আসে বৃষ্টির
সুবাস
চিত্রা পাল
বন্ধু,
কেমন আছ? ওখানে বৃষ্টি শুরু
হয়েছে? আমাদের এখানে এখন ঘনঘোর বর্ষা। আমাদের এই দেশের যে বৃষ্টির খ্যাতি আছে বেশ। যখন খুব গরম পড়ে, সবাই
আমরা বৃষ্টিকে ডাকি, বলি আয় বৃষ্টি ঝেঁপে, ধান দোবো মেপে।আর বৃষ্টিও আসে।
বৃষ্টি আসে মাঠ পেরিয়ে, ওই সুদূর
চাবাগানের ওপর দিয়ে গ্রামের মেঠো পথ ধরে,হাটের চালা,কুঁড়ে ঘরের খড়ের চালার ওপর
দিয়ে,নদীর বুকের ওপর দিয়ে ক্ষেত জনপদ ভিজিয়ে, ভাসিয়ে। ছোট নদী আর ছোট নয়,তার এখন
চাল চলন অহংকেরে। সে বুক ফুলিয়ে চলে।জেগে ওঠে তিস্তা তোর্ষা জলঢাকা মহানন্দারা।
করলা ধরলা কালজানি লিস ঘিস সবাই। এদের সঙ্গিনী প্রকৃতি এতো নিকটবর্তিনী,তার নিঃশ্বাসে এরা হিল্লোলিত, সে ছন্দ বাজে তাদের চলায়।বর্ষার বিপুল জলধারা
নিয়ে অবিশ্রাম কলশব্দে তাদের চলা। সে চলার ধ্বনি বাজে তার তরঙ্গে তরঙ্গে।বর্ষার
বারিধারা সিক্ত নিত্য সঞ্জীবিত অরণ্যের তরুলতাগুল্ম
সবুজ সরস ,প্রফুল্ল নবীন।
বেশ কয়েকদশক আগে যে বর্ষার সমারোহ দেখেছি, তেমন ঘনঘোর বৃষ্টি এখন হয় না। হিসেবি বর্ষার
সেই রাজকীয় সমাবেশ
বন্ধ। আগে মেঘের ঘনঘটা শুরু হতেই তার আসবার ঘোষনায় ব্যস্ত মত্ত দাদুরী গলা
ফুলিয়ে ক্রমাগত আহ্বান জানাতো। সন্ধ্যে
নামার আগেই শুরু হতো টুপটাপ রিমঝিম। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দুগুন চৌগুন তানে
ক্রমশঃ তার আলাপচারিতা জমে যেতো।বাইরের সঙ্গে যোগাযোগ বিহীন অবিশ্রাম
ঝর্ঝর শব্দের আছাদনে
ছিলো নিবিড় অবসরের
স্বাধীনতা। সে অবসর আরও ঘন হয়ে উঠতো গল্প গাথার
কল্পকাহিনীতে। আষাঢ়ে গল্পের আসরে যে যার মতো গল্প বলতো,তাতে মেতে উঠতো স্রোতৃবর্গ।কত কত শতাব্দী
আগে মহাকবি কালিদাস আকাশজোড়া ঐশ্বর্য নিয়ে মেঘের
উদয় দেখে চিরকালীন বর্ষার কাব্য মেঘদূতে
রেখে গেলেন আষাঢ়ের প্রথমদিনে বর্ষার আগমন বার্তা।
আজ বর্ষা আসে জল নিকাশি
ব্যবস্থা ভালো না থাকায় কষ্ট আর দুর্দশা নিয়ে। ঘরদোর সংসার ভাসিয়ে দেয়। বিশুদ্ধ
খাবার জলের অভাব, অসুখ বিসুখ, যাতায়াতের অব্যবস্থা জীবন দুর্বিসহ করে তোলে।
তবু প্রখর গ্রীষ্মের পরে
যখন বর্ষা আসে, প্রথম ধারাপতনে মাটির যে সোঁদা গন্ধ সে যে এখনও আমাদের নাড়া দেয়।
এখনও বৃষ্টির বাতাস বেয়ে আসা সুবাস সে খবর দেয় ‘ আমি এসেছি’।
বেড়ানো
চম্পা বিশ্বাস
"ঝরো ঝরো বরিষে বারিধারা"
আজ সকাল থেকেই অঝোর ধারায় বৃষ্টি চলছে। চারপাশ জলে থৈ থৈ। আষাঢ়ের এই ঝরো ঝরো মুখর বাদরদিনে সত্যিই আজ কাজে মন নেই। মন ছুটে চলেছে খোলা প্রান্তরে,সুন্দরী ডুয়ার্সের বিভিন্ন আনাচে-কানাচে।মনের পাখনা মেলে উড়ে চলেছি সবুজের মাঝে।
জানালা দিয়ে তাকিয়ে থেকে সিদ্ধান্ত নিলাম ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে আবদ্ধ না থেকে গাড়ি নিয়ে বের হব অজানার পথে। ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে বেশি সময় লাগলো না।সকল রকম প্রস্তুতি শেষে আমরা দুই বান্ধবী মিলে গাড়ি নিয়ে বের হলাম পথে। লাটাগুড়ি ফরেস্টের মধ্যে দিয়ে যাবার সময় দুইপাশের সবুজ আর বুনো গন্ধ যেন মন প্রাণ গ্রাস করছিল। গিয়ে দাঁড়ালাম মূর্তিতে। বৃষ্টি এখন থেমেছে। তবে নামবে যেকোনো সময়ে। বৃষ্টিতে স্নান সেরে মূর্তি এখন অপরূপা। লোকজনের কোলাহল এখন নেই। আমরা তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করছিলাম সৌন্দর্য,কিছু কিছু লেন্স বন্দীও করলাম।
কিছুক্ষণ সময় কাটানোর পর মনে হল সেবক গেলে মন্দ হয় না। অতএব আবার গাড়ীতে উঠে বসা।শুরু হল যাত্রা। পথে ছোটো ছোটো কয়েকটি ঝোরা সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দিচ্ছিল। সেবক পোঁছানোর সময় দূর থেকেই সৌন্দর্য উপভোগ করছিলাম। এখন বৃষ্টি নেই। অসংখ্য বানর বেড়িয়ে এসে খাবারের জন্য ঘোরাঘুরি করছে।আমরা সেবক কালিবাড়ি ও শিবমন্দিরে অনেকক্ষণ সময় কাটালাম। পায়ে হেঁটে চারপাশ ঘোরাঘুরির পর করোনেশন ব্রীজের কাছে আসলাম।বর্ষার জলে পরিপূর্ণ হয়ে তিস্তা নদী আজ সুন্দরী। চারপাশের পাহাড়ের এক অপূর্ব শোভা মনকে মোহিত করছিল। সব মিলিয়ে এক অপার আনন্দের মুখোমুখি আমরা। কিছু সুন্দর মুহূর্তকে লেন্সবন্দী করবার চেষ্টা করলাম। এভাবে কিছুটা সময় কাটানোর পর এবার ফেরার পালা।
গাড়ীতে বসে ভাবছিলাম - আষাঢ় মাসের মূর্তি আর সেবকের রূপ মনের মণিকোঠায় রয়ে গেল এক অপূর্ব স্মৃতি হয়ে।
কবিতা
আষাঢ় ও তুমি
ফিরোজ হক্
আষাঢ় ও তোমাকে নিয়ে কবিতা লিখবো লিখবো করেও
লিখে উঠতে পারি না
দৃঢ় আলিঙ্গন ও চুম্বনের সেতু তৈরির মাধ্যম
অধরা থেকে যায়
ধীরে ধীরে আষাঢ় আর সেতু হতে পারে না
নিজেরাই নিজেদের সেতু হয়ে যাই...
তারপর জীবনের গতি এগোতে এগোতে
আষাঢ় ধরা দেয়
দূরত্ব ঘনায়মান হয় ঘনিষ্ঠতায়
এগোতে থেকে চাল চুলোহীন সংসার
আষাঢ় আর রোমান্টিসিজমে বাস করে না
দুটি হৃদয়ে আষাঢ় বয়ে যায়
বেকারত্বের গ্রাসে...
পোয়াতি আকাশ
রিপন বর্মন
ও আমার বর্ষার সময়
ঘনিয়ে আসা পোয়াতি আকাশ
তোমায় আজ
ভীষণ বিষণ্ণ দেখাচ্ছে
তুমি কেন
আজ এত বেশি হতাশ?
ভয় পাচ্ছ কি? তোমার
কি চিন্তা হচ্ছে?
পোয়াতি উদরের
কালো শিরা উপশিরা ফুলে ফেঁপে আছে,
দিয়েছে হইত
আজ ডাক!
ভেতরটায়
খুব যন্ত্রনা, প্রসব বেদনায় দিচ্ছ হাঁক!
