মুজনাই
অনলাইন বৈশাখ সংখ্যা ১৪৩১
ক্রোড়পত্র
মা
ঋতুপর্ণা ভট্টাচার্য
আমার মা তাপসী ভট্টাচার্য আদতে ছিলেন শ্রীরামপুর হুগলি নিবাসী যদিও তাঁর কর্মজীবনের একটা দীর্ঘ সময় কাটে উত্তরবঙ্গের কোচবিহার শহরে। তাঁর পিতা শ্রী প্রমথনাথ ভট্টাচার্য শ্রীরামপুর শহরের অন্যতম শ্রদ্ধেয় লোকপ্রিয় এক ব্যক্তিত্ব যিনি নিজের পেশাগত কাজের পাশাপাশি সত্তরের দশকের অনেকটা সময় ধরে দু’বার কংগ্রেস পার্টির তরফে শ্রীরামপুর পুরসভার কমিশনার নির্বাচিত হয়েছিলেন। অত্যন্ত ছোট বয়স থেকেই পার্টির কাজে নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন তিনি। এমনকি ১৯৪৮ সালে গান্ধীজীর নিধনের পর তাঁর চিতাভষ্ম পার্টির নির্দেশে শ্রীরামপুরের উল্টোদিকের ব্যারাকপুরের গান্ধীঘাট থেকে গঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়ার দায়িত্বও তাঁর ওপরেই ন্যস্ত হয়েছিল। সামাজিক ক্ষেত্রেও বহু অভাবী মানুষকে দল মত ধর্ম নির্বিশেষে তাঁর এক্তিয়ারের বাইরে গিয়ে ব্যক্তিগতভাবেও অনেকসময় বহু সাহায্য আজীবন করেছেন তিনি, যেসব কথা বছর সাতেক আগে তাঁর মৃত্যুর পর ওইসব সাহায্যপ্রাপ্ত মানুষ ও তাঁদের পরিবারের মুখ থেকেই জানতে পারি আমরা। আমার মায়ের পিতামহ শ্রীযুক্ত ভূপতিনাথ সাংখ্যতীর্থ মহাশয় পূর্ববঙ্গের ঢাকা থেকে পরিবারসহ এপারে এসেছিলেন গঙ্গাতীরস্থিত শ্রীরামপুর শহরে বসবাসের জন্য। সেসময় শ্রীরামপুরের রাজা ছিলেন শ্রী কিশোরী গোস্বামী। উনি সেই রাজবাড়ির টোলের সংস্কৃত শিক্ষার প্রথম পণ্ডিতমশাই নিযুক্ত হন এবং রাজ আনুকূল্যেই শহরের একটি প্রধান জায়গায় জমি পেয়ে সেখানে বাড়ি করে বসবাস করতে শুরু করেন। বাড়িতেও টোল ছিল তাঁর আর ফলতঃ বাড়িতে পড়াশোনার পরিবেশ ছিল পুরোদস্তুর। সরস্বতীপুজো ও দুর্গাপুজো হত ঘটা করে। আমার মায়ের মা মালতীদেবী নিজে প্রথাগত পড়াশোনা বেশি দূর না করলেও শিক্ষিত ও নামী পরিবারের কন্যা ছিলেন। তাঁর পিতা শ্রী শ্রী কালীপদ তর্কাচার্য্য মহাশয় সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক থাকার পাশাপাশি সংস্কৃত বিষয়ে তাঁর অনন্য সাধারণ বুৎপত্তি ও অবদানের জন্যে জাতীয় পুরস্কারও পেয়েছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই এমন একটি পরিবারের অংশ হওয়ার ফলে আমার মায়ের শিক্ষাগত দিকটি প্রস্ফুটিত হয়েছিল বেশ ভালোমতোই। তবে সহজে নয়, কারণ বাড়িতে দুদিক থেকেই শিক্ষার পরিবেশ থাকলেও তার আলোটুকু মূলত নির্দিষ্ট ছিল বাড়ির ছেলেদের জন্যেই। আমার মায়ের সময়ে এসে