ফোকাস: ভ্রমণ
পাতালপুরীর রাজপ্রাসাদে
সুদীপ মজুমদার
রাজপ্রাসাদই বটে, তবে সেটা আমাদের দেশ থেকে অনেক অনেক দূরে, সুদূর আমেরিকায়। ভার্জিনিয়া রাজ্যের লুরে শহরের পশ্চিমে সেনানদোহা ভ্যালিতে মাটি থেকে প্রায় ১৬৫ ফুট নিচে ৮০ একর জায়গা জুড়ে এই রাজপ্রাসাদ। গত ২৭শে জুলাই,২০২৪ আমাদের সৌভাগ্য হয়েছিল এই জায়গা ঘুরে আসার। ঐ সময় আমেরিকায় ভাইয়ের বাড়ি ছিলাম। ওখান থেকে সবাই মিলে আমরা প্রকৃতির এই আশ্চর্য বিস্ময় লুরে ক্যাভার্নস দেখতে এসেছিলাম।
আসলে লুরে ক্যাভার্নস পৃথিবীর দীর্ঘতম প্রাকৃতিক গুহা। প্রকৃতির অগাধ ঐশ্বর্যে ভরা আমাদের এই পৃথিবী। প্রকৃতির এই সৌন্দর্যৈর কোনো তুলনা হয়না। প্রকৃতির তেমনই এক কীর্তি এই লুরে ক্যাভার্নস। টিকিট কাউন্টার থেকে টিকিট কেটে আমরা লাইন করে সুশৃঙ্খল ভাবে প্রায় একশো মিটার হেঁটে ধীরে ধীরে গুহায় প্রবেশ করলাম। মূল গুহায় ঢোকার আগে দুদিকে দেওয়াল জুড়ে এই গুহা সম্পর্কে সবকিছু বিশদে ডিসপ্লে করা আছে।
আবিষ্কারের গল্প - লুরে ক্যাভার্নস আবিষ্কার করেন এন্ড্রু ক্যাম্পবেল, সঙ্গে তাঁর ফটোগ্রাফার বন্ধু বেনটন স্টেবিস ও তেরো বছর বয়সী ভাইপো কুইন্ট। তারা তিনজনই এখানকার স্থানীয় বাসিন্দা। সেনানদোহা ভ্যালির বিস্তৃত এলাকা জুড়ে চুনাপাথরের উপস্থিতি তাদের আকৃষ্ট করে।১৮৭৮ সালের ১৩ ই আগস্ট গুহার কাছাকাছি এক গর্ত থেকে ঠান্ডা হাওয়া বের হয়ে আসছে দেখে ভেতরে কি আছে দেখার জন্যে এই তিনজন উৎসাহিত হয়ে পড়েন। শুরু হয়ে যায় ওনাদের গুহা রহস্য অভিযান। দেওয়ালে ওনাদের ছবিও রাখা আছে।
আরও যেসব তথ্য দেওয়া আছে তা হল এই গুহার দৈর্ঘ্য ২.৪ কিমি, ঘুরে দেখতে সময় লাগে ৪৫ মিনিট থেকে এক ঘন্টা ইত্যাদি। এন্ড্রু ক্যাম্পবেল সহ তিনজন আরো কিছু মানুষের সাহায্যে ওখানে খনন শুরু করেন। চার ঘণ্টা ধরে গর্ত খোঁড়ার পরে ওনারা একটা সুড়ঙ্গের খোঁজ পান। কিন্তু এই সুড়ঙ্গ দিয়ে ছোটখাটো চেহারার ক্যাম্পবেল ও কুইন্ট ছাড়া আর কারো প্রবেশ করা সম্ভব ছিল না। দড়ির সাহায্যে কিছুদুর নামতেই ওনারা এক স্বর্গীয় দৃশ্যের সাক্ষী হলেন। গুহার অপার রহস্য দেখে দুজনেই কিছুক্ষণের জন্য নির্বাক হয়ে পড়েন।

নির্বাক হবার দশা আমাদেরও হয়েছিল। প্রকৃতির এই বিষ্ময়কর জগৎ স্বচক্ষে না দেখলে এর সৌন্দর্য অনুভব করা সত্যিই কঠিন। এই পাতালপুরীতে ঢুকে প্রথমেই মনে হয়েছিল প্রকৃতির এক আশ্চর্য সাজঘরে এসে পড়লাম। বিদ্যুতের আলোয় গুহাগুলো যেন ঝলমল করছে। অসাধারণ প্রাকৃতিক কারুকার্য ও রঙের খেলা দেখে মুগ্ধ হয়ে পড়তেই হয়। গুহার তাপমাত্রাও খুব আরামদায়ক। সৌন্দর্য বর্ণনা করার আগে একটু বলি কিভাবে গড়ে উঠেছে প্রকৃতির এই আশ্চর্য বিস্ময়। মাটির নিচে পাহাড়ের চুনাপাথর মেশানো জল গলে গিয়ে অসংখ্য স্টেলেকটাইট ও স্টেলেকমাইটের সাহায্যে এই গুহা গুলো তৈরি হয়েছে। স্টেলেকটাইট হল দানা বাঁধা ক্যালসিয়াম কার্বনেট। হাজার হাজার বছরের বিন্দু বিন্দু জল ও অন্যান্য খনিজ পদার্থ এর সাথে যুক্ত হয়ে তৈরি হয়েছে জমাটবদ্ধ ক্যালসিয়াম কার্বনেট। এই জমাটবদ্ধ ক্যালসিয়াম কার্বনেট গুহার ছাঁদ থেকে নানা আকারে নীচের দিকে নেমে এসেছে। স্টেলেকমাইট আর এক প্রকার জমাটবাঁধা ক্যালসিয়াম কার্বনেট যা গুহার মেঝে থেকে ওপরের দিকে বেড়ে ওঠে।

এবার এই চোখধাঁধানো সৌন্দর্যের কথা একটু বলি। এই নীচের দিকে নামা আর উপর দিকে ওঠা এই দুটো পরস্পর মিলে গিয়ে অদ্ভুত আকৃতির স্তম্ভগুলো গঠিত হয়েছে। মনে হয় কারা যেন অপূর্ব কারুকাজ করা অনেকগুলো থাম প্রাচীন কোনো স্থাপনার থামের মত গুহার ভেতরে সাজিয়ে রেখেছে। গুহায় যে কত ধরনের স্ট্যালেকমাইট ও স্ট্যালেকটাইট মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে তার ইয়ত্তা নেই। গুহার কোথাও ছাঁদের কার্নিশ থেকে তোয়ালের আকারে পাতলা পাথর থরে থরে ঝুলে আছে , কোথাও বা তা ঝালরের মত ওপর থেকে ঝোলানো। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে রঙের খেলা।
লোহা মেশানো পাথর থেকে এসেছে লাল রঙ, তামা মেশানো পাথর দিয়েছে সবুজ রঙ। এভাবে বিচিত্র রঙের পাথরের স্তম্ভ, জোড়া স্তম্ভ, জলপ্রপাতের মত ঝালরগুচ্ছ, ভৌতিক স্তম্ভ, ভাঁজ করা কাপড়চোপড়ের মত বৈচিত্র্যময় সব সৃষ্টি, কোথাও মন্দিরের চূড়া, কোথাও বাবা লোকনাথ, কোথাও আলখাল্লা পরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কোথাও বা পাথরের ডিমের পোঁচ যা নির্বাক হয়ে মুগ্ধ চোখে শুধু দেখে যেতে হয়। তাও রীনা আর আমি মোবাইল ফোনে কিছু ছবিও তুললাম, যদিও জানি ছবি দিয়ে এই সৌন্দর্যের অর্ধেক ও বোঝানো যাবে না।
লুরে ক্যাভার্নস এর আরও একটি আকর্ষণীয় স্থান উইশিং লেক। সবাই তাদের মনের ইচ্ছা এখানে জানান দিয়ে যায়। গুহার এক জায়গায় চুঁইয়ে পড়া জল জমে এক কৃত্রিম সরোবর তৈরি করেছে, এর মধ্যে রঙিন কারুকার্যের যে প্রতিচ্ছবি দেখা যায় তাতে মনে হয় খুব গভীর সরোবর, আসলে এর গভীরতা দু ইঞ্চিরও কম। সত্যিই বিস্ময়কর। এই আলো ঝলমলে গুহার ভেতরে পাথরের অসাধারণ কারুকাজ ও রঙের অফুরন্ত খেলা দেখে কেমন যেন একটা ঘোরলাগা অবস্থায় আমরা ধীরে ধীরে গুহার থেকে মানে এই পাতালপুরীর রাজপ্রাসাদ থেকে বেরিয়ে এলাম।
উত্তরের দেশ ডেনমার্কে
চিত্রা পাল
উত্তর দিকের দেশ বলতেই ধরে নিই পাহাড় পর্বত তুষারাবৃত পর্বতগাত্র আর তার সঙ্গে হাড় হিম করা শীত। তাই উত্তরবৃত্তের দেশে যাবার কথা উঠতেই বললাম, ‘ওরে বাবা খুব শীত’।আধুনিক নেটওয়ার্কের যুগে ওসব ধারনা টারনা দূরে রেখে যখন বাস্তবে দেখলাম,শীতকালে সত্যিই খুব শীত, কিন্তু বছরের বেশ কয়েক মাস আমাদের সহযোগী আবহাওয়া,মানে আমাদের এই গরমদেশের লোকের পক্ষে আর তা ভ্রমণের অনুকূল তখন যাবার তোড়জোড় শুরু কোরে দিলাম।এই সব শীতের দেশে মোটামুটি এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত থাকে নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া। এক ট্র্যাভেল কোম্পানির সহযোগিতায় স্ক্যানডিনেভিয়ান দেশগুলোতে ঘোরার ব্যবস্থা পাকা হয়ে গেল।
ভ্রমণের ব্যবস্থা পাকা হয়ে গেল মানে আমাদের ফ্লাইটের টিকিট রিজার্ভ হয়ে গেল।আমরা যাবো এমিরেটসের ফ্লাইটে মুম্বই থেকে দুবাই। তারপর দুবাই থেকে ডেনমার্ক। তারিখ চোদ্দই আগস্ট, ভোর সাড়ে চারটে।এদিকে আগস্টের প্রথম সপ্তাহ থেকে মহারাষ্ট্ জুড়ে নেমেছে ঘনঘোর বর্ষা। তা একেবারে ঘনীভূত হয়ে উঠলো ৭/৮ তারিখ নাগাদ। মুম্বাই শহর জলমগ্ন, জনজীবন বিপর্যস্ত। এদিকে আমরা উৎকণ্ঠিত,ঠিকঠাক সময়ে বিমানবন্দরে পৌঁছতে পারবে তো? দু একদিন পর থেকেই আবহাওয়ার উন্নতি হতে শুরু হল, আমরা আশায় বুক বেঁধে ১০ই আগষট তিস্তাতোরষায় পাড়ি দিলাম কলকাতা। ১২ তারিখে হাওড়া থেকে দুরন্ত ধরে মুম্বাই । মুম্বাই থেকে দুবাই হয়ে সোজা ডেনমার্ক।
ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনে পৌঁছতে দুপুর হয়ে গেলো।স্থানীয় সময় একটা বেজে তিরিশ মিনিট নাগাদ পৌঁছুলাম। হোটেলের ঘরে লাগেজ রেখে আমরা বেরিয়ে পড়লাম কোপেনহেগেনের পথে। প্রথমে এলাম টিভোলি গার্ডেনে।এখানকার বিখ্যাত পার্ক টিভোলি গার্ডেন। এই পার্ক ১৮৪৩ সালের ১৫ই আগষ্ট জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়।আমরা আবার সেই দিনেই এসেছি।এক অপূর্ব আলোকমালায় সজ্জিত পার্কে দর্শনার্থীর সংখ্যা ও ছিলো বেশি। এই পার্কে বাচ্ছা থেকে বয়স্ক সবার জন্য আছে নানান খেলার নানান মজার আয়োজন।
দ্বিতীয়দিনে সকালের প্রাতঃরাশ সেরেই শুরু হল ভ্রমণ পর্ব।প্রথমে এলাম রসেলবার্গ ক্যাসেলে।রজেলবার্গ ক্যাসেলের বাগানটাও বৃহত্ পরিসর যুক্ত। রেনেসাঁ স্টাইলে তৈরি এ বাগান তৈরি করেছিলেনChristien 4th সিক্সটিন্থ সেঞ্চুরীতে। এটাই এদেশের সবচেয়ে পুরনো অভিজাত গার্ডেন। আর একটা কথা। ডেনমার্কের রাজাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক বেশ প্রাচীন। কলকাতার কাছে শ্রীরামপুরে ড্যানিশ উপনিবেশ ছিলো। ডেনমার্কের রাজা ফ্রেডারিখ 6th শ্রীরামপুর কলেজের থিওলজি বিভাগকে থিওলজিতে ডিগ্রীদানের বিশেষ সুবিধা প্রদান করেছিলেন। তার ফলে সেই ডিগ্রীর মান ছিলো তাঁর দেশের ডিগ্রীর সমমানের। আর সেক্সপীয়রের অমর কাহিনীর হ্যামলেট ছিলেন ডেনমার্কের রাজা। আবার ড্যানিশ লেখক হ্যান্স এনডারসনের রূপকথা (little Marmaid) মত্স্যকন্যার গল্প আমরা সবাই পড়েছি। সেই মত্স্যকন্যার ব্রোঞ্জ স্ট্যাচু দেখলাম সমুদ্রখাঁড়ির জলের ধারে এক প্রস্তর খন্ডের ওপর। এই মত্স্য কন্যার স্ট্যাচু যেন ডেনমার্কের প্রতীক। কোপেন হেগেন আগে ছিলো ভাইকিং মানে জলদস্যুদের মাছধরার কেন্দ্র বা গ্রাম। তারপরে পঞ্চদশ শতাব্দীতে এটি হয় ডেনমার্কের রাজধানী। এরপরে এলাম ক্রিশ্চিয়ানা প্যালেসে। এ ও ওই একই ধরণের। দুপুরে ড্যানিশ পেস্ট্রির ও কফির সাহচর্যে মুগ্ধ হলাম।
এই শহরে এসে একটা ব্যাপার দেখে মুগ্ধ হলাম, তাহলো এদের পরিবেশ সচেতনতা। অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে জীবনের সব পর্বে তার উপস্থিতি। সাইকেল যেহেতু পরিবেশ বান্ধব, পরিবেশ সহায়ক তাই সাইকেলের ব্যবহার বাড়াতে তার জন্য আলাদা লেনের ব্যবস্থা সব রাস্তার সঙ্গে। শুধু তাই নয়, সাইকেল আরোহীকে পথচারী সবসময় তার চলার সুবিধা দেবে। সাইকেল আসতে দেখলে পথচারীকেই পথ থেকে নেমে তার চলার সুবিধা দেবে, সাইকেল থামবে না, এটাই নিয়ম। এখানে তাই সাইকেল চলেও তীব্র গতিতে। আর নাগরিকেরাও তা মেনে নেয় দ্বিধাহীনভাবে। এর পরে চলে এলাম জাহাজঘাটায়, জাহাজে করে সাগর পাড়ি দিয়ে আর এক দেশে যাব বলে।
