Friday, August 2, 2024


 

সম্পাদকের কথা 


কবি লিখেছিলেন, `সেই সব হারানো পথ আমাকে টানে...` 

শুধু কবিকে নয়। আমাদের সবাইকেই টানে। সেজন্যই হয়ত আমাদের জীবনে ঘুরেফিরে আসে ফেলে আসা কোনও পথ। 

আবার কখনও নতুন পথের সন্ধানে ছুটে যাই এদিক ওদিক। মিশে যাই সেই পথের বাঁকে কোনও স্নিগ্ধ ছায়ায়। 

চেনা পথ অচেনা হয় কখনও। আবার অচেনায় চিনে ফেলি নিত্যদিনের সেই একই পথ। 

এরকম নানা পথ নিয়েই এবারের মুজনাই। আসলে নদীরও তো পথ রয়েছে নির্দিষ্ট। পথ বদলে ফেললে সে যেমন অচেনা, তেমনি জীবনের পথও চেনা-অচেনার গন্ধ মাখা এক অনবদ্য অভিজ্ঞতা! 


মুজনাই অনলাইন শ্রাবণ  সংখ্যা ১৪৩১

 রেজিস্ট্রেশন নম্বর- S0008775 OF 2019-2020

হসপিটাল রোড 

কোচবিহার 

৭৩৬১০১

ইমেল- mujnaisahityopotrika@gmail.com (মাসিক অনলাইন)

ক্রোড়পত্রে ব্যবহৃত সংগৃহিত  ছবি- যামিনী রায়   

প্রকাশক- রীনা সাহা    

সম্পাদনা, প্রচ্ছদ, অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায় 

মুজনাই অনলাইন শ্রাবণ  সংখ্যা ১৪৩১ 


এই সংখ্যায় আছেন যাঁরা 

উমেশ শর্মা, বেলা দে, গৌতমকুমার ভাদুড়ি, গৌতমেন্দু নন্দী

মণিদীপা নন্দী বিশ্বাস, অমলকৃষ্ণ রায়, পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়,

কবিতা বণিক, চিত্রা পাল, অনিতা নাগ, সুদীপ দাস,

 শুভেন্দু নন্দী, লিপিকর, তপন রায়চৌধুরী, মৌসুমী চৌধুরী,

জয়তী ব্যানার্জী, লীনা রায়, ঋতুপর্ণা ভট্টাচার্য, 

বুলবুল দে, অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী, রাজর্ষি দত্ত,

অলকানন্দা দে, জয়িতা সরকার, মনীষিতা নন্দী,

বিশ্বজিৎ সাহা, সুশান্ত পাল, আকাশলীনা ঢোল,

পর্ণা চক্রবর্তী, মঞ্জুশ্রী সাহা, বটু কৃষ্ণ হালদার


মুজনাই অনলাইন শ্রাবণ সংখ্যা ১৪৩১

 




 

 

`.....ঐ পথের ডাকে`


পথ 

মণিদীপা নন্দী বিশ্বাস


এ পথ গেছে কোন্ খানে গো কোন খানে... 

কে জানে! নির্ভেজাল শৈশবের নদী বাঁধের রাস্তা ধরে ছোটা আর সকলের চেয়ে পিছিয়ে পড়া দৌড়ে সেই মেয়ে কখন যে নিজের এক রাস্তা খুঁজে পেয়েছিল, আর আদৌ সে পথ কি তার একার! একার কিছুই তো নয় এ পৃথিবীর। শুধু নির্জন রাতের সে প'ড়ে থাকা বিষন্ন সাদাটে পথটা আর দু:খ যা সব তার। মাঝে মধ্যে দু একটা কুকুর কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে। এদিক ওদিক বিড়াল পেরিয়ে যায়। কখনো থমকে দাঁড়ায় পথের মাঝখানে। রেলিং বারান্দা থেকে কতগুলো সবুজ লতানে মানি প্ল্যান্ট বা সদ্য নতুন পাতায় মোড়া শেফালি গাছটাকে সঙ্গে নিয়ে সাক্ষী থাকে সেই মেয়ে। যে জীবনেও প্রাচীনা প্রবীণা এই পথগুলো বেছে নিতে চায়না। 

পথ দিয়ে কে যায় গো চলে/ ডাক দিয়ে সে যায়...  ঐ পথের ডাকেই তো তার ঘরে থাকা দায় হয়ে ওঠে। বাঁশির সুর বেজে ওঠে প্রাণে বুকের গভীরে স্তব্ধ রাতে। সবটুকু বেদনা আর যন্ত্রণায় যা রাতের আলোতেই স্পষ্ট। পূর্ণিমা এলে চাঁদ জ্যোৎস্নায় যেন সাগর থেকে ডাক আসে। পাহাড় সবুজ পেরিয়ে যায়, কখনো অজস্র লোহার চাকায় বাঁধা হয় পথ। ছোটে সে আপন মনে, কখনো মহানগরীর ভুলভুলাইয়ায় পথ চিনতে চিনতে দিন যায়, রাত যায়। কখনো উড়ানের দরজায় পাখি হতে পারে। কে চেনে আর! নিজের মনেই চোখ ছড়িয়ে দিয়ে কোন নির্দিষ্ট অকুল ভয়ঙ্করের কোন ভাবনা নয়। জীবনের অন্ধিপ সন্ধি তো টেনে নিয়ে যায় কখনো এলোমেলো লক্ষ্যহীন। কখনো বা নির্দিষ্ট লক্ষ্য আর গতির দিকে। আসা যাওয়ার পথের একধারে সেই বাড়িটা। 

কেউ এপারে আসবে বলে হাত বাড়িয়ে দেয়। কেউ বা নিজেই নৌকোর চড়ে বসে। এপারের কথা অন্য পারে পৌঁছে দেয় সুর আর বাণীর মিশেলে। কখনো উদাস সে মেয়ে ভাবে এ পথ ছেড়ে, এ নির্দিষ্ট বাস অতিক্রম করে কোথায় যাবে! 

জীবনের গতি কোথায় নিয়ে যাবে দু'আঙুলে আঙুল জুড়ে! কখনো গেয়ে ওঠে "আমার এই পথ-চাওয়াতেই আনন্দ। " কাকে যেন ডেকে বলে, 'পান্থ তুমি, পান্থ জনের সখা হে... ''পথে চলায় তোমার যেমন আনন্দ আমারও তেমনি। '  এই যে স্বাধীন বেহিসেবি পথ নিজের করে খুঁজে নেওয়া, সে কোথায় চলেছে! 

কখনো কালো অন্ধকার ময়, কখনো আলোয় ভরা পথে চলতে চলতে হাজার কাজের মাঝখানে মন গুন গুন করে। 'এ পথ গেছে কোনখানে গো কোনখানে/ তা কে জানে তা কে জানে! '
কোন দুর্ভেদ্য পাহাড়িয়া পথ, কখনো সাগর বেলায় বালি কাঁকরের রাস্তা। মনে মনে কোথাও পৌঁছনোর দুরাশা নেই। আসলে যে পথ দিয়ে শুরু, সে পথের শেষে কি আছে কে জানবে, কেমন করেই বা জানবে! সে পথের খোঁজ করলেই পাওয়া কি যায়! 

অজস্র পাথর ছড়িয়ে আছে। কখনো ঝর্ণা কখনো বাঁশির সুর। পথ চলতে চলতে নতুন হাওয়ার গন্ধ এসে লাগে, মনে হয়, 'তুমি হঠাৎ হাওয়ায় ভেসে আসা ধন... ' গোপন পথে নিজের মত বেরিয়ে পড়া। কোন গন্ধে যে বাতাস মেতে ওঠে কে জানে! যে মেয়ে পথ হারিয়েছে, তাকেও সচেতন করে তোলে ঐ বাতাসিয়া পথ। সে পথ রাঙা ধুলোর। কোন্ মালা থেকে যে পাপড়ি ঝরে পড়েছে! এমন করে নীরবে পথ বেয়ে এল যে, কোন সাড়া নেই তার, নিরুত্তর। পথ ই খবর পাঠালো, যেতে হবে। বেরিয়ে পড়। সেই জীবনের জীর্ণ পত্রগুচ্ছ কুড়িয়ে সেই তো হেঁটে চলা... আগামীর আলো অথবা অন্ধকার সে-ই তো দেখাবে.... 


 

`পায়ে হাঁটা সেই মাটির পথ.....`


দেশপ্রিয় পথ

গৌতমকুমার ভাদুড়ি

কলোনির রাস্তা কিংবা নতুন সরণি - পথটির এরকম নাম হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে নামকরণ আর হল না কিছুতেই। অবশ্য যখন এই পথের জন্ম হয় সেযুগে সরণি শব্দের প্রচলন তেমন করে চোখেও পড়ত না।সুতরাং নামকরণে তৎকালীনসমকাল খুব চেপে বসেছিল।মুখে মুখে তাই কলোনির রাস্তা নামেই পরিচয় ছিল সে রাস্তার।

কলোনি বলতে অবশ্য হাতে গোনা দশটি পরিবারের বাস্তু ঠিকানা।তার মধ্যেও জ্ঞাতিগোষ্ঠির মিশেলটাই ছিল প্রায় অর্ধেক, সুতরাং সর্বসাকুল্যে ছটি মাত্র পরিবার।বড়োদের মুখে শুনেছিলাম তাঁরা সকলেই দেশভাগের শিকার। ওদেশে বাস্তুহারা হয়ে অনেকটা এক কাপড়েই তাঁরা উঠে এসেছিলেন তখনকার জঙ্গলাকীর্ণ এই পরিত্যক্ত স্থানটিতে।কেউ বলার ছিল না বলে যে যেখানে পারলএকটা চালাঘর বানিয়ে সংসার পেতে বসল।কঠোর পরিশ্রমী ছিলেন এই পরিবারগুলোর সদস্যরা।

লতাগুল্ম সাফ করে ঘর তো বানানো হল কিন্তুজঙ্গল অতিক্রম করে সেসব বাড়িতে পৌঁছনো যে দুষ্কর।আলোচনায় বসলেন পরিবারের কর্তারা। তখন এরকম পঞ্চায়েত-প্রধান এসবের কাজকর্ম কিছু ছিল না।উমেশবাবু নামে এক মাতব্বর গোছের মানুষ গায়ে পড়েই সবাইকে সাহায্য করতে এগিয়ে যেতেন। এক্ষেত্রেও তিনিই এলেন। সাব্যস্ত হল, দিনে যে যার কাজ করবে, সন্ধের পর সবাইকে লাগতে হবে রাস্তা তৈরির কাজে। শুরু হল কর্মযজ্ঞ।কিন্তু সবই তো নিচু জমি, মাটি পাওয়া যে বড়ো সমস্যা। সবার বুদ্ধিতে বড়ো রাস্তার ধার ঘেঁষে একটা নর্দমা খুঁড়ে সেই মাটি দিয়ে খানিকটা কাজ হল। সমস্তটা মিলিয়ে একশো মিটারের মতো সেই রাস্তা। কিন্তু বৃষ্টির প্রকোপ দেখা দিল এরই মধ্যে। আর তখনকার দিনে বর্ষাকাল মানে তো কবে যে সূর্য উঠবে কেউ জানে না।অতএব বছরের বাকি সময়টা একহাঁটু কাদা ভেঙে সকলে যাতায়াত করতে বাধ্য হলেন। বর্ষা ফুরোতেই আবার নতুন উদ্যমে শুরু হল রাস্তা তৈরির কাজ। উমেশবাবু দু তিনজন মজুরেরও ব্যবস্থা করে দিলেন।কলোনিবাসীরা মরণপণ চেষ্টায় দিনরাত্রি ভুলে স্বেচ্ছা শ্রমদানে ব্যস্ত। ছোট একটা ডোবা ছিল। কে একজন প্রস্তাব দিলেন সেটিকে পুকুর বানানো হলে সেই মাটি দিয়ে রাস্তার কাজ অনায়াসে হতে পারে। কাজের উৎসাহ আরও বেড়ে গেল। সারারাতও কাজ করতে রাজি সকলে।পথের খোঁজে মরিয়া একদল মানুষ উঠে পড়ে লেগেছেন যেন।

কাজের সবটা সময় নিজেদের মধ্যেই গল্প চলে। এঁরা সকলেই এসেছিলেন ঢাকামৈমনসিংহ জেলা থেকে। বিপ্লবীদের গল্পকথাই সকলের মুখে তখন-নেতাজি, মাস্টারদা সূর্যসেন, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন,গান্ধীজী সবাইকেই কেউ না কেউ চাক্ষুষ দেখেছেন।ফেলে আসা দেশের গল্প বলার সময় এঁদেরই কথা উঠে আসে।কিন্তু এঁদের নামে তো অনেক রাস্তাঘাট তৈরি হয়েছে, হবেও ভবিষ্যতে। নতুন কিছু নাম দিলে কেমন হয়?

