তাঁতশিল্পে মণিপুরি নারীদের অবদান
শেখ একেএম জাকারিয়া
মণিপুরি জাতি ভারত ও বাংলাদেশের একটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বা জনসমাজের নাম। এদের আদি বসতি ভারতের মণিপুর রাজ্যে। মণিপুরিদের স্বকীয় ভাষা,বর্ণমালা,সাহিত্য ও সমাজনীতিসহ সমৃদ্ধ সংস্কৃতি রয়েছে। বর্তমানে ভারতের মণিপুর রাজ্যে ও বাংলাদেশের সিলেট বিভাগের বিভিন্ন অঞ্চলে মণিপুরি গোষ্ঠীর মানুষ বাস করে। বইপত্রাদি ঘেঁটে জানা যায়,বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে অষ্টাদশ শতক থেকে় মণিপুরিদের বসবাস। বর্তমানে এ দেশে প্রায় দেড় লক্ষ মণিপুরি বাস করে। মণিপুরি নারীদের সুনাম আছে তাঁতে তৈরি কাপড়ের জন্য। তাঁতে কাপড় বুননের জন্য তাদের নিজস্ব তাঁত রয়েছে। মণিপুরি নারী তাঁতিরা জন্মসূত্রে মায়ের কাছ থেকেই তাঁতের কাজ শেখেন। এ সম্প্রদায়ের শতকরা ৯৫ ভাগ নারী তাঁতশিল্পের সাথে জড়িত। সিলেটের শ্রীমঙ্গল, বিশেষ করে মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জে প্রায় ৬০টি গ্রাম মণিপুরি তাঁতশিল্পের জন্য বিশেষভাবে খ্যাত। কমলগঞ্জ উপজেলায় বিভিন্ন স্থানে মণিপুরি সম্প্রদায়ের মুসলিম নারীরা তাঁতের কাজ করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। জানা যায়,পুরো উপজেলায় প্রায় ২৫০ জন মুসলিম মণিপুরি নারী তাঁতের কাজ করছেন। আগে মণিপুরীদের মধ্যে বিষ্ণুপ্রিয়া ও মৈতৈরা এই কাজ করতেন। বর্তমানে নানা রঙের সুতো দিয়ে ফুল তুলা তাঁতের কাপড়ের দেশে-বিদেশে ব্যাপক চাহিদা থাকায় মণিপুরি মুসলিম নারীরা এ কাজে উৎসুক হয়েছেন । বাংলাদেশের প্রাচীন হস্তশিল্পের মধ্যে মণিপুরি হস্তশিল্প সু-প্রসিদ্ধ। এ হস্তশিল্প অনেকটা উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত। মণিপুরি সমাজে মেয়েদের তাঁতশিল্পের অভিজ্ঞতাকে বিয়ের ক্ষেত্রে বিশেষ যোগ্যতা হিসেবে দেখা হয়। মেয়েরা যখন জন্ম নেয়, একটু বড় হলেই মায়েরা মেয়েদেরকে তাঁতে বুনন কাজ শেখান এই উদ্দেশ্যে যে, এ কাজ শিখলে তাদের বিয়ের সময় এটা যৌতুকের একটা অংশ হিসেবে কাজ করবে। মনিপুরিদের বস্ত্র তৈরির তাঁতকল বা মেশিন প্রধানত তিন প্রকার। যেমন কোমরে বাঁধা তাঁত, হ্যান্ডলুম তাঁত ও থোয়াং। এই তাঁতগুলো দিয়ে সাধারণত টেবিল ক্লথ, স্কার্ফ, লেডিস চাদর, শাড়ি, তোয়ালে, মাফলার, গামছা, মশারি ইত্যাদি ছোট কাপড় তৈরি হয়। প্রধানত নিজেদের তৈরি পোশাক দ্বারা নিজেদের প্রয়োজন মেটাতেই সুদূর অতীতে মণিপুরি সম্প্রদায়ের মধ্যে তাঁত শিল্প গড়ে ওঠেছিল। পরবর্তীকালে তাঁত শিল্পে নির্মিত পণ্যসামগ্রী বাঙালি সমাজে প্রশংসিত ও ব্যবহৃত হয়। বিশেষ করে নকশাযুক্ত ১২ হাত মণিপুরি শাড়ি, নকশি ওড়না, চিত্তাকর্ষী শীতের চাদর বাঙালি মহিলাদের সৌখিন পরিধেয়। লোকপ্রিয় মণিপুরি নকশা হচ্ছে ঝাউ গাছ, সেফালি ফুল এবং মন্দিরের চিত্র। নকশাগুলো মইরাং ফি নামে বিদিত। রাজকুমারী 'মইরাং থইবি' নামানুসারে এ নামপ্রদান হয়েছে। জামদানি তাঁতে কাপড়ের ক্ষেত্রে নকশা তোলার জন্য মণিপুরি নারীরা সুচের মতো এক ধরণের তীক্ষ্ণ যন্ত্র ব্যবহার করেন,যার ফলে এ কাপড় বাঙালি নারীদের নিকট অতি প্রিয় হয়ে ওঠেছে। মণিপুরি নারীদের মুখ থেকে জানা যায়, তাদের তাঁতে কী ধরণের কাপড় বুনা হবে সেটা বেশিরভাগ সময় স্থানীয় আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করে। অদূর অতীতে মনিপুরি নারীরা আরও অনেক ধরণের নকশাযুক্ত কাপড় তৈরি করতেন। যেমন কানাপ, খাম্মেন, চাতপা, সাতকাপা