কুমকুম ঘোষ
নলেন গুড়ের গল্প ও শান্তিনিকেতন
"কিন্তু সবার চাইতে ভালো পাঁউরুটি আর ঝোলা গুড়" --
সুকুমার রায়ের এই কবিতায় ঐ যে "ঝোলা " শব্দটির উল্লেখ আছে তার অর্থ নিঃসন্দেহে তরল। আর ঝোলা গুড় বা তরল গুড়ের কথা আসলেই নলেন গুড়ের প্রসঙ্গ চলে আসে।এবছর এই নলেন গুড় তৈরি ও রস জ্বাল দেওয়ার উনুন,কড়াই কেমন দেখতে হয়,সে সম্বন্ধে সম্যক কিছু ধারণা হলো। প্রতিবছর শীতের সময় নলেন গুড় কেনা তো আমাদের বহুদিনের অভ্যেস।পিঠে পায়েস এবং নলেন গুড়ের স্বর্গীয় কম্বিনেশন পৌষ পার্বণে প্রায় প্রতি ঘরে ঘরে ঘটে চলেছে যুগ যুগ ধরে।
" শান্তিনিকেতন রোড ট্রিপ এবং টাটকা নলেন গুড়ের স্বাদ পাওয়া".......
সত্যি বলতে কি টাটকা নলেন গুড়ের স্বাদ উপভোগ করার সুযোগ টা হঠাৎ করেই পেয়ে গেছিলাম এবছর, ২০২০ র জানুয়ারী মাসে শান্তিনিকেতনের কাছেই কঙ্কালীতলা থেকে ফেরার পথে ।
বোলপুর ট্যুরিস্ট লজে দুটো ঘর আগে থেকেই বুক করে রেখেছিলাম আমাদের চার জনের জন্য।আমি , বেটারহাফ দেবাশিস, আমার ননদ টুকু আর ওর ছেলে , আমাদের স্নেহের ভাগ্নে অর্জুনের জন্য। আমরা দুজন শান্তিনিকেতন প্রায় প্রতিবছরই আসি কিন্তু ব্যাঙ্গালোর প্রবাসী ননদ ও তার পুত্রের শান্তিনিকেতন দেখা হয়নি। এই কালান্তক ভাইরাসের খবর তখনও যেহেতু আমাদের এদিকে পৌঁছায়নি তখন সাধের গাড়িটি নিয়ে ( ড্রাইভারের সিটে অবশ্যই নির্ভরযোগ্য স্বামীদেবতা দেবাশিস) বেড়িয়ে পড়েছিলাম। তখন এতো কোভিড বিধি,স্যানিটাইজেশন এর শৃঙ্খলা ছিলনা অতএব বিন্দাস রোডট্রিপ।দিল্লি রোড ধরে সোজা বোলপুর ভায়া ইলমবাজার। যারা ট্রেনে বোলপুর স্টেশনে নামেন তারা মিস্ করেন ইলমবাজার থেকে বোলপুর যাবার অসাধারণ অ্যাসফল্টের রাস্তাটি। দুপাশে অজস্র শাল পিয়ালের গাছ , মাঝখান চিরে রাস্তা টি মুগ্ধ করে বারবার। বর্ধমানের গুসকরা দিয়ে আর একটা রাস্তা আছে শান্তিনিকেতন ঢোকার কিন্তু ইলমবাজারের রাস্তাটা পছন্দ হয় এর অনাবিল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য ।
