Thursday, May 2, 2024


 

মুনা 

অনলাইন বৈশাখ সংখ্যা ১৪৩১

ক্রোড়পত্র 



মা আমার মা 

মিষ্টু সরকার 


ওগো আমার মা                                   
তোমার প্রহর গুনে কাটে আমার বাকি দিনগুলি ।
আমার ভাবনাতে সকল সময় জুড়ে থেকো তুমি।

পূর্ব বাংলার গাইবান্ধাতে জন্ম আমার মায়ের।   স্বর্গীয় বিরাজ মোহন নন্দী স্বর্গীয়া কিরণবালা নন্দীর ছোটো মেয়েটি , ঊষাকালের মতোই স্নিগ্ধ আর নরম, কিন্তু চেতনায় দৃঢ় স্বভাবের। ঊষা নন্দী, যিনি পরবর্তীতে ঊষা সরকার হন ।  নয় ভাই বোনের সবচেয়ে ছোট বোন । তারপর আর তার দুই ছোট ছোট ভাই।  বিবাহ সূত্রে স্বল্প দূরত্বে জলপাইগুড়ি ডাঙ্গাপাড়া থেকে দেবনগর  নিবাসী হয়েছিল আমার মা। বাবার হাত ধরে যখন তার নিজের সংসারে আসে  তখন থেকে আমার জ্যেঠতুতো বড় দাদা, দিদি  মা বাবাই এই চারজনের সংসার হল, আমি এলাম বেশ কিছুদিন পরে। আমাদের এই পাঁচজনের সংসারে এত শান্তিছিলো এখন আমার মাঝে মাঝে মনে হয় জীবনের গোল্ডেন টাইমটা আবার যদি ফিরে আসতো । 
মুখে হাসি মনে দৃঢ়তা , আর সবকিছুকে স্বাভাবিকভাবে  অতি সহজ চোখে দেখা আমার মা।  বাড়ির ছোট মেয়ে ও ছোট বউ হলেও দু বাড়ির দিকেই  কর্তব্যে  নিষ্ঠায় অনেক বড় ছিল আমার মা ।  
"কথা কম কাজ বেশি ।"  আজীবন এই নীতিতে বিশ্বাসী আমার মা। ছোট থেকে যেভাবে বড় হয়েছি এখন কিছু কিছু  তার  বুঝতে পারি । 
মায়ের  সেলাই এর হাত ছিলো অপূর্ব , আর গানের গলা বেশ ভালো ছিলো, মামাবাড়িতে গানের চর্চা ছিলো । আমার গান শেখার শুরু ও মা।  "নিঠুর হে এই করেছ ভালো" , "আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই " মায়ের প্রিয় দুটি গান । 
সাদা কালো বাংলা ছবির  ভালোলাগার হাতে খড়ি আমার মা । সেই সূত্রে আমি প্রায় সাদাকালো যুগের প্রায় সমস্ত কলাকুশলীদের চিনতে  শেখা । কানন দেবীর গান ছিল তার বড় প্রিয়। কপালের মাঝে ছোট্ট টিপ, আর অপর্ণা সেনের মতো ছোট্ট আঁচল,  তাঁত বা সিল্কের হালকা রঙের শাড়ি, আর মুখে পান ছিলো মায়ের সাজের বৈশিষ্ট। বাড়িতে কেউ এলে চায়ের সাথে তার পানটাও পাওনা ছিল । 
 স্পষ্ট মনে পড়ে  বিয়ের আগের দিন পর্যন্ত সংসারের কিছুই বুঝতাম না । মায়েরা যেমন হয় কল্পতরু ।  এর ভাগ পেয়েছি কি শুধুই আমি!! না না !!  আমার  দুই কুলের  দাদা,  দিদি, নাতনি , তার নাতনি নাতি তো আছেই, আর একজন সর্বাধিক প্রিয় তার ছোটভাই, যে ছিলো তার  সন্তান সম । অসম্ভবকে সম্ভব করতে মনের সমস্ত বাসনা পূরণ করার জাদুদণ্ড ছিল মায়ের হাতে । অবশ্যই মনের বাসনা শুধু  আমার নয়, অনেক মানুষ অন্তর্ভুক্ত ছিল । আর তার শেষ জীবনের  সঙ্গী তার নাতনি , দুজন-দুজনের  চোখের মণি।  কিছু মানুষের  ভাগ্যফল  না থাকলেও কর্মফল  ভগবান ও দুহাত তুলে দেন বা দিতে বাধ্য থাকেন। আমার মাও তেমন ই একজনা। 
কখনো কাউকে পর ভাবতে দেখিনি। লেখাটাতে হয়তো অনেক কিছু আছে, বা অনেক কিছু নেই আমরা  বরাবর- ই স্বভাবে গোপন, তাই লিখতে গিয়ে চোখের জল এলেও ভাব প্রকাশে অক্ষম আমি । 
মায়ের অপূর্ব হাতের রান্না খুব মিস করি, মিস করে আমাদের বাড়ির সবাই। একটা সময় ছিল আমি যখন বাইরে কারো হাতে খেতে পারতাম না, দোকানের খাবার তো  দূরস্থান , এখন আর উপায় নেই । শেষবার মায়ের হাতে খেয়েছিলাম শিঙ্গি মাছের ঝোল, যা অসুস্থ অবস্থায়  মেয়ে খাবে  বলে রেঁধেছিল ।  মায়ের বেস্ট রান্না  শিঙ্গি মাছের কালোজিরে বাটা ঝোল,বাঁধাকপির ঘন্ট,   ছোটোমাছের চচ্চড়ি,  আলুর দম , যে কোনো নিরামিষ রান্না, কচু শাক , মোচা ঘন্ট, যে কোনোধরনের খিচুড়ি,   সর্ষে সহ চালকুমড়োর চাক ভাজা কতো কি বলবো।  অদ্ভুতভাবে  মাসীদের  রান্নাও সমান ভাবে সুস্বাদু ।  এখনও এখানে বলে রাখি নিজের পাড়ার লোক থেকে সংসার পরিজন সবাই যেন তার আপন ছিল। অজাত শত্রু মা আমার।  নিজে বারো মাসে তেরো পার্বণ করলেও  কোনদিন  কোনো কিছুতে বাধ্য করেনি মা ও বাবাই ।                                                  
 মায়ের মুখে শোনা মায়েদের বাড়ির   লাগোয়া বাড়িটি ছিলো  কোনো এক মুসলমানদের ।  সুখ দুঃখ , জীবনের  স্থিতি-গতি একসাথে ভাগ করতেন সে দেশের মানুষ ।  এদেশে চলে আসার আগে বাড়ি কিনে নেন এক মুসলিম পরিবার, ওনারা বাড়িটি অক্ষত রেখে শুধু রাস্তার ধারের সদর দরজাটি- র ওপরের দিকের কিছু অংশ পরিবর্তন করেছিলেন চাঁদ-তারায় ।  তাদের নিজস্ব বাড়িটি অক্ষত রেখেছেন তাদের ওপারের দেশেরলোক !! এই ছবিটি স্মরণ করেই  মায়ের  আবেগে চোখ বুজে আসতো, মাথায় হাত উঠতো তাদের প্রতি  বিশ্বাস ও ভরসায় । 
জীবনের এই সহজ পাঠ সহ  আর এক গুরুত্বপূর্ণ  পাঠ  স্বাধীনতা আর উশৃঙ্খলতার মধ্যে পার্থক্য শিখিয়েছেন  আমার মা-বাবাই  । শুধু পছন্দ ছিল না সন্ধের পর বেরোনো , তার কারণ  রাস্তা ঘাটের ভয়। অহেতুক  জিনিসের ভারে নিজের জীবনকে অস্থির করে তোলা। 

