Monday, December 4, 2017






এই সংখ্যাকে লেখা ও ছবিতে সাজিয়েছেন যাঁরা-
শ্যামলী সেনগুপ্ত, মীরা সরকার, সুদীপ মজুমদার, শৌভিক রায়, কুমকুম ঘোষ, দেবপ্রিয়া সরকার,সম্পা দত্ত  প্রতিভা দে,  শিবু মন্ডল,শর্মিষ্ঠা রায়চৌধুরী, দেবযানী সিনহা, অনিমেষ সরকার, দেবাশিস ঘোষ, দীপশিখা চক্রবর্তী, জয় চক্রবর্তী, বেদান্ত দত্ত

সম্পাদনা ও অলঙ্করণ- শৌভিক রায়



সম্পাদকের কথা

শিরশিরে হাওয়ায় উসখুসে রোদ। ত্বকে টান। টান মনেও। এই সময়টা এলেই মন উচাটন। ডাকে চারদিক। রুক্ষ পৃথিবীর রূপটা সতেজ মনে হয়তো আনে এমন কোন ঝঙ্কার যা তার সঞ্চয় আজীবন। আমরা দেখি তাই। চলে যাই দেখতে ডাক শুনে অহর্নিশ। 
তবু আশা ছিল আরও লেখায় সেজে উঠবে ভ্রমণ সংখ্যা। তবে কি ধরে নেবো আমরা ভ্রমণবিমুখ হয়ে উঠেছি? নাকি দেখছি, বলছি না বা বলতে পারছি না! আসলে দেখতে গেলে জানতে হয়, জানতে গেলে পড়তে হয়, রাখতে হয় খোঁজ। হয়তো সবাই সেটা পারেন না। ট্যুরিস্ট তো হওয়াই যায়! ট্র্যাভেলার আর ক'জন হ'তে পারে। 
নতুন ক'রে এই শীতারম্ভে মুজনাই দিচ্ছে কিছু হদিশ, কিছু অভিজ্ঞতা। মুজনাই তো বয়েই চলে। তার ভ্রমণ তো জীবনব্যাপী। 
তাই....চরৈবতি।





ভরা থাক স্মৃতিসুধায়

নীলকন্ঠ অন্তহীন 
     মীরাসরকার 

নীল দিগন্তের হাতছানি যদি কেউ এড়াতে না পারে তো সে কি করে? বেরিয়ে পড়ে ঘরের কোণটি ছেড়ে । নিজেকে চলো চলো থেমো না। থেমে গেলে কি? থেমে গেলে মৃত্যু জেনো। ওই দ্যাখো সামনে বিছানো  বিস্তীর্ণ জীবনের পথ।পথ ডাকে 'আয় আয়'।
    তাইতো পথ যে চলার জন্যে ।ওকে অবহেলা করলে ঘাসের বন,ঝরাপাতা, মরাধূলোর আস্তরে ঢেকে যাবে অভিমানীর মত।যে পারে এড়াতে সে অন্য মানুষ।সংসারী বটে।বাজারের থলে,কলা , মূলো,ডি.এ,বাসভাড়া,ছেলের পড়া,মেয়ের খেলা,গৃহিনীর সুখ অসুখ সব মিলিয়ে তার চব্বিশ ঘন্টার দিনে কুলোয় না।বড় বড় ঝরা শালপাতায় মোড়া বনপথের নিশির ডাক তার কানে মোটে পৌঁছয় না।
    আর একদল আছে পথ যে তাদের উপভোগের উপকরণ।ট্রেনের টিকিট, প্লেনের ভাড়া, হোটেলের বাথরুম, বিছানা ইত্যাদি  এই আলোচনায় মগ্ন।পথের কথা পথেই পড়ে রয়।
      ভ্রমণে পথ ই তো সঙ্গী।আবার তবে বন্ধু খোঁজা কেন? নিজের জীবনের নিত্য চলন, অভ্যাস, যাপন সব নিয়ে যে সন্নিবিষ্ট ভ্রমণ তাতে কি মন ভরে না?
    আমার চলা সর্বক্ষণের চলা। চলতেই থাকি মনে মনে।চলি আর ঝুলিতে ভরি সঞ্চয়ের স্মারক । যত্নে রাখি উপল খন্ড অমূল্য রত্নের মত। হাজার লোকের মাঝেও আমি কখনো একা হয়ে যাই। এটাই আমার জীবন।
       সম্মুখে নীলকন্ঠ, পঞ্চচুল্লীর উত্তুঙ্গ শিখর থেকে রোদের গন্ধ মুছে গেছে। বসে আছি কৌশানির একটি হোটেলের নির্জন বারান্দায়।ধীরে ধীরে সারা পাহাড় বন অন্ধকারে ঢেকে যায়।পাতলা সাদা কুয়াশার চাদরে শরীর মুড়ে বনভূমি পাশ ফিরে শোয় বুঝি। এক দুই তিন করে যেমন আকাশে তারা ফোটে,দূর পাহাড়তলির শহরে ,রাস্তায় তেমনি জ্বলে ওঠে করুন আলোকবিন্দু।ঝিকমিক করে ওঠে রাতের জীবন। ভাসন্ত মেঘ ঢেকে রাখে শান্ত পাহাড়ের একান্ত নিভৃতি
      আমি উপান্তে বসে থাকি ব্রাত্যের মত। পঞ্চচুল্লী,নীলকণ্ঠ মাথাতুলে আহত অভিমানে চুপ করে থাকে। মনে ভাবি আমারি জন্য কতকাল অপেক্ষা করে আছে ঐ নীলাদ্রি । নীলকন্ঠ শিব। একটু অহংকার হয়।কেউতো জানে না তার সমুদয় প্রতীক্ষা শুধু আমার জন্য । আমি চেয়ে থাকব অপলক আর সে মলিন চাঁদের আলোয় একটু একটু করে ফুটে উঠবে দিগন্তের  আকাশে । তার করুন দুচোখে হাজার কোটি বছরের চাওয়া । 
       অন্ধকার বনের চিহ্ন মুছে দেয়।টিমটিমে আলোয় বহমান পাহাড়িয়াদের জীবন।সন্ধ্যা ঘন হবার আগেই নেমে আসে গভীর রাত । কুয়াশায় ভিজে ভারী হয়ে যায় তাদের কুকুরের বিশ্বস্ত ডাক।ঘুমিয়ে পড়ে চরাচর । জেগে আছি আমি আর নীলকন্ঠ । পৃথিবীর গভীর  থেকে ঝিল্লির কনসার্টে র একটানা সুর উঠে আসে। রাতচরা মথ আমার মুখের কাছে চশমার উপর খেলা করে। ঘুম এসে যায়। দোষ কি?চেয়ারে আরাম, মোটা কম্বল সঙ্গে ভাবনা ছিল কাল এই অনুভাবন তো থাকবে না।
      পঞ্জরে এসে খোঁচা দেয় শীত। 'বেশ তো ঘুমোতে চাইলে ঘরে গিয়ে  আরাম করো । সেঁধোও কম্বলের নীচে । এখানে এই ভড়ং কেন?'
     চোখ জ্বলে যায়।তোমার রূপ কত। কোথায় তুমি নেই!কৈলাসে, মানসে,কল্পায়,কেদারনাথে ও অমরনাথে। উত্তুঙ্গ শিখর । তুমি অজেয়,তুমি স্বপ্নিল, অর্ধনিমীলিত নয়ন। আমার অনন্ত চাওয়া যে তোমার কাছে তুমি তা জানো হে অন্তহীন।আমার সব চাওয়া সব প্রতীক্ষা  তোমাকে নিবেদন করলাম প্রিয়। আমি উপাচারের পূজায় বিশ্বাসী নই বটে তোমাকে  অস্বীকার করব সাধ্য কী। কেন এক জীবনে এতকিছু চাই । চাওয়ার যে শেষ নেই। ক্ষমা করো হে নটরাজ ।
    চোখ জ্বালা করে তবু ভাবি 'যদি তোমার দেখা না পাই প্রভূ এবার এ জীবনে-।'
     হঠাৎ ওই অন্ধকারের নিশ্ছিদ্র পাঁচিলে একটি সিন্দুরবিন্দু কে যেন এঁকে দেয় সকৌতুকে।ব্যগ্র চোখের সামনে একটু একটু করে প্রতিভাত হয় সেই লাল বিন্দু র আয়তন। একটু পুবে ,একটু উপরে, আরো  উপরে লালের আভা ছড়ায়।হাসতে হাসতে কে যেন রং ছিটিয়ে একটি একটি করে শৃঙ্গ রচনা করে। সারা আকাশ  চেয়ে থাকে। ঠোঁটে  মুখে চোখে হাসি ছড়িয়ে  পড়ে । কৌতুক ভরে দেখাও তুমি আমাকে । 'তাই তোমার আনন্দ  আমার পর' । আমি র বুভুক্ষুর মত,তৃষ্ণার্তের মত চেয়ে থাকি ।এই একান্তে তোমাকে পাবার জন্যই তো এখানে আসা।হিমেল হাওয়া গাছ গাছালির ফাঁকে উঠে আসে উপত্যকা জুড়ে । সারা পাহাড় জুড়ে তোমার অঢেল রৃপের বন্যা ।লাল কমলা রঙের হোলি।রঙের অট্টহাসি ।
    'একি তুমি একা একা  দেখছ সূর্যোদয় ।আমাদের ডাকোনি কেন?' আছড়ে পড়ে জনসমুদ্রের ঢেউ। আবার ভীড়ের মধ্যে মিশে যাই। পেছনে চেয়ে দেখি তুমি অভিমানের মেঘমালায় নিজেকে ঢেকে ফেলেছো। বিষন্নতাকে লুকিয়ে  ভাবি আবার কি দেখা হবে? কখনো?
    তুমি তো এখানেই থাকবে।আমি!আমি যে-আমার ঘরের চাবি ভেঙে কে নিয়ে যাবে আমাকে? তোমার কাছে?



এক উজানি সফর
শ্যামলী সেনগুপ্ত

 ফিরে যাচ্ছি শিকড়ের কাছে।ভুলেছিলাম যাকে বহু বহু দিন, ৩৭ বছর পরে ফিরে যাওয়া তার ছায়া-মায়া আলোবেলা টুকু কুড়িয়ে নিতে।তার আঁচল বিছানো পথ ধরে এগিয়ে চলেছে আমাদের wagnor.ভোরবেলার সাথে আমাদেরও যাত্রা শুরু ভূবনেশ্বর থেকে।কবে যেন আমার সন্তানের মঙ্গল কামনায় এক জাগ্রত দেবীর কাছে মুষ্টিভিক্ষা করেছিলাম--দেবী তাঁরিণী আমার ঝুলি ভরে দিলেন অথচ কৃতজ্ঞতা জানাতে গড়িয়ে গেল বছরের পর বছর।তাই বেরিয়ে পড়া।শরৎ প্রভাত ক্রমশ তীক্ষ্ণ হচ্ছে।আমরা থামলাম।চা।আহা!কতদিন পর আমার জন্মভূমি চায়ের গেলাস নিয়ে হাসিমুখে।সারি সারি চা-গুমটি।সব গুমটির সামনে একটা অতিরিক্ত টেবিল।তারওপর জড়ো করে রাখা নারকেল লাল কাপড় দিয়ে বাঁধা।জানিতো---তবুও আরেকবার জানতে চাই।দূর-দূরান্ত থেকে দেবী তাঁরিণীর উদ্দ্যেশে আসে নারকেল।কেওনঝর  বড়বিল কিরিবুরু এমনকি রাউরকেলাগামী সমস্ত বাসের চালকগণ সেইসব নারকেল সংগ্রহ করে পৌঁছেদেন মায়ের মন্দিরে।ঘটগাঁ তে থামবেই থামবে সব বাস।সহ-পরিচালকরা নারকেল নিয়ে নেমে যাবেন মন্দির প্রাঙ্গনে। সেখানে না থেমে এক চাকাও এগোবে না বাস।এসব তো জড়িয়েআছে আমার হাড়-মাংসে   এসব তো শোণিতের মতো প্রবাহিত আমার রক্তধারায়  এসব তো প্রোথিত আমার প্লেটলেটসে।চলছি।থামতে হচ্ছে টোলট্যাক্সের জন্য।অপার মুগ্ধতায় তাকিয়ে আছি আমার চেনা পথের দু'ধারে। ঘাসজমি  ফসলেরক্ষেত  বাড়িঘর-দোকানপাট   ধূধূ ভূমি   কলাবাগান  গোরুর পাল   সবপেরিয়ে ছুটছে সময়।সহযাত্রী-চালকের সঙ্গে ঝালিয়ে নিচ্ছি স্মৃতি।
             ঐ তো !!!ঐ তো আনন্দপুর।
             আমার কৈশোর   আমার তারুণ্য আমার প্রথম ও একমাত্র প্রেম সব মিলেমিশে আছে এইখানে।ডানপাশে বৈতরণী কে নিয়ে খানিক্ষণ এগিয়ে চলা।আসছি রে আসছি।ফেরার সময় । বলতে বলতে ২১৫ নং জাতীয় সড়ক ধরে এগিয়ে যাচ্ছি।
              ঘটগাঁ। সামনে মন্দিরের স্বাগতম তোরণ।সেখান দিয়ে চোখ মেলতেই দেখি বিশাল প্রাঙ্গণ।শ্বেত পাথরের সিঁড়ি।ভেতরে সুদৃশ্য দোকানপাট।নারকেল লাল ও জরিবোনা কাপড় ধূপ গুগ্গুল আরোআরোউপকরণ।বাইরেও সারি সারি  দোকান।টিকিট কেটে অর্ঘ্য সাজিয়ে দেবীর কাছে এলাম।দেবীর চারিপাশে কোনো দেওয়াল নেই।মাথার ওপরে দারুণ চাঁদোয়া।কোন ঘর নয়, দেবীর স্থান গণদেবতার মাঝে।সেইই কোন অনভিজ্ঞবেলা থেকে জেনে এসেছি যতবার দেওয়াল গড়া হয়েছে ততোবার ভেঙে পড়েছে। প্রদক্ষিণ পথটি বড়ো সুন্দর।আরো দেব-দেবীর মূর্তি  ছোটবড়ো ঘন্টা   আর তার বাইরে অপূর্ব বৃক্ষমেলা।মনভরেগেলো।অনাবিল বাতাস থেকে একবুক শ্বাস নিয়ে বেরিয়ে আসি।প্রিয় বিরিবড়া আর চাটনীর স্বাদ নিয়ে ক্ষীরমোহন এর টুকরোটি জিভের উপর রাখতে রাখতে ভাবি বৃথাই মিষ্টি নিয়ে এতো তর্কবিতর্ক!
             চালক সখা বলেওঠে --পাঁচকিলোমিটার দূরে একটা ফলস আছে।আবার হৈহৈ।এগিয়ে যাচ্ছি।বাঁক নিচ্ছি ।অনেক দূরে টিলার মতো কালোপাথরের পাহাড়। বাঃ!ভারি সুন্দর রাস্তা তো।ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া র তত্ত্বাবধানে তৈরি এই রাস্তা প্রায় কাঁধের কাছে পৌঁছেদিলো।পাহাড় ডেকেনিলো তার নিজস্ব ধ্বনিতে--কলকল কলকল।আঃ!
              ঐ তো ঝরণা! উদ্দাম উচ্ছল পাহাড়ি কিশোরী যেন।দলবেঁধে শুধু হৈহৈ।ধাপে পা ফেলে নেমেযাই।অনেক উঁচু থেকে লাফিয়ে পড়ছে জলধারা।গভীরনীল প্রজাপতির পাখায় পাখায় তৈরি হচ্ছে ইন্দ্রধনু।তবে এমন চঞ্চল তারা একটাও আমার ফোন-ক্যামেরায় ধরা দিলো না।পা ভিজিয়ে মনভিজিয়ে আবার শকটারোহণ।
              ফেরা।তবে এই ফেরাতেও যে জড়িয়ে আছে আনন্দ!
              এইপথেই তো পৌঁছেগেলাম ঝড়েশ্বর উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকার দপ্তরে।জড়িয়ে ধরলো মিনাক্ষী।কত্তদিন পরে!!
               ৩৭ বছর!বিশাল হলের একদিকে হেডমিস্ট্রেস আর অন্য প্রান্তে টিচার্স কমন টেবল।সকলে এক শাড়ি।হাল্কা পিঙ্ক জমিনে গভীর মেরুণ পাড়।মিনাক্ষীকে দেখে বলতে গেছিলাম--একটু ভালো শাড়ি তো- - - 
চোখ দেখলো সকলেই তাই।চুপ করে গেলাম।আন্তরিকতার চা-বিস্কুট শেষে উঠেপড়ি।স্কুলের ঘন্টা জানিয়ে দেয় পরের ক্লাসে যেতেহবে।মিনাক্ষী গেট পর্যন্ত পৌঁছেদিয়ে আর দাঁড়ায় না।একাদশ ইংরেজী অপেক্ষায়।
চালকসখা আমার প্রশ্নের উত্তরে জানায় সারা ওড়িষায় টিচারদের একই পোষাক।বাইরের যে কেউ দেখলে বুঝতে পারবে --ইনি স্কুলটিচার।আরো তত্ত্ব ও তথ্য শুনতে শুনতে পৌঁছেযাই আমার স্কুলে।সবাই নতুন।স্কুলটিও নতুনতর।সামনের দিকে পাঁচিলের দুই কোণ ঘেঁসে দাঁড়িয়ে থাকা প্রপিতামহ নিমগাছদুটি নেই।যাদের আমরা ডাকতাম ' অজা-আই ' বলে।যাদের পাতা দিয়ে আমরা একদিন স্কুলের সাদা দেওয়াল জুড়ে আল্পনা দিতাম সরস্বতীপুজো  গণেশপুজোর সময়।স্কুলের সামনেই পোস্টঅফিস।সেখান থেকে তুঁতেরআঠা আসতো।
               বাবা এখানেই এই ঘরে বসতেন।রোগীর ভিড়।সামনে বড়দান্ড।এখানে রথ টানাহতো।আজও হয়।পাশেই মন্দির।বিরাট মন্দিরের সিঁড়িতে বসে একসময় আমাদের কত গল্প ছিলো।বড়ো ইচ্ছে করছিলো তাদের সকলকে একসাথে পেতে।পাশেই আমরা থাকতাম।যা---দেখেআয়--ঘরটা।
  নাঃ!কি হবে আর।সখা বলে দু'বছর আগে আমি দেখেগেছি।সেই জানলার সামনে অনেক্ষণ দাঁড়িয়েছিলাম  যেখানে একদিন আমরা herburium এর bookতৈরি করেছিলাম।
             দাঁড়িয়ে থাকি বটানি ডিপার্টমেন্টের সামনে।আমাদের ছোট্ট বটানিকাল গার্ডেন।সাদা-কালো ছবিরা চোখের সামনে রোল করে।চোখের কোল ভিজেওঠে।ভাগ্যিস সখা স্টিয়ারিংএ বিশ্রাম নিচ্ছে!নয়তো ৭৭/৭৮ আবার ধরাপড়েযেতো।ঘুরতে ঘুরতে দেখি সব ছাত্রছাত্রী একই রঙের পোষাকে।আরে! তাইইতো।মেয়েদের সালোয়ার-কামিজ-ওড়না  আর ছেলেদের শার্ট-প্যান্ট  ডার্ক গ্রে আর পিঙ্ক কম্বিনেশন।ভালোলাগায় বুক ভরিয়ে সিটবেল্ট বাঁধি।আমার চিৎ-সাঁতারের বৈতরণী   আমার ডুব-সাঁতারের পুণ্যতোয়া  আমার জলখেলার স্রোতস্বিনীটিও কি একটু বুড়িয়ে গেছে!পাকা ব্রিজ ধরে এগোই আর দেখি শরবন উদ্বাস্তু-আবাস বসিয়েছে।আমার চোখের জল মুছিয়ে সখা স্টিয়ারিং এ হাত রাখে।

