গ্রন্থ আলোচনা
বইয়ের নাম- সুরমা কলিং
লেখক- শৌভিক রায়
প্রকাশনা- হাওয়াকল
মূল্য- 200 টাকা
আলোচক- মৃগাঙ্ক দাস
শৌভিক রায়ের লেখা "সুরমা কলিং " গল্পগ্রন্থটি পড়লাম।এক কথায় দুরন্ত আধুনিক ও সময়োপযোগী এক অনন্য গল্প সংগ্রহ। লেখক
রচনায় অত্যন্ত আধুনিক ও মননশীল।
এখানে প্রথমেই রচনার কতগুলো সাধারণ বৈশিষ্ট্য যা আমাকে তীব্র উদ্দিপীত করেছে সেগুলো একে একে বলছি।
প্রথমতঃ গল্প সংগ্রহের প্রতিটি গল্পেই,কোনও গল্প নেই। অধিকাংশ গল্পের মূল আশ্রয় হচ্ছে কোনও না কোনোও সাধারণ ঘটনা। কিন্তু এই
ঘটনাগুলোর সাথে যুক্ত প্রতিটি মানব-মানবী,বা অবস্থা ও অবস্থানের মানবিক বিশ্লেষন যা এক একটা গল্পকে এক অন্যমাত্রায় নিয়ে
গেছে।কখনো কোনও বস্তু ও মানুষের আন্তরিক সম্পর্কের ভেতরকার ছান্দিক মননশীলতা পুরানো,বেহালাকে পূর্ণবাবুর আশার অভিন্ন
রূপকল্প হিসাবে এঁকেছেন এক অনন্য পারদর্শীতায়। আবার একটা গল্পে "তরুণবাবুর কান" কখনো বেশী শোনে,কখনো সম্পূর্ণ বধির হয়ে
যায়,তা নিয়ে গল্প। এটুকু শুনলে বোঝা যাবেনা,গল্পটি কি?আবার সেই প্রেক্ষিত রচনার মধ্যে দিয়ে যে সামাজিক খন্ডচিত্র সামনে
এনেছেন, তা আমাদের অজান্তেই এক গহীন ব্যথার সমব্যথী করে তোলে। প্রতিটি গল্পেই এইরকম কায়াহীন ছায়ার মতো,গল্পহীন গল্পের
কাব্যিক রূপ প্রতিভাত করেছে।
দ্বিতীয়তঃ প্রতিটি গল্পেই লেখকের সমাজচেতনার ছাপ, আমাদের উপলব্ধিকে সচকিত করে তোলে।সমাজের ভিন্ন ভিন্ন ব্যবস্থা বা অব্যবস্থা
যাই বলিনা কেন তার বিরুদ্ধে লেখাতে জেহাদ এক অনিবর্চনীয় রূপ ধরে প্রকাশিত হয়েছে। বলতে চাইছি এই কাজটি করতে গিয়ে
বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই লেখক স্লোগান সর্বস্বতায় ভোগে, কিন্তু শৌভিক রায় তার কথকতার জাদুতে সমগ্র বাক্-সর্বস্বতাকে অতিক্রম করতে
পেরেছে এবং এইখানেই শৌভিক ভীষণভাবে প্রেমচাঁদ, কৃষণচন্দর, মানিক বন্দোপাধ্যায়দের উত্তরসূরি হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠার যাত্রা
শুরু করেছেন।
তৃতীয়তঃ শ্রেণীচেতনা। এক অনন্য শ্রেণীচেতনার অধিকারী শৌভিক রায়। জানিনা এই উপলব্ধি কোথা থেকে পেলেন তিনি। যে
নিম্নবর্গীয় মানুষের চালচিত্র বইটিতে আঁকা হয়েছে, যাদের সুখ-দুঃখ, ব্যথা-বেদনার এত কারুকার্যময় প্রকাশ তা অত্যন্ত তীব্র শ্রেণীচেতনা
না থাকলে ঘটানো সম্ভবই নয়।চরিত্রগুলো সব নিম্নবর্গীয় মানুষের মত আত্মনির্ভরশীল। প্রতেকেই সাবলম্বী, অর্থনৈতিক সম্পর্কে কেউ
