শরৎ চলে এলো। শুরু হয়ে গেল অপেক্ষার প্রহর। আর কয়েকদিন পরেই বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসবে মেতে উঠবে এই রাজ্য। যদিও কেউ জানিনা এবারেও কী হতে চলেছে দুর্গাপূজার ভাগ্য! কেননা এখনও অতিমারীর ভ্রূকুটি কাটে নি। ফলে যে বাঁধনহারা উচ্ছাস দেখা যায় এই সময়, তা অবশ্যই স্তিমিত। এবারেও মায়ের কাছে আমাদের চাওয়া হবে এমন এক পৃথিবীর যেখানে থাকবে না কোনও মহামারীর ভয়, নিরন্ন মানুষ পাবে পর্যাপ্ত খাদ্য, ঘুচবে বেকারত্বের অসহায় অবস্থা। একই সঙ্গে প্রার্থনা করব সন্ত্রাসমুক্ত সেই পৃথিবীর, যেখানে গোলাপ ফুটবে নির্ভয়ে, নারীদের ভাগ্য লিখবে না কোনও মৌলবাদী ফতোয়া। শরৎ প্রভাতে সেই স্বপ্ন তাই মনে। জানিনা স্বপ্ন কেবল স্বপ্নই থেকে যাবে কিনা!
এবং বিশ্ব
পোড়েনি এখনো
কুমকুম ঘোষ
দাহ করে এলামআত্মা; আশ্রয়,মুখোশ
এবং যা ছিল অবলম্বন।
থার্ড বেল বেজে গেলে
পর্দা ওঠে রোজ ;
আলোর ইশারায়।
এখনও পোড়েনি জলের দাগ
নিঃস্ব, স্তব্ধ , অমলিন।
শরৎ গদ্য
শিউলির চিঠি
চিত্রা পাল
ভাই কাশফুল,
তুমি কেমন আছ, মনে হয়তো
ভালোই। আমি তোমাকে আমার দেশের আকাশ বাতাসের অবস্থাটা একবার মনে করিয়ে দিতে চাই।
এতদিন বৃষ্টির মাতামাতি, ঝড়ের দাপাদাপি চলছিলো, তাই আসবার কথা কিছু বলিনি। এবার
ওরা ওদের বাক্স প্যাঁটরা নিয়ে চলে যাবার তোড়জোড় করছে। আকাশ মাঝে মাঝে ঘন
নীল।সূর্যোদয়ের কিরণ যখন আমার গাছের পাতায়
পাতায় ছুঁয়ে যায়,সে কিরণ স্পর্শে সমস্ত গাছপালা বৃক্ষলতা কেমন কেঁপে কেঁপেওঠে। আমার প্রাণের ভেতরেও কাঁপন ধরে,কেউ যেন মনে করিয়ে
দেয়,আমার প্রকাশ হবার, ফুটে ওঠবার সময় হয়ে এসেছে।এসেছে শরত্কাল, যে কাল তোমার
আমার,দেশের মানুষজনের একেবারে একেবারে
আপন।
সবারই
অভিব্যক্তি প্রকাশের সময় থাকে।তো আমার এই শরৎকাল, এই ঋতুই আমার সব,তার সঙ্গে
তোমারও সব। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে তোমাদের উত্সব
আনন্দ। সব জাতিরই কোন এক বিশেষ কাল আছে, যে কাল তাদের সমারোহের কাল, উৎসবের কাল।তেমনি আমাদের
বাঙালীদের এই শরত্কাল।শরত এলেই কেমন সকলের এক হয়ে আনন্দ উৎসবশুরু করার মন হয়ে । অবশ্য তার শুভ
সূচনা হয় আমাকে দিয়েই। প্রথম যেদিন দুটো একটা করে গাছের তলায় ঝরে পড়ি,সেদিন নিজের
আনন্দের সঙ্গে অন্যদেরও জড়িয়ে ফেলি। সেদিন
চোখে পড়ে নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা, সে
মেঘের ছায়া লুকোচুরি খেলে ধানের ক্ষেতে।ভোরের
সোনা রঙের আলোর স্পর্শে আমার কেমন যেন কাঁপন ধরে। আমি জানি তোমারও হয়। নদীর চরে
লুকিয়ে থাকা তুমিও সে কাঁপনে শিউরে উঠে মাথা তোলো।
সারাদিন
সূর্যের আলো বর্ষার জলসিক্ত গাছের পাতায় পাতায় যেন প্রাণের বীণা বাজিয়ে যায়। সে
সুর ঝংকারে সাড়া দিয়ে সারা রাত ধরে আমরা কোমল পল্লবের কোলে কোলে এক সাথে ফুটে উঠি।
ফুটে ওঠার মৃদু সৌরভ বাতাসে ভাসে। আমাদের কাছে এলেই তা পেয়ে যাবে। সকালে
বাতাসের উড়ন্ত আঁচলের দোলায় গাছের ডালপালা
চঞ্চল হয়ে পড়লে আমরা ভূমিতে বিছিয়ে পড়ি, তার ওপরে শিশির পড়ে হাসে, সে হাসি যেন
মুক্তোর মতো । ফুলের সাজিতে ভরে
উঠে যাই দেবতার পদতলে।সন্ধ্যায় অন্ধকার
যখন ঘন হয়ে আসে, আবার আমরা সেজে উঠি গাছের পাতার কোলে নতুন প্রাণের আবেগে। এমনি
করেই আমরা পুনর্জন্ম লাভ করি।শরত তপনে প্রভাতস্বপনে পরাণ বোধ হয় তাই চায়। আমার কথা তো বললাম, এবার তোমার কথা বলো।
ইতি
শিউলি
ঘরে ফেরার গান
অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী
টরন্টো,কানাডা
সকাল ৮ টা
২ রা সেপ্টেম্বর ২০২১
আমি চোখ বুজে এখান থেকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি বিকেলের পড়ন্ত আলোয় তুমি বাবার জন্য চা নিয়ে বাইরের বারান্দাটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছ। তোমার আলতা পরা পায়ের পাতা কতদিন ছুঁয়ে দেখেনি মা। চায়ের কাপ প্লেট এখন অল্প অল্প কাঁপে তোমার হাতে। সেই কাঁপার আওয়াজ, তোমার হাতের শাঁখা, পলা, চুড়ির আওয়াজের সঙ্গে মিশে অদ্ভুত এক অনুরণন সৃষ্টি করে। প্রতিবছর পুজোর আগে এই সময়টায় তোমার হাতে নতুন শাঁখা, পলা ওঠে। আরও উজ্জ্বল হও তুমি। বাবার গায়ে হালকা একটা চাদর যত্ন করে জড়িয়ে দিলে তুমি। বাতাসে এখন অল্প অল্প হিমের ছোঁয়া। ছাতিম ফুল গন্ধ ছড়াচ্ছে বাতাসে। বাবার হাতে এবারের শারদ সংখ্যার কোনো একটি বই। চেয়ারের পাশে লাঠি। সেবার পড়ে যাওয়ার পর থেকে ওই লাঠিই বাবার সঙ্গী। একটা সময় বাবা কতজনের ভরসার, বিশ্বাসের, দায়িত্বের অংশীদার হয়েছেন। বটগাছের মতো ছায়া দিয়ে গড়ে তুলেছেন আমাকেও; আজ আমিও বাবার ভরসার সাথী হয়ে কাছে থাকতে পারছিনা।
এখানে কাজ, শুধু কাজ। কেনা কেনা খাবারগুলো খেতে খেতে মুখে অরুচি ধরে গেছে। তোমার হাতের গন্ধ মাখা ভাত, ডাল, আলু ভাজার কথা মনে পড়ে খুব। এখন তো ভাদ্র মাস। এবছর তোমার গোপালের জন্য তালের বড়া, তাল ক্ষীর করেছো মা? তারপর তো নিজেরা একটুও মুখে না তুলে বিলিয়ে দেবে একে ওকে। তোমার অভি যে তোমার কাছে নেই.....তোমার খুসখুসে কাশিটা কমেছে মা? ফোনে কথা বলেও মন ভরেনা সেই এসে থেকেই। গ্রামে নেটওয়ার্কের সমস্যার জন্য খুব অস্পষ্ট ভাবে আমার কাছে পৌঁছোয় তোমাদের গলার আওয়াজ। রান্নাঘরে তোমার হলুদ মাখা আঁচল, পিঠময় ভেজা চুল ছড়িয়ে সাজি হাতে বাগানময় ঘুরে তোমার ফুল তোলা, তুলসীতলায় প্রদীপ জ্বালানো, বছরের এই সময়টা জুড়ে ভোরের আলো আঁধারিতে কমলা বোঁটায় টলমলে জলের কণা মাখানো শিউলি কুড়োনোর ছবি ; সবই আমার পিছুটান।