            আমরা ফিরছি- - - 



ভারত আমার ভারতবর্ষ...
Zero Point……….গোমুখ
                                                                    
   সুদীপ মজুমদার                                                                                             

১৯৮৪ সালে ২৩ বছর বয়সে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের Biochemistry Dept.থেকে গোমুখ গিয়েছিলাম সে কথাই এতদিন পরে......।
শঙ্কু মহারাজের  ‘বিগলিত করুণা জাহ্নবী যমুনা’ যারা পড়েছেন বা যারা পড়েননি সকলেই আশাকরি জানেন যে যমুনেত্রী গঙ্গোত্রী গোমুখের পথ ভারতের ভয়ংকরতম,দীর্ঘতম,ও সুন্দরতম তীর্থপথতবে স্নাতকোত্তর পর্যায়ের ১৪ জন ছেলে Educational Tour হিসেবে তীর্থে যাইনি ,গিয়েছিলাম হিমালয়ের আকর্ষনে যার শুরু একবছর আগে সান্দাকফু ট্রেকিং এর পর থেকে।আমাদের সঙ্গে গিয়েছিলেন আমাদের Sir কৃশানুদা ও Sr.Research Scholar সুব্রতদা।
হাওড়া-দেরাদুন পূজো স্পেশালে আমাদের প্রথম গন্তব্য হরিদ্বার। নাম থেকেই জায়গাটা সম্পর্কে একটা ধারনা হয়। কুমায়ুন হিমালয়ের দরজা যেমন কাঠগোদাম তেমনই গাড়োয়াল হিমালয়ের দরজা হল হরিদ্বার।গঙ্গোত্রী,যমুনেত্রী,ঋষিকেশ,কেদারনাথ,বদ্রীনাথ,দেরাদুন,মুসৌরী যেখানেই যান হরিদ্বার হয়ে যেতে হবে,তাই এখানকার একটা আলাদা গুরুত্ব আছে। এখানে প্রধান আকর্ষণ গঙ্গা, কোলকাতার গঙ্গার সাথে যার কোনো মিল নেই।
যাত্রা হবে শুরু

হরিদ্বার থেকে এক ঘন্টার বাস পথে এলাম ঋষিকেশ।কেউ বলেন-ঋষিদের দেশ ঋষিকেশ আাবার কেউ বলেন ‘ঋষিক’ মানে ইন্দ্রিয়।ইন্দ্রিয় দমন করা যায় যেখানে-ঋষিকেশ।মানে যাই হোক লছমনঝুলার ঝুলন্ত ব্রীজের ওপর থেকে শ্রবণেন্দ্রিয় দমন করা সত্যিই কষ্টকর ছিল।নীচে, অনেক নীচে স্রোতস্বিনী গঙ্গা আপন খেয়ালে বয়ে চলেছে  পরে সেই স্রোতের শব্দ আমরা বহুবার পাই উত্তরকাশীতে,গঙ্গোত্রী ও গোমুখের সমস্ত পথে।তবে প্রথম এই শব্দের যে অনুভূতি এখানে হয়েছিল তা লিখে বোঝাতে আমি অক্ষম। সেই সফরে আমাদের বন্ধুদের প্রায় সবারই বিশেষ নামকরন হয়েছিল।যেমন অসীম, চাঁদের আলোয় অপূর্ব লছমনঝুলার সৌন্দর্যে আনন্দে ব্রীজের ওপড় শুয়ে পড়েছিল। এক বাঙালী Tourist উৎকন্ঠা নিয়ে কী হয়েছে জানতে চাওয়ায় ও বলেছিল Beauty Stroke. ব্যাস অসীমের নাম হয়ে গেল আঁতু (আঁতেল থেকে)৷যুগল ছিল বেশ দায়িত্বশীল ছেলে।ট্রেন থেকেই দেখছিলাম ও সবার মালপত্রের খেয়াল রাখছে,প্রয়োজনে আমাদের ব্যাগও গুছিয়ে দিচ্ছে,বেচারার নাম হয়ে গেল কাকাবাবু, যা শুনলে ও আবার বেশ রেগে যেত। একবার কৃশানুদার সামনেই শুভংকর ওকে কাকাবাবু বলায় ও বলেছিল-“তোমার বাবাকে কাকাবাবু বলগে প্রত্যেক Limit এর একটা সীমা আছে”,আামাদের সঙ্গে কৃশানুদাও হাসিতে যোগ দিয়েছিলেন।আজও দেশে, কেউ কেউ বিদেশে উচ্চপ্রতিষ্ঠিত বন্ধুরা সেই সব নামেই পরিচিত।
               উত্তরকাশী ৷ঋষিকেশ থেকে বাসে সাত ঘন্টার পথ৷ পথের বর্ণনা দিচ্ছিনা কারন সামনে বর্ণনা করার মতো অনেক পথ পড়ে আছে৷ চারদিকে উচু পাহাড়ে ঘেরা অপূর্ব সুন্দর ছোট্টো জেলা শহর এই উত্তরকাশী। গঙ্গা এখানে উত্তরমুখী।

                                                                          শিবলিং শৃঙ্গ
                                                                      
                     
গঙ্গোত্রী এসে উত্তরে ভগীরথ শৃঙ্গ দেখেই মুগ্ধ হয়ে গেলাম। ওখান থেকেই নেমে এসেছে গঙ্গাপ্রানোণমত্তা, পূণ্যসলিলা। মসৃন চওড়া দুটি পাথরের প্রাচীর, মাঝখানে অনেক নীচ দিয়ে প্রচন্ড বেগে বয়ে যাচ্ছে ভারতের পূণ্য প্রবাহ। প্রধান আকর্ষন গঙ্গোত্রীর মন্দির। গোমুখের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। মন্দিরের সিঁড়ি, দেয়াল, প্রতিমা বলতে গেলে সব কিছুই পাথরের। তবে পাথর মাত্রই প্রাণহীন, এখানে তা মনে হয় না। মন্দির দর্শন করেই গঙ্গাস্নান। জল এত ঠান্ডা্ যে ডুব দিয়ে ওঠার পরে মনে হচ্ছিল গায়ে কেউ আগুন দিয়ে দিয়েছে। অল্প পরেই অবশ্য একটা ক্লান্তি দুরকরা আমেজ। কৃশানুদার পুজো দেবার ইচ্ছেকে অমান্য করে গোমুখের টানে সকলে কাঁধে রুকস্যাক ও হাতে লাঠি নিয়ে আমরা এক ভয়ংকর সুন্দর পথে পা বাড়ালাম। আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু ও অনেক উৎসাহ নিয়ে একদিন এ পথে এসেছিলেন। তখন ঋষিকেশ থেকেই হাঁটতে হতো, এখন গঙ্গোত্রী পর্যন্ত বাস চলছে। সেই মহাপ্রস্হানের পথ আর নেই


                                                                            গঙ্গোত্রীর মন্দির


কোনদিন হয়তো দেখবো গোমুখেও গাড়ী চলছে মানে যে কোনদিন ঐ পথের ও মহাপ্রস্হান হয়ে যেতে পারে। এটাকে অবশ্য পথ বলা যায় কিনা জানিনা, বেশীরভাগ জায়গাতেই দু থেকে আড়াই ফুট চওড়া। একদিকে উুঁচু পাথরের দেয়াল,মাঝে মাঝে সেখান থেকে উচ্ছ্বল ঝর্ণা নেমে পথ ভিজিয়ে আর একদিকের গভীর খাদে পড়ছে। সেই খাদের পাশদিয়ে বয়ে চলেছে গঙ্গা, যার রুদ্ধ গর্জন কানে আসছে। দু তিন জন করে একসাথে হাটছি।কৃশানুদা চেয়েছিলেন সকলে একসঙ্গে হাটি যদিও হিমালয়ে তা হয়না। এখানে সবাই একা, হিমালয় সবার। পঞ্চপান্ডবও একসাথে হেঁটে যেতে পারেনি। পথে চিরবাসা থেকে বন্দরভূজ শৃঙ্গ দেখার মুগ্ধতা নিয়ে এক সময় ভোজবাসায় পৌছালাম। লালবাবার আশ্রম। বিনা পয়সায় শুধু চা রুটি গরমজলই নয়,সঙ্গে যে আতিথেয়তা পেয়েছিলাম তাতে এই লালবাবারা ভগবানের সেবক না স্বয়ং ভগবান তা ঐ বয়সে ঠিক বুঝতে পারিনি। এরপর ধীরে ধীরে আমরা সাদার রাজ্যে প্রবেশ করলাম। এখানে সাদা ছাড়া আর কোনো রং নেই। পাহাড় থেকে কাঁটাগাছ সবই সাদা। কাছের পাহাড়ের মাথায় সাদার ওপর সোনালীর ছড়াছড়ি। রঙীন শুধু আমাদের মন, গোমুখ যত কাছে আসছে তত আরো রঙীন হচ্ছে।


                                                                            ভগীরথ শৃঙ্গ   
                                    
অবশেষে গোমুখ। ‘আহা! কি দেখিলাম,জন্মজন্মাতরেও ভুলিব না’ আনুভূতি। সামনে গঙ্গোত্রী হিমবাহ, প্রকান্ড একটা সবুজ বরফের দেয়াল দুই পাহাড়ের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।(বিজ্ঞানের ছাত্র আমরা, প্রাকৃতিক সবুজ বরফ? মনে হল জগতের সব বিশ্বাসীর দল আমাদের দিকে তাকিয়ে করুণার হাসি হাসছে।)হিমবাহ নিঃসৃত জলধারা এক বিরাট গুহামুখ দিয়ে বের হচ্ছে গঙ্গা রূপে। ঘড়িতে দুপুর বারোটা। 


ভারতবর্ষেরই গ্রীষ্মদগ্ধ কোনো শহরে এখন রাস্তার পিচ গলছে, এখানে বরফ গলছে। ‘সত্য সেলুকাস.........’

ফেরার পথে মুসৌরী,দেরাদুন সহ বেশ কিছু জায়গায় ঘুরেছিলাম, কিন্তু সব চেয়ে শান্তির ঘুমটা বাড়ি ফিরে মায়ের কাছেই হয়েছিল। লালবাবার কথায় ‘That is your Gomukh.’
                                                                            বিজয়ের তৃপ্তি

(ছবি- লেখক)


            

আরশিনগর ছাড়িয়ে
শৌভিক রায়

ঘরের পাশেই যদিও আরশিনগর, তবু সেই আরশিনগরের ঝকঝকে কাঁচে নিজেকে দেখাটা বোধহয় একঘেয়ে হয়ে যায়। তাই আরশিনগর নয়, সুযোগ পেলেই এদিক সেদিক পেল্লায় এই ভারতের! এমনিতে জীবনের জন্য সময় বরাদ্দ থাকে সামান্যই- মাত্র একটা জন্ম। আর দেশটা এতো বিরাট যে এক জন্ম কেন, কয়েক জন্ম লেগে যাবে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে। সময় তো আর প্রশ্রয় দেবে না! তাই ঝটপট যতোটা পারা যায় পায়ে মাখা হয় ধূলো....চোখে? 
আহা! যা দেখি তা জন্মজন্মান্তরেও ভুলবো না যে!  
স্টেশনের বাইরেই হাজির বিনোদ। দিল্লীতে আমার বিশ্বস্ত ড্রাইভার। নিজের শেভ্রলে ট্র্যাভেরায় যথারীতি ড্রাইভারোচিত গাম্ভীর্যে বসা। ঝকঝকে পোশাক, তকতকে গাড়ির গা। চটজলদি ব্যাগপত্তর গাড়ির মাথায় তুলে সোজা বেরিয়ে পড়া! "ওরে খেতে টেতে দিবি না নাকি?" "কিঁউ? রাজধানী মে তো ব্রেকফাস্ট দেতে হ্যায়! ভুখ লাগ গেয়া কেয়া ইতনা জলদি? দিখনা হ্যায় কি নেহি?" একি রে বাবা! দেখবো তো আমরা! তোর এতো জলদি কিসের। বেশি বলতেও ভয় লাগছে। এমনিতেই ভীতু মানুষ আমি। ড্রাইভার সাহেব, পরমাণিক দাদা, অনলাইন মেটেরিয়াল ডেলিভারি বয় প্রমুখের গম্ভীর মুখ ও প্রজ্ঞাকে ভয় খাই। তাই চেপে গেলাম। যদিও "ঘরের কর্ত্রী রুক্ষমূর্তি"র কাছে সেটি আমার পনের লক্ষ তেত্রিশ হাজার সতের নম্বর অপরাধ গণ্য হল! যাই হ'ক গুরগাঁও পার হয়ে জয়পুর-দিল্লী ফোর লেনের ধারে ড্রাইভার সাহেব থামলেন। ক্ষুন্নিনিবৃত্তি শেষে অতঃপর পুনরায় রওনা এবং অবশেষে ওই যে জয়পুর....শুরু হল আমাদের রাজস্থান দর্শন।



পিঙ্ক সিটি জয়পুর দেশের আর পাঁচটি রাজ্যের রাজধানীর মতো হতে হতেও আলাদা হয়ে গেছে তার নিজস্বতায়। রাজস্থানের সব শহরই বোধহয় কমবেশী এরকম। এ বলে আমায় দেখ তো ও বলে আমায়। পৌঁছনোর পর সে রাত কাটিয়ে পরদিন সকাল সকাল ড্রাইভার সাহেবের গাইডেন্সেই বেরিয়ে পড়া গেল। রাজস্থানেরই ছেলে, গাড়ি নিয়ে থাকে দিল্লীতে। হাতের তালুর মতোই চেনে নিজের রাজ্যকে। তাই খুব সহজেই দেখা গেল নাহারগড়, জলমহল, শিশোদিয়া রাণীর বাগান, যন্তরমন্তর, হাওয়ামহল, সিটি প্যালেস, জয় সিং মিউজিয়াম, বিড়লা মন্দির ইত্যাদি। প্রতিটি দ্রষ্টব্যের খুঁটিনাটিতে যাবো না। ছবিতে দিচ্ছি একটু বর্ণনা। শুধু বলবার এটাই যে জয়পুর দিয়ে রাজস্থান ভ্রমণ শুরু করায় এটা মাথায় ঢুকে গেল যে আগামী এক পক্ষকাল আমার জন্য অপেক্ষা করে রয়েছে বিস্ময়ের নানা সম্ভার নিয়ে।



 হাওয়া মহলের একদম ওপরে উঠে সত্যিই হাওয়া খেতে খেতে ভাবছিলাম আমাদের কোচবিহারের রাজকন্যা গায়ত্রী দেবীর নামোচ্চারণ মাত্র এবং কোচবিহার থেকে এসেছি বলে সামান্য খাতিরদারী পেয়েছি সিটি প্যালেসে...গায়ত্রী দেবী নামটির এমনই মহিমা! ভাবছিলাম সারা ভারতের আর্ট, ইঞ্জিনিয়ারিং একটা সময় কি নিদারুন জায়গায় পৌঁছেছিল তা বোঝাই যাবে না যদি না প্রতিটা স্থাপত্য, প্রতিটি শিল্প ভাল করে দেখা না যায়, ধারণা না থাকে সে সম্পর্কে এবং অতি অবশ্যই কল্পনাশক্তির বিকাশ যদি না হয়! জয়পুর সেটাই মনে করালো নাহারগড় ফোর্টের কারুকাজ বা সিটি প্যালেসের বৈভবে, জলমহলের রোমান্টিকতায় বা যন্তরমন্তরের অদ্ভুত বিজ্ঞানভাবনায়।  



দু'দিন দু'রাত কাটিয়ে আবার ব্যাগপত্তর ট্র্যাভেরায় চাপিয়ে চলা। গন্তব্য আজমির আর পুস্কর। যেতে পারা যেত হাতছানি দেওয়া মাখন পালিশ রাস্তায়। কিন্তু আমার ড্রাইভার সাহেবটি জানে আমি টুরিস্ট নআ ঠিক, ট্র্যাভেলার বরং। তাই রাস্তা হল রাজস্থানের গ্রামের ভেতর দিয়ে যাওয়া ভাঙাচোরা পথ যা সম্পূর্ণই বেমানান ওই ঝকঝকে রাস্তার পাশে। অদ্ভুত সব গ্রাম। উড়ছে বালি, মাথার ওপর লম্বভাবে কিরণ দেওয়া গনগনে সূর্য। নেই কোন মহীরুহ। ছোট ছোট বৃক্ষ। কাঁটাঝোপ। উট টানা গাড়ি। হরেক রঙের পাগড়ি মাথায় দেহাতি জনতা। একটা দু'টো দোকান। তাতে সামগ্রীও সামান্য। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আমাদের দিকে। এও রাজস্থান। রাণা, সোলাই, সোলাঙ্কি, ঠাকুর...তাদেরও রাজস্থান! সত্য দু'টোই। কাকে অস্বীকার করবো আর!



আজমির সম্পর্কে নতুন কিছু বলার নেই। আরাবল্লী পর্বত ঘেরা আধা উঁচু আধা সমতলের এই শহরটি বিখ্যাত তার দরগার জন্য। মইনুদ্দিন চিস্তির এই দরগাতে মিলবে ভারতের বৃহত্তম কড়াইয়ের দেখা। ফুলের, ধূপের গন্ধে সুরভিত ভারতের সম্ভবতঃ সর্বাধিক খ্যাত এই দরগায় মাথা ঠেকিয়ে একে একে দেখে নেওয়া আনা সাগর লেক, তারাগড় ফোর্ট, মেয়ো কলেজ, নারেলি জৈন মন্দির ইত্যাদি। ইচ্ছে থাকলেও বিস্তারিত বিবরণে যাচ্ছি না। আসলে কোন একটি জায়গার ইতিহাস না জানলে সম্পূর্ণ হয় না আমার ভ্রমণ। আপাততঃ এটুকুই বলার যে আজমিরের প্রতিষ্ঠাতা শাকম্ভরী চৌহান রাজ অজয়রাজা। আজমির দর্শন ক'রে চলা এবার পুষ্করে। নীল জলের অসামান্য পুষ্কর লেকের ধারে প্রজাপতি ব্রক্ষ্মার একমাত্র মন্দিরটি দর্শনে পূণ্য অর্জন আপামর ভারতবাসীর উদ্দেশ্য। আমি যে ব্যতিক্রম তা কখনোই বলবো না। তবে পুষ্করের পশুমেলা প্রাঙ্গন, উটের সারি, কাঁটাগাছের ঝোপ, অনবদ্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সর্বোপরি মরুভূমির বুকে পাহাড় ঘেরা এত সুদৃশ্য সরোবর....মুহূর্তেই প্রেমে পড়ে গেলাম পুষ্করের! 