চোখ জুড়ানো প্রাণের খেয়া
শ্যামলী সেনগুপ্ত
পায়ের প্রথম পাতা মাটির উপর। প্রথম টলমলে পদক্ষেপ। ভ্রমণের শুরু সেই থেকে। নদীর জলে ঢেউ তুলে বালির ওপর ঘুমিয়ে থাকা ঝিনুক ছুঁয়ে উঠে আসা জলের ওপর,যেখানে রোদের লুটোপুটি।আলপথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে ধানের সবুজ মেখে চুপি চুপি পিছু নেওয়া লাল ভেলভেট পোকাটির। কাঁধে লাঙল নিয়ে আঁকাবাঁকা পথ ধরে হেঁটে যাচ্ছে যে লোকটি, তার ভ্রমণ শেষ হবে পান্তার কাঁসির কাছে,লঙ্কা-মরিচের টাকনায়।না-ফুরনো দিনলিপি রেখে গেছে সেই ভ্রমণের আনন্দ, যখন সন্ধে নেমে যাবে বলে পাঁচ-ছয়টি বালিকা দৌড়ে আসছে চিত্রোৎপলার মাটির বাঁধের উপর দিয়ে প্রাণপণে, অর্জুনপুরের বন্ধুদের সাথে খেলা সাঙ্গ করে। তারা দৌড়চ্ছে, পিঠের উপর সাপের মতো নাচছে তাদের বিনুনি, খেজুর-চোটির বাঁধন সহ। তাদের ছোট্ট বুকে হাওয়ার দাপন। সন্ধে নামব নামব বেলায় পৌঁছতে পারার তীব্র 'হ্যাঁ' নিয়ে এই দৌড়বাজি। সাঁ সাঁ করে পেরিয়ে যাচ্ছে বাঁধের নীচের সর্ষে বাগান, আলু ক্ষেত। শীতের নদীটিও গুটিয়ে নিয়েছে নিজেকে চরের আড়ালে।চিত্রোৎপলার হাওয়া-জলে বেড়ে ওঠা সময় মহানদীর বালি ছুঁয়ে পৌঁছে যায় জঙ্গল,পাহাড়ের ঘেরাটোপে।সেই ভ্রমণপথে বন্ধুরা ইশকুল ড্রেসে সকালে প্রার্থনার ক্লাস থেকে শেষ পিরিয়ডের ঘন্টার ঠিনঠিন অব্দি থাকলেও ঘরে ঢুকে পরে নেয় নেংটি। আদুর গায়ে নেংটি পরে দিব্যি তারা ঘুরে বেড়ায় গ্রামপথে, বাঁধের জলে স্নান সারতে যায়।এই ভ্রমণে কতকিছুই দেখা হয়ে যায়। স্কুল পিকনিকে মহানদীর বালি আঁচড়ে মুমফলি বের করে আনা আর শিখে ফেলা মুমফলির খোলাটি প্রথম দিকে ভারি নরম থাকে আর দানাগুলি দাঁতে কাটলে বাদামের দুধে দাঁত আর জিভ মাখো মাখো হয়ে ওঠে। সেই ভ্রমণে উপরি পাওনা, নৌকোয় মহানদী যাত্রা। লম্বা নৌকোটি ষষ্ঠ, সপ্তমের নুনা-নুনিদের নিয়ে এগিয়ে যায় জল কেটে।দু'ধারে পাহাড়।নদী যেখানে বাঁক নিয়েছে, সেখানে জলের গভীর দাঁড় পায় না আর। তাই ফিরতি পথে সূর্য ডোবার আগের আকাশে আবীর ছড়িয়ে বৈঠার ছপছপ মেপে শেষ জানুয়ারির শীতল হাওয়া মনকেমনের গল্প হয়ে ওঠে। আজও সেই ভ্রমণের স্বাদ পাই চোখ বুঁজলে। সরকারি ভবনের সামনের দিগন্ত বিস্তৃত মাঠে চাঁদের আলো লুটিয়ে পড়ে। রাত জমে উঠলে সেই রুপোলি মাঠ অভিশপ্ত হয়ে ওঠে।ফেউয়ের ডাক চাঁদের রুপোলি ছুঁয়ে ছুঁয়ে ভবনের জানলার কাঠের পাল্লায় আঘাত করলে বাবা বলেন,বাঘ বেরিয়েছে।জানলা খুলে আমরা দেখতে পাই দিগন্তে-বিস্তার সেই মাঠ ঘেঁষে যে জঙ্গল, সেখানে খ্যা-খ্যা শব্দে হুণ্ডারের যাতায়াত,সামনের ছোট দুই পা ঝুলে থাকে। ভয়ে আমরা জানলা বন্ধ করে দেই।বাবা বলেন,অত ভয় পেতে নেই। জানলায় লোহার মোটা শিক-এর গরাদ। বাবা বলেন,প্রাণ ভরে দেখতে।প্রাণের খেয়া চেপে সেই ভ্রমণের দিক বদলে যায়। বৈতরণীর পাড়ের ভ্রমণ নতুন কাহিনী বোনে।বৈতরণীর জলে ভেসে যায় কার্তিক পূর্ণিমার বোইত। 'আ-কা-মা--বোই/গুয়াপান থোই।' কলা গাছের মাইজ দিয়ে বানানো নৌকোয় উড়ছে রঙিন কাগজের তে-কোণা পতাকা। ভেতরের প্রদীপের আলোয় ঝলসে ওঠে স্রোতের চলন। এই ভ্রমণের সঙ্গী এক গভীর রাত। মধ্য রাত পেরিয়ে বাস এসে দাঁড়ায় কটক শহরের বাদামবাড়ি বাস টার্মিনাস ছেড়ে কেওনঝর যাওয়ার রাস্তায়। নেমে আসে এক ছাত্রী আর দুই শিক্ষক-দিদি। একজন আমার মাতৃরূপা,অন্য জন দিদি।একজন ইংরেজি সাহিত্য, অন্য জন ভূগোল। চাঁদের আলোর ঢেউ তোলা বৈতরণীতে বয়ে যায় নৌকা। একলা মাঝি টেনে নিয়ে যায় তিন কন্যাকে। গভীর রাতের সেই নৌকো ভ্রমণের মতো আর ভ্রমণ পেলাম কই!!!
আমার জীবনের যাত্রা পথ এই তিন নদী ঘিরে। শৈশব থেকে তারুণ্যের অসাধারণ এই পথ!এই পথ আমাকে ভ্রমণের আনন্দ দিয়েছে। জীবনের জোয়ার-ভাঁটা চিনিয়ে দিয়েছে। শিখিয়েছে জল যাত্রায় সামাল সামাল বলে সামলে নিতে হয় নদী আর নৌকোকে।
একদা গোদাবরী তীরে
কবিতা বণিক
“গোদাবরীতীরে আছে কমলকানন
সেথা কি কমলমুখী করেন ভ্রমণ?”
এই কমলমুখী হলেন ত্রেতা যুগের শ্রীরামচন্দ্র পত্নী মাতা সীতাদেবী। শ্রীরামচন্দ্র , যিনি পিতার আজ্ঞায় বনবাসী হয়েছিলেন। সে সময় গোদাবরী তীরে পর্ণকুটীরে , এই দণ্ডকারণ্যে পত্নী সীতাদেবী ও ভাই লক্ষণের সাথে বাস করছিলেন। বারো বছর চিত্রকূটে কাটাবার পর ভরদ্বাজ মুনির কথায় তাঁরা দণ্ডকারণ্যে গোদাবরী তটে আসেন। সেখানে অগস্ত্য মুনির সাথে সাক্ষাত হয়। এখন দেখলাম তাদের পর্ণ কুটিরের পাশেই আছে অগস্ত্য মুনির মন্দির। এখন যদিও পর্ণ কুটির নেই। খুব সুন্দর ভাব মাধুর্যে ভরা শ্রীরাম,সীতা, লক্ষণের মন্দির। এক বছর চৌদ্দ দিন এই স্হানের পঞ্চবটীতে তারা বাস করেছিলেন বলে শোনা যায়। এখন এই জায়গা মহারাষ্ট্রের নাসিক শহর থেকে প্রায় দশ কিলোমিটার দূরে অবস্হিত। দেবী সীতাকে হারিয়ে শ্রীরামচন্দ্র এই গোদাবরীর পদ্মবনে দেবী সীতাকে খুঁজতে এসেছিলেন। শোনা যায় সত্যযুগে ব্রহ্মা পদ্মাসনে বসে সৃষ্টির পরিকল্পনা করেন এখানকার এই গোদাবরী তীরে , তখন এই জায়গার নাম ছিল পদ্ম নগর। হয়ত প্রচুর পদ্ম ফুল ফুটত। ত্রেতা, দ্বাপর যুগ শেষ করে এসময়ে পদ্মফুলের চিহ্ন মাত্র দেখলাম না। আবার এখানেই সাংখ্য দর্শন রচয়িতা কপিল মুনি এই গোদাবরী তীরে তপস্যা করেন। তাঁর তপস্যায় সৃষ্ট কপিলা নদী এখানেই গোদাবরীর সাথে মিলিত হয়েছে। একদম শান্ত ভাবে বয়ে চলেছে কপিলা নদী , অন্যদিক থেকে কলকল ছলছল শব্দে বয়ে চলা গোদাবরী নদী ও কপিলা নদীর মিলন স্হল দেখে ধন্য হলাম।মনকে শান্ত করার এক আশ্চর্য্য আনন্দময় স্হান। এই জায়গায় কপিল মুনির এক মূর্তি বসানো আছে। অবাক হয়ে দেখি গোদাবরী নদীর ওপর পাড়ে অনেকটা উুঁচুতে সোনালী রংএর নৌকো, শ্রীরামচন্দ্র, সীতা মাতা ও লক্ষণের সুন্দর কাটআউট রাখা আছে। যে কেওট বা মাঝি তার নৌকায় শ্রীরামচন্দ্র, সীতা মাতা ও লক্ষণকে নদী পার করেছিলেন , শ্রীরামচন্দ্রের আশীর্বাদে কেওটের নৌকা সোনায় পরিনত হয়েছিল। সূর্যের স্বর্ণালী আলোর প্রতিফলনে আরো মনোমুগ্ধকর হয়ে উঠেছে ঐ কাটআউটের বিগ্রহ। ত্রেতা যুগের এই ঘটনার কথা স্মরণ করিয়ে দেয় ঐ সুদৃশ্য কাট আউট বিগ্রহ।

শহরটির নামকরণ হয় নাসিক, অর্থাৎ নাসিকা থেকেই নাসিক কথাটির উৎপত্তি। শ্রীরামচন্দ্রের বনবাস কালে লঙ্কা অধিপতি রাবণের বোন সূর্পনখা মোহিনী বেশ ধরে লক্ষণকে বিবাহ করতে চাইলে লক্ষণ বার বার ফিরিয়ে দেওয়ায় সূর্পনখার রাগে রাক্ষসী রূপ বেরিয়ে পড়ে। তখনই লক্ষণ তার নাক কেটে ফেলে এই গোদাবরী তীরেই। এখানে পাথরে লক্ষণের নাক কাটার দৃশ্যও খোদাই করা আছে। রামসীতার মূর্তির কাছেই আছে পঞ্চ কুণ্ড। ব্রহ্ম কুণ্ড, বিষ্ণু কুণ্ড, মহেশ্বর কুণ্ড। এর কাছেই অগ্নি কুণ্ড ও মুক্তি কুণ্ড। এর পাশে রয়েছে সীতা মায়ের স্নানের জায়গা। কুণ্ডগুলো ডিসেম্বর থেকে মে মাস পর্যন্ত দেখা যায়। অন্য সময় গোদাবরী নদীর জলে ভর্তি থাকে। তুলসী দাসের রামায়ণের অরণ্য কাণ্ডে আছে শ্রীরামচন্দ্র সীতামাতাকে এই স্হানে অগ্নি দেবের কাছে রেখে যান ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরকে সাক্ষী রেখে। সূর্পনখা ছিলেন লঙ্কাপতি রাবণের বোন। রাবণের কুমতলবের আশঙ্কা করেই সীতামাতাকে অগ্নিদেবের কাছে রেখে তার ক্লোন মূর্তি বেদবতী মাতাকে পঞ্চবটীতে নিয়ে যান। গোদাবরী তট থেকে কিছুটা দূরে পঞ্চবটী বা পাঁচটি বটগাছের সমাহার। সেখানেই আছে সীতা গুহা। আজও সেই স্হানে বট গাছের সমাহার দেখা যায়। পাঁচটি গাছেদের গায়ে নম্বর দেওয়া আছে। পঞ্চবটীর সীতাগুহার মন্দিরে প্রবেশ করার পর খুব সরু পাথরের গুহা-পথ নীচের দিকে নেমে গেছে , যেখানে পাশাপাশি দুজন কোনভাবেই নামতে পারে না। নীচে নামার পর বেশ প্রশস্ত জায়গা। সেখানে শ্রীরামচন্দ্র, সীতা মাতা ও লক্ষণের বিগ্রহ পূজিত হয়। গুহার বাইরে এই স্হান থেকেই রাবণ সীতামাতাকে লঙ্কায় নিয়ে যান। রাবণ প্রথমে খর ও দূষণ নামে দুজন রাক্ষসকে প্রচুর সৈন্য সহ পাঠালে শ্রীরামচন্দ্র মোহিনী বাণ ছুঁড়লে সৈন্যরা প্রত্যেকেই একে অপরকে শ্রীরামচন্দ্র ভেবে যুদ্ধ করছেন। এইভাবে যুদ্ধে সমস্ত সৈন্য মারা গেলে শ্রীরামচন্দ্র খর ও দূষণকে বধ করেন। এরপর রাবণ রাক্ষস মারীচের সাহায্যে ( ক্লোন) সীতা হরণ করেন। গোদাবরীর ঠাণ্ডা শীতল জল স্পর্শ করে ও রামায়নের স্মৃতি বিজরিত স্হান দর্শন করে নিজেকে ধন্য মনে হল। হয়তো স্হান মাহাত্ম্যেই মনটা বেশ শান্ত হয়ে গেল। সমুদ্র মন্হনে উঠে আসা অমৃত কলস থেকে এক ফোঁটা অমৃত পড়েছিল গোদাবরী নদীর রাম কুণ্ডে। বার বছর পর পর কুম্ভ মেলা হয় এই গোদাবরী তটে। এই কুণ্ডের জলে স্নান করে স্বয়ং বিষ্ণু এবং মহেশ্বর শাপ মুক্ত হয়েছিলেন। তাই এই কুণ্ড হরিহর কুণ্ড নামেও পরিচিত। ত্রেতা যুগে শ্রীরামচন্দ্র পিতা দশরথের অস্হি বিসর্জন করে এই কুণ্ডে স্নান করেছিলেন বলে এই কুণ্ডকে রামকুণ্ড বলা হয়। এই কুণ্ডে আজও মানুষ তর্পণ করেন পিতৃপুরুষেদের উদ্দেশ্যে। পশ্চিমভারতের কাশী বলা হয় নাসিককে। পূণ্যতোয়া গোদাবরী এখানে মা গঙ্গার মতোই পূজিতা হন। গৌতম ঋষির তপস্যার ফলে ব্রহ্মগিরি পাহাড়ের ওপর থেকে নেমে আসে পবিত্র গোদাবরী নদী। এই নদীকে গৌতমী গঙ্গা বলা হয়। এখানে গোদাবরী মায়ের মন্দির শুধু কুম্ভমেলার একবছর খোলা থাকে। বাকি এগারো বছর শুধু কার্তিক পূর্ণিমার দিন খোলা থাকে।
