Monday, February 20, 2023

আমন্ত্রিত কবিতা
 

এই ২১ 

সুদীপ দত্ত 


এই ২১ এ 
তুই আমাকে বর্ণমালার মতো ভালবাসা দিয়ে যা মনীষা
অ আ ই-- নিষ্পাপ বর্ণের কাছে ভালবাসা রেখেছি সদ্য
শিউলিময় নিষ্কলুষ প্রথম প্রভাতে। 
মায়ের ক্ষীণকায় শাঁখা, বাবার গন্ধ মাখা ঘাম- পাঞ্জাবি। হালকা  লাল মলাটে লেখা বর্ণ পরিচয়। 
বাবার হাত ধরে স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ লিখতে লিখতে 
ক্রমশ বড় হয়েছি অথচ মনীষা, দিন দিন প্রতিদিন 
পল পল প্রতি পল 
ছোট হয়ে এসেছে বাবা, মা এমন কী ভালবাসার সবুজ ছায়াও।
এখন শূন্য মরূদ্যানে  বর্ণমালার মতো ভালবাসা অথবা, ভালবাসার মতো বর্ণমালা খুঁজে ফিরি মনীষা। 
তুই আমাকে বর্ণমালার মতো ভালবাসা  দিয়ে যা মনীষা
এই ২১ এ --


 বন্দনা  


বাংলা ভাষা বন্দনা
মৌমিতা মোদক 

আমরা বাঙালি
বাংলা আমাদের মাতৃভাষা।
তোমাকে শিখে জীবন গর্বে ঠাসা।
অ আ দিয়ে শুরু তুমি বর্নপরিচয়,
অ তেই অন্তিম;
মায়ের মত আগলে রাখো-
তুমি অপরাজেয় তুমি অসীম।
তুমি শুষে নাও জীবনে যত আছে না পাওয়া,
তোমার চর্চায় বদলে যায় নীমেষে দূষিত বাতাস,
বদলে যায় আবহাওয়া।
বাংলা ভাষা মোদের পরম পাওনা পরম আশীর্বাদ,
তোমায় অমরত্ব দিতে রক্ত ঝরিয়ে বারকত, আহমাদরা বেছে নিয়েছিল মৃত্যুখাদ।
মাথার উপর ছাদ তুমি প্রিয় মাতৃভাষা,
তোমায় দিলাম-
গোলা ভরা ধান আর উজার করা ভালোবাসা।



 

প্রবন্ধ 


আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ভাবনা

                   বিনয় বর্মন




ইউনেস্কো ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর প্রথম ঘোষণা করেছিল  আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ভাবনা l সে হিসাবে এ বছরে তার ২৪ তম বর্ষ উদযাপন হচ্ছে l এবারের থিম : Multilingual education - a necessity to transform education . 
রাষ্ট্র সংঘ ২০০৮ সালকে ইন্টারন্যাশনাল ইয়ার অফ ল্যাঙ্গুয়েজ বলে ঘোষণা করে l

       ভাষা শুধু আমাদের প্রকাশের মাধ্যম নয় , আমাদের আত্মপরিচয়ও l সারা পৃথিবী জুড়ে প্রায় ৭ হাজার ভাষার অস্তিত্ব আছে l কিন্তু প্রধান কিছু ভাষা বাদে বাকি বেশিরভাগ ভাষার অস্তিত্বই আজ সংকটের মুখে l কোন একটি ভাষা বহন করে যুগ যুগান্তর থেকে লালিত একটি জনগোষ্ঠীর জ্ঞান , মেধা ও সংস্কৃতির l একটি ভাষা গোষ্ঠীর ভাষার মধ্যে লুকিয়ে থাকে লোক-বিজ্ঞান লোক-ঔষধি ও কৃষিকর্ম ও তাদের কারু শিল্প ও চারু শিল্পের জ্ঞান l একটি ভাষা হারিয়ে যাওয়া মানে, সেই ভাষার সঙ্গে সম্পৃক্ত যুগ বাহিত জ্ঞান ও সংস্কৃতির বিলুপ্তি l 
ভাষার বিলুপ্তি ঘটে মূলত সেই ভাষায় বাচকের সংখ্যা কমে যাওয়ায় l কমতে কমতে কোন ভাষায় যখন বাচকের সংখ্যা শূন্য হয়ে যায় তখন তার অবলুপ্তি ঘটে  l

কম সংখ্যক বাচক যুক্ত জনগোষ্ঠীর ভাষা গুলো ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে l এর জন্য নানাবিধ অর্থনৈতিক , সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণ যুক্ত l তথাকথিত উন্নত বা বৃহত্তর সংস্কৃতির আগ্রাসনে ক্ষুদ্র সংস্কৃতি যেমন হারিয়ে যাচ্ছে , তেমনি বৃহৎ সংখ্যক বাচক যুক্ত ভাষা গোষ্ঠীর আগ্রসনে স্বল্প সংখ্যক বাচক যুক্ত ভাষা গোষ্ঠীর ভাষা গুলো হারিয়ে যাচ্ছে l আমাদের জীবন যাপন সমাজ ব্যবস্থা যেমন রাজনীতিই নির্ধারণ করে , তেমনি কোন ভাষার ভবিষ্যৎ ও বহুলাংশে নির্ধারিত হয় রাজনীতির দ্বারা l রাজনৈতিক শক্তিশালী  ভাষাগোষ্ঠীর দাপটে হারিয়ে যাচ্ছে কত ভাষা  l ভারতবর্ষে প্রায় ১৯ হাজার ৫৬৯ টি ভাষার অস্তিত্ব পাওয়া গেছে l তার মধ্যে বেশির ভাগই প্রায় অবলুপ্তির দোরগোড়ায় l আমাদের এই উত্তরবঙ্গেও একসময় দেড়শ'রও বেশি  ভাষা প্রচলিত ছিল। বর্তমানে বেশিরভাগই বিলুপ্তির দোরগোড়ায় l এক সমীক্ষা অনুযায়ী প্রতি ১৪ দিনে একটি ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে পৃথিবী থেকে।


       উত্তরবঙ্গের মুন্ডারী , আশুরী শবর , কুর ুক , মালপাহাড়ি , কয়া , রাউতিয়া , থারু , ধিমাল টোটো , তামাং , প্রভৃতি ভাষাগুলো আজ অস্তিত্বের সংকটে ভুগছে l

উত্তরবঙ্গের যে সমস্ত জনজাতিরা তাদের পরম্পরাগত ভাষায় কথা বলতেন আজ তাদের বেশিরভাগই বাংলা , হিন্দি , সাদরি , কিংবা নেপালিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠছেন l

      বিশ্বজুড়ে ভাষা সংরক্ষণ ও বিকাশের দাবি উঠছে l  তবে এ বিষয়টি সহজ নয় l রাজনীতি ও সংস্কৃতির আগ্রাসন রুখে দেওয়া সহজ কাজ নয়।

    ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে দেখা গেছে আমাদের ভাষা বাস্তুতন্ত্রের ক্ষেত্রে চারটি স্তর বিদ্যমান। সর্বোচ্চ স্তরে আছে ইংরেজি l উপনিবেশিক ঘোর (colonial hangover ) আমরা এখনো কাটিয়ে উঠতে না পারায় আমাদের প্রশাসনে কাজের ভাষা মূলত ইংরেজি রয়ে গেছে। পরবর্তীকালে শাসক গোষ্ঠীর হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান এই জাতীয়তাবাদী মনোভাব নেওয়ায় পরবর্তী স্তরের ভাষা হিসেবে হিন্দির আগ্রাসান সর্বব্যাপী l দ্বিতীয় স্তরে রয়েছে এই হিন্দি l তৃতীয় স্তরে রয়েছে আঞ্চলিক ভাষাগুলো l যারা তাদের এলাকায় থাকা ছোট ছোট জনজাতির ভাষা গুলোকে গ্রাস করে ফেলছে l

      আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস মানে শুধুমাত্র বাংলা ভাষার অধিকার ও বিকাশের দাবিতে সোচ্চার হওয়া নয়। প্রতিটি জনজাতির প্রতিটি ভাষা গোষ্ঠীর মানুষের ভাষার সুরক্ষা ও বিকাশ যেন নিশ্চিত হয় সে বিষয়ে সরব হওয়া।

দুর্ভাগ্যের বিষয় আর পাঁচটা বিষয়ের মত ভাষার উন্নয়ন ও বিকাশও রাজনীতি শিকার l এই যে নানান ভাষার একাডেমি গড়া হচ্ছে , তা মূলত ভোটকেন্দ্রিক রাজনৈতিক তোষণের ভাবনা থেকে l কোন ভাষার প্রকৃত উন্নয়ন ঘটাতে গেলে তাকে জীবনযাপনের সম্পৃক্ত করতে হবে l না হলে তা কেবলমাত্র প্রসাধনী উন্নয়ন (cosmetic change) হিসেবেই থেকে যাবে l যে ভাষা উচ্চশিক্ষা , গবেষণা , প্রশাসনের দৈনন্দিন কাজের ব্যবহার , কিংবা কর্মসংস্থানের জায়গায় ব্যবহৃত হবে না , তা কি করে টিকে থাকবে এই প্রবল পূঁজি নিয়ন্ত্রিত বাজারে ?
     ভাষার সংরক্ষণ ও সমৃদ্ধি ঘটাতে গেলে তাকে হতে হবে "ফাংশনাল" l যে ভাষা পেটের ভাত যোগাতে পারবে না , এই প্রতিযোগিতা মূলক সমাজ ব্যবস্থায় স্বাভাবিক নিয়মেই তা হারিয়ে যাবে জীবন থেকে l

        অথচ একটি প্রায় মৃত ভাষাকেও কি করে বিকাশের চরম স্তরে নিয়ে যাওয়া যায় তার উদাহরণ আছে আমাদের সামনে l ইজরাইল রাষ্ট্র গঠনের পর প্রায় মৃত হিব্রু ভাষাকে রাতারাতি রাষ্ট্রীয় ভাষায় পরিণত করা হলো l সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে শিক্ষার মাধ্যম উচ্চশিক্ষার ও গবেষণার উপযোগী করে তুলেছিলেন।

     এবারের আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসের মূল ভাবনা :  মাল্টিলিঙ্গুয়াল এডুকেশন বা বহুভাষিক শিক্ষা l এই বিষয়ে ভাবনার অবকাশ আছে l বিশেষত আমাদের দেশে l আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় এলিমেন্টারিস্তরে  ত্রি ভাষা সূত্র অনুযায়ী পাঠদান করা হচ্ছে l আঞ্চলিক ভাষা ( ফার্স্ট ল্যাঙ্গুয়েজ ) , ইংরেজি ( সেকেন্ড ল্যাংগুয়েজ ) ছাড়া তৃতীয় ভাষা হিসেবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সংস্কৃত অথবা হিন্দি শেখানো হচ্ছে। এক্ষেত্রে তৃতীয় ভাষা  ( থার্ড ল্যাংগুয়েজ ) হিসেবে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষাগুলোকে রাখা প্রয়োজন l তাহলে অন্ততপক্ষে কিছুটা হলেও ভাষাগুলোর সজীবতা বজায়  থাকবে l

তথ্যসূত্র  :
১ ) জনজাতিদের ভাষা ....  প্রকাশক :  মাতৃভাষা  
২ ) আলিপুরদুয়ার জলপাইগুড়ির ভাষা পরিস্থিতি /  অর্ণব সেন , (ইতিকথায় আলিপুরদুয়ার , প্রমথ নাথ সম্পাদিত )
৩ ) Wikipedia 
৪ ) ইন্টারনেট


