দ্বিতীয় পর্ব
ঝলমলে শরতে, প্রকৃতির অসামান্য রূপটান। কিন্তু মনে প্রসন্নতা না থাকলে সব বৃথা যায়। লক্ষ লক্ষ মানুষ উত্খাত হওয়ার আশঙ্কায় ভীত, কোথাও প্রযুক্তির ত্রুটিতে অসংখ্য মানুষ বাস্তুহারা, কোথাও অমানিশার ধারা, কোথাও আবার সন্ত্রাসের বলি আমারই প্রতিবেশী!
তাই আসন্ন শারদ উত্সব বড্ড ফিকে মনে হয়।
তবু মানুষ আনন্দে মেতে উঠবে সব ভুলে। আসলে আমাদের চারদিকে এত সমস্যা যে, সব ভুলে এই মেতে ওঠা ছাড়া বোধহয় উপায়ও নেই।প্রশ্ন কিন্তু তাও রয়েই যাচ্ছে- উত্সবের আলোয় আদৌ কি আলোকিত হবে আমাদের এই ছন্নছাড়া যাবতীয়?
স্মরণ
প্রখ্যাত নাট্যকর্মী, অভিনেতা ও পরিচালক ও মুজনাইয়ের অকৃত্রিম বন্ধু মদন রায়ের প্রয়াণে আমরা শোকস্তব্ধ। তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি।
এই পর্বে আছেন
গীর্বানী চক্রবর্তী, রুনা দত্ত, বটু কৃষ্ণ হালদার, ইন্দ্রাণী সমাদ্দার, সুশান্ত পাল, যূথিকা সাহা, অনুপ কুমার সরকার, দেবব্রত সেন
অনুভব
প্রথম শরতের রঙ তুলিতে আমার ডুয়ার্স
গীর্বাণী চক্রবর্তী
ভাদ্র মাস নিয়ে মধ্যযুগীয় কবি বিদ্যাপতি লিখেগেছেন “এ সখি হামারি দুখের না হিওর / এ ভরা বাদর মাহ ভাদর শূণ্য মন্দির মোর।।“আবার এই ভাদ্র মাসেই পড়ে প্রচণ্ড গরম যাকে বলে তাল পাকা গরম। তবে ভীষণ গরমেই হোক আর প্রচন্ড বর্ষাই হোক উত্তরবঙ্গের রাণী রূপবতী ডুয়ার্সে ভাদ্র মাসের যে একটা আলাদা মাধুর্য আছে একথা কিন্তু অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। ভাদ্র ও আশ্বিন এই নিয়ে বাংলার শরতের সংসার। আর শরৎ মানেই তো শারদীয়া। তাই যতই ভাদ্র মাসে আকাশ কালো হয়ে থাকুক কিংবা সূর্যদেব অবিরাম রক্তচক্ষু বর্ষণ করুক না কেন এর মধ্যেই ভীষণভাবে চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকি ডুয়ার্সের বিশুদ্ধ বাতাস থেকে জোর করে শিউলি শিউলি ঘ্রাণটা টেনে নেওয়ার।
বেশ কয়েক বছর ডুয়ার্সে থাকার ফলে শরতের প্রথম মাসটিতে ডুয়ার্সের রূপের সাথে উত্তরের অন্যান্য জায়গাগুলির কোথায় যেন একটু পার্থক্য চোখে পড়ে। যদিও সব ঋতুতেই ডুয়ার্স অনন্যা। তাই তো ডুয়ার্সকে ঘিরে থাকা ভুটান পাহাড় ভাদ্রের বাদল দিনে মৌন ঋষির মত কালো মেঘের চাদর গায়ে জড়িয়ে গুরুগম্ভীরভাবে চেয়ে থাকে দূরে সবুজ বনানীর দিকে আবার প্রচণ্ড রৌদ্রজ্জ্বল দিনে চঞ্চলা বালিকার মত সবুজ আবীর গায়ে মেখে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। ভাদ্রের বাতাসে কান পাতলে শোনা যায় ডুয়ার্সের ঝোরা ও নদীদের গান। প্রথম শরত থেকেই এখানে দেখা যায় এক স্বর্গীয় দৃশ্য। কাশবনে ছেয়ে যাওয়া ঝোরা আর নদীদের বিস্তীর্ণ চর। যত দূর চোখ যায় শুধুই কাশবনের স্বচ্ছন্দ সংসার।
প্রথম শরতেও একটি কুঁড়ি দুটি পাতার সাম্রাজ্য সুন্দরী ডুয়ার্স শ্রাবণী বৃষ্টির জলে পূর্ণযৌবনা। চোখ জুড়ানো সবুজের সমারোহের চাবাগানগুলিতে আছেন ঝাড়খণ্ড, ছোটনাগপুর, ছত্তিসগড় অঞ্চলের আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষেরা। যারা ইংরেজ আমলে চাবাগানে শ্রমিকের কাজ করতে এসে সমস্ত ডুয়ার্সকেই ভীষণ আপন করে নিয়েছেন। তাদের সরল মন আর অমায়িক ব্যবহার ও কঠোর জীবন সংগ্রাম দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায়না। কর্মবীর এই আদিবাসী সম্প্রদায় আজ থেকে প্রায় দেড়শ দুশো বছর আগে যখন ডুয়ার্সে চলে আসেন তখন সাথে নিয়ে আসেন তাদের কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও পূজাপার্বণকে। এই ভাদ্র মাসেরই শুক্লা একাদশীর দিন অনুষ্ঠিত হয় আদিবাসী সমাজের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পরব করম পূজা। এই দিনটি অত্যন্ত ভক্তি ও শ্রদ্ধার সঙ্গে পালন করা হয়। করম গাছ ও নানা ধরনের ফসলের চারাগাছ এই পূজায় পূজিত হয়। ডুয়ার্সে করমচা গাছকে করম ঠাকুর হিসাবে পূজা করা হয়।
তো যেটা বলছিলাম, ভাদ্রমাসেও কি অপরূপ শোভায় সজ্জিত ডুয়ার্স তা ডুয়ার্সের প্রকৃতির মাঝে না থেকে বোঝা যায় না। মাথার ওপর বিশাল আকাশ, ঘর হতে দু'পা ফেললেই নিবিড় অরণ্যের হাতছানি। বিচিত্র হাটবাজার, পূজাপার্বণ, রূপবতী প্রকৃতি, সহজ সরল মানুষ জন নিয়েই হৃদয়ে এক অনাস্বাদিত ভাললাগায় ভরে থাকে সবুজ ডুয়ার্স। কি ঝরঝর বাদল দিনে, কি প্রসন্ন শরতে, কি কুয়াশামাখা শীতে প্রতিদিনের দেখা রূপসী ডুয়ার্স নিত্য নতুন রূপের পসরা সাজিয়ে আমার সামনে হাজির হয়।
নীরার অভিসার আজ চাঁদ জোছনা নক্ষত্র ছুঁয়ে .....
রুনা দত্ত
নীরা আজও ডায়েরি খুলে বসেছে ভাবছে----
লিখবে ভালোবাসার এক অদম্য আরব্য রজনী। যেখানে আদম ও ইভ সারাজীবন নিবিড় আশ্লেষে একে অপরকে ভালোবেসে চলে , যেখানে শ্লীলতা অশ্লীলতার কোন সীমারেখা থাকেনা । থাকে শুধু সঙ্গমরত নারী পুরুষের এক অপূর্ব শিল্পসুষমার কাব্যরূপ ......
ঝুরো ঝুরো চাঁদ বৃষ্টির মতো নেমে আসে
ভিজিয়ে দেয় শৈল্পিক নারী পুরুষের
সমস্ত গোপন গ্রন্থি
মহুয়া আফিমের মাদকতায়
নারীর ঠোঁট চিবুক স্তনবৃন্ত নাভি ছুঁয়ে
শঙ্খশুভ্র উরুতে জমা হয়
পুরুষের ভালোবাসার স্বেদবিন্দু
দেহজ উষ্ণতায় মিশে যেতে যেতে
গোপন হলুদ গভীরে ছড়িয়ে পড়ে
ভালোবাসার জাফরানি সুঘ্রাণ ।
নীরা দেখে তার অজান্তেই কখন কবিতার ক্যানভাসে ফুটে উঠেছে নারী পুরুষের সঙ্গমের এক অপূর্ব কাব্যরূপ যেখানে দেহজ ভালোবাসার সীমা ছাড়িয়ে অসীমে বিলীন হয়ে গিয়েছে দুই আজন্ম প্রেমিক -প্রেমিকা।
নীরা ধীর পায়ে উঠে দাঁড়ায় , বাইরে বেড়িয়ে আসে , আস্তে আস্তে সব বাঁধন থেকে মুক্ত করে নিজেকে । সবুজ গালিচার বিছানায় এলিয়ে দেয় ভালোবাসবে বলে উন্মুখ হয়ে ওঠা এক নারীকে । অভিসারিকার মতো জুঁই বেলি ফুলের ঘ্রাণ মেখে হারিয়ে যেতে থাকে গভীর থেকে গভীরে ....
