মৌসুমী চৌধুরী
পেরেন্টস্
দোতলার নতুন ভাড়াটে ছেলেদুটির ভারী ভাব-ভালোবাসা, একটু যেন বেশিই। প্রথমদিন থেকেই এটা লক্ষ্য করেছেন সরমাদেবী। কত আর বয়স হবে ছেলেদুটির! এই মেরে কেটে পঁয়ত্রিশ /ছত্রিশ। সৌম্যকে দেখলে নজরুল ইসলামের কথা মনে পড়ে যায়! উচ্চতা পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি মতো। কাঁধ-ছুঁই-ছুঁই বাবরি চুল, সবসময় পনিটেইল করে রাখে। চোখদুটো বড় মায়াময়। আর অর্ঘ্য বেশ লম্বা, পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চির মতো। মুখে হালকা চাপ দাড়ি, যেন তরুণ যীশুর মতো মুখ!
ভাড়াটেদের সঙ্গে তেমন ঘনিষ্ঠতা করেন না সরমাদেবী। পূর্বেকার কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতার জন্য নিজেকে গুটিয়ে রাখেন। বাড়িউলি সুলভ গাম্ভীর্য বজায় রেখে চলেন। মাসের প্রথমে ভাড়াটা দিতে আসে সৌম্য আর অর্ঘ্য দু'জনে একসাথেই। তখনই শুধু ওদের সঙ্গে সরমাদেবীর কথা হয়।
ঠিক সকাল ন'টায় কাজে বেরিয়ে যায় ছেলেদু'টি। দু'জনেই কর্পোরেট অফিসে চাকরি করে। ওরা চলে গেলে ছাদে আসেন সরমাদেবী। এ সময়টা ছাদের গাছগুলোর পরিচর্যা করেন তিনি। মাটি নিড়িয়ে জল দেন, আগাছা পরিষ্কার করেন।
রোজ সারা দুপুর ছাদের দড়িতে ওদের দুটি তোয়ালে, পা'জামা আর ফতুয়া ঝোলে। ছোট প'জামাটা গোলাপী রঙের আর বড়টা ছাই রঙের। দেখলে মনেহয় একটা মেয়েদের আর একটা ছেলেদের পা'জামা বুঝি। কখনও বৃষ্টি হলে পা'জামা, ফতুয়াগুলো তুলে নিয়ে ব্যালকনির দড়িতে রেখে দেন সরমাদেবী। ওরা ফেরার পর সরমাদেবীকে "থ্যাঙ্ক ইউ, আন্টি" বলে মিষ্টি হেসে জামাকাপড়গুলো নিয়ে চলে যায়।
কখনও কখনও রবিবার সকালগুলোর বাতাস ওদের দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সুস্বাদু রান্নার সুবাসে ম' ম' করে। কখনও ওদের কুকারের মাংসে সিটি ওঠে। কখনও গলা ছেড়ে গান গায় ওরা,
_"আকাশভরা সূর্য-তারা, বিশ্বভরা প্রাণ,/
তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান,/
বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান॥..."
ওদের হা হা হি হি আর খুনসুটিতে বাড়িটা সরগরম হয়ে থাকে। বেশ লাগে সরমাদেবীর। এমনই এক ছুটির দিনে সরমাদেবী হঠাৎ দেখে ফেলেছিলেন অর্ঘ্য সৌম্যর ঠোঁটে ঠোঁট রেখে কী পরম আশ্লেষে আদর করছে! দৃশ্যটা দেখে ভেতরে ভেতরে একটা যেন জোর ধাক্কা খেয়েছিলেন তিনি! তবে কি ওরা সমকামী? ক'দিন আগে সমকামীদের কথা কাগজে পড়েছিলেন বটে! কিছুদিন আগে টিভিতে একটা আলোচনাও শুনেছিলেন।
সেদিন থেকে সরমাদেবীর মনটা বড্ড খচখচ করছে। তাহলে কি ওদের উঠে যেতে বলবেন? আবার তার যুক্তিবাদী মন বলছে, সমকামীতা তো কোন অপরাধ নয়। ওরা ওদের মতো করে সুখে থাকতে চাইছে তাতে সরমার আপত্তির কি আছে? আর জীবন ওদের, সেই জীবনকে নিজেদের মতো কাটানোর স্বাধীনতা তো ওদের আছে। এছাড়া দেড়শ কোটি জনসংখ্যার এই পোড়া দেশে এভাবেও যদি খানিকটা জনসংখ্যা কমে তো কমুক না। ক্ষতি কি! কিন্ত তবুও মনটা যেন একটু কেমন কেমন করে! ওদের দেখলেই বুকের ভেতরটা যেন শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়...