ব্রহ্মগিরি পর্বতে গৌতমঋষি ও তার স্ত্রী অহল্যা দেবী থাকতেন। একবার অন্যান্য ঋষিরা মিলে প্রতারণার মাধ্যমে গৌতম ঋষিকে গো হত্যার দায়ে অভিযুক্ত করেন। নিদান দিয়েছিলেন যে পাপ থেকে মুক্তি পেতে গঙ্গাদেবী কে আনতে হবে। সে কারণে গৌতম ঋষি শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করে পূজো শুরু করেন। ফলে দেবী পার্বতী ও মহাদেব খুশি হয়ে বর প্রার্থনা করতে বললেন। গৌতম ঋষি দেবী গঙ্গাকে আনার কথা বললে দেবী গঙ্গা বলেন মহাদেব অধিষ্ঠিত থাকলেই তিনি আসবেন। দেবী গঙ্গার ইচ্ছানুসারে মহাদেব ত্র্যম্বকেশ্বরে জ্যোতির্লিঙ্গ রূপে অধিষ্ঠিত হন। তাই দেবী গঙ্গা এখানে গৌতমী গঙ্গা নামে প্রবাহিতা, যাকে আমরা গোদাবরী নদী বলি। নাসিক শহর থেকে ত্র্যম্বকেশ্বর প্রায় সাঁইত্রিশ কিমি দূর। ঋষি গৌতম ব্রহ্মগিরি পর্বত থেকে নেমে আসা মা গঙ্গার স্পর্শে গোমাতার প্রাণদান করেছিলেন এবং ত্র্যম্বকেশ্বর মন্দিরের কাছে কুশ দিয়ে গোদাবরীর জলকে চারিদিক আটকে রেখে সেই জলে স্নান করে গো হত্যার পাপ থেকে নিজে মুক্ত হয়েছিলেন। এই কুণ্ডকে কুশাবর্ত কুণ্ড বলা হয়। কুম্ভ মেলার সময় এই কুণ্ডেও স্নানপর্ব চলে। পূণ্যার্থীরা গোদাবরীর এই কুণ্ডে তর্পণ করেন। গঙ্গা দেবী গায় বা গো মাতার উপর দিয়ে প্রবাহিতা হলেন, গোমাতার জীবন রক্ষা হল বলে নাম হল ‘ গোদাবরী’।
বেনারসের পথে পথে
ঋতুপর্ণা ভট্টাচার্য
বেনারস। আমাদের গতবারের পুজোয় উত্তরপ্রদেশ ভ্রমণের শেষ গন্তব্য। এই বেনারস বা কাশীধাম বাবা বিশ্বনাথের জন্য পরিচিত হলেও বেনারসে এলে বাবা বিশ্বনাথের আগে কাশীধামের রক্ষাকর্তা কালভৈরবের পুজো দেওয়ার রীতি। সেইমতো বেনারসে পৌঁছে প্রথম দিনের সকালেই আমরা গেছিলাম কালভৈরবের মন্দিরে পুজো দিতে যেটি বেনারসের বিশ্বেশ্বরগঞ্জ এলাকায় অবস্থিত। গোধূলিয়া চৌক থেকে মন্দিরে পৌঁছতে টোটোতে প্রায় মিনিট কুড়ি লাগে। বেনারসে তখন উৎসবের সময়। পিক সিজন। তাই মন্দিরেও ভিড় ছিল যথেষ্ট। তবে ব্যবস্থাপনা বেশ সুষ্ঠু নিয়মমাফিক হওয়ায় দর্শনে সময় বিশেষ লাগেনি। এমনকি এই মন্দিরে দেখেছিলাম পুজো দেওয়ার লাইনে দাঁড়ানো ভক্তদের নিঃশুল্ক সেবাদানও করছেন অনেক স্থানীয় মানুষজন। উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন পুণ্যধামে এই নিঃশুল্ক সেবার মধ্যে নিয়মিত পথ পরিষ্কার ও গরমের কষ্ট দূর করার জন্য হাতপাখার হাওয়া দেওয়ার চল আছে। অযোধ্যার মন্দির ও রামপথে আমরা মূলত পথ পরিষ্কার ও হুইল চেয়ার সেবা দেখেছিলাম, আর, এখানে দেখলাম হাতপাখার ব্যবহার।
কালভৈরবের পুজো শেষে বেনারসের অলি গলি দিয়ে ঘুরে প্রায় আধ ঘন্টাটাক পরে আমরা গিয়ে নেমেছিলাম ব্রহ্মা ঘাটে। বেনারস প্রধানত ধর্মস্থান হিসেবে পরিচিত হলেও ইতিহাসের চেয়েও প্রাচীন এ শহর আসলে নিজেই এক অনন্য অভিজ্ঞতা। এ শহর যতটা পুণ্যলাভের, ততটাই যেন নিজেকে নতুন করে চিনে নেওয়ারও। এখানে এলে তাই একবার হলেও পুরনো বেনারসকে মাকড়সার জালের মতো ঘিরে থাকা সংকীর্ণ, অপরিসর, এঁকে বেঁকে দূর থেকে দূরে হারিয়ে যাওয়া ঘিঞ্জি ঘিঞ্জি গলি ধরে হেঁটে বেড়ানো বড় জরুরি বলে আমার মনে হয়। একটি কি দুটি মাত্র মানুষের চলাচলের মতো উপযোগী এইসব গলিগুলিতে সাধারণ পথচারী মানুষদের পাশাপাশিই আবার অবলীলায় চলে বেড়াচ্ছে অসংখ্য রিকশা, স্কুটার, বাইক, টোটো, সাইকেল, ঠেলাগাড়িও। একটু পরে পরেই ইতিউতি স্থানীয়দের আড্ডা, জটলা, পুজোপাঠ। গলির দু’ধারের আকাশছোঁয়া পুরনো সব দুর্গসম বাড়ির অনেক ভেতর থেকে ক্ষীণ স্বরে ভেসে আসে তালে তালে পানের তবক তৈরির অদ্ভুত শব্দ, বেনারসের বিখ্যাত সঙ্গীত ঘরানার রেওয়াজি সুর ও নানা প্রকারের চেনা অচেনা বাদ্যের আওয়াজ। প্রতিটি পথের বাঁকেই আবার আছে বেনারসের ভোজনবিলাসী মানুষজনের সারাক্ষণের সঙ্গী বেনারসী পানের ছড়ানো খোলামেলা ধাঁচের অত্যন্ত পুরনো সব দোকান, পথের এখানে সেখানে বিশ্রামরত বা হেলেদুলে বিচরণ করা গোমাতার দল। এই বেনারসেই আবার সার সার বাড়ির দেওয়াল জুড়ে চোখে পড়ে অপূর্ব নিখুঁত হাতে আঁকা রঙবেরঙের ধর্মীয় চিত্রের আশ্চর্য বাহার। অযোধ্যা ও লক্ষ্ণৌতে সাধারণ রাস্তায় এ ধরনের দেওয়াল চিত্র চোখে পড়লেও বেনারসের অলিতে গলিতে বাড়ির পর বাড়ির দেওয়াল জুড়ে চিত্রিত এইসব রঙিন ছবির মান ও বৈচিত্র্য সত্যিই অতুলনীয়।
বেনারসে নদীবক্ষে নৌকোভ্রমণের মাধ্যমে ঘাট পরিদর্শনের ব্যাপারটা আমরা এইদিন সকালেই করেছিলাম। কালভৈরবের মন্দিরে পুজো দিয়ে গলির পর গলি পেরিয়ে হেঁটে এসে রেলব্রীজ লাগোয়া ব্রহ্মা ঘাটে নেমে তার পরের ঘাট দুর্গা ঘাট থেকে ভ্রমণের জন্য নৌকো ভাড়া করি আমরা। বেনারসে ঘাটের সংখ্যা সর্বমোট চুরাশি। তবে সাধারণ আধ ঘন্টা থেকে মিনিট চল্লিশের নৌকোভ্রমণে এদিকে দুর্গাঘাট থেকে ওপাশের হরিশচন্দ্র ঘাট অবধি দেখিয়ে দশাশ্বমেধ বা পর্যটকদের সুবিধামতো অন্য কোনও ঘাটে যাত্রীদের নামিয়ে দেয় এরা। আমরা ভ্রমণশেষে দশাশ্বমেধ ঘাটেই নেমেছিলাম, কারণ, সেখান থেকে আমাদের হোটেলটি ছিল হাঁটাপথের দূরত্বে। বর্তমানে এই পথে মণিকর্ণিকা ঘাটের পরে বেনারসের নতুন ঘাট তৈরির কারণে ঘাটের পর ঘাট হেঁটে গঙ্গার শোভাদর্শন এখন বয়স্কদের পক্ষে বেশ অসুবিধাজনক হয়ে গেছে। ফলে আগে ওইভাবে হেঁটে হেঁটে ঘুরলেও এবারে দলে বয়স্ক সঙ্গী থাকায় নৌকোভ্রমণের মাধ্যমেই ঘাট পরিদর্শন করেছিলাম আমরা। বেনারসের এ অভিজ্ঞতাও অবশ্যকরণীয়। হেঁটে ঘোরার পাশাপাশি নদীবক্ষে ভ্রমণের এ মুহূর্তগুলোও সারাজীবনের অমূল্য স্মৃতি হয়ে থেকে যায়।
বেনারসে আমাদের প্রথমদিনের দ্বিতীয়ার্ধটি কেটেছিল দশাশ্বমেধ ঘাটের গঙ্গা আরতি দর্শন ও বিশ্বনাথ গলিতে কিছু পুরনো পরিচিত দোকানে বসে রাত্তির অবধি দেদার আড্ডা গল্প ও কেনাকাটিতে। আরতি আমি এযাবৎ মোট তিন জায়গায় দেখেছি, অযোধ্যায় সরযূজী আরতি, হরিদ্বারের আরতি এবং বেনারসের গঙ্গা আরতি। পূজাপাঠ ও নিয়মনিষ্ঠার দিক থেকে সবকটি আরতিই একই রকমের হলেও প্রতিটির চরিত্রই কিন্তু একে অন্যের চেয়ে বেশ আলাদা। হরিদ্বারের আরতিতে যেমন পুঙ্খানিপুঙ্খভাবে শাস্ত্রবিধি মেনে মন্ত্র ও শ্লোকপাঠই প্রধান, অযোধ্যার সরযূজী আরতি আবার সেই তুলনায় বেশ অনাড়ম্বর, সহজ এবং ঘরোয়া ধরনের। বেনারসের গঙ্গা আরতি ঐতিহ্য আড়ম্বর ও মাত্রার দিক থেকে এদের মধ্যে সবচেয়ে চোখধাঁধান ও জমজমাট। বেনারসের ভোর ও সন্ধ্যার এই গঙ্গা পূজন এবং আরতি বেনারসের বেশ কয়েকটি ঘাটে আয়োজিত হলেও দশাশ্বমেধ ঘাটের গঙ্গা আরতিটিই সবচেয়ে জনপ্রিয়। দশাশ্বমেধ ঘাটের এই গঙ্গা আরতি আয়োজন করে গঙ্গানিধি সেবা সংস্থা। আরতি সন্ধ্যে সাতটার আগে শুরু না হলেও বিকেল চারটের পর থেকেই আরতি দর্শনের জন্য ঘাটের ধাপে ধাপে লোক জমতে শুরু করে। দশাশ্বমেধ ঘাটের সুবিশাল প্রশস্ত অংশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আরতি দেখার পাশাপাশি নদীবক্ষে নৌকোতে বসেও এই আরতি দেখা যায়। এবারে আমরা নৌকোতে বসেই আরতি দেখেছিলাম। জনপ্রতি দুশো টাকার বন্দোবস্তে নির্ঝঞ্ঝাট আরতি দর্শন পদ্ধতি। তবে এক্ষেত্রে আরতি শেষ হতে না হতেই নৌকোওয়ালারা উঠে যাওয়ার জন্য তাড়া দিতে থাকে যেটা একেবারেই বাঞ্ছনীয় নয়। তাই আমার মতে একটু কষ্ট করে হলেও বিকেল বিকেল ঘাটে চলে এসে পছন্দমতো জায়গা নিয়ে বসে পড়লেই আরতিটি শুরু থেকে শেষপর্যন্ত নির্বিঘ্নে উপভোগ করা সম্ভব। বেনারসের এই গঙ্গা আরতির মূল আকর্ষণ এর মনোমুগ্ধকর অপূর্ব সুরেলা ভজন সঙ্গীত যার টানেই আমি যে ক’বার বেনারসে এসেছি প্রতিদিন বিকেলে নিয়ম করে ঘাটে এসে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছি আরতির জন্য। গঙ্গা মাইয়ার ভজন, শিব স্তোত্রপাঠ ও শ্রীকৃষ্ণ ভজনের এত মধুর মনোহর সঙ্গীত বৈচিত্র্য অন্য কোনও জায়গার আরতিতেই আমি পাইনি। সমস্ত বাহ্যিক আড়ম্বর বাহুল্য ও চোখধাঁধান ঐশ্বর্যময়তা ছাড়িয়েও এই মনকাড়া সঙ্গীতই দশাশ্বমেধ ঘাটের গঙ্গা আরতির আসল প্রাণভোমরা।
আরতি শেষ হয়ে ঘাট ছেড়ে বেড়োতে বেড়োতে প্রায় আটটা বেজেই যায়। দুর্গাপুজোর সময় গোটা বেনারসেই পর্যটকদের দারুণ ভিড় আর তার মধ্যে বাঙালি পর্যটকই সিংহভাগ। দশাশ্বমেধ ঘাটের আরতিতেও তাই পুজোর এই সময়টায় প্রতিদিনই ভীষণ ভিড় হয়। যাই হোক, আরতি শেষে ঘাট থেকে উঠে এসে কিছুক্ষণের জন্য সেদিন আমরা গেছিলাম বিশ্বনাথ গলিতেও। এই গোটা বিশ্বনাথ গলি জুড়ে বাবা বিশ্বনাথের মন্দিরের মূল ফটক অবধি দু’পাশেই রয়েছে সার সার বেনারসী শাড়ি, বেনারসী পান, বেনারসের বিখ্যাত ঘন দুধ ঘিয়ে তৈরি নানারকমের মনোলোভা সুস্বাদু সব মিষ্টি, পূজনসামগ্রী ও বাসনকোসনের অসংখ্য দোকান ছাড়াও হরেকরকম মণিহারী ও দৈনন্দিনের জরুরি জিনিসপত্রের ছোট বড় অজস্র দোকান। এখানে আগে বেশিরভাগ দোকানই ছিল বাঙালি মালিকানায়, তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই ব্যবসার রাশ এখন সিংহভাগই চলে গেছে অবাঙালিদের হাতে। তবু এর মধ্যেও দাপটের সঙ্গে আজও টিকে আছে দাশগুপ্তের জর্দা ও আদি মোহিনী মোহন কাঞ্জিলালের শাড়ির দোকানটি। এর প্রধান কারণ হয়তো এনারা এখনও নিজেদের শেকড়ের বনেদী রক্তটাকে ব্যবসার রোজকার পাইপয়সার রূঢ় হিসেবের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেননি। আজও তাই দাশগুপ্তের জর্দার দোকানে গেলে কেনাকাটির চেয়েও নতুন কোনও মশলা চেখে দেখার পর্বটাই হয়ে দাঁড়ায় প্রধান। আজও কেবলমাত্র নির্লজ্জ ব্যবসা নয়, সম্পর্ক তৈরিতেই বিশ্বাসী এই পুরনো মানুষগুলো। এই নিখাদ আবেগের টানেই তো এই মাটিতে বার বার ফিরে আসা। এই তো আমার আসল বেনারস।