তখন যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্তের কথা সবার মুখে মুখে।চট্টগ্রামের এই মানুষটি নিজে ব্যারিস্টার।বিপ্লবীদের হয়ে কত যে মামলা লড়েছেন, সমস্তই বিনা পারিশ্রমিকে। উল্টে নিজেই ব্যাঙ্ক থেকেঋণ নিয়ে বিপ্লবীদের সাহায্য করেছেন।মানুষের জন্য করতে গিয়েই কারাবাস করতে হয়েছে তাঁকে বহুবার,মারাও গেছেন জেলখানাতেই।ততদিনে দেশপ্রিয় নামে পরিচিত হয়ে উঠেছেন যতীন্দ্রমোহন। সবাই ঠিক করলেন তাঁদের নিজে হাতে তৈরি এই কলোনির নাম হবে দেশপ্রিয় কলোনি আর এই রাস্তা পরিচিত হবে দেশপ্রিয়পথ নামে।

রাস্তা গড়ে উঠল, মাটির রাস্তা হোক তবু সকলের খুব প্রিয়।সকলের ভালোবাসা আছে তার প্রতিটি মাটির গাঁথনিতে।তখনও পাকারাস্তা ধারণাটি গ্রামে প্রবেশ করেনি। মাটির রাস্তাতেই ঘাসের চাপড়া বসিয়ে তাকে মজবুত করে তোলা হল।বর্ষায় একটু কাদা হয় ঠিকই কিন্তু নিজেদের হাতে তৈরি রাস্তায় একটু কাদা থাকলেই বা কী?সকলের বড়ো প্রিয় সেই রাস্তা- দেশপ্রিয় পথ, বড়ো রাস্তার চাইতেও তার প্রতি সকলের আকর্ষণ বহুগুণ বেশি।রাস্তার একধারে পুকুর অন্যধারে কুল পেয়ারা কামরাঙার ফলন্ত গাছ। প্রত্যেক বাড়িতেই ঠাকুরপুজোর ফুল পাবার জন্য জবা আর গাঁদাফুলের বিপুল আয়োজন।আমরা লঙ্কাজবার মধু খেতে বিকেল হতেই ছুটে যেতাম সেই রাস্তায়।

একটু যখন বুঝতে শিখেছি তখন দেখতাম ছোটপিসি আর তার সাত আটটি বন্ধু বিকেল হতেই জড়ো হত সেই রাস্তায় ।বেশ সেজেগুজেই বেরোত তারা।একটু বাদেই দেখতামপাটাকুড়ার ওদিক থেকে দুজন তিনজন সুন্দর যুবক অকারণ সাইকেল চালিয়ে সেই রাস্তার মাহাত্ম্যঅন্বেষণে বেরিয়েছে।একজনের নাম ছিল মলয়দা, আর একজন বুঝি বিপ্লবকাকু।এ পাড়ার দু চারজন দাদার সঙ্গে তাদের দারুণ ওঠাবসা, বুঝি একসাথে পড়াশোনাও করে।সেই অজুহাতে তাদের দৈনিকই আসতে হত এদিকটায়।আরবিশাল বড়োরাস্তা ফেলে তারা ওই দেশপ্রিয় পথেই বারবার সাইকেল চালিয়ে শেষপ্রান্ত পর্যন্ত যাবে, খানিকক্ষণ এমাথা ওমাথা করেসন্ধের মুখে বেরিয়ে আসবে।তারা সবাই সিগারেট খেয়ে গোল গোল করে ধোঁয়া ছাড়ত,আমরা সেটা দেখতেই ঘুরঘুর করতাম।

আমাদের পিসি ও পিসির বন্ধুনিরাও বিকেল হলে আর ঘরে থাকতে পারত না। সেজেগুজে তারাও কেন যেন দেশপ্রিয় পথের শেষপ্রান্তে গিয়ে জটলা করত। অনেকের হাতে বইও থাকত। তখন লাইব্রেরি ছিল না, ওভাবেই নিজেদের মধ্যে বই দেওয়া নেওয়া চলত।কানাঘুষো শুনতাম যে সেসব বইয়ের ভেতরে নাকি চিঠি পাচার হত। আরও অনেকদিন পর, তখন আমরাও স্কুল পাশ করে মৃদু বখাটে হয়ে উঠেছি, একবার মাস-পিটিশন হচ্ছিল যে এখানে পোস্ট অফিসের একটা লেটার বক্স বসালে খুব উপকার হয়। একজন বয়োজ্যেষ্ঠ রসিক মানুষ সে আলোচনায়মন্তব্য করেছিলেন, দেশপ্রিয় পথের জন্য কোনও লেটারবক্স দরকার নেই- এখানকার ছেলেমেয়েরা পোস্ট অফিসের কাজটা নিজেরাই করে নিতে পারে।সবাই হো হো করে হেসে উঠেছিল।

এখনও সে রাস্তা পাকা হয়নি,মাঝে মাঝেই সংস্কারের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। সেদিনের বিকেলগুলোও আর নেই। এখন বাৎসরিক কালী-শীতলা পুজোর দিনটিতেই যা লোকের ভিড়। সেদিনের পেয়ারা কামরাঙার নবীন প্রজন্মরা এখন রাস্তা পাহারা দেয়। ডাল ভেঙে ফল ছিঁড়বে সে ভয় তাদের নেই।বুড়িপিসি মানুপিসিরা ,মলয়দা বিপ্লবকাকুরা কে কোথায় হারিয়ে গেছে কে খবর রাখে। তাদেরই বড়ো প্রিয় পথ ছিল এই পায়ে হাঁটা মাটির রাস্তা –সেদিনের দেশপ্রিয় পথ।

 

 

 

 

 

 



 


স্মৃতির স্মরণি
উমেশ শর্মা

বেলাকোবার অদূরে সারি আমগাছ কালীবাড়ি। 
স্কুলের পথে ঢিল দিয়ে কাঁচা মিঠা আম পাড়ি।।
মিষ্টি৷ আম  টক আম সিঁদুরে  আম সব ছিল জানা। 
গাছে উঠে পাড়তে তো কেউ করতো না মানা।।
ধুলো মাখা পথে গাছ ছায়াতে যেতাম রোজ দিন।
বর্ষার কাদা ঘেঁটে জামা প্যান্ট হয়ে যেত মলিন।।
শীতকালে একটু রোদ পেতে মনে জমে যেত রাগ।
বুড়ো বয়সে তবু সারি আম এখনো ভুলেনি অনুরাগ।।


 