কারোর সাথে আবদ্ধ নয়। এই বোধ শ্রেণীচেতনা ছাড়া সম্ভব নয়।আর এই শ্রেণীচেতনা থেকেই নীচুতলার মানুষের যৌনচেতনা তার
রচনায় সাবলীল হয়ে উঠে এসেছে,যা কোনো সেন্সরশিপের অপেক্ষা রাখে না। অনেকটা যেন মহাভারতের "দ্রৌপদীর" মত পাঁচ স্বামী
নিয়ে ঘর করার পর কখনো দ্রৌপদীকে অসতী মনে হয় না।
তাই যৌনতা (তলপেট,বুদবুদির গরম ভাত) এক জরুরি অথচ জীবনের স্বাভাবিক ঘটনা হিসাবেই গল্পে একটা ডাইমেনশন তৈরি
করেছে। যৌনতার এই উত্তরণ কেবলমাত্র শ্রেণীচেতনা থেকেই আসা সম্ভব। উল্লেখ্য কবিতা, যেখানে যৌনতা এসেছে তার স্বাভাবিক
ছন্দে,নৃত্যপটীয়সী নারীর মত। শৌভিকের যৌনতাচেতনা তাই শ্রেণীচেতনার ঋদ্ধ মননের প্রকাশ হিসাবে স্বকীয়তায় উজ্জ্বল। এই
শ্রেণীচেতনায় সমৃদ্ধ "সুরমা কলিং " চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় শৌভিক অনেকদূর যাবে।
এই মুহূর্তে শৌভিকেল মথ এত ভাল "বামপন্থি" লেখক পাওয়া মুশকিল।
চতুর্থতঃ লেখক শৌভিক বড়, না স্টোরিটেলার বড় এটা বুঝতে আমার সময় লেগেছে। প্রতিটি গল্পে যেভাবে গল্পের গতিকে নির্ধারণ করা
হয়েছে, তাতে গল্প বলিয়ে শৌভিকই প্রাধান্য পেয়েছে। লেখক তার সৃষ্ট চরিত্রের মধ্যেই নিজেকে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় প্রকাশ করেছেন
যেন। কিন্তু "সুরমা কলিং " এর কোনও গল্পেই তা হয়নি,বরং সচেতনভাবে গল্প থেকে নিঃস্পৃহ থেকে একের পর এক মানব জমিনের
জটিলতাগুলোর বিন্যাসকে খুলে গেছেন। আর এই কথকতার প্রশ্নে আরও একটা বড় সম্পদ হল ভাষার ব্যবহার। লোক কথার মত সহজ
সরল করে বলে যাওয়া, এ যে কত কঠিন, যারা লেখালেখির সাথে যুক্ত তারাই জানেন এর মাহাত্ম্য। গালিবের ভাষায়,"আশা করনে কি
করতে হ্যায় ফরমায়েনা, গোয়েম মুশকিল, বগঢ়না গোয়েম মুশকিল "। (কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অনুবাদ-"আদেশ করেন যেন
লিখি সহজ অনাবিল,কিন্তু আমার দুরূহ রীতি ছাড়াই মুস্কিল") শৌভিক এই দুরূহ রীতি ছাড়তে পেরেছে। তাই আমার মনে
হয়"স্টোরিটেলার" হিসাবে শৌভিক সত্যিই অনেক দামী।
পঞ্চমতঃ পুরো বইটি এক অনন্য মননশীলতার কাব্যিক রূপ। কবিতার যে বেগময়তা তা গদ্যে পাওয়া দুষ্কর। কিন্তু "সুরমা কলিং "এর
ব্যতিক্রম। শব্দচয়ন,পরিমিতবোধ (কলাবতীর রাজকন্যা) শৌভিকের গদ্য রচনায় এক অন্য মাত্রা এনে দিয়েছে।
