Friday, May 2, 2025


 মুনা 

অনলাইন বৈশাখ  সংখ্যা ১৪৩২

সম্পাদকের কথা 

বাংলা নববর্ষের শুরুতেই যে নারকীয় ঘটনার সাক্ষী হল সারা দেশ, তার কোনও নিন্দা হয় না। আমরা, আপামর ভারতবাসী, শোকার্ত, মর্মাহত, ব্যথিত এবং ক্রুদ্ধ। পৃথিবীর কোনও সভ্যতা, কোনও ধর্ম, কোনও বর্ণ এই হত্যাকাণ্ডের সমর্থন করে না। কোনও ধর্মগ্রন্থে বলা নেই, এইভাবে ধর্ম জিজ্ঞাসা করে হত্যার মধ্যে দিয়ে স্বর্গলাভ হয়। কিন্তু বর্বর সন্ত্রাসবাদীরা সেই বিশ্বাসেই দিনের পর দিন আক্রমণ শানাচ্ছে এই ভারতভূমিতে। সারা পৃথিবীর নিন্দা, প্রতি আক্রমণ কিছুই থামাতে পারছে না তাদের। বিশেষ রাষ্ট্রীয় মদতে তাদের বধ্যভূমি হয়ে উঠেছে আমাদের প্রিয় জন্মভূমি। আমরা এই হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা করছি। দেশের প্রধানের কাছে আবেদন রাখছি, আমরা এর শেষ দেখতে চাই। ধর্মের ভিত্তিতে এই খুন কোনও ভাবেই মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। এই অন্যায় আরও রক্তপাতের জন্ম দেবে বলেই আমাদের মনে হয়। 

একই সঙ্গে আমরা পাশে রয়েছি সেই সমস্ত যোগ্য শিক্ষকদের, যাঁরা এক অদ্ভুত দোলাচলে রয়েছেন। আমাদের প্রার্থনা, তাঁরা দ্রুত স্থায়ী চাকরিতে ফিরে আসুন। পাশাপাশি আমাদের তীব্র ঘৃণা রইল সেই সমস্ত অযোগ্য শিক্ষক ও নিয়োগকারীদের জন্য যারা অবৈধ উপায়ে চাকরি জোগাড় করেছিলেন। আপনাদের কেউ ক্ষমা করবে না। 

বাংলা নববর্ষ এই রকম টানাপোড়েনে শুরু হল। জানিনা আগামী দিন কী রয়েছে। ভাল কিছুর আশায় আমরাও আর সকলের মতো। 

মুজনাইয়ের পাঠক, লেখক ও বন্ধুদের শুভেচ্ছা রইল।   


মুনা 

অনলাইন বৈশাখ  সংখ্যা ১৪৩২



রেজিস্ট্রেশন নম্বর- S0008775 OF 2019-2020

হসপিটাল রোড 

কোচবিহার 

৭৩৬১০১

ইমেল- mujnaisahityopotrika@gmail.com 

প্রকাশক- রীনা সাহা  

সম্পাদনা, প্রচ্ছদ, অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায় 


    এই সংখ্যায় আছেন যাঁরা

বেলা দে, চিত্রা পাল,

শ্যামলেন্দ্র চক্রবর্তী, গৌতমেন্দু নন্দী, রাজর্ষি দত্ত,

জয়তী ব্যানার্জী, বটু কৃষ্ণ হালদার, সঞ্জয় সাহা(এস. সাহা), 

অনিতা নাগ, পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়, মধুপর্ণা বসু,

শুভেন্দু নন্দী, প্রতিভা পাল, কেতকী বসু, মাথুর দাস,

অমিতাভ চক্রবর্ত্তী (অমিত আভা), উৎপলেন্দু পাল , এরশাদ,

অর্পিতা মুখার্জী, জনা বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রাণেশ পাল,

আশুতোষ বর্মন, পাঞ্চালী দে চক্রবর্তী, কবিতা বণিক,

মহঃ সানোয়ার, অলিপ্রভা পাটোয়ারি, মোহিত ব্যাপারী,

মিষ্টু সরকার, রণজিৎ কুমার মুখার্জি, জুলি আখতরী,

মজনু মিয়া, প্রিয়াঙ্কা চক্রবর্তী, কনক চক্রবর্তী


অনলাইন বৈশাখ  সংখ্যা ১৪৩২





 

বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলা নববর্ষ
                                 শ্যামলেন্দ্র চক্রবর্তী

"এভাবেই একক দশক
একেকটা বৈশাখ
রোজকার খোসা ছাড়ানোর জ্বালা ভালোবেসে
একেকটা লাঠি হেঁটে যায় দুর্মর “

পয়লা তারিখে একটু বেলা করে বিছানা ছাড়ার কি উপায় আছে নাকি! নতুন বছরের শুরু বলে কথা। বছরে দুটিই তো জোটে, জানুয়ারীতে একটি, অন্যটি বৈশাখে। একখানি হ্যাংলা, অন্যটি বাংলা। সে সময়ে আয়েসে বিছানা জড়িয়ে তিনি থাকতে দেবেন না। হাঁক শুনেই ঘুমের বারোটা বেজে যেতে কতক্ষণ।
- কী হল কি, নিকষার মেজ ছেলের মতো ঘুমাবে? বচ্ছরকার দিন, এর পরে কিছু থাকবে বাজারে! সারা জীবনটাতো আলু ভাতে কেটে গেল, আজকের দিনে কি একটু মাংস জুটবে না! বাপের বাড়ি ছাড়ার পর থেকে ভালো খাওয়াই তো ভুলে গেছি।

বোঝো কান্ড! দিনটা গেল আজ পয়লায়। আটশো টাকার মাটন আজ হাজারে কাটবে। পকেট তো বামদলের অসময়ের ব্রিগেডের, পনের দিন গেলে সেখানে চামচিকেতে বাসা বাঁধে, সেটা তখন এবানডন্ড এরিয়া। হাত ঢোকাতে কেবল গোপন জায়গা চুলকোলে।  

অগত্যা পুরনো থলেটাকে ঝাড়া দিয়ে, ফতুয়া গলিয়ে দে হাঁটা। যে কটা টাকা আছে একাউন্টে, খালি করেই আসি।

সবের দাম বাড়ছে, ইলেক্ট্রিক থেকে গ্যাস, দুধ থেকে কাজের মাসি, সরকার ধ্যানমগ্ন, শিবনেত্র ।

থলেখানি হাতে তুলতেই মনে পড়ে গেল পংক্তি কটা। কোট আনকোট থাকার মানে কথাগুলি কোনো নামজাদা বড় কবির থেকে ধার করা, তা কিন্তু নয়। যদি কেউ সেরকম ভেবে রাখে তাহলে বড় ভুল হবে। সামান্য লেখোয়ার আমিও, তার মাথা থেকেই কিভাবে বেরিয়ে এসেছিল কে জানে! যদিও তার লেখার কেউ ধার ধারে না, লবিই ক্রিয়াশীল সর্বত্র। লবির আমি লবির তুমি, লবি দিয়ে যায় চেনা ।

আসলে উপলব্ধি ব্যাপারটা নিজস্ব, যাকে বলে ব্যক্তিগত বিষয়। কিন্তু আহ্নিক ও বার্ষিক গতি প্রাকৃতিক এক ফেনোমেনান। বিজ্ঞানী বলবে বিজ্ঞানের কথা, আস্তিক বলবে সব ঈশ্বরের খেলা। পৃথিবী চব্বিশ ঘন্টায় নিজে একবার পাক খাছে, রাত হছে দিন হচ্ছে। খাচ্ছো খাও, কবীর সুমন বলেছিল না -খাঁও খাঁও। তা খাও না বাপু, ওরকম সূর্যের চার পাশে পাক খাওয়ার কি দরকার ছিল! তাতেই তো নববর্ষ আসছে। "খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে, বিরাট শিশু আনমনে।"  তোমার এ খেলায় তো আম বাঙ্গালীর শ্বাস উঠে যাবার যোগাড়।

কে যে কোথায় কোন খেলা খেলে আমআদমীর বোঝা মুশকিল। খেলাও কত রকমের, ইন্ডোর আউটডোর। যেটি বাইরে হয়, তা লোকে দেখে। ইন্ডোর খেলা দেখার সুযোগ নেই দর্শকের। নিজেরা খেলে নিজেরাই দেখে। দিল্লী কা লাড্ডু, যো খায়া ও পস্তায়া ।

চৈত্রের গরম পড়তে না পড়তেই সুপ্রিম আদালত উত্তপ্ত। ছাব্বিশ হাজারের দানাপানি বন্ধ, খেলার গেরোয়। আদালত হচ্ছে গিয়ে সাত্ত্বিক একটি সংস্থা , সারা বছর নিয়ম করে চলে। তার চালের গামলায় দু চারটি মুসুর ডাল পড়লে চলবে কেন! তুমি কেন এই অকম্মটি করেছো। দাও ফেলে সব পুকুরের জলে।

দুর্গা মা যাবার পর থেকে আকাশে শুকনো খটখটে। মেঘের দেখা নাই রে, বৃষ্টির দেখা নাই।

যার পায়ে খেলা আছে, সে তো খেলবেই। খেলা তো একার কারো বাপের না। বৈশাখ এ বছর ইনিংস শুরু করলো এক পক্ষের চোখের জল, আরেক পক্ষের বুক কাঁপুনি দিয়ে।  প্রথমে ভিজলো অভয়ার মা-বাবার চোখ, তারপর রাজপথ। পথ দখল হল, রাত দখল হল। তরমুজ মন্ত্রী বলেন, লাল পাখি পথে এসেছে। তাই কি? নীল সাদা পাখি ছিল না! টিয়া, ময়না- এগুলো কি চুপ মেরে গেছে সেন-গোস্বামী-সরকার-মুখার্জীদের মতো! ওরা দানাপানিতে ঠোঁট ডুবিয়ে উড়তে ভুলে গেছে।

রাজপথ আবার সরগরম। ধর্ণা, অবস্থান, লড়াই। লড়াই লড়াই চাই , লড়াই করে বাঁচতে চাই। কে বাঁচাবে? ঘোর কলি, প্রত্যেকে নিজে বাঁচলে বাপের নাম। ডুবছে মানুষ ওরা সন্তান মোর বিমাতার।  

তাতে কি? আমরা দক্ষিণের ঢেউয়ে আছি, আছি উত্তরের ফেস্টে। রোম পোড়ার পুড়বে, তার জন্যে বেহালার সুর কেটে গেলে আর কি পাওয়া যাবে! তাছাড়া একদিনে যখন সে গড়ে ওঠেনি, একদিনে মরেও যাবে না। যাবে, নিশ্চয়ই যাবে, স্লোলি বাট স্টেডিলি।

একটা চোর ধরতে সাধুগুলিকেও ল্যাঙ্গট খুলতে হল। বেনিফিট অব ডাউট বাইশ গজে আর কাঠগড়ায় আছে। সিভিল কোর্টে সে সব নেই। ফলে হাহাকারের তুলিতে তৈরী হল নববর্ষের চালচিত্র এবারে।