এই শরৎ কালের সময়টায় প্রতিবছর আমাকে হাতছানি দেয় সকালবেলার ধানগাছের ওপরের শিশির বিন্দু, ভোরের আবছা কুয়াশা, শিউলি, কামিনী, মল্লিকা, ছাতিম, হাসনুহানার পাগল করা গন্ধ,ফল বাগানের কামরাঙা, চালতা, আমলকী, ডালিম ,দিঘির পদ্ম, শাপলা, শালুক,পাড়ের কাশবন, তোমার হাতের নাড়ু, মোয়া, মুড়কি।
ছবির মতো ভেসে ওঠে, ব্যানার্জী বাড়ির ঠাকুর দালানে সিধু কাকার নিপুণ হাতের কারসাজিতে গড়ে উঠছে একচালায় মা দুর্গার ডাকের সাজ। দুর্গাপুজোর আমেজ এখন গ্রামের আকাশে, বাতাসে। ওখানকার পুজো পুজো গন্ধ মাখানো নরম মিষ্টি হাওয়া আমার কাছেও ভেসে আসছে যেন।আমার মনেও বেজে উঠেছে ছুটির বাঁশি।দুর্গা ঠাকুরের মুখ মনে করলে কপালে সিঁদুর পরা তোমার মুখই চোখে ভাসে মা।
বিগত দিনগুলোতে মহামারীর এই ভয়াবহতার মধ্যে হাজার হাজার মাইল দূরে থেকে তোমাদের কথাই সবচেয়ে বেশি মনে পড়েছে.. আতঙ্ক গ্রাস করেছে তোমাদের একাকীত্ব আর অসহায়তার কথা চিন্তা করে। এই ধুলো বর্জিত পলিশ করা জীবনকে ছাপিয়ে আমার গ্রামের আঁকাবাঁকা পথ ধরে ঘরের চেনা পরিসরে ফেরার ছুটি চেয়েছে মন।
আমি বরাবরের মতো ফিরে যাচ্ছি তোমাদের কাছে, তোমাদের পাশে, আমার সহজ সরল গ্রামের মানুষদের কাছে; আধুনিকতায় না হলেও আন্তরিকতায় যাঁরা সত্যিকারের খাঁটি। এই দুর্বিষহ পরিস্থিতিতে কর্মসংস্থানহীন কিছু মানুষকে নিয়ে শুরু হবে আমার আগামীর পথচলা। আজকে সকালের সূর্যকে সাক্ষী রেখে আসন্ন শারদীয়ার প্রাক্কালে আমার স্বপ্ন দেখার শুরু। শরতের আনন্দময়তা ও তোমাদের আশীর্বাদ তোমাদের ছেলেকে যেন সঠিক পথের দিশা দেখায়।
রোজকার মতো আজও আমার ডায়েরির পাতা জুড়ে মনের কথাগুলো সাজিয়ে দিলাম তোমার নামে। এরপর শুধু দিনগোনা..ভোরের স্বপ্ন সত্যি হওয়ার মতো করেই এই শরতেরই আগামী কোনো এক ভোরে আমি পৌঁছে যাব তোমাদের কাছে, আগামী প্রতিটি ভোরকে আরও সুন্দর, আরও সার্থক করে তুলতে।
আজি শরত তপনে প্রভাত স্বপনে
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়
আজও চোখে ভাসে অতীত দিনের সোনা মাখা স্মৃতি। বাড়ির উঠোনে আলো করে ফুটতো স্থলপদ্ম। গোলাপি স্থলপদ্মের ভারে নুইয়ে পড়া গাছটার সাথে, আকাশের তারার মতো ফুটে থাকা শিউলি গাছটার ভাব ছিল। সাঁঝের আঁধারে বা পূর্ণিমা রাতে একটু ফাঁকা ফাঁকা থাকলেও, জোনাকি জ্বলা আঁধার রাতে, শিউলি - স্থলপদ্মের মিলন ঘটত।
মাতৃপক্ষের শুরুতে শিশির ভেজা পাতার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো চুপটি করে ওদের লুকোচুরি খেলা দেখত। আমাদের বাড়িতে ঢোকবার রাস্তায়, সার সার রজনীগন্ধা মাথা উঁচু করে স্বাগত জানাতো, অতিথি -অভ্যাগতদের।
মহালয়ার ভোরে, মা ' ঘরের সব জানলা খুলে, পরদা সরিয়ে দিয়ে, নিজের হাতে জ্বেলে দিতেন গ্রীনচম্পা ধুপের কাঠি। গোবর নিকোনো উঠোনে, আলো করে ঝরে পড়ত হলুদ সাদা শিউলি ফুল। ভোরের সে আবেশ দুপুর, বিকেল পার করে সাঁঝবেলা অবধি মাতিয়ে রাখতো।
মাতৃপক্ষ জুড়ে কত না আয়োজন মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরে ঘুরে ঠাকুর দেখা ও প্রসাদ খাওয়া। কোন বন্ধু ক'টা ঠাকুর দেখল তার হিসাব নিকাশ চলতো।
খুব শৈশবে একবার চার-পাঁচটা জামা -প্যান্ট এর সেট পেয়েছিলাম। এক একদিন এক একটা সেট পরে, অন্য আর একটা সেট হাতে ঝুলিয়ে, পুজো মণ্ডপে ঘুরতে বের হতাম।
শ্রাবণ মেঘের বিদায় বেলায় এখনও সেই রবি কিরণ তার পূর্ণ ছটা ঢেলে দেয়। পূর্ণিমা চাঁদ তুলসীমঞ্চের গায়ে ঢেলে দেয় তার কোমল আলোর বর্ণছটা। আজও শরত তপনে প্রভাত স্বপনে ভেসে আসে পেঁজা তুলোর মেঘের পাহাড়। দূর গ্রামে কাশবনের দেশ থেকে ভেসে আসে আগমনী গান।
আজি শরত তপনে প্রভাত স্বপনে
অদিতি মুখার্জী সেনগুপ্ত
প্রতিদিন মানুষ যদি নিরিবিলি প্রকৃতির সাথে একান্ত সময় কাটাতে পারে, তবে সে মানসিক শারীরিক সব দিক দিয়ে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হবেন। আসলে আমরা তো প্রকৃতিরই অংশ।প্রকৃতি আমাদের দেহে মনে তো প্রভাব ফেলবেই সেটাই স্বাভাবিক। প্রকৃতি বলতে; প্রকৃতির যে কোন কিছু; যে কোন ঋতু, বনজঙ্গল, গাছপালা, সাগর, নদী, কিংবা দিগন্ত ভরা সাদা কাশফুল মন ভালো করে দেবার জন্য যথেষ্ট।
ষড়ঋতুর দেশ আমাদের এই বাংলাদেশ। প্রতিটি ঋতু ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। সকালে প্রকৃতি অপরূপ সাজে সজ্জিত হয়। শরৎ সকালের প্রকৃতির প্রসন্ন হাসি আর সুবর্ণ মােহন কান্তি দর্শনে মানুষ মাত্রই মুগ্ধ হয় । শরতের প্রকৃতির স্নিগ্ধ শান্তরূপ সকলকেই আকৃষ্ট করে।