একবার চোখ মেলে দেখ
শক্তি পাবে,
জুড়াবে তোমার
প্রাণ
তোমার সৃজন
বুকে করবে বলে ধারণ
বাতাসে গা
হেলিয়ে উৎসুক প্রকৃতি আছে দণ্ডায়মান।
তুমি আজ মুটি কেটে
ধর, দাও সৃজনের চিৎকার
পৃথিবীবাসীকে
দাও বৃষ্টি সন্তান উপহার।
অপেক্ষারতরা ভিজে
হোক একাকার...
খাল, বিল,
হাওর, নদ-নদী উঠুক হেসে আনন্দে উল্লাসে,
মৃত্তিকার
গতর হোক উর্বরতায় পরিপূর্ণ
প্রকৃতি
হয়ে উঠোক সবুজের অরণ্য।
দূর হোক
লুকায়িত সকল পাপ আবর্জনা,
দূর হোক
বিষণ্ণ মনের সকল কান্না, সকল হাহাকার...
ঝলমলে এক দিন
দীপু রায়
অলস সকাল ,স্যাঁতসেঁতে মন বৃষ্টি ভেজা ,
উঠছে রোদ, চরছে উল্লাসের পারদ,
আঃ কী মজা!
ঘন নীল গগনে, বরষনে শেষে রবি কিরণে
দিচ্ছে উঁকি, ঝলমলে এক দিন,
মনটা যে খুশিতে নাচে তা তা ধীন ধীন..
ওহে আরামপ্রিয় অলস মন,
চল ছুটি আজ, পৃথিবী ঘুরছে বন বন..
চাল ফুটো ঘরের, ভিজে ছিল সারাটা রাত
দুচোখ ছিল ঘুমহীন,
উনুনে চরেনি হাঁড়ি, জ্বলছিল খিদের আগুন
বরষন দিনে যারা ছিল কর্মহীন..
আজ, ঝলমলে এক দিন
কর্মময় হউক জগৎ,
মিটে যাক খিদে, খুশি হউক ক্ষুধাতুর শিশু
তাছারাও প্রাণঢালা খুশি হোক লুটোপুটি
রয়েছে যারা স্বভাবে শৌখিন।
বৃষ্টি
দীপ মুখার্জি
আজ তুই
ঝরঝর ঝরে পর
ঝরে পর তুই সন্ধ্যে নামার
আগে..বেলাশেষে মেঘবালিকা বেশে
ফুলে ওঠা নদীর কলস্রোতে পাড়ে লাগানো
নৌকোটা আলতো ঢেউয়ে ওঠানামা করছে..
ছইয়ের ভিতর মাঝির মনকেমন করা
মাঝিয়ালী সুর..বড় বেমানান
সন্ধ্যার হ্যারিকেন জ্বললো
হালকা আলোয়
বৃষ্টি তখনও
পড়ছিস
টুপটাপ।
তুমি এসেছিলে
নয়ন রায়তুমি এসেছিলে,এসেছিলে জৈষ্ঠ্য তখন শেষে।
তুমি এসেছিলে মেঠো পথে এসেছিলে মোর গাঁয়ে আষাঢ় রাঙা পায়ে ;
কোকিলের কুহুতানে চাতকের দীর্ঘশ্বাসে সবুজের ডাকে সবুজি সমাহারে।
তুমি এসেছিলে,এসেছিলে থৈ থৈ বর্ষা কদম ফুলে
তোমার ভরা যৌবন কালে ;প্রেম যমুনায় উথালপাথাল তরী
আমি প্রেমিক হই মাঝি হই তুমি তরীর পরী!
তুমি এসেছিলে,এসেছিলে মেঘ যুবতি
হিমালয় ডেঙিয়ে ধবল ধূসর কালো মেঘমুলুক লয়ে_
গগন ছেয়ে ;
আমি সবে কলি!
তবু দেখেছি,দেখেছি তোমায় শ্রাবণ ভেজা ঘাসে
তোমার নুপুর দুপুর বৃষ্টি নাচে।
ঝুল ধরা জানালা যত খুলেছিলে এক সাথে
আমি দেখেছি,দেখেছি তোমায় যৌবন ভেজা গা'য়ে।
তুমি তখন ষোল,তোমার যৌবন ভরা কালে।
আহা কী রূপ!
অপরূপ রূপ ডুবে যাই মরে যাই পুড়ে ছাই ছাই
কলি নই অলি হতে চাই ভিজতে বিভোর!
মুখদর্শন সুখদর্শন,শাপলা সন্ধ্যা কেয়া কামিনী
তুমি বকুল বেলি লিলি চাঁপা অলকানন্দ;
আমি সবে কলি!
তবু আষাঢ় মেতেছি শ্রাবণ ভিজেছি
হেঁটেছি গেয়েছি চেয়েছি কবি প্রেমিক হতে ;
চিঠিটা তখন বুক পকেটে আলতো যতনে।
ফেরার পথে তুমি শাপলা চেয়েছিলে;
আমি শ্রাবণ ভিজেছি শ্রাবণ শেষে একবুক জলে
সিসা'র ফাঁকে শুধু বলেছিলে " ফিরবো বর্ষা এলে"!
আয় ভিজিয়ে যা
বিজয় বর্মন
ওরে বৃষ্টি আয়রে ছুটে আয়,
একটুখানি ভিজা পরশ যারে দিয়ে যা,
হাওয়ার সাথে কত কথা,
একটুখানি মেঘের ছোঁয়ায় গা ভিজিয়ে যা।
আমি বড় বেহায়ারে ,
সব ভুলেছি জীবনকথা,
মৃত্যু এখন জীবন সঙ্গী, শত নষ্ট গাঁথা,
ওরে বৃষ্টি আয়রে ছুটে আয়,
একটুখানি মেঘের ছোঁয়ায় গা ভিজিয়ে যা।
বেইমান এ মন, ভাবি যতক্ষণ,
অসুখ জীবন জপের মালা,
এমন কেন হয়,
ওরে বৃষ্টি আয়রে ছুটে আয়,
তোর সাথে কাঁদবো আজি, জীবন দোটানায়।
সব ভুলেছি মায়া কল্প,
চাওয়া পাওয়ায় ভীষণ অসুখ,
তবু কেন মন মানে না,
আয় ভিজিয়ে যা, আমার মায়া মুখ,
একটুখানি মেঘের ছোঁয়ায় সতেজ ভরা বুক।
মন কেমনের বৃষ্টি চন্দ্রানী চৌধুরী
মাঝে মাঝে বৃষ্টি হলেই
বুকের ভেতর মন কেমনের সুর বেজে ওঠে
মনখারাপের দরজা দিয়ে
ভিড় করে আসে দীর্ঘশ্বাস
আষাঢ়ের জলভরা মেঘ সাথে নিয়ে আসে
অন্যরকম কষ্ট
অবুঝ মন ডানা ঝাপটায় অবিরাম
চোখের কোণে ঝড় বৃষ্টি
দু গাল বেয়ে নোনা জলের বন্যা নামে
আকাশ ভেঙ্গে উতলধারা এসে
চোখের পাতা ছুঁয়ে দিলে
বৃষ্টি জলে ধুয়ে মুছে যায়
চোখের বিষাদ
কেউ দেখে না আড়ালের মনখারাপ ।
আমি বর্ষা
রীতা মোদক
আমি বর্ষা
কথা দিলাম---
কাঁঠাল পাকা ভাপসা গরমের দুপুরে
পাতা উরিয়ে, পরাণ জুড়িয়ে
আমি ঝড়ো বাতাসে সাথে বাংলায় নামবো।
কালো মেঘের বুক চিরে
রাশি রাশি শিলা দিয়ে
বজ্র বিদ্যুৎ সঙ্গে নিয়ে
আমি ফিরবো ।
আমি হু হু বাতাসের সঙ্গে মিশে গিয়ে
শো শো আওয়াজে ভয় দেখিয়ে
তান্ডব নৃত্য করবো।
তারপর ?
আমি শান্ত স্নিগ্ধ হয়ে
রিম ঝিম সুরে,
ঝিরি ঝিরি ধারায়
মাঠ ঘাট পাড়ায়
ঝম ঝম শব্দে পরবো।
জীবন যে রকম
ড. ইন্দ্রাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
সারা রাত ঝমঝম বৃষ্টি।দু চোখের পাতা এক করতে পারে না চম্পা। টিনের চালা থেকে জল ঝরছে, বালতি কড়াই মেঝেতে দিয়ে রাখছে আর গজগজ করছে নিজের মনে , এই কারণে আমি বর্ষা কাল আইলেই ভয় পাই , গরীব লোকের হাজার ঝামেলি।পাকা ছাদ দেওয়া কি সহজ নাকি?
দিবাকর একটু নরম ধাতের খুব বেশি খাটতে পারে না। ঘুমিয়ে কাদা। বাজ পড়ার শব্দে ধড়মড়িয়ে উঠে বসে বলে -- ও চম্পি মাঝরাতে কি করতে লেগেছিস? ওহ ঘর যে ভেইসে গেল রে।তোর মাথায় কি ছাতি ধইরতে হবে ?