রাজপথ গরম, মরা বাঁচার লড়াই বলে কথা। আগস্ট থেকে সন্তান হারানোর ব্যথা তো ছিলই। রাত দখল, রাস্তা দখল। কিছু হল কি? ঐ ঘাড়ের নাম গর্দান হল। যে ধরা পড়েছিল, সেই ধরা থাকলো। শুধু শুধু সময় নষ্ট। এমন আওয়াজ দিচ্ছিল যেন মেঘ ভাঙ্গা বর্ষণ হবে, যেন মুরগী ফুটবল ডিম পাড়বে। খুন নাকি গণধর্ষণ সেটাই তো চুল্লিতে পুড়ে নাই হয়ে গেল মুরুব্বির উৎসাহে।

সেই আগুনেই ঘি পড়লো যেন। আন্দোলন ঢেউ তুলে দিল সমাজে। অস্থির হল রাজ্য। জ্যোতিবাবু বলেছিলেন না এক কালে, পুলিশ কি রসগোল্লা ছুঁড়বে! তাই বৈশাখ শুরু হল লাঠিতে ও লাথিতে। বাংরেজীতে অনুবাদ করলে বানান তো দুটোর একই।

আগুন ধিকিধিকি ছিলই। পাশের রাস্ট্রে লুট পাটের নমুনা দেখেছি এপারে বসে। মাতৃসমার অন্তর্বাস হাতে নিয়ে কিভাবে উল্লাস করেছে ছাগলগুলো। মুরগী, বালতি, কম্পিউটার - কিছুই বাদ রাখেনি কোলে তুলে নিতে।

এপারেও দেখলাম একই রকম ছবি। কোলে ছাগল তুলে চলে গেল ছেলে ছোকড়ার দল, গরু টেনে নিয়ে গেল। বাবা ছেলে খুন হল হাত ধরাধরি করে। ওয়াকফ আইন নাকি এর কারণ। কত জন এটি পড়েছে , তা নিয়ে একটা সমীক্ষা হওয়া দরকার ছিল বছরের শুরুতেই। কে করবে? কে দেবে কার গোয়ালে ধোঁয়া? পুতুল নাচে মঞ্চ , সূতো পেঁচানো ওস্তাদের আঙ্গুলে।

আমরা এবছর এভাবেই আছি। দুঃখে কান্নায় হাহাকারে। বাজার কিন্তু তার কাজ করেই চলেছে , গতকাল জ্যোতি-আলু এগারো টাকা, তো আজ পনের টাকা। ফড়েরা সদ্ব্যবহার করছে সুযোগের। তিন তলা বাড়ি বানাচ্ছে রাজবাড়ির মতো।

তবে একটা এচিভমেন্ট আছে। মানুষ ও হনুমান জাতির মধ্যে মিসিং লিঙ্কটি খুঁজে পাওয়া গেছে এ বছরের রামের জন্মদিনে। মিস্টার ডারউইন যদি থাকতেন, তিনি খুশি হতেন, নাকি ওপেনআইমারের মতো ফুপিয়ে কাঁদতেন, কে জানে !

 কেলগস কলেজের সভায় মহারাজ ঘোষনা করলেন, শিল্প হবে। হোক বা না হোক, এটা কি কম পাওনা! অন্ততঃ আশায় বাঁচে চাষা।

এমন রুক্ষদিনে প্রেমের জয়গান শুনলে কার না ভালো লাগে। বৈশাখী দোলা দিলেই মন নেচে ওঠে সুরে। সেখানে বয়স ইজ জাস্ট আ নাম্বার। ঘোষে বোসে না হোক, মজুমদারে হলেই বা  ট্রোল কেন বাপু। ওদের সুখেই আমাদের আনন্দ। এরম ভাবলে দোষ কোথায়!

প্রেক্ষিত যেমনই হোক,  নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে রাখলাম। পথ মসৃণ হোক, হোক ফুলে ফলে ঢাকা, সে পথে আমরাও গড়িয়ে যেন দিতে পারি চাকা । 



 স্বর্গ থেকে নরকে----- 

গৌতমেন্দু নন্দী


উপত্যকার সবুজ জুড়ে বন পাহাড়ের দেশে 

    আকাশ থেকে স্বর্গ নেমে সমতলে মেশে।
  
    ফার,পাইনের মাথা ছুঁয়ে তুষার মুকুট প'রে
    পিরপঞ্জাল পাহাড় শ্রেণী স্বর্গ যেন গড়ে।
 
     মাটির বুকে তৃণভূমির সবুজ গালিচায় 
    শুয়ে বসে ওঁরা যেন স্বর্গকেই আজ পায়।

     পাইন ঘেরা সবুজ ভূমি উপত্যকার বৃত্ত 
     রৌদ্রস্নাত হয়ে সে এক স্বর্গরূপের চিত্র ।

   জিঘাংসা-লাল রক্ত চোখ কাপড় ঢাকা মুখে
   হঠাৎ তারা আনলো আঁধার উপত্যকার বুকে।

      ধর্মের বিভাজন আর বিদ্বেষ হাতিয়ারে
   হানলো তারা আঘাত আজ ভূ স্বর্গের দ্বারে।

       মানুষ নয়, রক্তাক্ত হোল মানবতা
  মৌলবাদের হুংকারে নামল নীরবতা।


 

ধর্মীয় গোঁড়ামি প্রসঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের ছবি 
রাজর্ষি দত্ত 

বিশ্ববরেণ্য পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের ভাবনা ও মনন তাঁর বিভিন্ন ছবিতে ফুটে উঠেছে সার্থকভাবে। তাঁর উচ্চবংশীয় রক্ত, শিক্ষা ও ব্যক্তিত্ব কখনই উচ্চকিতভাবে কিছু আরোপ করে না - কিন্তু সিনেমার ভাষায় জোরালো বক্তব্যটির কোন খামতি বা স্বচ্ছতার অভাব ঘটেনি। এবং আশ্চর্যজনক ভাবে শিল্পের শর্তকে অক্ষুণ্ন রেখে!

আমরা যে সময়ের মধ্যে দিয়ে চলছি তাতে ব্যবহারিক ও মনস্তাত্বিক জগতে সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ, রাজনীতি, ধর্মরাজ্য, কালচার - এই ধরণের বিবিধ শব্দের শ্রবণ ও প্রয়োগে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। সম বিষয়কে মাথায় রেখে সত্যজিতের চিন্তাধারাকে, তাঁর কাজের মাধ্যমে বিশ্লেষণের অক্ষম প্রয়াস করা যেতেই পারে। শুরু করা যাক শেষ ছবি 'আগন্তুক' থেকে। একটি দৃশ্যে মনমোহন প্রশ্নের উত্তরে জানান- "যে জিনিস মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে, তাকে আমি মানি না, Religion এটা করেই, আর Organised Religion তো বটেই, সেই একই কারণে আমি জাতও মানি না।...."
যেহেতু আগন্তুক ছবির গল্প, চিত্রনাট্য সবটাই পরিচালকের, তাই এইভাবে তিনি মনমোহনের মুখ দিয়ে নিজের মত ও বিশ্বাসকে পেশ করেছেন - এ কথা অনেকেই বলেন!
আবার অন্যের লেখা গল্প নিয়ে ফিল্ম বানাতে গিয়ে তিনি বেছে নিয়েছেন এমন কিছু কাহিনী যা ধর্মীয় গোঁড়ামির উপর তীব্র কষাঘাত করে। যেমন 'দেবী'। মানুষের কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস নিয়ে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের গল্পটিকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গেলেন সত্যজিৎ রায়। বৃদ্ধ কালীকিঙ্কর - কে মাত্র দোষারোপ না করে ঊনবিংশ শতকের পটভূমিকায় দাঁড়িয়ে চরিত্রের কালী প্রীতির সুতীব্র বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করলেন। যার প্রভাবে শ্বশুরমশাই-এর স্বপ্নাদেশ প্রথমে না মানতে পারলেও পরে নায়িকা নিজেকেও দেবী রূপে বিশ্বাস করে ফেলেন। ধর্মের এই প্রভাবকে চূড়ান্ত আখ্যা দিয়ে সত্যজিৎ এক সাক্ষাতকারে বলেন " I once made a film Debi, the goddess. It dealt with religious dogmatism. It didn't attack religion as such - it attacked dogmatism - the extreme form of religion..." আর এই "extreme form" টাই এখন সারা বিশ্বে জনপ্রিয়। এতে করেই দেশনায়করা জনগণের বরমালা পান। মনে হয় সবদেশের মানুষই আসলে উত্তেজনা ভালবাসে। একপেশে, জমকালো বিবর্জিত, মূল্যবোধে আবর্তিত, সরলরৈখিক জীবন বোধহয় কিছু অ-প্রকৃত সংখ্যালঘুদের মধ্যে বর্তায় - বেশিরভাগের নয়।মহাপুরুষ ছবিটি সংস্কারচ্ছন্নতার বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিবাদ। ধর্মকে আশ্রয় করে ভন্ডামি এবং ধুরন্ধর ধর্মগুরুদের ব্যবসার জাল মানুষকে কিভাবে সম্মোহিত করে, রাজশেখর বসুর লেখা অবলম্বনে সিনেমাটি তারই জ্বলন্ত উদাহরণ। একই পুনরাবৃত্তি দেখা যায় ' জয় বাবা ফেলুনাথ ' - এ মছলি বাবাজির মুখোশ খুলে ফেলায় - রহস্য উন্মোচনের মোড়কে। 

কিন্তু এইসব ছায়াছবিগুলিতে ধর্মের সাথে রাজনীতি জড়ায় নি, যা এসে পড়ে 'গণশত্রু'  চলচ্চিত্রে। ধর্মের সথে ব্যবসা আর সেই ব্যবসায় রাজনীতি কিভাবে প্রভাব বিস্তার করে এবং একজন যুক্তিবাদী চিকিৎসককে কিভাবে কোণঠাসা করে দিতে পারে সমাজে এই ছবি টা প্রমাণ। ইবসেনের নাটক "An enemy of the people" - এর বাংলা সংস্করনে মন্দির প্রাঙ্গণে জীবাণুযুক্ত sacred চরণামৃত গ্রহণে ভক্ত সাধারণ মানুষের জন্য হিতকর্মটি আদপে কোন কাজে লাগে না।

জ্ঞানের আলোকে কুসংস্কার হয়তো অনেকটা দূর হয়েছে কিন্তু সেই শিক্ষা যা ধর্মীয় গোঁড়ামির পরিপন্থী, সেটা আজকের দিনে বড়ই অভাব। সমাজের উচ্চশিক্ষিত মানুষের মধ্যেই এর অভাব দেখা যাচ্ছে। আসলে বিজ্ঞানের প্রভাব একশ দেড়শো বছরের বেশি নয়, কিন্তু বাল্যকাল থেকে শিখে আসা সামাজিক রীতিনীতির বয়স হাজার বা দু হাজার। তাই বিজ্ঞানচেতনার উপর ভরসা কম - ছাপিয়ে যায় প্রাচীন ভাবধারা। তাই বিপ্লবী হয় ওঠেন না কেউ। আন্দোলন কিছুটা এগিয়েও থেমে যায়।

এই বর্তমানে দাঁড়িয়ে মানুষের বিবেক জাগ্রত করা ও কোন গোঁড়ামিকে প্রশ্রয় না দেওয়ার জন্য উল্লেখিত ছবিগুলি যেমন দেখা প্রয়োজন তেমনি মহাপুরুষ বা গণশত্রুর মত সিনেমাও তৈরি হয় দরকার।