ভাদ্র-আশ্বিন-এ দুই মাস শরৎকাল। বর্ষা যখন যাই যাই করে তখন বাংলাদেশের প্রকৃতির নাট্যমঞ্চে নেপথ্যে শরৎ সুন্দরীর আবির্ভাবের অদৃশ্য আয়ােজন চলতে থাকে । নিঃশব্দ চরণে সে যে কখন এসে হাজির হয় তা কেউ টেরই পায় না। অনেক সময় বর্ষা চলে গেলেও শরৎ আসতে কিছুটা দেরি হয়। হঠাৎ একদিন ভােরে ঘুম থেকে উঠে যখন দেখতে পাই, শিশিরসিক্ত দূর্বাঘাসের উপর সূর্য কিরণ পড়ে হাজারও মুক্তোদানার রূপ ধারণ করেছে আর আমাদের চারপাশে পথে ঘাটে টুকটাক দুই একটা সাদা কাশফুল উঁকি দিচ্ছে তখন জানতে পারি যে শরত ঋতু এসেছে।
কাশফুল এর শুভ্রতা এমনই যে এর ফুরফুরে হাল্কা আকৃতির মতনই মন দ্রুতই হাল্কা হতে থাকে। আমাদের আর কোনাে সন্দেহ থাকে না যে শরৎ সুন্দরী বাংলাদেশের বুকে এসে হাজির হয়েছে। বাংলাদেশে শরৎকাল সামান্য কিছুদিন স্থায়ী হয়। এ অল্প সময়েই প্রকৃতিতে নিয়ে আসে নতুন ছন্দ, নতুন সৌন্দর্য ।
শরতের প্রভাতে হালকা কুয়াশা আর বিন্দু বিন্দু জমে ওঠা শিশির এ ঋতুর প্রধান উপহার । এ সময় পূর্ণ যৌবনা নদী প্রাণচাঞ্চল্যে, খরতর বেগে ছুটে চলে আপন গন্তব্যে। রক্তিম সূর্য পূর্বাকাশে উদিত হয়। আকাশে সারসের দল সাই সাই করে উড়ে চলে কোনাে মানস সরােবরের দিকে। সুনীল আকাশে ভেসে বেড়ায় খণ্ড খণ্ড অসংখ্য সাদা মেঘের ভেলা। সুনীল আকাশের ছায়া পড়ে শান্ত নদীর বুকে। নদীর কোল ঘেঁষে ফোটে অজস্র কাশফুল। মৃদু বাতাসে ঢেউ খেলে যায় সেই সাদা কাশবনে। আকাশের স্নিগ্ধ সূর্যকিরণে মাঠ-ঘাট ঝলমল করে। হাঁটুজলে সাদা সাদা বক নিবিষ্ট মনে দাঁড়িয়ে থাকে। লােকালয়ে খেকশিয়াল আর বনবিড়ালের আনাগােনা বৃদ্ধি পায়। দোয়েল-কোয়েল আর বিভিন্ন পাখির কলকাকলিতে মুখরিত থাকে চারদিক। শরতের শারদীয় প্রভাতে নানা রঙের ফুল ফোটে। জুই, টগর আর মালতি ফুলের শুভ্র সৌন্দর্যে চারদিক মােহিত থাকে। শরতের প্রভাতে শিশির ভেজা শেফালি ফুল অনুপম সৌন্দর্য নিয়ে ঘাসের বুকে হাসে। আকাশে, বাতাসে আর দূর্বাঘাসে শরৎ তার স্নিগ্ধ সৌন্দর্য বিলিয়ে দেয়। এর অপূর্ব সৌন্দর্যে বাংলার প্রকৃতি ও পরিবেশ মােহনীয় হয়ে ওঠে।
শরতের শিশির ভেজা প্রকৃতির আস্তরণ ভেদ করে সুয্যিমামা আলাে ছড়ায়। সকালের মিষ্টি রােদ খুবই ভালাে লাগে। শরতের সকালের স্নিগ্ধ বাতাস শরীরে শিহরণ জাগায় । মাঠভরা ফসলের খেতে যখন সূর্যের প্রথম আলাে পড়ে তখন সবকিছু যেন চিকচিক করে। মােটকথা শরতের সকালের অপরূপ সৌন্দর্য এক মনােমুগ্ধকর পরিবেশের সৃষ্টি করে।
শরতের সকালের মনােরম পরিবেশ মানবমনকে প্রফুল্ল করে। সারা আকাশ জুড়ে বৃষ্টিহীন সাদা মেঘের বিচরণ মানুষের মনে প্রশান্তি এনে দেয়। সকাল বেলার মিষ্টি রােদ মানুষের মনকে ভাবুক করে তােলে । প্রভাতে ঘাসের ওপর বিন্দু বিন্দু শিশির কণা, বিভিন্ন গাছে গাছে ফুটে থাকা ফুলের সমারােহ, গাছে গাছে ডাকা পাখিদের কলকাকলি, বিভিন্ন ফুলের সুবাস প্রভৃতি থেকে যে আনন্দ পাওয়া যায় তার তুলনা রহিত।
শরতের সকালে নানান পিঠা বানানাে বাঙালি সংস্কৃতির একটি অংশ। প্রতিদিন সকালে গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতে সকালবেলা পিঠা দিয়ে নাস্তা করা হয়। তাছাড়া আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের পিঠার নিমন্ত্রণ জানানাে হয় । এভাবে গ্রামে বাঙালি সংস্কৃতিকে ধরে রাখা হয়েছে সুপ্রাচীনকাল থেকে।
বাংলাদেশ একটি কৃষিভিত্তিক দেশ। এদেশের অধিকাংশ লােক কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। বর্ষার পরপরই আসে শরৎকাল । তখন কৃষকরা খুব খুশি হয়। কেননা এ ঋতুতে ফসলের সম্ভাবনা জেগে ওঠে। বর্ষার দীর্ঘ সময় মাঠ-ঘাটে শুধু পানি আর পানি থাকে।কৃষক ফসলের যথাযথ পরিচর্যা করতে পারে না। তাই শরৎঋতুর আগমনে কৃষকরা আবার নতুন ফসলের আনন্দে থাকে। ঝিরঝির বাতাস ধানের খেতে ঢেউ দিয়ে যায় আর কৃষকের মনে দোলা দেয়। প্রকৃতিতে বহমান ঝিরঝির বাতাস কৃষকের সব ক্লান্তি দূর করে। তারা মনের আনন্দে জমিতে ফসলের পরিচর্যা করে আর মনে মনে সুখের স্বপ্ন বােনে।
শরতের সকাল জনজীবনে নতুন আমেজ এনে দেয়। তখন পল্লির পথঘাট শুকনাে থাকে। কোথাও কোনাে কাদা থাকে না। সকাল হতেই মানুষের মধ্যে কর্মব্যস্ততা শুরু হয়। সবাই যার যার কর্মস্থলে ছুটে চলে। গ্রামাঞ্চলের খেয়াঘাটে মানুষের ভিড় জমে।
শরতের সকাল কবি-সাহিত্যিকদের মনে বিশেষভাবে ধরা দেয়। শরতের অনাবিল সৌন্দর্য মানুষকে মােহিত করে। এ সময় বাংলাদেশ এক অপরূপ সাজে সজ্জিত হয়। বিশেষ করে শরতের সকাল সবার মন কেড়ে নেয় বিচিত্র সৌন্দর্য বিলিয়ে দিয়ে। তাইতাে অনেকের প্রিয় ঋতু শরতকাল।
সময় এবং সময়
ধ্রুবজ্যোতি পাল
সে একটা সময় ছিল।
বেশ একটা সময় ছিল।
করলাতে জল ছিল
জলের একটা আয়না ছিল
আয়নাতে ছবি ছিল
আলোভরা উঠোন ছিল
উঠোনেরও হাসি ছিল
আম-শিরীষের ছায়া ছিল
ছায়া-আলোর খেলা ছিল
গোটা একটা আকাশ ছিল
আকাশের নীল রং ছিল
‘অনুরোধের আসর' ছিল
বিকেল আলোয় ঘোরা ছিল
কাদামাঠে খেলা ছিল
হৃদয় তখন খোলা ছিল
হৃদয়ের রং সবুজ ছিল
এইচ. এম. ভি-র রেকর্ড ছিল
হেমন্ত আর সন্ধ্যা ছিল
কথা বলা পুতুল ছিল
যাত্রা-নাটক-গান ছিল
প্রাণ ছিল প্রাণ ছিল
আরো কত কিছু ছিল।
এখনো তো অনেক আছে।
আগের চেয়ে বেশি আছে।
সব পেয়েছির টান আছে
আরো পাওয়ার খিদে আছে
বাক্স বাক্স খেলা আছে
বাক্স বাক্স বাড়ি আছে
বাড়ির ভেতর বাক্স আছে
বাক্সের গায়ে খাঁচা আছে
খাঁচার ভেতর জীবন আছে
প্রাণ আছে, জীবন আছে?
