Tuesday, July 2, 2024


 

স্মৃতির বিদ্যালয়
বিকাশ দাস ( বিল্টু )

দুপুরের স্নিগ্ধ রোদকে চুম্বন করে আমি একা হাঁটছি শহর কলকাতার পথে। এই শহরের গলিগুলি বড্ড অদ্ভুত। গোলক ধাঁধার মতো। ক'দিন ধরে বিষণ্ণতা ভীষণভাবে ছুঁয়ে ছিল আমায়, এখনও আছে। কিছুই ভালো লাগছে না। কাজ আর কাজ। ব্যস্ততার ঘন্টি যেন লেপ্টে আছে বুকে। এর মাঝে হঠাৎ থমকে গেলাম বেহালার পাশে, একটি স্কুল দেখে। ভুলে গেলাম ব্যস্ততা। ভুলে গেলাম এন.ডি. এ, ই ন্ডি য়া। দিদি-মোদি। দেখলাম একদল স্নিগ্ধ শিশু রাস্তা পার হচ্ছে দল বেঁধে। কাঁধে ব্যাগ। ইউনিফর্ম। জানিনা মন কেন এত অবুঝ। সবুজ হয়ে উঠলো বুক। আমি ডুব দিলাম স্মৃতির ঘরে।

এখন আমি স্মৃতির বারান্দায়। পায়চারি করছি।ক্যানভাস জুড়ে মিঠে রোদ্দুরের আলো। আমি সেই আলোতে বসে ছোট্ট খোকা পড়ছি ' জীবনবিতান ' । অ-আ এর দেশ এক অদ্ভুত ভাল লাগার আবেশ। দিদি পড়াচ্ছেন। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো পড়ে যাচ্ছি লি-ডাবলি। সারা বাড়ি ভরে উঠছে কবুতরে। ওদের ভাষা ভীষণ প্রত্যয়ী। যেন আমার বুকের ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালির স্বর। 

মা ও ঘরে রান্না বসিয়েছেন। আজ সিদ্ধ ভাত হচ্ছে। বাবা গোয়াল থেকে গরু বের করে এখন জাবর কাটছে ঘাসের।  থেকে ভেসে আসা গলায়, কি নরম তীব্র স্বর। 'পড় রে বাবা, পড়.....' 
এরপরেই শোনা সোনা যেত অন্য একটি আকুতি। ' ভাত হইয়া গেছে। খাইয়া ল। স্কুল জাবি।'

আমার স্কুল জীবন শুরু গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। শিশুশিক্ষা কেন্দ্রে। এখান থেকেই আমি জানতে পারি, জলের অপর নাম জীবন। সাতের ঘরের নামতা। এক- এ চন্দ্র, দুই- এ পক্ষ। মনে না পড়ার মতো অনেক কিছুই আছে, তবে মনে রাখার মতোও অনেক। এক চিমটি ঘরে আমাদের চলতো পঠন-পাঠন। নলি বাঁশের বেড়ায় লটকানো ব্ল্যাকবোর্ডে দিদিমনি লিখতেন 'এ ', ' ঐ '.....

আমরাও মন্ত্রমুগ্ধের মতো সমস্বরে বলতে থাকতাম। কচুর পাতা ছিল আমাদের বর্ষার ছাতা। বাড়িতে অভাব আর অভাব। এক প্যান্ট- এ কেটে যেত সারা বছর। বাবা কুলিয়ে উঠতে পারতেন না। এ নিয়ে আমাদের কোনো অভিযোগ ছিল না। মনে পড়ে ' কলার পাতায় দোলায় চামর শিশির ধোয়ায় পা...'






তবে এই সমস্ত সব স্মৃতিকে ছাপিয়ে গেছে আমার হাইস্কুল জীবন। তখন হাফে প্যান্ট থেকে ফুল প্যান্ট- এ উত্তীর্ণ হওয়ার বয়স আমাদের। বাড়ি থেকে স্কুল যথেষ্ট দূরে আমাদের। মনে আছে এডমিশন টেস্ট দিতে দাদা নিয়ে গেছিল আমায়। সেদিনই পরীক্ষা গোয়েছিল।  ৫০ -এ ২৮ পেয়ে ১৩ নাম্বারে স্থান পেয়েছিলাম। এরপর যথেষ্ট বকুনি খেতে হয়েছিল আমায়।

আমার সেই প্রাণের বিদ্যালয়টির নাম 'শিবপুর হাই স্কুল'। আমার মরমিয়া স্বরের সাথে ঢেউ তোলে আমায়। আমিও পুলকিত হই গভীর ভাবে। শুনেছি বহু পুরানো এই স্কুল। তথ্য নথি থেকে জানা যায় বৃটিশ কাউন্সিল এর একটি ইংলিশ মাধ্যমের স্কুল। স্বর্গীয় কপিল উদ্দিন মিঞার প্রামাণ্য দলিল সে কথাই বলে। এই বিষয়ে বিস্তারিত একদিন বলব। 