যদিও একটি সিনেমা জনমানস তথা সমাজকে রাতারাতি পরিবর্তন করে ফেলতে পারে একথা কখনই ভাবতেন না প্রসিদ্ধ পরিচালক সত্যজিৎ রায়।


 

আজও অপেক্ষিত ছড়াসম্রাট ভবানীপ্রসাদ মজুমদার
(বিবৃতির অনুপ্রেরণায় উত্তরে কবির জন্মদিন।
কবির ছাড়ায় মানব সত্তার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে শিশু চেতনার বিকাশ)
 সঞ্জয় সাহা(এস. সাহা)

“এক দুর্গা রিক্সা চালায় কুচবিহারের হাটে
এক দুর্গা একশো দিনের কাজে মাটি কাটে।
এক দুর্গা রাস্তা বানায় পিচ ও পাথর ঢালে
এক দুর্গা রোজ চুনো মাছ ধরছে বিলে-খালে।
এক দুর্গা করছে মাঠে দিনমজুরের কাজ
এক দুর্গা খিদেয় কাঁদে, পায়নি খেতে আজ।
সবাই জানি, এদের কারো হয় না কোনও পূজো
এরা তো মা তোমার মতো নয়কো দশভুজো।
সব দুর্গার চোখে-মুখেই ফুটবে হাসি কবে?
মাগো, তোমার পুজো সেদিন সত্যি সফল হবে।”

কবির দরদি মনের পরিচয় এবং বাস্তব জীবনের অসাধারণ পর্যবেক্ষণ কবিতাটিতে ধরা পড়েছে। আমরা মৃত্তিকার দুর্গা বানিয়ে পুজো অর্চনা করি, কিন্তু প্রকৃত রক্তমাংসের দুর্গারা হয় অবহেলিত উপেক্ষিত। এই কবিতার মধ্য দিয়ে তিনি সমাজকে জাগাতে চেয়েছেন। 

বাংলা ছড়ার জগতে যার অবদান কোনোদিনই ভোলা যায় না, তিনি হলেন ভবানীপ্রসাদ মজুমদার। নিপাট মাটির মানুষ, খুব আন্তরিক, খুব কাছের সকলেরই আপনজন। শিশু-কিশোর থেকে বড়রাও তাঁর ছড়ায় মুগ্ধ না হয়ে পারত না। বিভিন্ন পূজা মণ্ডপে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মুখে মুখে আবৃত্তি হত তাঁর ছড়া। শিশু মনস্তত্ত্বের উপর এতটা বেশি প্রভাব তিনি ফেলতে পেরেছিলেন। কিন্তু সেই মহান মানুষটি বাংলা সাহিত্যে উপেক্ষিত রয়ে গেলেন। তার মৃত্যুর পরেও তাকে নিয়ে বাংলা সাহিত্যিকদের মধ্যে দেখা গেল না উত্তর থেকে দক্ষিণ কোন বঙ্গেই কোন উদ্দীপনা। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি বাংলা সাহিত্যে উপেক্ষিতই থেকে গেলেন। মরণোত্তরও তাঁকে দেওয়া হয়নি কোন সরকারি সম্মান। কোনো ছড়া স্থান পায়নি শিশুদের পাঠ্যপুস্তকে। একমাত্র সত্যজিৎ রায়ের হাতে সম্মানিত হয়েছিলেন 'সন্দেশ' পত্রিকার পক্ষ থেকে "সুকুমার রায় স্মৃতি" পুরস্কার। এছাড়া আর তাঁর ভাগ্যে জোটে নি কোন সরকারি সম্মান। এই মহান ব্যক্তিটিকে সসম্মানে বাংলা সাহিত্যে তাঁর অবদানের কথা তুলে ধরতে এবং বাংলা সাহিত্যে তাঁর প্রতিভাকে মূল্য দিতে উদ্যোগী হয়েছেন উত্তরবঙ্গের 'বিবৃতি' সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক মাননীয় দেবাশিস দাস মহাশয়। মাননীয় দেবাশীষ দাস মহাশয়ের অনুপ্রেরণায় উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের  জন্মদিন যথা মর্যাদা সহিত পালিত হয়। তারই অনুপ্রেরণায়  বিপুল আচার্য সম্পাদিত 'শব্দ' পত্রিকার উদ্যোগে দিনহাটা'র বয়েজ রিক্রিয়েশন ক্লাবে অনুষ্ঠিত হয় বিশিষ্ট কবি ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের জন্ম দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন অনুষ্ঠান। তারই প্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়ে আলিপুরদুয়ার টংঘর ও লোকমানস সাহিত্য পত্রিকার উদ্যোগে কবি মিহির দে'র বাড়িতে অনারম্বরে হলেও আন্তরিক ভাবে উদযাপিত হয় কবি ছড়াকার ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের জন্মদিন। তবে মূল অনুষ্ঠানটি অনুষ্ঠিত হয় মাথাভাঙায়। মাথাভাঙ্গা রেবতী রমন সেবা সদন গ্রন্থাগারে গত ০৯/০৪/২০২৫ তারিখ বিকেল পাঁচটায় আন্তরিক ভাবে উদযাপিত হয় কবি ও ছড়াকার ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের জন্মদিন।  উত্তরবঙ্গের বিশিষ্ট সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, কবি ও ছড়াকার আলোচনা করেন ছড়াসম্রাট ভবানীপ্রসাদ মজুমদার সম্পর্কে। তারপর চলে কবিতা পাঠের আসর। বাচিক শিল্পী হিরন্ময় দাস ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের মজার মজার ছড়া পরিবেশন করে স্রোতাদের মুগ্ধ করেছেন। প্রাবন্ধিক রাজর্ষি বিশ্বাসের আলোচনায় উঠে আসে কবি ভবানীপ্রসাদ মজুমদার এর নানা দিকগুলি। তারই বক্তব্যে আরও প্রকাশ পায় যে তিনি আজ পর্যন্ত একটিও সরকারি পুরস্কারে ভূষিত হননি, এমনকি মরণোত্তরও তাঁকে কোনো পুরস্কারে ভূষিত করা হয়নি। বিশিষ্ট ছড়াকার কবি মলয় দত্তের বক্তব্যে ফুটে ওঠে সম্প্রতি  বাংলা ভাষার করুন অবস্থার কথা। তিনি কবি ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের ভাষায় বলে ওঠেন 'বাংলাটা ঠিক আজ আমার আসে না।'

একই মঞ্চে প্রকাশিত হয় কবি সঞ্জয় সাহার 'আঁকশি' কাব্যগ্রন্থটি। রেবতী রমন সেবা সদনের সভাপতি শ্রদ্ধেয় ব্রজগোপাল সাহার কন্ঠে ভেসে উঠলো তাঁর সময়কার বিভিন্ন ছড়ার সংলাপ ও ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের নানা প্রসঙ্গ। আমরা সকলেই মুগ্ধ হলাম ছড়াকার সুনীল সাহার ছড়ার পাঠ শুনে। সমগ্র অনুষ্ঠানটি সুন্দরভাবে সঞ্চালনা  করেছেন কবি রীতা মোদক মহাশয়া।

ভবানীপ্রসাদ জন্মগ্রহণ করেছিলেন হাওড়া জেলার জগাছা থানার অন্তর্গত দাশনগরের কাছে দক্ষিণ শানপুর গ্রামে ১৯৫০ সালে। প্রয়াত হয়েছেন ৭ই ফেব্রুয়ারি ২০২৪। তাঁর পিতা ছিলেন নারায়ণচন্দ্র মজুমদার এবং মাতা নিরুপমা দেবী। কবির শৈশব জীবন তাঁর গ্রামেই কেটেছিল। পেশায় ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান শিক্ষক। কর্মস্থল ছিল হাওড়া জেলার শানপুর গ্রামের কালিতলা প্রথমিক বিদ্যালয়। পরে তিনি এই বিদ্যালয়টিরই প্রধান শিক্ষকের পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন।

  প্রধানত ছোটদের উপযোগী মজার মজার ছড়া-কবিতা লেখায় তাঁর জুড়ি ছিল না। তাঁর প্রকাশিত ছড়ার সংখ্যা কুড়ি হাজারেরও বেশি। ছড়া নিয়ে নিরন্তর নানান রকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করতে ভালোবাসতেন। তাঁর ছন্দে পর্বমিল ও অন্ত্যমিলের  ব্যবহার, চলিত-সাধুরীতির শব্দগুচ্ছকে একইসঙ্গে বসানো, ছড়ার শরীর বেয়ে নির্মল হাস্যরসের প্রবাহ, ভাব-ভাষায় শ্লেষ-ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ ও প্রতিবাদের আমদানি, কল্পনা ও বাস্তবতাকে তুলে আনা সবকিছুতেই শিশুমন মুক্তি পেত। ২০১৮ সালে একবার তোর্সা সাহিত্য পত্রিকার উদ্যোগে লিটিল ম্যাগাজিন মেলায় প্রধান অতিথি হিসেবে কোচবিহারে এসেছিলেন। এখানে এসেও তিনি কোচবিহার নিয়ে ছড়া লিখে ফেলেছিলেন,  "কোচবিহারের রাজার ছিল একটা কালো হাতি, 
যখন তখন সেই হাতিটাই করতো মাতামাতি।"
তিনি বলতেন, একবার ছড়ার জগতে প্রবেশ করতে পারলে শিশু থেকে বৃদ্ধ সকলেরই আত্ম উন্মোচন ঘটে। আনন্দের উৎস মুখ খুলে যায়। প্রকৃতি নিজস্ব ছন্দের মতোই অক্ষর,বর্ণ,শব্দ আপন খেলায় নৃত্যেরত। সেই নাচের তালটিকে ধ্বনির মধ্য দিয়ে আয়ত্ত করাই ছড়াকারের মূল কাজ।  এই কবিকে আমরা কোনোদিন ভুলতে পারব না।দেশে-বিদেশে যেখানেই বাংলা ভাষাভাষী মানুষ বাস করেন, ভবানীপ্রসাদ তাদের কাছেই পরম আপনজন হয়ে থাকবেন। এই উদ্যোগই হয়তো নিয়েছেন বিবৃতি পত্রিকার সম্পাদক দেবাশিস দাস মহাশয়। আমাদের শৈশব,আমাদের প্রতিবাদ, আমাদের মানব দরদি মন তাঁর ছড়ায় উদ্ভাসিত হোক, তেমনি আমাদের শিশুরাও তাঁর ছড়ার কাছে নিজেদের খুঁজে পাক । মানব সত্তার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে চেতনার বিকাশও নানাভাবে সহায়তা হোক। আর তিনি চিরদিন বেঁচে থাকুন বর্তমান প্রজন্মের প্রতিটি শিশুর মনে।


 