সর্বোপরি এ প্রসঙ্গে একটু তুলনা নিয়ে আমি দ্বিধাগ্রস্ত, কারণ শ্রেণীচেতনায় ঋদ্ধ এই গল্পমালা, জনগণের হৃদয়ের অনেক কাছের সম্পদ।
অনুভবের, উপলব্ধির জন্যই সৃষ্টি। একটা উপেক্ষিত শ্রেণীর প্রতি সমবেদনা ও ভালবাসার লক্ষ্যেই যেন এর সৃষ্টি। তুলনামূলক সাহিত্যের
আলোচনায় গিয়ে একে "ব্র্যান্ডেড"করাটা নির্বুদ্ধিতা, শুধু তাই নয়, এ যেন অমৃত মন্থন করে প্রতারণা পূর্বকতা দেবতার হাতে তুলে
দেওয়া।তবুও বলা উচিৎ মনে করেই বলছি। প্রায় ২০০শ বছর আগে ইউরোপে শিল্প, সাহিত্যে একটা রূঢ় ঝড় হয়ে উঠেছিল-
ইম্প্রেশনিজম, এবং এই ইম্প্রেশনিষ্টদের মধ্যে যারা ছিলেন, যেমন বোদলেয়ার,লরেন্স, কনরাডের মত বিখ্যাত সাহিত্যিকগণ, তেমনি
শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন গ্যগা, সেজান, ভ্যানগগ্ প্রমুখ। এই আলোচনায় প্রাসঙ্গিক করে, সেই ইম্প্রেশনিজম কি জিনিস জানলেই এই
আলোচনার প্রাসঙ্গিকতা ও তাৎপর্য বোঝা যাবে। খুব স্পষ্ট কথায় ইম্প্রেশনিজম বলতে বোঝায় impressionists interpret -
impressions, sensations and emotions that constituate a character's mental life, not
the description of the incidents or characters ". ইম্প্রেশনিস্টরা মানুষ বা ঘটনার সাথে যুক্ত মানব-মানবী
বা কোন ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত অন্তর্লীন ফ্লগুধারার মত প্রবাহিত মননশীলতা নিয়ে চিন্তা করে,ঘটনা বা চরিত্রের বহিরঙ্গ নিয়ে নয়।"
"সুরমা কলিং "গল্প সংগ্রহ (নাকি কাব্যগ্রন্থ) এমনি একটি গল্পমালা যা শুরু থেকে শেষ অবধি ঠিক এই কাজটি অত্যন্ত নিপুণতার সাথে
করেছে, ঈর্ষনীয়ভাবে করেছে।
আমি ব্যক্তিগতভাবে,বইটিতে গল্পগুলোর পরপম্পরা রক্ষা করে সাজানোর কাজের মুন্সিয়ানার প্রশংসা করলাম। তবে ছাপানোর কাজের
ভুলগুলো সংশোধন করা জরুরি।
১)"আরাবানের বিধবা"- এক অত্যন্ত সুন্দর সৃষ্টি।গল্পটি এক চিরাচরিত গন্ডীকে ভেঙে এক অচেনা জগতের বর্ণময়তা ও তার মননকে
সাদরে আমাদের (সাধারণের) জীবনের সাথে অত্যন্ত নিপুণতারর সাথে মিশিয়েছেন যা শুধু শৈল্পিক উৎকর্ষতায় অনন্য নয়,দরদী
মননের ছাপ রেখে যায়।উপসংহারে যখন গোকুলদা আর আরাবান মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়,তখন হিজরা জীবন বিলীন হয়ে এক
সামগ্রিক মনুষ্যত্বের মননের উত্তরণ ঘটে। সৃষ্টি সার্থকতা পায়।