`সাত আট মাইল পথ....`


বিস্মৃতপ্রায় মাইলস্টোনের এক রাজপথ
অমলকৃষ্ণ রায়

পথটা রাজআমলের। মাইল ফলকে মাপা। এ পথ কোনও সহজ-সরল পথ নয়, কখনও মেঠো স্থলপথ, কখনও পিচ ঢালা মোটরগাড়ি ছুটেচলা রাস্তা, কখনওবা নদীপথ, কখনও বিস্তীর্ণ বালির চরের উপর কাশ বিছানো পথ। এই বৈচিত্র্যে ভরা দুর্গম পথই আমায় বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে একাত্ম হবার সুযোগ ঘটিয়েছে। 
বেশির ভাগ মানুষের জীবনের পথটা সাধারণত অনেকটা এরকমই খানাখণ্ডে ভরা থাকে। সবাই তো আর সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মায় না। তাই কোনও নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্তের সন্তানকে সেসব পথ সন্তর্পণে পেরিয়ে তার স্বপ্নের গন্তব্যে পৌঁছোতে হয়। তাতে কেউবা সফল হয়, কেউ বিফল হবার যন্ত্রণাটাকে সারাজীবন সঙ্গী করে বাকিজীবন কাটায়। এটাই হলো জীবনসংগ্রাম। তাতে হারজিত থাকবেই।
কোচবিহার জেলার মাথাভাঙা মহকুমার শীতলখুচি ব্লকের এক অখ্যাত গ্রাম আবুয়ারপাথারে সে পথের ধারেই আমার গ্রামের বাড়ি ছিল। সেই বাড়ির পাশ দিয়েই বিছানো রয়েছে সর্পিল আকারের সেই আঁকাবাঁকা রাজআমলের পথ। মাথাভাঙা হাই স্কুল থেকে বারো ক্লাস পাশ করে এবিএনসিল কলেজে বিএসসি পড়তে যাবার সময় এই দুর্গম পথটাই আমায় মাসে-ছমাসে পাড়ি দিতে হতো। সে পথ আমায় মাঝিবিহীন নৌকা পারাপার করতে শিখিয়েছে, শিখিয়েছে একাকী সাইকেলের প্যাডেল চালিয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে। সে শিক্ষাটাই হয়তো আমায় প্রকারান্তরে সংসারজীবনের হাল ধরার শিক্ষা। নিজেই সংসার নৌকার মাঝির দায়িত্ব কাঁধে আস্ত সংসারকে টেনে নিয়ে যাবার শিক্ষা। আজও স্পষ্ট মনে পড়ে। সুদূর কোচবিহার শহর থেকে সাইকেল চালিয়ে নদীর পাড়ে এসে যখন দেখলাম নৌকাটা পাড়ে বাঁধা। ধারেকাছে কেউ নেই, তখন সাতপাঁচ চিন্তা না করে নৌকার পাটাটনে আমার সাইকেলটাতে শুইয়ে রেখে নির্দ্বিধায় বৈঠাটা হাতে তুলে নিলাম। কোনওরকম প্রশিক্ষণ ছাড়াই নদীটা পাড়ি দিয়ে পাড়ে পৌঁছে দেখি, বনোয়ারী মাঝি বাড়ি থেকে খেয়েদেয়ে খৈনি ডলতে ডলতে বেরিয়ে নৌকাটা দেখতে না পেয়ে ওপারের উদ্দেশ্যে গালাগাল করছে, তোর বাপের নৌকা এটা! মোক না কয়া যে ধরি গেলু! বেজন্মার ঘর। পাশাপাশি আমায় প্রশংসা করে বলেছিল, তুই নৌকাখান আনি ভাল করলু বাপই। না হইলে মোর সাঁতরে আনা খাইল হয়। 
জীবনের প্রথম নৌকা চালানোর অভিজ্ঞতা আমায় স্বাবলম্বী হতে শিখিয়েছিল। কোনও প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নিজেকে সামলে ওঠার মতো মনোবল তৈরি করে দিয়েছিল। তাই আমি বলব, আমার এই পথই আমাকে জীবনপথের চলার শিক্ষার হাতেখড়ি দিয়েছে। জীবনের পথ সবসময় যা প্রত্যাশিত সেটাই যে হবে, তা নয়। অনেকটা পরীক্ষায় পাঠক্রমের বাইরে থেকে প্রশ্ন এলে যা হয়, মুখস্থের বাইরের অচেনা প্রশ্ন হাতে পড়লে যা হয়, ঠিক সেরকমই। ঘাবড়ে না গিয়ে কী করে মন স্থির রেখে উতড়াতে হবে।
আমার জীবনের প্রথম চলার যে পথের কথা বলছি, সেটার সঙ্গে অন্তত কোচবিহারবাসীর একটা পরিচিতি রয়েছেই। যদিও সেটার যে খুব একটা নামডাক রয়েছে তা নয়। এ পথ আমার শৈশবের গড়াগড়ি দেবার পথ, কৈশোরের দৌরাত্মির পথ, গুরুগম্ভীর ভাব নিয়ে নিজের গ্রামের হাই স্কুলে শিক্ষকতা করতে যাবার পথ। এ পথ আমায় একদিন দেউড়ি পেরিয়ে বাড়ির চত্বর থেকে বেরিয়ে এসে মুক্তমনে বাইরের সমাজসংসারের সঙ্গে পরিচিতি ঘটিয়েছে। এ পথ স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছে। যখন দেখতাম, এই পথ ধরে কেউ কেউ শহরের কোনও সরকারি অফিসে চাকরি করতে যাচ্ছে, তখন ভাবতাম, আমি যদি কোনওদিন তাদের মতো হতে পারতাম।
সেই স্বপ্নটা একদিন কিছুটা হলেও বাস্তবায়িত হয়েছিল। সে পথ একদিন অন্য এক সুদূর প্রসারী পথের মোড়ে পৌঁছে দিয়ে বলেছিল, এবার থেকে নিজের ব্যাপ্তিকে আরও বাড়িয়ে তোল। শিক্ষা-দীক্ষা গ্রহণ করে সমাজে মাথা উঁচু দাঁড়াও। শুধু স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটির শিক্ষা নয়, বাইরের জগৎটা তোমাকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করার জন্য অপেক্ষা করছে। সমাজের ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, জ্ঞান-অজ্ঞান বোধ থেকে তুমি কোনটা গ্রহণ করবে, কোনটা করবে না সেটা বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে বিচার-বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নেবে। 
সারাজীবন ধরে সেটাই করে গেছি। তাতে কতটা ভাল, কতটা মন্দ তুলে এনেছি জানি না, তবে আমার সেই ছোটবেলার চেনা পথ থেকে একের পর এক সুদূর প্রসারী হাজাররকম খানাখন্দ, দুর্গমতার পথ পেরিয়ে জীবনটাকে একটা জায়গায় এনে থিতু করেছি। এবার আত্মসমীক্ষণের সময় এসেছে। সারাজীবন ধরে পথ চলতে চলতে কতটুকু পেলাম, কতটুকু পাবার কথা ছিল অথচ পাইনি। পাওয়া-না পাওয়ার হিসেব মেলাতে গিয়ে যখন ভীষণরকম ধন্দে পড়ে যাই, তখন বারবার আমার সেই ছোটবেলার পথটাই স্মৃতিতে ভেসে উঠে। তখন নিজের উপরে দোষ চাপিয়ে আপনমনে বলি, সেই পথ চলার  শিক্ষার হয়তো কোনও খামতি থেকে গিয়েছিল। তাই জীবনে যা পাবার ছিল তার সবটুকু অর্জন করতে পারিনি। তবে এও ঠিক, মানুষের জীবনে প্রত্যাশার কোনও শেষ নেই। তাই যতটুকু অর্জন করতে পারা যায়, তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। আমি সেটা বিশ্বাস করি। তাই জীবনের না পাওয়ার কোনও দুঃখ আমার সুখকে কেড়ে নিতে পারে না।
অনেক কথাই বলা হলো। এবার কোনওরকম কৌতূহল ধরে না রেখে আমার সেই পথটার সোজাসাপটা পরিচয়টা দিয়ে ফেলি। আমার সে পথটা গ্রামের বাড়ি থেকে পিডব্লিউডি মাটির সরক, মানসাই নদী, বালির চর, বাইগনের ছড়া নামের একটা ছোট নদী পেরিয়ে  মাথাভাঙা-কোচবিহার সরকের সাতমাইলে গিয়ে ঠেকেছে। চৈত্রের বাইগণের ছড়া নদীতে হাঁটু জল থাকত। সাইকেল ঠেলে পার হয়ে যেতাম অনায়াসে। আবার বর্ষার বাইগনের ছড়ার নদীতে থাকত একটা কলাগাছের ভেলা। তাতে দুটো দড়ি বাঁধা থাকত। ভেলা দিয়ে পার হবার জন্য কোনও মাঝি খাত না। সাইকেলটা ভেলায় তুলে দড়ি ধরে টান মারলেই অন্য পারে পৌঁছে যেতাম। তারপর সে রাস্তা ধরে সুকটাবাড়ি পেরিয়ে আবারও মেঠো পথে নেমে গিয়ে তোর্ষার ঘাটে ঠেকেছে। সেখান থেকে স্রোতস্বিনী তোর্ষা পেরোলেই সাজানো-গোছানো রাজার শহর কোচবিহার। এই বৈচিত্র্যে ভরা পথই হলো আমার জীবনে বড় হতে শেখার প্রথম পথ। প্রশ্ন আসতে পারে, পথিমধ্যে ‘সাতমাইল’ নামের একটা জায়গা কেন? আসলে আমার বাড়ির পাশে রাজআমলের পি ডব্লিউ ডি সরকটির পনেরো মাইলের খুঁটি ছিল। আর সাতমাইল থেকে রাজার শহর কোচবিহারের দূরত্ব সাতমাইল। সেখানেই ছিল সাতমাইলের খুঁটি। সেই খুঁটির এলাকার বাসস্ট্যাণ্ডকে ঘিরে ক্রমশ কিছু দোকানপাট গড়ে উঠতে উঠতে সেটা হয়ে উঠে সাতমাইলের হাট। তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়ালো, আমার বাড়ি থেকে সাতমাইলের দূরত্ব ১৫—৭=৮ মাইল।
এই সরক আবার পশ্চিমের দিকে আমার বাড়ি ছাড়িয়ে মাথাভাঙা-শীতলখুচিগামী পাকা সড়কে গিয়ে শেষ হয়েছে। সেই তেপথির নাম হলো শিবপুর চৌপথি। সেখানেই ছিল রাজআমলের সতেরো মাইলের খুঁটি। রাজার শহর থেকে সতেরো মাইল দীর্ঘ এই রাজআমলের রাস্তাটার সঙ্গে বর্তমান প্রজন্মের তেমন একটা পরিচিতি নেই। তাই বিস্মৃতপ্রায় এই পথটাকে নিয়েই দুকলম লিখতে ইচ্ছে হলো। কারণ এ পথ আমায় কষ্টসহিষ্ণু হতে শিখিয়েছে। শিখিয়েছে না পাওয়ার গ্লানিকে ভুলে যেতে। শিখিয়েছে জীবনের চাহিদার গণ্ডিটাকে সাধ্যের মধ্যে বেঁধে রাখতে। তাই এ পথের মাইলস্টোনগুলো আজ কিলোমিটারের নতুন খুঁটিতে পালটে গেলেও আমার কাছে এখনও সেটি রাজপথই। বিদ্যাসাগরের মাইলস্টোনে মাপা গ্রাম্য পথের মতো এ পথ আমার কাছে খুবই দামি।


 

`এই পথ যদি না শেষ হয়`


জীবনপথে চলতে গিয়ে হোঁচট খেতে খেতেই সন্ধান পাই নতুন নতুন পথের -----

গৌতমেন্দু নন্দী

সেই পথের কোথায় শুরু আর কোথায় শেষ কেউ জানিনা। তবুও চলতেই হয়। "জীবন পুরের" পথিক হয়ে জন্মের পর থেকেই সেই পথ চলা শুরু।

     কখনও আনন্দ কখনও বিষাদ, কখনও ক্লান্তি কখনও রোমাঞ্চ। চলার পথে ক্লান্তি এলে চলতে চলতেই উচ্চারণ করি " পথের ক্লান্তি ভুলে স্নেহ ভরা  কোলে তব মা গো বলো কবে শীতল হবে...কতো দূর আর কতো দূর বলো মা...... যতই দূঃখ তুমি দেবে  দাও তবু জানি কোলে শেষে তুমি টেনে নাও 
মা গো তুমি ছাড়া এ আঁধারে গতি নাই তোমারে কেমনে ভুলে রবো......"

      জীবন মানেই পথ। তাই জীবনের সংগীতের মতোই চলমান পথেরও সংগীত আছে।  পথের গানই পথ চলার মন্ত্র হয়ে দেখা দেয়। তাইতো আমরা সবাই চির পথিক। বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়েই এই পরিক্রমন্য পথের মধ্যে ধ্বনিত হয়েছে  অনন্ত জীবনের মহাসংগীত। 

     এই পথই আবার আহ্বান জানায় বন্ধুত্বের, সহযোগীর " পথে এবার নামো সাথী, পথেই হবে এ  পথ চেনা...." কখনও আবার এভাবেও আহ্বান  জানায়। " পথ দিয়ে কে যায়গো চলে ডাক দিয়ে সে  যায় ......" আবার আমরাই উচ্চারণ করি " পথ হারাব  বলেই এবার পথে নেমেছি ......"। আমরাই বলি ,
" যতো মত ততো পথ.."

      আমাদের জীবনের অনুষঙ্গে পথের এই দাবি বিভিন্ন ভাবেই জড়িয়ে আছে। সাধারণ চলার পথেও
এই ভালোলাগা, মুগ্ধতার কারণগুলোও পূর্ব নির্ধারিত  থাকেনা। পথের পরিসরই দৃষ্টিনন্দন পথচলার মাপকাঠি যে হবেই তা নয়। জীবনের বাঁকে বাঁকে যেমন লুকিয়ে  থাকে , আত্মগোপন করে থাকে অপার বিস্ময়, তেমনি অপরিসর পথের কোন বাঁকে কোন্ মুগ্ধতা, বিস্ময়ের হঠাৎ আবির্ভাব ঘটবে তাও পূর্ব নির্ধারিত  নয়। চমক যেমন থাকতে পারে তেমনি থাকতে পারে অবাঞ্ছিত, অপ্রত্যাশিত প্রত্যাঘাত। এই বাঁক বদলের, অপরিসর বা প্রশস্থ পথের কোনায় কোনায় জীবন নাট্যের পালাবদলের কাহিনীর রোমাঞ্চকর আবির্ভাব। তাঁকে প্রশ্রয় বা উপেক্ষাই হলো এগিয়ে চলা।  আমরা বলি, "চরৈবেতি চরৈবেতি....."

      কখনও রোমান্সের সুর মিশিয়ে উচ্চারণ করি---
" এই পথ যদি না শেষ হয় তবে কেমন হোত তুমি বলোতো...!!"


