সম্পাদকের কথা
উৎসব শেষে আবার শুরু একই পরম্পরা। ফিরে যাওয়া নিত্য জীবনে। এক একটি উৎসব আসে, প্রাত্যহিকতা থেকে মুক্তি পাই আমরা, পাই চলার রসদ। উৎসবের প্রয়োজন তাই অনস্বীকার্য। উৎসবের আলোতে আলোকিত হয় এমনকি প্রত্যন্ত অন্ধকারও।
কিন্তু আদৌ কি হয় তা ? তলিয়ে দেখলে উত্তরটা বোধহয় না-বাচক হবে। উৎসবের ঝলমলে দিনগুলিতেও অন্ধকার থাকে বহু মানুষের প্রাঙ্গন। কৈলাশ থেকে আসবার বা যাওয়ার সময় মা দুর্গা তাদের দাওয়ায় ক্ষনিকের জন্যও বসেন না, দীপাবলির আলো তাদের অন্ধকার ঘরে রশ্মি ফেলে না।
আলো আজও পড়ে নি আমাদের মননে, ভাবনায়, বৌদ্ধিক ভাবনায়। নিজেদের সৃষ্ট আইন তাই নিজেরাই ভাঙি শব্দ তান্ডব করে। দেশের কোনো মন্দিরে ঢুকতে আজও কোনো মা দুর্গা বা মহাকালী বাধা পান অনায়াসে।
উৎসব তখনই সফল হয় যখন প্রতিটি মুখে উৎসবের রেশ থাকে। উৎসব শেষে তাই বলা যেতে পারে প্রাণের, মনের, বোধের, মননের, রুচির, সংস্কৃতির উৎসব খুব দ্রুত আমাদের মধ্যে আসুক যেভাবে আসে নবান্ন কোনো এক কার্তিক দিনে।
আশা সেদিনের। নবান্নের নতুন প্রভাত আনুক নতুন সবকিছু আমাদের মাঝে।
এই সংখ্যায় আছেন যাঁরা
কুমকুম ঘোষ, সুব্রতকান্তি হোড়, যাজ্ঞসেনী, মৌসুমী চৌধুরী, সৌরবিশ্ব, নাসির ওয়াদেন, বেলা
দে, ইউনুস হোসেন,, কাকলি ভদ্র, সুব্রত নন্দী, রীনা মজুমদার, গায়েত্রী দেবনাথ, সব্যসাচী
ঘোষ, সুদীপ বাগ, পাপিয়া চক্রবর্তী, মহন্ত বিশ্বাস মোহন, দীপ্তিমান মোদক, মজনু মিয়া,
সুনন্দ মন্ডল, প্রসেনজিত রায়, চিত্তরঞ্জন সাহা, বাপ্পা রায়, সায়ন তরফদার
প্রচ্ছদ ও অন্যান্য ছবি- শৌভিক রায়
অনলাইন মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা, কার্তিক ১৪২৫ সংখ্যা
যোগাযোগ- হসপিটাল রোড, কোচবিহার
প্রকাশক- রীনা সাহা
সম্পাদনা, অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায়
অনলাইন মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা, কার্তিক ১৪২৫ সংখ্যা
প্রবন্ধ / নিবন্ধ
এপিটাফ : ২২শে অক্টোবর, ১৯৫৪
কুমকুম ঘোষ
"জীবনানন্দ দাশ-এর স্মরণে" প্রবন্ধে কবি বুদ্ধদেব বসু বলছেন--"কিছুকাল পূর্বে জীবনানন্দ দাশগুপ্ত স্বাক্ষরিত 'নীলিমা' নামে একটি কবিতা 'কল্লোলে' আমরা লক্ষ্য করেছিলাম ; কবিতাটিতে এমন একটি সুর ছিলো যার জন্য লেখকের নাম ভুলতে পারিনি।'প্রগতি'(১৯২৭) যখন বেরোলো, আমরা অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে এই লেখককে আমন্ত্রণ জানালাম, তিনিও তার উত্তর দিলেন উষ্ণ অকৃপণ প্রাচুর্যে। কী আনন্দ আমাদের, তাঁর কবিতা যখন একটির পর একটি পৌঁছতে লাগলো , যেন অন্য এক জগতে প্রবেশ করলাম----এক সান্ধ্য, ধূসর আলোছায়ার অদ্ভুত সম্পাতে রহস্যময়, স্পর্শগন্ধময়, অতিসূক্ষ্ম--ইন্দ্রিয়চেতন জগৎ --- যেখানে পতঙ্গের নিশ্বাসপতনের শব্দটুকুও শোনা যায়, মাছের পাখনার ক্ষীণতম স্পন্দনে কল্পনার গভীর জল আন্দোলিত হ'য়ে ওঠে। এই চরিত্রবান নতুন কবিকে অভিনন্দন জানিয়ে ধন্য হলাম আমরা।" ** ** ** ******** ** ** **
"কেবলি ব্যক্তির মৃত্যু হয়---তবু সময়ের কাছে
মানব ও মানবতা শাশ্বত কাহিনী হয়ে আছে।
ওরা মরে -- ফিরে আসে -- নতুন চেতনা এনে দেয়
যেন তা' অনাদিকাল থেকে শুধু অগণন গ্লানিক্ষয় শব
অন্ধকারে ব'য়ে তবু মহাজিজ্ঞাসার মর্মে উজ্জ্বল মানব " ..............
....…......................... ............
বন্ধু-সম্পাদক-কবি সঞ্জয় ভট্টাচার্য জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুর পরের বছর( 'দেশ' সাহিত্য সংখ্যা ১৯শে মার্চ,১৯৫৫) একটি প্রবন্ধ লিখলেন--"জীবনানন্দ দাশের কবিতা" এই শিরোনামে। সেখানে প্রথমেই তিনি বললেন--" রবীন্দ্রনাথের পর বাঙালি কবিতা- পাঠকের চিত্তে যদি কেউ প্রগাঢ় সাড়া এনে থাকেন তাহলে তিনি জীবনানন্দ দাশ। ভালো কবিতা লেখা আর ভালো কবি হতে পারা সম্ভবত এক কথা নয়। ভালো কবি উত্তরোত্তর ভালো কবিতা রচনা করে থাকেন।..........
