মুজনাই
অনলাইন বৈশাখ সংখ্যা ১৪৩১
ক্রোড়পত্র
মার হাতে স্টিয়ারিং
উজ্জ্বল আচার্য
আমরা সবাই যাত্রী। স্টিয়ারিং, হ্যাঁ, মার হাতে। জীবনের স্টিয়ারিং।এই পৃথিবীর জীবন পথে সকলের গন্তব্যই কিন্তু এক । এক অনিশ্চিত অজানা পথ। পথের শেষ কোথায় কি আছে শেষে কেউ জানে না। হামাগুড়ি থেকে শুরু করে মায়ের দু হাত ধরে হাঁটতে শেখা তারপর ক্রমশ জীবনযুদ্ধে জড়িয়ে পড়া।সবই হয় মায়ের সাথে থেকে মায়ের পাশে থেকে । মা এক বিষম শব্দ মা এক নির্ভরতা মা এক আশ্রয়স্থল মা এক শান্তির স্থল। মা এক স্বস্তি মা এক শান্তি মা এক সুখ মা এক পীড়ালাঘব শব্দ। মা এক ভরসা মা এক গতি মা এক আত্মনির্ভরতা মা এক যুদ্ধ জয়।
তখন কতই বা বয়স হবে ছয় বা সাত। মা হাসপাতালে। আমার জন্য এক ভাই আনতে গেছে। বাড়িতে মা ছাড়া কি ভালো লাগে। কাকার সাথে মার সাথে দেখা করতে যাওয়া। ভাইকে দেখে মার সাথে কথা বলে যখন ফিরব মা তখন একটা ঠোঙ্গায় একটা কলা আর একটা ডিম আর হাতে দশ পয়সা দিয়ে দিল।ডিম কলা পয়সা পেয়ে সে কি যে আনন্দ। তখন কি আর ছাই বুঝতাম মা নিজে না খেয়ে হাসপাতালের খাবার ডিম আর কলা আমার জন্য রেখে দিয়েছে। এই সময় এইটুকু খাবার মার খুব দরকার। মায়েরা এরকমই হয়। দশ পয়সা তখন অনেক দামি দুধ মালাই পাওয়া যেত দশ পয়সায়। আর পাঁচ পয়সায় আইসক্রিম। পাশের বাড়িতে থাকত এক আইসক্রিমওয়ালা কাকু। মাসে এক দু'বার উপায় হতো ওনার কাছ থেকে পয়সা দিয়ে আইসক্রিম বা দুধ মালাই খাবার। তবে আইসক্রিম কাকুটি ছিল খুব ভালো। রাতে বাড়ি ফিরে এসে মাঝে মধ্যেই আমায় বলতো যা একটা গ্লাস নিয়ে আয়। আমি দৌড়ে গিয়ে গ্লাস নিয়ে এলে আইসক্রিম কাকু বাক্স থেকে এক গ্লাস আইসক্রিম গলা জল আমায় দিত।মনের আনন্দে আইসক্রিম গলা জল খেয়ে খুব তৃপ্তি পেতাম সে সময়। ইস মার দেওয়া দশ পয়সায় আগামীকাল একটা দুধ মালাই খেতে পারব। কি যে আনন্দ হচ্ছে।
ক্লাস সেভেনে পড়ি তখন। স্কুল বন্ধ।হঠাৎ সেদিন বন্ধু দীপঙ্কর বাড়িতে এসে বলল সাহেবগঞ্জ যাবি? ওখানে একটা ক্লাবে স্পোর্টস এর অনুষ্ঠান হবে। তুই আর আমি নাম দেব। যদি পুরস্কার জিততে পারি বাড়িতে এসে সবাইকে সারপ্রাইজ দেব। খেলাধুলায় কোনদিনই আমি পারদর্শী ছিলাম না। স্কুলের খেলাধুলায় সেভাবে অংশগ্রহণও করতাম না। তবু বন্ধু দীপঙ্করের পীড়াপীড়িতে সাহেবগঞ্জের ক্লাবে গিয়ে লংজাম্পে নাম দিলাম দুজনে। দীপঙ্কর যদিও বা কোয়ালিফাই করল আমি লং জাম্পের সময় মুখ থুবরে পড়ে গেলাম। নাক ফেটে রক্ত বের হতে লাগলো।ক্লাবের কর্মকর্তাদের তৎপরতায় সুস্থ হয়ে এসে বাড়িতে মাকে বললাম আমি কেন প্রাইজ পেলাম না মা? আমার মা সংক্ষেপে উত্তর দিলেন -গাছে উঠতে পারিনা বড় ফলটা আমার! তোর দ্বারা খেলাধুলা হবে না, পড়াশোনাটা মন দিয়ে কর।
অনেক দিন পরের কথা। আমার এক সিনিয়র দাদা ছিলেন জ্যোতির্ময়দা। তার পুরনো গাড়ি বিক্রি করবেন বলে আমায় দেখাতে নিয়ে গেছেন বাড়িতে। যদি আমি কিনি বা অন্য কাউকে প্রস্তাব দিই সে কারণেই। সকাল সকাল জোতির্ময়দার বাড়ি গেছি। গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করার সময় দেখি সেখানে এক বিছানা, আর বিছানায় এক বয়স্কা মহিলা। বয়স্কা মহিলার মুখটা করুণ। জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কে মাসিমা? এখানে কেন?
তুমি কি আমার ছেলের কাছে এসেছো?
আপনার ছেলে! জ্যোতির্ময়দা আপনার ছেলে?
হ্যাঁ বাবা জ্যোতি আমার ছেলে।
তা আপনি গ্যারেজে কেন?