বেনারসের মন্দির চত্বর নতুন করে গড়ে ওঠার পর এই আমাদের প্রথম বেনারস ভ্রমণ। আগে যে ক’বার বেনারসে গেছি, বিশ্বনাথ দ্বার দিয়ে ঢুকে গলি দিয়ে এঁকে বেঁকে অনেকটা পথ হেঁটে এসে হয় এক নম্বর কি দু নম্বর গেট দিয়ে মন্দিরে প্রবেশ করেছি। একবার অবশ্য এই দুই গেটে অসম্ভব ভিড়ের জন্যে জ্ঞানবাপী মসজিদ লাগোয়া চতুর্থ গেট দিয়েও মন্দিরে ঢুকতে হয়েছিল। তবে সত্যি বলতে, ওই গেট দিয়ে যাতায়াত ভীষণই অসুবিধাজনক, এবং সেটা কেবলমাত্র পথটির অতিরিক্ত দৈর্ঘ্যের জন্য নয়, গোটা পথে অজস্র বাঁদরের উৎপাতই এর প্রধান অন্তরায়। আজ থেকে ছয় সাত বছর আগেও সেই সময়ের মন্দিরে যাঁরা ওই পুরনো চার নম্বর গেট দিয়ে ঢুকেছেন, কোনও না কোনওভাবে তাঁরা প্রত্যেকেই এ সমস্যায় ভুক্তভোগী। তবে এবারে গিয়ে দেখলাম এই চার নম্বর গেটটিকেই নতুন করে তৈরি করে একদম বড় রাস্তা থেকেই মন্দিরে প্রবেশের উপযোগী করা হয়েছে। এর ফলে প্রধানত বয়স্কদেরই অত্যন্ত সুবিধা হয়েছে, কারণ, আগে পুরনো সময়ের মন্দিরসংলগ্ন অপরিসর ঘিঞ্জি গলিতে একে অন্যের গা ঘেঁষে ঘেঁষে কষ্ট করে দাঁড়িয়ে যে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হত মন্দিরে প্রবেশের জন্য, এখন এই নতুন ব্যবস্থায় সে সমস্যা একেবারেই মিটে গেছে। আকাশচুম্বী সুবিশাল চার নম্বর এই ফটক দিয়ে এখন নিয়ম মেনে সুশৃঙ্খলভাবে সারিবদ্ধ হয়ে মন্দির চত্বরে প্রবেশের সুব্যবস্থা। মন্দিরের প্রতিটি বাঁকে বাঁকে এবং গোটা চত্বরেই অসংখ্য পুরুষ ও মহিলা রক্ষীর দল। ফলে নিরাপত্তা ও অন্যান্য সর্বপ্রকার সহায়তাও এখন এখানে সর্বক্ষণ উপলব্ধ। মন্দিরের ভেতরে জুতো বা মোবাইল ফোন কিছুই নিয়ে যাওয়া যায় না এবং এসবই গচ্ছিত রাখতে হয় বাইরে যেখান থেকে পুজোর ডালি নিতে হবে সেই দোকানেই। তবে পরে গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে দেখলাম অন্দরেও পুজোর ডালা সংগ্রহের সুবিধা আছে। এছাড়াও এবারই প্রথম মন্দিরসংলগ্ন গোধূলিয়া চৌক ও দশাশ্বমেধ রোড ধরে অসংখ্য হুইল চেয়ারের ব্যবস্থা দেখলাম, মন্দির দর্শন ও ঘাটের আরতি দর্শনের জন্য যা যথেষ্ট সুলভে উপলব্ধ। অযোধ্যা ও বেনারস, উত্তরপ্রদেশের এই দুই প্রধান পুণ্যধামেই বয়স্ক ভক্তদের জন্য প্রশাসনিক তরফের এইসব সুচিন্তিত ব্যবস্থাপনা সত্যিই ভারী প্রশংসনীয়।
মন্দিরে বাবা বিশ্বনাথ দর্শনের দুইটি প্রকার আছে, স্পর্শ দর্শন এবং দৃশ্য দর্শন। এর মধ্যে স্পর্শ দর্শনের জন্য অনলাইন টিকিটের ব্যবস্থা আছে। তবে সে টিকিট কাটলেও রাত আড়াইটার মধ্যে গিয়ে পুজোর লাইনে দাঁড়াতেই হবে। কারণ, মন্দিরের গেট খোলে প্রতিদিন ভোর চারটেয় এবং স্পর্শ দর্শন বন্ধ হয়ে যায় ঠিক পাঁচটায়। এই এক ঘন্টার মধ্যেই টিকিটসহ এবং টিকিট ছাড়া সকল ভক্তরাই স্পর্শ দর্শন করতে পারেন। তবে টিকিট কাটা থাকলে দর্শন নিশ্চিন্তে ও দ্রুত হয় যা বেনারসের পিক সিজনের ভিড়ের সময়ে খুবই জরুরি।
নবনির্মিত এই বেনারসের বাবা বিশ্বনাথ মন্দিরের ভেতরে ঢুকে এবারে বেশ অবাক হয়ে গেলাম। মূল মন্দিরটিকে ঘিরে অনেকটা প্রশস্ত ছড়ানো খোলামেলা জায়গা তৈরি হয়েছে ভেতরটায়, যার চারপাশ ঘিরে ছোট ছোট অসংখ্য মন্দিরে নিয়মিত পূজিত হচ্ছেন অন্যান্য আরও নানা দেবদেবীও। মূল মন্দিরের পাশেই মা অন্নপূর্ণার মন্দির ও ভোজনালয়। সেখানে দর্শন সেরে সরু গলি ধরে হেঁটে খানিকটা গেলেই মণিকর্ণিকার ঘাট লাগোয়া গঙ্গাতীরস্থিত বেনারসের নতুন ঘাট। অনেকখানি জায়গা নিয়ে বেশ সুপরিকল্পিতভাবে বানানো সুদৃশ্য এই অংশটিতে পুজো ও দর্শন শেষে এসে বসে ভক্তরা বেশ খানিকটা সময় শান্তিতে জিরিয়ে নিতে পারেন। ভোরের নরম আলোয় এই ঘাট থেকে ভরা গঙ্গার ওপরে সূর্যোদয় দেখার অভিজ্ঞতা সত্যিই এক স্বর্গীয় অনুভূতি।
তবে এই এত সব ভালোর মধ্যেও যে দু একটি কাঁটা মনের মধ্যেটায় খচ খচ করতে থাকে তার একটি হল মন্দিরে প্রবেশের মুহুর্তে পূজনসামগ্রী দোকানের দোকানিদের অসম্ভব দুঃসহ ব্যবহার। পূজাসামগ্রীর ডালি কেনা নিয়ে যেরকম নির্লজ্জভাবে ভক্তদের ক্রমাগত বিরক্ত করতে থাকে এরা তাতে কয়েক মুহূর্তেই সাধারণ পুণ্যার্থীদের ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। এ বিষয়টায় প্রশাসনের ভীষণভাবে নজর দেওয়া উচিৎ বলে আমার মনে হয়েছে। এই প্রথমবার বেনারসে এসে পুরীর পাণ্ডাদের অকথ্য বিশ্রি অত্যাচারের কথা মনে পড়ে গেল। আর যে জিনিসটা মনে অদ্ভুতভাবে এবারে ধাক্কা দিল সেটা হল মন্দির ঘিরে এই প্রবল উন্নয়নের জোয়ার। স্বাভাবিকভাবে দেখতে গেলে পুরনো অপরিসর সংকীর্ণ গলিপথ ভেঙেচুরে নতুন করে তৈরি এই প্রশস্ত মন্দির চত্বরে বয়স্ক পুণ্যার্থীদের ভীষণই সুবিধা হয়েছে, কিন্তু, সব দেখেশুনে কেন যেন মনে হল এর ফলে আদি প্রাচীন মন্দিরের সহজ ভক্তির ভাবটুকুই হারিয়ে গেছে চিরতরে। এ জিনিস ঠিক যেন বলে বোঝানোর নয়, যাঁরা সেই সময়ের পুরনো মন্দিরে গেছেন, ইতিহাসের চেয়েও প্রাচীন বেনারসের সেই সহজ আন্তরিক দৈবীভাবের মূল্যটা তাঁরাই বুঝবেন সঠিকভাবে। আসলে একটা ধর্মস্থান তো শুধু সেখানে পূজিত দেবতার মূর্তির উপস্থিতিতেই গড়ে ওঠে না, গড়ে ওঠে তাকে জড়িয়ে থাকা, ঘিরে থাকা, তাতে মিশে থাকা লক্ষ মানুষের অন্তরের বিশ্বাসে, তাদের হৃদয়ের সহজ যোগদানে। আজ পুরনো বেনারসের মন্দির ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা বহুযুগের পুরনো এক একটা গলি বাড়ি দোকানকে বুলডোজারের জোরে গুঁড়িয়ে দিয়ে যে নতুন ঝকঝকে মন্দির চত্বর ও ঘাট গড়ে উঠেছে তাতে অনেক আধুনিক সুবিধা আছে ঠিকই, কিন্তু স্বাভাবিক সেই অন্তরের যোগ, সেই প্রাণ যেন আর নেই। আশেপাশের বহুকালের পুরনো সেসব ফুলের আর পুজোসামগ্রীর ছোট্ট ছোট্ট কুঠুরির মতো এক চিলতে দোকান আর তার সদাহাস্যময় বাচ্চা বুড়ো দোকানী যারা অবলীলায় পেতলের ঘটভর্তি দুধ অচেনা দুঃস্থ ভক্তকে দিয়ে দিত বাবার মাথায় ঢালার জন্যে, কালের গহ্বরে যেন একেবারে নিশ্চিণ্হ হয়ে গেছে! এখনও মন্দির লাগোয়া বাইরের কিছু কিছু অংশে ভাঙাচোরা ক্ষত নিয়ে টিকে থাকা পুরনো কিছু হাভেলির অবশিষ্টাংশ পলকে ফেলে আসা অন্য এক বেনারসের কথা মনে পড়িয়ে দেয় আর চোরা একটা অস্বস্তির কাঁটা ক্রমাগত চিন চিন করে বিঁধেই চলে ভেতরটায়। তাই যত নির্বিঘ্নে, যত সহজেই এবারের বিশ্বনাথ দর্শন হোক না কেন, মন যেন ঠিক ততটা ভরল না। যত সময়োপযোগীই হোক, কিছু পরিবর্তন বোধ হয় সত্যিই কাম্য নয়।
বিশ্বনাথ দর্শন শেষে আমরা সেদিন গেছিলাম কোচবিহার কালীবাড়ি দেখতেও। বিশ্বনাথ মন্দিরের চার নম্বর গেট থেকে মিনিট কুড়ি টোটোতে গেলে সোনারপুরা বাঙালি মহল্লায় বড় রাস্তার ওপরেই অবস্থিত কোচবিহার রাজপরিবার দ্বারা নির্মিত ও পরিচালিত কোচবিহার কালীবাড়ি। অনেকখানি জায়গা নিয়ে তৈরি এই কালীবাড়ির দুটি মন্দিরেই এখনও নিয়মিত পুজো হয়। পাশেই আছে দ্বিতল একটি গেস্ট হাউসও, তবে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে তা এখন আর থাকার উপযুক্ত নয়।
আমাদের বেনারস ভ্রমণের শেষ দিনটি নির্ধারিত ছিল শহরের বিশেষ দ্রষ্টব্য কিছু জায়গা দেখার জন্যে যার মধ্যে পড়ে রামনগর ফোর্ট, দুর্গা মন্দির, হনুমান মন্দির, বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটি ও ভারতমাতা মন্দির এবং সারনাথ। তবে কিছু অসুবিধার কারণে এগুলির মধ্যে এবারে আমরা শুধুই রামনগর ফোর্টই দেখতে যাই। কাশীরাজের আবাসস্থল এই রামনগর দুর্গটি ব্রীজ পেরিয়ে গঙ্গার অপর পাড়ে অবস্থিত। টিকিট কেটে ঢুকে মহলের পর মহল ঘুরে দেখলাম কাশী রাজপরিবারের সংগৃহীত এবং নির্মিত অসংখ্য মূল্যবান ও অপূর্ব কারুকার্যমণ্ডিত বিভিন্ন দ্রব্যাদি, যেমন, চিনেমাটি ও পোর্সেলিনের আশ্চর্য কারুকাজ করা ফুলদানি, প্লেট, বিভিন্ন আকার ও ভঙ্গিমার ভারী সুন্দর সব পুতুলের বিশাল সম্ভার, দেশবিদেশের দুষ্প্রাপ্য মণিমুক্তখচিত অপূর্ব সব দেওয়াল ঘড়ির সংগ্রহ, সোনার কারুকাজওয়ালা মূল্যবান মণিমুক্তো বসানো হাতির দাঁতের, কাঠের, পিতলের ও রূপোর তৈরি হরেকরকম হাওদা ও পালকি, বিচিত্র সব রকমারি অস্ত্রের বিপুল সম্ভার এবং দারুণ দেখতে বিদেশি সব গাড়ির মেলা। মুগ্ধ হয়ে এই বিপুল ঐশ্বর্য দেখতে দেখতেই একসময় দুর্গের লম্বা ঘোরানো সুরঙ্গপথ দিয়ে পৌঁছে যেতে হয় গঙ্গাতীরস্থিত রাজবাড়ির বাইরের অংশে যেখানে খোলামেলা বাহির বারান্দা ও সবুজে মোড়া প্রশস্ত লম্বাটে একটি অংশের মাঝেই বিরাজ করছে রাজবাড়ির বংশানুক্রমে পূজিত হয়ে আসা শিব মন্দির। লালরঙা পাথরে তৈরি সুদৃশ্য এই মন্দিরটিতে এখনও নিয়মিত পুজো হয়। রাজবাড়ির কিছুটা অংশ পর্যটকদের জন্য খুলে দেওয়া হলেও ভেতরের কিছু অংশে এখনও বসবাস করেন রাজপরিবারের বর্তমান প্রজন্মের সদস্যরা। দুর্গের মিউজিয়ামে প্রদর্শিত দুষ্প্রাপ্য বিচিত্র সম্ভারের সাথে সাথে দুর্গের বাইরের গঙ্গার ধারের এই খোলামেলা অংশটির জন্যেও রামনগর ফোর্টে গেলে সত্যিই ভাল লাগে।
