গল্প
দুধ পুলি
মৌসুমী চৌধুরী
অফিস থেকে ফিরে ঘরে ঢুকতেই নলেন গুড়ের মিষ্টি সুবাস নাক ছুঁয়ে দিল সুমিতের। সুতপার রান্নাঘর থেকে
বাতাসের ডানায় ভর করে সুগন্ধটা ছড়িয়ে পড়েছে সমস্ত অ্যাপার্টমেন্টে। সুগন্ধের সঙ্গে সঙ্গে একটা মন-খারাপও ঝঁপিয়ে পড়ল তার বুকে। একটি দিন, সেই ক্ষতময় একটি দিন অতীত সরণি থেকে চট করে উঠে এসে তীব্র ব্যথা জাগিয়ে তুলছে সুমিতের বুকে...
পাড়ার বকুল মামীদের বাড়িতে রান্নার কাজ করতেন মা। পাড়াজোড়া সকলের মুখে মুখে সুমিতের মায়ের রান্নার বড় সুখ্যাতি ছিল। বাবা চলে যাবার পর মা তাই তাঁর সেই গুণটিকেই কাজে লাগিয়ে তাদের মা ও ছেলের দুটি পেট চালাবার ব্যবস্থা করেছিলেন। এছাড়া তো মায়ের আর কোন উপায় ছিল না। বকুল মামীর রান্নাঘরে সেদিন সক্কাল থেকে কাঠের জ্বালে পিঠে ভাজছিলেন মা। পৌষের তীব্র শীতেও মায়ের নাকের ওপর জমেছিল বিন্দু বিন্দু ঘাম, ব্লাউজ ভিজে উঠেছিল! উনুনে তখন দুধ আর নলেন গুড়ের মিশেলে টগবগিয়ে ফুটছিল ছোটবড় পুলি পিঠেগুলো! বেশ পেট মোটা পুলিগুলো ! পেটে তাদের টসটসে ক্ষীর ভরা। সুমিতের খুব খুব প্রিয় পিঠে। স্কুল থেকে ফিরে এক ছুটে মায়ের কাছে গিয়েছিল সুমিত। কড়াতে দুধপুলিগুলো দেখেই জিভে জল চলে এসেছিল তার। সঙ্গে সঙ্গে মায়ের কাছে বায়না ধরল সে,
— " খুব খিদে পেয়েছে, মা। এখুনি দাও, খাব। দুধ পুলি।"
মা চোখ পাকিয়ে বলে ওঠে,
— "জ্বালাস নে তো, এখন যা এখান থেকে। রাতে খাবি খন। বকুল বৌদির মেয়ে মুনু আর জামাই আসছে। তাদেরই জন্য তৈরি হচ্ছে এ সব পিঠে। ওরা আগে খাক... "
তবুও ছোট্ট সুমিত তখন নাছোড়- বান্দা,
— " এক্ষুনি দাও। এক্ষুনি আমি খাব। কি হবে একটুখানি খেলে? ...অতটা তো রয়েছে! দাও না মা। খুব খেতে ইচ্ছে করছে! "
অবুঝের মতো কাঁদতে থাকে সুমিত। তার কান্নাকাটি দেখে মায়ের মন নরম হয়ে ওঠে। একটা বাটিতে করে খানিকটা দুধ পুলি খেতে দেয় তাকে। আর তখনই ঘটে ঘটনাটা। পিছন থেকে বকুল মামী এসে চিল চিৎকারে গলা ফাটাতে থাকেন,
— " ওঃ সোহাগ করে ছেলেকে পিঠে খাওয়ান হচ্ছে? এত নোলা তোর ছেলের! এখনও কেউ খায় নি। মেয়ে-জামাই আসবে আমার। তুই জানিস না?"
অপ্রস্তুত মুখে মাথা নীচু করে মা বলে,
—" কচি ছেলেটা খাবে বলে বায়না ধরলে। ক্ষমা কর, বৌদি..."
বকুল মামীর মুখ থেকে বেরিয়ে আসা গনগনে কথাগুলো এফোঁড় -ওফোঁড় করে দিতে লাগল মাকে ,
— " তা আমার অনুমতি নিয়েছিলিস? চোর কোথাকার! এমনিতেই তো মায়ে- পোয়ে গন্ডে-পিন্ডে গিলিস।"
— "আমরা তোমাদের বাড়ির সব জিনিস আগলে রাখি, বৌদি। আমরা চোর নই। পেটের দায়ে আজ..."
আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে মিহি গলায় বলার চেষ্টা করেন মা।
কিন্তু বকুল মামীর অপশব্দে মায়ের গলার স্বর চাপা পড়ে যায়। ভারী হতে থাকে পৌষের বাতাস। চোখ ফেটে জল আসে সুমিতের। কাঁদতে কাঁদতে রাতে জ্বর চলে আসে তার। গভীর রাতে বিছানায় শুয়ে মায়ের চোখের জলের অঝোর ধারায় ভিজতে থাকে শিমূল তুলোর বালিশ। মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে সুমিত বলে,
— " আমি আর কোনদিন এমন করে তোমার কাছে খেতে চাইব না, মা। কেঁদো না তুমি। "
—" বাবু, তুই বড় হয়ে আমায় একটা এমন রান্নাঘর বানিয়ে দিস, যেখানে আমিই হব সর্বময়ী কর্ত্রী। যেখানে আমি স্বাধীনভাবে রান্না করব, পরিবেশনও করব...।"
কান্নায় বুজে আসছিল মায়ের গলা।
বাবা মারা যাবার পর সেই যে লাথি-ঝ্যাঁটা, গঞ্জনার জীবন শুরু হয়েছিল মা এবং সুমিতের, তা থেকে মায়ের আর রেহাই মেলেনি। পরের হেঁসেল ঠেলতে ঠেলতেই একদিন সুমিতকে একা করে দিয়ে মা চলে গেলেন না ফেরার দেশে। সুমিতের সেবার কলেজের শেষ বছর...।
আজ সুমিতের বাড়ির রান্নাঘরটি সমস্ত আধুনিক সুযোগ-সুবিধেযুক্ত। কোত্থাও এতটুকু তেল-কালি নেই। কিচেন চিমনি, এয়ারফ্রাইয়ার, মাইক্রোওয়েভ, মিক্সার গ্রাইন্ডার, ওয়াটার পিউরিফাইয়ার প্রভৃতি নানা আধুনিক সরঞ্জাম দিয়ে ওয়েল ডেকোরেটেড্ রান্নাঘর। রান্নাঘর নিয়ে স্ত্রী সুপতা বেশ শ্লাঘা অনুভব করে। তার রান্নাঘরে দেশী-বিদেশী, সাবেকি-নতুন নানা রেসিপি ট্রাই করে সে। সব কিছুই রয়েছে। শুধু সুমিতের বুক জুড়ে কিসের যেন এক শূন্যতা...
— "বা-আ-আ-পি-ই-ই! ওহ্ তুমি কখন ফিরে এসেছ? চুপচাপ বসে আছ যে এখানে! জামাকাপড় ছাড়নি কেন? চল চল।"
মেয়ে তিন্নি এসে গলা জড়িয়ে ধরে সুমিতের।
— "জানো বাপি, মা না আজ একটা ডেলিশাস সুইট ডিশ বানিয়েছে! ইয়াম্মি! ভারী সুইট নামটাও, জানো? 'দুধ পুলি'। ওঠ, ওঠ... এক্ষুনি খাবে, চলো।"
ফোকলা দাঁতে হাসতে থাকে তিন্নি।
—" না রে সোনা মা, দুধ পুলি আমি কক্ষনো খাই না। ছোটবেলা থেকেই ওই একখানা পিঠে আমার এক্কেবারে অপছন্দের। তোমারাই খাও। তোমার মাকে বরং বল আমায় এককাপ কড়া করে কফি দিতে।"
গাল বেয়ে নেমে আসা চোখের জল লুকিয়ে তাড়াতাড়ি বাথরুমে ঢুকে যায় সুমিত।
ভুলভুলাইয়া
লীনা রায়