-- আ মরণ মুখপোড়ার কথা শোনো। আমি মরছি ভাবনা চিন্তায় সে কেমন রঙ্গ কইরছে দ্যাকো। কাল সকালে আমার কাজে যেতি হবে ,তোমারে ও সবজির ভ্যান নিয়ে বেরতি হবে। শোনো পাকা ছাদ দিতে হবে ইবারে ই , আমি আরো দুটো বাড়ি কাজ বেশি নেবো তুমি কাল পিছনের ঘাসবন জঙ্গল সাফা করবা।
-- হ্যাঁ কাল ই জঙ্গল সাফ করে ঢেঁড়স বেগুনের বীজ বুনবো। সামনের বছর তোর ঘরে পাকা ছাদ হবে ই।
দিবাকর সেই কবে থেকে গেঞ্জির কারখানায় কাজ করত। লক ডাউনে বন্ধ। চম্পা যে ফ্ল্যাটে কাজ করে ওখানেই ভ্যান নিয়ে সবজি বেচে। চলে যায় সংসার কোন একরকমে। ছেলে টা লেখাপড়ায় মতি গতি নেই ।সাইকেলের দোকানে কাজ পেয়েছে ওখানেই থাকে খায় কাজ করে।
খুব ভোরে উঠে দিবাকর নিজের কাজে লেগে পড়েছে।চম্পা সংসারের সব কাজ সারছে তাড়াতাড়ি। কাজের বাড়ি যাবার সময় হয়ে এলো। হঠাৎ বাড়ির পিছনের দিক থেকে খুব চেঁচামেচি ।বুক ধক্ করে উঠল চম্পার। দিবাকরের কিছু হল নাকি?
প্রতিবেশীরা ধরাধরি করে আনল দিবাকর কে। ডান পায়ের বুড়ো আঙুলে সাপে কেটেছে।একটু উঁচুতে শক্ত করে বাঁধন দেওয়া হয়েছে। ছেলে দোকান থেকে
খবর পেয়ে ছুটে এল। সবাই মিলে শহরের হাসপাতালে নিয়ে গেল দিবাকরকে ।
চম্পা দিশেহারা। দুর্ভাবনায় হাতে কাজ আসছে না। নিজের ভাগ্যকে নিজেই গালমন্দ করে, বিড়বিড় করে - যত কষ্ট চিন্তা ভাবনা যেন একা চম্পার ই। সারা জেবনে একটু আনন্দের মুখ কোনদিন দেখতে পাবো নি?ফ্ল্যাটের দিদিমনি বৌমনি রা কত আনন্দে থাকে। সুখ আহ্লাদ বলে কিছু ই কি নেই তার এই ছাতাপোড়া জেবনে ? চার নম্বর ফ্ল্যাটের নিকিতা দিদিমনি ছাদে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে কত সুন্দর নাচছিল, সুমন দাদা ভিডিও করছিল । আর ঐ এগারো নম্বরের রুমা বৌদি কদম ফুল নিয়ে কি করবে ভেবে পায় না, দাদাবাবু খোঁপা য় লাগিয়ে দিয়ে ছবি তুললো ,কি যেন বলে ছেলপি। মোবাইলে সেই ছবি দিয়ে আবার কি হাসাহাসি,কত আনন্দ।কই কোনদিন দিবাকর ওই ফেলাটের দাদাবাবু র মতো ওর মাথায় লাগিয়ে দেয় নি। না মিথ্যে বলব নি মুখে পোকা হবে, দিবাকর ভালো মনিষ্যি গেরস্তি লোক, বাইরের মেয়েছেলের দিকে চোখ নাই।কখনো সখনো চম্পি বল্যে জড়ায়ে ধরে ,চম্পাও সে ডাকে সাড়া দেয়। কিন্তু বুকের ভেতর দিন আনি দিন খাই এই চিন্তাই কুরে কুরে খায়।
ধড়াম করে সাইকেল টা টিনের গেটে রাখল খোকন।চমকে তাকালো চম্পা -- ও খোকা তোর বাবা কেমন আছে বল দিকিনি।কখন বাড়ি ন্যে আসবি?আর আমি ওই মনিষ্যি কে কোনদিন ঝোপে জঙ্গলে পাঠাবো না এই তিন সত্যি করছি।
-- বাবাকে বিকেলে ছেড়ে দিতে পারে। কিন্তু খুব দুর্বল।একটা ইঞ্জেকশন দুপুরে র মধ্যে কিনে দিতে হবে।আরো কিছু ওষুধ। আমার হাতে টাকা নেই। তুমি দাও সব হাসপাতালে দিয়ে তারপর কাজে যাবো।
চম্পার মুখ শুকিয়ে এতটুকু। বাড়িতে একটা পয়সাও নেই। পর মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নেয়, বলে --
কোনো চিন্তা করিস নে খোকা। তুই চারটি মুড়ি আর চা খা।আমি বাগান থেকে সবজি ন্যে আসি। ফেলাটে সব বিক্রি হয়ে যাবে। ইঞ্জিকশন ওষুধ সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
-- ভ্যান নিয়ে বের হতে পারবো না। কাজে না গেলে মালিক হেভি ঝাড় দেবে।
-- ঠিক আছে তুই সাইকেলে পৌঁছে দ্যে আয়।দু ঘন্টা পরে ন্যে আসবি।
সাইকেলের হাতলে ভারী দুটো থলে ঝুলিয়ে নেয়।খোকন রেনকোট পরেছে। পিছনের সিটে চম্পা ,মাথায় ভাঙা ছাতি।বৃষ্টি নামল আবার ঝমঝম। তীরের ফলার মতো বিঁধছে বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা। রাস্তার পাশে কদম গাছ ফুলে ভরে আছে। তীব্র গন্ধ।চম্পার চোখে ভাসছে নিকিতা দির নাচের দৃশ্য। বৃষ্টিতে ভিজেও কেমন প্রাণখোলা আনন্দে ভাসছিল।
ফ্ল্যাটের গেটে পৌঁছানো মাত্র পাঁচ নম্বরের বৌদি চেঁচিয়ে উঠল এসেছে এসেছে চম্পা কাজে এসেছে।চম্পা হাত নাড়িয়ে বলে -- আর চিন্তে নেই গো সব কাজ সামলে নেব। আজ সবজিও আমি বেচব।ফিরেশ গিরিন সবজি।
ছেলের দিকে তাকিয়ে জানান দেয় -- ঘন্টা দুয়েক পরে এদিকে আসিস।।তোর হাতে টাকা দ্যে দেব।তোর বাবাকে আমি যেমন করে হোক সুস্থ করে তুলবো ই ।
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে উঠতে জোর গলায় চিৎকার করে চম্পা -- ওগো তোমরা বেরিয়ে এস গো। সবুজ সবজি। কচি পুঁই , মিষ্টি কুমড়ো,কলমি শাক, ধনে পাতা...
তিন নম্বরের জানলা থেকে ঠিক তখনই গান ভেসে আসে...
এই পুরাতন হৃদয় আমার আজি
পুলকে দুলিয়া উঠিছে আবার বাজি
নূতন মেঘের ঘনিমার পানে চেয়ে
আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে...
বৃষ্টিদিনের গান
অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী
চারপাশে ফুটে থাকা বর্ষার ফুলগুলোর, পাগল করা গন্ধে, ভেজা বৃষ্টির এই সন্ধেবেলায় ওরা দুজনও ভিজছিল নিজেদের হারিয়ে ফেলে। ওদের চোখের ভেজা পাতা, ভেজা গাল ধুয়ে যাচ্ছিল আষাঢ়ের এই অবিশ্রান্ত ঝরে পড়া বৃষ্টির জলে। হাতে হাত রেখে ভিজতে ভিজতে অবিরাম কথা বলছিল ওরা, হেসে হেসে। টুপুর আর রিমঝিমের অবাক করা চোখের সামনে এই তৃষাতুর, উন্মুখ প্রকৃতির মতোই ওরাও সেই কবেকার বৃষ্টিদিনে ফিরে গিয়েছিল যেন; অনেকগুলো আষাঢ়কে পেছনে ফেলে.....