অসম্ভবের চাওয়া আছে
গ্রীলের পাশে গাছ আছে
গাছেরও তো প্রাণ আছে
গাছেরও তাই মুক্তি আছে
দূরের সবুজ ছায়া আছে
ছায়াঘেরা বাড়ি আছে
বাড়ির সামনে বাক্স আছে
বাক্সে অনেক মানুষ আছে
মানুষেরা ভালো আছে?
অ্যান্ড্রয়েড আর ফোর-কে আছে
ভার্চুয়ালি বন্ধু আছে
বন্ধুদের হাসি আছে
হাসির মধ্যে ভাবনা আছে
মনের ভেতর পাঁক আছে
পাঁকের ভেতর সাপ আছে
বেঁচেবর্তে থাকা আছে
সৃষ্টি আছে বৃষ্টি আছে
প্রলয় আছে ধ্বংস আছে
বেনিয়মের নিয়ম আছে
নিয়ম কানুন ভাঙা আছে
ভাঙার পরেও গড়া আছে
রাতের পরে দিন আছে
কালোর পর সাদা আছে
আছে আছে সবই আছে
খুঁজে দেখলে আজও আছে।।
খুশির শরৎ
সুব্রত দত্ত
শরৎ মানে --- বর্ষার অত্যাচার থেকে বাঁচা,
শরৎ মানে --- প্রকৃতির নতুন রূপে সাজা।
সদ্যস্নাতা তরুণীর মত পরিতৃপ্ত হাসা,
সোনারোদে ঝিকিমিকি আনন্দেতে ভাসা।
শরৎ মানে --- হিমের পরশ লাগা,
শরৎ মানে --- শিউলি-গন্ধে জাগা।
কাশবনের দুলুনিতে কাঁপন লাগা প্রাণে,
পুজোর গন্ধ হৃদমাঝারে খুশির লহর আনে।
শরৎ মানে --- ধানের ক্ষেতে ছায়া-রোদের খেলা,
শরৎ মানে --- আকাশনীলে সাদা মেঘের মেলা।
বিলের জলে শাপলা ফুলের স্বপ্নে জাল বোনা,
ঢ্যাম কুড়কুড় ঢাকের বাদ্যে পুজোর দিন গোনা।
শরৎ মানে --- শিশির ভেজা ঘাস মাড়িয়ে যাওয়া,
শরৎ মানে --- পদ্ম-ঘ্রাণে নিজেকে ফিরে পাওয়া।
দেবী দুর্গার বিদায় বেলায় বিষন্ন সিঁদুর খেলা,
বছর পরে ফিরবে আবার, বসবে প্রাণের মেলা।।
শরৎ এলো
শ্রাবণী সেন
এক টুকরো আকাশ দেখি
আমার খোলা জানলা দিয়ে
আকাশ এসে হাতছানি দেয়
শরৎ সাদা মেঘকে নিয়ে।
সোনার আলো মেখে মেখে
রোদে সোনার ছোঁয়াচ লেগে
কাশের ফুলে খুশির হিলোল
মনের মাঝে উঠছে জেগে।
ভোরের বাতাস বইল আবার
শিউলি ফুলের গন্ধ নিয়ে।
একটুখানি আলো মাখি
ওইটুকু ওই জানলা দিয়ে।
জানলা আমার খোলা শুধু
আলো হাওয়ার আসা যাওয়া
বর্ষা গেলে শরত আসে
একই থাকে চাওয়া পাওয়া।
শূন্যতার বুক চিরেনারায়ণ দত্ত
বৃষ্টি চেয়েছিলাম। চেয়েছিলাম শরৎ-বসন্তের
রঙিন সম্ভার, এক আঁজলা বিশুদ্ধ বাতাস,
মুঠো মুঠো রোদ্দুর আর
নিকোনো একটি উঠোন...
ভুল শরোশয্যায় কবিতা বাষ্প হয়ে উড়ে যায়
হামাম দিস্তায় পিষ্ট হৃদয় মৃত্যুবীজ বোনে
শিশুর মতো কাঁদে আকাশ-শরীর!
শুধুই আঁধার কুহক, নির্জন গাঢ় বেদনা
বুকের গভীরে বাজে অহর্নিশ, বিবর্ণ অতীত...
নীড় হারা পাখির মতো নিদ্রাভঙ্গ চোখ।
সহসা শিউলি গন্ধ ভাসে বিশুদ্ধ বাতাসে
মুছে যায় নোনামাখা স্মৃতি...
শিশিরের শব্দের মতো শুনি কাশ ফুলের
নুপুর ছন্দ, স্বপ্ন উত্তাপে কী একটা উম...
সেঁকে নিই হিম শীতল কলজেটাকে
নতুন জলে ভাসাই মান্দাস।
উঠোনের ঘাসে ফোটে কাঙ্ক্ষিত পারিজাত
মন-বলাকা উড়ে যায় শূন্যতার বুক চিরে
অবেলায় লিখি অনাবিল আনন্দ লিপি।
পোড়া কাঠের বিমূর্ত বেদনা ঝেড়ে আবারও
ছুটে যায় ভাদ্রের সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে
তরলিত চাঁদের চুম্বক নয়নে পৌষালি মৌতাতে।
ফুল্লরার স্বপন শ্রাবনী সেনগুপ্ত
"অ ফুল্লরা কাজে যাবিক লাই?"
"হ গ মা,নদীর ধারটতে একটুকু যাই -"
"অখানে আবার কি আছে রে!"
"কাশফুল মা-কি সোন্দর যে-
এই শরৎকালটয় পেঁজা তুলোর মেঘ,
মা গ এই ভোরেতে দেখতে লাগে বেশ।"
"তা বললে হবেক রে ছুঁড়ি-
কাজের বাড়ি যা তাড়াতাড়ি।
পূজোর বোনাস পাবিক লাই তবে-
লতুন জামাটও লিতে হবে।"
ফুল্লরা তাই ছুট লাগালো জোর
গায়ে মেখে শরৎকালের ভোর।
শরত প্রাতের রবির কিরণ
নরম আদরে করলো বরণ।
এই বাংলার প্রতি ঘরে ঘরে
ফুল্লরাদের স্বপনেতে ভরে।
ভাদ্রমাস
মহাজিস মণ্ডল
"আজি শরত তপনে প্রভাত স্বপনে"
ঝরঝর ঝরিছে ওই শিশির ধারা
দিগন্তবিসারী আকাশের নীল পাখায়
আনন্দ অশ্রু বিহ্বল সে পাগলপারা।
চকিত চোখের চাহনি চমকিত
দিগ্বিদিক শূন্য হরষে সরসে ভাসে
ভাদ্রমাসে ভাবনার ভরসার ভিড়ে
ভালবাসা অবাধ শিহরণে হাসে।
শরৎ গল্প
আলো মানুষ
মৌসুমী চৌধুরী
এতদিন ধরে এই ভরা ভাদ্রমাসেও বৃষ্টি হচ্ছিল ঝমঝমিয়ে। বৃষ্টির টুপটাপ, ঝমঝম নাচের ছন্দ ফুটে উঠছিল রূপসার পায়েও!