বেনারস মূলত ধর্মস্থান হলেও এর অনেকগুলো আলাদা আলাদা রূপ আছে যার খানিকটা খুঁজে পাওয়া যায় বেনারসের মন্দিরে মন্দিরে, খানিকটা দশাশ্বমেধ ঘাটের চোখ ও মনপাগল করা গঙ্গা আরতিতে, খানিকটা এর প্রাচীনস্য প্রাচীন বিশ্বনাথ গলির বিচিত্র সব শব্দে গন্ধে দৃশ্যে, খানিকটা আবার গভীর রাতের বেনারসের আলো আঁধারি পথে পথে বা গঙ্গাপাড়ের ঘাটের পর ঘাট ধরে উদ্দেশ্যহীনভাবে হেঁটে বেড়িয়ে। এবারে যে চারটে দিন বেনারসে ছিলাম তার মধ্যে বেশ ক’দিনই আমরা রাতের খাওয়াদাওয়া সেরে চলে যেতাম দশাশ্বমেধ ঘাটে হাঁটতে। এখন বেনারসের মন্দির লাগোয়া নতুন ঘাট হওয়ার পরে দশাশ্বমেধ ঘাট থেকে বাঁয়ে মানমন্দির ঘাট পেরিয়ে হেঁটে মণিকর্ণিকা ছাড়িয়ে ওপারে যাওয়া বেশ দুষ্কর। এর একটি প্রধান কারণ এই দুই ঘাটের মাঝে তৈরি নতুন ঘাটের বিশাল প্রাচীর, এবং, আরেকটি এবারের ভীষণ বন্যায় ঘাটের নীচের অংশগুলোর ভয়ানক ভাঙাচোরা অবস্থা। এমনকি এবারের ভয়াল বর্ষার কারণে নাকি ঘাটসংলগ্ন গঙ্গাপাড়ের বদলে ঘাটের ওপরের উঁচু ছাদেই শব সৎকার প্রক্রিয়া চলেছে দীর্ঘদিন। আমরা তাই রাতে মণিকর্ণিকার দিকে না গিয়ে দশাশ্বমেধ থেকে ডাইনে দ্বারভাঙা ঘাট, রাজা ঘাট আর মুন্সী ঘাট দিয়েই হেঁটে বেড়িয়েছি।
রাতের বেনারস শহরের রূপ সত্যিই আলাদা। এত শান্ত, এত কোলাহলহীন সেই পরিবেশ যে ঘাটের কিনারায় দাঁড়িয়ে গঙ্গার স্রোতেরও শব্দ গোণা যায় অনায়াসে। সারাদিনের কাজ শেষে স্থানীয় বহু লোক এ সময় ঘাটের পর ঘাট হেঁটে ঘরে ফেরে, সাধু সন্ন্যাসীর দল ইতি উতি ছড়িয়ে নিজের নিজের মতো আমেজে থাকে বুঁদ হয়ে, ভিখিরিরা ঘাটের বড় বড় ছাতার তলায় গরু ও কুকুরের পাশে শুয়ে থাকে নিশ্চিন্তে। চারিদিকে এ সময় শুধুই অপার অপার্থিব শান্তি, কোথাও কোনও ছন্দপতন নেই। বেনারস যে কত বিচিত্র ধর্ম জাতি ও চরিত্রের মানুষকে একইসাথে নির্বিরোধে পরম মমতায় আগলে রেখে প্রকৃত অর্থেই এক সর্বধর্ম সর্বমত সমন্বয়ের দুর্লভ উদাহরণ হয়ে উঠেছে, রাতের বেনারস না দেখলে বোঝা যায় না। এবং এই বহুস্তরীয় চরিত্রের জন্যেই বোধহয় এক এক মানুষ একেকরকমভাবে এ শহরকে খুঁজে পায় নিজের মধ্যে, আর তারপর, নিজের নিজের মতোন করে লীন হয়ে নিঃশেষে মিশে যায় এতে। একবার এ শহরের অন্তর্নিহিত এই অমৃত রসের সন্ধান যে পথিক পায়, তার গোটা অস্তিত্বটাই বদলে যায় সারাজীবনের মতো, আর তখন, এই রসের টানেই বার বার সে ফিরে আসে এই মাটিতে, নিজেকে বার বার নতুন করে খুঁজে পেতে। তেরাত্তির শেষে অবশেষে বেনারসের পালা সাঙ্গ করে যখন ঘরে ফেরার সময় হল আমাদেরও, প্রতিবারের মতোই এবারও যেন এ মাটিতে মনের একটুখানি টুকরো গেলাম ফেলে রেখে, যার টানে মনে মনে জানি আবারও আসব ফিরে, এই গঙ্গাতীরে, খুব শীঘ্রই। জয় বাবা বিশ্বনাথ।
নদীর টান নাড়ির টান: ইছামতী
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়
ইছামতী, আহা ইছামতী !
ছোট্ট মিষ্টি একটা নাম। বহতা জলের ধারাই তো গঙ্গা। আমার তাই বার বার ঘুরে ফিরে আসা ইছামতীর কোলে।
বনগাঁয় আমার জন্ম। এই দেশ সেইদেশ ঘুরে আবারও যেন ঘরে ফিরে আসা তাই কখনো ডিঙি নৌকা করে, কখনো মানস নেত্রে আমি ঘুরে বেড়াই ইছামতী নদীর পাড় ধরে।
একটা নদীর সাথে আমার জীবনের এত ঘটনা জড়িয়ে আছে যে ইছামতী নদীর নাম শুনলেই একটা অত্যাশ্চর্য অনুভূতি মনের মধ্যে দোলা দিয়ে যায়। একটা শক্তি সব কিছুর অগোচরে কাজ করে।
লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে দক্ষিণ বঙ্গ ছেড়ে একেবারে উত্তরভারত। জীবনের টানা সতেরো বছর এই রাজ্য সেই রাজ্য, এই জেলা, কখনো সেই জেলা কর্মসুত্রে ঘুরে বেড়িয়েছি। ঘুরে বেড়িয়েছি বললে ভুল হবে। রথ দেখা কলাবেচা সেরেছি। সেই সব দিনগুলোতে যখনই একা হতাম, ইছামতীর টান অনুভব করতাম। আজও সেই টান বর্তমান। মৈপিঠে সেদিন রয়েল বেঙ্গল টাইগার বের হয়েছে, তড়িৎ গতিতে সেই খবর পেয়েছি বন্ধু স্বজনের মুখ থেকে।
যশোর জেলার মধ্যে দিয়ে ইছামতীর যে অংশ প্রবাহিত হয়েছে তাতে ইছামতী নদীকে একটা ছোটো নদী বলেই মনে হবে। যত দক্ষিণে যাওয়া যাবে কুমির, কামোট,হাঙর- সঙ্কুল বিরাট নোনা গাঙে পরিণত হয়েছে সুন্দরী ইছামতী। উৎস থেকে মোহনায় এই সুদীর্ঘ পথ চলতে চলতে কোথায় কোন সুন্দরবনের সুন্দরী গরান গাছের জঙ্গলের আড়ালে সে বঙ্গোপসাগরে মিশে গেছে সে খবর বনগাঁর গ্রাম্য অঞ্চলের মানুষ জন রাখে না।
আমার নিজের চোখে দেখা এই অতীব সুন্দর নদী ইছামতীকে যদি পশ্চিমবঙ্গ টুরিজম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন প্রোমোট করতো, তাহলে বহু ভ্রমণ পিপাসু মানুষ ইছামতীর অবর্ণনীয় রূপ উপভোগ করতে পারতো। এই জনপদ পর্যটকদের স্বর্গ ভূমিতে পরিণত হত।
মড়িঘাটা বা বাজিৎপুরের ঘাট থেকে নৌকো করে চাঁদুড়িয়ার ঘাট অবধি গেলে দেখা যাবে দুই তীরে পলতে মাদার গাছের লাল ফুল। জলজ বন্যবুড়োর ঝোঁপ ঝাড় শোভা বর্ধন করে আছে। এখানে সেখানে টোপো পানার দাম আপন মনের খেয়ালে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বুনো তিপ্পল্লা পাতারা সেজে উঠেছে তাদের হলদে ফুলের শোভা নিয়ে। কোথাও আবার উঁচু পাড়ে প্রাচীণ বট অশ্বত্থের সুনিবিড় ছায়ায় বসে ক্লান্ত চাষি তার ঘোমটা টানা বউয়ের হাত থেকে পান্তাভাত নিয়ে খেতে বসেছে। উলুটি, বাচড়া, বৈঁচি বনের ঝোপ দুই হাত দিয়ে কাছে ডেকে নিচ্ছে। নীল সাদা আকাশে মেঘের দল খেলা করছে আর তার নিচেই কালচে সবুজ বাঁশঝাড়।
এই বনে সেই বনে গাঙ্গ শালিকের বাসা। নানা রঙের লতানো ফুলের রাশি রাশি ঝাড়, দুহাত তুলে আহ্বান জানাচ্ছে। এই নোনা গাঙ্গের পাড়ে লোক বসতি তেমন একটা নেই। যে দিকে দুই চোখ যায়,সবুজ দূর্বা ঘাসের চর। কোথাও দু দশটা ডিঙ্গি নৌকা বাঁধা আছে। বনফুল ভর্তি ঝোঁপ ঝাড়। উঁচু শিমুল গাছের শুকনো ডালের ওপর সমাধিস্থ শকুনি বসে আছে। যেন কোনো ক্যানভাসে আঁকা শিল্পীর ছবি। কোনো ঘাটে গ্রাম্য মেয়ে বউরা স্নান করছে। তীরে প্রাইমারি স্কুলের মাঠ। জল নিয়ে খেলা করছে শিশু- কিশোরের দল। লম্বা লম্বা দো - চালাঘর, দরমা বা কঞ্চির বেড়া দিয়ে ঘেরা ফুলকপি, পালং, বেগুন, ধনেপাতা আলো করে সেজে উঠেছে।
এভাবেই সবুজ চরভূমি সেজে ওঠে। ছয় ঋতুতে ইছামতী তার ছয় রূপ ধারণ করে। বর্ষায় তার এক রূপ, শরৎ কালে অন্য রূপ আর শীতে তো কথাই নেই। উঠোনের ফুলবাগানে ফুল কমে আসলেও ইছামতীর আঙ্গিনায় ফুলের অভাব নেই। আকন্দ,কুন্দ, রঙ্গন আরও শত শত নাম না জানা ফুল শোভা বর্ধন করে।
জানি না পরজন্ম বলে কিছু হয় কি না তবে আগামী জন্মে ইছামতীর কোলেই জন্ম নিতে চাই, বেড়ে উঠতে চাই।
ভ্রমণ
অনিতা নাগ
বাবার কাছে একটা বই ছিলো, ভ্রমণ সঙ্গী। মোটা বইটার পাতায় পাতায় শুধু বেড়ানোর খবর, আর ছবি। সবই সাদা,কালো। কি যে প্রিয় ছিলো বইটা। গোলাপী রঙের প্রচ্ছদে এক ভাস্কর্যের ছবি। বাবা যখনই বইটা নিয়ে বসতেন, তখনই মনে মনে দিন গুণতাম। আবার কোথাও বেড়াতে যাওয়া হবে। সে’ যুগে বেড়ানোর জন্য সেরা গাইড বুক। আরো যখন ছোট ছিলাম, যখন এ'সব কিছুই বুঝতাম না,তখন হঠাৎ দেখতাম বাবা, মা কতো গোছগাছ করছেন। মা সব ভালো জামা কাপড় ধুয়ে কেচে রাখছেন। তারপর হঠাৎ একদিন হোল্ডল বলে একটা বড় ব্যাগের মতো জিনিষে চাদর, কম্বল, বালিশ, আরো কতো কিছু বাবা গুছিয়ে বেঁধে নিতেন। আমরা নাকি চেন্জে যাবো। হাওয়া বদল আর কি! তখন আমি অনেক ছোট, তিন/ চার বছর হবে। সব কিছু স্পষ্ট মনে নেই। যাওয়া হয়েছিলো ভূবনেশ্বর। ওটাই আমার ভ্রমণের প্রথম স্মৃতি। একটা বাড়ীতে ঘর ভাড়া নেওয়া হয়েছিলো। মা রান্না করতেন। স্টোভ আর বাসনপত্তর ভাড়া নেওয়া হয়েছিলো, কি সাথে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো, তা ঠিক মনে নেই। রোজ সকালে হাঁটতে বেড়োতাম মা,বাবা আর দাদাদের সাথে। দুধকুন্ডুর জলে খুব ক্ষিদে হয়। দুধকুন্ডুর জল রোজ আনা হতো। আসার সময় বাবা খাঁটি দুধ নিয়ে আসতেন। ফিরে ঐ বাড়ীর ছোটদের সাথে খেলতাম। মনে আছে খোকা আর খুকি নামে জমজ ভাইবোন আমার বন্ধু হয়েছিলো। খুব দুষ্টু ছিলো। একদিন মা সকলের জন্য ডিম রান্না করে, চাপা দিয়ে রেখে স্নান করতে গেছেন। খেতে দিতে গিয়ে দেখেন সব ডিম গায়েব। দুষ্টু দুটো সব খেয়ে ফেলেছিলো। ভাগের গোটা ডিম না পেয়ে খুব কেঁদেছিলাম। ওদের মা খুব মেরেছিলো ওদের। আজো মনে আছে ওদের কথা! এমনই হয়। ছোটবেলায় মনের গভীরে যা রয়ে যায় তাকে ভোলা সহজ নয়। একজন চিত্রকর থাকতেন। বারান্দায় বসে বসে ছবি আঁকতেন। কলকাতা থেকে আরো একটি পরিবার ওই বাড়ীতে ভাড়ায় ছিলেন। কলকাতায় ফিরে বাবা তাদের বাড়ী নিয়ে গিয়েছিলেন। বড় কাঁচের প্লেটে মিষ্টি দিয়েছিলো খেতে। সাদা সন্দেশের মাঝখানে হলুদ ডিমের কুসুমের মতো। মা