 

`অন্তবিহীন পথ চলাই জীবন` 


এ পথ গেছে কোন খানে...
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় 

দশটা চুয়াল্লিশ মিনিটের আপ বনগাঁ লোকালের সাথে ডাউন ট্রেন শিয়ালদহ গামি ট্রেনের ক্রসিং হতো গোবরডাঙা স্টেশনে । আর  সেই ট্রেনেই আসতেন সব স্যারেরা। আসতো  সব সহপাঠী। একঝাঁক  বন্ধু বান্ধবীরা। আমরা সাত জনের একটা টিম ছিলাম।ছাত্র সংসদের পত্রিকা সম্পাদক ক্ষীরোদ ঘোষ ছিল আমাদের টিম লিডার। ছিল রীতা বসু, অর্চনা ঘোষ, কৃষ্ণা মিত্র, স্নিগ্ধা দে, সুভাষ দাস। আমরাই ছিলাম কলেজের শেষ কথা। স্নিগ্ধা সব পরীক্ষায় প্রথম হতো। আমরা সবাই উন্মুখ হয়ে থাকতাম সোয়া এগারোটায় কলেজ গেটের মধ্যে দিয়ে প্রবেশ করবার জন্য ।  শুধু গেটের মধ্যে প্রবেশ করত না তপন, রাজেন আর সোমনাথ।  ওরা বসতো বিশ্বনাথদা'র চায়ের দোকানে।  সবাই বলতো ওরা তিন জনই বছর চারেক আগে পাশ আউট। স্রেফ রাজনীতি আর এই পথটার টানে রোজই কলেজে আসতো।

কলেজের  সেই পথটা আজও আমাকে খুব টানে।  রেললাইন পার হওয়ার পরই যেন একটা ছাত্রদের মিছিল।  কেউ গাইছে গান, কারো মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ আবার কারো বা সদাই মনে জিজ্ঞাসা,  "আচ্ছা রবি ঠাকুরের মেজবৌদির নাম কি ছিল রে ? "

টাউন হলের মোড়টা ঘুরলেই একটা নীল আকাশ।  আর তার দিগন্ত জোড়া উড়ন্ত  রঙিন কার্পেট। এক বর্ণিল সাগরে ডুব দিতেই সার সার পাম গাছ মধ্যপ্রদেশ বের করে দাঁড়িয়ে আছে।  কলেজ শুরু হওয়ার আগে থেকেই লোহার ফেন্সিং এর মধ্যে নানা রঙের ফুলের বাহার। গেটের মধ্যে অজস্র ছোট বড় রঙিন পাতাবাহার নানা রঙের ফুলের গাছকে পাহারা দিচ্ছে এক আগুন ঝরানো কৃষ্ণচুড়া।

চলাই জীবন আর থেমে যাওয়াই মরণ। জীবন নদীর গা ঘেঁষে ঠিক কবে থেকে আমার পথ চলা শুরু হয়েছিল  তা সঠিক ভাবে বলতে পারব না। আমাদের প্রত্যাশা এবং প্রাপ্তির মধ্যে একটা লম্বা পথ প্রতীক্ষার প্রহর গুনতে থাকে মৃত্যুর দুয়ার অবধি। একটা করে দিন এগিয়ে চলে, আশা থেকে উত্তরণ এর দিকে  এগিয়ে চলতে থাকে  জীবন। এই পথের গুঢ় রহস্য  ঠিক কবে  থেকে বুঝতে শিখলাম বলতে পারিনা।  কিন্তু   হঠাৎই   অনুভব করলাম এই পথ চলায় আমার চিরস্থায়ী সাথী কেউই  হবেনা। কিছু দূর গিয়ে লতার মতো কাউকে নির্ভর করি,তাকে  একান্তই আপন ভেবে এগিয়ে চলি। যে হাতটা ধরি সেই  হাতটা অদৃশ্য  আর একটা হাত এসে ছাড়িয়ে নিয়ে উধাও হয়ে যায়। একটা পথ আমাকে আজ জীবনের প্রান্ত দেশে এনে  দাঁড় করিয়েছে। তার সাথে   আমার কলেজের পথ অর্থাৎ গোবরডাঙা হিন্দু কলেজের প্রবেশ পথের কোনো মিল নেই।  

সেই পথে বনগাঁ, চাঁদপাড়া, ঠাকুরনগর থেকে বন্ধুরা যেমন আসতো, ঠিক তেমনি ভাবে আসতো অশোকনগর, হাবড়া, মছলন্দপুরের বন্ধুরা। এখন হঠাৎ কখনো  সেই পথে গেলে এস ওয়াজেদ আলীর আঁকা ছবি চোখে পড়ে। চেনা মুখগুলো আর নেই।  বদলে গেছে চুলকাটার ডিজাইন।  উধাও হয়েছে বেল বটম প্যান্ট। রবীন্দ্র সংগীত পরিবর্তিত হয়েছে চটুল হিন্দি গানে।  

প্রচন্ড গ্রীষ্মের দাবদাহেই হোক বা অবিশ্রান্ত বর্ষায় কিম্বা হালকা শীতের দিনে এই পথের রঙ বদলে যেত।  পথের ধার দিয়ে ছিল অসংখ্য ছোটো বড়ো দোকান।  ছিল বহু রঙ বেরঙা ঘটনার সাক্ষী ঐতিহাসিক  টাউন হল। কলেজ জীবনে দুই চোখের স্বপ্ন ছিল আকাশ ছোঁয়া। ক্লাসরুমে শব্দেরা আকার নিত।বাইরে রিমঝিম ভরা দুপুর। কলেজ গেটের বাইরে পড়ে থাকত  দীঘল বর্ণময় সাপের মতো আঁকাবাঁকা নিরব নিস্তব্ধ এক পথ। চোখে স্বপ্ন, মনে ইচ্ছা আর অদম্য সাহসকে ভর করে  তিলে তিলে এগিয়ে চলছিল জীবন। প্রত্যাশা এবং প্রাপ্তির দুরত্বে সব আশা বোধ করি  দুরাশায় রূপ নেয়।  যদিও এটা একান্তই আমার মত। সব পথই যেন এগিয়ে চলেছে 'টাওয়ার অব সাইলেন্সের" দিকে। যেখানে গুমরে মরে হাজার না বলা কথারা। তাই কবিগুরুর ভাষাতেই  বলতে চাই, " কোন দুরাশার সন্ধানে তা কে জানে তা কে জানে।....  এ পথ গেছে কোনখানে তা কে জানে তা কে জানে। "


 

`পথে যেতে যেতে....`


বাসে পাশে 

লিপিকর 


একই সময়ে একই এলাকার কর্মালয় থেকে মুক্তি মেলে দুজনের, প্রত্যহ না হউক, প্রায়শ:ই প্রত্যাবর্তনের পথে চারিচক্ষুর মিলন ঘটে, আলাপচারিতার সৌজন্য পার হয় দিন, সপ্তাহ, মাস, বছর, দশকও বা। দেখা হইলে সমাজের অব্যবস্থা, দুর্নীতি, বাসচালকের রূঢ়তা, কন্ডাক্টরের খুচরো-না-দিবার-অনাবশ্যক-কলহ ইত্যাকার অভিজ্ঞতা বিনিময়ের মধ্যেই সাধারণত: বাস আসিয়া পড়ে। “কেমন আছেন?”, “কতক্ষণ?” ইত্যাদি আলাপচারিতার মাঝেই একদিন মেয়েটির কপালে রক্তিম শৃঙ্খল চোখে পড়ে, আরও সময় বহিলে ছেলেটির কেশরাশি একটু ঈকটু করিয়া শ্বেতাভ ও হ্রস্ব-সংখ্যক হইতে থাকে। বাসে উঠিয়া মেয়েটি সম্মুখের কোনো একটি আসনে গিয়া বসিয়া পড়ে, ছেলেটি পশ্চাতের গবাক্ষের নিকটস্থ একটি বিশেষ আসনের দিকে ধাবমান হয়, পাইলেই ব্যাগ হইতে কোনো একটি রহস্যকাহিনী নিষ্কাশন করিয়া তাহাতে ডুবিয়া যায়, সমস্তদিনে ঐটুকুই তাহার বিনোদন, অবকাশ, মুক্তি, সে একটি বাস ছাড়িতেও এজন্য দ্বিধা করে না। মেয়েটিও বসিবার স্থান না পাইলে অধিকাংশ সময়ে ভীড় বাস ছাড়িয়া থাকে, গদির মোহমার্গে তাহারা একই পথের পথিক।


দীর্ঘ সহযাত্রায় তাহারা পরস্পরের বাসস্থানের অঞ্চল সম্বন্ধে জানিয়াছে। প্রভাতে আপিস যাইবার কালে তাহাদের গৃহত্যাগে যে দুই ঘণ্টার ফারাক, তাহাও কথোপকথনে প্রকাশ পাইয়াছে। ফিরিবার সময়ে মেয়েটির গন্তব্য আগে আসে, চারিচক্ষু মিলিত হইলে দুজনেই সামাজিকতা রক্ষার মুখব্যাদান করিয়া থাকে, ঐটুকুই। 


ক্যালেন্ডার উঠিয়া সবকিছু কম্পিউটার-চালিত হইয়া গেল ক্রমে-ক্রমে, মনিব পরিবর্তন না করিয়াও শুধু একই কর্মাবাসে থাকিবার নিমিত্ত ছেলেটিকে যে পরিমাণ শ্রম করিতে হইল শেষ কয়েক বৎসর, তাহাতে চাহিলে উচ্চতর বেতনের চাকুরি জোগাড়ও হয়তো করিয়া ফেলা সম্ভব হইত। কিন্তু অতীত লইয়া ভাবিয়া সবকিছুর সামাধান হয় না, ছেলেটির দীর্ঘ কর্মজীবন সমাপন হইবার উপক্রম হইয়াছে। ক্লান্তিকর দৈনন্দিনতার বাকী দিনগুলি যখন কমিতে কমিতে অঙ্গুলির কড়ে গণিবার উপযুক্ত হইল, তখন একদিন বাসে দুইজনের দেখা হইল। এখন বাসের আসনবিন্যাস পালটাইয়াছে, কোথাও বসিয়াই ছেলেটি সুখে বই পড়িতে পারে না, আজ সে মেয়েটির পার্শ্বে উপবেশন করিয়া মেয়েটির সঙ্গে গল্পে ইচ্ছুক হইল। দেখা গেল, মেয়েটিও কথাবার্তায় উৎসুক। ছেলেটি মেয়েটিকে আশু অবসরের বার্তা জানাইতে সে উপযাচক হইয়া ছেলেটির দুরভাষ সংখ্যাটি চাহিয়া লইল, শীঘ্রই মেয়েটির একমাত্র পুত্রের বিবাহ, ছেলেটিকে সে অনুষ্ঠানে সপরিবারে আসিতে হইবে। ছেলেটি আর তাহাকে বিব্রত করিতে চাহিল না এই বলিয়া যে, সে জীবনেও দার পরিগ্রহ করে নাই, বরাবরই সে একলা থাকে। মেয়েটি সংখ্যা টিপিয়া মিসড কল দিয়া কহিল, “আমার ফোন নাম্বার-টাও নিয়ে রাখুন।”, ছেলেটি নিজ যন্ত্রের পর্দায় সেটি দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কী নামে সেভ করবো?”


এক প্রৌঢ় ও এক প্রৌঢ়া সহসা আবিষ্কার করিল, তিন দশকের সহযাত্রায় প্রায়-প্রাত্যহিক প্রতীক্ষার অব্যক্তিগত আলাপে তাহারা পরস্পরের নামটুকুও জানিয়া উঠিতে পারে নাই।


 

`অন্য পথের গল্প....`



অব্যক্ত

তপন রায়চৌধুরী

 

লোকাল ট্রেনে হাওড়া থেকে বাড়ি ফিরছেন অরুণাংশু দত্ত। লম্বা সিটের একদম ধারে বসার  জায়গা পেয়েছেন। ব্যাগ থেকে একটা ম্যাগাজিন বার করে পড়া শুরু করলেন। লিলুয়া স্টেশনে এক দঙ্গল লোক উঠল। ভিড়ে ভরে গেল ট্রেনটা। অরুণাংশুর সামনের সিটটাতে একেবারে মুখোমুখি এক ভদ্রমহিলা এসে বসলেন। ম্যাগাজিন থেকে মুখ সরিয়ে ভদ্রমহিলাকে দেখলেন একঝলক। খুব চেনা চেনা লাগছে। কিন্তু মনে করতে পারছেন না, কোথায় যেন দেখেছেন ভদ্রমহিলাকে। একজন ভদ্রমহিলার দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। অরুণাংশু আবার পড়াতে মন দিলেন। বেলুড়ের কাছাকাছি ট্রেন এসেছে এমন সময় ভদ্রমহিলা বলে উঠলেন, “আচ্ছা দাদা, একটা কথা বলব।“

ম্যাগাজিন থেকে মুখ সরিয়ে অরুণাংশু ভদ্রমহিলার দিকে তাকালেন। বললেন, “আমাকে বলছেন?”

