Friday, May 3, 2024


 

মুনা 

অনলাইন বৈশাখ সংখ্যা ১৪৩১

ক্রোড়পত্র 




মা

রীনা মজুমদার 


মাকে নিয়ে কি শব্দে বেঁধে লেখা যায়!

মা নামে শব্দটিই বিরাট ব্যাপ্তি ও বড়ো প্রাপ্তি। মায়ের দান, আত্মত্যাগ, আদর্শ ও শাসনে থাকে সীমাহীন ভালোবাসা। মা, তোমাকে নিয়ে লিখতে গেলে যে স্মৃতি বিজড়িত দিনগুলো তোলপাড় করে ওঠে, কলমকে ঝাপসা করে দেয়।

দুই ঠাকুমা আর আমাদের ভাই বোনদের নিয়ে বড় সংসার সামলে তোমাকে দেখেছি ছোটবেলা থেকেই অনেক ভোরে পুজোর ফুল তুলে, তুলসী বেদী ধুয়ে কিছু সময় রাখতে ঘরের ঠাকুরের জন্যে। তুমি বলতে, "কিছু সময় ঠাকুরের সামনে নত হয়ে সারাদিনের চলার আদর্শ গড়ে নিতে, সংসারে একটু সময় ঈশ্বরকে দিতে হয়।"

জীবনের প্রথম শিক্ষা তো তোমার কাছেই। সময় করে পেপার পড়তে, ঠাকুরের বই পড়তে তুমি। আর ছিল তোমার হাতের রকমারি সেলাই। বাড়িতে পরার জামা, শীতের সোয়েটার তোমার হাতের সেই অমূল্য কাজ করা সোয়েটার, এসব নিয়েই তো বড় হয়েছি। 

সেলাই এ ভীষণ আগ্রহ ছিল বলে, মা তুমি জানতে আমিও অনেক সেলাই কাজ খুব ভাল বানাতে শিখে নিয়েছিলাম। করেছি কতরকমের হাতের কাজ তোমার সাথে সাথে। পরেও করছি অনেক সেলাই কাজ। একবার শিখিয়ে দিতে তারপর করে নিতে পারলে তুমি কত খুশি হতে! সব মনে পড়ে। এমনকি আমার রান্না ঘরের গোছানো কাজেও ভাল লাগা বলতে। তোমার শেখানো সেলাই কাজে কাঁথা স্টিচ শাড়ি করে তোমাকে পরিয়েছি। তা আমার বড় প্রাপ্তি মা।

শীতকালে তোমাদের উলের সেলাই তার বিভিন্ন ডিজাইন সব মায়েদের মাধ্যমে কত পাড়া যে ছড়িয়ে পড়তো! তোমাদের সেই সুখের বিকেলগুলো এখনো আমাকে আনন্দ দেয় মা।

এমন সব সুখস্মৃতি গুলো ছাড়াও তোমার জন্য আমার এখনও কষ্ট দেয়--বিশেষ করে নিজে মা হয়ে যখন ছেলেদের স্কুলের জন্য রেডি করতে গ্যাসে খাবার, মাইক্রোওভেনে করতাম! 

আমাদের ভাইবোনদের স্কুলের তাড়াহুড়োর সময় বিশেষ করে বর্ষাকালে মাটির উনুনে কাঠের ধোঁয়ায় রান্নাঘরটা ঝাপসা! তোমাকে দেখাই যেত না। কিন্তু তুমি আমাদের জন্য আগুনের সঙ্গে ভাতের হাঁড়ি নিয়ে লড়ে যাচ্ছ। 

তোমার কষ্ট হতো আমাদের বোধহয় না খেয়েই ইস্কুলে যেতে হয়! আর আমার কষ্ট হতো তোমার এই তাড়াহুড়োর মুহূর্তটাকে দেখে। 

বিয়ের পর মাকে বলতাম, মা তোমাদের হাতে কী নিজস্ব খরচের জন্য টাকা পয়সা থাকত! বাবা দিত? না থাকত না, জানি তখন ওরকম দিন খুব একটা ঘরে ঘরে ছিল না। 

মা বলত, "সংসারের সবই তো তোদের বাবা এনে দিত।"  সময় পাল্টেছে বলেই হয়তো মায়ের কথার মধ্যে কোথাও যেন একটু চাপা দুঃখ দেখতে পেয়েছিলাম। মা তো! মায়েরা সব ত্যাগ করে আপন সুখ খুঁজে নিতে জানে__ বলে, এখন তোরা দিস, তোর দাদারা দেয়। 

আমিও যেন মায়ের এই অনুভব থেকে জীবনের অনেক কিছু শিখে নিলাম।

তবুও মা ছোটবেলায় হঠাৎ কখনোও স্কুলে যাওয়ার সময় পাঁচ পয়সা দিত, তখন আমার খুশির মুখটা দেখে মায়ের চোখে এক তৃপ্তির ছোঁয়া অলক্ষ্যে আমিও দেখতাম। মা আর সন্তানের এই সুখানুভুতি কি কোন কিছু দিয়ে মাপা যায়? না, যায় না। 

মা তুমি খুব তাড়াতাড়ি চলে গেলে! তোমার জন্যে কিছুই করতে পারিনি।  সবার জন্য শুধু করেই গেলে। তুমি শেষের দিকে পুজো করতেই খুব ভালোবাসতে। তুমি ছিলে বন্ধুর মতো, তোমাকে সব বলা যায়। 
 আমাদের, দাদাদের বন্ধুর মায়েরা মাকে 'রত্নগর্ভা' মা বলত.... গর্বে বুকটা ভরে যেত মা।

মা তুমি আছো অন্তরে, তোমাকে নিয়ে লেখার ভাষাও বা আমার কোথায়! লিখেও কী শেষ করা যাবে কখনও? শুধু কিছু স্মৃতি আঁকড়ে মনের অনুভব টুকু বলা। 

মা তোমার আশিষ নিয়েই যেন তোমার আদর্শে সামনে এগিয়ে চলতে পারি। ঠাকুর আছেন, কবিগুরু শান্তনা দেন.... " আছে জন্ম আছে মৃত্যু" 

No comments:

Post a Comment