নক্ষত্রের আলোয় ভেসে যেতে থাকে নারী থেকে মানবীতে রূপান্তরিত হয়ে ওঠা এক নগ্ন অবয়ব
প্রবন্ধ
ভারতের সভ্য সমাজে এই সময়ে শুধু ভেজালের সমাহার
বটু কৃষ্ণ হালদার
মানব জীবনে মৌলিক চাহিদাগুলোর মধ্যে( খাদ্য বস্ত্র বাসস্থান শিক্ষা স্বাস্থ্য) খাদ্য একটি প্রধান ও মৌলিক চাহিদা ।জীবনধারণের জন্য খাদ্যের কোন বিকল্প নেই। সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রতিটি মানুষের প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাদ্য। বিশুদ্ধ খাদ্য সুস্থ ও সমৃদ্ধ শীল জাতি গঠনে একান্ত অপরিহার্য। শারীরিক ও মানসিক বিকাশে একমাত্র অবলম্বন হল বিশুদ্ধ খাদ্য। কিন্তু বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় বিশুদ্ধ খাবার প্রাপ্তি কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে ।চারিদিকে আজ ভেজালের সমাহার। কিছু মুষ্টিমেয় বিবেকহীন মুখোশধারী পাষণ্ড ব্যবসায়ী আড়তদার বেশি মুনাফা লাভের আশায় প্রতিনিয়ত মানব জীবনের দৈনন্দিন চাহিদা( চাল,ডাল,শাকসবজি দুধ, ঘি, মাখন, ছানা ,ফলমূল, মিষ্টি) গুলিতে বিষক্রিয়া মিশিয়ে বাজারে বিক্রি করছে। প্রশ্ন যারা এমন অমানবিক কর্মকাণ্ড করছে তারা কিংবা তাদের পরিবার কি এই নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য গুলি ব্যবহার করেন না?তবে এটা নিশ্চিত যারা, এমন কর্ম করছে তারা জেনেশুনেই নিজেদের কফিনের গর্ত নিজেরাই খুলছেন।জেনে শুনে এমন কর্ম যারা করছেন তারা নিজেরাই ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাসে ঠকে যান এবং প্রতিনিয়ত ঠকিয়ে যাচ্ছে সমাজকে।
১৯৯৪ সালে "environment protection agency"র প্রতিবেদন প্রকাশ পায়। সেখানে এক ভয়ঙ্কর তথ্য উঠে আসে, ফরমালিন ফুসফুস ও গলবিল এলাকায় ক্যান্সার সৃষ্টি করতে সাহায্য করে।২০০৪ সালের ১লা অক্টোবর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে গলবিল এলাকায় ক্যান্সার সৃষ্টির জন্য ফরমালিন কে দায়ী করেন। টেক্সটাইল কালার গুলো খাদ্য এবং পানীয় সঙ্গে মিশে শরীরে প্রবেশের পর ধীরে ধীরে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সঙ্গে ক্রিয়া বিক্রিয়া শুরু করে। অথচ এই সমস্ত মারণ কীটনাশক গুলি প্রয়োগ করা হয় সমস্ত সুষম আহার গুলিতে।এতে সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় আমাদের শরীরের লিভার, কিডনি,হৃদপিন্ড ,অস্থিমজ্জা গুলি। বাচ্চা শিশু ও বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে এর প্রভাব দ্রুত কার্যকারী হয় এবং তরুন তরুন দের ক্ষেত্রে কিছুটা দেরিতে ।
বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় ভেজাল খাদ্য একটি মরণ ব্যাধি হিসেবে দাঁড়িয়েছে। ভেজাল ভেজাল দ্বন্দ্বে ঝালাপালা কান। কিন্তু এখন প্রশ্ন হলো কারা ভেজাল দিচ্ছে আর কাদের প্রাণহানি ঘটছে?বর্তমানে বিভিন্ন সংবাদপত্রে দূরদর্শনের শিরোনামে শুরুতেই একটা সংবাদ বারবার জনতার দরবারে মাথা যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে তা হল ভেজাল কান্ড। বেশ কয়েক মাস আগে সুন্দরবনের বাসন্তী নামক স্থানে ভেজাল নিয়ে এক চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ্যে আসে। ছানার সঙ্গে প্লাস্টিক মিশিয়ে বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে। আবার এই কয়েকদিন আগে জীবন দায়ী ঔষধে ভেজাল ধরা পড়েছে এ খবর প্রকাশ্যে আসতে চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। কিছু স্বার্থান্বেষী, নির্বোধ, সমাজের নিয়ম লংঘন করে প্রশাসনকে রক্তচক্ষু দেখিয়ে প্রতিনিয়ত জনমানব কে ঠকিয়ে যাওয়ার প্রয়াস করে চলেছে নিরন্তর। আরে সমস্ত জেনেশুনেও প্রশাসন কেন নির্বিকার? এর উত্তর আজও অধরা। তবে কি এটা ধরে নিতে হবে যে সর্ষের মধ্যে ভূত লুকিয়ে আছে? কি হবে আগামী দিনের ভবিষ্যৎ?
ভেজাল খাদ্য মানে মানব শরীরে ধীরে ধীরে বিষ প্রবেশ করছে। এইভাবে অবাধ ভেজাল কারবার চলতে থাকলে হয়তো আগামী ৫০ বছরের মধ্যে সাধারণ মানব পরিণত হবে পঙ্গুতে বা মানসিক রোগী। দিনে দিনে হাসপাতালে ও ক্লিনিকগুলোতে লম্বা রোগীদের লাইন বেড়ে চলেছে। যে সময়ে সমাজ ব্যবস্থায় সুসভ্যতার বিকাশ ক্ষেত্র গড়ে ওঠেনি, ছিল না আধুনিকতার ছোঁয়া, সেই সমাজ ব্যবস্থায় মানুষজন শাকসবজি গাছের ফলমূল খেয়ে ও সুস্থ স্বাভাবিক ছিলেন এবং সুস্বাস্থ্যের অধিকারী সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন। বেঁচে থাকতেন বহু বছর সুস্থ স্বাভাবিক ভাবেই। এখন মৃত্যু শীয়রে দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রতি মুহূর্তে । দিনে দিনে বেড়ে চলেছে বিকলাঙ্গ শিশুদের সংখ্যা। প্রশ্ন কিন্তু কেন?এর জন্য দায়ী কি আমরা ভেজাল খাদ্য বস্তু কি করতে পারি না? মহিলাদের সন্তান সম্ভবা হওয়াটা এখন প্রতিবন্ধকতায় দাঁড়িয়েছে। সন্তানের জন্ম দিতে সাহায্য নিতে হচ্ছে ক্লিনিকের। প্রকৃতির আশ্চর্যতম বরদান গুলো আস্তে আস্তে বিলুপ্ত হতে চলেছে। জনসমাজ কৃত্রিম ব্যবস্থার প্রতি নির্ভর হয়ে পড়ছে।এই ভেজাল খাদ্য গুলো থেকে সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলো সন্তানসম্ভবা মহিলা ও গর্ভের ভ্রূণ টি। এমনি ভাবে চলতে থাকলে একদিন থমকে যাবে উন্নত বিকাশের ধারা । পৃথিবী পরিণত হবে বন্ধ্যা তে।