মুজনাই সাপ্তাহিক
নদী সংখ্যা
ইছামতী-- একটি ভালোবাসার নাম
কুমকুম ঘোষ
ইছামতী -- নদীর নামটির সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামটি। তাঁর যুগান্তকারী "পথের পাঁচালী" কি " ইছামতী" উপন্যাসের মূল চরিত্র হিসেবে উঠে এসেছে এই নদীর প্রবাহ। দুটি উপন্যাসের নায়ক নায়িকা থেকে অতি সাধারণ চরিত্র সকলের জীবনের ছোট বড়ো সব মুহূর্ত গুলো সম্পৃক্ত হয়ে আছে এই নদীর সাথে।বলা ভালো নদী এখানে কথা বলে তাদের হয়ে।
যেমন নীলবিদ্রোহের পটভূমিতে লেখা "ইছামতী" উপন্যাসের গৃহীসন্ন্যাসী ভবানী বাঁড়ুজ্যে,তার সেবাপরায়ণা স্ত্রী তিলু এবং তাদের খোকা, এমনকি অত্যাচারী নীলকর সাহেব শিপ্টন ও রামকানাই কবিরাজ সবার জীবনে জুড়ে আছে ইছামতী নদী।
"পথের পাঁচালী" উপন্যাসের হরিহর রায়ের বংশ পরিচয় পর্বে ইছামতী নদীর বুকে ঘটে যায় এক ভয়ানক ঘটনা।হরিহরের পূর্ব পুরুষ বীরু রায়ের একমাত্র পুত্র নৌকা থেকে উধাও হয়ে যায় এই ইছামতী র এক নির্জন চর থেকে। মাঝিরা অনুমান করে তাকে কুমীরে ধরে নিয়ে গেছে।
অপু ও হরিহরের জীবনের অনেকটা অংশ জুড়ে বিরাজ করে এই স্রোতস্বিনীর ধীর স্থির প্রবাহধারা।
ইছামতী নদীর সাথে আমার পরিচয় টাকী ভ্রমণের সাথে। অত্যন্ত বিখ্যাত ট্যুরিস্ট স্পট ও পিকনিকের আদর্শ জায়গা উঃ চব্বিশ পরগণা র টাকী ,যার পাশ দিয়ে বয়ে চলে এই নদী । টাকীর উল্টোদিকে ই বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলা । ইছামতী র বুকের মাঝে দুই দেশের সীমানা চিহ্নিত কোনো দৃশ্যমান কাঁটাতার নেই কিন্তু সীমারেখা আছে মাঝনদীতে। তাই এদিকের নৌকা কখনো ওদিকে যায়না।সব নৌকায় নিজের দেশের পতাকা লাগানো থাকে আর দুই তীরে সীমান্ত রক্ষী বাহিনী প্রহরায় থাকে চব্বিশ ঘন্টাই। কিন্তু অবাক লাগে ভাবতে নদীর মাছেরা কি সেকথা জানে ? কিংবা পাখীরা? বর্ডারের সেই অদৃশ্য সীমারেখা মুছে যায় নদীর ছলাৎ ছলাৎ শব্দে ,এক ঝাঁক বাটা মাছের রূপালী আঁশে সকালের রোদ পড়ে ঝকঝক করে। সূর্যোদয়ের মুহূর্তে ইছামতী র জলে তখন সোনা রোদের গান ঝিলিক দিয়ে ওঠে।
ভারত ও বাংলাদেশের পতাকা লাগানো জেলে নৌকা ঘুরছে ইছামতী র বুকে এ তো হামেশাই দেখা যায়। অনেক সময়েই দুই নৌকার মানুষেরা দূর থেকে হাত নাড়িয়ে সৌজন্য বিনিময় করছেন,এই ঘটনা দেখেছি নৌকায় করে মাছরাঙা দ্বীপে যাওয়ার সময় বা নিছকই নৌকাভ্রমণের সময়।
বিশেষ করে প্রতিবছর বিজয়া দশমীর দিনে এই নদী হয়ে ওঠে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের এক উজ্জ্বল উদাহরণ। হাজার হাজার মানুষ দুই পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকেন প্রতিমা বিসর্জন দেখার জন্য। ইছামতী র বুকে দুর্গা প্রতিমার বিসর্জন দুই দেশের প্রীতি ও ভালোবাসার অন্যতম হলমার্ক হয়ে থাকে।এই অনুষ্ঠান টিভিতে ডাইরেক্ট টেলিকাস্ট ও হয়।
এহেন নদীর প্রেমে পড়া যায় বারবার।তাই ফিরে ফিরে এসেছি এর তীরে। বন্ধুদের সাথে পিকনিক করতে একদিনের জন্য, কিংবা ২০১১ সালের ১৭ ই জুন যেদিন ভোর রাত থেকে মুষলধারায় বৃষ্টি পড়ছিল সেদিন এক রোমাঞ্চকর লঙ্ ড্রাইভ করেছিলাম স্বামী- কন্যা সহ এই নদীকে দেখতে,রাত কাটাতে। কখনও নদীর শোভা দেখতে রাত্রিবাস করেছি প্রিয় মানুষজনের সাথে, দিদি- জামাইবাবু র বিবাহবার্ষিকী পালন করেছি কিংবা প্রথমবারের সুন্দরবন ভ্রমণ করেছি টাকী পুরসভার সোনার তরী নৌকায়।
সুন্দরী "ইছামতী"আদতে তিনটি ধারায় প্রবাহিত হয় যার দীর্ঘ তম অংশ ২০৮কিমি ।নদীটি নদীয়ার কাছে ভৈরব নদ থেকে উৎপন্ন হয়ে একবার অধুনা বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আবার ঢুকে পড়েছে উঃ চব্বিশ পরগণায়। কত সমৃদ্ধ জনপদ এর দুই তীরে। এদিকে নদীয়া, উঃ চব্বিশ পরগণা জেলা ওদিকে সাতক্ষীরা, যশোর , চুয়াডাঙ্গা । বর্তমানে নাব্যতাজনিত সমস্যায় জেরবার এই নদী।প্রতিবছর বর্ষাকালে বন্যা লেগেই থাকে।টাকীর পরেই হাসনাবাদের কাছে এই নদী দুটো ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। একভাগ কালিন্দী নদী হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশে গেছে ।
সব সভ্যতাই তো নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে, তেমনি ভালোবাসারও জন্ম দেয়।
নদীমাতৃক বঙ্গে অনেক নদীর সাথে পরিচয় হয়েছে , বিশেষ করে আমি তো জন্মেছি ই গঙ্গাপাড়ের এক গ্রাম খড়দা'তে, ফলে নদীর সাথে আশৈশব জানাশোনা।।তবু গঙ্গা নয় ইছামতী"ই আমার ভালোবাসার নদী:
ঠিক যেমনটি বলেছেন কবি ....
" যখন যেমন মনে করি তাই হতে পাই যদি,
আমি তবে এক্ষণি হই ইচ্ছামতী নদী।
রইবে আমার দখিন ধারে সূর্য- ওঠার পার,
বাঁয়ের ধারে সন্ধেবেলায় নামবে অন্ধকার,
আমি কইব মনের কথা দুই পারের ই সাথে--
আধেক কথা দিনের বেলায়, আধেক কথা রাতে।।"
No comments:
Post a Comment