা পূরণের লক্ষ্যে শামিল হয় পুরোনো ঘোড়দৌড়ের ময়দানে। জেতা হারার প্রশ্নটা থাকে এখানে একেবারে গৌণ।
পয়লা বৈশাখ সকাল থেকেই পড়ে যায় সাজোসাজো রব। প্রতিদিনের লেট রাইজার কর্তা সেদিন ভোরবেলায় চান সেরে নতুন বস্ত্র পরিধান করে মিষ্টির দোকান থেকে ভোগ কিনে ছোটেন মন্দিরে। আরে লাইন দিতে হবে তো। সম্বৎসর রেশন,গ্যাস, কেরোসিনের দোকানে লাইন দিয়ে এখানেও নেই নিস্তার। সারা বছরের জন্য বিধাতার কৃপালাভ করতে হলে ওটুকুতো করতেই হবে।
দোকানদারও তার সাতসকালে ধোয়ামোছা করে আমপাতা, শোলারকদম ফুল দরজার চৌকাঠে ঝুলিয়ে প্রস্তুত শুধু পুরুত মশায়ের অপেক্ষায়। গণপতি মহারাজের পূজো দিয়েই নতুন বছরের বেচাকেনার সূত্রপাত। এরপর তো শুরু হবে হালখাতা। বড়শিতে টোপ গেঁথে মাছ ধরবার মতো পুরোনো বকেয়া আদায়ের সেই আদি ও অকৃত্রিম প্রচেষ্টা। গতবছর পাড়ার মুদি দোকানের হালখাতার হাল হকিকত এখানে পাঠকদের শোনাবার লোভ সংবরণ করতে পারলাম না। হালখাতায় নাম তুলে কিছু বকেয়া মেটানোর পর দোকানি আমার হাতে তুলে দিলেন স্রেফ একগ্লাস জল। মুখে বললেন," ঠান্ডা জল, খেয়ে নিন। গরমে ভালো লাগবে।" আমি বলি, " দাদা একটু অন্তত, ক্যাওড়ার জলও তো মেশাতে পারতেন"? ভদ্রলোকের সহাস্য জবাব," দাদা ক্যাওড়া এখন শ্যাওড়া গাছে। আগে নামুক, আগামী বছর বেঁচে থাকলে খাওয়াবো।" ভাবুন একবার!
এরপর আছে নতুন বছরের ভূরিভোজের বাজার। একথা হলপ করেই বলতে পারি,যেকোন লোক বাজারে গিয়ে মুখ ব্যাজার হবেই। কিনবেন কোনটা? মাছ মাংসতো কবে থেকেই কুলীন। চুনোপুঁটি থেকে রুই কাতলা দেমাকে একজন আর একজনকে দেয় টেক্কা। আর মাংসতো কহতব্যই নয়। মাংসের দাম শুনে আপনার পিতৃপুরুষের নাম স্মরণ করে পাঁঠার মতো ব্যা ব্যা করেও নেই নিস্তার। নিজের শরীর ও তেমন শাশালো নয়, প্রয়োজনে অন্তত এদিনের জন্য কেটে নেওয়া যেতো দু- চার কেজি গোস্ত । পাঠকেরা ভাবছেন ঠিক আছে, এর থেকে নিরামিষাশী হলেই ক্ষতি কি? সে গুড়েও বালি । কারণ এচোড় এখন দামে যেভাবে প্যাচোড় মেরে আছে, কার সাধ্য ওর মান ভাঙায়। উচ্ছের দাম শুনে কেনবার ইচ্ছেটাই গেল মরে। না খেয়েই মুখটা হয়ে গেল বিশ্রী রকমের তেতো। গুণহীন বেগুনের লেগেছে আগুন। মিষ্টি কুমড়োয় হুমড়ো খেয়ে পড়বার নেই কোন উপায়। সস্তার আলুও এখন পয়লা বৈশাখে একেবারে " সুয়োরানী"! ভাবছি,আমিষভোজীও নয়, নিরামিষাশীও নয়, পওহারী বাবার মতো বায়ুভক্ষণে প্রাণধারণের উপায়ের সন্ধান কোথায় পাবো? এরপরও বাড়ি ফিরে বাজারের ব্যাগ নামাতেই গিন্নির চিল চিৎকার ," এটুকুন বাজারে গুষ্টিশুদ্ধ লোকের কীভাবে চলবে?" গিন্নিকে বলি, " ভাগ্যিস, প্যান্টপরে বাজারে গিয়েছিলাম,তাই রক্ষে, নচেৎ ধুতি পরা থাকলে দোকানদারের সঙ্গে টানাটানিতে এই বাজার আনতেই খুলে যেতো কুঁচা।
তবুও আসে নববর্ষ -- যা জোগায় আমি জনতার সারা বছরের বাঁচার রসদ। একদিনের জন্য হলেও একটু খুশির হাওয়া। ছা- পোষা মানুষ একে অপরকে করায় মিষ্টিমুখ। ছোটরা বড়দের প্রণাম করে, বড়রা করেন তাদের আশীর্বাদ। যদিও মিষ্টি করেছে এখন অনাসৃষ্টি কান্ড। তার দামও মানুষের নাগালের বাইরে। গিন্নি মিষ্টি আনবার হুকুম করলে গিন্নিকে বলি, " আর কাজ নাই মিষ্টিতে ।মিষ্টির যা দাম,তাতে মাথাপিছু আনতে গেলে বেরিয়ে যাবে কুকুরের থেকেও লম্বা জিভ। এর থেকে ভালো," বোন্দে"! লাগবেও কম, হাতে হাতে ধরানো যাবে।" এরপর গিন্নির উত্তর পাঠককে শোনানো আমার পক্ষে অসম্ভব।
পরিশেষে এক অম্লমধুর রসিকতায় শেষ করবো আজকের রম্যাখ্যান। পয়লা বৈশাখের সকালে গিন্নির হাত থেকে একটা প্যাকেট খুলে পাঞ্জাবির মতো একটা বস্তু পরিধান করি। যদিও সেটা আদৌ পাঞ্জাবি নয়, বিশুদ্ধ ফতুয়া। গিন্নি জিভ কামড়ে বলে, ' এই ছি : ছি : এটা সেলের মাল। ফেরত ও নেবেনা। এক্কেবারে ঠকে গেলাম।" আমি তাকে আশ্বস্ত করি, এতে কিছু যায় আসেনা। মিনি স্কার্ট, মিনি ফ্রক, মিনি ব্লাউজ যদি বহাল তবিয়তে চলতে পারে, তবে মিনি পাঞ্জাবিতে দোষ কি? গিন্নির উত্তর, "তোমার সব কিছুতেই রসিকতা। ভুলতো হতেই পারে।" মনে মনে ভাবি, ভগবান এ ভুল কবে সত্যি হবে। এভাবে মিনি হতে হতে একদিন পরিধেয় বস্ত্র পরার যদি বালাই ঘুচে যায়, তবে মন্দ কি? বাঁচবে কাপড়, লাগবে না পয়সা। একসময় তো আমরা ওভাবেই ঘুরে বেড়াতাম বনে জঙ্গলে। দুচারটে পাতা ঝোলালেই চুকে যেতো ল্যাটা। কবে আসবে সেই সুদিন? নববর্ষের এই সুখ দুঃখের দিনে ছা- পোষা মানুষের সাথে এই অধমেরও একটাই প্রার্থনা --- " হরি দিন তো গেল,সন্ধ্যা হল,পার করো আমারে।'