Tuesday, July 2, 2024


 

অন্যরকম

শ্রাবনী সেনগুপ্ত 


আমার পুঁথিগত বিদ্যার সঙ্গে পরিচয় হয় পাড়ার ইস্কুলে।সেখানে দুইবছর পড়ার পর বাড়ি থেকে গোটা তিনেক স্টপেজ দূরের একটি খৃষ্টান মিশনারী স্কুলে প্রথম এবং দ্বিতীয় শ্রেণী ।তারপর একদিন ভর্তির পরীক্ষা দিতে গেলাম একটি অন্যধারার  বিদ্যালয়ে বাবার হাত ধরে এবং ভর্তি হয়েও গেলাম তৃতীয় শ্রেণীতে। মনে পড়ে,প্রথম দিনই অবাক হয়েছিলাম যখন দেখেছিলাম যে,মাঠে প্রেয়ারের পর দিদিমনিরা একেকটি লাইনকে একেকটি ফুলের নাম ধরে ডাকছেন ,আর সেই লাইনটি এগিয়ে যাচ্ছে স্কুলবাড়ির দিকে।আমি আর আমার এক বান্ধবী একসঙ্গে ভর্তি হয়েছিলাম,এবং দুইজনেই প্রেয়ার লাইনে স্যুটকেস রেখে চলে যাচ্ছিলাম,আর আমাদের দুইজনের বাবা ই দূর থেকে হাত দিয়ে ইশারা করে স্যুটকেস নিতে বলছিলেন।আজ,এতো বছর পরেও যেন সব ষ্পষ্ট চোখের সামনে দেখতে পাই।আমার সেই বান্ধবী,আজ বেশ কয়েক বছর হল পাড়ি দিয়েছে অন্য জগতে।
          যত দিন যেতে লাগল ততই বুঝতে পারছিলাম,এই বিদ্যালয়ের শিক্ষা দেবার পদ্ধতি একদম আলাদা।বিশিষ্ট ঐতিহাসিক চিন্ময় সেহেলেনবিশ এর স্ত্রী শিক্ষয়িত্রী উমা সেহেলনবিশ,অক্সফোর্ড এর ট্রাইপোস লক্ষীদি,সত্যজিৎ রায়,উৎপল দত্ত  এঁদের প্রচেষ্টায় এক অন্য ঘরানার বিদ্যালয় পাঠভবন ।
এখানে আমরা পড়াশোনার পাশাপাশি অনায়াসে পাঠ পেতাম মূল্যবোধের।মনে পড়ে,তখন পড়তাম তৃতীয় শ্রেণীতে,ক্লাস চলাকালীন দিদিমনি(আমরা মিস্ বলতাম) বললেন নীচে যেতে, বটুকদা (জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র)
এসেছেন,আগে ওঁর সান্নিধ্য পাওয়া,তারপর আবার ক্লাসে ফেরা।এখন বুঝি,কি অসামান্য ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্য পেয়েছিলাম,উনি আমাদের শেখাতেন ' আমাদের পাঠভবন ' গানটি।গানটি এইরকম - "আমাদের পাঠভবন 
                 আমাদের পাঠভবন
                 শিক্ষা ও দীক্ষায়
                 জ্ঞানে বিজ্ঞানে হেথা
                  নব পাঠ করেছি গ্রহণ"।
একবার তখন চতুর্থ শ্রেণী ,তখন আমাদের ক্লাসরুম থেকে এক একজনের ডাক পড়ল গান শেখানোর ঘরে,যেখানে থাকত একটি পিয়ানো।
সেই পিয়ানো বাজিয়ে গান শেখানো হত আমাদের । সেই ঘরে গিয়ে দেখলাম,অনেকগুলি টুকরো টুকরো ছিট কাপড়কে একসাথে সেলাই করে অনেক বড় একটা চাদর বানানো হচ্ছে,যে যখন সময় পাচ্ছে,বা পাচ্ছেন,গিয়ে সেলাই করে জুড়ে দিচ্ছেন একেকটা টুকরো।এই ছাত্র ছাত্রী এবং দিদিমনিদের  হাতে তৈরী করা বড় চাদরটি