 আবৃত্তি - মিঠু অধিকারী 


  ভাষা দিবসের অন্য কথা 


সব চরিত্র কাল্পনিক নয়

শ্রাবণী সেনগুপ্ত

"বাপ আমার,মাচানের উপর থনে কচি কয়টা লাউ পাতা পাইরা দে
 যা না রে,দুফুরে এটটু চচ্চড়ি রান্ধুম,ভাতের সাথে মানুষডা ভাল খায়।"
দ্রুত পায়ে বেরিয়ে যেতে যেতে মায়ের ডাকে ফিরে আসে ছেলে-মাচা নে উঠে লাউপাতা পেড়ে দিয়ে যায়।মাকে বলে যায়,"মা,আজ ভাল কইরা রান্ধ, আর আমার লগে বইয়া থাইক্য না,আজ আমাগো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থিক্যা একটা মিছিল বাইর অইব বাংলা ভাষারে রক্ষা করনের লাইগ্যা।আমি সেই মিছিলে থাকুম,ফিরতে দেরি অইব,তাই কই না খাইয়া  বইয়া থাইক্য না,তোমরা খাইয়া লইও।"আমিনা কন-"আমার বড়ো ডর লাগেরে বাপ,সাবধানে যাস।"উঠোন থেকে শাজাহান মিঞা কাশতে কাশতে বলেন-"তুমি কিছু চিন্তা কোরোনা গো
নাসিরের মা,এরা সব পুণ্যির কাজে যাইতাছে -মায়ের ভাষার মান রাখতে,ওদের কিসসু হইবনা।"নাসিরউদ্দিন চলে যায় তার আরো কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে।
                           বেলা গড়ায় -ভাতের থালা কোলে নিয়ে বসে থাকেন
আমিনা,বাড়ির সবাই কচি লাউ পাতা ,ডগার চচ্চড়ি দিয়ে সাপটে ভাত খেলেও তাঁর গলা দিয়ে ভাত নামেনা-বুকের কলিজা নাসির যে এখনো বাড়ি ফেরে নাই।হঠাৎ দৌড়ে আসে পাশের গ্রামের সনাতন-"চাচিগো, শুনছনি-আজ যে ব্যাবাক গুলি চলছে গো রাজপথে নাসির ভাইদের মিছিলের উপর,কত মানষে জখম হইছে ,চাচারে একবার আমার লগে আসতে কও।"-আমিনার মাথা চাপড়ানোর মধ্যে দিয়ে পরনের লুঙ্গি কষতে কষতে বেরিয়ে গেলেন শাজাহান মিঞা।সেদিন সারা এলাকায় একটি ঘরেও আলো জ্বলেনি,কতগুলি তরতাজা প্রাণ গুলিবিদ্ধ হয়ে ফিরে এসেছিল-প্রাণ দিয়েছিল তারা তাদের মায়ের জন্য-জন্ম নাভির জন্য।হ্যাঁ,অবশ্যই জয়ী হয়েছিল তারা-আজ মাকে তারা নিজ আসনে অধিষ্ঠিত করতে পেরেছে।
                           বেশ কয়েক বছর পরের আরেক একুশে ফেব্রুয়ারি।আজ আবার আমিনার উঠোনে আলোর মেলা।আশপাশের এলাকার লোকজন জড়ো হয়েছে এই দিনটি পালনের জন্য।ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা আমিনাবিবির বাড়ির সামনের এক চিলতে উঠোনে জড়ো হয়েছে তাদের নগেন দাদার নেতৃত্বে।এসেছে আশেপাশের বাড়ির ময়না,হাসিনা,শেফালী,নয়নারা।সব্বাই আজ জড়ো হয়েছে মাতৃভাষার জন্য উৎসর্গীকৃত দিনটিকে পালন করার জন্য।সস্তা কাঠের টেবিলে মায়ের স্নেহমাখা এমব্রয়ডারির মাঝে হাসিমুখে সেদিনের বীর শহীদ।বড়ো, ছোট কণ্ঠে ভেসে আসে-"আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি।"


 আবৃত্তি- সঞ্জয় সাহা 


 

আবৃত্তি- পূর্ণিমা বোস 


 

প্রবন্ধ 


বাঙালি ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ভুলে যাচ্ছে দিন দিন
বটু কৃষ্ণ হালদার