— "এ ভরা বাদর মাহ ভাদর শূন্য মন্দির মোর...।"
কিন্তু আজ সকালে ঘুম ভেঙে উঠে রূপসা দেখল শরৎ আলোয় ভেসে যাচ্ছে আকাশ। ভেসে যাচ্ছে মাটি, গাছ-গাছালি, পথ-ঘাট, ঘর-বাড়ি। মানুষেরাও যেন শরৎ আলো গায়ে মেখে কেমন আলো মানুষ হয়ে উঠেছে... রূপসার অন্তর ঘুলিয়ে উঠে আসছে নাচের এক একটি মুদ্রা। তার পায়ের স্ট্রোকে আজ যেন ফুটে উঠতে চাইছে শরৎ প্রকৃতির ছন্দময়তা —
"শরৎ, তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি।/ছড়িয়ে গেল ছাপিয়ে মোহন অঙ্গুলি॥"
আজকের এই শরত সকাল অনেকদিন বাদে আবার উৎসবমুখরতায় ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে রূপসাকে।
ছোটবেলা থেকেই প্রকৃতির মধ্যে নাচের তাল-লয়-মুদ্রা খুঁজে পায় রূপসা। এই যে বাগা -নের গাছগুলো কেমন সবুজ ডানা মেলে ছন্দে ছন্দে বেড়ে ওঠে। প্রতি ঋতুতে যেন আলাদা আলাদা ডান্সিং কস্টিউমস পরে গাছেরা নেচে ওঠে প্রাণের আনন্দে। আর ওই বাতাস, সেও তো নেচে নেচে চলে নানা বিভঙ্গে। ফুল, পাখী, নদী, ঝর্না সব্বার মধ্যেই লুকোনো নাচের মুদ্রা স্পষ্ট দেখতে পায় রূপসা। নাচ রূপসার প্যাশান, নাচ তার পুজো।
সেই ঘটনার পর নাচই তো তাকে ঢেকে দিয়েছিল স্নিগ্ধ আশ্রয় আঁচলে। নাচ তাকে কোল পেতে দিয়েছিল, যে কোলে তার আবার নতুন জন্ম হয়েছে। সেই দুর্ঘটনার পর সে এতটাই ভেঙে পড়েছিল যে কি করে আবার জীবন শুরু করবে বুঝে উঠতে পারছিল না! সৌম্য আর শ্বশুরবাড়ির লোকজনেরা পাশে থেকে সান্ত্বনা এবং সাহস যুগিয়ে গেলেও কিছুতেই যেন ক্ষতের উপশম হচ্ছিল না। দিনের পর দিন নটরাজের পায়ের কাছে বসে চোখের জল ফেলত সে। ভেবেছিল কোনদিনই বুঝি আর নচের জগতে ফিরতে পারবে না। আর তারপরই একদিন গুরুজি এসে হাত রাখেন পিঠে ,
— " এভাবে কেঁদে নিজেকে আরও অসুস্থ করলে কারও কিছু যাবে আসবে না, রূপসা। তোমায় তো বাঁচতে হবে। আঁকড়ে ধর নাচ- কে। ওঠ, আবার উঠে দাঁড়াও।..."
গুরুজিই রূপসাকে একটু একটু করে স্থিতিতে ফিরিয়ে দিয়েছেন। এখনও চিকিৎসা চলছে তার। চলছে নানা সূক্ষ্ম অপারেশন। কিন্তু পাশাপাশি গুরুজির আন্তরিক উৎসাহে চলছে নাচের কঠোর রেওয়াজও। গুরুজিই শিখিয়ে- ছেন দুঃখের মধ্যেও ছন্দ আছে, আছে তাল, লয়।
সেই ঘটনার আগে স্বামী ও পরিবারের বাইরে রূপসার জীবন তীব্রভাবে আবর্তিত হত তার নাচের স্কুল "সঞ্জীবনী"কে ঘিরে। তার সকাল বিকেলগুলো মুখরিত হয়ে থাকত নানা বয়সের ছাত্র-ছাত্রীদের কলকাকলিতে। তাদের হাতে ধরে একটু একটু করে শিখিয়ে তোলার মধ্যে রূপসা যেন ফিরে পেত নিজেকেই। ছেলে -মেয়েগুলো তার কাছে যেমন প্রশ্রয় পেত খুব। আবার অমনোযোগী হলে প্রচুর বকাও খেত মাথা নিচু করে বসে। আর সে সময়ই ঘটনাটা ঘটেছিল তার প্রিয় ছাত্রী শরন্যাকে কেন্দ্র করে। প্রায় দিনই নাচের স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে একটি বখাটে ছেলে উত্যক্ত করত তাকে। একদিন সেটা খুব বাড়াবাড়ির পর্যায়ে পৌঁছে গেল। মাঝ রাস্তায় ছেলেটি নাকি শরন্যার হাত ধরে টানাটানি করছিল। আর কোনক্রমে আঁচড়ে-কামড়ে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে পালিয়ে এসে রূপসার কাছে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল শরন্যা। শুনে রাগে ফেটে পড়েছিল রূপসা। তার বাড়ির কাছে মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছিল ছেলেটি। রূপসা কাছে গিয়ে তার গালে সপাটে এক চড় কষিয়েছিল। কড়া ধমক দিয়ে বলেছিল,
— " এরপর বেশি বাড়াবাড়ি করলে ইভ-চিজিং
-য়ের জন্য জেলের ঘানি টানিয়ে ছাড়ব।"
কোন জবাব না দিয়ে রূপসার দিকে হিংস্র দৃষ্টি
ছুঁড়ে দিয়ে চলে গিয়েছিল ছেলেটি।
তারপর মাস ছ'য়েক কেটে গিয়েছিল। ছেলেটিকে রাস্তাঘাটে কখনও আর পিছু নিতে দেখতে পায় নি শরন্যা। তবুও প্রথম প্রথম ভয়ে কুঁকড়ে থাকত বাপ-মরা মেয়েটা। কিন্তু দিন তো কেটে যেতেই থাকে। আবার নির্ভয়ে চলাফেরা করতে লাগল সে। নাচের বিভিন্ন বাঁক, বিভঙ্গ, তাল, মুদ্রার খুটিনাটি শিখে নিতে লাগল আগ্রহ ভরে। রূপসাও তাকে উজাড় করে দিতে লাগল সব। তারপরেই আসে সেই কালো দুর্যোগময় দিনটি, যে দিনটি থেকে আমূল বদলে যায় রূপসার জীবন।
পাঁচ বছর আগের সেই দিনটিও ছিল আজকের মতোই। গভীর নীল আকাশের বুক থেকে ঝরে পড়া সোনা রোদ্দুরমাখা এক উৎসবের দিন। কলকাতার এক বিখ্যাত পুজো কমিটির আমন্ত্রণে তাদের 'বিজয়া সম্মিলনী'তে নাচের অনুষ্ঠান করতে রূপসা গিয়েছিল তার ট্রুপ নিয়ে। খুব সুন্দর ও সফল হয়েছিল সেই অনুষ্ঠান। উদ্যোক্তারা আর্থিক পুস্কার সহ নানা পুরস্কারে সম্মানিত করেছিল রূপসা ও সহ-শিল্পীদের। সেই ট্রুপে ছিল তার প্রিয় ছাত্রী শরন্যাও। ফেরার পথে রাত প্রায় এগারোটা বেজে গিয়েছিল। নাচের মেয়েদের নিয়ে রূপসা গাড়িতে ওঠার জন্য কিছুটা হেঁটে পার্কিং জোনের দিকে এগোচ্ছিল। হঠাৎ কোথা থেকে একটা বাইক এসে রূপসা আর শরন্যার দিকে কিছু একটা ছুঁড়ে দেয়। যেন আগুনের গোলা! রূপসার মুখের বাঁদিকটা প্রচন্ড জ্বলতে থাকে। ততক্ষণে সে বুঝতে পারে তার মুখে অ্যাসিড ছোঁড়া হয়েছে। কিছুটা অ্যাসিড ছিটকে পড়ে শরন্যার হাতেও। তখনই সেই ছেলেটিকে দেখতে পায় রূপসা যে শরন্যাকে উত্যক্ত করত। বোধহয় তার মুখেই অ্যাসিড ছুঁড়তে এসেছিল সে, আর লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে সেটা এসে লাগে রূপসার মুখে। নাচের মেয়েরা সবাই ভয়ে চিৎকার করতে থাকে। সেখানেই জ্ঞান হারায় রূপসা।