অফিস থেকে ফিরেছি। কলিং বেলে হাত রাখতেই দরজা খুলে গেল। বোধহয় লোপা আমার অপেক্ষাতেই ছিল। ওকে দেখে অবাক হলাম। থমথমে মুখ, চোখ দুটো লাল। মনে হল খুব কান্নাকাটি করেছে।বুঝতে পেরেছিল আমি কারণ জানতে চাইছি।বলল দুপুরে খবর পেয়েছে ওর বাবা খুব অসুস্থ। ও বাবাকে দেখতে যেতে চায়। বাপের বাড়ি যাবে সেটা ঠিক আছে। অসুবিধে অন্য জায়গায়। ও ভাল করেই জানে আমার আজ কিছুতেই যাওয়া সম্ভব নয়। কাল অফিসে জরুরি মিটিং। আর সেটা সপ্তাহখানেক আগেই ঠিক করা। এদিকে প্রেজেন্টেশনও শেষ করে উঠতে পারি নি। কী করব ভাবছি। লোপা নিজেই মুশকিল আসান করে। ঠিক করে আজ ও একাই যাবে। আমি কাল অফিস ফেরত যাব।ব্যাগ গোছানো ছিল। তাড়াতাড়ি ওকে নিয়ে বের হলাম।
লোপাকে বাসে তুলে দিয়ে ঘরে এলাম। ফ্রেশ হয়ে এক কাপ চা বানালাম। টিভি অন করে ল্যাপটপ নিয়ে বসলাম।খবর শুনতে শুনতে প্রেজেন্টেশনের কাজ এগোতে থাকি। কাজ শেষ হতে হতে রাত প্রায় দশটা। খুব খিদে পেয়েছে। বিকেলে আজ কিছু খাওয়া হয় নি। তাড়াতাড়ি খাবার বের করে গরম করে নিই। খেতে বসতেই বিপত্তি। লোডশেডিং।মোবাইল ফোনের টর্চ জ্বালিয়ে মোম, দেশলাই বের করি। মোমের আলোয় ডিনার করে নিলাম। এঁঠো বাসন সিংকে রাখার সময় কারেন্ট এলো। আমি তাড়াতাড়ি সব সেরে সোজা বিছানায়।খুব ক্লান্ত আজ। বালিশে মাথা রাখতেই চোখের পাতা ভারি হয়ে এলো।
একটা অদ্ভুত অস্বস্তি বোধ কিছুতেই ঘুমোতে দিচ্ছে না। কেবল মনে হচ্ছে আমি একা নই। আর কেউ ঘরে আছে।গভীর রাত, খাটে এপাশ ওপাশ করছিলাম। হঠাৎ যেন মেঝে থেকে উঠে এলো শব্দটা। চমকে উঠে বসি। বেড সুইচ টিপি। কিন্তু আলো জ্বলে না। বোধহয় লোডশেডিং।কেমন একটা ভয় লাগতে থাকে।মোবাইল ফোনের টর্চ জ্বেলে সারা ঘরে আলো ফেলি।কিছু চোখে পড়ে না।
কিছু উল্টোপাল্টা ভয় মিশ্রিত ভাবনা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। এখন কেবল ভোর হবার অপেক্ষা। বিয়ের পর এ বাড়িতে আমার লোপার সংসার জীবন শুরু।এর আগে কখনো একা থাকি নি। একা আছি বলেই হয়ত ভয় করছে। তবে শব্দটা আমি স্পষ্ট শুনেছি।
আবারও খুট করে একটা শব্দ। বারবার মনে হচ্ছে কিছু তো আছে। হাত, পা অবশ হয়ে গেছে। হঠাৎ মুখের ওপর জোরাল আলো। আমি চোখ খুলতে পারছি না।মুখটা আলোর বৃত্তের বাইরে নিয়ে কে মুখে আলো ফেলছে তাকে দেখতে চাইলাম। একটা হাত আমার মুখ চেপে ধরে।
প্রতিরোধ করার সামান্য শক্তিও নেই।আলোটা সামান্য হলেও চোখে সয়ে এসেছে। সেই আলোতেই দেখলাম একটা চকচকে ছুরি। প্রচন্ড ক্ষিপ্রতায় আমার গলায় নেমে এলো।ফিনকি দিয়ে গরম রক্ত বেরিয়ে ভেসে যেতে লাগল শরীর। আমি দু' হাতে গলা চেপে ধরলাম। একটা জান্তব শব্দ বের হচ্ছে আমার মুখ থেকে।হঠাৎ আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতে যেতে কানে এলো একটি পুরুষ কণ্ঠ – “কাজ হয়ে গেছে লোপা.….. ”
পরিপ্রেক্ষিত
অর্পিতা দাস
এই নিয়ে নেই নেই করে এক মাসে প্রায় দশ দিন সে আসেনি। এদিকে তুলতুলের স্কুল,আদৃতের অফিস... একা হাতে সব সামাল দেওয়া...
