বিপুল তরঙ্গ রে
অনিতা নাগ
বহমান জীবনে তরঙ্গের পর তরঙ্গ কাটিয়ে এগিয়ে চলা। মনে পড়ে ছোটবেলায় পাড়ার এক ডোবায় ছোট ছোট ঢিল ছুঁড়তো সকলে মিলে। এক একটা ঢিল যেই স্পর্শ করতো জলকে অমনি এক তরঙ্গ তৈরী হতো। অনেকগুলো তরঙ্গ মিলিয়ে একটা আবর্ত। খুব মজার খেলা ছিলো। তখন বোঝার বয়সই হয় নি যে জীবন মানেই তরঙ্গের সমাহার। এমন কতো শত তরঙ্গ পেরিয়ে চলতে হবে জীবনে। প্রথম সমুদ্র দর্শন অনেক ছোটবেলায়। অবিরাম ঢেউ এর ভাঙা আর গড়া। সেই প্রথম দর্শনেই প্রেম। তখন সে প্রেম বুঝতে পারিনি। বেশ অনেকটা বড় হয়ে তাকে আবার দেখার সু্যোগ হয়। জীবন এগিয়ে চলে। কতো তরঙ্গ আসে, উথাল পাথাল হয় জীবন। তরঙ্গ থেকে তরঙ্গ হয়। ছোট, বড় অনেক রকমের তরঙ্গ। জীবনে প্রথম মৃত্যু দাদুর। তখন ক্লাস ফোর। মৃত্যুকে সেই প্রথম সামনে থেকে দেখা। বড্ড কষ্ট। একটা হাহাকার। আর তো এই মানুষটা হাত ধরে বেড়াতে নিয়ে যাবে না। ভর দুপুরে মাথায় ভিজে গামছা দিয়ে স্কুলের জানলায় গিয়ে দাঁড়াবে না। দাদুকে দেখেই পেটে ব্যথা শুরু। তারপর দাদুর হাত ধরে গুটিগুটি বাড়ী। ফিরতি পথে মিষ্টির দোকানে দু আনা করে দুটো ভাঁড়ে মিষ্টি দই নিয়ে ফেরা। দোকানী একদিন জিজ্ঞেস করেছিলো দু’ জায়গায় কেনো, এক জায়গায় দেবো? দাদু বললেন তুমি ঠকালেই আমি ঠকবো কেনো। দু’ জায়গায় নিলে আমার এক পয়সা বাঁচলো তো! সেই দাদুকে আর দেখতে পাবো না। বড্ড কষ্ট হচ্ছিলো। তার থেকেও বেশী কষ্ট হয়েছিলো সবাই যখন ঠাকুমাকে জোর করে আলতা পড়াচ্ছিলো, মাছ খাওয়াচ্ছিলো। ঠাম্মা কি অসহায় হয়ে সব করছিলো। মনে হচ্ছিলো চিৎকার করে উঠি। পারিনি। সেই প্রথম তরঙ্গ। তারপর কতো তরঙ্গ। উথাল পাথাল। আবার বয়ে নিয়ে চলা জীবনকে। বাবার চলে যাওয়ায় উত্তাল জীবন। রামকৃষ্ণদেবকে যেখানে দাহ করা হয়েছিলো সেই পূণ্য শ্মশানে বাবা নিঃশেষ হচ্ছেন আগুনে। পঞ্চভূতে মিশে যাচ্ছে তাঁর অস্তিত্ব। অসহায় আমি বহমান গঙ্গার দিকে তাকিয়ে তরঙ্গ গুণছি। এতো গভীর তরঙ্গ তো আমি চাইনি। বাবার শেষ কথা কানে বাজছে। মা'কে দেখো। আর দূরভাষে আমার ছেলে মেয়ের কান্না। মনকে কঠিন শিকলে বাঁধলাম। থামলে হবে না। চলতে হবে। চরৈবতি। সেই তরঙ্গ আজো ভুলিনি। ধীরে ধীরে শীতল হলো তরঙ্গ। পথ এগিয়ে চললো আপন ছন্দে। মা যখন চলে গেলেন নিঃস্ব হয়ে গেলাম। মা'র