আগামীতে আমরা চরম ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে চলেছি এমনই বার্তা গুঞ্জরিত।তার উপর অধিক লাভের আশায় যে সমস্ত বিষ ক্রিয়া ব্যবহার করা হচ্ছে তাতে দূষিত হচ্ছে মাটি জলবায়ু। আমরা ধীরে ধীরে সামাজিক ও মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়ছি। পৃথিবীর মানুষ অল্প বয়স থেকে সমস্যার শিকার গ্রস্ত হয়ে পড়ছে মাথার চুল পেকে যাচ্ছে, মৃত্যুর হার দিন দিন বেড়েই চলেছে,এ কথা কি কেউ অস্বীকার করতে পারবেন? বন্ধ হোক এমন মরন খেলা। আসুন আমরা সবাই মিলে এই পৃথিবী কে বাসযোগ্য গড়ে তোলার অঙ্গীকারে আবদ্ধ হই।যত দ্রুত সম্ভব এই বিষয়টিকে নিয়ে সরকার ও প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য অনুরোধ করছি তা না হলে এ পৃথিবী একদিন অনুর্বর ও মরুভূমিতে পরিণত হবে।
গল্প
রূপান্তর
ইন্দ্রাণী সমাদ্দার
পলি বলে - এই জানিস এখন রানা, দেবস্মিতা আর দেবমাল্য মুভি দেখতে যাচ্ছে। মোবাইল থেকে মুখ সরিয়ে মৌ জানায়, সে জানে সে কথা। তাকেও বলেছিল যাওয়ার জন্য কিন্তু সে যেতে চায়নি। তারচেয়ে বাড়ি গিয়ে প্রচন্ড গরমের অলস দুপুরে ঘুমোনোই শ্রেয়। এসি মেট্রোয় বসেও মৌ মানে মৌমিতা দাসের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। সামনে দাঁড়িয়ে ছোট্ট বেলার বন্ধু পলি, যাকে কোনো কথা না বললে পেটের ভাত হজম হয় না কিন্তু কী অনায়সে আজ সে মিথ্যে কথা বলে ফেলল। কেন যে বলল ? এখন সেটাই সে ভাবছে। শুধু সে কথা কেন ! মনের মধ্যে হাজারো কথা কিলবিল করছে। দেবমাল্যর সঙ্গে সকালেও কথা হয়েছে কিন্তু সে একবারের জন্যেও মৌ কে বলেনি মুভি যাবার কথা। দেবমাল্যর সঙ্গে পরিচয় টিউশন ক্লাসে। তখন দেবমাল্য আর জয়িতা সাইকেল চালিয়ে এক সঙ্গে আসত। জয়িতা ও দেবমাল্য ছিল প্রাণের বন্ধু। পড়া শেষ হলেই দুজনে দুজনের সাইকেল নিয়ে বেড়িয়ে পড়ত। পলি আর মৌ হাঁটতে হাঁটতে বাড়িতে যেত। তখনও মৌ সাইকেল চালাতে শেখেনি। রাস্তায় যেতে যেতে কোনদিন দেখত গাছের পাশে দুটো সাইকেল রাখা। আসে পাশে কেউ নেই কিন্তু দূর থেকে পরিচিত গলার হাসির আওয়াজ ভেসে আসছে। মৌয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব গভীর হতে সময় লাগেনি। পলি বার -বার বলেছিল “ছেলেটা সুবিধের নয় ” কিন্তু দেবমাল্যর নেশায় মৌ পাগল হয়ে গেছিল। হঠাৎ জয়িতা টিউশনে আসা বন্ধ করে দেয়।
দেবমাল্যর কাছে মৌ বেশ কয়েকবার জানতে চেয়েছিল জয়িতা কেন আসছে না। দেবমাল্য প্রত্যেকবার দায়সারা উত্তর দিয়েছিল। মৌয়ের চোখে তখন ভালোবাসার চশমা। জয়িতা অন্য স্কুলে পড়ত। আসতে আসতে মৌ ভুলে যায় জয়িতাকে। দেখতে দেখতে কলেজের শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছেয়। মৌয়ের আজকাল মনে হয় এবছর নবীন -বরণের পর থেকে তাঁদের প্রেম যেন একটু একটু করে ম্লান হচ্ছে। আজ মুভির গল্প শুনে সে বুঝতেই পারছে আসতে আসতে দেবমাল্য তাঁর জীবন থেকে মুছে যাবে। কিন্তু সে কিছুতেই তা হতে দেবে না। সেই ছোট্ট বেলার থেকেই যা চেয়েছে তাই পেয়েছে এমনটা নয় । তবে যা চায় সেটা আদায় করে নিয়েছে। যতক্ষন না আদায় করতে পারত মাথার ভিতর যেন একটা গুবরে পোকা কিলবিল করত। এই কদিন তাঁর পড়াশুনো মাথায় উঠেছে। সারা ক্ষন ফেসবুক খুলে দেখে দেবমাল্য কাকে লাইক দিচ্ছে। দেবপ্রিয়া কে পোষ্টে কি মন্তব্য করছে দেবমাল্য। সব সময় মনে হচ্ছে ওরা দুজনে ঘুরে বেড়াচ্ছে,আনন্দ করছে আর সে প্রতারিত হচ্ছে।
মৌয়ের চার কাকা। বড় জেঠু স্কুলের শিক্ষক, মেজ হচ্ছেন মৌয়ের বাবা, মৌয়ের সেজকাকা বিজ্ঞানী আর ছোটকাকা বহুবছর হল বিদেশে থাকেন। বাড়ির তিনতলায় সেজকাকার ল্যাবোরেটা রি । সংসারের কোন বিষয় বা বৈষয়িক কোন বিষয়ে তাঁর কোনো মাথা ব্যাথা নেই। বিয়েথা করেননি। চাকরি বাকরিও করেন না। একতলার বাড়ি ভাড়া আর ঠাকুমার পেনশন সমস্ত দিয়ে তাঁর বৈজ্ঞানিক গবেষণা চলে। দাদু থাকতে ল্যাবরেটারি করে দিয়েছিলেন। বাবাও জেঠু বলেন “নেই কাজতো খই ভাজ”। এই সব কথা শুনে সেজকা অম্লান বদনে বলেন – "একদিন দেখবে আমার গবেষনার সুখ্যাতি দিকবিদিক ছড়িয়ে পড়বে"। জেঠু সস্নেহে হেসে বলেন “তাই তো চাই”। ল্যাবরটারিতে বিশাল কর্মযজ্ঞ চলে। কত্ত রকম যন্ত্র-পাতি,গাছ -গাছালি, জীব জন্তু আছে –এই আলোআঁধারি ঘর গুলোতে। জ্ঞাণ হবার পর থেকে এখানে আসে বলে ভয় লাগে না । অন্য সময় সে কৌতূহলবশত আসত কিন্তু আজ সে উদ্দ্যেশ্য নিয়েই এসেছে। এখনে নানা রকম অলৌকিক যন্ত্রপাতি আছে । যদিও সেজকার মতে সবই বৈজ্ঞাণিক তথ্য নির্ভর। সেই ছোট্ট বেলার থেকে দেখে দেখে সেও খানিক জানে । তবে কখনো কাজে আসবে ভাবেনি। আজ সে সেজকাকে বলে- “ তোমার কম্পউটারে বসে ,আমিও একটু বিজ্ঞান সাধণা করি” শুনে সেজকা খুব খুশি হয়ে বলেন “ নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই একজীবনে আমি কী আর এত কাজ শেষ করে যেতে পারব। তুই শেষ করবি আমার অসমাপ্ত কাজ। ” মৌ জানে ল্যাবরটারিতে কোথায় রিমোটের মত দেখতে অতি ক্ষুদ্র যন্ত্র থাকে। যার ভিতরে আছে মেমারিচিপ। প্রোগ্রাম সেট করে সেই পোগ্রাম মেমারি চিপে ট্রান্সফার করতে হবে। কাজ করতে করতে আজ হঠাৎ তাঁর মনে হয় জয়িতা কর্পুরের মত কেন যে মিলিয়ে গেল । কলেজে কত পুরনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হল কিন্তু জয়িতার সঙ্গে আর কখনো দেখাই হল না। মেমারি স্লটের কাজ শেষ করে সব কিছু সেভ করে । পাশের ঘরে সেজকার টাইমেশিনের চেয়ারের দিকে এগোয় । তার আগে রিমোট ক্লিক করে সেজকার টাইম মেশিনের চেয়ারে বসে। দেখতে পায় দেবমাল্য আর জয়িতা সেই স্কুল জীবনের মত হাসি মুখে সাইকেল চালাচ্ছে / কিছুদিন পর হাসি নেই, কথা কাটাকাটি হচ্ছে / জয়িতার চোখে জল, সে চিৎকার করছে আর বলছে “তোকে ছাড়া বাঁচবো না ”/দেবমাল্য বোঝাচ্ছে -“মন খারাপ করিস না । বেশীদিন কাউকে ভালো লাগে না। মৌ কেও লাগবে না।”