বলেছিলেন ডিম সন্দেশ। সেই প্রথম খেয়েছিলাম ডিম সন্দেশ। ভূবনেশ্বর থেকে আমরা পুরী গিয়েছিলাম। ধর্মশালার স্যাঁতস্যাঁতে গুমোট একটা ঘর। দৃষ্টিহীন পান্ডা দাদু, সমুদ্র, বালি, ঝিনুক। স্টোভে ডেকচিতে ফুটে উঠা ভাতের গন্ধ! পুরী বললে এই টুকরো টুকরো স্মৃতির কোলাজ ভেসে উঠে। আজ পরিণত বয়সে ফিরে দেখতে গিয়ে আমার বাবাকে নতুন করে চিনলাম। জীবন সঙ্গিনীর জন্য কি অসীম ভালোবাসা! যে মেয়েটা একান্নবর্তী পরিবারের জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সামলায়, সামলায় তিনটে ছেলেমেয়ের ঝক্কি, স্বামীর সিফটিং ডিউটির ঝক্কি, তারও যে শরীর মনের বিশ্রাম প্রয়োজন সেই অনুভব থেকেই বাবা আমাদের নিয়ে বেড়াতে যেতেন। অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ তেমন ছিলো না। বেড়াতে গিয়ে বিলাসিতা ছিলো না। ছিলো আনন্দ আর মজা। এমন সব স্মৃতির কোলাজে আলো হয়ে আছে ছোটবেলার ভ্রমণ। অনেকবার বাবা বেড়াতে নিয়ে গেছেন। গাইড ওই ভ্রমণসঙ্গী। রেলগাড়ীর জানলার সামনে বসতে পারলেই হলো। কয়লার ধোঁয়ায় চুল, মুখ সব কালো হয়ে যেতো। তবু ঐ ছুটে চলা দেখতে বড্ড ভালো লাগতো। আজও লাগে। তবে সে'দিন আর এ'দিনে অনেক তফাৎ। বাবার ঐ বইয়ের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে কতো যে বেড়ানোর মজা! পাহাড় থেকে সমুদ্র, মরুভূমি, সব, সব, ঘুরে বেড়াতাম। অনেক সিনেমা ও দেখেছি। ‘বিগলিত করুণা, জাহ্নবী যমুনা’, ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’। হিংলাজ যাওয়ার পথে সেই কুন্ডু আমাকে বড্ড নাড়া দিয়েছিলো। যে জলে যাত্রীরা কাপড়ের পুটুলিতে চাল বেঁধে দিতেন। যদি কোনো অন্যায় গোপন থাকতো তা স্বীকার না করা অবধি সেই চাল ফুটতো না। আজো এই দৃশ্য আমাকে ভাবায়। এমনও কি হয়! জানা হয়নি আজো। ‘অমৃত কুম্ভের সন্ধানে’ কতোবার পড়েছি মনে নেই। সিনেমাও দেখেছি। এই বই আমাকে এতোটাই প্রভাবিত করেছিলো যে আমি এলাহাবাদ গিয়ে সঙ্গমের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম। আজ কুম্ভ নিয়ে এতো মাতামাতি, সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে কুম্ভের খবর, তখন তো এ'সব কিছুই ছিলো না। তবু মানুষ তার বিশ্বাস নিয়ে ছুটে যেতো কুম্ভে। রাস্তার দু’ধারে বিশাল বিশাল ধূধূ করা খালি মাঠগুলো কুম্ভের সময় জনারণ্য হয়ে যায়। আমি যেনো দেখতে পেলাম রাশি রাশি তাঁবু, পুণ্যার্থীর ভীড়ে ঠাসা সেই কুম্ভকে।
বিয়ের পর প্রবাস বাস। প্রথম যাওয়া ট্রেনের ফাষ্ট ক্লাস কুপে। মা,বাবা, নিজের শহর, নিজের ভালোলাগা সব ছেড়ে সেই যাওয়ায় ভ্রমণের মজা ছিলো না। তবু নতুন স্টেশন এলেই অবাক চোখে তাকিয়ে দেখতো সেই মেয়ে। ছুটতে ছুটতে সেই ট্রেন নিয়ে গিয়েছিলো অনেক দূরে। চেনা গন্ডীর বাইরে অন্য এক অচেনা শহরে। বিয়ের পর প্রথম পূজোয় বেড়াতে যাওয়া বেনারসে। আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগের কথা। আনরিজার্ভ কামরায় দরজার সামনে কাগজ পেতে যাওয়া। তিনঘন্টার রাস্তা। তবু আজ ভাবলে অবিশ্বাস্য লাগে। বেড়াতে যাচ্ছি এই আনন্দে মশগুল তখন। তখন বেড়ালো মানে নতুন একটা জায়গাকে দেখা। সবই তো অচেনা। কোথায় কি আছে, কি দেখবো, কোথায় থাকবো, সবই খুঁজে নিতে হতো। তবে সেই খুঁজে নেওয়ার মধ্যে বিস্ময় ছিলো, মজা ছিলো, ভয়ও ছিলো। প্রথম বেড়াতে গিয়ে একটা দোকানে বসিয়ে কর্তা হোটেল খুঁজতে গিয়ে, আসে আর না। জিনিসপত্র নিয়ে অচেনা শহরে একা বসে ভয়ে কান্না পাচ্ছিলো। ভয় হচ্ছিলো কোথায় বসিয়ে গেছে যদি খুঁজে না পায়! তারপর সে আসাতে শান্তি। তখন বয়স কম। দশাশ্বমেধ ঘাট, মন্দির একবার করে গেলেও আশপাশে ঘুরে বেড়ানোতেই বেশী আনন্দ। বেনারসের গলি, পানের দোকান, রাবড়ি, প্যারা, আজো মনে আছে। সহজ, সরল লোকজন। তবে আজকের বেনারসের সাথে তেমন মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। আমাদের ফেরার ট্রেন ছিলো দশমীর রাত্রে। আমরা হোটেলে চেক আউট করে রাতের শোয়ে সিনেমা গিয়েছিলাম। বেড়িয়ে দেখি শুনশান রাস্তা ঘাট। দোকানপাট সব বন্ধ। চারদিক জনমানবশূন্য। রাস্তায় দাঁড়িয়ে যখন ভাবছি কি করবো, তখন একজন পান দোকানী, যার থেকে মশলা,পান কিনেছিলাম,তার দেখা পেয়ে হাতে স্বর্গ পেলাম। তিনি বললেন বিসর্জন নিয়ে রায়ট হয়ে গেছে। সব বন্ধ। ঐ রাতে তিনি আমাদের বেনারসের অলিগলি দিয়ে স্টেশনে পৌঁছে দিয়েছিলেন। সে'দিন তিনি না এলে কি হতো জানি না। বড় দাদার মতো আগলে তিনি আমাদের পৌঁছে দিয়েছিলেন। সে ঋণ কোনোদিন ভুলবো না। বহুবছর পর্য্যন্ত চিঠিতে যোগাযোগ ছিলো। তারপর সময়ের স্রোতে আমিও ভেসে গেছি এক দেশ, থেকে অন্য দেশে। নতুন পরিচয়ের ভীড়ে পুরোনো পরিচয় চাপা পড়ে গেছে। তবে কবির ভাষায় ‘কিছুই যায় না ফেলা’। মন সিন্দুকে সব রয়ে যায়। ভ্রমণ মানে তো শুধু ঘুরে বেড়ানো নয়। নতুনকে জানা, নতুনকে চেনা। শুধু নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধাণই নয় প্রত্যেক জায়গা আপন বৈচিত্র্যে স্বতন্ত্র। কতোকিছুর আদান প্রদান, কতো মানুষের সাথে পরিচয় হয়।
বাবা মা'র সাথে শেষ ঘুরতে যাওয়া কেদারবদ্রী। আজ থেকে চুয়াল্লিশ বছর আগের কথা। বাবার গাইড ভ্রমণ সঙ্গী। দুর্গম তীর্থ। কতো প্রস্তুতি। বাটার দোকানে নিয়ে গিয়ে বাবা কের্স জুতো কিনে দিয়েছিলেন। মা'র কের্স জুতো চাই শুনে দোকানদার খুব অবাক হয়েছিলেন। বন্ধু র থেকে দুটো সালোয়ার-কামিজ চেয়ে এনেছিলাম। আমার মোটে তীর্থ করতে যাওয়ার ইচ্ছে ছিলো না। তবু যেতে হয়েছিলো। না গেলে যে কি হারাতাম তা জানতেই পারতাম না। গৌরী কুন্ড থেকে হাঁটা পথে এগিয়ে চলতে চলতে পথের বাঁকে বাঁকে বিস্ময়। প্রকৃতি তার রূপ, রস গন্ধ নিয়ে ছড়িয়ে আছে পথের দু'পাশে। আর ছিলো মানুষ দেখার বিস্ময়। কতো সাধু,কতো সন্ন্যাসী, কতো যোগী! দুর্গম পাহাড়ে কেউ গুহায়, কেউ একটু ছাউনি করে আছেন। কোন্ প্রাপ্তিতে এতো আলো, এতো আনন্দ তাঁদের, তার হদিস করা সম্ভব নয়। পথ চলতে চলতে কতো নতুন মানুষ, কতো নতুন বন্ধু। যতো এগোই, পথ আর শেষ হয় না। যারা ফিরছেন, জিজ্ঞেস করলে বলেন আগে হ্যায়। যতো এগিয়েছি ততো কঠিন হয়েছে পথ। অবশেষে যখন পৌঁছোলাম বিকেলের পড়ন্ত আলোয় মায়াময় কেদার শৃঙ্গের রূপে আজো মজে আছি।
ভ্রমণের মানে ক্রমশঃ বদলে যাচ্ছে। গুগলের সৌজন্যে সব তথ্য হাতের মুঠোয়। এখন আর ঘন্টার পর ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে ট্রেনের টিকিট কাটতে হয় না। মুঠোফোন, কম্পিউটার, ল্যাপটপের একটা ক্লিকে ট্রেন, ফ্লাইট, বাসের টিকিট হয়ে যায়। এখন আরামের যাওয়া। ভালো হোটেলে থাকা। ব্যাগপ্যাক আর ট্রলিতে জিনিষ নেওয়া। কর্পোরেট ভ্রমণের কতো ব্যবস্হা। বেড়াতে গিয়ে ক্যামেরার লেন্স দিয়ে বেশী দেখা। স্যোশাল মিডিয়ায় সব আপডেট দেওয়া।বদলে যাওয়া জীবনের সাথে বদলে যাচ্ছে ভ্রমণের চালচিত্র। এখন বেড়াতে যাওয়ার আগে ব্লগ দেখে নিই। ট্রেনের বাতানুকুল কামরা, নাহলে ফ্লাইট এখন বেড়াতে যাওয়ার প্রথম পছন্দ। ব্যাস্ত জীবনে সময় বড্ড কম। কম সময়ে সবটা ঘুরে নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। কোনো জায়গায় গিয়ে দু’দন্ড সেখানে না থাকলে সবই যেনো অধরা থেকে যায়। কোভিড এর সময় থেকে ভার্চুয়াল ভ্রমণও আমার বেশ পছন্দের। স্যোশাল মিডিয়ায় বেড়াতে যাবার হরেক খবর, কতো নতুন জায়গার খোঁজ, কতো গল্প। বেশ লাগে আমার। ছোটবেলায় মানচিত্র দেখার মতো। দেখা যায়, জানা যায়,তবে ধরা যায় না। ভ্রমণ যে শুধু মনের আনন্দের জন্য তা তো নয়। কতো অজানা অভিজ্ঞতা, অপ্রত্যাশিত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা, অপরিচিত সংস্কৃতি, জীবন পদ্ধতি এবং আচরণ সম্পর্কে জানার এক সহজ উপায় ভ্রমণ। ভ্রমণের সাথে অর্থনীতির এক নিবিড় সম্পর্ক। সেই কারণেই দেশ, বিদেশের পর্যটন ব্যবস্থা ক্রমশঃ উন্নত ও আকর্ষনীয় হয়ে উঠছে। এখন আর বিশেষ কোনো ছুটি বা উৎসবের দিনের অপেক্ষা নয়, সারাবছরই পর্যটন সচল থাকে।
অপেক্ষায় থাকি চার দেওয়ালের ঘেরাটোপের বাইরে বেড়োনোর। ব্যাস্ত শহরের গন্ডী পেরিয়ে খোলা আকাশ, পাহাড়, সমুদ্র, নিদেনপক্ষে কোনো নদীর কাছে পালিয়ে যাওয়ার জন্য মন আনচান করে। তবে যতোই আধুণিক ব্যবস্থা হোক না কেনো ফেলে আসা দিনগুলো যে মনের মাঝে রয়ে গেছে আজো। বেড়াতে যাবার আগে ভ্রমণসঙ্গী উল্টে দেখে নিই সবার অগোচরে। দেখলেই সকলে বলবে তোমার যত্তো সব! ভ্রমণসঙ্গী বইটা আজো এক আবেগ আমার কাছে, তা কি আর সকলকে বলা যায়! অপেক্ষায় থাকি দু’চোখ মেলে, ঘরের সামনের শিশিরকণাটুকু যেনো অদেখা না থেকে যায়। আর মনে মনে গুনগুন করি ‘কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা’।।
কাশীধামে একবার
মনীষিতা নন্দী
বেনারসী আঁচলে লেখা থাকে মৃত্যু
মৃত্যুর রঙ কেমন? জানা নেই।
নীল মসলিনে মিশে যায় আগুন ঘ্রাণ
গেরুয়া - কমলা নেভেনা কখনও
সবুজ চূড়ো বেয়ে পালাচ্ছে সাদা ধোঁয়া কুন্ডলী
খুঁজি তারে আশমান জমিন, ধরতে ছুঁতে নারি
ঘাটের পরে ঘাট সাজিয়ে
হলদে নেকলেস বোনে সন্ধ্যেপাখী
নীল শাড়িতে হলুদ হার, মানিয়ে যাবে ঠিক কোনোদিন
প্রেমালাপের অন্যনাম তখন মনিকর্ণিকা .......
