অদিতি মুখোপাধ্যায় (সেনগুপ্ত)
আশার আলো
অরুনিমা কফি খেতে-খেতে শিমলার গেস্ট হাউসের জানালা দিয়ে বাইরে বরফ পরার মনোরাম দৃশ্যটা উপভোগ করছিলো। আজ মা, বাপি আর সোহম ভাইয়ার সাথে তার খুব আনন্দে কেটেছে। সে এই প্রথমবারের জন্য কোথাও বেড়াতেএসেছে আর খুব আনন্দ করেছে যেমন স্নোম্যান বানিয়েছে, আইস-স্কেটিং করেছে আর প্রিয় বন্ধুদের জন্য অনেক উপহার কিনেছে। হঠাৎই
ভাইয়ার গলা ফাটানো চিৎকারে সে সম্ভিত ফিরে পেলো।
মা অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ভাইয়া কে শান্ত করার চেষ্টা করলো। ভাইয়া খুবই শান্ত আর ধীর প্রকৃতির, সে কেন হঠাৎ এতটা উত্তেজিতো হল তা অরুনিমার কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছিলনা। মা ও বাপীর অনেক জিজ্ঞাসাবাদ এর পর ভাইয়া যখন মুখ খুললো তার সারমর্ম এই দাঁড়ালো যে তার কোণো এক বন্ধু তাকে বলেছে যে অরুনিমা তো তার নিজের কেউ না, তাহলে অরুণিমার সকল আবদার, সকল ইচ্ছে কে সোহম এতো প্রাধান্য দেয়ে কেন। সোহম এর এটাতেই ঘোরোতর আপত্তি। তার বক্তব্য অন্যেরা কেন তার ইচ্ছের মাঝে হস্তক্ষেপ করবে। সে অরুণিমার জন্য যা ইচ্ছে করবে এতে অন্যের বলার কোনো অধিকার নেই। এবার অরুনিমার মনে পরে যায় সেই অভিশপ্ত দিন গুলোর কথা, কিভাবে তাকে বিহারের এক প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে মেয়ে পাচারকারী এক দল উঠিয়ে এনে প্রায় বিক্রি করেই ফেলছিলো। রাখি পূর্ণিমার সেই রাতে যখন মেয়ে পাচারকারীর দলটা আই. পি.এস সোহমের হাতে ধরা পরেছিলো তখন উদ্ধার করা মেয়েগুলোর মধ্য দশ বছরের অরুনিমা ও ছিলো। সে সোহমের পা জড়িয়ে ধরে ভাইয়া বলে ডেকেছিলো আর সোহম যখন তাকে জিজ্ঞেস করেছিলো যে সে কেন তাকে "ভাইয়া" বলে ডাকছে। অরুনিমা খুব সহজ-সরল ভাবে উত্তর দিয়েছিলো যেহেতু রাখি পূর্ণিমার পূণ্য তিথিতে সোহম তাকে শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা করেছে, সেহেতু সোহম তার ভাইয়া। ছোটো মেয়েটির এই কথা গুলো সোহমের অন্তর আত্মা কে স্পর্শ করেছিলো, সে দ্বিতীয় বারের জন্য কিছু না ভেবে মেয়েটিকে তার বাড়ীতে নিয়ে আসে এবং যখন জানতে পারে যে মেয়েটির বাবা-মা এর মৃত্যুর পর তাকে তার মামা ঐ পাচারকারী এর পান্ডা এর কাছে বিক্রি করে দিয়েছিল,তখন সোহম তার বাবাকে বলে মেয়েটিকে দত্তক নেয়ে এবং তার নামকরণ করে "অরুনিমা"। সেই দিন থেকেই অরুণিমা হয়ে ওঠে ওই পরিবারে এক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। তার সকল আশাই তার মা, বাপি ও ভাইয়া পুরন করে। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট করার জন্য তার ভাইয়া উপহার স্বরূপ তাকে জিজ্ঞেস করে সে কোথায় বেড়াতে যেতে চায়, সে তখন শিমলাতে যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করায় ভাইয়া খুব উৎসাহের সাথে টিকিট কেটে আনে। তাই বন্ধুর ওই রকম একটা উক্তিতে ভাইয়ার রেগে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। অরুনিমা ভাইয়া আর মা কে জড়িয়ে ধরে বলে "মা দেখো আজকের মত পুরো বছরটাই খুব ভালো কাটবে। অন্য কে কি বললো তা নিয়ে ভাবিনা, তোমরাই তো আমার সব"। বাইরের মত ঘরের ভিতরেও একটা সুমধুর হিমেল হাওয়া বয়ে গেল। সোহম বলে উঠল, "আমার ছোটো সোনা বোন, তোর সকল মনোবাঞ্চা পুরন হোক"।
আর মা সোহমের উদ্দেশ্যে বলে উঠল :-
এসেছিলি ভবে যবে -
হেসেছিলাম আমি, কেঁদেছিলি তুই।
বুঝতেই পারিনি কখন কবে -
হঠাৎই বড় হয়ে গেলি তুই।।
এখন ব্যথিত হৃদয় কাঁদে আমার যখনই,
হেসে হেসে স্নেহ-মাখা স্পর্শে সকল কষ্ট ভোলাস তখনই।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস সর্বদাই রবে,
হবি তুই আমার অপরাজিত এই ভবে।
সার্থক নামকরণ হবে সোহম তোর,
আশা পুরণ করবি সকলের এই বিশ্বাস মোর।
@মুজনাই অনলাইন পৌষ সংখ্যা ১৪২৭
No comments:
Post a Comment