।/ সাইকেল নিয়ে দুজনে চলেছে । বাদিকে দেবমাল্য ডান দিকে জয়িতা / একটা লরি ছুটে আসছে দেবমাল্য জয়িতা কে ধাক্কা মারল/ জয়িতার রক্তমাখা শরীর মাটিতে, একি পাশ কাটিয়ে দেবমাল্য এগিয়ে যাচ্ছে / একটা বাড়ির সামনে জয়িতার দেহ রাখা। এক ভদ্রমহিলা কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে গেলেন। টাইম মেশিনে বর্তমানে ফিরে এসে মৌ রিমোটে ক্লিক করে। নিজের ওপর আজ বড্ড রাগ হচ্ছে মৌএর। একটা মানুষ চিরতরে চলে গেল । সে চাইলে কী একটু খোঁজ করতে পারতো না যে কেন জয়িতা আসছে না? আর কাকে ভালোবাসল সে! একটা ঘৃণ্য মানুষ কে সে ভালোবেসেছে। যে একজন নিরীহ মেয়ের হত্যাকারী। এই সব ভাবতে ভাবতে ল্যাবরোটারির মুখের সামনে সেজকার সঙ্গে দেখা। সেজকা হেসে বলেন, ”হল তোর বিজ্ঞান সাধনা”। মৌ মাথা নাড়ায়। নিজের ঘরে এসে মৌ মোবাইলে কন্টাক্ট লিস্টে দেখে জয়িতার স্কুলের কেউ আছে কিনা। খুঁজে খুঁজে একমাত্র পায় সুস্মিতাকে। সুস্মিতার সঙ্গে কলেজে আলাপ। জয়িতার স্কুলে পড়েছে জেনেও কেন যে জয়িতার কথা জিজ্ঞাসা করল না! তবে সে লক্ষ্য করেছে দেবমাল্য সুস্মিতার থেকে একটু দূরত্ব রাখে। মৌ সুস্মিতার নাম্বার ডায়েল করে। ওপাশে সুস্মিতার গলা শোনা যায়। কিছুক্ষন এমনি আলাপচারিতার পর মৌ জানতে চায় জয়িতার কথা। সুস্মিতা জানায় বহুদিন আগে লরি অ্যাক্সিডেন্ডে জয়িতা মারা গেছে। সেই ঘটনার পর থেকে তার মা বাক -শক্তি হারিয়ে শয্যাশায়ী । ফোন রেখে সে ভাবে জয়িতার মৃতূর জন্য যে দায়ী তাকে এত সহজে ছেড়ে দেওয়া ঠিক হবে না। এরপর ফোন করে দেবমাল্য কে আগামীকাল খানিকটা যেচেই মৌ দেখা করতে বলে এক রেস্টুরেন্টে ।
সময়ের কিছু আগেই পূর্ব নির্ধারিত রেস্টুরেন্টে পৌঁছে যায় মৌ। কিছুক্ষণ পরে আসে দেবমাল্য । খাবার অর্ডার দিয়ে সে যায় ওয়াশ রুমে। সেখান থেকেই ফোন করে দেবস্মিতা কে। জানায় হঠাৎ বাড়িতে কিছু আত্মিয় চলে আসায় আজ তাঁদের দেখা করা হবে না। ওয়াশ রুম থেকে দেবমাল্য কে ফিরতে দেখে ব্যাগ থেকে মৌ রিমোট বার করে ক্লিক করে। হঠাৎ টেবিলের দিকে এগোতে গিয়ে দেবমাল্যর হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যায় । শরীরে ভিতর থেকে যেন কাঁপুনি দিতে থাকে । গলা শুকিয়ে আসতে থাকে। কাকে দেখছে সে ? কোথায় গেল মৌ ? মৌ বসেছিল ? সেখনে এখন দুই বেনুনি ঝুলিয়ে বসে আছে কিশোরী জয়িতা । মৌ এর কথায় সম্বিত ফিরে পায়। মৌ জানতে চায় কি হয়েছে দেবমাল্যর ? দেবমাল্য জানায় সেরকম কিছুই হয়নি তার একটু মাথা ঘুরে গেছিল। চেয়ারে বসে কথা বলতে বলতে খাবার চলে আসে । দেবমাল্য চুপচাপ খেতে থাকে। মৌ ওড়নার আড়ালে লুকিয়ে থাকা রিমোটের সাহায্যে থট রিডিং এ জানতে পারে সামনের জনের মনের কথা। সে আবার রিমোট ক্লিক করে । খেতে খেতে মৌ এর দিকে তাকিয়ে সে অবাক। কোথায় মৌ ! সামনে বসে দেবস্মিতা । অদ্ভুত গলার টোনে দেবস্মিতা বলে ওঠে “ কি গো বাড়িতে নাকি অনেক লোক ?”। ভয়ে দেবমাল্য দিক বিদিক শূন্য হয়ে ছুটতে থাকে ।
পেছনে মনে হচ্ছে কারা যেন ছুটছে। কে ছুটছে? জয়িতা নাকি মৌ নাকি দেবস্মিতা ? কোন দিকে যে দেবমাল্য যাচ্ছে সে নিজেই জানে না । আর ছুটতেও পাচ্ছে না । হঠাৎ দেখে একটা লরি ছুটে এল। একটা হাত এগিয়ে আসছে লরির ভিতর থেকে। চেনা গলার ডাক। জয়িতা ডাকছে-“চল আমরা আবার আগের মত সাইকেল চালাবো।” দেবমাল্য উঠে পড়ল লরিতে। লরির জানলা দিয়ে সে দেখে রক্তে মাখমাখি হয়ে তাঁর দেহ মাটিতে পরে আছে।
বিষ্ণু বাবুর অভিজ্ঞতা
সুশান্ত পাল
একটা ওজ-পাড়া গায়ের মাঝ দিয়ে রেল লাইন সমান্তরালে চলে গেছে বহুদূর |যেন পাড়াটাকে দুভাগ করে চিরে দিয়েছে দু টুকরো লৌহপিণ্ড |সারবাঁধা সুপারি গাছ গুলো ট্রেন যাত্রীদের সঙ্গে ছুটে চলে অবিরত |প্লাটফর্মহীন ছোট্ট একটা স্টেশন অদূরে দাঁড়িয়ে একাকিত্ব পালন করে চলেছে |গ্রামের উকিল বিষ্ণু বাবুর এই নিঝুম জায়গাটা ভীষণ প্রিয় |ভদ্রলোক কলকাতাতে দীর্ঘদিন ছিলেন বলেই হয়তো এইভাব |স্ত্রী মারা গেছে তা বহুদিন, ঠিক মতো মুখটাও মনে পরে না আর |একমাত্র ছেলে এখন ইংল্যান্ড এর সাসাক্স অঞ্চলে বড়ো চাকরি করে |বছরে একবার এসে দিন সাতেক থেকে যায় |ভদ্র লোক একাই থাকেন সঙ্গে তার পুরোনো চাকর কনক বাড়ির কাজ কর্ম দেখা শোনা করে |বিষ্ণু বাবু রোজ বিকেলটা ওই স্টেশনেই নির্জনতা উপভোগ করেন |যাত্রীদের ভিড় তখন একটুও থাকে না |কারণ বিকেল চার টায় শেষ ট্রেন বেরিয়ে যায় |তারপর শান্তি শুধু শান্তি, সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নয় টায় তিনি বাড়ি গিয়ে রাতের রুটি খেয়ে একটা গল্প বই নিয়ে শুয়ে পড়েন |কত বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছে তার এই দুবছরে |