ছপছপ করে রাস্তার জমা জলে পা ডুবিয়ে, জল ছড়িয়ে অকারণ বকম বকম করতে করতে এগিয়ে আসছিল ওরা। হ্যাঁ, ওরাই। সব জায়গাতেই ওরা একসঙ্গে। কি স্কুল, কি খেলার মাঠ, মেলা, সার্কাস, পুতুলনাচ, কুলপি মালাই, রঙবেরঙের কাঠি বরফ, চিত্রহার, অনুরোধের আসর, পাড়ার ফাংশন.... সব জায়গায়। ওদের একজন আরেকজনের পাশের বাড়িতে ভাড়া এসেছে বেশ কয়েক বছর হবে। না বোঝা অংকগুলো ছুটির দুপুরে একসঙ্গে করে নেওয়া, ট্রান্সলেশন না পারলে একজনের কাকুর দুজনকেই সমান কানমলা দেওয়া, একসঙ্গে আচার চুরি, একসঙ্গে পেঁয়ারা গাছে উঠে পেঁয়ারা পাড়া; সবই একসঙ্গে। এই তো সেদিন,যখন ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি এল, তাদের একজন আরেকজনকে বলল, 'চল, 'পথের পাঁচালী'র দুর্গার মতো চুল ভিজিয়ে বৃষ্টিতে ভিজে আসি। ' যেই কথা সেই কাজ; ভরা আষাঢ়ের বৃষ্টি গায়ে মেখে কী ভেজাই না ভিজলো দুজনে।বৃষ্টির জমা জলে উঠোনে কয়েকটা চড়াই যখন স্নান সেরে নিত ; বারান্দায় মেলে রাখা মা কাকিমাদের গন্ধ মাখা ভেজা শাড়িগুলোকে ঘর বানিয়ে খেলতো ওরা। ঝড় বৃষ্টির ছুটির দুপুরগুলো মায়ের গা ঘেঁষে আলো আঁধারি ঘরে বসে গল্প শুনতে শুনতে দুজনের মন একসঙ্গে পাড়ি দিত তেপান্তরের মাঠে। দুজনের চোখে একই স্বপ্ন এঁকে যেত বৃষ্টিঝরা দিনগুলো। খোলা জানলা দিয়ে বাইরের অঝোরে ঝরে পড়া বৃষ্টির ছাট নিতে নিতে কল্পনায় খাট হতো নৌকো.. আর ওরা হতো নৌকোর মাঝি.. যে বেশি চঞ্চল, সে ভয় দেখাত 'বাদলা হাওয়ায় আমাদের ময়ূরপঙ্খীর পাল কেমন উথাল পাথাল; টের পাচ্ছিস? '.....
দুজনেরই মন যে এমন উথাল পাথাল হবে, ওদের কারোরই জানা ছিল না তখন.. পরের আষাঢ়েই বিষন্নতা ছেয়ে গিয়েছিল ওদের মনের আকাশে। যে ভাড়া এসেছিল, তার বাবার চাকরীর বদলীর নির্দেশ এসেছিল। আরেকজনকে সম্পূর্ণ একা করে দিয়ে, নিজেও একাকী হয়ে চলে গিয়েছিল ও। প্রথম প্রথম ওদের বাবাদের দূরভাষে কিছুদিন যোগাযোগ থাকলেও পরবর্তীতে সময়ের স্রোতে সবকিছু অদলবদল হয়ে যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়েছিল একসময়। মনের গহীন কোণে বিশেষ কোনো বর্ষা ফুলের গন্ধ বা নিজেদের নামগুলোই হয়তো ওদের দুজনকে নিজেদের কথা মনে করাতো আকাশ ছেয়ে আষাঢ় আসবার দিনগুলোতে......
টুপুর তার বাবার বদলীর চাকরি সূত্রে কয়েকমাস আগে এখানে এসে রিমঝিমকে বন্ধু করে পেয়েছে। ওদের দুজনের মনের খুব মিল। ঠিক যেন মায়ের কাছে শোনা মায়ের সেই বকুল ফুল সই ।আজ রিমঝিম ওর মাকে নিয়ে প্রথম এলো ওদের এখানকার এই কোয়ার্টারে। মায়েরা, ওরা নিজের নিজের মতো গল্প করছিল যে যার ঘরে। তারপর এই কান্ড। হতবাক হয়ে বারান্দার শেডের নীচে দাঁড়িয়ে ওরা ওদের দুজনের মাকে এই প্রবল বৃষ্টিতে ভিজতে দেখছে। একজনের মা বৃষ্টি, আরেকজনের মা মেঘমালা। বহুবার শোনা মায়েদের মেয়েবেলার একটা গল্প ছবি হয়ে যাচ্ছে ওদের চোখের সামনে। ওদের মধ্যে যে বেশি চঞ্চল, সেই রিমঝিমের চোখে দুষ্টুমি খেলে গেল.. বর্ষার ময়ূর পেখম মেলল ওর মনে.. টুপুরকে শেডের বাইরে নিয়ে যেতে যেতে ও বলতে থাকলো 'চল, আমরাও বৃষ্টি আর মেঘমালা হই.... ' বৃষ্টির একটানা শব্দে ওর কথাগুলো হারিয়ে যেতে যেতেও হাসনুহানার গন্ধ মাখা ভেজা বাতাসে রয়ে গেল একমুঠো ভালোবাসা হয়ে.....
রং নির্ণয়
সুদীপা দেব
স্থানীয় একটি সংবাদ পত্রে পেইন্টিং আর্টিস্ট এর কাজ করি। একটু-আধটু আঁকতে পারি বলে বেশ কিছু বছর ধরে কাজটা পাকা হয়ে গেছে ওই অফিসে। নিজস্ব একটা স্কুলও চালাই। লোকজন ইদানিং নাম-টাম জানে আমার। সোশ্যাল মিডিয়ায়ও ছবি দিই মাঝে মাঝে। মোটামুটি চওড়া ফ্রেইন্ডলিস্টে সবার মন্তব্যের উত্তর দেওয়ার সাধ্য আমার নেই। শুধু থাম্ব ইমপ্রেশন দিয়ে দায় সারি। সত্যি বলতে, গতে বাঁধা সবার মন্তব্য পড়াও হয় না । ওইতো একই কথা– বেশ ভালো, খুব ভালো,দারুণ, লাভলী, ইত্যাদি।
বছরখানেক হল শ্রীমতি মৌসুমী সেন নামে একজন আমার ফেসবুক বন্ধু হয়েছেন। তিনি একটু খেঁটেখুঁটে বড়সড় করে মন্তব্য লেখেন। সেগুলো বেশ চোখে পড়ার মতো। খুব আন্তরিকতার ছোঁয়া থাকে। যেন মনে হয় সত্যিই ছবিগুলো তিনি খুঁটিয়ে দেখেন। সম্ভবত তিনি রঙের মানে বোঝেন। তবে আমার ওই দায়সারা অভ্যাসবশত তাঁর মন্তব্যে আলাদাভাবে কোন অভিব্যক্তি প্রকাশ করিনি কখনো। মাঝে মাঝে দু-তিনবার আমাকে মেসেঞ্জারেও লিখেছেন। যেমন একদিন লিখলেন
–মিঃ শুভেন্দু, আপনার ছবিতে অফুরান এক মুগ্ধতা অনুভব হয়। ছবিগুলো 'ন্যাশনাল এক্সিবিশন অফ পেইন্টিং, স্কাল্পচার এন্ড গ্রাফিক আর্টস' এ দেবার মতো।
আমি লিখলাম
–ধন্যবাদ
বিনা দরকারে কারো সাথেই খুব একটা চ্যাট করিনা, মেয়েদের সাথে চ্যাট করতে আরো ভয় পাই।
এরপর আবার একদিন,
–'নকশিকাঁথা' ছবিতে রাইট কর্নারে ব্ল্যাক শেড এর মানে কী? নীল-সবুজ এর কম্বিনেশন টেক্সচার খুব ভালো লেগেছে। ওটাই আর একটু বেশি হতে পারত। গোয়াস পেইন্টিং করেছেন কখনো? গোয়াস এবং এক্রিলিক একই ক্যানভাসে ইউস করা যায়? পছন্দ করেন?