আ_মরি প্রাণের বাংলা ভাষা,অমি তোমায় বড় ভালবাসি।আমার গর্ব এই ভাষাতেই আমি মা বলে ডাকি। বাঙ্গালীর অতি প্রিয় বাংলা ভাষা বর্তমানে শুধু ভারত বর্ষ নয়,সমগ্র বিশ্বে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।উনিশ শতকের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের রেনেসাঁ শুরু হয় এই বাংলায়। এরপর বাংলাভাষাকে নিয়ে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।স্বামী বিবেকানন্দ,রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর মত মনীষীরা কাঁধে করে বাংলা ভাষা, সাহিত্যকে বয়ে নিয়ে গেছে বিশ্বের দরবারে। ধীরে ধীরে বাংলা ভাষার জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে সমগ্র বিশ্বে।সেই সঙ্গে বাড়তে থাকে বাঙ্গালী জাতির মুন্সিয়ানা।এই বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির টানে বিদেশীরা পাড়ি দেন এই বাংলায়। কিন্তু লজ্জাজনক বিষয় হলো এই বাংলা ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে অনেকেই শহীদ হয়েছেন। তার মধ্যে অন্যতম হলো ১৯৫২ সালে অবিভক্ত বাংলাদেশ,১৯৬১ সালে আসামের শিলচরে বরাক উপত্যকায় ভাষা আন্দোলন অন্যতম।সালটা ছিল ১৯৫২ ,বাংলাদেশ ছিল পাকিস্তানের অধীনে, উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা ঘোষণা করেন।আপামর জনসাধারণ মনে প্রাণে সেই ঘোষণা মন থেকে মেনে নিতে পারেনি, ভুলতে পারেনি যে উর্দু নয়, বাংলা তাদের প্রাণের প্রিয় ভাষা।শুরু হয় বাংলা ভাষার তরে  আন্দোলন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটি এক অমর রঞ্জিত রক্তে রাঙা ইতিহাস হয়ে আছে। স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্র ভাষা হবে বাংলা সে সিদ্ধান্ত জাতীয় কংগ্রেস আগে থেকে নিয়ে ছিল। কিন্তু পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা কি হবে সে সম্পর্কে মুসলিম লীগ কোনো অনুষ্ঠানিক প্রস্তাব গ্রহণের আগে পাকিস্তানে ঠিক হয়ে যায়।পাকিস্তানি প্রতিষ্ঠার প্রাক্কালে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চান্সলর জিয়াউদ্দিন আহমদ এক বিবৃতিতে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা উর্দু হওয়া উচিত মনে করেন।কিন্তু শাহীদুল্লা সহ ভাষা বিদগণ ও জনগণ মেনে নেন নি সেই প্রস্তাব,কারণ তাদের শিরায় শিরায় তখন বাংলা ভাষা একমাত্র অবলম্বন বলে মনে করেন ।কারণ জন্মের পর এই ভাষায় তারা প্রথম মা বলে ডেকেছে। তাই তারা তীব্র প্রতিবাদ জানান। কিন্তু রাষ্ট্র ভাষা প্রশ্ন তে মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে কোনো প্রস্তাব গৃহীত না হলে ও রাষ্ট্রের প্রশাসনে অ বাঙালি উচ্চ পদস্থ আমলাদের আধিক্যর কারণে ভিতরে ভিতরে উর্দু কে একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা করার চক্রান্ত চালাতে থাকে।এ চক্রান্ত ধরা পড়ে যায় নতুন রাষ্ট্রে পোস্টকার্ড,এনভেলাপ, প্রভৃতিতে ইংলিশ শব্দর সঙ্গে উর্দু ভাষার ব্যবহার দেখে। ভাষা আন্দোলন কার্য চালানোর জন্য তমদ্দুন মজলিস সভা গঠন করা হয়।
এই সভা থেকে ১৯৪৭ সালের ১৫ ই সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা বাংলা না উর্দু শীর্ষক পুস্তক লিখে ভাষা আন্দোলনের সূচনা করা হয়।এর পর তমদ্দুন মজলিশ বসে থাকেনি, ছাত্র শিক্ষক কর্মী সংযোগে বৈঠক করেন।এই সব কাজের মূল উদ্যোক্তা ছিলেন এই মজলিশের প্রতিষ্ঠাতা আবুল কাশেম।ওই বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিজ্ঞানের শিক্ষক অধ্যাপক নুরুল হক ভুঁইয়া কে আহবায়ক করে রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রামের পরিষদ গঠন করেন।চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে বাংলা ভাষা আন্দোলন এর আগুন।৯৪৮সালের ৪ঠা জানুয়ারি পূর্ব বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম ছাত্র লীগের একটি অংশ পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম ছাত্র লীগ নামে একটি সংগঠন আত্ম প্রকাশ করেন।প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ সংগঠন ভাষা আন্দোলনের প্রশ্নে 
মতদ্দুন মজলিশের অবস্থান কে সমর্থন করেন। লীগ এর নাম করন করা হয় সংগ্রাম পরিষদ। এই লীগ এর পক্ষ থেকে ১১ ই মার্চ থেকে ১৯মার্চ পর্যন্ত ঢাকা শহরের সর্বত্র বাংলা ভাষার দাবিতে বিক্ষোভ চলতে থাকে।১৯ শে মার্চ কায়েদে আজম জিন্নাহর ঢাকা সফর করার কথা ঘোষণা করা হয়।এই সফরের আগে তৎকালীন চিফ মিনিস্টার খাজা নাজিম উদ্দিন পরিস্থিতি সামাল দিতে সকল দাবি দাওয়া মেনে নিয়ে সংগ্রাম পরিষদ এর সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এর পর জিন্নাহ ঢাকা শহরের রেসকোর্স ময়দানে এক জনসভায় ও কার্জন হলের বিশেষ সমার্তন অনুষ্ঠানে ভাষণ দেন উর্দুতে,  এবং সেই সঙ্গে উর্দু কে রাষ্ট্র ভাষারমর্যাদা দান করেন।কিন্তু সেই ভাষণে ব্যপক প্রতিবাদ হয়।বিশাল জনসভায় এ প্রতিবাদ টের না পেলে ও এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত কিছু তরুণ যখন ভাষা সম্পর্কে তার বক্তব্যর প্রতিবাদ জানায় তখন তিনি থমকে যান এবং বক্তব্য শেষ না করে ফিরে আসেন।পরদিন তিনি বাংলা ভাষা সমর্থকদের সঙ্গে বৈঠক করেন ।কিন্তু উভয়েই নিজ নিজ বক্তব্য তে অবিচল থাকায় বৈঠক ভেঙে যায়।এই ভাবে চলতে থাকে আন্দোলন, অবশেষে সাল টা ছিল ১৯৫২, খাজা নাজিম উদ্দিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ঢাকায় এসে ২৭ শে জানুয়ারি পল্টন ময়দানে এক জন সভায় ভাষণ দেন উর্দু ভাষায় এবং সেই সঙ্গে ঘোষণা করেন উর্দু হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা, যে নাজিম উদ্দিন ১৯৪৮ সালে বাংলা রাষ্ট্র ভাষা র দাবি মেনে নিয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন, তাঁর এ হেন ঘোষণায় বিশ্বাসঘাতক তার প্রতিবাদ এ ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি প্রতিবাদ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এই দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু সংখ্যক ছাত্র ও প্রগতিশীল কিছু রাজনৈতিক কর্মী মিলে মিছিল শুরু করেন। মিছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছাকাছি আসতেই পুলিশ ১৪৪ ধারা অবমাননার অজুহাতে আন্দোলনকারীদের উপর গুলি বর্ষণ করেন, নিহত হন বাংলা ভাষা বুকের মাঝে রাখতে চাওয়া বীর সন্তানেরl রফিক, সালাম, বরকত সহ বহু বীর সন্তানেরা। শহীদ দের রক্তে রঞ্জিত হয়ে গেলো রাজপথ, আবার ও লেখা হলো প্রতিবাদী দের রক্তে রঞ্জিত অভিশপ্ত ইতিহাস। শোকবহ এ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে, তখন থেকে প্রতিবছর ২১শে ফেব্রুয়ারি দিনটিকে শোক দিবস হিসাবে পালন করা হয়।অবশেষে ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করলে ৯ ই মে অনুষ্ঠিত গণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া হয় ।আবারো প্রমাণ হয়ে গেলো যে আন্দোলন যদি সঠিক পথে হয় জয় লাভ হবেই হবে, প্রতিপক্ষ একদিন ঠিক পরাজয় মানবে।
১৯৫২সালে ২১শে ফেব্রুয়ারী ঢাকার ইতিহাসে ঘটে যাওয়া ভাষা আন্দোলনের মর্যাদা রক্ষার দ্বিতীয় আন্দোলন হোল ১৯৬১ সালে ১৯ শে মে আসামের বরাক উপত্যকা য় ঘটে যাওয়া ভাষা আন্দোলন। ১৯ শে মে শিলচর ভাষা দিবস হিসাবে পালিত হয় কারণ এই উপত্যকায় বসবাস কারি সংখ্যা গরিষ্ট বাঙালি তাদের বাংলা ভাষা কে স্বীকৃতি দিতে পথে নেমেছিল.. আর তাতে চলেছিল গুলি বর্ষণ, যাতে কমলা ভট্টাচার্য সহ শহীদ হয়েছিলেন এগারো জন ভাষা সৈনিক।স্বাধীনতার পর উত্তর ভারত বর্ষের প্রথম ভাষা আন্দোলনের ভাষা শহীদ, এর পর দক্ষিণ ভারতে ব্যপক হিন্দি আধিপত্য বিরোধী ভাষা আন্দোলনের প্রকাশ পায়। এই দেশের ভাষা আন্দোলনের প্রথম হলেন শহীদ ষোড়শী কমলা ভট্টাচার্য ।কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল বাংলা ভাষার প্রাণ পুরুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম শতবর্ষ উদযাপনের মাত্র কয়েক দিন পরেই এই আন্দোলন তথা শহীদ বরণ দিবস।আগে থেকেই চলমান আসামের বাঙ্গাল খেলা,দাঙ্গার সাথে শুধুমাত্র অসমিয়া ভাষা কে আসাম রাজ্যের একমাত্র সরকারী ভাষা ঘোষণা করায়।এই আন্দোলনের সূচনা হয় বরাক উপত্যকায়  শিলচর শহরের রেল স্টেশন চত্বরে ঢুকে পড়ে গোটা স্টেশন দখল করে নেয়, অফিস কর্মচারীদের চেয়ারে বসে পড়ে. কর্মকর্তারা বসবার জায়গা না পেয়ে ফিরে যান, প্রশাসন কে অচল করে দেয়, ওই বছর ২৬শে মে ঈদ উৎসবের দিন সকল ধর্ম প্রাণ বাঙালি মুসলমান রা বুকে কালো ব্যাজ পরে হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে নীরব প্রতিবাদে সামিল হন। সাম্প্রদায়িক ঊর্ধ্বে এক গৌরব উজ্জ্বল অধ্যায় এটি।ইতিহাসে অবশেষে বাংলা ভাষা সরকারী স্বীকৃতি লাভ করে।
মহান শিলচর এর ভাষা আন্দোলন আমাদের মতো বহু ধার্মিকদের এক বিশেষ বার্তা বহন করে, নিজ ভাষা ধর্ম ছাড়া অন্য ধর্মের ভাষার প্রতি দেওয়া দরকার ।ফেডারেল রাষ্ট্র নীতি হাওয়া দরকার।স্বাধীনতার আগে থেকে যে সমস্ত বাংলা ভাষা পরিচালিত স্কুল গুলি কে বাঁচিয়ে রাখা।তাই এগারো টি স্বীকৃতি ভাষা ছাড়া ভারত বর্ষে অন্যান্য ভাষার সার্বজনীন অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
বুকের রক্ত দিয়ে বাঁচিয়েছিল বাংলা ভাষার মান। সেই বাংলা ভাষা বর্তমানে বিশ্বের দরবারে জয়জয়কার। ইউনেস্কোর তত্ত্বাবধানে বাংলা ভাষাকে_"sweetest language in the word"হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।স্পানিশ ও ডাচ ভাষাকে যথাক্রমে দ্বিতীয় তৃতীয় স্থান হিসেবে নির্বাচিত করা হয়েছে।আবার মার্কিন ব্যালট  পেপার এ বাংলা ভাষার ব্যাবহার করা হয়েছে।এর আগে অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকার সংসদ ভবনে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবেস্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।বাঙালি হিসেবে আজ গর্ব করার দিন।কিন্তু সেই বাংলা ভাষা এই বাংলায় বর্তমানে উপেক্ষিত।ভাষা আন্দোলনের শহীদদের আত্মত্যাগের দাম এই বাংলা না দিলেও বিশ্ব দরবারে তার প্রাপ্য মর্যাদা লাভ করেছে। একি কম গৌরবের কথা।
আজ বাঙালি ভুলে গেছে আপন পথে চলতে/
আজ বাঙালি ভুলে গেছে বাংলা কথা বলতে/আজ বাঙালি হয়ে গেছে অন্য ভাষার দাস/বাংলা ভাষায় বললে কথা পড়বে তোমার লাশ।বর্তমান সময়ে বাঙালি আজ ভুলতে বসেছে তার প্রিয় বাংলা ভাষা।শুধু তাই নয় বর্তমান রাজ্য সরকারের আমলে বাংলা ভাষায় শিক্ষক নিয়োগ চেয়ে রাজেশ অরুণ তরুণদের মৃত্যুবরণ করতে হচ্ছে।এই সময়ে বাংলা ভাষার মান তলানি তে এসে ঠেকেছে।এই ভোট উৎসবে রাজ্য সরকারের তরফ থেকে ভোটের স্লিপ প্রদান করা হচ্ছে তাতে উর্দু ভাষা ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে কি বর্তমান রাজ্য সরকার ১৯৫২ সালে অবিভক্ত বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের কথা ভুলে গেছে।তৎকালীন সময়ে অবিভক্ত বাংলাদেশের বাঙ্গালীদের উপর উর্দু ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার অপমান তারা সহ্য করতে পারেনি।সালাম,রফিক, বরকত রা বুকের রক্ত দিয়ে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস তৈরি করে গেছেন। অথচ বাংলা ভাষার পিঠস্থান এই পশ্চিমবাংলায় ভোটের স্লিপ উর্দু ভাষাকে প্রাধান্য দিয়ে রাজ্য সরকার কি বুঝাতে চাইছেন? কিন্তু একটা কথা মনে রাখা দরকার,এটা পশ্চিম বাংলা।এখানে বাংলা ভাষা, সাহিত্যর ঐতিহ্য সংস্কৃতি যুগ যুগ ধরে বহন করে চলেছে। তাই কখনোই রাজ্য সরকারের চাপিয়ে দেওয়া উর্দু ভাষার দালালি করা এই পশ্চিমবঙ্গের মানুষ মন থেকে মেনে নেবে না।উর্দু ভাষাকে প্রাধান্য দিয়ে এই পশ্চিমবাংলাকে জঙ্গী কার্যকলাপের প্রধান আশ্রয় স্থল ও পাকিস্তান বানিয়ে তুলতে চাইছে।এ কথা অস্বীকার করার উপায় আছে কি? এখন প্রশ্ন বর্তমান রাজ্য সরকার সত্যিই কি পশ্চিমবাংলার বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কথা ভাবেন?খোদ পশ্চিমবাংলায় ভোটের স্লিপ উর্দু ভাষাকে প্রাধান্য দিয়ে বাঙালি সমাজের ভাবাবেগে আঘাত করেছেন। এর ফল কিন্তু আগামী দিনে মারাত্মক হতে চলেছে,তা বলা বাহুল্য।কিছু রাজনৈতিক দল ১৯৫২ সালে অবিভক্ত বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, ও ১৯৬১ সালের আসামের শিলচর এর ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস  মুছে দিতে চাইছেন। বাঙালির অতি প্রিয় বাংলা ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে সমাজের তরুণ-তরুণীরা বুকে বুলেটের চিহ্ন এঁকে ছিল।সেই ইতিহাস বর্তমান  সরকার ভুলে গেলেও বাঙালি সমাজ কিন্তু ভুলে যায়নি।আজও এই দুই বাংলায় যথার্থ সম্মানের সঙ্গে ভাষা দিবসের শহীদদের কথা স্মরণ করে ভাষা দিবস পালন করেন। ভাষা আন্দোলনের শহীদদের সম্মানার্থে তাদের বেদীতে মাল্যদান করেন।তাই যতদিন বাঙালি বিশ্বের বুকে থাকবে ততদিন তারা বাংলা ভাষাকেই নিজেদের প্রিয় ভাষা রূপে বরণ করবেন। প্রয়োজনে বাংলা ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে আবারো বাঙালি সমাজ মৃত্যুবরণ করতে প্রস্তুত হবে।উর্দু ভাষাকে নয়।


  গল্প 


খেলাঘর 

অভিষিক্তা বসু 

 

স্বাধীনোত্তর ভারতবর্ষে  সর্বত্রই তখন গভীর  অচলাবস্থা । বাংলায় তখন কিছু দামাল তরুণ সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার জন্যে তৎকালীন  শাসক বর্গের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। প্রশাসন ও তখন কঠোর  দমন নীতি কে অস্ত্র করেছে। কত যে মায়ের কোল শূন্য হয়েছে বাংলায় তার অন্ত নেই, আবার কত মা… শুধুই তার  হঠাৎ নিরুদ্দেশ সন্তানের ঘরে ফেরার প্রত্যাশায়, অপেক্ষার বিনিদ্র নিশি যাপন করতে করতে  মৃত্যর কোলে ঢোলে পড়েছে। তবু সমাজে সাম্য আনতে সাম্যের লড়াই এ  মেতে উঠেছে এক দল বেপরোয়া । 

নিখিলেশ তখন সবে আঠারোর উন্মাদ গণ্ডীতে , সদ্য স্কুল ফাইনাল পাশ করে এ , সি কলেজে সাহিত্য বিভাগে ভর্তি হয়েছে। নিখিলেশের পরিবার শহরের অন্যতম বনেদী, অভিজাত, রক্ষণশীল  ব্রাহ্মণ পরিবার। সামাজিক অস্থিরতা তখন সমস্ত তরুণ সন্তানের মা-বাবার চোখের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। কলেজে- কলেজে তখন কিছু উঠতি জননেতা রাজনৈতিক ভাষণের মাধ্যমে যুব সমাজ কে আকর্ষণ করার চেষ্টায় রয়েছে। নিখিলেশের কলেজেও এর অন্যথা হয় নি। উত্তপ্ত শোণিতে তখন যেন জোয়ার এসেছে। মোহগ্রস্তের মতন সাহিত্য সমালোচনার মাঝেও তার মন ছুটে যেত   কলেজের মাঠে ভাষণ রত যুবনেতা প্রকাশ পাইনের বক্ত্যবের স্বচ্ছতায়। সমাজে তখন এই একদল যুবক ঘরছাড়া বাউন্ডুলের  তকমা এঁটে নিয়েছে।  নিখিলেশ ও এই প্রবল হাত ছানি থেকে নিজেকে বেশী দিন আড়াল করে রাখতে পারে নি। তার চোখেও তখন নতুন সমাজ গঠনের স্বপ্ন বিকাশ পেতে শুরু করেছে। কলেজের ক্লাস ফাঁকি দিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক মিটিং, মিছিলে তার আনাগোনা শুরু হয়। কলেজ তার কাছে ক্রমশ হয়ে ওঠে শুধুমাত্র ভ্রমনের স্থান।