 দেওয়া হবে মাদার টেরিজার আশ্রমে ।আমাদের বিদ্যালয়ে কি সুন্দর গান,গল্পের মধ্যে দিয়ে সহজ করে শিক্ষা দেওয়া হত।আরেকবারের আরেকটি ঘটনা মনে খুব দাগ কেটে গিয়েছিল - আমার তখন তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণী,আমার এক বন্ধু,আরেকজনের মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিল,তখন লক্ষী মিস্ ক্লাসে এসে বলেছিলেন যে,বল কে মাথা ফাটিয়েছ,অন্যায় করলে স্বীকার করতে শেখ,তখন যেই বন্ধু মাথা ফাটিয়েছিল,সে উঠে দাঁড়িয়ে দোষ স্বীকার করেছিল,তখন লক্ষী মিস্ বলেছিলেন যে,তোমার এই সৎ সাহসের জন্য তোমায় ক্ষমা করে দিলাম,আর কখনো এমন অন্যায় করো না।আমার ওই শিশু বয়সে খুব অবাক লেগেছিল,এখনো অবাক হই,এভাবেও শিক্ষা দেওয়া যায়।
                  প্রাইমারী থেকে যখন সেকেন্ডারি বিদ্যালয়ে উন্নীত হলাম,সেইদিন রেজাল্ট এর সঙ্গে আমাদের পেন্সিল,ইরেজার দেওয়া হয়েছিল।প্রাইমারীতে গান শিখতাম পিয়ানো বাজিয়ে,সেকেন্ডারি তে সংস্পর্শে এলাম সুপূর্ণা মিসের,ঠাকুর পরিবারের ।এইরকম সংগীতশিল্পীর কাছে গান শেখা, ভাবাই যায়না। কত কত রবীন্দ্রনাথের গান যে গলায় তুলিয়ে দিয়েছিলেন,আর ছিলেন সুকেশদা।অজয়দা,আলো মিসের বাংলা ক্লাস কোনোদিন ভোলার নয়।আলো মিস্ আমাদের নিয়ে গিয়েছিলেন 'সাউন্ড অফ মিউজিক ' দেখাতে,ওই যে ভালবাসা ,মুগ্ধতা চারিয়ে গেল মনের গভীরে,আজও তা অটুট।' সাউন্ড অফ মিউজিক ' এর উৎসস্থল খুব টানে আমায়, স্বপ্নের মতন। বুদ্ধদেব গুহর 'খেলা যখন '
পড়ে আমরা গিয়েছিলাম আলো মিসকে অনেক সাহস সঞ্চয় করে জিজ্ঞেস করতে যে,ওই বইতে উল্লিখিত আলো দত্ত কি উনিই?ইন্দিরা গান্ধীকে যেদিন হত্যা করা হয় সেদিন উনি পাবলিক বাসে স্কুল ফেরত অসুবিধায় পরা দুটি ছেলে মেয়েকে নিজের বাড়ি নিয়ে গিয়ে পরে ওদেরকে নিজেদের বাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।অজয়দার খুব ব্যক্তিত্ব ছিল,ধুতি পাঞ্জাবি পরে আসতেন।ওঁকে অবশ্য খুব বেশিদিন পাইনি, পরে অন্য কোথাও চলে গিয়েছিলেন।মনে পড়ে মৈত্রেয়ী দি আসতেন 
স্কুটার চালিয়ে,গায়ে থাকত সাদা অ্যাপ্রন,পড়াতেন জীবন বিজ্ঞান।উচ্চ মাধ্যমিকে অঙ্ক পড়াতেন পিনাকিদা,যাঁর জ্ঞান,যোগ্যতা কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসরের থেকে কম নয়,উনি পারমিউটেশন কম্বিনেশন পড়ানোর শুরু করেছিলেন ব্ল্যাক বোর্ডে কয়েকটি আপেল একে - রবীন্দ্রনাথ খুব আপেল খেতে ভালবাসতেন বলতে বলতে।এইরকম ছিল আমাদের পড়াশোনা।
                    যখন নবম শ্রেণী,শান্তিনিকেতন নিয়ে গিয়েছিল আমাদের ইস্কুল থেকে।আমাদের সঙ্গে গিয়েছিলেন সুমিত্রা নারায়ণ(শ্যাম বেনেগালের বোন),ওঁর মেয়ে বনিদি তখন শান্তিনিকেতনের হোস্টেল এ থাকত।মনে আছে,উনি মেয়ের জন্য কতরকমের শুকনো খাবার করে নিয়ে গিয়েছিলেন ।আমরা,মেয়েরা গিয়েছিলাম হোস্টেলে,আর মেয়েদের হোস্টেল 