একটু বিরক্ত হলাম। অদ্যিকালের গোয়াস নিয়ে কি দরকার এত? মনে মনে আরো ভাবলাম তুমি কে হে আগ বাড়িয়ে এত জ্ঞান দেবার! ছবিটা আমি এঁকেছি আমাকেই বুঝতে দাও। এবার সৌজন্যমূলক ধন্যবাদটুকু আর দিতে ইচ্ছা করল না। নিজের পছন্দের রং সম্পর্কে কোন উত্তরও দিলাম না। তবু কেন জানিনা পরদিন স্টুডিওতে গিয়ে 'নকশিকাঁথার' সামনে দাঁড়িয়ে অনেক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। এভাবে কেউতো কখনো বলে না! অবচেতনে ওনাকে সমর্থনও করলাম বোধহয়। প্রোফাইল ঘেঁটে দেখলাম ওনার বয়স পঞ্চাশের নীচে। আমার চেয়ে বয়সে প্রায় দু'তিন বছরের বড়। ছবিতে দেখে মনে হয়েছে ব্যক্তিত্বপূর্ণ মুখে একটা সহজ সরল মাধুর্য আছে। যেন কত পরিচিত। উনি একজন ডাক্তার গিন্নি। নামকরা কার্ডিওলজিস্ট প্রদ্যুৎ সেনের স্ত্রী। নিজে ছবি আঁকেন বলে মনে হয় না। কারণ কোন আঁকা ছবি প্রোফাইলে দেখিনি কিন্তু ছবির ব্যাপারে গভীরতা এবং আমার ছবিতে দারুণ উৎসাহ দেখে একটু আশ্চর্য হই।
১৭ই এপ্রিল২০২০, লিখলেন
–বেঙ্গল গ্যালারি অব ফাইন আর্টস এ আপনার এক্সহিবিশনে যাবার খুব ইচ্ছে ছিল। এরপর কখনো হলে আমায় জানাবেন। আপনার স্টুডিও স্ফটিকে একবার যাওয়ার ইচ্ছে রইল। একই শহরে থাকলে নিশ্চয়ই একদিন চলে যেতাম।
এবছর গত ফেব্রুয়ারিতে বিখ্যাত কবি আফসানা আহমেদের কাব্যগ্রন্থ 'শেষ বিকেলের রোদ' এর প্রচ্ছদ এঁকেছিলাম। সোশ্যাল মিডিয়ায় সেখবর পৌঁছে দিলাম। তিনি কমেন্ট বক্সে লিখলেন –কালো রং এত সুন্দর! শিল্পীর তুলিতেই সম্ভব। ছবির লোকায়ত দর্শন আরো বেশি দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে। শুভেচ্ছা রইল, ভালো থাকবেন।
কমেন্ট দেখে মনে বেশ লাগলো।
এর মধ্যে প্রায় গোটা চার পাঁচটি ছবি পোস্ট করেছি। হঠাৎ খেয়াল করলাম গত দেড়মাসে মৌসুমী সেনের কোন কমেন্ট পড়েনি। আর একটা পুরনো ছবি পোস্ট করলাম। সারাদিন অনেক মন্তব্য এলেও যার অপেক্ষা করছি তিনি কিছু লিখলেন না। কাল রাত প্রায় সাড়ে এগারোটার সময় ফেসবুকে দেখলাম
Nabonita Chakraborty is with Mousumi Sen–
"আমাদের সকলের প্রিয় মৌসুমীদি আজ অতিমারীর শিকার। বড্ড তাড়াতাড়ি চলে যেতে হল। দিদি যেখানে থাকো ভালো থেকো।"
সাথে প্রাণবন্ত হাসি মুখের একখানা ছবি এটাচ করা।
বুকের ভেতরটা ধড়াস করে উঠল। দু-তিনবার ভালো করে লেখা এবং ছবি দেখলাম। এবার তাড়াতাড়ি মেসেঞ্জার ওপেন করে দেখি প্রায় মাস খানেক আগে এসএমএস করেছিলেন। দেখতে ভুলে গিয়েছিলাম। লেখা ছিল
–চারদিকের পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠছে, খুব সাবধান থাকবেন।
ইসস, এত উদাসীন কেন হলাম! সেদিনও কি উনি অসুস্থ ছিলেন! একটু যদি জিজ্ঞেস করতাম! কি ভুল করে ফেলেছি! নিজেকে কিছুতেই ক্ষমা করতে মন চাইছে না। চোখ দুটো অজান্তে ঝাপসা হয়ে উঠছে।
অসমাপ্ত ইচ্ছে
নবনীতা
কুয়াশাটা একটু বেশি মনে হচ্ছে আজ ৷ নভেম্বরের শেষ প্রায় ৷ ঠান্ডাও বাড়ছে ক্রমশ ৷ বিকেল হতে না হতেই চারিদিক ধোঁয়াটে হয়ে আসছে ৷আশেপাশের যে জায়গাগুলো নীচের দিকে সেখানে কুয়াশা জমাট বেঁধে আছে ৷ এত কুয়াশায় দূরের পাহাড় প্রায় অদৃশ্য ৷ আশেপাশের দোকানপাট আর হোটেলগুলোই ঝকঝকে আলো নিয়ে কুয়াশা ফুঁড়ে তাদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে ৷
আজ শনিবার ৷ ধীমান কাল রাতে ঢুকেছে দার্জিলিং এ ৷ রাজ্য সরকারের একসিকিউটিভ পোস্টে কাজ করার সুবাদে সরকারি বাংলোতে এসে ওঠে সে প্রতিবার ৷ কখনও কাজে ,কখনও অকাজে ৷ দার্জিলিং তাকে হাতছানি দেয় প্রতি দু তিন মাস অন্তরই ৷ বিয়ে থা করেনি সে ৷ মা বাবাও নেই এখন ৷ পিছুটানহীন জীবনে দার্জিলিং যেন একটুকরো আনন্দের ঠিকানা ধীমানের কাছে ৷ তাই সে বারে বারে ছুটে ছুটে আসে এখানে ৷
ম্যালের যে রাস্তাটা মহাকাল মন্দিরের ঠিক পাশ দিয়ে গ্যাছে সে রাস্তা ধরেই হেঁটে চলেছে ধীমান ৷ এই রাস্তাটা ওর বরাবরের পছন্দের ৷বেশ কিছুটা হেঁটে গেলে বাঁ দিকে একটা বাঁক নেয় রাস্তাটা ৷ ডান পাশে কিছুটা এক্সটেনডেড এরিয়া ...আর তাতে দু একটি বসার জায়গা ৷ এখানে এলেই ঐ জায়গায় একটা বিকেল কাটানো তার গত ক'বছরের অভ্যেস হয়ে গিয়েছে ৷ আজও অভ্যেস মতো সেই উদ্দেশ্য নিয়েই হাঁটতে শুরু করেছে সে ৷কিন্তু একটু দূর থেকেই লক্ষ্য করে আজ যেন চেয়ারটায় কেউ একজন বসে আছে ৷ কুয়াশার জন্য স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না তাকে ৷কাছে গিয়ে দেখা উচিৎ মনে করে ধীমান ৷ কে জানে পাশে যদি বসার অনুমতি মেলে ৷ তবে তার জন্য যে চমক অপেক্ষা করে আছে তা কাছে গিয়ে বুঝতে পারল ৷ চেয়ারে বসে মধ্য চল্লিশের মহিলাটি আর কেউ নয় ...নীপা !
হারিয়ে যাওয়া দীর্ঘ কুড়িটা বছর যে একদিন আচমকাই এভাবে সামনে এসে দাঁড়াবে...কখনো ভাবেনি ধীমান ৷ পা দুটো হঠাৎই বেজায় বিদ্রোহ করে ওঠে ৷ এক পা সামনে এগিয়ে যাওয়ারও শক্তি হারিয়ে ফেলে ৷এভাবে কতটা সময় কেটে গেল বুঝে ওঠার আগেই নিজেকে নীপবীথির সামনে আবিষ্কার করে ধীমান ৷ মুহূর্তের উত্তেজনায় এবং ঘটনার আকস্মিকতায় থতমত খেয়ে যায় উভয়েই ৷
প্রথমটা কেউ-ই বুঝে উঠতে পারে না কী বলবে ৷ খানিক সামলে নীপবীথিই বলে ...
-"আরে ধীমান বাবু যে !! আপনি এখানে ?
একা নাকি...?
বরাবরের মতো একটা হাল্কা হাসি টেনে ,প্রশ্ন এড়িয়ে যায় ধীমান ৷
বলে...-" তুমিও তো একা দেখছি ..."
- " কই ....না তো ৷ এই তো আপনি আছেন ৷"
বলেই নিঃশব্দ হাসিময় চোখে জরিপ করতে থাকে নীপবীথি ধীমানকে ৷
শুকনো হাসে ধীমান ৷
দীর্ঘ কুড়ি বছর...কম কথা নয় ...তবুও জীবনের বিশেষ কিছু অধ্যায় ভোলার নয় ৷ নীপবীথির স্বভাবে কথায় একটা সহজাত স্মার্টনেস আর রসিকতা আছে ৷ আর সেটা বরাবরই অস্বস্তিতে ফেলত ধীমানকে ৷আজও তাই হল ৷
- "কতদিন পর দেখা হল বলুন তো ? "
নীপবীথির প্রশ্নে একটু হাসার চেষ্টা করেন ধীমান ৷ কিন্তু হাসি ঠিক এল না ৷ আসলে দীর্ঘদিন যার স্মৃতিতে ডুবে থেকে বারে বারে এখানে ছুটে আসা,যাকে একটিবার সামনে পাওয়ার জন্য মনে মনে মহাকালকে হাজার বার ডাকা ....সে যদি আচমকা এভাবে সামনে এসে যায় , তবে বিশ্বাস করতে একটু তো সময় লাগেই ৷
হালকা করে চোখ বুলিয়ে নেয় নীপবীথির মুখে ধীমান ৷ নীপা ...তার নীপা ...আজ এতদিন পর ....তার সামনে !! উফ্ কী যে এক উত্তেজনা ভেতর ভেতর চলছে ধীমানের বলে বোঝানোর নয় ৷ এই মধ্য চল্লিশে এত আবেগ আসছে কোথা থেকে সে নিজেও বুঝে পাচ্ছে না !