তবে জানি বারবার প্রেমে পড়তে হবে সুন্দরী রাজস্থানের। তাই আবার এগোনো। আবার চলা। ঝকঝকে ফোর লেন পথে এবার হাজির রাজপুত শৌর্য-বীর্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন চিতোর গড়ে। যে দেখে নি এই গড় তার পক্ষে কল্পনা করাও অসম্ভব কিভাবে ইতিহাস জুড়ে রয়েছে চিতোরের প্রতিটি ইঁটে, পাথরে, ধূলিকণায়। এশিয়ার বৃহত্তম এই ফোর্টেই দেখা যায় রাণী পদ্মাবতীর মহল, রাণা কুম্ভের মহল, ফতে প্রকাশ প্যালেস, রতন সেন প্যালেস, জয়মল প্যালেস। রয়েছে কীর্তি স্তম্ভ, বিজয় স্তম্ভ। মা কালীর মন্দির, জৈন মন্দির, মীরাবাঈয়ের মন্দির, কুম্ভ শ্যাম মন্দিরের পাশাপাশি ভবানী মন্দির, গোমুখ সরোবর ইত্যাদি সব মিলে সে এক অকল্পনীয় ব্যাপার। সাতশো একর বিস্তৃত একশো আশি মিটার উচ্চতার এই ফোর্টটি সত্যিই রাজস্থান তো বটেই ভারতের গর্ব। আর সত্যি বলতে চিতোরগড়কে উপলব্ধি করতে হলে কোন দিন বা সময় বিচারে করা সম্ভবই না। এখানে ইতিহাস এতোটাই সমৃদ্ধ যে তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করতে হয় তা। হতে হয় একাত্ম।

কিন্তু ছাপোষা মানুষ আমি। সাধ আর সাধ্যের মধ্যে ফারাকটা বিস্তর। তাই সাধ থাকলেও সাধ্য থাকে না। বিদায় জানাতে হয় এক অসামান্য ঐতিহাসিক জায়গাকে। পেছনে পড়ে থাকে চিতোর। টাইমমেশিনে নিয়ে গিয়েছিল যেন কোন এক সুদূর অতীতে যেখানে ষড়যন্ত্র, ঈর্ষা, লোভ, কাম সব কিছুই যেন মিলিয় গিয়েছিল মীরাবাঈয়ের গানে। ঘটেছিল উত্তরণ। আত্মার।



অবশেষে উদয়পুর। মোটামুটিভাবে সফরসূচীর মাঝে এসে বিশ্রাম এখানে তিনচার দিন। তবে ওই নামেই বিশ্রাম।




 কেননা মহারাণা উদয়সিংহের প্রতিষ্ঠিত অতীতের মেবার রাজধানী এই শহরটির প্রাকৃতিক অসামান্য সৌন্দর্যের সাথে যোগ হয়েছে এতো কিছু নিদারুন  দ্রষ্টব্য যে বারবার দেখেও আঁশ মেটে না। আরাবল্লী পর্বতে ঢাকা ঘন নীল আকাশ  উদয়পুরে। রাতে বেশ ঠান্ডা, দিনে গরম। 



এখানকার সিটি প্যালেসের ঐশ্বর্য চোখধাঁধানো। মন্ত্রমুগ্ধ হতে হয় নানান কারুকাজ ও দ্রষ্টব্য সামগ্রী দেখে। 


পিছোলা লেকের মধ্যে অবস্থিত লেক প্যালেস যেন একটি চিরন্তন কবিতা। সাদা মার্বেলের এই প্যালেস পূর্ণিমা রাতে যে রূপ নেয়, বাজি ধরে বলতে পারি, একটিও এরকম আর পাওয়া যাবে না সারা পৃথিবীতে। আজ এই প্যালেসটি হোটেলে পরিণত হয়েছে।


 ফতে সাগর লেক, নেহেরু গার্ডেন, সঁখিয়ো কি হাভেলি, লেক পিছোলা, গুলাব বাগ, জগদীশ টেম্পল, মিউজিয়াম, জগ মন্দির, কলাকেন্দ্র ইত্যাদি


 সব মব মিলে অপ্রতিরোধ্য উদয়পুর। মনুষ্য সৃষ্ট লেকের মধ্যে এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম জয়সমন্ড লেকের উদয়পুর সত্যিই যেন প্রাচ্যের ভেনিস। ফতে সাগর লেকের মাঝে থাকা দ্বীপের অবসারভেটরি ক্যালিফোরনিয়ার বিগ বিয়ার লেকের সোলার অবজারভেটরির অনুকৃতি। নীল জল, সবুজ পাহাড় আর অসাধারণ স্থাপত্যের উদয়পুর রাজস্থান ভ্রমণের একটি অসাধারণ সুখস্মৃতি হয়ে রইবে আজীবআঁকাবাকা পথে উদয়পুর থেকে আরাবল্লীর সব্বোর্চ মাউন্ট আবুতে পৌঁছে যাই এক দুপুরে। "ওয়েসিস অন ডেজার্ট" নামে খ্যাত মাউন্ট আবুর উচ্চতা পাঁচ হাজার পাঁচশো ষাট ফিট (গুরুশিখর)। কেদারনাথ-বদ্রীনাথ, দার্জিলিং ইত্যাদি ভ্রমণকারীর কাছে প্রথম দর্শনে মাউন্ট আবু তেমন না টানলেও ক্রমে আরাবল্লীর পাথরের গায়ে প্রকৃতির নিজস্ব কারুকাজ মুগ্ধ করলো।




 ব্রক্ষ্মাকুমারিজ প্রেয়ার হল, অচলগড় ফোর্ট, নাক্কি লেক, 

দূর্গা মন্দির ইত্যাদি সবাই নিজের নিজের মতো ক'রে অদ্বিতীয়। শিহরণ জাগায় মাউন্ট আবুর সূর্যাস্ত।




 কিন্তু সব কিছু ভুলে গেলাম দিলওয়াড়া মন্দিরে প্রবেশের সাথে সাথে। এগারো থেকে তেরো শতকের তৈরী মার্বেল পাথরের এই মন্দিরগুলি সত্যিই ভারতের শ্রেষ্ঠতম। সারা ভারতের বহু মন্দির এবং তাদের গাত্রে স্থাপত্য দেখার সুযোগ হয়েছে। কর্ণাটকের বেলুড়ের স্থাপত্য যেমন মর্যাদা পেয়েছে কালো পাথরে শ্রেষ্ঠতমের তেমনি মার্বেল গাত্রে এই ঐশ্বরিক কারুকাজ না দেখলে বিশ্বাসই হয় না শিল্পকলার কোন উন্নত স্তর স্পর্শ করেছিল ভারত একদিন। প্রণাম জানাই সেইসব শিল্পীদের যাঁরা মার্বেল গাত্রে খোদাই করেছিলেন অবর্ণনীয় অসাধারন, অসামান্য এই শিল্প।ন।
অবশেষে প্রবেশ ল্যান্ড অফ ডেডস-এ। মাউন্ট আবুতে ঠান্ডা উপভোগ ক'রে রাতারাতি পৌঁছে যাওয়া মার ওয়ার বা মৃতদের দেশে। হ্যাঁ যোধপুর। বিখ্যাত ব্লু সিটি। আয়তনে রাজস্থানের দ্বিতীয় বৃহত্তম। ধু ধু মরুভূমির খুব কাছে চলে এসেছি বোঝাই যাচ্ছে। ত্বকে টান ধরছে, ঠোঁট শুষ্ক। চারদিকে বালি আর কাঁটা ঝোপ। সেই কাঁটাই দিব্যি চিবোচ্ছে চরতে থাকা উট। উট সওয়ারী মাথায় রঙবেরঙের পাগড়ি বেশ জাঁদরেল গোঁফের ভয় ধরানো কেউ। কেউ আবার উটের গাড়িতে নিয়ে চলছে পশরা। মাউন্ট আবু থেকে দুপুরে বেড়িয়েছিলাম। তাই পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যে নেমে গেল। অবশ্য সন্ধ্যে হচ্ছে এখানে সাতটা নাগাদ। ভোর হচ্ছে সাড়ে-ছয় সাত। আসলে সরে এসেছি অনেকটাই পশ্চিমে তাই আমাদের ওদিকের সাথে মিলবে না সেটাই স্বাভাবিক আর এটাও যুক্তিগ্রাহ্য যে দেশের টাইমজোনটা নিয়ে কিছু পরিবর্তন অবশ্যই দরকার। সত্যিই তো অরুণাচলে যখন ভোর রাজস্থানে তখন রাত। যাই হ'ক যোধপুরে রাত কাটিয়ে সকালে হোটেলের জানালা থেকে পুরু কার্টেনটা সরাতেই চোখ আটকে গেল একটু দূরে সামান্য উঁচুতে থাকা ফোর্টে। এই সেই বিখ্যাত মেহরনগড় ফোর্ট।



 তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নেওয়া। রাঠোর বংশের হাত ধরেই সৃষ্ট যোধপুরের এই ফোর্ট সম্ভবতঃ রাজস্থানের ফোর্টগুলির মধ্যে সবচেয়ে দূর্ভেদ্য। ফোর্টের সামনে থাকা রাণীসার পদমসার লেক আহ্বান জানাচ্ছে যেন ফোর্টে প্রবেশ করতে। ঘোরানো রাস্তায় ফোর্টের বিশালত্ব দেখতে দেখতে পৌঁছাই মূল প্রবেশদ্বারে। তারপর বিস্ময় পরতে পরতে উন্মোচিত হতে থাকে শিশমহল, ফুলমহল, মোতিমহলে, অস্ত্রসম্ভারে, কামান সজ্জায়, পোষাক-আশাকে। এ বলে আমায় দ্যাখ তো ও আমায় দেখ। ফোর্টের ওপর থেকে সমস্ত উদয়পুর নজরে পড়ে, যেভাবে উদয়পুরকেও দেখা গেছিল সিটি প্যালেস থেকে। ফোর্ট দর্শন শেষে যশবন্ত থাডা, যোধপুর সিটি প্যালেস বা উমেদ ভবন, 




গভর্ণমেন্ট মিউজিয়াম, ঘন্টাঘর ইত্যাদি দেখে কেটে যায় দেড়দিন। এখনও বাকি এই সফরের বেশ খানিকটা।
যোধপুর-পোখরান-জয়শলমির পথ আমার স্মরণীয় যাত্রাপথের একটু। ভয়ঙ্কর সুন্দর একেই বলে। হলুদ বালি, তপ্ত-দগ্ধ চারধার, ছায়ার অনুপস্থিতি, হাতের নাগালে চলে আসা সূর্য, ঝলসে দেওয়া হাওয়া....আমরা চলছি গোল্ডেন সিটিতে...জয়শলমিরে। রাস্তা টানা চলে গেছে বালির ওপর দিয়ে। মাঝে মাঝে বাঁক। দেখা মিলছে বালিয়াড়ির। বেশ লম্বা যাত্রা শেষে আকাশে যখন সূর্য এক অদ্ভুত সৌন্দর্য নিয়ে ডুবুডুবু আমাদের প্রবেশ তখন সোনার শহরে। সকালের অপেক্ষায় না থেকে রাতেই চক্কর কাটলাম সারা শহর। সত্যি সোনার শহরই বটে। নিওনের হলদে আলোতে আরও খোলতাই হয়ে উঠেছে যেন চারদিক। দূরে বাজছে সারেঙ্গীতে অজানা মন আনচান করা গান। 
সকালের ঝলমলে আলোতে মন আনন্দে নেচে উঠলো। চারদিক সোনা সোনা। সোনা ঝরাচ্ছে সূর্য নিজেও। ঝটপট রেডি হয়ে চলা এবার সোনার কেল্লা দেখতে।




 জয়শলমিরের এই ফোর্ট হলুদ বেলে পাথরের অপূর্ব এক স্থাপত্য, বাঙালি মাত্রেই একে জানেন সোনার কেল্লা হিসেবে। সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদার জন্য বিখ্যাত এই কেল্লা। ফোর্টের রঙমহল, জুনা মহল, মোতি মহল, গজবিলাস তো বটেই নজরকাড়া জৈন ও হিন্দু মন্দিরগুলিও।





 কেল্লার বিশালত্ব, রঙ সব মিলে ভাল লাগার রেশ থেকেই যায়। রেশ থেকে যায় হাভেলি দর্শনেও। পাটওয়ান, নাথমলজী, সেলিম সিং প্রত্যেকের হাভেলিই তাদের সুদৃশ্য জাফরি, সিলিং, ম্যুরাল, অলিন্দ সব নিয়ে অনিন্দ্যসুন্দর।



 গদী সাগর লেক, ফকরোল মিউজিয়াম, তাজিয়া টাওয়ার ইত্যাদি দিয়ে শেষ হয় জয়শলমীর। এবার চলা খুড়ি গ্রামে। স্যান্ড ডিউনস দেখতে। অনেকেই যান সাম-এ। আমার পছন্দ ছিল খুড়ি কেননা তুলনামূলকভাবে ভিড় কম আর পাকিস্থানের বর্ডারটিও কাছে।



খুড়ি নিরাশ করে নি। অদ্ভুত সুন্দর বালিপ্রবাহে অস্তমিত সূর্যের আভা আর বালির রঙ পাল্টানো দেখে তদগত হ'তে হয়। প্রকৃতির এই রঙবিলাস যে কি সুন্দর হতে পারে তা বিশ্বাসই হয় না! 




বালির ঢেউয়ে হারিয়ে যেতে যেতে কেবলই মনে হয় সত্যিই একটা মাত্র জন্ম বড্ড ছোট, ভীষনই কম!
সফরের সব শেষে হাজির হই বিকানিরে। সাধারণতঃ বিকানিরকে ট্যুর অপারেটেররা তাদের সূচীতে রাখে না। কিন্তু বিকানির থরের অন্যতম প্রবেশদ্বার তো বটেই, শহর হিসেবেও দুরন্ত। বিকানিরের জুনাগড় ফোর্ট তার অপরূপ কারুকাজ নিয়ে পর্যটকদের মোহিত করে।



পাশাপাশি রয়েছে লালগড় প্রাসাদ, গঙ্গা গোল্ডেন জুবিলী মিউজিয়াম, জৈন মন্দির, দেবী কুন্ড সাগর, করণীমাতা মন্দির। তবে এটাও ঠিক সমানে ফোর্ট দেখতে দেখতে খানিকটা ক্লান্তি আসে। কিন্তু পাশাপাশি এটাও ঠিক প্রত্যেকটি ফোর্ট তার নিজের মতো করে আলাদা। আর বিকানিরেই আমাদের নতুন অভিজ্ঞতা হ'ল হাভেলিতে রাত কাটাবার। সে অভিজ্ঞতা এককথায় অন্যরকম। সে অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখে ফেলা যায় এক আলাদা কাহিনী।



রাজস্থান ভ্রমণ এখানেই শেষ হয়। বিকানির থেকে টানা ফিরে আসা দিল্লীতে। বলছি ঠিকই ভ্রমণ শেষ হল। আসলে ভ্রমণ শেষ হয় না কোনদিনই...না একক মানুষ শেষ করতে পারে তার চলা, না মনুষ্য প্রজাতি। তাই তো টাইগ্রিস ইউফ্রেটিসের সেই মানুষের পোঁতা  বীজ আজও বহন করে চলেছি আমি বা আমার মতো অনেকেই। কখনো তাই রাজস্থানে, কখনো টেমসের ধারে, কখনো ব্রাজিলের জঙ্গলে....
চরৈবতি।।


(ছবি- লেখক)




ভার্সে ভ্রমণ--সুন্দর ও ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা
       কুমকুম ঘোষ