নলি বাঁশের বেড়া তখন উঠে গেছে। স্কুলটির মাঝে আড়াআড়ি ভাবে ছিল এক সাইজের বিল্ডিং। যে আমগাছ দুটো রয়েছে তার পশ্চিম দিক বরাবর। এই এক নাগাড়ে ঘরগুলি ক্রমান্বয়ে ছিল বিভিন্ন শ্রেনীকক্ষ। সময়ের সাথে নিজেকে সাবলীল করে তুলেছি ততদিনে। হাসান স্যার বাংলা পড়াতেন। আর এক স্যার প্রিয় নজরুল। ওনার সান্নিধ্য তখনও পাইনি সেভাবে। কিন্তু স্কুলের আকাশে বাতাসে আজও তার নাম ভাসে।

গুটিগুটি পায়ে বড় হতে থাকলাম আমরা। নরম ঘাসের বাগিচায় হাঁটতে চলা শুরু। স্যারদের আন্তরিকতায় জীবনকে পাওয়ার এ এক অন্য অধ্যায়। 

আর এক জনকে ভীষন করে মনে পড়ে। তিনি ছিলেন বলেই, আজ আমি নিজেকে নিজের মতো চিনতে পেরেছি। শুধুই অর্থই কি মানুষ হতে সাহায্য করে। উত্তর যদি বলা হয়। বলব না। একটি সরকারি চাকরি কখনও একটি বড় মানুষের উর্ধ্বে হতে পারে না। কতটা বড় মানুষ হতে পেরেছি, এর বাইরে যার কাছ থেকে মানুষ হওয়ার মন্ত্র শিখেছি। তিনি হেডস্যার। রুপম সাহা। রাশভারী, গুরুগম্ভীর মানুষটির সাথে আজও আমার বিচ্ছেদ- এর গল্পটি লেখা হয়ে আছে। কোনদিন যদি আত্মজীবনী লেখার মতো সময় আসে। লিখব। 



 
সময়ের নাও তরতর করে বয়ে চলে। মানসাই ধরলার পূবালী সঙ্গীত গায়ে মেখে আমরা গায়ক হয়ে উঠেছি। জীবন যুদ্ধের গায়করা এমনই। এখন কে কোথায় বাজনা বাজাচ্ছে, জীবনকে সাজাচ্ছে খবর নেওয়া হয়না। যাইহোক, ষষ্ঠ শ্রেণীতে দ্বিতীয় হওয়ার পর, নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। শুরু হয় কঠিন অধ্যাবসায়। তখনও কোন গৃহশিক্ষক ছিল না। স্যারদের পড়ানোতেই হয়ে যেত সব। আজও ফিকে হায়নি কোনো তারা। স্মৃতির মণিকোঠায় জ্বলজ্বল করে জ্বলছে নীরদ স্যার, ললিত স্যারদের ক্লাস। মৌসুমী ম্যাম যখন পড়াতেন, যেন কোনো মা আমাদের খাইয়ে দিচ্ছেন সুগন্ধি চালের ভাত। কবিতা কি? জানতে পারি মন্টু বাবুর পড়ায়। সুব্রত স্যার, রতন স্যার, ভাস্কর স্যার লায়েক স্যার, বরেন স্যার, দেবাশিস স্যার। তখনকার সময়ের তরুণ তুর্কি। আজ অনেকেই অন্য স্কুলে আছেন। যোগাযোগ আছে কয়েকজনের সাথে। বন্ধুবৎসল। আপন করে নেওয়ার প্রবণতা ছিল ওনাদের। কাজেই উত্তরণ ঠেকাতে পারেনি স্কুলের। আমিও এরপর প্রতিটি পরীক্ষায় প্রথম হতে থাকি। একটি গ্রামীণ স্কুল অল্প সময়ে এভাবেই সেজে উঠলো তরতর করে। বিভিন্ন অনুষ্ঠান, কর্মসূচির মধ্যে দিয়েও উজ্বল হতে থাকলো তার গতি। প্রতি বছর রেজাল্ট হতে থাকল। স্টার পেতে থাকলো। সেই সময় স্টার ছিল, সত্যিই স্টার। 







এখন স্কুল প্রাঙ্গণ ছেয়ে আছে কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়ায়। জারুল এর শোভায় মুগ্ধকর উঠোন। সবটাই প্রিয় হেড স্যারের সৌজন্য। 

আজ ক'মাস হলো স্যার অবসর নিয়েছেন। দেখা হয়নি আর। আমিও পারি জমিয়েছি শহর কলকাতায়। আজ কেন জানি কচিকাঁচাদের দেখে মন কেমন করে উঠলো বুক। অজান্তে চোখে জল এলো। ভালো থাকুক আমার স্মৃতির বিদ্যালয়...

No comments:

Post a Comment