 বরাবরের মেধাবী ছাত্র নিখিলেশ কপাল গুনে সাহিত্য বিভাগে  তার নাম খানা সে বছরের মতন টিকিয়ে রাখতে পারে। প্রথম বর্ষের রেজাল্টের দিন কলেজ ক্যম্পাসে আড্ডা দিতে গিয়ে তার নজর কাড়ে এক দল মেয়ের একটি জটলা। এর মধ্যে থেকে উচ্ছ্বসিত হালকা হলদে শাড়ি পড়া , লম্বা এক ঢাল কালো অলক রাশির ছটা , কানের পাশে কুঞ্চিত এক গোছা চুলের মাঝে উঁকি দেওয়া ছোট কানের দুল আর প্রবল ভাবে শরীরী ঝাঁকুনিতে আড্ডার মধ্যমণি হওয়া মেয়ে টি কে এক নজরে বেশ ভালো লেগে যায় নিখিলেশের। একটু খোঁজ খবর নিতেই জানতে পারে মেয়ে টি এবারের প্রথম বর্ষের ইতিহাস বিভাগের ছাত্রী। নাম অনামিকা পাণ্ডে। 

এক দিকে সদ্য নকশালী পৃষ্ঠায় নাম লেখানো নিখিলেশ দীক্ষা নিচ্ছে সমস্ত পিছুটান সময়ের স্রোতে ভাসিয়ে দেওয়ার, আর অন্যদিকে তার মনে নতুন করে অনামিকা নামক পিছুটান সৃষ্টি করছে, বুনে চলেছে কিছু রঙিন স্বপ্ন। গোষ্ঠীর মিটিং- মিছিলের মাঝেও এখন তার নিত্য আনাগোনা কলেজ প্রাঙ্গনেও। কলেজের নবীন বরণের দিন আলাপ পর্ব টি সারা হয়ে যায় নিখিলেশের সাথে অনামিকার।
সময়ের অগ্রগতির সাথেই আলাপের কাল সীমানা পেড়িয়ে ঘনিষ্ঠতা বারে দুজনের মধ্যে। কলেজের সমস্ত প্রেমিক যুগলের অন্যতম জুটি তখন নিখিলেশ- অনামিকা। ক্লাসের বেঞ্চ , লাইব্রেরীর টেবিল, তেতলার ছাদ এমনকি মাঠের দেবদারু গাছ ও তখন তাদের সদ্য অঙ্কুরিত প্রেমের সাক্ষী বহন করে চলেছে। অনামিকার প্রবল আকর্ষণে তখন কিছুটা শিথিল হয়েছে নিখিলেশের গোষ্ঠীর আড্ডা। বান্ধবীদের মারফত কখনও কখনও আদান-প্রদান হত প্রেমের আখরে ভরা অভিসারী চিঠি। 

বেশ ভালোই কাটছিল দিন গুলো। কিন্তু ওপর ওয়ালার বিচার  খণ্ডানো সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। কোনোমতে কলেজের ফাইনাল পরীক্ষা টা দিয়েই নিখিলেশ পাকাপাকি ভাবে রাজনৈতিক দলে জড়িয়ে পড়ে।  এখন শুধু বিপ্লবের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়া । অনামিকার প্রবল আকর্ষণ কখনও কখনও পথের অন্তরায় হলেও তাকে আমল দেয় নি সে। একটা সময় অনামিকাও বুঝে গিয়েছিল তার প্রেমিক পুরুষ টি অত সহজে ধরা দেবে না। এভাবেই তাকে সকলের সাথেই ভাগ করে নিতে হবে। 
অনামিকার ফাইনাল পরীক্ষার আগেই তার বাড়ির লোক তার জন্যে পাত্র খুঁজতে আরম্ভ করে। তার দাদারা জেনে গিয়েছিল তাদের এই সম্পর্কের কথা। তাদের মতন অবাঙালি রক্ষণশীল পরিবারে মেয়েদের উচ্চ শিক্ষাই অনেক বড় বিষয়, সেখানে কিনা প্রেম বিবাহ !! নৈব, নৈব চ। আনামিকার মুখে নিখিলেশ একদিন সব জানতে পারে। সে তার বাড়িতে মায়ের কাছে গিয়ে অনামিকা কে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। শুনেই নিখিলেশের মা মূর্ছিত প্রায় । ছেলে  বলে কিনা  শাল্গ্রাম শিলা স্থাপন করা ব্রাহ্মণ বাড়িতে ঐ অবাঙালি পরিবারের মেয়ে আসবে !!

 নিখিলেশের বাবার কানেও কথা টি গিয়ে পৌঁছালে তিনি কোনোভাবেই মত দেন না। এদিকে একদিন অনামিকার বাড়িতে  নিখিলেশ এসে উপস্থিত হয়। অনামিকার দাদারা তাকে প্রায় মারতে তেড়ে  আসে। দু পরিবার যেন কিছুতেই তাদের ভালবাসাকে স্বীকৃতি দিতে চায় না। অনামিকার বান্ধবীর হাতে পাঠানো চিঠির উল্লেখ মতন সেদিন গভীর রাতে নিখিলেশ শহর সংলগ্ন রেল স্টেশনে অপেক্ষা করে তার।   কিন্তু সামাজিক প্রতিরোধ  ও পারিবারিক সম্মান উপেক্ষা করে অনামিকা বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসার মতন কঠিন সিদ্ধান্ত ও নিতে পারে না।এক সময় নিখিলেশের অপেক্ষার মেয়াদ ফুরিয়ে যায়। শেষ ট্রেন টাও  স্টেশন ছেড়ে বেড়িয়ে যায়। জীবনের আর কোনও উদ্দেশ্য তার মনে আসে না। সে রাতেই সে সিদ্ধান্ত নেয় , আর নয় তার নিঃশ্বাসের শেষ বাষ্প টাও এবার সে উৎসর্গ করবে দেশের জন্যে। 

অনামিকার প্রতি প্রগাঢ় অভিমানে সে নিজেকে রাজনীতির কঠিন ও বেপরোয়া দিকে ঠেলে দিতে থাকে। প্রায় প্রতিদিনই খবরের কাগজের শিরোনামে তার বিভিন্ন দুঃসাহসিক কর্মকাণ্ডের কাহিনী প্রকাশিত হতে থাকে। কখনও পোশাকি নামে ,কখনও বা ছদ্ম নামে তার কার্যকলাপ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। নিখিলেশের বাবার সম্মানে আঘাত হানে ছেলের এমন কাজ কর্ম। প্রায়ই বাড়ি ফিরে বচসা শুরু হয়। ঘরছাড়া হয় নিখিলেশ। তারপর একবার এই ডাল তো আরেকবার এই ডাল, কখনও কখনও গা ঢাকা দিয়ে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে ঘুরে বেড়াতে থাকে সে। কখনও একলা হলে মনের কোনে ঝড় তোলে অনামিকার স্মৃতি। সেদিনের পর আর কোনোদিন খোঁজ করে নি সে তার। ক্রমে তার গায়েও সেঁটে গিয়েছে নকশালি তকমা। 

একটা সময় প্রশাসনের কঠোর দমন নীতি প্রয়োগের ফলে নকশাল আন্দোলন স্তিমিত হয়ে আসে। বহু তাজা রক্তে ভেসে যায় বাংলার রাজপথ। দীর্ঘ সময় ফেরার থাকতে থাকতে একটা সময় ক্লান্ত হয়ে পরে নিখিলেশ। তাকে  ধরা পড়তে হয় পুলিশের হাতে। বিচারে ১২ বছর তার সাজা হয়।  

১২ বছর সংশোধনাগারের আবহাওয়ায় তার একমাত্র সাথী ছিল অনামিকার স্মৃতি । এক মুহূর্তের জন্যও তাকে সে ভুলতে পারে না। শয়নে – স্বপনে – জাগরণে সব সময় তার সাথে কাটানো ভালবাসার মুহূর্তেরা তাকে বেঁচে থাকার  রসদ জুগিয়ে গিয়েছে। কখনও সে কারো কাছে জানতে চায় নি অনামিকা কেমন আছে। অথচ খুব সহজেই সে তার খোঁজ নিতে পারত। কারা জীবনের এই চার দেওয়ালের মাঝে ,সে খুব একটা কারোর সাথেই তেমন মেলামেশা করে না। ইতিমধ্যেই সে খবর পেয়েছে তার গ্রেপ্তারীর খবরে তার বাবা  কালের পথে   যাত্রা করেছে। স্বামীর মৃত্যু ও ছেলের হাজতবাস এর ধাক্কা তার মা ও সামলাতে পারে নি । বাবার মৃত্যুর মাস খানেকের  মধ্যে মা ও ইহলোক ত্যাগ করেন । কাগজে কলমে সে এখন সর্বহারা । নেই কোনও পিছুটান। এই ১২ বছরের জেল জীবনে কেউই তার খোঁজ রাখে নি। দলের ছেলেরা অনেকেই বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে গিয়েছে। কেউ কেউ আপোষ করে নিয়েছিল পুলিশের সাথে। তারা এখন ঘোরতর সংসারী । নিখিলেশের মতন মানুষের ছায়াও তারা মারায় না। কিন্তু , এত গুলো বছর শুধু একজন তার খোঁজ রেখে গিয়েছে। নিয়ম করে প্রতি মাসেই সে দেখা করে যেত। সে আর কেউ নয়, নিখিলেশের ছোট বেলার বন্ধু  প্রবাল। তার মাধ্যমেই সে তার বাবা- মা এর মৃত্যুর খবর টুকু পেয়েছে। বর্তমানে নিখিলেশের বাড়ির দেখা শোনার দায়িত্ব ও সে ঘাড় পেতে নিয়েছে। 

এমনই একদিন প্রবাল দেখা করতে আসে নিখিলেশের সাথে জেলে। সেদিন শুরু থেকেই নিখিলেশ ভীষন অন্যমনস্ক ছিল। কথায় কথায় প্রবাল জানায়, তার গ্রেপ্তারীর কিছুদিন পরই অনামিকার বাড়ি থেকে তাকে এক বড়োলোক পরিবারের ব্যাবসায়ি ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। এক দীর্ঘশ্বাস ঝড়ে পরে নিখিলেশের। অনামিকা এখন পরস্ত্রী । তার কথা ভাবা তা বোধ হয় অন্যায় হচ্ছে। খুব জানতে ইচ্ছে করে তার সেও কি কখনও এমন ভাবে কষ্ট পায়, যন্ত্রণায় কেঁদে ওঠে। নাকি সব ভুলে ধনী স্বামীর আহ্লাদে সে এখন মজে গিয়েছে। অনামিকা কে ভোলার তাগিদে সে যেন তার হৃদয়ের গভীরে আরও গভীরে ইমারত তৈরি করছে।

১২ বছরের মেয়াদ শেষ হবার আগেই এই ১০ বছরের গোড়ায় ছাড়া পায় নিখিলেশ তার জেল জীবনের সুখ্যাতির জন্যে।  সেদিন আগে থেকেই রিক্সা নিয়ে উপস্থিত ছিল প্রবাল জেলখানার বাইরে। একরকম জোর করে তাকে সে তার বাড়িতে নিয়ে যায়। পথে যেতে কত কিছুই যেন অচেনা মনে হয় নিখিলেশের। এক সময় অনামিকার বাপের বাড়ির পথ টাও অতিক্রম করে তারা।মনে ভেসে আসে জমাট বাঁধা মলিন স্মৃতি গুলো। পথের ধারে নোংরা ঘিঞ্জি বস্তি ,  উলঙ্গ পথ শিশুর হাহাকার  এসব কিছু দেখে কেমন যেন অস্থির হয়ে ওঠে তার মন। তারা তো এই সমাজের স্বপ্ন দেখে নি। তারা  তো সামাজিক সাম্য  আনতে চেয়েছিল। দশ বছরে তার চেনা শহর এত অচেনা হয়ে গেছে যে আজ যেন সে নিজেকেই চিনতে পারছে না। অথচ সমাজ গড়ার অঙ্গীকারে আজ তারাই সমাজের দাগী আসামী। এই সমস্ত ভাবতে ভাবতেই রিক্সা এসে থামে প্রবালের বাড়ির সামনে। 

