মুজনাই সাপ্তাহিক
নদী সংখ্যা
(করতোয়া নদী মোহনার সম্মুখে)
আমার প্রিয় নদী
গৌতম চক্রবর্তী
নদীমাতৃক সভ্যতার
মাতৃস্বরূপিণী ত্রিস্রোতা
মুজনাইয়ের এবারের বিষয়ভিত্তিক লেখা ‘আমার প্রিয় নদী’ লিখতে বসে দেখলাম মুজনাই সম্পাদক বড়ই সমস্যায় ফেলে দিয়েছেন বিষয় বৈচিত্র্যে। শুরু করার সময় কুলকিনারা খূঁজে পাচ্ছিলাম না যে আমার প্রিয় নদী কোনটি নয়। আমার বাড়ির পাশের করলা, যাওয়া আসার পথের তিস্তা, তোর্ষা, জলঢাকা, মুজনাই, বালাসন, মহানন্দা, সুটুঙ্গা এমনকি ডুডুয়া, গিলান্ডি, মাল, লিস, ঘিস, কালজানি, চেল, অজস্র ঝোরা, খোলা সবই যে আমার প্রিয়। কারণ ডুয়ার্সের প্রতিটি জনপদ গড়ে উঠেছে এই নদীগুলি এবং ঝোরাগুলিকে কেন্দ্র করেই যে। তাই “আমার প্রিয় নদীকুল” শিরোনামেই বিষয়বস্তূর অবতারণা করতে গিয়ে আচমকা মনে এল সেই সুপ্রাচীন ত্রিস্রোতা তথা করতোয়ার কথা যাকে কেন্দ্র করে এই ভূখন্ড, এই বরেন্দ্রভূমি, কোচ, কামতাপুর রাজ্যের উত্থান-পতন। কালের অমোঘ নিয়মে এই নদী আজ গল্পগাথায় পরিণত। কিন্তু নদীমাতৃক সভ্যতার মাতৃস্বরূপিণী ত্রিস্রোতা এখনো আমার প্রিয় নদী। ডক্টর চারুচন্দ্র সান্যাল, ডক্টর অরুণ ভূষণ মজুমদারের লেখা নিবন্ধ, রেণেলের ম্যাপ, সমসাময়িক পত্রিকা, জলপাইগুড়ি বিষয়ক বিভিন্ন বই থেকে সংগৃহীত তথ্যাবলী নিয়ে কলম ধরলাম। ইতিহাস, কল্পনা, বাস্তবতার সংমিশ্রণে লেখাটি সম্পৃক্ত হলেও ভূমিকম্পের ফলে মাটির নিচে অবলুপ্ত হয়ে যাওয়া করতোয়া এবং ত্রিস্রোতার পুণ্য সলিলের ওপর বর্তমানে দাঁড়িয়ে আছে জলপাইগুড়ি সহ এক একটা জনপদ। এটাই বাস্তবতা। আসলে বিশ্বাসে মিলায়ে বস্তূ, তর্কে বহুদূর।
ত্রিস্রোতা নামের উৎপত্তি
উত্তরবঙ্গের প্রাচীন এবং প্রধান নদী ত্রিস্রোতা। ত্রিস্রোতার উৎপত্তি এবং মাহাত্ম্যের মত
তার অবস্থান এবং গতিপথও বর্ণিত হয়েছে বিবিধ শাস্ত্র, পুরাণ,
তন্ত্র এবং গ্রন্থে। ত্রিস্রোতা নামটির মধ্যেই নিহিত রয়েছে ত্রিধারার রহস্য। তিস্তার মূল গতিপথের বিবরণ ডক্টর
চারুচন্দ্র সান্যাল এর লেখা “তিস্তা করতোয়ার
রূপরেখা” নিবন্ধে রয়েছে এবং তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে
বারোটি নদী মানচিত্রের বিবরণ। চারুচন্দ্র
সান্যাল তিস্তার এই মূল গতিপথের আরো পরিষ্কার চিত্র তুলে ধরেছেন। রেনেলের