ফি ইত্যাদি। এগুলো এখন আর তেমন একটা দেখা যায় না। নকশা তৈরিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন মণিপুরি নারীরা। বর্তমানে মনিপুরিরা নিজেদের ব্যবহার ও বাজারে বিক্রয়ের জন্য তৈরি কাপড়ে কিছুটা সহজ প্রকৃতির নকশা তোলে আনেন। সিলেটের মণিপুরি তাঁতের সুনাম এখন দেশজুড়ে। দিন দিন বাড়ছে মণিপুরি তাঁতের তৈরি পোশাকের কদর ও চাহিদা। বাড়ছে মণিপুরি তাঁতের তৈরি পোশাক বিক্রির দোকান। সিলেট শহরের লামাবাজারেই রয়েছে একশ'র বেশি মণিপুরি পোশাকের দোকান। সিলেটে বেড়াতে এসে মণিপুরি তাঁতের তৈরি পোশাকের দোকানগুলোতে ঢুঁ মারেন না, এমন নারী পাওয়া যাবে না। প্রায় সময়ই পরিব্রাজকদের ভিড় লেগেই থাকে লামাবাজারের দোকানগুলোতে। বছরের এ সময়ে মণিপুরি পোশাকের চাহিদা খুব বেশি থাকে। শহরের প্রতিটি দোকানে চলে উদ্দীপনাপূর্ণ ক্রয়বিক্রয় । এখানকার উল্লেখযোগ্য শো-রুমগুলো হচ্ছে, জালালাবাদ মণিপুরি শাড়িঘর, তানজিনা মণিপুরি শাড়িঘর, নিউ শ্যামল মণিপুরি শাড়িঘর, শীতল মণিপুরি শাড়িঘর, রূপকথা মণিপুরি ঘর, ঐশী মণিপুরি শাড়িঘর প্রভৃতি। সিলেট শহরে মণিপুরি আবাস স্থাপন করা হয়েছে এমন পাড়া বা এলাকা রয়েছে ১২টি। এলাকাগুলো হচ্ছে, খাদিমপাড়া, শিবগঞ্জ, কুশিঘাট (নয়াবাজার), লামাবাজার, মণিপুরি রাজবাড়ি, লালাদিঘীরপাড়, আম্বরখানা, বড়বাজার, সুবিদবাজার, সাগরদিঘীরপাড়,কেওয়াপাড়া ও নরসিংটিলা। প্রতিটি পাড়াতেই আছে তাঁত। এ তাঁতে শিল্পদক্ষতাসম্পন্ন নারীর স্পর্শে প্রতিদিন তৈরি হচ্ছে নানারকমের পোশাক। শুধু সিলেট শহরেই নয়, বিভাগ জুড়েই আছে তাঁতের পোশাক তৈরির কারখানা। এ বিভাগের ৪ জেলায় মোট তাঁত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৪০০৮টি। তাঁতের সংখ্যা ৬৫০৩টি। তারমধ্যে হবিগঞ্জ জেলায় তাঁত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২৯১ এবং তাঁতের সংখ্যা ৫৩২টি, মৌলভীবাজার জেলায় তাঁত প্রতিষ্ঠান ৩১৩৭টি এবং তাঁতের সংখ্য ৫০৩৫টি, সুনামগঞ্জে তাঁত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১৬৮টি এবং তাঁতের সংখ্যা ২৫৫টি এবং সিলেট জেলায় তাঁত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৪১২টি এবং তাঁতের সংখ্যা ৬৮১টি। মণিপুরি নারীরা তাঁত দিয়ে প্রায় সব ধরনের পোশাকই তৈরি করেন । এরমধ্যে বিভিন্ন জাতের শাড়ি, চাদর, ফতোয়া, থ্রিপিস, বেড কাভার, পাঞ্জাবি, ছোটদের পোশাক ও শার্টের বেশি চাহিদা রয়েছে। তাঁতবস্ত্রের দরদাম সম্পর্কে মণিপুরি নারী তাঁতিরা জানান, প্রকারভেদে তাঁতের শাড়ি ৬০০ থেকে ২৫০০ টাকা, বালুচরি জামদানি ২৭০০ থেকে ৩২০০ টাকা, মণিপুরি শাড়ি ৭০০ থেকে ১৮০০টাকা, মনপুরা শাড়ি ৬০০ টাকা, পাঞ্জাবি ৩০০ থেকে ১৩০০ টাকা, ফতুয়া ২০০ থেকে ৫০০ টাকা, নকশিকাঁথা ৭০০ থেকে ২০০০ টাকা, গামছা ২৫০ টাকা, শার্ট ২০০ থেকে ২৫০ টাকা, শিশুদের পোশাক ৬০ থেকে ৫০০ টাকা,হাতব্যাগ ২০০ থেকে ২৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সিলেটে উৎপাদিত তাঁতবস্ত্র শুধু স্থানীয়ভাবেই বিক্রি করা হয় না,পণ্য বিক্রেতারা দেশের বিভিন্নস্থানে তা সরবরাহ করে থাকেন। সিলেটের প্রবাসীরাও মণিপুরি তাঁতশিল্পের প্রতি ঝুঁকতে শুরু করেছেন। এ কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পৌঁছে যাচ্ছে মণিপুরি পোশাক ও হস্তশিল্প। তাঁত ব্যবসায়ীগণ জানান, সরকারি পৃষ্টপোষকতা ও ঋণ সুবিধা পেলে এ শিল্প বিকশিত হবে। এতে শুধু সিলেটবাসী নয় পুরো দেশবাসী উপকৃত হবে।