Friday, September 13, 2019









পাঠ প্রতিক্রিয়া
আলোচক- শৌভিক রায়

কাব্যগ্রন্থ: এবং নাব্যতা
কবি: নীলাদ্রি দেব 
সদ্য প্রকাশিত হয়েছে তরুণ কবি নীলাদ্রি দেবের 'এবং নাব্যতা`। নীলাদ্রির কবিতা মানে এক ঝকঝকে এক স্মার্ট ভুবন। শব্দ নিয়ে ওস্তাদ বাজিগরের মতো তরুণ এই কবি কখনো জাগলিং করে  আবার কখনো যেন সুক্ষ তারের ওপর দিয়ে হেঁটে চলে। এই মুহূর্তে, আমার জানা ও পড়ার মধ্যে, এত কম বয়সে এরকম ভাবে লেখার মানুষ কম। সেদিক থেকে দেখতে গেলে নীলাদ্রির শুরু ভীষণ প্রতিশ্রুতি জাগানো। আশা করা যায় যে, আগামীতেও নীলাদ্রির এই যাত্রা অব্যাহত থাকবে।
'এবং নাব্যতা` গ্রন্থে ঠাঁই পেয়েছে ১৭টি কবিতা। কবিতাগুলির কোনো শিরোনাম নেই, সংখ্যা দিয়ে প্রকাশ করা হয়েছে কবিতাগুলি। প্রতিটি কবিতা নিজের মতো করে যেমন আলাদা, তেমনি সামগ্রিক পথ শেষে মনে হয় যেন একটি অখণ্ড কবিতার বিভিন্ন অংশ পড়লাম। এখানেই এই কাব্যগ্রন্থটি নীলাদ্রির আগের দুটি কাব্যগ্রন্থের থেকে আলাদা হয়ে উঠেছে। কোনো কবিতায় আকারে বৃহৎ নয়। সবচেয়ে বড় নয় সংখ্যক কবিতাটি ১৪ লাইনের, সর্বনিম্ন চার লাইনের (কবিতা সংখ্যা ৬)....বাকি কবিতাগুলি ৪ থেকে ১৪-এর মধ্যে ঘোরাফেরা করেছে। কিন্তু এর মাঝেই নীলাদ্রি যা বলতে চেয়েছে, তা স্পষ্ট বলতে পেরেছে। দু`একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে- 
'নদী আর নদী বাঁধের মাঝে / পরিযায়ী মানুষের দল / বালিয়া মাছের মত ভাসে / ওদের পিত্ত জমতে জমতে ব্যালট হয়...' 
'প্রতিটি সম্পর্ককে একদিন নদীর কাছে রেখে আসতে হয়/ নদী অপেক্ষা করে / খইয়ের হাঁড়িতে কাঁচা টাকা কজন্যে সময় / ধুনোর আগুনে জমতে থাকে ছাই...' 

কাব্যগ্রন্থের নাম  'এবং নাব্যতা` থেকেই বোঝা যায় যে, কবিতাগুলির অনুষঙ্গে নদী থাকবেই। গভীরভাবে পড়লে পরিষ্কার হয় যে, এই কাব্যগ্রন্থের মূলেই রয়েছে নদী ও নদী-ভাবনার এক অনন্য প্রয়াস, হয়ত বা কবির নিজস্ব নদীযাপন, হয়ত বা যে নদী মানব সভ্যতার আদি থেকে মানুষকে সৃজনশীল হতে সাহায্য করেছে, সেই নদীর প্রতি কবির ব্যক্তিগত তর্পন। আর এটা তো ঠিক যে, নদীর মতোই প্রবাহিত আমাদের মানব জীবন। তাই এক অর্থে কবির এই উচ্চারণ আদতে জীবনেরই গান। আর সেই গানকে নদীর স্রোতের মতো স্বাভাবিকভাবে গাইতে পেরেছে নীলাদ্রি। অবগাহন করেছে নদীর গভীরে, তুলে এনেছে নদীর ভেতর থাকা অজস্র রত্নকে।