একবারতো একটা পাগল প্রায় কামড়ে দিতো, অন্ধকারে পাগলের মুখে পানের পিক পরে যাওয়ায় পাগল খেপে তারা করেছে একটুর জন্য রক্ষা সেবারের মতো |আর একবার নিজের লাঠি মনে করে একটা হাত দুয়েক কিসের হার তুলে নিয়ে চলে এসেছেন |এর অবশ্য কারণ আছে ভদ্রলোক টর্চ ব্যবহার করেন নাহ, এতেনাকি চোখের ক্ষমতা কমে যায় | যাইহোক এভাবে বেশ নিরুপদ্রবে কেটে যাচ্ছিল তার অবসর দিন গুলো |
পুজোর পর সেবার খুব ঠান্ডা পড়ছিলো, তাই স্বভাবত তিনি চাদর টুপি পরে বেড়িয়েছেন |বাতাসে শীতের আমেজ, শো শো করে বাতাস বইছে, চারিদিকে নিস্তব্ধ জমাট বাধা অন্ধকার |সেদিন বেরোতে একটু দেরি হয়েছিল তার |অবশেসে দশ মিনিট হাঁটার পর তিনি পৌঁছলেন কিন্তু একটা আশ্চর্য ঘটনায় তিনি থমকে দাঁড়ালেন, সিমেন্টের ব্রেঞ্চিতে তার বয়সী কে যেন বসে আছে |এতে অবশ্য অবাক হওয়ার কিছু নেই হয়তো কেউ শেষ ট্রেন ধরতে না পেরে কালকের সকালের ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছেন |বিষ্ণু বাবু গুরুত্ব না দিয়ে একটু অসন্তুষ্ট হয়ে বেজার মুখে একটা চুরুট ধরিয়ে বেঞ্চের দিকে এগোলেন |এগিয়ে সামনে গিয়ে চমকে উঠলেন যে লোকটা বসে আছে সে তার পরিচিত মুখ |অনেক দিন আগে কোথায় যেন দেখেছেন? ঠিক মনে পড়লো না তবে বেশ পরিচিত, এ মুখ তার অচেনা নয়|হটাৎ মুহূর্তের মধ্যে বিষ্ণু বাবুর সারা শরীর এ বিদ্যুৎ খেলে গেলো |এযে কুড়ি বছর আগের সেই বর্ধমান জেলার নামকরা খুনি, বীভৎস ভাবে পনেরো টির বেশি খুন করে শেষ পর্যন্ত বিষ্ণু বাবুর জেরায় ফাঁসির সাজা পান |তবে তাই যদি হয় এটা কী তবে?ভূত !কিন্তু ভুতের ভয় তার নেই, তাই সাহস নিয়ে বলেন তোমারতো ফাঁসি হয় তবে এখানে কী করছো?লোকটি কাপা কাপা গলায় বললো হ্যা হুজুর ফাঁসি হয়, কিন্তু শান্তি পাই নি |আপনিতো খুনের কারণ না জেনেই আমাকে জেরার উপর জেরা করে ফাঁসি কাঠে দিয়ে নাম কামালেন |কিন্তু আমি নাম কামালাম খুনি উপসর্গ নিয়ে |তাতে আমার কষ্ট নেই কিন্তু আপনার একটু ভুলের জন্য শেষ একজনকে খুন করতে পারলাম নাহ |মন্ত্র মুগ্ধের মতো শুনতে লাগলেন বিষ্ণু বাবু |প্রশ্ন করলেন কী এখনো তোমার সাধ মেটেনি,তুমি সত্যি পাপি |তোমার অনুশোচনা হয় নাহ !লোকটি বললেন শুনুন তবে |
আমার নাম হরিপদ চৌধুরী, বিখ্যাত জমিদার পরিবাবের ছেলে |কিন্তু ওসবে আমার মন ছিল না |আমার বয়স তখন পনেরো হবে তখন ঘর ছাড়ি, পরে ছদ্দবেশে বাড়িতে গিয়ে যা দেখলাম তাতে আমার মাথা ঘুরে গেলো |আমায় হারানোর শোকে মা তখন দেহ ত্যাগ করেছেন, বাবারও অবস্থা সংকীর্ণ |খুব কষ্ট পেলাম জানেন তবে আর ফিরলাম না |সেদিনেই শপথ নিলাম যে এমন কিছু করবো যাতে করে প্রায়শ্চিত্ত করতে পারি |শুরু করলাম তন্ত্র সাধনা, সেই ইতিহাস অনেক বড়ো তাই আর বলছি নাহ, তবে বিস্তর শক্তি অর্জন করলাম |কতো লোকের কঠিন অসুখ সাড়িয়েছি, কতো বীভৎস মানসিকতার আগাম পূর্বাভাস পেয়ে তাঁদের খুন করেছি, আজ অব্দি যাদের খুন করেছি সবাই ভয়ঙ্কর রকমের অপরাধী |কোনো মায়ের যেন কোল খালি না হয় তার জন্য আপ্রাণ সাধনা করেছি |সৎ কাজে লাগালে তন্ত্র মন্ত্র আরো জোরালো হয়, বিস্তর ক্ষমতা হলো আমার |
মন্ত্র মুগ্ধ হয়েও চাদরের ভিতরে ঘামে ভিজে বিষ্ণু বাবুর প্রায় চৈতন্য হারানোর দশা |শেষ টুকু যা মনে আছে তার সারমর্ম এই একদিন হরিপদ বাবু ধ্যানে বসে দেখলেন এক চাকর তার গৃহ মালকিনকে চুপে চুপে বিষ দিচ্ছে, এই কারণে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ছেন কয়েক দিন পর পর, কারণ তিনি মরলেই চাকরের চুরি করতে সুবিধা |শেষ পর্যন্ত এই স্টেশনেই নেমে সেই চাকরকে খুন করতে আসেন হরিপদ চৌধুরী |কিন্তু পুলিশের লোক এখানেই তাকে গ্রেপ্তার করে |ইচ্ছে করলে পালতে পারতেন কিন্তু তন্ত্রের অপব্যাবহার তিনি করেন নি |বাকিটা বিষ্ণু বাবু জানেন |
পরদিন সকালে অজ্ঞান অবস্থায় স্টেশনের পাশে বিষ্ণু বাবুকে পেয়ে হাসপাতাল নিয়ে যান স্টেশন মাস্টার |দুদিনের মধ্যেই সুস্থ হন তিনি, তবে পুলিশ এসে তাকে জানান কে বা করা? বিষ্ণু বাবুর চাকরকে খুন করেছে|হয়তো বিষ্ণু বাবুকে খুনের চেষ্টা হয় |বিষ্ণু বাবু অবশ্য বলেন সেদিন তার শরীর খারাপ ছিলো তাই অজ্ঞান হয়ে পড়েছেন, কেউ তাকে খুনের চেষ্টা করেন নি |একটা স্বস্তির নিঃশাস ছেড়ে মুচকি হাসেন |তবে সেই স্টেশনে আর বিষ্ণু বাবুর টিক্কির নাগাল পাওয়া যায় নি |
বাঁচার স্বাধীনতা
যুথিকা সাহা
প্রতিমা এই ই প্রতিমা কোথায় যে যায় ,এইযে ,ভর দুপুরে কোথায় গেছিলে শুনি ?মাথা নীচু করে বললে ,তুমি তো সবই জানো ---জানি মানে !!ঐ হারান কবরেজের কাচে ---হ্যাঁ তোমার সাহস তো দেখছি অনেক বেশী।কি দোষ হয়েচে------আমি বলেছি না কোন ওষুধ খাওয়া চলবেনা ,তো চলবেনা ।তা শোন, আমি আজ বড় মেয়ের বিঁয়ে পাকা করে ফেলেছি । কি কাইচো ?এতটুকুন মেয়ে সবে নেকাপড়া শিখচে---হু লেখাপড়া ওসব দিয়ে কি হবে শুনি ! মেয়ে মানুষের আবার লেখা.....বলি একখানা তো ছেলে জম্ম দিতে পারলেনা ঐ তিনখানাই মেয়ে বিঁয়োলে,এতেও আমার দোষ ? বড় বড় কথা বলবেনা ওসব মেয়ে মানুষের মুখে মানায়না বুঝলে,সংসারে হেঁসেল ঠেলা ,স্বামীর সেবা করা, সংসার আঁকড়ে বাঁচাই মেয়ে মানুষের কাজ ।আমি যা ভালো বুঝেছি করেছি ব্যাস।বড় মেয়ে সবে চোদ্দ আর মেজ দশ এর মধ্যে দু তিনটে পেটেই নষ্ট হয়েছে এখন যেটা সেটার বয়স দুই ,আবার যেন প্রতিমার শরীরের মধ্যে কেমন করে গা গোলায় বমি ভাব ।তাই নিয়েই সব কাজ করতে হয়।মনের কথা কাকে বলবে, কেইবা শুনবে !