ক্রুজে বসে আছি। তেতলা রেলিঙের ধারে। আর কিছু পরেই সন্ধ্যারতি। দশাশ্বমেধ আর মনিকর্ণিকার ঠিক মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে আমাদের ক্রুজ। আকাশ কালো হয়ে গিয়েছে আগেই। তবে ধোঁয়ার চাকায় বেশ খানিকটা অংশে ধূসরের মেশামেশি। এ ধূসর সর্বক্ষণের। কারণ, মনিকর্ণিকার বুকে উজ্জ্বল কমলা আগুন আর পোড়া চামড়ার গন্ধ, কখনওই নিভে যাবার নয়। জীবনের পরম ও চরমতম সত্য, মৃত্যুকে আরো দৃঢ়ভাবে বাস্তবের রঙ্গমঞ্চে প্রতিদিন প্রতিরাতে, মুহূর্তে মুহূর্তে প্রতিষ্ঠা ক'রে চলে এই ঘাট। কমলা আগুনের বুক চিরে কুন্ডলী পাকানো ধোঁয়া ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে থাকে, ঠিক পাশেই বিশ্বনাথ মন্দিরের গাঢ় সবুজাভ আলো - আঁধারি চূড়ায়। সব জরা, ব্যাধি, জ্বালা, যন্ত্রণা অতিক্রম ক'রে, এ যেন আক্ষরিকভাবেই পরমেশ্বরের কোলে আশ্রয় খুঁজে পাওয়া; একদিকে অনবদ্য মুক্তি আর অন্যদিকে জন্মান্তরের সকল সম্ভাবনার দরজায় কঠিনতম শেকলখানি তুলে দেওয়া। হরিশ্চন্দ্র ঘাটেও এ শিখা জ্বলে আদি অনন্তকাল। তবে রঙ তার খানিক হলদেটে। স্বকীয়তা ভরপুর। বিকেল পাঁচটা থেকে টানা দু'ঘন্টা এই সরকারী "স্বামী বিবেকানন্দ" নামের ক্রুজে চেপে, গঙ্গার হাওয়া খেতে খেতে, আস্সি, কেদার, প্রাচীন হনুমান, ললিতা, পঞ্চগঙ্গা, রাজেন্দ্রপ্রসাদ, তুলসী, নমো, চেত সিং, মুন্সী, হরিশ্চন্দ্র, দশাশ্বমেধ, মনিকর্ণিকা - ইত্যাদি নামের প্রায় সত্তরটি ঘাট ঘুরে যেন আমরা অপার হলদে উদযাপনে মেতে ছিলাম। কালো ক্যানভাসে একের পর এক চিকচিক পাথর সমেত হলুদ নেকলেস। পঞ্চগঙ্গা ঘাটের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে অপরূপ আলমগীর মসজিদ। এতদিন খাতায় কলমে কিংবা পর্দায় যে ছবি দেখেছি, আজ তা সামনে থেকে চাক্ষুষ করবার অভিজ্ঞতায় পরিতৃপ্তির স্নান করছি। চোখ জুড়ে খেলা করে জীবন্ত ইতিহাস স্বর। এবারের বৃষ্টিতে ঘাটের সিঁড়ির অনেকটা অংশ ঢেকে গিয়েছে গঙ্গাপৃষ্ঠে। তাই ওপরের মন্দির - বারান্দাতেই লাল পোশাকের পুরোহিতরা নানা রূপে সাজিয়ে তুলছেন তাঁদের শিল্প। সুরে তালে বাদ্যে ধূপের গন্ধে ভরিয়ে দিচ্ছেন দশাশ্বমেধ - মনিকর্ণিকার যুগল সন্ধ্যারতি। আগুন রঙে যেন মুহূর্তে মুহূর্তে ধুয়ে যাচ্ছে সব কালো, সব পাপ। মন ভরে উঠছে অদ্ভুত এক কান্নাভেজা আনন্দে। এর ঠিক আগেই সারা সকাল দুপুর ঘুরে ঘুরে বেড়িয়েছি সারনাথের সবুজ বাগানে। বুক ভরে নিয়েছি উষ্ণ - মৌন - বোধি নিঃশ্বাস...
পায়ে পায়ে লেগে থাকে তোমার পরশ
অনাথপিন্ডদ সূতা জেগে ওঠে বুকে
একবার ছুঁয়ে দাও, মাথা ভিজে যাক অষ্টস্নানে
দুঃখ মেখে কষ্ট কথায় ফিরে এসো নগরলক্ষ্মী
হরিৎ ক্ষেত্রে স্তূপীকৃত লাল কমলা স্বর্ণালংকার
সম্পদে সম্পদে হেঁটে বেড়াই ছুঁয়ে দেখি রঙ রূপ
এখানে স্নানঘর, ওখানে প্রার্থনা, সেখানে অধ্যয়ন
যেদিকে তাকাই, সোনারোদে ভেসে বেড়াও তুমি
হলদে - সবুজ দুপুর ঘিরে মৌনতার মৌতাত
স্তূপে স্তূপে মিশে যায় অস্তিত্বের রেশটুকু
সব না দেখা, না শোনা, না শেখা, মিলে মিশে
বন্ধ মাটি বুক চিরে গেয়ে যায় "বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি"...
আধ্যাত্মিকতার পথে অপার শান্তির খোঁজ নিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখেছি বেনারসের পথঘাট অলিগলি। আভূমি প্রণাম করেছি, সানাইয়ের মহীরুহ, ওস্তাদ্ বিসমিল্লাহ খানের চিলেকোঠায় রেওয়াজের ঘর - বারান্দাকে; তাঁর স্পর্শ আঁকড়ে থাকা সানাই, বাঁশি আর বিছানাকে। বেনারসী পান, ফিনফিনে রেশম সুতোয় বোনা সিল্ক, বেনারসী ক্ষীর লস্যি, হিঙের কচুরি, জিলিপি, নানাবিধ ফুচকা, চাট ও উপাদেয় নিরামিষ খাবারের যোগ্য সঙ্গত নিয়ে, ঠুংরী, দাদরা, কাজরী, চৈতি, কবীরের দোঁহার মতো আন্তরিক ধ্রুপদীয়ানা বুকে, পরদিন আমরা পৌঁছলাম গঙ্গার হলুদ নেকলেস - ঘাট সমাহারের ঠিক উল্টোপিঠে ব্যাসকাশীতে। এখানেই আছে বেনারসের প্রথম স্বাধীন রাজা বলবন্ত সিং - এর তৈরী রামগড় দুর্গ। শোনা যায় ও'পাড়ের চেতসিং ঘাটের ওপর বেনারসের আরেক রাজা চেত সিং - এর তৈরি প্রাসাদ থেকে এই পাড়ের রামগড় দুর্গ অবধি এক লুক্কায়িত টানেল বা দীর্ঘ সুড়ঙ্গ পথের উপস্থিতির কথা। হেস্টিংসের আক্রমণ থেকে বাঁচতে, এই পথেই নাকি রামগড় পালিয়ে এসেছিলেন রাজা চেত সিং। অন্যদিকে হেস্টিংসকে প্রবল পরাক্রমে প্রতিহত করেন তৎকালীন বেনারসের জনগণ। আরও কথিত আছে, এখানে, এই গঙ্গা মায়ের কাছটিতে বসেই নাকি দেবী অন্নপূর্ণার দ্বারা বিতাড়িত ব্যাসদেব রচনা করেছিলেন তাঁর মহাভারত। রামগড় ফোর্টের চত্বরে অবস্থিত এক শিবমন্দির, সে স্মৃতিচিহ্ন আজও বহন ক'রে চলে। তাই হয়তো মনে করা হয়, বেনারসে এসে, ব্যাসের এই কাশীতে একবারও না এলে যেন কাশীভ্রমণ কিছুতেই সম্পূর্ণ হয়ে ওঠেনা। দুর্গটির পুঙ্খানুপুঙ্খ দেখে, তৎকালীন জমিদারি বৈভব - বীরত্বের কিছু কিছু অনুভব নিয়ে, অনেকক্ষণ বসে রইলাম গঙ্গার ঠিক পাশটিতে, মন্দির - চাতালে। যতদূর যায় চোখ, ভাসিয়ে নিতে চেষ্টা করলাম। যতটা চোখে দেখি, অন্তরে যেন দেখি তারও অনেক বেশী। "চোখের আলোয়, চোখের বাহিরে"। বিকেল গড়িয়ে এলে একটু উঁকি দিয়ে দেখে এলাম মানবদরদী, হারিয়ে যাওয়া, রহস্যময় ঐতিহাসিক রাজনীতির সাক্ষী, এক অন্যতম রাষ্ট্রনায়ক লালবাহাদুর শাস্ত্রী মহাশয়ের আদরের "এতটুকু বাসা" কে। কত যে ছোটো ছোটো দুঃখকথা আর ক্ষত বুকে বসে আছে এই কালজয়ী ইতিহাস ঘর! একরাশ মনকেমনকে সঙ্গী ক'রে হু - হু ক'রে সামনে এল ধর্মভীরুতা আর আধ্যাত্মিকতার পুরোপুরি ভিন্ন দুটো পথ। কিছু আগেই, খুব ভোরে, সম্পূর্ণ পরিখা ঘেরা, বিশ্বনাথ মন্দিরকে বাধ্যতামূলক দর্শনের ও ঠিক তার পাশেরই লোহার ঘেরাটোপে আটক, মুঘল সম্রাট, ঔরঙ্গজেব নির্মিত, জ্ঞানব্যাপী মসজিদকে বাধ্যতামূলকভাবে অদর্শনের যে অযাচিত অদরকারী ধর্ম - বিদ্বেষ - ভয়ের ব্যবসা সংক্রান্ত তিক্ত অভিজ্ঞতা গিলে খাচ্ছিল; শেষ বেলায়, তার ওপরেই সম্পূর্ণ প্রলেপ দিল সত্যিকারের অধ্যাত্মবাদের সমূহ উপকরণ। সবচাইতে প্রাচীন শহর, শিব - পার্বতীর প্রেমের শহর, ভক্তের শহর, ইতিহাসের শহর, স্মৃতির শহর, নস্ট্যালজিয়ার শহর, সুরের শহর, ছবির শহর, শিক্ষার শহর, ভালোবাসার শহর, এই বেনারসের ভক্তিবাদ; শুধুমাত্র ঢক্কানিনাদ না হয়ে, সিমেন্ট - বালি - ইঁট - কাঠ - মন্দিরের চার দেওয়ালে সীমাবদ্ধ না থেকে, আমাদের প্রাণের আরাম হয়ে থেকে গেল শেষ অবধি। তাই ছেড়ে যেতে মন চায়না। "আবার হ'বে তো দেখা, এ' দেখাই শেষ দেখা নয়", এই রেশটুকু নিয়ে আমরা বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটির গেট দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। এবারের গন্তব্য, মুঘলসরাই রেলস্টেশন, বর্তমানে যা দীনদয়াল উপাধ্যায় নামে পরিবর্তিত। ফেরার পথে কিছু কিছু সহযাত্রীর ভয়াবহ ট্রেনডাকাতির কবলে পড়ার দৃশ্য প্রত্যক্ষ ক'রে, অনেকটা বুক ধড়ফড়ানি আর পরম শক্তিমানের প্রতি আমাদের এই কানের কাছ দিয়ে বেরিয়ে অক্ষত রয়ে যেতে পারার অপরিসীম কৃতজ্ঞতাবোধকে সাথে নিয়ে, ফিরে এলাম বাঁকুড়া; ভরপুর উৎসব মরসুমে, মহাষষ্ঠীর এক অপূর্ব মায়াময় রৌদ্রকরোজ্জ্বল ভোরে।।
আমার "দর্শন"-এ ভ্রমণ
গৌতমেন্দু নন্দী
আমার ভ্রমণ বৃত্তের কেন্দ্রে অবস্থান আমার ঘরের চার দেওয়াল। তাকে কেন্দ্র করেই আমার ভ্রমণ পরিধি আবর্তিত। সেই কেন্দ্রের টানেই ভ্রমণের সার্থকতা।
চার দেওয়ালের মধ্যেই আমার বিশ্বের যাবতীয় ওরঅনুসন্ধান। দেশ বিদেশের ঠিকানা নিরন্তর খুঁজে চলি এখানে বসেই। নিত্য যাপনে মনন চিন্তনের অনুশীলনে "বাহির"এর ঠিকানার অনুসন্ধান করি ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে থেকেই। ঘরের অস্তিত্ব আছে বলেই "বাহির"এর মাধুর্য অনুভূত হয়।
রহস্যাবৃত কুয়াশাময় পাহাড়ি উপত্যকা, নদী-জঙ্গলের সীমানায় হঠাৎ কোন বনচরের দর্শন,বা সাগর সৈকতে বসে উত্তাল ঢেউয়ের দিকে চেয়ে থাকা কিংবা কোন মরু প্রান্তরে বসে সূর্যাস্তের সাক্ষী থাকা-------- সবকিছুই ভ্রমণের অনুষঙ্গ। যে ভাললাগাটা আবর্তিত হয় আমার নিজস্ব ঠিকানা ঘর কে কেন্দ্রকরেই।
দশ-পনেরো দিনের জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে ছুটে যাই কখনও তুষারাবৃত কাশ্মীরের গুলমার্গের কোলে,কখনও আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের সাগর সৈকত-- ঘেঁষা সবুজ নৈঃশব্দ্যে বা বারাটাং জঙ্গলে জাড়োয়া উপজাতিদের দর্শনে, হোতে পারে বিদেশের প্যারিসের আইফেল টাওয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে
স্যেন নদীর দুই পাড়ের নাগরিক কোলাহল উপভোগ করা------ভ্রমণের এই আনন্দ পূর্ণতা পায় ঘরে ফিরব বলেই। ঘরের চার দেওয়াল আছে বলেইতো বৈচিত্র্যের এই অন্বেষণ, তাঁর স্পর্শ সুখ থেকে এই আনন্দানুভূতি। যে আনন্দের সঙ্গে অবচেতনে মিশে থাকে চার দেওয়ালের হাতছানি,ঘরে ফেরার আকুতি।
কোভিড পরিস্থিতির সেই দুঃসহ নাগরিক জীবন! যখন অদৃশ্য শ্বাস রোধকারী ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র দানবীয়
অভিঘাতে, রূদ্ধতার অভিশাপে বিপন্ন গোটা বিশ্বের নাগরিক জীবন,তখন মুক্তির স্বাদ খুঁজে নিয়েছি
ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যেই। সেখান থেকেই মানস ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েছি দিগ্বিদিক।
ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে পড়ার সময় ঘরে ফেরার আনন্দ নিয়েই ভ্রমণ সূচিকে আমরা সাজিয়ে তুলি।
ঘরের দেওয়ালের খোলা জানালায় উন্মুক্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে যখন কল্পনায় ভাসতে ভাসতে পৌঁছে যাই ডুয়ার্সের অরণ্য পথে নদী পাহাড়ের দিগন্তরেখায় বা ভুটান পাহাড়ের দেশে তখন কীভাবে যেন কল্পনা আর বাস্তব অদ্ভুত ভাবে মিলেমিশে যায়।
কালি-কলম নিয়ে ভ্রমণের অক্ষর যাপনে দূরত্বের বেড়াজাল ভেঙে যায় চার দেওয়ালের নিবিড় ঘনিষ্ঠতায় ------
তাইতো খুব প্রাসঙ্গিক মনে হয় মান্না দে র কন্ঠের সেই বিখ্যাত গানের প্রথম দুটি লাইন -------
" চার দেওয়ালের মধ্যে নানান দৃশ্যকে
সাজিয়ে নিয়ে দেখি বাহির বিশ্বকে..."