সময়ে বৈদ্যুতিক চুল্লি। তাতে কি মা'র কষ্ট কম হলো? জানতে পারিনি। আমার জীবন দায়িনী মা তখন আগুনে জীবনের সব তরঙ্গ কেটে বেড়িয়ে পড়েছেন সুদূর কোন পারের দিকে। সেখানে বাবা নিশ্চয় তার অপেক্ষায় আছেন। কিন্তু আমি যে রিক্ত হয়ে গেলাম। স্রোতস্বীনির সামনে দাঁড়িয়ে একটাই প্রার্থনা আগুনের পরশ মণিতে জুড়োক তোমার সকল ব্যথা। তোমার যে কষ্ট সন্তান হয়ে কমাতে পারিনি, তা থেকে তুমি মুক্ত হও। এই তরঙ্গ আমি আগলে রাখলাম।
ততোদিনে সমুদ্র শহরে থাকার সুবাদে তাকে অনেক কাছ থেকে দেখা। তার সঙ্গে তখন গভীর সখ্যতা। যখনই জীবনে দুঃখ এসেছে, অন্ধকার গভীর হয়েছে, পায়ে পায়ে তার সামনে গিয়ে বসেছি। তরঙ্গের পর তরঙ্গ গুণেছি। কতো রূপ তার। কতো রস তার। হেসে খলখল, গেয়ে কলকল। ধীরে ধীরে মন শান্ত হয়েছে।জীবনকে নতুন করে চিনতে শেখা তার কাছে। থামতে জানে না। আমরা পিছিয়ে পড়ি জীবনের পথে চলতে চলতে। সে যেনো মৌনী তাপস। আপন ব্যাপ্তি নিয়ে তার নিত্য ভাঙা গড়া। তাকে ঘিরে ব্যাস্ত জীবন প্রবাহ। সকাল থেকে রাত, কতো রূপে তার বয়ে চলা। সকালের আলোয় কখনো সে রক্তিম রাগে সেজে ওঠে, কখনো সুনীল জলরাশির লুটিয়ে পড়া। আবার জ্যোৎস্নায় রূপোলী আলোর আভরণ। সুন্দরী চঞ্চলা কিশোরী যেনো। তাকে ঘিরে কতো আয়োজন। দোকান পাট, কেনাকাটা, ব্যাস্ত মানুষ জন। আনমনা সে। নিজেকে নিয়েই মত্ত সে আপন খেলায়। সীমা দিয়ে এই অসীমকে বাঁধা যায় না। অরিরাম ভাঙা গড়ার খেলা চলছে। বিরামহীন তরঙ্গের দোলায় বয়ে চলা আপন ছন্দে। এই তরঙ্গ জীবনের পরম পাঠ শেখায়। যতোবার এই বিশালের সামনে এসে দাঁড়াই জীবনের সব জীর্ণতা, অবসন্নতা ফিকে হয়ে যায়। সে যেনো কানে কানে বলে ভাসিয়ে দাও যতো অন্ধকার, যতো না পাওয়া। ভরিয়ে নাও নিজেকে আলোয় আর আনন্দে। এই তরঙ্গ শিখিয়েছে যা পড়ে রইলো পিছে তাকে আর ফিরে পাওয়া যায় না। কিন্তু জীবনে থামার অবকাশ নেই। সময় তোমার অপেক্ষা করবে না। পিছিয়ে পড়লে মুখ থুবড়ে পড়তে হবে। তরঙ্গ যেমন ভাসিয়ে নিয়ে যায় তার সামনে আসা সবকিছুকে। তেমনই জীবন তরঙ্গ আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে চলে অনন্তের পথে। থামার উপায় নেই। চরৈবতি, চরৈবতি
তরঙ্গ মিলায়ে যায় তরঙ্গ উঠে
কুসুম মিলায়ে যায় কুসুম ফোটে।।
No comments:
Post a Comment