বলে ছেলেরা প্রবেশাধিকার পায়নি,তাই ওরা বাইরে বেশি করে চপ খেয়ে নিয়েছিল, আর তার টাকা দিয়েছিলেন দিদিমনিরা।খুব ভাল লেগেছিল,সেই শান্তিনিকেতন প্রথম যাওয়া,তারপর সে হয়ে উঠল সব থেকে আপন।আমাদের এক বন্ধুর দাদুর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের চিঠির আদানপ্রদান ছিল,তাই ও সেই চিঠির ঘরে(উদয়ন এ)ঢুকতে পেরেছিল।আমরা স্কুল থেকে গিয়েছিলাম গুরুসদয় দত্তর ব্রতচারী মিউজিয়াম এ।আজ অবশ্য তার কাছাকাছি আমার বাস,যদিও মিউজিয়াম বন্ধ হয়ে গেছে।
                  পাঠভবনের আরেকটি বিশেষত্ব হল গরমের আর পূজোর ছুটির আগে সাহিত্য সভা।মনে পড়ে আমরা একাদশ শ্রেণীতে পড়ার সময় করেছিলাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ' ঘাটের কথা '
আরো ছোটবেলায় দাদার ধুতি পাঞ্জাবি পরে অমল ও দইওয়ালার দইওয়ালা হয়েছিলাম ।তাছাড়া কবিতা,নাটক,গান, পাঠ সবই হত।আমাদের বিদ্যালয়ে মাতৃ ভাষায় দক্ষতা অর্জনের উপর খুব গুরুত্ব দেওয়া হত ,মাতৃ ভাষায় দখল থাকলে অন্য ভাষাও আয়ত্বে আসবে,এইটি বিশ্বাস করা হত ।কথাটি ভীষণভাবে সত্যি, তা নিজের জীবন দিয়ে উপলব্ধি করেছি।টেক্সট বই পড়ে,নিজের ভাষায় লেখার উপর জোর দেওয়া হত ।ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত সব বিষয় পড়ানো হত ইংরেজিতে,তারপর  বিদ্যালয় থেকেই ঠিক করে দেওয়া হত কে বাংলা মাধ্যমে পড়বে,কে ইংরেজি মাধ্যমে।এখন অবশ্য পাঠভবনে  আর বাংলা মাধ্যম নেই। তবে কিছু বই ইংরেজিতে পড়ানো হত,যেমন ইতিহাসে রোমিলা থাপার।আমরা পেন ব্যবহার করেছি ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে,তার আগে পেন্সিল।প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই আঁকার উপরেও জোর দেওয়া হত ,কোনো লেখা লিখলে,তার সঙ্গে আঁকা আবশ্যিক।গরমের ছুটিতে বাড়ির কাজ ছিল-সেই ছুটিতে কি কি করেছি,বা কোথায় বেড়াতে গেছি সব লেখা ও আঁকায় খাতা ভরানো। ডায়েরি লেখা ছিল আবশ্যিক।মা বলতেন,কোনোদিন কোনো কবিতা বাড়িতে মুখস্ত করাতে আরেকটি বিশেষ উপকারী বিষয় ছিল হাতের লেখা,এবং শ্রুতিলিখন,যা অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত আমাদের করতে হয়েছিল।তার জন্য স্টার পাওয়া যেত।শিক্ষক শিক্ষিকারা বলতেন,উচ্চারণ শুনে বানান লিখতে, যে জন্য আজও কোনো অচেনা শব্দের(ইংরেজি,বা বাংলা)সঠিক বানান লিখতে পারি উচ্চারণ শুনে।লাইব্রেরি ক্লাসের কথা খুব মনে পড়ে। লাইব্রেরিয়ান বন্দনা মিস্ বলতেন যে , বইয়ের ধুলো ঝাড়ো, হয় তবেতো বই এর সঙ্গে বন্ধুতা হবে। ভৌতবিজ্ঞানের স্বনামধন্য শিক্ষক তীর্থঙ্কর দা,দীপঙ্কর দা ,রসায়নের সমীরদা,অংকের শঙ্কর দা ,ঈশিতা দি,শকুন্তলা দি সবার কথা খুব মনে পরে।মনে পড়ে ভামতিদির ফেয়ারওয়েলের দিন