দীর্ঘদিন কোমায় থাকার পর যখন তার জ্ঞান ফেরে তখন রূপসা দেখে তার মুখের বাঁদিকটা, বাঁ-কানের লতি সম্পূর্ণ পুড়ে বিকৃত হয়ে গেছে। সবটা এবড়ো খেবড়ো মাংস্পিন্ড যেন। জীবন সম্পূর্ণ বদলে গেল রূপসার। লোকে তাকে কেমন এড়িয়ে চলতে লাগল। বাচ্চারা তাকে দেখলে কেঁদে উঠত। এমনকি তার ছাত্রছাত্রীদের বাবামায়েরাও বাচ্চাদের তার কাছে নাচ শিখতে পাঠানো বন্ধ করে দিলেন। দিনরাত্রি তীব্র হতাশা টুঁটি চেপে ধরতে লাগল। সেই কষ্টের দিনগুলিতে শুধু শরন্যাই সবসময় পাশে ছিল তার। খুব অপরাধবোধে ভুগত মেয়েটা,
— " আমার জন্যই তোমার এত কষ্ট পেতে হল, আন্টি। আমাকে ক্ষমা কর।"
— " দূর পাগলী, এ তো দূর্ঘটনা, আমার কপা- লে ছিল। এমন করে ভাবিস না কক্ষনো।"
ধীরে ধীরে একটু একটু করে শরন্যার হাত ধরে চলতে লাগল রূপসা। ঘন্টার পর ঘন্টা সে আর শরন্যা নাচের অনুশীলন করত। তারপর একদিন একের পর এক ফিরে এল অন্য ছাত্রছাত্রীরাও। আবার তাদের কলকন্ঠে ভরে উঠল রূপসার "সঞ্জীবনী"। যে ছেলেটি অ্যাসিড ছুঁড়েছিল, একদিন ধরা পড়ল সে। যাবজ্জীবন সাজা হল তার।
বহু পরিশ্রম করে আজ অ্যাসিড আক্রান্ত মেয়েদের নিয়ে একটি সংগঠন তৈরি করছে রূপসা। নাম তার "আলো"। "আলো"র সদস্যারা অনবরত লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে তাদের মতো মেয়েদের আর্থ-সামাজিক প্রতিষ্ঠার জন্য। খোলা বাজারে যাতে অ্যাসিড বিক্রি বন্ধ হয় সেই বিষয়ে তারা সোচ্চার। অ্যাসিড বিক্রির ক্ষেত্রে দোকানদারেরা যাতে সজাগ ও সতর্ক থাকেন সেরজন্য তারা প্রতিনিয়ত পথসভা, মিটিং, মিছিল করে সচেতনতার বার্তা ছড়িয়ে দিচ্ছে। রূপসা এই সংগঠনের সভাপতি। আজকাল "আলো" রূপসাকে কানায় কানায় ভরিয়ে রেখেছে।
হঠাৎ শরন্যার ডাকে সম্বিত ফিরে পায় রূপসা
— " একি আন্টি, তুমি এখনও এখানে বসে আছ? ওদিকে মেকআপ আর্টিস্ট যে এসে যাবেন একটু পরেই। তাছাড়া আলোর সদস্যরাও অনেকেই এসে গেছেন। নিচের ঘরে তারা সাজগোছও শুরু করে দিয়েছেন।"
পাঁচ বছর পর আবার সেই পুজো কমিটির
উদ্যোক্তাদের আমন্ত্রণে 'বিজয়া সম্মিলনী'র অনুষ্ঠানে পারফর্ম করতে এসেছে রূপসা। এবার তার সহশিল্পীরা হলেন "আলো"র সদস্যরা, অ্যাসিড হামলায় আক্রান্ত সব মেয়েরা। জীবনের সমস্ত অন্ধকার অলিগলি পেরিয়ে যারা হেঁটে যাচ্ছে আলোকময় উত্তোরণের পথে। দু'চোখ ভরে রূপসা দেখছে স্টেজের ওপর দুরন্ত পারফর্ম করছে সেইসব আলোময় মানু্ষেরা। আর তারা যেন দু'হাতে লুটেপুটে নিচ্ছে এই শরতের সবটুকু সোনারঙা আলো,
—" আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে,/ আমার মুক্তি ধুলায় ধুলায় ঘাসে ঘাসে॥"
আবেগে ঝাপসা হয়ে আসে রূপসার চোখ।
শরৎ কবিতা
শব্দকথা
অরবিন্দ মাজী
অক্ষরদের ঘোরাফেরা-
আঙ্গুলের চঞ্চল স্রোতে,
ক্লান্তিহীন বিবমিষায়-
শব্দরা নিঃশব্দে ভাসে,
অতিদূর নীল আকাশে...
যখন মৌনমুখ পক্ষিকূল-
নিশ্চিন্তে পাখনা মেলে-
সপরিবারে আপন কুলায়-
ফিরে যায় ঝাকে ঝাকে-
দিন শেষে গোধূলি বেলায়...
মন্দিরের ঘন্টায় শব্দরা বাতাসে-
জীবন্ত হয়,আজানের আওয়াজে-
অক্ষরেরা শব্দমালা গেঁথে চলে,
চঞ্চলা যুবতী চুলের বেনী-বন্ধনে,
অনড় পাথরও সুমধুর কথা বলে...
শরতের মাধুরী
অপর্না ঘোষ
ঋতু পরিক্রমায় আজ শ্রাবণ নিয়েছে বিদায় ,
তবুও ভাদ্রের শুরুতেই বৃষ্টি ঝরছে অঝোর ধারায়।
শরতের প্রকৃতিতে রৌদ্র ছায়ার লুকোচুরি দেখা যায়,
নীলাম্বরে সাদা পেঁজা তুলোর ন্যায় মেঘ ভেসে বেড়ায়।
মাঠে মাঠে সবুজ ধান খুশিতে নেচে ওঠে,
নদীর দুকুল ঘেঁষে কাশফুলে খুশির মাতন তোলে।
শিউলি ফুলেরগন্ধ মাখা স্নিগ্ধ পরশে,
ভোরের বেলায় ঘাসের আগায় শিশিরের ছোঁয়া পরে।
শরতের সূর্যাস্ত মোহনীয় দৃশ্য ফুটে ওঠে প্রকৃতিতে,
রাতে রুপালি চাঁদের আলোতে ভরে যায় দিক-দিগন্তে।
মনোরম ও নবরূপে প্রকৃতি উঠেছে সেজে,
চারিদিকে সাড়া পড়ে উৎসবের আমেজে।
মিষ্টি বাতাসে বেজে ওঠে আগমনী সুর,
উদাসী মন আজ হয়েছে আনন্দে মধুর।
শরৎকাল দুঃখ-বেদনা, ক্লান্তি-গ্লানি দেয় ভুলিয়ে,
জাতি ধর্ম নির্বিশেষে মেতে ওঠে শারদীয়ার আনন্দে।।
কাশের পালকে লেখা
অভিমন্যু
আজি প্রভাতী তপনের কিরণে হাসে প্রকৃতি
শিউলির গন্ধে ম ম এ ভুবন,
পেঁজা তুলোর মতো রুপালি নরম মেঘ জমেছে
সুনীল গগনে পলকেই যায় ছেয়ে
একঝাঁক সাদা বক যায় উড়ে,
তালে তালে নেচে ওঠে দোয়েলের পুচ্ছ
টুনটুনি দেয় আনন্দের শিস ;
বিন্দু বিন্দু শিশির পড়েছে সবুজ ঘাসের বাগিচায়,
কাশের পালকে লেখা হয় অপরূপ সৃষ্টি।
পদ্মপাতার ডালায় প্রদীপখানি জ্বেলে
আপনার করে বরণ করি শরতেরে।
হিমেল বাতাস যায় বয়ে
কানে কানে যায় ভালোবাসার কথা কয়ে,
স্বপনের একটু ছোঁয়ায় কলিগুলো ফুল হয়ে ফোটৈ।
ভাদু উৎসবে মাতে বাঁকুড়া বীরভূম পুরুলিয়া
আগমনির গান দূর থেকে ভেসে আসে।
শারদ আমেজ
প্রতিভা পালসেন
মনের-তারে আজ শারদীয়া-সুর,
শিউলির গন্ধ-মাখা ভোরের আমেজ;
শ্রাবণমেঘের মনখারাপ সরিয়ে
সাজিয়ে নিলাম চিলতে-রোদ, সংগোপনে!