গোল বাঁধল ২৫ ডিসেম্বর ছুটির দিনে। সৌম্য-অর্ঘ্য বাড়িতেই ছিল সেদিন। দল বেঁধে এল পাড়ার মোড়লরা আপত্তি জানাতে,
-" সরমাদেবী, এটা ভদ্রপাড়া। এখানে সমকামী ভাড়া দেওয়া যাবে ন। ছেলেপিলে নিয়ে সংসার করতে হয় আমাদের। এসব বেলেল্লাপনা এ পাড়ায় চলবে না।"
সরমাদেবী দেখলেন, ছেলেদুটো খরগোশ ছানার মতো ভয়ে একেবারে সিঁটিয়ে আছে! মাথাটা গরম হয়ে গেল তাঁর। পড়শীদের সামনে রুখে দাঁড়িয়ে তিনি বললেন,
-"ওরা আমার আত্মীয়। নিজের জন। তাই ওরা এখানেই থাকবে। আপনারা এখন দয়াকরে আসুন।" বলেই গম্ভীর মুখে গটগট করে উপরে উঠে যান সরমাদেবী।
বছরের প্রথম দিন আজ। একটু ভোরবেলায়ই ঘুম থেকে উঠেছেন সরমাদেবী। কাছেই কালীমন্দিরে যাবেন পুজো দিতে। বারান্দা থেকে দেখলেন পিঠে ব্যাগ-প্যাক নিয়ে আজ ছুটির দিনেও ভোর ভোর বেরিয়ে যাচ্ছে সৌম্য আর অর্ঘ্য। কোথায় যাচ্ছে কে জানে!...
ভর সন্ধেবেলায় ধুপ ধরাতে ধরাতে হঠাৎ কানে এল, ছেলেদুটোর ঘর থেকে একটা কচি বাচ্চার তীক্ষ্ণ কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। বিষয়টা কি, তা বোঝার জন্য ছুটে গেলেন সরমাদেবী। দরজা খোলাই ছিল। ঢুকেই দেখেন, মাস ছয়েকের ছোট্ট একটি বাচ্চাকে ফিডিংবোতলে দুধ খাওয়ানোর চেষ্টা করছে সৌম্য। আর তাড়স্বরে চিৎকার করে যাচ্ছে বাচ্চাটি। ধমকে উঠলেন সরমাদেবী,
-" এ কি? কি হচ্ছে এসব? এ কার বাচ্চা?"
সৌম্য খুব শান্তস্বরে উত্তর দেয়,
"এ আমাদের মেয়ে ঝিলমিল। আমরা একে অ্যাডপ্ট করেছি, আন্টি।"
ততক্ষণে বাচ্চাটা আরও চিৎকার করতে শুরু করেছে, একেবারে গলা ফাটিয়ে! সামলাতে না পেরে ঘাবড়ে যাচ্ছে সৌম্য। দ্রুত কাছে এগিয়ে গেলেন সরমাদেবী,
"দাও, দাও দেখি নি আমাকে। থামাতে পারি কিনা দেখি। শিখতে হবে এসব বুঝেছ হে, সব শিখতে হবে ধৈর্য্য ধরে। বাচ্চা মানুষ করা মুখের কথা নয়!"
তারপর একটু থেমে সরমা দেবী বলেন,
"নিজের না হলেও তিন তিনটে ভাইপোকে মানুষ করেছি... আমার কাছে ট্রেনিং নিতে হবে তোমাদের।"
হঠাৎ গাল বেয়ে নোনা স্রোত নামতে থাকে সরমাদেবীর। চিরটাকাল বাঁজা বলে শুভকাজ থেকে শাশুড়ি তাঁকে দূরে রেখেছেন। তাই আজ তাঁর বুকের ভেতরটাও যেন ঝলমল করে উঠছে সৌম্য আর অর্ঘ্যর পেরেন্টস্ হয়ে ওঠা দেখে!
@মুজনাই অনলাইন পৌষ সংখ্যা ১৪২৭
No comments:
Post a Comment