ফিরে দেখা
সম্মিলিতা দত্ত
অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ- এর সংমিশ্রণে তৈরী একটি অধ্যায় হলো স্কুলজীবন। আর অতীতকে জীবন্ত করে এনে বর্তমানকে ভুলিয়ে দেওয়ার নামই হলো স্মৃতি।কমবেশি সবারই হয়তো জীবনের সবচেয়ে মধুর স্মৃতি স্কুলজীবনের সাথেই জড়িয়ে থাকে!
প্রাথমিক স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে যখন হাইস্কুলে প্রবেশ করলাম তখন আনন্দ যেমন হয়েছিল তার পাশাপাশি একটা ভয়ও কাজ করছিল। নতুন ক্লাস, নতুন বন্ধুবান্ধব , নতুন নতুন মাষ্টারমশাই, দিদিমণি-রা। কী জানি বাবা কেমন হবেন তারা! তারা কি আমার আগের স্কুলের প্রমোদ স্যারের মতো, যিনি পড়া না পারলে মাঠের মধ্যে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখতেন? আর তারপর সেখানে বসেই উনি আমাদের সকল পড়া কণ্ঠস্থ করাতেন। কিন্তু সেই বকাঝকার মধ্যে কোনো রাগ ছিল না, বরং ছিলো আমাদের প্রতি এক গভীর স্নেহ, যা আমি এখন বুঝতে পারি।
স্কুলের নাম শালকুমারহাট হাই স্কুল। আমাদের বাড়ি থেকে মাত্র দু'মিনিটের পথ। কিন্তু প্রথম দিন যখন সেই রাস্তা দিয়েই স্কুলের দিকে হাঁটছিলাম, মনে হচ্ছিল যেন যুদ্ধ জয় করতে যাচ্ছি। একটা চাপা উদ্বেগ কী জানি কী হয়! ক্লাসে গিয়ে ফাস্ট বেঞ্চের কোণায় গিয়ে চুপটি করে বসেছিলাম। আমাদের প্রথম ক্লাস নিতে এলেন দীপক স্যার ।দেখেই বোঝা যায় বেশ হাসিখুশি ও ভালোমানুষ তিনি। আমাদের তিনি অঙ্ক পড়াতেন। এছাড়াও ইংরেজি , বাংলার একজন দিদিমনি আর পরিবেশ বিজ্ঞানের জন্য আরো তিনজন মাষ্টারমশাই ছিলেন। প্রত্যেকেই ভীষন ভালো পড়াতেন আর খুব ভালোবাসতেন আমাদের। আমারও ভয় ধীরে ধীরে কেটে গেলো এবং আস্তে আস্তে অনেক বন্ধুবান্ধব হয়ে গেলো। টিফিনটাইমে ছোঁয়াছুঁয়ি, লুকোচুরি খেলা বেশ জমতো আমাদের। স্কুল ছুটি হওয়ার পরও আর ফিরতে ইচ্ছে করতো না বাড়িতে। অপেক্ষায় থাকতাম কালকের দিনটা কখন আসবে! দিন যেন ফুরোতেই চায় না।
একবারের ঘটনা বেশ মনে পড়ে। আমি তখন পড়ি ষষ্ঠ শ্রেণীতে। আমাদের স্কুলে অফিস রুমের সামনে একটা মুক্ত মঞ্চ ছিল। যেখানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পালন করা হতো। যদিও সেটা আমাদের কবাডি খেলার জন্যই বেশি ব্যবহৃত হতো। একদিন সেরকমই খেলছিলাম। প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়ের হাত থেকে বাঁচতে গিয়ে আমার পিছনে থাকা এক বান্ধবী একটুর জন্য নীচে পড়তে পড়তে ওই মুহূর্তে আমাকে ধরে ফেলে এবং আমিও ওর সাথে নীচে পড়ে যাই। যেহেতু মুক্ত মঞ্চটা অনেকটাই উঁচু ছিল, আমার মনে হয়েছিল আমি যেন বাতাসে ভেসে ভেসে কোথাও গিয়ে পড়ছি। যদিও পরে সেই মেয়েটি স্বীকার করেছিল, সে ইচ্ছে করেই অমন করেছিল। "আমি পড়বো তাহলে তুই পড়বি না কেন? খেলবোও একসাথে আর পড়বো তো তোকে নিয়েই পড়বো।" এই ছিলো তার বক্তব্য।
আমাদের সংস্কৃত পড়াতেন বিউটি দিদিমনি। তিনি পড়ানোর সময় সবসময় আমার দিকে নজর রাখতেন। কারণ আমি প্রচুর গল্প করতাম ক্লাসে বসে। তিনি সেটা খুব ভালো জানতেন। আর সেজন্য তিনি আমার নামই রেখে দিয়েছিলেন 'গল্প '। ক্লাসে এসে বলতেন ' এই যে গল্প আর কত গল্প করবি !' এছাড়াও কথায় কথায় হাসতাম বলে আমার আরেকটা নাম ছিল "হাসুরি"।
সেসময় একটা চল ছিলো শিক্ষক- শিক্ষিকাদের মজার মজার নাম দেওয়া। তাই শুধুমাত্র তিনিই নন, আমাদের ইতিহাস যিনি পড়াতেন অর্থাৎ দীপক দাস স্যার, ওনার নামও আমরা দিয়েছিলাম রাগী স্যার(কারণ তাকে প্রথমবার দেখে মনে হয়েছিল উনি ভীষন রাগী), এছাড়া প্রণয় স্যারের নাম লাঠি স্যার( হাতে তার সবসময় লাঠি থাকতো) ইত্যাদি ইত্যাদি।