মানচিত্র এই গতিপথকে স্বীকৃতি দিয়েছে। ভুটানের উত্তরে হিমালয়ের কোলে সিকিমের পাহাড় থেকে উৎপত্তি
হয়ে প্রাচীন তিস্তা সমতলের দিকে নেমে আসার সময় লেপচা এবং পাহাড়ি
জনজাতির গ্রামবাসীরা তিস্তাকে তাদের পছন্দমতো নাম দিয়েছিল। যেমন স্যা ছু, রং নিউং, রঙ্গ, দিসতা, তিস্তা।
মূল নদী তিস্তা জলপাইগুড়ির উত্তরে পৌঁছে সোজা দক্ষিণে চলতে শুরু করেছিল। সমতলে তিস্তা তিনটে স্রোতধারায় প্রবাহিত
হয়েছিল বলেই তার নাম হয়েছে ত্রিস্রোতা। তিস্তা
সমতলে নেমে প্রবাহিত হতো তিনটি স্রোতধারায় যেগুলির
নাম ছিল পাঙ্গা, যমুনা এবং করতোয়া। জলপাইগুড়ি শিলিগুড়ির পথে নদীগুলির
অবস্থান, গতিপথ ও বর্তমান উৎসস্থল এবং সেইসঙ্গে
হলদিবাড়ির পশ্চিমদিকের নদীগুলির অবস্থান বিস্তারিত আলোচনায় পর্যালোচনা করলে দেখা
যায় ত্রিস্রোতার গতিপথের নির্দিষ্ট ক্ষেত্রটি দাঁড়ায় শিলিগুড়ির অদূরে অধুনা
জলপাইগুড়ি জেলার উত্তর প্রান্তে সেবক রেলপুলের দক্ষিণে। ত্রিস্রোতার প্রায় পুরো অবস্থানটি ছিল অবিভক্ত
জলপাইগুড়ি জেলার পশ্চিমপ্রান্ত জুড়ে। আর “তিস্তা
করতোয়ার রূপরেখা”
নিবন্ধে চারুচন্দ্র সান্যাল লিখেছেন ভারতের প্রসিদ্ধ একান্ন পীঠের ভ্রামরী পিঠ
তিস্তা করতোয়ার তীরে।
পাঙ্গার গতিপথ
যেখানে তিস্তা সমতলে নামে সেখানে পাঙ্গা,
যমুনা এবং করতোয়া সহ তিনটি স্রোতধারা সৃষ্টি হয়। প্রাচীন তিস্তার সমতলের গতিপথ তিনটি স্রোতধারায় প্রবাহিত
হয়েছিল বলেই এর নাম ত্রিস্রোতা। উল্লিখিত
নদী মানচিত্রগুলিতে করতোয়া এবং যমুনার পূর্ব দিকে পাঙ্গা নদীর অবস্থান । শিলিগুড়ির কাছে সেবক এর পর এই তিন
স্রোতধারার উৎপত্তি হয়ে তারা আলাদা আলাদাভাবে প্রবাহিত হতো জলপাইগুড়ি এবং
হলদিবাড়ি শহরের পশ্চিম দিক দিয়ে এবং পুনরায় একধারায় মিলিত হতো অবিভক্ত
জলপাইগুড়ি জেলার দক্ষিণে দেবীগঞ্জে যেটা অধুনা বাংলাদেশে। কিন্তু পরবর্তীকালে পাঙ্গার গতি পরিবর্তনের ফলে কার্যত
একটি ধারায় পরিণত হয় অধুনা বাংলাদেশের শালডাঙ্গাতে।
করতোয়ার গতিপথ
আমরা জানি প্রাচীন কামরূপের পশ্চিম সীমানা ছিল করতোয়া নদী।
তিস্তার বিপুল জলরাশি থেকে তিনটি স্রোতধারা নির্গত হয়েছিল। করতোয়া ছিল তাদের মধ্যে একটি। ত্রিস্রোতার পশ্চিম ধারা করতোয়ার গতিপথ
বর্ণনাতে ডক্টর চারুচন্দ্র সান্যাল তাঁর নিবন্ধে
লিখেছেন জলপাইগুড়ি জেলার উত্তর-পশ্চিম দিয়ে করতোয়া গিয়েছিল প্রায় ৪৫ মাইল
