Friday, May 3, 2024


 

মুনা 

অনলাইন বৈশাখ সংখ্যা ১৪৩১

ক্রোড়পত্র 




টুকরো কথা

শ্রাবণী সেনগুপ্ত 

 ১)"আয় তোর চুলটা বেঁধে দেই তেল দিয়ে।"
  "না না,কি যে বলো মা,তোমার কোনো আক্কেলজ্ঞান নেই,এক্ষুনিতো বেরোব এইভাবে মাথায় তেল দিয়ে বেরোনো যায়!"
আজ সেই মেয়ে কমে যাওয়া রুক্ষ চুলে হাত বোলাতে বোলাতে চোখের জল ফেলে।
২)"
"দিদি, জমি আমার দেখা আছে, কিন্তু আমাদের 
সামর্থ্য নেই,"বস্তিবাসী তিন মেয়ের মায়ের কথার উত্তরে,"চিন্তা করছ কেন,আমি তো  আছি,মেয়েদের নিয়ে এই পরিবেশে থেকোনা,ওরা বড়ো হচ্ছে।"বললেন আরেকজন
মা,যাঁর ফ্যামিলি পেনশন ভরসা, মেয়ের বিয়ে হয়নি,ছেলে সবে কলেজে।
৩)"মা,আমাদের ছোটবেলার কোনো জামা নেই কেনগো?" "তোমাদের আর দরকার নেইতো,তাই যাদের দরকার তাদের দিয়ে দিয়েছি।"আর কিছু বলার অবকাশ নেই।
৪) আলো আছে,তাও না জ্বালিয়ে অন্ধকার ঘরে হারিকেন হাতে নিয়ে  নিঃশব্দে কাজ সারছেন মা,যাতে বাকিদের ঘুমের কোনো ব্যাঘাত না ঘটে।কিশোরী মেয়েটি কিন্তু আধো ঘুমে আধো জাগরণে খেয়াল রাখছে,আর নিজের মধ্যে বপন করছে।
৫)অকালে বিধবা বোনের হাতে তুলে দিচ্ছে ফ্যামিলি পেনশনের পুরো টাকা।রান্না করে নিয়ে যাচ্ছে বেশ কিছু দূরের পথ একে তাকে সঙ্গী করে।
৬)সামনে হারমোনিয়াম,গলা চলে যাচ্ছে শেষ রিড পর্য্যন্ত।কোনো রেওয়াজ নেই ।মনে পড়ে সেই ছোটবেলায় ছিল হাতির দাঁতের হারমোনিয়াম,যেটা বাবা বেলো করতেন,উনি বাজাতেন।বলতেন,"বাবা ব্যালে,আমি বাজাই।"গান শুনে একজন সাহেব টর্চ উপহার দিয়েছিলেন।সব কিছু গিয়ে এখন সংসারের গর্ভে ঢুকে গেছে।
৭)"মাসিমা আপনাকে কি সুন্দর দেখতে,কি রং"
   নার্সটি বলল।"কপালে টিপ পরতে পারিনা।"টকটকে ফর্সা,গোলাপী ঠোঁট,কালো চুল,মাখন ত্বক মাসিমা হাসপাতালের বিছানায় বসে বললেন।
৮)মেয়ে হাসপাতালে গিয়ে দেখল, বিছানার চারদিকে রেলিং দেওয়া,তার মধ্যে শুয়ে মা আয়াদের কুরুশ বোনা  শেখাচ্ছেন।মেয়েকে দেখে একগাল হেসে বললেন,"ওরা বুনতে চায়,কিন্তু ঠিক পারছেনা,তাই একটু শিখিয়ে দিচ্ছি।"তারপর চুপি চুলি বললেন,"আমার যে দেখাশুনা করে ওকে কিছু টাকা দিসতো,ওরা রাত্তিরে আলোচনা করছিল পিকনিক করবে একদিন,আমার তো রাতে ঘুম হয়না,তাই শুনতে পেয়েছি।আহারে কতই বা রোজগার বল,তুই একটু কিছু দিস মন খুলে একটু আনন্দ করুক।নার্স দিদি বলেন,"মাসিমার কি সহ্যক্ষমতা,যেই ওষুধ ভেনের মধ্যে দিয়ে পুশ করলে সবাই যন্ত্রণায় কাতরায়,সেই ওষুধ উনি চুপচাপ সহ্য করে যান।"মেয়ে জানে কেন,মা অস্থির হলে যে সে ভেঙে পড়বে ,তাই -
৯)চলে গেলেন মা,মেয়ে হাসপাতালে আয়া দিদিকে একখানা সবুজ রঙের শাড়ি দিলে,সে সংকোচে বলল,"দিদি,মাসিমাকে তো বাড়ি ফিরিয়ে দিতে পারলাম না,তাও তুমি শাড়ি দিলে!" মেয়ে বলল,"মা যে আমায় বলে গিয়েছিল গো,এই শাড়ীটার কথা,এমনকি আলমারির কোন তাকে আছে সেই কথাও।"
১০)একান্নবর্তী পরিবারের  বহুদিনের রান্নার মাসির মেয়ের সেই বাড়ি থেকেই বিয়ে হয়।পরবর্তীকালে হাঁড়ি আলাদা হলে সেই মাসি বড় জায়েদের পরিবারের রান্নার ভার পায়।সেই মেয়েটি পরে বাড়ি করার জন্য টাকার প্রয়োজনে কারোর কাছ থেকে সহজ না পেয়ে এইখানে বলে,এবং যথারীতি তার সমস্যার সমাধান হয়।মা ছেলেকে বলে যান,"ওর থেকে টাকা ফেরত চাইবিনা।"যদিও মা না বললে ছেলে,মেয়ে কেউই জানত না,এই সাহায্যের কথা।
১১) একান্নবর্তি পরিবারের অনেক ঝড়ঝাপটা অন্যায় আচরণের প্রতিবাদ করতে না পারা,শান্ত,নির্বিরোধী মানুষটির সম্বল ছিল মানুষের প্রতি ভালবাসা,বিশ্বাস,আপন পর নির্বিশেষে স্নেহ।কিন্তু যাদের বেশি স্নেহ দিলেন,নিজের ভাল থাকাকে উৎসর্গ করলেন,তারাই তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পরিবারকে ব্রাত্য করল,আর কিছু পাওয়ার নেই যে।বরং অনাত্মীয় যাঁরা,তাঁদের থেকে অনেক শুভেচ্ছা শুভকামনা পেয়েছে তাঁর পরিবার।
১২)বাবার রেলের চাকরির সুবাদে রাঁচি,নেতারহাট ঘোরা মেয়েটি সবার খুব আদরের,প্রিয় ছিল।কিছু ক্ষেত্রে তাঁর ভালবাসার অপাত্রে দানে সে কষ্ট পেলেও অনেক মানুষের হৃদয়ে সে আজও দেবতা রূপে আসীন।
   বয়সের আগেই ,কুড়ি বছর আগে চলে যাওয়া স্নেহময়ীর স্নেহের কিছু ফল্গুধারার পরিচয় দিলাম, আরো কত যে বাকি রয়ে গেল।

No comments:

Post a Comment