এ কেমন নববর্ষ 

জয়তী ব্যানার্জী 


প্রিয় বন্ধু 
           চারিদিকে অশান্ত বাতাবরণ ,অস্থির পরিবেশ মনটাও বড্ড খারাপ। এই জন্যই তো কালি কলম এক করে বসলাম, রবি ঠাকুর তোমায় একটা চিঠি লিখব বলে। 
তুমি বলেছিলে ,
      "ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই 
      ছোট সে তরী "
                 কিন্তু সত্যিই কি কবিগুরু আর ঠাঁই হলো না। আমরা কি এতটাই বোঝা হয়ে গেলাম ? কিছুই যে বুঝতে পারি না গো। মনটা বড় অস্থির কিন্তু প্রকৃতি তো বসে থাকে না। কোকিলের কুহুতানে আকাশ বাতাস ধ্বনিত হয়, বাসন্তিক দুর্গোৎসবের বাজনা দূর হতে দূরে মিলিয়ে যায়। যেখানে অঞ্জনা নদী তীরে খঞ্জনী হাতে নিয়ে পথ চেয়ে বৃদ্ধা বসে থাকে । কবি তুমি তো পারো, কালবৈশাখীর উড়ো হাওয়ায় সবকিছুকে উলটপালট করে দিতে। বাউল বাতাসরুপী ঝড় কে আলিঙ্গন করে তোমার স্নিগ্ধ লালায়িত কলমের আঁচড়ে বেঁধে দিতে। তাহলেই বোধ হয় সাতমহলার স্বপ্নপুরীর হাজার বাতি নিভে যাবে, চারিদিক আলোর রোশনাইতে ভরে যাবে। 
মুক্তকণ্ঠে যদি আরও একবার গেয়ে ওঠো, 
     'আমার মুক্তি আলোয় আলোয়'......
       তবে তো বন্ধু পৃথিবী বোধহয় শান্ত হবে ।প্রকৃতির নিয়মে আমরা যে পথযাত্রায় শামিল হই, সেখানে তো বারো মাসে তেরো পার্বণের ভিড়ে ঠাই পাওয়া ভার। চরক শেষে ছেলের দলের ঢাক- ঢোল নিয়ে নগর সংকীর্তন আজও যেন কানে আসে,
      আহা কি আনন্দ 
             আকাশে বাতাসে 
     শাখে শাখে পাখি ডাকে 
         কত শোভা চারিপাশে
                কিন্তু সেই মহানন্দের দিনে আমরা কি আনন্দে শামিল হতে পারছি ?পারছিনা ।কবি আজ আমরা দ্বিধাগ্রস্ত ।পায়ের তলার শক্ত মাটি ও বোধহয় নড়বড়ে ।
কিন্তু ,
কিন্তু কেন ,এমন দৈন্যদশা? বাসন্তিক কুহুতান কে বিদায় দেওয়ার আগেই প্রকৃতি যেন তৈরি হয়েছিল নববর্ষকে বরণ করবার জন্য। কিন্তু সে বোধ হয় প্রস্তুত নয় ।
       কিন্তু বন্ধু এমন তো হওয়ার কথা ছিল না ।যে মাটিতে জন্ম নেয় সীতা ,সাবিত্রী ;
যে মাটি ধন্য মাতঙ্গিনী, প্রীতিলতার রক্তে; 
যে মাটিতে অন্যায় সমাজের বিরুদ্ধে রাজনন্দিনী জেহাদ ঘোষণা করে ;
            সেই মাটিতেই তো শরৎ বাবু র সাবিত্রী চৌকাঠের ওপারে থেকেও নিজের অস্তিত্বকে জানান দেয়। কেন তোমার সন্দীপ ;তোমার গোড়া ----এরা কি পারে না অসির বদলে মসী হয়ে সমাজকে রক্ষা করতে? মাকে রক্ষা করতে তোমার বীরপুরুষ ছেলে যেমন ঘোড়া ছুটিয়ে যায়, ঠিক তেমনি মিনিও তো খুঁজে পায় আরেক পিতৃস্নেহ সেই ঊষর মরুপ্রান্তরের কাবুলিওয়ালার মধ্যে। তাহলে কবি ____
তুমি ই বলো, তুমি বলে দাও---- আমরা কি হারিয়ে যাব? নাকি হেরে যাব এই নৃশংস অত্যাচারিত সমাজের কাছে। তা তো হতে পারে না। তুমিই তো শিখিয়েছো জীবনের জয় গান গাইতে। তোমার হাত ধরেই তো শিখেছি, 
      "সংকটেরও বিহ্বলতায় হয়ো না ম্রিয়মাণ"
              সত্যিই কবি আজ তুমি বহুদূরে ।আমাদের নাগালের বাইরে ,কিন্তু তুমি আজও আছো। তুমি আছো বলেই তো পোস্টমাস্টারের নৌকো পালে বাতাস লাগিয়ে পৎ পৎ করে বয়ে যায় ।আর রতন নদী পাড়ে বসে ভাবে," পালে যখন বাতাস লাগিল মনে হইল এই পৃথিবীতে কে কাহার "...কিন্তু আমাদের ছোট্ট রবির সাথে আজও কিন্তু নতুন বছরের স্বপ্ন দেখি আমরা। আর বলি বা দুলে দুলে পড়িও, 'জল পড়ে পাতা নড়ে'। 
      মনটা বড় ভারাক্রান্ত ..তাই আজ লিখতে বসে অনেক কথা লিখে ফেললাম। আমি জানি, তুমি যে আমাদেরই লোক, তাই তুমি শুনবে ।শিলং পাহাড়ে আজও যে বন্যা বসে আছে তোমার পথ চেয়ে ।তুমি কি কেবলই ছবি ____না তাতো হতে পারে না। এই কলঙ্কিত সমাজের চাবিকাঠি আমরা তোমার কাছেই ফিরে পাব কবি ।তুমি ফিরে এসো ।তোমার জৈবিক সত্ত্বাই আবার জানান দেবে ,
      "ওই মহামানব আসে 
         দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে".. 
        তবেই তো আমরাও শান্ত হব ।নতুন কিশলয় নতুন বছরকে করবে আলিঙ্গন ।দেখা হবে তোমায় আমায় ওই মিলনের পারে। 
     ভালো থেকো কবি ।আর ভালো রেখো আমাদেরকেও।


 

প্রিয় লোক উৎসব পয়লা বৈশাখ একলা হয়ে যাচ্ছে
বটু কৃষ্ণ হালদার

"বছর শেষে ঝরা পাতা বলল উড়ে এসে/একটি বছর পেরিয়ে গেল হওয়ার সাথে ভেসে/নতুন বছর আসছে তাকে যত্ন করে রেখো/স্বপ্নগুলো সত্যি করে খুব ভালো থেকো"আবার একটা বছর হয়ে গেল শেষ। চারদিকে উদাসী মন পাগল করা হাওয়া বোধহয় বুঝিয়ে দেয় -- এখন চৈত্র মাস। শুকনো পাতা উড়িয়ে, ধূলো ছড়িয়ে, পুরোনোক সরিয়ে নতুনের আবাহনে তাই মাতোয়ারা চৈত্র মাস।

সেকারণেই বোধহয় সঠিকভাবেই কবি লিখেছিলেন,-- " সেদিন চৈত্র মাস, তোমার চোখে দেখেছিলেম আমার সর্বনাশ।
চৈত্র মাসে বের হয় , গাজনের সঙ। ঢাকের বাদ্যির সাথে সাথে শিব পার্বতীর নাচ, হনুমানের লম্ফঝম্ফ, মুন্ডমালিনী কালিকার ভয়াল মূর্তিসহ শোভাযাত্রা আরও কত কী। এমাসের কল্যানে আছে, সিদ্ধি,ভাঙ, গাঁজা, আফিমের নেশার মৌতাতে বুঁদ হয়ে থাকার ঢালাও ব্যবস্থা। অবশ্য বাঘছাল পরিহিত ভোলে বাবার ঐ ব্যাকডেটেড ফর্মুলার নেশা এখন একেবারেই অচল। বরং বিশ্বায়নের কল্যানে মুক্ত বানিজ্যের ছত্রছায়ায় প্রদান করে নিয়েছে, চরস,ড্রাগস,ব্রাউন সুগার,হাসিস আর সর্বকালের প্রাণহরা সোমরস " বিপিনবাবুর কারণ সুধা।
তবুও আসে চৈত্র মাস, আসে চৈত্র সেলের বাজার, বাজে গাজনের ঢ্যাম কুড়াকুড় বাদ্যি, চলে গাজনের সঙ। মন আনচান করা এলোমেলো হাওয়ায় গাছের পুরোনো পাতা ঝরিয়ে চৈত্রমাস ঘোষণা করে নতুন বছরের আগমন বার্তা। পুরোনোকে সরিয়ে তবেই তো জায়গা নেবে নতুন।
কবি অক্ষয়কুমার বড়াল 'নববর্ষে' কবিতায় লিখছেন, "সমীর শিহরে; বিহগ কুহরে;/তটিনী সুধীরে পড়িছে লুটে।/আকাশের ভালে মেঘের আড়ালে/সোনামুখী উষা উঠিছে ফুটে।" বলছেন কুসুম-সাজে সেজেছে ধরণী; চারিদিকে গান, হাসি, কাছে আসা-আসি; বর্ষ ঘুরে যায়, ধরা ঘুরে আসে --- কিন্তু হৃদয় কি ঘুরবে না? নববর্ষের কাছে মানুষের অসীম আশা; নববর্ষকে কেন্দ্র করেই উজ্জীবিত হতে চায়; নববর্ষ নামক এক সন্ধিক্ষণে মনোবীণায় বাঁধতে চায় নতুন তার। কিন্তু নববর্ষ তো আর অতীতকে অপনোদন করে নয়।অতীতের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার ধারাবাহিকতা নিয়েই বর্ষ-বরণ! মধুসূদন যতই লিখুন, "ভূত-রূপ সিন্ধুজলে গড়ায়ে পড়িল বৎসর"; মন মানে না, অতীত দিনের ভুলের ফর্দ যে আমাদের কুঁড়ে কুঁড়ে খায়! এখনও যদি অতীতচারী না হই; নিজের, সমাজের, রাষ্ট্রের কৃতকর্মের অন্যায় সংশোধন না করি তবে আগামীর নববর্ষ আমাদের ক্ষমা করবে না। সমৃদ্ধ ভারত, কুশল-রাজ্য যদি নির্মাণ করতে হয় তবে অতীত-চারণ করতেই হবে। নববর্ষের আনন্দবার্তার মাঝে তাই ফেলে আসা দিনগুলির ত্রুটি স্বীকার করে সজাগ মতদান করতে হবে। এই নববর্ষ তাই পঞ্চায়েত নির্বাচনে ত্রুটি অপনোদনের যথার্থ মরশুম হয়ে উঠুক। অবশ্য পূর্বের সদর্থক আনন্দ-রসও যেন ঢেলে নিতে পারি নতুন পাত্রে -- "কাল যে কুসুম পড়বে ঝরে/তাদের কাছে নিস গো ভরে/ওই বছরের শেষের মধু/এই বছরের মৌচাকেতে।" তোমার সদর্থক যে আশা-প্রেরণা আছে, তা আমায় দাও। বাংলায় যতটুকু আলো এখনো আছে, নিবে গিয়ে অন্ধকারে বাঙ্গালির গৃহ আবৃত হবার আগেই সেই বাতিতে নতুন তেল আর উসকো কাঠি দিয়ে আলোকিত করার নামই হোক নববর্ষ। বাঙ্গালির বর্ষপঞ্জিতে সনাতনী-সংস্কৃতির মেলবন্ধনের দিন হয়ে উঠুক বর্ষবরণ, হিন্দুর মিলন মেলা।

