Thursday, April 3, 2025


 

বেরুবাড়ী ও একটি ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ

দেবদত্তা বিশ্বাস


 স্বাধীনতা পরবর্তী ঐক্যবদ্ধ ভারতীয় উপমহাদেশের মানচিত্র অঙ্কনে নিঃসন্দেহে জলপাইগুড়ি জেলার অন্তর্গত বেরুবাড়ী এলাকার ভারতভুক্তির আন্দোলন এক অনন্য জায়গা করে নিয়েছে আধুনিক ভারতীয় ইতিহাসের পাতায়।

        কোচবিহারের ভারতভুক্তির পর র‍্যাডক্লিফ লাইনের পার্শ্ববর্তী ছিটমহল গুলির অবস্থান ধীরে ধীরে এক জাতীয় সমস্যার আকার ধারণ করে।জলপাইগুড়ি জেলার বৃহত্তম মৌজা বেরুবাড়ীতেও দেখা যায় একই সমস্যা।১০ নং নগর বেরুবাড়ী ও ১১ নং খারিজা বেরুবাড়ী ছাড়া ১২ নং বেরুবাড়ী ইউনিয়নের অবস্থান এমন দাঁড়ায় যে চিলাহাটিকে যদি পূর্ব পাকিস্তান নিজের দখলে নেয় তবে ভারত থেকে ঢোকার একমাত্র পাকা রাস্তাও পূর্ব পাকিস্তানে চলে যাবে।১২ নং বেরুবাড়ী ইউনিয়নে চারটি ছিট মহল যুক্ত হওয়ায় পূর্ব পাকিস্তানের লোলুপ দৃষ্টি এই অঞ্চলে বাড়তে থাকে।এদিকে ১৯৪৮ সালে প্রকাশিত 'ব্যাগে ট্রাইব্যুনালে' অন্যান্য অঞ্চলের নাম উল্লেখ থাকলেও বেরুবাড়ী অঞ্চলের সীমান্ত সমস্যার উল্লেখ হয়নি।স্বভাবত,পাকিস্তান একসময় 'লড়কে লেঙ্গে বেরুবাড়ী' বলে হুমকি দেয়।এবং ১২ নং বেরুবাড়ী ইউনিয়নকে নিজের বলে দাবি করে।পূর্বতন চার হাজার ও উদ্বাস্তু হয়ে উঠে আসা আট হাজার নাগরিকের নাগরিকত্বের সমস্যা বড় হয়ে দাঁড়ায়।এদিকে ঐতিহাসিক নেহেরু নুন চুক্তিতে বেরুবাড়ী সমস্যার সমাধান হয়েছে বলা হলেও কিছু বিতর্কিত বিষয় সামনে উঠে আসে।যার ফলে সমস্যা সমাধানের চাইতে নাগরিকদের মধ্যে বিভিন্ন মতামতের সৃষ্টি হয়।

            এমত অবস্থায় ১৯৫৮ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর,১২ নং বেরুবাড়ীর মানিকগঞ্জে নেহেরু নুন চুক্তি বাতিলের দাবিতে তৈরি হয় বেরুবাড়ী প্রতিরক্ষা কমিটি।জনমত নির্বিশেষে সবদলের লোক একসাথে মিলে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে একই মঞ্চ থেকেই নিজেদের দাবিতে সোচ্চার হোন।ঐতিহাসিক বেরুবাড়ী আন্দোলনের প্রথম পর্বে(১৯৫৮ থেকে ১৯৭৪ সাল)ভারতীয় সংবিধানের ব্যাখ্যা,ভারতীয় নাগরিক ও রাজনৈতিক দলগুলির ভূমিকা,পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিধানসভা ও লোকসভার ভূমিকা,জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বেরুবাড়ী হস্তান্তর স্থগিত হয়ে যায়।

             ১৯৭৪ সালের ১৬ই মে।বেরুবাড়ী আন্দোলনের ইতিহাসে যুক্ত হয়ে এক পালক।ইন্দিরা মুজিব চুক্তির মাধ্যমে বেরুবাড়ীকে ভারতের সাথে রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।

             ইন্দিরা মুজিব চুক্তিতে বেরুবাড়ীর প্রতিকূল এলাকাগুলির অবস্থান নির্দিষ্ট করে বলা হলেও বাস্তবে তার রূপায়িত হয়েছিল না।১৯৮৯ সালে দক্ষিণ বেরুবাড়ীস্থিত প্রতিকূল অবস্থান গুলিতে বাংলাদেশ খুঁটি স্থাপনের মাধ্যমে এগুলিকে নিজের এলাকার অন্তর্ভুক্ত করায় দক্ষিণ বেরবাড়ীর নাগরিকবৃন্দ আবার আন্দোলনের প্রস্তুতি নেন।এতে আবার নাগরিকবৃন্দের ভিটে মাটি হারানোর প্রশ্ন দেখা দেয়।তাছাড়াও কিছু সরকারি সম্পত্তির চিহ্নিতকরণ দুই দেশের মধ্যে অনির্দিষ্ট হয়ে যায়।এরপর বছরের পর বছর এই নিয়ে চলতে থাকে নানা আন্দোলন।বেরুবাড়ী আন্দোলনের প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বের মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে।একটি ছিল ভারতীয় ভূখণ্ড পাকিস্তানকে না দেওয়ার প্রসঙ্গ দ্বিতীয়টি ছিল বাংলাদেশের মানচিত্রে দখলিকৃত ভূখণ্ড গুলিকে পুনরায় ভারতে অন্তর্ভুক্তির দাবি।

           এরপর ২০০৫ সাল ,২০০৬ সাল, ও ২০১১ সালে নানা সময় কেন্দ্র থেকে প্রতিনিধি দল ও মন্ত্রীরা আসেন এবং এই অঞ্চল পরিদর্শন করে সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দেন।বেরুবাড়ী প্রতিরক্ষা কমিটির সাথেও আলোচনায় বসেন।

           অবশেষে ২০১১ সালের ছয় সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ডক্টর মনমোহন সিং ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উভয় দেশের অন্যান্য সমস্যা সহ ছিটমহল বিনিময়, প্রতিকূল অবস্থান এলাকা নিয়ে চুক্তিবদ্ধ হন।ভারতের পক্ষে বিদেশ মন্ত্রী শ্রী সালমান খুরশিদ, বাংলাদেশের বিদেশ মন্ত্রী শ্রীমতি দীপু মনি এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।২০১৫ সালের ৬ জুন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী শ্রীমতি মমতা বন্দোপাধ্যায়ের ঢাকা সফরকালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে মিলিত হয়ে ভারত বাংলাদেশ স্থল সীমানা বিষয়ে 'মনমোহন হাসিনা' চুক্তিকে অনুমোদন দেন।এর ফলে ভারত বাংলাদেশ ছিটমহল ও প্রতিকূল অবস্থান সমস্যার চিরস্থায়ী সমাধান হয়।জলপাইগুড়ি জেলার প্রশাসনিক মানচিত্রে ঘটে একটি বিরাট পরিবর্তন।

            সার্থক হয় বেরুবাড়ী আন্দোলন।বেরুবাড়ী আন্দোলন দীর্ঘ সময় ধরে ভারতীয় ইতিহাসে চলা সংগ্রামী নাগরিকদের অসাধারণ অবদান।বেরুবাড়ী ইউনিয়ন অধুনা দক্ষিণ বেরুবাড়ীর ভারত অন্তর্ভুক্তির আন্দোলন চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে বহু যুগ ধরে।

No comments:

Post a Comment