আমবাড়ি ফালাকাটা এবং ভজনপুর এর ওপর দিয়ে। এখনও ফাটাপুকুরের কাছে রয়েছে করতোয়া বলে একটি নদী। তারপর কোচবিহার
রাজ্যের ঘোড়ামারা নদী এর সাথে মিলিত হয়। করতোয়া তার গতিপথে প্রাচীন কোচবিহারের অন্তর্গত
শালডাঙ্গাতে ঘোড়ামারা এবং দেবীগঞ্জে তিস্তার পরিত্যক্ত বুড়ি তিস্তার ধারাকে বুকে
তুলে দক্ষিণে আত্রাই নাম ধারণ করে গঙ্গার সঙ্গে মিলিত হয়। ১৭৮৭ সালে উত্তরবঙ্গে ভয়ানক ভূমিকম্পে ভূপ্রকৃতির ব্যাপক
ওলটপালট হওয়ার আগে পর্যন্ত সমতলে তিস্তার এই গতিপথ অব্যাহত ছিল।
যমুনার গতিপথ
ত্রিস্রোতার মধ্য ধারা হলো যমুনা। ডক্টর চারুচন্দ্র সান্যালের “তিস্তা
করতোয়ার রূপরেখা” নিবন্ধে হান্টার সাহেবের বর্ণিত অংশে
পাওয়া যায় তিস্তার একটি শাখার নাম ছিল যমুনা। যমুনা নদী বাহাদুর তালুক, নগর
বেরুবাড়ি, গড়ালবাড়ি ইত্যাদি এলাকার ওপর দিয়ে
প্রবাহিত হওয়ার পর ভূজারীপাড়াতে দক্ষিণ বেরুবাড়ীতে প্রবেশ করেছে এবং সাতকুড়ার
পশ্চিম দিক দিয়ে প্রবাহিত হয়ে দক্ষিণ বেরুবাড়ির দক্ষিণ সীমান্ত কীর্তনীয়া
পাড়ায় নাউতারি নবাবগঞ্জে গিয়ে তার নামটিও হারিয়ে ফেলেছে। দক্ষিণ বেরুবাড়ীর দক্ষিণ সীমান্ত
কীর্তনীয়া পাড়া-নাউতারি নবাবগঞ্জে পাঙ্গা ও যমুনা পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হয়ে
ঘোড়ামারা নাম ধারণ করে এখান থেকে এই মিলিত ধারা ঘোড়ামারা নামে প্রবাহিত হয়েছে দক্ষিণে।
ত্রিস্রোতা বা বুড়ি তিস্তা
চারুচন্দ্র সান্যালের মতে, তিস্তা তখনও পূর্ব বাহিনী হয়নি। ২৬.৩৫ মিটার উত্তর অক্ষরেখা থেকে বাঁক নিয়ে দক্ষিণে প্রবাহিত হত। মেখলিগঞ্জ এর পশ্চিম সীমা ছুঁয়ে আজকের হলদিবাড়িকে পূর্ব দিকে রেখে রংপুর অতিক্রম করে দিনাজপুরে প্রবেশ করত তিস্তা। ফার্মিন্জারের ১৭৭০-১৭৭৯ সনের বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট রেকর্ডের অংশ উদ্ধৃত করে বলতে পারি ত্রিস্রোতা ১৬৮৯ সালের আগেই দিনাজপুরে আত্রাই নদীর সাথে মিলে গঙ্গায় পতিত হত। ১৭৭৯ সালে ফকিরগঞ্জ অর্থাৎ জলপাইগুড়ি শহরের কয়েক মাইল দক্ষিণে মাদারগঞ্জ এর কাছে তিস্তার একটা শাখা কাশিয়াবাড়ী হয়ে পশ্চিম দিকে এবং তারপরে দক্ষিণে বেঁকে দেবীগঞ্জের কাছে করতোয়ায় মিশেছিল। এই নদীর বিস্তারের বিষয়ে ডঃ চারুচন্দ্র সান্যাল লিখেছেন তিস্তা মন্ডলঘাট এবং হলদিবাড়ির