মেয়ে দুটো ইস্কুলে গেছিলো,একটু বাদে এলো বললো মা কি হয়েছে ? বাবা বলল কিস্যু হয়নি কাল থেকে তোমাদের ইস্কুলে যাওয়া চলবেনা। সুধা বড় মেয়ে ,বললো তোর বে দেবো এই মাসেই ,ভালো পাত্র পেয়েছি ।ছেলের মা অসুস্থ তাই সংসারে একখানা মেয়েমানুষ চাই তাই ছেলের বে দেবে,হ্যাঁ ওরাই সব খরচা দিয়ে নিয়ে যাবে ,বড় ভরা সংসার ছেলে মন্দ নয় ,জমিজমা আছে অভাব নেই।
প্রতিমা বলল ,ছেলে কত বড় হবে সুধার চেয়ে ?
কত আর হবে বাড়ির বড় ছেলে এর আগে বে হয়েছিল সাত বছর , সে বৌ মারা গেছে ।
ওই পক্ষের একটা ছেলে আছে ,সে আবার হাঁটতে চলতে পারে না ,সমস্যা ওখানেই ,ওরা তাই ছেলের বে দেবে যাতে করে কোলে সুস্থ ছেলেপুলে হয় আর সংসার সামলায় ।
প্রতিমা ---কি কইচো দোজ বর !সে তো অনেক বয়েস ।
কেন তোমার বে হয়নি ,এই বয়সে? আর আমি মরদ কোন অংশে কম শুনি এখনো শরীর জোয়ান।তোমার ঘাটতি পড়েছে কিছুতে!ওসব দেখে লাভ নেই গাঁটের খরচ নেই কোনো এমন পাত্র হাতছাড়া করে কেউ ,আমার কিএমন রোজগার আছে,বলি মুখেতো বলছো তোমার বাপের ঘর থেকে কি পয়সাকড়ি দিয়ে সাহায্য করবে ?সে ক্ষমতাও তো নেই ,নেহাত আমি বলেই তোমাকে বিনা পয়সায় উদ্ধার করেছিলাম। বাপের ঘরের ভাঁড়েতো কানাকড়িও ছিলোনা।তা বলি খালি হাতে কোন রাজপুত্তর তোমাকে এসে নিয়ে যেতো শুনি!!প্রতিমা --মুখে কোনো কথা নেই ,আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে ঘরের দিকে যেতেই --স্বোয়ামী বললো ,
আমি এখন বেরোবো কি আছে দাও দুটো মুখে দিয়ে যাই,পুরুত মশায়ের কাছে গিয়ে দিনক্ষন ঠিক করে আসতে হবে ।
রাতের বেলা মশারির নীচে দুই মেয়ে নিয়ে ঘুমোচ্ছে প্রতিমা,বিছানায় ক্লান্ত শরীরটা নিয়েই কোলের মেয়েকে বুকের দুধ দিচ্ছে ,প্রতিমারও কেমন চোখ লেগে গেছে ,বুকের একপাশের কাপড়খানা সরে গেছে ,পুরো যৌবন ফুটে উঠেছে বয়সতো বেশী নয় ,তাই শরীরের বাঁধনখানা হাজার কাজেও ঠিক আছে ,তা পুরুষ মানুষের চোখে পড়ে যায়।ওই দেখে
তার স্বোয়ামী তাকে টান মারলো বললো, মেয়েতো দুধ খেয়ে ঘুমিয়ে গেছে এবার আমার যে বড় খিদে এই জোয়ান শরীরে--প্রতিমা কাপড় খানা ঢাকা দিতে গেলেই ,আমার কাছে লজ্জা! ও ঢাকা দিয়ে কি লাভ ,এই বলে তাকে বুকে টেনে নিতেই ,প্রতিমা আজ ছেড়ে দাও না ,শরীরের মধ্যি কেমন করতিছে মনে হয় ---.কি আবার পোয়াতি !ভালো তো ,না না ছাড়ো, ছাড়বো কি বলছিস আমি জোয়ান মরদ আমার শরীরের খিদে মেটা আগে ,মেয়েমানুষ ঘরে এনেছি কেন ?আমি কি বাইরে যাবো শালী --এখন আমার সোহাগ ভালো লাগছেনা বুঝি ,দেখ আজ তোকে সোহাগ কেমন দেখাচ্ছি,প্রতিমার শরীরটা যেন নিংরে খেলো,প্রতিমার মুখ থেকে কেমন গোঁ গোঁ শব্দ,কেমন যেন শরীরটা অসার---–প্রতিমা মনে মনে ভাবতে লাগলো,কেন এই মেয়ে মানুষের ঘেন্নার জেবন রোজ রোজ শরীরের জ্বালা মেটানো,মেয়েমানুষ বলে কি সাধ আহ্লাদ থাকতি নেই !তার ইচ্ছে নেই ,শুধু অন্যের ইচ্ছেয় এই বেঁচে থাকা ,তার ইচ্ছে পূরন করা ,আমি কি একটু নিজের ইচ্ছেয় বাঁচতে পারি নে,তার অধিকার নেই ,চোখের জল ফেলতে ফেলতে কখন দুচোখের পাতা একহয়ে বুজে গেছে,তার নিজেরই অজান্তে।
দিভাই
অনুপ কুমার সরকার
মা ! মা ! ও মা .....
দুপুরে মায়ের কাছে স্পর্শ বায়না ধরেছিল, সে এগরোল খাবে । দুপুরে এগরোল কোথায় পাবে স্পর্শ এসব বোঝে না । কোনমতে ভুলিয়ে ভালিয়ে রাজী করানো হয় রাত্রে এগরোল নিয়ে আসা হবে । বাড়িতে যে এগরোল বানানোর আয়োজন করা কতখানি ঝামেলার কাজ সে সম্বন্ধে তার কোনো ধারনাই নাই । ভাত খাওয়ার জন্য মা ডাকছে জেনেও , স্পর্শ বলছে দেখো তো মা অংকের উত্তরটা মিলছে না কেন ? ওরা দুই ভাই । বড়ো জনের নাম সৌম্য আর স্পর্শ ক্লাস টু । শহর থেকে ভিতরে 20-25 মিনিটের ( বাসে ) পথ হলেও মাঝে মাঝে জ্যামের কারনে মিনিট পঁয়তাল্লিশ লেগে যায় । স্পর্শের মা অংক বিষয়ের একজন গৃহ শিক্ষিকা হলেও নিজের বাসাতেও পড়ান । তবে নিচু ক্লাসের ছাত্র পড়ান না তিনি । শহরে পড়াতে গেলে তবেই কিছু টাকা চোখে পড়ে এবং ঠিক টাইম মতো টাকা পাওয়া যায় ।বাসা ভাড়া দিয়েও থাকা খাওয়া দিব্যি স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে চলে যায় ।
মিতিনের সাথে সুমনা ( স্পর্শের মা ) দিদির পরিচয় হওয়া সদ্য মাস দুয়েক হয়েছে । তাও আবার বর্তমানের সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় সোস্যাল জগত ফেসবুকে । পরিচয়টা ফেসবুকে হলেও সম্পর্কের পরিসর যথেষ্ট মূল্যবান । মিতিন যেহেতু বই পড়তে ভালোবাসে সেই সূত্র ধরেই পরিচয় ঘটে । নিজের কোনো দিদি না থাকায় সুমনাকে নিজের দিদির মতোই সম্মান করে ও ভালোবাসে । বয়স সবে চল্লিশ পেরোলে কী হবে, তার কাছে বয়সটা যে একটা সংখ্যা মাত্র তাকে দেখলেই যেকোন বিচক্ষণ ব্যক্তি অনুধাবন করতে পারবে । মিতিন ভালোবাসার ছলে সুমনাকে সংক্ষেপে দিভাই আবার মাঝে মাঝে দিদিভাই বলে । দিভাই খুব একটা সাধারণ মানুষ হলেও, স্বাধীনভাবে স্বচ্ছল জীবন কাটাতে ভালোবাসে । কোনোরকম বাধ্যবাধকতা বা নিয়মকানুনের তোয়াক্কা করে না । কতখানি ব্যক্তিস্বাধীন তা তার ড্রেস পোষাক দেখলেই বোঝা যায় । বেশিরভাগ সময়ই জিন্স আর ফুলহাতা শার্ট পরতে ভালোবাসে । আর সর্বদাই ছোট ছোট চুল দিভাইকে ভিন্ন মাত্রা দেয় ।