“হ্যাঁ।“

“আপনি কি বিধান কলেজ থেকে পাশ করেছেন?”

স্বভাবতই উৎসুক হলেন অরুণাংশু। ম্যাগাজিনটা কোলের ওপর রেখে বললেন, “হ্যাঁ, কেন বলুন তো?“

“কোন ইয়ার পাসড আউট?”

“১৯৭১।“

“সাবজেক্ট কী ছিল?”

“পল সায়েন্স অনার্স।“

অরুণাংশু তখন প্রায় চিনে ফেলেছেন ভদ্রমহিলাকে। তবে একশোভাগ নিশ্চিত হতে পারছেন না। কিন্তু ভদ্রমহিলাই হেসে বললেন, “আপনি কি অরুণাংশু দত্ত?”

একগাল হেসে অরুণাংশু বললেন, “ইয়েস। আপনি তো নিশ্চয়ই সুভদ্রা বোস?”

“হ্যাঁ।“ হেসে ঘাড় নাড়লেন ভদ্রমহিলা।

 

তারপর কলেজ জীবনের নানা মধুর স্মৃতি শুরু হয়ে গেল তাদের মধ্যে। হকারের চিৎকার চেঁচামেচি, ভিড় এসব কিছুই যেন আর গায়ে লাগছে না।

 

ট্রেনের ভিড় ক্রমশ বাড়ছে। তাদের মুখোমুখি সিটদুটোর মাঝখানে লোকেরা এসে দাঁড়িয়েছে, যা হয় একটা লোকাল ট্রেনে। ওদের কথায় ছেদ পড়ল তখনকার মত। অরুণাংশু আবার পড়াতে মন দিলেন। কিন্তু মন যে আর ম্যাগাজিনে বসছে না!   

 

সবেমাত্র তখন কলেজে ঢুকেছে অরুণাংশু। লম্বা ঢ্যাঙা চোয়াড়ে চেহারা, রং কালো, একেবারেই বিশেষত্বহীন এবং সর্বোপরি আর্থিকভাবে দুর্বল। হীনম্মন্যতার কারণে নিজেকে সবার থেকে তফাতে রাখতেই বরাবর পছন্দ করত সে আর, সেই কারণেই কলেজের প্রথম দিন থেকেই ক্লাসরুমের শেষ দিকের বেঞ্চিগুলো ছিল তার খুব পছন্দের জায়গা।

 

শ্রীরামপুর রেল স্টেশন থেকে কিছুটা দূরে ছিল অরুণাংশুর বাড়ি। তিন-চারটে টিউশন বাবদ তখন তার তিরিশ টাকা মাসে আয়। সাইকেলে চেপে  স্টেশন, সেখানে সাইকেল গ্যারেজ করে, তিন টাকার মান্থলি সম্বল করে কলেজ যাতায়াত।

 

পল সায়েন্স অনার্স ছিল প্রধান বিষয়। তবে নামেই অনার্স, কারণ, কলেজের নিয়মানুসারে প্রথম কয়েক মাস শুধুমাত্র পাস সাবজেক্টেরই ক্লাস হবে। তারপর একটা এলিমিনেশন টেস্ট হবে এবং তখনই নির্ধারিত হবে কোন কোন অনার্স বিষয়ে কারা কারা সুযোগ পেল। সেই নিয়মেই প্রথম কয়েকমাস ক্লাস হল শুধুমাত্র পাস বিষয়ের ওপর।   

 

পাস সাবজেক্টের ক্লাসগুলোর সময় একটা বিশেষ ব্যাপার নজরে এল অরুণাংশুর পাস অনার্স মিলিয়ে ছাপ্পান্ন জন ছাত্রছাত্রী। তার মধ্যে প্রায় সত্তর-আশি ভাগই মেয়ে। কোনো মেয়ের দিকে বিশেষভাবে তাকানো, কিংবা যেচে আলাপ করা তার সঙ্গে, এমন সাহস সে করেনি কোনোদিন। বরং নিজের কুরূপের কারণেই মেয়েদের থেকে সে শত হস্তে দূরে থাকত। তাছাড়া যে-কঠোর পারিবারিক আবহাওয়া বা অনুশাসনের মধ্যে সে বড় হয়েছে, কখনও  কোনো মেয়ের সঙ্গে আলাপ, বন্ধুত্ব বা অন্যরকম সম্পর্ক হতে পারে, এসব সে স্বপ্নেও ভাবতে পারত না। কিন্তু বয়সজনিত চরিত্র তো এসবের ধার ধারে না। তাই এখানেও কিছুটা অন্যরকম হল। একটি মেয়ের দিকে তার চোখ চলে যেত বারবার। সে কমলিকা। শুধু অসাধারণ সুন্দরী বললে কম বলা হবে, সেইসঙ্গে এক নিটোল মনোরম ব্যক্তিত্ব প্রকাশ পেত তার চলাফেরা এবং কথাবার্তায় কোনো ছেলে তার দিকে একবারের বেশি না তাকিয়ে থাকতে পারত না। উঁচু ক্লাসের ছেলেরা এমনকি ইউনিয়নের ছেলেরাও তাকে বেশ লোভাতুর দৃষ্টিতে দেখত। কমলিকা বুঝতে পারত সব, কিন্তু তার ব্যক্তিত্ব এমনই প্রখর ছিল যে কেউই সম্ভবত সাহস করে তার কাছে এগোতে সাহস করেনি

 

কমলিকার সঙ্গে একটি মেয়ে সবসময় ছায়ার মতন থাকত। তার নাম সুভদ্রা। প্রায়ই দেখা যেত, ওরা দুজন ক্লাসে ঢুকত একসঙ্গে, আবার, ক্লাস শেষ হয়ে গেলে বেরিয়ে যেত একসঙ্গে। শুধু তাই নয়। ক্লাস চলাকালীন ওদের দুজনকে সবসময় পাশাপাশি বসতে দেখা যেত। অথচ অদ্ভুত ব্যাপার,  কমলিকা যেখানে অপরূপ সুন্দরী, সুভদ্রা সেই তুলনায় একেবারেই সাদামাটা দেখতে। বাস্তবে বোধহয় এমনটাই হয় কিনা কে জানে।        

 

অনার্সের প্রথম দিনের ক্লাস। অরুণাংশু যথারীতি শেষ বেঞ্চিতে। আর, এই শেষে থাকার সুবাদে সে দেখতে পাচ্ছিল সবাইকে, যদিও পেছনটাই। সবসমেত মোট আটাশ জন অনার্সের ছাত্রছাত্রী। তার মধ্যে চব্বিশজন মেয়ে, চারজন ছেলে। সামনের দিকে সব মেয়েরা বসে, আর, ছেলেদের মধ্যে সে ছাড়া বাকি তিনজনকে একটু কষ্ট করেই খুঁজে নিতে হল। অনার্সের ক্লাস ছিল দিনে দুটো কিংবা তিনটে কোনো বিশেষ ঘরে, বাকি সব পাসের ক্লাস। অরুণাংশু ঠিক করল, ক্লাস শেষ হওয়ামাত্র সে একরকম ছুটেই বেরিয়ে যাবে ক্লাস থেকে।

 

সেসময় কলেজে পড়াশুনার আবহাওয়া ছিল বেশ ভালোই। প্রাইভেট টিউশন বলে কোনো ব্যাপার ছিল না বললেই চলে। ছাত্রছাত্রীরা অধ্যাপকদের ক্লাস লেকচারের ওপরই সম্পূর্ণ নির্ভর করত। অনার্স ক্লাস তো বটেই, এমনকি পাসের কোনো ক্লাসও কেউ খুব একটা মিস করত না। বেশ মনে পড়ে, এস এস বলে একজন অধ্যাপক ছিলেন, সপ্তাহে দুটো ক্লাস ছিল তাঁর, তিনি প্রথম দিন যা পড়াতেন, পরের দিন প্রথম দশ-পনেরো মিনিট আগের দিনের পড়া ধরতেন, তারপর নতুন জিনিস পড়াতেন। কেউ ফাঁকি দিতে পারত না তাঁর ক্লাস। কারণ, রোল কল করার সময় তিনি রেজিস্টার দেখে নাম ধরে ডাকতেন এবং আগের দিন অনুপস্থিত থাকলে তিনি ‘অনুপস্থিতির যথাযথ কারণ জানতে চাইতেন। তখন মিথ্যে কথা বলে খুব একটা পার পাওয়া যেত না।                   

 

একটা দিনের কথা মনে পড়ে। পি সি এম স্যারের অনার্সের ক্লাস ছিল সেদিন। প্রথমেই বলে দিলেন তিনি, “আজ যা পড়াব তার ওপর তিনটে প্রশ্ন দেব, তোমরা পরের দিন সেগুলোর উত্তর লিখে নিয়ে আসবে।“

 

পি সি এম স্যারের ক্লাস ছিল সপ্তাহে দুদিন। যথারীতি সকলের উত্তরপত্র পরের দিন স্যারকে জমা দিতে হবে। সামনের সপ্তাহে স্যার এলেন ক্লাসে আটাশ জনের খাতা নিয়ে। এসেই প্রথমে রোলকল করে একবার সকলের দিকে তাকালেন। এটা স্যারের বরাবরের একটা অভ্যেস ছিল। রোলকল করার পরে কিছু বলার আগে বা পড়ানো শুরু করার আগে একবার দেখে নিতেন সবাইকে। তারপর লেকচার শুরু করতেন। সেদিনও এর ব্যতিক্রম ছিল না। সকলে টানটান বসে। স্যার খাতাগুলো নিয়ে এসেছেন, এবার কী বলবেন কে জানে!

 

হঠাৎ বলে উঠলেন, “অরুনাংশু দত্ত কে আছ, হাত তুলবে।“

 

অরুণাংশু তখন কাঁপতে শুরু করেছে। নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে আসছে! স্যার যে তারই নাম করলেন! ভয়ে ভয়ে হাত তুলল সে

গম্ভীর গলায় স্যার বলে উঠলেন, “ওহ্ তুমি!”

 

বলার সঙ্গে সঙ্গে সকলের চোখ তখন ঘুরে অরুণাংশুর দিকে তাকিয়ে! সে কী করবে বুঝে উঠতে পারছিল না। স্যার আবার বলে উঠলেন, “এখানে এসো।“

 

ক্লাসের শেষ বেঞ্চিতে সে। স্যারের কাছে পৌঁছতে গেলে অনেকটা পথ হেঁটে যেতে হবে। ক্লাসরুমের দুধারে সার সার বেঞ্চিতে ছেলেমেয়েরা বসা। মাঝখানে চওড়া পথ। অরুণাংশু উঠে দাঁড়াল আস্তে আস্তে। মনে হল, পাদুটো ভারি হয়ে গেছে তার। বোধহয় হাঁটতে পারবে না, এমনই অবস্থা! স্যার আবার বললেন, “কী হল? তোমাকে আসতে বললাম যে! কথা যায়নি কানে?”

“হ্যাঁ স্যার।“

 

অস্ফুটে বলল অরুণাংশু। স্যার সেটা শুনতে পেলেন কিনা জানি না। অরুণাংশু হাঁটতে শুরু করল। মনে হল, এত দীর্ঘ পথ এই প্রথম সে হাঁটছে জীবনে। সাতাশ জোড়া চোখ তখন তাকে জরিপ করছে বুঝতে পারছে। কোনোমতে একটা নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে স্যারের সামনে গিয়ে দাঁড়াল অরুণাংশু

 

স্যার বললেন, “আমি যা যা বলেছি আগের দিন ক্লাসে, দাড়ি কমা পর্যন্ত, সবটাই তোমার খাতায় দেখছি। এটা কারুর খাতায় আমি পাইনি, একমাত্র তোমারটা ছাড়া। এটা কীভাবে করলে তুমি!”

