ভ্রমে ভরানো ভ্রমণের কথা
বুলবুল দে
বিয়ের দুবছর পর প্রথম মা হয়েছে সীমা, মেয়েকে নিয়ে উৎসাহ উদ্দীপনায় টগবগ করে ফুটছে, চিরকাল নিজের প্রতি চরম উদাসীন আর অযত্নশীল সে, যতদূর পারা যায় নানারকম বাধা বিপত্তির পাশ কাটিয়ে পরম যত্নে মেয়েকে বড় করে তোলার চেষ্টায় তৎপর। নিজের চরম দুঃখ কষ্টের কালো কালো আবর্জনা গুলোকে পুটলি বেঁধে রেখে দিচ্ছে এক কোণে। তার চারপাশে তখন ঝলমলে স্বপ্নগুলো হেসে হেসে ভেসে বেড়াচ্ছে। পৃথিবীর কতকিছু চেনাতে হবে,দেখাতে হবে, শোনাতে হবে,বোঝাতে হবে যে ! তারমধ্যে প্রকৃতি চেনানোর কয়েকটি ধাপ,মানে হল গিয়ে পাহাড়, নদী,জঙ্গল,ক্ষেত খামার ইত্যাদি হয়ে গিয়েছে, এবার বাই উঠল সমুদ্র দেখানোর। অনেক বলে কয়ে বরকে তো রাজি করাল, কিন্তু ভীতুর ডিম বর আবার বরকন্দাজ ছাড়া বৌ-মেয়ে নিয়ে দূরে যেতে সাহস পায়না (পরে অবশ্য ধীরে ধীরে সাহস বেড়েছে)। যাইহোক,কাছাকাছি পুরী যাওয়াই স্থির হল আর বরকন্দাজ হল সীমার ভাই। বিয়ের পর পরও গিয়েছিল একবার সেখানে।বরকন্দাজের ভূমিকা নিয়েছিল তার শাশুড়ি ও নন্দাই। যাইহোক রেলপথে যাত্রা করে পৌঁছনো তো গেল, কিন্তু সে পুরী যে তাকে পুড়িয়ে খাঁক করে দেবে সে যাত্রা কে তা জানত !!
------ প্রথম দিন----
সমুদ্রের ধারে হোটেল ভারা নিয়ে কোনও রকমে প্রাতরাশ সেরে মেয়েকে সমুদ্র দেখানোর উত্তেজনায় সোল্লাসে সবাইকে নিয়ে চলল সমুদ্র তটে। সমুদ্রের ঢেউয়ের চেয়েও বিশাল বিশাল ঢেউ তখন তার বুকে এসে ধাক্কা মারছে, আহা ! কি অবাক টাই না হবে তার মেয়ে। কিন্তু বিরাট সাগর দেখে মেয়ে তো ভয়ে কুঁকড়ে একেবারে কাঁকুড় ফল। তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই কাঁকুড়, বাঁদর হয়ে সাগরের বুকে লম্ফ ঝম্ফ শুরু করে দিল । ফুরফুরে মনে সীমার মুখের ঝিনুকের ডালা খুলে যখন মুক্তার হাসি ঝিলিক দিচ্ছে ঠিক তখনই ঘটল অঘটনটা! হঠাৎই এক সুবিশাল উর্মিমালা তাকে পেঁচিয়ে কাত করে টেনে নিল জলের ভেতর। হাঁকুপাঁকু করে নোনতা জল খেতে খেতে প্রথমটায় সাঁতারে অজ্ঞ সীমা মন কে বেশ বুঝ দিল, ভয় কি পাশেই তো বর দাঁড়িয়ে আছে, এখুনি টেনে তুলবে ওকে --- কিন্তু কই, সময় কেটে গিয়ে দম আটকে আসছে তবু তো তুলছেনা! জলের ভেতর খাবি খেতে খেতে কোনোরকমে চোখ খুলে এক পলকে বরের ঠ্যাং দুটো দেখতে পেল। দেখেছ, কেমন ঠায় দাঁড়কাকের মত দাঁড়িয়ে আছে ! পাশের মানুষটাকে যে আশেপাশে দেখা যাচ্ছেনা সেদিকে কোনো হুঁশ নেই ! আর ঐ যে একমাত্র ভাইটারও তো দেখি তার একমাত্র দিদির দিকে কোনও লক্ষ্যেই নেই। কিন্তু --- কিন্তু তার বুকের কলজে, চোখের মণি ? কয়েক হাত দূরেই তো ও মামার সাথে দাঁড়িয়ে ছিল, যে সদাই সীমা কে চোখে হারায়, এই সমুদ্র কি তার মন থেকেও নিজের মা কে কেড়ে নিল? অথচ এদের দিকে তটস্থ নজর রাখতে গিয়েই তো নিজের থেকে নজর সরিয়ে ফেলেছিল সে। তাহলে আর কি, সলিল সমাধি ই বুঝি তার ভবিতব্য। অবলম্বনহীন, হাহাকারের সাথে মন ও শরীরকে হালকা করে দিয়ে ঠাকুরের নাম জপতে জপতে নোনা জল খেয়ে চলছিল সে।