সুমনা দিদি পরিশ্রমকে ভয় পায় না । হাসিমুখে যে কোন কাজ হাসিল করে ফেলে । তবে তার হাসিখুশি ভর্তি মুখটার অন্তরালে আছে একটা সংগ্রামী জীবনের বীরাঙ্গনা চরিত্র । দিভাই কবেই জীবনের গতিপথের খেই হারিয়ে ফেলেছে সেসব বোঝা যায় না । সেলাই করা হাটুতে সেলাইয়ের দাগ এক সময়ে মিটে গেলেও হৃদয়ের মনিটরে লিপিবদ্ধ হয়ে থেকে যায় চিরকাল । বাপের বাড়ির অবস্থা সাদামাটা মধ্যবিত্ত হলেও, শ্বশুর বাড়ির অবস্থা বিরাট আভিজাত্য পরিপূর্ণ । দিভাই নিজের জীবনের অভ্যন্তরীণ মৃত স্বপ্ন গুলোকে দুই ছেলের মাধ্যমেই প্রকাশ করতে চায় । সুমনা দিদির কাছে সৌম্য ও স্পর্শ আলাদা আলাদা দুটো সম্পদ । নিজে অংকের জাহাজ হতে পারেনি ঠিকই তবে সৌম্যকে অংকের লঞ্চ নয়, অংকের জাহাজই তৈরী করতে চায় । বিষাদ বিধুর জীবনে সুমনা দিভাই রোজ স্বপ্ন দেখে সংগ্রামশীল লড়াইয়ের শেষ মাইলফলক ছুয়ে দেখার স্বাদ গ্রহণ করবেই । একাকীত্বের লড়াইয়ে এখনও জয়ী না হলেও, সংগ্রামী জীবনের ঠেলাগাড়িতে এখন ।
মিতিন প্রায়ই সন্ধ্যার দিকে ফোন করে, যখন সুমনা দিভাই শহর থেকে টিউশনি করে বাসায় ফেরে । নিত্যদিনের ব্যস্ত মুখর জীবনে দিভাই মনের মতো করে নিজেকে নিয়ে খুব একটা ভাবার সময় পায় না । ঐ যখন রিক্সা বা বাসে তখনই একটু আধটু সময় । ঠিক তখনই একটু একটু করে পড়তে পড়তে কত গল্প আর উপন্যাস শেষ করে ফেলেছে সে নিজেও জানে না । মোবাইলে পিডিএফ ফাইল তো, তাই সুযোগ পেলেই সময় নষ্ট করে না । এসবের মাঝে নিজের জীবনই যে কবে একটা আস্ত উপন্যাস হয়ে গেছে সেটা বুঝতেই পারেনি সুমনা দিভাই । এমনকি টিউশনি করানোর ফাঁকে ফাঁকে দুই চার লাইন ( চুপি চুপি ) পড়ে ফেলে । হাজার ব্যস্ততার মাঝেও দিভাইয়ের এই ভয়ঙ্কর নেশায় একটু সামিল হতে না পারলে দিনটা অস্বস্তিতে কাটে ।
সিংহভাগ সময় টিউশনি করতে আর স্পর্শের পিছনে কেটে যায় । দিভাইয়ের কাছে মিতিন জানায় কাল রাতে তোমার ফেসবুক আইডির চিরুনি তল্লাশি করেছি । 'চিরুনি তল্লাশি' র কথা শুনে দিভাই খুব খুশি হয় । মিতিন দিভাইয়ের কাছে জানতে চাইল যে, দাদার ( স্পর্শের বাবা ) নতুন কোন ছবি পোষ্ট করো না কেন ? ফোনের অপর প্রান্ত থেকে উত্তর আসে, ভাই তুই কালকে চিরুনি তল্লাশি করে জানতেই পারলি না তোর দিভাই বিধবা ! একথা শুনে মিতিনের আঁখি পল্লবে অশ্রুধারা প্রবাহিত হতে লাগল এবং একটা শব্দ আর উচ্চারণ করতে পারেনি । মিতিনের একথা বুঝতে অসুবিধে হয়নি যে, দিবাকর সান্যালের নামটা আজও সুমনা দিভাইয়ের হৃদয়ে ক্ষনে ক্ষনে উচ্চারিত হয় ।
ধারাবাহিক উপন্যাস
অপরাজিতা
দেবব্রত সেন
প্রথম পর্ব
৫// সুলেমান বসে আছে বাঁধের ধারে
শীতের সকাল ,দশটা হবে! চারদিক সোনালি ক্ষেতে ভরে আছে ধান! কেউ ধান কাটছে ,তো কেউ ঝারাই মারাই করছে! দলবদ্ধ ভাবে ! সুলেমান বাঁধের (তিস্তার ) ধারে বসে আছে, হাসিখুশি সূর্যটার ফুরফুরে রোদ্দুরে গা ' টা গরম করছে।তাকে দেখে মনে হচ্ছে, মন ভালো নেই তার! গালে হাত দিয়ে কিছু একটা ভাবছে। এদিকে মালতি আর তার মেয়ে পুজা , হেটে চলছে সুলেমানদের বাড়ি, পথেই দেখা!
আরে ভাবিজান যে, কই যাও? কিছু মনে করলেন নাকি আবার? বৌদি ডাকটা আর ভাল লাগে না! তাই আর কি, তাই ভাবিই কই কেমনে ।আমার ভাবি ডাকটাই ভালা লাগে!একটু মন মন মরা ভঙ্গিতে, ইশদ হাসির ফাকে সুলেমান বলে উঠল।
যা পার কও, তবে তুই এখানে সুলেমান ! কি করিস? যেটা ভালো বুঝিস, সেই বলে ডাকিস। আমার আপত্তি কই, কিছু বলব যে!
সুলেমান পুজার মা মালতির দিকে তাকাল! বলল, হ,' ভাবিজান চলো যাই , বাড়ির দিকে চলো। ভালাই করছ! অনেক দিন আহ নাই! বেড়বার আয়ন লাগে না? অনেক দিন পর দেখা, সাক্ষাইত!
সময় কই ভাই। জানোই তো, অভাগীনিটার সংসারের কথা।মানুষের বাড়ি কাজ করে সংসার চলে।
আমিইও বাড়ি থেইক্যা বেরবার পারি না ভাবি। হাটবাজার বন্ধ! যাবার পারি না! শরীরটা বিশেষ ভালা নাই! ওই পুলাডাই যায়,! ওই টুকিটাকি খরচ - বর্তন যদি লাগে।
পুজার দিকে সবিনয় ভঙ্গিতে তাকাল সুলেমান! বলল,
মা'গোটা কেমনে আছে? আসলে সুলেমান নারী জাতিকে দেবী মনে করে! আর নারী তো, মা জাত। আর তার মতে শরতের শিউলি, কাশ ও পদ্মের সমাহিতে শুভ পক্ষ অর্থাৎ মাতৃ বা দেবী পক্ষ। আর এই দেবী পক্ষের হাতেই অশুভ শক্তি তথা অসুর শক্তির বিনাস ঘটে।।হিন্দুদের মতো এই প্রখর মাতৃ শক্তিতে বিশ্বাসি সুলেমানও।
পুজা বলল , ভালো আছি কাকু।তুমি কেমন আছো?
সুলেমান !! ওই যায় আর কি! সবই আল্লার কৃপা রে মা। আল্লাহ যেইভাবে দিনটারে নিয়া যায়, ওই ভাবেই যায়। শিবুটা না এই বৎসর উচ্চ মাধ্যমিক দিব বুঝি ?
টেস্ট পরীক্ষা চলছে। । ধান কেমন হইছে সুলেমান। পুজার মা মালতি বলল।
আর কি! সবে আল্লার -মহব্বতের দান ভাবি।
এই সময় পথ চলতে চলতে একজন পথ চলতি, গ্রামের লোক বলল, সালাম ওয়ালেকিউম! কেমনে আছেন ভাইজান?