২)"কলাবতীর রাজকন্যা"-সৃষ্টির কোনও ধর্ম হয় না, হয় না কোনো জাত। বর্তমান জীবনের এক জটিলতম সমস্যাকে যেভাবে ফোটানো
হয়েছে, তা কেবলমাত্র ক্যানভাসে আঁকা একটা জীবন যন্ত্রণার সাথে তুলনীয়। সবচেয়ে আমাকে আকৃষ্ট করেছে আঙ্গিক ও পরিমিতবোধ।
এই বিষয়টা এক বহুল প্রচলিত বিষয়, যা এখন আর মনকে নাড়া দেয় না। সামান্য দুঃখ প্রকাশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। শৌভিকের সাফল্য
মাত্র চোদ্দ লাইনে এর একটা সার্বজনীন বেদনার রূপ দিতে পারা আর হৃদয়ের কোনো একটা জায়গায় মোচড় দিতে বাধ্য করা। লেখাটার
একটা রূপ এর একটা বড় বৈশিষ্ট্য। একটা সফল সৃষ্টি।
৩)"একদিন প্রতিদিন "- উপলব্ধির এক অন্যরূপ। সাধারণ এক কাজের মেয়ের সাথে মা ও মেয়ের দুই ভিন্ন ব্যবহার, এক থেকে অন্য
প্রজন্মে পরিবর্তিত হয়ে গেছে। বস্তুত যেটা প্রায় অসম্ভব, সেটাই দেখানো হয়েছে।
৪)"শিল্পী"- একজন মোটিভেটেড খুনির বিবরণ।এক চূড়ান্ত মোটিভেশন যেমন কোনও সাধককে নির্বাণ লাভে সাহায্য করে, ঠিক তেমনি,
কাজটা যাই হোক না কেন, তন্ময়তা তাকে সেই কাজের শ্রেষ্ঠ শিল্পী হিসাবে মর্যাদা দেয়।এখানে তেমনি একটা মানুষের তন্ময়তার
বিবরণ, যে তন্ময়তায় সে খুন করাকে শৈল্পিক স্তরে নিয়ে গেছে,তার ২২তম খুনের সময়। সে কল্পনার এক নিঁখুত শল্যচিকিৎসকই হ'ক
বা শিল্পী হ'ক, নিঁখুত ছবির টান বা তুলির টান হোক, তা অবশ্যই তুলির টানের মতই বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে। অনবদ্য কল্পনা।
৫)"তারক আর কিশোরকুমার"- একজন অটোচালকের জীবনের অজান্তেই গড়ে ওঠা এক ভালবাসার গল্প।কিশোরকুমারের সঙ্গীত উঠে
এসেছে তার হৃদয়ের অনুরণন হিসাবে। এইখানেই লেখকের স্বকীয়তা ভীষণভাবে ফুটে উঠেছে।আরো অনেকভাবে অনেক ভাষায় একে
প্রকাশ করা যেত। কিন্তু নায়কের শ্রেণীর (অটোচালক) কল্পনা, তার শ্রেণী চরিত্রের এক দুর্দান্ত প্রকাশ ঘটিয়েছে।অটোচালকের মুখে
সাহিত্য বুলি অত্যন্ত বেমানান হতো।সবচেয়ে বড় পুরো গল্প সংকলনেই শৌভিক তার নিজের শ্রেণী চরিত্রকে পরিস্ফুট করেছে, যা
পৃথিবীর খুব বিখ্যাত হাতে গোনা লেখকের লেখায় দেখা যায়। এটা স্পষ্ট যে লেখক জানেন তিনি, কার বা কাদের জন্য লেখেন।
৬)"ইচ্ছেপূরণ"- এক অনবদ্য মাইক্রোগল্প। স্বামী-স্ত্রীর খুনসুটি দিয়ে যে গল্প শুরু, মুহূর্তেই তার ট্রাজিক সমাপ্তি মনটাকে ভারী করে
তোলে।মধ্যবিত্ত সংসারের সীমাবদ্ধতা ও তার থেকে উদ্ভূত বেদনাময় পরিণতি। অন্তরে এক হাহাকারের জন্ম দেয়। তাই গল্পটা শেষ