 

ধড়ে কিছুটা প্রাণ এল অরুণাংশুর। খুব বিনীত ভাবে আস্তে বলল সে, “স্যার, আমি শর্ট হ্যান্ড জানি

উদ্ভাসিত স্যারের মুখ তখন। বললেন, “ও, তাই বুঝি! ভেরি গুড। আমার বিশ্বাস, তুমি খুব উন্নতি করবে জীবনে

 

স্যারের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে অরুণাংশু মাথা নীচু করে নিজের জায়গায় চলে গেল। কোনোদিকে না তাকিয়েও পরিষ্কার বুঝতে পারল, ক্লাসের সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে সপ্রশংস দৃষ্টিতে।

 

ক্লাস শেষ হল। স্বভাবতই প্রত্যেকদিনের মত সেদিনও ক্লাস ছেড়ে বেরোতে যাবে, এমন সময় পেছন থেকে শুনতে পেল মেয়েলি কণ্ঠস্বর, “শোনো।“

দাঁড়িয়ে গেল অরুণাংশু। কমলিকা! কী বলতে চায় ও? বিস্ময় চেপে রেখে বলল, “আমাকে বলছ?”

“হ্যাঁ। একটু কথা ছিল তোমার সঙ্গে।“

 

বরাবর মেয়েদের এড়িয়ে চলেছে সে। কোনোদিন কোনো মেয়ে এভাবে তাকে কিছু বলতে পারে, তাও কমলিকার মত মেয়ে, এটা ছিল তার ধারণার বাইরে প্রায় কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল, “বলো।“

“একটু ওদিকটায় যাবে। বসে কথা বলা যাবে ওখানে।“ 

 

কলেজটা ছিল ঠিক গঙ্গার পাড়ে। কলেজ আর গঙ্গার মাঝখানে একটা কাঁটাতারের বেড়া। বেড়ার এপাশে অর্থাৎ কলেজ ক্যাম্পাসের মধ্যে সবুজ ঘাসের গালিচা পাতা আছে যেন। গঙ্গার হাওয়ায় উথাল পাথাল চারিদিক। অপূর্ব মনোরম পরিবেশ। কমলিকা ইঙ্গিত করল ওইদিকটাতেই।

 

একটা সৌজন্যমূলক দূরত্ব বজায় রেখে ওরা দুজন পাশাপাশি বসল। সামনে বিস্তীর্ণ জলরাশি। দুএকটা নৌকা দেখা যাচ্ছে দূরে। শান্ত পরিবেশ। কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর কমলিকা বলল, “একটা উপকার করবে আমার?”

 

বেশ অবাক অরুণাংশু প্রথমটায়। সে সাধারণের চেয়েও সাধারণ। সে কী উপকার করবে এই সুন্দরী মেয়েটার জন্য! একটু সামলে নিয়ে বলল, “কী উপকার?”

“তোমার নোটসের খাতাটা একটু দেবে আমাকে।“

মনে মনে ভাবল অরুণাংশু, এ তো সামান্য ব্যাপার। বলল, “ঠিক আছে। কোনো ব্যাপার নয়। এই নাও।“

অরুণাংশু দিয়ে দিল খাতাটা। তারপর কমলিকা বলল, “চল, ক্যান্টিনে যাই।“

 

অরুণাংশু ইতস্তত করছিলভাবছিল,  এই তো বেশ আছি, আবার ক্যান্টিন কেন ... কমলিকা সম্ভবত খাওয়াবে আজ, কী দরকার এসবের, পরের দিন তাকে আবার খাওয়াতে হবে, নিজের পকেটের অবস্থা তো অরুণাংশু ভালোই জানে, ... তাই বুদ্ধি করে বলল, “না না, ক্যান্টিনে যাব না।“

“কেন?”

“আমার পেটের রোগ আছে। বাইরের খাবার তেমন স্যুট করে না।“

একটু হেসে কমলিকা বলল, “ও আচ্ছা।“

 

ফলে ওখানে বসেই সাধারণ কথাবার্তা হল। একসময় সে জিজ্ঞেস করল কমলিকাকে, “তোমার বাড়ি কোথায়?”

কমলিকা বলল, “হিন্দমোটর। তুমি কোথায় থাকো?

শ্রীরামপুর 

 

এইরকম আরও দুচারটে সাধারণ কথাবার্তা হল – অরুণাংশুর বাড়িতে কে কে থাকেন, তারা ক’ভাই বোন, কমলিকার বাড়ির খবরাখবর জানা হয়ে গেল সেইসঙ্গে। এইভাবে তাদের আলাপ-পরিচয় হল এবং প্রায় প্রত্যেকদিনই তারা ওই জায়গাটায় বসে কথাবার্তা বলত, অরুণাংশু তার নোটসের খাতা কমলিকাকে দিত, ও এনে দিত খাতাটা পরের দিন। 

 

একটা দিনের ঘটনা। অরুণাংশু কলেজ ক্যাম্পাসে ঢুকছে, এমন সময় তখনকার ইউনিয়নের জি-এস কাছে এসে বলল, “এই শোন বে!”

দাঁড়িয়ে গেল অরুণাংশু। জি-এস দাদা বলল, “তোর ওই মেয়েটার সঙ্গে কী সম্পর্ক রে?”

“কোন মেয়েটা?”

অরুণাংশু জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। বেশ ভয় করছিল তার

জি-এস দাদা অরুণাংশুর থুতনিটা ধরে নেড়েচেড়ে বলল, “কোন মেয়েটা! যেন ভাজা মাছটা উল্টে খেতে পারিস না!”

 

অরুণাংশু ভয়ে কুঁকড়ে আছে তখন। কিছুটা আন্দাজ করছিল, জি-এস দাদা কমলিকার কথা বলছে নিশ্চয়ই। কিন্তু সরাসরি ওর নাম করতে মন সায় দিচ্ছে না। যদি হিতে বিপরীত হয়!  গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল ওর। ভয়ে ভয়ে বলল, “সত্যিই দাদা, বুঝতে পারছি না

“বেশ, আমিই বলছি। কমলিকা। তোদের ক্লাসে পড়ে।“

“ও আচ্ছা।“

“কী সম্পর্ক তোদের মধ্যে? ব্রেক টাইমে মাঝেমাঝেই তো তোদের ওই গঙ্গার ধারটায় দেখতে পাই। বেশ গপ্প মারিস দুজনে

“না না, ওই পড়াশুনা নিয়ে কথাবার্তা হয়।“

“অন্য কিছু নয় তো? কোনো ইন্টুমিন্টু?”

“না না।“

“দেখো চাদু, সেসব যেন না হয়। তাহলে কিন্তু ...“

কথাটা বলে ইউনিয়নের দাদাটা অরুণাংশুর থুতনিটা আরেকবার নেড়ে দিয়ে চলে গেল।

 

অরুণাংশু বুঝল, কমলিকা সকলেরই টার্গেট। যাই হোকসেযাত্রা বেঁচে গেল অরুণাংশু। কারণকমলিকার সঙ্গে মেলামেশার জন্য তাকে মার খেতে হল না তাছাড়া সত্যিই তোকমলিকার সঙ্গে তো তার কোনো প্রেমের সম্পর্ক ছিল না কিন্তু তাই বলে এটা অস্বীকার করার উপায় নেইকমলিকাকে তার ক্রমশ ভালো লাগতে শুরু করছিল কলেজে যতক্ষণ থাকতক্লাস করতওর দিকে অরুণাংশুর চোখ চলে যেতই ওর চলাফেরাকথাবার্তাসাজপোশাকব্যক্তিত্ব সবকিছুই মুগ্ধ করত অরুণাংশুকে বাড়িতে ফিরে নানা কাজকর্মের মধ্যে ওর কথা মাঝেমাঝেই মনে হত মনে হতপরের দিনটা তাড়াতাড়ি চলে আসুককলেজে গেলেই তো ওকে আবার দেখতে পাওয়া যাবেএইসব সুখচিন্তা নিয়ে অরুণাংশু ঘুমোত প্রত্যেকটা দিন 

 

কলেজে যাওয়ার সময় প্রত্যেকদিন একটু ভালো পোশাক পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সুন্দর করার চেষ্টা করত অরুণাংশু, যাতে করে কমলিকার চোখে নিজেকে সামান্য হলেও একটু আকর্ষণীয় রাখা যায় কিন্তু কোনোভাবেই কখনও মুখ ফুটে কিংবা হাবেভাবে ওর প্রতি কোনোরকম দুর্বলতা প্রকাশ পাকএটা সে  ভেতর থেকে চাইতে পারত না এর প্রধান কারণসে  দেখতে ভালো নয়কমলিকার পাশে নিজেকে নিতান্তই এলেবেলে মনে হত তার  সর্বোপরি তার কঠিন আর্থিক অবস্থা এবং কঠোর পারিবারিক অনুশাসন নিজেকে সংযত রাখতে বাধ্য করত অথচ কমলিকাকে নিয়মিত নোটস দেওয়াব্রেক টাইমে কলেজ ক্যাম্পাসে পড়াশোনা ছাড়াও অন্যান্য সাধারণ গল্পগুজবএসবেই দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল একরকম

 

পার্ট ওয়ান পাশ করে অরুণাংশু একটা চাকরি পেল নর্থ বেঙ্গলে এবং আর্থিক কারণেই চাকরির অফারটা সে নেবে ঠিক করল কিন্তু পড়াশুনার ইতি ঘটুক এখানেইএটা সে চাইছিল না কোনোমতেই ঘনশ্যামবাবু ছিলেন কলেজের অফিস ক্লার্ক খুব ভালোবাসতেন অরুণাংশুকে তাঁকে একদিন অরুণাংশু তার এই চাকরি পাওয়ার ব্যাপারটা বলল সেইসঙ্গে খোলাখুলিভাবে তার পারিবারিক অবস্থার কথাও বলল ডিটেলে ঘনশ্যামবাবু সবটা শুনে নিয়ে বললেন, “তুমি পনেরো দিনে একবার কলেজে আসতে পারবে তো?”

অরুণাংশু বলল, “হ্যাঁ

তাহলে অ্যাটেন্ড্যান্সের ব্যাপারে তোমাকে ভাবতে হবে না কিন্তু আরেকটা কাজ করতে হবে

বলুন

নোটস ইত্যাদির ব্যাপারে তোমার সাবজেক্টের অনার্সের তিনজন টিচারের সঙ্গে একটু কথা বলে রাখো

তাই হবে

 

ঘনশ্যামবাবুকে যা যা বলেছিল অরুণাংশুসবটাই সে তার অনার্সের শিক্ষকদের বলল তাঁরাও সকলে উৎসাহ দিলেন তাকে এবং নোটস ইত্যাদি তাঁরা দেবেনসে-ব্যাপারে নিশ্চিত করলেন তাকে যথারীতি পুরো ব্যাপারটাতে উৎসাহিত হল অরুণাংশু পড়াশুনাটাও থাকবেচাকরি করতে পারবে – একটা নতুন দিগন্ত খুলে গেল অরুণাংশুর কাছে

 

কমলিকাকে সবটা জানাল অরুণাংশু সে শুনে বলল, “সেকীতাহলে নোটসের কী হবে!”