''উফ্, আর পারা যাচ্ছে না"
একা একা স্বস্তিকাকে কথা বলতে দেখে আদৃত শান্ত গলায় বলে, "আচ্ছা,এখন বেশি কিছু করতে হবে না তোমায় ,আজকের লাঞ্চটাও আমি ক্যান্টিনেই খেয়ে নেব ।"
"সে না হয় হল, তা মহারানী কী এভাবেই চালাবে... পরের মাসে আমি..."
"সে তুমি যা ভালো বোঝো।"
আদৃত বেরিয়ে যাবার পর আলুথালু বেশে চন্দনা এসে উঠোনে লুটিয়ে পড়ে, "বৌদি, তুমি আমাকে গালমন্দ যা খুশি কর, এখন অন্তত পক্ষে দু'হাজার টাকা দিয়ে আমায় উদ্ধার কর। "
স্বস্তিকা কিছুই বুঝে উঠতে পারে না।
চন্দনা ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে," মানুষটার ভীষণ অসুখ গো..."
"যে মানুষটা তোকে একদিনের জন্যও সুখ দিতে পারেনি, তারই জন্য তুই কেঁদে মরছিস।"
চোখের জল মুছে কপালে হাত ঠেকিয়ে চন্দনা, " যতই হোক স্বামী তো। "
স্বস্তিকার কাছে টাকা পেয়ে "দুগ্গা দুগ্গা" করে বেরিয়ে পড়ে চন্দনা। স্বস্তিকার সারাদিন কাজের ফাঁকে ফাঁকে মনে হতে থাকে চন্দনার সেই, "যতই হোক স্বামী" কথাটা।
সত্যিই নারী হৃদয় বড়ই বিচিত্র,যখন- তখন যে ঘরের থেকে বের করে দেয় তাকেই সুস্থ করে তোলার জন্য হন্যে হয়ে ফিরছে। ঠাকুর ওকে শক্তি দিও সবটা সইবার ...
স্বস্তিকার চোখেও জল টলমল করতে থাকে।
অনুভূতি
মনোমিতা চক্রবর্তী
-- আহ্ আজ বড় শান্তি লাগছে ! জানিস বুনু নারায়ণ বাবু আমার প্রশংসা করে বললেন আমার মতো এতো ভালো কাজ ক'জন করে।আসলে,ব্রাহ্মণদের কত্ত দান করলাম বল ? নিয়ম ভঙ্গের অনুষ্ঠানের খাওয়ার দাওয়ারও যা প্রশংসা করলেন না উনি কি বলবো তোকে!বিশেষ করে সরষে ইলিশ, মায়ের খুব পছন্দের ছিল যে,তাইতো করেছি ।
এক মুখ হাসি নিয়ে অনসূয়া বলে-- হ্যাঁ দাদা মায়ের পরলৌকিক কাজে দান করে, লোক খাইয়ে তুমি শান্তি পেয়েছ কিন্তু আমার শান্তি কোথায় জান ? যখন তুমি কাজের দোহাই দিয়ে বাড়িতে মাকে একলা ফেলে রেখে গিয়েছিলে তখন মাকে আমার কাছে এনে যা পেরেছি খাইয়েছি, যত্ন করেছি , সাধ্য মতো বেড়াতে নিয়েগেছি। সব সময় পাশে থাকার চেষ্টা করেছি।
বলেই অনসূয়া হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলে।
-- বয়স হয়েছে তাই মা গত হয়েছেন এত আক্ষেপ এর কি আছে বুনু ?
অনসূয়া -- ঠিকই বলেছ দাদা, তুমি বড়লোক ,তুমি লোক খাইয়েই শান্তি পেয়েছ কিন্তু আমি তো মায়ের সান্নিধ্যেই শান্তি পেতাম।কি আর করা যাবে আমাদের অনুভূতি গুলোই যে আলাদা দাদা।
No comments:
Post a Comment