নীপবীথিকে শেষ বিকেলের আলোতে কি ভীষণ মোহময়ী লাগছে ! ঠিক আগের মতোই ৷বয়স ছুঁতে পারেনি কোনভাবেই ৷ কোথাও কোন জড়তা নেই , কোথাও কোন বাঁধা নেই ,যেন একটা পাহাড়ী নদী ৷ সদা উচ্ছ্বল ... সদা তৎপর ৷ কী একটা যেন আছে ওর মধ্যে ৷ এত টানে ! খুব সুন্দরী নয় ,অথচ নজর কাড়ে ৷ খুব চটকদার নয় অথচ আলাদা করে নিজেকে তুলে ধরতে জানে ৷ কিভাবে যেন সবার মাঝে থেকেও স্বতন্ত্র থাকতে পারে নীপা ৷
-" কী ব্যাপার মশাই কী ভাবছেন এত ? "
নীপবীথির কথায় সম্বিত ফেরে ধীমানের ৷
-" কই ...না তো...কিছু না ৷ "
-"তারপর ? এখানে যে... ঘুরতে নিশ্চয়ই ?" বলে নীপা৷
কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে যায় ধীমান ৷
পাল্টা প্রশ্ন করে ..
-"তোমার এখানে আসাও নিশ্চয়ই ঘুরতে ?"
চুপচাপ অন্যদিকে চোখ ঘুরিয়ে নেয় নীপবীথি ৷
কি বলবে ...ভেবে পায় না সে ৷ বলা কি আদৌ উচিত হবে ? নাকি বলে কোন লাভ হবে ধীমানকে ৷ ওতো কোনদিনও বোঝেইনি নীপবীথিকে ৷
সেদিনও নির্বিকার ছিল ....আজও তাই থাকবে হয়তো ৷ তাছাড়া এখন এতদিনে ঘর সংসার হয়েছে নিশ্চয়ই ৷
"আজ খুব ঠান্ডা ৷ চলো হাঁটতে হাঁটতে কথা বলা যাক ৷ ঠান্ডা বাড়ছে ৷ এখানে আর বসে থাকাটা উচিত হবে না ৷ বয়স হচ্ছে তো ৷ "
একটা অবিশ্বাসের হাসি আপনা থেকেই ছড়িয়ে পড়ে নীপবীথির মুখে ৷ধীমানের থেকে এমন প্রস্তাব এ জীবনে কখনও পাবে আশা করেনি সে ৷ তাই বলেই ফেলে...-"আপনি ?...হাঁটবেন ? আমার সাথে ?"
মুখ থমথমে হয়ে যায় ধীমানের ... ৷
কথা বাড়ায় না নীপবীথি ৷ মৌন সন্মতি জানিয়ে গায়ের চাদরটা একটু আটোসাটো করে ধীমানের সাথে পা মেলায় ৷
পাহাড়ে সন্ধ্যা ঝুপুস করে নেমে আসে ৷ স্ট্রিট লাইটগুলো এই কুয়াশার সন্ধ্যায় মলিন হয়ে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকে , ক্লাসের লাস্ট বেঞ্চে শাস্তি পাওয়া ছাত্রটির মতো ৷
ধীমান আর নীপবীথি হাঁটতে থাকে ৷ দুজনেই চুপচাপ ৷ দীর্ঘ রাস্তাটা জুড়ে খালি কুয়াশা আর হঠাৎ করে আসা এক আধ জন মানুষ তাদের নৈঃশব্দের মাঝে ঢুকে পড়তে থাকে ৷ এমনই এক পাহাড়ি রাস্তায় পাশাপাশি হাঁটার কত ইচ্ছে ছিল একসময় নীপবীথির ৷ আজ এতদিন পর কেন যে এসব হচ্ছে তার সাথে ? বরাবর তার সাথে এমনটা ঘটে ৷ সময়ের ব্যাপার সময়ে হয় না কিছুতেই ৷ আর যখন হয় তখন কিছুতেই একটা সুন্দর পরিণতি পায় না তা ৷ অর্ধেক জীবন এভাবেই কাটল ৷
নৈঃশব্দ ভাঙে ধীমান ৷
"কেমন আছ নীপা ? "
- ভেতর অব্দি কেঁপে ওঠে নীপবীথির ৷এ নামেই তো ডাকত সে তাকে...কিন্তু চুপ করে থাকে ৷কিছু বলতে পারে না আবেগে, গলা কাঁপার ভয়ে ৷ তার চুপ থাকাকে একসময় ভয় পেত ধীমান ৷ এই মুহূর্তে ঠিক সেই ভয়টাই আবার অনুভব করল যেন ৷তবু ভয় কাটিয়ে আবার বলল...
-" জিজ্ঞেস করলে না তো একবারও আমি কেমন আছি ? " কথাটা বলেই ধীমান বুঝতে পারে একটা ভুল কিছু বলে ফেলল হয়ত সে ৷ আড় চোখে নীপবীথির অভিব্যক্তি বোঝার চেষ্টা করে ৷ প্রায়ন্ধকার এই জায়গাতেও ধীমান স্পষ্ট বুঝতে পারে এক দুর্বাশা দৃষ্টি তাকে ভস্ম করে দিচ্ছে ৷
- "আপনি তো বলতেনই আপনি ভালোই থাকেন সবসময় ৷ তাই সে প্রশ্ন করব কেন খামোখা ? আর আমার কথা যদি বলেন...তো ভালো থাকতে শিখে গেছি ৷ নিজের ভালো লাগাটা যখন অন্য কেউ গুরুত্ব দেয় না, তখন নিজেকেই সে গুরুত্বটা বুঝে নিতে হয় ৷" কথাগুলো ইচ্ছে করেই কেটে কেটে বিঁধিয়ে বিঁধিয়ে বলে, নীপবীথি ৷
ধীমান বুঝতে পারে কথা ক'টা তাকে উদ্দেশ্য করেই বলা হল ৷ নীপবীথির ভালোলাগাকে একদিন উপেক্ষা করেছিল সে ৷ আকুল হয়ে নিজেকে সমর্পণ করতে চেয়েছিল তার কাছে সেদিন তার নীপা ৷কতবার কতভাবে যে নীপবীথি তার আত্মসম্মান,আত্মাভিমান বিসর্জন দিয়ে নিজেকে ধীমানের কাছে মেলে ধরেছিল তার ঠিক নেই ৷ কিন্তু ঠিক ততবারই চুপ থেকেছে ধীমান ৷ আসলে ধীমানের সমস্যাটা কোনদিন বুঝতেই চায়নি নীপা ৷ নীপবীথিকে যে সে সত্যিই কতখানি ভালোবাসত তা সেই জানে ৷ আর সেইজন্য সে চায়নি তার নীপা তার সাথে লড়াই করুক , জীবন সংগ্রাম করুক ৷ বরং চেয়েছিল নীপা রাজরানী হোক ৷তার যোগ্য সংসার পাক ৷ কি করে বোঝায় সে নীপবীথিকে ? সময় সুযোগ অনুকূলে না থাকলে মানুষ শুধু ইচ্ছে দিয়ে কিছুই করতে পারে না ৷ তখন কতই বা বয়স ধীমানের ...পঁচিশ /ছাব্বিশ ৷সদ্য কলেজের পার্ট টাইমের চাকরীটা পেয়েছে ৷ জীবনের তুমুল সংগ্রামের রাস্তায় দাঁড়িয়ে ...একা ৷ নীপা তখন তৃতীয় বর্ষ , বোটানী অনার্স ৷কি করে সে ফুলের মতো একটা মেয়ের জীবন সেই কাঁটার পথে নিয়ে যায় ! কিন্তু অবুঝ নীপা যে কান্ড করে বসে সেই রাতে তাতে তাকে আটকানোর একটাই রাস্তা তার মনে তীব্র বিদ্বেষ তৈরি করা ৷তাই করেছিল সে ৷
সে বছর কুড়ি আগের কথা ৷ ধীমানের আজও স্পষ্ট মনে পড়ে সেই জানুয়ারি মাসের রাতটির কথা ... কনকনে ঠান্ডা ...এই দার্জিলিং শহর...