ছেলেমেয়েরা পড়াশোনার সমান সুযোগ পেলেও অত্যন্ত মেধাবী ও দৃঢ়চেতা না হলে সে সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করা সম্ভব ছিল না। এই আমার মাই যেমন স্কুলের পড়া শেষে কলাবিভাগে না গিয়ে বিজ্ঞান নিয়ে পড়বেন ঠিক করায় তাঁর পিতামহ যারপরনাই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন, কারণ তাঁর পরিবারের মেয়েরা বিজ্ঞানের ল্যাবরেটরিতে বসে ব্যাঙ কাটুক কি বাড়ির বাইরে সকলের সাথে মিলে এক্সকারশনে যাক এটা তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি। তবে এই পর্বের পড়াশোনার ক্ষেত্রে তাঁর পাশে দৃঢ়ভাবে এগিয়ে এসেছিলেন আমার দিদা। যৌথ বিশাল পরিবারের সবরকম ভ্রুকুটি হেলায় অগ্রাহ্য করে ছড়ানো বিশাল বাড়ির কোণের একটি ঘরে মাকে পড়তে বসিয়ে বাইরে থেকে শিকল তুলে দিতেন তিনি যাতে বাড়ির সারাক্ষণের হট্টগোলের জন্য কোনরকম অসুবিধা না হয় তাঁর পড়তে। দিদার এই নিরন্তর আন্তরিক সহযোগিতাই আমার মায়ের জীবনের গোড়ার দিকের ভিতটা খুব শক্ত করে গড়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল। স্নাতকোত্তর পড়তে পড়তেই আমার মায়ের বিয়ে হয়ে যায়। আমার বাবার পরিবারও আদতে বাংলাদেশের, যদিও তখন বহুদিন ধরেই তাঁরা মালদহ শহরের বাসিন্দা। বাবা প্রথমে জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়াতে থাকলেও বিয়ের বছর দুয়েকের মধ্যেই কোচবিহারের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিয়ান হয়ে চলে আসেন। আশির দশকের প্রথম দিকে আমার জন্মের পর মাও আমাকে নিয়ে এখানে এসেই থিতু হন এবং এর পরের প্রায় পঁচিশ বছর কোচবিহারেই বসবাস করেন। কোচবিহারের পূর্ব গুড়িয়াহাটি বালিকা বিদ্যালয়ের জীবনবিজ্ঞানের শিক্ষিকা ছিলেন তিনি। স্কুলের সময়টুকু বাদ দিয়ে বাকিটুকু প্রথম থেকেই কেবলমাত্র পরিবারের জন্যেই বরাদ্দ ছিল তাঁর। আমরা দু বোনে স্কুল থেকে ফেরার কিছুক্ষণ পরেই তিনিও ফিরতেন বাঁধা রিকশায়। তারপর ছিল আমাদের বাড়ির পড়াশোনার পাট, নয়তো প্রাইভেট টিউশন অথবা শনি রোববারের আঁকা, গান কি নাচের স্কুল। এছাড়া প্রতিদিন ভোরে সাঁতারের ক্লাস তো থাকতোই। আর এই সবেতেই সঙ্গী মা। সময়ের স্রোত বেয়ে জীবন বদলে যেতে থাকলেও আমাদের জীবনে মায়ের এই ছায়াসঙ্গের জায়গাটা কখনও বদলায়নি। প্রথাগত হিসেবে কি যুগোপযোগী, ঘরের মধ্যে ও বাইরে নিজেদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে সর্বদা তাঁর অকুণ্ঠ ও নিরবচ্ছিন্ন সঙ্গ ও সহযোগিতা