হেসে বলল অরুণাংশু, “একজন ঠিক জুটে যাবে তোমার কোনো চিন্তা কোরো না

 

কথাটা বলতে একটু খারাপ লাগছিল অরুণাংশুর পনেরো দিন ওকে দেখতে পাবে নাকথাবার্তাও হবে না বলা বাহুল্যসেটা মোবাইলের যুগ নয়এমনকি ল্যান্ড লাইনও লোকের ঘরে ঘরে সেভাবে পৌঁছয়নি যোগাযোগের মাধ্যম বলতে পোস্টকার্ড কিংবা ইনল্যান্ড লেটারযেটার অস্তিত্ব বা প্রয়োজন আজ লুপ্ত বলা যায় তো যাই হোকঅরুণাংশুর তখন একটাই লক্ষ্য - নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে

 

তবে কমলিকা ভেতরে ভেতরে কষ্ট পেল কিনাসেসব কিছুই বুঝতে পারল না অরুণাংশু হয়তো পেল কিংবা পেল নাযেটাই হোকসম্ভবত ওর প্রবল ব্যক্তিত্ব তাকে কিছুই বুঝতে দেয়নি

 

চাকরিতে জয়েন করল অরুণাংশু পনেরো দিন বাদে যখন প্রথম ফিরে এল এবং কলেজে দেখা হল কমলিকার সঙ্গে,  উচ্ছ্বসিত হয়ে কমলিকা  বলল, “ও তুই এসেছিসকবে এলি?”

 

তখন তুমি’ থেকে ‘তুই’ এসে গেছে অবশ্য মাঝে মাঝে ‘তুমিও যে একেবারে চলত নাতেমন নয়  

 

কমলিকার এরকম উচ্ছ্বাস অরুণাংশু এই প্রথম দেখল অনার্সের ক্লাস শেষ করে ওরা কলেজ ক্যাম্পাসের মধ্যে সেই গঙ্গার ধারটায় গিয়ে বসল চাকরি জীবন কেমন লাগছেসেইসঙ্গে বাড়ির খবরাখবরবিস্তারিত জানতে চাইল কমলিকা সবটাই বলল অরুণাংশু তারপর কমলিকা টিফিন বার করল ওর ব্যাগ থেকে অরুণাংশুকে ওর ভাগ থেকে কিছুটা দিল এটা আগেও অনেকবার করেছে ওকিন্তু অরুণাংশু সবসময় নিত না তবে ভদ্রতাবশত মাঝেমধ্যে নিতহয়তো একটা মিষ্টি কিংবা স্যান্ডউইচ কিন্তু সেবার নিলনাহলে ওর উচ্ছ্বাস বা আনন্দকে অসম্মান করা হত

 

আরও একটা জিনিস খেয়াল করল অরুণাংশু কমলিকার মধ্যে এমনিতেই ও খুব রিজার্ভড টাইপের মেয়েকিন্তু এবার যেন ওর কথাবার্তায় এবং আচার ব্যবহারে তার মনে হলঅনেক বেশি আন্তরিক আগের তুলনায় কথা বলছে একটু বেশি এবং পড়াশোনা ছাড়া নিজের অতি সাধারণ কথাও যেন সবকিছু শুনিয়ে ও আনন্দ পেতে চাইছে হয়তো এমন হতে পারেসেদিনের পরে আবার সেই পনেরো-ষোলো দিন পরে দেখা হবেসুতরাং জমে থাকা কথা যেন এখনই না বললে নয়

 

এইভাবে পনেরো-বিশ দিন ব্যবধানে অরুণাংশুর নর্থ বেঙ্গল  টু কলেজ এবং কলেজ টু নর্থ বেঙ্গল চলতে থাকলসেইসঙ্গে  পড়াশোনআর কমলিকার সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ দেখতে দেখতে পার্ট টু পরীক্ষার সময় চলে এল কলেজে আর কোনো ক্লাস থাকল না

 

পনেরো দিন বাদে পরীক্ষা শুরু অরুণাংশু ২০-২২ দিনের ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে এল কমলিকার সঙ্গে আগেই কথা হয়ে গিয়েছিলতারা কলেজে আসবে তবুও

 

সেটাই হল নিয়মিত কলেজে আসা-যাওয়া চলতে থাকল  কখনো লাইব্রেরিতেকখনও গঙ্গার ধারে মিট করা কথা হত পড়াশুনা নিয়েকখনো-বা একটু অন্যরকমতবে ভাব-ভালোবাসার কথা নয় কিন্তু হাবেভাবে কমলিকা যেন অরুণাংশুর পাশে বসেই একটু ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করত কিন্তু অরুণাংশু নিজেকে সংযত এবং সাবধানে রাখত

একদিন বলল কমলিকা, “আচ্ছা অরুণাংশুএই কলেজ শেষ হওয়ার পর আমাদের যোগাযোগটা থাকবে কী করে?”

একটু যেন অন্যরকম সুর সেদিন কমলিকার কথায়! 

অরুণাংশু সটান বলল, “কলেজ শেষ হওয়ার পর আর যোগাযোগের কীসের দরকারআমি তো একটা চাকরি করছিসেটাই করব তুই নিশ্চয়ই এম এ করবিতারপর চাকরি করবিতারপর  বিয়েনতুন জীবনে ঢুকে যাবি

 

কথাগুলো বলেই ওর দিকে তাকাল অরুণাংশু কেমন যেন বিবর্ণ দেখালো ওকে কথাগুলো এভাবে বলা হবেও বোধহয় একেবারেই আশা করেনি  

 

ঠিক পরের দিন। কলেজে কমলিকার সঙ্গে যে-সময়ে দেখা হওয়ার কথা মোটামুটি সেই সময়ে অরুণাংশু হাজির। অপেক্ষা করছে কমলিকার জন্য লাইব্রেরিতে। প্রথম ওইখানে দেখা হয়, তারপর হয়তো গঙ্গার পাড়টায় যাওয়া হবে অবশ্য সেটা নাও হতে পারে  কারণ, কোনো কোনো দিন লাইব্রেরিতেই পুরো সময়টাই কেটে যায়। পড়াশোনা বা অন্যান্য গল্পগুজবের মধ্য দিয়ে।

 

কিন্তু না, সে আসছে না। এত দেরি সে তো করে না কখনও! কিছু হল নাকি? প্রায় পনেরো মিনিট হয়ে গেল। হঠাৎ মনে অরুণাংশুর, গতকাল ও খুব আঘাত পেয়েছে, তাই বোধহয় ... ! তাহলে কি আজ ও আসবে না? এইসব ভাবনা চলছে ভেতরে, হঠাৎ সুভদ্রা ঢুকল লাইব্রেরিতে এবং অরুণাংশুর দিকেই আসতে দেখা গেল কিন্তু ওকে ঠিক আশা করেনি অরুণাংশু এই সময়ে যাই হোকসামনে পরীক্ষাআসতেই পারে লাইব্রেরিতে

 

ঠিক অরুণাংশুর মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসে সুভদ্রা হেসে বলল, “কীরেকেমন আছিস?”

ভালো তুই?”

ভালো কীরকম প্রিপেরেশন হচ্ছে?“

“চলছে একরকম।“

“কদিনের ছুটিতে এসেছিস?”

“পরীক্ষা শেষ হওয়া পর্যন্ত তো বটেই। তা’ তোর কীরকম প্রিপেরেশন?”

“ওই তো, চালিয়ে যাচ্ছি একরকম। শোন, ক্যান্টিনে যাবি? এখানে তো এইভাবে কথা বললে, এক্ষুনি এসে লাইব্রেরিয়ান বকা দেবে।“

 

মনে মনে হাসল অরুণাংশু, প্রায় তিনটে বছর তো কাটিয়ে দিল, ক্যান্টিনে একদিনও যাইনি সে ফুটো পকেটের কারণে। এখন তো চাকরি করছে, আজ তো যেতেই পারে ক্যান্টিনে। প্রথম প্রথম কমলিকা বারকয়েক বলেছিল ক্যান্টিনে যাওয়ার কথা, যায়নি ওই একই কারণে, আজ সুভদ্রার দৌলতে নাহয় ... বলেই ফেলল, “যেতে পারি ক্যান্টিনে, কিন্তু একটা শর্তে।“

সুভদ্রা হেসে বলল, “কী শর্ত?”

হেসে বলল অরুণাংশু, “আমি পে করব কিন্তু

সুভদ্রাও হাসল, বলল, “ও হ্যাঁ, তুই তো এখন চাকরি করিস ... চল, শর্ত মঞ্জুর।“

 

ক্যান্টিনে অরুণাংশু আর সুভদ্রা পাশাপাশি বসল। চা-শিঙ্গাড়ার অর্ডার দিল অরুণাংশু। সুভদ্রাই শুরু করল কথা, “দেখতে দেখতে তিনটে বছর কেটে গেল, না রে?”

“যা বলেছিস।“

“বেশ ভালোই ছিলাম একসঙ্গে। এরপর তো কোথায় কিভাবে সব ছিটকে যাব, কে জানে!”

“হ্যাঁ ঠিকই।“

“তুই তো তবু একটা চাকরিতে ঢুকেছিস, এরপর আরও উন্নতি করবি নিশ্চয়ই। আমাদের মেয়েদের জীবন বড়ো অনিশ্চিত রে!”

“তা কেন। তোরও তো একটা প্ল্যান আছে নিশ্চয়ই। এম এ করবি কি এরপর, নাকি অন্য কোনো প্ল্যান ...”

“এম এ! আগে পরীক্ষা দিই, রেজাল্ট বেরোক, অতসব ভাবতে পারি না আমি। তাছাড়া তোর আর কমলিকার মত ব্রিলিয়ান্ট তো আমি নই।“

অরুণাংশু  চুপ করে থাকে

সুভদ্রাই বলল, “তুই তো নিশ্চয়ই চাকরির সঙ্গে সঙ্গে এম এ-টাও চালিয়ে যাবি? তাই না?”

“না রে বাবা, এম এ করার কথা এখন ভাবছি না। চাকরিটা করছি মন দিয়ে, এটুকুই বলতে পারি।“

“কমলিকা? কমলিকা কী করবে?”

অরুণাংশু সমঝে নিল নিজেকে সুভদ্রা হঠাৎ কমলিকার কথা জানতে চাইছে! ঘুরিয়ে বলল, “সে তো তুই ভালো বলতে পারবি। তুই তো ওর বেস্ট ফ্রেন্ড

“সে তো ঠিক আছে, তবে পড়াশোনার ব্যাপারে বা কেরিয়ারের ব্যাপারে তুই নিশ্চয়ই ওর মনের ইচ্ছেটা জানিস। কারণ, তোদের মধ্যে নিশ্চয়ই এসব নিয়ে আলোচনা হয়েছে!“

 

অরুণাংশু সতর্ক। এবারও তার সাবধানী উত্তর, “দ্যাখ, শেষ পর্যন্ত কে কী করবে, সেটা বলা ভারী শক্ত। তবে ও পড়াশুনায় ভালো, এখানেই নিশ্চয় ইতি টানবে না পড়াতে। অন্তত আমার তেমনটাই মনে হয়।“

“আচ্ছা, ওকে তোর কেমন লাগে?”

 

সুভদ্রার কথার সুর এবার যেন বেশ অন্যরকম লাগল। কেমন যেন একটা ভাবনা খেলে গেল অরুণাংশুর মধ্যে! কমলিকার আজকে আসার কথা, এলো না। সুভদ্রা এলো। কমলিকার গতকালের বিবর্ণ মুখের ছবিটা ভেসে উঠল। সুভদ্রা কি তাহলে কমলিকার দূত হয়ে এসেছে? কমলিকার প্রতি অরুণাংশুর মনোভাব জানতেই কি সুভদ্রার আসা? তবে এবারও ডিফেন্সিভ খেলল অরুণাংশু।  

 

সুভদ্রার কথার উত্তরে হেসে বলল, “এই তোকে যেমন লাগে, ঠিক তেমন।“

“এটা ইয়ার্কির কথা। তুই এড়িয়ে যাচ্ছিস আমার প্রশ্নটা।“

“কী বলব বল? একসঙ্গে পড়েছি, দেখতে ভালো, পড়াশুনায় ভালো, নিজের একটা ব্যক্তিত্ব আছে, ওকে সবারই ভালো লাগবে। আলাদা করে কী বলব বল।“

“তবুও বিশেষ করে ...?”

“বিশেষ করে আবার কী! সব ভালোলাগাগুলো তো বলেই দিলাম।“

“তাও আর কিছু ...?”           