........ কিন্তু শিল্প-কর্ম এমনই একটি ব্যাপার যাতে আন্তরিকভাবে ব্যাপৃত হলে শিল্পী ক্রমেই আত্ম-সংস্কার ও আত্মোন্নতি করে থাকেন। রবীন্দ্রনাথের পর আত্মোন্নতিতে যিনি সবচাইতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, তিনি ছিলেন জীবনানন্দ দাশ। জীবনানন্দ দাশের আত্মোন্নতি - পরায়ণতা রবীন্দ্রোত্তর কাব্যের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা এবং লক্ষণীয় বিষয়" ..........
.............................. ........
"সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধ্যা আসে ; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল ;
পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পান্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল ;
সব পাখি ঘরে আসে -- সব নদী -- ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন ;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।
********************************************************************
সিসৃক্ষু ব্যক্তি মাত্রই নির্জন ও নিঃসঙ্গ। কবি জীবনানন্দ দাশ ও আমৃত্যু এই নির্জনতা ও নিঃসঙ্গতা কে লালন করেছেন মননে , শব্দে ও চিত্ররূপ এর নির্মাণকল্পে।সেই তিনি "কবিতার কথা" প্রবন্ধের শুরুতেই লিখে দিয়েছেন এক অমোঘ চিরন্তন সত্য রূপ--" সকলেই কবি নয়।কেউ কেউ কবি; কবি -কেননা তাদের হৃদয়ে কল্পনার এবং কল্পনার ভিতরে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার স্বতন্ত্র সারবত্তা রয়েছে এবং তাদের পশ্চাতে অনেক বিগত শতাব্দী ধরে এবং তাদের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক জগতের নব নব কাব্য - বিকীরণ তাদের সাহায্য করছে। সাহায্য করছে ; কিন্তু সকলকে সাহায্য করতে পারে না; যাদের হৃদয়ে কল্পনা ও কল্পনার ভিতরে অভিজ্ঞতা ও চিন্তার সারবত্তা রয়েছে তারাই, সাহায্যপ্রাপ্ত হয় ;"......
..................... আত্মমগ্ন কবি তাই তাঁর শুদ্ধতম পাঠকের কথাটি ভাবেন গভীরভাবে এবং যেন প্রায় নীরব স্তোত্রের মত উচ্চারণ করেন--"কবিতার ভিতর আনন্দ পাওয়া যায় ; জীবনের সমস্যা ঘোলা জলের মূষিকাঞ্জলির ভিতর শালিকের মতো স্নান না করে বরং যেন করে আসন্ন নদীর ভিতর বিকেলের শাদা রৌদ্রের মত ; ------ সৌন্দর্য ও নিরাকরণের স্বাদ পায় ".....
........
......... কবি তাই আজীবন খুঁজেছেন হিরণ্ময় সকালের রোদ্দুর , ভিজে মেঘের দুপুর, জেগে থাকা মৃত নক্ষত্র ,উদ্বেল কাশের বন, কচি লেবুপাতার মতো নরম সবুজ আলো-- খুঁজেছেন আজীবন ...বেতের ফলের মতো নীলাভ ব্যথিত দুই চোখ আর প্রভাতীস্তবের মতো সান্ত্বনা খুঁজেছেন এই ভেবে---"কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে।".....
....... সেদিন রাতে সম্ভবত কুয়াশা ছিল--রূপসী বাংলার নীল কুয়াশা।
তারিখটি ২২শে অক্টোবর, ১৯৫৪, শুক্রবার ; বাংলা ৫ই কার্তিক , ১৩৬১ সাল।
রাত ১১টা ৩৫ মিনিট। কার্তিকের নীল কুয়াশায় কবি বিলীন হয়ে গেলেন("যদি আমি ঝরে যাই একদিন কার্তিকের নীল কুয়াশায় "--কবিতা সংখ্যা ১৭ : রূপসী বাংলা)
কবি জীবনানন্দ দাশ : রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কবিতার গগনের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র - পুরুষ।
যন্ত্রণার আনন্দে
সুব্রত কান্তি হোড়
বাংলা কাব্যে আধুনিকতার ছবি মূর্ত হয়েছিল তাঁর তুলির বিমূর্ত টানে। গহীন কোণ থেকে জীবনকে দেখেছিলেন ভিন্ন ভিন্ন স্বাদে, বিভিন্ন রূপে।সাদা খাতায় রাখা যন্ত্রণাময় আনন্দের স্বাদ, অব্যক্ত ভালবাসার আস্বাদে কারও মুখ তিতকুটে আবার কারো মনে অমৃতের ভাব ফুটে ওঠে। জীবনস্রোতের চিরাচরিত ধারাকে অগ্রাহ্য করে তাই বলতে পেরেছিলেন "শান্তশিষ্ট দেবতার দিন শেষ হয়ে গেছে, এখন সে পুরোপুরি দেবতা। কোন বিরাটতার নিকট মাথা নোয়াবার কোনো প্রয়োজন নেই।"
সত্যিই কোনো প্রয়োজন ছিল না।মাতা কুসুমকুমারী দাশগুপ্তের কাব্যচর্চায় প্রভাবিত শৈশব বাস্তব অভিজ্ঞতায় সরস হয়ে ব্যাথা বেদনার মধ্যেও প্রেমের উপাদান খুঁজে পেয়েছিলেন। তিনি তাই নষ্ট প্রেমের কথায় বলতে পেরেছিলেন" প্রেম তাকে ব্যাথা দিয়ে ঢের শিখিয়েছে। জীবনকে পরিপূর্ণ ভাবে গড়ে তোলার জন্য দরকার ছিল এই প্রেমহীন মমতাহীন সহানুভূতিহীন মেয়েটির শেষ প্রেমের স্পর্শ। জীবনের সব আশা বিশ্বাস স্বপ্ন কল্পনার মূল্য দিয়েও দেখেছে সেই রূপসী প্রতিমার বুকের ভেতর খড় আর ধূলো। শুধু শিশুসুলভ একটা বিহ্বলতা ব্যাথা নিয়ে বছরের পর বছর এই খড় মাটির কথা ভেবেছে সে। তারপর মনে হল এ পৃথিবী কেমন বৈদগ্ধবতী, এই পৃথিবীতেই থাকতে হয়। এইখানে বেঁচে, ভালবেসে নিষ্ফল হয়ে, নষ্ট প্রেমের কথা ভেবে ভেবে এমন একটা অপরিসীম চেতনার রস বুকের ভেতর জেগে ওঠে, সমস্ত সৃষ্টির গভীর অন্তরের ভিতর প্রবেশ করা সহজ হয়ে ওঠে। "