সালটা ২০০৩এর ২৫শে ডিসেম্বর।আমরা ৬জন,দুটি পরিবার--আমি-দেবাশিস- আমাদের বালিকা কন্যা তিন্নি এবং আমাদের বন্ধু মনীত-জোনাকী ও ওদের শিশুকন্যা মোহর---চলেছি পশ্চিম সিডিমের রডোডেনড্রন স্যাংচুয়ারীর ভার্সে ট্রেক করতে।ছোট সহজ ট্রেক মাত্র ৪কিমির পথ।অসুবিধা বিশেষ হবেনা এই ছিল প্রাথমিক ভাবনা।যাই হোক খুব মজা করে ক্রিশমাসের আগের রাতটা দার্জিলিং মেলে কাটিয়েছি সবাই।দুই কন্যা মোজা ঝুলিয়ে সকালে অনেক উপহার পেয়েছে কাল্পনিক সান্তাবুড়োর কাছ থেকে। নিউজলপাইগুড়ি স্টেশনে যতবার পৌঁছই ততবার ই ভালো লাগে।শীতের রোদ আর কুলির হাঁকাহাঁকির মধ্যেই আমরা সতেজ ট্যুরিস্ট গটগট করে ট্রলি ব্যাগ টানতে টানতে উঠে পড়ি ওভারব্রিজে।একদিকে সিঁড়ি অন্যদিকে স্লোপিং--এদিক দিয়ে নামলাম সোজা ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের মধ্যে।সেখানে তখন প্রচুর ভিড়।শীতের ছুটিতে সব বাঙালী ই বেড়িয়ে পড়েছে যেন। রঙবেরঙের শীতের পোশাক আর হরেক কিসিমের গলার আওয়াজ, দরদাম চলছে গাড়িওয়ালাদের সাথে।বেশীরভাগের গন্তব্য দার্জিলিং ও সিকিমের গ্যাংটক।সেসময় ভার্সে একটু অফরুট ই ছিল।  সম্ভবত কোন একটি ভ্রমণ পত্রিকার সুবাদে নামটা জেনেছিল দেবাশিস।যেখানে ভিড় সেখানে নয়, নির্জন প্রকৃতির সান্নিধ্যে কয়েকটা দিন কাটানো।সাথে একটু অচেনা জায়গায় যাওয়ার রোমাঞ্চ , সর্বোপরি পুরো সিঙ্গালিলা রেঞ্জের ১৮০ডিগ্রি ভিউ--শৌখিন ফটোগ্রাফার দেবাশিসের মিনোল্টা ক্যামেরার সদ্য কেনা ৩০০টেলির এক্সপেরিমেন্ট, রিঙ্কুদার(মনীতের ডাকনাম) ডাকাবুকো অ্যাটিচুড আর আমাদের দুই সহধর্মিণীর সবেতেই সায় দেওয়া বা নেচে ওঠা আরকি।অফরুটে যেতে আর কি বা চাই? 
অতএব--
মন চল যাই ভ্রমণে
নিত্যানন্দ অঙ্গনে--এই বাণী ই সম্বল। হইহই করে গাড়ীতে মালপত্র চাপানো হলো।তবে এই গাড়ী যাবে জোড়থাং পর্যন্ত, সেখান থেকে হিলে-ভার্সে।অফরুটে যাওয়ার প্রথম হ্যাপা গাড়ী পাওয়া তাই এভাবে ভেঙ্গে ভেঙ্গে যেতে হবে।অগত্যা, তাই সই।পথে একবার মাটিগাড়ার এক দোকান থেকে মুড়ি কিনলাম।সফরে মুড়ি-চিঁড়ে-চানাচুরের স্টক থাকলে কনফিডেন্স লেভেলটা আমার মতো মুড়িপ্রেমীর আবার বেড়ে যায়! জোড়থাং পৌঁছে আর একটা টাটাসুমোর বন্দোবস্ত করা গেল।আগের ড্রাইভার ই সব ঠিক করে দিলেন, কথা হলো ইনি আমাদের হিলে পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে ফিরে যাবেন এবং দুদিন পর হিলেতে এসে অপেক্ষা করবেন ।আমরাও ভার্সে থেকে ব্রেকফাস্ট করে এসে যাবো।  এখান থেকে আমাদের রাস্তা সোজা মেল্লি হয়ে নয়াবাজার-নামচি-সোমবাড়িয়া-ওখরে-হিলে এবং ভার্সে। মেল্লিবাজার পৌঁছতেই দুপুর,এক রেস্তোঁরায় ঢোকা হলো।মালকিন দুই বোন।কি অমায়িক হাসিমুখ।অসাধারণ মোমো ও চাটনি খেলাম সেখানে সঙ্গে সিকিমের চাউমিন। হাতের গুণ এবং জায়গার মহিমা কিনা জানিনা সিকিমের মত সুস্বাদু ও সস্তা মোমো আর কোথাও খাইনি এখনো। দোতলা ঘরের পাশ দিয়ে সুন্দরী তিস্তা বয়ে যাচ্ছে আর আমরা ধোঁয়া ওঠা গরম মোমোয় কামড় দিচ্ছি।এও তো এক লতা মঙ্গেশকরের গান সঙ্গে ভি বালসারার পিয়ানো আ্যাকোর্ডিয়ানের যুগলবন্দীর মত মরমী অভিজ্ঞতা। দোকানটি এখনও তেমনি জমজমাট,মালকিন দিদিদের বয়স বেড়েছে আমার মতো কিন্তু হাসিমুখে আজো খদ্দেরদের আপ্যায়ন করছেন--দেখলাম দুবছর আগে লামাহাট্টা থেকে ফেরার সময় হিলে পৌঁছতে বিকেল ৪টে বেজে গেল।বাইরে বেশ ঠান্ডা তখন,দুই কন্যে সোয়েটার ছেড়ে বসেছিলেন ভেতরে,বাইরে বেড়িয়ে--ওরে বাপরে বলে গাড়িতে ঢুকে পড়লো।আমরাও দুই মা'--চান্স পেয়ে বকুনি দিয়ে সোয়েটার টুপি পড়িয়ে দিলাম। বিকেলের ম্লান আলোয় চারপাশ লাজুক কন্যে যেন।দূরে পাহাড় সারি খানিক মেঘে ঢাকা, চাল ধোওয়া রঙ চারপাশে।নীরবতার পদতলে আমরা ৬জন..গাড়ী সশব্দে নেমে গেল।  হিলেতে থাকার জায়গা একটাই।সিকিম ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের বাংলো।কারণ ভার্সে(বার্সে)সহ হিলের পুরো এলাকাটাই সংরক্ষিত, রডোডেনড্রন স্যাংচুয়ারী। হেরিটেজ অঞ্চল। তবে সেটিকে বাংলো বলা নিতান্তই বাহুল্য,কানাছেলের নাম পদ্মলোচন যেমন,..কারণ মেনটেনেন্স অতি করুণ।বুকড ছিল কিনা আজ আর মনে নেই তবে সেই শেষ বিকেলে ঐ জনমানবহীন(২/৩টে বাড়ী মাত্র) হিলেতে সেই বাংলোর কেয়ারটেকার সাদরে ঘর খুলে দিলেন।অপরিচ্ছন্নতার নিদর্শন সব ঘরেই।জানলার কাঁচ কয়েকজায়গায় নেই।(এখন কেমন জানিনা)।তাতে কি? ঘর তো? আমরাই সোৎসাহে কাগজ সাঁটলাম। ইলেকট্রিক নেই।মোমবাতির আলোয় চা মুড়ি সহযোগে সান্ধ্য জলখাবার সারলাম।ইতিমধ্যে কেয়ারটেকার এসে ডাইনিং এ কিছু কাঠ জ্বালিয়ে চিরকালীন হিটারের বন্দোবস্ত করে দিলেন।আমরাও বাচ্ছা কাচ্ছা(স্বামীরা) সমেত হাত পা সেঁকতে লাগলাম সঙ্গে সুগায়িকা জোনাকী থরলো চিরকালীন রবি ঠাকুরের গান---"আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে"....জীবন পূর্ণ তখন যেন।  ৭টা নাগাদ(কলকাতায় সন্ধ্যে তখন) রাতের খাবার এসে গেল।--ভাত, স্কোয়াশের তরকারী, ডিমভাজা। বাইরে তখন প্রবল ঠান্ডা, আনতে আনতেই সে খাবারও প্রায় শীতল। যাইহোক দ্রুত ডিনার পর্ব শেষ করেই বিছানায়।ওরেব্বাস , যেন বরফজল ঢেলে দিয়েছে কেউ , ওদিকে কাগজসাঁটা জানলা ভেদ করে হিমশীতল হাওয়া এক্কবারে রাজযোটক যেন।মোজা মাংকিটুপি আর বাকি শীতপোষাক সহ ডবল লেপ।তবু ঠান্ডায় কাঁপছি আমরা। কোনক্রমে রাতটা পার হলো ছেঁড়াছেঁড়া ঘুমে।মোরগের ডাকে ভোরবেলাতেই উঠে পড়লাম।বাইরে বেড়িয়ে মন খুশ্।ঝকঝকে নীল আকাশের ইজেলে সিঙ্গালিলা রেঞ্জের বরফঢাকা পাহাড়চূড়া ইতিমধ্যে এঁকে রেখেছেন প্রকৃতিরাণী।আকাশে হালকা মেঘ পানসি নৌকার মথ এদিক ওদিকে ভাসছে। দেখি ঘাসের ডগায় টুকরো বরফকুঁচি ঝলমল করছে।স্থানীয় এক ব্যক্তি এটিকে "টিষার" বললেন।তুষারের অপভ্রংশ আরকি! 


                                                           ভার্সের পথে আমরা কজন

ঝটপট প্রাতরাশ সারলাম ডিমভাজা ও পাঁউরুটি সহযোগে।দুজন পোর্টার ও নেওয়া হলো এখান থেকে।তারা এগিয়ে গেল, আমরাও পিছে পিছে এগোতে লাগলাম  নির্জন হিলে  , তার গুটিকয় বাসিন্দা আর দিগন্তের পাহাড়কে সাক্ষী রেখে।  ১০৫০০ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এই অভয়ারণ্য।হিলে থেকে মাত্র ৪কিমির সহজ হাঁটাপথ।পোর্টাররা পটপট বাঁশের কয়েকটা ডাল ভেঙ্গে দুই কন্যার হাতে ধরিয়ে দিল।তারাও কদম কদম বঢ়ায়ে চলল ,সাথে আমরাও।
এই অরণ্য রেড পান্ডা সহ শিয়াল, সজারু,জায়েন্ট কাঠবেড়ালী হিমালয়ান ব্ল্যাক বিয়ার,বুনো শুয়োরের নিজস্ব বাসভূমি তবে সেই শীতের সকালে কেউ  নিজের বাসা ছেড়ে আসবে না সেকথা পোর্টাররা আগেই জানিয়ে আমাদের নিশ্চিন্ত করেছিলেন। চারপাশে ঘন রডোডেনড্রন বন সঙ্গে পাইন, ফার , ওক দেওদার গাছের ছায়ায় ঘেরা সংকীর্ণ পায়ে চলা পথ।একটাই গন্তব্য এদিকে--ভার্সের একমাত্র থাকার জায়গা 'গুরাসকুঞ্জ"।রডোডেনড্রন এর স্থানীয় ভাষার নাম--"গুরাস' ফোটার সময় মার্চ-এপ্রিল।সেসময় এই অঞ্চলে রক্তিম হোরিখেলা চলে প্রকৃতির মাঝে। ডিসেম্বরের শীতে এইসব চিরহরিৎ বৃক্ষে একটা গুরাস ও নেই।অনেক খুঁজে দু-একটা বিক্ষিপ্ত ফুল নজরে পড়েছিল সেবার(রডোডেনড্রনের রঙবাহারী রূপ পরে মে' মাসে একবার ইয়ুমথাঙ্ এ দেখেছি)। 

                                                             "গুরাসকুঞ্জ"..ভার্সের একমাত্র রিসর্ট

২৬শে ডিসেম্বরের সেই যাত্র ছিল মনোরম ও হৃদয়গ্রাহী। বেশ দুপুর দুপুর পৌঁছে গেলাম।ম্যানেজার অধীরবাবু উপস্থিত। গেট খুলে ঘাসে ঢাকা এক প্রসস্ত ভূমি পেরিয়ে রিসর্ট।আমাদের ঠাঁই হলো দোতলার ডর্মিটারিতে ।ঢালা বিছানা।কাঁচের শার্সি দেওয়া বিশাল রুম।পথশ্রমে একটু ক্লান্ত সকলেই।তবু সেই নির্জনতম প্রান্তটি ঘুরে দেখলাম।তখন মোবাইলের রমরমা যুগ নয়। অতএব হিলেতে পৌঁছে সেই যে যোগাযোগ, তার পর দুদিন নো টাওয়ার নো কানেকশন। ভার্সেতে একটি হিলটপ আছে।মেয়েদের রেখে রিঙ্কুদা ও দেবাশিস টুক করে চড়ে এলো বিকেলের দিকে। আমরা চেয়ার পেতে গল্প করছি নীচু স্বরে,  নীরবতার সাথে সাক্ষাৎ মোলাকাৎ যেন, রিসর্টের লাগোয়া ফরেস্ট গার্ড ব্যারাক। সেখানে দেখলাম ভার্সের বানান লেখা--BARSEY SANCTUARY। ব্যারাক মানে পাথরের ইঁট গাঁথা টিনের চালের দুটি ঘর, কেউ নেই সে সময়। পাথরের দেওয়াল ও তিনকোণা টিনের চাল--পাহাড়ী অঞ্চলের বাড়ীগুলোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য।বরফ পড়লে যাতে ঝরে যায়।ভার্সের রিসর্ট টিও একই ধরণের।সামনের ঘাসে ছাওয়া মাঠটায় সোলার ল্যাম্প লাগানো।অন্ধকার হয়ে গেলে জ্বলে ওঠার কথা কিন্তু নাঃ।এগুলি মেরামতির অভাবে বিকল।  সে রাত তো গল্পগুজব , গান ,বাচ্ছাদের ছড়া ইত্যাদির মধ্যে কেটে গেল। আগের রাতে ঠান্ডায় ঘুম হয়নি কারোর--এদিন সেটা পুষিয়ে নেওয়া গেল। রিসর্টের লাগোয়া ফরেস্ট গার্ড ব্যারাক। সেখানে দেখলাম ভার্সের বানান লেখা--BARSEY SANCTUARY। ব্যারাক মানে পাথরের ইঁট গাঁথা টিনের চালের দুটি ঘর, কেউ নেই সে সময়। পরদিন ২৭শে ডিসেম্বর, সুন্দর রোদ ঝলমলে সকালটা আলস্যে কাটালাম ,ঘুরতে ঘুরতে ছোট ম্রিয়মান দুটি গুরাস পেলাম অনেক উঁচুতে।সে ছবি বিশেষ ভালো এলোনা।কিন্তু যে সিঙ্গালিলা পাহাড়দঙ্গলের ছবি দেখতে কিংবা ফটো তুলতে এই স্থানে আশা তা আর পূরণ হচ্ছে না দেবাশিসের।মেঘের ফাঁকে কখনও পান্ডিম বা কখনো জোড়মাথা কাবরু দেখা দিয়ে যাচ্ছে মাঝেমধ্যে।সপার্ষদ কাঞ্চনজঙ্ঘার মহিমময় শ্বেতশুভ্র উপস্থিতি মোটেই নেই।উপরন্তু কাঞ্চনজঙ্ঘা যেন বরফহীন কালচে পাহাড়।এমনসময় রিসর্টের রাঁধুনীর স্বামীকে দেখি পিঠে বিশাল ঝুড়ি নিয়ে কাঠ জোগাড়ে জঙ্গলে চলেছেন।ক্যাসুয়ালি আমরাও তার সাথে আলাপ করছিলাম।ভয়ংকর ভার্সের আগাম ভবিষ্যৎ বাণীটি সেই ব্যক্তি কিন্তু তখন ই করেছিলেন আমামাদের সামনে--"পাহাড় কালা হ্যায় , থোকা গিরেগা"..।  অভিজ্ঞ ব্যক্তিটি সেই আগাম তুষারপাতের কথা ভেবে জ্বালানী সংগ্রহে চলেছেন।এদিকে ঝলমলে রোদ, ছবি তোলা ঘুরে বেড়ানো চলছে।একদল কলেজের ছেলেমেয়ে দুপুরে এলো হিলের দিক থেকে ট্রেক করে কিন্তু খাবারের দাম শুনে আর অপেক্ষা করলো না বিশেষ।নেমে গেল।


                                                                  বরফ পড়ছে তখন--গুরাসকুঞ্জ

সে আমলে(২০০৩ সাল) কলকাতায় ১৮টাকায় ১ডজন ডিম পাওয়া যায় সেখানে ম্যানেজার অধীরবাবু একটি ডিমকারির দাম নিতেন ১২টাকা করে।সব ই নাকি শিলিগুড়ি থেকে আনাতে হয়।  যাই হোক আমরা তো সব জেনেই গেছি। অতএব দাম চোকাতে হবেই। 
তীব্র ঠান্ডা সেদিনটা , পরদিন আমরা ফিরবো।সেই দুজন পোর্টার ই আসবে।পরের গন্তব্য ছিল লাভা-লোলেগাঁও।
ঘটনার সূত্রপাত মাঝরাত থেকে।দলের সর্ব কনিষ্ঠ সদস্যাকে বাথরুমে নিয়ে যেতে মোমবাতি জ্বালানো হলো আর আমরাও দেখলাম এক অনবদ্য রোমাঞ্চকর তুষারপাতের দৃশ্য।যেন সুইজারল্যান্ড--পুরো অঞ্চলটা সাদা বরফে ঢাকা।ধারাবাহিক শ্বেত-শর বর্ষণ।  সামনের ঘাসজমি, ব্যারাকের ছাদ মায় সোলার আলোগুলো ঢেকে গ্যাছে পুরু বরফে।তার ওপর চাঁদের আলো পরে যেন স্বর্গীয় শোভা!! বিপদের দিকটা চিন্তা না করেই পরদিন ঘুম ভাঙলো।আমরা দুই বান্ধবী শাড়িটাড়ি পরে রেডি।ভাবখানা এমন যে গটগট করে হিলেতে নামবো, আগে থেকে বলা-কওয়া সেই টাটাসুমো থাকবে আর বর-বাচ্ছা সহ উঠে রওয়ানা দেবো লাভা। বিষয় তা ছিল না। পোর্টাররা স্থানীয় ভাষায় কি বলছিল বুঝিনি।কিন্তু অবস্থা সঙ্গীন সেটা বুঝলাম যখন ম্যানেজার আমাদের শাড়ীর পরিবর্তে "দাদাদের ট্রাকপ্যান্ট পরুন বৌদি" বললেন।বেশ।তাই সই।সঙ্গের কোকা -৩০ দুই মেয়েকে খাইয়ে দিলাম আর কি ভেবে দেবাশিস ব্র্যান্ডির ছোট বোতলটা ওর ক্যামেরার ব্যাগে নিয়ে নিল।মোহরের(৫বছর বয়সী তখন) জন্য "দাজু" নামের বয়স্ক পোর্টারের বন্দোবস্ত হলো।সে ওকে কাঁধে নিয়ে নামবে।আর রিসর্ট থেকে আর একটি পোর্টার মোট ৩জনকে নেওয়া হলো বাকী মালপত্র বইবার জন্য। শুরুতেই বিপত্তি।জোনাকী বরফে আছাড়া খেলো।স্যান্ডেল পরা পা'দুটো প্লাস্টিকে বাঁধা ছিল যাতে পা না ভেজে!!!!(পাঠক অবাক হবেন না-এটা বোকামো হলেও সত্য)।এগোতেই পারছে না।প্লাস্টিক খুলে ফাঁকা চটি পরেই চলা শুরু। আমার তবু বাটার ঢকা পাম্প শু ছিল।বাকিদের ও  স্নিকার পা'এ ।মাথার ওপর অঝোরে তুষারপাত চলছে, পাশের গাছ রাস্তার বাঁক সব ই সাদা। আশা একটাই হিলে পৌঁছে গাড়ী পাবো। ৪কিমি রাস্তা পুরোটাই ঢাকা বরফে ফলে সময় লাগলো আগের চেয়ে অনেক বেশী।২৮শে ডিসেম্বর,২০০৩--সেদিন বহুকাল পড়ে দার্জিলিং এও তুষারপাত হয়েছিল  । 



                                                                  "প্রবল তুষারপাত তখন ভার্সেতে"

বরফ পড়েছিল ঐ অঞ্চলের সর্বত্র ই।এবং পরে শুনেছিলাম তখন নাকি সবাই বরফ দেখতে ছুটেছিল দার্জিলিং।  হিলেতে পৌঁছে দেখি কোন গাড়ী আসেনি। প্রথমে আশ্রয় নিলাম এক পোর্টার ভাই এর বাড়ী। 
মনটা একটু দমে গেলো।একে তো দুই কন্যার সারা শরীর প্রায় ভিজে গেছে উপরন্তু চটি পরে হাঁটার ফলে জোনাকীর দুটো পা' ঠান্ডায় জখম। পোর্টারদের সাথে আলোচনা করে দেবাশিস ও রিঙ্কুদা সিদ্ধান্ত নিল হেঁটে ওখড়ে পৌঁছলে হয়ত সেখানে গাড়ী পাওয়া যাবে বা আমাদের গাড়ীও অপেক্ষা করতে পারে।  জোনাকীর জন্য একজোড়া বুটজুতো(মহার্ঘ সেসময়) জোগাড় হলো, টাইট ও বুড়ো আঙুল ছেঁড়া বলে পরিত্যক্ত ছিল। সেটাই পরলো জোনাকী।ওদিকে ১২টা বাজে, প্রকৃতির রূপ আরো কঠোর, রূঢ়। আকাশ কালো , অঝোরে তুষারপাত হচ্ছে। তবু এবারও আবার হাঁটা মোটরেবল্ রোড দিয়ে। একদিকে পাহাড়, উল্টোদিকে জঙ্গল, খাদ।আমরা পাহাড়ের দিকে ধার ঘেঁষে চলেছি।ঝপাৎ ঝপাৎ আওয়াজ।গাছের ওপর তুষারের ভার পরলেই ডাল ভেঙ্গে নীচে পড়ছে।পোর্টাররাও পাহার ঘেঁষে চলেছে।সবার সামনে "দাজু"পিঠে মোহর ওঁকে জাপটে ধরে আছে।কন্যার জন্য রিঙ্কুদা ও জোনাকী ও প্রাণপনে প্রায় হাঁটু বরফের ওপর দিয়ে ছুটতে বাধ্য।কিন্তু একটা সমস্যা দেখা দিল।মোহর জলে ভিজে ঠান্ডায় প্রচন্ড কাঁপছে ।  থামা হলো পাহাড়ের বাঁকে ব্র্যান্ডি খাইয়ে দেওয়া হলো বাচ্ছাদের ।একটু ধাতস্থ হয়ে আবার সেই বরফ-ঢাকা পথে হাঁটা শুরু হলো।যে করেই হোক অন্ধকার নামার আগে গাড়ী পেতেই হবে। একটা সময় আমি দেখলাম একা হাঁটছি, একদম একা।সামনে রিঙ্কুদারা বা পোর্টাররা কেউ নেই।যেহেতু দেবাশিস কন্যা-স্টিল ক্যামেরা-ভিডিও ক্যামেরা নিয়ে হাঁটছে সেহেতু ও পেছনে আছে জানি কিন্তু হঠাৎ আতঙ্ক ও একাকিত্ব আমাকে আক্রমণ করলো প্রকৃতির ই মতো।আমি সব ভুলে দেবাশিস ও তিন্নির ধাম ধরে চিৎকার করতে লাগলাম।ছুটতে লাগলাম সেই বরফ -প্রান্তরের পেছন দিকে।কতক্ষণ ছুটেছি মনে নেই --সেসময় অনন্ত মনে হয়েছিল। বেশ খানিকটা পেছনোর পর একটা বাঁকে ওদের দেখতে পেয়ে ধরে প্রাণ এলো। পরে দেবাশিস বলেছিল তার সেসময়ের উপলব্ধির কথা---হাতে দামী ঘড়ি, পকেট ভর্তি টাকা ও দুটো দামি ক্যামেরার বিনিময়ে তখন কেউ যদি একটু গরম জল আর শুকনো পোশাক দিত আমাদের মেয়েকে ও সানন্দে তাকে সব দিয়ে দিত।মাঝপথে নাকি মেয়ে আর হাঁটতে চাইছিল না। হাঁটুগেড়ে বসে পড়ছিল বরফের মধ্যেই।চোখে মুখে বরফ বিশেষকরে কোঁকড়াচুলে জমে যাচ্ছিল।
এক অসহায় পিতা তখন সে... 