শ্রমনা গুহঠাকুরতার গানের কথা।
          সত্যজিত রায়ের অনেক সিনেমাতে আমাদের বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের দেখা গেছে।যেমন সোনার কেল্লার কুশল,ফটিকচাঁদ এর রাজীব(আমার ক্লাস মেট),তোপসে অর্থাৎ সিদ্ধার্থ,ঘরে বাইরের শুটিং চলাকালীন আমাদের বন্ধুরা সব স্কুলবাসে করে ইন্দ্রপুরী স্টুডিওতে নামত। সত্যজিৎ রায়ের জন্মদিনের দিন তাঁর বয়সের সমপরিমাণ মোমবাতি পাঠানো হত ।শ্রদ্ধেয় অনুপ ঘোষালের বাবা ছিলেন আমাদের বিদ্যালয়ের করণিক । আমাদের স্কুলবাসের নটবরদা, অচিন্ত্য দা,বাবলুদা এঁদের দায়িত্ববোধের কথা না বললেই নয়।একবার হয়েছিল কি,স্কুল বাসের জন্য অপেক্ষা করছি, বাস আর আসেনা,হঠাৎ আমি দেখতে পেলাম নটবর দা একটা ট্যাক্সি নিয়ে এসে আমায় একটু দূর থেকে আমায় ইশারায় ডাকছেন।আমিতো ছুটে ট্যাক্সিতে উঠে গেছি।এদিকে মা খুব ভয় পেয়ে গেছেন, নটবরদার সারা মুখে ছিল বসন্তের দাগ,মা তো ওঁকে কোনোদিন দেখেননি,তাই ভেবেছিলেন যে,মেয়ে হারিয়ে গেছে।সে এক কাণ্ড হয়েছিল বটে।
                 এইভাবেই গতানুগতিকতার বাইরে গিয়ে এক অন্যরকম আবহে শিক্ষাপ্রাপ্ত হয়েছি।
মার খাওয়াতো দূরস্থান, বকাও সেভাবে খেয়েছি বলে মনে পরেনা, ভুলগুলি শুধরে দেওয়া হত খুব স্নেহমিশ্রিত শাসনের মধ্যে দিয়ে।চক্ষুদান মহান দান তা আমাদের শেখানো হয়েছিল,এবং বাড়ির সবাইকে বোঝাতে বলা হয়েছিল।পেন্সিল কল দিয়ে কেটে সেইটি স্কুলের মেঝেতে না ফেলে নির্দিষ্ট ডাস্টবিনে ফেলা,আশেপাশে নোংরা না করা,এইসব শিক্ষাও স্কুল থেকেই।আর একটি বিষয়ের উপর খুব জোর দেওয়া হত ,সেটি হল,সবসময় বইয়ের সঙ্গে খাতা,পেন,পেন্সিল বের করা।শিক্ষক শিক্ষিকারা যখন পড়াতেন তখন যাতে মনোযোগ বিক্ষিপ্ত না হয়, তারজন্য তাঁদের কিছু কিছু বলা নোট করে নেওয়া,এই রানিং নোটস নেওয়া আমায় পরবর্তীতে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে খুব সাহায্য করেছে।আমাদের শিক্ষক শিক্ষিকারা বলতেন সোজা হয়ে বসে পুরো মনোযোগ দিতে,মাইন্ড বডি কোঅর্ডিনেশনের উপর খুব জোর দিতেন।আরো বলতেন সামনে একটি ঘড়ি নিয়ে পড়তে বসতে,নিজে ধীরে ধীরে পড়ার জায়গায় একটানা বসে পড়ার সময় বাড়াতে।খুব উপকার হয়েছিল,প্রথমে হয়ত দশ মিনিট বসলেই মনে হত একটু উঠি,কিন্তু ধীরে ধীরে তা অনেকক্ষণ ধৈর্য্য ধরে বসে থাকতে সাহায্য করেছিল। কত যে বড় মানুষদের সংস্পর্শে এসেছিলাম,এখন বুঝি, যাঁরা অন্য অনেক লোভনীয় জায়গা ছেড়ে অল্প বা প্রায় বিনা পারিশ্রমিকে উমাদিদের ডাকে শুধু শিক্ষাদানের উদ্যেশ্যে এই বিদ্যালয়ে যোগদান করেছিলেন। আমি নিজের কর্মজগতে ছাত্রছাত্রীদের এইভাবে শেখানোর চেষ্টা করি।

No comments:

Post a Comment