এই নীরব চেতনার অন্তর্দৃষ্টিতে প্রেমিক কুজ্ঝটিকার সাম্রাজ্যে বসে প্রতীক্ষায় ছিল সকল শ্লেষ উপহাসকে সহ্য করতে, ক্ষমা করতে।
তাই তো তিনি লক্ষ কোটি প্রেমিকের মত সাধারন মানুষ হয়ে ভালবাসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেই ভালবাসা তাকে এমন ঠকাল, সেই দুঃখ পৃথিবীর সকল বেদনার চেয়ে গভীরতম অন্ধকারের রূপ বলে মনে হল। জীবন পদে পদে অসঙ্গত অভদ্র ব্যবহার করলেও সফলতার মুখাপেক্ষী হয়ে ছিলেন। অবশেষে জীবনের সাথে মানিয়ে নিতে বেশ দেরী হয়ে গেল অন্তর্মুখী ব্যক্তিত্বের। তার কথায়
"পৃথিবীর কানে
শস্য গায় গান,
সোনার মতন ধান
ফলে ওঠে যেইখানে, —
একদিন —হয়তো —কে জানে
তুমি আর আমি
ঠান্ডা ফেনা ঝিনুকের মত চুপে থামি
সেইখানে রব পড়ে।"
চেয়েছিলেন সেই ভালবাসার আঁচলের নীচে লুকিয়ে থাকতে। কিন্তু সেই ভালবাসাই তাকে পথে পথে ঘুরিয়েছে, ব্যাথা দিয়েছে। একটি প্রেমিকার জন্য অনন্তকাল অপেক্ষা করবে ভেবেছে...। গভীরভাবে জীবনকে শ্রদ্ধা করে অন্য প্রেমিকের সরস উপাদান গ্রহণে সমৃদ্ধ হয়ে বলেছেন —
"ধূ-ধূ মাঠ,—ধানক্ষেত,—কাশফুল,—বুনো হাঁস, বালুকার চর
বকের ছানার মত যেন বুকের উপর
এলোমেলো ডানা মেলে মোর সাথে চলিল নাচিয়া।"
কিন্তু নিরেটভাবে সব বিশ্বাস হারিয়ে নিজেকে কখনও নক্ষত্রখচিত আকাশের রঙীন ফানুস মনে করেছেন আবার কখনো কাচের খেলনা যার পরতে পরতে চিড় ধরেছে। সব কিছুর অবসান এক রহস্যময় হাতে। ট্রামের শিথিল চাকায় পিষ্ট জীবন কারো কাছে দুর্ঘটনা আবার কারও কাছে স্বেচ্ছায় বিধাতার কোলে প্রত্যাবর্তন।
বিধাতার বৈদগ্ধ্য ও প্রখরতায় মুগ্ধ হয়ে অকথন-অসার সৃষ্টির গভীর অতলে ডুব দিয়েছিলেন। তুলে এনেছিলেন গাজনের রস। সিক্ত করেছিলেন নৈঃশব্দের ভাষা। সেই রস গ্রহণে মন বুঝেছে দুঃখ-যন্ত্রণা জমে জমে সুখ-আনন্দের বীজ জন্মায়। যার মধ্যে নিহিত ভবিষ্যতের স্বপ্নের আশা। তিনি গাইতে পেরেছিলেন তাই—
"কোন এক অন্ধকারে আমি
যখন যাইব চ'লে—আরবার আসিব কি নামি
অনেক পিপাসা লয়ে এ-মাটির তীরে
তোমাদের ভিড়ে!
......
নক্ষত্রের পানে যেতে-যেতে
পথ ভুলে বার-বার পৃথিবীর ক্ষেতে
জন্মিতেছি আমি এক সবুজ ফসল! —
.......
মাঠে—মাঠে—আড়ষ্ট পউষে
ফসলের গন্ধ বুকে ক'রে
বার-বার পড়ি যেন ঝরে!
.......
হেমন্তের রৌদ্রের মতন
ফসলের স্তন
আঙুলে নিঙাড়ি
এক ক্ষেত ছাড়ি
অন্য ক্ষেতে চলিব কি ভেসে
এ সবুজ দেশে
আর এক বার!
.......
ক্ষুধিতের ভাষা
বুকে ক'রে-ক'রে
ফলিব কি! —পড়িব কি ঝ'রে
পৃথিবীর শস্যের ক্ষেতে
আর একবার আমি—
নক্ষত্রের পানে যেতে-যেতে।"
অনলাইন মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা, কার্তিক ১৪২৫ সংখ্যা
একটি চিঠি
পরজন্ম
যাজ্ঞসেনী
আমি আবার আসব। আসব তোমাদেরই মাঝে। তোমরা, যারা আমাকে এত স্নেহ আর ভালোবাসা দিয়েছিলে, তাদের ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা থাকেনা। তবুও যেতে হয়। বড় মায়া। কত স্মৃতি। কত লেখা ! একটা লেখাও ঠিক লিখতে পারিনি। কিন্তু তোমরা, 'মুজনাই 'এর সবাই নিমেষে আমাকে আপন করে নিয়েছিলে। পরজনমে আমি তোমাদের সবার মনের মধ্যে ইচ্ছে হয়ে লুকিয়ে থাকব। যতবারই তোমাদের কোন ইচ্ছে হবে, আবারও দেখা হয়ে যাবে যাজ্ঞসেনীর সঙ্গে। প্রতিদিন, প্রতি পল, প্রতি মুহূর্তে-----।
অনলাইন মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা, কার্তিক ১৪২৫ সংখ্যা
মুক্তগদ্য /গল্প
ফেলে আসা বাড়িটি
মৌসুমী চৌধুরী
নিতান্ত সাদামাটা সেই কাঠের বাড়িটি তার বুকের ওমে ভরে রেখেছে আমার আস্ত মেয়েবেলাটি। বাড়িটিতে ঘর ছিলো মোট চারটি। দুটো বড় ঘর, আর দুটো মাঝারি। বাড়ির সামনে আর পিছনে ছিলো বারান্দা। সামনের বারান্দাটা বাঁশের তৈরি জাল দিয়ে ঘেরা ছিল। পেছনের বারান্দটা ছিলো খোলা। দুটো বারান্দারই শেষ প্রান্তে ছিলো মাঝারি সাইজের ঘর দুটো। পুবমুখী ঘরটিতে আমি থাকতাম আমার ঠাকুরদার সাথে। ঘুম ভাঙতেই হলুদ-রঙা রোদ্দুর দুলতে দুলতে, মাথা নাড়তে নাড়তে ঝাকড়া কাঁঠাল গাছটির ফাঁক ফোকর গলে হুমড়ি খেয়ে পড়ত বিছানার ওপর। দাদু মজা করে বলতেন, "ওঠো শিশু মুখ ধোও পর নিজ বেশ"... শীতকালে সোহাগী রোদ আলতো পায়ে যখন পৌঁছতো, তখন ঘাসের ডগায় ঝলমল করে উঠতো অযুত কোটি হীরক কুচি। জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখতাম আমি। আর ফাল্গুন-চৈত্র মাসে ঝেপে ফুল আসতো আশে পাশের পলাশ
গাছগুলোতে, যেন লালে লাল হয়ে উঠত
দিগন্ত। দূর দিগন্তের দিকে চেয়ে গরমের দুপুরগুলিতে মনটা ভারী উদাস হয়ে উঠতো আমার । অন্ধকারের জরায়ু ছিড়ে শারদ ভোর যখন ছুঁয়ে দিতো শিউলির ডাল তখন শিউলি-সুবাস উৎসব গন্ধ হয়ে নাকে লাগতো। আবার সাথে আমলকী বনের মতো দুরুদুরুও করতো বুকখানা, কারণ শারদ উৎসব শেষেই তো বার্ষিক পরীক্ষার রক্তচক্ষু....
