মুজনাই সাপ্তাহিক
নদী সংখ্যা
নদী, কোথায় তোমার ঘর
নন্দিতা পাল
নদী দেখলেই চুপ করে কথা শুনতে ইচ্ছে করে আমার। এত কথা তার উচ্ছল শিশুর মত। আর কথা শুনতে শুনতে মন নীরবে কখন চলে যায় একের পর এক জীবনের পৃষ্ঠায়। নদী পুকুরের দেশে আমার ছোটোবেলা কেটেছে। যখন দাদুর বাড়ি যেতাম তোরসার হাত ধরে যেত রাস্তাটা। বাবা মায়ের চাকরি সুত্রে ছিলাম যে শহরে, যেখানে গল্প হত ভরা মান্সাইয়ের সাথে। তিস্তা নদী পেরিয়ে ছিল আমার স্কুল এক শহরে। সেই কুয়াশায় নদী হারিয়ে যেত সাদা একটা চাদরে, মাছ ধরার ডিঙ্গি গুলো দূরে চিকচিক জলে দাঁড় বাইত। বর্ষার চরগুলো হারিয়ে যেত এক্কেবারে, কোথেকে এত রাগ নদীর, গর্জনে কান পাতা দায়। একবার ভনঙ্কর সেই রূপ দেখলাম তোরসার, আটকে রাখতেই পারছে না নদী তার রাগ, ঘনঘন বাঁধের উপর চোটপাট। আর সেই বৃষ্টির রাতে দুদ্দাড় লোকের দৌড়াদৌড়ি, চিৎকারে কান রাখা দায়। আমাদের সবে ছাদ হয়েছে তখন, পাড়ার অনেক লোক আমাদের বাড়িতে, সবার হাতে দরকারি বা প্রিয় জিনিস। আমার তো মনে আছে, সবে মাধ্যমিক পাস করেছি, সেই একমাত্র সার্টিফিকেটটা নিয়ে ছাদে উঠে যাব ভাবছি। যাই হোক, সে প্রয়োজন হয়নি কারণ নদী বুঝতে পেরেছিল রাগ টা বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে, জল কমে এসেছিল সে রাতে, বৃষ্টিও।
এরপর গঙ্গা পেরিয়ে কলকাতা, বাড়ি ছেড়ে দূরে পড়াশুনো। সে আমলে কামরূপ এক্সপ্রেস ছাড়া তেমন ভালো কোন ট্রেন ছিল না। ট্রেনের চাকা যখন গড়াতে শুরু করত, চোখের সাথে মন ঝাপসা হয়ে আসত বাড়িতে খুশিতে দিন কাটানোর স্মৃতিতে। ট্রেনের ভারী চাকার আওয়াজে কান্না যেন গলার কাছে দলা হয়ে থাকত। এরপর, সকালে যখন গঙ্গা নদীর ওপর দিয়ে যেতাম, ভোরের আলোয় নদীর হাসিমুখ দেখে পেতাম নতুন উদ্যম, ঝাপসা কাটিয়ে নতুন বন্ধুদের মুখ গুলো মনে পড়তে দিন শুরু হত। এরপর দিন যত গড়িয়েছে, দূর শহর, বিদেশ পাড়ি, যাই হোক না কেন – প্লেনের জানালা দিয়ে যখন দেখেছি গঙ্গার মুখ, মন আনন্দে ভরে উঠেছে ঘরে ফেরার। গঙ্গার বিভিন্ন ঘাটে যাই বারবার, এক এক জায়গায় তার অন্য রকম রূপ। ভরা বৃষ্টিতে টইটম্বুর নদী, কুলের কাছে জলের অবিরাম কথা। গরমের দিনে স্রোত তেমনি গভীর, তবু দেখেছি কিছু লোকেদের ছপাং দেওয়া জলে। গঙ্গা শুধু নদী নয়, যখন ঘাটে চুপ করে বসি শুনতে পাই অনেক গল্প, বছরের পর বছর আগের অনেক ইতিহাস যার সাক্ষী ছিল সে। গঙ্গার বুকে সূর্যোদয় দেখেছি বাতাস এসে ফিসফিস করে ঘুম ভাঙ্গায় নদীর, সূর্য তো চোখ খুলে নদীকেই প্রথম দেখে তার মোলায়েম চোখে। আর বিকেলের পড়ন্ত আলো কিছুতেই যেন নদীর আঁচল ছাড়তে চায় না। মাঝিরা ভরা নদীতে গান ধরে উদাস করা বাউল। আমার মন ও অনেকবার জিগ্যেস করেছে, নদী, তোমার ঘর কোথায়। হেসে ছলকে গঙ্গা নির্বিকার বয়ে চলেছে দুর্বার গতিতে। আজ মনে হয় মা গঙ্গার ঘর আমার মনে, আমার ভাবনায়। আমি গঙ্গাকে নিজের মনে বয়ে নিয়ে চলি, যা বারেবারে ফিরিয়ে আনে আমায় নিজের জায়গার ঠিকানায়।
ছবি- লেখক
No comments:
Post a Comment