মনপিয়নের ঝুলি ভ'রে,
রাঙিয়ে দিলাম ধূসর ওই আকাশ-কোণ
শরতের অনুরাগে!
জরা-জীর্ণতার আঁধার সরিয়ে
একটু আলো আসুক এবার, নতুন-রূপে;
মনের স্যাঁতসেঁতে চোরাগলির ঠিকানা হোক
সুদীর্ঘ রাজপথ!
অভিশপ্ত-সময়ের স্বজনহারা কান্নাগুলো
শুষ্ক-দাগে স্থিত হোক স্মৃতির কোলাজে,
নিশ্চুপে!
কাশের দোলায় বাউল বাতাস খুঁজে নিক
প্রভাতী অভ্যর্থনা, আনমনে!!
তুষার কান্তি ভালোবাসা
চন্দন কুমার দাস
মেঘমুক্ত আকাশের মত হৃদয়,
নিখাদ সোনা রোদের মতো ভালোবাসা ;
এমন লাবণ্যময়ীর সংগ আমি চেয়েছিলাম ।
তোমায় অনুভবে চিনেওছিলাম;
এ যেন তুষার কান্তি ভালোবাসা ।
স্পর্শ পাই নি ঠিকই কিন্তু হৃদয় জুড়ে শীতলতা
তুমি যেন তুষারশুভ্র হিমালয় ;
সোনা রোদ মেখে তুমি যখন আমার দিকে চেয়েছিলে -------
আমি তখন উড়ে যাচ্ছি এক ঝাঁক পাখি হয়ে শাপলা শালুকের ফুল,
পদ্মের কুঁড়ি গুলো তখনও হিমেল বাতাসের দোলায় দুলছে।
সবুজ ধানের ক্ষেতে উঠছে হিল্লোল,
কাশ ফুলে ঢাকা বক্ষপট ,বয়ে চলছে স্রোতস্বিনী
মনের অজান্তে কখন অনুচ্চারিত স্বরে বলে উঠলাম --"মা তুমি !"
তারপর ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে
দূর দিগন্ত নীল আকাশে আমি মিলিয়ে গেলাম।
কিন্তুু আমার হৃদয় পড়ে রইল তোমার ধূলার 'পরে
তালপুকুরের সবুজ বিছানো মখমলে।
শরতের মহিমা
কবিতা বণিক
বর্ষা বেলার মেঘ,
জল ভরা কলসে করে পৃথিবীর অভিষেক।
কালো মেঘ, ঘন কালো মেঘ, বজ্র্র মেঘ,
কোদালে মেঘ মাটিকে সরসিত করে তাদের শীতল ধারায়।
সবুজ করবে বলে।।
বর্ষার শেষ বেলায়
বৃষ্টির অঝোর ধারার শেষে ক্লান্ত মেঘ,
আলোর সাথে লুকোচুরি খেলে ছেঁড়া মেঘের দল আকাশের গায়।
অলস মেঘ ভেসে চলে দূর ঠিকানায়।
শরত আসবে বলে।
মেঘেদের খেলা শেষে
শরতের মেঘেরা পাল তোলে আকাশের গায়।
মেঘেদের বড় সাধ মাটিতে নামার, শিউলি-পদ্মের সাথে আলাপচারিতার ।
মেঘেরা মাটিতে নামে যেন কাশের বনে।
দূর্গা আসবে বলে।
পূজোর গন্ধ মেখে
কালো দিঘীর জলে শালুক-পদ্মের খেলা।
সাদা কাশের বনে লাগে দোলা, পথে শিউলি আঁকে আলপনা।
শারদলক্ষীর আগমনে চলে পূজোর ছুটির জল্পনা।
পূজোয় মাতবে বলে।।
আশ্বিনের ডাকে
সুনন্দ মন্ডল
এলো যে শরৎ
আকাশের কোলে, মাটির গায়ে।
ফুটল কাশ
দুলছে দেখো, শিউলির বাঁয়ে।
প্রভাতের রবি
জেগেছে আবার, কালো রাত মুছে।
নীল মেঘ যেন
ছেয়ে গেছে দূরে, দিগন্তের কাছে।
ভাদ্রের নামে
আঁকা আছে, কত আল্পনা মেঝেতে।
আশ্বিনের ডাকে
জেগে ওঠে উমা, বাঙালির খুশিতে।
শরৎ যাপন
অলকানন্দা দে
লক্ষ্মীর ঝাঁপি খুলেছে আকাশ, আয়না দিঘির জল
কী রং দিলে জুতসই হবে বল না শরৎ, বল!
মেঘের গায়ে আঁকবো আমি অবাক মনের ছবি
স্বাক্ষর দেবে মেধাবী রৌদ্র, বনেদি তারা রবি।
বসুন্ধরার খোঁপায় ঘেরা ফোটা শিউলির হার
আলোর নদীতে জীবনযাপন ঘন নীল সংসার।
অলস সরস শিশির মেখে মাটির পথে যাব
নদীটার জলে মন ডুবিয়ে একটু উদাস হব!
দুটো হাত ধরে টানাটানি করে শিশু কিশোর কাশ
জীবনরসে ভরে নাও মন, থাকি না যে বারোমাস।
এই কথা বলে হাসল হঠাৎ বিনিময় করি সুখ
বসুধা বাগানে ফুটেছে শরৎ ভাবনারা উৎসুক।
রসদ এনেছে আধার ভরা বিলোবে দাওয়ায় বসে
ধারাবিবরণী করবে বাতাস প্রাণপণ উল্লাসে।
লক্ষ্মীমন্ত পূবের লালে শারদীয়া ধরে সুর
সম্মোহনে কবিতা লিখি চোখ পাতি বহুদূর!
সম্প্রসারিত নীলাম্বরে গোধূলি-সন্ধ্যা বেয়ে
আশার কথারা নেমে আসে মনে প্রীতি সরোবরে নেয়ে।
মরিয়া আবেগে বায়না করে কানে কানে বলে শোনো
তারায় তারায় জাগ্রত রাতে অথৈ স্বপ্ন বোনো।
আবাদ করো অক্রেয় প্রেম দুর্বার অভিমানে
সোনার আভা প্রত্যয় দেবে অমাবস্যার মনে।
ঋতুর প্রান্তে অমর শরৎ আত্মজীবনী গড়ে
সাধের পৃথিবী খোলা জানালায় মনঃসংযোগে পড়ে।
শ্রেষ্ঠ আমোদে দু-এক চুমুক, পরোপকারী বেলা
রোমন্থনে সবুজ প্রহর বছর ভরের চলা!