প্রণয় স্যারের ক্লাসে বসে আমি গান্ধীজির ছবি আঁকতাম আর কল্পনা করতাম লাঠি হাতে স্যার এবং লাঠি হাতে গান্ধীজি-কে। দুজনে লাঠি নিয়ে একে অপরের সাথে যুদ্ধ করছেন। ওনারা এই কথা পরে অবশ্য জানতে পেরেছিলেন কিনা জানি না, কিন্তু জেনে থাকলেও তার কোনো প্রতিক্রিয়া আমাদের দেখাননি।
পঞ্চম শ্রেণী থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত সত্যি বলতে আমার সেরকম কোনো বন্ধুবান্ধব ছিলো না। যারা ছিলো তারা ছিলো নামমাত্র বন্ধু। আমরা যেমন ইউজ অ্যান্ড থ্রো বলপেন ব্যবহারের পর সেগুলো ডাস্টবিনে ফেলে দেই, তারাও সেরকম প্রয়োজনে আমাকে ব্যবহার করতো। কিন্তু তবুও আমি কীসের এক অমোঘ টানে একদিনও স্কুল বাদ দিতে চাইতাম না। সে যতই রোদ - ঝড়-বৃষ্টি যাই থাকুক না কেন! বাড়ি থেকে যেতে না দিলে কান্নাকাটি করতাম। এখন মনে হয় যে আমি ঠিক কাজই করতাম। নাহলে হয়তো স্কুলজীবনের কিছু সুন্দর মুহূর্ত আমার উপভোগ করা হয়ে উঠতো না।
অষ্টম শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষার ফলপ্রকাশের পর এক বিশেষ কারণে আমার সাথে আমার চারজন বান্ধবীর ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। অবশেষে আমি আরো নতুন বন্ধু পেয়ে যাই। তাদের সাথে টিফিন ভাগ করে খাওয়া, টিফিনটাইমে হাইবেঞ্চে বসে গানের লড়াই এইসব চলতো। আমার ভূগোল পড়তে ভালো লাগতো না বলে ওরাও ভূগোল ক্লাস বাদ দিয়ে আমার সাথে মাঠে বসে ভূতের গল্প শুনতো আমার কাছ থেকে।
এছাড়াও আমি ওদের বিনাপয়সায় স্পোকেন ইংলিশ এর তালিম দিতাম। ওরাই ছিলো আমার প্রথম ছাত্রী ।ওদের আমি নিজের সাধ্যের বাইরে শেখানোর চেষ্টা করতাম (যেহেতু নিজেই তখনও ধরাকে সরা জ্ঞান করি)।ওরা সেটাতেই অবাক হয়ে যেতো। আমার নাম ছিলো ' ব্রিটিশ'।
নবম শ্রেণীতে পড়াকালীন করোনা মহামারির জেরে স্কুল কলেজ অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। পরিস্থিতি কিছুটা ঠিকঠাক হওয়ার পর যখন বিদ্যালয় পুনরায় চালু হয়, ততদিনে আমি দশম শ্রেণীতে উঠে গেছি। আমাদের অঙ্ক করাতেন সুমন্ত দেবনাথ স্যার। তিনি আমার উপরে কড়া নজর রাখতেন বলে আমি তার চোখ এড়িয়ে লাস্ট বেঞ্চে গিয়ে বসে থাকতাম। আমি তার ক্লাসে ভালো অঙ্ক পারতাম বলে উনি আমাকে ডাকতেন ' অঙ্কের ভাগ্যবতী' বলে।
মাত্র দুইমাস ক্লাস করার পর আবার সব বন্ধের নির্দেশ। বাড়িতে বসে বসে খালি দিন গুনতাম কবে আবার সবকিছু ঠিক হবে, বন্ধুদের সাথে দেখা হবে। এভাবে দেখতে দেখতে চলে এলো টেস্ট, তারপর মাধ্যমিক। পরীক্ষার পর আমি বিজ্ঞান বিভাগে পড়ার জন্য চলে গেলাম অন্য স্কুলে। এরপর যতদিন ঐ স্কুলে ছিলাম এমন কোনো দিন ছিলো না যখন আমার আগের বিদ্যালয়ের কথা মনে পড়েনি। উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে বিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরও মনে হয়েছিল, আরেকবার যদি সেই ছোট্টবেলাকার সম্মিলিতা হয়ে যেতে পারতাম! তাহলে হয়তো আর কোনোদিন বড়ো হয়ে যাওয়ার কথা ভাবতামই না। স্কুলের পরীক্ষা অনেক অনেক ভালো ছিলো, কারণ জীবনের পরীক্ষায় তো কলমই ছোঁয়ানো যায় না। স্কুলজীবনের মতোই কি আস্তে আস্তে জীবনের বাকি অধ্যায়গুলোও একদিন শেষ হয়ে যাবে এইভাবে?
স্কুলবাড়ির সামনে দিয়ে গেলে এখনও দেখতে পাই ইউনিফর্ম পড়া ছোটো আমি-কে। যে কিনা সুর করে বলে চলেছে,
"ওপেনটি বায়স্কোপ
রায়টেনে টেলেস্কোপ
চুলটানা বিরিয়ানা
সাহেববাবুর বৈঠকখানা।"
তমাল গাছের ছায়ায় পড়ে থাকা শুকনো পাতাগুলোও যেন বলে ওঠে,
"বন্ধু চল রোদ্দুরে
মন কেমন মাঠজুড়ে
খেলবো আজ এই ঘাসে
তোর টিমে তোর পাশে।"
No comments:
Post a Comment