নববর্ষ উৎসব বাংলার গ্রাম্য জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এ দিনটিকে ঘিরে গ্রাম বাংলার সাধারণ মানুষের উদ্দীপনা,উন্মাদনার শেষ থাকেনা। নববর্ষের আগে তারা ঘরবাড়ি ব্যবহার্য সামগ্রী সমস্ত কিছু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে। শুধু তাই নয় কৃষিভিত্তিক বাংলার কাছে এই দিন টা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, কারণ পহেলা বৈশাখের ভোরের বেলা গৃহস্থের কর্তারা নিজ নিজ চাষের জমি, বাস্তুভিটা তে খড়ের আঁটি দিয়ে আগুন জ্বালায়। এই দিনে বাঙালির ঘরে ঘরে শিল নোড়া দিয়ে নিমপাতা ও কাঁচা হলুদ বাটা হয়। তারপর সেই মিশ্রণে একটু সরিষার তেল দিয়ে সবার প্রথমে মাখানো হয় বাড়ির গরু,ছাগল সহ নানান গৃহপালিত পশুকে। তাদেরকে নদীতে কিংবা বাঁধে নিয়ে গিয়ে স্নান করানো হয়। এরপর বাড়ির ছোটরা সমস্ত বড়দের পায়ে সেই মিশ্রণ দিয়ে আশীর্বাদ নেন। এই প্রাচীন রীতিনীতি বাঙালি সমাজে বহু যুগ ধরে চলে আসছে। তবে ইদানিং এইসব রীতিনীতি জনপ্রিয়তা ধীরে ধীরে কমে আসছে। সকালে স্নান সেরে সবাই পবিত্র হয়। সাধ্যমত নতুন বস্ত্র পরার চেষ্টা করে বাঙালিরা। নববর্ষের টানে ঘরে ফিরে আসে বাইরে থাকা সন্তানরা, আগমন ঘটে আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধবদের। এই দিন বাঙালির ঘরে ঘরে নানান পদের সমাহারে একে অপরের সঙ্গে নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় চলে।
নববর্ষকে উৎসব মুখর করে তোলে বৈশাখী মেলা। বিভিন্ন জায়গায় এই মেলার মাধ্যমে বৈশাখী উৎসবকে পালন করা হয়ে থাকে।স্থানীয় কৃষিজাত দ্রব্য কারুপণ্য লোকশিল্প জাতীয় পণ্য কুটির শিল্পজাত সামগ্রীর হস্তশিল্প সামগ্রী এই মেলার বিশেষ আকর্ষন। আবার কোথাও কোথাও এই মেলায় গ্রাম বাংলার হারিয়ে যাওয়া প্রাচীন সভ্যতা সংস্কৃতি যেমন _যাত্রা পালা গান,কবি গান,জারি গান,গাজন গান,লোকসংগীত,বাউল সংগীত, ভাটিয়ালি গান পরিবেশন করা হয়ে থাকে।আবার লায়লা মজনু,ইউসুফ জুলেখা,রাধাকৃষ্ণের,মতো প্রভৃতি আখ্যান উপস্থাপিত করা হয় কোথাও কোথাও। আবার কোথাও চলচ্চিত্র প্রদর্শনী,নাটক, পুতুল নাচ,নাগরদোলা,সার্কাস ইত্যাদি মেলার বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে।তাছাড়া শিশু-কিশোরদের জন্য বিশেষ আকর্ষণ ছিল "বায়স্কোপ"। বর্তমান সমাজে এই বাইস্কোপ একেবারে হারিয়ে যাওয়া সংস্কৃতি হয়ে উঠেছে। তবুও এসবের কারণ এই বৈশাখী মেলাকে বাঙালি সমাজের আনন্দঘন লোক সংস্কৃতির ধারক ও বলা হয়।
সত্যি সেলুকাস কি বিচিত্র এই দেশ। ভারতবর্ষে প্রবেশ করার পর বিভিন্ন বৈচিত্র দেখে তার সেনাপতি সেলুকাসের উদ্দেশ্যেই এই উক্তি করেছিলেন সম্রাট আলেকজান্ডার। উক্তিটি তৎকালীন সময়ে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তবে এই উক্তির সত্যতা নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন ওঠে।আসল সত্য হলো গ্রীক ভাষায় আলেকজান্ডারের সেনাপতি সেলুকাসকে কি বলেছিলেন সেটি পরিষ্কারভাবে জানা যায়নি।সম্ভবত দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের লেখা "চন্দ্রগুপ্ত" নামক নাটকে আলেকজান্ডারের আবেগঘন অনুভূতি র মুহূর্তটি সম্পর্কে লিখেছিলেন, সত্যি সেলুকাস কি বিচিত্র দেশ এই উক্তিটি। ভিন্ন ভাষাভাষী সংস্কৃতির মিলনক্ষেত্র হল পবিত্র ভারত ভূমি। ভিন্ন ভাষা সংস্কৃতির দেশে প্রতি মাসে কোন না কোন উৎসবে মেতে ওঠেন দেশবাসী। সেই বৈচিত্র্যময় দেশে বাঙালি সমাজ হলো এক অতি প্রিয় জনজাতি। কথায় আছে"বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ"। সে সমস্ত পার্বণের মধ্যে এক অতি প্রিয় উৎসব হলো পহেলা বৈশাখ। একটি বাঙালির সার্বজনীন লোক উৎসব। চৈত্র মাসের শেষ ও বৈশাখ মাসের প্রথম দিনকে বাঙালিরা আনন্দঘন পরিবেশে বরণ করে নেয়। কল্যানা নতুন জীবনের প্রতীক হলো বাঙালির হৃদয়ের উৎসব নববর্ষ। বাংলা নববর্ষ পালনের সূচনা হয় মূলত সম্রাট আকবরের সময় থেকে। সে সময়ে নববর্ষ পালিত হতো অর্ত ব উৎসব বা ঋতু ধর্মী উৎসব হিসেবে। কৃষিপ্রধান এই দেশে কৃষি কাজের সঙ্গে নববর্ষ উৎসবের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। কৃষি কাজের সুবিধার্থে মুঘল সম্রাট আকবর ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে ১০/১২ মার্চ বাংলা সন প্রবর্তন করেন এবং তা কার্যকর হয় তার সিংহাসন আরোহণের সময় থেকে (৫ নভেম্বর ১৫৫৬)। হিজরি চান্দ্রসন ও বাংলা সৌরসন কে ভিত্তি করে বাংলা সন প্রবর্তিত হয়। নতুন সনটি প্রথমে "ফসলি সন" নামে পরিচিত ছিল, পরে তা বঙ্গাব্দ নামে পরিচিত হয়।

সব জায়গায় ধরে নেওয়া হচ্ছে শশাঙ্ক হিন্দু সম্প্রদায়ের কাল অধিপতি ছিলেন।তিনি এই বঙ্গাব্দের সূচনা করেছিলেন। বাংলা নববর্ষের শুভ সূচনা তার রাজ্যভিষেকের ঘটনা কালক্রমে বঙ্গাব্দের সূচনা হিসেবে ধরা হচ্ছে। এই তথ্য উড়িয়ে দিয়ে অনেকে আবার সম্রাট আকবর কে বঙ্গাব্দের সূচনাকারী হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। তবে অংকটা আমাদের একটু মিলিয়ে নেওয়া ভালো। ইতিহাসের নানান জায়গায় তথ্য অনুযায়ী,বঙ্গাধিপতি শশাঙ্কের রাজ্যাভিষেক হয়েছিল ৫৯৩ খ্রীষ্টাব্দে।সেই বছর থেকেই চালু হল বঙ্গ নববর্ষ ও বঙ্গাব্দ। হিসাব অনুযায়ী দাঁড়ায়,৫৯৩ + ১৪২৯ (বঙ্গাব্দ) = ২০২২ (খ্রীষ্টাব্দ),এটা কি বঙ্গাব্দ সূচনা হওয়ার জন্য যথেষ্ট প্রমাণ নয়?ওদিকে আকবর মোগল সম্রাট হয়েছিল ১৫৫৬ খ্রীষ্টাব্দে। তাই যারা বঙ্গাব্দের সূচনাকারী আকবরকে ক্রেডিট দিতে চায় তাদের হিসাব অনুযায়ী,১৫৫৬ খ্রী: + ১৪২৯ বঙ্গাব্দ = ২৯৮৫ খ্রীষ্টাব্দ।অর্থাৎ আকবর যদি বাংলা নববর্ষ চালু করতো তাহলে ইংরেজি ক্যালেন্ডারে এই বছরটা দাঁড়াতো ২৯৮৫ খ্রীষ্টাব্দ। তাই বঙ্গের অধিপতি নরেন্দ্রাদিত্য শশাঙ্ক হলেন বাংলা নববর্ষের জনক। বাকুঁড়ার সোনাতপন গ্রামে ১২০০ খ্রিস্টাব্দের প্রাচীন মন্দিরের গায়ে বঙ্গাব্দের উল্লেখ আছে যা আকবরের সিংহাসনে বসার ৩০০ বছরেরও আগের প্রামাণিক ঘটনা। তাই বঙ্গাব্দের সূচনাকারী কে তা নির্ণয় করার জন্য পাঠককুলের উপর দায়িত্ব দেওয়া হলো? 

বর্তমান আধুনিক সভ্যতায় পাল্টেছে নাগরিকদের জীবনযাত্রার ধরন। চারিদিকে বেড়ে চলেছে প্রতিযোগিতার পাল্লা। সময় কে কিনে নেবার প্রয়াস। বিশ্ব আজ তালুবন্দি। এসময় মানুষ প্রাচীন সভ্যতা সংস্কৃতি ছেড়ে আপন করেছে এন্ড্রয়েড সেট ও ইন্টারনেট। বাঙালিয়ানা খাবার ছেড়ে সবাই হয়েছে রেস্তোরা মুখি। ভাত,ডাল,মাছআলুভাজা, পোস্ত ছেড়ে বাঙালি এখন চাউমিন, বিরিয়ানি চিকেন কাবাবে অভ্যস্ত হয়েছে। বাইরের জাঙ্ক ফুড খাওয়ার ফলে মানুষ নিজেদের বিপদ নিজেই ডেকে আনছে অজান্তে। মানুষ অল্পতেই রোগব্যাধি গ্রস্ত হয়ে পড়ছে। অল্প বয়সে মাথার চুলে পাক ধরেছে, চুল ঝরে গিয়ে বাড়ছে টাক ধারি মানুষের সংখ্যা। অল্প বয়সে হার্ট অ্যাটাক হয়ে মারা যাচ্ছে। দিনে দিনে সন্তান ধারণের ক্ষমতা হারাচ্ছে নারীরা, সেই সঙ্গে বাড়ছে বিকলাঙ্গ সন্তানের সংখ্যা। তবুও কারো হুশ নেই। ধুতি-পাঞ্জাবি ছেড়ে বাঙালি আর টাই তে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। ইংরেজি আর হিন্দি ভাষার চাপে ভুলতে বসেছে বাঙালির অতিপ্রিয় বাংলা ভাষাকে। ধুতি-পাঞ্জাবি ভাত ডাল মাছ আলু পোস্ত ছেড়ে বাঙালি নিজের ভাষা সংস্কৃতি কে হারিয়ে অন্য ভাষা সংস্কৃতির দাস হয়ে যাচ্ছে।নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে উপেক্ষা করার প্রবণতা সবথেকে বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে যুব সমাজের মধ্যে। যাদের মধ্যে আগামী ভবিষ্যতের স্বপ্নের বীজ লুকিয়ে থাকে, সেই যুবসমাজের হাত ধরেই লেখা হবে বাঙালির প্রাচীন সভ্যতা-সংস্কৃতির নিধনের ইতিহাস। তার জীবন্ত নিদর্শন হল রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়।