                                                                     
                                                           কাঞ্চনজঙ্ঘা সপার্ষদ--ডেলো টপ থেকে

আবার আমরা হাঁটা শুরু করলাম।এবার একসাথে তিনজন। 
এভাবেই সকাল ১০টা থেকে হাঁটতে হাঁটতে বিকেল ৪ টে নাগাদ প্রথম একটা ইলেকট্রিক পোস্ট দেখা গেল।নীচে দেখা যাচ্ছে ওখড়ে।রিঙ্কুদারা আগেই পৌঁছেছে সেখানে আমরাও পৌঁছলাম এবং আরো এক অত্যাশ্চার্য অভিজ্ঞতা হলো বিনয়ী, সুভদ্র পাহাড়ীয়া মানুষের সান্নিধ্যে।
মানুষ নন---সাক্ষাৎ ঈশ্বর সেদিন দেখা দিয়েছিলেন আমাদের প্রাণ বাঁচাবার জন্য। স্থানীয় এক কনট্রাকটরের বৃদ্ধ বাবা-মা ওখড়েতে থাকতেন তখন।বরফ পড়া দেখে ওনারা স্বামী-স্ত্রী খাবার ও রসদ তাঁদের পৌঁছে দিয়ে ফিরবেন বলে গাড়িতে উঠছিলেন তখন পাহাড়ের ওপর থেকে দাজুর পিঠে নেমে আসা মোহরের অবস্থা দেখে উনি চমকে যান।রিঙ্কুদা জোনাকীকে দেখে পোর্টারদের সাথে কথা বলে আমাদের অবস্থার কথা শোনেন
সঙ্গে সঙ্গে ওদের নিয়ে আবার নীচে নেমে উনুনটা ছেড়ে দেন ও কড়া চিনি দেওয়া গরম চা'এর বন্দোবস্ত করেন।ইতিমধ্যে ঠান্ডায় কাবু মোহর একটু ধাতস্থ হয়, আমরাও পৌঁছে যাই সেই গরম উনুন ও গরম চা'এর কাছে। উনি(নাম জানতে চাইনি কেন?::ঈশ্বর ঈশ্বর ই বলে?) আমাদের সেই আপাদমস্তক ভেজা অবস্থায় ভেজা লাগেজ ওনার নতুন মাহিন্দ্রা ম্যাক্সের মধ্যে চাপিয়ে নামিয়ে দিলেন জোড়থাং এর এক হোটেলে।হোটেল মালিককে নির্দেশ দিলেন স্থানীয় ভাষায় আর আমরা পেলাম---গরম ঘর, গরম জল, গরম চাউমিন। ওনাকে কোন ধন্যবাদ দেওয়ার কথা কি মনে পড়েছিল? নাঃ সুযোগ ই দেননি তিনি।নিমেষে যেন উধাও হয়েছিলেন।পরে গুরাসকুঞ্জের ম্যানেজারের সাথে আমাদের দেখা হয়েছিল, কিন্তু তাকে জিজ্ঞেস করে বা বিবরণ দিয়েও সেই মহৎ-হৃদয় পরিত্রাতার নাম জানতে পারিনি।
ঈশ্বরের পোশাকী নাম কে ই বা কবে জানতে পেরেছে? 

                                                       রাধা-গোবিন্দ মন্দির--কালিম্পং

ডেলো টপ থেকে ফেরার পথে একটি সুন্দর রাধা-গোবিন্দ মন্দির আছে।বিগ্রহের সামনে আমরা দুই মা' দুই কন্যা তখন।জোনাকী গান ধরলো রাধা-কৃষ্ণের স্মরণে এক মরমীয়া লোকগীতি--তুমি কোন গোয়ালিনী /রসের বিনোদিনী...
আমরা চারজন কাঁদছিলাম নিঃশব্দে ।চোখের জল বাঁধ মানছিল না কেন?  
মন্দিরের পুরোহিত অবাক চোখে দেখছিল আমাদের চারজনকে।
অন্তর্লোকে হয়ত স্বয়ং ঈশ্বর ও।।

(ছবি- দেবাশিস ঘোষ)



বালাজীর ডাকে

দেবপ্রিয়া সরকার

বিবাহ পরবর্তী  ভ্রমণের উদ্দেশ্যে যে বছর প্রথম দক্ষিণ ভারত গিয়েছিলাম, সে বার কন্যাকুমারী কেরালার সামুদ্রিক সৌন্দর্য্য এবং নীলগিরি পর্বতের নৈসর্গিক দৃশ্যপট উপভোগ করতে করতে দক্ষিণ ভারতের সবথেকে  জনপ্রিয় তীর্থস্থান তিরুপতি দর্শন বাকি রয়ে গিয়েছিল কোনো এক দৈবিক প্রভাবে যখন আমার সদ্যজাত কন্যা নার্সিং হোমের নিওনেটাল ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে বিপদের সাথে লড়াই করছিল সেই সময় আমার স্বামী হঠাৎ তিরুপতি বালাজীকে স্মরণ করে ফেলেছিলেন এবং মনে মনে ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন যে, মেয়ে বিপন্মুক্ত হলে তাকে নিয়ে তিরুপতি দর্শনে যাবেন কিন্তু মেয়ের বয়স পাঁচের কোঠায় পৌঁছে গেলেও মনের সেই বাসনা অপূরণই রয়ে গিয়েছিল
                                               এবছর পূজোর ছুটিতে বদ্ধপরিকর চিত্তে বালাজীর দর্শনে যাব স্থির হল সমস্ত বাধাকে দূরে সরিয়ে রেখে সওয়ার হলাম ছুটির উড়ানে প্রথম গন্তব্য চেন্নাই কিন্তু সেখানে পৌঁছে তিরুপতি দর্শনে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করতেই বাঁধলো বিপত্তি সেটি ছিল দিপাবলীর প্রাক্ মুহূর্ত তখন নাকি তামিলনাড়ু তথা সমগ্র দক্ষিণ ভারতীয়দের তিরুপতি দর্শনের আদর্শ সময় বাইরের দর্শনার্থীদের এই সময় না যাওয়াই শ্রেয় ভিড়ের কারনে কোন ট্রাভেল এজেন্টও স্পেশাল টিকিট দিতে নারাজ অতঃপর ত্রাতার ভূমিকায় মুঠোফোনের অন্তর্জাল অনলাইনে তিনশো টাকার টিকিট পাঁচশো টাকায় কেটে আমার স্বামীর মুখে তখন যুদ্ধ জয়ের হাসি!



                                          সঙ্গে বয়ঃজেষ্ঠা মা শিশুকন্যা থাকায় কাকভোরে বাসে যাওয়ার রিস্ক নেওয়া গেল না তাই উপায় ভাড়া করা গাড়ি চার ঘন্টা ডেকান ট্র্যাপের চড়াই -উৎরাই এবং তিরুমালার পাহাড়ী পথ পেরিয়ে শেষমেষ পৌঁছানো গেল তিরুপতি মন্দিরে স্পেশাল টিকিট কেটেও দু' ঘন্টার ওপর লাইনে দাঁড়াতে হল দর্শনের অপেক্ষায়! যাঁরা স্পেশাল টিকিট কাটেননি তাঁরা জানালেন তাঁদের প্রতীক্ষা আট থেকে দশ ঘন্টা ছাড়িয়েছে
                                          অনবরত 'গোবিন্দা গোবিন্দা ' ধ্বনি শুনতে শুনতে, লোহার খাঁচার ভেতরে  সর্পিল লাইন পেরিয়ে, চার পাঁচটি সিকিউরিটি চেকিং অতিক্রম করে যখন মূল মন্দিরের সম্মুখে পৌঁছালাম তখন গর্ভগৃহের স্বর্নালী ছটায় দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছিল কয়েক সেকেন্ডের দর্শন তারপর আবার লাইন প্রসাদ নেওয়ার এই মন্দিরের প্রণামীর বহর অন্যতম দর্শনীয় জিনিস প্রসাদ লাড্ডু সংগ্রহের পর দেখতে গেলাম ভারতের এই অন্যতম বিখ্যাত মন্দিরের কর্মকান্ড যদিও নিরাপত্তার ঘেরাটোপে বেশিরভাগটাই রয়ে গেল অদেখা এমনকি তোলা গেল না ছবিও এতোটা পথ যাত্রা অনেকটা সময় দাঁড়িয়ে থাকার ক্লান্তির মাঝেও মনের মধ্যে ছড়িয়ে রইল এক পরম প্রাপ্তির আনন্দ


(ছবি- শৌভিক রায়)



পুরীধাম জয়জগন্নাথ দর্শন
      সম্পা দত্ত

প্রকৃতির রুপ অপরুপ রুপতার,
সাগরবেলায়, বালুতটে মন, ডাকে আরবার,,
নেশা লাগে চোখে, সূদুরের হাতছানি বারবার !!
ভ্রমণ পিয়াসী মন ছুটে যায়, চোখ খোঁজে কোন অজানায়!!
সব মানুষ ভ্রমণ বিলাসী। আমিও কম নই। কোথাও বেড়াতে যাবার আলোচনা উঠলেই মন নেচে গেয়ে ওঠে--- "মন মোর মেঘের সঙ্গী/ উড়ে চলে দীগ দীগন্তে পাণে/ নিঃসীম শূণ্যে ------"।
নুতন নুতন জায়গা, সেখানকার কৃষ্টি লোকাচার,পরিবেশের সাথে পরিচিত হতে ভীষণ ভাললাগে।  আর বেড়াতে যাওয়া সে কাছে পিঠে হলেও ক্ষতি নেই। প্রাকৃতিক দৃশ্য নয়নলোভা হলেই যথেষ্ট।
      পাহাড়, সাগর দুটোই টানে আমাকে। তবে কদিন আগেই পাহাড়ে ঘুরে আসার সুবাদে সাগরের দিকেই যাবার টিকিট কাটা হল। এমনি করেই তল্পিতল্পা গুটিয়ে সপরিবারে ও সাথে পারিবারিক বন্ধুর পরিবার নিয়ে জগন্নাথ দর্শণে বেড়িয়ে পড়লাম। জগন্নাথ ধাম পুরী।
নিউ কোচবিহার স্টেশন থেকে গৌহাটি এর্নাকুলাম এক্সপ্রেসে আমরা রওনা হলাম দুপুর ১২:৩০ মি: নাগাদ।
আমরা বড়রা বাদেও ছোটোরা ডালিয়া, ভাস্কর, পাপিয়া বন্ধু স্বপন দার ছেলে সৌরভ। দুপুর রাত দুবেলার খাবার নিয়ে। সবাই মজা করতে করতে ছুটন্ত ট্রেনের জানালা দিয়ে দৃশ্য উপভোগ করতে করতে চললাম।
আহা! প্রকৃতির ছুটন্ত রুপ যেন কত ব্যস্ততা। একসময় বিকেলের সূর্য দীগন্তরেখায় অস্তরাগের আবীর ছড়িয়েছে। ধীরে ধীরে রাত্রির নিঃস্তব্ধতা ডেকে পাটে বসলেন সূর্যদেব।
সবাই আনন্দ করে, রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। আটটা তেই সবাই ট্রেনে ঘুমিয়ে পড়ল কেউ জেগে রইল। চলতি পথে হকার, মানুষজন সব মিলিয়ে অনেক অভিজ্ঞতা হল।
মাঝে মাঝে স্টশনের কলরব। পরদিন আবার একই গতিতে ট্রেন ছুটছে। আমরা প্রথমে ভুবনেশ্বর নামব, পরে পুরী যাব। কোলকাতা ছেড়ে ট্রেন চলতে লাগল। পথের দুপাশে অপরুপ ছোট ছোটো টিলা পাহাড় মেঘ যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। কটক স্টেশনে নামলাম সবাই ট্রেন লেট ছিল বলে। নেতাজীর জন্মস্থান বলে কথা মন কেমন এক অজানা আনন্দে ভরে উঠল।
বেলা ১:৩০ মিঃ ভুবনেশ্বর স্টেশনে পৌঁছলাম। সেখানে আমার ভাসুর, ভুবনেশ্বরেই চাকরী করেন ।ইনকাম ট্যাক্স অফিসার,  শঙ্কর বোস দাদা ।নিজ বাড়ি রাঁচীতে, তিনি সব ব্যবস্থা আগে থেকে করে রেখেছিলেন। আমাদের গাড়ি করে হোটেলে নিয়ে গেলেন। হোটেল লিঙ্গরাজ। অত্যাধুনিক সুসজ্জিত হোটেল। সবাই দাদাকে সেখানে সন্মান করেন। আমারাও ভীষণ যত্ন আত্তি পেলাম। বোসবাবুর পরিবারের লোক বলে কথা।দাদা আমাদের কোনো টাকা পয়সা দিতে দেননি হোটেলে থাকার। তিনি সব মিটিয়েছেন।
হোটেলে ফ্রেশ হলাম সবাই যে যার রুমে। সুপার ডিলাক্স রুম। একদিনের ট্রেন জার্নি, দুপুরে হোটেলের নীচে খেতে গেলাম। যেন স্বপ্নপুরী বাইরে সূর্যের আলো ঝলমলে অথচ রুমের ভীতরে নীলাভ মায়াবী আলো মায়াময় পরিবেশ। খাওয়া সেরে একটু বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে কাছাকাছি জায়গা দেখতে বের হলাম। উদয়গিরি খন্ডগিরি গুহা পর্বত।
হোটেল থেকে ঠিক করে দেয়া ট্রেকার করে প্রথমে আমরা দাদা'র ফ্ল্যাট ঘুরে গুহাপর্বত দেখতে এলাম। অপূর্ব শিল্পীর শিল্পকীর্তী পাহাড় কেটে নানা রুপ দিয়েছে। উঁচু পাহাড়। অনেক গাছ তার উপড় বাঁদর লাফালাফি করছে, মানুষ দেখলে ওদের দৌরাত্ম বেড়ে যায়। সেখানে উড়িয়া ফিল্মের স্যুটিং চলছিল। আমি ডালিয়া (ভাসুর ঝি ) দুজন নীচে থেকে গেলাম। বড় রা বাচ্চাদের নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উপড়ে উঠে গেল। কিছুক্ষন পর নীচ থেকে দেখছি স্লিপার রাস্তা দিয়ে দৌড়তে গিয়ে ভাস্কর, পাপিয়া, সৌরভ তিনজনেই হুমড়ি খেয়ে নীচে গড়িয়ে আসছে। সবাই কিংকর্তব্য বিমূঢ় উপায় নেই। পাপিয়া, সৌরভের অল্পের উপড় দিয়ে গেল কিন্তুু ভাস্করের মারাত্মক অবস্থা পা বেঁকে গেছে হাটতে পাচ্ছে না। সবাই অস্থির। গাড়ির চালক খুব ভাল মানুষ হেল্পফুল। বোসদা কে ফোন করা হল তিনি দ্রুত চলে এলেন ভুবনেশ্বরে #ক্যাপিটেল হস্ পিটালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করালেন। এক্স রে অষুুধ দিয়ে ছেড়ে দিলেন। সবার মন খারাপ সমূদ্র, জগন্নাথ দর্শন আর হবেনা, অতএব ফিরতি টিকিট কাটতে হবে। আমি ডালিয়া, পাপিয়া ট্রেকারে বসে থাকলাম গাড়ি চালক আমাদের পাহার়া দিচ্ছেন। ওরা নার্সিং হোমে। খুব ভাল গাড়িচালক, বলছিল ম্যডাম ভয় পাবেন না আমি আছি।সত্যি সে খুব ভালো মাণুষ।
মন খারাপ করে হোটেলে ফিরলাম। পরদিন ব্যথা কম থাকাতে আবার রওনা হলাম নন্দন কাননের উদ্দেশ্যে। পথে সকালের জলখাবার খেয়ে নিলাম । নন্দন কাননে পৌঁছলাম বারোটায়। সেখানে হুইল চেয়ার ভাড়া পাওয়া যায়। আমরা হেঁটে, ভাস্কর হুইল চেয়ারে করে ঘুরল। অনেক বড় নন্দন কানন, সম্পূর্ণ ঘুরতে তিনদিন সময় লেগে যাবে গাইডের কথা অনুসারে। আমরা জীব, জন্তুু, পাখি, ময়াল সাপ, বাঘ, সিংহ, শিম্পান্জী দেখলাম। খুব ভাল লাগছিল ঘুরে ঘুরে দেখতে, ক্যামেরা দিয়ে ছবিও তোলা হল।
ফেরার তাড়া ছিল, বিকেলেই আমরা পুরী রওনা হব। খেয়ে বিশ্রাম নিয়ে, দাদার কাছে বিদায় নিয়ে চললাম পুরীর উদ্দেশ্যে, প্রথমে কোনার্কের সূর্য মন্দির দেখে নিলাম। অপূর্ব শিল্পের সৃষ্টিসম্ভার। পাথর কেটে কতরকম দেবদেবীর মূর্তি মন্দিরের দেয়ালে। রথের চাকা পাথর কেটে তৈরী। মন্দিরের ছায়া কোনোদিন মাটিতে পড়েনা গাইড সব সুন্দর করে বোঝাতে লাগল।
নাবিকরা দিক নির্নয়ের জন্যে মন্দির তৈরী করেন। সমুদ্র দূরে সরে গিয়েছে। এইসব নানারকম  তথ্য সম্ভার বলতে লাগলেন।
মন্দির খুব ভাল লাগল। ভুবনেশ্বরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে নানা মন্দির অপূর্ব পাথর শিল্প ।
মন্দির দেখে আবার চললাম, চলছে তো চলছে, সামনে আকাশ নীল হয়ে আসছে ফাঁকা ধূধূ নীল আর নীল, জিজ্ঞেস করতেই চালক বললেন সমুদ্র কাছে এগিয়ে আসছে । মনে মনে চাপা উত্তেজনা অনুভব করছি সমুদ্র দেখার, প্রথম দেখব তাকে। সন্ধ্যে নেমে আসছে। ছোটোছোটো বাচ্চা বয়স্ক সবাই পাথরের জিনিষ ফেরী করছে। কিনে নিলাম নবগ্রহ, জগন্নাথ, সুভদ্রা, বলরাম' কে।
আবার চলা। এবার সাতটা বেজে গেল। চালক বলতে লাগলেন সামনে বীচ আছে চলুন দেখবেন। সামনে আসতেই আমরা নামলাম গাড়ি থেকে।
বীচে প্রচুর লোকের সমাগম। সমুদ্র ভীষণরকম তর্জন গর্জন করছে । পূর্ণিমায় ভরা জোয়ার। উথাল পাথাল ঊর্মিমালা। আমি অস্থির রকম ভয়ঙ্কর  চিৎকার জুড়়লাম। ডালিয়া আমি দুজন দুজন কে আনন্দে জড়িয়ে ধরলাম। আমাদের অবুঝপনায় বড়রা হাসতে লাগল।কি গর্জন শব্দ চঞ্চল সে-- প্রথম সমুদ্র দেখার অনুভুতি আজও ভুলিনি।