সুলেমান বলল, ওয়ালে কিউম সালাম! ভালা।
তারপর কি জানি কয় ভাবি? ও হ্যাঁ ,ধান! মোটামুটি ভালাই হইছে। দ্যাখলা না শালার আকাশটা, কতই না বাহানা করল! জল নাই নাই কইরা শ্যাষে আবার জলও হইল। আমি তাও তো রোয়া গারবার পারছি! কেউ কেউ একদমই পারে নাই। বিচুন নষ্ট হইয়া গ্যাছে। ওই বিচুন সমস্যা! আমার যেইটুক বাজছে, বাবলু দা"রে দিসি।বেচারা রোয়া গারতে পাইছে! হ্যারো অবস্থা করুন । বড় অসুখে ভুগছে আইজ দুইমাস ধইরা।
এই গল্প গুজব করতে করতে বাড়িতে এলো।
সুলেমান তার স্ত্রীকে ডেকে বলল, এই বউ, বউ! ভাবিরে বইতে দে। আমি আইতাছি। চা বসাইয়া দাও। এই বলে কই জানি, গেল। সুলেমানের বউয়ের নাম রুবিনা বেগম। নিঃসন্তান! ছেলেপুলের জন্য অনেক টাকা পয়সা খরচ হয়েছে তার, চিকিৎসার জন্য! কিন্তু কোনো লাভ হয় নাই। তাই সে ছেলে পুলে দেখলেই খুব আদর করে ভালোবাসে, কাছে টেনে নেয়!আর যেই ছেলেটার কথা সুলেমান ছেলে ছেলে বলছে, সে তার পোস্য পুত্র। বলাই যায় এখন সে নিজেরই ছেলে। খুব ভালোবাসে ছেলেটাকে।
ক্ষানিক পরে, তুরন্ত চলে এলো সুলেমান! সামনেই ছোটো বাজার বসে! নিয়ে এলো একটা পোল্ট্রির মুরগী ! বলল, ভাবি আর পুজা শোনো তোমাগো আইজ বিনা খাওয়ায় ছাড়তাছি না!
.........বউ চা হইছে?
............ হুম হইছে!
............এই যে চা নাও!
......... ভাবি আর পুজা মা রে দিসস?
..........রুবিনা হুম দিসি।
আমি তাহইলে মুরগীটারে যবাই করি।
পুজার মা এদিক ওদিক করে দেখল আর বলল, এই সুলেমান তোমাদের বাড়ি আত্মীয় স্বজন আসবে নাকি?
আত্মীয় স্বজন ! কুটুম তো তুমরাই? আর কেডা আত্মীয় আইবো কওনে! যারা আছ্যে হেরা ত কাম কাইজে ব্যাস্ত মাইনষে, এহন আইবো কেমনে!
সুলেমান বলল, এই বউ একটা বটি দিয়া যাও।
পুজার মা, মালতি বলল, মুরগী যবাই কর, কর! যদি তোমরা খাও!! আমরা কিন্তু খাব না।
কেন ভাবি? কিছু হইছে নাকি? সুলেমান বলল।
আমরা পো ল্ট্রি মাংস খাই না রে সুলেমান, মালতি বলল! আর পুজা শুধু হ্যাঁ সূচক মাথা নেরে বলল, একদম সুলেমান কাকু। সত্যিই তাই।
সুলেমান একটু নরম সূরে বলল, ও! আমি তো জানতাম না ভাবি!না হলে মাছই নিয়া আইতাম।
আমরা খাইনা কারণ ওই গুরুদেবের বারন আছে।
সুলেমান ভাবছে হিন্দু প্রচলিত রীতিতে এরকমও নিয়ম আছে! ও হ্যাঁ আমাদেরও আছে যেমন শুকর ও মদ কোরানে নিষিদ্ধ । তবে এখানেও হয়তো একটা কারণ আছে । নইলে খাদ্যে আবার বাধা কিসে। এটা বোধ হয় ধর্মীয় কারণ। আচ্ছা সে কি হয় হোক! সেটা ধর্ম গুরুদের বিষয়।
........অ! ঠিক আছে! এত দিন পর আইলা আর বিনা খাওয়ায় পাঠাই কি কইরা ভাবি? ভাবি, তোগো হিন্দু মাইনষের যতসব আজগুবি নিয়ম। আমি ভাই অতসব নিয়ম টিয়ম ধারধারি না।
মালতি বলল, অন্যদিন এসে খাওয়া যাব। আজ যেই কাজে এসছি, সে কাজ হোক আগে! আগে বসো তো, কিছু কথা আছে!
সুলেমান বলল, আচ্ছা ঠিক আছে ভাবি! তাই হোক! এই বসলাম! এহন কি কতা আছে কও, আগে শুনি।
পুজার সাথে যে ছেলেটার ঘুরছে, প্রেম করছে!ওদের দুজনের মধ্যে ভালোবাসা আছে। মানুষজন তো আছে, গাঁয়ের পাচ জনে পাচ কথা কয়। আমি নাকি ভালো না। মা মেয়ে মিলে বলে মাঘিগিরি করছি? বাড়িটা নাকি বেইশ্যাখানা খুলেছি! এগুলো কি ভাল লাগে বলো, কি জ্বালায় না চলছি। কখনও মনে হয় সুইসাইড করে বসি, সংসার আর টংসার, যাক সব ভেসে যাক। এসব আর একদম সহ্য হয় না! এখন কি করা যাবে বলত সুলেমান?
এই শুনে সুলেমান তো তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠার মতো।হাতে একটা চকচকে বটি। একদম তমতমে মেজাজ হয়ে উঠল সুলেমানের! এমন ভাব হল, যেন এক্ষুনি পেলেই তাদের শরীর ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে দেয়। বলল, ভাবি কেরা কইসে, একবার তোমার মুখে শুনি, নাম কও দেখি! আইজ ওর একদিন না আমার একদিন! , আইজ ওইডিরে কাইট্টালবাম! তারপর জেলে যাওনের হয় যামু, ফাঁসি হয় হোক।
আহ, প্রশমিত হবি কি? মাথা ঠান্ডা কর। পরিস্থিতি বুঝে কাজ করত হইব! মাথা গরম করলে কাজ হবে কি? বল! এর একটা বিহিত হওয়া দরকার। সুলেমানের স্ত্রী বলে উঠল।
সুলেমান বলল, হ ' বউ ঠিকই কইসছ। আমি উপযুক্ত জবাব দিমু ভাবি! একটা অসহায় মাইনষের খারাপ দ্যাখা! আর হ্যারা কি ধোয়া তুলশি পাতা! কিয়ের অসহায় মাইয়াডার সাহায্য করব, তা না কইরা যেই না সেই কইয়া বেড়াতাছে।
আচ্ছা ভাবি হেইডা হইল ইমপরটেনট কতা। আগে পুজা মা'র বিয়াডা দিইয়া লই! হেই কাজটা যত তাড়াতাড়ি হয় তত ভালো হয়। আমি কাইলপরশু শচীনদের বাড়ি যাহয়াম, সামনের মাঘেই বিয়ার কতা পাকা করতে! চিন্তা কইরো না ভাবি। সব দেখতাছি। তুমি শুধু পুজা মা 'র কাকুদের ফোন কইরা কও যে বিয়া লাগছে! পারলে কিছু সাহায্য কর! যদি করে তো ভালোই। আর যদি না করে, তবে দরকার নাই।
পুজার কাকুদের কথা বলতেই মালতির চোখেমুখ শুকিয়ে গেল! তৃষ্ণার্ত তৃষ্ণার্ত ভাব! গলাও জড়িয়ে আসছে! কথা বেরোচ্ছে না। মাথা চক্করের সমান। সুলেমান বউকে ডাক দিল, বউ জল আন। রুবিনা জল এনে দিল। সুলেমান পুজার মাকে শক্ত করে ধরল! পুজাকে বলল, মা' গো জল ঢাল তো মা, তোর মায়ের মাথায়। আমি ঘাড়সহ দেহ পৃষ্ঠ টান করে ধরে, আমার মনে হচ্ছে হার্ট এটাক!
(চলবে)
মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা অনলাইন ভাদ্র সংখ্যা ১৪২৬
প্রকাশক- রীনা সাহা
ঠিকানা- হসপিটাল রোড, কোচবিহার
ইমেল ঠিকানা- mujnaisahityopotrika@gmail.com
সম্পাদনা- শৌভিক রায়
মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা অনলাইন ভাদ্র সংখ্যা
No comments:
Post a Comment