বাঙলা ক্যালেন্ডারে নববর্ষ হল পয়লা বৈশাখ। বসন্তের শেষে গ্রীষ্মের আগমনেই আসে বৈশাখ। আর সেটা চৈত্রের চিতাভষ্ম উড়িয়ে। প্রস্তুত নববর্ষে সব অর্থেই পরিবর্তন চাই। বিশ্বপ্রকৃতির পরিবর্তন, রূপবৈচিত্রের পরিবর্তন, চিন্তা-চেতনার পরিবর্তন, সেই সঙ্গে রাজনৈতিক পরিবর্তন। 'শুকনো গাঙ্গে আসুক জীবনের বন্যা'; ভেসে যাক জীর্ণ পুরাতন; বাংলার গ্রাম-জনপদ থেকে বারুদের ঘ্রাণ মুছে যাক; গ্রীষ্মে বীরভূম সহ সারা বাংলায় মধ্যদিনের রক্ত নয়ন যারা দেখিয়েছে তাদের বিদায় চাই। নরেন্দ্র নামাঙ্কিত কালপুরুষের নববিধানে সমগ্র ভারতের সঙ্গে বাংলার রাজনৈতিক আকাশ নির্মল হোক, জীবনবৃক্ষ রূপ মনুষ্য-বিটপী যেন নির্বাচনের নিঃশ্বাসে নিঃশঙ্ক হতে পারেন। আসুক 'নববর্ষের পুণ্য বাসরের কালবৈশাখী'। আর তার জন্য যে মূল্যই চোকাতে হোক না কেন -- সে যুদ্ধ 'হোক সে ভীষণ'। ভয় ভুলে উপভোগ্য হোক 'অদ্ভুত উল্লাস'। কালবৈশাখে নেমে আসুক তার বিজয় রথ। বাংলায় তাঁর পিনাকের টংকার শুনতে পাচ্ছি। মানুষের ধৈর্যের বাঁধ যেহেতু ভেঙ্গে গেছে, তাই 'ভাঙনের জয়গান' গাই -- 'বাঁধ ভেঙ্গে দাও/ বাঁধ ভেঙ্গে দাও/ বাঁধ ভেঙ্গে দাও।'



 

নববর্ষ, দিন বদলের গল্প কথা

অনিতা নাগ 


নববর্ষ মানেই তো নতুন জামা, মন্দিরে পূজো দেওয়া, বাড়ীতে ভালো ভালো রান্না, মজা হুল্লোড়। বিকেলে বাবার হাত ধরে দোকানে হালখাতার নেমন্তনে যাওয়া, রঙিন সরবত, মিষ্টির বাক্স, বাংলা ক্যালেন্ডার। নববর্ষ বললে এই স্মৃতিগুলো অনামিকাকে আচ্ছন্ন করে আজও। তখনো নিশ্চয় জীবনে অনেক সমস্যা ছিলো। কিন্তু ছোটরা তা টের পেতো না। বড়রা অশুভকে আড়াল করে রাখতেন। নববর্ষের আগে নীলষষ্ঠী থেকেই উৎসবের সূচনা হতো। এমন সহজ ছন্দে ছোটবেলাটা দিব্যি কেটেছে। নববর্ষের আরেক আকর্ষণ চৈত্র সেল। সে বড্ড মজার ব্যাপার। সবকিছুতেই সেল এর লেবেল লাগিয়ে হাতিবাগানের ফুটপাতে যেনো মেলা বসতো। এখনো সেল চলে। মনে পড়ে এইসময়টায় মা অনেক কেনাকাটা করতেন। প্রবাসে থাকতে এই চৈত্র সেল বড্ড মিস করতো অনামিকা। তবে নতুন জামা, মন্দির, ভালো রান্না এ’ গুলোতে ছেদ পড়ে নি কখনো। ঠাম্মা বলতেন বছরের প্রথম দিন যেমন চলবে সারাবছর তেমন কাটবে। তাই খুব চেষ্টা থাকতো দিনটাকে বিশেষ করে তোলার। এখন তো অনলাইনের যুগ। কয়েকবছর আগে অনামিকাও সেলে কতো কিছুই কিনতো। এখন তো মুঠোফোনেই সব নাগালে পাওয়া যায়। তবু আজও সেলে কিছু কেনাকাটা করে অনামিকা। গড়িয়াহাটের ফুটপাতে সেলের ট্যাগ লাগিয়ে যারা পসরা সাজিয়ে বসেন, এটাই তাদের রুজি রুটি। তাই প্রয়োজন না থাকলেও কিছু কেনাকাটা হয়েই যায়। আবাসনের গন্ডির ভেতরে তো ফেরিওয়ালা আসে না। তাই বেড়িয়ে পড়ে মাঝেমধ্যে। চার দেওয়ালের বাইরের জীবনটা বড্ড টানে। মাঝে মাঝে বাসে, অটোতে বেড়িয়ে পরে অনামিকা। বাইরের জগতের একটা অন্যরকম ছন্দ আছে। জ্যাম, ভীড়, হকারদের হাঁকাহাঁকি, পড়ন্ত সূর্যের আলো, ফুচকার গন্ধ। বেশ লাগে অনামিকার। তবে সবাই ছুটছে। সকলেরই গন্তব্যে পৌঁছোনোর তাড়া। সেখানে অপেক্ষা নেই। শুধু পিছিয়ে পড়ার ভয় আর আক্ষেপ। 
 নতুন বছর, ১৪৩২ ঠিক সময় মতো এসে পড়লো। সাথে খর বৈশাখের তপ্ত প্রবাহ। কিন্তু মনে কোনো আনন্দ নেই অনামিকার। তেমন করে বৈশাখকে আহ্বান করতে পারলো না। বলতে পারলো না এসো হে বৈশাখ, এসো এসো’। বুকের মধ্যে জমাট বাঁধা কষ্ট। বিনা নোটিশে কর্মহারা শিক্ষকদের হাহাকার, তাদের চোখের জলে ঝাপসা আজ নববর্ষের আনন্দ। যোগ্য অযোগ্য বিচার করবে কারা! উত্তর জানা নেই। চারদিকে নেই নেই রবটা এতো প্রখর যে সব আনন্দই কেমন ম্লান হয়ে যায়। নিয়ম মেনে ঠাকুরের আসনে নতুন কাপড় পেতেছে অনামিকা। গোপাল, জগন্নাথকে নতুন সাজে সাজিয়েছে। ফুলের অর্ঘ্য দিয়েছে। প্রদীপের আলোয় সব অন্ধকার মুছে যাক সকলের জীবন থেকে, অন্ধকার মুক্ত হোক সকলের জীবন। এ’ তার নিত্যদিনের প্রার্থণা। কিন্তু অন্ধকার যেনো আরো নিবিড় হচ্ছে ক্রমশঃ। অভয়া হত্যার বিচারহীন দীর্ঘ সময় ক্রমশঃ দীর্ঘতর হচ্ছে। নানান ঘটনার স্রোতে সবাই হয়তো ভুলতে বসেছে মেয়েটাকে। অনামিকা ভুলতে পারেনা ক্ষমাহীন এই অপরাধকে। কিন্তু কিচ্ছু করার ক্ষমতাও তার নেই। তাই বলে সময়ের চাকা থেমে থাকে না। সময় এগিয়ে চলে আপন ছন্দে। পলাশ, শিমুল, কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়াকে তাদের জায়গা ছেড়ে দিয়ে বিদায় নিয়েছে। কৃষ্ণচূড়া রাধাচূড়ার ডালে ডালে লাল, হলুদের ছোঁয়া। আবার বছর পার করে পলাশ, শিমুলের দেখা মিলবে। প্রকৃতির আবর্তন চলে আপন ছন্দে। কিন্তু আমাদের জীবন থেকে যারা হারিয়ে যায় তারা আর ফিরে আসে না। তাদের আর ফিরে পাওয়া যায় না। শুধু স্মৃতিগুলো থেকে যায়। বিকেলে কর্তার সাথে একটু বেড়িয়েছিলো। দোকানে দোকানে হালখাতার ভীড়। তবে রঙিন সরবতের জায়গায় ঠান্ডা পানীয়ের বোতল। ক্যালেন্ডার, মিষ্টিমুখ, আছে সবই। শুধু একটা বদল এসেছে। বাবার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিলো অনামিকার। বিয়ের পর কখনো নববর্ষে কলকাতায় থাকলে বাবা নাতি নাতনিদের নিয়ে হালখাতা করতে যেতেন। রঙিন সরবতের জন্য বাচ্চাগুলোও সারাদিন অপেক্ষায় থাকতো। এই অপেক্ষাটা মিস করে অনামিকা। এমন করে আজকাল আর অপেক্ষা করতে হয় না। রঙিন সরবত রূপ বদলে বোতল বন্দী হয়ে এসে যায়। সবই যেনো নাগালের বড্ড কাছে। শুধু নাগাল পাওয়া যায় না আপনজন গুলোর। তাদের জন্য অন্তহীন অপেক্ষা। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্ম, এই তিন নেই এর চক্করে বেশীরভাগ ছেলে মেয়েরা নয় প্রবাসী, নয় বিদেশ বাসী। অনামিকার মতো কতো বাবা মা বুকের উপর পাথর চাপা দিয়ে দিন কাটায় তার হিসেব কে রাখে! দিনান্তে একটা ফোনকল, সপ্তাহে কয়েকবার ভিডিও কল, এই নিয়েই দিন কাটানো। নববর্ষের দিন বাড়ীতে কতোরকম রান্না হতো। সেও করতো। এখন আর করে না। ছেলেমেয়ের পছন্দের রান্নাগুলো আর করে না। কষ্ট হয়। কিন্তু বলার উপায় নেই। ওরাও তো সখ করে ঘর ছেড়ে বাইরে নেই। জীবনযুদ্ধে টিঁকে থাকার এই লড়াইয়ে তারাও দৌড়চ্ছে। মনে মনে একটাই প্রার্থণা ধীরে ধীরে চল আর পথ ভুল করিস না। পথটা বড্ড কঠিন। চোখের জল মোছে অনামিকা। সে হারতে ভালোবাসে না। দু’বেলা ঠাকুরের সামনে প্রদীপ জ্বেলে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে। প্রার্থণা করে লক্ষ, কোটি শিখা হয়ে তুমি সারা বিশ্বকে অন্ধকার মুক্ত করো। আগামী প্রজন্ম এই অন্ধকারের গ্রাস থেকে মুক্ত হোক। প্রার্থণা করে নিজের জন্য। অন্ধকারের মধ্যে থেকে আলো খুঁজে নেওয়ার শক্তিটুকু যেনো জীবনের শেষ দিন অবধি আগলে রাখতে পারে। দিন বদলের পালায় নতুন ভাবে নববর্ষ বাঁধা পড়ুক সকলের জীবনে। আগামী প্রজন্ম গুগল হাঁতড়ে সনাতন নববর্ষের ইতিহাসকে জানুক। জীবনের পড়ন্ত বেলায় অনামিকা সতাতন ও বর্তমানের বদলে যাওয়া নববর্ষকে আগলে রাখে সোহাগে আর ভালোবাসায়। মনের তারে একটা সুর বেজে চলে অবিরত

‘ যা হারিয়ে যায় তা আগলে ব’সে রইবো কত আর?’