ভাস্করের পা সামান্য ফুলে আছে। বেশিক্ষণ সেখানে থাকা হল না রাত হয়ে আসছে। আবার বসলাম গাড়িতে । এবার তিন ঘন্টা পর জগন্নাথধাম পুরীতে পৌঁছলাম। আমরা ভারত সেবাশ্রম সংঘে সবাই বসে সন্ধ্যা আরতি দেখলাম। ছেলেরা হোটেল দেখতে গেল। সী ফেস হোটেল স্বর্গদ্বারের পাশেই হোটেল হেভেন, সেখানে গিয়ে উঠলাম। খুব সুন্দর, রুম থেকেই সাগরের উচ্ছাস দেখা যায়। করিডরের সামনে লন, বসে বসে অগুণতি ঢেউ গোনো। কি অপরুপ রুপ।
সেদিন রাতে খেয়ে শুয়ে পড়লাম পরদিন সমুদ্রে স্নান জগন্নাথের পূজো অনেক কাজ। রাতেই হোটেলে পান্ডা এসে পরদিনের পূজোর ব্যবস্থা, টাকা পয়সা কত কি লাগবে হিসেব দিয়ে গেলেন।  পরদিন সকালে সমূদ্রে সূর্য ওঠা দেখলাম। কি অপূর্ব লাগছিল দেখতে, ডিমের লাল কুসুম সূর্য়টাকে। বেলা বাড়লে সমূদ্র স্নানে চললাম। পরম আত্মতৃপ্ততা। অনেক ভাললাগা। বালুতটে বসে সমুদ্র দেখা অসাধারণ। আমরা স্নানে নামতে পাপিয়া কে নিই নি ছোটো বলে। কিনাড়ায় বসে ছিল। হঠাৎ চোরাবালিতে পা ডুবে যাচ্ছিল আমার,, তল পাচ্ছিলাম না। তাই দেখে মেয়ের কি কান্না সবে ছ'বছর বয়স।কথিত আছে সমুদ্র কিছইু নেয় না, নিলেও ফিরিয়ে দেয়। সেদিন হঠাৎ এক মৃতদেহ ঢেউয়ের জোয়ারে কিনারায় ফিরে এসেছিল।  পরে একজন টেনে ধরে সে যাত্রায় মুক্তি পেলাম।
স্নান সেরে মন্দিরে পূজো দিতে গেলাম। প্রসঙ্গতঃ বলে রাখি পা ব্যথা নিয়ে ভাস্কর সবার কোলে কোলে ঘুরছে।
সাম্প্রতিক কালে ও ভাল আছে,বড় হয়েছে,  এখন একজন ডাক্তারি ছাত্র।
আবার পূজোর কথায় আসি। প্রচন্ড ভীড় ঠেলে মন্দিরে গর্ভগৃহে পৌঁছলাম সিংহদূয়ার দিয়ে। মন্দিরে ঢুকতে চারটি দরজা। ভিতরে তিনভাইবোনের দারুমূর্তি। কূপন কেটে ভোগ দেয়া হল। কথিত আছে জগন্নাথের ভোগ খেয়ে শেষ করা যায় না। ঠিক তাই আমরা ছোটোতিন হাড়ি ভোগ, এগারোজন মিলে খেয়ে ও শেষ করতে পারিনি। মাধব মিশ্রজীর তত্বাবধানে সব সুষ্ঠুভাবে হয়ে গেল।




একটা অটো ভাড়া করে, মাসীর বাড়ি, গুন্ডিচা মন্দির, সিদ্ধবকুল,চৈতন্যদেবের পায়ের ছাপ। চৈতন্য চারণ ভূমি পূরীধাম। সোনার গোপাল, আঠারোনালা, রাজবাড়ি সব ঘুরে ঘুরে দেখলাম, কিছু জায়গায় পূজো দেয়া হল। গাইড দেখাতে লাগল জগন্নাথের ভোগঘর, পর পর হাড়ি বসিয়ে রান্নাহয়। সারাবছর নিজেদের জমির ফসল চাল ডাল উৎপাদিত করে জগন্নাথের ভোগ হয়। স্বাদে গন্ধে অতুলনীয় সেই ভোগ।
আবার ফিরলাম হোটেলে। রাতে সমুদ্র দেখে পাড় দিয়ে সবাই হাটলাম, বসে থাকলাম। পরম শান্তি। মনে হতে লাগল কাছে পিঠে হলে এখানেই বসে কাটিয়ে দিতাম সময়। যাই হোক আবার পরদিন স্নান খাওয়া শেষে, রওনা হলাম চিল্কার উদ্দেশ্যে। গ্রামের মেঠো পথ, শহর ছেড়ে এগোতে লাগল। নারকেল গাছ সমুদ্রে কিনারায় সার বেঁধে দাড়িয়ে। বঙ্গোপসাগরের সংগম মিলনস্থল, নদীর সাগরের মোহনা। চিল্কায় পৌঁছে বাঙালী হোটেল পেলাম, সেখানে টাটকা চিংড়ির ঝোল, সবজি ডাল চাটনি পাপড় দিয়ে ভাত খেয়ে নিলাম সকলে। হোটেলের পাচক কুচবিহারের লোক, আমরা কুচবিহার থেকে গেছি জেনে ভীষণ খুশি, দেশের বাড়ির লোক কত মজা পেলো। কাজু কিস্ মিস্ খেতে দিল, হাত ধুতে ওয়াশরুমে গেলে। কত গল্প করল সে, ------ পুরীতে অড়হড় ডালে প্রচলন। জগন্নাথ নাকি ভীষণ পছন্দ করেন।
খেয়ে আমরা চললাম জলবিহারে। ঘাটে ভুটভুটি সার দিয়ে দাড়ানো, দাম করে টিকিট কেটে বসে পড়লাম। ডালিয়ার জল দেখে ভয়। তবুও চললাম ছোট ছোটো সমান তালের ঢেউ কেটে চলছে। মাঝে মাঝে ডলফিনের উঁকি। হালকা হাওয়া দিচ্ছে:। অক্টোবরের শেষের দিক, ঠান্ডা সবে পড়ছে। সেখানে অনেক লাল কাঁকড়া দেখলাম। তিনঘন্টা চিল্কাহ্রদে চলল জলবিহার। বঙ্গোপসাগরের মোহনার বালুতটে শিশুসুলভ আচরণে প্রচুর ঝিণুক কুড়ালাম। যত্ন করে রেখে দিয়েছি সেগুলো। নুলিয়া বাচ্চাদের সাথে ছবি তুলল আমাদের বাচ্ছারা।
অনেক মজা করে রোদে পুড়ে ঝিণুক কুড়িয়ে,  আবার হোটেলে ফিরলাম। পরদিন আবার জগন্নাথ মন্দিরে ঠাকুর দর্শণে গেলাম। দর্শনীয় স্থান দেখলাম। প্রচুর কেনাকাটা করলাম সবাই,ঘরে ফেরার অপেক্ষায়, প্রিয়জনদের উপহার দেবার জন্য।সেখানে বাঙালী হোটেল বৌদির হোটেল, দারুন রান্না।
ঘরে ফেরার টান থেকেই যায়। অনেকদিন হল বাইরে। ফেরারদিন সকালে গেলাম ধবলগিরি বা ধৌলী, কলিঙ্গ যুদ্ধক্ষেত্র এইসব দর্শনীয় স্থান চাক্ষুষে দেখে নিতে। প্রতিটি জিনিষ অসাধারণ দেখতে। কাহিনি রচনায় অনেক কিছুই বাদ থেকে গেল । দুপুরে আকাশ কালো করে মেঘ করল। বৃষ্টিও অনবরত শুরু হল, তবুও সাগরনীল তার বুকে শত সহস্র ঊর্মমালাকে জায়গা করে দিচ্ছে। আমাদের ফেরার সময় স্টেশনে যাব। মেরিন ড্রাইভ দিয়ে গাড়ি এগোচ্ছো দু চোখ দিয়ে সমুদ্র দেখছি। ছেড়ে আসতে মন চাইছিল না। চোখ দিয়ে জল চলে আসছিল আমার। আস্তে আস্তে পিছনে ফেলে এগিয়ে এলাম,, দূরে সরে যাচ্ছে পুরীর সমুদ্র, কি কষ্ট যন্ত্রণা চেপে স্টেশনে চলে এলাম । কোলকাতার ট্রেন। সেখানেএ দিন কয়েক থাকব। তারপর কুচবিহার ফিরব। সেখানে ও কত অজানা ইতিহাস আছে জানবার। পুরী একবার নয় বারবার যাওয়ার সুন্দর এক স্থান,,, হিন্দুদের পবিত্র সেরা চার ধামের এক সেরা তীর্থস্থান।
এরপর আবার নুতন করে কোলকাতার গল্প জমে উঠবে!!! সমুদ্দুরের কথাই স্মৃতির পাতায় সোনার অক্ষরে উজ্বল হয়ে থাক মনের মনি কোঠায়।
ভ্রমণ কাহিনী লেখা অনেক শক্ত কাজ। আমার চোখে দেখা অনুভুতি টুকুই ধরে রাখলাম। দেখতে দেখকে বারো বছর একযুগ পার হয়ে গেল। তবু ও তুমুল অসম্ভব স্মৃতিতে বেঁচে থাকবে পুরী ভ্রমণ জগন্নাথ ধাম দর্শণ।
প্রণাম বাবা জয় জগন্নাথ !!



(ছবি- সংগৃহীত)





লাক্ষা মিনিকয় ভ্রমণ
     প্রতিভা দে
  
আমার বাড়ি আসাম ।এখান থেকে গেলাম কেরল ।কেরল থেকে ভ্রমণ শুরু হলো । গিয়ে উঠলাম একটি দ্বীপে
সখানে শুধু বালি এমন যেন পাউডার।
কিন্তু পায়ে সেন্ডেল পরতে হয় করাল ঢুকে যেতে পারে।
আছরে পড়া সমুদ্রের ঢেউ বসে আছি পারে ।পারে ভেসে আসছে জেলি ফিস,
সামুক,ঝিনুক, একটা অক্টোপাসের বাচ্চা ও এসে ছিল অনেকেই ওটার সথে
ফটো নিল ,তার পর একজন বলল এমাছ কাঁচা খাওয়া যায় বলেই টেনে ছিড়ে খেতে শুরু করল ,জলথেকে তোলার সাথে সাথে মাছটা ও মরে গেল।
     চারিদিকে শুধু নারকেল গাছ আমাদের একটা একটা ডাব খেতে দিল।
দুপুরে লাঞ্চ দিল ওখান কার অধিবাসীদের রান্না নিজে নিয়ে খেতে হয়
প্রচুর আইটেম মাছ, মাংস তরীতরকারী ও ছিল রাইতা দই দিয়ে তৈরী।খাওয়া দাওয়া র পর ওখান কার অধিবাসীদের নৃত্য গান দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ কাট লো।



  ফিরে এলাম জাহাজে।আমাদের জাহাজের নাম ছিলো"টীপুসুলতান"
আবার সারারাত ধরে জাহাজ চলল 
সকাল সকাল আবার অন্য দ্বীপে
সে দ্বীপ ছিল সমুদ্র টা বেশি গভীর নয় বেশি দূর পর্যন্ত অনেকেই হেঁটে অন্য ছোট ছোট দ্বীপ গুলো ঘুরে এলো।
আবার তেমনি খাওয়া দাওয়া নৃত্য গীত
ক ইবু জাতী ,মিনিকয় দ্বীপের অধিবাসী।
 আবার এলাম অন্য দ্বীপে
পৌঁছে গেলাম দ্বীপে ।বড় জাহাজ অনেক সময় আইলেন্ডর কাছাকাছি পৌঁছাতে পারে না জলের লেভেল কম থাকে বলে
তখন জাহাজ থেকে নেমে বোটে করে কিনারায় যেতে হয়।জাহাজ থেকে নেমে বোটে ওঠা খুব রিসকি।কারণ সমূদ্রের ঢেউ এ দোলা বোটের উপর ঢেউ খাওয়া জাহাজ জাহাজের পাটাতন উচুতে তা থেকে নামতে হয়।জাহাজের লোকেরা সাহায্য করে নামতে ,না হলে দুটোর মাঝখানে পড়ে গেলে থেতো।
  জাহাজে একজন নার্স থাকেন।কিছু ঔষধের ব্যবস্থা থাকে।



 অনেক পেগনেন্ট মহিলা আইল্যান্ডে চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকে না বলে শহরে যায় ।এমনকি জাহাজে সন্তান প্রসব করে ফেলে।খুব কম বয়সী মেয়েদের বিয়ে হয়ে যায়।
আর একটি আইল্যান্ড পৌঁছনোর পর দেখলাম সে এক অপূর্ব দৃশ্য।যত প্রটার
ছোট ছোট কড়ি শঙ্খ জীবন্ত হেঁটে চলছে।
জীওলজীর কিছু স্টুডেন্ড ওরা ও গুলো ধরে ধরে পরীক্ষা নিরীক্ষা করছে।একটি ও জীবন্ত গুলো যাতে না মরে সে গুলো কে সাবধানে ছেড়ে দিচ্ছে।
কিছু ম‍রে থাকা খোল তুলে নিলাম স্মৃতি হিসেবে।কিন্তু কোন ঝিনুক বা কিছু কমে যাচ্ছে বলে পাড় থেকে নেওয়া মানা করা হচ্ছে।


  সেখান থেকে ঘুরতে গেলাম শহরে সর্বত্র নারকেল গাছের সারি তার ফাঁক দিয়ে চলছে আমাদের বয়ে নেওয়া ছোট ছোট গাড়ি মেটাডোর। নিয়ে গেল মিউজিয়াম জীবন্ত সামুদ্রিক প্রানী, মাছ যেমন শার্ক, তিমির বাচ্চা, অক্টোপাস,
অন্যান্য আরও অনেক সমুদ্রের করাল,
শঙ্খ শামুক দেখতে পেলাম। 
কোথায় ও দেখতে পেলাম গেঞ্জি তৈরী শিল্প সেখানে কিছু কেনা কাটা করলাম।
   আবার বোটে করে ছোট ছোট দ্বীপে নিয়ে গেল যেখানে জলের গভীরতা কম
এবং সামুদ্রিক সাপ।মাছ রঙিন মাছ ,বড় বড় মাছ সব চোখে দেখতে পেলাম।
 সব অদ্ভুত দৃশ্য সেই সাথে সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গ পড়ে গেলে বাঁচাতে পারব কিনা সেই ভয়। 
 এক ভয়ংকর অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে এলাম আবার জাহজে।জাহাজ আবার শুরু করল চলতে ,বিশাল সমুদ্র আরব সাগর ।ভারতের পশ্চিমে লাক্ষা মিনিকয় 
দ্বীপ ছোট ছোট দ্বীপ ।সেখানে থাকে অনেক লোক।নারকেল, মাছ প্রধান ব্যবসা ,জীবিকা।
জাহাজ টিপু সুলতান বিরাট ।জাহাজটা
ঘুরে ঘুরে এ প্রান্ত থেকে ঐ প্রান্ত হেঁটে হেঁটে সমুদ্রের দৃশ্য উপভোগ করতে করতে চলছি ।দুলছে দুলছে।


জাহাজ যখন ছাড়ে সেটাও উপভোগ্য
একটা একটা করে দড়ি ছাড়তে থাকে
বেলেন্স রেখে যাহাতে জাহাজ কোন দিকে বেশী কাৎ হয়ে পড়ে।যদি ও 60ডিগ্রী কাত পৃথিবীর তার মেরুদন্ড তে থাকে তাই জাহাজ ও ততটা হেলে থেকে চলে সেটা মাধ্যাকর্ষনের নিয়মে চলে।জাহাজের বেলেন্স সব সময় পরখ করা হয়।ছাড়া বা নোঙর করার সময়
মানুষ কে সাবধান করে দেওয়া হয়যাতে
মানুষ ঠিক বেলেন্স এ থাকে।
এক একটি দড়ির মূল্য একলাখ টাকা
  ভিতরে রূমগুলো এয়ার কন্ডিশনার,
প্রচুর জল ,সমুদ্রের জল মোডিফাইড করে ব্যবহার যোগ্য করা হয়।
খাওয়ার জল পার থেকে কিনে নেওয়া।
মাঝ সমুদ্রের বালী হাঁস ,ডলফিন দৃশ্য গোচরে আসে।ফেনীল সমুদ্রে জল কেটে কেটে এগিয়ে যায়।
  পাইলট বোট তীর থেকে ছাড়তে বা
পৌঁছে দিতে সাহায্য করে কারণ তাদের আলাদা ট্রেনিং থাকে কোথা দিয়ে জহাজ
ঠিক ভাবে চলতে পারবে উপযুক্ত গভীরতা না থাকলে জাহাজ আটকে যাবে।
  এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা নিয়ে ঘুরে এলাম। কেরলে খুব সুন্দর নারকেল গাছের বোট সাজানো সব নারকেলের পাতা দিয়ে রুমের মত। 
 অপরূপ সমুদ্র, সমুদ্রের বুকে এক বিষ্ময়কর যাত্রা সত্যি ভুলার নয়।
জাহাজের রেলিংয়ে দাড়িয়ে সমুদ্র তার বিশালতা, দৌড়দান্ত প্রতাপ স্বচক্ষে উপভোগ করার ভাগ্য হয়ে ছিল।
 নীল সমুদ্র জায়গায় জায়গায় দেখলে মনে হয় কে যেন সিগ্রিন কালারে রং করে রেখেছে।
  সেফটি ড্রেস পরিয়ে দিত স্নান করতে গেলে। ছোট পাতলা বোট দিয়ে নিজে
ড্রাইভ করার ব্যবস্থা ছিল।
সব সময় কিছু লোক প‍রখ করত কেউ যেন ডুবে না যায়।
   জাহাজে সব কিছুই পাওয়া যায় তবে
দামটা একটু বেশি।
 খেলার যায়গা আছে। একটা হেলিকপ্টার অনায়াসে নামতে পারে যাতে কেউ অসুস্থ হলে খবর ক‍রে নিয়ে যাওয়া যায়। কোন প্রকার বিপদ হলে
কাছে ধারের জাহাজ কে খবর পাঠানো যায় তেমন হকি টকির মত ব্যবস্থা।
লাইট সংকেত।  কোন প্রকার অন্য জাহাজেসাথে টোক্কর না হয় তার জন্য লাইট সংকেত সামনের, পেছনের।
লাইফবোট খাবার বিস্কিট যদি টাইটানিক এর মত ঘটনায় পরে ।ছোট ছোট বোট বাধা থাকে ।
 কম্পিউটার দ্বারা পরিচালিত।
কোথায় ও আগুন লাগলে কোথায় লেগে ছে  সংকেত পৌঁছে যায় জাহাজের সকল কোনে।
   এতো ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও সকল সময়
এক ভয় ভালো লাগা সব নিয়ে এক
অপূর্ব অনুভূতির  ভ্রমণ কোন দিন ভোলার নয়।
(ছবি- লেখিকা)


এ বঙ্গ ভান্ডারে তব বিবিধ রতন...