 

অরুণাংশু বুঝতে পারল, বেশ ভালোই বুঝতে পারল, প্রশ্নগুলো সুভদ্রার হলেও আসলে এই সবটাই কমলিকার অন্তরের কাতর জিজ্ঞাসা। নিশ্চিতভাবে বুঝল সে, কমলিকা তার জীবনসঙ্গী হিসেবে তাকেই বেছে নিয়েছে, এখন শুধু  বাজিয়ে নিতে চাইছে  সুভদ্রার মাধ্যমে।

 

পরের দিন কমলিকা এলো যথারীতি। এবার কিছুটা অফেন্সিভ অরুণাংশু। সরাসরি বলল ওর চোখের দিকে তাকিয়ে, “গতকাল এলে না যে!”

“একটা কাজে আটকে গিয়েছিলাম।“

 

কথাটা বলতে গিয়ে একটু যেন অস্বস্তি হচ্ছিল ওর মধ্যে। অরুণাংশুর মনেই হচ্ছিল, এটা ও ঠিক বলছে না। তাছাড়া সুভদ্রার মাধ্যমে তার দিক থেকে পজিটিভ কোনো সাড়া পেল না, সেটাই বোধহয় ওর অস্বস্তির মাত্রা কিছুটা বাড়িয়ে দিয়েছিল! অরুণাংশু আর কিছু ঘাটাল না। শুধু বলল, “ও আচ্ছা।“

একটু যেন থমথমে আবহাওয়া। হাওয়া বাতাস চলছে না যেন। হঠাৎ স্তব্ধতা ভেঙে কমলিকা বলল, “তা কী ঠিক করলে?”

অরুণাংশু হকচকিয়ে গেল প্রথমটায়। তারপর সামলে নিয়ে বলল, “কী ব্যাপারে?”

“না, এর পরে?“

 “ও আচ্ছা। এই তো, চাকরিটা করছি, বড় ফ্যামিলি আমাদের, দাদারা আছে, ভাই-বোনেরা আছে, ফ্যামিলিতে কন্ট্রিবিউশনের ব্যাপার আছে। যাই হোক, তুমি কী করবে?“

“ইচ্ছে তো ছিল অনেক কিছু ... দেখি ... ভাবছি ...”

 

অরুণাংশু ভালোই জানে, কমলিকা অত্যন্ত চাপা মেয়ে, অত্যন্ত রিজার্ভড। যে-ইচ্ছেটা ওর মনের মধ্যে ছিল, সেটা ও কিছুতেই মুখ ফুটে প্রকাশ করতে পারছিল না  বা করবে না। কারণ, সেটা ওর প্রকৃতিবিরুদ্ধ কাজ হবে।

 

কলেজের উলটোদিকে একটা সিনেমা হল ছিল। উত্তম কুমারের একটা সিনেমা এসেছিল। কমলিকা বলে উঠল হঠাৎ, “একটা ভালো সিনেমা এসেছে আমাদের সিনেমা হলটাতে। যাবে?”

 

অরুণাংশুর মনে হল, সিনেমা দেখাটা কমলিকার মূল উদ্দেশ্য নয়, ও আরও কিছুটা সময় নিরিবিলি তার সঙ্গে কাটাতে চায়, কিছু বলতে চায় বা করতে চায়, এমন কিছু, যখন অরুণাংশুর এড়িয়ে যাওয়ার আর কোনো রাস্তা থাকবে না। মিথ্যে বলতে বাধ্য হল সে, “সেটা সম্ভব নয় বুঝলে। আমি অফিসের কিছু কাজ নিয়ে এসেছি, যেটা কমপ্লিট করে কাল আমাকে নর্থ বেঙ্গলে ফিরে যেতে হবে।“

 

কমলিকা হতাশ হল, স্পষ্ট বোঝা গেল। তবুও যথাসম্ভব স্বাভাবিক থেকে আরও কিছুক্ষণ এটা সেটা গল্প করে কাটাল ওরা। তারপর একদম শেষে কমলিকা বলল, “তাহলে আজই কি আমাদের শেষ দেখা?”

অরুণাংশু বলল, ”শেষ দেখা কেন হবে। তুমি একটা পোস্টকার্ডে কয়েক লাইন লিখে আমাকে পোস্ট করে দেবে। আমি চলে আসব। নাহলে যেদিন রেজাল্ট বেরোবে সেদিন তো আসবোই। দেখা হবে।“

 

তো যাই হোক, রেজাল্ট বেরোনোর আগে ওদের আর দেখা হয়নি। দেখা হল রেজাল্ট বেরোনোর দিন। ওরা পাশ করল ভালোভাবেই। কমলিকার সঙ্গে দেখা হল। অরুণাংশু বলল, “কনগ্র্যাচুলেশনস।“

উত্তরে ও-ও একই কথা বলল। তারপর কমলিকাই উদ্যোগী হয়ে বলল, “চলো, ওই গঙ্গার ধারটায় বসি।“

 

সেই চেনা জায়গাটায়। সুন্দর সবুজ ঘাসের গালিচা। গঙ্গার উথাল পাথাল হাওয়া। ওরা বসল পাশাপাশি। কিছুক্ষণ চুপচাপ। তারপর কমলিকাই বলল, “অরুণাংশু, একটা কথা বলব?”

কেমন একটা লাগল যেন কমলিকাকে। একটা ভীষণ আর্তি নিয়ে কথাগুলো বেরিয়ে এল ওর ভেতর থেকে। ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না অরুণাংশু, কী বলতে পারে কমলিকা! যতটা সম্ভব স্বাভাবিক স্বরেই বলল সে,  “বলো।“

এবার একদৃষ্টে অরুণাংশুর দিকে তাকিয়ে কমলিকা বলে উঠল, “তোমার কাছে আমার একটা পাওনা ছিল।“

ভেতরটা ধক করে উঠল অরুণাংশুর। তবুও নিজেকে স্বাভাবিক রেখে কোনোমতে বলল সে, “বলো, কী পাওনা?”

কমলিকা মাথা নীচু করে ফেলেছে তখন। বেশ কুণ্ঠা নিয়ে বলল, “না, সে বলা যাবে না।“

অরুণাংশু বললা, “যা বাবা! এ আবার কী কথা। পাওনা আছে বলছ, অথচ বলা যাবে না! এটা কেমন কথা!“

 

মাথা নীচু অবস্থাতেই অস্ফুটে বলল কমলিকা, “বলছি তো বলা যাবে না। তুমি বুঝে নাও।“

অরুণাংশুর তখন প্রবল অস্বস্তি ভেতরে। বুঝতে পারছে, ও কী বলতে চাইছে। তবে বুঝল, এখনই এর একটা নিষ্পত্তি হওয়া দরকার। বলল, “তবে আমার তোমার কাছ থেকে কিছু পাওনা নেই।“

 

কমলিকা এবার সরাসরি তাকাল অরুণাংশুর দিকে। সে দৃষ্টি বড় বেদনার, বড় কষ্টের। কিন্তু অরুণাংশু জানে, তাকে ভেঙে পড়লে চলবে না। তাই সরাসরি চোখে চোখ রেখে বলল, “আসলে, আমি তোমার কাছ থেকে কিছু এক্সপেক্ট করি না।“

কমলিকা কিছুক্ষণ অরুণাংশুর দিকে তাকিয়ে রইল একভাবে। যেন কথাটা সে হজম করতে পারছে না। তারপর একরকম নিজেকে উজার করে ছেড়ে দিয়ে বলল, “অরুণাংশু, তুমি কী চাও বলো?”

একটু থমকে গেল অরুণাংশু কমলিকার কথায়, তারপর বলল, “আমি কিছু চাই বা চাইব তোমার কাছে, এরকম স্পর্ধা আমার নেই।“

 

কমলিকার কী হল জানি না, কয়েক মুহূর্ত শুধু একভাবে তাকিয়ে রইল অরুণাংশুর দিকে। আর, অরুণাংশুরও কী হল, সে চোখ সরাতে পারল না ওর দৃষ্টি থেকে। কেমন যেন হিপ্নোটাইজড সে!  কমলিকা বলে উঠল, “অরুণাংশু, আমি সব বুঝতে পারছি, সবটা। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছি না।“

অরুণাংশু বলল, “ঠিক তাই। আমিও।“

তবুও যেন হাল ছাড়া যাবে না। কমলিকা আবার  বলল, “কিন্তু অরুণাংশু, কোনোভাবেই কি কিছু করা যায় না?“

বলতে বাধ্য হল অরুণাংশু, “না গো। এই মুহূর্তে ‘না’-এর পাল্লাই যে বড় ভারি!”

 

ওইটাই ছিল ওদের শেষ মিটিং। বেশ কিছুদিন পর সুভদ্রার কাছ থেকে খবর পেয়েছিল অরুণাংশু, কমলিকার বিয়ে হয়ে গেছে।

 

আজ চল্লিশ বছর বাদে যেন সিনেমার মতন ঘটনাগুলো মনে পড়ে গেল অরুণাংশুর। হঠাৎ যেন সংবিৎ ফিরল তার। একবার বাইরেটা দেখে নিল। উত্তরপাড়া ছেড়ে গেল ট্রেন। এমন সময় হঠাৎ কানে এল এক ভদ্রমহিলার কণ্ঠস্বর, “সুভদ্রা, চলি রে।“

 

অরুণাংশুর মনে হল, তারই পেছনদিকে অন্য এক ভদ্রমহিলা ছিলেন। তিনি সম্ভবত নেমে যাচ্ছেন পরের স্টেশনে। ভিড় ঠেলে তার দ্রুত চলে যাওয়ার কারণে সামান্য ভিড়ের চাপ অনুভব করল অরুণাংশু। কারণ, সে সিটের একেবারে ধারে বসেছিলা। কিরকম যেন খুব চেনা লাগল ভদ্রমহিলার গলা। কিন্তু দেখতে পেল না তাকে সুভদ্রাকে বলেই ফেলল অরুণাংশু, “আচ্ছা, একটা কথা বলব?”

সুভদ্রা হেসে বলল, “হ্যাঁ, বলুন না।“

“যিনি চলে গেলেন, আপনার বন্ধু সম্ভবত, তাই না।“

“হ্যাঁ।“

“খুব চেনা লাগল গলাটা।“

হেসে বলল সুভদ্রা, “ও কমলিকা।“

অরুণাংশু বিস্মিত কন্ঠে প্রায় আর্তনাদ করে বলল, “তাই বুঝি! আমাকে বললেন না একবারও!”

সুভদ্রা মাথা নীছু করে হেসে বলল, “না বলে ভালোই করেছি।“

 

হিন্দমোটর স্টেশন এসে গেল। অরুণাংশু জানে, কমলিকা এখানেই থাকে। সে জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে কমলিকাকে খুঁজতে চেষ্টা করলাম আপ্রাণ। পেল না। কমলিকা হারিয়ে গেল ভিড়ের মধ্যে।          

 

কোন্নগর স্টেশন আসছে। সুভদ্রা উঠে দাঁড়াল সিট ছেড়ে। ও নামবে এবার। হেসে বলল, “অরুণাংশু, যাচ্ছি।“

“হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক আছে।“

 

কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থাকল অরুণাংশু। ভেতরে ঝড়ের পূর্বাভাস। কমলিকা নিশ্চয়ই তাকে দেখেছে, কিন্তু দেখা দিল না। কেনই বা দেখা দেবে! সে যে তার ‘পাওনা’টা পায়নি। অভিমানী মেয়ে!

 

বড় অস্থির লাগছে যে!  কিন্তু ... না না, কিছুতেই না,  ঠিক থাকতে হবে অরুণাংশুকে! মনটাকে ঘুরোনোর জন্য ব্যাগ থেকে ম্যাগাজিনটা বার করতে গিয়েও করল না। একটা স্টেশন পর তাকেও যে এবার নামতে হবে।