গাছগাছালি, পাখপাখালির স্নিগ্ধতায় ভরা ছিলো সেই বাড়িটি। আর পাড়াটি দাঁড়িয়ে থাকতো পল্লী বধুর মতো "ছায়ার ঘোমটা মুখে টানি।" চারদিকে আম, কাঁঠাল, বেল, কৃষ্ণচূড়া, শিমূল, পলাশ ইত্যাদি নানা গাছেদের আদর আশ্রয়। মাথা উঁচু করে দেখতাম, গাছগুলো সবুজ পতাকা হয়ে ছুঁতে চাইছে সুনীল আকাশ। পাড়ায় ঢোকার মুখে একটা বিশাল শিমূল গাছে সারা বছর ঝুলতো প্রচুর মৌচাক। বছরের একটা সময় মনোজ কাকু লোকজন নিয়ে ভাঙতেন সেই মৌচাক। পাড়ার সবাই কিনে নিতেন সেই চাক-ভাঙা খাঁটি মধু।
সন্ধ্যেবলায় হ্যারিকেনের আলোয় দাদুর তত্ত্বাবধানে দক্ষিণের খোলা বারান্দাটিতে পড়তে বসতাম মাদুর পেতে।
হ্যারিকেনের ভূতুরে আলোয় তির তির করে কাঁপতো পাশের বাড়ির বেলগাছের ঘন সবুজ পাতা। ওই বয়সে গা-টা কেমন
যেন ছমছম করে উঠতো। পুটি বলেছিলো, সন্ধ্যের পর ব্রক্ষ্মদত্যি বেলগাছে বসে পা দোলায় আর ভুরুক ভুরুক করে তামাক টানে। দাদু বলতেন,
" না সোনা, ভূত-প্রেত বলে কিচ্ছু নেই। ওসব তো ছেলে ভোলানো গল্প কথা।" ছোট্ট মনটি আমার দোলাচালে পড়ে যেতো। তবুও কেন যেন সন্ধ্যেবেলায় বেলগাছটির দিকে তাকালে একটা শিরশিরে ভয়ের স্রোত নেমে আসতো শিঁরদাড়া দিয়ে।
আমাদের সেই বাড়িটির সাথে একরকম গলাগলি করে ছিলো পুটিদের
বাড়ি। ওদের লিচুর ডাল ঝুঁকে থাকত আমাদের বাড়ির সীমানায়, আর আমাদের শিউলি গাছটা মাথা বাড়িয়ে উঁকি দিতো ওদের বাড়ির দিকে। পুটিদের
লিচুতলায় প্রতিদিন বিকেলে বসতো গল্প দাদুর আসর। আমার দাদুর আদি অকৃত্রিম স্নেহরসে ভিজতো পাড়ার সব কচিকাঁচারা। ব্যাঙ রাজকুমার, ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমী, গোপাল ভাঁড়, শেওড়া গাছের শাঁকচুন্নি.... কত রকমারি গল্প থাকতো
দাদুর ঝুলিতে...
তারপর তো থাকলাম কত রকম
বাড়িতে... বিবাহসূত্রে শ্বশুরালয়ের প্রত্যন্ত গ্রামের বাড়ি, স্বামীর কর্মসূত্রে ভাড়া ফ্ল্যাট বাড়ি, নিজের পাথর খচিত আধুনিক ডিজাইনের বাড়ি... কিন্তু সেই কাঠের বাড়িটিতে আমাদের পাঁচজনের সংসারের অম্ল-মধুর স্মৃতি সাদা-কালো ছবি হয়ে মন ক্যামেরায় বন্দী রইলো চিরদিন। সেই বাড়িটির আনাচে কানাচে আজও যেন
ভেসে থাকতে দেখি প্রিয় কিছু মানুষের নির্ভেজাল ভালোবাসাকে, বাড়িটার পরতে পরতে ফুটে থাকতে দেখি আমার শৈশব
ও তার হাসি-কলতানকে....