‘ আমাকে তোর বাড়িতে নিয়ে এলি কেন প্রবাল। আমি তোদের সংসারের মতন মানানসই নই  একেবারেই ।‘ 
‘একদম কোনও কথা বলিস না নিখিল। আজ তুই ছাড়া পাবি শুনেই মা দুদিন আগে থেকেই বলে রেখেছে আমাকে তোকে যেন আমি প্রথমেই আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসি। মা কত কিছু রান্না করেছে তোর জন্যে তুই দেখবি চল ‘ ।
প্রবালের বাড়িতে প্রবেশ করতেই প্রবালের মা, এগিয়ে আসেন। 
নিখিলেশ , প্রণাম করলে , তাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন তিনি। ‘ বাবা , যে দেশ গড়তে তোমরা বিবাগী হলে সে দেশ তো উচ্ছনে গেছে। বড়লোক আরও বড়লোক হচ্ছে আর , গরিব আরও গরিব , আর মধ্যবিত্তের তো নাভিশ্বাস ‘ 
‘আঃ ! মা তুমি এই কি কথা নিয়ে পড়লে। ও কতদিন পর আমাদের বাড়িতে এলো ,ওকে একটু বিশ্রাম করতে দাও। ‘ 
নারে প্রবাল তুই ব্যস্ত হোস না, ১০ বছর তো বিশ্রামই করলাম।
‘ না না বাবা , তুমি একটু ভালো করে স্নান করে ভালো কাপড় পরে এসো তো দেখি। তারপর সেই ছোট্ট বেলার মতন তোমাদের দুই বন্ধুকে একসাথে পাত পেরে খাওয়াই।‘
‘ মাসিমা , আপনি ব্যস্ত হবেন না। আমি ঠিক আছি’।
প্রবালের পীড়াপীড়ি তেই এক প্রকার বাধ্য হয়ে নিখিলেশ স্নান সেরে প্রবালের দেওয়া পাজামা পাঞ্জাবী পরে এসে বারান্দায় বসলো। চারিদিকে চোখ ঘুরিয়ে দেখতে থাকলো সে। মধ্যবিত্তের বাড়ির উঠোন , ঘরের সাজসজ্জা সবেতেই এক পরম স্নেহশীল পরশ। যেন খুব যত্নে সব কিছু কে দুহাত দিয়ে আগলে রাখা। নিখলেশের হঠাৎ তার বাড়ির কথা মনে পড়ল। আজ না হয় এই বেলা সে প্রবালের বাড়ির অতিথি , কিন্তু তারও তো একটা বাড়ি আছে। কে জানে সেই বাড়ির কি দশা হয়েছে এত গুলো বছরে। এমন দশ – পাঁচ কথা ভাবতে ভাবতে প্রবাল এসে সামনে দাঁড়ালো। সঙ্গে একটি অল্প বয়সী বিবাহিত মহিলা। চেহারা মধ্যেই তার ব্যক্তিত্বের স্পষ্ট আভাস মেলে।
নিখিল, তোর সাথে আলাপ করিয়ে দিই, ইনি হচ্ছেন আমার সহধর্মিণী শীলা। তোকে আগে ওর কথা বলি নি,  ভেবেছিলাম একেবারে সাক্ষাতে তোকে চমকে দেবো। 
শীলা এগিয়ে এসে প্রণাম করতে  চাইলে নিখিলেশ প্রায় লাফ দিয়ে ওঠে। 
না না আমাকে প্রণাম করো না , বোন । প্রবাল এ তোর ভারী অন্যায়, আমাকে আগে বলবি তো। তোদের জন্যে তো কোনও উপহার আনা হয় নি আমার। 
শীলা বলে,’  দাদা , বোন বলে আপন করলেন আবার উপহারের কথা বলে পর করে দিলেন। আপনার মতন সাহসী মানুষের চরণ ধুলির থেকে বড় উপহার আর কি হতে পারে আমার মতন সামান্য নারীর কাছে। ‘ 
প্রবাল ঃ ‘  নে এবার জবাব দে। ‘ 
দুই বন্ধুতে আজ বহু বছর পর হা হা করে হেসে ওঠে। প্রবালের মা ঠাকুর ঘর থেকে তাদের এই হাসির দৃশ্য দেখছিলেন প্রাণ ভরে । 
দুপুরের খাওয়া দাওয়া, বিশ্রাম ইত্যাদির পর নিখিলেশ বলে – ‘ ভাই প্রবাল , এবার যে আমাকে যেতে হবে। আমার বাড়ির চাবি খানা দে দেখি এবার ‘ ।
হ্যাঁ,  যাবি  তো । তোকে তো আমি আটকে রাখতে পারবো না সে আমি জানি। অন্তত আজকের দিন টা থেকে যা।
নারে প্রবাল , তা হয় না।  
আচ্ছা চল , আমিও যাবো তোর সঙ্গে। তুই আসবি জেনেই আমি বাড়ির বাইরের জঙ্গল সব পরিস্কার করিয়ে রেখেছি। কিন্তু ভিতর টা করাতে পারি নি। তোদের বাড়ির ওত দামী দামী জিনিসপত্র। কোনটা খোয়া গেলে তখন , সেই ভয়ে আর …।
তুই যে এতদিন বাড়ি টাকে আগলে রাখলি এই বা কম কিসে রে প্রবাল। না হলে তো সাতে ভূতে ভোগ করতো । এত ইতস্তত করছিস কেন?   
বাড়ির উঠোন থেকে মাসিমা আর শীলা কে বিদায় জানিয়ে দুই বন্ধু রওনা দিল নিখিলেশের বাড়ির উদ্দ্যেশে। পথে যেতে কত চেনা- অচেনা মানুষ। কেউ বা হেসে এগিয়ে এল । আবার কেউ এড়িয়ে যেতে চাইল। উপেক্ষা আর ভালোবাসার সাজানো শব্দ গুলো এখন নিখিলেশ এখন  ভালই বোঝে। আধা  ভাঙা প্রাচীরের সাথে কোনও ক্রমে ঠেস দিয়ে আছে সুবিশাল গেট টি। এই গেট খানা নিখিলেশের বাবার জন্মের আগের তৈরি করা। গেটের  তালা খুলে ভেতরে ঢুকতেই দুটো ছোট্ট বিড়াল ছানা দৌড় দিয়ে পালালো  গোয়াল ঘরের ভেঙ্গে পড়া ঝুপড়ির আড়ালে। 
নিখিলেশ ঠাট্টা করে বলল, দেখ প্রবাল আমাকে দেখে অবলা প্রাণীও বোঝে জেল খাটা  আসামী।
কি যে আবোল তাবোল বলিস তুই । 

প্রবাল চলে গেলে নিখিলেশ  ধুলোবালি ঝাড়তে  ঝাড়তে এক প্রাচীন নস্টালজিয়ায় যেন ডুবে যাচ্ছিল। জমিদারীর পাঠ চলে গেলেও নিখিলেশের বাবা তার রাজকীয়তা বজায় রেখেছিলেন বেশ কিছু বছর। আভিজাত্যের গরিমার অতল স্পর্শ থেকে কখনও তিনি নীচের দিকে নামতেই পারেন নি। আর তার মা স্বামী আজ্ঞা কেই জীবনের শেষ ঠাঁই বলে মেনে নিতেন। অশিক্ষা আর কুসংস্কারের ঘেরাটোপ থেকে কখনও আলোর পথে হাঁটতেই পারেন নি । 

 অতীত স্মৃতির ঘোর কাটলো ওর ঘরের পাশে কাঁঠাল গাছে কোনও এক নিশাচর পাখির  ডাকে। প্রবালের বাড়ি থেকে আসার সময় মাসীমা রাতে খাবার সঙ্গে দিয়ে দিয়েছিলেন, সেখান থেকেই কিছুটা খেয়ে শুয়ে পড়ল নিখিলেশ । জীবনে এই প্রথম এই সুবিশাল বাড়িতে আজ সে সম্পূর্ণ একা।  এত খানি একা সে সেই সময়ও ছিল না যখন পুলিশের হাত  থেকে বাঁচতে এখানে ওখানে আত্ম গোপন করতে হত। তখন জীবনে একটা উদ্দেশ্য ছিল। আজ সে উদেশ্য ও নেই । তার জন্য ভাববার মতন আর একটি প্রাণীও অবশিষ্ট নেই। এসব সাত- পাঁচ ভাবতে ভাবতেই ক্লান্তি নেমে আসে দু চোখ দিয়ে। 

সকালে প্রায় বেশ বেলাতেই ঘুম ভাঙল নিখিলেশের। আজ সকাল টা তার কাছে কেমন যেন উদ্দেশ্যহীন । পাড়ার মোড়ের চা এর  দোকান থেকে চা খেয়ে , এলোমেলো ভাবেই ঘুরতে ঘুরতে এল, করলা নদী সংলগ্ন কিং সাহেবের ঘাটে ।  বহুদিন পর খোলা আকাশের নীচে ,মুক্ত বাতাসে কিছুটা সময় কাটিয়ে, হঠাৎ তার মনে হয় , সমাজে বাস করতে গেলে সংসারী না হলেও নিজের দু বেলা খাদ্য সংস্থানের জন্য অন্তত সামান্য উপার্জন তাকে করতে হবে। পুরোনো আমলের কিছু পরিচিত দোকানে সে হিসেব রক্ষকের কাজ খোঁজে। কম পারশ্রমিকের একটি কাজও সে পেয়ে যায়।  

 সকাল ১০ টা থেকে বিকেল ৫ টা অব্দি দোকানের হিসেব পত্র দেখেই বেশ দিন যাচ্ছে। খুব একটা কারোর সাথেই সে কথা বলে না। আপন মনে কাজ করে। দোকানের মালিক পক্ষও বেশ খুশি। কিন্তু সন্ধ্যার পর তার বড্ড একা লাগে। রোজ রোজ প্রবালের বাড়িতে যাওয়াটাও দৃষ্টি কটু  ব্যাপার। আসা যাওয়ার পথে সে প্রায়ই দেখে বহু শিশু শিক্ষা থেকে বিমুখ। একদিন একটি ছেলে কে ডেকে তাকে পড়াশোনার কথা বলতেই সে পাড়ার আরও পাঁচ- ছয় টা কচিকাচা কে নিয়ে এসে নিখিলেশের বাড়ির বারন্দায় উপস্থিত হয়। মাস খানেকের মধ্যে তারা বেশ আগ্রহের সাথেই অনেক কিছু শিখে যায়, যার ফলে তাদের গরিব মা-বাবা রাও বেশ আনন্দিত হয়। নিখিলেশের ও ভালোই লাগে অন্তত সমাজের কিছু কাজে তো সে নিজেকে উৎসর্গ করতে পারছে। তার সাধ্যমতন সে ওদের বই  -খাতা  সহ খাবার কিনে দেয়। খালি পেটে তো  শিক্ষা হয় না। ‘নতুন মাস্টার’  নামে  ইতিমধ্যে বেশ নিখিলেশের নাম ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। সন্ধ্যাকালীন এই পাঠশালায় কিছুদিনের মধ্যে আরও ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বেড়ে গেল। এভাবেই কেটে গেল প্রায় একটা বছর।

দোকানের কাজ মেটাতে আজ বেশ সন্ধ্যে হয়ে গেল। বাচ্চা গুলো বোধ হয় নিখিলের ফেরার অপেক্ষায় ব্যাস্ত হয়ে পড়েছে। বেশ জোরে পা চালিয়ে সে বাড়ির পথে, হেঁটে যাচ্ছিল। হঠাৎ , কানা  গলির মোড়ে অন্ধকারে কাঁথা মুড়ি দিয়ে কে যেন বসে আছে বলে মনে হল। আর ঠিক পাশেই একটি বাচ্চা মেয়ে , এই খুব জোর বছর পাঁচ- ছয়ের  একটি মেয়ে  বসে কাঁদছে। নিখিল একটু এগিয়ে এলো ওদের সামনে। বাচ্চা টিকে নাম জিজ্ঞ্যেস করতেই সে বলল তার নাম জুঁই । 

