ইছামতী, আহা ইছামতী
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়
ছোট্ট মিষ্টি একটা নাম। বহতা জলের ধারাই তো গঙ্গা। আমার তাই বার বার ঘুরে ফিরে আসা ইছামতীর কোলে।
বনগাঁয় আমার জন্ম। এই দেশ সেইদেশ ঘুরে আবারও যেন ঘরে ফিরে আসা তাই কখনো ডিঙি নৌকা করে, কখনো মানস নেত্রে আমি ঘুরে বেড়াই ইছামতী নদীর পাড় ধরে।
একটা নদীর সাথে আমার জীবনের এত ঘটনা জড়িয়ে আছে যে ইছামতী নদীর নাম শুনলেই একটা অত্যাশ্চর্য অনুভূতি মনের মধ্যে দোলা দিয়ে যায়। একটা শক্তি সব কিছুর অগোচরে কাজ করে।
লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে দক্ষিণ বঙ্গ ছেড়ে একেবারে উত্তরভারত। জীবনের টানা সতেরো বছর এই রাজ্য সেই রাজ্য, এই জেলা, কখনো সেই জেলা কর্মসুত্রে ঘুরে বেড়িয়েছি। ঘুরে বেড়িয়েছি বললে ভুল হবে। রথ দেখা কলাবেচা সেরেছি। সেই সব দিনগুলোতে যখনই একা হতাম, ইছামতীর টান অনুভব করতাম। আজও সেই টান বর্তমান। মৈপিঠে সেদিন রয়েল বেঙ্গল টাইগার বের হয়েছে, তড়িৎ গতিতে সেই খবর পেয়েছি বন্ধু স্বজনের মুখ থেকে।
যশোর জেলার মধ্যে দিয়ে ইছামতীর যে অংশ প্রবাহিত হয়েছে তাতে ইছামতী নদীকে একটা ছোটো নদী বলেই মনে হবে। যত দক্ষিণে যাওয়া যাবে কুমির, কামোট,হাঙর- সঙ্কুল বিরাট নোনা গাঙে পরিণত হয়েছে সুন্দরী ইছামতী। উৎস থেকে মোহনায় এই সুদীর্ঘ পথ চলতে চলতে কোথায় কোন সুন্দরবনের সুন্দরী গরান গাছের জঙ্গলের আড়ালে সে বঙ্গোপসাগরে মিশে গেছে সে খবর বনগাঁর গ্রাম্য অঞ্চলের মানুষ জন রাখে না।
আমার নিজের চোখে দেখা এই অতীব সুন্দর নদী ইছামতীকে যদি পশ্চিমবঙ্গ টুরিজম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন প্রোমোট করতো, তাহলে বহু ভ্রমণ পিপাসু মানুষ ইছামতীর অবর্ণনীয় রূপ উপভোগ করতে পারতো। এই জনপদ পর্যটকদের স্বর্গ ভূমিতে পরিণত হত।
মড়িঘাটা বা বাজিৎপুরের ঘাট থেকে নৌকো করে চাঁদুড়িয়ার ঘাট অবধি গেলে দেখা যাবে দুই তীরে পলতে মাদার গাছের লাল ফুল। জলজ বন্যবুড়োর ঝোঁপ ঝাড় শোভা বর্ধন করে আছে। এখানে সেখানে টোপো পানার দাম আপন মনের খেয়ালে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বুনো তিপ্পল্লা পাতারা সেজে উঠেছে তাদের হলদে ফুলের শোভা নিয়ে। কোথাও আবার উঁচু পাড়ে প্রাচীণ বট অশ্বত্থের সুনিবিড় ছায়ায় বসে ক্লান্ত চাষি তার ঘোমটা টানা বউয়ের হাত থেকে পান্তাভাত নিয়ে খেতে বসেছে। উলুটি, বাচড়া, বৈঁচি বনের ঝোপ দুই হাত দিয়ে কাছে ডেকে নিচ্ছে। নীল সাদা আকাশে মেঘের দল খেলা করছে আর তার নিচেই কালচে সবুজ বাঁশঝাড়।
এই বনে সেই বনে গাঙ্গ শালিকের বাসা। নানা রঙের লতানো ফুলের রাশি রাশি ঝাড়, দুহাত তুলে আহ্বান জানাচ্ছে।
এই নোনা গাঙ্গের পাড়ে লোক বসতি তেমন একটা নেই। যে দিকে দুই চোখ যায়,সবুজ দূর্বা ঘাসের চর। কোথাও দু দশটা ডিঙ্গি নৌকা বাঁধা আছে। বনফুল ভর্তি ঝোঁপ ঝাড়। উঁচু শিমুল গাছের শুকনো ডালের ওপর সমাধিস্থ শকুনি বসে আছে। যেন কোনো ক্যানভাসে আঁকা শিল্পীর ছবি। কোনো ঘাটে গ্রাম্য মেয়ে বউরা স্নান করছে। তীরে প্রাইমারি স্কুলের মাঠ। জল নিয়ে খেলা করছে শিশু- কিশোরের দল। লম্বা লম্বা দো - চালাঘর, দরমা বা কঞ্চির বেড়া দিয়ে ঘেরা ফুলকপি, পালং, বেগুন, ধনেপাতা আলো করে সেজে উঠেছে।
এভাবেই সবুজ চরভূমি সেজে ওঠে। ছয় ঋতুতে ইছামতী তার ছয় রূপ ধারণ করে। বর্ষায় তার এক রূপ, শরৎ কালে অন্য রূপ আর শীতে তো কথাই নেই। উঠোনের ফুলবাগানে ফুল কমে আসলেও ইছামতীর আঙ্গিনায় ফুলের অভাব নেই। আকন্দ,কুন্দ, রঙ্গন আরও শত শত নাম না জানা ফুল শোভা বর্ধন করে।
জানি না পরজন্ম বলে কিছু হয় কি না তবে আগামী জন্মে ইছামতীর কোলেই জন্ম নিতে চাই, বেড়ে উঠতে চাই।
No comments:
Post a Comment