আজ কে পুজো শুরু
সৌরবিশ্ব
গত কয়েকদিন উদাস হয়ে দিন কাটছিল শিউলির। শরতের শিউলির মতো মিষ্টি তার চোখ দুটো। সে চোখ খুঁজে বেড়াচ্ছে মানুষটাকে। বাড়িতে থাকলে ঝগড়া,,, দু চার কথা শোনাতে ছাড়ে না ,,,, অনেক দুঃখে ওটা অন্য রকমের সুখ।। মেয়ে মানষের মনের এ খবর পুরুষের বৈঠা তল পায় না।। আজ ছ'দিন হল, মানুষটা গেছে শহরে। আরে এ কদিন। দুগ্গা পূজা ছেল না!!! মেলার মাঠে ওই বড় পুজোয় শিউলির প্রকাশ তেলেভাজা বেচে,,, মেলা থেকেই কিনে আনে। রঙিন চুড়ি, মাথার চিরুনী, খোঁপার ফুল,,, রংবাজার থেকে শাড়ি। কিন্তু তার চেয়েও দামী ছ দিন পর বাড়ী আসা মানুষটার মুখ দেখা।
কাল রাতে ঠাকুর ভাসান গেছে,,,, মেলার মাঠে সব গুছিয়ে নেওয়ার পালা ।। বাড়িতে বউটা যে কি করছে,, প্রকাশনতুন কেনা শাড়ি টার দিকে চেয়ে একটু শান্ত হয়।
একটু পরেই ফিরবে মানুষটা,,,, যাই রান্না ঘরটা একটু গুছিয়ে রাখি,,,, নিজেকেই বলে ওঠে শিউলি।। এ শিউলি বারোমাসের,,,,
********************************************************************
ধুনুচি প্রতিযোগিতা চলছিল গতকাল শহরতলির ক্লাবে। আট বছরের পুটু ঢাকের তালে বাবার সাথে কাশি বাজাচ্ছিল।। আজ ভোরে বাড়ী বাড়ী ঘুরেছে,,, ঢাকবাজিয়ে আর একটু কিছু যদি পাওয়া যায়।। বাবা আজ বেশ খুশি।। বোন, ভাই, পুটু আর পুটুর মায়ের জন্য নতুন জামা কাপড় কেনা হবে। বাড়ী ফিরছে আজ পুটু। আজ থেকে শুরু ওর পুজো। গ্রামে গিয়ে বলতে হবে। পটা, গবু, সোনাদের শোনাতে হবে শহরের গল্প,,,, কত্ত লোক, ইয়া বড় ঠাকুর, আলো আর আলো,,,, কতো কথা । গল্প শুনতে শুনতে ওদের চোখ গুলো গোল্লা গোল্লা হয়ে যায়।। তখন পুটুর নিজেকে বীর বীর মনে হয়।
********************************************************************
আফ্রিনের মন খুব খারাপ।। কয়েকদিন দেখতে পায়নি সায়নকে।। আফরিনের বাবার বেশ কয়েকটা মাছ ধরার ট্রলার আছে। আফরিন১,আফরিন২ আফরিন৩---- এরকম নাম দিয়েছে আব্বু। তারই একটা চালায় সায়নের বাবা।
তখন খুবই ছোট, তখন থেকেই চেনে সমবয়সী সায়নকে।। তবে কবে থেকে সায়নকে ও সানু বলে ডাকে সেটা ও বলতে পারবে না।
দুর্গাপূজা শুরু হয়েছে বলে কলেজ বন্ধ।। কলেজে গেলে তবেই দেখার সুযোগ।।
তখন সবে ও ক্লাস টুএলভ,,, অনেক ভয়, গোঁড়ামি আরও অনেক কিছুর রক্তচক্ষু উপেক্কা করে পরিণত নারীর মত একদিন সানুকে জানিয়েছিল তাঁর মনের কথা।। বলেছিল বাঙালীর জীবনে চোদ্দ পাবনের জীবন চায় সে। ঈদের সাথে হিন্দুদের তের পার্বন জুড়ে পেয়েছিল বার মাসে চোদ্দ পাবনের কনসেপ্ট।। সানু ভয় পেয়ে , গিয়েছিল,,,, রাজি হয় নি।। ধীরে ধীরে সাহস জুগিয়েছে আরফিন।। এখন ওরা চোদ্দ পর্বনের স্বপ্ন দেখে একসাথে।
কলেজ খুললে শুরু হবে ওদের নতুন জীবনের বোধন।
অনলাইন মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা, কার্তিক ১৪২৫ সংখ্যা
কবিতা
দুটি কবিতা
নাসির ওয়াদেন
স্মৃতিপট
এখনও মনের ঝুল বারান্দার কোণে
কলেজ গালিচা ঘাস
ঠোঙা হাতে ঝালমুড়ি খাওয়া --
কলেজ লনের একপাশে দেবারতি
মধুমিতা নীলাদের গোপনে
বেড়ে ওঠা ঘরকন্নার কথা
দু'পেয়ে হাওয়ার মাঝে শূন্যে বিলীন
হ্যারিকেন আলো পেতে বিছানো ঘাস
পাশাপাশি ঘেঁষাঘেঁষি পর্দার ধুলো
নিবিড় জোছনার শীৎকার সুখ
গোপন পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডালে•••
পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নেই শুধু জ্বলা
সূর্যের মতো জ্বলে ওঠা
হাঁসের মৈথুন তীব্র কশাঘাত
ভাললাগা বুকে দস্যু নদী --
আলোর প্রাচীর গেঁথে ভাললাগা ঝড়
ফিরে আসে স্মৃতিপটে অদৃশ্যে পরস্পর
ডানাওয়ালা খেত
সব্জিগুলো নালিশ জানাতে জানাতে
ক্লান্ত হরিণ এক একজন যাযাবর
প্রত্যহ প্রত্যূষে প্রতিটি ঈশ্বরকে খুন
করছে আমার রসনালৌল্য লিপ্সা
বাদামী অহংকার খেতের ভেতরে
কানামাছি খেলে জরায়ুর সাথে
কী চমৎকার অতিবেগুনি রশ্মিকণা
সূর্যকে অশ্ব বানিয়ে ফেলে আসা
দিগন্তের মুখে পরায় চাঁদ-লাগাম ---
ভালবাসার কাঙাল হলে তুমি শেষে
একহাত আলোর নেমন্তন্ন পেলে না
শুধু কাঁদে ভাগ্যহীনা ডানাওয়ালা শস্যভূমি•••
ধেনো গন্ধ
বেলা দে
কার্তিকের ধেনোগন্ধ
পিঠেপুলির বাঙ্গালী মনে
গৃহস্থালী সেজে ওঠে
রকমারি নোনতা মিষ্টি আয়োজনে।
কৃষকের ঘামরক্ত জড়ানো
হিরণ্যফসল এসময় নিকোনো গোলায়
সব কষ্ট সঙ্গে নিয়ে নবান্নের ছন্দে ফেরে
পল্লীবাসী মন
এই স্বপ্নের ফসলেই উৎসব আপ্যায়ন
বছরভর অন্নবস্ত্রের সংস্থান
তবু ওদের বুকের ভিতর
বাংলা বেঁচে আছে বলে
অমল অনিন্দ্যসুন্দর।
নবজাতক গাছ হবে
ইউনুস হোসেন
আজ;
দুজনে ঘাসের ভিড়ে,
কাঁচপোকাদের দলে;এই চাঁদহীন আকাশে,
নিশাচরদের উদ্যানে।
রাতের গাঢ় নিশ্বাসে;
ভার হয়ে উঠছে চারিপাশ,
একলা হরিণ ঘুরছে এদিক ওদিক;
কচি ঘাসে মুখ, আমলকি বনে।
হিম আবেশের ঈষৎ সংলগ্নে;
বনভূমি জুড়ে বইছে প্রাগৈতিহাসিক অনুরাগ।
এই এমন সন্ধিক্ষণে কাঁচপোকাদের ভিড়ে,
একাত্ম হয়ে রই;
এ নিস্তব্ধ নীড়ে-হাতঘড়ির শব্দেও মধুরতা,
শ্বাসবায়ু জড়িয়েছে একে অপরে;
নিমগ্ন রতিসুখে।
ঘাসের গর্ভে এ রাতের স্বীকৃতি স্থাপন করব,
পূর্ণতা পাবে গাছ হয়ে; দুই সত্তার মিলন।
নবজাতক গাছ হবে নবজন্মে;
আমরা হ'ব মৃত্তিকা।
নবান্ন
কাকলি ভদ্র
হেমন্তের আলপথ পেরিয়ে
থেমে যেতে হয় শূণ্য ক্ষেতে
একলা এবং একলা...