 আমার চারিত্রিক গঠন বেশির ভাগই বাবাইয়ের  মতো । শুনতে হতো বাপ কি বেটি।  এই নিয়ে গর্ব ও ছিলো।  এখন মনে হয় আমি আমার মায়ের মতোও  অনেকটা ।  বাবাই ছিলো বন্ধু আর মা কে একটু বেশি ভয় পেতাম।  জীবন তাদের এক অদ্ভুত স্বস্তি দিয়েছিলো, সব দিকে না পাওয়া মানুষ দুটির  জীবনে তাদের সন্তানের শিক্ষা নিয়ে কোনো আক্ষেপ ছিলো না।  
মা আর বাবাই ছিল এক পরিপূরক জুটি। জীবনে চলার পথে দুজনে দুজনের কাজ হাসিমুখে করে গেছে,   কোনো দ্বিধা না রেখে।  কিভাবে অল্প তে সন্তুষ্টি অর্জন করা যায় তাতে মায়ের সজাগ দৃষ্টি ছিল।  কোনো না পাওয়া বা  অধরা কে অপূর্ণ না রেখে তার বিকল্প সৃষ্টিতেই ছিলো তার উদ্যোগ।   নিজের সংসারের গোপন সুখ ছাড়া  বাইরে সুখ খুঁজতে যায়নি আমার মা ।  নিজের   মা-বাবার  আদর্শ  চিরদিন  মেনে চলেছেন ।  মা তার    শ্বশুর-শাশুড়ি কে পায়নি এই আক্ষেপ ছিলো  চিরদিনের । তাতে এই সংসারের  কোনো নিয়ম নীতি মানতে তার আটকায় নি।         
  দুজন গোপনে  আমাকে বাদ দিয়ে যেকোনো সংসারের আলোচনা করতো,  এক্ষেত্রে  সেই কাজটি  ফলপ্রসূ না হলে , বাবাই  সরল মনে বলে ফেলতো, কিন্তু মা কোনদিন দ্বিতীয় বার সেটি আলোচনা করত না ।  
বাবাই কে হারানোর আট বছর পর  একদিন কোমরের হার ভেঙে  বিছানা নিলো মা,  দীর্ঘ আটমাস !! ২০২০-র এক জুন মাসের শেষে চলে গেল মা ।    নাত জামাই কে খুব পছন্দ হলেও তার প্রিয় নাতনির  বিয়ে টা আর দেখা হলো না । 
 শুধু আমায় নয়, যারা তার কাছে ছিল সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেল ।   শেষ সময়ে মুখে ছিলো অদ্ভূত এক প্রশান্তি , সব কারণ বলতে নেই।  
শেষ কটা দিন আমি মায়ের কাছেই ছিলাম তার সেবায়। কিন্তু  তার অবচেতন মস্তিষ্ক মানতে চায়নি সে কথা। বলতো মেয়ের সংসারে অসুস্থ মানুষ আছে, তাই সে আমার সাথে দেখা করে চলে যায়। আর আমায় কাছে থাকা প্রয়োজনীয় মানুষ বলে মনে করেছেন  ।  
জানিনা কি করে একটা সবকিছু ভুলে যাওয়া, বিছানা থেকে পাশ ফিরতে না পারা মানুষ , যে কাউকে চিনতে পারতো না, যখন তার সন্তানের অস্তিত্ব প্রায় সংকটের মধ্যে । বৃহস্পতি-বারের  পুজোটা  মনে রাখতো  শুয়ে শুয়ে, পাঁচালি পড়া , শেষ করতো উলু সহযোগে । পূর্ণিমা পুজো, প্রাত্যহিক সন্ধ্যা যে মানুষটা নেই সেই বাবাই কে খেতে দিতো, সবাইকে না খাইয়ে খেতে চাইতো না । 
কিচ্ছু ভুলে থাকেনি আমার মা।