ভ্রমণের ওপর আলোকপাত
শুভেন্দু নন্দী
অজানাকে জানবার, অদেখাকে দেখবার প্রবল আকাঙ্ক্ষা মানুষের চিরন্তন। তাই তো এক স্থান থেকে আরেক স্থানে ঘুরে বেড়ানো- কাছে অথবা দূরে। সখে,নেশায়,অভিজ্ঞতা লাভ ও অবশ্যই জ্ঞান আহরণের মহৎ উদ্দেশ্যে। কখনও পদব্রজে, কখনও জলপথে, কখনও বা আকাশ পথে এককভাবে কিম্বা সপরিবারে। এতে একঘেয়েমী দূর হবার সাথে সাথে দৃষ্টিভঙ্গিরও প্রসারতা লাভ করে। সড়কপথে অর্থাৎ ট্রেনে,বাসে,গাড়িতে আবার ট্যুরিস্ট সর্ভিসের যানবাহনেও ঘোরাঘুরি করা।
প্রতি বছর অন্ততঃ একবার ভ্রমন যাত্রা- তা সে শৈল শহর, বন-জঙ্গলে, সমুদ্র সৈকতে বা তীর্থস্থানে -যেখানেই হউক না কেন। আর বাঙালীরা তো এ ব্যাপারে মুখিয়েই থাকেন। দুঃসাহসী বাঙালী বা ভারতীয়দের পাহাড়ের দুর্গম পথে চড়াই-উতরাই পার হয়ে সর্বোচ্চ শৃঙ্গে আরোহন, সমুদ্রপথে আন্দামান অভিযান,কিম্বা প্রণালী, ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রমের অনেক নজির আছে। গগন-ভেদী সু-উচ্চ পাহাড়- তার কোলে অনাদরে ,অবহেলায় গজিয়ে ওঠা শত সহস্র গাছ, এদিক সেদিক আগাছার জঙ্গল,ফল ফুল,সবুজের হাতছানি বরাবরই তাঁদের আকর্ষনের বস্তু। পাহাড়ি ঝর্ণার জলের তিরতির করে ওঠা-নামা , ঝোরার মৃদুমন্দ ছন্দে বয়ে যাওয়া আর ঐ আঁকাবাঁকা রাস্তা- মনকে এক অদ্ভূত উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া। তাই তো এই ছুটে ছুটে বেড়ানো। অভিজ্ঞতা ও স্থানীয় অধিবাসীদের সাথে পরিচিতি লাভ, তাঁদের জীবনযাত্রা সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান আহরণের চেষ্টা। সমুদ্র সৈকতে সাগরের বেলাভূমিতে উত্তাল সমুদ্রের উথালীপাথালী নীল জলরাশির ঢেউয়ের এক টানা গর্জন এক অনাস্বাদিত আনন্দের অভিব্যক্তি ও উত্তেজনার আলোড়ন সৃষ্টি। ভেতরকার স্মৃতিগুলোকে উজাড় করে এবং যেন সাগরের ঢেউয়ের মত শতধা হয়ে আচ্ছাদিত করে রাখে প্রান-মনকে। একইভাবে অরণ্যের গভীরে, সুঁড়িপথে গাছের পাতার মর্মর- ধ্বনি,ভেতরের এক অদ্ভূত গন্ধ, পাখিদের কলকাকলী, জন্তুজানোয়ারের পদ চিহ্নের আভাস,তাদের নিজস্ব আওয়াজে ভয়ের সাথে অবিমিশ্র ভয়ের অনুভূতির সৃষ্টি, "অরণ্যের সাফারী"-তে আতঙ্ক মিশ্রিত আনন্দের সঞ্চার।
জলপাইগুড়ির ডুয়ার্স অরণ্যে কিম্বা ঝাড়খণ্ডের রাঁচিতে "বেতলা ফরেস্টে" ভ্রমনের সুবাদে এক ভয়ংকর সুন্দরের অভিজ্ঞতা।বনের গভীরে মত্ত বাইসনের দাপাদাপি, এক পাল হরিনের ভীরু চকিত চাহনী কিম্বা "ক্যাপিচিনো"র দন্ত বিকশিত করে খিঁচিয়ে ওঠা, নীল আকাশে রঙবেরঙের পাখিদের ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে মিলিয়ে যাওয়া, জঙ্গলে হাতি দেখা দিয়েই অদৃশ্য হয়ে যাওয়া আর বাঘ-সিং-মামার গভীর ঝোপঝাড়ে আত্মগোপন, অদূরে কোয়েল নদীতে স্বাপদসংকুলের জল খেতে আসার স্পট,নরম মাটিতে পায়ের চিহ্ন- সব মিলিয়ে এক হাড়হিম করা অনুভূতি।.......
ইতিহাস,ভূগোল, বিজ্ঞান অধ্যয়নে যে পুঁথিগত বিদ্যালাভ হয় -তা চাক্ষুষ ভাবে যাচাই করার সূযোগ ঐ সব ঘটনার স্থানগুলোতে ভ্রমন করেই হয়। যেমন সভ্যতার ধ্বংসাবশেষের স্থলে গিয়ে একই শিক্ষা অর্জিত হয়। মনও খুব তৃপ্ত হয়। অর্থাৎ ভ্রমন যে শিক্ষার অঙ্গ- এটা পুরোপুরি সত্য। স্বামী বিবেকানন্দ আসমুদ্রহিমাচল ঘুরে বেড়িয়ছিলেন পদব্রজে। তৎকালীন ভারতবর্ষে বসবাসকরা অধিবাসীদের জীবনযাত্রা সম্বন্ধে প্রত্যক্ষ জ্ঞানলাভ করতে। অনেকে আবার তীর্থস্থান দর্শন করার জন্য দূর-দূরান্ত থেকে আগমন করেন বিক্ষিপ্ত মনকে শান্ত করতে, মন্দিরে পুজো, আরাধনায় ব্যপৃত থাকেন শ্রীবৃদ্ধি লাভ ও পরিবারের মঙ্গল কামনায়। গঙ্গাসাগরে অবগাহন করেন পুণ্য সঞ্চয়ের জন্য। এইভাবেই একদিন কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কার ও ভাস্কো-ডা-গামার জলপথে উত্তমাশা অন্তরীপ হয়ে ভারতের কালিকট বন্দরে যাবার পথ আবিষ্কার। মানুষ তো হাজার হাজার বছর ধরে সৃষ্টির আদিকাল থেকে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কার সাধ্য যে রোধে তার গতি?
প্যারিস
মাথুর দাস
কোন্ দেশটা সুন্দর আর
কোন্ দেশটা কুৎসিত,
কোন্ দেশে গরম বেশি
কোন্ দেশে বা খুব শীত !
তর্ক কথায় হারিস না
পারিস যদি প্যারিস যা,
মন জুড়োবে প্রাণ জুড়োবে
এমন দৃশ্য এবং সঙ্গীত !!
স্যেইন নদীতে প্রমোদ ভ্রমণ
মমার্তে দাও ঠেক,
চার্চ নতেরদেম, ল্যুভর, আর
দামেসনিল লেক ।
আইফেল টাওয়ারে
নাই ফেল যাওয়া রে !
ডিজনিল্যান্ডেও হরেক মজা,
দেখ্ ভাই দেখ্ !!
বলাকা মনঅর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী
দূরকে জানার দুর্বার ঝোঁক
উঁকি দেয় বারেবারে,
ফেরারী মনের অবুঝ ঠিকানা
অচিনের দরবারে।
ভ্রমণপিপাসু কিছু মন যেন
পিছু ফিরে যেতে চায়,
ফেলে আসা সেই রম্যস্থানের
খুব চেনা ঠিকানায়।
দেশ বিদেশের কতশত পথে
মৌন পাহাড়,মরু,
নির্জন দ্বীপ, শ্যামল বনানী
মনোহারী কত তরু।
হাতছানি দেয় ইতিহাস সব
মন্দিরে,মসজিদে,
প্রাসাদ,খিলান,গম্বুজ জুড়ে
অতীত জানার খিদে।
সমুদ্রতট কিংবা পাহাড়ে
মায়াবী সূর্যোদয়,
অস্তরাগের নিবিড় আলোর
আলেখ্য মনোময়।
দৃষ্টিসুখে মাতোয়ারা প্রাণ
যাযাবর হয়ে ছোটে,
বন্দী মুঠোয় উসুলের নেশা
একযোগে সব জোটে।
দেখার তাগিদে মনোলোভা হয়
আপাত তুচ্ছ কিছু,
হাত বাড়ালেই চাঁদ ছুঁয়ে আসে
গল্পেরা পিছুপিছু।
সাদামাটা কিছু সাধাসিধে সাধ
ঘরের জানালা দিয়ে,
উঁকি দিয়ে বোনে রাশি রাশি খুশি
সেরার পসরা হয়ে।
ভ্রমণের নথি নকশিসুতোয়
নানা রঙে ফুল বোনে,
সত্যি,অলীক স্বপ্নমায়ায়
দূরে বা ঘরের কোণে।
লাগাম ছাড়া পক্ষীরাজে
ছাড়িয়ে তেপান্তর,
ময়ূরপঙ্খী মন নদীতে
জাদুর ছুমন্তর।
দীর্ঘ দিনের পাড়ির নেশা বা
টুকরো সফর সেচে,
প্রিয় সখ হয়ে
ভ্রমণ বিলাসী মনটুকু থাক বেঁচে।
পথের গল্প
বিপ্লব রায়
পথের ডাকে ছুটে চলি,
স্বপ্নেরা যে ডাকে বলে।
নীল আকাশে মেঘের ভেলা,
মনে ভাসে নতুন দোল।
সবুজ ঘাসে পায়ের ছোঁয়া,
পাহাড় কোলের শান্তি মেলে।
নদীর স্রোতে খুঁজে ফিরি,
জীবন জয়ের সোনার ঢেলে।
চেনা গণ্ডি ভেঙে বাইরে,
নতুন কিছু দেখার তাড়া।
প্রকৃতির রঙিন পরশে,
মন যে পায় সুখের ধারা।
পাখির গানে প্রাণের জাগে,
বাতাসে মেশে সুরের মায়া।
অজানাতে চলার পথে,
সব হারিয়ে মেলে ছায়া।
ভ্রমণ শেখায় পথের ভাষা,
জীবন মানে চলতে থাকা।
প্রতিটি ধাপে গল্প গড়ে,
আকাশ, মাটি, জলের ধ্বনি।
এভাবেই আমি খুঁজে ফিরি,
অজানা পথের অনন্ত রূপ।
ভ্রমণ মানেই মুক্তি পাওয়া,
প্রকৃতির সাথে হৃদয় ছুঁপ।
উড়ানসম্মিলিতা দত্ত
মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে
পাখিদের মতো যাই উড়ে।
পার হয়ে যাই বিস্তীর্ণ আকাশ
প্রাণ ভরে নিই মুক্ত বাতাস।
ভারতের সীমা ছাড়িয়ে
পৌঁছাবো আফ্রিকা গিয়ে।
রিখটারসভেল্ড পর্বতমালায় গিয়ে যখন পড়বো
অরেঞ্জ নদীর ধারে একটু বিশ্রাম নিয়ে নেবো।
লুচি ঘুগনি সহযোগে সারবো আহার
নদীর তীরে তাঁবু ফেলে দেখবো গাছের বাহার।
হাতে আমার থাকবে টোটাভরা বন্দুক
তার সাথে থাকবে সাহসে ভরা বুক।
যেতে যেতে শুনবো পথে বুনিপের কথা
কাউকে ছাড়ে না সে, আফ্রিকার উপদেবতা।
রাতের বেলা তাঁবুর বাইরে জ্বেলে রাখবো আগুন
হায়নার ডাক শুনতে পাবো, দেখতে পাবো বেবুন।
উড়ে উড়ে পার হয়ে যাবো কালাহারি
সেখান থেকে উত্তর -পশ্চিমে গেলেই সলসবেরি।
কোথাও কোনো জনমানুষ পড়বে না চোখে
মন করবে সারাটা জীবন ওখানেই যাই থেকে।
ঘুরেফিরে সবুজ দেখে চোখ পাবে মোর শান্তি
এক নিমিষে গুঁড়িয়ে যাবে আমার সকল ক্লান্তি।
সুদূর পানে সর্বদা আমি দিতে চাই পাড়ি
উড়ে যাবো অসীমে ,ফিরবো না আর বাড়ি।
No comments:
Post a Comment