এক্সকারশন ...হোটেলের পিছনের সেই সবুজ লন...ঘন কুয়াশা ....ক্ষণেকের জন্য দুটো ছায়া মূর্তির এক হয়ে যাওয়া....আর তারপর ...ঠিক তারপরই হঠকারীর মতো সজোরে এক ধাক্কায় নীপাকে সে সরিয়ে দেওয়া ৷ সেই রাতটা একটা সুন্দর রোমান্টিক পরিণতির দিকে যেতে পারত ৷ কিন্তু সবার ভাগ্যে সুখ সয় না ৷ এই ঘটনার পর নীপা ধীরে ধীরে হারিয়ে যায় ধীমানের জীবন থেকে ৷ পুরোপুরি ৷
জীবন সংগ্রামের ঐ সময়ে সেও আর খুব বেশি আবেগকে প্রশ্রয় দেয়নি ৷ তবে জীবনে থিতু হওয়ার পর এই দার্জিলিং কে আকড়ে ধরেছে ৷
উফ্ !! আর ভাবতে পারে না ধীমান ৷ মাথাটা ঝিমঝিম করে ওঠে ৷ প্রেসারটা কি বাড়ল নাকি ! টাল খেতে গিয়েও সামলে নেয় নিজেকে ৷ সাথে সাথে তাকে ধরে ফেলে নীপবীথি ৷
-" কি হল শরীর খারাপ নাকি আপনার ? পড়ে যাচ্ছিলেন তো ৷ চলুন আর হেঁটে কাজ নেই ৷ কোন্ হোটেলে আছেন ? সাথে এসেছে কেউ ....স্ত্রী বা ছেলেমেয়ে ... ? "
অনুশোচনার হাসি হাসে ধীমান ৷ কি করে বলবে সে .....কাউকেই সাথি করতে পারেনি এতগুলো বছরেও ৷তাই উত্তরসূরিদেরও দেখা পায়নি এ জীবনে ৷ সবার মধ্যেই যে সে নীপবীথিকেই খুঁজে চলেছে বারবার ৷ তাই মায়ের হাজারো অনুরোধ , দাদার বকাবকি কোনটাই গ্রাহ্য করেনি সে একদিন ৷
- "চলুন ফেরা যাক তবে ৷ " আলতো করে ধীমানের হাতটা ছুঁয়ে বলে নীপবীথি ৷ হোটেলের পথে হাঁটতে থাকে দু'জনে ৷ শীত জাঁকিয়ে আসছে ৷
নীপবীথির মনে পড়ে যায় অনেক কিছু ৷ এসব তো ভোলার নয় ৷ ভোলা যায় না চেষ্টা করেও ৷ আজ কুড়ি বছর ধরে মনে মনে যাকে সবচেয়ে কাছের জায়গাটি দিয়ে রেখেছে , যে মানুষটির স্মৃতিকে আশকারা দিতে ফি বছর সে দার্জিলিং - এ আসে ৷ ঐ হোটেলেই ওঠে ৷ঐ লনেই বসে থাকে ঘন্টার পর ঘন্টা... আজ এতদিন পরে সেই মানুষটি তাকে ধরা দিয়েছে ৷ ঠিক ওর কাছেই ..ওর পাশেই হাঁটছে ..!! উফ্ এ যে কি পরম পাওয়া...!!বলে বোঝানোর নয় ৷
নাহ্ এই মুহূর্তটি অক্ষয় থাকুক তার জীবনে ৷ এর বেশি কিছু চেয়ে এই পাওয়াটুকুকে অপমানিত করতে চায় না এখন আর নীপবীথি ৷ বয়স বেড়েছে ৷ ধৈর্য , বুদ্ধি সবেতেই পরিণত হয়েছে সে ৷ কুড়ি বছর আগের নীপবীথির চাহিদার সাথে এই নীপবীথির চাহিদার পার্থক্য অনেক ৷ তাছাড়া যে এন .জি.ও তে সে কাজ করে , আজ এখানে কাল ওখানে করে বেড়াতে হয় বছরভর ৷ বিশাল এক সংসারের বিশাল দায়িত্ব তাঁর নির্ভরযোগ্য কাঁধে চাপিয়ে রেখেছে কর্তৃপক্ষ ৷ তবে আজ যা পেল সে, তাতে তার আগামী দিনগুলিতে বেঁচে থাকার জন্য রসদ হয়ে গেল ৷ এতদিন ধরে এখানে আসার উদ্দেশ্যতে এবার ইতি টানলেও চলবে ভাবে সে ৷
এসব ভাবতে ভাবতেই নীপবীথির হোটেল চলে আসে ৷ ধীমানকে শুভরাত্রি জানিয়ে হোটেলের লনে চুপচাপ এগিয়ে চলে নীপবীথি ৷ হোটেলের রাস্তাটা যেন একটু বেশি দীর্ঘ হয়ে উঠেছে এই মুহূর্তে ৷ নীপবীথি মনে মনে চাইছে ধীমান একবার ডাকুক তাকে , ফিরে আসুক তার কাছে ৷ হাজারো জমিয়ে রাখা কথা বলে যাবে সারা রাত ৷ অনেক অভিমান ,দুঃখ চাপা আছে সেসব আর রাখবেনা যদি সুযোগ পায়৷কিন্তু না..সেরকম কিছু হল না ৷
চোখের ম্লান হাসিতে বিদায় জানিয়ে সামনের দীর্ঘ রাস্তা ধরে নিজের গন্তব্যের দিকে পা বাড়িয়ে ধীর পায়ে চলতে থাকে ধীমান ৷যদিও পা চলছে না তার ৷ক্লান্তিটা চেপে ধরেছে যেন ৷ধীমান মনে প্রাণে চাইছিল নীপবীথি একবারটি ডাকুক ওকে ৷ নীপার সাথে আরো অনেকটা সময় কাটানোর ইচ্ছে হচ্ছিল ধীমানের ৷আসলে একটা সুযোগ চাইছিল সে ৷ কিছু পুরোনো বোঝাপড়া ..কথা বলে মিটিয়ে নেওয়া যেত যদি !! ৷ একটিবার শুধু....৷ কিন্তু না এমন কিছু ঘটে না ৷ একটা জড়তা থেকে কেউ কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারেনি পরিবার ,পরিস্থিতির কথা ৷ আর জেনেই বা কী লাভ...ধীমান ভাবে শুধু শুধু ওর সুখের পৃথিবীর ঠিকানা নিয়ে নিজের কষ্ট বাড়িয়ে তোলা ৷
তার চলে যাওয়ার দিকে ভীষণ এক আক্ষেপ নিয়ে তাকিয়ে থাকে ধীমান ৷ নীপবীথির শরীর ধীরে ধীরে কুয়াশার আড়ালে ঢাকা পড়তে থাকে ৷ আর সেই সাথে হয়ত চিরকালের মতো অসমাপ্ত রয়ে যায় ধীমানের একান্ত ইচ্ছেটুকুও ৷৷
আল্লাহর মেহেরবানি
অদিতি মুখার্জী সেনগুপ্ত
সারাটা রমজান মাসে, হাওড়া জেলার খড়ুবেরিয়া গ্রামের ভাগ চাষী রফিক মিঞা আল্লাহর কাছে একটাই দোয়া করেছেন যেন এ বছর ভালো বৃষ্টি হয়। গতবছর খরায় তার জমির ফসল সব নষ্ট হয়ে গেছিল। মহাজনের কাছে প্রচুর ধার দেনা হয়ে গেছে। তার ওপর জমিটাও তো তার নিজস্ব নয়। যদিও বা সরকার অনুদান দিয়েছিল, সবই জমির মালিক, পয়সা পিচাশ,আবদুল্লাহ তা আত্মসাৎ করেছিল। খুবই কষ্টে দিন কেটেছে রফিক মিঞার পরিবারের। পয়সার অভাবে মাকেও হারাতে হয়েছে বিনা চিকিৎসায়। ছোট্ট ছেলেটার মুখের দিকে চেয়ে বড়ো মায়া হয়। সেদিনই তো বলছিল, "আব্বু, এবার রমজানে আমায় আম্মি মাংস রেঁধে খাওয়াবে তো?" ছোট্ট ছেলে কি অত শত বোঝে? রফিক মিঞা চোখের জল সংবরণ করে বলেছিল," হ্যাঁ রে বাপজান, বৃষ্টি ভালো হলে চাষ- আবাদ ও ভালো হবে আর তখন আমাকে পায় কে। মহাজনের সব দেনা শোধ করেও হাতে কিছু থাকবে। তখন রমজানে যা চাইবি, তাই খাওয়াবো।"
রফিক মিঞার ভাই, রিফত মিঞার আবার একটাই ভয়। অতিবৃষ্টিতে তে তো তার নিচু জমির ফসল সব ধ্বংস হয়ে যাবে। ঘরের চাল ও তো সেই আগের ঝড় জলে উড়ে গিয়েছিল। কোনোরকমে সেটা কে ঠিক করেছে। রফিক মিঞা ভাইকে ভরসা যোগায়। বলে,"আল্লাহর ওপর বিশ্বাস রাখ ভাইজান। ওনার রহমতে আশাকরি ভালোই হবে।
প্রত্যেক দিনের মত আজও রফিক মিঞার জমির আলে বসে দুরের মেলগাড়িটা কে যেতে দেখল। "পথের পাঁচালীর" অপু আর দুর্গার মত, রফিক মিঞা আর ওর ছোট্ট ছেলে, সিরাজ ও চলমান ট্রেন দেখতে ভীষণ ভালোবাসে। হঠাৎই সিরাজ চিৎকার করে উঠল,"আব্বু, এই দেখো আকাশ কেমন কালো করে এসেছে।" বলতে না বলতেই এক দু ফোঁটা বৃষ্টির জল ওদের গায়ে এসে পড়ল। বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে বাপ-বেটা দুজনেই ভিজে গেল। রফিকের মনে আশার আলো জাগল।