টুংটাং মেঠো কুয়াশায়
দুব্বোঘাসের ঘুঙুর
পিলসুজে জ্বলে ওঠে
গোধূলিয়া সোহাগ,
শিশিরের মরমি আঁচে
ধুকপুক জলমুগ্ধতা।
তারপর...
দীর্ঘ রাত শেষে ছুঁয়ে যায়
আদিম অণুরণন!
তারও পর...
সূর্যের মতো অপেক্ষায়...
কুয়াশার বিনুনি ছিঁড়ে উঁকি দেবে
লাঙলের ফুল্লরাকাব্য!!!
কার্তিকের আহ্বানে
সুব্রত নন্দী
নীলাম্বর এখন আর ডাকছেনা নিনাদ,
পেঁজা তুলোট জীমূতেরা বলাকার সাথে,
শিউলি সুবাস গন্ধে মাতোয়ারা সংসার,
নবান্ন উৎসবে ঋদ্ধ গ্রামবাংলার বাতাস,
কার্তিকের আহ্বানে নবজাগরণ অহর্নিশ,
মুক্ত বাতায়ন,ঋতুর পরিবর্তনে নবীন বরণ,
স্নিগ্ধ শীতল বাতাস প্রত্যুষে স্নিগ্ধতা জাগায়,
ভোরের শিশিরকণা দেয় শীতল অনুভব,
ঘাসের ডগায় জেগে থাকে জীবনের জল!
ধরণীতে ফিরে আসে মনমুগ্ধকর পরিবেশ,
এসো সবাই মিলে বরণ করি বিধাতার দান,
ফিরে পাই নতুন ধারায় জীবন্মুক্ত প্রাণ।
অষ্টাদশীর শঙ্খবালিকা
রীনা মজুমদার
মনে পড়ে ?
ভোরের আলোয় হারায় শঙ্খবালিকার অনুভূতি শিশিরে ধানের ক্ষেতে ভেজা সবুজ অভিমান
নীরবে প্রসারিত হাত !
উড়ে যায় একঝাঁক ডানার রোদস্নান l
মনে পড়ে ?
ব্যস্ত দুপুরে কার্তিকের নবান্নে ভেজা চুলে শঙ্খবালিকার ঢেঁকির নতুন চালধোয়া হাত !
মনে পড়ে ?
সন্ধ্যায় হারায় ক্লান্ত শালিখের সুর
অন্ধ পেঁচা টেনে দেয় গোধূলির শেষ আলো
আকাশ আপন করে নক্ষত্রলোক
আঁধারে জাগে শঙ্খবালিকার সোনালী রাত !
মনে পড়ে ?
মেলালে গলা ! ...
" আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে-- এই বাংলায়... "
থাক ! থাক কিছু স্মৃতি-অনুভবে -
নির্জন দুপুরে শুকোতে দিই আঁধারে
জীবনবহনের স্বপ্নময় স্তব্ধ নরম
মনে পড়া রূপকথা l
কার্তিকের চঁাদ
গায়েত্রী দেবনাথ
রোদ্দুরে বাংলা পোড়ায়,ধানসিড়ির খোজে
কৃষ্ণচূড়ার ছায়া উজ্জল আলোকে ভাসিয়েছে
রাঙা দু-খানি পা পদচ্ছাপ রাখবে
হয়তো বা শালিকের বেশে
কার্তিকের চঁাদ পূর্ণ নবান্নের বেশে
উজ্জল তুলো ভাসবে স্মৃতির বাতাসে
তুচ্ছ ধূলোর বাতাস মুখ গুজেছে পরিশ্রমের পাশে
বনের শিকড় যাকে বেধে রাখে বাংলার মাঠে
কাগজের নৌকো ভেসে বেরায় নোনা ঘাটে
অন্য রকম নবান্নের দেশ
সব্যসাচী ঘোষ
আজ আর নিছক কবিতা নয়
ধানের শিষ, শিশির ভেজা ধান
নবান্নের আঘ্রান সবই আজ -
প্রশাসনিক।।
নবান্নের দেশে অন্ন জোটে পরিশেষে
ভারতবর্ষের মাটিতে আজ অর্থের গর্ত
কৃষকের মৃত্যুতে ঋণ মুকুব পায়-
কৃষি মহাজন।
আকাশে আজ অদ্ভুত দাম্ভিকতা
শস্যের দানায় দানায় গরিবের রক্ত,
বুভুক্ষু মানুষের স্বপ্নে হানা দেয়-
বিভো অপো পেটিএমরা।
নবান্নের দেশে বিশ্বাসের অভাব
ক্ষুধার নিবৃত্তি হয় ডেটাপ্যাকে,
তিনলাখি চায়ের চুমুকে ঘুম ভাঙে
বিশ্বাস পত্নীর।
নবান্নের দেশে বাগিচার মালি
কেটে পরে ফুলফল নিয়ে,
অপেক্ষা আগাছারা কবে ভিড় করে
রাজপ্রাসাদের তীরে।
গ্রাম বাংলা
সুদীপ বাগ
নবান্নের আঘ্রান , হরিৎক্ষেত নর্তকী
সুর ধরেছে মেঠো পথ, আজ গোধূলিটুকুই বাকি।
আসন জুড়ে নকশী কাঁথা শোনায় প্রাণের গান