হওয়ার পরেও অনেকক্ষণ লাগে পৃষ্ঠা ওলটাতে পরের গল্পে যাওয়ার জন্য।
৭)"সুরমা কলিং "- কভার স্টোরি আপডেটেড। গল্পটির তিনটি বৈশিষ্ট্য ১) স্বামী-স্ত্রীর চাওয়া পাওয়া, ২) শিল্পী ও কারিগরের মধ্যে
ফারাক বোঝানো, ৩) শিল্পীর আত্মচেতনা ও আত্মসম্মানবোধ, নিজেকে বিক্রি না করে দেওয়ার অনমনীয় দৃঢ়তা। আমি,যখন লিখছি,
যথেষ্ট সচেতন থাকতে হচ্ছে, মনে পড়ে যাচ্ছে জীবনানন্দের সেই মন্তব্য যা তিনি আলোচকদের প্রসঙ্গে বলেছিলেন,"অক্ষমতা পিচুটি
মাখা চোখে...।" জানি আমার বোধ,আমার উপলব্ধি আমি বর্ণনা করতে পারব না, কারণ আমি শৌভিক নই।কারণ আমি যা উপলব্ধি
করি, তা সঠিকভাবে উপস্থাপনা করার বিদ্যেও আমার নেই।এই সমস্ত তাত্ত্বিক কচকচানি, গল্পটির অনবদ্য সুষমাকে মলিন করে দিতে
পারে। না পাওয়া জীবনে কিছু স্বীকৃতি পাওয়ার পর, প্রথমে যার কথা মনে পড়েছে, সে বহুদূরে থাকা সাফল্য বা ব্যর্থতার উৎকণ্ঠায়
থাকা স্ত্রী সুরমা। কিন্তু সেই মুহূর্তে মোবাইলে বেজে ওঠে রিংটোন। লেখা ভেসে ওঠে-"সুরমা কলিং "। আশ্চর্য সুন্দর ভালবাসার
টেলিপ্যাথি?
৮)"সমাপতন"- অন্যান্য গল্পের তুলনায় দুর্বল লেগেছে।রেণুবালা হৃদয় ছুঁয়ে যেতে পারেনি। গল্পের বিন্যাসও দুর্বল মনে হয়েছে।
রেণুবালা কি অতীতের ভ্রান্তির ভুল চোকালো অথবা দীর্ঘকালীন পুষে রাখা যন্ত্রণার প্রতিশোধ নিল? যার জন্য সত্যিকারের সমাপতন
হয়ে তা হয়ে উঠতে পেরেছে কি?
৯)"পূর্ণবাবুর বেহালা"- এক অনবদ্য রসময় সৃষ্টি। সমস্ত জীবনের অপূর্ণ বাসনাগুলো জীবনের কোন এক সময় আবার সামনে এসে
দাঁড়ায়।কল্পনাগুলো, ভালোলাগা -ভালবাসা যা প্রাত্যহিক জীবনের বহুমুখী চাপে হারিয়ে যায়, হঠাৎ জীবনের অবেলায় তার মুখোমুখি
হতে হয় পূর্ণবাবুকে এবং তার অপূর্ণতাই তার ওপর ভর করে। প্রত্যেক মানুষের জীবনেই বোধ একবার, পূর্ণবাবু হয়ে ওঠা তাই
অনিবার্য হয়ে ওঠে। আমি ব্যক্তিগত ভাবে পূর্ণবাবুর মধ্যে নিজেকে দেখতে পাই।ভায়োলিন কি সুর সৃষ্টি করল সেটা মেইন নয়, কিন্ত এই
আকুলতার এক সর্বগামী দৃষ্টিভঙ্গি উন্নীত হয় এক চমৎকার গল্পে। সার্থক রচনা।
১০)"তলপেট "- একটু হালকা হাওয়া। নারী-পুরুষের ব্যক্তিগত জীবনের ভালোলাগা ও ভালবাসার গল্প যা চিরাচরিত পথ ছেড়ে একটু
ভিন্ন পথে এগোয়।দুজনের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ গল্পটিকে এক অন্য মাত্রা দিয়েছে। সুমতিকে কখনো অসতী মনে হয় না। সুমতির প্রেম