 

বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলা নববর্ষ
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়

 ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের আয়োজনে,  শাহবাগ -রমনা'র বটমূল থেকে মঙ্গল যাত্রা দিয়ে প্রতি বছর  বাংলা নববর্ষের সূচনা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, ছাত্র ছাত্রী ছাড়াও সর্বস্তরের হাজার হাজার মানুষ এই মঙ্গল যাত্রায় অংশ নিয়ে থাকেন। আমাদেরই বড় আবেগের দেশ বাংলাদেশ। তাই  এই শোভাযাত্রার দিকে আমাদের সবারই নজর থাকে। এইবার সেদেশে পরিবর্তনের ঝড় বইছে।তাই আগের যা কিছু সবটাই বদলে ফেলতে হবে।  মঙ্গল যাত্রার " মঙ্গল " শব্দটা নিয়েও তাই এবার  প্রবল আপত্তি। দাবি উঠলো  কেন এই যাত্রার নাম মঙ্গল যাত্রা হবে, এর নাম করনের পরিবর্তন চাই।

 আমাদের  প্রাণের ভাষা বাংলা ভাষা। তাই মঙ্গল শব্দের অপসারণ আমাদের আবেগকে ভীষণ ভাবে নাড়া দিয়েছে। মানুষের কল্যাণে নতুন কিছু সবসময়ই কাম্য। কিন্তু মঙ্গল শব্দের অপসারণ আমাদের আহত করেছে। যে কোনো ভাবে অতীত ঐতিহ্য প্রাচীন সংস্কৃতির মূলে কুঠারাঘাত করতে হবে। অবশেষে নববর্ষের শুভ যাত্রার নাম পরিবর্তিত হয়ে অবশেষে   হল "আনন্দ যাত্রা"। জানি না এই পরিবর্তনে বাংলা দেশ কতটা এগিয়ে যেতে পারল।

একটা সময় বাংলাদেশ গর্ব করে বলতো আমাদের হুমায়ুন আহমেদ আছে। আজ বড়ো করে এই প্রাতঃস্মরণীয় লেখকের ছবি টাঙিয়ে নতুন প্রজন্মকে বলা হচ্ছে ঢিল ছুড়তে। এসব দেখে নিজেদের খুবই নি:স্ব বলে মনে হয়।  

এ তো গেল কাঁটাতারের ওপারের খবর।  এপার বাংলায় নানা ফন্দি ফিকির করে লাটে তুলে দেওয়া হচ্ছে শিক্ষা। আমরা যা শিখলাম যা শেখালাম প্রতি পদে পদে সেই বিষয়টা  ভুল প্রমাণিত করবার এক অদ্ভুত প্রয়াস চলছে। নতুন সৃষ্টি করবার ইচ্ছেকে শেষ করে দিয়ে নতুন  সংস্কৃতির মোড়কে অশিক্ষার প্রসার ঘটছে অহরহ। এই খারাপ লাগা বিষয়গুলোর তালিকা আর বড়ো না হলেই অসোয়াস্তির মেঘ কাটবে।


 

নববর্ষ জনান্তিকে

মধুপর্ণা বসু

কাঠ পুতুলের মত জীবন হয়ে উঠেছে যান্ত্রিক। এই বোধহয় একুশ শতকের দস্তুর। দিন মাস বছরের অনুপুঙ্খ হিসেব রাখায় ভীষণ আলস্যদোষ।যেন-তেন সূর্যোদয় সূর্যাস্ত টপকে সময় খুন করাই এখন অভ্যাসের দাস।আবেগের তাড়নায় বেশ অনুভব করি বাইরে চৈত্র মাস, 'তোমার চোখে দেখেছিলেম, আমার সর্বনাশ।' এখন তো সর্বনাশ বাইরে থেকে ঘরের দরজা ধাক্কা দিয়ে যায় রোজ।দক্ষিণ বায়ু,গোধূলির কালবৈশাখী,শিলাবৃষ্টিতে বাগান, ছাদে শিল কুড়িয়ে মুখে ভরা এইসব আনন্দের বোয়্যাম কবেই উজার করে দিয়ে মনমরা অতিথির মতো পৃষ্ঠ দেখিয়ে কখন চোখের আড়ালে বুঝতেও পারি না। তেমনই মনের তরঙ্গের চূড়ায় এক বৈশাখে কুশল বিনিময়, সন্দেশ, মিষ্টি, নতুন পাটভাঙা ঢাকাই শাড়ি গন্ধ সহযোগে পাজামা পাঞ্জাবীর খড়মড় শব্দে কদাচিত বাঙালী বাড়িতে গাছপাঁঠা, সমেত তেলমশলায় মাংসের ঝোল পঞ্চপদ হয়, অথবা নিছক বাড়িতে রান্না করে নববর্ষ আয়োজন হয় কিনা তা নিয়ে বেশ সংশয় আছে মনে। আমাদের চারপাশ, পরিবার থেকে পাড়া, আর তার থেকে বিস্তারিত অঞ্চল বা শহর ছেড়ে শহরতলি কেমন যেন রুদ্ধশ্বাসে ঝঞ্ঝার সামাল দিতে সবসময়ই প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিসের গন্ধ ওড়ে শহর, রাজ্য তথা গোটা দেশের আকাশে,মাঠে প্রান্তরে? কেউ যেন ভালো নেই। একটা সুখী শান্তির পরিবার থেকে বিন্দু বিন্দু নৈরাজ্য সিন্ধু হতে হতে চাপা উত্তেজনা,ভয়, অস্তিত্বের সঙ্কট, রাজনৈতিক অসহ্য অস্থিরতা, দলাদলির প্রাত্যহিক নাটকে আমাদের সচল জীবনকে তোলপাড় করে দেয় রোজ। আনন্দে মত্ত হয় কিছু মানুষ, কারণে বা অকারণে অথবা নিছকই হুজুগ বুঝে। কিন্তু সুখ শান্তির জায়গা খুঁজে পাওয়া দুর্লভ। পুরানো বছরকে বিদায় দিয়ে নতুনকে অভ্যর্থনা করাও যেন একরকম শুধু দেখানোর জন্যে।নিজেদের ওই কুমিরছানা দেখিয়ে ভোলানো যে আমরা সব ভালো আছি। All is well, নিঃসন্দেহে দারুণ মিথ্যেকে নেশাগ্রস্ত জড়িয়ে ধরে শুধু সামনে খাদের দিকে পা বাড়িয়ে দেওয়া। এই কি সময়? এই কি সেই সমাজ,সেই দেশ যেখানে মানুষ তার সব আশা আর দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারে, সকল দেশের রাণী সে যে... এসব অতীত খুঁড়ে দেখে আমরা ক্লান্ত বিধ্বস্ত। বর্ষবরণ উৎসব আসে, শ্রেণী বিশেষে চাকচিক্য, জমক কিছু কম হয়না। হাতিবাগান, গড়িয়াহাট সেলের বাজার অতি সূক্ষ্ম পরিদর্শনে বেশ বেরঙিন, সাদামাটা। অনলাইনে এখন বাঘের দুধও খুঁজলে মিলতে পারে।সপরিবারে নববর্ষের মেজাজ আনন্দমেলা,গান গল্পের অবকাশ এখন হাতে গুনে সংখ্যা লঘু।বাঙালী নস্টালজিয়া বহু ক্ষেত্রে বেশ চমকিত করার মতো হলেও দূরদর্শনের বর্ষবরণ বৈঠকে যেন পঙ্কজ সাহা, ছন্দা সেন, শাশ্বতী, চৈতালী, অভাবদুষ্ট। রামকুমার চাটুয্যে,বন্যা চৌধুরী, দেবরাজ অনুপস্থিতি নব্যেরা কি তেমন করে ভরিয়ে তুলতে পারেন? এখন শাড়ি অলঙ্কার চড়া মেকআপে ঢেকে গেছে প্রাণের স্পন্দন।ঋতুচক্রের নিয়মে চৈত্র শেষে বৈশাখ আসছে রণ দামামা বাজিয়ে। থার্মোমিটারের পারা চড়বে ঊর্ধ্বমুখে আর দু-এক দিনের আমোদের স্রোতের ভাঁটায় নিভে যাবে আর একটা নববর্ষ। জীবন চলবে গড্ডরিকায় যতদিন না আমরা যুদ্ধকালীন মানসিকতায় পরিবর্তন না আনি। প্রতিবারের মতো আমার বর্ষবরণ অত্যন্ত নীরবে হয়তো কবিতার সাথে, জনান্তিকে। 


 

নববর্ষ 

বেলা দে 


"গাছে গাছে ফুল ফুটেছে 

নববর্ষের ডাক এসেছে
তুমি আমার বন্ধু হও
নববর্ষের কার্ড লও"