আসলে এটা তো একটা মস্ত বাড়ি, সিঁড়ি ভাঙ্গা আমার পক্ষে সম্ভব হয় না রে বাবা। তাই জ্যোতি আমার এখানে সবকিছুর ব্যবস্থা করে দিয়েছে।
ছি ছি মাকে কেউ গ্যারেজ ঘরে রাখে? এত বড় লোক জ্যোতিদা। বড্ড নিচ মনে হল।জ্যোতিদা এত নিম্ন রুচির এত নিম্ন মানসিকতার জানলে এখানে আসতামই না। কিছু না বলে গাড়ি না দেখেই বের হয়ে এলাম। জীবনে আর জ্যোতির্ময়দামুখো কখনো হইনি।
গ্রাম থেকে শহরে এসেছেন দেবাশীষ বাবু। সদ্য পিতৃহারা সে। মা ছেলে বউয়ের সংসার। কিন্তু কিছু কিছু জীবন কেন যে এরকম জটিল করে তোলে নিজেদেরকে ভাবলে অবাক হই। শহরে এসে কাজের লোকের অভাবে সংসারে অশান্তি। বড্ড চাপ গিন্নির। দুবেলা অশান্তি। বাড়িতে মা সব কাজে হাত লাগাতো। এখানে লোকের বাড়িতে ঠিকে ঝি-র কালচার। চেষ্টা করেও জুটছে না সব সময়ের জন্য কাজের মাসি। হঠাৎ স্ত্রীর পরামর্শে গ্রামের জমি জমা বিক্রি করে সবকিছু আত্মসাৎ করে মাকে নিয়ে এসে তুলল বাড়িতে। কাজের লোকের চিন্তা নাকি দূর হয় স্বামী-স্ত্রীর। বাইরে এরাই আবার মুখোশ পরে থাকে। মাতৃভক্তি পিতৃভক্তি নিয়ে বক্তব্য রাখে। জ্যোতির্ময়ের একমাত্র সন্তান এখন ড্রাগ এডিক্ট আর দেবাশীষের মেয়ে ক্লাস টুয়েলভ পাস করেই কোন লম্পট ছেলের সাথে গাঁটছড়া বেঁধে বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। স্টিয়ারিং সঠিকভাবে চালনা করতে না পারলে কত অঘটনই না ঘটে যায় জীবনে।
একবার ক্লাস এইটে হাফ ইয়ারলি পরীক্ষায় রেজাল্ট একটু খারাপ হয়েছিল। মা সন্ধ্যেবেলায় ডিম লাইটের চিমনি মুছতে মুছতে বলল -বেশি পাকিস না আর ফাঁকিবাজ হোসনা। ফাঁকি দিলে এমন ফাঁকে পড়বি জীবনে উঠতে পারবি না। বৃক্ষ তোমার নাম কি ফলে পরিচয়, মনে রাখিস কথাটা।ম্যাজিকের মত কাজ হল কথাটায় । বড্ড মন খারাপ হলো সেদিন। সত্যি তো সব মা-বাবাই চান ছেলে পড়াশোনা করুক। মানুষের মত মানুষ হোক। পড়াশোনা ছাড়া এই বয়সে আর আছে কি। বাবা সে সময় একটা টেপ রেকর্ডার কিনেছিলেন। মার অনুমতি নিয়ে বাড়িতে ওটা চালানো হতো। দিনে দুবার। স্কুল থেকে ফিরলে আর রাতে ভাত খাবার সময়। সাকুল্যে আধঘন্টা। আমার প্রিয় খাবার ছিল রাতে আলু সেদ্ধ আর ঘি ভাত। মাধ্যমিক দেব সেবার। এক রাতে ঘি শেষ হয়ে গিয়েছিল। বাবা হয়তো আনতে ভুলে গিয়েছিলেন। বাবা সেসময় পার্টি করতেন। আর সে কারণেই বাড়িতে সব সময় নেতা-মন্ত্রীর ভিড় ক্রমশ বাড়ছিল। বাবার সময় অযথা কেটে যাচ্ছিল। বাবার সময় নষ্ট হচ্ছিল। মার মনে হল সংসারের ক্ষতি হচ্ছে এতে।
বাবাকে সেদিন বললেন তোমার দ্বারা পার্টি হবে না। ছেলেদের প্রতি দায়িত্ব পালনে সংসারের প্রতি দায়িত্ব পালনে যথেষ্ট খামতি দেখা যাচ্ছে। তুমি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হচ্ছ ক্রমশ । আজ ছেলের ঘি এর কথা তুমি ভুলে যাচ্ছ। ভবিষ্যতে আরো অনেক কিছু ভুলে যাবে। সংসারটার ক্ষতি হবে। সবার দ্বারা সবকিছু হয় না। তোমার দ্বারাও পার্টি হবে না। তারপর থেকে বাবা অনেক চেঞ্জড।মার কাছে তার সন্তানেরা আসল হীরে মানিক। মায়েরা জীবনের সবকিছু ত্যাগ করতে পারেন সন্তানের জন্য । আর সন্তানেরও উচিত মার যোগ্য মর্যাদা দেওয়ার। মার প্রতি কোন অন্যায় অবিচার না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা।মার আশীর্বাদ সন্তানের উপর থাকলে কোন অশুভ শক্তি কোন ক্ষতি করতে পারে না । মা তোমার প্রতি রইল অনেক শ্রদ্ধা ও প্রণাম। তোমার জন্যই পৃথিবীতে আজ এত কিছু পেয়েছি মা। খুব ভালো থেকো মা।
No comments:
Post a Comment