মুক্ত বিহঙ্গ কুলায় ফেরে গৃহে কলতান।
চিত্রভানু ডোবার তালে , অষ্টাদশী গৃহে
মঙ্গল শাঁখ বাজায় সুরে ,আলতা পায়ে মেখে।
পেলব আলো অভিমানী সন্ধ্যাতারা দেখে
দূরে কোথাও ঝিঁঝিঁ পোকা গানের সুর শেখে।
ভোরাই সুরের একতারাতে আগমনী সুর বাজে
লাঙ্গল কাঁধে সাদেকমিঞা ক্ষেতের চেনা কাজে।
শিশির ফোঁটা নগ্ন ঘাসে সিক্ত শ্রীচরণ
মলয় ঘেরা কুটির উঠোন, উদাস দুনয়ন।
বাংলা রূপসী হয় যে কবি কে পেয়ে
পাপিয়া চক্রবর্তী
কাক ডাকা নির্জনে শিশিরের বিলাপ
মাখে নবান্নের ধান।
ধূসর রঙের হাঁস ধানসিঁড়ি নদী জলে
ডুব দিয়ে খোঁজে কার্তিকের হারনো গৌরব।
বিষণ্ণ বক রূপসার জলে ধুয়ে নেয় ডানার বিষাদ।
বাদামী শালিখের দীর্ঘ দীর্ঘশ্বাস ছুঁয়ে,
বাতাস লেখে শোকগাথা কাঠাল পাতায়।
জলঙ্গির কলমির লতা মাথা তুলে চায়
লক্ষ্মী পেঁচার ডাকে।
এইসব শোকগাথা বিষণ্ণ বিলাপ পার হয়ে
হেমন্তের চাঁদ নারিকেল পাতায় -
কী যেন বার্তা লেখে রুপলি সংকেতে।
বাংলার নদী মাঠ ক্ষেত জন্মান্তরে বিশ্বাসী হলে
বাংলা রূপসী হয়; চেনা উদাস কবির ঘ্রাণে
সেই পাখির নীড়ের মতো চোখ;
স্বপ্ন রঙে এঁকে রাখে দারুচিনি বন
তার মন দু'দন্ড শান্তি দিতে চায়
প্রিয় এক নিঃসঙ্গ কবিকে
যে কবি প্রতিশ্রুতি রেখে যায় ফিরে আসার
পৃথিবীর শেষে কোন দূর মেঘে, বিস্ময় দেশ ভ্রমণের শেষে ।
পল্লীর তীরে
মহন্ত বিশ্বাস মোহন
যদি ফিরে আসি বধূ এই বাংলায়
ঘর বেঁধে রেখো কোনো পল্লীর তীরে,
হয়তো নায়ে নদী বেয়ে বেয়ে
ফিরব আমি ধীরে ধীরে ।
পূবে শুনবে ভাটিয়ালি সুর
একটানা ভাসে দূর বহুদূর
আকাশ বাতাস নদী নীরে ।।
হয়তো টুপরি মাথায় দুপুরের বেলা
মাঠ ছেড়ে, ঘাট ছুঁয়ে ফিরি একলা ;
তুমি উঠোনে দাঁড়িয়ে থেকো চেয়ে
গ্রাম ছাড়া মেঠো পথের বাঁকে
কখন আমি ঘরে ফিরে আসি
সবাই যে ফেরে একে একে ।
যখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যায়
আঁধার নামে লতাপাতা ঘিরে
হয়তো গো-পাল লয়ে আমি
তক্ষুণি আসব ফিরে ।
তুমি সবে পুজোতে ঘরের মাঝে
কুলবধূ রবে লক্ষীর সাজে
সাঁঝের প্রদীপ জ্বালিয়ে দ্বারে ।।
তোমার স্বপ্ন
দীপ্তিমান মোদক
তুমি দেখিয়েছ
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়কে কীভাবে স্বাগত জানাতে হয়
শহরের ইমারতে না থেকেও
গ্রামের ছোট্ট কুটিরে কীভাবে স্বপ্ন বোনা যায়।
যন্ত্রের নীচে হৃদয় চাপা পড়েছে
অসহ্য যন্ত্রণা।
তোমার বনলতা সেন এসে তখন
দু দণ্ড শান্তি দিয়ে যায়।
তোমার কিশোরীর চালধোয়া ভিজে হাত
আমার দিকে এগিয়ে আসে,
ভালোবাসা দেওয়ার জন্য।
আমি গ্রহণ করি
সেই ভালোবাসায় ডুবে থাকি।
তোমার মাঝে আমি কোনো অন্ধকার দেখি না
আলো দেখি,যা আমায় দেয় আনন্দ।
আমি তোমারই স্বপ্ন দেখি জীবনানন্দ।
উর্বর জমি
মজনু মিয়া
হৃদয়ের জমিতে ফসল
রোদ বৃষ্টি দুঃখ কষ্ট সয়ে তা ফলাই।
লাঙ্গল দিয়ে বুকের উপর
যখন গরুর পা আর কড়কড় করে ফ্বলা,
পাঁজর ছিঁদ্র করে ঢুকে
তখন জীবন অস্থির হয়ে যায় তার কষ্টে!