পেয়েছি, এবং আজও তাঁর প্রায় সত্তর ছুঁই ছুঁই বয়সে এসেও এ নিয়মের বিন্দুমাত্র অন্যথা ঘটেনি। আজও তাঁর কাছে আমরা তাঁর সন্তানই, এবং তিনি আমাদের মাই। উত্থান পতন সব মানুষের জীবনেই আসে, বিশেষ করে যখন জীবনের মোটামুটি অনেকখানি সময় পেরিয়ে যায়। ব্যক্তিগতভাবে দেখতে গেলে সেদিক দিয়ে কঠিন টালমাটাল সময় আমার জীবনেও এসেছে। কথায় বলে, মানুষকে সবচেয়ে বেশি চেনা যায় জীবনের এই কঠিন সময়গুলোতেই, আর এটা পরিবারের মধ্যে বা বাইরে, সবখানেই সমানভাবে সত্যি, এবং ঠিক তেমনি করেই, জীবনের এইরকম একটি চূড়ান্ত কঠিন সময়েই আমার মা ঠিক মায়ের উপযুক্ত ব্যবহারটাই করেছিল! আমার একান্ত নিজস্ব একটি সিদ্ধান্তকে কোনও রকম প্রশ্ন না করে দুনিয়ার কারুর কথা একবিন্দুও না ভেবে শক্ত হয়ে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন তখন তিনি, তাতে নিশ্চিত ভাগ্যদোষে সময় এলে পরে যেমন ডুবেছিলাম একসাথেই, আবার সেই সময়েরই চাকা ঘুরলে পরে ভেসেও উঠেছিলাম একসাথে।
এতটা সময় পেরিয়ে এসে আজ মনে হয় আমার মায়ের সবচেয়ে বড় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হল তাঁর অসম্ভব দৃঢ়চেতা মানসিকতা, যেকোনও পরিস্থিতিতে নিজের পরিবারের প্রতি নিঃশর্ত সীমাহীন ভালবাসা আর কঠিন টালমাটাল সম্পূর্ণ অনিশ্চিত সময়েও সমাধানের প্রতি পূর্ণ আস্থা রাখা। ঘর বাহির সমান তালে ও সমান দক্ষতার সাথে সামলানো যেকোনও নারীর পক্ষেই অত্যন্ত কঠিন, তবুও ঈশ্বরের আশীর্বাদে এই দারুণ অগ্নিপরীক্ষায় আমার মা সবসময়ই চূড়ান্ত সফল। মায়ের বাইরের একটা খুব ব্যস্ত জগৎ থাকার পরেও তাই ঘরের মধ্যে আমরা মাকে কেবলমাত্র মা হিসেবেই পেয়েছি, যাঁর কাছে সবসময় শিশু হওয়া যায়, যা নয় তাই আবদার করা যায়, যাঁর কাছে সব প্রশ্নের উত্তর না থাকলেও সব সমস্যার সমাধান অবশ্যই থাকে। আর, আমার মা আজও ঠিক এইরকমই।
জীবনের প্রায় দুই তৃতীয়াংশ পেরিয়ে এসে তাই আজ একটিই পরম উপলব্ধি আমার, একজন প্রকৃত মা সঙ্গে থাকলে জীবনে এগোতে আর অন্য কোনও শক্তিরই দরকার হয় না, আর তা না হলে পদে পদে লড়াই, এবং, এই দুর্ভাগ্য আমার আশেপাশের নানা মানুষের জীবনে আমি বহুবার দেখেছি। তাই আজ প্রত্যেকটি মুহুর্তে মনে হয় ঈশ্বরের পরম আশীর্বাদে এক্ষেত্রে আমি সত্যিই ভাগ্যবান, যে একজন সত্যিকারের আদর্শ মায়ের সাথে সাথে এ জীবনে একজন সত্যিকারের বন্ধুও আমি আমার মায়ের মধ্যেই পেয়েছি, আমার সব উত্থানে যে, আমার সব পতনে যে, আমার প্রতিটি মুহূর্তেও যে।
No comments:
Post a Comment