অরণ্যের ভেষজ ভালোবাসা
শিবু মণ্ডল

সেবারে কলেজে ফার্স্ট ইয়ার,না সেকেন্ড ইয়ার, হ্যাঁ সেকেন্ড ইয়ারই হবে। মায়াশহর জলপাইগুড়িতে মেসে থাকি। ইচ্ছে করলে সপ্তাহান্তে বাড়ি যাই নয়ত যাই না। কলেজ ও পড়াশুনার ফাঁকে ফাঁকে এদিক ওদিক সাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়াই একা নয়ত বন্ধুদের সাথে। সময়টা এপ্রিল- মে হবে।এক সন্ধ্যায় দোতলায় মেস কাকিমার ঘরে কিরিদিং কিরিদিং ল্যান্ডফোন বাজে। মনে হল আমার ফোন এল নাতো! তখনও মোবাইলের চল শুরু হয়নি। তাই মেসের কারও ফোন এলে মালকিন কাকিমার ঘরের ফোনেই আসে সে ঘরের লোকের হোক বা কোনও বান্ধবীর। সে হাঁক দিয়ে ডাকে আমাদের। তাই ফোনের আওয়াজেই সবার মনে সু ডাকত – ‘আমায় কেউ মনে করেছে না তো !’ সেদিনের ফোনটি ছিল কলকাতা থেকে আমার এক জ্যাঠতুতো দিদির। ও আর ওর এক বান্ধবী আসবে শিলিগুড়ি আমাদের বাড়িতে ঘুরতে। আমি বললাম আয় ভালো কথা, সে বলল আমাদের নর্থবেঙ্গল ঘোরাতে হবে। আমি বললাম অবশ্যই ঘুরাব। উত্তরবঙ্গের প্রাকৃতিক বৈচিত্রের মধ্যে লালিতপালিত হওয়ায় আলাদা করে তখনও উত্তরবঙ্গ ভ্রমণের কথা ভাবিনি । যখন যেখানে ইচ্ছে ও সুযোগ হয়েছে চলে গেছি- কখনো মিরিক, কখনো দার্জিলিং- পাহাড়ই বেশি পছন্দের ছিল। অরণ্য মানে অভয়ারণ্য ঘোরার কথা তেমন মাথায় আসেনি কোনদিন কারণ শিলিগুড়ি ছোট শহর হলেও চারিদিকে বনাঞ্চল পরিবেষ্টিতই বলা চলে। আবার আমাদের বাড়ি যেখানে সেখান থেকে দু’পা পূবে গেলেই বৈকুন্ঠপুর ফরেস্ট। যখন তখন চলে যাই বন্ধুবান্ধব মিলে জঙ্গলের ভিতরে কোনও নেপালি বস্তীতে মাছ ধরতে বা ভুট্টা আনতে। আর শীতের সিজনে তো পিকনিক লেগেই আছে।
মঞ্জুদির ইচ্ছে নর্থবেঙ্গলের বনজঙ্গল ঘুরে দেখবে। তা ঠিক হল জলদাপাড়া অভয়ারণ্য ঘুরতে যাব। কিন্তু খোঁজখবর নিয়ে বোঝা গেল যেএভাবে এক-দু’দিনের নোটিশে সেখানে সরকারী ফরেস্ট বাংলো বুক হয় না। তার জন্য তিনমাস আগে চিঠি লিখে আবেদন করতে হয় আর সৌভাগ্যক্রমে ঘর খালি পেলেও শেষমুহুর্তে কোন না কোনো মন্ত্রী বা আমলার আগমনে তা খারিজ হবেই হবে। তবে ট্যুরিস্ট ডিপার্টমেন্টের মাধ্যমে জানতে পারলাম যে অভয়ারণ্যে ঢোকার মুখে একটি প্রাইভেট ট্যুরিস্ট লজ আছে সেটা খালি থাকলে ঘর পেয়েও যেতে পারিসেই ভরসাতেই মঞ্জুদি ও নমিতাদির সাথে শিলিগুড়ি থেকে আলিপুরদুয়ারগামী বাসে চেপে বসলাম সকাল সকালযেতে যেতে নিজেদের মধ্যে প্ল্যান করে নিচ্ছি যে যদি থাকার কোনও বন্দোবস্ত না হয় তবে দিনে দিনে ঘুরেই চলে আসব। মাদারিহাটে নেমে লোকাল জিপে করে দশমিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেলাম অভয়ারণ্যের গেটে। জঙ্গলে গেলে নাকি ভূতে পায় ছোটবেলায় শুনেছি। সবুজ রৌদ্রের ঘনঘোরে যেন আমাদেরও ভূতে পেয়েছিল সেদিন। নিস্তব্ধতার মধ্যে যেন অচেনা আওয়াজ করে গেট খুলে গেল। ভেতরেই সাজানো পরিসরে ছায়া রঙের একটি একটি বাংলো।আর কোনো দিকে দিকে যাবার রাস্তা খোলা ছিল নাঅগত্যা সেই প্রাইভেট লজে গাছের মত বসে থাকা ম্যনেজারের শরণাপন্ন হতেই সেও যেন অদ্ভুত কিছু দেখছে এমন বিস্ময়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। রাত্রিবাসের জন্য রুম পাওয়া যাবে কিনা জানতে চাওয়াতেই নানারকম সন্দেহপরবশ প্রশ্ন পাতার মত ঝরতে শুরু করল। কোথা থেকে এসেছি, আমাদের পারস্পরিক সম্বন্ধ কী, এখানেই কেন এসেছি ঘুরতে? ইত্যাদি ইতাদি ! মঞ্জুদি ও নমিতাদি আমার থেকে মাত্র দু’তিন বছরের বড় হবে। বুঝতে পারলাম কৈশোর পেরনো তিনটি ছেলেমেয়ে কোনো অভিভাবকহীন হয়ে ঘুরতে আসতে পারে তাও আবার এরকম বনেজঙ্গলে- এটা যেন সেই ম্যনেজারটি মানতে পারছিল না। ম্যনেজারকে মরিয়া হয়ে বোঝাতে চেষ্টা করতে লাগলাম। অবশেষে সে যখন রাজি হল তখন ঘটনাটিকে বেশ চ্যালেঞ্জিং ও অ্যাডভেঞ্চারাস্‌ মনে হয়েছিল। ঘরভাড়া কত ছিল এখন আর মনে নেই তবে সেই কাঠের ঘরের বেশ কেমন একটা পুরোনো জল জল গন্ধ এখনও নাকে ভেসে আসে। দুপুরে আলুভাজা, ডাল আর ডিমের ঝোলভাত খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম চারপাশটা একটু ঘুরে দেখতে। বাংলো লাগোয়া মাঠেই চিড়িয়াখানা নয় তবে একটি খাঁচায় কতগুলো হরিণকে বন্দি করে রেখেছে দেখে অবাক হলাম। আমরা যেমন বাড়িতে খাঁচায় হাঁস মুরগি পালি তেমনই। আমি ভাবি জঙ্গলেও কেন এদের খাঁচাবন্দি করে রাখা? পর্যটকদের সহজ মনোরঞ্জনের জন্য এই দৃষ্টিকটু ব্যবস্থা ! নিক্কনের ক্যামেরায় কয়েকটি ফোটো তুলতেই রিল শেষ হয়ে গেল। লজের ম্যানেজারের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম যে রিল কেনার জন্য মাদারিহাট যেতে হবে। সুসজ্জিত গাছেদের দুপাশে সাক্ষী রেখে পাথুরে রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে এগোচ্ছি বাইরে জিপ ধরার জন্য। সে রাস্তায় পড়ে থাকা শুকনো পাতা, সেই রাস্তার গায়ে লেগে থাকা গাড়ির চাকার দাগ যেন চোখ ফেরাতে দেয় না! মনে হয় যেন এই পাতা আগে কখনো দেখিনি, এই দাগ লেগে থাকা রাস্তা যেন অনেক দিনের চেনা ! বাইরে দাঁড়িয়ে আছি গাড়ির অপেক্ষায়, দু’পা তফাতেই একটি ঘুমটি দোকান, আমার নেশা ধরে যায়। দিদিদের বলি তোরা কিছু মনে করিসনা কিছুক্ষণ অন্য দিকে মুখ ঘুরে থাক আমি আসছি ওই দোকানটি থেকে। সেই বয়সের নেশা তখন হয় নেভিকাট নয় তো নয়। মঞ্জুদিদিও বুঝতে পেরে মুচকি মুচকি হেসে বলে বুঝতে পেরেছি, যা যা টেনে আয় ! আমি শুধু লজ্জাবতি হাসি হেসে ছুটে যাই আর ভাবি নিষিদ্ধ পানের এই যে ছাড়পত্র পাওয়া বড়দের কাছ থেকে তাতে যেন আমিও অনেকটা বড় হয়ে গেলাম।




অভয়ারণ্যে রাত যেন নেমে আসে নিজের বিস্তার বাড়িয়ে দিয়ে পুরোপুরি নির্ভয়ে। সেই রাত্রির ভয়ে বাংলোকে ঘিরে যে কটা হ্যালোজেন লাইট আর হলদেটে বাল্ব তারা যেন জড়সড় হয়ে থাকে। ততক্ষণে অবশ্য ম্যনেজারের যাবতীয় সন্দেহ ও জড়তা কেটে গেছে আমাদের নিয়ে। পরেরদিন ভোরে হলং বাংলো থেকে হাতি সাফারি বুকিং হবে কিনা অনিশ্চয়তা ছিল, কিন্তু খুব সহজেই ম্যনেজ হয়ে গেল ম্যানেজার সচলদার উদ্যোগে। সন্ধ্যার চা’পানের আড্ডায় বেশ গুছিয়ে আড্ডা হল। জানলাম সে রাণাঘাটের লোক। রাণাঘাটের প্রসঙ্গে কবি জয় গোস্বামীর কথা উঠতেই সচল দা উচ্ছলিত হয়ে উঠল। বলল জয়ের সাথে তো আমার দাদার মত সম্পর্ক, দাঁড়াও দাঁড়াও তোমাদের জয়ের কবিতা শোনাচ্ছি।ছোটোবেলা থেকেই আমার আবার একটু আধটু ডায়েরি লেখার শখ।উস্কানি পেয়ে আমিও খুলে ফেললাম আমার মামার দেওয়া এল আই সি কোম্পানির ছোট ডায়েরিটা। তাতে টুকরো টাকরা লেখার মধ্যে যে কয়েকটা কবিতা সেগুলি সবই প্রেমের কবিতা। সচলদার ভালো লাগলো কিনা বোঝা গেল না, তবে দিদিরা যে ভাইয়ের গোপন ঘরের হদিশ পেয়ে বেশ ইন্টারেস্ট পেল বুঝতে পারলাম।
রাতের খাবারের ডাক পড়ল। লাল টকটকে দেশি মুরগির ঝোল আর রুটি। আরও দুটো ফ্যামিলি ছিল সেই বনভোজনের আসরে। মোট দশ-বারো জন ভ্রমণ পিপাসুর এই  সমারোহে কোনও অবাঞ্ছিত কোলাহল ছিলনা দেশি মুরগির ঝোলঝাল গন্ধ আর সেঁকা রুটির উষ্ণতা ছাড়া। এ দেখে বৃষ্টি কেন চুপচাপ বসে থাকবে। সেও এল, সে ঝাঁপিয়ে এল অথচ গাছবন্দি থাকার ফলে তার আসার পূর্বাভাস টের পাইনিতবে কেউ কেউ পেয়েছিল। সন্ধ্যের মুখে যখন আমরা মাদারীহাট থেকে রিল নিয়ে ফিরছিলাম তখন বাংলোর একটু আগেই বনের মধ্যে এক দল ময়ূরীর মাঝে দুটি ময়ূর পেখম তুলে নাচছিল। ময়ূর তো কতই দেখেছি, কিন্তু ওদের ঘরে এসে ওদের এরকম মনোহরণ করা নৃত্য-অনুষ্ঠান এর আগে দেখিনি।
পরদিন খুব ভোরে উঠে দেখি জিপ এসে গেছে আমাদের নিতে। কোনমতে রেডি হয়ে চললাম হলং বাংলোর দিকে। গতরাতের বৃষ্টিভেজা হয়ে গাছগুলো যেন সবুজে চুপচুপ করছে। চারিদিকে কৌতূহলী নজর পাক খাচ্ছে জিপের সব সওয়ারিদের, এই কিছু দেখা গেল বুঝি, তবে না হলং বাংলো পর্যন্ত কিছুই দেখা যায়নি।পৌঁছে দেখি সেখানে আমাদের অভ্যর্থনায় হাজির হয়ে আছে চারটে কুনকি হাতি, তাদের সাথে মাহুত বন্ধু পরিচয় করে দিল, কি কি যেন নাম বলেছিল আজ আর মনে নেই। তাদের সবার কড়া পরা পিঠ ও কাঁধের উপর চৌকো এক আসন বাঁধা। একেক হাতির উপর চারজন করে বসা যায়। আমাদের যে সাথী ছিল তার আবার ছোট্ট একটি ছানা ছিল। আমাদের সাফারির দলটি হেলতে দুলতে জঙ্গলে ঢুকে পড়ল। অরণ্য তার অপার ভাণ্ডার নিয়ে আমাদের পরিক্ষকের মত হাজির। তার বৃক্ষেরা ফিসফিস করে একে অপরকে সংকেত চালান করে, সাবধান করে দেয় অচেনা, অযাচিত গতিবিধি সম্বন্ধে। চারদিকে ঘিরে থেকে তীক্ষ্ণ নজর রাখে। পাতাদের সর্‌ সর্‌ আওয়াজে মৃদু শাসানীও থাকেপর্যটক ভয় পায়না বরং রোমাঞ্চিত হয়, সহযাত্রীকে উল্লাসে বলে ঐ দেখ ঐ দেখ বাইসন ছুটে যায়। লতা-পাতা, ঝোপঝাড়ের মধ্য দিয়ে পথের হাঁটা সঙ্কেত ধরে ধরে এগোতে থাকে আমাদের সাফারি। আমাদের গন্তব্য নির্দিষ্ট, আমাদের গতিবিধি সংরক্ষিত কারণ মাহুতবন্ধু সব জানে ! হাথি আমাদের সাথী সেও জানে, সেও জানে তার পেশাদারিত্ব ! তারপরও সে ভোলেনা তার মাতৃত্ব। তার ছানা পিছিয়ে গেলে সেও দাঁড়িয়ে পড়ে, ছানার ক্ষিধে পেলে তাকে স্তনপানও করাতে দ্বিধা বোধ করে না। আর আমরা ঘাড় নিচু করে সেই অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখি আর ক্যামেরাবন্ধি করি। মাঝে এক তিরতিরে ঝোরা পেরতে গিয়ে সে এক কীর্তি! বাচ্চা হাতিটি বার বার পাড়ে ওঠার চেষ্টা করছে আর কাদামাটি বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে জলে। জলের মাঝে মা হাতিটি দাঁড়িয়ে আছে, যতক্ষণ না তার বাচ্চাটি পাড়ে উঠছে তার আগে সে উঠবে নাপ্রথমে আমরা ভাবলাম বাচ্চা হাতিটি বুঝি সত্যিই পাড়ে উঠতে পারছে না, সবাই আহা উঁহু করছি। কিন্তু পরে বুঝলাম যে সে মস্তি করেই কাদা মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। পর্যটকদের একপ্রস্থ মনোরঞ্জন দেবার পর মা হাতিটি শূর তুলে এগিয়ে যেতেই তর-তর করে পাড়ে উঠে গেল বাচ্চাটিআমরা গিয়ে পড়লাম জলদাপাড়া অভয়ারণ্যকে দ্বিধাবিভক্ত করে দেওয়া এক তৃণভূমির সামনে। দূরেমানুষের থেকেও উঁচু উঁচু ঘাস আর ঘাস। এত হরিণ এত হরিণ যেন মনে হয় গ্রামের কোনো মাঠে ছাগল চরে বেড়াচ্ছে। আরও কিছুটা উত্তরে এগোতেই মাহুত বন্ধু দূরের দিকে হাতের ইশারা করলদেখতে পেলাম আমাদের কাঙ্ক্ষিত জলাদাপাড়ার অধিপতিকে ! একশৃঙ্গ গণ্ডার তার শৃঙ্গ উঁচিয়ে যেন আমাদের বলছে সার্থক তোমাদের সাফারি, দেখা হয়ে গেল এবার ভালয় ভালয় ফিরে যাও । আমাদের ফিরতে হতই,আমরা ফিরে এসেছিলাম তবে সঙ্গে এনেছিলাম তাবিজে বন্দি করা অরণ্যের ভেষজ ভালোবাসা সেই তাবিজগুণে আজও ঘুরে বেড়াই পাহাড়ে জঙ্গলে।  
(ছবি- শৌভিক রায়)



সঙ্গে লেপচাজগৎ 
শর্মিষ্ঠা রায়চৌধুরী

প্রতিবছরের মত এবারের চলতি বছরে গরমের ছুটিতে আমার দেওর,জা,ওদের ছেলে ঋষিকে নিয়ে কোচবিহারের বাড়ীতে এলো । ওরা এলে আমরা দু-চারদিনের জন্য কোথাও বেড়াতে যাই । ঋষির আবদার তার জেঠুর কাছে পাহাড়ে যাবে সে এবারের ছুটিতে । সেইমত ভাই (দেওর ) কলকাতা থেকে অনলাইনে বুক করে রেখেছিল ।আমাদের এবারের গন্তব্য হল লেপচাজগত এবং আশেপাশের জায়গাগুলো ঘুরে দেখা ।

         যদিও আমরা মে মাসের মাঝামাঝি গিয়েছিলাম, তবুও লেপচাজগৎ যাওয়ার সঠিক সময় অক্টোবর থেকে শুরু করে এপ্রিল মাস পর্যন্ত । কারন ওইসময় ভিউপয়েন্ট থেকে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের কাঞ্চনজঙ্ঘার মনোরম দৃশ্য প্রকৃতিপ্রেমিদের কাছে উপরিপাওনা ।
লেপচাজগৎ হলো প্রকৃতিপ্রেমি ও নব-দম্পতিদের মধুচন্দ্রিমার জন্য আদর্শস্থান ।এখানকার স্বর্গীয় - সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হবেন না এমন মানুষ বোধহয় বিরল ।দার্জিলিং থেকে মাত্র ১৯ কিমি. দূরত্বে অবস্থিত লেপচাজগৎ হলো একটি ছোট্ট সুন্দর গ্রাম এবং রিজার্ভ ফরেস্ট অঞ্চল ।এখানে ওয়েস্ট বেঙ্গল ফরেস্ট ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশনের একটি লজ রয়েছে । এই স্থানটি ভ্রমণপিপাসুদের কাছে এখনো ততটা প্রকাশ্যে আসেনি । তাই এখানকার স্বর্গীয় সৌন্দর্য্য অটুট ।

      
       অবশেষে এক শুক্রবার নিউকোচবিহার রেলস্টেশন থেকে ৩-২৫ মি.এর উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেসে রওনা হয়ে ৬-৪৫ মিনিটে পৌছলাম এন.জে.পিতে । সেইরাতটা শিলিগুড়ির একটা হোটেলে কাটিয়ে পরদিন সকাল ৮টা নাগাদ আগে থেকে বুক করে রাখা একটা ইনোভা করে দূগ্গা-দূগ্গা বলে বেরিয়ে পরলাম । ড্রাইভার তেনজিং বেশ হাসিখুশি প্রকৃতির । হিন্দিতে কথা বললেও ওর ভাঙা ভাঙা বাংলা শুনতে বেশি ভালো লাগছিল ।
আমাদের গাড়ি তিস্তবাজারের কাছাকাছি একটা রেঁস্তোরায় দাঁড়ালে প্রাতঃরাশ পর্ব মিটিয়ে রওনা হলাম । এরপর পৌঁছালাম ঘুম হিল স্টেশন । সেখানে কিছুসময় কাটিয়ে কিছু স্মৃতি মুঠোফোনে বন্দী করে গাড়ি ছুটলো লেপচাজগৎ এর দিকে যা কিনা ঘুম থেকে ৮ কিমি. দূরত্বে অবস্থিত ।প্রসঙ্গতঃ বলে রাখি,শিলিগুড়ি থেকে ৬৮ কিমি. দূরত্বে "লেপচাজগৎ" সেইসব ভ্রমণবিলাসীদের কাছে অত্যন্ত প্রিয় যারা দার্জিলিং শহরের তথাকথিত কোলাহল ও জনবহুলতা এড়াতে চান । নিরিবিলিতে ছুটি কাটাতে চান প্রকৃতিরানীর রঙ রূপ গায়ে মেখে । বেশ কয়েকটি হোমস্টে রয়েছে এখানে । সেগুলি হলো,যথাক্রমে - কাঞ্চনকন্যা হোমস্টে,লেপচাজগৎ হোমস্টে,রেনু হোমস্টে,লেপচাজগৎ প্রাইভেট হোটেল,ফরেস্ট বাংলো..... 