নামটা শুনেই নিখিল প্রায় বছর ১২ পেছনে ফিরে গেল । অনামিকার জুঁই ফুল খুব পছন্দের ছিল। জুঁই ততক্ষণে উঠে এসে , নিখিলেশের জামার কোনা ধরে বলছে ‘ আমাকে কিছু খেতে দাও না। আমার খুব খিদে পেয়েছে। ‘ কথা টা শুনে নিখিলেশ তাকে জিজ্ঞ্যেস করলো –
তুমি কার সাথে এখানে এসেছো? তোমার বাড়ি কোথায় ?
মেয়ে টি বলল , আমার মা এর খুব জ্বর । ঐ যে মা শুয়ে আছে।
নিখিলেশ দেখল, রাস্তার ধারে এক খানা চাদর মুড়ি দিয়ে কেউ শুয়ে আছে, মুখ খানা দেখা যাচ্ছে না। 
অনেক ডাকাডাকির পরও সারা না মিললে,   সে একটা রিক্সা ডাকে , তাদের বাড়ি নিয়ে যাবে বলে । রিক্সা ডেকে , যখন সেই মহিলা কে তুলবে বলে সে মুখের থেকে চাদর টা সরালো ,তখন পড়ন্ত গোধূলির আলোয় সে চমকে উঠলো। এতো , অনামিকা !! 
অনু !!
আর কিছু ভাবার মতন স্থিরতা তখন তার ছিল না। কোনও ক্রমে তাদের নিয়ে বাড়ি পৌঁছে,  সে দেখল তার ছাত্রছাত্রীরা বসে রয়েছে। তাদের মধ্যে একজন বড়ছেলে কে ডেকে নিখিল বলল-
বিশু  , ছুটে যা তো তোর প্রবাল কাকার বাড়ি , কাকিমা আর দিদিমা কে বল এখনি একবার আমার বাড়ি আসতে।    

কথা মতই বিশু ছুটল। সমস্ত বিবরণ দিয়ে   সে  শীলা ও প্রবালের মা কে নিয়ে এল। সে সময় প্রবালও বাড়িতেই ছিল। তিন জনেই ছুটে এসে,অজ্ঞান প্রায় অনামিকা কে দেখে তো স্তম্বিত হয়ে গেল। এরপর নিখিলের সেবা যত্নে  তাকে প্রাণে বাঁচানো গেলেও তার স্মৃতি শক্তি  ,বাক শক্তি হারিয়ে যায়। শরীরের নিম্ন ভাগ আড়ষ্ট হয়ে যায়। প্রবাল অনামিকার বাড়িতে খবর দিলে তারা জানায় , তাদের কাছে সে মৃত। 
সারা শরীরে অকথ্য  আত্যাচারের চিহ্ন স্পষ্ট, বুঝতে কারোরই কিছু বাকী থাকে না অদৃষ্টের খেলা। বোধ হীন অনামিকার দায়িত্ব ও ছোট্ট জুঁই বড় হতে থাকে তার আদরের নিখিল কাকুর কোলে- পিঠে চড়ে। অনামিকার জন্যে একটি লোক রেখে দেয় নিখিল। সারাদিনের পর এখন বাড়ি ফেরার একটা টান জন্মেছে তার। কিন্তু যার জন্য সে এতো গুলো বছর একটা নীরব তপস্যা করলো, আজ সে শুধু তার অবোধ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। অনেক কথা শোনার পর শুধুই একটা মৃদু হাসি, জোছনার আলোর মতই ম্লান। 

নিখিলেশের সবটা জুড়ে জুঁই বড় হতে থাকে। অনামিকার অধরা স্বপ্ন গুলো একটু একটু করে নিখিল পূরণ করতে থাকে। জুঁই এখন অষ্টাদশী । তার মনেও পরে না,কোন অতল অন্ধকার থেকে তারা উঠে এসেছিল এই ক্ষণ ভঙ্গুর দালানে। এখন এটাই তার চরম আশ্রয়।কখনও কোনও অভাব বোধ হতে দেয় নি নিখিলেশ। 

পড়ন্ত বিকেলের শেষ সূর্যের কিরণ টাও যখন দিগন্তে মিলিয়ে যাচ্ছে ,তখন ছাদের এক কোনে দাঁড়িয়ে নিখিলেশ একা একাই কথা বলে চলছে হুইল চেয়ারে বসা অনামিকার সাথে।  এই সময়টা তাদের একান্ত নিজস্ব। অনামিকা তো শ্রোতা মাত্র। আজ কখন জুঁই এসে দাঁড়িয়েছে নিখিলেশ তা টের পায় নি। নিখিলের অতীত স্মৃতির কিছু কথা জুঁই শুনে ফেলে। কৌতূহল জন্মে তার মনে। নিখিলেশ আসলে কে? সে দৌড়ে যায় প্রবালের বাড়ি। শীলা আজ আর কিছুই গোপন করতে পারে না। আদ্যপ্রান্ত সব শোনার পর এক গভীর শ্রদ্ধা নিয়ে সে ফিরে আসে। 

 এরপর ,  বেশ কয়েক বছর পর , জুঁই পড়াশোনার পর্ব চুকিয়ে কলেজের অধ্যাপিকা হিসেবে যোগ দেয়। এতদিন সে নিখিল কে বুঝতেও দেয় নি, তার জীবনের সমস্ত কাহিনী যে তার অজানা নয়। শীলাও ছিল প্রতিশ্রুতি বদ্ধ। মনে মনে জুঁই সেদিনই স্থির করেছিল নিখিলেশের এই আত্ম ত্যাগ কে সে বিফলে যেতে দেবে না।  

অনামিকার শরীর আজকাল একদম ভালো থাকে না। দিনের বেশির ভাগ সময় তাই নিখিলেশ তাই অনামিকার শিয়রে বসেই কাটায়। সন্ধ্যার পর জুঁই এসে বলল-
আজ একটা কথা তোমায় বলতেই হবে , কাকু। 
কি বল ?
 অন্তত এবার আমাকে তুমি তোমার সন্তান হওয়ার স্বীকৃতি ত টুকু দাও। মা ও হয় তো তাই চায়। 
জুঁই এর এই কথায় চমকে ওঠে নিখিলেশ। 
গোধূলির শেষ রশ্মি ডানায় মেখে শ্রান্ত পাখিরা তখন তাদের আশ্রয়ে ফিরছে। অনামিকার অনিঃশেষ দৃষ্টি তখন জানালার প্রান্তে গিয়ে স্থির । দু চোখের কোণে তখন বহু জন্মের  তৃপ্তির আশ্বাস। এভাবেই স্থির অবিচল দৃষ্টি নিয়ে মিলিয়ে যায় অনামিকার সাধের বাসনা কুসুম। 
জুঁই তার মায়ের প্রিয় গান খানিতে সুর দেয় – ‘ খেলা ঘোর বাঁধতে যে এসেছি …’।।   


 

 

 

 

 

 

 

 



 

প্রকাশ  


ভাষা
সুনন্দ মন্ডল

 অভিমান জমে থাকা বুকে রক্তাক্ত স্বপ্নরা ছুটে চলে শিরায় উপশিরায়। কিছু কথা গোপনে থেকে যাওয়ার মতই থেকে যায় অবিচ্ছেদ্য জীবনের দিন। কত রঙিন, কত আশার আসর বসেছিল হৃদয়ে, আজ তা বেরঙিন মুখাপেক্ষী কলমি লতার মত আঁকড়ে আছে। ভাষাহীন জীবনযাপনে মত্ত দুটি প্রাণ। নেই আগের মত চাঞ্চল্য আর উচ্ছলতা। অজস্র ভাষা বুকে আঁকড়ে এগিয়ে যাওয়া নৌকাটাও স্রোতের ভাষা জানে। কিন্তু আজ ভালোবাসার মানেটা বুঝতে যোজন পথ ব্যবধানের রহস্য ঘেরা বৃত্তে আটকে গেছি। 


 আবৃত্তি- সীমা সাহা 


 

মুক্তগদ্য 


বাংলা ও বাঙালি

দেবর্ষি সরকার


তুমি না হয় একটু থামো।
থামোই না। অতশত কঠিন উচ্চারণ এবং কঠিন এর ইতিহাস শুনতে চাই না। তুমি কোথা হতে আসলে ও কোথা তোমার জন্ম তা জেনে আমাদের লাভ কি?
না। তুমি একটিবার ভেবে বলোতো, কত ইতিহাস কোন কাজে আসে আমাদের?
ওইযে দূরে মহিলাটি দেখতে পাচ্ছ গ্রামীণ,আঢ়পৌরে,কোলে তার শাকের বোঝা। সেই বোঝা নিয়ে বিক্রির আশায় পথ চলেছে। সেই নারী কি অত ইতিহাসে যানে তোমার? ইতিহাস জেনে কি তার পেট ভরবে? কক্ষনো না।
ও আবার একটি পাঁচ ছয় বছরের শিশুকেও দেখতে পাচ্ছি তার কোলে। আহা, কি জীর্ণ, কতটা রোগা পাট কাঠির মত শরীর টি। ইস্, কতদিন ওই না হয় আধপেটা খেয়ে আছে। সে তো কেবল ক্ষিদে কান্না পেলে মা মা বলে চেঁচামেচি করে আর কান্না করে। সে কি তোমার ইতিহাস জানে! সে ইতিহাস জেনে তার শরীরে হাতি বাস করবে তুমি বলো?

আবার ওই দিকে চাও তো। হ্যাঁ হ্যাঁ ওই দিকে। দেখো কতগুলো দিনমজুর কাঠফাটা রোদ্রের মধ্যে নিজেদের শরীরের ঘাম মাথা থেকে পায়ে ফেলে দিনরাত খেটে চলেছে ।দেখো তাদের দিকে চেয়ে ওই অভাবের শরীরে কোন অংশে তুমি তোমার ইতিহাসের ছাপ দেখতে পাচ্ছ! পাচ্ছ দেখতে! এ জন্মে পাবেনা।

ওই তো মাঠে কতগুলি শ্রমিক আলু তুলছে। তাদের বাচ্চাগুলো হয়তো এসে কাজ হাতে নিয়েছে। কিছু উপরি পয়সা কামানোর আশায়। তাদেরকে জিজ্ঞেস করো তো তারা তোমার ইতিহাস জানে নাকি ।শুনতে পেলে বলো আমাকে।

এবার এদিকে এসো। হ্যাঁ এদিকে, ওইযে সামনে দেখতে পাচ্ছ কতগুলি বৃদ্ধগোছের ও না না পুরুষ মরদোও তো আছে কতগুলো। দেখতে পাচ্ছ না তারা তাস পেটাচ্ছে আর থেকে থেকে চিৎকার করে উঠছে। এদের মধ্যে গিয়ে জিজ্ঞেস করো তো কজন তোমার সুগভীর ইতিহাস জানে! বলতে পারবে না, মোটেও না।

ওই যে দেখতে পাচ্ছো সামনে নিসন্তান ,স্বামীহীন দরিদ্র মহিলাটি অনবরত কেঁদেই চলেছে, তার স্বামী কাল বেঘোর ট্রেনে কাটা পড়েছে। স্বামী জীবিত থাকা অবস্থায় সে ছিল তাদের পরিবারের একমাত্র সহায় ও সম্বল। সারা জীবন মুখবুজে অভাবে দিন কাটিয়ে, আধপেটা খেয়ে বা কোনদিন না খেয়ে তার দিন কেটেছে। আর বর্তমানে স্বামী মারা যাওয়ার পর তার জীবনের দুঃখ আরো অতিরঞ্জিত হয়ে উঠেছে। তাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করো তো সে তোমার ইতিহাস কতটা জানে বলতে পারবে না। বুঝলে তো বলতে পারবেনা।

