ভঙ্গুর মেরুদণ্ড
মৌসুমী চৌধুরী
দূর থেকে জটলাটা দেখে মনে মনে একটু থমকে যায় দীপ্ত। ভীষণ একটা অস্বস্তি যেন ঘিরে ধরে। এই তো এখুনি আবার হাত তালি বাজিয়ে "টাকা দে" বলে রে রে করে ধরবে। ঋজুকে টিউশন পড়িয়ে বাড়ি ফিরছে দীপ্ত। সন্ধেটা একটু গড়িয়ে গেছে৷ একটা অঙ্ক কিছুতেই মিলছিল না। সেটা মেলাতে গিয়েই দেরী। এদেরকে তো আগে কখনও এ পথে দেখেনি!কে জানে বাবা, নতুন আমদানি হল নাকি! দমবন্ধ করে কোনক্রমে জায়গাটা পেরোনোর সময় দীপ্তর কানে আসে,
— "এই চিকনা, আমাদের কিছু না দিয়ে কোথায় চললি রে ? দে, দে রে ... কিছু তো দিয়ে যা..."
গাঁকগাঁক আওয়াজে দীপ্তকে ঘিরে ধরল তিন চারজন কিন্নরী। জোরে জোরে তালি বাজাতে লাগল তারা। ভয়ে ঘামতে থাকে দীপ্ত। আজই মাস মাইনের টাকাটা দিয়েছেন ঋজুর বাবা। শুনেছে আজকাল এরা নাকি চুরি-ছিনতাই প্রভৃতি নানা ক্রাইমের সঙ্গে যুক্ত থাকে।
হঠাৎই কিন্নরী দলের একজন ভালো করে দীপ্তর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,
— " আরে স্যার, আপনি?"
অস্বস্তিতে সিঁটিয়ে যায় দীপ্ত। মুখ থেকে কথা সরে না।
— " আমায় চেনেননি, তাই না? আমি কিন্তু আপনাকে ঠিক চিনেছি। আপনি দীপ্ত স্যার না?"
বলেই ঢিপ করে দীপ্তকে প্রণাম ঠোকে ফর্সা বিনুনি ঝুলনো দীর্ঘদেহী কিন্নরীটি।
অস্বস্তিতে মুহূর্তের জন্য একটু যেন পিছিয়ে সরে আসে দীপ্ত। তার বাইশ বছরের শিক্ষকতা
জীবনের মাথায় হাতুড়িপেটা করেও কোন কিন্নরী ছাত্রের কথা মনে পড়ল না তার।
— " চিনতে পারলেন না তো, স্যার। আমি পলাশ। এখনকার নাম যদিও পাপড়ি। সেই যে "সৃষ্টি কোচিন সেন্টার"-এ পড়তাম। আপনারা রাখলেন না, বাবাও বের করে দিল বাড়ি থেকে...।"
তখন চাকরি পায়নি দীপ্ত। সকাল সকাল "সৃষ্টি কোচিন সেন্টার"-এর মালিক বিপ্লবদার ফোন আসে ,
— " আপনার ক্লাসে যে একটা হাফ-লেডিজ রয়েছে, ওই গে আর কি। এতদিন বলেননি তো স্যার?"
— " কেউ হাফ-লেডিজ হলে আমি কি করব?
আমি বলতে যাব কেন? আশ্চর্য তো!"
বিরক্তি আর বিষ্ময়ে উত্তর দেয় দীপ্ত।
— " আরে ওই পলাশ। অন্য গার্জিয়ানরা তো দল বেঁধে অবজেকশান করছেন। ওকে আর এই কোচিনে রাখা যাবে না। তাঁদের ছেলেদের এমন একজনের সঙ্গ থেকে দূরে রাখতে চান তাঁরা।"
শেষদিন পলাশ খুব কেঁদেছিল। আর্তনাদ করে বলেছিল,
— "স্যার আমাকে বের করবেন না। তাহলে যে
রাস্তায় দাঁড়াতে হবে। অনেকের অনেক বিদ্রূপ-অবজ্ঞা নিয়েই তো টিঁকে ছিলাম। আমাকে থাকতে দিন। আমাকে বাঁচান, স্যার।"
কেউ কিছুই করেনি পলাশের জন্য। কেউ বাঁচায়নি তাকে। আর দীপ্ত তো খুব সুচারুভাবে বিষয়টি ইগনোর করেছিল।
পাপড়ি হঠাৎ তার ঝোলা থেকে একটা বড় ক্যাডবেরি বের করে দীপ্তর হাতে গুঁজে দিয়ে বলে,
— " নিন, স্যার। সামান্য গুরুদক্ষিণা। একদিন আপনি অঙ্ক শিখিয়েছিলেন। যদিও জীবনের অঙ্ক মেলাতে পারিনি। অ্যাই তোরা স্যারকে যেতে দে, সর সর যা ..."
মাথা নিচু করে নিজের পথে এগিয়ে যায় দীপ্ত। পিছন থেকে কিন্নরীদলের হাততালির ফটাস ফটাস শব্দ যেন জাতির মেরুদণ্ডের ভঙ্গুর দিকটিকে বিদ্রুপ করতে থাকে।
No comments:
Post a Comment