শ্রীহরি দত্তের প্রচ্ছদ অত্যন্ত মানানসই এবং অর্থবহ। কাব্যগ্রন্থের ভেতরে থাকা দুটি ছবি কেবল তুলির আঁচড় নয়, তাতে ফুটে উঠেছে নদীর গাম্ভীর্য ও উদারতা। আলোপৃথিবী প্রকাশনের মুদ্রণ, কাগজ সবটাই যথেষ্ট ভাল। একটি মুখবন্ধ লিখেছেন কবি সুবীর সরকার। ভাল লাগে সেটি পড়তে। সবশেষে যে  'ক্যানভাস চুরি' করে নীলাদ্রি 'আগামীর পথ খুঁড়ে` রেখেছে, সে ক্যানভাসে আবার নদীর জল তার দাগ রেখে যাক। 'মুজনাইয়ের বালক`-এ বলা আমার সেই বহুবার বলা কথা আবারও বলি, 'জলের দাগ আসলে মোছা যায় না'। আর নীলাদ্রি তো জলে ভিজেছে!




কাব্যগ্রন্থ: লোকসংগীত শুনি
কবি:সুবীর সরকার


আঠারোটি কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে কবি সুবীর সরকারের কুড়ি নাম্বার কাব্যগ্রন্থ 'লোকসংগীত শুনি`। যে কবির এতগুলি কাব্যগ্রন্থ ইতিমধ্যেই প্রকাশিত তার কবিতা নিয়ে নতুন করে কিছু বলবার অবকাশ থাকে না বলে ব্যক্তিগতভাবে মনে করি। 