ভেতর দিয়ে কাশিয়াবাড়িতে বুড়ি তিস্তা নামে চিলাহাটির ভেতর দিয়ে দক্ষিণে দেবীগঞ্জের কাছে করতোয়াতে মিশে গিয়েছিল। কয়েক বছর বাদে বুড়ি তিস্তা অন্য পথে যাওয়ার ফলে এই ধারাটিও শুকিয়ে গেল। উল্লিখিত নদী মানচিত্রগুলিতে এই বুড়ি তিস্তার বিবরণও তুলে ধরা হয়েছে। বুড়ি তিস্তার গতি পরিবর্তনের ফলে পাঙ্গা তথা মূল নদী তিস্তা খয়েরবাড়ি এবং বোনাপাড়াতে কিছুটা পূর্ববাহিনী হয়ে তারপরে দক্ষিণে দক্ষিণ বেরুবাড়ির মানিকগঞ্জের পশ্চিম দিক দিয়ে প্রবাহিত হয়ে অধুনা বাংলাদেশে নাউতারি নবাবগঞ্জে পাঙ্গা নামটি হারিয়ে ফেলে। জলপাইগুড়ি থেকে হলদিবাড়ির পথে নারায়ণপুরের পর পশ্চিমবাহিনী একাধিক জলধারা বিশেষ করে কাশিয়াবাড়ির কাছে পশ্চিমবাহিনী মৃত ধারাটি ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হয়ে আছে।
পলি এবং বালি ঘাটলে উঠে আসে ইতিহাস
প্রাচীনকালে তিস্তা নদীর তীরে গড়ে উঠেছিল বহু দেশের
রাজধানী, শিক্ষা
সংস্কৃতির কেন্দ্র, বাণিজ্য কেন্দ্র এবং ধর্মীয় পীঠস্থান। কালের প্রভাবে সেসবের অনেক কিছুই আজ
অবলুপ্ত। অনেক কিছুই
তলিয়ে গেছে তিস্তার পলি এবং বালিতে।
কালের বিবর্তনে কখনো কখনো অযাচিতভাবে বেরিয়ে আসে সেসবের কিছু চিহ্ন বা প্রাচীন
ইতিহাসের কিছু নিদর্শন। তখন
সেই সব নিয়ে শুরু হয় নানান জল্পনা কল্পনা। তিস্তার গভীর পলি এবং বালি থেকে তুলে আনা হয় প্রাচীন
ইতিহাসের নানা উপাদান। প্রাচীনকালে বহু
দেশের সীমানা নির্ধারক নদী ছিল এই তিস্তা। খেয়ালী তিস্তার গতি পরিবর্তনে একদিকে বিলীন হয়েছে কত
গ্রাম, কত প্রাকৃতিক সম্পদ। কত মানুষ হয়েছে ভূমি ছাড়া,
বাস্তুহারা। বিধ্বংসী তিস্তাতে
প্রলয়ংকরী বন্যায় কত মানুষ এবং প্রাণী ভেসে গেছে। উত্তরবঙ্গের প্রাচীন নদী তিস্তাকে নিয়ে মানুষের কল্পনার
অন্ত নেই। তিস্তা খেয়ালী,
রাক্ষসী, তিস্তা বিধ্বংসী। তিস্তা পাড়ের মানুষ,
তিস্তাপারের ভাষা, তিস্তা পাড়ের গান,
তিস্তাপারের প্রবাদ, তিস্তাপারের সংস্কৃতি নিয়ে কত কিছুই
গড়ে উঠেছে তিস্তাকে কেন্দ্র করে। কত
নাটক-সিনেমা এবং বিভিন্ন ধরনের গল্পকথা তৈরি হয়েছে তিস্তাপাড়ের মানুষের জীবনকাহিনী
নিয়ে। উত্তরবঙ্গের
মানুষের কাছে তিস্তা এক দেবী।
তিস্তা বুড়ির গান এবং নাচ আজও উত্তরবঙ্গের গ্রামীণ জীবনের এক অমূল্য সম্পদ।
No comments:
Post a Comment