সে এক অদ্ভূত মৃত্যু দৃশ্য । মায়ের প্রিয় যারা পরপারে আছেন সবাই তাকে নিতে এলো, সবার সাথে কথা বলছে মা। সবশেষে এলো মায়ের মা, আমার দিদা। মায়ের যাত্রা সম্পূর্ন হলো। আমি ও নিশ্চিন্ত হলাম মা তার কাছের আত্মীয়দের কাছেই যাচ্ছেন। আমি আর কাঁদিনি সেদিন , কান্না আসেনি। 
কতো কতো বছর পর ও তার চেনা মানুষেরা আমার সাথে যোগাযোগ করে তার খোঁজ নিলো।  এমন সৌভাগ্য ক'জনের হয়। আমাদের কাছে থাকার চেয়েও তার বাবাইয়ের কাছে যাওয়া বোধহয়  বেশি জরুরি ছিল ।  নার্সিং হোম তার পছন্দ ছিল না,  তাকে যেতেও হয়নি।  এখানে একটা কথা না বললে হচ্ছে না, মায়েদের ভাই-বোনদের সবার প্রতি সবার টান খুব বেশি। আর মায়ের সাথে টানটা তার থেকে একটু বেশি।  আমার ছোট মাসি - মা - ছোটো মামা মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে চলে যায়।  জীবনে অনেক কিছু হোলো না, কিন্তু এই জীবনে ভগবান যেমন মা -বাবা দিয়েছেন এ আমার অনেক জন্মের পুণ্যের ফল।  বারে বারে যেনো তোমায় ডাকতে পাই মা বলে। আমায় ছুঁয়ে থেকো মা।

No comments:

Post a Comment