সুবীর সরকার নামটি আধুনিক কবিতার পাঠকদের কাছে যথেষ্ট পরিচিত। এপার-ওপর দুই বাংলাতেই কবি সুবীর সরকারের পাঠক সংখ্যাও প্রচুর।
সুবীর সরকারের কবিতার পাঠক হিসেবে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ হই যে বিষয়ে তা হল কবির কবিতার বহুমাত্রিকতায়। সুবীরের কবিতার বৈশিষ্ট্যই হল প্রতিটি লাইন যেমন আলাদা করে একটি অর্থ বহন করে, তেমনি সামগ্রিকভাবে সম্পূর্ণ কবিতাটি নতুন ভাবনা বয়ে নিয়ে আসে। এক ম্যাজিক রিয়ালিজমের দরজা যেন পরতে পরতে খুলে যায় সুবীরের কবিতার ছত্রে ছত্রে। আর সেই রিয়ালিজমের মুখোমুখি আমরা দেখতে পাই টংঘর, মাকনা হাতি, ভুট্টাবন, বরফ কাটার ছুরি, মোরগ লড়াই অথবা প্রোফাইল পিক। শব্দ নিয়ে দুরন্ত এই খেলায় সুবীরের জুড়ি মেলা ভার। এখানে একটা কথা না বলে পারছি না যে, কবিতা কিন্তু আদতে কয়েনেজ বা শব্দ-চয়ন। আসলে আমরা তো কেউ নতুন কথা বলছি না কিছু। কেননা নতুন কথা বলবার নেইও কিছু। মানুষের শাশ্বত বিষয়গুলি যা মানবজীবনে সর্বকালে, সর্বদেশে এক, তা নিয়ে নতুন কিছু বলবার আর কি-ই বা থাকতে পারে! তাহলে কি কবিতা লেখা হবে না? নিশ্চয়ই হবে। আর সে কবিতা আলাদা হয়ে উঠবে কবির নিজস্ব শব্দ নির্মাণে। শব্দ সংযোজনে এক নতুন পরিভাষা সৃষ্টি করে একজন বর্তমান কবি আলাদা হয়ে ওঠেন তাঁর অগ্রজ কবিদের থেকে। যিনি নিজস্ব ভাষা সৃষ্টি করতে পারেন না, তাঁকে আমি অন্তত কবি বলতে রাজি নই। বন্ধু কবি অজিত অধিকারীর মতো আমি তাঁকে কবিতা-লিখিয়ে ভাবতে পারি, কিন্তু কবি নয়। সৌভাগ্য যে, 'লোকসংগীত শুনি` কাব্যগ্রন্থের স্রষ্টা নিজস্ব নির্মাণে সফল হয়েছেন বহুদিন আগেই। তাঁর কবিতার ভাষা তাঁর নিজস্ব শৈলী এবং অত্যন্ত যত্নে সেই ভাষাকে লালন করে চলেছেন তিনি। দু'একটা উদাহরণ দেওয়া যাক- 'তোমাকে নিয়ে চলে যাবো একটা দশ নদী বিশ ফরেস্টের পৃথিবীতে/ টংঘরের পাশে বাজতে থাকবে গির্জার ঘন্টা/ সুপুরিগাছের ছায়ায় আমি তোমার চোখে চোখ রাখবো`।এখানে লক্ষ্যণীয় যে, আদ্যন্ত প্রেমের কবিতা হয়েও নির্মানটি অন্য প্রেমের কবিতাগুলি থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছে তার আঞ্চলিক কিছু শব্দবন্ধের, যেমন টংঘর, সুপুরি গাছের ছায়া গির্জার ঘন্টা ইত্যাদির প্রয়োগে। আবার এই কবিতাটির মধ্যেই করাতকলের সামনে থেকে কবি দীর্ঘ পদযাত্রা শুরু করতে চেয়েছেন তাঁর প্রেমাস্পদের সঙ্গে। এই যে আঞ্চলিকতা থেকে সামগ্রিকতাকে স্পর্শ করবার প্রচেষ্টা সেটিই কবিতাটিকে আর পাঁচটি প্রেমে কবিতার থেকে আলাদা করে দেয়। আবার 'শিকার` কবিতাটিতে মাত্রা পাঁচটি লাইনের মধ্যে যে নির্মম চিত্রকল্প ফুটে উঠেছে তা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখাচ্ছে বর্তমান সময়ের শঠতা, ছল-চাতুরী ও বিশ্বাসভঙ্গের ঘৃণ্য ইতিহাসকে। এরকমভাবেই আইসবার, শোকযাত্রার প্রতিবেদন, জাহাজডুবি ইত্যাদি কবিতাগুলি নিজস্বতায় ভাস্বর। নগর জীবনের যন্ত্রণা, বিরুদ্ধ প্রকৃতি, চাতুর্য ও  অবক্ষযের এই পৃথিবী ফুটে উঠেছে কবিতাগুলির মধ্যে। সুবীর সরকারের বিভিন্ন কবিতার পাঠক হিসেবে বলতে পারি যে, কবি সুবীর সরকার তাঁর নামের সঙ্গে এই কাব্যগ্রন্থে কোনো আপোষ করেন নি। বরং উত্তরণের দিকে যে যাত্রা তাঁর শুরু হয়েছিল নব্বইয়ের দশক থেকে তা যেন আরও একটু মাত্রা পেলো এই কাব্যগ্রন্থের হাত ধরে। 

বরাবরের মতো অনবদ্য ছবি এঁকেছেন আমার ছাত্র শিল্পী শ্রী শ্রীহরি দত্ত। শ্রীহরির ছবির মধ্যে এক অদ্ভুত আবেগ খেলা করে। এক্সপ্রেশনিজমের আর একটি সুন্দর উপহার দিয়েছেন শ্রীহরি তাঁর এই সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে। কাব্যগ্রন্থের নাম ও কবিতাগুলির সঙ্গে সাযুজ্য রেখে এই প্রচ্ছদ মন কাড়বে সচেতন পাঠকের একথা বলা যায়। কাব্যগ্রন্থটি কবি উৎসর্গ করেছেন তিন তরুণ কবি শ্রীমতি মণিমা মজুমদার, শ্রীমতি মীনাক্ষী মুখার্জি ও শ্রীমতি পূর্বালী চক্রবর্তীকে। কবি সুবীর সরকারের তরুণ কবিদের প্রতি এই স্নেহ ভাল লেগেছে। কাব্যগ্রন্থটির কাগজ ও মুদ্রণ ঝকঝকে। আলোপৃথিবী প্রকাশনা ভাল কাজ করেছেন।   

No comments:

Post a Comment