যদি তোমার খুব ইচ্ছে হয় নিজের ইতিহাস শুনবার তাহলে দৌড়ে চলে যাও ওই সামনের বিলাসবহুল বাড়িটাতে। ঘরে ঢুকেই দেখতে পারবে ঠান্ডা ঘরে এক মস্ত বই পাহাড়ের মধ্যে একটি মানুষ মুখ খুঁজে বসে আছে। সামনে তার সারি সারি বই এবং কিছু বই খোলা অবস্থায় পরে রয়েছে। অর্থ আছে, সুখ আছে, বিলাসিতা আছে ,প্রেম আছে, খাওয়ার যথেষ্ট যোগান আছে ,তাই তার কোন চিন্তা আছে বলে মনে হয় না ।সারাটা দিন পাহাড় ধ্বংস করে চলেছে। তাকে জিজ্ঞেস করো তোমার ইতিহাস দেখে চোখ বন্ধ করে অনর্গল বলে দেবে। সেসময় দেখবে তার মোবাইলটি তোমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে সে বলবে ,আমি যা বলছি তা ভিডিও বন্দি করে রাখুন। পরে সেই ভিডিওটি গণমাধ্যমে দেখিয়ে সে পরিচিতি ও নাম কামাবার বৃথা চেষ্টা করবে ।নিজের পাল্লাকে কেবল সে ভারি করতে পারে ,তার চেয়ে বেশি কিছু নয়।

আমি বলি ওদিকে যেও না। কখনো ভুলেও যেও না। জন্ম লগন হতে চিরটা কাল তুমি ছিলে অতি শান্ত ,স্নিগ্ধ ,সরল,সবল নিরহংকারী মানুষ। ওদিকে গেলে যান্ত্রিকতা ও স্বার্থপরতার কাটা তোমার বুকে ,শরীরে বিধে বসবে। ওদিক থেকে নিজেকে সবসময় সামলে রাখবে ভাই।

তার চেয়ে বরং এদিকে এসো। এই যে দেখতে পাচ্ছো হাতের আঙ্গুলগুলো সেগুলোই তোমার  ইতিহাস ঠিক ঠাক ভাবে জানে। এইযে পায়ের নিচের সবুজ ঘাস গুলোকে দেখতে পাচ্ছো এদের জিজ্ঞেস করো নিজের ইতিহাস দেখবে একটা দমকা বাতাস দম করে এসে এদেরকে মাথা ধরিয়ে ঝাঁকিয়ে দেবে। ঘাসগুলি এইভাবে তোমাকে জানান দেবে যে তারাও তোমার  গরিমার ইতিহাস সম্পূর্ণ অবগত। 
যে দমকা বাতাসটি তোমার  চুলগুলোকে এলোমেলো করে দিয়ে গেল সেও হয়তো তোমার জন্মের সময় ঠিক এমনটি ছিল। সেও হয়তো ওই স্থানটিতে উপস্থিত ছিল যখন তোমার জন্ম হয়েছে, সে জানে তোমার ইতিহাস। সামনে যে ওই যে স্রোতস্বিনী নদী দেখতে পাচ্ছো সেই নদীটাও জানে তোমার জন্মের ইতিহাস ।গিয়ে জিজ্ঞেস করো, শুনতে পাবে।
আরোও যদি শুনতে হয় চলো উত্তরে যাই। সেখানে আছে গগনভেদি অসংখ্য পাহাড় পর্বত।
সেই পাহাড়কে না হয় জিজ্ঞেস কোরো জন্মের ইতিহাস । ওই পাহাড়ে যখন উঠবে তখন দেখতে পাবে সাদা তুলোর মত শুভ্র মেঘ তোমার ,আমার শরীর ছুঁয়ে যাবে, তাদেরকে তখন না হয় জিজ্ঞেস কোরো নিজের ইতিহাস, সেও বলে দেবে  ইতিহাসের বৃত্তান্ত।কারণ তার তো কোনো চিন্তাই নেই। মাথাহীন ব্যক্তির আবার মাথাব্যথা!
আর যদি বলো ভালোবাসা তবে বলি ঠান্ডা ঘরে বিলাসিতায় জীবন কাটিয়ে ভালোবাসা কখনো আসে না ভাই। বহুকাল আগে আমি তখন ছিলাম না সত্যি তবে পরে যা জেনেছি, যা শুনেছি তাতে করে বলতে পারি তুমি যখন প্রায় মরেই যাচ্ছিলে তখন কোন বিলাসবহুল ব্যক্তি নিজের চৌপদি থেকে মুখ সরিয়ে কোমর বেঁধে তোমাকে উদ্ধার করতে আসেনি। বলতে পারবে তাদের পরিচয়!  পারবে না। তখন এসেছিল ওই শাক বিক্রি করা মহিলাটি, তোমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল ঐ দিন মজুর গুলো , তোমাকে সাহস যুগিয়েছিল আলুক্ষেতে কাজ করা শ্রমিক গুলো ,তাস পেটানো মানুষগুলোও তোমাকে উদ্ধার করতে এসেছিল কোমর বেঁধে। এসব মানুষের রক্ষক হয়ে তখন কাজ করেছিল চারপাশের পঞ্চভূত।
এরা সাধারণ মানুষ, খেটে খাওয়া মানুষ সবাই। দিন গেলে যাদের খাওয়ার জোগাড়ের চিন্তায় ভাঙা খাটে শুয়ে ঘুম উড়ে যায় তারা সেই সকল মানুষ।
ওই সাহেব সমান লোকদের সামনে যারা সারাদিন বইয়ের পাতায় মুখ গুজে বসে থাকে তাদের চোখে যারা "গ্রামীন," "গেয়ো ভূত," "অসহ্য," "পীড়িত," "দাস ," "জানোয়ার সমান," "ছোটলোক," "মানুষের কোন ধর্মই যাদের মধ্যে নেই","অসভ্য," "অশিক্ষিত"তারাই আপনার আসল বন্ধু। নিজেদের নামটা হয়তো তারা লিখতে পারেনা তবে তোমার নামটা তারা বুকে ভরসা নিয়ে উচ্চারণ করতে পারে দিনরাত।

এই আমরাই তোমার প্রকৃত মর্ম বুঝতে পারব ভাই। আর কেও নয়। তুমি আমাদের সাথে থাকো আমরাও তোমার সাথে থাকবো সবসময়। তোমার মর্ম আর কেউ বুঝতে পারবে না ,এ কথা ফলাও করে বলতে পারি। আমরা আমাদের চেতনা দিয়ে তাদের বন্ধদরজায় হানা দেব, তাদের শরীরের প্রত্যেক লোমকূপে পৌঁছে দেবো জয়ের আনন্দ। তাদেরকেও মাথায় আমরা পরাবো স্বরবর্ণ এবং ব্যঞ্জনবর্ণের গাঁথা মালা, তাদের হাতে তুলে দেব বর্ণ পরিচয়ের পুস্তক খানি।
চলো যাওয়া যাক।


 ভাবনা 


 আ মরি বাংলা ভাষা

মোদের গরব মোদের আশা

           চিত্রা পাল


মোদের গরব মোদের আশা/ আমরি বাংলা ভাষা। সত্যি এর কোন তুলনা নেই।আমার মাতৃভাষা বাংলা ভাষা আজ বিশ্বের সবচেয়ে মধুর ভাষা এমনও শুনেছি। মাগো বলে যখন ডাকি সে মা জননীকেই ডাকি,বা দেশমাতৃকাকেই ডাকি, বা জগত্‌জননীকেই ডাকি একেবারে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকেই সে ডাক, সে আহ্বান আসে, মায়ের কাছে সমর্পিত হয়ে। এমন মধুর ভাষা দুটি দেশের মাতৃভাষা। একটি স্বাধীন দেশের সরকারি ভাষাও। সে তো সহজে হয়নি। কত প্রাণের বিনিময়ে কত ত্যাগের বিনিময়ে হয়েছে। সব চেয়ে বড় কথা আমাদের মাতৃভাষার জন্য এক স্বাধীন দেশের জন্ম  হলো। আর রক্তাক্ত ২১শে ফেব্রুয়ারি দিনটি ঘোষিত হলো সারা পৃথিবীর সবার মাতৃভাষা দিবসের সম্মান রূপে।  

 এমন করে ভালোবেসে যে ভাষাকে আমরা আন্তরিক মর্যাদা দিয়েছি, সম্মান দিয়েছি, তার ভালোবাসাতে  ঘাটতিও কিছু কম হচ্ছে না আজকাল। তার শুদ্ধ প্রবাহে মিশে যাচ্ছেঅন্য ভাষা।  পথে ঘাটে সাধারণ বাক্যালাপে প্রবলবেগে মিশে যাচ্ছে ইংরেজী হিন্দী এসব ভাষা।পরিষ্কার শুদ্ধ বাংলায় সাধারণ কথাবার্তা বলার লোকের সংখ্যা বেশ বিরল।এ প্রজন্মের বাঙালিরা এই মেশানো ভাষাতেই কথা বলতে যেন স্বচ্ছন্দ। এমনভাবে  এভাবে আমাদের মাতৃভাষা হারিয়ে যাক তাও যে আমরা চাই না। আমরা চাই আমাদের গর্ব হয়েই থাকুক আমাদের মাতৃভাষা। সে ব্যাপারে আমরাই যদি সচেতন হই তাহলে লাভ আমাদেরই। আমরা আমাদের মাতৃভাষাকে সহজে ধরে রাখতে পারবো ।                  

 



 আমন্ত্রিত কবিতা 


অশ্রুময় ৮ই ফাগুনে
সপ্তাশ্ব ভৌমিক

বুলেটের বুকে যত ক্রোধ 
বর্বরের নৃশংস বোধ 
চিনেছিল এই প্রতিরোধ
অক্ষরের অভ্রান্ত আগুনে
অশ্রু-ময় ৮ই ফাগুনে! 

ভাষা আজো শপথের প্রাণ 
ভাষা আজও হৃদয়ের গান 
ভাষা আজও বিশুদ্ধ স্নান 
স্বপ্ন-মুগ্ধ শহীদের দানে
অশ্রু- ময় ৮ই ফাগুনে!


 মুক্তগদ্য 


ভাষাহীনা ভাষার বেদনা’
অলকানন্দা দে

যবে থেকে পুরোনোকে ভেঙে নতুন সংস্কৃতির ব্যস্তসমস্ত স্টেশনে এসে পৌঁছেছি আমরা, তবে থেকেই পড়ার প্রতি আগ্রহ কমে গেছে আমাদের অবিশ্বাস্যভাবে। মুঠোয় ধারণ করা জগতটা কোন লেখা দেখলেই, সেটা গল্প হোক কবিতা হোক প্রতিবেদন হোক প্রবন্ধ হোক স্মৃতিকথা হোক বা ভ্রমণ কাহিনী, ভীষণ অনীহা দেখায় পড়তে জেনেশুনেই। মনেহয় এটাই ভাবে, এই এত বড় কথার পাঁচালি পড়ে শেষ করার ধৈর্য বা সময় কোথায়। যা বলার সংক্ষেপে বলো, ছোট করে বলো। এই ছোট হয়ে যাওয়া কথারা যে ভাব প্রকাশে একান্তই ব্যর্থ। এসে যায় আবার সেই ইন্টারনেট স্মার্টফোনের কথা। এখানে মাতৃভাষাকে কোণঠাসা করে এক জগাখিচুড়ি আয়োজনে যে কথোপকথন চলে তাতে মনে হয় আমরা জগতের সেরা দরিদ্র, ভাষাহারা। দশজনে যখন মশগুল হচ্ছে এই ভাঙাচোরা বাংলা ভাষার কথার মৌজে, তখন ভেতর থেকে এক চড়া হাঁক আসে, ‘আমি নিলামে উঠেছি দেখো বিস্মরণের শিরায় শিরায়!’ দুঃখটা ঘুরপাক খায় বাংলা ভাষার আদুড় অবস্থা দেখে!