      বেলা ১ টা নাগাদ পৌছালাম স্বর্গ- সুন্দরী " লেপচাজগৎ"-এ । আসার পথে প্রকৃতির পরতে পরতে সাজিয়ে রাখা সৌন্দর্য্যে চক্ষুসার্থক হয়েছিল । রাস্তার দুপাশে পাইনের সারি আহাঃ কি সুন্দর ।
বেশ ঠান্ডা এখানে । আমরা গিয়ে উঠলাম আগে থেকে অনলাইনে বুক করে রাখা রেনু হোমস্টেতে । পাহাড়ের কোলে সুন্দর ছিমছাম সাজানো পাশাপাশি দুটো ঘর বরাদ্দ ছিল । পরিপাটি করে গোছানো ঘরদুটি । ফ্রেশ হয়ে জঙ্গলে খানিকটা ঘুরে গেলাম ভিউ পয়েন্টে ।যেখান থেকে সূ্র্যোদয়- সূর্যাস্তের মনোরম দৃশ্য দেখা যায় ।বেশকিছু স্থানীয় মানুষদের সাথে পরিচয় হলো । ওরা কত অবলিলায় পাহাড়ে ওঠানামা করে ।বেশকিছুক্ষন ট্রেকিং করে পৌছালাম ।চারদিকে মেঘে ছেয়ে আছে ।দু- একজন পর্যটকদের সাথে আমরাও অপেক্ষা করছিলাম যদি এই মেঘযুক্ত আকাশে একটু দেখা পাই ।কিন্ত মেঘেদের দৌরাত্বে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা এযাত্রায় হবে না ভেবে নিরাশ হয়ে যখন ফিরব ভাবছি ঠিক তখনি করূণাময়ী কাঞ্চনজঙ্ঘার আবির্ভাব হলো পাহাড়ের বুকে আকাশফুঁড়ে ।আমরা প্রায় একসঙ্গেই সবাই চেচিয়ে উঠলাম কা- ঞ্চ- ন- জ- ঙ্ঘা.....


     ফিরে এলাম হোমস্টেতে । রাত বাড়ার সাথে ঠান্ডা পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল মে মাসেও ।তাই লেপ- কম্বল সম্বল করে সুখনিদ্রায় গেলাম হোমস্টের সাজানো শয্যায় সে রাতের মত নৈশভোজের পরে ।
      পরদিন সকালে গরমজলে স্নান সেড়ে চা খেয়ে হোমস্টেকে বিদায় জানিয়ে ওদেরই ঠিক করে দেওয়া গাড়িতে রওনা হলাম জোড়পোখরির পথে । দুধারে পাইনের সারিকে পেছনে রেখে আমাদের গাড়ি শুখিয়াপোখরি পৌছালো ।এটা একটা ছোট গ্রাম যাকে কেন্দ্র করে বাজার বসেছে,সেদিন ছিল হাটবার । দোকানিরা নিত্যপ্রয়োজনীয় নানা পশড়া সাজিয়ে বসেছে ।হাটটা ঘুরে দেখে একটা দোকান থেকে চা দিয়ে গলা ভিজিয়ে গাড়ি এগিয়ে চলল ।পৌছালাম জোড়পোখরি নামের অপূর্ব সুন্দর জায়গায় ।এখানেও একটা টুরিস্টলজ রয়েছে যেটা অনলাইন বুক করা যায় ।এমন একটা স্বর্গীয় অনুভূতি হচ্ছিল এখানে এসে ।পাহাড়ের গায়ে,লজের কানায় কানায়,ফুলেদের জলসায় মেঘেদের অবাধ আনাগোনা আমরা প্রাণ ভরে উপোভোগ করছিলাম ।বলাই বাহুল্য সঙ্গে থাকা ক্যামেরা আর মুঠোফোনে বন্দী হচ্ছিল মেঘেদের দেশে আমাদের বিভিন্ন পোজে ছবি তোলা ।বয়স একধাক্কায় অনেকটা কমে এসেছিল আমাদের ।তখন সবাই আমরা ঋষির সমবয়সি ।গাড়ি আবারও এগিয়ে চলল জোড়পোখরিকে পেছনে ফেলে । পৌছালাম নেপালের সীমান্ত বর্ডারে ।জায়গাটা স্থানীয় লোকমুখে সীমানা বাজার নামে পরিচিত চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মৃতের কবর ।তার চারপাশেই গড়ে উঠেছে বাজারটি।কিছু কিউরিও সপ,খাবরের দোকান,গরম পোষাকের বিকিকিনি চলছে । পর্যটকদের কেনাকাটার বহরও কম নয়,আমিও সেদলে ভিড়ে গিয়ে কিনে ফেললাম দু-একটা মোমেন্টোস্ ।ঠান্ডার কামড় এখানে দ্বিগুন । এরপর গাড়িতে উঠে পথ ধরলাম সেদিকে যেদিক গেছে নেপালের পশুপতি । পৌঁছালাম নেপালের প্রবেশদ্বারের কাছে । এখানে বাইরের গাড়ি প্রবেশ নিষিদ্ধ ।যথাস্থানে পরিচয় পত্র ......দেখিয়ে অনুমতি নিয়ে ওখানকার গাড়ি করে পার হলাম নেপালের প্রবেশ দ্বার ।এখানে মহাদেবের একটি মন্দির আছে যা পশুপতি মন্দির নামে পরিচিত ।ভগবান শিবকে পশুপতি নামে ডাকেন নেপালের বাসিন্দারা ।

মন্দির ঘুরে আমরা গেলাম পশুপতি মার্কেটে ।এখানে এসে চোখ ধাঁধিয়ে গেল ।দেশি - বিদেশি নানান সামগ্রির দোকান । কসমেটিক্স খুব সস্তা এখানে। ড্রাইভার তেনজিং অপেক্ষা করছিল,আমরা ফিরতেই একগাল সরল হাসি হেসে বলল "আইয়ে ম্যাডাম" ।গাড়ি এগিয়ে চলল পরবর্তী গন্তব্য মিরিকের পথে ।বিকেল চারটায় পৌছালাম ।হোটেলে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে চলে এলাম মিরিক লেকে ।এর আগেও একবার মিরিকে এসেছিলাম,খুব ভালোলেগেছিল । কিন্তু এবারে আগের সেই মিরিককে আর পেলাম না । পর্যাপ্ত রক্ষনাবেক্ষণের অভাবে জায়গাটার সৌন্দর্য্য নষ্ট হতে বসেছে । লেকের ধারের অপরিচ্ছন্নতাই তার প্রমান । দুএকটা ছবি তুলে সন্ধ্যা নামার কিছু পরেই ফিরে এলাম হোটেলের আরামদায়ক ঘরটাতে ।পথের ক্লান্তিতে সবাই তাড়াতাড়ি ডিনার করে শুয়ে পরলাম ।পরদিন সকালে স্নান,ব্রেকফাস্ট সেড়ে বেড়িয়ে পরলাম ।একে একে মিরিক কটেজ,মনাস্ট্রি ,সৌরিনি টি গার্ডেন দেখে পাহাড় ছেড়ে নেমে এলাম সমতলের বুকে ভাড়ার গাড়ি চোড়ে ।ঘরে ফেরার পালা,মনখারাপিয়া বাঁশি বেজে উঠলো সবার মনে,ঋষির মুখ ভার ।ওর বাবা-মায়ের সাথে আমরাও ওকে কথা দিলাম,আবার আসবো পাহাড়ে,,,,অন্যকোন পাহাড়ের দেশে,,,যেথায় মেঘের ভেলায় ভেসে বেড়াব,,,পাইনের সারি,,,সূর্যোদ়য- সূর্যাস্ত,,,বুক ভোরে শ্বাস নেব ক'টা দিন ।দূর থেকে ভেসে আসবে পাহাড়িয়া বাঁশির সুর....
(ছবি- লেখিকা)



পাহাড়ি কন্যা ঝালং বিন্দু


দেবযানী সিন্হা  

আমার প্রানের শহর আলিপুর দুয়ার। প্রতিদিন সূর্য দেখার মতো আমার চোখ মুগ্ধ হয়ে পাহাড় দেখে।আমার শহরের উত্তরপ্রান্ত জুড়ে বিস্তীর্ণ পাহাড়।
পাহাড়ের সাথে আমার ভালোলাগার সম্পর্ক চিরন্তনী। যখনি ব্যস্তদিনের ফাঁকে ছুটি পেয়েছি তখনি ছুট্টে গেছি পাহাড়ের কাছে।
বছর বারো আগের কথা লক্ষ্মীপূজোর ঠিক পরের দিন পরিবারের কজন মিলে বেড়িয়ে গেলাম পাহাড়িকন্যা ঝালং বিন্দুর সৌন্দর্য উপভোগ করতে।আলিপুরদুয়ার থেকে নিজস্ব গাড়িতে সকাল ছটায় আমাদের যাত্রা শুরু হলো।সকালের হাল্কা ঠাণ্ডাগরম আবহাওয়ায় ছুটছে গাড়ি। নিমতিতে হাইরোডের পাশে খাবারের দোকানে সকালের খাবার খেয়ে কিছু শুখনো খাবার সাথে নিয়ে ঘন বনের মাঝরাস্তা দিয়ে গাড়ি এগিয়ে চলেছে দূর পাহাড়ের হাতছানিতে।নিমতি পাড় হয়ে চাবাগান আর চাফুলের মৃদু গন্ধ হাসিমারা ছোট্ট গাঁ ঘেষে চলে এলাম মাদারিহাট তারপর বীরপারা বাইপাস হয়ে সেনাছাউনির পাশ দিয়ে চলে এলাম খুনিয়ামোর, ক্রমশ আরো এগিয়ে যাচ্ছি গভীরতম বনের বুক চিরে পিচঢালা রাস্তায়।ডান দিকে সুদীর্ঘ গাছের বনভূমি চাপরামারি।মনে হচ্ছে যেন ধাপ সিঁড়ি ভেঙে চলেছি পাহাড়ি কন্যার ডাকে।এই মনোমোহিনী দৃশ্য ক্যামেরা বন্দী করে চলেছি খুশি আর আনন্দের মেলবন্ধনে।
পাহাড়ি পথের ধারে নানা রকমের জানা অজানা গাছের সারি।রোদ্রছায়া মাখা আমেজে আমরা চলেছি ঝালং এ।কিছুদূর অন্তর অন্তর পাহাড়ি ঝরনা। মন চাইছিল একটু ছুঁয়ে আসি।আবার ভয় হচ্ছিল এই দুর্গম গিরিতে জনমানবহীন পথে কোনো জন্তুজানোয়ার এসে পড়ে। পাহাড়ের কোলে অপূর্ব সুন্দরী ঝালং,ছোটো ছোটো বাড়ি বিভিন্ন ফুলে সাজানো, বিশেষ করে নানা রঙের অর্কিড মন মাতাল করে দেয়।ঝালং এর জলঢাকা হাইডেল পাওয়ার প্রোজেক্ট তার কথা না বললেই নয়,আমাদের এক পরিচিত ব্যক্তির কল্যানে যন্ত্রদানবের কাছে যাওনা সে এক বিরল অভিজ্ঞতা। অনবরত টারবাইন ঘুরছে অতি দ্রত গতিবেগে, সে এক মহাজাগতিক ভয়ংকর অনুভূতি। বৃহৎ যন্ত্রদানব যার কোনো বিরাম নেই।উচ্চরব শব্দে কানে তালা লাগার উপক্রম। সেখান থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে দেহে প্রান এলো।বিশাল আকৃতির পাইপলাইনের জলোচ্ছ্বাস শুধুই চোখেমুখে ভয় স্নায়ু কে গ্রাস করছে।




তারপরের গন্তব্য স্থল ভুটান সীমান্তে ভারতের শেষ জনপদ যেন কোনো শিল্পির তুলিতে আঁকা পাহাড়ি গ্রাম বিন্দু।ঝালং থেকে বিন্দু ১১ থেকে ১২কিমি দূরত্ব। বিন্দু চোখজুড়ানো ভালোলাগা।সে এক মনোরম অনুভূতি। জলঢাকার সাদাফেনা মিশ্রিত জলস্রোতের রুপ, বিশাল বিশাল আকৃতির পাথর আর ভয়াবহ তীক্ষ্ণ গর্জন মনকে উদ্বেল করে তোলে। দুপুরের খাবার এই পাহাড়ের কোলের ছোট্ট হোটেলে গরম গরম ভাত ডিমকারি হলো আবার কয়েক জন চাউমিন মোমো খেলো।জলঢাকা নদীর ওপর অবস্থিত হাইড্রো ইলেকট্রিসিটি প্রোজেক্ট বিন্দু।সবাই মিলে বাঁধের ওপর দিয়ে হেটে গেলাম ভুটানের মাটিকে একটু স্পর্শ করার জন্য নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে। সেনা সুরক্ষা বল সর্বদা অতন্দ্র প্রহরী হয়ে আছে এই পাহাড়ি কন্যার যত্নে।
সারাদিন সবুজঘেরা পাহাড়ের আলিঙ্গনে থেকে অবশেষে ঘরে ফেরা কুয়াশাচ্ছন্ন অন্ধকারের পথ বেয়ে সমতলে নেমে আসা আবার ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে। এর পরেও অনেকবার গিয়েছি কিন্তু সেই প্রথম দেখার স্মৃতি আজও মধু মিশ্রিত। 


(ছবি- শৌভিক রায়)




ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
অনিমেষ সরকার

  ভ্রমন বিষয়টা শুনলেই মনটা ময়ুরের মত নাচতে শুরু করে দেয়৷ সেটা যেখানেই হোক না কেনো৷ বাড়ি থেকে কিছুটা দুরত্বে অথবা সুদূর বিদেশে ৷ মাঝে মধ্যে মন আর শরীরকে চাঙ্গা করতে ভ্রমনে যাওয়া সবচেয়ে ভালো ওষুধ৷ খুব বেশি পাহাড় দেখিনি তবে আমার গ্রাম থেকে কিছুটা দুরে অবস্থিত ভাঙ্গা পাহাড়ে গিয়েছিলাম ৷ কথায় আছে  No one can replace the taste of tour.  সুতারং অভিজ্ঞতাটা ভালো বইকি খুবই ভালো ৷ বাড়ি থেকে এই রাত তিনটে বেরিয়ে পরলাম , ভাঙ্গা পাহাড়কে দেখব বলে সকালের আলোয়৷ বাইকে করে দুজনে সোয়েটার চাপিয়ে মালবাজারে টুনবাড়ি মোর থেকে বাঁদিকে ঘুরতেই আরও চারকিমি পথ, মাথ ঘাট জঙ্গল চাবাগানের গলি পেরিয়ে অবশেষে শুকিয়ে যাওয়া নদীতে পৌছলাম৷ 


ভাঙ্গা পাহাড় কোনো একসময় উচু পাহাড় ছিল চা চাষ করতে গিয়ে কা ধাপ ধাপ করে কেটে পাহাড় সমতল সমান অবশেষ রয়েছে৷ পাঁচটায়  দেখলাম সূর্যদয় অভুতপুর্ব আনন্দ হল৷ হিম করা বাতাস আর ওখানে একটা মন্দির আছে , সকাল থেকে গান বাজছে ভক্তি গীত মনে হচ্ছে তামিল ভাষার৷ গুরুজি তামিল ভাষী তা আগেই একবার বলেছিলেন ৷ মুহুর্তগুলোকে উপভোগ করতে করতে কখন যে সুর্য প্রখর হয়ে গেছে বুঝতে পারিনি ৷ তবে একটা কথাই যাই বলুন দেশ বিদেশ যাই হোক ভ্রমন কিন্তু মানুষের রক্তে মিশে গেছে৷৷
(ছবি- শৌভিক রায়)




    তুমি কি কেবলি ছবি...



                                  হাম্পি--কর্ণাটক
                                      দেবাশিস ঘোষ
    

ত্রয়োদশ শতকে  কর্ণাটকের বর্তমান বালেরি জেলায়(রেলস্টেশন :হসপেট) গড়ে উঠেছিল এক বিশাল হিন্দু সাম্রাজ্য। প্রায় দুশো বছর ধরে এখানে শিল্পী ও শ্রমিকরা গড়ে তুলেছিল এক পাথুরে সাম্রাজ্য--যেন স্বয়ং বিশ্বকর্মার সাথে দক্ষতার প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছিল সেই সব স্থপতিরা।বর্তমানে  ইউনেসকো(UNESCO) এটিক  "হেরিটেজ সাইট"-এর মর্যাদা দিয়েছে।

                                                                                                 কল্যানমন্ডপম--ভিঠ্ঠল মন্দির
  
                                                                                                     বিকেলের আলোয় বিরূপাক্ষ মন্দির

                                       রাণীদের স্নানের জলাশয়--স্বচ্ছ জলে নীল আকাশের ছায়া আজও একই ভাবে প্রতিবিম্বিত

                                                       স্টেপড্ ট্যাঙ্ক--পাথরের ধাপ নেমে গেছে সরোবরে

                                                                        রাজার হাতিশাল




                                                                  পাথরের রথ--এটি কর্ণাটক সরকারের লোগো

                                                                    এই কাঠগোলাপ গাছটি(frangipani tree) শতাব্দীপ্রাচীন---
                                                                    এখনও ফুল ফোটে এই গাছে।হাম্পি সাম্রাজ্যের মধ্যে অবস্থিত

                                                                                            মনোলিথিক গণেশের মূর্তি

                                                                                  বাজার--লঙ্ শট ভিউ



 উটি --কুন্নুর হেরিটেজ রেল সফর
দেবাশিস ঘোষ
















লাভা
                                   দীপশিখা চক্রবর্তী








পাম্পুবস্তি

রাজাভাতখাওয়া
জয় চক্রবর্তী







বুদ্ধ পার্ক,রাভাংলা
দক্ষিণ সিকিম
বেদান্ত দত্ত




No comments:

Post a Comment