কিন্তু তাহলে যে তার মেয়ে অনাথ হয়ে যাবে! কি হবে ওর? মেয়ের ভাবনা আসতেই তার মধ্যে যেন শক্তি সঞ্চার হল। সে প্রাণপনে হাত পা ছোড়ার চেষ্টা করতে করতে ঠাকুরকে ডাকতে লাগল, বাঁচাও ঠাকুর আমাকে বাঁচিয়ে দাও! হঠাৎ --- ঐ তো, ঐ তো মেয়ের গলা, চিৎকার করছে --- " বাবা, মামা, মা কোথায় গেল? মাকে তো দেখছিনা ! আরে ঐ তো মায়ের শাড়ি।" নড়াচড়া করার ফলে সীমার আঁচলটা ওপরে ভেসে উঠেছিল আর সে মাত্র এক বুক জলের নীচে ডুবে ছিল । চেঁচামেচি, হুলুস্থুলু করে ওরা টেনে টুনে তোলার পর সীমা দেখলো থেমে থেমে অনেকটা সময় দম বন্ধ করে থাকার ফলে সে পেট ভর্তি জল খেলেও গলা ভর্তি খায়নি। তার মানে সে খুব বেশিক্ষণ জলের নীচে ছিলো না! কিন্তু সাঁতারে অজ্ঞ তার, যেন মনে হচ্ছিল গভীর জলের ভেতর অনন্তকাল পেরিয়ে যাচ্ছে। কোনোরকমে দৌড়ে হোটেলে এসে অনেকক্ষণ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদল। মেয়েও ছুটে এসেছিলো সাথে। তারপর মনটা হাল্কা হলে অভিমানটা যথারীতি ছুঁড়ে ফেলে দিল। মেয়ের জন্যই বুঝি সে যাত্রা রক্ষা পেল।
------- দ্বিতীয় দিন------
পরের দিন সাইট সিইং এ যাবে, বাসে যাত্রী ভরে গেলে কন্ডাকটর সমস্ত নিয়ম কানুন জানিয়ে মস্ত বক্তৃতা দিয়ে বারবার সাবধান করে বলল, কলকাত্তাইয়াদের ওপর উড়িয়াদের নাকি ভীষণ
রাগ। বাঙালিরা নাকি উড়িয়াদের হেয় করে, শহর নোংরা করে যায়, ইত্যাদি ইত্যাদি, তাই কেউ যেন ভুলেও জানলা দিয়ে থুথু বা কোনোকিছু বাইরে না ফেলে।
সূর্য মন্দির, নন্দনকানন, আরও সব দেখেটেখে মেয়েকে নিয়ে খুশি খুশি মনে আবার বাসে ফিরে আসছিল সীমা বারোভাজা খেতেখেতে, আচমকাই পেটটা কেমন গুলিয়ে উঠল। অনেক চেষ্টা করেও আর চেপে রাখতে পারলনা--- বেমক্কা ই বারোভাজার ঠোঙাটা জানলা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে হাতের পলিপ্যাকটার মধ্যে পেটের সবটা ঢেলে তারপর যেন ঠান্ডা হল। এরপর বেশ শান্তিতেই চলছিল, হঠাৎ করে বাসটা মস্ত ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়ল আর বাসে উঠে এল একজন ষণ্ডামার্কা লোক। হুঙ্কার দিয়ে বাঙালিদের গুষ্টি উদ্ধার করে বলে উঠল------" এত নিষেধ করা সত্ত্বেও, এত নিয়ম বেঁধে দেওয়ার পরেও আপনাদের এত আস্ফালন! আজকে এর বিহিত করেই ছাড়ব। কে ফেলেছেন উঠে দাঁড়ান।" পুরো বাস নিশ্চুপ। কেউ উঠছেনা। উঠবে কি, জানেইতো না ব্যাপরটা কি, ফেলেছেতো সীমা ! কণ্ডাকটর অনেক বোঝালো এই বাস থেকে কিছু ফেলা হয়নি। লোকটি বলছে এই বাস থেকেই ফেলা হয়েছে এমনকি ফেলা হয়েছে একেবারে তার মুখের ওপর!! বাসের নাম্বার সে