পৃথিবীর এই স্মার্ট মঞ্চে কিন্তু ভাষা চর্চা এলাহিভাবে হতে পারতো। এখানে আমি মাতৃভাষার কথাই বলছি। পৃথিবীময় এই যোগাযোগের প্রসার ভাষাকে আরও প্রসাধনে সাজিয়ে পেশ করতে পারতো মানুষের সম্মুখে। কিন্তু না, এই ব্যবস্থা সবথেকে আগে যেটা হরণ করল তা হ’ল ধৈর্য। শর্টকাট পথ দেখাল যাবতীয় চিন্তাভাবনাদের এবং কথাদের। তাই লেখার মাধ্যমে কোনকিছু বলতে চাওয়া আশাকে গুঁড়ো করা আর কি। লেখা তার আওয়াজ হারিয়েছে এই রঙ্গিলা পৃথিবীর মঞ্চে। আগেই বললাম, পড়তে না চাওয়াটাই এখন স্বভাবী ধরে নিতে হবে। ভাষা আর মুখ খোলে না তাই। ছন্নছাড়া কাল বুঝি শপথ নিয়েছে ভাষাকে ভুলিয়েই ছাড়বে। সেই পথে এগোচ্ছি সকলে ত্যাগ করে শেকড়ের যা কিছু। এ অসুখ মন থেকে মনে স্নায়ু থেকে স্নায়ুতে ছড়িয়ে গেছে অতিমারীর মতোই। খুব প্রয়োজন একে রোধ করা। না হলে সংকেত ভাষার দাসত্ব করতে করতে ভাব বিনিময় বন্ধ হবে চিরতরে একদিন। এভাবে চলা তো সুস্থ হতে পারে না। বাংলা ভাষার শ্রীমুখ অভ্যর্থনার অভাবে ক্রমাগত একাকীত্বে ভোগে। মানুষের বর্ধমান অবহেলা প্রাণ নিতে পারে তার।

তবে পাঠক পরিবার কি একেবারেই মুছে গেল। না, তেমন তো নয়। না হলে লেখালেখি নিয়ে এখনো নাড়াচাড়া করছেন যাঁরা তাঁরা তাঁদের উৎসাহ ধরে রেখেছেন কিভাবে! আসলে তুলনায় এত অল্প যে কষ্ট হয় মানিয়ে নিতে। প্রতিদিন একটু একটু বই পড়া এই ধৈর্যকে ফিরিয়ে আনতে পারে নিশ্চিত। বই মনঃসংযোগ বাড়ায়, পড়ার প্রতি আগ্রহ বাড়িয়ে অভ্যাসকে গড়ে অবহেলা সরিয়ে। ‘পড়া’ কে ভালোবাসতে পারলে আলাদা মানসিক তৃপ্তি যা চিরসঙ্গী আমাদের। বিপন্ন মাতৃভাষার হাতদুটো ধরে তাকে মনের সদর অন্দরে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা বাংলার অস্তিত্বকে পতন বিমুখ করতে পারে। না হলে ধরিত্রীর ইতিহাসে শুকিয়ে যাওয়ার বড় ভয় আছে যা অপমান অভিমান ও লজ্জার।  


 

গল্প 


আ মরি বাংলা ভাষা!
 দেবদত্তা বিশ্বাস
      
      সকাল থেকে মন ভালো নেই গাবলুর।সারারাত ধরে মায়ের পাশে চুপটি করে শুয়ে কেঁদে কেঁদে চোখগুলো একদম টোপাকুলের মত ফুলে উঠেছে।কাঁদবে নাইবা কেন?কাল রাতে বাবা মার কম কথা কাটাকাটি হল না গাবলুকে নিয়ে।তারপর থেকে মা একদম গুম মেরে রয়েছে।ঘটনা হল গাবলু এবারের পরীক্ষায় ইংরেজিতে খুব কম নম্বর পেয়েছে।গাবলু ইংলিশ মিডিয়ামে ক্লাস সিক্সে পড়ে।ওদের ইংরেজির চাপটাই বেশি।কিন্তু গাবলুর যে বরাবর বাংলাটাই ভালো লাগে।পড়ার বইয়ের নিচে লুকিয়ে ছোটদের নানা বই পড়া ওর অভ্যাস।মা বলেছে, সেটাই নাকি কাল হয়েছে।বাবা তো এই যুক্তি মানতে নারাজ।বাঙালির ছেলে বাংলা পড়বে না এ কেমন কথা?ওদিকে স্কুলের সব গার্জিয়ানের মাঝে মায়ের তো মান সম্মান যায় যায়।
          গাবলুর খুব খিদে পায়।মাকে ভয়ে ভয়ে বলে মা কিছু খেতে দাও।মা দুম করে মুখের সামনে থালাটা রেখে দিয়ে দূরে সরে যায়।গাবলুর কান্নায় গলার কাছে কিছু একটা দলা পাকিয়ে ওঠে।ছুটে ঘরের ভিতরে গিয়ে মুখ লুকিয়ে কাঁদে সে।কাঁদতে কাঁদতে কখন যেন ক্লান্ত গাবলু ঘুমিয়েও পরে।হঠাৎ গাবলু দেখে ওর মাথার সামনে একজন দাঁড়িয়ে।ওর থেকে খুব বেশি বড় নয় ছেলেটা।ছেলেটা পরম যত্নে গাবলুর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে কিগো কাঁদছো কেন?মা বকেছে তাই মন খারাপ?গাবলু বলে তুমি কিভাবে জানলে?ছেলেটি মুচকি হেসে বলে আমি সব জানি।গাবলু গোমরা মুখে বলে এভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে অন্যের কথা শোনা কি ঠিক?ছেলেটি উত্তর দেয় না।শুধু মুচকি হেসে গাবলুকে বলে এসো আমার সাথে এসো।এই বলে নিজের হাতের পাতা দিয়ে গাবলুর দুই চোখ বন্ধ করে।মুহূর্তে ওরা পৌঁছে যায় একটা স্তম্ভের নিচে।জায়গাটাকে খুব চেনা লাগলেও গাবলু মনে করতে পারে না ঠিক।গাবলু খুব আশ্চর্য বোধ করে।এমন সময় দূর থেকে আরো দুজন ছেলে আসে।হাসিমুখে তিনজনে দাঁড়ায় গাবলুর সামনে।সবার হাতে একটা করে মোমবাতি।গাবলু ও একটা মোমবাতি হাতে নেয়।ওদের অনুসরণ করে বাতিটি জ্বালিয়ে দেয় স্তম্ভের সামনে।ওরা হাতে হাত রেখে গোল হয়ে দাঁড়ায়।গাবলু মোহাচ্ছন্নে আবিষ্ট হয়ে ওদের হাত ধরে চোখ বন্ধ করে।দৃশ্যপট বদলে যায় ঘনঘন।তখন ঢাকা শহরের বুকে দলে দলে তরতাজা প্রাণ বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে শাসকের বিরুদ্ধে।নিজের মাতৃভাষার স্বীকৃতির দাবিতে ওরা প্রাণ দিতে প্রস্তুত।একটা সময় শাসক দল গুলি চালায় ওদের উপরে।একে একে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে তরতাজা প্রাণগুলো।ওই তো ওই তো!ওরা তিনজনই তো এগিয়ে আসছে ভিড়ের পিছন থেকে সামনে।নির্ভীক !দুর্দম!মুখে ওদের স্লোগান।নিজের প্রাণের ভাষা,নিজের গর্বের ভাষার স্বীকৃতির দাবিতে ওরা অনড়।সামনে থেকে গুলি চলে গুম গুম গুম।লুটিয়ে পড়ে ওরা তিনজন।রক্তে মাখামাখি হয় রাজপথ।শেষ শ্বাস পর্যন্ত ওদের মুখে একটাই কথা জয় বাংলা!এরপর সব কিছু নিস্তব্ধ হয়ে যায়।
        চমকে চোখ খোলে গাবলু।এক ঝটকায় হাত সরিয়ে নেয় ওদের হাত থেকে।হাসিমুখে ওরা নিজের পরিচয় দেয়।ওরা রফিক, বরকত ও সালাম।সমবেত কন্ঠে ওরা শহীদ মিনারের সামনে গাইতে থাকে "মোদের গরব মোদের আশা আ মরি বাংলা ভাষা"।গাবলু ও মন্ত্রমুগ্ধের মতো ওদের সাথে গলা মেলায়।আহ্ !কি তৃপ্তি কি আনন্দ।নিমেষে মন ভালো হয় গাবলুর।মায়ের বকাবকি আর ওর মন খারাপ করতে পারে না।গাবলু আরো জোরে জোরে মাথা দুলিয়ে গাইতে শুরু করে।ওরা তিনজন মিলে গাবলুর পিঠ চাপড়ে দেয়।

পরিচিতি 


আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস
 সম্রাজ্ঞী রায় 

      'মা' মানেই  আবেগ, নাড়ির টান। সেই মায়ের মুখের ভাষা 'মাতৃভাষা '। কিন্তু মাতৃভাষার জন‍্য আত্মবলিদানের কথা ২১ ফেব্রুয়ারির আগে পৃথিবীর ইতিহাসে ছিল না। মাতৃভাষাকে ঘিরে আন্দোলনের পটভূমিটি ছিল আমাদের প্রতিবেশী দেশ, বাংলাদেশ।  
      ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে ধর্মের ভিত্তিতে  গঠিত হয় পাকিস্তান- পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তান। মূলত  পশ্চিম পাকিস্তান  শাসন করতে থাকে সম্পূর্ণ পাকিস্তানকে। পশ্চিম পাকিস্তানের ভাষা উর্দু আর পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা। সরকারি বেসরকারি সমস্ত কাজকর্মে চাপিয়ে দেওয়া হতে থাকে উর্দু ভাষাকে।বাংলা ভাষার মানুষ  ক্রমশ হতাশ হতে থাকেন। শুরু হয়  আন্দোলন। ক্রমে তা পরিণত হয় রাষ্ট্র বিপ্লবে।
        ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি  শাসকের বর্বর অত‍্যাচার ও গুলিতে নিহত হন অনেক  আন্দোলনকারী। তবুও বিপ্লব চলতে থাকে। ক্রমে বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমানের  নেতৃত্বে  স্বাধীন  রাষ্ট্র গঠিত হয়, নতুন নাম হয় বাংলাদেশ। তার মূল ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায় বাংলা ভাষা। তাই ২১শে ফেব্রুয়ারি দিনটি বাংলাদেশে ভাষা শহীদ দিবস হিসেবে পালিত হয়।
       ২০১০সালে রাষ্ট্রপুঞ্জের ৬৫ তম অধিবেশনে ২১ শে ফেব্রুয়ারি দিনটিকে সর্বসম্মতিক্রমে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে ঘোষনা করা হয়।
    এর মাধ্যমে  বিশ্বের দরবারে আবারও বাঙালির দেশপ্রেম তথা মাতৃভাষার প্রতি প্রেম প্রতিষ্ঠিত হল।

 


 আমন্ত্রিত কবিতা 


একুশে ফেব্রুয়ারি 
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় 

বার বার তুমি ফিরে ফিরে আস
একুশে ফেব্রুয়ারি 
চোখে ভেসে ওঠে মৃত্যুমিছিল
আঁকা হয় সারি সারি 
ভাষার সে গান শহীদের দান
আজও হায় শোনা যায় 
রক্ত ঝরানো ফোটা ফুল গুলি 
আসে না তো ফিরে হায়।

সাঁঝের আজানে শঙখ ধ্বনিতে
শুনি মর্মর ধ্বণি 
রফিক সালাম জব্বার ভাই 
মাতৃভাষার মণি 
কেঁপে ওঠে বুক ছুঁয়ে যায় মন
একুশ কে কাছে পেলে 
ভাষার লড়াইয়ে কতগুলো প্রাণ 
অকালে গেল যে চলে।


 

আমন্ত্রিত কবিতা 


পলাশ ভালোবাসা
দেবযানী সেনগুপ্ত

রক্তলাল পলাশ বেদি
 বরকত রফিক ঘুমিয়ে ওই
 মাতৃভাষার মান বাঁচাতে
 শহিদ আমার হাজার ভাই।
 রক্তে রাঙা একুশ আসে
 শাহবাগের শহিদ মিনার
 রক্ত ঝরা হৃদয় এখন
 পলাশ হয়ে ছড়িয়ে পড়ে!
 ফাগুন- আগুন আলিঙ্গনে
 ঘুমিয়ে আছে আমার ভাই
 পলাশ ফুলের ভালোবাসা
 আমরা তোদের ভুলব না।।