সন্ধে তারা
পৌলোমী চক্রবর্তী
সেই সন্ধের কথা
আজও মনে দেয় নাড়া
পূর্ণিমার দিনে চারিদিক স্তব্ধ
নেই কোনো সাড়া
কি অপরূপ সেই মুহূর্ত
পৃথিবী যে এত
সুন্দর হতে পারে
ভাবিনি কখনো তাতো
জোৎস্না ভরা আলোরণ
চারিদিকে নেই কোনো মানুষজন
কলকল শব্দে তিস্তা চলেছে বয়ে
দিশেহারা সঙ্গীহীন হয়ে
চাঁদের আলোয় তোমার
সেই মুখখানি দেখে
মনের উদাসতা
বলছে চোখে
এ যেন আমার
সেই স্বপ্নে ভরা
প্রথম দেখা
সন্ধে তারা।।
ওগো শরৎ সুন্দরী
বিজয় বর্মন
বর্ষা বিনোদনে আমি ভেসে যাই,
তাথৈ ছন্দ মন গহনে,
ছলাত ছলাত জলের ছোঁয়ায়,
ভাঙ্গন ধরিল মনে।
উদাস দেখি আকাশ পানে,
মেঘেদের ডানা মেলি,
বাতাসের সাথে যাই উড়ে যাই,
প্রান্তহীন প্রান্তরে খেলি।
সুপ্ত বাসনায় শ্যামল ও সুন্দর,
শুকনো কাদায় সুবাসিত প্রাণ,
শিউলির কুঁড়ি উঁকি দিয়ে যায়,
কাশবনে বুঝি করিছো আহ্বান।
আকাশ নীলে মেঘের ছবি আঁকা,
পাতায় ফুলে তোমার আগমন,
জানালায় আমি কান পেতে রই,
বোবা সংলাপে তোমাকে স্মরণ।
বাজিবে ঢাক ঢোল, বাজিবে বাদ্দি,
মায়াজালে আবদ্ধ মহামায়া,
জীবন্ত প্রকৃতি, আমি সঙ্গী হব,
মুছে দিয়ে যেও,মহাকালের ছায়া।
শরৎ -উপাখ্যান
দীপ মুখার্জি
ওগো প্রিয়,
হতে পারি আমি তোমার
এই শরতের কাব্যমালা,
হতে পারি তোমার সেই
মনমাতানো নদীর ঢেউ-
হতে পারি আবছা আলোয়
মায়াবী মুখে দাঁড়িয়ে থাকা
তোমার সেই স্বপ্ন পরী।
হতে পারি তোমার সেই প্রিয়
নীলরঙা পাখি কিংবা হতে পারি
রাগ ইমনের সুর।
প্রিয়তম,
মনে আছে- সেই যে একবার
শেষ ভাদ্রের ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে,
সেই নুতুন ব্রিজের ওপর হাতে হাত রেখে
দাঁড়িয়ে থাকা-আলো আঁধারিতে।
না বলা কত কথা তোমার সেই
চোখের চাউনিতে-
ওগো,তোমার আলিঙ্গন স্পর্শে
দেখা না হওয়া সেই অভিমান গুলো যেনো
শরতের প্রথম কুয়াশা হয়ে নেমে আসলো
চোখ জুড়ে।
প্রাণসখা,
চলো না আবার সেই দুজনে মিলে
হারিয়ে যাই শুভ্র কাশের বনে,
চলো না মেঘনৌকোয় ভেসে যাই দুজনে,
সেই যে মনে আছে না..সন্ধ্যা নামা বিকেলে
শান্ত নদীর ধারে বাঁধের ওপর
তোমার আলিঙ্গন,কিংবা
সন্ধ্যা আরতি তে ঠাকুর প্রণামের সময়
টুক করে আমার স্নেহচুম্বন-
এটুকু নিয়েই চলো না আবার শুরু করি
নূতুন ভাবে নুতুন রূপে,
নুতুন কাব্যে ভরিয়ে দেই
আমাদের শরৎ উপাখ্যান।।
শরৎ বিশেষ কথা
রাখিবন্ধন - এক সুখের একতারা
চন্দ্রানী চৌধুরী
সময়ের সাথে সাথে জীবনবৃত্ত একটু একটু করে ঘুরতে থাকে । আর সেইসাথে হৃদয় নিংরানো নানা অনুভূতি মনের গভীরে জমা হয় । স্মৃতির দেরাজ খুলে সুখের একতারা হাতে আজ ফিরে যাব তেমনই এক আলোর দিনে ।
জীবনের বেশ কিছু বছর আমার একটি ছোট্ট শহরে বাস করার সুযোগ হয়েছিল। সেখানকার মানুষের আন্তরিকতা আজও আমার মনকে নাড়া দেয় । আজ বলব সেই শহরের রাখিবন্ধন উৎসবের গল্প।
আমি তখন সেখানে এক বেসরকারী বিদ্যালয়ে শিক্ষিকা ছিলাম । প্রতি বছর রাখি পূর্ণিমার দিন সেখানে এক অপূর্ব আনন্দমুখর অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হত । সমস্ত ছাত্রছাত্রীরা একে অপরের হাতে রাখি পরিয়ে আনন্দ উৎসব পালন করত। সেইসাথে বিদ্যালয়ের সমস্ত শিক্ষক , শিক্ষিকা ও শিক্ষাকর্মীদের হাতে রাখি পরিয়ে প্রণাম করত সমস্ত ছাত্রছাত্রীরা ।
রাখি পূর্ণিমার কদিন আগে থেকেই ছাত্রছাত্রীদের গল্পের বিষয়বস্তু থাকত রাখি । কে কেমন রাখি কিনবে তার আলোচনা চলত পরস্পরের সাথে । তারপর সেই বিশেষ দিনে বন্ধুরা সবাই পরস্পরকে পরম উৎসাহে রাখি পরিয়ে দিত । বিদ্যালয়ে ঢুকতে না ঢুকতেই রাখি পরানোর জন্য ওদের উৎসাহ দেখে এক অদ্ভুত ভালোলাগা তৈরি হত । সবাই নিজের ক্লাসে বসে সুশৃঙ্খলভাবে একে একে এসে আমাদের রাখি পরিয়ে দিত। এতোজনের রাখি পরে আমাদের সবারই দু হাত ভরে যেত । কি যে আনন্দ হত তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। এই আনন্দ উপভোগ করার জন্য প্রতি বছর সেই বিশেষ দিনটির অপেক্ষায় থাকতাম।
সেখানকার আরেকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল । ছাত্রছাত্রীরা বিদ্যালয়ের শিক্ষক শিক্ষিকাদের রাখি পরিয়ে বিদ্যালয় থেকে অনুমতি নিয়ে আশেপাশে কোন অফিস থাকলে সেখানে গিয়ে চেনা-অচেনা সবাইকে রাখি পরিয়ে আসত । এক অপূর্ব পরিবেশ ছিল -রাস্তায় বেরোলেই দেখা যেত সবার হাত ভর্তি রাখি । আনন্দ - হাসি -মজা সবার ঘরে ঘরে ।
দশ বছর হয়ে গেল সেই সুন্দর শহর ছেড়ে চলে এসেছি । তবু মনের মণিকোঠায় সেখানকার রাখি পূর্ণিমা উৎসব জ্বলজ্বল করে । গত বছর থেকে সমস্ত বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে আছে । জানিনা রাখি পূর্ণিমা সেখানে কিভাবে পালন করা হচ্ছে । বুক ভরা আশা নিয়ে আছি জীবনে আর একবার অন্তত পুরোনো বিদ্যালয়ের রাখির উৎসবে যোগদান করে সেই আনন্দের স্বাদ আবারও ফিরে পাব ।
শরৎ ছড়া
ভাদ্র আসে
মুনমুন সরকার
শরতের রঙ মেখে গায়ে
তাল পাকা গরম নিয়ে
আকাশ ঝকঝকে সাদা-নীলে
বিলঝিলে ডুবো-ডুবো জলে
শালুক পাতা জড়িয়ে থাকে
বাঁশবনে ডাহুকেরা ডাকে
নদীর চরে ভরা কাশে
শ্রাবণ পেরিয়ে 'ভাদ্র আসে'||
মেঘের ভেলায় চড়ে
আকাশ রুদ্রমূর্তি ধরে
বাতাস নিজের মতো চলে
রৌদ্র-বৃষ্টি লুকোচুরি খেলে
কখনও ঝরে অবিশ্রান্ত বর্ষণ
ভরায় সৌন্দর্যপিপাসুদের মন
বৃষ্টি ভিজে ঋতুর রানি....
এলো বার্তা নিয়ে আগমনী||
ভাদ্র মাসে মজনু মিয়া
ভাদ্র মাসে তাল পাওয়া যায়
তালে -তালের পিঠা,
চিনি, গুড়ের সাথে চাউল
তালে বাড়ায় মিঠা।
তালে কিন্তু রসও হয় খুব
তালের বড়া খেয়ে,
দুধের সাথে মিলিয়ে নেয়
হাতের কাছে পেয়ে।
যত মজাই হোক খেতে তাল
তালে আছে জ্বালা,
তাল তলাতে গেলে পরে
দিও না চোখে তালা!
ছোটদের শরৎ
অভ্রদীপ ঘোষ