পরিক্রমণ এত জটিল,অথচ লেখনীর বলিষ্ঠতায় অত্যন্ত সুখপাঠ্য (পাঠ্য শব্দটায় আপত্তি আগেই জানিয়েছি) হয়ে উঠেছে। একগুঁয়ে বুকুর
সরল জীবনদর্শন ও সার্বিক সরলতা সকলকে মুগ্ধ করে।
১১)"সাধুচরনের একদিন"- আবার সেই মানব-মানবীর জীবন যন্ত্রণা ও বক্রগতির প্রেমের বিশ্লেষণ। দুই ভিন্ন চরিত্র একখানে হৃদয়ের
টানে বাঁধা পড়ে। সেইমুহূর্তের দুজনের মনস্তাত্ত্বিক অপূর্ব বিশ্লেষণ, অবশেষে মিলন অথবা বিচ্ছেদ যা নান্দনিক রূপ লাভ করে। প্রতিটি
গল্পের মত স্বকীয়তায় সমুজ্জ্বল। বাউণ্ডুলে সাধুচরণ গল্পের নায়ক, যে বলার চেয়ে ভাবে বেশী।দিনশেষে ব্যথাই সম্বল যার। শৌভিক
অস্তমিত সূর্যের লাল ছটায় রক্তিমতা প্রদান করে জীবনের ছোটখাটো চাওয়া পাওয়ার চেয়েও যে জীবন অনেক বড় তা স্পষ্ট করে।এই
আশাবাদই সার্থকতা লাভ করে।
১২)"বদুবুড়ি ও গরম ভাত"- একজন ক্লিষ্ট, নিরন্ন,জীবনযুদ্ধে পরাজিত নারীর মনোজগতের এক অসীম মায়াময় কথন।জীবনের
আবর্জনা,গলিত পচাগলা,সমাজের ক্লেদ যাকে ছিন্নভিন্ন করেছে,অথচ মনুষ্যত্ব মারতে পারেনি।কোমরের দীর্ঘকালীন ব্যথা নাকি সমাজের
নপুংসকতাকে অতিক্রম করে রুখে দাঁড়ায় নারীর সম্মান রক্ষার অসম লড়াইয়ে। জীবনের সায়াহ্নে যার ভালোলাগা,একটুখানি গরম
ভাত আর কাঁচা লঙ্কার মিষ্টি সুবাস সে পেয়ে যায় নিজের রক্তেই। অনবদ্য আখ্যান।
১৩)"কবীরের দোহা"- সমাজের এক অন্ধকার দিক "কুসংস্কার "। যে ধর্মীয় অন্ধত্ব মানুষকে দিনদিন এক ভয়ংকর অন্ধকারের দিকে
নিয়ে চলেছে,তার প্রতি তীব্র কষাঘাত দেখতে পাই। এক দুর্দান্ত আলেখ্য। এক এমন চিত্রকল্প যা পড়তে পড়তে নিজের বিশ্বাসটা যাচাই
করে নিতে হয়। এক মহান উপলব্ধি, যা বিজ্ঞান মনষ্ক মানুষ, বিজ্ঞান মনষ্কতা নিয়ে ভাবনা ছড়াবে,ষঅথচ সমাজ সংস্কারে নামবে না,
তা আদৌ সম্ভব? ঘুমের মধ্যে হাঁটা একটা রোগ, যাকে পুঁজি করে এক নারীর ওপর সতীত্ব চাপিয়ে তাকে অবস্থার শিকার বানিয়ে,
গণপ্রতারণা ও শোষণ চালিয়ে যাওয়ার কুৎসিত চক্রান্ত। যেখানে প্রশাসন ও নির্বিকার, সেখানে এমন এক ব্যবস্থা, সবাই মিলে এক অশুভ
ষড়যন্ত্রে সামিল হয়ে সমাজটাকে উচ্ছনে পাঠাচ্ছে। অত্যন্ত সময়োপযোগী এবং লেখনীর গুণে কাল-উত্তীর্ণ হওয়ার যোগ্যতা রাখে।
শৌভিক রায়কে ধন্যবাদ এরকম আধুনিক একটি গল্পসংগ্রহ উপহার দেওয়ার জন্য।
No comments:
Post a Comment