সত্যিই সে বছর আল্লাহর রহমতে বৃষ্টি ভালই হল আর রফিক মিঞার জমি শস্য শ্যামলা হয়ে উঠল। রিফত যে ভয়টা করেছিল সেটার থেকেও মুক্তি পেল। ওর জমির ফসল ও ভালোই হল। মহাজনের সব ধার মেটাতে পেরেছে রফিক মিঞা আর রিফত মিঞা। আবদুল্লাহ অবশ্য এক চতুর্থাংশের বদলে অর্ধেক ভাগ নিয়েছে যেহেতু আগের বছর খরার জন্যে সে ভাগ পায়নি। তবুও আল্লাহর রহমতে রফিকের আর রিফতের লাভই হয়েছে। দুই ভাই মিলে হর্ষোল্লাসের সাথে রমজান পালন করবে ঠিক করল। ছোট্ট সিরাজ ও খুব খুশি কতদিন পর আম্মির হাতের ভালো-মন্দ রান্না খেতে পারবে। কবি ঠিকই বলেছেন,"বর্ষারানী আসছে, কৃষকেরা হাসছে।"
বিট্টু সুজাতা কর
কাঠবিড়ালিটা মুন্নিরহাটের ওপর দিয়ে উঠে মাথায় চড়ে বসল।দুবার ব্যস্ত ভঙ্গিতে কিচমিচ কিচমিঢ করে লাফ দিল সামনের অপরাজিতা গাছে।লতানো গাছটায় লাফ দিয়েই বুঝল ভুল করেছে আবার লাফ দিল,এবার ভারেন্ডা গাছের গায়।মুন্নি খিলখিল করে হেসে উঠল।কাঠবিড়ালিটাকে সে ডাকে বিট্টু।তার পোষমানা। রোজ দুপুরে সে এই বাগানে বিট্টুর সঙ্গে খেলা করে।বিশ কাঁঠা জমির ওপর তাদের বাড়ি।দশ কাঁঠায় বসত বাড়ি,দশ কাঁঠায় বাগান।তার দাদু মনি সান্যাল তার জীবদ্দশায় দু ছেলের জন্য কাপড়ের দোকান,সুপারির ব্যবসা করে দিয়ে গেছিলেন।ছেলেরা বাপের মৃত্যুর পর কম্পিটিশন এ টাকা ওড়ানো শুরু করলো।যার ফলে হলো দশ বছরে দুই ব্যবসাই লাটে উঠতে বসেছে।ধার -কর্য এত হয়েছে যে সংসার চলা দায় ।মুন্নি মনি সন্যালের বড়ো ছেলে মনোজের মেয়ে।দশ বছর বয়স।স্কুলে যাওয়া ছাড়া সারাদিন কাটে এই বাগানেই।বিট্টু ছাড়াও তার কাছে আসে মিনি বেড়াল,জাম্বো কুকুরের মিঠিয়া টিয়া।
মুন্নি শুনল মা ডাকছে, 'মুন্নি বাড়ি আয়, ঘুমোবি'। মুন্নির মা মিষ্টি।সত্যিই সে মিষ্টি।টকটকে রং আর টুকটুকে লাল ঠোঁট।সব সময় মুখে হাসিটি লেগে আছে।সেটা সবার সামনে,আসলে সে অনেক চোখের জল ফেলে।সে ভালো জানে মনোজ ডুবছে,সাথে তারাও।বাড়িতে জনা পনেরো লোক,তিনটের আগে মা মুন্নিকে ঘুমোতে ডাকতে পারেনা।মুন্নি দুপুরে খাওয়ার পর এই দেড় ঘন্টা সময় কাটায় তার পোষ্য দের সঙ্গে।মুন্নি ঘরে এসে দেখল বাবার সঙ্গে মায়ের কথা কাটাকাটি হচ্ছে।মিষ্টি বলছে,'তুমি বাড়িটাও ছাড়বেনা,এমন বড় বাড়ি,বড় বড় ঘর,মন্দির।কোথায় পাবো ফ্ল্যাটে?মুন্নি সারাদিন বাগানে খেলে।কোথায় আমরা এসব পাবো তুমি প্রমোটারের হাতে বাড়ি তুলে দিলে'। মনোজ ভেংচি কাটলো,'হু মন্দির আর বাগান ফলছেন উনি।বলি এরপর হাঁড়ি চড়বে কিনা সে খেয়াল আছে?আজ সন্ধ্যায় প্রমোটার চাকলাদার বাবু আসবেন।জল-মিষ্টি পাঠিয়ে দেবে বসার ঘরে'।মনোজ দমদম পা ফেলে শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।হঠাৎ ফিরে এসে মিষ্টির দিকে তাকিয়ে বলল,'না পোষায় যদি বাপের বাড়ি চলে যাবে'।মুন্নি দেখল মা দু হাতের তালুতে মুখ ঢেকে বসে আছে।মুন্নি গিয়ে জড়িয়ে ধরে কি হয়েছে মা,বাবা বকেছে তোমায় ?' মিষ্টি শক্ত করে মুন্নিকে বুকে চেপে ধরে।
সন্ধ্যাবেলা মুন্নি দেখল বেজায় মোটা এক ভদ্রলোক সঙ্গে কমবয়সী একটি ছেলে গাড়ি থেকে তাদের বাড়ির সামনে নামল।মুন্নি এই সময় তাদের বাড়ির সামনে সাইকেল চালায়।মোটা ভদ্রলোক তার গেল টিপে দিয়ে বলল,'এই যে খুকি মনোজ বাবু তোমার কে হন?'মুন্নি বলল,'আমার বাবা হন'।
'তাকে বলো চাকলাদার আঙ্কল এসেছেন'। মুন্নি সাইকেল দাঁড় করিয়ে দৌড়ে ভেতরে গেল বাবাকে ডাকতে।চাকলাদার ঘুরে ফিরে বাড়ির চারপাশ দেখতে লাগলেন।এই অঞ্চলটা ঠিক শহরে নয়,শহরের একটু বাইরে।কিন্তু এখন এমন জায়গাই পছন্দ করে।নির্মল বাতাস,শব্দ দূষণ,বায়ু দূষণ -সব কিছুর থেকে দূরে একটি নিজস্ব খাঁচা।সবকিছু থাকবে।বৈভব-ঐশ্বর্য।ইন্টেরিয়র ডেকোরেশন করা ড্রয়িং রুম, বেড রুম, টয়লেট।জীবন্ত প্রাণী বলতে কোনো দামি ব্রিডের বিদেশি কুকুর আর নিজেরা।চাকলাদার উচ্চ-মধ্যবিত্ত,উচ্চবিত্তের নার্ভটা একদম ধরে ফেলেছেন।তবে মনোজকে এসব কথা বলা চলবেনা,বলতে হবে বড্ড দূর শহর থেকে।জমির দাম তেমন উঠবেনা।চাকলাদার খুব একটু হেসে নেন মনে মনে,'হে,হে,হে'।
মুন্নি জল-মিষ্টি দিতে গিয়ে শুনল তাদের বাড়ি আর বাড়ি থাকবে না।ফ্ল্যাট উঠবে এখানে।তাদের বসত বাড়ি আর বাগান নিয়ে তৈরী হবে চাকলাদারের স্বর্ণমহল হাউসিং কমপ্লেক্স।মুন্নি কিছু বুঝল কিছু বুঝল না।শুধু তার দশ বছরের আধফোটা, অবোধ শৈশবের অপরিণত বুদ্ধি তাকে জানান দিল তার বিট্টু,মিনি,জাম্বো,মিঠাই ভীষণ বিপদে পড়তে চলেছে।বিট্টু হয়তো মারাই পড়বে।পরদিন থেকে মুন্নির আর স্কুল যেতে ইচ্ছে করলো না।সে মাকে বললো তার শরীর খারাপ।সে খেলনা ঠিকমতো।দুপুরে বিট্টু কাছে আসতেই সে আতঙ্কে কেঁপে উঠল।বিট্টুকে বুকে জড়িয়ে,জাম্বকে আদর করে,মিনির মাথায় হাত বুলিয়ে বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,'কেউ না,কেউ তোদের আমার কাছ থেকে নিয়ে যেতে পারবে না'।সে রাতে সত্যিই মুন্নির জ্বর এলো।জ্বরের প্রবল তারসে মুন্নি ভুল বকতে লাগলো।মিষ্টি-মনোজ সারারাত মুন্নির মাথায় জল ঢালতে লাগলো।ভোরবেলা মুন্নি চোখ খুলে মিষ্টির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,'চাকলাদার আঙ্কল কি বিট্টুকে মেরে ফেলবে মা? বিট্টু যে গাছ ছাড়া বাঁচেন।সব গাছ কেটে ফ্ল্যাট হলে ও কোথায় যাবে মা? আমার বিট্টুকে বাঁচিয়ে দাও মা,আমার বিট্টুকে বাঁচিয়ে দাও'।মিষ্টি শক্ত হাতে মেয়ের হাত ধরে বসে থাকে।
ছড়া/ কবিতা