পাকা ধান সবুজ সবজিতে
মাঠের রুপ যখন হেসে উঠে তো
মনের বাঁধ ভেঙ্গে যায় তখন।
আধ মরা জীবনে সুখের পরশ
মা বাপ বৌ ছেলে মেয়েরা
আনন্দে গান ধরে।
আবার পানি দিতে হবে
সময় এলো নতুন ফসল বোনার,
এখানে জাই ফলাতে চাই না কেন্
ফলে খুবই উর্বর জমি
মন মানসিকতা ঠিক তো
ফসল ফলানো সাহসিকতারই কাজ।
নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে
সুনন্দ মন্ডল
সত্যিই চোখে নেশা ধরেছিল
সবুজের ঘন বুক চিরে তোমাকে পেয়েছিলাম
নীলাম্বরীর মুগ্ধতায় স্তব্ধতা এসেছিল কিছুক্ষন
তবুও থামেনি চলার পথে ক্যাকটাসের বিবর্ণতা
ঝোপের গুচ্ছে কিছু আশা লুকিয়ে
শুরু করেছিলাম আদিগন্ত মিলিয়ে দেবার খোঁজে
লাল নীল বর্ণেরা পথ ভোলাতে চেয়েও
পারেনি চোখের তীক্ষ্ণতাকে কেটে বেরিয়ে আসতে
তখনও অনিন্দ্য সুন্দর মোহের মতোই 'নীলকন্ঠ'
আমার পিছনে বড় শিমূল গাছের নিচু ডালে
ডানা ঝাপটে এসে বসেছিলো
আপন চেনা মানুষের বেশে হাত বাড়িয়ে
ধরতে চেয়েছিলাম নীল মহিমা মিতুল ভাষ্যময়ীর সুর
অবলোকনে ফিরে চেয়েছিলাম অন্যমনে
সারি সারি গাছের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রেখে
কুটিরের খোঁজে চোখ ফেরালাম স্রোতের প্রতিকূলে
অনামি পাখির টানে পলক কিছুতেই পড়েনা
গালের টোপে কিছু আলাপি চেতন গ্রাস করেছিল যেন
ভালোবাসার গানে ভালো বাসা পেতে অধীর আমি
দুরন্ত তেষ্টা মেটাতে জলের অভিলাষী মন
ছুটে আশ্রয় নিলো কুমারীর জীর্ণ আঁচলে
ঘন মেঘের আবরনে ঢেকে এলো শরৎ
আকাশের গায়ে অন্ধকারের কুটিল ছায়া
সাবধানের বাণী শোনাতে নেমে এলো বৃষ্টি
কুমারীর ভিজে যাওয়া চুলে সিক্ত প্রেম
নিস্তব্ধ ঠোঁটে বিচরণ করে রক্তিম অভিবাদন
বিলাসী পোশাকের আড়ালে সুডৌল স্তনের টিপটিপ
রেখে যেতে চায় রাতের অঙ্গীকার
সেদিন কার খোঁজে এসেছিলাম জানিনা
মনের গহীন আজও শূন্যতায় সুর আঁকে
ভাঙাচোরা স্মৃতি জোড়া লাগিয়ে
নীলাম্বরী ডাকে অবচেতনে ঘুমের পরি সেজে
শেষ আহ্বানে বলে যেতে চেয়েছিল হয়তো
"আমিই সেই নীলকন্ঠ পাখি"
যার খোঁজে চোখের ঘুম উবে যায় সমুদ্র পারে
মিটমিট করে জ্বলে জোনাকির শুভ জ্যোতি
আবার আসব ফিরে
প্রসেনজিত রায়
হিমালয়ের বক্ষ চিঁড়ে
সিন্ধু-গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র এক করে
আবার আসব ফিরে আপন তীরে।
মরুভূমির বালি এনে দেব বাংলার বুকে
বাংলার কোয়েল উড়ে যাক মরুর দেশে
এক মুঠো হাসি জন্ম নিক এই উপমহাদেশে।
আপন বেগে চলব বয়ে
ধানসিড়িটির পাশ দিয়ে
কোয়েল-দোয়েল-শঙ্খচিল এসে বসুক আমার কোলে। আবার আসব ফিরে শ্যামবনানীর বক্ষ ফুঁড়ে
ময়না-টীয়া-কাকাতুয়ার ঘরে
শস্য-শ্যামল প্রানের ঝাঁক নিয়ে ধূসর মরুচরে।
নীল প্রজাপতি ডানা মেলুক
একটা সূর্যের উদয় হোক
আমার বুক ধুয়ে স্বপ্ন জাগুক অভাগীর ঘরে ঘরে।
সোনালী ধানে নবান্ন হোক একপাতে
রূপোলী চাঁদের জ্যোতস্না ঝরুক একসাথে
উৎসবে আত্মহারা কাঁধ মিলুক একটাই বড়োদিনে।
আবার আসব ফিরে একবুক প্লাবন নিয়ে
চার দেওয়ালের অট্টালিকা ভেঙে পড়ুক
হিন্দু-মুসলিমের ঠাঁই হোক এক ঘরে।
পতাকার রঙ যত ধুয়ে যাক
সব রক্ত এক হোক
নতুন চারাগাছ জন্ম নিক 'মানুষ' নামে।
কাঁটাতার ছিন্ন করে, বুলেটের কাঁচা রক্ত ধুয়ে
হিংসা-বিবাদ-দূষণ যত এক করে
আমার ঢেউ আঁছড়ে পড়ুক সাত সাগরে।
হেমন্তর ছড়া
চিত্তরঞ্জন সাহা
মিষ্টি শীতের নবান্নতে
হেমন্ত তাই এলো,
সবুজ মাঠে অানন্দতে
সুখটা ফিরে এলো।
তুলোর মত সাদা সাদা
মেঘগুলো সব ভাসে,
গাছে গাছে পাগলা হাওয়ায়
শিউলি টগর হাসে।
ভােরের বেলায় ঘাসে ঘাসে
শিশির কণা ঝরে,
ধুম পড়ে যায় পিঠা পুলির
এই বাঙালির ঘরে।
খেজুর গাছে মাটির কলস
রস পড়ে টুপ টুপ,
হেমন্তের এই শীত অামেজে
সবাই থাকে চুপ।
মাঠে মাঠে সোনালী ধান
চাষীর মুখে হাসি,
হেমন্তকাল অালোর ঝলক
মুক্ত তারার রাশি।
ভাবনা
বাপ্পা রায়
মনের অগোচরে কুঁড়ে কুঁড়ে খায় ভাবনা,
নোংরা ডাস্টবিন থেকে উড়ে এসে ঢোকে।
তিলে তিলে খুন করে স্বপ্ন গুলোকে;
রুদ্ধ করে দেয় এগোনোর সুচালো পথ।
মাঝে মাঝে মাথাচাড়া দেয়--
নিজেই ভাবি খুন করি!
'খুন'! সে তো গিরগিটি;
কখনো লাল,সবুজ,নীল কিংবা গেরুয়া রঙে ভাসে,
বলি হতে হয় নিরীহ পশুদের।
আর ভাবনা; উড়ে এসে বসে!!
আমার বাংলা
সায়ন তরফদার
আমার বাংলা, তোমার বাংলা,
বাংলা মোদের সবার।
সবচেয়ে মহান, সবচেয়ে সুন্দর,
তাই তো ফিরেছি আবার।
আমার ভাষা, তোমার ভাষা,
বাংলা মোদের মাতৃভাষা।
সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ, সবচেয়ে মধুর,
সে আমার বাংলা ভাষা।
বাংলার শিল্প, বাংলার সংস্কৃতি,
ভুলতে পারিনা কখনও।
সবচেয়ে মহান, সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ,
তাইতো ভুলিনি এখনও।
বাংলার রূপ, বাংলার সৌন্দর্য,
দেখি আমি বারবার।
হে ঈশ্বর, হে ঈশ্বর,
বাংলা মায়ের কোলে আমি জন্মাতে চাই বারবার।
অনলাইন মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা, কার্তিক ১৪২৫ সংখ্যা