টুকে নিয়েছে। সীমা তো জানে যে কালপ্রিটটা সে নিজে আর ফেলার সময় এক ঝলক যেন দেখেওছিলো যে একটা বাইক পাস করে গেল। ভয়ে তার মুখ একেবারে কালো। আবার চিৎকার করে উঠল লোকটা--- "স্বীকার করুন, নইলে একজনকে নয়,সবাইকে আটকে রেখে দেব,আমার ক্ষমতা আপনারা জানেন না।" ড্রাইভারকেও হুমকি দিলেন যে গাড়ির লাইসেন্স তিনি বাজেয়াপ্ত করে দেবেন,বাইরে নাকি তার দলবল দাঁড়িয়ে আছে। এদিকে কেউ স্বীকারও করছেনা ওদিকে লোকটার হুহুঙ্কারও বেড়ে চলছে। সীমা মনে মনে প্রমাদ গুনলো। শেষমেশ মনস্থির করে নিল সত্যিটা বলেই দেবে। তার জন্য এতগুলো লোকের হ্যারাসমেন্ট হতে পারেনা। সে উঠে দাঁড়িয়ে সমস্তটার বিবৃতি দিয়ে নিজের দোষটা স্বীকার করে নিয়ে তার ওপর কি কোপ পড়বে তার জন্য প্রস্তুত হয়ে রইল। কি আশ্চর্য! লোকটা মুহুর্তেই ঠান্ডা হয়ে কেমন যেন লজ্জিত হয়ে পড়ল ! কণ্ডাকটরকে কি যেন বলে বাস থেকে নেমে গেল, বরং তার সহযাত্রীরাই যেন কেমন একটা দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে রইল। কেন লোকটা এমন করে চেঞ্জ হয়ে গেল? আসলে লোকটা বোধহয় ভেবেছিল দোষী কোন পুরুষ মানুষ হবে, অমন নরম সরম নিরীহ টাইপের দেখতে মহিলা আশা করেনি। বাস আবার চলতে শুরু করল। এ যাত্রায়ও বিপদ মুক্ত হয়ে জগন্নাথকে শতকোটি প্রণাম জানালো সীমা
..........তৃতীয় দিন --------
আগামীকাল পুরী ছেড়ে চলে যেতে হবে, তাই আজ বিকেলে অনেকক্ষণ সময় তারা সমুদ্রের ধারে কাটাচ্ছে। সন্ধ্যার পর থেকেই যত সময় যাচ্ছে, সমুদ্র ততই স্বঘোষিত দর্পে তীরের আরও ভেতরে ঝাঁপিয়ে ঝাঁপিয়ে আসছে,আর সব মানুষের দল হেরো সৈন্যের মত ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছে। এই পেছাতে গিয়েই আর এক কাণ্ড করল যত কাণ্ডের ভান্ড সুমী অপগন্ড। আজ সে সমুদ্র থেকে অনেক দূরেই দাঁড়িয়ে ছিল কিন্তু তার অন্যমনস্কতার ফলে আচমকাই একটা ঢেউ সেই অবধি চলে এল আর
দৌড়াতে গিয়ে টাল সামলাতে না পেরে একপাটি জুতো বালিতে ফেলে রেখে এল, অমনি ঢেউ সেই জুতোকে বুকে করে মাঝ সমুদ্রে দে ছুট! রে রে করে এগিয়ে যেতেই দেখে জুতো মহাশয়া ঢেউয়ের মাথায় চেপে হাসতে হাসতে এগিয়ে আসছে। সবাই ঝাঁপিয়ে পরে যেই তাকে ধরতে গেছে, চোখের নিমেষে অমনি সে মাঝ সমুদ্রে দোলায়মান! এই ভাবে বেশ কিছুক্ষণ জুতো-মানুষের ছোঁয়া ছুঁয়ি খেলা চলার পর হঠাৎই সে এক বিশাল ঢেউয়ের দোলায় চেপে টা টা বাই বাই জানিয়ে কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গেল। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পরও তার দেখা না পেয়ে রেগেমেগে দ্বিতীয় জুতো টাকেও জলে জলাঞ্জলী দিয়ে ক্ষুন্ন মনে হোটেলে ফিরে চলল সীমা। উঃ মেয়েকে সাগর দেখানোর মাশুল একেবারে কড়ায় গণ্ডায় উসুল করে নিল পুরী!!
No comments:
Post a Comment