চিরকুটে নববর্ষের ফুল আঁকা কার্ড হাতে পড়তেই আমার তরফ থেকে সঙ্গে সঙ্গে রিটার্নের প্রস্তুতি, সে পাড়ার বন্ধু হোক অথবা স্কুলের, খুদেবেলায় ওইটুকুতেই কত আনন্দ। ও যেমন ফুলের ছবি দিয়েছে আমি অন্য আঁকা চিন্তা ভাবনার পর ফ্রকপড়া কার্ড হাতে ধরা একটা মেয়ের ছবি এঁকে ওতে ভিন্ন একটা কবিতা লিখে হাতে গুঁজে দিয়েছি। এদিনের মতন রকমারি কার্ড বাজারে আসেনি আর পয়সা চাইবো কার কাছে। আজ তো ছেলেবেলা হারিয়ে গেছে অতি প্রাচুর্যের মেঘে, উপরিপাওনা এন্ড্রয়েড ফোন,  মা অথবা বাবা হাতে ধরিয়ে দেন শৈশবাবস্থায়, ওদের নববর্ষ হ্যায় হ্যালোতে শেষ একটু পাখা গজাতেই রেস্তোরাঁ অথবা বন্ধুত্বের ঠেকে, এখন তো বন্ধুর সাথে আবার বান্ধবীও জুটে গেছে, একসাথে সবাই মিলে নতুন বছরের সেলিব্রেশন হৈচৈ করে। সেকালে ছিল সন্ধেবেলা বাবার হাত ধরে দোকান দোকান ঘুরে হালখাতা করা,মনোরঞ্জন কাকুর সোনার দোকান, অমূল্য কাকুর "মহাকাল বস্ত্রালয় " কাপড়ের দোকান, মাধব সাহার মুদিদোকান হয়ে বাড়ি ফিরে ভাইবোনের সঙ্গে মিষ্টি বাটাবাটি করে খাওয়া। সেই লাড্ডুভরা প্যাকেটেই কি আনন্দ। আলোর রোশনিতে সাজানো মল থেকে ক্রয় হয়নি জামাকাপড়, ফুলছাপা ছিটকাপড়ে মায়ের হাতে তৈরি ফ্রক পড়ে একে ওকে তাকে ঘুরে দেখিয়েও এনেছি, কম রোজগেরে অধিক সন্তানের পিতাদের কাছে প্রত্যাশা কোনো বন্ধুদেরই অবশ্য চোখে পড়ে  নি। এখন নিউক্লিয়াস  যুগে না চাইতেই অনেক পাওয়া। একমাত্র সন্তানের জন্য হা করতেই হাজির। এরপর অনলাইনের সুবাদে ঘরে বসে নিজের পছন্দমতো কুরিয়ারে অর্ডার করলেই বাড়িতে এনে হাজির তার অর্থমূল্য যতই হোক না। এতকিছুর পরেও অনেক মানুষের মন থেকে বাংলার সংস্কৃতি, কৃষ্টি হারিয়ে যায়নি, যারা একটু বেশি সংস্কৃতিমনা তারা কিছু না কিছুর সাথে জড়িয়ে থাকেই, আর শিল্প সংস্কৃতি আর শিল্পী মনের সংখ্যা অনেক বেড়েছে বোধকরি  আগের চাইতে। আগে ছিল সুযোগের অভাব এখন যেটা একেবারেই নেই। আমরা বাড়ির বারান্দায় মায়েদের কাপড় টাঙিয়ে নাচ গান আবৃত্তি করেছি১লা বৈশাখ এবং ২৫শে বৈশাখ এলে, এখন স্টেজ মাইক্রোফোন পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ কোনোটারই অভাব নেই। অভাব নেই শিল্প সচেতন মানুষের। যতই দিন এগিয়ে চলেছে মানুষের চ্যালেঞ্জিং স্বভাব আরও অধিকতর ব্যপৃত হচ্ছে। বিভিন্ন সংস্থা, স্কুল,কলেজ এবং শিক্ষায়তন বাংলা নববর্ষের কৃষ্টি সাধনে সফল হচ্ছে। এভাবেই বেঁচে থাক বাংলার প্রথা হালখাতা। 


 

মনুষ্যত্ব 

শুভেন্দু নন্দী 

সাইকেলে জোরে পা চালিয়ে গুনগুন করে পরিচিত একটি হিন্দী গানের কলি আওড়াতে আওড়াতে অন্যমনস্কভাবে ছুটছিলো অনিকেত। এ.টি.এম. থেকে হাজার দশেক টাকা তুলেছিলো। বাড়িতে কিছু রিপেয়ারিং-এর কাজ চলছে। লেবার পেমেন্ট  করতে হবে। আজ রবিবার। অফিসে যাবার তাড়া নেই।  হঠাৎ মনে হোলো কেউ তাকে অনুসরণ করছে না তো ? চারিদিকে ছিটকে চোর ও পকেটমারদের দৌরাত্ম্য ক্রমশঃই বেড়ে চলেছে।  সেল ফোনের দিকেই আগ্রহটা বেশী। নাঃ, আর পারা যাচ্ছেনা। বড্ড চায়ের পিয়াসা। "ঐতো সামনেই একটা চা-বিস্কুটের দোকান"- বলে ওঠে অনিকেত। সাইকেলটা দোকানের পেছনে এককোণে লক্ করে দোকানঘরের ভেতর প্রবেশ করলো। ভালো করে তার মোবাইল ফোন এবং পকেটে টাকার অবস্থান পরীক্ষা করে আড়চোখে  চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো।
- দাদা, এখানে নতুন এলেন বুঝি? কয়েকজন অল্প বয়স্ক যুবক তাকে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো।
-হ্যাঁ - মোটামুটি তাই-ই - অনীক বলে ওঠে। মনে মনে ভাবলো এর পরে হয়তো অবধারিতভাবে প্রশ্ন 
তুলবে - কী করা হয়, মহাশয়ের কোথায় থাকা হয়? ইত্যাদি ইত্যাদি ভাববাচ্যে প্রশ্ন। কিন্তু তেমন কোনও প্রশ্নের মুখোমুখি হোলোনা -ভেবে খুব অবাক লাগলো অনীকের। আসলে  কৌতুহল,উচ্ছ্বাস-  দিনের পর দিন যেন হারিয়েই যাচ্ছে। মানসিক চাঞ্চল্যতাই বিরাজ করছে তার মূলে। আর আছে বেকারত্বের জ্বালা। অন্ততঃ ছেলেগুলোর চোখে-মুখে তার দৃঢ় ছাপ প্রতীয়মান। আর বেশী গবেষণা করার ইচ্ছে এই মুহুর্তে তার নেই।  পিয়াসা সাঙ্গ করে দোকানে দাম মিটিয়ে দেয় অতঃপর।  বিধির বিধান একেই বলে! সাইকেলে কিছুদূর পথ এগিয়ে দেখতে পায় অনীক পথের ওপর অচেতন হয়ে পড়ে থাকা একজন। অবিন্যস্ত চুল। সারা শরীরে,জামাকাপড়ে রক্তের দাগ। অনীক বিচলিত না হয়ে হনহন করে এগিয়ে গেলো ।
- কি দাদা, কি দেখছেন ? আরে, চলে যান মশাই। 
ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ কী ? একজন 'মাতাল' তার কাছে এসে বিড়বিড় করে অসংলগ্ন ভঙ্গীতে বলে উঠলো।
- আরে আরে ! বলছেন কি আপনি? লোকটার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে, এখনও। হাসপাতালে এক্ষুনি নিয়ে যাবার দরকার। এখনও প্রাণ আছে দেখছি। - বলে একজন রিকশাওয়ালার কাছে এগিয়ে যায় অনীক।
- ঝামেলা তাহলে নিলেনই দাদা। ঠিক আছে। এই বুবু! শিগগীর এদিকে আয় দেখি। নিয়ে যা এই দাদাকে আর আঘাতে ক্ষতবিক্ষত ঐ অসহায় লোকটিকে। সাবধানে নিয়ে যাবি,বুঝলি। 
- দাদা আপনাকে আমার প্রণাম। আর আমি হলাম
রাজু। রাজু পাঁড়ুই। তিনকূলে কেউ নেই আমার। ছিল এক পিসী। কিছুদিন হোলো তাঁর স্বর্গবাস হয়েছে। শুনুন- সামনেই নার্সিং হোম। পকেটে টাকাকড়ি কিছু আছে কী ? এই নিন দুশো টাকা। কাজে লাগতে পারে।
- কিন্তু আমার সাইকেল? অনীক চিন্তিত মনে তাকে বললো।
- ওঃ কিস্সু হবে না মশাই। এটা আমার ডেরা!
তারপর কি ভেবে একা একাই ধীরে ধীরে চালিয়ে
নিয়ে যেতে লাগলো ।
সেদিন সব কিছু সেরে বাড়ি ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেছিলো। লেবাররা অনেক রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করে চলে গেছিলো। রমলা-ওর বৌয়ের আহ্বানে - অনীক খেতে বসলো। ছেলে-মেয়ে ততক্ষণে ঘুমিয়ে
পড়েছে। পরের দিন লেবারদের পেমেন্ট মিটিয়ে দিলো অনীক। ওরা "বাবুর " এ ধরনের মহান হৃদয়ের গল্প আগে অনেকবার শুনেছে। যাই হোক, রাজুর দুশো টাকা মিটিয়ে দিয়ে তাকে ধন্যবাদ দেবার সাথে চা খাওয়ার অফার দিয়েছিলো এবং সানন্দে তা গ্রহনও করেছিলো রাজু। অবশ্য ইনট্ক্সকিটেড অবস্থায় নয়। অনীকের কিছু টাকা খসেছিলো জখম লোকটিকে ভর্তি ও ওষুধ কেনার পেছনে। অবশ্য তার পরোয়া করেনা একদম অনীক। এ ব্যাপারটা তার বৌ অবশ্য বোঝে আর মনে মনে তাঁকে সমীহও করে থাকেন।
........আজ এত বছর পরে তার মনে হোলো মানুষের সদগুণ,সহানুভূতি, শুভবুদ্ধি,বোধোদয় আজও বিরাজমান- তার বিরাট প্রমাণ তথাকথিত ঐ  রাজু পাঁড়ুই। মনে মনে তাকে নমস্কার জানালো অনিকেত।


 

মুখোশের ভিড়
প্রতিভা পাল 

(১)
অবাঞ্ছিত জন্মদাগের মতো কিছু অতীত, কারণ কিছু
ভাবনার ভাঙাচোরা অলিন্দে ঘুরেফিরে 
ঘুমিয়ে পড়ে সহসা, শব্দহীন রাতের কার্ণিশে! 
স্বপ্নঘোরে জীবন্ত যখন, 
যাপন জুড়ে ক্লান্তির অসহায় জীবন-পরিধি।
প্রশ্নতীর বিদ্ধ পাঁজরের পরতে।
হাসির মুখোশ কান্না লুকোয় মনের কারাগারে... 

(২)
নিঃশব্দ মিছিল হেঁটে চলে সময়ের অলিগলি পথ।
সৌজন্য সম্ভারে আন্তরিক সদ্ব্যবহার। 
কৃত্রিম নিয়ন আলোয় অস্পষ্ট সব মুখের সারি।
পায়ে পায়ে সমান্তরাল দূরত্বে দ্বন্দ্বর দীনতা অথচ! 
মুখোশ তবু নিশ্চল! 
মনের তরঙ্গে রাত আরও গভীর.... 

(৩)
মুখোশের ভিড়ে শত আনন্দ ঘিরে কত দুঃখ জীবন হাসে রোজ
জঙধরা রাতে ঘোলাটে চাঁদের সাথে মেঘ রাখে একলা মনের খোঁজ.... 


 

ক্যামপাসের কথা

চিত্রাপাল

 

তুমি যেন চলে যেও না, ক্ষণিক প্রাপ্তির আনন্দ পাওয়া

শিশুর মতো, যে কিছু একটা নতুন পেলেই ছুঁড়ে ফেলে দেয় পুর্বপ্রাপ্তি। 

তুমি চলে যেও না কাটা ঘুড়ির ভেসে যাওয়ার মতো

হাওয়ায় হাওয়ায় উড়ে গিয়ে চলে যাবে সীমানা ছাড়িয়ে পাখীর মতো

তুমি চলে যেও না সাগরের ঢেউয়ের মতো, যে শুধু অস্তিত্বহীন হয়ে

মিশে যায় বালুকাবেলায়। তোমার বর্ষা ভেজা মুখ বসন্তাগমনের সৌরভ

গ্রীষ্মের তপ্ত হাওয়া তিস্তা বূড়ির গান সব আছে আমার স্বর্ণসিন্দুকে

যা মিশে আছে আমার অস্তিত্বের সঙ্গে আজও এই গোধূলিবেলায়

রেখে দিয়ে এক মায়াবী আবেশ।