কলকাতা থেকে দিল্লি রোড ধরে শক্তিগড়ের (ল্যাংচার জন্য বিখ্যাত) পরেই আসে পানাগড়। এবং দার্জিলিং মোড় (কলকাতা থেকে সড়কপথে এদিকদিয়েই উত্তরবঙ্গে যাওয়া হতো ফরাক্কা ব্রিজ তৈরি হবার আগে) । এই মোড়টি আজকাল মিস হবার সম্ভাবনা আছে ব্রিজ হবার জন্য। যাইহোক সাইনবোর্ড ফলো করে ডানদিকে ঘুরলেই সোজা রাস্তা।এই রাস্তাতেই ১১ মাইল গ্রাম,ইচ্ছাই ঘোষের দেউল আছে। ইলমবাজার ঢোকার আগে অজয় নদের ওপর ব্রিজটি যতবার পার করি ততবার ভয় করে এই বুঝি ভেঙে পরলো, এতো নড়বড়ে সেটা। তবে অঘটন কিছু এখনও ঘটেনি।ব্রিজ পার করে অত্যন্ত ভাঙাচোরা টোলপ্লাজা (হায়রে ডিজিটাল ইন্ডিয়া)য় হাতে হাতে টোল দিয়ে সোজা বোলপুর লজ।
শান্তিনিকেতন এর কাছেই কঙ্কালীতলা নামকরা সতীপিঠ। খন্ডিত সতীর কাঁকাঁল এখানে পড়েছিল। জনশ্রুতি এমনি। আমরা চারজন টোটোভাড়া করে সেদিন বেড়িয়েছিলাম মন্দির দেখতে। পথের ধারে এতো সরষে ক্ষেত আগে দেখিনি। হলুদে সবুজের ঢেউ খেলছে চারপাশটা।
কঙ্কালীতলা থেকে ফেরার পথে "মালিপুকুর" নামে একটা গ্রামের পাশে পাঁচিল ঘেরা মাঠের ভেতর কাঁধে বাঁক নিয়ে একজন স্থানীয় মানুষ চালাঘরের দরজায় তালা ঝুলিয়ে দিচ্ছিলেন দূর থেকেই দেখেছিলাম। আমাদের টোটোচালক ভাই সেদিকে দেখিয়ে বললেন -- ওখানে নলেন গুড় তৈরি করে ও। উৎসাহিত ভাগ্নে - দাদা দাঁড়াও দাঁড়াও দেখবো" বলতেই সে থামলো এবং সদলবলে আমরা সেই চালাঘরের সামনে।বেলা তখন প্রায় বারোটা- একটা হবে; যিনি ওখানে গুড় তৈরি করেন এবং বাঁক কাঁধে দাঁড়িয়েছিলেন , দেখেই বোঝা যাচ্ছিল ঘরে ফেরার তাড়া ছিল তাঁর সেই ভর দুপুরে । আমাদের দেখে একটু বিরক্ত ই হলেন কিন্তু আমরা হই হই করে -- "গুড় নেবো গুড় নেবো" বলাতে গম্ভীর মুখে আবার ঘর খুললেন (আহা নলেন গুড়ের সুবাস ঘরময় ছড়িয়ে ছিল) , আমাদের হাতে পাটালি গুড় যেটা নলেন গুড়ের শক্ত কেক যা সাধারণত পায়েসের মধ্যে দেওয়া হয় ভেঙে ভেঙে দিলেন আমরাও টুকরো মুখে দিয়েই চটপট কিনে নিলাম দু' কেজি করে গুড় (দাম সম্ভবত ১৭০/১৬০ টাকা কেজি ছিল) এবং তখনকার বাজারের তুলনায় বেশি দাম নিলেন মনে আছে, অবশ্য বিশেষ দাম যাচাই করার সুযোগ দেননি সেই দাদা। ওদিকে ঘরের বাইরে ওনার গুড় তৈরি র উনুন, চৌকো লোহার বিশাল কড়াই, মাটির হাঁড়ি আর বাঁক কাঁধে ওনার একটা ছবি মোবাইলে পটাপট তুলে নিয়ে সোজা মাঠের বাইরে বেরিয়ে এলাম আমরা। আর উনি তড়িঘড়ি বাঁক কাঁধে মালিপুকুরের পিচঢালা রাস্তা দিয়ে রওয়ানা হয়ে গেলেন নিজের বাড়ির দিকে।
" খেজুর গাছ ও রসের হাঁড়ি"....
নাহ্ ওনার নামটা জানা হয়নি তখন।
কিন্তু ওনার ঐ তাড়াহুড়ো র সাথেই জড়িয়ে আছে নলেন গুড় তৈরি র পুরো প্রক্রিয়াটি। আদতে ওনাদের " শিউলি" বলা হয়। এরা খেজুর গাছ কেটে তার থেকে রস বেড় করে ,সেই রস জ্বাল দিয়ে খেজুরের গুড় অর্থাৎ নলেন গুড় তৈরি র পেশায় যুক্ত থাকেন। শীতের মিষ্টিতে, পায়েসে, পিঠেতে নলেন গুড় যোগানোই যুগ যুগ ধরে এনাদের কাজ (বাপ- পিতামহের পেশা আঁকড়ে আছেন এখনও)। এই কাজ শুরু হয় ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত। প্রথমে খেজুর গাছ কেটে মাটির হাঁড়িটি বাঁধা তারপর রসে টইটুম্বুর হাঁড়িটি ভোরবেলা থাকতে থাকতে নামিয়ে এনে দ্রুত জ্বাল দেওয়া( রোদ উঠে গেলেই ঐ রস মজে যাবে)। এবং আবার দুপুরের মধ্যে দ্বিতীয় বার গাছে উঠে হাঁড়ি বাঁধার কাজ থাকে। পাতলা সোনালী তরল নলেন গুড় নাগড়িতে ভরে বাজারে আসে আর কেকের মত গোলাকার শক্ত গুড় পাটালি নামে আমরা কিনে আনি। চক্রাকারে ঘটতে থাকা এক গ্রামীণ কুটির শিল্প বাঙালির রসনায় সুবাস ছড়িয়ে দেয় প্রতি শীতে।
এখানে প্রথম প্রশ্ন ই হলো "খেজুরের রস" থেকে তৈরী গুড়ের নাম " নলেন গুড়" হলো কেনো?
" নলেন গুড়ের" সাথে সরু নল এবং নরুন শব্দের অঙ্গাগী যোগ আছে। আবার শব্দটার সাথে প্রাচীন দ্রাবিড় সভ্যতার যোগ ছিল বলেও মনে করা হয় । বাংলা- দ্রাবিড় অভিধানে "ণরকু" শব্দের অর্থ ছেদন করা বা কাটা। এখনও নাপিতের কাছে থাকে নখ কাটার যন্ত্র নরুন। (আধুনিক নেল কাটারের যুগে এটা প্রাচীন কিন্তু আমাদের ছোটবেলায় বাড়িতে দেখেছি) খেজুর গাছ থেকে রস বের করতে প্রথমে দা' দিয়ে নিপুণ শিল্পীর মত এই "শিউলি"রা থাকে থাকে তিন থাক খেজুর গাছের মাথার দিকের কান্ডটা চেঁছে ফেলেন , তারপর সেখানে "নরুন" দিয়ে গর্ত করে একটা নল ফিট করে তার নীচে হাঁড়ি বেঁধে দেওয়া হয়। এজন্য ই নাম হয়ে যায় "নলেন"গুড়।
খেজুর গাছ কাটার পর প্রথম যে রস বেড়িয়ে আসে তাকে বলে-- জিরান রস। জিরানের পরের দিন যে রস বেড় হয় তাকে বলে-- দোকাটা। আর তৃতীয় দিন যে রস বেড়োয় তাকে বলে -- তেকাটা।
অভিজ্ঞ "শিউলি" রা বলেন মানুষের মত গাছ ও "জিরান" অর্থাৎ বিশ্রাম চায়। খুঁচিয়ে রস বেড় করে নেবার পর কদিন আর খোঁচানো নয়, কদিন জিরানের পর তবেই আসে জিরান রস। তৈরী হয় "জিরানকাটের" শ্রেষ্ঠ গুড় আজকাল বিশেষকরে যেটা পাওয়া দুষ্কর হয়ে গেছে।
" নতুন বছর ও একটি বিশেষ আশা"....
ভাইরাস- মুক্ত জীবনে( আশঙ্কা যদিও আবার দেখা যাচ্ছে) এবার আবার যাবো শান্তিনিকেতনের অদূরে ঐ মালিপুকুর গ্রামে ; পেশায় "শিউলি" ঐ শ্রমজীবী মানুষটির পিতৃদত্ত নামটি জানতে। হুড়োহুড়িতে যেটা জানা হয়নি এবারে। আক্ষেপ একটাই এবার আর সঙ্গী হিসেবে পাবোনা স্নেহের ভাগ্নেকে(কোভিড বিধির বাধ্যবাধকতা ) যার আন্তরিক উৎসাহ পরোক্ষে সাহায্য করেছে এই "নলেন গুড়ের গল্প" লিখতে ।
@মুজনাই অনলাইন পৌষ সংখ্যা ১৪২৭
No comments:
Post a Comment